স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
-
গল্প- ফেরিওয়ালা
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
ফেরিওয়ালা
-উজ্জ্বল সামন্তস্টেশনে দাঁড়ায় ছুটে এসে, বাড়ি থেকে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটেই আসতে হয়। একটা ভাঙা সাইকেল ছিল কিন্তু সেটা বয়সের ভারে অকেজো হয়ে গেছে। সেই ভোর বেলায় উঠে নানা রকম কাঁচামাল কেটেকুটে রেডি করে মালপত্র গুছিয়ে ব্যবসায় বের হতে হয়, অনেকদিন ধরেই এই রুটিন চলছে। সকালের প্রথম ট্রেনটা মিস হয়ে গেল। ওখানে অনেক ডেলি পেসেঞ্জার যাতায়াত করে। বেশ কিছু বিক্রি হয় । মদন মজুমদারের মসলা মুড়ি খাইনি এমন কোন ডেলি প্যাসেঞ্জার নেই ওই ট্রেনে।
শিয়ালদায় নেমে আবার এ লোকাল সে লোকাল ট্রেন ধরে সারাদিন বিক্রি করে। দুপুরে এক ফাঁকে শিয়ালদার স্টেশন সংলগ্ন রাস্তার হোটেলে ভাত খেয়ে নেয় । সবজি ভাত। প্রতিদিন তো আর মাছ ,মাংস ,ডিম জোটে না। কতটুকুই বা বেচাকেনা হয়। বাড়িতে দুটো বাচ্চা মেয়ে আছে । ওদের জন্য সপ্তাহে একদিন একটু মুরগীর মাংসের ছাঁট নিয়ে যায়। মেয়ে দুটো বড্ড ভালোবাসে খেতে। স্কুলের মিড ডে মিলে একটা করে ডিম দেয়। দুটো ডিম মেয়েরা লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে আধখানা করে চারজন মিলে খায় রাত্রে । ওইটুকু মেয়েও বোঝে তারা গরীব।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, এক পিস চিকেন, ভাত খাওয়ার সময়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনা। কোনরকমে ভাতগুলো মুখে ভরে। মুড়ির বাক্স সমেত ঝোলা নিয়েই স্টেশনের বাইরে ৪/৫ জন হকারকে মসলা মুড়ি বানিয়ে দিয়েই স্টেশনে ছোটে লোকাল ধরতে। স্টেশনের বাইরে ওই হকার গুলো প্রতিদিন ওর কাছে মসলা মুড়ি কিনে খায় দুপুরে। অনেকদিন হয়ে গেল একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। পুজোর আগে স্টেশনের বাইরে ১জন হকার মেয়ে দুটোর জন্য জামা দেয় বিনামূল্যে। বেশ কয়েক বছর দিয়ে আসছে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। কাল রাতের ঝড়ে ঘরের টালির ছাদে কটা টালি ভেঙেছিল। প্রচুর বৃষ্টি তে ঘর প্রায় জলে ভেসে গেছে। সারারাত চারটি প্রাণীর কোন ঘুম নেই। কোথাও বালতি কোথাও হাড়ি কোথাও থালা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। তাই বুঝি নিজেই ওদের বস্তি থেকে একটা মই জোগাড় করে টালি গুলো বসাবে। ধার করেই টালি লাগাবে এখন। অমর দা বলেছেন পরে টাকা দিলেই হবে।
অন্য মনস্ক হয়ে ট্রেন থেকে রানিং অবস্থায় নামতে গেলে বৃষ্টিভেজা প্লাটফর্মে পা হড়কে ট্রেনের স্লিপারের নিচে পা আটকে যায়। ফাস্ট প্যাসেঞ্জার স্টেশনে থামলে ,প্ল্যাটফর্মে মদন অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ মারাত্মক জখম হয়েছে। হাড় ভেঙে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। আরপিএফ বা অন্যান্য হকাররা ছুটে আসে। মদন কে সরকারি হসপিটালে ভর্তি করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও অপারেশন করে মদনের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। এর কিছু দিন পরই অতি মারির প্রকোপ শুরু হয়। লকডাউন চলতে থাকে। বাস-ট্রেন সব বন্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। বাড়ি ফিরে এসে মদন বিছানায়। সুস্থ হতে মাস খানেক সময় লাগবে।
সংসারের বেহাল অবস্থা। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটানো এখন চিন্তার। ওর স্ত্রী দু বাড়ির ঝিয়ের কাজ করতো। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের কারণে বাড়ির মালিক বারণ করেছে কাজে আসতে। ওর মধ্যে এক বাবু বলেছেন তোকে কাজে আসতে এখন হবেনা । আমি মাস মাইনে দিয়ে দেবো। ওর অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে বস্তির আরো তিন চার জন হকার বন্ধু এসেছিল, যে যা পেরেছে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য করেছে। কিছুদিন আগে একটা এনজিও এসে চাল ডাল তেল নুন দিয়ে গেছিল। ওই কটা দিন মোটামুটি চলেছে। রেশনের ফ্রী চাল ও গম পেয়েছে তাই এক বেলা কোন রকমে কিছু মুখে তুলতে পারছে। কিন্তু তারপর কি হবে , এই ভেবে ভেবে মদনের রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে। একটা কৃত্রিম পা লাগাতে গেলেও অনেক খরচা। কোথায় থেকে পাবে এত টাকা!
হকার বন্ধু অজয় আজ সন্ধ্যায় এসেছিল মদনের সঙ্গে দেখা করতে। লকডাউনে তার ও তাদের মত হকারদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বস্তির কয়েকজন ছোঁয়াচে রোগের কারণে মারা গেছে। ওদের এক হকার বন্ধু গতকাল রাতে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভাল না। মদন ক্র্যাচ নিয়ে ওকে এগিয়ে দেয়। বলে লকডাউন উঠে গেলে আর ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতে পারবে না। অজয় বলে স্টেশনের বাইরে তুই একটা ব্যবসা কর। হকার ইউনিয়নের সেক্রেটারিকে বলে একটা জায়গার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। আমি অশোকদা কে বলে দেব।মহাজনকে বলে ব্যবসার কিছু মালও বিনা অ্যাডভান্সে করে দেবো। তুই এত চিন্তা করছিস কেন ? মদন। আমি তো তোর বন্ধু, এখনো বেঁচে আছি !…..
-
প্রবন্ধ-নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
– শিলাবৃষ্টিভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল “
– কবি অন্নদাশংকর রায়ভূমিকা :~
বাংলা কাব্য জগতে – হাতে অগ্নিবীণা, ও রণতূর্য, মুখের বাঁশের বাঁশরী আর রোমান্টিক কবিমন নিয়ে ধূমকেতুর মতই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। তাঁর কবিতা ও গানে একই সঙ্গে বিদ্রোহের, পৌরুষের ও যৌবনের বেদনার ভাষা বানীরূপ লাভ করেছে । রবীন্দ্রোত্তর – কাব্যজগতে নজরুল রবিতাপে কিন্তু হারিয়ে যাননি ; বরং রবীন্দ্র মায়াজাল ভেঙে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন।জন্ম :~
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের চব্বিশে মে (বাংলা ১১ই জ্যেষ্ঠ) অতি দরিদ্র এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা – কাজী ফকির আহমেদ, মাতা – জাহেদা খাতুন। বাল্যনাম – দুখুমিঞা। দারিদ্র্যতার কারণে শৈশব থেকেই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নজরুল।প্রতিভার প্রেরণা :~
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁরও সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল। দেশে ফিরলেন অনেক রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে। বুকে ছিল পরাধীনতার দুঃসহ বেদনা। রচনা করলেন “রিক্তের বেদন”। আবির্ভূত হলেন – বাংলার কাব্যাকাশে। তিনি বিদ্রোহের কবি, বৈভবের কবি।গজল :~
সঙ্গীতের প্রতি নজরুলের অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই। কবিতা রচনার সাথে সাথে তিনি রচনা করেছেন সঙ্গীত, করেছেন সুর সংগ্রহ। অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। যেহেতু প্রবন্ধের বিষয় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত, সেহেতু গজলের প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।
বাংলা গজল গানে নজরুল সার্থক স্রষ্টা। পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যই গজলের জন্ম। গজলের দুটি অংশ –
১) অস্থায়ী এবং ২) অন্তরা। অস্থায়ী অংশ সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হয়, অন্তরা তাল ছাড়া, এই অংশকে বলা হয় – শের বা শেয়র। গজল গানে নজরুল নানারকম রাগ রাগিনী এনেছেন। মূল কাঠামো ঠিক রেখে তিনি – ঠুংরী ও দাদরার আঙ্গিকে বেশ কিছু গজল রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি গান – “উচাটন মন ঘরে রয়না”, “আধো আধো বোল লাজে”।
আবার বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রনে নতুন ধারার গজল সৃষ্টিতে তিনি অতুলনীয়।
বাগেশ্রী এবং পিলু রাগের মিশ্রনে তিনি সৃষ্টি করলেন –
“চেয়োনা সুনয়না ” দুটি বিপরীতমূখী রাগ এই গানে একাত্ম হয়ে গেছে। “আমার যাবার সময় হল”,”পাষানের ভাঙলে ঘুম “- অসামান্য দুটি গজল। নজরুলের গজলের কয়েকটি বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যেমন – তাঁর হাতে –
১) বিদেশী শব্দগুলো একেবারে “বাঙালি” হয়েগেছে।
২) আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করেছেন।
৩) বাংলা সঙ্গীতে নজরুলের গজল একটি বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে বিত্তশালী এবং মুটে মজুরের গানের যে সীমারেখা ছিল – নজরুলের গজল যেন একটি যাদুকাঠিতে সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। “বাগিচায় বুলবুলি তুই” বা “কে বিদেশী, মন উদাসী” গজল গুলি জাত বেজাতের সীমা লঙ্ঘন করল। তাঁরই একটি গানে বলব – “পাষানের ভাঙালে ঘুম, কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়? ” ।শ্যামাসঙ্গীত :~
ভক্তিগীতি রচনায় নজরুল
যে অসাধারনত্ব এনেছেন – তা তাঁর আগে কারোরই বোধহয় সম্ভব হয়নি। তাঁর ভক্তি গীতির সংখ্যা – কৃষ্ণ, শ্যামা ও ইসলামী মিলিয়ে প্রায় ৭-৫০। এই গানগুলি এক অপূর্ব আলোয় ঝলমল করছে।
যে তিনটি শ্যামাসঙ্গীত প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে – সেগুলি – শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ,বলরে জবা বল, কালো মেয়ের পায়ের তলায়।শ্মশানে জাগিছে > কৌশিক / ত্রিতালে রচিত। আশাবরী ঠাট, মালকোশের প্রভাবে – অপূর্ব এটি একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ কালীস্তোত্র। শ্মশান কালীর এই রূপ আর কোথাও পাওয়া যার না।
বলরে জবা বল -> গানটি ভাষার সারল্যে কাব্য সৌন্দর্যে বাঙালীর হৃদয় হরণ করেছে।
কালো মেয়ের পায়ের তলায় -> গানটি মিশ্র আশাবরী রাগে দাদরায় নিবদ্ধ। অসাধারণ সুর সংযোজনায় গানটি অতুলনীয়।।
এছাড়াও বেহাগ খাম্বাজ / দাদরায় – বক্ষে ধরেন শীব যে চরণ ;
দেশ খাম্বাজ / দাদরায় – আমার মুক্তি নিয়ে কী হবে মা, তুই লুকাবি কোথায় কালী।
নজরুলের এই সুরের সাম্রাজের বিশালতা শুধু অনুভব করতে হয়।উপসংহার :~
বঙ্গ সংস্কৃতির এক গৌরবময় সম্পদ নজরুলের গজল ও শ্যামাসঙ্গীত সহ সমস্ত গান। নজরুল গীতি যেন – অমৃত সুরসুধায় সিক্ত এক অপূর্ব আস্বাদন সামগ্রী। তিনি বলেগেছেন – “গান আমার আত্মার উপলব্ধি”। -
গল্প- মানবিক ও অমানবিক
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মানবিক ও অমানবিক
–অমিত কুমার জানামেদিনীপুর শহরের গোলাপীচকের যুবক ছেলে সুভাষ পেশায় মারুতি ড্রাইভার। সে তার বয়স্ক বাবা এবং অসুস্থ মায়ের সঙ্গে এককামরার একটা একতলা বাড়িতে থাকে। ওর মা মারাত্মক ‘নার্ভ ডিসঅর্ডার’ রোগে আক্রান্ত। ড্রাইভারি করে ওর যা উপার্জন হয় তার বেশিরভাগটাই মায়ের ওষুধ কিনতে খরচ হয়ে যায়। তবুও এতটুকু বিরক্ত না হয়ে মাতৃসেবা থেকে সুভাষ নিজেকে কখনও বিরত রাখে না।মা অসুস্থ থাকায় রান্নাবান্নার কাজটাও তাকেই সামলাতে হয়। প্রতিদিন সকালে রান্নাবান্না এবং স্নান, খাওয়া সেরে নটার মধ্যে মালিকের মারুতি নিয়ে সে চলে আসে কেরানীটোলায়। ওখানে অনেক মারুতির সাথে সেও অপেক্ষা করে ভাড়া ধরার জন্য।
সুভাষের একটি বিশেষ গুণ হলো পরোপকার। অপরের বিপদে আপদে নিজের সমস্যাকে হেয় করে সে সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই তো মাসখানেক আগের কথা:
সুভাষ মারুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল রোডের পাশেই। হঠাৎ দুটো মোটর বাইকের মুখোমুখি এক্সিডেন্ট। একজন বাইক আরোহী লুটিয়ে পড়লো রোডের উপরে । তার অচেতন দেহ থেকে রক্তস্রোত বেয়ে পড়ছিল। সুভাষ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মারুতিতে করে আহত আরোহীটিকে পৌঁছে দিয়েছিল নিকটবর্তী জেলা হাসপাতালে। ডাক্তার তার খুব প্রশংসা করে বলেছিল যে বেশি দেরী হলে অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য বাঁচানো সম্ভব হতো না। এতে সুভাষ যেন অমূল্য পুরস্কার প্রাপ্তির এক অনাবিল আনন্দ পেয়েছিল। কেননা আর যাই হোক সে একটা জীবন বাঁচিয়েছে তো।প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও সুভাষ মারুতি নিয়ে কেরানীটোলায় পৌঁছেছিল যথাসময়ে। মারুতির মধ্যে বসেই ছিল সে। কিন্তু সেদিন তার পেট ব্যথা করছিল খুব। হয়তো বদহজম হয়ে গেছিল। সে আর বিলম্ব না করে পার্শ্বস্থ মেডিসিন শপে গেল অ্যন্টাসিড কিনতে। তার চোখে পড়লো দোকানের সামনেই পড়ে রয়েছে এক বান্ডিল টাকা। প্রথমে সে হকচকিয়ে গেল। তারপর টাকার বান্ডিলটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল বান্ডিলের সবকটি নোটই দুহাজারের। গুনে দেখলো মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা রয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ ওই মেডিসিন শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে এটা ওদের কারও কিনা। দু একজন মিথ্যা বলে ঐ বান্ডিলটা আত্মসাৎ চেষ্টাও করলো। অথচ যে হতভাগা মারুতি চালিয়ে সামান্য উপার্জন করে মায়ের জটিল রোগ নিরাময়ের চেষ্টায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে তার ঐ টাকার প্রতি কিঞ্চিৎমাত্র লালসা নেই। সত্যিই এ যুগেও কোন কোন মানুষের অভাবেও স্বভাব নষ্ট হয় না। সুভাষের মতো কেউ কেউ শত কষ্ট নির্বিঘ্নে সহ্য করেও অমূল্য মানবতা ও সততাকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
এই ঘটনার মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখানে হাজির হলো বহুমূল্য প্যান্ট শার্ট পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এসে না এসেই মেডিসিন শপে জিজ্ঞেস করলেন ,-“আমি এইমাত্র আপনার দোকান থেকে ফিরে গেছি। কিন্তু আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল এখানেই পড়েছে বোধহয়। কেউ যদি…”
শপকীপারের মুখ থেকে শুনলেন ঐ ভদ্রলোক শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ ।নাম প্রকাশ রায়। সুভাষ প্রকাশ রায়ের নামটা কোথায় যেন শুনেছে। সে প্রাণপণ মনে করে চেষ্টা করলো।
সুভাষ টাকার বান্ডিলটা প্রকাশ রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,-“গুনে নিন ,ঠিক আছে কিনা।”
প্রকাশ রায় সুভাষের সততায় ভীষণ অভিভূত এবং আনন্দিত হয়ে বললেন,-” এই উপকারের বিনিময়ে তুমি কি চাও বলো?”এবার প্রকাশ রায়ের কথা সুভাষের মনে পড়লো। সে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা হৃদয়স্পর্শী ভিডিও দেখেছিল। হেডলাইনে লেখা ছিল “শহরের বিখ্যাত মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভের কি অমানবিক আচরণ।”
ভিডিওতে দেখাচ্ছে : কেরানীটোলার বাজারে প্রকাশ রায়ের দুটি পা ধরে একটা ক্ষুধার্ত পথশিশু ভিক্ষা চাইছে কিন্তু অসহিষ্ণু প্রকাশ রায় শিশুটিকে সপাটে চড় মেরে যাচ্ছে।সুভাষ শিশু নিপীড়নের এই বেদনাময় স্মৃতির বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর প্রকাশ রায়কে মার্জিতভাবে বললো , -“এর বিনিময়ে আমার কিছু দাবি নেই। তবে আমার একটি পরামর্শ- আপনি ওই হতভাগা পথশিশুটির ওপর হাত তুলে ঠিক করেন নি। কারোর প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারেন, তেমনই অসহায়ের প্রতি অত্যাচার করার অধিকারও আপনার নেই।”
ততক্ষণে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সুভাষের উপদেশবার্তা তাঁর মোটেই সহ্য হলো না। তিনি সুভাষকে টেনে তার গালে সজোরে দু চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে বললেন, -” তোর এত বড় স্পর্ধা, তুই আমাকে জ্ঞান দিস্। ছোটোলোক কোথাকার…”
চারিদিকে যেন সবাই নির্বাক দর্শক! কেউ একজনও মানবিকতা প্রদর্শনের সাহস দেখাল না। একজনও এগিয়ে এলো না এই ঘৃণ্য অমানবিকতার বিরুদ্ধে সদর্পে প্রতিপাদ জানাতে।আর বেচারা সুভাষ! তার তো আর কাজ নেই তাই পথশিশুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার মার্জিত প্রতিবাদ করার মানবিকতা উপচে পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকায় তার মতো সাধারণ ছেলের হয়তো দশ- বারো মাস আরামেই কাটতো। তা না করে…
ইস্, সুভাষের মতো দুষ্প্রাপ্য নির্ভেজাল মানবিকতার প্রতীকটা যদি এমন ভাবতে পারতো!এখনো কতিপয় সুভাষ বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তাদের সততা,নিষ্ঠা, মনুষ্যত্ব। তারাই প্রকৃত জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। তারা যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব তা তারা প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করতে পারে। এমন মহানুভবতার প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা উদ্ভাবিত হবেই হবে।
—– -
কবিতা- “ছেঁড়া তমসুক”
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার আমার।।
ছেঁড়া তমসুক
– সঞ্জিত মণ্ডলমনের গহন কোনে সুক্ষ্ম এক তীক্ষ্ণ অনুভূতি সূচ ফোটায়,
বুকের মাঝখানে ঠিক মনের কাছটায়।
দিনরাত কত রক্ত ঝরায়-,
শুধু কত রক্ত ঝরায়!
বারে বার মনে পড়ে যায়,
কখন কোথায় কবে, বিলোল বক্ষে কার
চন্দনের পত্রলেখা নিমেষের তরে তবু করেছি আবিষ্কার!
কখন কোথায় কার প্রদীপ্ত চোখের সেই নীলাভ তারায়,
হারিয়ে গিয়েছি কত মায়াবী সন্ধ্যায়।
কখন কোথায় কার বঙ্কিম গ্রীবায়
চুম্বনের ব্যাপ্ত শিহরণে নিশীথ মায়ায়
হারিয়েছি তবু সেই আমার আমিকে আপন ইচ্ছায়।
জানিনা কোথায় আছো কার আঙিনায়।
তথাপি খুঁজেছি কত নিশীথে সন্ধ্যায়
কখনো পদ্মাপারে, কভু মেঘনায়;
ধরণীর বুকের ভীতরে, কভু মেঘে, কভু দূরে,
কভু নীল সাগরের তীরে
আকাশের ভেসে যাওয়া মেঘে কভু নীল নিলীমায়-
গাঙচিল সারসের প্রমত্ত ডানায়—-
কখনো বা দোয়েলের কোকিলের গুপ্ত ঠিকানায়।
আক্ষেপ থেকে যায়, খুঁজে আমি পাইনি তোমায়।জানিনাতো আজ তুমি আছোটা কোথায়!
হয়তো কোন সুদূর পল্লীবাংলায়,
নিদাঘ দুপুরে,গৃহস্থের বধু সেজে কলসী কাঁখে জল আনতে যাও।
হয়তো দুপুর শেষে, সানের ঘাটেতে বসে অতীতের স্মৃতি দিয়ে মেখে
পা ছাড়িয়ে বসে তুমি কাঁচা আম লবণে জরাও।
হয়তো উদাস দিনে আপন আঙিনা কোনে শালিকের ঝগড়া শুনে বাঁশের বেড়ার কোনে, আপনার মনে কভু আনমনা হও।
নয় কোনো কোন ঘুঘু ডাকা উদাসী দুপুরে
আপনার জিভের উপরে,
জামের রঙীন দাগ মুছে ফেলে দিতে তুমি আয়না তুলে নাও ।
জিভ দেখে, চকিতে কী ভেবে তুমি আয়না ফেলে দাও—-।এখানে তখনি জেনো এ বুকের কোনে
আয়নার ভাঙা কাঁচ তীব্র ফুটে যায়।
এই দূরে,রূপনারাণের তীরে,
আমার অজান্তে বুকে তীব্র ব্যথা হয়।
গোধুলীর রাঙা মেঘ হৃদয়ের আনাচে কানাচে নীরবে নিভৃতে কতো রক্ত ঝরায়,
জানিনাতো তোমারও হৃদয়ে বুঝি আমারই মতোই কোনো একদিন সেথা রক্ত নদী বয়—-।
মনে হয় তুমি বুঝি ভোলোনি আমায়।
তাই আজও ব্যথাটা কমে না কিছুতেই;
ছেঁড়া তমসুক খানা, কবে যেন আরো ছিঁড়ে যায়,
ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ভাঙা চোরা দিন গুণে একা একা নদী তীরে আজো বসে তব প্রতীক্ষায়
ছেঁড়া তমসুক খানি নদীজলে ভেসে চলে যায়। -
কবিতা- নিজস্বী
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নিজস্বী
-সুনির্মল বসুকিছু কিছু অহংকার থাকা ভালো, কিছু কিছু অহংকার তোমাকে আলাদা করে চেনায়,
ঝরো ঝরো বর্ষায় কচি কলা পাতার উপর জলের টুপ টুপ শব্দ যেমন কথাকলি বানায়,রাত জেগে তুমি তো তারাদের গল্প শোনো,
সবুজ দ্বীপে তুমি তো একলাই হেঁটে যাও,
পাহাড়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে শাল পিয়ালের বনে হাঁটতে-হাঁটতে তুমি একটা তুমি খোঁজো,
তোমার সেই তুমিটা আজও তো এলো না,
প্রতিদিন নদীর কাছে দাঁড়িয়ে তুমি তাকেই একান্ত খুঁজে যাও,
বড় দীঘি সবুজ মাঠ পাইন বন ইউক্যালিপটাস গাছ,
পদ্ম ঝিল, উদাসী শিরীষ বন তোমার বন্ধু,
ফুলের উপত্যকা তোমার অবকাশ, তোমার বুকের মধ্যে জেগে থাকে ভালবাসার পৃথিবী,মধ্যরাতে তোমার দরোজা হাট করে খোলা,
কেউ আসবে, তাঁর আসার প্রতীক্ষায়,
না পাওয়ার বেদনা গুলো তোমাকে কবিতা লেখায়,
সব সময় তুই একা,শুধু বর্ষায় বসন্তে, কবিতা লেখার সময় তুমি একা নও, কারা যেন তখন চুপি চুপি আসে,
জল জঙ্গল গাছপালা নদীর ধার ঝাউবন দেবদারু
বীথি তোমার কবিতায় কথা বলে,
তখন তোমার তুমির জন্য কোনো কষ্ট থাকেনা,
কল্পনায় তুমি তাঁর সঙ্গে বহু দূরে যাও,
তোমার তুমির সঙ্গে সারা বিকেল হাঁটো,
গম্বুজওয়ালা প্রাসাদের চূড়োয় দাঁড়িয়ে কবুতর ওড়াও, তোমার তুমি তখন হেসে ওঠে খিলখিল,
কোনো কোনো দিন আকাশ জুড়ে মেঘ করলে,
তোমার কল্পনার তুমি বাতাসে আঁচল উড়িয়ে গান করে, মন মোর মেঘের সঙ্গী,আসলে, দুঃখ তোমাকে কাঁদায় না, বেদনা তোমাকে স্পর্শ করে না,
নিজের মনের সবুজ দ্বীপে তুমি তো একজন রবিনসন ক্রুশো,কিছু কিছু অহংকার থাকা ভালো, কিছু কিছু অহংকার চিবুকে ঝুলে থাক, কিছু কিছু অহংকার তোমাকে আলাদা করে চেনাক।
-
গল্প- মধুমাসের আলিঙ্গনে
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মধুমাসের আলিঙ্গনে
-পায়েল সাহুহ্যাঁ, ওরা ভালোবাসে দুজন দুজনকে, শত অমিল, ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়া সব কিছু পার করেও শেষ পর্যন্ত একসাথেই হাত ধরে চলে |
ওরা নীলাভ আর চন্দ্রিমা | দুজনেই বিবাহিত এবং জমিয়ে সংসার করে ছেলেমেয়ে নিয়ে, তবু কোথাও একটা বড়ো ফাটল ছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে দুজনের সংসারেই, যতটা ফাটল থাকলে একটা গোটা মানুষ ঢুকে পড়তে পারে অন্যের মনের জগতে, দখল নিতে পারে অন্যজনের সম্পূর্ণ অস্তিত্ত্বের |
নীলাভ বেশ বড়ো মাপের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সমস্ত দিনের ব্যস্ততা সামলেও তার শখ কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি করা, অন্যদিকে চন্দ্রিমা বহুদিন ধরে বাচিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এবং বেশ নামী শিল্পী |
আলাপের সূত্র বাচিক শিল্প হলেও সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে আরো বেশিদূর এগোতে সময় নেয়নি |অথচ কেউই তার সংসারের ফাটলের কথা কখনো কারো কাছে স্বীকার করেনি, শুধু অনুভব করেছে অন্যের একাকিত্বের, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রকম অভ্যাস হয়ে উঠেছে একে অপরের |
দিনটা ছিলো পয়লা বৈশাখ, শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরিতে অনুষ্ঠিত অপূর্ব এক সাহিত্য বাসরে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলো ওরা দুজন, বাচিক স্কুলের আরো অনেকের সাথেই |
কিন্তু ফেরার সময় কিভাবে যেন আলাদা হয়ে গেলো সবার থেকে, হয়তো বা ইচ্ছে করেই | অবশ্য এমনটাই প্ল্যান ছিলো ওদের, দুজনে একা হওয়ার | নাই বা হলো নিভৃতি, তবু পাশাপাশি হাত ছুঁয়ে হাঁটা, দুজনের হাজার কথা বলা, একসাথে পাশাপাশি বসে বাড়ি ফেরার সময় টুকু একসাথে থাকা | ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়ার সময় কেউ তো কাউকে দেখতে পায়না, তাই মুখোমুখি, পাশাপাশি বসে বন্ধুত্বের উদযাপন করার সুযোগ নিলে ক্ষতি কি !
কিন্তু ওরা যখন সত্যিই একা হলো,সামান্য একটু কথার পরেই দুজনেই যেন খেই হারিয়ে ফেললো, কি যেন বলার ছিলো, কি যেন অভিযোগ ছিলো, শুধু চুপ করে পাশাপাশি আঙুল ছুঁয়ে ফেরার গাড়িতে বসে রইলো ওরা,মাঝেমাঝে দুজন দুজনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে চাওয়া ” আমার সব টুকুই তোমার, যা কিছু ভুল বোঝা ছিলো, আজ অনুভব করে নাও, সেসবই যে মিথ্যা “|
নেমে যাওয়ার সময় আগে এলো চন্দ্রিমার, বিদায় বেলায় নীলাভ আকুল হয়ে শুধু দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো চন্দ্রিমার হাত, চন্দ্রিমার চোখে তখন টলমল করছে মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু |
নীলাভর চোখের মৃদু শাসনে মৃদু হাসিতে মুখ ভরিয়ে চন্দ্রিমা বলল ” এই স্পর্শটুকু সঞ্চয় করে রাখবো চিরকাল “|
চন্দ্রিমাকে বিদায় জানিয়ে নীলাভ যেন আজ নতুন হলো, নতুন পুরুষ হলো কারো জীবনে, বিগত পাঁচ বছরের সম্পর্কে যেন নতুন রং দিয়ে গেলো মধুমাসের প্রথম দিন, চন্দ্রিমার উষ্ণতার পরশে সত্যিই যেন বৈশাখ ছুঁয়ে গেলো তাকে , তার সলজ্জ দৃষ্টির ভাষায় যেন নতুন করে চিনলো তার প্রেয়সীকে | এ কি সত্যিই পরকীয়া?? নাকি বন্ধুত্বের থেকে আরো কিছু বেশি ভরসায়,বিশ্বাসে, আবদারে, অভিযোগে গড়ে ওঠা এক মধুর সম্পর্ক | নিজের মনেই হেসে ফেলে নীলাভ, অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকা সহযাত্রীদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে আজ প্রাণখোলা আনন্দে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলো
” দুচোখে হঠাৎ করে কালবৈশাখী/
চৈত্রের শেষ বেলা পাতা ওড়ে নাকি?/
গত বছরের মায়া ভেঙে যাবে বলে,/
রাজপথ ভেসে গেছে অচেনা কাজলে,/
তুমিও অঝোরে তাকে শুধু ভালোবেসো… এসো হে বৈশাখ, এসো এসো “|সমাপ্ত
-
রম্য- “বাংলা ভাষার হালচাল”
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
“বাংলা ভাষার হালচাল”
-রাখী চক্রবর্তীমা জী দুধ লিজিয়ে,,
–সুবহ্ সুবহ্ মা জী দুধ লিজিয়ে, ঘুমের বারোটা বাজাইয়ে।রূকো যাই,
কি মনে করকে আজ জলদি জলদি আয়া,
—কা হা জলদি মা জী,
–চুপ রহো,কালসে দশ বাজে আনা।ঘুম পুরা নেহি হোতা তো গা ম্যাজ ম্যাজ করতা হ্যায়
–জী মা জী ।জো আপ বোলেঙ্গে
ঘর থেকে লালমোহন বাবু বললেন, ভুতাই তুই রোজ এই সময়েই দুধ দিয়ে যাবি।দশটার সময় এলে আমি চা খাবো কি করে,অফিস যেতে হবে না আমাকে।
সীমা দেবী চিৎকার করে বললেন,
ম্যায় যো বলুঙ্গা ওহি হোগা
ভুতাই দশ বাজে আনা
ভুতাই গোয়ালা জানে এখন কি কি হবে,হাঁ মা জী ঠিিক হ্যায়
বলেই ভুতাই দে ছুট
লালমোহন বাবুর স্ত্রী সীমা দেবীর হিন্দিতে কথা বলা শুরু হয় ভুতাই আসার সময় থেকেই।তারপর সেটা চলে বাজারে ,কাজের মেয়ের সাথে,পাড়া প্রতিবেশি ।লালমোহন বাবু কিছু বলতে গেলেই বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দে কাঁপতে থাকে গোটা পাড়া।
সীমা দেবী সকাল ন’টার সময় বাজারে যান, কর্তা অফিস চলে যায় তারপর।বাজারে গিয়ে উনি হিন্দিতে কথা বলেন।ওনার ধারণা হিন্দিতে কথা বললেই মান সম্মান বাড়ে।বাংলা ভাষার কোন দাম নেই ।মাথা নত করতে হয় না হিন্দি ইংরেজি ভাষাতে কথা বললে।এবার জেনে নি উনি আসলে কি ভাষায় কথা বলেন
দোকানদার–আমার থেকে আলু নিয়ে যান ও দিদি, ও বৌদি,নিয়ে যান,,–আলু কত করে দেতা হ্যায় ?
–পঁচিশ টাকা কিলো।কত দেব?
–টুয়েন্টি ফাইব ! ও ঠিক হ্যায়
দো কিলো দো।পটল কত করে দেতা হ্যায় ?ও ভী দো কিলো দো।
তারপর মাছের বাজারে গিয়ে সীমা দেবী বলেন,
আরে ভাই এ ফিস মরা হ্যায় তো।জিন্দা ফিস দো,লাফালাফি করতা হ্যায় ও ফিস চাই—ইলিশ মাছ লাফালাফি করে না মা জননী,কৈ মাছ নিন খুব নড়েচড়ে,লাফালাফি করে
–কৈ কত করকে দেতা হ্যায়?
–হাজার টাকা কেজি
–ঠিক হ্যায় দোঠো ওজন করো
বাজারের থলি নিয়ে বাড়ি ফিরে সীমা দেবী বারান্দায় বসে ভাবেন হিন্দি ইংরেজীতে কথা বলে বাজার মাত করে দিয়েছি।
সন্ধ্যা বেলায় কর্তা বাড়ি ফিরলে আবার চলে হিন্দিতে কথাবার্তা ।এর একটা কারণ আছে লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত যাবেন ঘুরতে ।ছেলে কলকাতায় থাকে ।ফোন করে মাকে বলে দিয়েছে হিন্দিটা ইংরেজিটা একটু চালু রেখো মা,
কাজ দেবে।
ব্যস ,আর থামেন নি উনি হিন্দি, ইংরেজি ,বাংলা ভাষার দফারফা করে ছেড়েছেন ।
সীমা দেবী কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেলে সবাইকে বলেন, বিদেশ যাতা হ্যায় হামলোগ ।
লালমোহন বাবু মহা ঝামেলায় পড়েছেন।না হিন্দি না বাংলা আবার ইংরেজি ভাষাও আছে।
–কত বার বলবো।উত্তর ভারত বিদেশ না। ,ভারত নাম শোননি ?–তোমার বেশি বেশি ।না হয় একটু বিদেশ বললাম।
–ঠিক আছে যা বলার বলো ।উত্তর ভারতে গিয়ে আবার ভাষার প্রদর্শন করো না যেন।—বলবো ,হিন্দি ইংরেজি ভাষায় কথা বলবো,বাংলা ভাষায় আছে টা কি,
–ঠিক আছে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না,পুরো কথা হিন্দি ও ইংরেজিতে বলবে তবেই বুঝবো দম আছে তোমার, বাংলা ভাষাকে অপমান ! কিছুতেই আমি সহ্য করবো না,এই আমি বলে রেখে দিলাম
–ঠিক আছে ঠিক আছে, রেস্টুরেন্টে গিয়ে এগরোল দিন বলো কেন? ময়দায় ডিম প্যাচানো খাবার দিন ,বলতে পারো তো,শুধু আমার বেলায় দোষ,সেদিনকে ফোনে কাকে যেন বললে,রবিবার হলি ডে মর্টন না হলে জমে না,আমি কতবার তোমার কথা শুনে হেসেছি বলো ?
–সেটা অন্য ব্যাপার,ভুল তো কিছু বলছি না
যাইহোক তিন চার দিন পর লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত ঘুরতে গেলেন,দিল্লিতে লালমোহন বাবুর দিদি থাকেন ,ওখানে থেকেই সব জায়গায় ঘুরবেন।দিল্লিতে পৌছে
ট্রেন থেকে নেমে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন ওনারা,
একটা টাটা সুমো আসতে দেখে সীমা দেবী চিৎকার করে উঠলেন
গাড়ি স্টপ গাড়ি স্টপ ,
— গাড়ি থামবে না।তুমি চিল্লে মরো
–কেন থামবে না।আমি কি বাংলা ভাষায় কথা বলছি ?হিন্দি ,ইংরেজি তুমি একাই পারো ?
রণ বাববার বলে দিয়েছে ,মা বাইরে যাচ্ছো হিন্দিতেই কথা বলবে,ছেলেকে তো আর ইনসালট করতে পারিনা
–একদমই না,। ঐ দেখো গাড়ি চলে এসেছে
চলো ,গাড়িতে উঠে বসো
সুমোতে বসলেন সীমা দেবী,বাব্বা বহুত গরমি,
আজি শুনতে হো ড্রাইভার,হ্যালো
জানলা কা কাঁচ নিচে নামা দো,নিশ্বাস নিতে কসট্ হোতা হ্যায়–“আজি শুনতে হো”,এটা পতিদেবকে সম্মোধন করে বলতে হয়,বুঝলে
ওই দেখো ড্রাইভার ছেলেটা তোমার কথা শুনে হাসছে
–ভুল তো বলি নি।
–না না ভুল কিসের ,বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষার মিলন করে ছাড়ছো।ফুলশয্যার রাতে যেমন আমাদের মিলন হয়েছিল।মনে আছে কি বলেছিলে ? হা হা ,
আমি গোলাপ ফুল বলতে তোমার কি হাসি
–গোয়ালার সাথে রোজ হিন্দিতে কে কথা বলে তুমি না আমি।ও তো বাংলা বোঝেই না।
হিন্দি আমার রক্তে আছে ।
মুখ দিয়ে তো এক অক্ষর হিন্দি শব্দ বের হয় না।
–আমার পূর্ব পুরুষদের একটা ঐতিহ্য আছে ,
বাংলা ভাষাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ভাষা ।অহেতুক হিন্দি বলি না।যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে বলতেই হবে,বিমলদা’র ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে আমাদের বাড়ি তে আসে তোমার সাথে কি সুন্দর বাংলাতে কথা বলে তোমাকে প্রণাম করে,আর তুমি বলো জি তে রহো বেটা,আরে মন খুলে আশীর্বাদ করতে হয়,তুমি এমন ভান করো যেন বাংলা বলতেই পারো না,
ওনাদের কথোপকথনের মধ্যে
ড্রাইভারের ফোনে রিংটোন বাজবে
“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” গানটা শুনে লালমোহন বাবু বলেন,
তোমার নাম কি ভাই?
–আমি উদিত প্রসাদ
–শোন ভালো করে উদিত ওর ফোনের রিংটোনে কি সুন্দর গান রেখেছে ।আর তুমি ফোন চালাতেই পারো না।আবার রিংটোন রেখেছো বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায় ।
–মুহু বনদ্ করো,প্রেসটিজ হ্যায় মেরা
—সে তো ভালোই জানি,বাংলাতে কথা বলো,লোকে সন্মান করবে।কখনও শুনেছো কোনও ইংরেজকে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কোন বাংলায় কিছু বলতে ।হিন্দি ভাষী যারা তারাও কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে আনে না।কিন্তু আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার অপমান করছি।বাংলার মধ্যে হিন্দি ইংরেজি ভাষাকে টেনে আনছি।কেন ? এ প্রশ্ন শুধু আমার না।–স্টপ ।অনেক হয়েছে ,রোজ সকালে কে বলে গুড মর্নিং ।এক কাপ চা দাও ।পেয়ালা কি তুমি বলো ?আসলে কথা বলার সময় আমাদের খেয়াল থাকে না তাই বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলি।তার মানে এটা না যে বাংলা ভাষাকে অপমান করছি
–সব মানলাম ।কিন্তু তুমি জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না।
বাংলাতে কথা বললে হিন্দি বলবে না।করেগা ,খায়েগা ,দেগা অসহ্য লাগে ।
মনে রেখো ,”বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা ,নয়তো অবহেলার।
এই ভাষাতেই “ভারত ছাড়ো” হুঙ্কারে বৃটিশরা হয়ে ছিল জেরবার “–দাদা আপনারা এখানেই নামবেন তো?।আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো দাদা।বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা নয়তো অবহেলার।যথার্থ বলেছেন দাদা।
–থ্যাঙ্ক ইউ ভাই
লালমোহন বাবুর ইংরেজি মেশানো বাংলা কথা শুনে
সীমা দেবীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । চোখ দিয়ে মা চন্ডীর রুদ্র রুপ বেরিয়ে পড়েছে ।
লালমোহন বাবু মনে মনে ভাবছেন সব জ্ঞান মাটিতে মারা গেল।ধ্যাত তেরি,,কি দরকার ছিল থ্যাঙ্ক ইউ বলার ।অশেষ ধন্যবাদ ভাই বললে কি হতো।ঠিকই তো কথা বলার সময় খেয়ালই থাকে না কি বলছি।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে লালমোহন বাবু হেসে বললেন,
তুমি ঠিক বলেছো গো, কথা বলার সময় অনেকেরই খেয়াল থাকে না
উদিত গাড়িটা থামিয়ে বলল, বৌদি খুব সুন্দর কথা বলেন ।বৌদির কথা শুনে একটু হাসলাম।এটাই বা কম কিসের । মানুষের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় কিছু কিছু কথা।সে বাংলা ভাষায় হোক বা জগাখিচুড়ি ভাষায় ।আমি তো খুব হাসলাম,আপনাদের মনে রাখতেই হবে, দাদা
আমি আপনাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিচ্ছি
সীমা দেবী বললেন, অল রাইট।ঠিক আছে
লালমোহন বাবু হেসে বললেন ,এই তো আগে ইংরেজি বলে তারপর না হয় বাংলায় বলে দিও।কোনও সমস্যা নেই।
–লেটস গো।চলোলালমোহন বাবু স্ত্রীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওনার কানে কানে বললেন ,আমি তোমাকে ভালবাসি,আই লাভ ইউ।
সীমা দেবী মুচকি হেসে বললেন আই লাভ ইউ টু,তিন চার পাঁচ ছয় সাত,,,,উদিত হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো, সূর্যটাও অস্ত যাওয়ার আগে শেষ হাসিটা হাসলো।
-
প্রবন্ধ- লীলাময়ী লীলা মজুমদার
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
লীলাময়ী লীলা মজুমদার
-সুমিতা দাশগুপ্তবড়ো ইচ্ছে, তাঁর জন্মদিনে একখানা হলদে পাখির পালক উপহার দিই ।
তুমি বলবে — ওমা সে তারিখ তো কবেই পেরিয়ে গেছে !
আমি বলি তাতে কী? তারিখ পেরিয়ে গেলেই তো আর জন্মদিনটা মিথ্যে হয়ে যায় না , বিশেষ করে আপামর বাঙালির বুকের মধ্যে একখানি মায়ার পিদ্দিম জ্বালিয়ে দিয়েছেন যিনি তাঁর তো প্রতিটি দিনই জন্মদিন!
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তিনি হলেন আপামর বাঙালি পাঠকের প্রিয় লীলাময়ী, লীলা মজুমদার ।
এখন মুশকিল হলো উপহারটা যে দেব ,তা সেই পালকখানা পাই কোথায়? তাকে তো ঝগড়ু আর ঝগড়ুর ভাই ছাড়া কেউ দেখেই নি !
গুণুপন্ডিত বললে -” তা ওকেই শুধোও না গিয়ে।”
আহা, তা কি আর আমি ভাবিনি ভাবছো , মুশকিল হলো ঝগড়ুকেই বা পাই কোথায়!।সে তো বোগি আর রুমুকে সঙ্গে নিয়ে সারা দুপুর ,খোয়াই এর মধ্যে সেই ফুল খুঁজে বেড়ায় ,যা নাকি কক্ষনো শুকোয় না। কবে থেকে যে খুঁজেই চলেছে,আজও পায় নি -তবে কিনা চায়ও না পেতে! বলে, পেয়ে গেলেই তো সব মজা মাটি!
গণশা পরামর্শ দিলে — “পদিপিসির বর্মীবাক্সটা একবার খুঁজে দেখলে হতো না? ধনরত্নের মধ্যে যদি একখানা পালকও লুকিয়ে থাকে! ” শুনে গুপির সে কী হাসি !বললে
“ওরে সে বাক্স তো এখন খালি।ওর ভিতরের সোনাদানা, মণিমুক্তো,মায় , বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া মন্তরের পুঁথিখানা পর্যন্ত কবেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে সবাই।”
তাহলে উপায়?
আচমকা পেরিস্তানের চোরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কালোমাস্টার বললে—
“সবাই জানে আমি মানুষটা মোটেও সুবিধের নই, কাউকে যেচে পরামর্শ দিই নে, কিন্তু এই যে ছেলেটা এর মতো এতো ভালো মনের মানুষ
ভূ ভারতে আর কোথাও দেখলাম না। আমায় আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখেছে ওর গোপন আস্তানায়, বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে এনে খাওয়ায়।
তাই হদিশখানা বলেই দিচ্ছি। ঐ সামনের পাহাড়ে পাকদন্ডী বেয়ে উপরে উঠে যাও দিকিনি, ওখানে পাহাড়ের ঢালে বড় লামা থাকে ।ওর পুষ্যি হলো ধিঙ্গিপদ , সারা দিনমান ,হেথা হোথা ঘুরে ফিরে কাজকর্ম করে , দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। শোনো তাকে আবার আহ্লাদ করে ঘাস খাওয়াতে যেও না যেন , সে কেবল সুয্যির আলো খায়।”
বড়লামার বাড়ি পৌঁছে দেখি,ধিঙ্গিপদ রোদে কাঠকুটো শুকোতে দিচ্ছে , আমাদের তো পাত্তাই দেয় না,বড় গুমোর তার, অনেক সাধ্যসাধনার পর, বললে
” যতদূর জানি পাহাড়চূড়োয় মেঘের দেশে যে বাতাসবাড়ি, হলদে পাখি ইদানীং সেখানেই আশ্রয় নেছে ,আর কিছু জানি নে ,যাও ভাগো” ।
তাড়া খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। তারপর ধিঙ্গিপদর কথামতো
পাকদন্ডী বেয়ে উঠছি তো উঠছিই , চারপাশে সে কী ঘন বন, বনের মধ্যে হু- হু করে হাওয়া বয় , পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো , আড়াল থেকে কারা যেন উঁকি ঝুঁকি মারে , তাকালেই চট করে সরে যায় ,সে ভারি রোমহর্ষক ব্যাপার! ভয় কাটাতে গুপি পকেট থেকে টিনের ব্যাঙ্ কটকটিখানা বের করে যেই না, কটকট করতে লেগেছে ওমনি কোথা থেকে একদল নোংরা জামাকাপড় পরা ছেলে মেয়ে এসে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে ভয়ের রাস্তাটুকু পার করে দিয়ে গেল। একটাও কথা কইলে না। বোবা নাকি রে বাবা!
বন ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠেই দেখি, মাথার উপরে উপুড় করা প্রকান্ড একখানা গামলার মতো কী চমৎকার নীল আকাশ,রাস্তার ধারে ধারে, বাগান ঘেরা চমৎকার সব বাড়িঘর। সাদা রেলিং দেওয়া কাঠের বারান্দায় সারি সারি টবে রঙবেরঙের ফুল ফুটেছে, বাগানে নাসপাতিগাছে , সোনালীরঙা রস টুপটুপে পাকা ফলের বাহার । আরে এইটিই তো তাঁর ছেলেবেলার বাড়ি।
এরপর যতো এগোই পাকদন্ডীর প্রতিটি বাঁকে ,থুড়ি পৃষ্ঠায় কতো যে বিখ্যাত মানুষের ঠিকানা! তাঁদের অতুলনীয় কীর্তি কলাপ , অসামান্য জীবনযাপনের মনকাড়া গপ্পো।
ও হরি !এতক্ষণ বলি নি বুঝি , হলদে পাখির পালক খোঁজার অছিলায় তাঁরই লেখা বই নিয়ে বুঁদ হয়ে আছি আবারও। আহা ,যদি সত্যি হতো এই পথ চলা ! হঠাৎ শুনি মনের ভিতর ঝগড়ুই কথা কয়ে উঠলো
“সত্যি যে কোথায় শেষ হয়,আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু বলা মুশকিল।কেন তোমাদের রবিঠাকুরই তো বলে দিয়েছেন ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি ,ঘটে যা ,তা সব সত্য নহে’ —পড়ো নি বুঝি!”
এতক্ষণে হয়তো বিজ্ঞজনের ভ্রূ কুঁচকে গেছে। —এটা আবার কী ধরনের প্রবন্ধ ! গুরুগম্ভীর একখানা বিষয়, থান ইটের মতো শক্ত শক্ত শব্দ আর, তথ্যের বুনটে ঠাসা থাকবে , তবেই না বুঝি! কিন্তু কী আর করা , যাঁর সম্পর্কে লিখতে বসেছি তিনি মানুষটাই যে এমনই। সহজ সরল ভাষায় ,কখন যে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যান ,কেউ টেরটিও পায় না। তাঁর চরিত্রদের কেউ বা “বারান্ডাওয়ালা” টুপি পরে, আবার কারোও বা উত্তেজনায় চোখ “জ্বলজ্বলিং”।
যাঁর বর্ণনার এমন সহজ সরল ভাষা, তাঁর জন্য এমন ভাষাই তো লাগসই ,কী বলো!
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাইঝি, সুকুমার রায়ের বোন ,এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রেখে , অনায়াসেই নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন শিশুসাহিত্যের পোক্ত জমিতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রী, স্বর্ণপদকসহ , রবীন্দ্র পুরস্কার ,দেশিকোত্তম আরও কতশত সম্মাননায় ভূষিত, কর্মজীবনে কখনও বা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীর শিক্ষকতা আবার কখনও বা কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদের গুরুদায়িত্ব ,এইসব সামলেও, তিনি অনায়াসেই খেলতে নেমে পড়েন শিশুমনের আঙিনায়।
কথায় বলে , নিজের ছেলেবেলা ভুলে যাওয়া নাকি মহাপাপ। লীলা মজুমদারের কলমের মায়ায় ,ঘটে যায় সেই শাপমুক্তি। কতো কী-ই যে মনে পড়িয়ে দেন তিনি! বাথরুমে বন্দী কতশত দুষ্টু শিশুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সাবানের ফেনার রঙিন বুদবুদে রামধনু তৈরী করার ফন্দি ফিকির , আঙুলের ডগায় স্কেল নাচানোর খেলা , তিনিই তো শিখিয়ে দিয়েছেন কতগুলো ফুটোকে ময়দা দিয়ে জুড়ে তৈরী হয় পাঁউরুটি।
সেইসব মনে পড়তেই প্রাপ্তবয়স্করাও নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যান শিশুদের সঙ্গে পথ হাঁটতে। চলে লম্বা শোভাযাত্রা ।সেই শোভাযাত্রায় থাকে , কানকাটা নেড়ি ,ডানা ভাঙা পাখি,পকেটমার , বাঁশ বাগানের ভূতের দল, মায় রাতের বেলায় পুল পার হওয়া মালগাড়ির চেনে লেগে থাকা গানের সুর , টং -লিং – টং লিং।
দৈনন্দিন জীবনের ব্যথা বেদনায় দরদী হাতে মলম লাগিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। বুঝিয়ে দেন এই পৃথিবীটা মোটেও স্বর্গরাজ্য নয় , ভালো লোকের পাশাপাশি চোর জোচ্চোর ফেরেববাজেরও অভাব নেই কিন্তু তাই বলে তোমার মনের ভিতরে মায়ার প্রদীপখানি কিছুতেই নিভতে দেওয়া চলবে না। কারণ তুমি যে মানুষ!
তাঁর মুখচ্ছবিতে তামাম বাঙালি খুঁজে পায় নিজের ঠাকুমার আদল , আদর করে সকলের মনেই গেঁথে দিয়ে গেছেন জিয়নকাঠির মন্ত্র।তাই তো মনখারাপের আঁধার পেরিয়ে আজও ভোরের আলোয় হেসে ওঠে বাঙালি ,পায় প্রতিদিনের পথ চলার নতুন উৎসাহ। -
গল্প- বদ অভ্যাস
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
বদ অভ্যাস
-সুমিতা পয়ড়্যাটিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে এলো যেন! বাড়ির সামনে দিয়ে লম্বা রাস্তা চলে গেছে চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত। সেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। দু-একটা ঝাঁপ ফেলা দোকান খোলা। রাস্তাতে লোকজন নেই, একেবারে শুনশান।
দূরে কোথাও মেঘমল্লার রাগের সুর ভেসে আসছে। বাতাসে ঝোড়ো হওয়া। স্যাঁতসেতে বাতাসে গরম গরম আর চা খেতে ইচ্ছে হলো অক্ষয়বাবুর।
বয়সটা প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। কদিন পরেই চাকরি জীবনের অবসর নেবেন। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে চাকরির সূত্রে। বাড়িতে এখন লাবু আর তিনি।
লাবু হলো গিয়ে অক্ষয়বাবুর একমাত্র সঙ্গী লাবণ্যময় দেবী। যেমন তার প্রভা তেমন তার গুণ। একাই এই বয়সেও সংসারটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। অক্ষয়বাবু মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে স্ত্রীকে নিয়ে একটা আলাদা গর্ববোধ করেন। উপরে সবসময় খুনসুটি। এতে লাবুর মেজাজ থাকে সপ্তমে চড়ে। আর অক্ষয়বাবু এটাই উপভোগ করেন খুব বেশি করে। নুন ছাড়া রান্নার স্বাদ কেমন বিষাদ হয় তেমনি লাবণ্যময়ী দেবীর চিৎকার বকবক ছাড়া সংসারটাও কেমন যেন বিস্বাদ লাগে অক্ষয়বাবুর।
সাহসে ভর করে অক্ষয়বাবু বলেই ফেললেন, লাবু ভিশন চা আর পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছে; খাওয়াবে গো!
লাবণ্যময়ী দেবী বলে উঠেন, এত খাই খাই করো না তো! শরীরটা ঠিক রাখতে হবে, বয়স হয়েছে এটা জানো তো!
বলে নিয়ে আবারও বললেন—-ঠিক আছে, আজ দিচ্ছি। ঘনঘন বলবে না কিন্তু!
অক্ষয়বাবু হেসে উঠলেন, বললেন–না না আজই প্রথম, আজই শেষ। আমি জানতাম তুমি আমাকে না বলতে পারবে না। তাইতো তোমাকে এত ভালোবাসি।লাবণ্য দেবী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে! বলেই রান্না ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আর পকোড়া এসে হাজির।
দুজনে মুখোমুখি বসলেন ব্যালকনিতে। খাওয়া শুরু করলেন গল্প করতে করতে।কিন্তু যেটা হবার সেটা তো হবেই। যা ঘটবার তা তো ঘটবেই। সেখানে কারুর কিছু করার থাকে না।
হঠাৎ অক্ষয়বাবুর হাতটা কেঁপে ওঠে আর চায়ের কাপটা থেকে ছলকে খানিকটা গরম চা পড়ে যায়। পড়বি তো পড় একেবারে লাবণ্যময়ী দেবীর পায়েই পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে লাবু দেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন—-কি যে করো বুঝি না বাপু! সবকিছু তোমারই কি হতে হয়? অসহ্য! যত্তসব বদ অভ্যাসের রাজা। গরম চা টা ফেললো ফেললো আমার পায়েই ফেললে। মেঝেতেও তো পড়তে পারতো! তানা সেই আমার কপালে। উফফ! কি যন্ত্রনা মাগো। এদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই।অক্ষয় বাবু বললেন, আরে ইচ্ছে করে করেছি নাকি! হঠাৎ হাতটা কেটে গেল। তা আমি কি করবো বলো! শান্ত হও লাবু। সরি লাবু। দেখি কোথায় লাগলো! গরম চা টা পড়েছে। পুড়ে গেল কিনা দেখি। দাও পাটা। একটু বার্নল লাগিয়ে দিই। দেখাও পা টা। আর কখনো হবে না।
সরি- সরি- সরি।লাবণ্যময়ী দেবী বকবক শুরু হয়েছে। থামানোটা অত সহজ নয়। তবু বলে গেল এক নিঃশ্বাসে—–
আমার তো সকাল-সন্ধ্যা বলে কিছু নেই; শখ- আহ্লাদ বলে কিছু নেই।
তার ওপর যত বদঅভ্যাসগুলো সব সহ্য করতে হবে। খালি কাজ বাড়াও। কোন কাজই তো কোন সাহায্য নেই, শুধু অকাজ। দুমিনিট শান্তিতে বসব তারও উপায় নেই। তুমি কেমন মানুষ কে জানে? ভগবান কি দিয়ে তৈরি করেছেন তোমাকে?অক্ষয়বাবুও কম যান না। বলে ফেললেন—‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’
ব্যাস আর যান কোথায়?লাবণ্যময়ী দেবী বলে ওঠেন: না মশাই! কেউ এমনি এমনি বলে না। একটাও যদি ভাল অভ্যাস দেখতাম তাহলে আর বলার জায়গায় থাকত না। সব বাজে অভ্যাস— যাকে বলে বদ অভ্যাস।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেশের মধ্যে নাক ঝাড়া —কোথায় গিয়ে কি পড়ল তা কে দেখে শুনি! সেই তো আমি। কোনদিন বেসিনটা পরিষ্কার করেছ?না তো!
কোনদিন দেখলাম না পাপোশ গুলো সুন্দর করে ঠিক জায়গায় রয়েছে। দোমড়ানো মোচড়ানো—-
পাপোশ দিয়ে কেউ পায়ের ওপরের জল গুলো মুছে জানা ছিল না। তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে জানতেই পারতাম না।
যেখানে বই পড়ছে সেখানে বই খুলে রেখে চলে গেলে। কে গোছায় শুনি! ছোটবেলায় শুনেছিলাম বই খুলে রাখলে ভুতে পড়ে নেয়। তুমি নিজেই একটা ভূত তাই তোমার কাছে কোন ভূতেরাও আসবেনা। ওরাও জানে তোমার ছিরিগুলো! কি সুন্দর সুন্দর সব অভ্যাস! এক্কেবারে যা তা।এইতো সেদিন চোখের চশমাটা পড়ার সময় নিয়ে পড়বে তারপর তাকে খুঁজতে গিয়ে ঘরবাড়ি সব লন্ডভন্ড করবে। করেছিলে কিনা বল! তোমার সঙ্গে কোন মানুষ থাকবে? কেউ থাকবে না। আমি বলে বর্তে গেলে এ যাত্রায়।
তুমি যে কি পারো আর কি পারো না, তা একমাত্র আমি আর ওই ওপর ওয়ালায় জানেন।
বাথরুমে যাবে জল দেবে না। জলের নাকি ঘাটতি চলছে! পরবর্তী প্রজন্ম খেতেই পাবেনা। তাই বাথরুমে জল না দিয়ে জল জমাচ্ছেন। তোমাকে পৃথিবীর সব জল ধরে রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন ভগবান।
আর এদিকে ফ্ল্যাট বাড়িতে যে গন্ধে গন্ধে বাস করাটা কি দুর্বিষহ তা কে ভোগ করে শুনি! খুব যে বড় বড় কথা বলছে!জায়গার জিনিস জায়গায় থাকলে অন্ধ মানুষও খুঁজে পায়। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম। আজো তা পালন করে চলেছি। আর তুমি তো চোখ থাকতেও অন্ধ। কিছুই খুঁজে পাওনা। এক জায়গার জিনিস কোথায় গিয়ে বাস করছে তা এই আমি ছাড়া কেউ জানে না।
অক্ষয়বাবু আবার বলে উঠলেন—–তোমার কি কোন বদ অভ্যাস নেই। যদি তোমারটা বলি!
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠলেন—-হ্যাঁ! হ্যাঁ! বল! বলো না! থামলে কেন! দেখি কি দোষ দেখতে পাচ্ছ!
বছরে কটা ছাতা হারাও খেয়াল আছে? ভোটের ডিউটি সারতে গিয়ে প্রতি ভোটে লুঙ্গি- গামছা- মশারি আমি ফেলে আসি, আমি! তাই না! নতুন জিনিস গুলো পাল্টে পুরনো নিয়ে আসি আমি।
আর কত বলব! বলতে গেলে মহাভারতও মুখ লুকাবে। বদ অভ্যাসের রাজা তুমি। বুঝেছ!
মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে পাল্টাতে। ভালো হতে। ভালো ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে। সেটা তোমার দ্বারা হবে না তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি। আর যার নয়ে হয় না তার নব্বই এ হবে! কক্ষনো না। কোনদিনও না।দেখছো,এই পকোড়াগুলো খেয়ে তেলটা কেমন গেঞ্জিতে মুঝে নিলে! দেখেছো তোমার কি অবস্থা! দিনে দিনে কি যে হবে কে জানে! আমাকে আরো কতই না সহ্য করতে হবে!
লাবু অশান্তি করো না। চুপ করো প্লিজ। এত মাথা গরম করতে নেই।
দেখো তোমারও অনেক বদ অভ্যাস আছে। আমি কিছু বলি না তাই।মানুষ মাত্রেই ভালো মন্দ অভ্যাস থাকে। কারো বেশি তো কারুর কম এই যা। কিন্তু থাকে তো। সে গুলোকে এভাবে বলার কি আছে? ভালো লাগবে না সেদিকে দেখবে না। আমিও দেখি না। তাই কখনো তোমাকে কিছু বলিও না।
লাবণ্য দেবী বললেন: থামলে কেন? বল বল, বাকি রাখছো কেন? এইটা বাকি আছে বলে ফেলো!
অক্ষয় বাবু বললেন: আজ্ঞে না, তোমার মত এত বকবক বা ঝগড়া করার অভ্যাস আমার নেই, অপ্রয়োজনীয় কথা নাই বা বললাম।
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠেন: ও আমি ঝগড়া করি, বকবক করি—তাই না! ঠিক আছে মনে থাকে যেন! এই আমি মুখ বন্ধ করলাম। আর কোন কথাই বলবো না। দেখি তুমি কি করে থাকো?অক্ষয় বাবু বললেন, আরে, মহা মুশকিল! আমি কি তাই বললাম! ওটা তো কথা প্রসঙ্গে কথা বলা। লাবু তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। রাগ করো না প্লিজ। লাবু শুনছো!
এই লাবু ডাকে একটা মাদকতা আছে। এটা লাবণ্যময়ী দেবী ভিতরে ভিতরে বারংবার উপলব্ধি করেছেন। তখন যেন সব রাগ, সব ক্ষোভ এক নিমেষে কোথাও উধাও হয়ে যায়। প্রেমের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে- দুরান্তে কোন এক অজানা দেশে। আসলে অক্ষয়বাবু মানুষটা তো খুব ভালো মানুষ।
সামান্য কারণে একটু বেশি বেশিই করে ফেলেন লাবণ্যময়ী দেবী। নিজের ভুলটা বুঝতে দেরি হয় না তার।
সমস্ত রাগ উধাও করে লাবণ্যময়ী দেবী বলে বসলেন, আর এক কাপ চা দেবো নাকি?
অক্ষয় বাবু বললেন, দেবে বলছো! দাও তাহলে!দুজনে দুজনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। যেন সেই অবশ হওয়া চাহনি—যাকে বলে শুভদৃষ্টি! দুজনেই যেন এক আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন এক পূর্ণতায়। এ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে বিশ্বাস আর ভরসায়। রাতের আকাশের চাঁদটাও ফেল ফেল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে অবাক বিস্ময়ে।
দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন: দেখো, চাঁদটা কেমন দেখছে আমাদেরকে! বলেই দুজনে হা হা হা হা করে হাসিতে পুরনো হয়ে ওঠেন।
আর দুজনেই একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন—-
“এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি! বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…………………।” -
কবিতা- মায়াবৃক্ষ
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
মায়াবৃক্ষ
-সোহিনী সামন্তকেউ কি পেয়েছো মায়াবৃক্ষের দেখা?
যা কিনা কুড়ে খেয়েছে মনের পাটাতন,
অদৃশ্য অশরীরীর মতন উবে গেছে মনের অভিলাষায়…
মায়াবৃক্ষের ফলস্বরূপ বিবেক, খালি মনের দরজায় টোকা মেরে যায়…এঁকেবেঁকে ওঠা মায়াবৃক্ষের শাখা-প্রশাখায়, কত না আছে বেদনার আখ্যান..
তুমি কি খোঁজ পেয়েছো সেই মায়াবৃক্ষের?
যার গায়ে পাপ নামক পিঁপড়ের দল বাসা বেঁধেছে…
পিঁপড়ের দল সেই বৃক্ষের ধমনীর রস আস্বাদন করেছে…
পুণ্য বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে তা বৃক্ষের মধ্যে পুনর্জীবনের আশা মাত্র…
পৃথিবীর মায়ায় আমরা চিরন্তন উজ্জীবিত,
মায়ার খেলায় বৃক্ষের শিকড় যথাযথ বন্দি,
প্রেম পুষ্পের জাগরণ ঘটে মন বৃক্ষের উন্মোচনে,
যত খেলা আছে, সবই অপূর্ণ থেকে যায়…
খেলার দুনিয়া কেবল বিভীষিকাময়, বৃক্ষ যে হবে আন্দোলিত।