গল্প- পুরুষ সিংহ

পুরুষ সিংহ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

-মৈনাককে এই পারমিশনটা দেওয়ার আগে তোমার কি একবারের জন্য মনে হল না আমার সঙ্গে একবার পরামর্শ করা উচিত।

-মিথ্যা বলব না। মনে যে একদমই হয়নি তা কিন্তু নয়। আর মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এই চল্লিশ বছরে আমি নিজের সিদ্ধান্তে কোন কাজটা করেছি বল তো?

-এ তো তোমার অভিমানের কথা হয়ে গেল সেজ বউ।

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখার্জি বাড়ির সেজ বউ নিরুপমা বলল, এই বয়সে আবার অভিমান! হতো এককালে খুব অভিমান হতো তোমার ওপর। যখন তুমি তোমাদের পরিবারে সমানাধিকারের তত্ব প্রয়োগ করতে ব্যস্ত ছিলে। তোমার রোজগার ছিল সবচেয়ে বেশি। আর তোমার আদর্শও ছিল ঝুড়ি ঝুড়ি। তাই তো সমান দৃষ্টিতে সকলকে দেখার জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তানদের সবসময় ভালো কিছু থেকে বঞ্চিত করে এসেছো।
গেরস্তে সবাই একই খাবার, একই জামা কাপড় পরলেও অন্দরে চলত অন্য খেলা। তোমার তিন ভাই সবাই হরলিক্স, বিস্কুট, ফল আলাদা করে এনে তাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতো। আর আমার মৈনাক, মিঠি এরা শুধু শশা চিবিয়ে বড় হয়ে গেল। আর আমি যেহেতু বড়লোক ঘরের মেয়ে ছিলাম তাই তো তোমার ধারনা ছিল, বড়লোকের মেয়ে মানেই হিংসুটে।
ভাগ্যিস আমার বাবা একরকম জোর করেই মৈনাক আর মিঠিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ওনার কাছে। তাই ওরা এই রকম নামকরা স্কুল থেকে পড়াশোনা করে আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে।
হিমাংশু বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, তাহলে বাবা হিসাবে আমার কোনো অবদানই নেই দেখছি।
পুনরায় মুখ ঝামটা দিয়ে নিরুপমা বলল, অবদান আবার নেই। ওরা জীবনে যেটুকু অভাব কষ্ট পেয়েছে সে তো তোমার দৌলতেই পেয়েছে।
-আমি কি শুধু ওদের কে কষ্টই দিয়েছি সেজ বউ?
নিরুপমা আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, থাক না আর মনে করিও না সেইসব পুরানো দিনের কথা। তার চেয়ে বরং বাজারে যাও। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য ভালো মন্দ বাজার করে নিয়ে এসো। আজ আমাদের কতবড় আনন্দের দিন বলো। আমাদের মৈনাক এম এস এ চান্স পেয়েছে।
হিমাংশু বাবু বললেন, আনন্দের সঙ্গে দুঃখটাও তো পেছন পেছন এলো।
দেখো তুমি যেটাকে দুঃখ ভাবছো সেটা কিন্তু আমার কাছে মোটেই দুঃখের নয়। স্বামীর পড়াশোনাতে স্ত্রী পয়সা খরচ করবে এতে লজ্জিত হওয়ার তো কিছু নেই!
মৈনাকের সমস্ত লেখাপড়ার খরচ তো আমার বাবা চালিয়ে এসেছে এতদিন। কৈ তখন তো তোমার খারাপ লাগেনি ? তাহলে আজ হঠাৎ শোক করছ কেন?
-দেখ দাদুর টাকায় পড়াশোনা করা আর বউ এর টাকায় পড়াশোনা করার মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ আছে।
-একদম ঠিক বলেছো তুমি। তফাৎ আছে দুটো ভাবনার মধ্যে। শ্বশুরের পয়সার ওপর কেমন যেন একটা জোর থাকে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষের। কিন্তু পুত্রবধূর পয়সার ওপর সেই জোর নেই। বরং তোমার মনে হচ্ছে তুমি অপারগ বলেই তোমার বৌমার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হচ্ছে। এম বি বি এস পাশ করেই তো ছেলেটা আর্মিতে জয়েন করেছিল। যা উপার্জন করেছিল তা তোমাদের মুখার্জি পরিবার আলাদা হওয়ার পর ধারদেনা মেটাতেই শেষ করে ফেলল। ভবিষ্যতের জন্য কিছুটি সঞ্চয় করেনি মৈনাক।
তারপর এম এস এ চান্স পেতেই রীতিমতো চিন্তা পড়ে গিয়েছিল মৈনাক। কোথা থেকে জোগাড় হবে পড়াশোনার খরচ। দাদুর কাছ থেকে আর নতুন করে কোনো টাকা নিতে চাইছিল না ও। আমি তখন বলেছিলাম আমার যে কুড়ি ভরি গয়না বেঁচে আছে তা বিক্রি করে কিংবা বন্দক দিতে। তখন তিথি বলল, মা এত কেন ভাবছেন? আমি আছি তো? আমি যা পেমেন্ট পাই তাতে কষ্টশিষ্ট করে আপনার ছেলেকে আমি ঠিক পড়াতে পারব।
দেখলাম মৈনাকও রাজি হয়ে গেল। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন সুন্দর সমঝোতা আছে তখন আমরা শ্বশুর শাশুড়ি হয়ে আপত্তি করতে যাবো কেন? দেখ মৈনাক যেমন আমাদের সন্তান। ঠিক তেমনি তিথির স্বামী। স্বামীর জীবনে স্ত্রীর অবদান কি শুধু হেঁশেল ঠেলা তে? স্ত্রীরা যেমন রেঁধে বেড়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের খাওয়াতে পারে ঠিক তেমনি বিপদে অর্থ সাহায্যও দিতে পারে।
হিমাংশু বাবু আবার বলেন, তুমি ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখো বৌমার কাছে আমি কতটা ছোট হয়ে গেলাম?
রাখ তো তোমার ঠুনকো মান সম্মান। তিথি সব জানে। মৈনাক ওকে সব বলেছে। যৌথ পরিবারটা ধরে রাখতে গিয়ে তুমি যে আজ নিঃস্ব সেটা তিথির অজানা নয়।
আর শোনো তোমার সেকালের ভাব ধারনা এবার ত্যাগ করো। স্ত্রী দিবারাত্রি সংসারের জন্য পরিশ্রম করে যাবে তার বেলায় তোমাদের মতো পুরুষ মানুষের তেমন একটা খারাপ লাগে না। কিন্তু স্ত্রী পরিশ্রম করে টাকা এনে সংসারের হাল ফেরালে তখন মান সম্মানে লাগে খুব!
হিমাংশু বাবু বেশ বুঝতে পারছেন বিষয়টা এবার নিরুপমার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। নিরুপমা বিয়ের পর হিমাংশু বাবুদের গ্ৰামের স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। তখন কিন্তু হিমাংশু বাবুর মা বাবা চরম আপত্তি করেছিলেন। ওনাদের যুক্তি ছিল বউ এর রোজগারের টাকায় খাওয়ার থেকে উপোস থাকা ভালো। আর হিমাংশু বাবুও চুপচাপ তার মা বাবা কেই সমর্থন করেছিলেন।
সেই পুরোনো ঘা থেকে রক্তক্ষরণ হওয়ার আগেই চুপচাপ বাজারে চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন হিমাংশু বাবু।
হিমাংশু বাবু বাজারে বেরিয়ে গেলে তিথি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, মা তুমি বাবাকে এত কড়া কথা শোনালে তবুও বাবা কিন্তু সব কিছু চুপচাপ সহ্য করে গেল। আমি তো ভাবতেই পারছি না বাবার মতো রাশভারী মানুষ একান্তে তোমার কাছে যেন কত অসহায়!
নিরুপমা বলল, বৌমা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই হচ্ছে বোঝাপড়া বা সমঝোতার ভিতের ওপর তৈরি। যৌবনে পুরুষ মানুষের থাকে অন্য উদ্দীপনা। নিজেকে পুরুষ সিংহ মনে করে। কিন্তু চামড়ার শিথিলতা আসার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে যৌবনের ভুলগুলো। বুঝতে পারে, মা বাবা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছাপিয়ে বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে স্ত্রী’কে। তাই তখন বুড়ো সিংহের মতো মাঝে মধ্যে হুংকার ছাড়লেও আস্ফালন করার ক্ষমতা থাকে না। চুপচাপ স্ত্রীর বাক্য শিরোধার্য করা ছাড়া উপায় থাকে না আর।

Loading

2 thoughts on “গল্প- পুরুষ সিংহ

  1. বাহ! দারুন লাগলো

Leave A Comment