স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
-
“অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার” – এর ফলাফল
অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার” – এর ফলাফল
“আলাপী মন” আয়োজিত “অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার”-এ অংশগ্ৰহণকারী সকল কলমকে বিনম্র শ্রদ্ধা, সকলেই নিজের ভাবনায়, সৃষ্টিতে অনন্য।
গল্প বিভাগে তিনটি, কবিতা বিভাগে চারটি করে লেখা নেওয়া হয়েছিল- কলমের ধারাবাহিকতা, বিষয় নির্বাচন, সাহিত্যের উৎকর্ষতা নিয়েই আমরা পথ চলতে চেয়েছি।বিচার বা নিখুঁত বিশ্লেষণে নয়, মন ছুঁয়ে যাওয়া কয়েকটি কলম আমরা বেছে নিয়েছি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কলমে। সাহিত্যের গভীরতায় অবলীলায় সন্তরণ করেছেন যাঁরা বা বিষয় ভাবনার অনন্যতায় যাঁরা মুগ্ধ করেছেন-
কবিতা বিভাগে:-
প্রথম- শ্রী অসীম দাস, কবিতা- “ফেরারী ফৌজ“
দ্বিতীয়- শ্রী প্রদীপ শর্ম্মা সরকার- “বিনিসুতোয় প্রেম“
তৃতীয়- শ্রী কাজল দাস- “আমি সেই মুখ“গদ্য বিভাগে:-
প্রথম- শ্রী সুজিত চ্যাটার্জি, রম্য- “নগ্ন চরিত“
দ্বিতীয়- শ্রীমতী পায়েল সাহু, গল্প- “অভি“
তৃতীয়- শ্রী সঞ্জিত মন্ডল, গল্প- “গল্প“
শ্রী রাণা চ্যাটার্জী, গল্প- “ভারতমাতা“বিশেষ পুরস্কার:-
শ্রী সুমিতা দাশগুপ্ত, প্রবন্ধ- “লীলাময়ীর লীলা কথা“ -
কবিতা- মায়া
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মায়া
-শৌভিক মন্ডলঅনন্ত নির্যাতিত নদীপথ,
পচা মরদেহ প্রবাহিত।
গাঙচিলের ক্ষুধা নিঃশ্বাস।
নিষিক্ত প্রেম, দীর্ঘ প্রতীক্ষা…
চোখের তুলসী পাতায়
প্রিয়জনের করপুট জলে
এ-কার মুখচ্ছবির পিছুটান!
মায়াময়..….. -
কবিতা- অস্থায়ী ছুটি বারো মাস
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
অস্থায়ী ছুটি বারো মাস
-কাজল দাসআমাদের স্কুলে প্রজাপতি আসে না যে আর,
শুকিয়েছে ফুল গাছ আসেনা হেড মাস্টার।
ঘরে বসে অনলাইন শাস্তি ভীষণ রকম,
আমাদের শৈশব নিচ্ছে কিনে মুঠোফোন!
ভালো লাগছে না,
যেন সব অচেনা,
মিছে এই সান্ত্বনা,
বন্ধু নেই-
যেতে দাও স্কুলে,
ছুটে যাই মন খুলে,
মেঘেদের পাল তুলে,
আকাশেই-
লাগছে না ছুটি ভালো আর।আকাশের নীলে মেঘেদের শুনি হাহাকার,
অনেক হয়েছে, ছুটিদের নেই দরকার।
পড়ে আছে ক্লাসরুম ধ্বংস স্তূপের মতন,,
সময়ের পেন্সিল সিলেবাসে বন্দি এখন।
ভালো লাগছে না,
বসে বসে দিন গোনা,
মোবাইলে পড়াশোনা,
ইচ্ছে নেই-
বন্ধন ছিঁড়ে,
ইউনিফর্ম পরে,
গল্পের আসরে,
ফিরতে চাই-
লাগছে না ছুটি ভালো আর। -
গল্প
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
গল্প
– সঞ্জিত মণ্ডলআজ একটা গল্পের কথা বলি ।যদিও এটা গল্প নয়,আসলে কারো জীবনের কোনো ঘটনা যখন গল্প হয়ে যায় তখন সেটা আমাদের অনেক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যাই হোক, আজ আমার,
গল্পের নাম!! “আমি,লতা ও য়্যালোভেরা”!! সঞ্জিত মণ্ডলের
ছোট গল্প!! “আমি লতা ও য়্যালোভেরা”!!
দক্ষিণ শহরতলির এই জায়গাটা আমার বেশ পছন্দ।আমার বিয়ের অনেক আগে এক আত্মীয়তার সূত্রে বেড়াতে এসে মনে মনে ঠিক করেছিলাম বাড়ি তৈরী করার মত যদি আর্থিক সঙ্গতি কখনো হয় তবে এমন জায়গাতেই বাড়ি করব। তা উপরওয়ালা বোধ হয় আমার মন বাসনা শুনেছিলেন।বিয়ের পর নানান জটিল পরিস্থিতিতে বাড়ি ছাড়া যখন একমাত্র ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায় তখন অদ্ভুত ভাবে এক যোগাযোগের মাধ্যমে এক টুকরো জমি পাওয়া যায়। বিস্তর ধার দেনা করে বাইপাসের ধারে সেই জায়গার উপরে মনের মত একটা ছোট্ট দোতালা বাড়ি করলাম। স্বামী স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে ছোট্ট সংসার।
সদ্য রিটায়ার করেছি। সময় কাটানোর জন্যে ছাদের উপর ছোট্ট একটা বাগান করেছি– সবই টবের উপর।দু চারটে লঙ্কাচারা যেমন লাগিয়েছি তেমনি লাগিয়েছি বেগুন আর টমাটোর চারা। বেল ফুল আমার খুব পছন্দের সেটা লাগিয়েছি আর লাগিয়েছি রজনীগন্ধা।
আমার বড়দিদি মীরার বাড়িতে পাথরকুচি গাছের ফুল দেখে অবাক হয়েছিলাম। সেটা লাগিয়েছি।আর লাগিয়েছি য়্যালোভেরা অর্থাৎ ঘৃতকুমারী।এই গাছগুলোর পিছনেই আমার সময় কেটে যায়।
প্রথম প্রথম ৯টা বাজলেই মন কেমন উসখুস করত। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতাম বাস ধরার জন্যে কত লোকের হুড়োহুড়ি। যেটা আমি কিছুদিন আগেও করতাম।আরো দেখি অটোর কতটা লম্বা লাইন। অফিস টাইমে চারজন না পাঁচজন নেবে তাই নিয়ে তর্কাতর্কি, খুচরো না থাকলে নেমে যান এর চোখ রাঙানি। রিটায়ার করে প্রথম প্রথম কষ্ট হোত। তবে এখন আত্মপ্রসাদ লাভ করি এই ভেবে,যে রিটায়ার করে সিনিয়র সিটিজেন হয়েছি। বাসের হুড়োহুড়ি অটোর ঝামেলার ঊর্দ্ধে উঠে গেছি। এখন বাগানের কাজেই সময় কাটাচ্ছি।
সেদিন বেলা পর্যন্ত রোদ ওঠেনি।নিড়ানি দিয়ে গাছের গোড়া খুসে দিচ্ছি।ছাদের উপর টবের গাছগুলো খুবই অভিমানী। সামান্য যত্নের ত্রুটি বিচ্যুতিতে নিঃশব্দে দেহ রেখে দেয়।এক মনে তাই গাছের সেবা করছি।
পাশের বাড়ির ছাদ থেকে কে যেন বলল, দাদু, ও দাদু,আমায় একটা য়্যালুভেরা দেবে?
প্রথমটায় খুব একটা পাত্তা দিইনি। কে কাকে কি বলছে কে জানে।
তা ছাড়া সদ্য সিনিয়র সিটিজেন হওয়া সত্বেও দাদু ডাকটার সঙ্গে ততটা পরিচিত হইনি।দাদু ডাকাটাও ততটা পছন্দ করিনা।
কিন্তু আবার সেই ডাক ! এবার না তাকিয়ে পারলাম না।
দেখি পাশের বাড়ির ছাদে বেশ জোয়ান বয়সের স্বাস্থ্যবতী একটা মেয়ে আমাকেই বলছে।
দাদু ডাকটা যেহেতু আমার পছন্দের নয়, তাই মুখ ব্যাজার করে বলি,কি বললি?
য়্যালোভেরা গো য়্যালোভেরা, মেয়েটি বলল, দাওনা একটা।
বললাম, কি করবি?
উত্তর এলো, কি করবো জানোনা? হেয়ার কন্ডিশনিং করবো, হেয়ার স্পা করবো, আরো কত কি।
আমি বলি, এতো কিছু করবি তা তুই য়্যালোভেরা চিনিস?
মেয়েটি বেমালুম পাথরকুচি গাছ দেখিয়ে বললো ওইতো য়্যালোভেরা।
বললাম, তোর মাথা আর মুন্ডু!
ওটা হচ্ছে পাথরকুচি।কবিরাজী নাম,পাষাণভেদী।
তোকে আমি চিনিনা জানিনা তুই কে? হঠাৎ কোত্থেকে ওদের ছাদে উদয় হলি? কি করিস তুই?
মেয়েটি বললো, ও হরি,তুমি আমায় চেনোনা?
আমি তো রোজ তোমাকে দেখি,গাছের গোড়ায় কি খুটুর খুটুর করছো। আরে আমি হলাম গিয়ে লতা। মায়ের হয়ে এদের বাড়িতে প্রক্সি দিতে এসেছি।
অবাক হলাম আমি। বলি, প্রক্সি দিতে!
লতা বললো হ্যাঁগো, মায়ের শরীরটা ভালো নয়,খুব দুর্বল, মাথা ঘোরে সব সময়।সে কথা আবার এদের বাড়িতে বলে দিওনা যেন,অসুস্থ শুনলে হটাৎ করে চাকরীটা নট হয়ে যেতে পারে। তাই যেদিন মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনা, সেদিন এসে মায়ের কাজ গুলো করে দিই।
বললাম, মা কে সাহায্য করিস, সেতো খুবই ভালো কথা। তা কি কি করিস?
লতা বললো, কেন কাপড় কাচি,বাসন মাজি,ঘর ঝাট দিই,মুছি।আর টুকটাক ফাই ফরমাস খাটি।
বললাম, তা ভালো ই তো কাজ করিস।তবে তুই যেটা চাইছিলিস,আর যেটা দেখালি ওগুলোর কি কি কাজ জানিস?
লতা বললো, য়্যালোভেরা মাথায় লাগালে চুল ভালো হয় জানি, তবে আর কিছু জানিনা।
বললাম, শোন, যেটা ব্যবহার করবি,তার গুণাগুণ ভালো করে জেনে তবে ব্যবহার করবি।
শোন তবে,য়্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী হলো, তিক্ত- মধুর রসযুক্ত,ভেদক,পুষ্টিকারক রসায়ন।চক্ষুর হিতকারক,বলকারক,শুক্রবর্ধক। বিষ দোষনাশক, জ্বর,প্লীহা,রক্তপিত্ত ও চর্মরোগ নাশক।পোড়া জায়গায় লাগালেও খুব উপকার পাওয়া যায়।ঘৃতকুমারির রস থেকে তৈরি মুসব্বর মধু মিশিয়ে খেলে কফে খুবই উপকার পাওয়া যায়।
লতা বললো, তবে যে বলে, য়্যালোভেরা চুলের গোড়া শক্ত করে, খুব ভালো কন্ডিশনারের কাজ করে?
বললাম,য়্যালোভেরার অনেক গুণ।ওর গুনের অন্ত নেই।
লতা বললো, আর পাথরকুচি না কি বললে?
বললাম,পাথরকুচির আর এক নাম পাষাণভেদী। গাছটি পাথর ভেদ করেও নাকি উঠতে পারে।গুণা গুণ,রক্তপিত্ত এ পাথরকুচির রস সকাল বিকাল দু চামচ করে খেলে রক্তপিত্ত আরোগ্য হয়।সর্দি হলে,মৃগিরোগে,প্রস্রাব না হলে, শিশুদের পেটব্যথায় পাথিরকুচি পাতার রস খুবই উপকারি।
লতা হাঁ করে সব শুনছিল, আর ওর পায়ের কাছে লুটোপুটি খাওয়া ছোট্ট সাদা স্প্যানিয়াল কুকুরটিকে কাতুকুতু দিছিল। কাতুকুতু খেয়ে ওটা পালাচ্ছিল আবার কাতুকুতু খাবার লোভে ফিরে ফিরে আসছিল।ওটা লতার খুবই অনুরক্ত। মায়ের হয়ে প্রক্সি দিতে আসলে,আগে ওকে আদর করলে তবে ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র মিলবে। লতা তার কাজের ফাঁকে ছাদে কাপড় মেলতে এসে দিব্বি আমার সাথে গল্প জুড়েছে।
আমার পায়েও একজন লুটোপুটি খাচ্ছে। তবে সে স্পানিয়াল নয় বেড়াল। আমার খুব নেওটা।সাদায় কালোয় মেনি। সব সময় পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে। লতাকে বললাম বেড়ালের কথা। বেড়ালের গল্পে লতা হেসে লুটোপুটি।কেন অত হাসলো ওই জানে।হাসির দমক থামলে বলল, বেড়াল তো মা ষষ্টির বাহন। তোমাদের বাড়িতে অনেক ছেলেপুলে হবে দেখো। বলেই হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো, বললো,কালো বেড়াল কিন্তু ভালো নয়।কেন ভালো নয় জিজ্ঞাসা করতে বললো,কালো বেড়াল ডিঙোতে নেই,কালো বেড়াল খুব অশুভ হয়।
আমার খুব রাগ হয়ে গেল শুনে।।বললাম, শুধুমাত্র কালো হবার সুবাদে ও অশুভ! লতাকে কোনো আঘাত করার ইচ্ছাই ছিল না।তবুও মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো, তোরও তো গায়ের রঙ কালো, তাহলে তুইও কি অশুভ?
লতা বোবা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, ওর মুখটা থমথমে হয়ে উঠেছে দেখে কথা ঘোরালাম, বললাম,বেড়ালরা যদি পরস্পর বলাবলি করে যে শুধু কালো মানুষ কেন কোনো মানুষ কেই বিশ্বাস কোর না, কখন যে ধাঁই করে ঢিল ছুড়ে মারবে তার ঠিক নেই।খুব সাবধান।কালো বলে তাচ্ছিল্য করিস না।
লতা থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে বললো, সুপারষ্টিশন, সুপারষ্টিশন।
চমকে উঠলাম।বললাম,লতা,তুই সুপারষ্টিশন জানিস? লতা ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলো যে সে শুধু জানে তাই নয় সে ও সব কিছুর ঘোরতর বিরোধী।বললাম, তুইকি একটু আধটু লেখাপড়া জানিস? লতা বললো, আমিতো স্টুডেন্ট।
তাচ্ছিল্য করেই বললাম,হ্যাঁ, তুই আবার স্টুডেন্ট! তা কোন কেলাশের ইস্টুডেন্ট?
লতা বললো,বিএ,ফিলজপিতে অনার্স, ফাইনাল ইয়ার।
এবার চমকাবার পালা আমার। আমি বোবা হয়ে শুনছি।ও বলে চলেছে,আজ কলেজ যাবো না তাই তোমার সাথে গল্প করছি।
আমি বলি, তুইতো আমাকে অবাক করলি, তুই বিএ অনার্স পড়ছিস,ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী! অথচ মায়ের প্রক্সি দিতে এসে বাসন মাজছিস।
তা তোর বয়েস কতো?
এই চব্বিশে পড়েছিগো দাদু।
মনে মনে বলি, দুত্তেরি,আবার সেই দাদু!
লতা আবার শুরু করল,জানতো দাদু,আমার দুটো বছর একদম নষ্ট হয়ে গেল। না হলে বি,এ, র গণ্ডীটা কবেই পেরিয়ে যেতাম।
তারপর খানিক উদাসী হয়ে বললো,জানতো দাদু, সব বাড়িতে প্রক্সি দিতে ইচ্ছা করেনা। এমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে যে ভীষণ অস্বস্তি হয়।দেখছো তো আমার কেমন ডেভেলপড ফিগার।
বললাম, হ্যাঁ, তাতো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু দাদু হয়ে গেলেও আমিও তো পুরুষ মানুষ।তোর সঙ্গে গল্প করছি, এতো কথা বলছি– তোর অস্বস্তি হচ্ছে না?
লতা বলল, ধুর, অস্বস্তি হবে কেন? তুমিতো আমার বন্ধু হয়ে গেছ।।তোমার কাছে অকপটে সব বলা যায়।
আমি অন্যমনস্ক হলাম,মনে মনে আমার এই চিন্তা হল যে,এইতো মাত্র ক মিনিটের পরিচয়।এরই মধ্যে লতা আমাকে এত বিশ্বাস করল যে আমাকে একেবারে বন্ধু বানিয়ে ফেললো!
লতা বোধহয় আমার মনের কথা পড়তে পারলো। বললো,তুমি কি ভাবছো বুঝতে পারছি। শুধু এইটুকু জেনে রেখো,আমরা,মেয়েরা,সে সুশ্রী হই আর কুশ্রী হই, পুরুষ মানুষের দৃষ্টি দেখলেই বুঝতে পারি সে দৃষ্টির মর্মার্থ কি। তুমি যখন আমার দিকে তাকাও, সে দৃষ্টিতে কোনো অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি। তোমার হয়তো মনে নেই তুমি আর একদিন আমায় বকেছিলে। বলেছিলে,এএই মেয়ে, কে রে তুই,ছাদে অমন করে হুটোপাটি করছিস? আমি কিন্তু রাগ করিনি। স্পানিয়ালকে নিয়ে আস্তে আস্তে নেমে গেছিলাম। ভেবে দেখেছিলাম,আমার দাদু বেঁচে থাকলে হয়তো ছাদে হুটোপাটি করার জন্যে অমন করেই বকা দিত।তোমার কথায় বা চোখের চাহনিতে খারাপ কিছু থাকলে তোমার কাছে য়্যলোভেরা চাইতামইনা।
বললাম,সে তুই ওদের বাড়ি থেকে আমার সম্বন্ধে শুনেছিস,তাই আমাকে ভালো চোখে দেখিস।অথবা এমন হতে পারে যে তোর দিকে যাতে খারাপ চোখে না তাকাই তার জন্যে আগাম সুরক্ষা নিয়ে রাখলি।
লতা এবার সত্যি আহত হোল।আবার মুখ ভার হয়ে উঠলো। প্রমাদ গুনলাম। কথা ঘোরালাম ,বললাম,লতা,তুই আজকে কলেজে যাবিনা?
কলেজের কথায় লতার মুখের থমথমে ভাবটা আস্তে আস্তে কাটল,মুখটা ওর ধীরেধীরে উজ্বল হয়ে উঠলো। আমার মনে ভরসা এলো। বললাম, হ্যাঁরে,তা বি,এ,পাসের পর কি করবি?
লতা মুচকি হেসে বললো, বিয়ে করে ফেলবো।
বললাম,এতো কনফিডেন্টলি যখন বলছিস,তোর পাত্র নিশয়ই ঠিক করা আছে।
আছেইতো,লতা বললো,আমার বয়ফ্রেন্ড। একটু থেমে বললো,ওর জন্যেই তো আমার দুদুটো বছর নষ্ট হোলো। এতদিনে এম,এ,টা আমার হয়ে যেত।
বললাম, সে কিরে,ও কি তোকে পরীক্ষায় বসতে দেয়নি?
লতা কেমন হেঁয়ালি করে বললো, ধরো একরকম তাই। একটু থেমে আবার বললো,ও এত জেদী যে বার বার পিল খেতে বলে।
দু দুবার কিউরেট করাতে হলো।
লতার বয়ফ্রেন্ডের কথা আর শোনা হয়নি।কেবল পড়া হয়েছিল,তাও আমার য়্যালোভেরা গাছের নীচে দলাপাকানো একটুকরো কাগজে। কদিন ছাদে ওঠা হয়নি। বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে গেছিলাম অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে।
ফিরে এসেইসেই ছাদে ছুটলাম,গাছগুলোর নিশ্চয়ই দফারফা হয়েছে।
য়্যালোভেরা গাছের তলায় দলাপাকানো কাগজের টুকরোটা পেলাম।
কাগজের টুকরো ,দলা পাকানো , এখানে থাকার কথা নয়।কৌতুহলী হয়েই ভাঁজ খুলে দেখি লতার চিঠি।লতা চিঠি লিখছে, দাদু নয়,বন্ধু সম্বোধন করে।।খুশী হলাম।পড়তে শুরু করলাম।
ও লিখেছে,তোমার নম্বরটা অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না। তোমার য়্যালোভেরা আর নেওয়া হল না।তুমি আমাকে ছাদে আসতে বলে নিজেই আসতে ভুলে গেলে। আমি আবার মা হতে চলেছি। দেখো, তুমি পুষলে বিড়াল,আর মা ষষ্টি কৃপা করল আমাকে।মনে পড়লো, বিড়ালের কথা শুনে কেন লতা হেসে কুটিপাটি হয়েছিল।
লতা লিখেছে আগের দুটোকে রাখতে পারিনি। আমার বয়ফ্রেন্ড দায়ীত্ব নিতে অস্বীকার করেছে।
লতার কথা প্রকাশ্যে আনার পরে,
লতার পরিণতির জন্যে তো বটেই অনেকেই লতার পরিণতির কথা ভেবে বিচলিত হয়েছেন, অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন,কিন্তু আমরা জানি শহরে কাজ করতে এসে, বা মায়ের কাজের বাড়িতে প্রক্সি দিতে আসা লতারা কেউ হারিয়ে যায়,অন্ধকার অমানিশায়, কেউ বিক্রী হয়ে যায় কোনো ধনীর গুহায়, কেউ বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
কেউ কেউ কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকে, ধ্বসে যাওয়া, পচে যাওয়া,গলে যাওয়া সমাজের নর্দমার ধারে, নামহীন,গোত্রহীন, রক্তহীন,বর্ণ গন্ধহীন সংসারে রুগ্ন শিশু পয়দা করতে করতে অপুষ্টি আর অনাহারে নিঃশেষে জীবন দান করে আঁস্তাকুঁড়ের ধারে। কেউ বা লোকের বাড়িতে কাজ করে উদ্বৃত্ত উচ্ছিষ্ট খেয়ে কোনো মতে জ্বেলে রাখে জীবনের আলো।
তারপর,তারপর হারিয়ে যায়,অস্থির সমাজের বলি হয়ে, শহরে,শহরতলীর বস্তিতে, গ্রামে গঞ্জে, ধান ক্ষেতে,পাটক্ষেতের ধারে, কাদায় মধ্যে মুখ গুঁজে মেরে শুইয়ে রাখা হয়, ধর্ষণের পরে গলা টিপে অথবা ফাঁস লাগিয়ে মুখ বিকৃত করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, প্রমাণ লোপাট করার জন্য আগুন লাগিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেয় । এমন শত সহস্র লতারা সমাজের বুক থেকে স্রেফ হারিয়ে যায়। দু চার দিন লেখালেখি হয়, কেউ কেউ নড়ে চড়ে বসে, তারপর সব থিতিয়ে যায়। সমাজ সংসার দেশ আবার নিরুত্তাপ উদাসীনতায় এগিয়ে চলে। আবার রাত্রি নামে, আবার অন্যায় অত্যাচার ব্যাভিচার ধর্ষণ হয়, কেউ ধরা পড়ে বেশীর ভাগ প্রমাণাভাবে পার পেয়ে যায়, বিচার দীর্ঘায়িত হয়, এই ভাবেই লতাদের ভাগ্য আবর্তিত হয় সমাজের পঙ্কিলতায়।
লতার চিঠিটা পড়তে পড়তে,বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছিল।কষ্ট কত গভীর হতে পারে,ভালোবাসা কত হৃদয় বিদারক হতে পারে,আত্মত্যাগ কত মর্মস্পর্শী হতে পারে,একদিকে তার যেমন পরিচয় পাচ্ছিলাম ওর চিঠিটার ছত্রে ছত্রে সেই সঙ্গে পরিচয় পাচ্ছিলাম ওর মানসিক দৃঢ়তার। গঙ্গাদেবীর মতো সন্তান বিসর্জন দিয়ে নয় বরং সেই সন্তানের জন্যে ওর আত্মত্যাগের অঙ্গীকার ভেতরে ভেতরে ওর ইস্পাৎ কঠিন লড়াইয়ের মানসিকতায় ধন্য মনে করেছি নিজেকে এই ভেবে, যে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও লতার মত একজন বন্ধু আমি পেয়েছি।
ও লিখেছে আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম কানাই। ওকে ভালোবেসেছিলাম অন্ধের মতো। ওর দাবীকেই প্রশ্রয় দিয়ে ওর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি।প্রথম যখন আমার শরীরে আর একজনের অস্তিত্ত্ব টের পেলাম, ভয় পেয়েছিলাম প্রচন্ড।
লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি। মনের ব্যথা মনে চাপতে গিয়ে ততদিনে নিজের সর্বনাশ করে ফেলেছি।ছুটে গিয়েছি ওর কাছে। যেন কিছুই হয়নি মুখ করে ও আমায় নিয়ে গেল ডায়মন্ড হারবারের এক ক্লিনিকে। গর্ভ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেলাম।
তারপর ওর সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।কিন্তু,বড়লোকের বখাটে ছেলে,নানা আছিলায়, লোভ দেখিয়ে,ভয় দেখিয়ে আবারও আমার গর্ভে বীজ পুতে দিলো। আবার একই কায়দায় আমাকে মুক্তও করল।
কিন্তু বুঝতে পারলাম যে চেষ্টা করেও অজগরের গ্রাস হতে আমি মুক্ত হতে পারবো না। যে বাঘ একবার নারী রক্তের স্বাদ পেয়েছে,সে বারবার হানা দেবেই।আমার প্রতিরোধ যখন তৃতীয় বারে ভয়ঙ্কর হয়েছিল,ও আমার মাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।আমাকে বেচে দেবার কথা বলে।আমরা শহরে এসে মায় বেটিতে কোনোরকমে অন্নসংস্থান করে থাকি।ও সারাক্ষণ ছায়ার মতো পেছনে লেগে থাকে।আমরা অসহায়ের মতো ওই অজগরের গ্রাসেই পড়ি।
তবে এই শেষ বার।ওর নামে অবৈধ সহবাসের নালিশ করেছি থানায়।ওর হুমকির কথা জানিয়ে আইনি সাহায্য চেয়েছি।ইতিমধ্যেই ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা পড়েছি বিপদে।আমাদের বস্তি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।সেই বড়লোকের বেটা কানাই পয়সা ছড়িয়ে, নেশার জিনিস বিলিয়ে বস্তির ছেলেদের হাত করে রেখেছে।এখানে আর থাকতে পারবোনা।
আমি অজ্ঞাত বাসে চললাম বন্ধু। সেই অজ্ঞাত বাসে আমার সন্তানকে আমি বজ্র দিয়ে গড়ে তুলবো। গাণ্ডীব তুলে দেব ওর হাতে। যারা সর্বনাশ করবে বলে নারীমাংস খুবলে খায়,যারা সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই মেরে ফেলতে চায়,যারা ধর্ষকামী,যারা নারীদের নিয়ে ব্যবসা করে,তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মন্ত্রে আমার সন্তানকে আমি দীক্ষিত করবো।
দাদু বা বন্ধু, তোমাকে যে নামেই আমি ডেকে থাকিনা কেনো আমার মতো দুঃখিনী মেয়েদের কথা তুমি লিখে রেখো। বিদায় বন্ধু। যাবার সময়ে তোমাকে প্রণাম করে যাব ভেবেছিলাম।সেটা আর হোলো না।শুধু দূর থেকে তোমার আশীর্বাদ চাইবো। যাবার বেলায় শুধু এইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে যাই,যে এ জীবনে অন্তত একজন মানুষ আমি পেয়েছি,যার চোখে কোনো লোভ দেখিনি।আসি বন্ধু।
লতার চিঠি শেষ।হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে উপচে আসা অশ্রুবারি চশমাকে ঝাপসা করে তুলেছে।
য়্যালোভেরা গাছটার দিকে স্তব্ধ হয়ে ঝাপসা চোখেই তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মনে মনে বিড় বিড় করলাম, অহল্যা,দৌপদী,কুন্তী, তারা, মন্দোদরী স্তথা। পঞ্চকন্যা স্মরেনিত্যং মহাপাতক নাশনম।ষষ্ঠ কন্যার নাম আমি যোগ করলাম, তার নাম হলো লতা। -
কবিতা- সুখ দুঃখ
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সুখ দুঃখ
-অনিমা দাসসুখ দুঃখে গড়া জীবন
তাদের নিয়েই চলা ,
দুঃখ আসবে সুখ আসবে
নিয়মের এই খেলা ।দুখের পরে সুখ যে আসে
জীবনের এই খেলায় ,
দুঃখে মোরা ভাসবো নাতো
থাকবো না তো হেলায়।সুখ দুঃখ পাশাপাশি
বড়ই কাছাকাছি ,
সুখ দুঃখ নিয়েই আমারা
সহজ ভাবে বাঁচি।চলছে খেলা জগৎ জোড়া
দুলছি মোরা দোলায় ,
জগতের এই কঠিন খেলায়
জ্বলছি শুধুই জ্বালায়।সত্য কখনো মিথ্যা হয়
মিথ্যা কখনো সত্য ,
গায়ের জোরে সব হয়ে যায়
লাগে না কোন তথ্য ।সুখ দুঃখের জোয়ার ভাটায়
ধরো শক্ত করে হাল ,
সামলে চলা এগিয়ে যাওয়া
থাকবে চলার তাল ।সুখ পেতে চায় জনে জনে
থাকে সবার মনে ,
দুঃখ সে তো ,যায় না ভোলা
থাকে সবার সনে। -
কবিতা- যেদিন রবো না
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
যেদিন রবো না
-অমর দাসযেদিন রবো না পৃথ্বী মাঝে আমি যে তোমার
সেদিন এই পৃথিবীটা তোমার হবে যে অন্ধকার ।
যে প্রেম দিয়েছো মোরে আর না লভিবো আমি।
যে প্রেম দিয়েছি তোমায় সে যে ফুরাবে জানি।
কত দুঃখ দিয়েছি তোমায় আর কত যে বেদনা,
তবু তুমি মোরে দিয়েছো সুখ দাওনি তো যন্ত্রণা ।
সারা জীবন মুখ বুজে সহেছো কত ক্লেশ সীমাহীন,
স্নিগ্ধ শীতল স্বভাবে কর্ম করেছো তুমি বিরামহীন।
রোগগ্রস্ত হতভাগ্য মোরে তুমি দিয়েছো যে সাহারা,
তুমিই তো হয়েছো মোর বন্ধু যখন আমি দিশেহারা।
কখনো আমি হয়েছি তোমার দিশা তুমি যে আমার,
রবোনা যেদিন বিশ্বমাঝে এ পৃথিবী মোর অন্ধকার।
কত ভালোবাসা দিয়েছি আমি মোর সন্তানের তরে।
শুনবো না “বাবা” ডাক যবে রবোনা ধরণী পরে।
জন্ম মৃত্যুর এ যে কি খেলা কাহারো তো মুক্তি নাই
জন্ম মৃত্যুর মাঝে দেখো মোদের কোথাও নেই ঠাঁই।
জানি আমি অনেক অভিমান আছে আমার উপরে
লয়ে যাবো সাথে সব অভিমান মুক্ত করি তোমারে।
যতো সুখ আছে আমার সব দিয়ে যাবো তোমারে।
যতো দুঃখ দিয়েছি তোমায় ফিরিয়ে দাও মোরে।
শিক্ষা, দিক্ষা, প্রেম-প্রীতি,ভালোবাসা,আর সংস্কার
পড়ে রবে সবই মোর যবে চলে যাবো মরনের ওপার।
আমার শৈশব, কৈশোর আর আমার জীবন যৌবন,
আজ হয়েছে ইতিহাস ,নেই যে যৌবনের কলতান ।
চারিদিকে শুধু শুনিতে যে পাই আহ্বান ওপারে ।
যেতে হবে ওপারে তোমায় আমায় বিধাতার বিচারে।
যাবার বেলায় শুধু বলে যাই কখনো ভুলোনা মোরে।
তোমার স্মৃতি লয়ে চলে যাবো আমি মরনের ওপারে। -
কবিতা- তুমি আর আমি
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
তুমি আর আমি
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আমি তোমাকে পাত্তা দিচ্ছি,
অথচ তুমি পাত্তা পেতে চাইছো অন্য কারো।
কিন্তু সে তোমাকে চিনছেইনা।তুমি হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছো তাকে,
আমি হয়তো তখন তোমারই অপেক্ষায়।আমি প্রেমের চাদরে ঢাকতে চাইছি তোমাকে,
তুমি হয়তো তখন ব্যস্ত অন্য কোনো প্রেমে।আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছি তোমার দিকে,
তুমি তখন হাত পাতছো তার কাছে।
আমি তখন অপেক্ষায় তোমারই দরজায়।
আমি তাকিয়ে আছি তোমার দিকে।
তুমি আমায় দেখেও দেখছোনা।এমন করে কত ভালোবাসা,অপেক্ষার দিন কেটে যাচ্ছে।
তুমি যেন একবগ্গা জেদী ঘোড়া।
যত টেনে ধরছি সে মুখ আমার দিকে –
তত যেন তার জেদ বাড়ছে।
আমি যেন শুনতে পাচ্ছি,
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে
দূরে, বহুদূরে।কিন্তু দূর থেকেও ভালোবাসতে
আমার ভালো লাগে।
অনন্ত অপেক্ষায় থাকতে
আমার ভালো লাগে।
যেমন ভালো লাগে
অমলতাসের হলুদ ফুলের
গুচ্ছে প্রজাপতির খেলা দেখতে।
পাখীর কিচিরমিচির, খোলা আকাশে
ডানা মেলে উড়ে যাওয়া দেখতে।
হয়তো কিছুই পাবোনা জেনেও,
আমি শুধু তোমায় ভালোবাসবো,
তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
যেনো এমন ভালোবাসাও কিন্তু সহজ নয়।। -
কবিতা- রম্য কল্পনা
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
রম্য কল্পনা
-তমাল হাইতএকটা সকাল আলসেমি মাখা,
হঠাত ই মনে পড়ে তাকে, চেয়েছি বারেবারে যাকে।চকিতে মেসেজ, “আছো নাকি একলা ঘরে”!
ফিরিয়ে দিল উত্তর নিমেষে,
আমায় অবাক করে!“আছি একলা বসে নিরালায়, তোমার কি খবর ?
হঠাত ডাকলে যে বড়, হতে চাও নাকি যাযাবর!”ওই একটি কথায়, আশকারা পায় আমার চঞ্চল মন,
নিমেষে উধাও আলসেমি যত, ভেঙে ফেলতে উদ্যত সব বারণ।কল্পরাজ্যে হারাই দুজনে আদুরে স্পর্শে নব জাগরণ!
কামনার ভাষা দুই চোখ বোঝে,
কারণ খোঁজা মানা অকারণ।লেহিত চরণ সংযম ভাঙে, কামনার শীৎকার,
দলিত মথিত দেহপল্লব,
একে অন্যের শিকার।তীব্র আবেশে সঙ্গম সুখে, সমুদ্র হোক তোলপাড়,
কামনার নারী দিতে অমৃত বারি, এসো ফিরে বারবার। -
গল্প- পাশেই আছো মা
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
পাশেই আছো মা
– রাণা চ্যাটার্জীকইগো শুনছো জানলা দিয়ে সকালে আলো ফুটতে না ফুটতেই ধড়ফড় করে উঠে বসল তৃণা। অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা রজতকে ঠেলেই চলেছে। “উফ কি হলো কি”!
জানো আজকে স্বপ্ন দেখলাম মা কে।এই নিয়ে প্রায় সাত বার গো।বলছি হ্যাঁ গো এটাও কি সম্ভব বলো!!
“আচ্ছা গো,আর একটু শুয়ে নেই,উঠে বলছি” বলেও আর ঘুম এলো না রজতের।”মনটা প্রসন্নতা য় ভরে উঠেছে তার ।মা আজ প্রায় দেড় বছর নেই,অসম্ভব যন্ত্রণা কাতর মুখ নিয়ে দুরারোগ্য ব্যাধিতে অনেক বছর কষ্ট সহ্য করে বেঁচেছিলেন। শয্যাশায়ী হলেও আপ্রাণ মনোবলে শরীরের কষ্ট উপেক্ষা করে সকলের দিকে ছিল সমান নজর।নতুন বিয়ে হয়ে আসা এবাড়ির বউ তৃণা কে ভীষন স্নেহ করতেন মা।”যা তুই পড়তে বোস,আমি সব সামলে নিচ্ছি” এমন ভাবে সাপোর্ট কজন শাশুড়ি করে! অতীত থেকে চলে আসা একটা ভুল ভাবনা শাশুড়ি আর বৌমা বুঝি দুই প্রতিপক্ষ সেটা এ বাড়ীতে এলে কারোর বোঝার উপায় থাকতো না এরা দুজন মা মেয়ে না শাশুড়ি বৌমা! একটা নিখাদ বন্ধুত্ব যে কত সুন্দর ভাবে ডালপালা মেলতে পারে, পল্লবিত হয় তার চরম সুন্দর দৃষ্টান্ত ছিল তৃণা ও শাশুড়ি সবিতা।দুজনের মধ্যে ছিল দারুন একটা এডজাস্টমেন্ট যা অন্যদের ঈর্ষান্বিত করত। দুপুরে খাওয়া শেষ হলে কাজ গুছিয়ে চলতো দুজনের নিটোল গল্পের আসর।সময়ের সাথে সাথে সংসারে বহু বাধা-প্রতিবন্ধকতা এসেছে, বাইরের লোকের আক্রমণ ।”ও দিদি রান্নাঘরটা ছেড়ে বউটাকে কাজে লাগাও” “ওর যখন সময় হবে ঠিক দায়িত্ব বুঝে নেবে”এমন চাঁচাছোলা উত্তরে থেমে যেত প্রতিপক্ষ।
যেদিন সবিতা দেবীর মৃত্যু হল কে জানতো তৃণা ও রজতের হাতে দুপুরের শেষ খাবার টা খেয়ে শান্তির ঘুমের ঢলে পরবেন উনি । খেতে খেতে জড়িয়ে যাওয়া গলায় বারবার বলছিলেন, তার নিজের স্বর্গীয়া দিদির নাম করে,’ ওই দেখ ওই দেখ দিদি ডাকছে আমায়!”বিষয়টা আজ ভাবলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ওঠে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর যন্ত্রনা।
ব্যালকনিতে সবিতা দেবীর যে মালা পড়া ছবিটা রয়েছে, প্রত্যেকটা দিন ঘুমাবার আগে রজত হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মায়ের সঙ্গে সব কথা শেয়ার না করলে তার যে ঘুম আসবে না !যেন মা তাকিয়ে বলে, যারে সকালে উঠতে হবে অফিস জার্নি, শুয়ে পর।তৃণা প্রায়শই স্বপ্ন দেখছে আর বলছে জানো আজও মা কে দেখলাম কি সুন্দর স্নান সেরে নতুন শাড়িটা পরে বেঞ্চে বসে।আমি পড়ছিলাম মাথায় হাত রেখে বলছে যা খেয়ে নে,।এর পর দুজনে প্রতিদিনের মতো সবজি বাজার বেরুলাম। অবাক কান্ড কি জানো, মা একদম সুস্থ,নিজেই হেঁটে বাজার যাচ্ছে। পাড়ার সবাই দেখে খুব অবাক যে মানুষটার শেষ কয়েক
বছর হুইল চেয়ারে কেটেছে একদম নিরোগ,সূর্যের আলোয় আলোকিত।ঘুম থেকে উঠে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মন খুশিতে ভরে উঠলো রজতের।মনে মনে বললো আমি তো জানি মা, তুমি কেবল ছবি নও এ সংসারের রক্ষাকারী,সব সময় আমাদের পাশে আছো।যেখানেই থাকো ভালো থেকো মা,প্রণাম তোমায়।
-
কবিতা- একটি মেয়ের গল্প
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
একটি মেয়ের গল্প
-পাপিয়া ঘোষ সিংহশ্যামল ঘেরা গ্রামের মাঝে ছোট্ট মাটির ঘরে,
একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা সোহাগে – আদরে।
তন্বী মেয়ের হাসির পরশ থাকতো লেগে মুখে,
এমন করেই কাটছিল দিন, আনন্দে ও সুখে।মনেতে বসন্ত এলো,ফুটলো হাজার ফুল,
ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে প্রেমেতে মশগুল।
রূদ্র তোমার ও রূপ দেখে তন্বী পাগলপারা,
তোমার নিবিড় চাউনি তাকে করলো দিশেহারা।এখন মেয়ের চোখের কোণে শ্রাবণ লেগে থাকে,
মেঘের গায়ে উদাস হাতে জলছবি সে আঁকে।
রাতজাগা তার দুটি আঁখির কাজল যায় ধুয়ে,
একদিন তো ঘুমোতে যেত স্বপ্ন ভরে নিয়ে।স্বপ্ন গুলো ধূসর মরু, ফুল ফোটে না বাগে,
তন্বী মেয়ে আর কাঁদে না গভীর অনুরাগে।
তোমার ও বুক আকাশ হয়ে দেয় না যে আর ঠাঁই,
মন ভাঙার শব্দে কেবল চমকে ওঠে তাই।এখন মেয়ে হাতড়ে মরে ছোট্ট মাটির ঘর,
যেখানেতে সবাই আপন, কেউ ছিল না পর।
যেখানেতে ছিল না তো নিন্দে – অপমান,
জানতো না সে জীবন মানে কান্না- প্রহসন।মেয়ের চোখে এখনো ভাসে আবছা এক ছায়া,
আসবে তুমি আবার নিয়ে অনুরাগের ছোঁয়া।
ভালোবাসা বাঁধবে যে ঘর মন্দবাসা ছেড়ে,
সেই মেয়েটি ভালোবেসে বাঁচবে নতুন করে।