অকাল বৃষ্টি
-সুনির্মল বসু
একটা শীতল পুকুর, একটা মাটির ঘর, অদূরে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর,
পুকুরের ওপারে কাঠবাদাম গাছ, নিবিড় বাঁশবন, উঠোনে ডেয়ো ফলের গাছ, ডানদিকে ধূ ধূ মাঠ,
সেইসব সোনালী সকালগুলো আমায় পিছু ডাকে, বলে, যাবি, আয় না, আমার সঙ্গে আয়,
কি করে যাবো, আমার যে অনেক কাজ,
সে দিনের রাতের আকাশটা মনে পড়ে, উঠোনে মাদুর পেতে পড়াশোনা, স্বপ্নের মতো আকাশের তারা গোনা, বাঁশবনে জোনাকির আলো, দিনগুলো ছিল বড্ড ভালো, মাঠে দিনের আলোর মতো সারারাত জ্যোৎসনার বৃষ্টি,
সিরাজদার বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়া,
আমাদের বাড়িতে মানিক মিস্ত্রির পিসিমা আসতেন হাতে দুটো নারকেল নিয়ে,
কাকু মাঠ থেকে ভেজা শালিক এনে বলতো, বাবু, একে বাঁচাতে হবে,
সকালে হরেন বাবু পড়াতে আসতেন,কী মায়াময় মানুষ, কী গরীব, বড্ড ভালোবাসতেন আমায়, পড়াতেন, মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি,
মল্লিকদের পাঠশালায় দুর্গা প্রতিমা গড়তেন অনিল পাল, স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম,
সকাল বেলায় শিউলি ফুলে ভরে যেত আমাদের উঠোন,
মহালয়ার ভোরে মা ডেকে তুলে দিতেন, মাইকে বাজতো বীরেন ভদ্রের কণ্ঠস্বর,
সকালে মালুম কাকু দুধ দিতে আসতো, কোনো কোনো দিন মোড়ল কাকু মাঠ থেকে মানকচু তুলে এনে দিত, বিশ্বনাথ কাকু বিকেল হলেই, প্যারেড করাতেন,
মাটির মিষ্টির দোকান দিতাম আমি কুদুর, পিতিশ আর তপু,
সেই উদাস হাওয়া, সেই ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে জামরুল কুড়োবার দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল,
মাঝে মাঝে কে যেন পেছন থেকে বলে, যাবি,
যেতেই তো চাই, সবুজ মাঠে আগের মতো ছুটে বেড়াতে চাই,
বাবার পাশে শুয়ে বাঁশবনের মাথায় বড় চাঁদটাকে দেখতে চাই, আশ্চর্য সুন্দর সরল একটা পৃথিবী ছিল তখন,
অভাব ছিলো, দারিদ্র ছিল, সরল মানুষ ছিল, গাছে গাছে ফুল ছিল,
মানুষের মুখে ভালোবাসা ছিল, অরণ্য পাখির গলায় গান ছিল,
এরপর জীবন আমাকে নিয়ে গেছে কতদূর, কতদিন হোল, আমি নদীর তীরে হেলে পড়া নিম গাছের নিচে নোঙ্গর করা একটা নৌকোর পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি,
আজ অভাব গেছে, খুশিতে থাকার সব উপকরণ হাতের মুঠোয়,
তবুও মাঝে মাঝে কে যেন পেছন থেকে ডাকে, বলে,
আয়,আয়, আমার সঙ্গে যাবি,
খুব ইচ্ছে করে, পিছনে হাঁটি, খুব ইচ্ছে করে পিছনে ছুটি,
সময় বলে, তা আর হয় না, হারানো দিনগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকতে পারে,
কিন্তু যে দিনগুলো চলে যায়, তা আর কখনো ফেরে না,
শুধু স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে এসে অকাল বৃষ্টির মতো সময়ে অসময়ে ঝরে যায়।