শিখন
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
_কি রে ময়না কখন ফিরে আসলি মৌ দের বাড়ি থেকে?মৌ এর টেস্ট পেপার টা নিয়ে এসেছিস তো?
আমি মুখ টা হাঁড়ির মতো করে জবাব দিয়েছিলাম, না।মৌ আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দিতে পারবে না বলেছে।
আমার মা অবাক হয়ে বলল,সে কি কথা! তুই অনেক দিন আগে থেকেই বলে রেখেছিস ওকে যে মৌ এর বোর্ডের পরীক্ষা টা শেষ হলেই ওর টেস্ট পেপার টা নিবি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মৌ আমার থেকে বয়সে এক বছরের বড়ো ছিল।ও আমার পাড়ার বন্ধু ছিল।
আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ছিলাম,তাই তো আমি জানতাম মা।মৌ এর কাছ থেকে টেস্ট পেপার টা পেয়ে যাবো বলেই তো অন্য কোনো দাদা, দিদিকে আগে থাকতে কিচ্ছুটি বলি নি। এখন এদিকে মৌ টেস্ট পেপার টা দেবেনা বলছে। অঙ্কের স্যার তো আগামীকাল থেকেই টেস্ট পেপার নিয়ে যেতে বলেছে টিউশনি তে।
মায়ের মুখ টা ও বেশ চিন্তিত দেখালো। কিছুক্ষণ পর মা বলেছিল, হয়তো ওর সত্যি কোনো অসুবিধা হয়েছে তোকে টেস্ট পেপার টা দিতে। তবে এরপর থেকে আর মৌ এর কাছে কোনো পুরানো বই চাইতে যাস না।
আমি তোর বাবাকে বলছি ।উনি ওনার কোনো ছাত্র ছাত্রীর কাছ থেকে ঠিক একটা পুরাতন টেস্ট পেপার এর জোগাড় করে আনবেন।
এরপর প্রায় মাস খানেক পরের ঘটনা। আমার মনে মৌ কে নিয়ে যেটুকু অভিমান ছিল তা একমাসে নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে অনেক দূর। আমি আবার আমার বান্ধবীর সান্নিধ্য লাভের আশায় দিনরাত সময় পেলেই মৌ দের বাড়ি ছুটে যাই।মৌ ছিল আমার কাছে অনুপ্রেরণা।ওর হাতের লেখা এতো সুন্দর ছিল যে দেখে মনে হতো যেন টাইপ করে লিখেছে।খেলা ধূলা তে ও তুখোড় ছিল। প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় প্রাইজে ঘর ভরিয়ে দিতে।আর দেখতে ও ছিল ভীষন সুন্দর।
আমি মৌ কে অনুসরন করতাম মনে প্রাণে।
সেদিন রবিবার ছিল। আঁকার ক্লাস থেকে ফিরে এসে টিফিন করেই মৌ দের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ওদের উঠানে এসেছে একজন রদ্দি ওয়ালা।মৌ ,মৌ এর দিদি,দাদা ওর মা সবাই মিলে পুরানো বই খাতা ,পেপার গুলো ভালো করে চেক করে রদ্দি ওয়ালা কে দিচ্ছিল। পূজা সংখ্যা,মাসিক পত্রিকা,নাইন,টেনের বই এর মধ্যে লাল হলুদ রঙের এ বি টি এ এর টেস্ট পেপার টা উঁকি মারছিল।আমি বই খাতার গাদার মধ্যে থেকে একরকম ঝোঁ মেরে টেস্ট পেপার টা উঠিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি সাল টা দেখেছিলাম।বড় বড় করে লেখা ১৯৯৬।
মুহুর্তের মধ্যে চোখ টা ঝাপসা হয়ে এসেছিল।বই টা ফেলে এক ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলাম।মৌ যদিও পিছন থেকে ডেকে ছিল। কিন্তু সেদিন আমি আর সাড়া দিই নি। আমার কিশোরী মন সেই দিন প্রথম বুঝতে পেরেছিল বেইমানি কি জিনিষ।
মা রান্না ঘরে খাসীর মাংস রান্না করছিল। খাসীর মাংস হলেই মাকে আমি পীড়াপীড়ি করে বলতাম,মা মৌ কে একটা ছোট বাটিতে মাংস দিয়ে আসি। মৌ মাটন খেতে খুব ভালো বাসে।মৌ কে খাইয়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম।
আমি মায়ের পিছনে দাঁড়াতেই মা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার আজ তাড়াতাড়ি প্রিয় বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফিরে এলি যে?
আমি আর সেদিন নিজেকে স্থির রাখতে পারি নি।অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ব্রন ভরা গালে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে খুলে বললাম মৌ দের বাড়িতে বই বিক্রির সমস্ত কথা।মৌ যে ইচ্ছা করেই আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দেয় নি সেটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।
কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমি বলছিলাম,মা তুমি তো জানো আমি মৌ কে কত ভালোবাসি।বাবা ওনার স্কুল থেকে পুরানো প্রশ্ন পত্র, রেফারেন্স বই আনলেই আমি মৌ কে দিয়ে আসতাম।যাতে মৌ এর রেজাল্ট আরো ভালো হয়।মৌ যখন যেখানে যেতে বলত আমি ছুটতাম ওর সঙ্গে।মা বারণ করলে ও খুব একটা শুনতাম না।মৌ ওর জীবন বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সব ছবি ও আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নিত। কোনোদিন না করি নি। নিজের পড়ার ক্ষতি করেও মৌ এর কাজ করে দিতাম।মৌ এর প্রতি আমার একটা টান ছিল।
মা আমার মাথায় নিজের বাঁ হাত টা বুলিয়ে সেদিন বলেছিল,মন খারাপ করিস না ময়না। তুই কাউকে ভালো বাসিস বলেই যে সে তোকে ভালোবাসবে তার কোনো কথা নেই। বরং যে তোকে ভালোবাসে তাকে তুই অবশ্যই ভালোবাসার চেষ্টা করবি।হয়তো সে তোর মতো পড়াশোনায় ততটা ভলো নয়।হতে পারে সে গরীব,হতে পারে সে দেখতে খারাপ।মোট কথা সে হয়তো তোর সমকক্ষ কোনো দিক থেকেই নয়। তবু ও তাকে তুই ভালোবাসবি।কারন সে তোকে ভালোবাসে।যে সম্পর্ক দেওয়া নেওয়ার ভিতের ওপর গড়ে ওঠে তা কিন্তু চিরস্হায়ী হয় না কখনো।এই তো তোর জীবন শুরু।কত ঠকবি তারপর তো শিখবি। সেই শিখন আজীবন কাজে লাগবে।
স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সংসার জীবনে এসেও আমার বন্ধুর অভাব হয় নি কোনদিন।মৌ এর কাছ থেকে ঠকে আমি শিখে নিয়েছিলাম দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে বন্ধুত্ব গড়া উচিত নয়। বন্ধুত্ব গড়তে হয় কেবল মাত্র বিশ্বাস আর ভালোবাসায়।তাতে বন্ধু সংখ্যা যদি কম থাকে তাও ভালো।