গল্প

গল্প- দত্তক

দত্তক
– শিলাবৃষ্টি

আমি রিনিঝিনি রায়। ছেলেবেলা থেকে কানাঘুষো শুনতে হয়েছে আমি দত্তক নেওয়া মেয়ে। একটা একান্নবর্তী পরিবারে আমি বড় হয়েছি। মায়ের কোনো অযত্ন ছিলনা কোনদিন। কিন্তু বাবা! না সেই মানুষটা হয়তো আমাকে সেভাবে মেনে নিতেই পারেননি। আসলে বাড়িতে আর পাঁচজন মানুষ যখন সমালোচনার ঝড় তোলে, তখন বাবা হয়তো ভাবেন যে বিরাট ভুল করে ফেলেছিলেন অতীতে!
আসলে আমিও এ বাড়ির আদব কায়দা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারিনি। আমার ভিতরে সবসময় একটা বিদ্রোহ কাজ করে। ছোটবেলায় বলতে পারতামনা, এখন বলি, প্রতিবাদের ভাষা আমার ঠোঁটে। আর সে জন্য কথায় কথায় আমাকে শুনতে হয় ” আমি এ বাড়ির দত্তক “।
” বিনোদবিহারী কোয়েড কলেজে ” সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী আমি। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আজও কলেজে এসেছি। লিজার পিরিয়ডে অমল যথারীতি হাজির।
– চল রিনি এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে আসি ক্যাণ্টিনে।
অমল যে আমাকে লাইক করে সেটা আমার বুঝতে অসুবিধে হয়না। আমিও ওকে পছন্দ করিনা তা নয়! তবে ওকে সব বলা উচিৎ। বললাম
-তুই বাইক এনেছিস আজ?
-হ্যা, কেন রে?
-আজ লাস্ট পিরিয়ডের ক্লাসটা ডুব দিবি?
-বাব্বা! আজ রিনিঝিনি রায়ের হলো কি?
-ইয়ার্কি মারিসনা তো..
বিকেলের পড়ন্ত রোদে অমল আর আমি বাইকে
দিল্লী রোড ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও হঠাৎ বিনা মেঘেই বৃষ্টি নামলো। শেষে একটা মধ্যবিত্ত ধাবায় আমরা ঢুকে চা আর ওমলেট অর্ডার দিয়ে কোণের দুটো চেয়ার দখল করে বসলাম। এটা সেটা কথার পরে অমল বললো
-এবার আসল কথাটা বলে ফেল রিনি
– কি আসল কথা?
– যার জন্য ক্লাস অফ করে আমাকে নিয়ে এতদূর ছুটে এলি?
– হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস অমল…
– কিরে প্রোপোজ করবি নাকি?
বলেই অমল হা হা করে খানিক হেসে নিল।
নারে, যাতে তুই আমাকে কোনোদিন না প্রোপোজ করিস সেই ব্যবস্থা করতে।
কথাটা বলার সাথে সাথে অমলের মুখটা যেন রক্ত শূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । বললো
-কাউকে ভালোবাসিস তুই?
-না তো –
– তবে? আমার ভালোবাসায় তোর কি আস্থা নেই?
– আজ আমার সব কথা তোকে শুনতে হবে।
– বল
জানিস অমল আমাদের বাড়িটা মানে আমি যেখানে থাকি সেটা একটা একান্নবর্তী পরিবার। এখনো এক রান্নাঘরে চোদ্দ জনের রান্না হয়।
বাবারা তিন ভাই। আমার বাবা মেজ।
জ্যেঠুর দুই সন্তান। কাকারও এক মেয়ে। কিন্তু আমার মায়ের বিয়ের ছ বছর কেটে যাওয়ার পরেও কোল ভরে কোনো সন্তান এলোনা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, অনেক জড়ি বুটি খাইয়েছিল ঠাম্মি কিন্তু না, মা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল! জ্যেঠু কাকুরা যখন তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ভীষণ সুখী, মা বাবা তখন আড়ালে চোখের জল ফেলতো। ঠাকুমা কথায় কথায় মাকে আঁটকুড়ি বলতো। সেই সময় একদিন হঠাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশের এক বান্ধবী এ বাড়িতে আসেন আর মাকে জানিয়ে যান তিনিও ভাগ্য দোষে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি একজন পরিপূর্ণ মা। তিনি একবছরের একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছেন। মা যেন কথাটা শুনে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। বাবার কাছে দিন দুবেলা করুণ আবেদন নিয়ে বসে থাকলো। বাবা রাজি হতে পারেন নি সহজে, ঠাকুমা একেবারেই বেঁকে বসলো। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকলো। মাও জেদ ধরে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করলো। অনেক লড়াই এর পরে পুরুলিয়ার এক অনাথ আশ্রম থেকে মা যে শিশু কন্যাকে দত্তক নিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটা আজ তোর সামনে বসে আছে অমল..
বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে যায় আমার। নিজের ভাবাবেগকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। অমল কিন্তু নির্লিপ্ত। সে শুধু বলে
তাতে কি? কি এসে যায় তাতে?
অমল!
-বল, উত্তর দে। এতদিন যে শব্দগুলো শুধু মনেই জমা রেখেছিলাম, আজ তা প্রকাশ করছি রিনি।আই লাভ ইউ। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি পাগলী।
-কিন্তু, এ হয় না অমল। তোর বাড়ির কেউ আমাকে মেনে নেবেনা।
-দূর! আগে তো আমি তোকে প্রাণ ভরে ভালোবাসি, তারপর বাড়ি।
-অমল, আমাকে যে মা অনাথ আশ্রমে ফেলে চলে গিয়েছিল হয়তো সে কোনো
কুমারী! হয়তো মুসলিম! হয়তো বা
পতিতা! একবার ভেবে দেখ, কেন আমায় মানুষ মেনে নেবে?
-তোর কি দোষ? নিজেকে অসম্মান করিস না। যে মা তোকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল, পরম স্নেহে তোকে আগলে বড় করে তুলেছে, তোকে সন্তান হিসেবে পেয়ে যার সব শূন্যতা ভরে গেছে সেই তোর আসল মা।
অন্য কিছু আর ভাববিনা কোনোদিন।
বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশে কালো মেঘ ছিল।
ফেরার পথে একবার দাঁড়িয়ে ও শুধু আমায় বললো – তুই নিজেকে ঘৃণা করিস?
আমি কোনো কথা না বলে ওর পিঠে মাথা রাখলাম।

দুদিন কলেজে যাইনি। জ্বর কমছিলনা বলে মাকে নার্সিহোমে এডমিট করতে হয়েছিল। আগামীকাল সকালে ছুটি দেবে। বিকেলে অমল এসে হাজির। আমি তো চমকে গেছি প্রথমে। ও আমার ক্লাসমেট বলে পরিচয় দিল। বাবা মাও অবাক হয়েছে বুঝলাম। বাবা বসার টুলটা এগিয়ে দিল।এরপর ও বসে নিজস্ব বাচনভঙ্গীতে আলাপ চালিয়ে গেল। হঠাৎ একসময়ে মাকে প্রশ্ন করে বসলো
– মাসীমা! আপনার সেই ছোটবেলার বান্ধবীর নাম কি? যার কথায় আপনি রিনিকে দত্তক নিয়েছিলেন?
আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল।
– বুড়ি। ভালো নাম অসীমা
– বাড়ী কোথায় ছিল মাসীমা?
– মগরার দিকে। পরে…
– পরে কোন্নগরে ফ্ল্যাট কিনেছিল। অসীমা সরকার। আমার মা। মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আর আমিই সেই দত্তক নেওয়া ছেলে অমল।
অপার বিস্ময়ে আমি চমকে তাকাই অমলের দিকে। এও কি সম্ভব?
ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট কিরে হাসছে।
দেখ কি মিল আমাদের। একেবারে রাজজোটক।
বলেই মা আর বাবাকে প্রণাম করে বললো
—- আমি নিজেকে উপযুক্ত করে আবার আসবো। সেদিন রিনিকে চেয়ে নেব আপনাদের কাছ থেকে। আজ আসি।
আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি।

Loading

One Comment

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page