-
কবিতা- মনমোহিনী
মনমোহিনী
-সুবিনয় হালদারপুঞ্জিভূত ক্ষোভের লাভা গাদাগাদা
তুঁষে চাপা ধিকধিকিয়ে জ্বলছিল সে বুকে-,
নীল আকাশে তারা গুলো মিটিমিটি
চাঁদেরহাটে ভোগবিলাসে জ্যোৎস্না মেখে-
চুপিচুপি দিব্যি ছিলো স্বর্গ সুখে ;
আয়েশ করে দুষ্টু ছেলে ছলেবলে-
খাচ্ছিল পঞ্চ-ব্যঞ্জন বৃদ্ধাঙ্গুল চেটে !মনমোহিনী ছদ্মবেশী অমৃত কলস হাতে
বিলিয়ে দিলো সকল সুধা নৈরাজ্যের হাটে ;
রাহু কেতু জলের তোড়ে গেঁড়ি গেলা গিলে
উদ্ভ্রান্ত পোষ্য স্তাবক চাটুকার পঞ্চভূতে মিলে,
বিষিয়ে দিয়ে নিভিয়ে দিলো গোকুল অন্ধকারে !দাপিয়ে বেড়ায় হিংস্র প্রায় ভস্মাসুর শতশত
সদলবলে কসাই সেজে ভালোবাসে কত
সুযোগ বুঝে মারছে কোপ নিচ্ছে লুটে সর্বস্ব !আরো কতটা সময় ধরে থাকবি-রে সব নিশ্চুপ ;
আর কতটা গভীর তলে- কালো প্রহর কামড়ে খেলে
খুলবে তবেই সাঙ্গ প্রাণে দয়াদানের মৌন মুখ !চোখ চেয়ে সব অন্ধ সেজে থাকিসনে আর
সব বুঝে সব শুনে সবাই মিছে কেন সাথ ;
তাই চুপিচুপি শক্ত মনে চোয়াল চাপা কণ্ঠস্বর
সমবেত পদধ্বনি বজ্র মুষ্টি আওয়াজ কর । -
কবিতা- ইচ্ছে ডানা
ইচ্ছে ডানা
-গঙ্গাধর পরামানিকইচ্ছে আমার পাখি হয়ে উড়বো আকাশে
কিচিরমিচির মধুর ধ্বনি ছড়িয়ে বাতাসে,
মাছ হয়ে সাঁতার কেটে ঘুরবো জলের দেশে
ফুল হয়ে ভরাবো ভুবন মনোহারী সুবাসে।পাহাড় চিরে ঝর্ণা বেয়ে ছৎ-ছলাৎ-ছল
আমি হব তৃষ্ণাহারী মিষ্টি নদীর জল,
প্রজাপতি হয়ে রঙিন পাখনা দেবো মেলে
বৃক্ষ আমি, ক্লান্ত পথিক বসবে ছায়া তলে।বনের রাজা সিংহ আমি গর্জনে বন কাঁপে
নৃত্য-গীতে মন মাতাবো বন ময়ূরের রূপে,
তাঁরা ভরা রাতের আলোয় চাঁদের মুখে হাসি
সূর্য মাখা দিনের আলোয় স্বপ্ন-সুখে ভাসি।। -
কবিতা- ১৬ই ফাগুন
১৬ই ফাগুন
-শুক্রাচার্য্য…বিংশ শতকের ফাগুন বদলেছে
নবীন বহ্নির অর্ণবে…
বাঞ্ছিত তিমিরের অভিলাষ না জানি
অন্তরীক্ষে চাহিয়া কবে…
বৃন্তে গাথা পরিণয়ের গল্প শিশিরের
ন্যায় ঝরে যাবে…
লগ্নের জাহ্নবী সায়াহ্নের তিতিক্ষায়
মৃত্যু কে খাবে…
তবুও রোমাঞ্চিত হবে বসন্ত তুমি!
সেই আগের মত…
কেন রহে আড়ালে বসন্ত অন্তরালে
মন চঞ্চল অবিরত…
ভালো মন্দের বাতাসে উড়িছে আকাশে
জানা অজানা কুঞ্জে…
শব্দে শব্দে বিমর্ষ হৃদি নিসর্গের বুকে
ছবি আঁকে গুঞ্জে… -
গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা
সোনার সিঁড়িতে পা
-সুনির্মল বসুতখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশিরের শব্দ, মাঠে মাঠে কাশফুল, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেলা, দীঘির জলে শাপলা শালুক, নদীতে ভেসে যাচ্ছে গায়নার নৌকো। উদাসী প্রকৃতি। বাতাসে বাজছে উৎসবের সুর।
তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন।
গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।
মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।
অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।
মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।
অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।
ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।
একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।
গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।
এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।
জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।
একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।
অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।বিশ্বরূপ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।
জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাবসলিউটলি,নট।
দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।
সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।
-
কবিতা- লাশ
লাশ
– সুব্রত আচার্য্যলাশ ভেসেছে ! লাশ ভেসেছে !
খবরটা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের গতিতে , শহর থেকে গ্রামে। গ্রাম তখন ঘুমিয়ে ছিল। সারাদিনের ব্যস্ততা , যানজট , কোলাহল তারপর রবিবার , ছুটির দিন , একটু দেরিতে ঘুম ভাঙবে শহরের। ততক্ষণে কাগজে- কাগজে , চায়ের দোকানে , পাড়ার রকে ছড়িয়ে পড়েছে খবরটি।আমরা খবর পেতেই দেখতে গেলাম। দেখি জীবন্ত লাশের ভীড়ে শুয়ে আছে বছর কুড়ি- বাইশের নিথর এক দেহ। নিথর দেহটি যেন সবুজের অঙ্গিকার। পুলিশ এসে সরেজমিনে সবকিছু দেখছে।
আজ এই ফাগুনে ভেসে ওঠে কুড়ি থেকে বাইশ বছরের লাশ। উপচে পড়া ভীড়ে কারা যেন বলে উঠলো , দেখতো ভালো করে কোন দলের লাশ। আমাদের কেউ নয় তো ? কখাটা শুনে চমকে উঠলাম। লাশের আবার দল হয় না কি !
রবিবারের সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। আমার মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে সেই শব্দ গুলো। শব্দের পর শব্দ বসাতে বসাতে এগিয়ে যাই মানচিত্রের দিকে , কখনও নিজের চারণভূমিতে , কখনও- – – – -।
লাশের স্তুপে আজ তুমি। হয়তো আমি আগামীকাল। হয়তো বা , হয়তো বা জীবন্ত লাশ। -
কবিতা- বসন্ত বিলাপ
বসন্ত বিলাপ
-পাপিয়া ঘোষ সিংহকবিতার ছন্দ আজ পথভ্রষ্ট
গতিপথ হারিয়েছে শব্দতরঙ্গ।
ভালোলাগা,ভালোবাসা বনবাসে আজ
মাতৃ হারা অসহায় শাবক বিহঙ্গ।খুশি গুলো মুখঢেকে দূরে গেছে চলে,
হাসি গান কেড়েছে এ বিষম সময়,
কথাকলি কথা খোঁজে, রাতদিন ধরে
শূন্যতা এ জীবন জুড়ে ছেয়ে রয়।বসন্তবিলাপ করে, দেয় যেন শীতের কামড়
সুমিষ্ট কুহুতান হয়না তো কর্ণগোচর,
দূর থেকে ভেসে আসে বেহাগের সুর,
অশ্রুজলে ধুয়ে যায় কলম আঁচড়।সাগরের ঢেউ নিয়ে যায় বালি ঘর,
দৃষ্টি যায় যতদূর– অসীম শূন্যতা,
আর কি আসবে ফিরে, স্বর্ণালী ক্ষণ?
আর কি আসবে ফিরে স্নেহ-শীতলতা? -
গল্প- একা’দশী তিথি
একা’দশী তিথি
-সুবিনয় হালদারচতুর্থ প্রহর শেষে ঊষালগ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে পৃথিবী।
নিশি সমাপন মুহূর্ত জানান দেয় পাখিদের সমবেত কিচিরমিচির ডাক আর আজানের আওয়াজ।
মা’ ষষ্ঠীর শঙ্খধ্বনিতে সকাল-সকাল তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে নেয় একা’দশী, আজ তার আর্য্য-ভূমিতে সংস্কৃতি যজ্ঞের পৌরোহিত্য করতে হবে।
সেখানে তার পরিচিত বহু মানুষজন আসবে, নমোনমো দুগ্গাদুগ্গা করে আত্মপ্রত্যয়ে বেড়িয়ে পরে একা’দশী।সেখানেই সেদিন প্রথম দেখা- তিথি ; পঞ্চমীদির সাথে ছোটবোন দ্বিতির হাত ধরে এসেছিল ওখানে।
দিদি’ই তাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়-, বাক্য বিনিময় হয় সামান্য কিছু- ব্যাস এইটুকু।
তারপর ধীরেধীরে দামোদরে জোয়ার আসে! কোটালে ভেসে যায় সবকিছু কিন্তু তিথি সেটা বোঝেনি কখনোই!
তবুও আসে, জানান দেয় সে আছে !
তিথির মেজ বোন অষ্টমী খুব সুন্দরী। মনে সংগোপনে লালিতপালিত কামিনীকাঞ্চন শোভিত যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষীত !
আসাযাওয়া গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে। দিন যায়- বছর ঘুরে বছর আসে আর যায়- ; উত্তর থেকে দক্ষিণায়ন অতিবাহিত হয় কত কিন্তু উত্তর মেলেনি আজো !বসন্তের পরন্ত বৈকালে ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ায় মর্মরধ্বনির সাথে কোকিলের ডাক শুনে নেচেছিল মন !
চেতনা পুরে প্রেরণা’ এসে জাগিয়েছিল সাদা খামে হলুদ ছোঁয়ার অনুভূতি !
তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলো- এক মায়াবী আলোর উৎস সন্ধানে ;
তার’ই জন্যে সে অপেক্ষা করছিলো- অনেকটা সময় ধরে, রাস্তার পাশে গাছের তলায় এক যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে।
পথচলতি কত মানুষ- কত ব্যস্ততা- বাস গাড়ির হর্ণ এর বিকট আওয়াজ- দুষিত আবহাওয়া- সব কিছু উপেক্ষা করে !
সমস্ত বাধা অতিক্রম করে হন্তদন্ত হয়ে ঘামে-নেয়ে একসা শরীরে একা’দশী তিথির সামনে দাঁড়ালো- ;
অন্যমনস্ক তিথি যেন রূপকথার দেশে মায়াবী পরী,
কী বলবে- ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো-না !সুন্দর পরিপাট্য বেশভূষায় বেশ লাগছে ।
একা’দশীকে এইভাবে বোকা স্ট্যাচুর মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো- চলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে ! বলে সটান রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে থাকলো !
একা’দশী তখন ওর কাছে গিয়ে আলতো স্বরে বললো- তোমাকে-না আজ খুব সুন্দর লাগছে ।
ধ্যাৎ,মোটেই না- ; কী-যে বলো-না- আজকাল ; বলে- শরৎ মেঘের ওড়না উড়িয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে চললো-,
অগত্যা সে-ও ওর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলো !মোড়ের বাম দিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করলো । ও কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বললো- ওঠো ;
একা’দশী আগে উঠে বসার পর সে তার একেবারে পাশে- গায়ে গা-ঠেকিয়ে গেটের দিকে বসলো ।অটোরিকশা চলতে থাকলো একা’দশীর নাজানা গন্তব্যে !
হাওয়ায় তিথির চুল গুলো ঠোঁট স্পর্শ করে উড়ে এসে পরছে একা’দশীর মুখে আর তিথির মেয়েলি গন্ধে তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে এক পারিজাতের নরম স্নিগ্ধতা ভরিয়ে দিচ্ছে !
তার শাড়ির আঁচলটা বারবার উড়ে এসে ওর মুখমণ্ডলটা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে কেউ যেন একটা কাশফুল দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে !তিথির ঘোরে আচ্ছন্ন একা’দশী শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকে ! হাল্কা লাজুক হাসি আর চোখেমুখে উজ্জ্বল আভার উপস্থিতি ভরে উঠেছে তিথি ।
কোন কথা বলছেনা দেখে সে জিগ্যেস করতে যাবে- ঠিক সেই সময় তিথি বলে উঠলো- এই দাঁড়াও- দাঁড়াও এখানে ।নেমে পড়লো দুজনে । ভাড়াটা বের করার আগেই তিথি চালকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে একা’দশীর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় বললো- চলো- সামনের ওইখানে আমরা যাবো !
দেখলো দূরে একটা বড় বিল্ডিং আর তার গেটের বাইরে ইংরেজিতে লেখা- The Asylum .
-
কবিতা- কথা ছিল না
কথা ছিল না
-সুনির্মল বসুগভীর রাতে সরল বস্তি কাঁদে, গভীর রাতে যে মেয়েটি একলা ঘরে ফেরে,এ শহর তাঁর দিকে কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি,
গভীর রাতে যে বেকার যুবক চাকরির সন্ধান করে একবুক হতাশা নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরেছে,এশহর তাঁর ফিরে
চেয়ে দ্যাখে নি,গভীর রাতে চাঁদ, নীহারিকা মন্ডল চেয়ে দ্যাখে,
গভীর রাতে কেঁদে ওঠে ক্ষুধার্ত শিশু,
পথেই লেখা হয় যাদের জীবনলিপি,গভীর রাতে বাতাস কাঁদে, নদী কাঁদে,
আকাশ ও সমুদ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,
কারা কেড়ে খায় শিশুর খাবার,কারা ভোগের মধ্যেই করছে জীবন কাবার,কারা পৃথিবীতে আনছে দূষিত বাতাস,
তাদের চিহ্নিত করো,বলো,এ দেশ আমার,
এ দেশ নয় তো লুটের খামার,এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,
ছদ্মবেশীদের চেনো,শোধ করো জন্মভূমির ঋণ,প্রাসাদের নীচে কেন বস্তি,কেন জীবন হারিয়েছে স্বস্তি,কারা প্রতিদিন আকাশকে করছে কালো,
দেশে কতজনের হয়েছে ভালো,তাদের চিহ্নিত করো,
চোর সাধুর ভেক ধরেছে কেন,সুন্দর আকাশ একদিন আমরা আনবোই,
এই সত্যটা জেনো। -
কবিতা- জেগে ওঠার গান
জেগে ওঠার গান
-সুমিত মোদকফিরে আসা বললেই , ফিরে আসা যায় না ;
নদীতে ঢেউ অনেকটাই বেড়ে গেছে ;
সামনেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে মাটির বাঁধ ;
এ সময় মাটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা খুবই প্রয়োজন ;
জলের সঙ্গেও …ভেঙে পড়া ঘর-সংসার , সমাজ , সভ্যতায়
নতুন করে জেগে ওঠার গান …
অথচ , যে ক্ষ্যাপা জীবনের গান বাঁধল
তাকে সকলে দিল দূর করে ;মানুষ যখন নিজেকে আর খুঁজে পায় না
তখনই দেখে অন্যের দিকে ;
খুঁজে নিতে চায় অন্যের অন্ধকার দিক ;
হাঁটে সে দিকে …এখনও অনেকটা পথ বাকি বাড়ি ফিরতে ;
হয়তো এতো দিনে সেই চেনা জানা মানুষ গুলো
বদলে নিয়েছে নিজেদের মতো করে ;
বদলে নিয়েছে গতি পথ , মনুষ্যত্ব …নদীতে ভাসতে ভাসতে , ভাসতে ভাসতে
নাবিকও এক দিন মাটি ছুঁয়ে দেয় ;
মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে ;মাঠের সোনালী ধান খামার বাড়িতে
উঠে এলে , দুগ্ধবতী গাভী চরে বেয়ায় ;
একে একে উড়ে আসে সাদা সাদা বক ,
অতি পরিচিত পাখি ;
বাতাসে বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ …কুয়াশা আর ধোঁয়াশা সরিয়ে মেখে নেবো
প্রথম সকালের রোদ ;
তাই ফিরে আসা বললেই ফিরে আসা যায় না । -
কবিতা- ভেল্কিবাজি
ভেল্কিবাজি
–সুবিনয় হালদারমধ্যযুগের বর্বরতা হার মেনেছে ঘাড়
অশ্রুজলে ঘাট হয়েছে
সমস্বরে এবার তোল আওয়াজ,
শালতি চড়ে বালতি ভরো
গুল্তি ছুড়ে গিঁট্টি কষে দাবিয়ে রাখো
আব্রু নিয়ে খেলা করে পালিয়ে কেন গেলি ?
টপাটপ রোষানলে উল্কি-
ভেল্কিবাজির কল্কি রে ভাই
ভেল্কিবাজির কল্কি !আগুনের ফুলকি ওড়ে
ফুলকি ওড়ে- ওই-
অন্ধকারে কালের ঘরে ত্রাসের নাচন
রণ-রঙ্গে সাজছে মাতন
দুর্গন্ধে বাতাস কেন ভরলি ?
চারিদিকে ধিকধিকিয়ে জ্বলছে যত চুল্লী ;
ভেল্কিবাজির কল্কি রে ভাই
ভেল্কিবাজির কল্কি !দুল্কিচালে খিল্লি মারে অসভ্যতার পাল্কী
লকলকিয়ে জিভের লালা
টসটসিয়ে লোভের ক্ষুধা গলি-,
বুলবুলিদের মাঠের ফসল জবরদখল
নিত্য রাতে হাঁড়িকাঠে হচ্ছে কেবল বলি ;
ভেল্কিবাজির কল্কি রে ভাই
ভেল্কিবাজির কল্কি !সাত বেয়ারা সাত সমুদ্র মিলেমিশে এক
সবাই কেমন ঘুপটি মেরে সুপ্ত মনে
করছে রে ভাই বাস,
ভেল্কিবাজির গিল্লি গিলে
গুপ্তধনে আয়েশ করে দিব্যি আছেন স্যার ;
ঝুল্কি তালে তাল মিলিয়ে জাগছে এবার পল্লী
ভেল্কিবাজির কল্কি রে ভাই-
ভেল্কিবাজির কল্কি !