“রইবো দোঁহায় মুখোমুখি”
-শম্পা সাহা
আহা! বাঙালি রান্নার কথা বলবে, ভাববে, ভাবতে ভাবতে জিভে জল চলে আসবে, অথচ সেখানে ইলিশ নেই, তাও আবার হয় নাকি? এ যেন টক ছাড়া চাটনি, তেল ছাড়া তেল পটল!
যদিও ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা হলে এক দল ইলিশ ঝোলাতো আর অন্য দল গলদা চিংড়ি তা বলে রসনা রঞ্জনে কোনোটাই যে বাঙালি ব্রাত্য করে রেখেছে, তা বাঙালির অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না! যদিও এই মাগ্গিগন্ডার বাজারে ইলিশ, চিংড়ি খেলার মাঠে ঝোলানো হয় না, তা বলে ইলিশ দেখলে বাজার ঘোরতা বাঙালির নোলা যে নালেঝোলে হয় না , এ বদনাম দেয় কার হিম্মত! তাই ফাঁক পেলেই সুখেনের বিরাট আঁশবটির পাশে , চিৎ হয়ে শুয়ে “জলের রূপোলী” শস্যকে সুখে মিটিমিটি হাসতে দেখে, বুক পকেটে একটা ঘষা দিয়ে নোটের ধার ভার বুঝে সামন্তদা লুঙ্গিটা একটু উঁচু করে, সামনের কাদা জল বাঁচিয়ে থলে এগিয়ে দেয়,
-দে, ওইটা!
আঙুল দিয়ে দেখায় সেই মাছের রানীকে, যার গায়ে সকাল আটটার রোদ পিছল খাচ্ছে! সুখেন মনযোগ দিয়ে মাছ ওজন করে কাটতে যেতেই সামন্তদার প্রাণ ফাটানো চিৎকার,
-থাক, থাক কাটিস না। ও তোর বৌদি কাটবে খনে!
বলতে গিয়ে কি জিভটা একটু বেশি লালাসিক্ত!
সামন্ত গিন্নীর মাছ কাটায় বড্ড অনীহা। এখন বয়সের ভারে, ভারী শরীর নিয়ে মেঝেতে বসাই দুষ্কর, তাই অন্যান্য দিন সামন্তদা মাছটা কেটেই আনেন। কিন্তু আজ গল্পটা অন্য রকম। আদরে যত্নে ব্যাগের ভেতরকার মহার্ঘ্য বস্তুটি মোটেও অন্যান্য দিনের মত ডাইনিং স্পেসের সিংকের পাশে পড়ে থাকে না। আজ সামন্তদা, নিজে হাতেই একখানা বড় গামলা বের করে তাতে শোয়ান সে সুন্দরীকে। বৌদি,
– কি মাছ আনলে, দেখি?
বলে, বাইরে বেরিয়ে অতখানি বড় নধরকান্তি ডিম ভরা ইলিশ দেখে অলস ধিক্কার জানিয়ে, বঁটি নিয়ে থেবড়ে বসেন মেঝেতে। হাঁক পড়ে,
– ও ময়নার মা, দেখ তো, নেপালের চায়ের দোকানে ছাই পাস নাকি? দুটো টাকা নিয়ে যাস।
এই গোটা এলাকায় একমাত্র নেপালেরই কয়লাতে চা হয়, আর বাকি সব দোকানগুলোতে তো গ্যাস সেই কবে থেকেই। তাও কি এই কাঠ কয়লা থাকতো নাকি, তন্দুরী চা না কি একটা বিক্রি করে , পঁচিশ টাকা করে দাম, তাই এখনো ওই মাটির উনুন টিকে রয়েছে। না হলে কবে সাফ্ হয়ে যেত! এই এলাকার সব বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজনে ছাই সাপ্লায়ার একমাত্র নেপালই।
ছাই আসার আগে মাছ ভালো করে ধুয়ে সাফ হবে। কানকোর ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে, ঘষে ঘষে ল্যালপ্যালে ব্যাপারটা ধুয়ে তারপর মাছ কাটা। সন্তর্পণে, যাতে একটুও বাড়তি ফেলা না যায় আঁশটুকু বাদে। কানকো, মাথা, মায় নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত রয়ে যায়, ভাজা হবে বলে। মাথাটা, লাউ দিয়ে জমে যাবে। তবে কত্তা গিন্নী দুজনেরই অম্বলের ধাত, তাই সর্ষে ভাপার লোভ ছাড়লেও খুব বেশি দুঃখ নেই! সামান্য কালো জিরে ফোড়ণ, গোটা কয়েক কাঁচা লঙ্কা আর কয়েক ফালি লম্বা করে কাটা কালো বেগুন। কর্তার আবার সুগার, না হলে আলু লম্বা করে কাটা, দুফালি দিলে বেশ জমতো ব্যাপারখানা! তা কি আর করা যাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবনা মতন হয়ে যায়, ইলিশের নাড়িভুঁড়ি আর তেলটুকু ভাজা। সাদা ধবধবে ভাত আর কাঁচা লঙ্কা, এক চিমটে নুন। যতই হাই প্রেশার থাক, একদিন খেলে কি আর হবে? তারপরে থকথকে মাছের মাথা দিয়ে লাউঘন্ট! ফোরণ শুধু সাদা জিরে আর তেজপাতা।ঝালের জন্য গোটা কয় কাঁচা লঙ্কা! বিরিয়ানি পোলাও মাৎ! শেষে বেগুন দিয়ে পাতলা করে ইলিশের পেটি, গাদার ঝোল। ল্যাজাটাও বা কি করে? সেও এদের সঙ্গেই কড়াতে! ব্যস, এই দিয়ে এক পেট ভাত খাবার পর, সামন্তদা যখন এসে বসেন খাটের ধারে, ফ্যানের হাওয়া, আর হাল্কা বর্ষা শেষের মেঘাচ্ছন্ন ভাব, গিন্নী হেলতে দুলতে এসে পাশে বসে বলেন, আজ মাছটা কিন্তু খুব স্বাদের ছিল, ডিমভরা হলে কি? তখন ডিম সহ পেটির স্বাদের সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছরের দাম্পত্য মাখো মাখো হয়ে সুগন্ধ ছড়ায়। এই দিনের জন্যেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,”রইবো দোঁহায় মুখোমুখি মিলন আগ্ৰহে!” বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে ঝিরঝিরিয়ে!