গল্প- বিউটিপার্লার

বিউটিপার্লার
-রাখী চক্রবর্তী

ভেজানো ঘরের দরজা খুলে জয়তী ঘরের ভেতর ঢুকলো,
দিশা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
জয়তীকে দেখে দিশা বলল, কেমন আছিস বল, আমাকে দেখতে এলি ?
জয়তী বলল, হ্যাঁ গতকালের ঘটনা পেপার, টিভি, খবরে সবখানে দেখাচ্ছে, রেখাদি নেই ভাবতেই পারছি না, তোমার এই অবস্থা হল কি করে ?, এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছি এর মধ্যে কতকিছু ঘটে গেল, তুমি সুস্থ আছো তো দিশা দি?
-হ্যাঁ রে,
-এবার বলো তো ঠিক কি হয়েছিল গতকাল রাতে পার্লারে?

দিশা ঢোক গিলে বলল, শোন তবে, সকাল ন’টা, “আমি বিয়ে বাড়ি গেলাম দিশা, ব্রাইডাল এলে চালিয়ে নিও।”

-রেখাদি, তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি আর পিঙ্কি চালিয়ে নেব।

রেখাদির বিউটিপার্লারে আমি দশ বছর ধরে কাজ করছি, খুব বিশ্বাস করে রেখাদি আমায়। আজ রেখাদির মাসতুতো বোনের বিয়ে, তাই সকাল আটটায় পার্লার খুলতে বলল রেখাদি, আমি তাই অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম, রেখাদি সকাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে গেল, আমাদের হেল্পার পিঙ্কিও চলে এসেছে তাড়াতাড়ি, কিন্তু বিয়ের সিজনে পার্লার একদম ফাঁকা, ভাবাই যায় না।

আমি আর পিঙ্কি সকাল থেকে পার্লারে আছি, একটাও কাস্টমার এলো না, আজ বিয়ের তারিখ, একটাও ব্রাইডাল এলো না।
ব্রাইডাল এলে সামলাতে পারি না জানিসই তো, যাইহোক সকাল এগারোটা বেজে গেল। পিঙ্কিকে চা আনতে বললাম,
পিঙ্কি চেয়ার মুছতে মুছতে বলল, দিশাদি হাতের কাজ করে নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পর পিঙ্কি চা এনে বলল, “দিশাদি আমাকে বিকেল পাঁচটায় ‌ছুটি দেবে?”
আমি চায়ের কাপে আরামের চুমুক দিয়ে বললাম, কেন ?
পিঙ্কি মাথা চুলকে বলল, “বিয়ে বাড়ীতে যাব।”
-আগে বলিস নি কেন? রেখা‌ ম্যাডাম নেই, জয়ীতা আসবে না।
-দাও না, তেমন কাস্টমার তো নেই।
আমি বেশ রেগেই বললাম, বিকেল থেকে শুরু হবে কাস্টমারদের আসা, না না তোকে ছুটি দিতে পারব না, রেখাদি শুনলে ভীষণ রেগে ‌যাবে।
পিঙ্কি হাতজোড় করে বলল, “প্লিজদি, আমি আইব্রোশ এলে করে দেব, একটু দেরি হলেও ক্ষতি নেই।
-ঠিক আছে যাবি, তবে ব্রাইডাল এলে‌ একটু সাহায্য করে দিস আমাকে কেমন।
পিঙ্কি মাথা নাড়িয়ে দোকানে গেল দুপুরের খাবার আনতে।

সন্ধ্যা বেলায় ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। পিঙ্কিকে বিকেল পাঁচটায় ‌ছুটি দিয়ে দিলাম, বাচ্চা মেয়ে আনন্দ করুক।
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি, দু’চোখ জুড়ে ঘুম, শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি বলেই ঘুম পাচ্ছে, কেউ নেই পার্লারে,
রাস্তাটা ফাঁকা, তেমন জমজমাট নেই অন্য দিনের মতো। ঝড় বৃষ্টি খুব হচ্ছে তেমন কেউ বাইরে বের হচ্ছে না।
হঠাৎই, ট্রিং ট্রিং করে ফোনের রিং বেজে উঠল । আমি চোখটা বন্ধ করে
নানান কথা ভাবছিলাম, তাই ফোনের রিং শুনে চমকে উঠলাম, ফোন তুলে বললাম,
হ্যালো কে বলছেন?
-আমি সাজতে আসবো।
-আমাদের পার্লার আটটায় বন্ধ হয়। এখন সাতটা।
-এক মিনিটে আসছি।বলেই ফোনটা কেটে দিলো।

“আমি আসবো তাই পার্লারের দরজা খুলে রেখেছেন”

দরজার দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম মেয়েটি আলুথালু বেশে চলে এসেছে পার্লারে।
আমি হেসে বললাম,আপনি ফোন করেছিলেন ?
-হ্যাঁ
-শাড়ি গয়না এখানে পড়বেন? না কি, শুধু সাজবেন.. বলতে বলতেই কারেন্ট চলে গেল মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলাম।
মেয়েটি বলল, বেনারসি শাড়ি পড়েই এসেছি।
আমি বললাম, আপনি চুড়িদার পড়ে এসেছেন।
মেয়েটি হেসে বলল, লাল বেনারসি, ভালো করে দেখো।
আমি দেখলাম পুরো লাল দেখাচ্ছে মেয়েটিকে, মনে মনে ভাবলাম ‌ভুল তো দেখিনি, তবে বেনারসি শাড়ি কখন পড়লো
-কি গো সাজাও
আমি বললাম, হ্যাঁ এই তো।
আমি মেয়েটিকে সাজাচ্ছি আর গল্প করছি।হঠাৎ একটা দমকা হাওয়াতে পার্লারের দরজা খুলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম রেখাদিকে দেখে, রেখাদি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম- রেখাদি তুমি!

রেখাদি গম্ভীর গলায় বলল, কটা বাজে?
পার্লার বন্ধ করবে না?

আমি ঘড়ি দেখে বললাম- রাত আটটা বাজেনি তো রেখাদি, তুমি তো বলেছো রাত আটটার আগে যেন পার্লার বন্ধ না করি।
রেখাদি কর্কশ স্বরে বলল, তাই ! দেখো রাত একটা বাজে…
আমিও হেসে বললাম, দেখো রেখাদি
ঐ তো ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। একটা ব্রাইডাল এল, ফোন করেই এল। সাজালাম, এই তো বসে আছে দেখো।
-কোথায়?
আমি দেখলাম চেয়ারে কেউ নেই!
-সত্যি তো তুমি পার্লারে ঢুকতেই মেয়েটাকে আর দেখতে পেলাম না।
রেখাদি বলল, ফোন করে এসেছিল মেয়েটি! ফোন তো ডেড, তা কত নিলে পাঁচ হাজার না সাত?
আমি এখন বেশ ভয় পাচ্ছি, ফোন ডেড আমি তো জানতাম, তবে মেয়েটি ফোন করলো এটাও সত্যি, যাই হোক ভয় মাথায় নিয়ে রেখাদিকে বললাম, সাজানো কমপ্লিট হয় নি চলে গেল মেয়েটি…
-কি নাম সেসব কিছু বলেছে?
– পিউ সরকার মেয়েটির নাম। রামলাল বাজারে থাকে। ওর বিয়ে আজ। তাই সাজতে এসেছিল বেনারসি শাড়ি পড়ে এসেছিল আমি খোঁপা করে দিলাম, সাজালাম।
রেখাদি আমার কথা শুনে খুব হাসছে, বিকট সে হাসি যেন মেঝে ফেটে যাচ্ছে।
কি বললে পিউ সরকার? হা হা হা দেখো তো এই মেয়েটি কি না?
আমি মেয়েটির ছবি দেখে বললাম, হ্যাঁ, এই মেয়েটি, তবে তুমি এতো হাসছো কেন?
-আমার মাসতুতো বোন পিউ ,ওর বিয়ে আজ। গতকাল খবর আসে ওর হবু বর খুন হয়েছে। পিউ সেই দুঃসংবাদ শুনে গলায় দড়ি দিয়ে পাখায় ঝুলেছে।
আমি রেখাদির কথা শুনে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, রেখাদির‌ মুখটা‌ নিচে পা দুটো চেয়ারের ওপর, আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
রেখাদি তোমার মুখটা নিচে কেন তুমি নিমিষেই ফ্যানের ওপর উঠলে কিভাবে?

-দিশা আমার পার্লার ফাঁকা করে দে।
-রেখাদি ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় যাব থেকে যাই রাতটুকু..

-ঐ দেখ পিউ এসেছে। আয় বোন
-পিউ তো মারা গেছে।
-হা হা হা আমি তো বেঁচে আছি, তোর রেখাদি,হাহাহাহা
আমি আর না ভেবে দৌড়ে রাস্তায় চলে এলাম। তারপর গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরলাম, তখন রাত তিনটে।
পরের দিন টিভিতে খবরে দেখাচ্ছে মৃত বোনকে হসপিটাল থেকে দেখে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন বিউটিপার্লারের মালকিন রেখা সাউ।
আমি খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।গায়ে তখন ধুম জ্বর।
সেই থেকে আমি আমার শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছি। এখন জানতে চাস না কেন?

জয়তী পুরো ঘটনা শুনে বলল, কিন্তু দিশাদি, তোমার মুখের আদল রেখাদির মতো হলো কি করে! সেটা বললে না তো?
-থাক না, বাড়ি যা,
-না বলো
-কি রে জয়তী কখন এলি?

জয়তী পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, মাসীমা কেমন আছেন?
– একমাত্র রোজগেরে মেয়েকে হারিয়ে আছি।

-এমন কথা বলবেন না, দিশাদি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।

-কি বলছিস, মেয়ে আমার ভালো হয়ে যাবে, পাড়ার ছেলেরা শ্মশানে ‌পুড়িয়ে এল দিশার মৃতদেহকে। তুই দিশার ঘরে ঢূকলি আমি দেখলাম, তখন শ্মশান যাত্রীদের জন্য আমি আগুন, নিমপাতা মিষ্টি জায়গা মতো রাখছিলাম।

জয়তী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, আর ভালো করে খাটটা দেখলো না কেউ বিছানায় নেই তো‌।
তারপর জয়তী দেখল, দিশা নিজের ঘরে কারোর চুল বাধছে, কাউকে সাজাচ্ছে, জয়তী এক মুহুর্ত দেরি না করে দৌড় লাগালো, রাস্তায় এসে ও হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটতে লাগলো, হাঁটতে হাঁটতে জয়তী
বিউটি পার্লারের সামনে এসে দাঁড়ালো, হাল্কা আলো‌ জ্বলছে বন্ধ বিউটি পার্লারে,ওর মনে হলো কেউ আছে পার্লারে, তখন রাত আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি….

Loading

One thought on “গল্প- বিউটিপার্লার

  1. দুর্ধর্ষ রোমহর্ষক। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতো ঘটনা। অসাধারণ।

Leave A Comment