গল্প

গল্প- মহানুভবতা

মহানুভবতা
-শচীদুলাল পাল

 

 

স্টেশন শ্রীরামপুর । প্রায় ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে পড়লো ফিজিক্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মনীষা। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ট্রেনটি ধরতে না পারলে তার সঠিক সময়ে ফিজিক্স স্যারের কাছে লিলুয়ায় টিউটোরিয়ালে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অন্যদিন লেডিসে ওঠে।লেডিস কম্পার্টমেন্ট দূরে ছিল তাই
আজ সামনেই জেনারেল কম্পার্টমেন্টের ভীড়ে ঠাসা লোকালে উঠতে বাধ্য হলো সে।
১৯ বছরের ফর্সা সুন্দরী ছিপছিপে গড়ন, আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।সে ট্রেনের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এক রুক্ষ শুষ্ক চুল,মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধ ময়লা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ।সে অনেকটা কাছে এসে তার হাত চেপে ধরল।মুখে যেন কি সব বলছে।মনীষা রেগে চীৎকার করে উঠলো।
— অসভ্য! জানোয়ার!
লোকটা আরও জোরে হাত চেপে ধরলো। মনীষা বললো
— ছাড়ুন। হাত ছাড়ুন।
সাথে সাথে ট্রেনের লোকজন বুড়োটাকে মারতে মারতে বললো
–বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। কামুক বুড়ো! মার শালাকে।
বুড়োকে মেরে তারা বীরত্ব প্রকাশ করতে লাগলো। মেরে তার পাঞ্জাবি ছিড়ে দিল।মুখে এমন ভাবে মারলো কপাল কেটে ঝরঝর রক্ত ঝরতে লাগলো। ঠোঁট ফেটে রক্তের ধারা বইতে লাগলো।
আরও যাদের হাত নিসপিস করছিল তারাও এসে মারতে মারতে পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।মনীষা ট্রেনের জানালায় এক ঝলক দেখলো রক্তাক্ত বৃদ্ধটি গোঁগাচ্ছে।
পুরো কম্পার্টমেন্ট বুড়োটার বিরুদ্ধে নানান কটুক্তি ও আদিম রসের রসদ পেয়ে কুৎসায় মসগুল হয়ে গেলো।
একজন বুদ্ধিজীবী বলছিল
–এক রকমের পুরুষ আছে এই পৃথিবীতে। কামনার আগুনে জ্বলছে।মেয়ে দেখলে তাদের স্পর্শ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এইসব বিকৃত মস্তিষ্ক পুরুষ জাতি দেশ ও সমাজের শত্রু।

সপ্তাহে একদিন সে টিউশন পড়তে আসে লিলুয়ায়। লিলুয়ায় নেমে আজ সে একটা রিক্সা নিল। অন্যদিন পায়ে হেঁটেই যায়। সারা শরীর কাঁপছে।
তার মনে হলো আজ তারই জন্য বৃদ্ধটির এই হাল হলো। সে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে লাগলো। বুড়োটা কি যেন তাকে বলছিল!

টিউটোরিয়াল কক্ষে সে আজ সব শেষ বেঞ্চে বসলো। আনমনা।কিছুই তার ভালো লাগছে না।৯৫% মার্কস পেয়ে সে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে।টিউটোরিয়াল হোমে ও কলেজের ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট।
স্যার তাকে গতকালের পড়ানো থেকে প্রশ্ন করলেন। মনীষা থতমত হয়ে বলতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরে আসবার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরলো। জানালা দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে এলো উল্টো দিকের সেই প্লাটফর্মে সেই বৃদ্ধটি পড়ে আছে। সে তড়িঘড়ি করে নেমে বৃদ্ধটির কাছে গিয়ে দেখলো শীতে জুবিথুবি হয়ে প্লাটফর্মেই পড়ে আছে। বৃদ্ধটির কপাল ও ঠোঁট দিয়ে রক্তটা জমাট বেঁধে আছে। উস্কোখুস্কো চুল, শতছিন্ন পাঞ্জাবি ।কেউ ভিখারি ভেবে কিছু রুটি দিয়েছিল। সেগুলো কুকুরে টানাটানি করছে। মনীষা ব্যাগ থেকে চাদর বের করে বৃদ্ধটির গায়ে জড়িয়ে দিল।
রুমাল দিয়ে বৃদ্ধর রক্ত মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো আপনার নাম কি?
বৃদ্ধটি বললো
— জানি না
বাড়ি কোথায়?
— জানিনা, ভুলে গেছি।
আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
— মনে নেই।
এবার সে মনীষাকে বললো
— আমি বাড়ি যাবো।
এবার মনীষার মনে হলো এই কথাটাই সে হাত ধরে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট স্বরে বারবার বলতে চাইছিল কিন্তু চলন্ত ট্রেনের শব্দে ও পাবলিকের চেঁচামেচিতে সে শুনতে বা বুঝতে পারেনি।
এবার মনীষা বৃদ্ধটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।এবার সে নিজেই শক্ত করে তার হাত ধরলো। আপ ট্রেনের প্লাটফর্মে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠালো। তার নিজের স্টেশন শ্রীরামপুর আসলে বৃদ্ধটিকে নিয়ে হাত ধরে নামিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ঘরে এলো।
মা বাবাকে সব কথা বর্ণনা করে শুনালো।আদর্শবাদী পিতা তার বর্ণনা শুনে মেয়ের প্রশংসা করে বললো
— উপযুক্ত কাজ করেছিস মা।
— বাবা, আমিতো তোমার কাছ থেকে আদর্শ মানবিকতা ও শিষ্ঠতার জ্ঞান লাভ করেছি।
— কিন্তু ঘরে রাখলে কোনো সমস্যা হবেনা তো?
— না বাবা। আমি দেখবো বৃদ্ধকে।
মাকে বললো জল গরম করতে।
নিজে হাতে দুধ সুজির হালুয়া বানালো। জল গরম হয়ে গেলে বৃদ্ধটিকে স্নান করালো। ঘসে ঘসে শরীরের নোংরা উঠিয়ে দিল।বাবাকে বললো একটা তোমার পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে দাও।ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল।
লক্ষ করলো বৃদ্ধটির চোখমুখে এক আভিজাত্যের ছাপ।
ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে
চামচে করে খাওয়াতে গেলো।
–খান।
বৃদ্ধটি ঘাড় নেড়ে বললো
খাবেনা।
এবার মনীষা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে আনলো। ধমক দিয়ে বললো
— খাও। তোমাকে খেতেই হবে।
এবার ধমক খেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো এক চামচ খেলো।
দ্বিতীয় চামচের বেলায় আবার ধমক। এভাবে তাকে পেট পুরে সবটাই খাওয়ালো।
মুখ মুছিয়ে দিয়ে সিঙ্গল বেডের ঘরটিতে নিয়ে শুইয়ে দিল। মশারী খাটিয়ে চারিদিক গুঁজে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।
মনীষা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বৃদ্ধটির ঘরে গিয়ে দেখলো, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
সে তাকে বিরক্ত না করে পড়তে বসলো। ফিজিক্সের একটা অঙ্ক সে কিছুতেই পারছে না। অন্যদিন ঝটপট করে ফেলে। আজ তার মনে বিরক্তির ভাব।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখলে গুটি গুটি পায়ে কখন এসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধটি। সে খাতাটি টেনে নিল। পেন নিয়ে অবশিষ্ট অঙ্কটি কাঁপা কাঁপা হাতে করে দিল।
মনীষা হতবম্ব হয়ে গেলো। এটা কি অলৌকিক! এ কিভাবে সম্ভব। ইনি কে? কি তার পরিচয়? ইনি তো সাধারণ মানুষ নন। ছুটে গেলো বাবা মার কাছে। সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললো। তারা এসে জিজ্ঞেস করলো।
–কি নাম আপনার? কোথায় থাকেন? বাড়িতে কে কে আছে? বৃদ্ধ লোকটি বললো
— ভুলে গেছি। মনে করতে পারছিনা।
আপনার বাড়ির ফোন নম্বর বলুন।
এবার সে কষ্ট করে স্মৃতি হাতড়ে মনে করে একটা নম্বর বললেন।
মনীষা সামনে ফিজিক্স খাতাতেই লিখে নিলে।
অমিত মিত্র কল করলেন। রিং হচ্ছে।
একবার দুবার কিন্তু কেউ উঠাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর তৃতীয় বার চেষ্টা করতেই অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো
— আমি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়ের ছেলে ডাঃ হিমাদ্রি রায় বলছি। অমিত বাবু ভাবলো, যে ছেলে নিজের নামের আগে পিতার নাম আগে বলে সে নিশ্চয়ই কোনো আদর্শ পুত্র।
— কাল থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার ঘরে রয়েছেন। উনি নাম বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারছেন না। মনে হয় স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করে এই নাম্বারটা উনি বলতে পেরেছেন।
— আপনি লোকটার বিবরণ বলুন।
অমিতবাবু সংক্ষেপে বর্ননা করলেন।
ডাঃ হিমাদ্রি অপরপ্রান্ত থেকে বললেন
— হ্যাঁ। আমার বাবা।প্রফেসার সমুব্ধ রায়।আমি তার পুত্র ডাঃ হিমাদ্রি রায়। বাবা আজ দিন কয়েক থেকে নিখোঁজ। খুঁজেছি নানাভাবে অনেক। কিন্তু পাইনি।আপনার ফোন পেয়ে অনেক আনন্দিত। আমি মাকে নিয়ে এখনই আসছি।
মনীষা ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে বললো
—এই যে স্যার। আপনার নাম কি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
আপনার ছেলের নাম কি ডাঃ হিমাদ্রি রায়?
— কিছুই মনে পড়ছে না।
মনীষা স্নান করিয়ে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে, চুল আঁচড়ে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে বললো
—এখুনি আপনার ছেলে আসবে আপনাকে নিতে।
বাধ্য শিশু যেমন মায়ের দিকে নির্ভয়তায় চেয়ে থাকে তেমনি ভাবে অপলকে চেয়ে রইলো বৃদ্ধটি।
অনেকক্ষণ পর এক দামী গাড়ি এসে থামলো বাড়ির গেটের সামনে। নেমে এলেন ডাঃ হিমাদ্রি রায় ও তার মা।
ঘরে এসে অমিত বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন।
অমিতবাবু বললেন
— এ সব সম্ভব হয়েছে আমার কন্যার জন্য।
এবার সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়ীতে উঠাতে যাবেন তখন প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলেন মনীষাকে।তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো,বললেন
— আমি বাড়ি যাবো।
এরপর একবছর কেটে গেছে।
প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়, একদিন স্ত্রী মনোরমা, পুত্র ডাঃ হিমাদ্রিকে নিয়ে এক বিশাল গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে মনীষাদের বাড়িতে এলেন। সেদিন ছিলো ছুটির দিন।মনীষা ও তার বাবা মা বাড়িতেই ছিলো।
মনোরমা বললেন
— আজ আমার স্বামীকে ফিরে পেয়েছি আপনাদের মহানুভবতার জন্য।
অমিত বাবু বললেন
— সব কৃতিত্ব আমার কন্যার।
ডাঃ হিমাদ্রি বললেন
— বাবার সর্ট টার্ম মেমোরি লস হয়েছিলো। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
এবার প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় এগিয়ে এসে বললেন
— আমি একটা ভিক্ষা চাইছি।
আপনারা রাজি থাকলে দেবেন।
–বলুন। কি চাইছেন?
— আমি আপনার মেয়ে মনীষাকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চাই।
মনীষার বাবামা বললেন
— এতো আমাদের সৌভাগ্য।
আনন্দে মনীষার দুচোখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
প্রফেসর সম্বুদ্ধ স্যার ও মনোরমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো।সম্বুদ্ধ স্যারের হাত শক্ত করে ধরে বললো
” আমি বাড়ি যাবো “।
নিদিষ্ট দিনে মনীষা ও হিমাদ্রীর মহা ধূমধামে বিয়ে হয়ে গেলো।

Loading

3 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page