রম্য রচনা

  • রম্য রচনা

    রম্য- আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ

    আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ
    -সুনির্মল বসু

     

     

     

    বন্ধুগণ, আপনারা সবাই আমাকে চেনেন, বাসে ট্রামে ট্রেনে অফিস-আদালতে আপনারা সবাই আমাকে দেখেছেন, আমার সবজান্তা ভাব অথবা হাত ছুঁড়ে লম্বা ডায়লগ বাজি শুনে মনে মনে বিরক্ত হলেও, মিষ্টি করে হেসে বোঝাতে চেয়েছেন, বক্তা হিসেবে আমি এডমান্ড বার্কের ভায়রা ভাই, মুখেন
    মারিতং জগৎ, কথাটা আমাকে দেখেই চালু হয়েছিল।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ, আপনারা আমাকে বিলক্ষণ চেনেন।
    আগের আগের শতকে রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ জন্মালেন, আমি তাদের জন্মজয়ন্তী পালন করি, অথচ এদের জীবনের অনেক কিছুই জানিনা, না জেনে বিজ্ঞতার ভান করি। খ্যাতি অর্জন করার দিকে আমার বরাবরের লোভ। আমি যোগ্যতা ছাড়াই যশ প্রত্যাশী। যদি আমরা সত্যিকার রবীন্দ্র চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরনে, আমাদের কাজ কর্মের মধ্যে তার প্রতিফলন কোথায়, সবার ক্ষেত্রে নয়, অনেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা লোক দেখানো হয়ে যায় নাকি, আমরা নিজেদের সংস্কৃতিপ্রেমী প্রমাণ করতে গিয়ে,একটা অলীক জীবনের আবহ তৈরি করছি নাকি, বিষয়টি ভেবে দেখার মনে হয় সময় এসেছে।

    রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমার পাঞ্জাবীর শিল্পকর্ম দেখে আপনি অবশ্যই বুঝে নেবেন, আমি কতখানি সংস্কৃতিকে স্পর্শ করে আছি।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
    আমি মানবিকতাকে খালে ফেলে দিয়েছি, বিবেক শব্দটিকে খুন করে আমার হাতে রক্তের দাগ, মূল্যবোধ শব্দটিকে কবে যে নির্বাসনে পাঠিয়ে ছিলাম, আজ আর তা মনে করতে পারি না, কারণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।

    আমি রবিনসন ক্রুশোর মতো একক দ্বীপে থাকি। আমি থাউজেন্ড পার্সেন্ট স্বার্থপর। আমি কোনো সম্পর্ক মানি না, মুখে আন্তরিকতা দেখাবার অভিনয় করি। যে বিষয়ে আমার স্বার্থ জড়িত আছে, সেখানে আমি ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকি। সর্বক্ষণ ক্ষমতার অলিন্দে আমি ওৎ পেতে বসে আছি। সকলের স্যালুট পাওয়াটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে।

    প্রাচীন সম্পর্কগুলো ব্যাকডেটেড বলেই, আমি সব সম্পর্কের পাট চুকিয়ে দিয়েছি। আমার তুতো ভাইয়েরা চারদিকে বৃদ্ধাশ্রমের রমরমা বানিয়েছে।
    আসলে, আমার স্বভাবটা হোল, পাকাল মাছের মতো। আমি এক পুকুরে থাকতে পছন্দ করি না, বারবার নিজের সুবিধামতো পুকুর বদলাই। জগতটা টাকার বশ, এই সার সত্য কথাটা আমি ভালোভাবে বুঝে নিয়েছি। তাই উপরি উপার্জনের দিকে আমার
    ঝোঁক বেশি।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
    আমার পারিপার্শ্বিক মিডিয়াগুলো লক্ষ্য করুন। সেখানে সাংস্কৃতিক গরম মশলা নিয়মিতভাবে পরিবেশিত হয়। নায়িকার বহুবিবাহ থেকে সন্তানের জনক সম্পর্কিত প্রশ্ন, মিডিয়াতে অগ্রাধিকার পায়। অগণিত মানুষের কান্না, জীবন সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, কিংবা মহৎ কর্তব্যবোধের ছবি কখনো অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মতো মিডিয়ার চোখে পড়ে না। টিআরপি বাড়ানোই যেখানে শেষ কথা, সেখানে আদর্শের কথা তোলা, আকাট মূর্খামি।

    বন্ধুগণ, আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। আমাকে আপনারা অবশ্যই চেনেন। স্যুট টাই পরলে ,আমাকে বেশ সফিস্টিকেটেড লাগে। কথা বার্তায় আমি কখনো প্লেটো, কখনো অ্যারিস্টোটল। আমি জগাদার চায়ের দোকানে চারমিনার সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বোদলেয়ার থেকে আলবেয়ার কামু্র সাহিত্য নিয়ে গলা ফাটাই। অথচ, কিছু অনুবাদের বাইরে আমি কিছু পড়ি নি। কারণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।

    আমার চলাফেরা তেরিয়া ধরনের। আমি প্রথা ভাঙ্গা দুর্বিনীত একালের আঁতেল। যতই লম্ফঝম্প করি না কেন, বিপদ দেখলে, আমি খাটের তলায় আত্মগোপন করি। তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে স্রেফ শীতঘুমে চলে যাই। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বরাবর যা করেন, এই সরল চালাকিটা অনেক কষ্ট করে শিখে নিতে হয়েছে।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। এই সমাজে আপনি আমাকে বিভিন্ন রূপে দেখতে পাবেন। ধরুন, আমি একজন চিকিৎসক, পাশাপাশি আমার কবিতা লেখার অভ্যাস। আমার কবিতায় আমি মাইথোলজিক্যাল আঙ্গিকে সামাজিক নানা ঘটনা কাটাছেঁড়া করি। প্রশংসা পাই, হাততালি কুড়াই। কিন্তু নিজের পেশার ক্ষেত্রে
    অসহায় রুগীর ব্যাপারে কোনো আর্থিক কনসিডার করিনা।

    আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। কর্পোরেট হাউসে বসে শিল্প-সাহিত্যের ঠিকা নিয়ে বসে আছি। এই জায়গাটাকে আমি এমনভাবে কুক্ষিগত করে আছি,
    আমার জান পেহেচান পীরিতের লোক ছাড়া, এখানে নো এন্ট্রি’ বোর্ড ঝোলানো আছে। পেয়ার মহব্বতের এই জায়গায় সাধারণের প্রবেশের অধিকার নেই। তাই বস্তাপঁচা সাহিত্য এখন পাবলিককে গিলতে হচ্ছে।

    আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
    সাহিত্য একসময় নিঃসঙ্গ দিন রাতের সারস্বত চর্চা ছিল। এখন কবিতায় আমি নতুন আঙ্গিক এনেছি।
    আমার একটি কবিতার নমুনা,
    ল্যাম্পোষ্টের মাথায় আর টিভির এন্টেনায় বিচক্ষণ কাগ হেগে যায়। অন্য একটি কবিতায়,
    তুমি সাগর আমি ঢেউ, তুমি কুত্তা আমি ঘেউ।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। আমার মধ্যে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সভা সমিতিতে আমি এ নিয়ে দু-চার কথা ভাষণ দিয়ে থাকি। কিন্তু আদপে অন্য নারী নয়, নিজের বাড়িতেও আমি নারীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখি না।
    অথচ কথায় বলে, চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হোম।

    বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। একটু লক্ষ্য করে চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, বিভিন্ন পেশায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার মতো হামবাগ সমাজের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। গানে নাটকে অভিনয় জগতে, কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসায়, সাহিত্য ক্ষেত্রে ‌,সর্বত্র এইসব হামবাগদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। এখন সমাজে শ্রোতা কম, বক্তা বেশি।

    বন্ধুগণ, আমরা এগোচ্ছি। তবে সামনের দিকে নয়,
    ব্যাক গিয়ারে এগোচ্ছি। চলতে জানা যেমন জীবনের অংশ, থামতে জানা তেমনি জীবনের জন্য প্রয়োজন।

    করিৎকর্মা আমার মতো হামবাগদের এই কথাটা কে বোঝাবে। সাফল্যের সিঁড়িতে পৌঁছবার এই সহজ রাস্তাটা আমার মতো হামবাগ ছাড়া ,সত্যিই কতজন
    জানেন।

    ( কৃতজ্ঞতা স্বীকার- শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ঘটক)

  • রম্য রচনা

    রম্য- বনাম প্যাটন ট্যাঙ্ক

    বনাম প্যাটন ট্যাঙ্ক
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের লোকেরা জানতো না একদিন ছেঁড়া প্যান্টের যুগ আসবে।
    ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে শরীরের অসভ্য জায়গা ঢেকে ঢুকে বুক চিতিয়ে বলবে- এই দ্যাখ, এটা তোর চাইতে দামী।
    প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের স্মার্ট লোকগুলো
    হঠাৎ ক্যাবলাকান্ত হয়ে গিয়ে ছেঁড়া প্যান্টের ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে থাকবে আর মনে মনে বলবে,
    একি? কেন?
    কানের পাশে ফিসফিস করে কেউ একজন এক কানে রিং দুল পড়ে পানমশলার থুথু জমানো মুখে উচ্চারণ করে যাবে,
    একেই বলে সভ্যতা,চাঁদু। ফ্যাশন সভ্যতা।

    সভ্যতা কী। সহজ কথায় বলতে গেলে,
    মিছরি- সোজা হাতে ধরে খাও কিংবা বাঁকা হাতে। স্বাদ একই থাকবে, মিষ্টি।
    পাড়ার জনদরদী মিশুকে মিঠু বৌদি পেখম তোলা ময়ূরের মতো সেজেগুজে, ঝর্ণার মতো কলকল করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বান্ধবী তনুকে বললো- জানিস, কালকে ইউ টিউবে দারুণ একটা রান্না শিখলাম।
    -কি রে? উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে।
    -উচ্ছের বিরিয়ানি
    -এ মা, উচ্ছে দিয়ে, ভালো হবে? স্বরে সন্দেহের তিতকুটে গন্ধ ।
    মিঠু বৌদি ঠোঁট বাঁকিয়ে চ্যালেঞ্জ নেবার ভঙ্গিতে বললো- হবে না মানে, ফাটাফাটি হবে। আমি তোকে করে খাওয়াবো।
    এসে গেল সেই চ্যালেঞ্জিং উচ্ছে বিরিয়ানি ডে। সন্ধ্যেবেলাই মিঠু বৌদি উড়ন্ত পাখির মতো উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে এক গামলা উচ্ছে বিরিয়ানি উপহার দিয়ে গেল।
    ডিনারের ব্যবস্থা পাকা। সুতরাং আজ তনুর রাতের রান্না নেই। সকালের চিকেন কারি ফ্রিজে রাখা আছে। গরম করে নিলেই হবে।

    যথাসময়ে ডাইনিং টেবিলে ইউ টিউবের বিশেষ বিরিয়ানি পরিবেশিত হলো। হায় হায়, এ কি হলো, ছি ছি ছি , এটা একটা খাদ্য! মানুষ খায়? গরুও ছোঁবে না।
    তনুর স্বামী ছুটে চলে গেল বেসিনে। ওয়াক থু ওয়াক থু করে ভালো করে মুখ ধুয়ে এসে বললো- তোমার সুন্দরী বান্ধবীকে বলে দিও। দুনিয়ায় বহু খাদ্য আছে, কিন্তু তার সবই মানুষের জন্যে নয়।
    ভাগ্যিস ঘরে খানিকটা মুড়ি ছিল। চিকেনকারি দিয়ে মুড়ি, খুব একটা মন্দ নয়।
    বোঝা গেল, যেখানে যা মানানসই সেটাই সভ্যতা। অন্যথায় ভোগান্তির একশেষ।

    প্যাটন ট্যাঙ্কের যুগে চোর আসতো রাতে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে।
    ধরা পড়লে রক্ষে নেই। বারোয়ারী ঠ্যাঙানি। মেরে লাট করে দেবে। শেষে কেউ একজন বীরপুরুষ কাঁচি দিয়ে মাথার চুল কোপচে খামচা করে কেটে, শেষ বারের মতো শাসানি দিয়ে ছেড়ে দেবে।
    যুগাবসানে চোর আসে দিনদুপুরের মধ্যিখানে। চুল নিজেই মেল পার্লার থেকে চোরছাঁট ছেঁটে তাতে ব্রাউন কালার লাগিয়ে দেবানন্দ স্টাইলে বেঁকে বেঁকে এসে ক্লায়েন্টের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে, গালে ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে, পেটের কাছে সেই জায়গায় দেশীগান ঠেঁসে ধরে বলে,
    কী আছে বের করে দে..শিগগির।
    ক্লায়েন্ট বেচারা কাঁপতে কাঁপতে ঘড়ি, ওয়ালেট, মোবাইল ফোন স্বহস্তে সর্বশান্ত হয়ে কেৎরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
    ছেঁড়া প্যান্ট স্টাইলিশ চোর যাবার আগে শেষ শাসানি দিয়ে গেল- বেশি বাড়াবাড়ি করলে দাদাকে বলে দেবো, ম্যাঁও সামলাতে পারবি না। তোর পুলিশ বাবা আমার জাঙ্গিয়া কেচে দেবে। যা ফোট।

    মলয় মল্লিক প্রতিদিনের মতো সেদিনও তার কাজের জায়গায় যাবেন বলে সদর দরজা খুলে বাইরে পা রেখেই চমকে এবং বমকে গেলেন। স্বাভাবিক।
    দরজার সামনে চাপচাপ রক্ত, মরা মুরগির ঠ্যাং, পালক ছত্রাকার হয়ে রয়েছে।
    একটি ছোকরা ছেলে, মোটা বেঁটে সাইজের কাঠের গুঁড়ির ওপর ফটাফট করে মুরগী কেটে বিক্রি করছে।
    মলয় মল্লিক রেগে কাঁই। মুরগী কাটা ছেলেটাকে তেড়ে গেলেন- আহাম্মক, আমার বাড়ির দরজায় মুরগী বেচার জায়গা বানিয়ে ফেললি? যাওয়া আসায় রাস্তা। যা খুশি তাই করবি, কী ভেবেছিস কী! হঠা,, হঠা সব এখন থেকে, এক্ষুনি সরিয়ে নে বলছি, নইলে..
    এইবারে মুরগী কাটা ছোকরা উঠে দাঁড়ালো। পরনে সেই ফ্যাশানের ছেঁড়াপ্যান্ট। গায়ে স্লিভলেস গেঞ্জি। সারাগায়ে রক্তের ছিটে। একেবারে নিখুঁত বুটিক ডিজাইন।
    -নইলে কী? বেশি ভাঁজবেন না। ব্যবসা করছি। কোনও চুরিচামারি করছি না। বেকার বাঙালির ছেলে। সৎ পথে করে খাচ্ছি। ব্যাগড়া মারবেন না।
    -শোনো শোনো, তোমাকে ব্যবসা করতে মানা করিনি। আমার দরজাটুকু ছেড়ে, যেখানে খুশি বসো।
    -দূর মশাই, দরজা দেখাচ্ছে। দরজা আপনার, তাই বলে কি কর্পোরেশনের ফুটপাতও আপনার? লে হালুয়া।
    কিচ্ছু সরবে টরবে না। যান তো, যা পারেন করে নিন। তারপর বুঝবেন আমি কে..
    লিখে রাখুন আমার নাম ডাব্বু। আট থেকে আশি সব্বাই একডাকে চেনে। দাদা এখানে বসতে বলেছে, ব্যাস। কোনও কথা হবেনা।
    ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গেছে। লাগদাই সিন। এসব ক্লাইম্যাক্স সিন দেখার রসিক পাবলিক প্রচুর ।
    মল্লিক মশাই এবার একটু নরম হয়ে বললেন- ঠিক আছে, বসো এখানেই বসো। ব্যবসা করো। কেউ তো মানা করছে না। তাই বলে মুরগী ? ঘরের সামনে! না না এটা কীভাবে সম্ভব? গন্ধে কেউ টিঁকতে পারবে এখানে? অন্য কিছু করো, ফুল বিক্রি করো।
    – হাসালেন দাদা। এই গুড্ডু বসে বসে ফুল বেলপাতা বেচবে ? হেঁ হেঁ,আপনি ফুলের গন্ধ শুঁকবেন? হেঁ হেঁ ,
    শুনুন স্যার, ছোটো মুখে একটা বড়ো কথা বলে রাখি, ভবিষ্যতে মিলিয়ে নেবেন।
    মা কালীর দয়ায় যদি এই মুরগির ব্যবসাটা জমে যায়, তাহলে আপনার পাশের বাড়িটাই আমি কিনবো। প্রতিবেশী। দুবেলা দেখা হবে।
    খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে আবারও বসে পড়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ করে মুরগী কাটতে শুরু করলো।
    মল্লিক মশাই রাগে ফুলছিলেন। মনে মনে বললেন- এটা যদি আমাদের সেই প্যাটন ট্যাঙ্কের জামানা হতো, তাহলে এক্ষুনি ও-ই মুরগির জায়গায় তোকে ফেলে ঘচাং ফু করে দিতাম শালা।

    কী আর করা যাবে। সেই প্যাটন ট্যাঙ্কও নেই তার দাপুটে গর্জনও নেই।
    এখন ফ্যাশনের ছেঁড়াপ্যান্টের মুখ ভ্যাংচানো দেখার যুগ। একটু মানিয়ে নাও গুরু। সহ্যশক্তি মহাশক্তি, মহাগুণও বটে। চিন্তা নেই। অনিয়ম টেঁকসই হয় না।
    দু’দিন বৈ তো নয়।

    (প্যাটন ট্যাঙ্ক একটি পুরাতন যুদ্ধাস্ত্র। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যবহার করে অসামান্য সাফল্য পেয়েছিল ভারতীয় বাহিনী)

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- “বাংলা ভাষার হালচাল”

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    “বাংলা ভাষার হালচাল”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    মা জী দুধ লিজিয়ে,,

    –সুবহ্ সুবহ্ মা জী দুধ লিজিয়ে, ঘুমের বারোটা বাজাইয়ে।রূকো যাই,
    কি মনে করকে আজ জলদি জলদি আয়া,
    —কা হা জলদি মা জী,
    –চুপ রহো,কালসে দশ বাজে আনা।ঘুম পুরা নেহি হোতা তো গা‌ ম্যাজ ম্যাজ করতা হ্যায়
    –জী মা জী ।জো আপ বোলেঙ্গে
    ঘর থেকে লালমোহন বাবু বললেন, ভুতাই তুই রোজ এই সময়েই দুধ দিয়ে যাবি।দশটার সময় এলে আমি চা খাবো কি করে,অফিস যেতে হবে না‌ আমাকে।
    সীমা দেবী চিৎকার করে বললেন,
    ম্যায় যো বলুঙ্গা ওহি হোগা
    ভুতাই দশ বাজে আনা
    ভুতাই গোয়ালা জানে এখন কি কি হবে,হাঁ মা জী ঠিিক হ্যায়
    বলেই ভুতাই দে ছুট
    লালমোহন বাবুর স্ত্রী সীমা দেবীর হিন্দিতে কথা বলা শুরু হয় ভুতাই আসার সময় থেকেই।তারপর সেটা চলে বাজারে ,কাজের মেয়ের সাথে,পাড়া প্রতিবেশি ‌।লালমোহন বাবু কিছু বলতে গেলেই বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দে কাঁপতে থাকে গোটা পাড়া।
    সীমা দেবী সকাল ন’টার সময় বাজারে যান, কর্তা অফিস চলে যায় তারপর।বাজারে গিয়ে উনি হিন্দিতে কথা বলেন।ওনার ধারণা হিন্দিতে কথা বললেই মান সম্মান বাড়ে।বাংলা ভাষার কোন দাম নেই ।মাথা নত করতে হয় না হিন্দি ইংরেজি ভাষাতে কথা বললে।এবার জেনে নি উনি আসলে কি ভাষায় কথা বলেন
    দোকানদার–আমার থেকে আলু ‌নিয়ে যান‌ ও দিদি, ও বৌদি,নিয়ে যান,,

    –আলু কত করে দেতা হ্যায় ?

    –পঁচিশ টাকা কিলো।কত দেব?

    –টুয়েন্টি ফাইব ! ও ঠিক হ্যায়
    দো কিলো দো।পটল কত করে দেতা হ্যায় ?ও ভী দো কিলো দো।
    তারপর মাছের বাজারে গিয়ে সীমা দেবী বলেন,
    আরে ভাই এ ফিস মরা হ্যায় তো।জিন্দা ফিস দো,লাফালাফি করতা‌ হ্যায় ও ফিস চাই

    —ইলিশ মাছ লাফালাফি করে না মা জননী,কৈ মাছ নিন খুব নড়েচড়ে,লাফালাফি করে

    –কৈ কত করকে দেতা হ্যায়?

    –হাজার টাকা কেজি

    –ঠিক হ্যায় দো‌ঠো ওজন করো

    বাজারের থলি নিয়ে বাড়ি ফিরে সীমা দেবী বারান্দায় বসে ভাবেন হিন্দি ইংরেজীতে কথা বলে বাজার মাত করে দিয়েছি।
    সন্ধ্যা বেলায় কর্তা বাড়ি ফিরলে আবার চলে হিন্দিতে কথাবার্তা ।এর একটা কারণ আছে লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত যাবেন ঘুরতে ।ছেলে কলকাতায় থাকে ।ফোন করে মাকে বলে দিয়েছে হিন্দিটা ইংরেজিটা একটু চালু রেখো মা,
    কাজ দেবে।
    ব্যস ,আর থামেন নি উনি হিন্দি, ইংরেজি ,বাংলা ভাষার দফারফা করে ছেড়েছেন ।
    সীমা দেবী কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেলে সবাইকে বলেন, বিদেশ যাতা হ্যায় হামলোগ ।
    লালমোহন বাবু মহা ঝামেলায় পড়েছেন।না হিন্দি না বাংলা আবার ইংরেজি ভাষাও আছে।
    –কত বার বলবো।উত্তর ভারত বিদেশ না। ,ভারত নাম শোননি ?

    –তোমার বেশি বেশি ।না হয় একটু বিদেশ বললাম।
    –ঠিক আছে যা বলার বলো ।উত্তর ভারতে গিয়ে আবার ভাষার প্রদর্শন করো না যেন।

    —বলবো ,হিন্দি ইংরেজি ভাষায় কথা বলবো,বাংলা ভাষায় আছে টা কি,
    –ঠিক আছে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না,পুরো কথা ‌হিন্দি ও ইংরেজিতে বলবে তবেই বুঝবো দম আছে তোমার, বাংলা ভাষাকে অপমান ! কিছুতেই আমি সহ্য করবো না,এই আমি   বলে রেখে দিলাম
    –ঠিক আছে ঠিক আছে, রেস্টুরেন্টে গিয়ে এগরোল দিন বলো কেন? ময়দায় ডিম প্যাচানো খাবার দিন ,বলতে পারো তো,শুধু আমার বেলায় দোষ,সেদিনকে ফোনে কাকে যেন বললে‌,রবিবার হলি ডে মর্টন না‌ হলে ‌জমে না,আমি কতবার তোমার ‌কথা শুনে ‌হেসেছি বলো ?
    –সেটা অন্য ব্যাপার,ভুল তো কিছু বলছি না
    যাইহোক তিন চার দিন পর লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত ঘুরতে গেলেন,দিল্লিতে লালমোহন বাবুর দিদি থাকেন ,ওখানে থেকেই সব জায়গায় ঘুরবেন।দিল্লিতে পৌছে
    ট্রেন থেকে ‌নেমে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন ওনারা,
    একটা টাটা সুমো আসতে দেখে সীমা দেবী চিৎকার করে উঠলেন
    গাড়ি স্টপ গাড়ি স্টপ ,
    — গাড়ি থামবে না।তুমি চিল্লে মরো
    –কেন থামবে না।আমি কি বাংলা ভাষায় কথা বলছি ?হিন্দি ,ইংরেজি তুমি একাই পারো ?
    রণ বাববার বলে দিয়েছে ,মা বাইরে যাচ্ছো হিন্দিতেই কথা বলবে,ছেলেকে তো আর ইনসালট করতে‌ পারিনা
    –একদমই না,। ঐ দেখো গাড়ি চলে এসেছে
    চলো ,গাড়িতে উঠে‌ বসো
    সুমোতে ‌বসলেন সীমা দেবী,বাব্বা বহুত গরমি,
    আজি শুনতে হো ড্রাইভার,হ্যালো
    জানলা কা কাঁচ নিচে নামা দো,নিশ্বাস নিতে কসট্ হোতা হ্যায়

    –“আজি শুনতে ‌হো”,এটা‌ পতিদেবকে সম্মোধন করে‌ বলতে হয়,বুঝলে
    ওই দেখো ড্রাইভার ছেলেটা তোমার কথা শুনে হাসছে
    –ভুল তো বলি নি।
    –না না ভুল কিসের ,বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষার মিলন করে ছাড়ছো।ফুলশয্যার রাতে যেমন আমাদের মিলন হয়েছিল।মনে আছে কি বলেছিলে ? হা হা ,
    আমি গোলাপ ফুল বলতে তোমার কি হাসি
    –গোয়ালার সাথে রোজ হিন্দিতে কে কথা বলে তুমি না আমি।ও তো বাংলা বোঝেই না।
    হিন্দি আমার রক্তে আছে ।
    মুখ দিয়ে তো এক অক্ষর হিন্দি শব্দ বের হয় না।
    –আমার পূর্ব পুরুষদের একটা ঐতিহ্য আছে ,
    বাংলা ভাষাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ভাষা ।অহেতুক হিন্দি বলি না।যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে বলতেই হবে,বিমলদা’র ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে আমাদের বাড়ি তে আসে তোমার সাথে কি‌ সুন্দর বাংলাতে কথা বলে তোমাকে প্রণাম করে,আর তুমি বলো জি তে রহো বেটা,আরে মন খুলে আশীর্বাদ করতে হয়,তুমি এমন ভান করো যেন বাংলা বলতেই পারো না,
    ওনাদের কথোপকথনের মধ্যে
    ড্রাইভারের ফোনে রিংটোন বাজবে
    “তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” গানটা শুনে‌ লালমোহন বাবু বলেন,
    তোমার নাম কি ভাই?
    –আমি উদিত প্রসাদ
    –শোন ভালো করে উদিত ওর ফোনের রিংটোনে কি সুন্দর গান রেখেছে ।আর তুমি ফোন চালাতেই পারো না।আবার রিংটোন রেখেছো বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায় ।
    –মুহু বনদ্ করো,প্রেসটিজ হ্যায় মেরা
    —সে তো‌ ভালোই জানি,বাংলাতে কথা বলো,লোকে সন্মান করবে।কখনও শুনেছো কোনও ইংরেজকে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কোন বাংলায় কিছু বলতে ।হিন্দি ভাষী যারা তারাও কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে আনে না।কিন্তু আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার অপমান করছি।বাংলার মধ্যে হিন্দি ইংরেজি ভাষাকে টেনে আনছি।কেন ? এ প্রশ্ন শুধু আমার না।

    –স্টপ ।অনেক হয়েছে ,রোজ সকালে কে বলে গুড মর্নিং ।এক কাপ চা দাও ।পেয়ালা কি তুমি বলো ?আসলে কথা বলার সময় আমাদের খেয়াল থাকে না তাই বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলি।তার মানে এটা না যে বাংলা ভাষাকে অপমান করছি
    –সব মানলাম ।কিন্তু তুমি জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না।
    বাংলাতে কথা বললে হিন্দি বলবে না।করেগা ,খায়েগা ,দেগা অসহ্য লাগে ।
    মনে রেখো ,”বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা ,নয়তো অবহেলার।
    এই ভাষাতেই “ভারত ছাড়ো” হুঙ্কারে বৃটিশরা হয়ে ছিল জেরবার “

    –দাদা আপনারা এখানেই নামবেন তো?।আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো দাদা।বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা নয়তো অবহেলার।যথার্থ বলেছেন দাদা।
    –থ্যাঙ্ক ইউ ভাই
    লালমোহন বাবুর ইংরেজি মেশানো বাংলা কথা শুনে
    সীমা দেবীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । চোখ দিয়ে মা চন্ডীর রুদ্র রুপ বেরিয়ে পড়েছে ।
    লালমোহন বাবু মনে মনে ভাবছেন সব জ্ঞান মাটিতে মারা গেল।ধ্যাত তেরি,,কি দরকার ছিল থ্যাঙ্ক ইউ বলার ।অশেষ ধন্যবাদ ভাই বললে কি হতো।ঠিকই তো কথা বলার সময় খেয়ালই থাকে না কি বলছি।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে লালমোহন বাবু হেসে বললেন,
    তুমি ঠিক বলেছো গো, কথা বলার সময় অনেকেরই খেয়াল থাকে না
    উদিত গাড়িটা থামিয়ে বলল, বৌদি খুব সুন্দর কথা বলেন ।বৌদির কথা শুনে একটু হাসলাম।এটাই বা কম কিসের । মানুষের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় কিছু কিছু কথা।সে বাংলা ভাষায় হোক বা জগাখিচুড়ি ভাষায় ।আমি তো খুব হাসলাম,আপনাদের মনে রাখতেই হবে, দাদা
    আমি আপনাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিচ্ছি
    সীমা দেবী বললেন, অল রাইট।ঠিক আছে
    লালমোহন বাবু হেসে বললেন ,এই তো আগে ইংরেজি বলে তারপর না হয় বাংলায় বলে দিও।কোনও সমস্যা নেই।
    –লেটস গো।চলো

    লালমোহন বাবু স্ত্রীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওনার কানে কানে বললেন ,আমি তোমাকে ভালবাসি,আই লাভ ইউ।
    সীমা দেবী মুচকি হেসে বললেন আই লাভ ইউ টু,তিন চার পাঁচ ছয় সাত,,,,

    উদিত হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো, সূর্যটাও অস্ত যাওয়ার আগে শেষ হাসিটা হাসলো।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- বেনারসের রস

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    বেনারসের রস
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    একটা বিশাল হলঘর । তার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা অদ্ভুত দর্শন পিলারের উপর একটা বহুমূল্য হীরে রাখা আছে।
    সেই হীরে চুরি করতে হবে। কিন্তু সেই হীরে অবধি যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। অত সহজ নয় ব্যাপারটা।
    প্রত্যেক পদক্ষেপেই মৃত্যু হতে পারে , কেননা মেঝেতে ল্যান্ড মাইন পোঁতা আছে।
    মেঝেটা সাদা আর কালো টালি দিয়ে ঢাকা। কোন টালির তলায় মরণফাঁদ লুকিয়ে আছে কেউ জানেনা।
    কিছু টালি আছে নিরাপদ। কিন্তু চেনার উপায় নেই। সেই নিরাপদ টালির ওপর পা রেখে রেখে, সম্পুর্ণ আন্দাজে মানে কপাল ঠুকে এগিয়ে যেতে হবে সেই হীরের দিকে। রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য। একটু ভুলচুক হলেই মাইন ফেটে অবধারিত মৃত্যু ।
    দৃশ্যটা অমিতাভ বচ্চন অভিনীত একটি সিনেমার।
    কিন্তু কথা হলো বেমক্কা এই দৃশ্যের অবতারণা কেন ? সবুর করুন সব জেনে যাবেন ।

    নারায়নী , বেনারসে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন। সদ্যোজাত নাতনির মুখ দেখবেন বলে।
    দেখলেন। কী সুন্দর , কী সুন্দর । মা দুর্গার ছবি দেওয়া লকেট শুদ্ধ সোনার চেন নাতনির গলায় পরিয়ে দিয়ে চুমু খেয়ে আদর করলেন।
    বিনয় বাবুর চোখে জল। মুখে পবিত্র হাসি। বললেন,, দ্যাখো দ্যাখো কী সুন্দর হাসছে দ্যাখো।
    ওরে, এই ফোকলা মুখের ভূবণ ভোলানো হাসিটুকু দেখবো ব’লে ছুটে এসেছি। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন ,,
    বড়ো হও। অনেক অনেক বড়ো হও, মা আমার।

    পরের দিন সকালে , বেনারসী বেয়ান, নারায়ণী কে বললেন চলুন , বিশ্বনাথ দর্শন করে আসি , যাবেন?
    নারায়নীর খুব যে ইচ্ছে ছিল তেমন নয়। কেননা এর আগের বারে যখন এসেছিলেন তখন দর্শন করে গিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট মধুর নয়।
    সরু সরু গলি। গলির দুপাশে সার সার দোকান। নানান পশরা সাজানো। অসম্ভব ভীড়। সেই ভীড়ের মাঝে আচমকা হাজির হয়ে যায় ইয়া দশাসই বেপরোয়া পালোয়ান মার্কা ষাঁড় । সিং এর বহর দেখেই পিলে চমকে ওঠে।
    হাঁটার স্টাইল জমিদারের মতো। রাস্তা জুড়ে বসে থাকে মহারাজের মতো। খায় ভগবানের মতো , পরম আদরে ভক্তের প্রেম মিশ্রিত পবিত্র প্রসাদ।
    সেই প্রসাদ , উদরে রাত কাটিয়ে প্রভাতে কিংবা সন্ধ্যায় দেহ নিঃসৃত হয়ে বিপুল আকারে সশব্দে পথিমধ্যে যেখানে সেখানে পতিত হয়ে পড়ে থাকে।
    পথিক গন অবিচলিত ভাবে নিরুদ্বেগে সেগুলো পাশ কাটিয়ে নির্বিকার চলে যান। নিতান্তই স্বাভাবিক নিত্যকার ঘটনা।
    কিন্তু নারায়নী কোলকাতার বেহালার মেয়ে। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তার এবিষয়ে বিস্তর মানসিক ফারাক।
    তাই তাকে পথ চলতে হয় , ঐ অমিতাভ বচ্চনের সিনেমার মতো। সাবধানে , চোখ খোলা রেখে। একটু অন্যমনস্ক হলেই কেলেংকারী । পায়ে গোবরে মাখামাখি হয়ে বিদিকিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে।
    শুধু তো পা নয় শাড়ি বাঁচানোর ব্যাপারও আছে।
    শাড়ির নিচের দিকে ঐ জিনিস লেপ্টে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। তাই শাড়ি গুটিয়ে প্রায় হাঁটুর কাছ বরাবর।
    রাজকাপুর অভিনীত মেরা নাম জোকার ছবিতে একটা গান ছিল। সুপার হিট।
    এ ভাই জারা দেখকে চলো উপর ভী নেহি , নিচে ভী ডাঁয়ে ভী নেহি , বাঁয়ে ভী,,,,
    মনে মনে গুনগুন করতে করতে হাঁটলে নিরাপত্তা বোধ সজাগ থাকবে।
    তাই দেখে বেনারসী বেয়ান হেসে বাঁচেন না। বলেন ,,
    এ কি কান্ড। এইভাবে চললে তো রাত কাবার হয়ে যাবে।
    নারায়নী নাক সিঁটকে বলেন ,,,
    না রে বাবা ,, আমার বড্ড ঘেন্না করে।
    শুধু কি এই ? এরপর আছে বাইক যন্ত্রণা। সংকীর্ন গলির মধ্যে ভয়ংকর বিরক্তির কারণ এই বাইক।
    দুপাশে দোকান। সামনে দশাসই ষাঁড়। পিছনে বাইকের কর্কশ আওয়াজ।
    বিশ্বনাথের গলি তো নয় , যেন মহাভারতের চক্রব্যূহ । একবার ঢুকলে বেরিয়ে আসার জন্যে সাধ্যসাধনা করতে হবে ।
    প্রতি মুহূর্তে নারায়নীর মনে হচ্ছিল ,,
    হে বিশ্বনাথ , তুমি মাথায় থাকো। আমাকে রেহাই দাও। এই গলির যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্ত ক`রে দাও। আমি বাড়ি যাবো।

    মেয়ে ইন্দ্রাণী খুব খুশি। আনন্দে ডগমগ হয়ে বললো , মা তোমরা এসেছো খুব ভালো হয়েছে। হ্যাঁ গো মা , তোমরা এখন এখানে কিছুদিন থাকবে তো ?
    নারায়নী নাতনি কে, এ ডি অয়েল মাখাতে মাখাতে বললেন ,,,
    হ্যাঁ , কিছুদিন তো থাকতেই হবে। এতদূর থেকে এলুম। দু চার দিন না থাকলে হয়। তুইও একটু সামলে ওঠ।
    মেয়ে আস্বস্ত হয়ে বললো সেই ভালো। আমি তো এখন কিছুই করতে পারছি না। সব কাজ শ্বাশুড়ি একা হাতে করে।
    নারায়নী অবাক হয়ে বলেন ,,,
    সে কী ! তোদের কাজের লোক , কী যেন নাম? কুন্তী,,, সে কোথায় গেল ?
    শ্বাশুড়ি রান্নাঘরে ছিলেন। বেয়াই বেয়ান সেই কোলকাতা থেকে এসেছেন। আপ্যায়ন না করলে হয় ? কুটুম্বিতা জরুরি। তাই রান্নাঘরে ভীষণ ব্যাস্ত। পঞ্চব্যাঞ্জণের নিখুঁত আয়োজন।
    শেষের কথাটা কানে গিয়েছিল। বললেন ,,
    কুন্তীর কথা আরকি বলবো। সে ভেগেছে।
    বলেই মুচকি হাসলেন ।
    মেয়েরা মুচকি হাসিতে সর্বদাই রহস্যের গন্ধ পান। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
    নারায়নী , দুজনের চোখ মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন। কিছুই বুঝতে না পেরে বলেই ফেললেন ,,,
    কী ব্যাপার ?
    মেয়ে বললো,,
    ওসব শুনে তুমি কী করবে ? ওরা ওই রকমই, বাদ দাওতো।
    বাদ দাও বললেই কী বাদ দেওয়া যায় । কেমন যেন অন্যরকম স্মেল পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েদের মনে কৌতূহল বাসা বাঁধলে তার নিরসন না হওয়া অবধি ভাত হজম হবেনা। বিশেষ করে তাতে যদি স্ক্যান্ডালের গন্ধ থাকে।
    নারায়নী বললেন,, মানে প্রায় আবদার করে বললেন ,,,,
    শুনি না , কী ব্যাপার ?
    ইনু ( ইন্দ্রাণীর আদুরে নাম ) র শ্বাশুড়ি বেশ রসিক মানুষ । রসের কথা রসিয়ে বলতে পারেন । বললেন ,,,,
    আরে , ভেগেছে মানে নতুন নাগর জুটিয়ে তার সঙ্গে ভেগেছে।
    নারায়নী একটু কপাল কুঁচকে বললেন,,,
    যতদুর শুনেছিলাম ,,, মানে,, ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল না ?
    > ঠিকই শুনেছিলেন। তবে কী জানেন , ওর বরটারও একটা মেয়ের সঙ্গে নাকি লটঘট আছে ।
    ইনু মাঝখানে বলে উঠলো ,,,
    মেয়ে বলছো কেন , সেটাও তো একটা বউ।
    নারায়নীর ঠোঁটের কোণেও এবার দুষ্টু দুষ্টু মুচকি হাসি । বললেন,,,
    কী সব কান্ড রে বাবা । একটা সংসার করা বউ পালালো , আর একটা সংসার করা বরের হাত ধরে । লাও ঠ্যালা,,
    তিন জনেই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
    বেনারসী বেয়ান চোখ মোটকে চাপা গলায় বললেন ,,,
    জানেন তো আমাদের এই বেনারসে একটা প্রবাদ চালু আছে ,,,
    বেনারসে , সিঁড়ি , ষাঁড় আর রাঁঢ় থেকে সাবধান।
    আবারও বেদম হাসির ফোয়ারা ছুটলো ।

    বেনারসে এসে গঙ্গা আরতি দেখবেন না ?
    সে কী কথা ? চলুন চলুন,, খুব ভালো লাগবে। চলুন ।
    বেনারসী বেয়াই জোর তাগাদা দিলেন। কিন্তু বিনয় বাবুর তেমন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। বললেন ,,,
    না,, মানে,, শরীরটা ঠিক নেই। ঐ আসবার সময়ে ট্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়ে ,,
    > ও, হ্যাঁ , তাওতো বটে । ব্যাথা ট্যাথা কোথাও হয়েছে নাকি ?
    > হ্যাঁ , এই কোমরের কাছটা,,
    > এইরে যন্ত্রণা আছে নাকি ?
    > না,, তেমন কিছু নয়। তবে সামান্য একটু জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে ।
    > না না,, তবে তো অবহেলা করা চলে না, দাঁড়ান,, ডাক্তার কে একটা ফোন করি।
    বিনয় বাবু , অপ্রস্তুত হয়ে বললেন ,,,
    না না ,, আপনি ব্যাস্ত হবেন না। ও কিছু না। প্যারাসিটামল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
    > ও,, আচ্ছা ,, ঘরে কি প্যারাসিটামল আছে ? ওগো ,, একবার এদিকে আসবে ? তাড়াতাড়ি ।
    পড়ে গেলেন কীভাবে ? কী হয়ে ছিল কী?
    বিনয় বাবু পরলেন ফ্যাঁশাদে। সব কথা কী সবসময় সব লোককে বলা যায় ? নাকি সেটা শোভনীয় ?
    কীভাবে বলবেন জোরসে ছোটো বাইরে পেয়েছিল , বারবার টয়লেটে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে , হালকা হওয়া যায়নি। প্যান্টের চেন আটকে গিয়েছিল। তাকে সাহায্য করতে মিডল সিট থেকে তার স্ত্রী নিচে নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে গড়িয়ে পড়ে যান। তাকে ধরতে গিয়ে তিনি নিজেও পড়ে যান শুধু নয় প্যান্টের মধ্যেই কম্ম সেরে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলেন ।
    না না ধুস । এসব কেউ কুটুম বাড়িতে গল্প করে ? ছি ছি । প্রেশটিজের ব্যাপার।
    বিনয় বাবু , কথা উরিয়ে দিয়ে বললেন ,,
    না না ,, কিছু নয়। ওই একটু লেগে গিয়েছিল আরকি।
    বিষয় কে আরও হালকা করবার জন্যে বললেন , আরে বাবা বুড়ো হাড়ে এসব একটু আধটু হয়েই থাকে । বলেই হা হা ক`রে একাই হেসে উঠলেন। সেই কৃত্রিম হাসি তে প্রাণ ছিলোনা ।
    কিন্তু মজার কথা হলো , রিলে সিস্টেমের মাধ্যমে নারায়নী থেকে জামাই বাবাজী। জামাই বাবাজী থেকে ইনু। ইনু থেকে শাশুড়ী মা হয়ে শ্বশুর মশাই পর্যন্ত কথাটা রটে গিয়েছে । তবুও কেউ তা প্রকাশ করছেন না , নিতান্তই সৌজন্যের খাতিরে ।
    ভদ্রসমাজে এটাই রীতি , ভদ্রতা ।

    পরদিন দুপুরে সর্ষে ইলিশ দিয়ে ভাত খেতে খেতে পরম তৃপ্তির সাথে বিনয় বাবু বললেন বাহ চমৎকার। এখানে এমন ভালো ইলিশ পাওয়া যায় জানতাম না তো। দারুণ।
    বেনারসী শ্বশুর একগাদা হেসে মাছের কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন ,,,
    শুধু মাছের প্রশংসা করলে হবেনা মশাই । রাঁধুনির প্রশংসাও চাই ।
    বেনারসী শ্বাশুড়ি তৎক্ষনাৎ কথাটা লুফে নিয়ে বললেন,,,
    অবশ্যই । সকাল থেকে খেটেখুটে রান্না করলুম ,, তার একটা মূল্য নেই ?
    নারায়নী সেই কথায় সায় দিয়ে বললেন,,,
    ঠিকই তো। ইলিশ হোক বা যা-ই হোক , কাঁচা খেয়ে তো তারিফ করা চলেনা। তারিফ রান্নার। কী,, ঠিক কি-না ?
    বেনারসী শ্বশুর বাঁহাত দিয়ে ডাইনিং টেবিল চাপড়ে বললেন ,,
    ওয়েল সেড ম্যাডাম , ওয়েল সেড। চলুন , আজ সন্ধ্যারতি দেখতে যাবো সব্বাই মিলে। অবিশ্যি যদি মিষ্টারের শরীর ভালো থাকে ।
    নারায়নী , কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বললেন ,,,
    একদম । চলুন , সব্বাই যাবো।
    বেনারসী শ্বাশুড়ি বললেন ,,,
    না না,, ইনু বাচ্চাকে নিয়ে একা থাকবে কেমন করে। আমি যাবো না। তোমরা যাও। আমি তো বলতে গেলে প্রায় রোজই দেখি। ওনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। খুব ভালো লাগবে।

    খাওয়াদাওয়া শেষ করে , বিনয় বাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে পরলেন। এদিকে ওনাকে দেখতে না পেয়ে , নারায়নী একটু চিন্তিত হয়ে মেয়ে কে বললেন ,,,
    হ্যাঁ রে ইনু , তোর বাবা কোথায় গেল বলতো! তোকে কিছু ব’লে গিয়েছে?
    ইনু অবাক হয়ে বললো,,,
    কই,, না তো ! এই দুপুরবেলা,, কোথায় গেল?
    নারায়নী মাথা ঝাঁকিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন ,,
    ভালো লাগেনা বাবা। যত্তো ঝামেলা,, ওফ্ফ।
    ইনু হঠাৎ বললো , ও হ্যাঁ , মনে পরেছে। বাবা বলছিলো বটে , দুপুরে খাওয়ার পরে সকলকে চমকে দেবো।
    নারায়নীর চোখ গোলগোল হয়ে উঠলো ।
    বলিস কীরে? চমক! এ আবার কেমন কথা ! চমকে দেবার কী আছে , সারা জীবন ধরেই তো চমক আর ধমক দিচ্ছে । দ্যাখ কী খেল দেখায়। আর ভাল লাগেনা বাপু।
    নারায়নীর কথা শেষ হতেনা হতেই , হাতে সবুজ পাতায় মোড়া বড়ো আকারের একটা ঠোঙ্গায় গুচ্ছের খানেক বেনারসী পান নিয়ে হাসতে হাসতে বিনয় বাবু এলেন।
    নারায়নীর মেজাজ বিগড়ে ছিল। তারমধ্যে ওনাকে হাতে পানের খিলির ঠোঙ্গা নিয়ে হাসতে দেখে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। চিৎকার ক`রে বললেন,,
    কী ব্যাপার কী তোমার ,কাউকে কিছু বলা নেই , হুট ক`রে বাইরে চলে গেলে? অচেনা জায়গা,,, বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে শুনি,,।
    বিনয় বাবু সেসব কথায় কান না দিয়ে হঠাৎ নাচতে শুরু করে দিলেন , সঙ্গে গান,,,
    খাইকে পান বনাও রসওয়ালা
    খুল যায় বন্ধ আকল কা তালা।
    সেই নাচ গানের দাপটে সব্বাই সেখানে এসে হাজির। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দেখার পরে , বেনারসী বেয়ান, বেয়াইও নাচতে শুরু করে দিলেন। সঙ্গে তারস্বরে ডন ছবির গান। তাতে মিশলো অমিতাভ বচ্চনের নাচের স্টাইল।
    খাইকে পান বনাও রসওয়ালা,,,,
    নাচগান যেমন হঠাৎ শুধু হয়েছিল , তেমনই হঠাৎ করে শেষ হলো ।
    নারায়নীর ঠোঁটের আগায় মৃদু হাসির ঝিলিক বুঝিয়ে দিলো তিনিও খুব মজা উপভোগ করেছেন।
    বিনয় বাবু, সকলের হাতে ম ম করা গন্ধ ছড়ানো বেনারসী পান বিলোতে বিলোতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ,,
    যৌবনের বৃন্দাবন , বার্ধক্যের বারাণসী।
    জয় হোক জয় হোক বাবা বিশ্বনাথের।
    জয় হোক আমার নাতনির।
    নাতনির নরম মাথায় , পরম স্নেহের হাত রেখে আপ্লূত গলায় বললেন,,,,
    ওরে মা আমার , আবারও কতদিন পরে,
    মনে এতো সুখ , এতো আনন্দের অনুভূতি পেলাম।
    সে যে শুধু তোর জন্যে রে মা আমার ,, শুধু তোর জন্যে ।
    শেষের কথা গুলোর মধ্যে কেমন যেন মন পাগল করা আবেগ লুকিয়ে ছিল , তাই
    বিনয় বাবুর গলা সামান্য কেঁপে উঠল । সেই আবেগের দোলা ছড়িয়ে পড়লো সবখানে।
    সকলেরই চোখের কোল চিকচিক করছিল , আনন্দে ।।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- “ঘুম ঘুম চাঁদ”

    অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার”

    “ঘুম ঘুম চাঁদ”
    -রাখী চক্রবর্তী

    “দিনের শেষে ঘুমের দেশে”
    ক্লান্ত শরীর বিছানায় বসলেই চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসে,কিন্তু পরিপাটি করে শোওয়ার‌ ব্যবস্থা করলেই ‌ঘুম উধাও হয়ে যায়।
    সারাদিনের কাজ,ব্যর্থতা, হাসি মজা সব মগজের এক প্রান্তে রেখে ঘুমকে প্রেমিক প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরে ভালবাসতে হয় তবেই নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমানো যায়।
    ফুটপাথে যার শুয়ে থাকে তারা চাঁদকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে,চিন্তা ভাবনা নেই,হারিয়ে যাওয়ারও কিছু নেই ওদের,দুনিয়ার ‌সবচেয়ে সুখী ওরা, আমরা তাই ভাবি।
    ঘুম যে অনেক প্রকারের হয় সেটা ওরা জানলেও মাথা‌ঘামায় না ।
    যেমন ভাতঘুম, রুটি ঘুম, বিরিয়ানি ঘুম।
    কতো রকমের যে ঘুম হয়।আবার চোর ,ডাকাত ,প্রেমিক প্রেমিকা
    এনাদের ঘুম একটু অন্য রকমের।
    গেরস্থদের দুপুর বেলার ভাত ঘুম অনেকটা এই রকম গৃহকর্তা গৃহকর্ত্রী মুখে এক খিলি পান গুজে বিছানায় এলিয়ে পড়েন।তারপর ভাত ঘুম ।ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ মুখ একটু ফোলা ফোলা লাগে ।বেশ লাগে দেখতে
    ,মানে ঐ বাড়ির কর্তা‌ গিন্নি এনাদের কথা বলছি আর কি।

    ছেলে ,বৌমা ,মেয়ে অফিসে টিফিন টাইমে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু রুটি ঘুম দিয়ে দেন।মানে দুটো কি তিনটে রুটির খাওয়ার জন্য ঘুম বরাদ্দ দশ মিনিট । অবশ্য অফিসের বসদের দিনে ঘুমানো বারণ আছে,টানটান উত্তেজনা ওনাদের মধ্যে কাজ করে কি দিন কি রাত,
    এরপর এক বিশেষ মুহুর্ত আসে বড়লোক বা মধ্য বিত্ত চাকুরিজীবি দের ছুটির দিনে ,মর্টন বা চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে বিরিয়ানি ঘুম চলবে টানা চার ঘণ্টা ।
    চিন্তা ভাবনার কোন বালাই থাকে না এই ঘুমে ।ফলে স্বপ্নরাও আসে না ।লালপরী নীলপরীরা রাতের ঘুমে আসে ।দিন ওদের পছন্দ না।
    যে ছেলেটা বা মেয়েটা
    সারাদিন কাজের পর রাতের বেলায় খাতা পেন নিয়ে লিখতে বসে ছাদে বা বেড়ার ছাওনির এক চিলতে ঘরে মনে মনে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে ,
    ঘুম ঘুম চাঁদ তাদের কাছে খুব রোমান্টিক ।পেটে ক্ষুধার জ্বালা থাকে পরিবারের ভার থাকে সারা শরীর জুড়ে ।কিন্তু চোখে ঘুম নেই ।চাঁদকে নিয়ে কবিতা লিখে যায় ‌একটার পর একটা,যদি প্রকাশকের মনে ধরে,কবিতা যদি ছেপে বের হয়,তাহলে মা বাবা আর বলতে পারবে না ছাই কপালে কিছু ‌হবে না,ও সব লেখালেখি বাদ দে,

    একমাত্র চোর ডাকাতরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়।
    আমাদের ঘুম যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে হয় তার জন্য ওরা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে।চোর ডাকাত বলে কি ওরা মানুষ না ? ওদের প্রার্থনা কি ঠাকুর শুনবে না?নিশ্চই শোনে ঠাকুর ।নিজেদের চোখের ঘুম নষ্ট করে ওরা মা বাবা পরিবারের পেট ভরায় ।তাই ওদের কাছে ঘুম ঘুম চাঁদ বাতুলতা মাত্র ।

    “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকমিকি তারা ঐ
    মাধবীরাত আসে নি কো বুঝি আর জীবনে আমার” বিখ্যাত গান
    প্রেমিক প্রেমিকার মনে ঝড় তোলে।ঘুমের দেশে ওরা পৌছে তো যায় ,কিন্তু ঘুম কতটা গাঢ় হয় সেটা ওরা নিজেরাও জানে না।ঘুমের মধ্যে ওরা ঘর সংসার করে পরিপাটি করে । প্রেমিকার খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়িয়ে প্রেমিক বলে ,”সারাজীবন তোমার হয়ে থাকবো।সত্যি ,সত্যি, সত্যি তিন সত্যি “।ঐ চাঁদকে সাক্ষী রেখেই চলে ওদের কতো না অঙ্গীকার ।

    বৃদ্ধাশ্রমে বসে মা বাবারা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবে,যে চাঁদকে জন্ম দিলাম, মানুষ করলাম সেই চাঁদই ঘুম কেড়ে নিল।রাত বাড়তে থাকে চাঁদেরও ঝিম আসে।ঘুম ঘুম চাঁদ প্রহর গোনে অপেক্ষা কিছু মিনিটের ।তারপর বিশ্রাম ।
    অবাঞ্ছিত মা বাবাদের বিশ্রাম নিতে নেই ,ভাবতেই হবে তাদের সন্তানের কথা।তাই নিজেদের অজান্তে ঘুম পাড়ানির গান গেয়ে ওঠে মায়েরা
    “ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি আমাদের আসল বাড়িতে এসো,
    আসার সময় আমার চাঁদের চোখের
    ঘুমটি নিয়ে এসো ”

    “খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে,
    মা বাবা তোদের জেগে আজও
    তোদের প্রাণের পরশ পেতে”

    তারপর আরও‌ রাত বাড়ে আস্তে আস্তে ঘুম ঘুম চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে যায়,
    রাতের শেষে ঘুমের দেশে বিশ্রাম
    নেয় চাঁদ,তারপর ভোর হয় শুরু হয় আমাদের জীবন সংগ্রাম,,দিনের শেষে ঘুমের দেশে

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- বেহালা টু বেনারস

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।। 

     

    বেহালা টু বেনারস
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    বেহালা টু বেনারস। এটাকি পাশের পাড়া, যাবো বললেই অমনি হুট ক`রে যাওয়া যায় ? সবেতে বাড়াবাড়ি ।
    ছেলে কুন্তলের মেজাজি মার্কা কথা শুনেও বিনয় বাবু বিনীত সুরে বললেন ,, আহা,,রাগ করছিস কেন ? এমন কিছু বিদেশবিভুঁই তো নয় । বেনারস। প্লেনে মাত্র কিছুক্ষণের ব্যাপার। ফস ক`রে চলে যাবো।
    টাকা একটু বেশি খরচ হবে , এ ই যা,, তা যাক। টাকা বড়কথা নয়। আসলে আমার আর তর সইছে না।
    শিগগির শিগগির যেতে হবে রে।
    নারায়নী দেবী এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন , এবার তিনি ঝলসে ওঠে বললেন,,, তর সইছে না , ফস ক`রে চলে যাবো,, আহা রে,, কী সখ,,
    খালি নিজেরটা বোঝে। আরও যে মানুষ আছে , তারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে সে দিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই ওনার।
    বিনয় বাবু বুঝলেন , টার্গেট তিনিই।
    তাই খানিকটা অবাক হয়েই বললেন,, মানে,, এ কথার মানে কী?
    নারায়নী দেবী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ছেলে কুন্তলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার নাকের কাছে তর্জনী তুলে তর্জন ক`রে বললেন,,, খবরদার যদি প্লেনের টিকিট কেটেছিস, দেখিস আমি কী করি। যাওয়া ঘুচিয়ে দেবো।
    বিনয় বাবুর অবাক হবার ঘোর কাটছে না। বললেন ,, আরে বাবা ব্যাপারটা কী ? প্লেনে কী হয়েছে ? অসুবিধে কী?
    নারায়নী আরও ক্ষেপে গিয়ে বললেন,,,,
    ন্যাকামি হচ্ছে ? যেন কিচ্ছুটি জানেনা । আমি হার্টের রুগী । ডাক্তার আমাকে নাগরদোলা চড়তে মানা করেছিল , মনে নেই?
    বিনয় বাবু চোখ কপালে তুলে বললেন ,,,
    বোঝো ঠ্যালা । তারপর নিজের কপালে চটাস ক`রে চাপর মেরে বললেন , কী সর্বনাশ,, নাগরদোলার সঙ্গে প্লেনের কী সম্পর্ক রে বাবা !
    নারায়নী ঘুসি পাকানো হাত তুখোড় বিপ্লবীর মতো আকাশে ছুঁড়ে বললেন,,, অবশ্যই সম্পর্ক আছে। ডাক্তার বলেছে নাগরদোলা চড়বেন না,,, এর মানে কী ?
    বিনয় বাবু ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখ গোলগোল ক`রে বললেন,,, কী ?
    নারায়নী দেবী দাপটে উত্তর দিলেন,,, মানে,, মাটি থেকে আকাশে , আকাশ থেকে মাটিতে ঘুরপাক খাওয়া যাবে না। নাগরদোলা চড়াও যা, প্লেনে চাপাও তা , একই। মাটি আকাশ , আকাশ মাটি । আমি নেই। আকাশে দম আটকে মরতে চাই না। যা হবার মাটিতে হোক। এই মাটিতে জনম আমার , যেন এই মাটিতেই মরি।
    বিনয় বাবু শুধরে দিতে উচ্চারণ করলেন ,,, ওটা মাটি নয়,, দেশ।
    নারায়নী হারবার পাত্রী নয় , বললেন,, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। দেশ। আরেবাবা দেশ আর মাটি একই। দেশের মাটি। দেশ মাটি , মাটি দেশ। বুঝেছ ?
    এবার হিটলার ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে বললেন ,,, দ্যাখো , বেশি চালাকি করবার দরকার নেই। খালি কথা ঘোরানোর ধান্দা ।
    তারপরেই ছেলের দিকে ঘুরে , তাকে সাক্ষী রাখার মতো ক`রে বললেন ,,, কুনু ( কুন্তলের ডাক নাম ) তুই বল , ডাক্তারের কথা অমান্য করা কি উচিৎ ? হার্টের ব্যাপার । কিছু কি বলা যায় , যদি একটা খারাপ কিছু হয়ে যায় ? তখন তোদেরই তো হ্যাপা পোহাতে হবে বল,,।
    হাসপাতাল,, ঘর,, হাসপাতাল,, ঘর,,, টাকার শ্রাদ্ধ , অশেষ ভোগান্তি ,,,,
    বিনয় বাবু আর বিনয় রাখতে পারলেন না। চিৎকার ক`রে বললেন ,,
    মূর্খতার একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিৎ । ডাক্তারের পরামর্শ । নিকুচি করেছে ডাক্তারের । ডাক্তার না ছাই। পরামর্শ তো তোমার হোমিওপ্যাথি হেঁপো মামার। উনি নাকি ডাক্তার ! দূর দূর,,, হোমিওপ্যাথি আবার ডাক্তার ।
    আগুনে ঘৃতাহুতি । রণং মূর্তি ।
    এই,, খবরদার বলেদিচ্ছি, মামা তুলে কথা বলবে না।
    ডাক্তার ইজ ডাক্তার । হোমিওপ্যাথি বলে হ্যালাফ্যালা করবেনা একদম।
    > একশোবার করবো । বেশ করবো। আমিও হাজারটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম গড়গড় করে বলে যেতে পারি। ডাক্তারি ফলাচ্ছে।
    বুড়িধারি মেয়েকে বলছে ,, নাগরদোলা চাপবে না , আইসক্রিম ছোঁবে না , ফুচকা খাবে না। ডাক্তার হয়েছে,, দূর দূর,, সামান্য একটুখানি সুগার বেড়ে গিয়েছিল সারাতে পারেনি ,, আবার বড়ো বড়ো কথা ।
    >সামান্য একটুখানি ? কি মিথ্যুক রে,,। দ্যাখ দ্যাখ কুনু,, তোর বাবা কিরকম মিথ্যেবাদী দ্যাখ একবার। চারশো পাঁচশো সুগার নাকি একটুখানি !
    এইবার মোক্ষম যুক্তির ঠ্যালায় , বিনয় বাবু চুপসে গিয়ে চুপ ক`রে গেলেন । সত্যিই তাই। দুবেলা ইনসুলিন নিতে হয়। খাওয়ার খুব ঝামেলা। এটা বাদ , সেটা বাদ। যাচ্ছেতাই জীবন। সবচেয়ে মুশকিল হলো , ডাক্তার যেগুলো খেতে বারন করেছে , সেই গুলোই বেশী ক`রে খেতে ইচ্ছে করে। অথচ উপায় নেই। নারায়নীর ত্রিনয়ন এড়িয়ে কিচ্ছুটি করার উপায় নেই । সর্বক্ষণ নজরদারি চালু আছে। আর সেই কারণেই স্ত্রী এখন স্বামীর চক্ষুশূল। অথচ তাকে ছাড়া চলে না। এ এক মহা গেড়ো। কাছে থাকলেও জ্বালা , না থাকলে মহাজ্বালা।
    কুনু,, আমি বলছি ,, এক্ষুনি যা, বেনারসের টিকিট নিয়ে আয় , প্লেনেই যাবো।
    বিদ্রোহিণী নারায়নী ঝংকার দিয়ে বললেন ,,
    কখনোই নয়। তুই ট্রেনের টিকিট নিয়ে আয়। সারারাত কুউউ ঝিক ঝিক ক`রে শুয়ে শুয়ে দুলতে দুলতে যাবো , আহঃ কী মজা ,, যা কুনু বেরিয়ে পড়। দেরী হয়ে গেলে টিকিট ফুরিয়ে যাবে বাবা। আর শোন ভালো কথা,, আজকের ট্রেন যদি না পাওয়া যায় , কালকের নিবি,, যা যা বেরিয়ে পড়,,।
    বিনয় বাবু শেষ চেষ্টা করার জন্যে বললেন,
    আমার কিন্তু কোমরে স্পন্ডালাইটিস আছে । সারারাতের ট্রেনের ঝাঁকুনি তে যদি ব্যাথা বেড়ে যায় , দেখাবো তখন মজা ।
    নারায়নী মুখ ভেংচে বললেন,,,,, ওরে আমার স্পন্ডালাইটিস রে। বয়সকালে অমন ব্যাথা সকলেরই হয়।ও জিনিস যাবার নয়। চিরসঙ্গী স্পন্ডালাইটিস ।
    __ কেন , তোমার ডাক্তার মামা কে বলোনা,, ঐ সর্বরোগ হরণকারী সাদা সাদা ঝাঁজালো গুলি গুলি মহৌষধি সাপ্লাই দিক।
    কুন্তলের এসব দেখা অভ্যেস আছে। সারাদিন , সারারাতেও এর মীমাংসা হবে না। তাই ঠান্ডা গলায় বললো৷,,
    তোমরা আগে নিজেদের মধ্যে ফয়সালা ক`রে নাও , কী করবে,,, তারপর আমাকে বোলো।
    কুন্তল চলে গেল।

    বিনয় বাবুদের একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রাণীর বিয়ে হয়েছে বেনারস এ। গতকাল রাতে জামাই ফোন ক`রে সুসংবাদটি দিয়েছে।
    ইনুর (ইন্দ্রাণীর আদুরে নাম ) মেয়ে হয়েছে । এইমাত্র।
    সেই সংবাদ শোনা মাত্রই বিনয় বাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন তিনি যাবেন বেনারস। নাতনীর মুখ দেখবেন। সুতরাং নারায়নীও গোঁ ধরলেন , তিনিও যাবেন।
    মেয়ের তিন মাসের গর্ভাবস্থায় গিয়েছিলেন। সেবার অবিশ্যি ছেলেও সঙ্গে ছিল। ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার অবস্থা ছিল অন্যরকম। হার্ট কিংবা সুগার নামক কোনও রোগ বালাই ছিলনা। হঠাৎই এই ছ মাসের ভেতর কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। মেয়েটার অতদূরে বিয়ে হবার কারণেই হয়তো। কি আর করা। ভালো মনমতো সুপাত্র পেলে , বাবা-মা এমন স্যাকরিফাইস তো করেই থাকেন। নতুন কথা কিছু নয়। তবু , মন মানে না। সেই পুরনো কথা মনে পড়ে। স্নেহ অতি বিষম বস্তু ।
    এ যাতনা মেয়ের বাবা মায়ের একান্ত পাওনা।

    জয় হলো তোমার ভোলা । কার সাধ্য তোমায় হারাবে।
    নাহ,,, এক্ষেত্রে ভোলার জয় হয়নি। বরঞ্চ উল্টোটাই হলো। জায়া র জয় জয়কার ।
    পরের দিনই রাতের ট্রেনে জায়গা পাওয়া গেল। তবে এ সি তে নয়। সেসব অনেক আগেই নো ভ্যাকান্সি হয়ে বসে আছে। অগত্যা সেকেন্ড ক্লাস।
    সেকেন্ড ক্লাস , থ্রি টায়ার । একটা আপার, একটা মিডল বার্থ।
    নারায়নী ব্যাজার মুখে বললেন ,,,
    হ্যাঁরে কুনু,,, এই নিচে একখানা পেলিনা, এতখানি ওপরে ওঠা , ওফঃ,, কী যন্ত্রণা বলো দেখি।
    এইতো ফাঁক পাওয়া গেছে। আরকি ছাড়া যায়। লোপ্পা ক্যাচ। বিনয় বাবু কথাটা টুক করে লুফে নিয়ে বললেন ,,
    এখন এসব কথা আসছে কেন ? আমার কথা তো তখন তেতো লেগেছিল , এবার কী মনেমনে আক্ষেপ হচ্ছে ? নাও, এবার গাছে চড়া প্রাকটিস করো।
    নারায়নী চুপ করে রইলেন বটে , কিন্তু তার চোখ মুখের চেহারায় অতৃপ্তির ছায়া স্পষ্ট ।

    কুন্তল বাবাকে ওপরে , আর মাকে মিডল সিটে শোবার পরামর্শ দিলো। বিনয় তৎক্ষনাৎ সেই প্রস্তাব খারিজ ক`রে বললেন,,
    অসম্ভব , আমি সুগার পেসেন্ট । বারবার উঠতে হয়। আমার লোয়ার হলেই ভালো হতো। যাক , হয়নি যখন , ঐ মিডিল দিয়েই চালিয়ে নেব।
    এবার ভোলার জয় হলো। অকাট্য যুক্তি। জজে মানবে। সুতরাং হাঁচড়পাঁচড় ক`রে নারায়নী মগডালে চড়ে গেলেন।
    চড়ে গেলেন নাকি চড়িয়ে দেওয়া হলো।
    কুন্তল বয়সের তুলনায় লম্বা বেশি। সিক্স ফুট প্লাস। সে মা কে খানিকটা বাস্কেট বল খেলায় ঝুরিতে বল ফেলে গোল করার ঢং-এ টং য়ে তুলে দিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,,
    সাবধানে নামিয়ে নিও। ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না। দেখো,, কেলেংকারী বাধিও না।
    বিনয় বাবু ছেলেকে আস্বস্ত ক`রে বললেন,,
    না না । চিন্তা নেই ।
    জামাই কে হোয়াটসঅ্যাপ ক`রে কোচ নাম্বার , সিট নাম্বার সব দিয়ে দিয়েছি। সেই এসে শাশুড়ি কে পাঁজাকোলা ক`রে নামিয়ে দেবে। কোনও চিন্তা নেই।
    ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। কুন্তল এ যাত্রায় যাবে না। ওর ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষা আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। ও ফিরে গেল। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

    মাঝরাত্তির হবে তখন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উর্ধশ্বাসে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। কামরার সাদা আলো গুলো সব নিভিয়ে দিয়ে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। নীল বাতির আবছা আলোয় কামরার এমাথা থেকে ওমাথা যেন মৃত্যুপুরী।
    আপার বাঙ্কে নারায়নী নাক ডাকছে। বিনয় বাবু মনে মনে গজরাচ্ছেন ,,, আশ্চর্য মহিলা যাহোক। এই দুলুনি খেতে খেতে কেমন নাক ডাকছে,,,
    ওফ্ফ বলিহারি যাই বটে,,।
    এই আক্ষেপের কারণ আছে।
    সব্বাই ঘুমোচ্ছে , শুধু ওনার চোখে ঘুম নেই । এই নিয়ে বার পাঁচেক মিডল বার্থ থেকে নেমেছেন আর উঠেছেন।
    ওনার সিটের নিচেই লোয়ার বার্থের যাত্রী ওনার এই বারংবার ওঠা নামায় যথেষ্ট বিরক্ত। তিনি আবার অবাঙালি। কিছুক্ষণ পরেই আবারও বিনয় বাবু নিচে নামলেন। এবার সেই অবাঙালি যাত্রী বিরক্ত স্বরে হিন্দি তে বললেন ,,,
    বারবার উপর নিচ কর রহে হেঁ আপ , কেয়া বাত হ্যায় জী। চ্যায়েন নেহি হ্যায় কা,,!
    বিনয় বাবুর হিন্দি তেমন আসেনা। তাই চ্যায়েন শব্দের অর্থ বুঝতে পারলেন না।
    তিনি সরল মনে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে পরিস্কার বাংলায় বললেন ,,,
    না না,, চেন তো আছে কিন্তু খুলছেনা।
    বিচ্ছিরি ভাবে আটকে গেছে । তারপর অনুনয় ক`রে বললেন ,,
    আপনি একটু হেল্প করতে পারেন ? আর যে পারছি না।
    ভদ্রলোক , জয় রামজি কী, ব`লে পাশ ফিরে শুলেন।
    হঠাৎ চোখ গেল ওপরে। নারায়নী উঠে বসে ড্যাবড্যাব ক`রে তাকিয়ে আছে। বিনয় বাবু অসহায় গলায় বললেন,,,
    এয়ারহস্টেস রা এব্যাপারে যথেষ্ট এক্সপার্ট।
    নারায়নী কোনও কথা না বলে গুটিগুটি ওপর থেকে নিচে নেমে আসার চেষ্টা করলেন। তাই দেখে বিনয় বাবু হা হা ক`রে বললেন,,,,,,
    আরে আরে করছো কী,,, পড়ে যাবে যে,,,
    কে কার কথা শোনে। নারায়নী তার জেদ বজায় রাখবেই। বিশেষ ক`রে ঐ এয়ারহস্টেস শোনার পরেই তার মাথায় আগুন জ্বলে গেছে । শয়তান ব্যাটাছেলে , সারাটা জীবন ধরে যার সেবা নিয়ে গেল , সে কিছু নয়,,,? বিমানসেবিকা ? বেইমান।
    যে ভয় করা হচ্ছিল ঠিক সেটাই ঘটে গেল এবার । নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে একেবারে গড়িয়ে গেলেন।
    বিনয় বাবু কোন রকমে দুহাত বাড়িয়ে জাপটে ধরতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। দুজনেই জরামরি করে ধরাস ক`রে মেঝেতে পরলেন।
    নারায়নী মা গোওও বলে আর্তনাদ করে উঠলেন। বিনয় বাবু হতবুদ্ধি হয়ে মেঝেতে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে অনুভব করলেন , তার শরীর থেকে গরম জলস্রোত বেরিয়ে এসে তার প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে ।

    সকালে বেনারস ষ্টেশনে জামাই বাবাজী এলেন বটে কিন্তু শাশুড়ী কে আর ওপর থেকে পেড়ে আনতে হলোনা । কেননা তিনি নিজে থেকেই খসে পরেছেন। আর খসে পরেছে নারায়নীর দুপাটি বাঁধানো দাঁত। সিটের নিচ থেকে অবিরাম হেসে চলেছে।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- “নেই কাজ তো খই ভাজ”

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

     

    “নেই কাজ তো খই ভাজ”
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    “নেই কাজ তো খই ভাজ “
    প্রবাদ বাক্যটি শুনে একটা বিষয় মাথায় ঢোকে না খই ভাজা কি কোন কাজের মধ্যে পড়ে না ?অকর্মণ্য গুলোই
    কি খই ভাজার দায়িত্ব নিয়েছে, জানি না বাপু!
    চিড়ে ভাজা, মুড়ি ভাজা, চাল ভাজা এগুলো কাজের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।খই সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি তাই বোধহয় খই ভাজাকে পরিশ্রমের আওতায় আনা হয়নি।
    সাধারণত
    হাতে কাজ না থাকলে মানুষ কি করে।বৌ ,ঝি ,পাড়ার কাকিমা জেঠিমা মাসীমা ঠাকুমা এনারা পিএনপিসি অর্থাৎ পর নিন্দা পরচর্চা করতেন ।না ,না রাগ করলে হবে না সবার কথা বলিনি কিন্তু।
    কেউ কেউ ঠাকুর দেবতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।তাহলে খই ভাজার কথা এলো কেন?
    ছেলেরা বা বয়োজ্যেষ্ঠরা হলে চায়ের দোকানে আড্ডা বা ক্লাবে আড্ডা দিতেন। না,না
    বড় ভুল‌ হয়ে গেছে তখন কি ক্লাব ছিল না কি,তখন মাঠ ঘাট ছিল, পথে ঘাটে বনে জঙ্গলে শৌচকর্ম করতে যেতেন আর নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন
    ।সেখানে তো খই ভাজার কোন প্রশ্নই আসত না ।এমন প্রবাদ প্রবচনও তো হতে পারতো “কাজ নেই তো ধম্ম কম্ম কর” বা “কাজ নেই তো সেলাই ফোড়াই কর” বা‌ “কাজ নেই তো রাজনীতি কর” ‌।এই
    রাজনীতি’র ব্যাপারটা ঠিক না,ছেড়েই দিলাম, রাজনীতির গভীরে প্রবেশ না করাই ভালো।আসল  কথায় আসা যাক
    গ্রামের মা ,বৌ ,ঝি’রা অন্ন সংস্থানের জন্য খই ভাজে।শুধু খই কেন মুড়ি, চিড়ে, চাল ভাজে।ওনাদের পরিশ্রমকে কুর্নিশ জানাতে হয় ।সবচেয়ে বড় কথা
    দই দিয়ে খই খেতে যে অসাধারণ লাগে তা কম বেশি সবাই জানি।তাই খই বা খাবার নিয়ে
    কোন রকম ব্যঙ্গ রসিকতা করা একদম ঠিক না।ধনীদের কাছে সবই হাস্যকর।খেটে খাওয়া মানুষ গুলো জানে খই ভাজতে গেলে আগুনের প্রয়োজন হয়।ইদানীং রান্নার গ্যাস সব জায়গায় পৌছেছে।কিন্তু কয়েক বছর আগেও জ্বালানীর জন্য কাঠ জোগাড় করা কতো কষ্টের ছিল ।
    বর্ষায় কাঠ ভিজে থাকতো।হাঁড়ি চড়তো না।মাটির দাওয়া বসে কপাল চাপড়াতো আর বৃষ্টি দেখতো অসহায় মা‌ ঠাকুমারা , ওনাদের চোখের জলের সাথে বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো।
    প্রত্যন্ত গ্রামে আজও জ্বালানি হিসেবে কাঠই ব্যাবহৃত হয়,
    আধুনিক যুগে এয়ারকন্ডিশন ঘরে বসে বলা যেতেই পারে ” নেই কাজ তো
    পপকর্ন ভাজ”।কিন্তু কে বলবে ? আমি আপনি না কি ‌নতুন প্রজন্মের কেউ ?
    ” নেই কাজ তো পপকর্ন ভাজ “
    খই ফোটার মতোই শব্দ হবে ফুটফাট।হাঁড়ি চড়বে ।ভাত ফোঁটার গন্ধ পেয়ে ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলো মাঠ থেকে ছুটে এসে বলবে,” মা ভাত খিদে পেয়েছে “
    দিন বদলাচ্ছে জীবন ধারণের গতি পাল্টাচ্ছে ।তাই খইয়ের বদলে প্রবাদ বাক্যে পপকর্ন যদি যুক্ত হয়।”নেই কাজ তো পপকর্ন ভাজ” । বেশ বড়লোক বড়লোক ব্যাপার শোনাবে তাই না।
    আর খইটা থাক আগের মতোই দই ,কলা, মিষ্টি দিয়ে খাওয়ার জন্য।আর সবশেষে প্রার্থনা করি প্রতিটি শিশুর মুখে যেন খইয়ের মতো বুলি ফোটে,বোবা শব্দটি চিরতরে মুছে যাক,চিরতরে,,,,,

  • রম্য রচনা

    রম্য- দর্পণে আত্মারাম

    দর্পণে আত্মারাম
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ করে ফিরেই, দাঁতে নিমপাতা কাটো, আগুনের তাপ নাও, লোহা স্পর্শ করে বিশুদ্ধ হও। জানাই তো আছে নিশ্চিত, অতৃপ্ত আত্মা ঘুরঘুর করছে এখনো, এখানেই আশপাশে। এইতো ছিল আপনজনের দেহ। ভালোবাসার আকুল প্রত্যাশায় মোড়া। তাহলে! সেই দেহস্থ আত্মা অতৃপ্ত, বোঝা গেলকীভাবে?
    এইতো কথার মতো কথা।
    আরে বাবা, নিজের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি চলে না। নিজের লোক। রক্তের সম্পর্ক। কোথায় ছিলে বাপধন? কাজ গুছিয়ে সরে পড়েছো। এখন রেড সিগনাল দপদপ করছে। অনুশোচনা?
    পাপী শরীর। জ্ঞানপাপী মন।
    কর্তব্যনিষ্ঠার পাঠ মুখস্থ, কন্ঠস্থ, মগজস্থ। শুধু পালনের অনীহা।
    জীবিতকে ভয় নেই। সে বাৎসল্য বোধে মৃয়মান। কিন্তু, মৃত ভয়ানক। জীবিতের লৌকিক। মৃতের অলৌকিক।
    ক্ষমতা বড়ো লোভনীয়। শুধু নিজের জন্যে। অন্যের ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। কর্তব্যপালন-ধর্ম, নিজের প্রতি। অন্যের প্রতি বর্জনীয়। অন্ধকার মনে সাপের বাসা। দেহ পুড়লেই স্মৃতি বিলুপ্ত নয়। দেনা পাওনার হিসেব, চুটকি মেরে নিকেশ হয়ে যায় না।
    অশৌচ দেহ, অশৌচ মন।
    ভেক ধরো, সাজো। নিখুঁত অভিনয়ে প্রমাণ করো তোমার কর্তব্যপরায়ণতা।
    মালসায় হবিস্যি রাঁধো। মুখ ব্যাজার করে ঘি মাখিয়ে আলো চাল সেদ্ধ ঢোঁক গিলে নাও। মাত্র তো ক’টা দিন। খোঁচা খোঁচা চুল দাড়ি, হাঁটু পযন্ত ট্যাঁং টাঁং করা জ্যালজেলে ধুতি, উত্তরীয়র, গলায় ঝুলোনো লোহার চাবি। বগলে কুশাসন। লোকাচার শেষ। তারপর..
    তন্ত্রধারকের দুর্বোধ্য দেবপুঁথি উচ্চারণকে আরও দুর্বোধ্য ক’রে হয়ে যাও শুচি শুদ্ধ।
    বিগ সাইজ পারশে মাছ সহযোগে সবান্ধবে সেরে ফ্যালো অন্তিম কর্ম।
    আহা.. উনি পারসে বড্ড ভালোবাসতেন। ব্যস। নিশ্চিন্দি। আর ভয় নেই। ভাবনা নেই। ঝাড়া হাত পা। আত্মা তৃপ্ত। পরমাত্মার জয়জয়কার কেত্তন। বুক ফুলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি।

    কোথাও কী কোনও ফাঁক রয়ে গেল? দ্যাখনদার লোকাচার কেরামতিতে? মন মোমবাতি বাতাসে দুলছে। সারারাত বিনিদ্র এপাশ ওপাশ।
    অর্ধাঙ্গিনীর শাস্ত্রসম্মত সাবধানী উপদেশ, বাৎসরিক কাজে পুষিয়ে দেওয়া যাবে ‘খন। গয়া কিংবা হরিদ্বার। একটু বেড়ানোও হয়ে যাবে। ঘুমোও দেখি। যথেষ্ট করেছো, আবার কী!

    মৃত বড়ো ভয়ংকর। জীবিত নিরীহ। বাৎসল্য বোধে টইটম্বুর।
    কোথায় যেন মন্দ বাতাস বইছে। কে যেন কু গাইছে। একটা খিকখিক তাচ্ছিল্য হাসির শব্দ। ফিসফিস করে, কানের পাশে পরিচিত কন্ঠ, শ্রদ্ধাহীন শ্রাদ্ধ- হায় রে গর্ভজাত আদরের সন্তান আমার, হায়..
    কে! কে? ও.. তু…মি.. বিশুদ্ধ আত্মা!

  • রম্য রচনা

    রম্য- মুখোমুখি

    মুখোমুখি
    -রীণা চ্যাটার্জী

    “দু’জনে মুখোমুখি কতো যে সুখী…” ধুর ধুর স্রেফ বাজে কথা। মুখোমুখি বসে সুখী! হয় না, হওয়া যায় না। আচ্ছা প্রথম মুখোমুখি বসার কথাই ধরি না হয়। সেই যে প্রথম দিন বসালো ঘেঁটি ধরে নাছোড় অভিভাবকরা পাত্রপক্ষের সামনে এনে, আড়চোখে দেখি বাবুমশায় মাথা নীচু করে ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে। বুঝলাম ষোলো আনার ইচ্ছেয় আঠেরো আনা লাগাম। বাবা- মায়ের বাধ্য সন্তান। ঠিক বুঝতে পারলাম না বশে রাখা যাবে, না কি বাধ্য সন্তান হয়েই থাকবে আজীবন। লাভ-ক্ষতি যাই হোক, জীবনে তো রিস্ক নিতেই হয়, দোনামনা করে আর একবার মুখোমুখি বসলাম- সোজা বিয়ের পিঁড়িতে। হাতে হাত- সম্প্রদানের মন্ত্র.. একবার তাকালোও না সামনে বসে থেকে। মনে মনে ভাবলাম, ধুর ছাতা কি ভীতু মাল রে বাবা! কিসের মুখোমুখি? কোথায় সুখ!
    হাল ছাড়লাম না, এরপর শুভদৃষ্টির সময় এলো, চোখ তুলে তাকালো এবার, একদম মুখোমুখি। বেশ একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। উঁহু, সুখ তো মালুম পেলাম না, আচ্ছন্ন ভাব কেমন যেন। একে কি সুখ বলে? কে জানে?
    আবার মুখোমুখি- পাশাপাশি সব কিছুই হলো কিন্তু সামনে যজ্ঞের আগুন, সিঁদুর দান। আগুনে ঝলসাবো না কি সুখ খুঁজবো? অটোর পেছনের লেখা তখন চোখের সামনে, ‘সুখ সপনে (স্বপ্নে) শান্তি শশ্মানে’- সুখ খুঁজেই পেলাম না, তো সুখী হওয়া!
    বাসর ঘর- এবার পাশাপাশি। চোখাচোখি হলো বার কয়েক। কিন্তু ওই যে বলে না শত্রু, বন্ধু’র মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। চোখাচোখি আমাদের হলেই ওদের গলায় খুশখুশে কাশি আসছে। কেন রে বাবা! এতো শত্রুতা কিসের তোদের বুঝলাম না! রাত কেটে গেল, ভোর হয়ে এলো। কোথায় সুখ?
    আবার একবার মুখোমুখি- একেবারে ফুলের আসরে। বেশ সুখী সুখী পরিবেশ। ভাবলাম দেখি যদি মুখোমুখি বসে সুখী হওয়া যায়। খুব বেশী অপেক্ষা করতে অবশ্য হলো না। আত্মীয়, বন্ধুদের সাথে প্রবেশ করলেন। ওনারা কিছুটা জ্ঞান ঝেরেই চলেছেন, আর আমি ভেবেই চলেছি কতোক্ষণে ফাঁকা হবে, আর মুখোমুখি বসা যাবে। স্ত্রী-আচার, বাক্য- বিলাপ, হাসি- মস্করা সেরে অনিচ্ছুক পায়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন সবাই। যাক বাবা বাঁচা গেল। উনি দরজা বন্ধ করছেন। আমি মনে মনে একদম প্রস্তুত হয়ে বসলাম, মনে বড়ো আশা। এবার দু’জনে শুধু মুখোমুখি.. সুখ ধরা দেবেই, পালাবার আর পথ পাবে না।
    কি আর বলি, মুখোমুখি বসলেন- ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে ফিসফিস আওয়াজ কানে এলো। এখানেও শত্রুতা! আড়ি পাতছে বোধহয় এতোক্ষণ যাঁরা ঘরে জ্বালাছিলেন তাঁরা। উনি উঠলেন.. খুব সন্তর্পণে আলোটা নিভিয়ে দিলেন। মুখোমুখি বসা? অন্ধকারে? নাহ্, সে গুড়ে বালি। বসা হলো না, তো সুখী হওয়া!
    মুখোমুখি বসার ইচ্ছেটা মরে নি, তখনো মনে গেঁথে আছে। সুখী হওয়ার আশা কেই বা ছাড়তে পারে! তাই আমিও আশা ছাড়ি নি, চেষ্টাও করলাম বিয়ের পরে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি বসার। আনাচ- কানাচে, আড়ালে- আবডালে, কিন্তু বিধি বাম। ছেলের ওপর মায়ের যা সতর্ক, কড়া দৃষ্টি! কোনোরকমে মুখোমুখি হলেই মিছরির ছুড়ি ঠিক কেটে দেবে সুখের জাল। সুখ কোথায়?
    এরপর তো প্রয়োজনে জীবনে অনেকবার মুখোমুখি বসা হলো। কিন্তু সুখ? যতোবারই বসলাম দেখি একটা একটা বিপত্তি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া- মুখোমুখি হিসাবে বসা কি করলে ভালো হয়। বলা বাহুল্য মতের মিল হয়নি। উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। চুম্বকের রীতি মেনে দুই মেরুর আকর্ষণে সংসারে জুড়ে থাকা। সুখ কোথায়?
    মেয়ের বিয়ে- আবার মুখোমুখি। বাজেট.. চিন্তা। সবার অলক্ষ্যে চোখে চোখে ইশারা, উদ্বেগ সব যেন ঠিক করে মিটে যায়, ভুল ত্রুটি না থাকে। মান- সম্ভ্রম, দায়- দায়িত্ব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তখন দুই জোড়া চোখের দৃষ্টির মিলনে। সব কিছু ভালোভাবে মেটানোর জন্য কতোবার মুখোমুখি বসা হলো উৎকণ্ঠা আর মন খারাপের গল্প নিয়ে। কিন্তু সুখ কোথায়?
    আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, এখন আর মুখোমুখি বসার উপায় নেই, সম্ভবও নয়। ঘরে ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি। মনের ইচ্ছে মনেই থেকে গেল মনে হয় এই জীবনে- জলাঞ্জলি দিয়ে দিলাম একরকম মুখোমুখি বসার ইচ্ছেটাকে।
    আজ সকাল থেকে সব কিছু অন্যরকম লাগছে। অনেকগুলো মুখের ভিড় আমার চারপাশে। আরে এ কি দেখি? যার সাথে সারাজীবন মুখোমুখি বসার স্বপ্ন দেখলাম- সুখ খূঁজবো বলে সে যে একদম মুখোমুখি বসে আছে। কিন্তু অমন ভাবে তাকিয়ে কেন? চোখের কোনে জল যেন মনে হচ্ছে! কেন? কিন্তু মুখোমুখি বসেও সুখ মালুম হচ্ছে না কেন? অনেকক্ষণ এইভাবে যখন কেটে গেল, শুনি আশেপাশে সবাই বলছে এবার বডি নিয়ে গেলে ভালো হয়, অনেকক্ষণ তো হলো। বুঝতে পারলাম, আর মানুষ নেই, বডি হয়ে গেছি। কি হলো? কি যেন পড়লো! দেখি, দু’ ফোঁটা তপ্ত অশ্রু পড়লো আমার হিম ঠাণ্ডা কপালে। একটা অদ্ভুত অনুভুতি হলো, কেঁপে উঠলো সমস্ত অন্তর আত্মা, দুলে উঠলো পৃথিবী… আমার মুখোমুখি বসে আমার জন্য চোখে জল! অতৃপ্ত মন মুখোমুখি বসার তৃপ্তির সাধে গুনগুন করে উঠলো, ‘দু’জনে মুখোমুখি কত যে সুখী.. ফুরাবে সব হাসি ক্রন্দনে, এতো ভাবতেও পারি….” ভাবার আর অবকাশ দিলো কোথায় সময়… মানুষের জন্য সময় থাকে না, এখন তো বডি.. কত আর সময় থাকে? ভাবার সময় নেই, ভাবতে দেবার সময় নেই।

    পরিচিত, প্রিয় মুখটা আস্তে আস্তে সামনে থাকে সরে যাচ্ছে, শুনতে পেলাম কোরাসের, ‘বলো হরি, হরিইই বলল….

  • রম্য রচনা

    রম্য- সাঁড়াশী জিন্দাবাদ

    সাঁড়াশী জিন্দাবাদ
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    গঙ্গা সাগর মেলায় লাখো সাধুবাবা হাজির। হাজির লাখো লাখো পুণ্যার্থী। মানুষের চাওয়ারও শেষ নেই দুঃখেরও শেষ নেই। শেষমেশ ভরসা সাধুবাবা।
    মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা সাধুবেশী সাধকের পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ কান্না।
    বাবা এই বয়সে স্বামী আমার অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে, আমাকে দুরছাই করছে বাবা, আমি কী নিয়ে বাঁঁচবো বাবা।
    বাবা গাঁজার ছিলিমে সুখটান দিয়ে বললো, আরে দুর বেটি। ভয় কী। সাহস কর। রুখে দাঁড়া। মনকে সাঁড়াশী কর। কামড়ে ধর। সাঁড়াশীর কাছে সবাই জব্দ।

    সাঁড়াশী। কেন জানিনা, খুব কম বয়স থেকেই এই যন্ত্রটির প্রতি আমার বিশ্বাস আস্থা প্রগাঢ়। অনেক সময় একে আমার অস্ত্র বলে মনে হয়।
    সাঁড়াশী আক্রমণ। অর্থাৎ এমন ভাবে সজোরে চেপে ধর, যা ছাড়িয়ে পালানো প্রায় অসম্ভব। সাঁড়াশী জেরায় জেরবার হয়ে আচ্ছা আচ্ছা প্রভাবশালীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছে দুঁদে উকিল। কিন্তু, দেখলে মনে হবে, ওটা নিতান্তই সাদামাটা একটা রান্নাঘরের আর পাঁচটা সাধারণ রান্নাবান্নার সাহায্যকারী একটি বস্তু। কিন্তু কী সাংঘাতিক এর ক্ষমতার বহর, না না শুধু ক্ষমতার কেন, নামের মাহাত্ম্য, সেকি কম?
    আমার তো মনে হয় নামের মস্তানিতে সাঁড়াশী সেরা। কেননা শক্তপোক্তর কথায় যদি আসা যায়, তাহলে তো রান্নাঘরের হামানদিস্তে, শিলনোড়া, তারা-ও কম যায় না। কিন্তু সাঁড়াশীর কাছে ওদের কেমন যেন ম্রিয়মাণ মনে হয়। মনে রাখতে হবে, কুটিরশিল্প কারখানার ( পড়ুন রান্নাঘর ) সেরা যন্তর সাঁড়াশী।

    একজন প্রৌঢ়া মহিলা, সামান্য মানসিক ভারসাম্যহীন। পাড়ার দুষ্টু ছেলেপিলের দল দেখতে পেলেই চিৎকার করে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, সাঁড়াশী.. ব্যাস, আর যায় কোথায়। মহিলা মুখে যা আসতো তাই বলে গালমন্দ করতো। ছেলেরাও প্রৌঢ়ার ক্ষাপামি দেখে ভারি মজা পেত। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে বারবার উচ্চারণ করতো, সাঁড়াশী..সাঁড়াশী.. প্রৌঢ়ার মেজাজ আর কন্ঠস্বর আকাশ বিদীর্ণ করতো, কিন্তু মজা পাওয়া কিশোরগুলোর মন হয়তো বা পাথর দিয়ে গড়া, অথবা সাঁড়াশী শব্দের এমন মজাদার মাহাত্ম্য গুণ তাদের এমন পাগল করে তুলতো, যেখানে হৃদয় নামক বস্তুটি কিছুমাত্র নরম হতে পারতো না।
    এই গেল নাম মাহাত্ম্য।

    সাঁড়াশী হৃদয় লোক, আরও ভয়ংকর। অনেকটা বাংলা সিনেমার কমল মিত্র টাইপ। ধরলে আর রেহাই নেই। তা সে উত্তম কুমারই হোক কিংবা সুচিত্রা সেন।
    “নিজে রোজকার ক’রে তারপর বড়ো বড়ো কথা বললে ভালো হয় না কী?” ব্যাস, হয়ে গেল। এইকথা শোনার পর কোন লায়েক ছেলে-মেয়ে নিজের মান খুইয়ে বাপের কাছে থাকবে? চললো তারা আজন্মের আস্তানার মায়া কাটিয়ে কেরিয়ার গড়ার পথে। চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট।
    এককথার ধাক্কায় বাড়ি থেকে দূর করে দিতে একটুও দয়া মায়ার ধার ধারত না। বেড়িয়ে যাও মানে, বেড়িয়ে যাও। এ কথার আর নড়চড় হবে না। ওদিকে স্ত্রী কেঁদে ভাসাচ্ছে। যতই হোক মায়ের প্রাণ। ডুকরে কেঁদে বলছে, ওগো একি করলে, ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
    সাঁড়াশী হৃদয় বাপের কোনও হেলদোল নেই। নাইটগ্রাউন গায়ে চাপিয়ে ফুরফুরে চুরোট দাঁতে চেপে, ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ভাব খানা এমন, যেন কিছুই হয়নি। হতে পারে না। আর হলো তো ভারি বয়েই গেল। একটা বেপরোয়া হিটলারি মনোভাব। আমার কথাই শেষ কথা। ফাইনাল সিদ্ধান্ত। কেউ নাক গলাতে এসো না। লাভ হবে না। ইয়ে বাত নেহি, সাঁড়াশী কা ফান্দা হ্যায়।

    সাঁড়াশীর কাজ, শক্ত করে চেপে ধরা। দারুণ শক্ত। নির্দয়তার চরম নিদর্শন। সাঁড়াশী আলগা হয়ে গেলেই, ধপাস।
    পপাত ধরণী তল। ছত্রাখান হয়ে চিত্তির।

    কলেজে পড়া ছেলে। পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী নয়, যতটা বন্ধুবান্ধব, ফুর্তি আর অপ্রয়োজনীয় এদিক ওদিকে উড়ুক্কু মন। এককথায় পয়সাওয়ালা বাপের কু-পুত্তুর। সেদিন সারারাত বাড়ি ফিরলো না। মা কেঁদেকেটে একসা।
    ওগো ছেলেটা আমার কোথায় গেল? এমন তো কখনও হয় না। যত রাতই হোক বাছা আমার বাড়ির বাইরে ক্কখনো রাত কাটায় না।
    একি হলো গো?
    ছেলের ছাইপাঁশ গিলে বাড়ি ফেরার কথাটা এখানে উহ্য রইলো।
    বাপ কিন্তু চুপচাপ। খানিক পরে একটি কথাই উচ্চারণ করলো, চিন্তার কিচ্ছু নেই, সকাল হলেই ঠিক ফিরে আসবে। যাবে কোথায়, যাবার কি কোনও জায়গা আছে? তোমার বেয়াক্কেলে আদরে সে জাহান্নামে গেছে।
    গর্ভধারিণী অশ্রুসিক্ত হয়ে অনুযোগ করলো, তুমি কি পাষাণ ?
    সাঁড়াশী হৃদয় বাপ নির্লিপ্ত মেজাজে চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশে তারা দেখলেন। কিছু গুনগুন করে সুর ভাঁজলেন না।

    পরদিন সকালেও, ছেলে এলো না। এলো একটা ফোন৷ ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, এখনই দশ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে রাখুন।
    ফোনটা বাবা ধরে ছিলেন। কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, দশ লাখ কেন, একটি পয়সাও পাবে না। কুলাঙ্গারটা তোমাদের কাছেই যতদিন পারে থাক। রাখতে না পারলে ফেরত পাঠিও। যদিও ওকে ফেরত নেবার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।
    ফোন কেটে গেল না। ওপ্রান্তের সব কথাই ভেসে আসছিলো, অচেনা কন্ঠ, কী সাংঘাতিক বাপ মাইরি তোর। মিলিটারি! তোর সব প্ল্যান খতম। নকলি কিডন্যাপ নাটক ফিনিশ। এবার যা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা।
    এবার ছেলের সুমধুর বাণী, শালা, বাপ তো নয়, সাঁড়াশী। কেবল চিমটি কেটে ধরতে পারে, ওফঃ।
    এবার ফোন কেটে গেল। বাপ আবারও চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, হতচ্ছাড়া…

    আলগা দিলেই হাতছাড়া। ওহে কড়াই বাছাধন, সাঁড়াশীকে গরম দেখিও না। যত গরমই হও সাঁড়াশী কান ধরে নামিয়ে আনবে। বুঝতে পেরেছো? জোরসে ধরো হেঁইও। এ-যুগে সাঁড়াশীই শেষ কথা। মোক্ষম দাওয়াই। সুতরাং, সেই সাধুবাবার জুতসই নিদান ।
    মনকে সাঁড়াশী করো। কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। যুগের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হলে, টিঁকে থাকতে হলে, বলো, সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।
    সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।।

You cannot copy content of this page