পলাশ শিমূলের দিনগুলো
-সুনির্মল বসু
ডি এম অফিস। নর্থ বেঙ্গল। ডুয়ার্স। সকাল সাড়ে নটায় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ার গাড়ি অফিস করিডোরে ঢুকলো। নন্দিনী সেন গাড়ি থেকে নেমে দূরে গাছ পালার দিকে চাইলেন।
চোখের কালো চশমা খুলে দেখলেন,অজস্র শিমূল পলাশে চারদিক ছেয়ে আছে।
মাথার ওপরে নীল আকাশ। গাছের পাতা সবুজ। দূরে কোথাও গান বাজছিল,
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার।
ভদ্রমহিলা পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব। উনি এক সময় যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন, সেটা বোঝা যায়। কপালের সামনের দিকে কিছু চুলে পাক ধরেছে।
তিনি নিজের চেম্বারে গিয়ে বসলেন। টেবিলের ওপর পলাশ আর শিমূল ফুলের গুচ্ছ রাখা আছে। এ নিশ্চয়ই ওর খাস বেহারা সাবিত্রীর কাজ। সাবিত্রী জানে, ম্যাডাম ফুল ভালোবাসেন।
নন্দিনী মুহূর্তের জন্য অতীতে ফিরে গেলেন।
উইমেন ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা। কত কতদিন ওখানেই এসে দাঁড়িয়ে থাকতো কৃষ্ণেন্দু। কোনো কোনোদিন দূরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতো।
একেক দিন কলেজ ছুটির পর, ঝিলের ধারে গিয়ে
বসতো ওরা দুজন। কত কথা হতো। কত স্বপ্ন ছিল সেদিন ভবিষ্যতে জীবন ঘিরে।
দূরের পলাশ বন দেখছো,
হ্যাঁ তো,
শিমূল ফুলের ডালে শালিক পাখি বসে মধু খাচ্ছে,
কি অপূর্ব দৃশ্য,
ভারী মায়াময়,
তোমার অফিসের কি খবর,
আমাকে নর্থ বেঙ্গলে ট্রান্সফার করে দিচ্ছে,
তুমি কিছু বলো নি,
বলেছিলাম, অফিস বলছে কোন উপায় নেই। যেতেই হবে।
এদিকে আমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে, বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হবে।
দূরে কোথাও রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল, বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা।
মনে হয়, শান্তিদেব ঘোষের গলা,
অমন দরাজ গলা আর কজনার,
সিকিউরিটির ওসমান খাঁন সেলাম করে অফিসে ঢুকলো। একটা স্লিপ দেখিয়ে বলল, ম্যাডাম, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
আসতে বলো।
ভদ্রলোক দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, আসতে পারি।
আসুন। বসুন। বলুন।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবা নন্দিনী সেন একটু চমকে গেলেন। সামনে কৃষ্ণেন্দু। নর্থ বেঙ্গলে আসার পর, এখানেই বিয়ে করে নতুন করে ফ্ল্যাট কিনে সংসার পেতেছে।
হায় ভালোবাসা,
কৃষ্ণেন্দু বলল, পৌরসভা থেকে আসছি।বালুরঘাটের রাস্তা সেংশনের টাকাটা
যদি কাইন্ডলি গ্র্যান্ট করে দেন,
নেসেসারি ফাইলপত্র দেখান,
অ্যাটাচি কেস থেকে ফাইলপত্র কৃষ্ণেন্দু টেবিলের ওপর রাখলো। সব দেখে, নন্দিনী ফাইলে সই করে দিলেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, নন্দিনী,
ধন্যবাদ কেন, এটা আমার অফিসিয়াল ডিউটি,
কেমন আছো তুমি,
খুব ভালো,
সেসব দিনের কথা মনে পড়ে,
জেনে কি লাভ,
উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা, ল্যাম্পপোস্ট, ঝিলের ধার, পলাশ বন, শিমূল ফুলের সুরভি, কিছুই কি মনে নেই,
মনে আছে বলেই তো, ভালোবাসাটাকে সস্তা হতে দিইনি,
সেদিন আমি তোমার প্রতি অবিচার করেছিলাম নন্দিনী,
তাই নাকি, কবে থেকে এই বোধদয় হোল,
নর্থ বেঙ্গলে পোস্টিং হবার পর, আমি হাই সোসাইটির মেয়ে অনিন্দিতাকে বিয়ে করলাম,
খুব ভালো,
না নন্দিনী, কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারেনা,
কেন,
বিয়ের কিছুদিন পর আমার সামান্য আয় নিয়ে সংসারে অশান্তি। ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে রিসেন্টলি রনদীপকে বিয়ে করেছে।
তোমার মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু, সেদিন ঝিলের ধারে পলাশ শিমূলের ছায়ায় বসে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসার শপথ নিয়েছিলাম।
আমি কথা রাখতে পারিনি। কিন্তু আজ চেয়ারে তোমাকে দেখে, চমকে গিয়েছি।
তুমি চলে গেলে, খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম এক সময়।
এরপর মন শক্ত করলাম। পলাশ শিমূলের দিনগুলির মধ্যে আমি ভালোবাসার শক্তি খুঁজে পেলাম। ভাবলাম, ভালোবাসা হারেনা, ভালোবাসা মরে না, আমাকে প্রমাণ করতে হবে।
গ্রাজুয়েশনের পর আমি এ গ্রেডে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিলাম। তারপর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আজ এখানে।
একলার জীবন,তোমার কষ্ট হয় না,
ভালোবাসাটাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি, মানুষের জন্য কাজ করছি। আজ আমি একা নই, কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দু বলল, আজ আসি।
অফিস থেকে বেরোতেই, ওসমান খাঁন প্রশ্ন করলো, কাজ হয়েছে সাহেব।
কৃষ্ণেন্দু বলল, হ্যাঁ।
ওসমান বলল, ম্যাডাম কোনো ফাইল আটকে রাখেন না, অনাথ শিশুদের জন্য অনেক অনেক কাজ করেন।
বিমর্ষ কৃষ্ণেন্দু পথে নেমে এলো। একটা সিগারেট ধরালো। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মনে মনে বলল, পলাশ শিমূলের সৌন্দর্য সেদিন আমি দেখেছিলাম। নন্দিনীও দেখেছিল। বসন্ত দিনের ভালোবাসার শক্তি আমি সেদিন দেখতে পাইনি।
নন্দিনী দেখেছিল।
আমি যা পারিনি, নন্দিনী তা করে দেখিয়েছে। ভালো থেকো নন্দিনী।
পিচ ঢালা পথের উপর যখন পলাশ শিমূলের চূর্ণ এসে পড়েছে। আলগোছে কৃষ্ণেন্দু কয়েকটা পলাশ ফুল নাকের কাছে তুলে নিল। দূরে লাউড স্পিকারে কোথাও গান বাজছিল, রঙ শুধু দিয়েই গেলে, সে রঙ কখন লাগলো আমার মনে, আমার জীবন মরণ ধন্য করে।
কৃষ্ণেন্দু মনে মনে বলল, একদিন তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি চলে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমাকে আমি কাঁদিয়েছিলাম নন্দিনী। আজ তোমার সাফল্যে আমি খুশি। আমার খুশির এই চোখের জল, তুমি কোনোদিন দেখতে পাবে না নন্দিনী।