রম্য রচনা

  • রম্য রচনা

    রম্য- শেষ সাক্ষাৎকার

    শেষ সাক্ষাৎকার
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    দাশরথি দাশ আজ দুপুরে দেহ রাখলেন। বাহাত্তুরে বুড়োর জীবনাবসান। বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যাথা। শ্বাসকষ্ট। নিমেষে নিঃশব্দে এপার থেকে ওপার।
    নো হসপিটাল। নো নার্সিংহোম। নো সন্দেহজনক বাড়তি বিল। নো বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রাণান্তকর নরকযন্ত্রণা।
    আহা, কী চমৎকার শান্তিময় মৃত্যু। ওগো, সকলেরই কেন এমন করে মরণ আসে না?
    আবদার বোঝো…
    না, আসবে না। মরণের ধরন দেখে বোঝা যায়, মানুষটি কেমন ছিল। ভালো নাকি বজ্জতের একশেষ।

    পাড়া প্রতিবেশী আর গুটিকয়েক পরিচিত লোক, কাঁচ ঘেরা গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। নির্বিবাদী, ভাল মানুষের শেষ বিদায়। রোববারের ক্ষণিকের বৃষ্টি ভেজা গোধূলি বেলায়, সকলেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, মুখের এক্সপ্রেশনে যেন নিদারুন করুণ ভাব বজায় থাকে। কেননা এইটাই রেওয়াজ। তাছাড়া, যেকোনো মৃত্যুই দুঃখের, এইটুকু আপ্তবাক্য ছাড়া, দুঃখের আর কোনও কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, কারোর পক্ষেই।
    সুতরাং মিনিট দশেকের দুঃখী অভিবক্তি চালিয়ে যাওয়া এমনকি কঠিন কর্ম।
    এ দুনিয়ায় কেইবা কার খবর রাখে। সবই স্বার্থের সম্পর্ক। সম্পর্ক হলো স্বল্প আয়ুর ভেজাল নাটিকা।
    যতক্ষণ প্রয়োজন, ততক্ষণ কাছে থাকা, খবরাখবর নেওয়া। আদিখ্যেতার জয়জয়ন্তী। প্রয়োজন মিটে গেলেই সটকে গিয়ে ভুলে যাওয়া।
    আচ্ছা, সত্যিই কী কেউ ভুলে যায় ! নাকি প্রয়োজন ফুরোলে দূরে সরে যায় ইচ্ছাকৃত ভাবে, নানান ছলে, বাহানায়, শুধুমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চিত কারণে?
    এই বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে পি এইচ ডি করা চলে।

    দাশরথি বাবু বিপত্নীক। বছর দুয়েক আগে মিনতি দেবী ক্যান্সারে ভুগে চলে গেছেন। সন্তানাদি নেই। মানে, হয়নি। তেমন কোনও আত্মীয় পরিজনও নেই। সেই দিক থেকে বলতে গেলে, দাশুবাবু ভাগ্যবান।
    আত্মীয়ের মতো অবিশ্বাসী, পরশ্রীকাতর, হিংসুটে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর সন্তান? বিয়ে করার আগে আর বিয়ে করার পরে। আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরী হবে। সে পুত্রই হোক কিংবা কন্যা। তবে সবাই নিশ্চয় একইরকম নয়। সব জলাশয় এঁদো পুকুর নয়। কিন্তু গ্যারান্টি দেবার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই।
    বাজার থেকে দেখে শুনে বাছাই করে আম কিনে এনে, খাবার সময় সেটা দড়কচা বেরুলো। যাক,
    থাকার মধ্যে আছে এক শালা অর্থাৎ শ্যালক। শ্যামল সূর।
    “মহাপ্রস্থানের পথে” লেখা কাঁচ ঢাকা, রজনীগন্ধা ফুল আর চন্দন গন্ধ যুক্ত ধূপকাঠি জ্বালানো গাড়ি যখন, শ্মশানের দিকে গড়িয়ে গেল, একটুও অশ্রুপাত কোথাও ঘটলো না। শুধু দীর্ঘশ্বাস মেশানো একটি কন্ঠস্বর শোনা গেল, আহা, বড় পুণ্যবান মানুষ ছিলেন। একটুও কষ্ট পেলেন না। কাউকে কষ্ট দিলেনও না। কেমন নিঃশব্দে নীরবে চলে গেলেন। একেই বলে ভাগ্যবান মানুষ। হায় রে, আমাদের কপালে কী লেখা আছে কে জানে! আবারও দীর্ঘশ্বাস।
    এবারেরটা আরও বড় এবং গভীর। সম্ভবত সে বেচারি অনুমান করতে পেরেছে, শেষের সেদিন বড় ভয়ঙ্কর।

    শ্মশান যাত্রী মাত্র একজনই। শ্যালক, শ্যামল সূর।
    তাতে অবিশ্যি অসুবিধের কিছু নেই। কেননা, সেই প্রাচীন হরিধ্বনি দেওয়া, কিংবা মুঠো মুঠো খই ছড়ানো কেস বিদায় নিয়েছে। বাঁচা গেছে। যা দিনকাল আসছে, এবার হয়তো ভার্চুয়াল শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা হবে।

    শ্মশানের যাবতীয় নিয়মাবলি শেষ করে, জামাইবাবুর মরদেহ, আধুনিক চুল্লীতে ঢুকিয়ে দিয়ে শ্যামল এসে বসলো শ্মশানের পাশেই নিরিবিলি গঙ্গা ঘাটের সিঁড়িতে।
    সামনে পবিত্র গঙ্গা, পিছনে অন্তিম গন্তব্য শ্মশান, মাঝখানে মানুষ। আহা, কী অসাধারণ কম্বিনেশন। এইতো জীবনের বাস্তব চিত্র।

    ঘড়িতে এখন রাত আটটা বেজে গেছে। কাজ সম্পূর্ণ করতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
    জায়গাটা কেমন যেন আলো আঁধারি মতন। একটা গা ছমছম ভাব। অবিশ্যি এটাই যে কোনো শ্মশানের চিরাচরিত আবহাওয়া।
    কেমন যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শরৎকাল। এমনই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পরক্ষণেই যেটা ঘটলো, সেটা কিছুতেই স্বাভাবিক নয়।
    শ্যামলের পাশে একটি লোক এসে বসলো। তাকে দেখেই চমকে উঠে অস্ফুট গলায় বললো,
    একি আপনি, মানে আপনি কী করে ? দাশুদা!
    হ্যাঁ, জামাই বাবুকে দাশুদা বলেই ডাকতো শ্যামল।
    দাশুবাবু চিরাচরিত অমাইক হাসিতে গাল ভরিয়ে বললেন, এলুম.. দেখলুম একা-একা বসে রয়েছো তাই..
    শ্যামলের এখনো ঘোর কাটেনি। কাঁপা গলায় অবিশ্বাসির দৃষ্টি নিয়ে বললো, কিন্তু..কিন্তু, আপনি তো এখন..
    হ্যাঁ, পুড়ছি। আধুনিক চুল্লীর ভেতর রগরগে আগুনে পুড়ছি। ভুল বললুম। পুড়ছে। আমার খোলসটা। আমি এখন এখানে, তোমার পাশে।
    বাঁচা আর মরার মধ্যে এইটুকুই ফারাক। বেঁচে থাকলে দেহ আর আত্মার একত্র বাস। মরে গেলে দেহ আর আত্মার বিচ্ছেদ। এখন আমি বিদেহী।
    শ্যামল হতবিহ্বল হয়ে শুনছে, তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
    দাশুবাবু শ্যামলের চোখ মুখের অবস্থা দেখে আবারও হেসে বললেন, ওহে শালাবাবু, ঘোর কাটাও, স্বাভাবিক হও।
    এতই সহজ! স্বাভাবিক হও। কী করে হবো শুনি। এতদিনের ধারণা, বিশ্বাস, অবলীলায় ধুয়ে মুছে ফেলা যায়? ইয়ার্কি নাকি, ফাজলামো হচ্ছে?
    এই মশাই সত্যি করে বলুন তো কে আপনি? কেন মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছেন, কী মতলব?
    শ্যামলের গলায় মোটামুটি তেজ ছিল, তবুও কুন্ঠিত। ইদানিং কালের বাঙালি স্বভাবের মতো। ঘরে বাঘ, বাইরে নেংটি ইঁদুর।
    দাশুবাবু আবার হাসলেন। মুচকি হাসি। কেমন যেন কবি কবি হাসি। হাসি অথচ হাসি নয়। যেন ভাবের ঘোর।
    সেই এক কবি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। বললুম, ভাই চা খাবে একটু, চলো। কবি বন্ধু আমার উদাস কন্ঠে ওই রকম হেসে বললো, চা? ও..চা, মানে খেলেও হয়, না খেলেও হয়।
    যাইহোক, দাশুবাবু বললেন দ্যাখো শালা বাবু। তুমিই আমার অন্তিমকালের একমাত্র শেষ সঙ্গী।
    তাই আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব তোমর নামে উইল করে দিয়েছি। সেই সবকিছুর এখন তুমিই মালিক।
    শ্যামল মনে মনে বললো, দুর মশাই, আমাকে ছাড়া আর কাকেই বা দিতেন। ত্রিভুবনে আছে কে আপনার?
    এই হলো মানুষের মন। কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। কেবল সৌজন্যের চাটুকারিতা আছে।
    তাই মুখে বললো, আমি তো আপনাকে বারণ করে ছিলাম দাশুদা। আমি কী ওসবের মর্যাদা দিতে পারবো। কোনও ভালো আশ্রম কিংবা মঠে দান করে দিলেই ভালো হতো।
    দাশুবাবুর ঠোঁটে আবারও সেই হাসি। বললেন, বেশ তো। তোমার যদি তাই মনে হয়, করবে। সে সুযোগ তো তোমার হাতে রইলোই।

    পথের মাঝে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট, বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে প্রজাপতির ডানার মতো পিরপির করে নড়ছে। পড়বি তো পড় ন্যাপার চোখে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। এদিক সেদিক আড়চোখে দেখে নিয়েই সটান পকেটে চালান। তারপরেই সদগতি।
    হালকা করে চুল্লু মেরে, খানিকটা মাংস কিনে, বউয়ের সামনে ফেলে দিলো, ঝপাৎ। বউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ সব নিয়ে এলে, টাকা পেলে কোথায়?
    ন্যাপা দুলকি চালে বডি নাচিয়ে বললো, ভগবান দিয়েছে। যাও, মালটা কষে রাঁধো দেখি।
    এই হলো পোড়ে পাওয়া ষোলো আনা।
    পেলে ছাড়াছাড়ির কোনও সিন নেই। ভোগ করো , আয়েস করো। পরের ধনে পোদ্দারি করো। কিন্তু মুখে সাধু-সন্ত বুলি আওড়াও। ফোকটায় বাণী বিতরণ করো।
    তবেই তো তুমি মনুষ্য পদবাচ্য। সম্মানীয় জ্ঞানী। পাড়ার ক্লাবের নিষ্কর্মা সভাপতি।

    শ্যামল এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। জ্ঞানী মানুষের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ঠিকই বলেছেন। কী হবে এসব? সবই অনিত্য। এই আছে, এই নেই। খালি হাতে আসা, খালি হাতে যাওয়া। একটা দীর্ঘশ্বাস।
    দাশুবাবু আআড়চোখে, এক আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে শ্যামলের মুখের দিকে। ঠোঁটে সেই মায়াবী কবি কবি হাসি। তারপরেই আচমকা ধমকে উঠলেন, দূর শালা। মানে শালাবাবু, এসব বাজে কথা। আমি বলছি শোনো, লোটা নিয়ে আসা, কম্বল বগলে যাওয়া। লোটা কম্বল নাতিদীর্ঘ জীবন।
    শ্যামলের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী? মাথায় কিচ্ছু ঢুকলো না, তাই না? আরে বাবা অভিজ্ঞতা। এতো বচ্ছর যেখানে ছিলুম, সেইখান থেকেই অর্জন করা অমূল্য অভিজ্ঞতা।
    লোটা মানে পেট, মানে খিদে। ভোগ, লালসা, কামনার খিদে নিয়ে এসেছিলুম। আর অছেদ্দা, লাঞ্চনা, অপ্রাপ্তির ক্ষেদ দিয়ে বোনা কম্বল বগলে, করুণ সুরে ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে নিষ্ঠুর প্রস্থান। হা হা হা..
    মন চলো নিজ নিকেতনে। কী হলো, মাথায় ঢুকেছে এবার?
    শ্যামলের পিঠে জোরে জোরে দু’টো চাপড় মেরে, আকাশ কাঁপিয়ে হা হা হা করে হাসতে হাসতে হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেলেন দাশরথি দাশ।

    শ্যামল চোখ খুলে দেখলো, সামনে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। বাবু কী ঘুমিয়ে গেলেন? কাম তো সারা হো গিয়া বাবু। ও ছাই ভসম জোলে দিবেন তো?
    আসুন আসুন, বহৎ দের লাগিয়ে গেলো, জলদি আসুন বাবু।
    শ্যামল বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, মনে মনে উচ্চারণ করলো, ঠিক বলেছ ভাই এক্কেবারে ঠিক বলেছ। দেরি হয়ে গেল, বড্ড দেরি।

  • রম্য রচনা

    রম্য- শাঁখের করাত

    শাঁখের করাত
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    হরিহর গোঁসাই প্রায় প্রতিদিনই হরিসংকীর্তন শুনতে যান মঠে। সেদিনও গেছেন, শুনছেন হরিনাম। কিন্তু আজকে যেন কিছুতেই মন বসছে না। উসখুস করছেন। বারবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। চোখে মুখে ভক্তি ভাবের বদলে উৎকন্ঠা ভাব।
    পাশে বসে থাকা এক ভক্ত, আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ও হরিদা ব্যাপার কী? আজ তোমাকে বড্ড অমনোযোগী দেখছি। বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছো, কারুর কী আসবার কথা আছে নাকি?
    হরিদা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, না গো ভাইটি। বাইরে নতুন জুতোজোড়া ছেড়ে রেখে এসেছি কিনা, যদি চুরি হয়ে যায়?
    আমি চলি ভাই। কালকে সেই পুরনো ছেঁড়া চটি পড়েই আসবো।
    হরিবোল.. হরিবোল,
    সেই রামপ্রসাদের গান খানা মনে আছে?
    ‘সংসার ধর্ম বড়ো ধর্ম মা
    তাই পারিনে ছেড়ে যেতে।’

    জীবন কাটলো সংসারের দায় সামলাতে। শেষ বয়সে এসে, শেষ পাড়ানির কড়ি যোগারের মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু অভ্যেস পিছু ছাড়বে কেন?
    অভ্যেস হলো পোষা বেড়াল। তিতিবিরক্ত হয়ে দূরে ছেড়ে দিয়ে এলেও, ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে ফেরৎ আসবে।
    সংসার জাল হলো মায়া সুতোয় বোনা। অভিমন্যুর চক্রবুহ্যে এনট্রি আছে এক্সজিট নেই।

    আসল কথা মন। যে রঙে রাঙাবে, মনে সেই রঙ ধরবে। সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এলেই মন কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে ওঠে। কামনা বাসনাগুলো কিচ্ছুক্ষণের জন্য হলেও নির্বাসনে যায়। বৈরাগী হতে চায় মন।
    মনে হয় এইতো প্রকৃত জীবন চেতনা। বৈভব ঐশ্বর্য সঞ্চয়, সুখ দিতে পারলো কৈ? শান্তি?
    চল মন বৈরাগী হই।
    আহা রে, যেন কতই সহজ। চল, লগা দিয়ে চাঁদ পেড়ে আনি গোছের ব্যাপার। যেন শিশুর হাতের চুষিকাটি।
    ঠাকুর বলেছিলেন, সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছ হয়ে। মাঝেমধ্যে সাধুসঙ্গ করবি। কিন্তু সাধু পাই কোথায়! ভন্ড আর ধর্ম বেচা কারবারি গিজগিজ করছে।
    গন্ধমাদন পর্বতের বুকে হাজারো আগাছার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে প্রাণদায়ী বিশল্যকরণী? চিনব কীভাবে, কে চিনিয়ে দেবে?

    উত্তরাখন্ডের কেদারনাথ মন্দিরের কিছুটা দূরে, এক নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে, আচমকাই সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এক যোগী পুরুষের।
    তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি এখানে মানে কেদারনাথ মন্দিরে কেন এসেছি। বলেছিলাম, দর্শন করতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
    উনি বলেছিলেন, আজ এখানে আসা কত সহজ। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এখানে আসতে অনেক কষ্ট, ক্লেশ স্বীকার করতে হতো। রাস্তা ছিল না। পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে, হিংস্র জন্তুর নজর এড়িয়ে, দিনের পর দিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থেকে পায়ে হেঁটে এখানে যারা শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারতেন, তারা ছিলেন নিরাসক্ত যথার্থই ভক্ত। দেবতার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতেই আসতেন তারা।
    সেসময় এখানে না ছিল ঠিকঠাক থাকার আশ্রয়, কিংবা ভোজনের ব্যবস্থা।
    পরোয়াই করতেন না তারা সেইসব বাধা। তাদের মুখে আর অন্তরে ছিল একটাই নাম,,,
    জয় শিবশম্ভু, জয় কেদারনাথ, জয় ভোলে নাথ।
    এই হলো বিশ্বাস। ভক্তি। পূজা নিবেদন।
    সেই তাদের সঙ্গে তোমাদের এখানেই পার্থক্য। তোমরা এসেছো প্রমোদ ভ্রমণে। অন্যরকম পরিবেশে ছুটি কাটাতে। একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেতে। হাওয়া বদল করতে।
    হিমালয়ের অতুল সৌন্দর্যের অপরূপ মায়াবী পরিবেশে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল সন্ধ্যার আঁধার। মন্দির থেকে ভেসে আসছিল মৃদু ঘন্টার ধ্বনি, আর নাম না জানা পাহাড়ি রাতজাগা পোকা পতঙ্গের রহস্যময় ডাক।
    জটাজুট ধারী প্রায় উলঙ্গ যোগী চলে গেলেন গুহাভ্যন্তরে। দেনাপাওনা, প্রত্যাশা, ভোগবাসনা হীন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। যেখানে ভোগবাদীদের কঠোর ভাবে প্রবেশ নিষেধ।

    রাতে হলিডে হোমের আরাম বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছে না। কেবলই সেই সাধুবাবার কথাগুলো মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন এসেছি এখানে?
    ভক্তি নেই, বিশ্বাস নেই, পুজো অর্চনা নেই, ঈশ্বরের প্রসাদ পাবার বাসনা নেই এমনকি তার কাছে কোনও প্রার্থনাও নেই। তাহলে? তাহলে এই দেবভূমিতে কেন, কেন?

    দু’টি হাত। একটি থাকুক সংসার দায়িত্ব কর্তব্য পালনে। অন্য হাত থাকুক ঈশ্বরের চরণে। কিন্তু হায়রে..তেমন হচ্ছে কৈ!
    দু:টি হাত দিয়েই মনেপ্রাণে আষ্টেপৃষ্টে ধরা আছে সংসারের মায়ার বাঁধন দড়ি। উপায় নেই, উপায় নেই। পালাবার উপায় নেই । এই তোমার অনিবার্য নিয়তি।

    আর মাত্র ক’দিন। ফিরতে হবে চিরাচরিত যাঁতাকলের সংসারে। ঘানিটানা ডাল ভাতের অফিস কাছারি জীবন। সেই খুঁটেই বাঁধা আছে মন।
    তা নাহয় হলো । কিন্তু শেষপর্যন্ত এই সংসার সব হিসেব চুকিয়ে দেবে তো? মূল্য দেবে তো? অন্তত শেষ বয়সের মর্য্যাদাটুকু? কে বলে দেবে?
    আমি মনের বশে নাকি, মন আমার বশে?
    কে বলে দেবে?
    প্রত্যাশায় ভরপুর মন, গভীর রাতে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে বাঁশিতে সুর তোলে মালকোষ রাগে। সংসারী মনে শাঁখের করাত।
    হরি হরি করি নাকি পিষে মরি?
    মন বলে আমি মনের কথা জানি না। হায়রে,
    মন অতি বিষম বস্তু।

  • রম্য রচনা

    রম্য- জয় বাবা শনিনাথ

    জয় বাবা শনিনাথ (রূপক)
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    মাথা গরম বোঝাতে কত কথাই না ব্যবহার করা যায়। রগচটা, বদমেজাজি, রাগী, খোচোপার্টি, তিরিক্ষি মেজাজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
    যেমন গদাইদা। হেব্বি খোচোপার্টি। উচ্চারণের কায়দাই আলাদা। বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখলে মনে হবে, সারা দুনিয়ার একছত্র অধিপতি।
    সেদিন গলির মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে গুলতানি করা গদাইকে, কী কুক্ষণেই না হরিদা, অভ্যেসবশত জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, কিগো গদাই কেমন আছ?
    ব্যাস, আর যায় কোথায়, দিলো ছুটিয়ে ভাষার তোড়.. তোর কী বে শালা, খুব খারাপ আছি, কী করবি? তুই..আমার ভালো করতে পারবি। মুরোদ আছে? যা ভাগ শালা এখান থেকে। যতসব ফালতু মাল, যা ভাগ। ভালো মারাতে এসেছে শালা।
    হরিদা বুঝলো গতিক সুবিধের নয়। মানে মানে কেটে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বিরসবদনে কাঁচুমাচু হয়ে সরে গেল।
    দুর্বলতার লক্ষণ। দুর্জনেরে করহ পরিহার।
    য পলায়তি স্ব জীবতি।
    কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকমও হতে পারতো। হরিদাও যদি ঐ একইরকম তিরিক্ষি মেজাজের ভাষাবিদ হতো, তাহলেই খেল জমে যেত। লাগ ভেলকি লাগ। পিয়ারি লালের খেলা দেখে যা। মার কৈলাশ। কিন্তু তেমনটা হবার নয়। কেননা, হরি দা তথাকথিত ভদ্রলোক। ভদ্রলোকেরা গা বাঁচিয়ে চলাতেই নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পছন্দ করে। কিন্তু সব আম একই জাতের হয়না। প্রকার ভেদ আছে। শুনুন তবে।
    রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু।
    যেমন নেলোদা। সে আবার গদাইকে গুলে খেয়ে নিতে পারে। বাপেরও ঠাকুর্দা আছে।
    ধরা যাক। হরিদা যেমন বলেছিল, ঠিক তেমন করেই নেলোদা, গদাইকে বললো, কিরে গদাই কেমন আছিস?
    একগাল পানমশলা মেশানো হাসি দিয়ে গদাইদা মালাই মাখাবে, কেন? ওই যে বললুম, বাপেরও ঠাকুর্দা আছে। নেলোদা পার্টির তল্লাটে নেতা। লোকে খাতির করে। প্রমোটারি আর দালালী করে টু পাইস কামিয়েছে। দেমাক খুব। দেশের মহারাজা, মহামন্ত্রী, মহামাত্যদের সঙ্গে দেদার ওঠাবসা। তাদের বরাভয় হাত নেলোর উর্বর মাথায়। সুতরাং তাকে পায় কে!
    গদাইয়ের মতো হাজারো ফুটো কানেস্তারা তার চারপাশে ঘুরঘুর করে একটু পেসাদ পাবার আশায়।
    নন্দী খুশ তো মহেশ্বর খুশ। কাক খুশ তো শনি খুশ। বাহনই আসল। তার পিঠে চেপেই তো এ লোক থেকে সে লোক অবাধ যাত্রা।

    – আরে দাদা আমার। তুমি যেমন রেখেছ গুরু। গোবদা মোটা ভুঁড়ি বাগিয়ে জাপটে ধরতে গেল গদাই। নেলোদা একটু পিছনে সরে গিয়ে বিরক্তি স্বরে বললো, ‘এই এই..দূর থেকেই ঠিক আছে। বেশি ঘষটাঘষটি লাগাস না, জামা খারাপ হয়ে যাবে।
    এই হলো কায়দা। মেশো- কিন্তু দূরত্ব ঘুচিয়ো না।
    শনি ঠাকুরের মতো। পুজো নেবে, কিন্তু ঘরে ঢুকবে না। সে জানে, এ পুজো ভয়ের পুজো । ভক্তির ছিটেফোঁটাও নেই।
    গদাই থেমে গেল। মুখের চেহারা শুকনো আমের আঁটি। করুণ সুরে বললো, দূরে সরিয়ে দিও না ওস্তাদ, মরে যাবো একেবারে গুরু।
    হায়রে, কোথায় গেল রগচটা স্বভাব! কোথায় সেই তিরিক্ষি মেজাজের বোলচাল? তেল চুঁইয়ে ফুটো কানেস্তারা ফাঁকা।
    ধরাযাক, একটু আগে ঝার খাওয়া হরিদা ঠিক সেই মুহূর্তে সেখান দিয়েই ফিরে আসছে। কী হতে পারে?
    হরিদা, গদাইয়ের শুকনো ঘুঁটের মতো মুখটি দেখে, প্রতিহিংসার চাপা মুচকি হেসে, যদি গদাইয়র দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, তাহলে? সিনটা একবার কল্পনা করুন। কিন্তু না, তেমনটা হবার নয়।
    হরিদা নির্বিবাদী নিরীহ ছাপোষা নাগরিক। তেলেও আছে জলেও আছে। আবার সুবিধেমত কিছুতেই নেই। দুহাত তুলে ভজ গৌরাঙ্গ। ঠোঁটের আগায় অমায়িক দেবত্ব হাসি। প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসী। জনদরদী নেতাদের মূল্যবান ভোটার জনগণেশ।
    মতি স্থির নেই। যে যখন যা বোঝাচ্ছে, তাই বুঝছে। নিজের কোনো মতামতই নেই। কাঁঠাল পাতায় বিশ্বাসী। খুড়োর কলের কারসাজি বোঝবার ক্ষমতাই নেই।
    আচ্ছা সত্যিই কী তাই ? একটু ভাবুন।
    ছোটোরা বড়দের দেখে শেখে। বাবাকে দেখে ছেলে। গুরুকে দেখে শিষ্য। রাজাকে দেখে প্রজা। ভালো দেখলে ভালো শিক্ষা । মন্দ দেখলে মন্দ।
    যে দেশের রাজাই দুর্নীতিবাজ। সেই দেশের প্রজা সমুদয় সাধু-সন্ত হবে, আশা করা যায় কী?
    কিন্তু, একথাও তো ঠিক, সকলের সবকিছু ধাতে সয় না।
    তাহলে তাদের বাঁচার উপায় কী?
    তোয়াজ। শনির বাহন ভুশণ্ডির কাক বাবাজীদের তোষামোদ করে যাও। জ্যান্ত শনির সিন্নি চড়াও। পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে, মহল্লায় মহল্লায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জ্যান্ত শনিদের খোসামোদ করে যাও।
    হ্যা হ্যা করে হাসো। হ্যাঁ এ হ্যাঁ মেলাও। যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করে দাও, তুমি তাদেরই লোক। তোলা চাইলে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করো।
    ভক্তিহীন শক্তিপুজো। অঞ্জলি লহ মোর।
    ব্যস, আর কোনও চিন্তা নেই। এবার যা প্রাণ চায় তাই করো। স্বাধীনতা উপভোগ করো। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। বলার সাহস থাকবে না। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকবে সব। তুমি শনির কৃপা দৃষ্টিতে ধন্য। অন্যথায় কুদৃষ্টিতে ভস্মীভূত।

    ভুলে যাও, পৃথিবীতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বলে কিছু আছে। রাজা যেখানে রাজধর্ম পালনের দায় অস্বীকার করে, তখন তুমি কে?
    মনে রেখো, তুমি ভোটার। শুধুই ভোটার। মগজধোলাই হয়ে যাওয়া নিরীহ গোবেচারা মাথাগুনতি নতমস্তক কর্তব্যপরায়ণ, কর্মহীন, অন্নহীন, গৃহহীন, স্বাস্থ্যহীন, উপার্জনহীন, শিক্ষাহীন, প্রবল দেশভক্ত ভোটার নাগরিক।
    আর কেউ নও, কিচ্ছু নও। শুধু জ্যান্ত শনি পুজোর নিষ্ঠাবান পূজারি। জয়ধ্বনি দাও। বলো, জয় বাবা শনিনাথ। যুগ যুগ জিও ।

  • রম্য রচনা

    রম্য- ফুলদানি

    ফুলদানি (রূপক)
    -সুজিত চ্যাটার্জি

    বৌমা, এ-ই নাও ধরো। বৌমা একটু ইতস্ততভাবে হাত বাড়িয়ে ধরলেন, সন্তর্পণে।

    -যত্ন করে রেখেছিলাম এদ্দিন। এবার তোমার হাতে তুলে দিলাম। না না, মনে কোনও কিন্তু রেখো না। বিশ্বাস.. বুঝলে, আস্থা, একশো আনা আছে তোমার ওপর। তাইতো তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। নইলে, আমার কী দেবার লোকের অভাব, নাকি নেবার লোকের।
    শাশুড়ির পরম দান হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চোখ বুলিয়ে বৌমা ভাবলেন, একে রাখি কোথায় ? নিরাপত্তার কারণে যেখানে সেখানে, যা হোক তা হোক করে তো একে রাখা যাবে না। কোথায় রাখি এই সম্পদ?

    ফুটদেড়েক লম্বা। হালকা পাতলা ফিনফিনে কাঁচের ফুলদানি। নিচের দিক থেকে একটা সোনালী কোমল হাত যেন একটি ঘোলাটে সাদা পাত্রের ধাত্রী। সেই পাত্রের মধ্যে থাকবে রঙবেরঙের প্রজাপতির মতো ফুল। সরু লম্বাটে মেহগনি কাঠের টেবিলে বিছানো থাকবে হাতে বোনা, নিখুঁত নকশা করা রেশমি কাপড়। তার ওপর থাকবে এই দৃষ্টি নন্দন দুষ্প্রাপ্য বেলজিয়াম ফুলদানি।

    আমি কী বলছি, বুঝতে পারছ বৌমা?
    বৌমার হাতে ঐতিহ্যের প্রতীক। বেলজিয়াম ফুলদানি। চাপ দিতেও বুক কাঁপছে। মড়মড় করে গুঁড়িয়ে যায় যদি। এতো শুধু ফুলদানি নয়। স্নেহ, বিশ্বাস আস্থার আধার।
    গুঁড়িয়ে গেলে ঐ সরলতায় ভরা বৃদ্ধার হৃদয়ে চিড় ধরবে। এমন নিষ্ঠুরতা, না না। অসম্ভব।

    সেই থেকে আছে। শোকেসে। ফুলদানিতে ফুল সাজাবার বাহারী কৌলিন্য এখন অস্তমিত। তাই তার পাকাপোক্ত ঠাঁই, শোকেস। স্মৃতি। মায়াময় ভালবাসার চিহ্ন।

    বৌমা এখন শাশুড়ি। কালের নিয়মে। ছেলে আর ছেলের বউ, কর্পোরেট হাউসের উচ্চ পদাধিকারী। ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে, রাতের বেডরুম আর সকালের বাথরুম।
    কখনো সখনো লাঞ্চ কিংবা ডিনার। কেমন যেন বুড়ি ছোঁয়া গোছের ব্যাপার। আছি আবার নেইও।
    পরিচিত মুখ, অপরিচিত সম্পর্ক। চেনা তবুও অচেনা। বিস্তর ফাঁক। কেমন যেন আড়ি আড়ি, ভাব ভাব খেলা। কথাবার্তার আদান-প্রদান মাপা। প্রয়োজন ভিত্তিক। নিষ্প্রাণ। আন্তরিকতাহীন কর্তব্যের দায় সারা। এক ছাদের তলায় সময়ের রুদ্ধশ্বাস জীবন যাপন।আ স্থা বিশ্বাস ভালবাসার ফুলহীন ফুলদানি, দমবন্ধ শোকেসে আটক।

    সেদিন, একাকীত্বের নির্মম ঘুমহীন গভীর রাতে, মানবী, নরম বিছানার সুদৃশ্য পালঙ্কে নির্বাক, স্থির তাকিয়ে ছিল সেই প্রাচীন ফুলদানিটির দিকে। শাশুড়ীমা’য়ের শাশুড়ী থেকে মানবী।
    অনেক পথ, অনেক সময়। এবার থেমে যাবার সময়। পুরাতন বিশ্বাস, আস্থা, ভালবাসার বুঝি এখানেই সমাপ্তি।
    মানবী, খুব সন্তর্পণে, পরম আদরে, ফুলদানি খানি তুলে নিল হাতে। অনেক অনেক অনেকদিন পরে, মানবীর স্পর্শে যেন ঘুম ভাঙলো তার। আঁচলের প্রান্ত বুলিয়ে যেন স্নেহ মাখিয়ে দিচ্ছিল তাকে মানবী।
    এইতো সেই সোনালী কোমল হাত। এইতো সেই ঘোলাটে সাদা রঙের পাত্র। না না.. কোথাও কোনও মলিনতা নেই। এতটুকুও ধূসর বিষণ্ণ হয়নি উজ্জ্বলতা। মানবীর বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস।
    রঙ হারিয়েছে মন। উজ্জ্বলতা খুইয়েছে পরিবেশ। অন্ধকারে ঢেকেছে পরিস্থিতি।
    দু’হাতে স্মৃতি পিছুটানকে বুকে জাপটে ধরে, কাঁপন ধরা ঠোঁটে, ভিজে চোখে, ধীরে ধীরে বসে পড়লো পালঙ্কে।
    ঠিক তখনই যেন, ঐতিহ্য, ফিসফিস করে বললো- মানবী কাঁদো, আরও কাঁদো। কিন্তু সাবধান। যেন শব্দ না হয়। নবজন্ম পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। ব্যাঘাত না হয়।
    সেই গভীর অন্ধকার বেয়ে, কে জানে, কোন সে অচিন দূর থেকে ভেসে আসছিল একটা সুর।
    বাঁশি.. বাঁশি.. তোমায় দিয়ে যাবো কাহার হাতে…
    আমার রাত পোহালো।

  • রম্য রচনা

    রম্য- সংসারের মহিমা (রূপক)

    সংসারের মহিমা

    রীণা চ্যাটার্জী

    ইঁদারায় জল তোলার বালতির সাথে কোনও তফাত নেই জীবনের। ডোবাচ্ছে আর তুলছে, ভরছে আর খালি করছে। সংসারে যেমন প্রয়োজন তেমন, যখন প্রয়োজন তখন। সকালে ঘুম চোখ খুললেই শুরু, চা দিয়ে..শুধু একবার হাঁক দেওয়া মানে কিন্তু খুব সোজা দিনের প্রথমবার ডুবনো, চা হাজির। ‘এক টানেতে যেমন তেমন…’  শুরু হলো তারপর একে একে ফরমাস কোথায় তেল? কোথায় বেল? বলার সাথে সাথেই জোগান চাই, এইটাই আসল খেল। একবার সংসার ইঁদারায় ডোবাবে, তুলবে, খালি করবে আবার ডোবানোর পালা। জীবন তোমার, দড়ি সংসারের হাতে। ক্লান্ত হয়ে গেলেও আসুবিধা নেই কোনো, লাট খাওয়াতে খাওয়াতে সংসার ঠিক নামিয়ে দেবে ইঁদারায়, পাক দিতে দিতে তুলে আনবে। বেলা বাড়বে ক্রমশঃ দীর্ঘনিঃশ্বাসে, জীবন এগোবে ধীরে ধীরে। লাট খাওয়া বালতি ঘষা খেয়ে ফুটো হবে, তুবড়ে যাবে। মন বলবে, “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি..” সংসার বিস্ময়ে বলবে, “সে কি! দুই টানেতে রোগী?’

    বলবে না! ইনভেস্টমেন্ট তো উশুল হয় নি। কতবার টেনেছে সে হিসাব কেউ কি রাখে? সবার প্রয়োজন আলাদা, সেইমত ডোবানো আর তোলা। কে কতোবার ডোবালো, ভেবে কি লাভ?

    অবশ্যই এর মধ্যে আছে সমবেদনা, বালতি ফুটো হয়েছে দেখতে পেলেই আহা আহা করে দৌড়ে এসে সারিয়ে তুলবে। ফুটো বালতি হলে যে আর সুবিধা মত ডোবাতে পারবে না সংসার ইঁদারায়। তাই সমবেদনার মলম তো লাগাতেই হবে। পাঁঠা মন ভাবে, বাহ্ বেশ– আর বোধহয় টান দেবে না। আনন্দে গেয়ে ওঠে, ‘তিন টানেতে রাজা উজির.. চার টানেতে সুখী.. সবাই সুখী..’ জীবন সুখী, সম্পর্ক খুশী। আরে বাবা! সুখী হতেও তো জানা চাই।

    সুখী! ভুলের স্বর্গ ভাঙতে দেরী হয় না, যখন আবার ডুবিয়ে দিয়ে ক্লান্ত বালতিটাকে টেনে হিঁচড়ে তোলে আর ডোবায়। রাতের অবসরে ক্লান্ত, জীর্ণ অবয়ব জিরোয় আর ভাবে, আর কতো? আর কেন?

    ডোবানো আর তোলা- তোলা আর ডোবানোর মাঝে কেউ খেয়াল করে না, দড়িটা ক্রমশঃ আলগা হয়ে গেছে। অবহেলার অলেখ্য ছিঁড়ে যায় একসময়। লাট খেয়ে লুটিয়ে পড়ে সব সম্পর্ক  ছিন্ন করে অতল জলে। দৌড়ে আসে পরিচিত কিছু মুখ। মন তখন বলে, ‘পাঁচ টানেতে মাটি ছেড়ে শূণ্যে ওঠা যায়..’ হাত বাড়ালে, চোখের সামনে শুধুই অসহায় শূণ্যতা! 

    পঞ্চত্ব প্রাপ্তির অবশেষে আকাশে বাতাসে কালো ধোঁয়ায় পঞ্চভূতে মিলিয়ে যেতে যেতে কানে আসে, ‘ ছয় টানেতে আকাশেতে ভেসে থাকা যায়..’ ভেসে যায় ইচ্ছে, স্বপ্ন, সুখ, আকাক্ষা, ভালোবাসা সব!

    সারাজীবনের অবহেলার শেষে, ঘরে ফটোর ফ্রেমে ফুলের মালা, ভালো ভালো কথায় স্মৃতি রোমন্থন, চোখের জল! নিজের অবস্থান না বুঝতে পেরে  মহান, দেবতা এইসব অনুভূতি আসে মনে। কানে আসে, ‘সাত টানেতে তুমিই হবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কালী…’ কিছু দিন পর ফটোর মালা বাসি হবে, মাছি উড়বে, সব রস–গন্ধ শুকিয়ে গেলে মাছিও উড়ে যাবে। শুকনো মালা ফটোয় ঝুল মেখে দুলতে থাকবে।

    তারপর আর কোনো ব্যস্ততা নেই, হাঁক নেই- ডাক নেই। ভুলে যাওয়ার সংসারে নিস্তরঙ্গ অবসর, সব ফাঁকা, সব খালি, ‘আট টানেতে স্বর্গ- নরক সবই পাবে খালি..’ আর দম নেই, আর কোনও টান নেই। সংসারের কি মহিমা বাবা! কারিগরিটা ভাবো দিকি একবার..

  • রম্য রচনা

    রম্য- কল্কি এলো দেশে (রূপক)

    কল্কি এলো দেশে (রূপক)
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    সত্য কী? সহজ উত্তর, যা মিথ্যে নয়।
    পিতৃসত্য কী ?
    এইতো প্যাঁচে ফেলে দিলেন। পিতৃসত্য বললেই , মগজে আসবে রামচন্দ্র, বনবাস, রাবণ, সীতাহরণ, লঙ্কাকাণ্ড। মানে হুলুস্থুল ব্যাপার।
    আচ্ছা, রামচন্দ্র বনবাস স্বীকার করতে গেলেন কেন। সরাসরি বাপের মুখের ওপর বলে দিলেই হতো…
    দূর মশাই , আপনি প্রতিজ্ঞা ফতিজ্ঞা করে উল্টোপাল্টা জট পাকিয়েছেন, আপনি যা পারেন সালটান, আমি বনে গিয়ে লাইফ হেল করতে পারবোনা, ব্যাস।
    জঙ্গলে গিয়ে টিপ প্রাকটিস করার সময় খেয়াল ছিল না, আলটপকা অন্য কেউ শব্দভেদী ধনুর্বাণ খেয়ে মারা যেতে পারে , নিদেনপক্ষে উন্ডেড হতে পারে? আপনি তো রাজা। আপনার রাজনৈতিক বিবেচনা কী বলে? পাবলিক নিয়ে কাজ। অন্ধ বাপ মায়ের একমাত্র অবলম্বন ঝপ করে কেড়ে নিলেন। নেহাৎ বিরোধী বলে কিছু নেই , বেঁচে গেছেন। নইলে দেখতেন, ওই এক ইস্যুতে কুপোকাত করে দিতো। রাজ্যপাট হারিয়ে আপনাকেই বনবাস নিতে হতো।

    যাক, সেসব কিছু হয়নি। কেন হয়নি? যুগধর্ম। সেই যুগটাই ছিল সত্যের যুগ। সত্যের জন্য যেকোনো বলিদান, আত্মত্যাগ, নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করাই ছিল সুসমাজের রীতি। তাই, সুবোধ বালকের মতো রামচন্দ্র বনে চলে গেলেন। কিন্তু লক্ষ্মণ গেলেন কেন? ওর তো পিতৃসত্য পালনের দায় ছিল না , তবে?
    মনে হয়,বাল্মিকী মুনি ভেবেছিলেন, বোধহয়..
    রামচন্দ্র , রাজপুত্র বলে কথা। দুম করে একলা বনে গিয়ে সামাল দিতে পারবেন না। একটা সাপোর্টিং ক্যারেক্টর সঙ্গে জুড়ে দিলে পরবর্তী কালে সুবিধেই হবে। সুতরাং চালাও লক্ষ্মণ। একেই বলে দুরদর্শিতা। লক্ষ্মণ না থাকলে কীভাবে সবদিক ম্যানেজ হতো বলুন তো? এইরকম ভাই থাকলে একটা কেন, দশটা রাবণের মাথা কাটা কোনও ব্যাপারই নয়।

    কিন্তু, সীতা? তিনি স্বামী সঙ্গিনী কেন হলেন! তিনি অনায়াসে রাজপ্রাসাদের যাবতীয় সুখ ভোগ করতেই পারতেন। কেউ বাধা দেবার ছিল না। অথচ তিনি তা করলেন না। পতি পরম গুরু। এই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে তিনি স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন।
    এসব সত্য পরায়ণতা প্রকৃতপক্ষে যুগের ব্যাপার।
    কালের অমোঘ টানে, সেই যুগ বিদায় নিলো, সঙ্গে নিলো সেই যুগ পরায়নতা।
    যুগ কখনও একজায়গায় চুপটি করে ললিপপ খেতে খেতে দাঁড়িয়ে থাকে না। যুগ অর্থাৎ কাল বা সময়। সে ছুটে চলেছে। থামার উপায় নেই। উত্থান পতন, ভাঙা গড়া, ভালো মন্দ সব্বাইকে সঙ্গে নিয়ে সে চলেছে। পরিবর্তন আবার পরিবর্তন, চক্রবৎ পরিবর্তন।
    আজকের যুগে দাঁড়িয়ে, সত্যযুগের রীতি প্রত্যাশা করা মুর্খতার সামিল। ভাবুন একবার। সত্য প্রত্যাশা নাকি মুর্খতা। কোন যুগে বাস করছি! সত্যবাক্য, সত্যনিষ্ঠা প্রায় উধাও। তাহলে হাতে রইল কী? লবডঙ্কা। ঠকবাজি আর ঢপবাজির রমরমা জলসা।
    ললিতা, আপেল খেতে খুব ভালবাসে। তার স্বামী ললিত, অফিস ফেরতা লাল টুকটুকে আপেল কিনে বাড়ি এলো। ভালবাসার আপেল। ডাইনিং টেবিলের ওপর ফলের ঝুড়িতে সাজানো রইল। দুপুরে টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে ললিতা খাবে। জৌলুশ বাড়বে। ললিতার ঠোঁটে চাঁদের হাসি। আড়চোখে প্রেমের ঝলক। আহা, আপেল কেনা সার্থক।
    পরদিন দুপুরে, ললিতের ফোন বেজে উঠলো। ললিতার তীব্র ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর,
    -কী আপেল এনেছো শুনি, ওটা আপেল? সারা গায়ে মোম লাগানো। ছুরি দিয়ে কাটতে গিয়ে টের পেলুম। ভাগ্যিস কামড়ে খাইনি। তাহলে তো বুঝতেই পারতুম না। ছি ছি ছি… আমাকে ক্যান্সার ধরিয়ে মারতে চাও.. কান্না..ফোন কাট।
    ললিত, অপরাধীর মতো মুখ করে, মাথা নিচু করে বসে রইল। আপেলওয়ালার মুখ, মনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। ব্যাটা মিথ্যুক, জোচ্চর। এইভাবে ঠকালি, সংসারে আগুন লাগালি! দাঁড়া, তোর দেখাচ্ছি মজা।
    আস্ফালনই সার, ললিত জানে, আসলে কিসসু হবে না। বিষ্ঠায় লাথি মারলে, নিজেকেই নোংরা হতে হয় ।
    এই হলো যুগধর্ম। মিথ্যের বেসাতি।

    সুশান্ত , বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। অনেক লড়াই করে, কৃচ্ছসাধন করে, সুশান্তকে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন।
    উপার্জনশীল করে তুলতে তার ভূমিকা মনে রাখার মতো।
    সেই ছেলে লায়েক হয়ে উঠলো। বিয়ে থা করে, বাবা-মা কে, টাটা বাই বাই করে কিংবা না করে, আলাদা ফ্ল্যাট কিনে, জবরদস্ত খেলনাবাটি সংসার পেতে ফেললো। এখন, হাম দো, হামারা এক এর যুগ। বাইচান্স কখনো সখনো হামারা দো হয়ে যায়।
    আচ্ছা, এবার বলুন, এটা কোন সত্য..
    একে বলে নিদারুণ সত্য। একেই বলে যুগসত্য। যে যুগে যেমন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলো। ভালো মন্দ, ন্যায় অন্যায়, মারো গুলি। স্বার্থপর হও, নিজের আখের গুছোবার ব্যবস্থা দ্যাখো। প্যানপ্যানানি স্মৃতি ফৃতি ডোন্ট কেয়ার। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, “আয় আয় কাছে আয়” করার রাস্তায় নো এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে রাখতে হবে। বউ যেখানে আমি সেখানে, এই ফর্মুলা এপ্লাই করতে হবে জীবনে। বউ যা বলবে তাই শেষ কথা। নিজের কোনও বক্তব্য বা মতামত থাকতে পারে না, থাকবে না। ওল্ডম্যানদের জন্যে, ওল্ড এজ হোম আছে। পুরাকালে বানপ্রস্থে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কই, তারা তো তাতে দুঃখিত হতো না। বরঞ্চ আনন্দের সাথে তারা তাদের ভবিতব্যকে স্বীকার করে নিতে জানতো। তারা মহানুভব ছিলেন। তাহলে, এখন বৃদ্ধাশ্রমের কথা উঠলেই গেল গেল চিৎকার , কেন রে বাবা ? যত্তসব ফালতু।

    সেই রামও নেই , সেই রাজত্বও নেই। কেবল আওয়াজ আছে। আওয়াজ তুলে ভীড় জমাও। ভোটের মেশিনে ফুল ফোটাও। রামলীলা ময়দানে রাবণ যুগের লীলাকীর্তন করো। মনুষ্যত্ব যাক, নাগরিকত্ব থাক।
    এবার প্রশ্ন করুন , এটা কোন যুগ ?
    নরখাদকের যুগ।
    ছিলো নর নারায়ণ, হ’য়ে গেল নর খাদক।
    যুগ ধর্ম। পরিবর্তন, কিন্তু কোনদিকে?
    ভালবাসা , শ্রদ্ধা , সহনশীলতা, বিশ্বাস, মানবতা, মানে মনুষ্যত্বের সাথে জড়িত সকল সুপ্রবৃত্তি নিম্নগামী। মনুষ্যত্বহীন হীনমন্যতা জাতির অবক্ষয় ডেকে আনে। নর নারায়ণ থেকে নর খাদক।

    বাহাত্তুরে ননী ঠাকুমা, তার চালাঘরে সে আজ একা। একদিন অনেকে ছিল। কেউ মারা গেছে , কেউ চলে গেছে , কেউ বা ভুলে গেছে।মারা যাওয়া মানুষ গুলোর প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে , চলে যাওয়া মানুষ গুলোর জন্য চিন্তা আর শুভকামনা আছে, আর ভুলে যাওয়া অমানুষ দের জন্য আছে করুণা।
    ননী ঠাকুমা আজও একলাই আগলে রেখেছে শ্বশুরের ভিটে। উঠোনের তুলশী গাছ টা শুকিয়ে গেছে। তবুও, অভ্যেস বশত সন্ধ্যায় ধুপ দেখায়, জল দেয়। কেউ কেউ হেসে বলে,
    _ মরা গাছে জল ঢেলে কী হবে ঠাকুমা , ও গাছ কী আবার বেঁচে উঠবে ?
    ঠাকুমা হেসে বলে,
    _ মাটিতে ওর মঞ্জরী ছড়িয়ে আছে রে বাপ। ওরা জেগে উঠবে। নতুন সবুজ চারা। আশা মরে না রে বাপ, স্বপ্ন বেঁচে থাকে ভালবাসা আর ইচ্ছের কোলে। রাতের আঁধারের ওপারেই আছে নতুন সকাল।

    টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় , স্বর্গের নন্দনকাননে বসে আছি। পৃথিবীতে যেন কোথাও কোনও দুঃখ কষ্টের লেশমাত্র নেই। অনাহার নেই , অপুষ্টি নেই , অসহ্য অনাদর অসম্মান নেই , নির্দয় প্রতারণা নেই , ধর্ষন নেই। কেবলই উচ্ছ্বাস, আবেগ মথিত উল্লাসে উৎসবমুখর জীবন। মেনকা রম্ভা উর্বশী দের উন্মুক্ত আনাগোনা। আহা, চোখ জুরিয়ে গেল। প্রাণে অফুরন্ত বসন্তের হিল্লোল। যেন কল্পতরু বৃক্ষের নিচে বসে, কামধেনু গাভীর দুগ্ধ পান করছি। আহা, কী আনন্দ,
    মনের সুখে গান আসবে গলায়,
    “আয় সবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
    নাচিবি ধিরি ধিরি, গাহিবি গান “

  • রম্য রচনা

    রম্য- করোনার দাওয়াই

    করোনার দাওয়াই
    – তূর্য বাইন

     

     

    সাতসকালে নেতাই দেখি একখানা ঝুড়ি মাথায় নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে, ওষুধ নেবে গো, ওষুধ।
    ঝুড়িতে করে ওষুধ ফেরি করতে বাপের জন্মে দেখিনি, শুনিওনি কখনো।
    ভাবলাম,খ্যাপার মাথাটা বুঝি আবার গরম হয়েছে। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।
    নেতাই এক হাত দিয়ে খপাত করে আমার জামাটা টেনে ধরে বলল, এক্কেরে মোক্ষম ওষুধ,একবার নিয়েই দেখ না। এখনো গরম আছে, ভাপ বেরোচ্ছে।
    আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কীসের ওষুধ,নেতাই?
    সে দ্বিগুণ অবাক হয়ে বলল, এডা এট্টা জিগেস করার কতা হল? এই জন্যি লোকে তুমারে নে হাসাহাসি করে। কিচ্চু খবর রাকো নাকো। করোনার ওষুধ গো!
    বলতে বলতে সে মাথা থেকে ঝুড়িটা নামাল। তাকিয়ে দেখি, তার মধ্যে তাল তাল গোবর, সত্যিই টাটকা!
    আমি রেগে গিয়ে বললাম, খ্যাপামি করার আর জায়গা পাসনি? এটা করোনার ওষুধ!
    সেও ক্ষেপে গিয়ে বার দুয়েক তুর্কি নাচ নেচে বলল,আমার কতা বিশ্বেস হচ্চে না? একবার এর মদ্দি হাত ডুবিয়ে দ্যাকো না! দিলীপবাবুর গোয়ালের খাঁটি মাল। এর মদ্দি সোনা মিশে আচে বলে হলদে দেকাচ্চে।
    বলতে বলতে সে আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।আমি টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি পড়লাম সেই গোবরের ঝুড়িতে। আমার গায়ে হাতে গোবর মেখে সে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার।
    আমার অবস্থা দেখে পাগলা হাততালি দিয়ে বলল, বেশ হয়েছে। এ যাত্রা তুমি বেঁচে গেলে! আর কোরনা তুমারে ছুঁতি পারবে নাকো!
    –মানে?
    –এই যে তুমি ওষুধ মেকে আচো, একন নিজির গালে-মুকি হাত দেবা? কিচু খাবা? কেউ তুমার হাত ধরবে? উল্টে টেরেনে-বাসে তুমারে জায়গা ছেড়ে দে লোক পালাবে! তালি কোরনা আসপে কনথে?
    আমার মনে হল, নেতাইয়ের মন্ত্রী হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি ওর হাতে একখানা একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে সরে পড়লাম।

  • রম্য রচনা

    রম্য- পূণ্য পূণ্যি

    পূণ্য পূণ্যি
    সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    পুণ্যি চাই হে বন্ধু, পুণ্যি চাই। যেনতেন প্রকারেণ পুণ্যি চাই। পাপময় অন্ধকার জীবনে আরও অনেক কিছুর সাথে পুণ্যিও চাই।কিন্তু কীভাবে পাই , কোথায় পাই ? যাই , কুম্ভ মেলায় যাই । পূর্ণকুম্ভ। তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে সঙ্গমে গোটাকয়েক ডুব মারলেই , পুণ্যির কুম্ভ কানায় কানায় পূর্ণ।

    কানাইদা মনস্থির করেই ফেলেছেন, এবার পূর্ণকুম্ভ যোগ। সুতরাং এলাহাবাদের কুম্ভমেলা কিছুতেই মিস করা যাবে না। কিন্তু সবকিছু, ইচ্ছের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে না। তালভঙ্গ হলো।
    কানাই দার জাগরী দোস্ত বাদু দা বললেন- দুর বোকা , অতদূর যাবার কী দরকার ? আমাদের গঙ্গাসাগর আছে না, তবে ? পৌষসংক্রান্তি তে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আয়। একই ফল রে বাবা। শুধুশুধু অত খাটাখাটুনি করে কী হবে। কমখরচে ঝামেলা মিটে যাবে।
    ঝামেলা। পুণ্যি অর্জনের বাসনায় , ঝামেলার অনুপ্রবেশ। আরে ভাই জীবনটাকে ঘষেমেজে চকচকে করতেই তো পুণ্যির পিছনে ছোটা। একটু আধটু ভোগান্তির কাঁটা দলতে না পারলে , পুণ্যি আসবে কেমন করে? ঘন্টার পর ঘন্টা উপোস দাও, ভরা কলসি বাঁক কাঁধে নগ্নপদব্রজে, মাইলের পর মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে বাবা ভোলানাথের মাথায় জল ঢালো , ভিজে কাপড়ে রাস্তার ওপর সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করতে করতে ডন্ডি কাটো । মোদ্দা কথা যে ভাবে পারো শরীর কে শাস্তি দাও। দেবতা তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করবেন , হবে পুণ্যি লাভ।

    ধর্না দাও, অনশন করো, বহুজন সমাবেশ ঘটাও তবে না দাবি আদায়।
    আসলে আদায়। এমনি এমনি হবে না বাপু। ঝামেলা চাই। হরতাল চাই , অগ্নিসংযোগ চাই , যে ভাবেই হোক টনক নাড়াও।
    এতো গেল মর্তলোকের ফর্মুলা। ঊর্ধলোকের বেলাতেও মোটামুটি ব্যাপারটা একইরকম। দাবি আদায়ের মতো পুণ্যি আদায়।
    চাইলেই যদি পাওয়া যেত, তাহলে তো মিটেই গেল। কিন্তু তা তো হবার নয়। সাধ্যি সাধনা চাই।

    কানাইদার পুণ্যি চাই। একটু কষ্ট করে, ভীড় , হোগলার ঘর, টয়লেটের ঝক্কি সামলে , ঠিক সময়ে হাড়কাঁপানো হাওয়ায় একটা ডুব দিলেই যদি পুণ্যিলাভ হয়ে যায় , মন্দ কী? তারপরেই একশ এক টাকার চুক্তিতে বেঁটে গরুর ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার। আর কি চাই । হয়ে গেল মোক্ষলাভ। গঙ্গা মাতা কি…জয়।

    দেবতারা কম চালাক নয়। তারাও কায়দা জানেন।কেমন করে সাধনা চটকে দিতে হয়। তারাও অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন।

    ঋষি বসেছেন সাধনায়। সিদ্ধিলাভ হয়হয় অবস্থা , ঠিক এই ক্লাইম্যাক্স এ, উর্বশী কে ফিল্ডে নামিয়ে দিলেন দেবতা । যাও, ঋষির ধ্যান ভঙ্গ করো। শুরু হয়ে গেল ক্যাটরিনা ডান্স। ঋষি প্রথমে একচক্ষু , পরক্ষণেই দুইচক্ষু খুলে , চক্ষুছানাবড়া। ধড়মড় করে উঠে পড়লেন। বাঘছাল, কমন্ডুল, ত্রিশূল , সাধনা , সব রইল। তিনি চললেন গহীন জঙ্গলের নিভৃতে। সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশী । দেবতা মুচকি হেসে , পুনরায় নিশ্চিন্তে ধ্যানমগ্ন হলেন।

    কানাইদার , আর এক পরম মিত্র, গঙ্গাসাগরের কথা শুনে বললেন-  ক্ষেপেছো , ওই মেলা তে গিয়ে তুমি আর ফিরতে পারবে ভেবেছ। নোংরা, ভীড়, ইনফেকশন , না না, ওসব মতলব ছাড়ো। নন্দকে চেনো তো? ওর কী অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল জানো ?
    কানাই দা, মাথা নেড়ে জানালো, না ভাই , জানিনা।
    শোনো , সে দারুণ মজার ব্যাপার ভাই ।

    এটা যেসময়ের ঘটনা , তখন , এতো আলোর রোশনাই , জমাটি সাজানো, এতো আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ ছিল না ওখানে । যাইহোক,, তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী, মোক্ষম পুণ্যস্নান সময় ছিল ভোররাতে। নন্দ, নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে তৈরি হয়ে সাগর তীরে এলো।কিন্তু একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো।
    একজন নাগা সন্যাসী , একাকী , একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় বুকের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে।
    নন্দ, সেই মায়াময় আধ্যাত্মিক পরিবেশে, উলঙ্গ নাগা সন্যাসীদেখে, ভক্তি উথলে উঠলো। ধরাস করে তার পায়ের ওপর সাষ্টাঙ্গপ্রণাম ঠুকে দিলো।
    নাগাবাবা বিরক্ত হয়ে বললেন-  কী হচ্ছেটা কী , প্রণাম করছেন কেন। একি অসভ্যতা। উঠুন , উঠুন .. সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করবার আর লোক পেলেন না…?
    -না মানে , আপনি সন্ন্যাসী মানুষ , তাই…
    -দুরমশাই , আমি সন্ন্যাসী টন্ন্যসী কিচ্ছু নই। দুঃখের কথা কী বলব , জামাকাপড় খুলে এই এখানে , ঠিক এইখানে বালির ওপর রেখে , একটা ডুব দিয়ে, ফিরে এসে দেখি, আমার জামা কাপড় সব উধাও। কোন হারামজাদা সেগুলো নিয়ে পালালো বলুন তো ভাই আমার । চারিদিকে চোর , গাঁজাখোর আর ধান্দাবাজ গিজগিজ করছে।

    তারপরেই ভদ্রলোক করুণ স্বরে বললেন-  একটা এক্সট্রা পরিধান কী আপনার কাছে আশাকরা যায় ? নইলে বড্ড আতান্তরে পড়ব।
    ভাগ্যিশ নন্দর সঙ্গে এক্সট্রা ধুতি ছিল , তাই রক্ষে।
    লজ্জার একশেষ।

    তাই বলছি , সাগর পেড়িয়ে লঞ্চে চেপে অতদূর শুধুশুধু না গিয়ে , আমাদের কলকাতার বুকেই মিনি গঙ্গাসাগর বসে, জানা আছে কী?
    কানাইদা করুণ ভাবে তাকিয়ে থেকে , বললো-  তাই নাকি , কোথায় রে?
    ময়দানে… বাবুঘাটের কাছেই। এলাহি আয়োজন। খাওয়া থাকা একদম ফ্রী। দলেদলে গঙ্গাসাগর যাত্রী সাধুবাবারা এইখানে জমায়েত হয়। চলে যা। দেখে আয়, কতরকম বাবা। বাইক বাবা, মোবাইল বাবা, না দেখলে কিসসু বুঝতে পারবি না।ধুনি জ্বালিয়ে নাগা সন্যাসীর খেল, দেখে আয়। ঘরের পাশে নিখরচায় জব্বর পুণ্যি।

    কানাইদা , নেহাৎ কৌতুহল বশে সত্যিই চলে গেল বাবুঘাটের সেই টেকে। আশ্চর্য , বন্ধু একটুও বাড়িয়ে বলেনি। চমৎকার আয়োজন। নানান প্রদেশের তাঁবু। শুধু সাধু নয়, বহু পূণ্যার্থীর বিপুল সমাবেশ। খাওয়া থাকার এমনকি সাগরে যাওয়ার ব্যবস্থার বিশাল আয়োজন।
    কানাইদা ভাবতে লাগলো , কারা পুণ্যবান ? যারা সাগরে কপিল মুনির মন্দিরে বা সঙ্গমে স্নান করবেন তারা , নাকি, যারা তথাকথিত পূণ্য অর্জনের জন্য এমন প্রশস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তারা?

    কানাইদা রাতে , অন্ধকার ঘরে শুয়ে মানসতীর্থ ভ্রমণ করতে করতে, এলাহাবাদ ত্রিবেণী সঙ্গম , গঙ্গাসাগর থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত ঘুরে এলেন। নাঃ, কোথাও পূণ্যি নেই। পূণ্যি মনে , পবিত্রতায়, সেবায়। যার হদিস, কানাই দা, মনে মনে পেয়েই গেছেন।
    কে যেন বলেছিলেন , সেই অনেকদিন আগে – তীর্থ নয়, তীর্থ নয়, তীর্থপথ আমাদের , মনে যেন রয়।

  • রম্য রচনা

    রম্য- জীবন নদী

    জীবন নদী
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

    ছন্দা, রান্নাঘরে চা তৈরিতে ব্যস্ত। শীতের সকাল, অলসতা কাটাতে চায়ের জুরি নেই। হঠাৎ ছাদের ওপর দমাদম শব্দ। কী হলো ব্যাপারটা। কে যেন ছাদের ওপর তাথৈ নিত্য করছে। কার এমন বেয়াক্কেলে কাজ! কে সেই নরাধম। পুরনো মান্ধাতা আমলের বাড়ি। চারিদিকে ফুটিফাটা হয়ে আছে। বর্ষায়, ঘরে জল টপকায়। কী আশ্চর্য রে বাবা। থামার নাম নেই, দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। ছন্দার শরীর যেমন ভারী, গলার আওয়াজও তেমন বাজখাঁই। হাঁক দিলেন- এই, কেরে…? কে লাফাচ্ছে ছাদে? ছাদ ভেঙে আমাদের চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কে…? 
    ছাদ থেকে জবাব এলো- আমি, কেন? কী হয়েছে?
    উনি, এবাড়ির কর্তা, সাধন দত্ত। ইনিও বিপুল বপুর অধিকারী। ওনার শরীরের নজরকাড়া অংশ হলো, ভুঁড়ি। ভুঁড়ি তো নয়, ঠিক যেন একটা বিগ সাইজ ধামা।
    ছন্দা, রেগে কাঁই! তুমি ! আশ্চর্য… বলিহারি যাই বাপু। ওই বিশাল বপু নিয়ে তুমি ওই ফাটা ছাদে, তাথৈ নেত্য শুরু করেছো?  বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে নাকি? হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লে কী সব্বনাশ হবে, সেই জ্ঞান আছে? নেমে এসো, চা হয়ে গেছে।
    সাধন বাবুর ঠোঁটের গোড়ায় অনেক কথাই এসেছিল, চায়ের কথা শুনে, সেগুলোকে আবার যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই পাচার করে দিলেন। নেশা অতি বিষম বস্তু।

    সাধন দত্ত, হাটখোলার বনেদি বংশের বংশধর। রাজত্ব গেছে বটে, কিন্তু রাজরক্তের আগুনে তেজ যায়নি। যাবেও না। আভিজাত্যের অহংকার বড় অভিমানী, তাকে ত্যাগ করা অসম্ভব।

    চায়ে চুমুক দিয়ে ছন্দা বললেন- কী ব্যাপার, বুড়োবয়সে নাচানাচি শুরু করলে যে?
    সাধন বাবু ব্যাজার মুখে বললেন- নাচানাচি নয়, ব্যায়াম।
    ছন্দা যেন আকাশ থেকে নেমে এলো। ব্যায়াম ? তুমি? কবে থেকে?
    -আজই শুভ সূচনা করলাম।
    ছন্দা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই অলস, নিষ্কর্মার ঢেঁকি, ব্যায়ামে মনোনিবেশ করবে, এইটা ঠিক হজম হলো না, বললেন- ব্যায়ামের নাম কী, ডান্স মোটু ডান্স?
    সাধন বাবু, একটু মুচকি হেসে বললেন- এই ব্যাপারটা আগে বুঝলে, আজ এই কথা শুনতে হতো না।
    ছন্দা।

    এই হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন- তার মানে! তুমি ছাদে মিঠুন হয়ে দাপাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না! ছাদের কী হাল, তুমি জানোনা?
    সাধন বাবুর মুখে এখনো সেই রহস্যময় হাসি, স্লিম স্লিম, এখন স্ললিমের যুগ। মোটকা ঢাউস, ময়দার বস্তার মতো ফিগার, এখন চলে না।
    ছন্দার চোখের চাহনি বদলে গেল, অবাক হয়ে বললেন- কী ব্যাপার বলতো, কীসব বলছো, মাথার ঠিক আছে তো? 
    -হানড্রেড পারসেন্ট। এইযে, মিসেস দত্ত! আপনাকে বলছি, ইয়েস ম্যাডাম, আপনাকে…  ব্যায়ামটা শুরু করুন, নইলে, ভোগান্তির একশেষ হতে হবে, এই বলে দিলুম।
    ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, কী যেন ভাবলেন, তারপর, হালকা গলায় বললেন -কথাটা মন্দ বলোনি। দিন দিন বড্ড ভারী হয়ে যাচ্ছি। দু’ পা হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে মরি। অসুখের যেন শেষ নেই বাপু। সব এই মোটা হবার কারণে।
    সাধন বাবু, চোখ বুঁজে, মাথা নাড়িয়ে, দার্শনিকের মতো বললেন, মোটা কেউ কী হতে চায় , তবুও হয়ে যায়।
    ছন্দা, ঝাঁঝিয়ে উঠলেন…থামো দেখি। গাদাগাদা তেল মশলা না হলে তো জিভে স্বাদ আসে না। ব্যায়াম করে ছাই হবে। ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন গনেশ ঠাকুর হয়ে, বড়ো বড়ো লেকচার। যাও বাজার যাও। মাছ মাংস তেল মশলা সব বাদ। শুদ্ধু ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ আর ভাত। তোমার মুখরোচক খাওয়ার ধুম, আজ থেকে বন্ধ। লুচি, পরোটা, পোলাও সব বন্ধ।
    সাধন বাবু, ঠক করে টেবিলে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রুদ্রমূর্তি…ফালতু কথা একদম বলবে না, আমি একা খাই? তুমি কি করো? খেয়েদেয়ে দুপুরবেলা ভোঁসভোঁস করে ঘুমোয় কে, আমি? আমাকে ঢ্যাঁড়স দেখাচ্ছে?  তুমি গেলো ঢ্যাঁড়স, কচু…. 
    কচুটা, বেশ জোরালো করে ছাড়লো।
    ছন্দাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়- মুখ সামলে কথা বলো! কচু? কচু কাকে দ্যাখাচ্ছ শুনি। অলক্ষুণে কথাবার্তা। ঘরের বউকে কেউ এসব কথা বলে, ছি ছি…

    -কেন বলবো না। বেশ করেছি বলেছি। তুমি ঢ্যাঁড়স দেখাবে, আমি ছেড়ে দেবো।
    ভুলে গেলে চলবে না। ছন্দার জাঁদরেল গলা, আমিও বেশ করেছি…তুমি সক্কাল বেলায় ছাদটাকে ব্যায়ামাগার করে তুলবে, তার বেলা কিছুনা ?
    শীতের সকালে ঠান্ডা নয়, উত্তাপ বাড়ছে। কেউ কমতি যায় না…
    বেশ করেছি, আমার বাবার ছাদ, আমি যা খুশি তাই করবো। ছাদে সুলভ কমপ্লেক্স করবো। বড় বাইরে পাঁচ টাকা, ছোট বাইরে দু’টাকা করবো, তাতে কার বাবার কী ?
    ব্যাস হয়ে গেল। এইবার আঠারো দিনের কুরুক্ষেত্র শুরু।
    -তুমি আমার বাপ তুল্লে…কান্না, ছন্দার মোক্ষম অস্ত্র। ঠিক আছে , থাকো তুমি তোমার বাবার এই ভুতুড়ে ভাঙা বাড়ি নিয়ে। ভুলে যেওনা, আমারও বাপের বাড়ি আছে। চললুম। খবরদার আনতে যাবে না , এই ব’লে দিলুম।
    দুমদাম করে পা ঠুকে ঠুকে শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো ছন্দা। এই দরজা কখন খুলবে, তা, মা মনসাই জানেন।

    সাধন বাবুও মিলিটারি কায়দায় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছন্দাকে শুনিয়ে বললেন, শোনো, ভালো করে কান খুলে শুনে রাখো, তোমার বাপের বাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু, সেটা তোমার পাকাপোক্ত থাকার জন্যে নয়। দু’ দিনের জন্যে বেরাতে যাবার জায়গা। কথাটা মনে রেখো, হ্যাঁ… ঠাকুর বলেছিলেন, সংসারে থাক পাঁকাল মাছ হয়ে। অতই সোজা? ঠিক উল্টো হবে। সংসারের পাঁক, সারা গায়ে মাথায় মুখে মাখামাখি হয়ে গেছে। ও পাঁক পরিস্কার হবার নয়। ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। বাঁচা গেছে। রোজ ঝামেলা, রোজ খুঁত ধরার কম্পিটিশন। মাছের মুড়ো নিয়েও অশান্তি। দরকার নেই মা আমার। আলাদা করে রেঁধে বেড়ে খাও। বুঝবে ঠ্যালা। রোজ বাজার যাও, দরদস্তুর করে মাছের বাজারে ল্যাজেগোবরে হও, মুদির দোকানের ফর্দ সামলাতে ভিরমি খেতে হবে। খুব ভালো হয়েছে। দ্যাখ কেমন লাগে…

    আরে ভাই, এর নাম সংসার। অত সহজ নয় রেহাই পাওয়া। বিষফোঁড়া ফেটে গেল, পুঁজ রক্ত বেরিয়ে গেল, আহা, কী আরাম। কিন্তু, সন্তান যখন বিষিয়ে যায়, বিষফোঁড়া কেন, বিষধর কোবরাকেও হার মানায়।
    কদিন যাবৎ নতুন একটা উৎপাত শুরু হয়েছে। ছেলের বউ, ছেলেকে উস্কানি দিচ্ছে। বাড়িটা বাপের কাছ থেকে লিখিয়ে নেবার জন্যে।
    নির্লজ্জতা আর স্বার্থপরতার বোধকরি , কোনও সীমা থাকে না। আগে কায়দা করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতো- একটা লেখাপড়া করে রাখা ভালো। মানুষের কথা তো বলা যায় না, কখন কী হয়… তাই…।
    কিন্তু বিগত কয়েক মাস যাবৎ ব্যাপারটা জোর খাটানোর পর্যায়ে গেছে। খানিকটা যেন, ভয় দেখানো হুমকির সুর। দেখে নেওয়া গোছের ব্যাপার। দত্ত দম্পতির আপত্তি এখানেই। তুই তো না চাইলেও পেতিস। চেয়েই ভুল করলি। বুদ্ধি যে-ই যোগান দিক, ক্ষতি কিন্তু ছেলের। সম্পত্তির কথা ছেড়েই দিলাম, ভালবাসা? বিশ্বাস? আস্থা? সবই হারাবি। এ অমূল্য ধন, গেলে আর ফেরেনা।
    আরে বাবা মোলে তো তোরাই ভোগদখল করবি। অত তাড়া কিসের,,?
    ছন্দা ব্যবসায়ী বাপের মেয়ে। লাভ ক্ষতির হিসেব খুব বোঝে। বললেন, খবরদার বলে দিলুম, ভুলেও ওদের ফাঁদে পা দিও না। এসব ওই বউয়ের বুদ্ধি। ওই শেখাচ্ছে। সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে শেষে পাখি উড়ে যাবে। আমাদের পথে বসাবে।
    সাধন বাবু, খেঁকিয়ে উঠলেন… থামোতো, সব বউ শেখাচ্ছে…তোমার ছেলে শিখছে কেন! ওকি ছেলেমানুষ! নিজস্ব বুদ্ধি নেই। পরের মেয়ে কে দোষ দিয়ে কী হবে! নিজের রক্তই যখন ঠিক নেই।
    যাক, ওসব নিয়ে মাথা খারাপ করে লাভ নেই। ভেবে দেখি, কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
    ছন্দা, কথায় সায় দিয়ে বললেন… অবশ্যই , ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।

    দোতলার এই বারান্দাটা, দত্ত দম্পত্তির ভারী পছন্দের। দু’জন দুটি চেয়ার পেতে, অল্প দূরে বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিপাট শান্তি। অনেক খোঁজখবর করে শেষপর্যন্ত এই ফ্ল্যাট টাই পছন্দ হলো। নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ, সর্বোপরি সম্মুখে বহমান গঙ্গা। চুনাপুকুর লেনের সেই পুরনো বাড়িটা স্থানীয় এক প্রভাবশালী প্রমোটারের কাছে বেচে, এই ফ্ল্যাট কেনা। ছেলে কেও বঞ্চিত করেননি। তাকেও তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে, সম্পর্কের ইতি।পাওনাগণ্ডার হিসেবনিকেশ, রক্তের সম্পর্ক কে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে। শকুনের বাসা বাঁধা গাছে , কোকিলা গান করে না।

    এখন ফাগুনের মাঝামাঝি। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। অন্ধকার বারান্দায় পাশাপাশি বসে দত্ত দম্পতি। লন্ঠনের আলো জ্বেলে, ভেসে যাওয়া জেলে নৌকার দিকে তাকিয়ে, মনেমনে স্মৃতির অতলে কতকিছুই খুঁজছিলেন।
    নীরবতা ভেঙে ছন্দা বললেন… কী ভাবছ ?
    _ নাঃ, কিছুনা ,,
    _ ভেবো না, অকারণে মন ভারী করোনা।
    _ অকারণে? কী বলছ, তুমি জানো!
    _ আমি মা হয়ে জানবোনা? তাইকি কখনও হয়!
    _ তবে ?
    _ আমরা তো আমাদের কর্তব্য করেছি। সেখানে তো কোনও ফাঁকি নেই , তঞ্চকতা নেই। এই-বা কম কী। প্রতিদানে কোনও প্রত্যাশা রেখোনা , দুঃখ পাবে।
    _ কিন্তু , সম্মান ! প্রতিদানে ভালবাসা, সম্মান আশা করাও কি ভুল? অন্যায় ?
    _ অমানুষের কাছে ভালবাসা, সম্মান প্রত্যাশা শুধু ভুলই নয়, চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।
    সাধন বাবু , চুপটি করে বসে রইলেন। চোখ গঙ্গার দিকে স্থির।মনেমনে বললেন , ঠিক বলেছো ছন্দা, ঠিক বলেছ, একদম ঠিক।
    -ঘরে চলো। রাত হয়েছে। কাল ভোরবেলা উঠে ওই গঙ্গার ধারে , ডান্স মোটু ডান্স ব্যায়াম, প্রাণ ভরে চালিও, কেউ আর চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বাধা দেবে না। এখন শোবে চলো…
    কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসছিল। রবীন্দ্র সঙ্গীত….
    এবার নীরব করে দাও হে তোমার
    মুখর কবি রে… এবার

  • রম্য রচনা

    রম্য- লবি বনাম ঈশ্বর দা

    লবি বনাম ঈশ্বর দা
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    কী চাও? লেখক , কবি, সাহিত্যিকের তকমা পেতে? তাহলে, কালক্ষেপ করোনা । লবিতে নাম লেখাও।
    লবি চাই লবি। লবির আমি লবির তুমি করতে হবে। তেল দাও তেল, নইলে কপালে ঢংঢং। তুমি কোথায় কী দু’চার খানা রদ্দিমার্কা গল্প, কবিতা লিখেছ , সেগুলো ভদ্রলোকের পাতে দেওয়ার উপযুক্ত কিনা , সেসব মারো গুলি। কে কার ছ্যাঁদা দেখবে , অত সময় কই। লবিতে নাম লেখাও , দল পাকাও, গায়েগায়ে মাখামাখি করে গদগদ গলায় , দাদা দাদা, দিদি দিদি করো। লবির মাতব্বর দের ডাকা , নিজের ঢাক নিজেই পেটাও অনুষ্ঠানে, যথাযথ নিয়ম মেনে উপস্থিতি দিয়ে, ব্যাগার খাটো। গান গাইতে গাইতে দলবেঁধে, প্রভাত কিংবা সান্ধ্য ফেরী করো , চাঁদা দিয়ে সদস্য পদ নাও। টাকা দিয়ে ম্যাগাজিনে লেখা ছাপাও। পিকনিকে যাও। বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠানে , লালপেড়ে শাড়ী জরিয়ে , শঙখ , উলুধ্বনি দাও।
    অথচ , আপনি চেয়েছিলেন কবিতার মাঝে থাকতে।হয়ে গেলেন, লবির সদস্য। লেখালেখি গেল চুলোর দুয়ারে। এখন কেবল লবির দাসত্ব , তথাকথিত সাহিত্য সভায় করতালি দেবার যন্ত্র।
    নেপোয় দই মারবে । নাম ফাটবে লবির মাতব্বর দের। আপনার কপালে ঢুঁঢু ।

    রাধিকা বসু। সারা সপ্তা, সারা মাস, সারা বছর, তারচেয়ে বলা ভালো জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিলেন , স্বঘোষিত কবি মহোদয় দের ডাকা সারস্বত সভার সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথির গুরুদায়িত্ব পালন করে।
    কে এই রাধিকা বসু। কী পরিচয় ? এককথায় বলাযায় ইনিও স্বঘোষিত কবি। কী করে কবি হওয়া যায় ! কবি হওয়া যায় নাকি , দোকানদার হবার মতো? যায় । লবি লবি, স্রেফ লবি করে ভেজাল কবি অবশ্যই হওয়া যায়।

    বাঁশবনে শিয়াল রাজা। গোঁজামিলের কবিতা পাবলিক নেবে কেন? তারা সব বোঝে। ওখানে ফাঁকিবাজি ক্যাচ কট হয়ে যাবে।
    রাধিকা বসুর হাল কি আর বলবো। যে কোনও ওই ভেজাল কবিদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখুন । দেখবেন উনি মঞ্চ আলো করে বসে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনাকে সম্বর্ধিত করা হবে। গলায় উত্তরীয় পরিয়ে , হাতে ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেওয়া হবে। হাততালি হবে না , কিন্তু মাইকে হাততালি দেবার আবেদন জানালে, মৃদু টকাটক একটু শোনা যেতে পারে, তবে তা শুধু ক্ষণিকেরই নয়, নিষ্প্রাণও বটে।
    এবার উনি বক্তব্য রাখবেন। উচ্চগ্রামে বাঁধা কন্ঠস্বর, একই মুখস্থ বুলি আওড়াবেন। নিজের লেখা একই কবিতার পুনরাবৃত্তি হবে।
    হবেই তো। এছাড়া আর উপায় কী। আছেই তো ওই দু-এক খানা সম্বল। সাহিত্যের কথা বিশেষ পাওয়া যাবে না , তবে ফলাও করে আত্মপ্রচারের বাণী পাওয়া যাবে।আর পাবেন, নিকটবর্তী পাশের রাষ্ট্র এবং বাংলা ভাষার প্রতি তার কী অপরিসীম ভালবাসা, তার মোক্ষম বিজ্ঞাপন।

    নবীন, এখন এই দলে নাম লিখিয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় হাজিরা দেয়। একেবারে পিছনের সারিতে বসে, জুলজুল করে তাকিয়ে দ্যাখে। মঞ্চে বসে থাকা লোকগুলোর বক্তৃতা শোনে। বোঝবার চেষ্টা করে, ওরা ওখানে, মানে উঁচুতে কেন! কোন দক্ষতা বা যোগ্যতা, ওদের উঁচুতে বসিয়েছে! এরা কারা? এদের নামও শোনেনি কখনো। এদের কথায় বিশেষ কিছুই নেই , যা ভাবতে শেখায়, মন আন্দোলিত হয়, মনেহয় ছুট্টে গিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাই , নাহঃ, তেমন কিছুই হয়না।
    তবুও ওদের কথার শেষে, নিয়ম বশতঃ হাততালি দিতে হয়। ইচ্ছে করে না, তবুও দিতে হয়, নিয়ম।

    নবীনের ভালো লাগে না। আজকাল তাই , এইরকম সভা গুলো এড়িয়ে যেতে চায়। ও ভাবে, এইভাবে অকারণ সময় নষ্ট না করে, এইসময় টুকু সে পড়বে। কিছু লিখবে। এদের কাছে কিছু জানার বা শেখার নেই। এইতো সময় , এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে। অনেকটা পথ। সভার ভীড় বাড়ানো হাততালি দেওয়া দর্শক হয়ে কী লাভ?

    ঠিকই তাই। লাভ কী? এটাই মোক্ষম প্রশ্ন। লাভ ক্ষতির অঙ্কটা ঠিকঠাক বুঝতে পারা চাই। নবীন, দক্ষতা যোগ্যতার খোঁজ করছে। কিন্তু ওর কচিমাথা বুঝতেই পারেনি, ওখানে একটি বিশেষ জিনিস চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে , তার নাম, লবি। লবি তে গা ভাসাতে, দক্ষতা যোগ্যতার প্রয়োজন হয়না। শুধু তেলের দরকার হয়।হ্যা হ্যা করে হেসে, ট্যাংট্যাং করে গায়ে গা ঘসে যাও। দুহাত তুলে বলো, আমি আছি, আমি আছি। আমি তোমাদেরই লোক। বিশ্বাস অর্জন করো। শত্রু মিত্র বাছাই করতে শেখো। চুটিয়ে চুকলি করো। যখন যেমন, তখন তেমন পলিসি ধরো। খুঁজে খুঁজে, নামজাদা লোকেদের বাড়িতে মিষ্টির বিগ সাইজ বাস্ক নিয়ে যাও। ভাব জমাও। ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসো। জোঁকের মতো কামড়ে ধরো। রক্ত চুষে খেয়ে, টইটম্বুর গায়ে গতরে হয়ে , তাল বুঝে, ঝুপ করে খসে পরো। ব্যাস কম্ম ফতে। আর তোমাকে পায় কে। যাও, এবার তুমিও মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ঝাড়ো। এখন তুমিও কেউকেটা।

    সেবার কলকাতা বইমেলায় ঈশ্বর দা র সঙ্গে দেখা। নবীন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, বললো,,,
    চিনতে পারছেন ?
    নবীন, এখন আর নবীন নেই। চুলে পাক ধরেছে। মুখেও সময়ের ছাপ।
    ঈশ্বর দা, একটুক্ষণ নবীনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন , লাভক্ষতির অঙ্কটা মিলিয়ে দিয়েছো দেখছি।
    নবীন লজ্জা পাবার ভান করে বললো ,,,,,
    কি যে বলেন,,, ভালো আছেন ঈশ্বর দা?
    ঈশ্বর, নবীনের চোখে চোখ রেখে বললেন,,,,
    খুব ভালো আছি , মনে। তবে, শরীরটা বুড়িয়ে গেছে।
    নবীন, স্বান্তনা দেবার মতো করে বললো,,,,,,
    তা ঠিক। কিন্তু এই বয়সেও তো নিজের পায়েই চলছেন , লাঠি নির্ভর তো হননি।
    ঈশ্বর , মৃদু হেসে বললেন ,,,,
    কোনও কালেই লাঠি নির্ভর হইনি। হতে চাইনি। অবলম্বন বড্ড খারাপ জিনিস। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে, পরিত্যাগ করা মুশকিল। গুল্মলতা আর বৃক্ষের মধ্যে তফাৎ নিশ্চয়ই জানো। বৃক্ষ কেবল মাটিকে আশ্রয় করে আকাশ ছুঁতে চায়। গুল্মলতা চায় , বৃক্ষের অবলম্বনে আকাশ দেখতে। কিন্তু , মজার ব্যাপার কি জানো, কোনও কারণে বৃক্ষটি ধরাশায়ী হলে,, হা হা হা,,,,,,
    ঈশ্বরের ওই হাসির মধ্যেই বাকি কথা গুলো লুকিয়ে ছিল। নবীনের তা বুঝতে অসুবিধে হলোনা। শুধু তাইনয়, এই কথার অভিমুখ যে তারই দিকে, তাও অন্তত তার বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কেননা, সে-ও যে শেষপর্যন্ত এই সহজ পথটাই বেছে নিয়ে ছিল। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে, লবি তে গা ভাসিয়ে ছিল। তাতে তার চলার পথ সুগম হয়েছিল। নানান সাহিত্য কমিটির মাতব্বর দের সঙ্গে ওঠাবসা , সঙ্গে রাজনৈতিক চাটুকারি যোগাযোগ। সুতরাং, এই হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে হাসতে পারলো না। বরঞ্চ একটু গম্ভীর গলায় বললো,,,,,,
    সময় কিন্তু পাল্টে গেছে ঈশ্বর দা। আপনাদের সময় আর এই সময়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেটা নিশ্চয়ই মানবেন।
    ঈশ্বর স্বগতোক্তি করলেন ,,,,,,,,
    সময় , কাল।,,,,,, কালের নিয়মে সময়ের বদল।
    কিন্তু নবীন, নিয়মের কোনও বদল হয়েছে কী?
    ধারা ? সহজে, বিনা পরিশ্রমে, অযোগ্যতা দুর্বলতাকে ধামাচাপা দিতে যে অনৈতিক পথ নেওয়া হতো , সেই প্রচলিত ধারার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কী? না, হয়নি । হবেও না। তবে, একথাও ঠিক, আম আর আমড়া, সমমর্যাদা পায়না। যার যেথা স্থান, সে ঠিকই,,,,,,,,,,
    ঈশ্বর দা কথা থামিয়ে দিলেন। নবীন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বর দা , একটু ইতস্ততভাবে বললেন,,,,,,
    কিছু মনে করোনা নবীন। আমি বোধহয় একটু বেশি বলে ফেলেছি।,,,,,
    না ঈশ্বর দা , আমিই আসলে বেশি প্রত্যাশা করে ফেলেছি। লোভ ঈশ্বর দা লোভ। যশস্বী হবার লোভ। আপনাদের দেখে বড় হিংসে হতো। আপনার মতো লেখক দের সমকক্ষ হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, আজ বুঝতে পারি। ওই যে আপনি বললেন , যার যেথা স্থান। আম আর আমড়া। খুবই সত্যি কথা। লবি করে, আপনাদের মতো লেখক দের কাছাকাছি আসতে হয়তো পেরেছি। কিন্তু সাধারণ পাঠকের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারিনি। তাদের মনের সবটুকু জুড়ে , আপনার মতো প্রকৃত সাহিত্যিকের পাকাপোক্ত বাস। সেখানে আমার মতো লবিবাজ ভেজাল লেখক অপাংক্তেয়। আমাদের স্থান, ভেজাল সাহিত্য সভার উঁচু মঞ্চে। আর, আপনি আছেন , যোগ্যতায় দক্ষতায় প্রতিভায় পাঠক মনের মনিকোঠায়।
    আপনাকে আর একবার প্রণাম করবার অনুমতি দিন ঈশ্বর দা।
    নবীন নিচু হয়ে প্রণাম করতে গিয়ে দেখলো, সেখানে কেউ নেই। হাতের আঙুল ঠেকলো মাটিতে, বইমেলার ধুলো তে। মেলার মাইকে তখন ঘোষকের কন্ঠস্বর,,,,,
    প্রখ্যাত সাহিত্যিক আমাদের অতি প্রিয় , প্রাণের লেখক , ঈশ্বর রায়ের অবিস্মরণীয় স্মৃতির উদ্দেশ্যে, উপস্থিত আমরা সবাই , একমিনিট নীরবতা পালন করবো।

    নবীন , মখ তুলে , সন্ধ্যার কালো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে , হাজারো তারার মধ্যে, ঈশ্বর দা কে খুঁজছিল। নবীন নিশ্চিত, সাহিত্যিক ঈশ্বর রায় , নিজস্ব উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করবেন চিরকাল। কোনও লবির প্রয়োজন হবেনা।।

You cannot copy content of this page