-
তফাৎ
তফাৎ
-চিন্ময় মহান্তীশতচ্ছিন্ন নোংরা গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটা পরিত্যক্ত বোতল কুড়োচ্ছিল রেল লাইনে। ধীরে ধীরে ভর্তি হচ্ছিল বস্তাটা। হ্যাঁ অবশেষে ভর্তি হলো। তারপর সেটাকে পিঠে ঝুলিয়ে ছেলেটা হাঁটা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
আজ দুদিন হলো রোদের তাপ বেড়েছে , সাথে গরমও। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ছেলেটা আশ্রয় নিল চৌ রাস্তার মোড়ে , বড় বটগাছটার তলায়। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো বছর কয়েক আগের দিনগুলো , মা তখনও জীবিত ছিল। স্কুলের বন্ধুদের সাথে স্কুল থেকে ফিরে আসার পথে কতই না দোলনা দোলনা খেলেছে এই বটের ঝুরি ধরে। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখে জল এলো ছেলেটার। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগলো। একটু জল খাওয়ার জন্য সে এগিয়ে গেল সামনের টিউবওয়েলটার দিকে। জল খেয়ে গলাটা ভিজতেই ছেলেটার সম্বিত এলো। সে বস্তাটা পিঠে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল সামনের বাজারের দিকে।বস্তার বোতলগুলো মন্ডলের ভাঙা চুরোর গাদায় ঢেলে দিয়ে কয়েকটা পয়সা নিয়ে এসে সৎমায়ের হাতে দিলে আজ কোনো ঝাঁঝালো টিপ্পনী শুনতে হবে না , অন্ততঃ শান্তিতে দুটো ভাত খেতে পারবে ; এই চিন্তা করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ছেলেটা।
সামনের দিক থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে একজন আইসক্রিম বিক্রেতা আসছিল। তাকে দেখে ছেলেটা বলল , ‘ ও আইসক্রিম কাকু একটা সাদা বরফ দাও না , খেতে খেতে যাবো। ‘ আইসক্রিম কাকু বলল , ‘ কেন বাবা একটা আইসক্রিমই নাও না। ‘ ছেলেটা বলল , ‘ না কাকু ! আইসক্রিম কেনার পয়সা নেই যে আমার কাছে। ‘ ছেলেটার ঘর্মাক্ত শীর্ণ মুখটা দেখে আইসক্রিম কাকুর মনে দয়া হলো। সে মনে মনে ভাবলো , ‘ আমার ঘরেও তো এই ছেলেটার বয়সী ছেলে আছে। এ তো আমার ছেলেরই মতো। ‘ বাক্সটি খুলে একটা আইসক্রিম ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল , ” নাও বাবা। পয়সা লাগবে না। ” ছেলেটা আইসক্রিম খেতে শুরু করল। আইসক্রিম কাকু ঢপ করে আওয়াজ করে বাক্সটা বন্ধ করে ছেলেটার মুখের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল , ” বাবা এই বয়সে তোমার তো ইস্কুলে যাওয়ার কথা। এসব কেন করছো ? ”
” মা মারা যাওয়ার পর সৎমা এসে আমার ইস্কুল ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছে ,’ লেখাপড়া শিখে কি হবে তার থেকে এখন থেকে দুটো পয়সা সংসারে দিতে পারলে কাজে লাগবে , ” বাবা যে আমার থেকে তাকেই বেশি ভালবাসে- কাকু, আসছি কাকু , দেরি হলে পিঠে লাঠি পড়বে ;” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই ছেলেটা হাঁটতে শুরু করলো। আইসক্রিম কাকু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো , তারপর প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা এসে পৌঁছালো বাজারে । সঞ্জীব সরকারের কাপড়ের দোকানটা পেরোলেই মন্ডলের আড়ৎ । কাপড় দোকানটার সামনে এসেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। দোকানটাকে নতুন করে সাজিয়েছে সঞ্জীব । গোটা কয়েক পুতুল এনে নতুন পোশাক পরিয়ে দাঁড় করে রেখেছে দোকানের সামনে। ছেলেটা অবাক হয়ে ভাবলো এতোগুলো মানুষ নতুন পোশাক পরে এখানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন ? কৌতূহল নিয়ে ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে দেখল , মানুষ নয় ঠিক মানুষের মতো দেখতে পুতুল। সে সেগুলি দেখে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল , ” তোদের কি ভাগ্য বল ,তোরা পুতুল হয়েও দামী দামী নতুন নতুন পোশাক পরে আছিস। আর আমি দেখ মানুষ হয়েও এতো হতভাগা যে একটা গেঞ্জি জুটেছে সেটাও ছেঁড়া ফাটা। ” ছেলেটা যে পুতুলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি সঞ্জীব। হঠাৎ ছেলেটাকে দেখে সে দোকানের ভেতর থেকে চিৎকার করে বলল , ”এই ছেলে সর ওখান থেকে । নোংরা হাত দিয়ে ফেলিস নি তো। ” ছেলেটা খানিকটা আপরাধীর ঢঙে বলে , ” না না। ” তারপর হাঁটা দিল মন্ডলের আড়তের দিকে। যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল , ” ভগবান তোমার এই সৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কতো তফাৎ , কেউ কিছু না পেলে আমাকে খেতে দেয় না , কেউ তার ত্রিসীমানা থেকে তাড়িয়ে দেয় আবার কেউ আদর করে তার সামর্থ অনুযায়ী খাওয়ায়। ”
ছেলেটা এসে পৌঁছাল মন্ডলের আড়তে। তাকে দেখে বিধান মন্ডল বলল , ” যা বাবা মালগুলো গাদায় ঢেলে দিয়ে তোর কাকিমার কাছে যা ,দেখ আজ আবার তোর জন্য কি খাবার বানিয়ে রেখেছে কে জানে। ” ছেলেটা বস্তা ফেলে ছুটে মন্ডল কাকুর ঘরে ঢুকে ডাক দিল , ” কাকিমা ও কাকিমা। ” নিঃসন্তান মন্ডল কাকিমা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল , ” আহারে বাছার মুখটা খিদেয় একেবারে চুপসে গেছে। দাঁড়া আমি খাবার নিয়ে আসি। ” কাকিমা চটপট রান্না ঘরের দিকে দৌঁড়াল । ছেলেটা মনে মনে ভাবল , ” মন্ডল কাকিমা আর আমার সৎ মায়ের মধ্যে কতো তফাৎ। দুজনেই তো মহিলা। কেউ দেবী অন্নপূর্ণা আর কেউ ….।” ছেলেটার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই কাকিমা ফিরে এসে বলল , ” দেখিতো বাবা হা কর , খাইয়ে দি। ” ছেলেটা খেতে খেতে কাকিমার মুখের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকল যেন সাক্ষ্যাত দেবী মাকে দেখছে। -
মূল্যবান সজ্জা
মূল্যবান সজ্জা
-চিন্ময় মহান্তীঢাক কাঁধে সাইকেল চালিয়ে পাড়ায় ঢুকলো ঢাকি ।
মেয়েটা খেলছিল রাস্তায় , ঢাকি দেখেই ছুটে এলো ঘরে ;
বাবাকে জড়িয়ে ধরে —–
আদুরে গলায় বলল , ‘ বাবা , তুমি দিলে ফাঁকি ! ‘বাবার কন্ঠ রুদ্ধ হলো । চোখ দুটি পেলো চরম লজ্জা ।
খুকুর পুজোর ফ্রক এখনো কেনা বাকি ;
মাসাবধি ঝুলছে কারখানায় নোটিস । অনির্দিষ্টকালীন বন্ধ ।
বাবা মেয়েকে বলল , ‘ আদর দিয়েছি মা। একি কম সজ্জা!’অষ্টমীর ঢাকে কাঠি পড়লো । মেয়েটা তাকালো বাবার দিকে।
‘ বাবা –বাবা ! তোমার চোখে জল কেন বাবা ? ‘
‘ তোর ফ্রকটা এখনো যে দোকানেই মা ! ‘
‘ তাতে কি হয়েছে বাবা । না বাবা -না । পুজোতো হয়নি ফিঁকে । ‘নবমীর দিনে মেয়েটা বাবার সঙ্গে হাত ধরে প্যান্ডেলে গেল ।
চারিদিকে আলো । নতুন পোশাকের গন্ধ ।
চাইনিজ মেনুর রেস্তোরা গুলো ভিড়ে গাদাগাদি । মেয়েটা সব দেখল ।
বাবার হাত ধরে টানতে টানতে একটা ঘুগ্নির দোকানে গেল ।দশমী এলো । মেয়েটার চোখে জল ।
বাবা শুধায় , ‘ কাঁদিস কেন মা ? চারিদিকে কত বাজির শব্দ । ‘
‘ বাবা । মা যে চলে যাচ্ছে , আমাকে ছেড়ে !
সেই জন্মকালে যেমন গিয়েছিল আমায় ছেড়ে ! ‘
বাবা চোখ মুছে বলল , ‘ কি করবি মা বল ! ‘মা চলল । সবাই পিছু পিছু চলল , কলরব -বোলে ।
মেয়েটা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল , ‘ তুই যখন আসবি মা , সামনের বছর ।
দেখবি আমি অনেকটা বড় হয়েছি । আর একটা নতুন ফ্রকও পরেছি ।
শুধু দেখিস মা যেন বাবার কারখানাটা খোলে । ‘মেয়েটার প্রার্থনা শুনে বাবা ভাবে —
আমি নতুন একটা ফ্রক কিনে দিতে পারিনি ঠিকই ,
কিন্তু ব্যথায় সমব্যথী হতে শেখাতে পেরেছি ।
এটাই তো ওর জীবনে চলার মূল্যবান সজ্জা হবে ,
ফ্রক , সেতো অচিরেই ছিঁড়ে যাবে । -
ভালবাসার শেকড়
ভালবাসার শেকড়
চিন্ময় মহান্তী১
বিকেল হলেই সাজতে বসে ফুলকি । টান টান করে চুল আঁচড়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায় । বার কয়েক আয়নায় তাকিয়ে দেখে নেয় নিজেকে । ওঘর থেকে হাঁক দেয় তারই সখী ফুলি , ‘ কি লো হইছে । ‘ ফুলকি কপালে টিপ লাগাতে লাগাতে বলে , ‘ হ যাই । ‘ তারপর দুজনে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় রাস্তার বড় লাইটটার নিচে ।
রাত বাড়তে থাকে , বাড়তে থাকে বাবুদের আনাগোনা । ফুলকির এসব আর ভালো লাগে না । সে বেণীর চুলগুলো নাড়তে নাড়তে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাড়ায় ঢোকার মুখে রাস্তার দিকে । পরপর তিন তিনটে বাবুর ধকল সয়ে ফুলি বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় ফুলকির কাছে , বিড়বিড় করে বলে , ‘ টাকা দিয়েছে বলে মানুষ বলে ভাবে না , হায়নাগুলো । ‘ ফুলির কথা কানে যায় না ফুলকির । কোনো উত্তর না পেয়ে ফুলি ঝাঁঝিয়ে বলে , ‘ ইনি আবার পিরিতে মজেছেন । ধুর ! আমাদের আবার এসব ।’ বিরক্ত হয়ে চলে যায় ফুলি চার নম্বর বাবুর সাথে । ফুলকি তখনও দাঁড়িয়ে থাকে । অপেক্ষা করতে করতে ফোনটা বার করে গোপন মানিব্যাগ থেকে । তারপর একটা নম্বর ডায়াল করে । ওপ্রান্ত থেকে শোনা যায় , ‘ যাচ্ছি গো যাচ্ছি । জ্যামে আটকে পড়েছি । ‘ ওর মুখ থেকে ‘ গো ‘ ডাকটা শুনতে বেশ ভালো লাগে ফুলকির । ফোনটা কেটে যায় কিন্তু তার কানে ভ্রমরের গুনগুন আওয়াজের মতো ঘনঘন বেজে যায় , ‘ যাচ্ছি গো যাচ্ছি । ‘২
ফুলকির আজ ভীষন মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা । যখন বাবু তার কাছে আসতো সেজেগুজে দামী পারফিউম মেখে । সে মুখটা গুঁজে দিত বাবুর বুকে । তারপর কাজলের তলে রাত-ভোর এঁকে যেত হাজার স্বপ্ন । সেই স্বপ্নগুলোর শেকড় মাটি খুঁজে পায় একদিন , ফুলকির সিঁথি ভরে ওঠে সিঁদুরে । টেবিলের উপর রাখা আয়নাটা তুলে নেয় ফুলকি , নিজের বিবর্ন মুখটা দেখে আঁতকে ওঠে । বাবুর জন্য মনটা কেমন করে ওঠে । সে চলে গেলে বাবু কি করে একা থাকবে – এই চিন্তা এসে গ্রাস করে ফুলকির দৃষ্টি । ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঝাপসা হয় । কয়েক ফোঁটা চোখের জল টপটপ করে পড়ে বালিশের বুকে ।
বাবু ঘরে ঢুকে দেখে ফুলকি কাঁদছে । কাছে গিয়ে পরম আদরে চোখের জল মুছিয়ে বলে , ‘ তুমি ভালো হয়ে যাবে ফুলকি । ‘ ফুলকি জানে যে রোগ এসে ধরেছে তাকে তা থেকে মুক্তি একমাত্র মৃত্যু , তবুও বাবুর কথায় মাথা নেড়ে জানান দেয় এখনো ভালো হয়ে বাবুর সাথে দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করার আশা রয়েছে তার বুকে । দু’ হাত বাড়িয়ে বাবুর মুখটা কাছে টেনে নেয় ফুলকি , তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে , ‘ বাবু , পরজনমেও যেন এই ভাবে কাছে পাই তোমায় ! তুমি থাকবে তো ? ‘ কথাটা শুনে ফুলকির ডান হাতের কব্জিটা চেপে ধরে বাবু । চারটি চোখের জল জানিয়ে দেয় ভালবাসার শেকড় মাটির ভেতরের জল খুঁজে পেয়েছে । -
বুমেরাং
বুমেরাং
-চিন্ময় মহান্তী১
দশম শ্রেনীর গণ্ডি পেরিয়ে এবছর একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে তিতলি । নতুন স্কুলে এসে তার নতুন বান্ধবী হয়েছে রিয়া । বন্ধুত্বের দিন কয়েক পর একদিন ক্লাসের ফাঁকে তিতলি দেখল , রিয়া একটা স্মার্ট ফোন বের করে কি সব করছে । তার কৌতুহল হলো । সে রিয়ার আরো একটু কাছে এগিয়ে দেখল , সে ফেসবুক খুলে কি যেন করছে । স্মার্ট ফোন তো স্বপ্নের কল্পনা , তিতলি এখনো কীপ্যাড ফোনও ভালো করে হাত দিয়ে দেখেনি । রিয়ার হাতে স্মার্ট ফোন দেখে তার আগ্রহ প্রবল হলো । সে বলল , ” দে না রিয়া একবার দেখি । ” রিয়া তার হাতে ফোনটি দিতেই তিতলি সেটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল । কি সুন্দর সোনালী রঙের পাতলা একটি ফোন । দেখেই তার মনে সেরকম একটি ফোন পাওয়ার আকাঙ্খা বাসা বাঁধল , সে রিয়াকে জিজ্ঞেস করল , ” কত দাম রে রিয়া ? ” ” বারো হাজার, ” বলেই রিয়া ফোনটি তিতলির হাত থেকে নিয়ে মন দিল ফেসবুক চ্যাটে । অপরের জিনিসের প্রতি নিজের অধিকার থাকে না অথবা সেটি কেনার সামর্থ থাকে না বলে অনেক সময় শুধুমাত্র চোখের দর্শন তৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করার জন্য যেরূপ দূর হতে সেই কাঙ্খিত দ্রব্যটির প্রতি অসামর্থ ব্যক্তি তাকিয়ে থাকে , তিতলিও সেরকম দেখতে লাগলো । এমন সময় পাশাপাশি বসে থাকা মেয়েদের মধ্য হতে একটি সোরগোল উঠল , ” চল চল ম্যাডাম ক্লাসে যাচ্ছেন । ” রিয়া তড়িঘড়ি ফোনটি উড়নার নিচে লুকিয়ে ক্লাসে চলে গেল । তিতলিও তার পিছুপিছু গেল ।
সুবিকাশ তিতলির বাবা । তিনি উঠানে কয়েক গোছা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ঝুড়ি বুনছিলেন । এই ঝুড়ি বিক্রি করে যেটুকু আয় হয় তাতেই দিনাতিপাত হয় । তিতলি স্কুল থেকে ফিরে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো । সে সচরাচর এমন করে না , স্কুল থেকে ফিরে সোজা ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে হাঁক দেয় , ” মা খেতে দেবে এসো । ” আজকে মেয়ের এমন ব্যতিক্রম আচরণ দেখে সুবিকাশ বললেন , ” কিছু বলবি মা ! ” তিতলি আমতা আমতা করে বলল , ” বাবা , আমার বান্ধবী রিয়া , স্মার্ট ফোন নিয়ে স্কুলে যায় । আমাকে একটা কিনে দাও না । ” স্মার্ট ফোন সম্পর্কে সম্পূর্ন অজ্ঞ তিতলির বাবা মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন , ” কত দাম মা ? ” তিতলি বাবার এই প্রশ্নে খানিক প্রফুল্ল হয়ে বলল , ” বেশি নয় দশ – বার হাজার মাত্র । ” তিতলির কাছে যেটি মাত্র , সুবিকাশের কাছে যে সেটি বিস্তর তা তিতলির ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বুঝলো না । সুবিকাশ সরাসরি অসম্মতি জানিয়ে মেয়েকে কষ্ট দিতে চাইলেন না । নিরস কন্ঠে বললেন , ” দেখছি ! ” পিতার বাক্যে আশা পেয়ে তিতলি ঘরে ঢুকল ।২
দু’ মাস কেটে গেছে । তিতলির বাবার দেওয়া কথা এখনো বাস্তবায়িত হয় নি। তিতলি আগের মতোই স্কুলে গিয়ে , ক্লাসের ফাঁকে রিয়ার ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে । তার এইরূপ একটি ফোন প্রাপ্তির আকাঙ্খা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে । এই নিয়ে ইতিপূর্বে সে তার বাবাকে দু’ চারটি কড়া কথা শুনিয়েছে । বাবা তার অক্ষমতা বোঝাতে সমর্থ হন নি। মা বার বার বলেছেন , ” জেদ করিস না মা , আমাদের সংসার খুব কষ্টে চলে । তার উপর তুই যদি এমন জেদ করিস , কি করি বলতো ! ” মায়ের কথায় সেদিন তিতলি চুপ করেছে । এর জন্য হয়তো তিতলিকে দায়ী করা যায় না । এই বয়সে এই রকম একটা জেদ মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় । যারা একে জয় করতে পারেনা তারা বিমুখ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে । আর তার ফল ভয়াবহ রূপে দেখা দেয় । বিপরীত পক্ষে এই জেদ যদি পড়াশোনা মুখী হয় তাহলে একটি সুফল লাভ হয় । কিন্তু কার্যত বহু ক্ষেত্রেই এটি বাহ্যিক চাহিদা মুখী হয় , যদি পিতা মাতার মধ্যে সন্তানের আবদার মেটানোর অত্যধিক প্রবনতা থাকে । তিতলির ক্ষেত্রে তাই হলো । সেদিন রিয়া ফোনটি নিয়ে কি করছিল , তিতলি অধিক কৌতুহলী হয়ে ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল , ” দেখি দেখি একবার দে। ” রিয়া তিতলির এই আচরনে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল , ” দিন দিন কত দেখবি , একটা কিনে নিলেই পারিস তো । ” রিয়ার কথা শুনে তিতলির মনের অতল হতে না পাওয়ার একটি কষ্ট বুদবুদের আকারে বিবেকে আঘাত করল । আজ এই অপমানের জন্য নিজের বাবার অসামর্থতাকে দায়ী করে চুপ করে সে সেই স্থান ত্যাগ করলো । রিয়া ফোন নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল , বান্ধবীর হৃদয়ে যে একটি অপমানের তির সে বিঁধল তা বুঝতেই পারল না । তিতলি স্কুলের সারাটা সময় মন খারাপ করে কাটাল । একবারের জন্যও আর রিয়ার মুখোমুখি হলো না ।
স্কুল থেকে ফিরে কাউকে কিছু না বলে সে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল । খিল তোলার শব্দে তিতলির মা ছুটে এসে দরজা চাপড়ে বলতে লাগলেন , ” কি হলো মা ? দরজা খোল । ” স্ত্রীর হাঁকডাকে সুবিকাশ হাতের কঞ্চিগুলো উঠানে ফেলে ছুটে এলেন । বাবা মায়ের তীব্র আর্ত আহ্বানে তিতলির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না । ছোটো থেকে আদরের মেয়ের সমস্ত আবদার মিটিয়ে , মেয়ের কাছে দারিদ্রতাকে লুকিয়ে রেখে সুবিকাশ যে একটা বড় ভুল করেছিলেন তা বুমেরাং হয়ে তার কাছেই ফিরে এলো । -
জোয়ার ভাঁটা
জোয়ার ভাঁটা
-চিন্ময় মহান্তী১
কালাচাঁদ পৃষ্ঠদেশে পুস্তকের থলেটি লইয়া তাহার কাকার সহিত পাঠশালা হইতে আসিতেছিল । একটি লাল মাটির নুড়ি তাহার পদাঘাতে গড়াইতে গড়াইতে আসিতেছিল । তাহার কাকা তাহাকে বারংবার বলিতেছিলেন , ” একটু তাড়াতাড়ি চল বাবা । ” কিন্তু কালাচাঁদের , কাকার কথার প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ ছিল না । সে অভ্যাসবশতঃ সেই নুড়িটাকে পদাঘাত হইতে অব্যাহতি দান করিতে বিশেষ উৎসুক হইতেছিল না ।
কাকার সহিত যখন কালাচাঁদ ঘরে ঢুকিল দেখিল উঠানের মধ্যখানটিতে অনেকগুলি মহিলা জমায়েত হইয়া কিছু একটা ঘিরিয়া রাখিয়াছে । তাহার পিতা অদূরে বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া মুহ্যমান হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন । রাতুল কাকা কয়েকটা খড়ের আঁটি লইয়া বুন্দি পাকাইতেছেন । কালাচাঁদ উৎসুক হইয়া গ্রাম্য মহিলাদের ভিড় সরাইয়া দেখিল , একটা সাদা ধুতি মুখ অবধি ঢাকিয়া কেহ যেন ঘুমাইতেছে । সে সেই ঘুমন্ত মানুষটির নিকট গিয়া তাহার মুখের ঢাকা সরাইতেই দেখিল তাহার মাতা তাহাকে ছাড়িয়া চিরনিদ্রামগ্ন হইয়াছেন । কালাচাঁদ এই দৃশ্য দেখিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল । দীর্ঘকাল রোগ শয্যায় শায়িত থাকিয়া তাহার মাতা অদ্য পরলোক যাত্রা করিয়াছেন । কালাচাঁদ কাঁদিতে কাঁদিতে পিতার নিকট আসিয়া , তাহার মাতার মৃত্যুর জন্য পিতাকে দায়ী করিতে লাগিল । অর্থের অকুলান জনিত কারনে তিনি যে স্ত্রীর সুচিকিৎসা করাইতে পারেন নাই ,তাহা কিরূপে সদ্য মাতৃহারা এই সন্তানকে বুঝাইবেন তাহা স্থির করিতে ব্যর্থ হইয়া অবনত মস্তকে পুত্র কর্তৃক আরোপিত দোষারোপ হজম করিতে লাগিলেন । এমতসময় কালাচাঁদের কাকা মহিম চাটুয্যে আসিয়া তাহাকে বলিলেন , ” বাবা দোষারোপ করার সময় এখন নয় । তোমার মায়ের সদগতি করতে হবে , চল । ” কাকার কথামত সে তাহার মাতার নিকটে গেল । মহিম চাটুয্যে একটা ধুতি লইয়া আসিয়া তাহাকে পরাইলেন । পাড়ার যুবক রীতেশ আসিয়া বলিল , ” মহিম খুড়ো , শ্মশানে কাঠ পৌঁছানো হয়েছে । ” মহিম খুড়ো তাহার কথার উত্তরে বলিলেন , ” আচ্ছা , সবাই মিলে চল তাহলে । ” রাতুল খুড়ো বুন্দিটি কালাচাঁদের হাতে দিয়া বলিলেন , ” বাবা , এটিতে আগুন দাও । ” কালাচাঁদ তাহাতে অগ্নি সংযোগ করিল । সকলেই ‘ হরিবোল বোলহরি ‘ বলিয়া হরিধ্বনি সহযোগে কালাচাঁদের মাতাকে লইয়া শ্মশান অভিমুখী হইল । কালচাঁদের পিতা চন্দ্রকান্ত বারান্দার সেই খুঁটিটিতে ঠেস দিয়া দেখিলেন তাহার সহধর্মিনী তাহাকে ছাড়িয়া স্বর্ন রথে আরোহন করিয়া স্বর্গে যাইতেছেন।
শ্মশানে আসিয়া কালাচাঁদের মাতাকে চিতার উপর উপুড় করিয়া শুয়াইয়া দেওয়া হইল । পুরোহিত তাহার যথাবিহিত কর্ম সমাপন করিয়া কালাচাঁদকে বলিলেন , ” বাবা এবার মুখাগ্নি করো । তারপর জলে ডুব দিয়ে মায়ের দিকে না তাকিয়ে দূরে গিয়ে বসো । ” কালাচাঁদ হাতে করিয়া কুঁচি কাঠি দ্বারা নির্মিত অগ্নি শলাকাটি মাতার মুখের সম্মুখে লইয়া গিয়া ফিরাইয়া লইল । তাহার চক্ষু বিদীর্ন করিয়া অশ্রু আসিয়া কোমল চিবুক বহিয়া ভূমে পতিত হইতে লাগিল । ইহা দেখিয়া তাহার কাকা তাহাকে বক্ষে জড়াইয়া বলিলেন , ” বাবা সবাইকে একদিন এই ভবের মায়া ফেলে যেতে হয় । ” কাকার এই তত্ত্বে কালাচাঁদের অশ্রু বিন্দুমাত্র কমিল না । সে বারংবার বলিতে লাগিল , ” আমি আমার মাকে পোড়াতে পারবো না । ” পুরোহিত বলিলেন, ” বাবা , তুমি মুখাগ্নি না করলে যে তোমার মায়ের সদগতি হবে না । ” কালাচাঁদ পুরোহিতের কথা শুনিয়া কি ভাবিল বলিতে পারিনা । তাহার মাতার মুখাগ্নি করিয়া জলে ডুব দিয়া উঠিয়া গিয়া , দূরে চিতার দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিল । পুরোহিতের বিধান মান্য করিয়া সে তাহার মাতার স্বর্গ গমন দেখিতে পাইল না । শিশু মনে মাতার স্বর্গারোহণের একটি কাল্পনিক চিত্র আঁকিতে লাগিল । যেখানে সে দেখিল স্বর্গ হইতে একটি স্বর্ন রথ নামিয়া আসিল , তাহাকে দুইটি পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে । তাহার মাতা সেই রথে বসিয়া রহিয়াছেন ।
শবদেহ পোড়ানো শেষ হইতেই কালাচাঁদের কাকা তাহার নিকটে আসিয়া দক্ষিণ স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন , ” চল বাবা , বাড়ি চল । ” কালাচাঁদ কাকার হাত ধরিয়া গৃহ অভিমুখী হইল।২
পুর্বোক্ত ঘটনার পর দীর্ঘ দুই বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে । কালাচাঁদের পিতা চন্দ্রকান্ত আজ সাজিয়া গুজিয়া রাসের মেলা দেখিতে যাইতেছেন । সাজা বলিতে একখানা সাদা পাঞ্জাবি ও একটি নীল রঙা জিন্স প্যান্ট পরিয়া , টেরি কাটিয়া গায়ে দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত রজনীগন্ধা সেন্ট ঢালিলেন । তাহাকে দেখিয়া বুঝিতে পারা কঠিন যে তাহার পত্নী গতা হইয়াছেন । উঠানে কালাচাঁদ সুখী গাভীর দুই মাসের বাছুরটিকে ঘোড়া বানাইয়া খেলিতেছিল । চন্দ্রকান্ত উঠানে আসিতেই তাহাকে দেখিয়া সে বলিল , ” বাবা , কোথায় যাবে ? ” পুত্রের কথায় কোনো উত্তর না করিয়া চন্দ্রকান্ত বাহির হইয়া গেলেন । কালাচাঁদ পিতার যাইবার পানে চাহিয়া রহিল। এই দৃশ্য দূর হইতে তাহার মাতার সখী পার্শ্ববর্তী গৃহের বধূ অনু লক্ষ্য করিয়াছিলেন । তিনি তাহার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন , ” চল বাবা , ক্ষীর বানিয়েছি , খাবি চল । ” কাকিমার কথা শুনিয়া ক্ষীরের প্রতি লোভ বশত কালাচাঁদ তৎক্ষণাতের জন্য পিতার কথা ভুলিল ।
রাসের মেলায় ঘুরিতে ঘুরিতে এক সুন্দরী রমনীকে দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বিমোহিত হইলেন । তিনি তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে ঘুরিতে লাগিলেন। দীর্ঘক্ষন পর রমনী ইহা লক্ষ্য করিয়া সরাসরি তাহাকে বলিলেন , ” আপনি পিছু নিয়েছেন কেন ? ” চন্দ্রকান্ত নিশ্চুপ রহিলেন । রমনীর সখী কানে কানে বলিল , ” বুঝ্ছিস না , তোর রূপে পাগল হয়ে গেছে , তুইও তো স্বামী পরিত্যক্তা , পুরুষটি দেখতে তো ভালোই , যদি ……। ” দীর্ঘক্ষন চুপ থাকিয়া চন্দ্রকান্ত রমনীকে উদ্যেশ্য করিয়া বলিলেন , ” আপনার নাম কি ? ” রমনী বলিলেন , ” সুকন্যা ” । উহাদের মধ্যে বাক্যালাপ শুরু হইয়াছে দেখিয়া সুকন্যার সখী অনতিদূরে সরিয়া গেলেন । গল্প প্রসঙ্গে উভয়ে উভয়ের জীবনের অতীত বলিতে লাগিলেন । হঠাৎ করিয়া সুকন্যা বলিয়া বসিলেন , ” আমাকে বিয়ে করবে চন্দ্র ? ” চন্দ্রকান্ত হইতে এতো সহজেই তিনি সুকন্যার নিকট চন্দ্র হইয়া উঠিবেন তাহা কল্পনাও করেন নাই । তিনি বলিলেন , ” তোমার ফোন নম্বর দাও , পরে ফোনে বলবো । ” সুকন্যা তাহার ফোন নম্বর বলিতে লাগিলেন । চন্দ্রকান্ত আপনার সেলফোনটিতে তাহা টুকিয়া লইলেন । বর্তমান এন্ড্রয়েড ফোনের যুগে তাহার মান্ধাতা আমলের কাতুমার্কা সেল ফোনটা সুকন্যার নিকট বাহির করিতে কুন্ঠা বোধ হইতেছিল , প্রেমের নিকট সেই কুন্ঠা হার মানিয়া গেল ।
সন্ধ্যা নামিয়া আসিল । মেলার ভিড় কমিতে লাগিল । উহারাও উভয়ে উভয়ের প্রতি অদ্যকার মত শেষ প্রেমদৃষ্টি বিনিময় করিয়া লইলেন।চন্দ্রকান্ত যখন ফিরিয়া আসিলেন ,দেখিলেন কালাচাঁদ খাটিয়ায় শুইয়া অঘোরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তিনি মধ্যাহ্নের অবশিষ্ট ভাত একটি স্টিলের সানকিতে বাড়িয়া খাইতে বসিলেন । এমতসময় তাহার ফোনটি বাজিয়া উঠিল , ফোন ধরিতেই অপর প্রান্ত হইতে একটি নারীকণ্ঠ বলিল , ” চন্দ্র বাড়ি পৌঁছেছ ? ” চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” খেতে বসেছি । ভেবে কাল তোমাকে বলবো । ” ” আচ্ছা ” বলিয়া সুকন্যা ফোন কাটিয়া দিলেন । চন্দ্র খাওয়া শেষ করিয়া , এঁটো বাসন তুলিয়া রাখিয়া পুত্রের পাশের একটি খাটিয়ায় শুইলেন।
৩
সুকন্যার সহিত চন্দ্রের প্রেম উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে লাগিল । পুত্রকে তিনি বিষ নজরে দেখিতে লাগিলেন । উঠিতে বসিতে কালাচাঁদ তাহার পিতার অত্যাচারের শিকার হইতে লাগিল । একদিন অপরাহ্নে কালাচাঁদ সুখী গাভীকে খড় দিতে ভুলিয়া গিয়াছিল । চন্দ্রকান্ত কোথায় বাহির হইয়াছিলেন বলিতে পারিনা , ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন সুখীর সম্মুখের ঝুড়িটি খালি, একটিও খড় নাই । ইহা দেখিয়া পুত্রের উপর যারপরনাই ক্রুদ্ধ হইয়া তিনি একটি বাসের কঞ্চি কুড়াইয়া তাহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন । কালাচাঁদের তীব্র কান্না শুনিয়া তাহার কাকা মহিম ছুটিয়া আসিলেন । তিনি চন্দ্রকান্তকে বলিলেন, ” ছিঃ চন্দ্র, দুধের বাছাকে মারছিস । ” চন্দ্রকান্ত তাহার ভ্রাতার প্রতি একটি তীব্র অশ্রাব্য বাক্যবান প্রয়োগ করিয়া বলিলেন , ” আমার ছেলে না তোর ছেলে , দরদ উথলে উঠছে । দেখেতো মনে হচ্ছে তুই ওর বাবা । ” মহিম আর কোনো বাক্যব্যয় না করিয়া আপনার ঘরে চলিয়া গেলেন । তিনি ভাবিলেন পৃথক হাঁড়ির ভাত যখন খাই তখনতো আর দেখিতে যাওয়া ঠিক নহে । তাহার মনে পড়িল এই চন্দ্রকান্তই একদিন তাহার বধূকে চুলের মুঠি ধরিয়া থাপ্পড় মারিয়াছিলেন , যদিও সেদিনের রন্ধনে অতিরিক্ত লবন হইবার পশ্চাতে চন্দ্রকান্তর বধূরেই ভূমিকা ছিল , কিন্তু তিনি তাহা বিশ্বাস করেন নাই , মহিম বুঝিয়াছিলেন ইহা পৃথক হইবার অজুহাত । সেইদিন হইতেই ভাতের হাঁড়ি পৃথক হইয়াছে ।
হঠাৎ চন্দ্রকান্তের ফোন বাজিয়া উঠিল । তিনি কঞ্চিটি ফেলিয়া ফোন ধরিয়া উঠানের এক কোনায় গিয়া কথা বলিতে লাগিলেন । তাহার ফোনের কথোপকথনের মধ্যে একটি কথা শোনা গেল , ” আগামী ২২ এ বৈশাখ দিনটি ভালো আছে , রায়চকের মহামায়া মন্দিরে ……। ” বাকি কথোপকথন শ্রুত হইল না । চন্দ্রকান্ত উঠান ছাড়িয়া পূবের মাঠের দিকে চলিয়া গেলেন।৪
সকাল হইতেই পিতা গৃহে অনুপস্থিত রহিয়াছিলেন । অদ্য কালাচাঁদের গৃহে উনুন জ্বলে নাই । প্রাতে জল সহযোগে কয়েকটা মুড়ি খাইয়া কালাচাঁদ সেই যে তখন হইতে সুখী গাভীর বাছুরটির সহিত খেলায় মতিয়াছে এখনো তাহা ভাঙে নাই । সূর্যদেব শিরের উপর বিরাজ করিতেছেন । কালাচাঁদের আপন মস্তকের ছায়া তাহার পদযুগলের নিকট দৃশ্য হইতেছে । তাহার কাকিমা সকাল হইতেই দেখিয়াছেন যে সে উঠানে খেলিতেছে এবং তাহার নিকটে আসিলে তাহার পিতা চন্দ্রকান্ত কটু কথা শুনাইতে পারেন ইহা ভাবিয়া আসিতে সাহস করেন নাই । এক্ষনে কালাচাঁদকে উঠানে দেখিয়া তিনি নিশ্চিত হইয়াছেন তাহার পিতা গৃহে নাই । যদি থাকিতেন তাহা হইলে কালাচাঁদের খেলা সমাপ্ত হইত । তিনি তাহার নিকটে আসিয়া বলিলেন , ” বাবা চান করেছিস । ” কাকিমার গলা পাইয়া তাহার খেলা ভাঙিল । সে বাছুরটিকে ছাড়িয়া দিয়া কাকিমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল , ‘ না । ‘ তাহার কাকিমা বলিলেন , ” চল বাছা , চান করে খেয়ে নিবি । ” কালাচাঁদ কাকিমার হাত ধরিয়া উঠান ত্যাগ করিল।
সন্ধ্যা নামিল । পাখিরা আপন বাসায় ফিরিতে লাগিল । চন্দ্রকান্ত , সুকন্যাকে লইয়া গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন , মেঝের মধ্যখানটিতে একটি চট পাতিয়া বই খুলিয়া কালাচাঁদ পড়িতেছে, ” ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা ….। ” তাহার পিতার সহিত এক রমনীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কালাচাঁদের জমিদার হইয়া পায়রা পুষিবার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হইয়া গেল । চন্দ্রকান্ত , সুকন্যার প্রতি কালাচাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে তাহাকে বলিলেন , ” এ হলো তোর নতুন মা । ” কালাচাঁদ চাহিয়া দেখিল কিন্তু নিরুত্তর রহিল । সে কিছুতেই তাহার মাতার স্থলে অন্য কাউকে বসাইতে পারিল না । সুকন্যাও তাহাকে পুত্র বলিয়া মানিয়া লইতে বিশেষ আগ্রহ দেখাইলেন না । কালাচাঁদ এবং সুকন্যার পারস্পরিক অনাগ্রহ দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বুঝিলেন , জোরপূর্বক গাধাকে পিটাইয়া ঘোড়া বানানো যায় না । তিনি একটি খাটিয়ায় বসিয়া, সুকন্যাকে ডাকিয়া বলিলেন , ” সু , তুমিও বসো । ” কালাচাঁদ সেইস্থল হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া উঠানে আসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল । চন্দ্রকান্ত বারকয়েক ডাকিয়া তাহার গলা না পাইয়া বলিলেন , ” আপদ গেল । ” কালাচাঁদ উঠান হইতে পিতার কথাটি শুনিতে পাইল । তাহার শিশুমন হয়তো বুঝিল এখানে থাকা অনাবশ্যক তাই সে গৃহের নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া বড় রাস্তা ধরিল । অনেক রাত্রি পর্যন্ত ফিরিয়া না আসিলেও চন্দ্রকান্ত তাহার পুত্রের খোঁজ করা আবশ্যক মনে করিলেন না । আপদ বিদাই হইয়াছে ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।
৫
বাইশ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে । সেইদিনের সেই ছোট্ট কালাচাঁদ বর্তমানে কালু মস্তান হইয়াছে । সেইদিন রাস্তা হইতে তুলিয়া আনিয়া ডাকাতের সর্দার বিলু তাহাকে আশ্রয় দিয়া বড় করিয়া তুলিয়াছে । তাহারই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বয়স ভারাক্রান্ত বিলুর সমস্ত অসামাজিক কর্মের দায়িত্ব কালু আপন স্কন্ধে লইয়াছে । অদ্য ব্যাংক ডাকাতি করিয়া বিস্তর অর্থ লইয়া আসিয়া বৃদ্ধ বিলুর নিকট দিতেই , বিলু খুশি হইয়া সকল সদস্যদের তাহা বিলাইয়া দিয়া আপন ভাগের অর্থ পুরস্কার স্বরূপ কালুর হস্তে তুলিয়া দিয়া বলিল , ” এই টাকা তোর । ”
কালু পূর্বে বহু ডাকাতি করিয়াছে কিন্তু এই ধরনের বড় ডাকাতি এই প্রথম । অনেকগুলি টাকা হাতে পাইয়া সে ভাবিতে বসিল , এই টাকা লইয়া কি করিবে ? সে দেওয়ালে টাঙানো বৃহৎ আরশিটিতে তাহার প্রতিবিম্ব দেখিতে লাগিল । পশ্চাৎ হইতে একটি কন্ঠ শুনিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল তাহার সহকর্মী ভোলা তাহাকে ডাকিতেছে । সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিতেই সে নিকটে আসিয়া বলিল , ” রানু মাসির কাছে খবর পেলাম নতুন আমদানি হয়েছে , এই প্রথম সে এই লাইনে এসেছে , যাবি নাকি ? ” যদিও ইহার আগে সে এই পথ মাড়ায় নাই , কিন্তু সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে । ভোলার কথা শুনিয়া এবং নিজের পকেটে বিপুল অর্থ দেখিয়া সে রাজি হইল ।
উদ্যেশ্যস্থলে পৌঁছাইয়া কালু দেখিল , বিজলী বাতির ম্লান আলোকে অনেকগুলি ঝুপড়ি দেখা যাইতেছে ; তাহারেই একটির দরজার নিকট গিয়া ভোলা মৃদুস্বরে ডাকিল , ” রানু মাসি আছো নাকি ? ” তাহার ডাকে ঝুপড়ির দরজা খুলিয়া একজন মধ্যবয়সী মহিলা বাহির হইয়া আসিল । ভোলা, কালুকে দেখাইয়া তাহাকে বলিল , ” এ হলো আমার বন্ধু । অনেক বলে কয়ে আজ নিয়ে এলাম । সেই নতুনটি কোথায় ? ” রানু মাসি একটি দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল । ভোলা , কালুকে বলিল, ” যা ঐ ঘরে ঢুকে পড় । ” কালু পূর্বে এই ব্যাপারে অভ্যস্থ নয় বলিয়া ইতস্তত করিতে লাগিল । রানু মাসি তাহা দেখিয়া বলিল , ” এ ভোলা এ তুই কাকে লিয়ে আলি । এ ছোড়া তো দেখছি ম্যাইয়া ।” রানু মাসির কথা কালুর কানে বিঁধিল , তাহার পুরুষত্ব লইয়া ঠাট্টা শুনিয়া সে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া দরজা ঠেলিয়া ঢুকিয়া দেখিল , ঘরে একটি নীল বাতি জ্বলিতেছে । একটি রমনী সাজিয়া গুজিয়া তক্তার উপর বসিয়া রহিয়াছে । ব্যাঘ্রের আক্রমন নিকটে দেখিয়া সেই রমনী হু-হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল । তাহার কান্না দেখিয়া কালুর অন্তর ব্যথিত হইল । সে ইহা দেখিয়া অনুভব করিল তাহার হৃদয়ে শৈশবে যে মনুষ্যত্ব রহিয়াছিল তাহা এখনো টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে । কালু সেই রমনীর নিকট গিয়া বলিল , ” তুমি কাঁদছো কেন ? ” রমনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল , ” আমি কখনো ভাবিনি যে এই পথে আসতে হবে , ভাগ্য আমাকে এই পথে নিয়ে এলো । ” কালু উৎসুক হইয়া বলিল , ” কেন ? যদি কিছু মনে না কর আমাকে খুলে বলো । ” কালুর কথায় রমনীটি কি ভরসা পাইল তাহা আমি অজ্ঞাত , তাহার জীবনের আদ্যপ্রান্ত বলিতে শুরু করিল । দুইজনের গল্প শেষ হইতে চাহে না । ভোর হইয়া আসিল , ভোলা দরজা ঠেলিয়া বলিল , ” কইরে কালু যাবি না । ” ঘরের অভ্যন্তর হইতে উত্তর আসিল , ” আর কিছুক্ষণ দাঁড়া ।” কালু পকেট হইতে একটা পাঁচশত টাকার নোটের বান্ডিল বাহির করিয়া , রমনীর উদ্যেশ্যে বলিল , ” এই নাও হেনা , তোমার বাবার চিকিৎষা করাও । ” কালাচাঁদ উঠিয়া দাঁড়াইল , হেনা তাহাকে প্রনাম করিয়া বলিল , ” তুমি আমার দেবতা । আমার বাড়ি যেও । ” কালাচাঁদ না চাহিলেও হেনা জোরপূর্বক তাহার গালে একটি ভালোবাসার মুহূর্ত আঁকিয়া দিল । কালাচাঁদ বলিল , ” আর তুমি এখানে আসবে না । আমি থাকতে এভাবে তুমি নিজেকে বিক্রি করবে না । আজ আসি , কাল তোমার ঠিকানায় পৌঁছে যাবো । ” কালাচাঁদ দরজা খুলিয়া চলিয়া গেল । হেনা ঠাকুরের উদ্যেশ্যে প্রণাম করিয়া বলিল , ” ঠাকুর তুমি অপার করুনাময় , তোমার আরাধনা আজ সফল হলো । ”৬
সকাল হইতেই হেনা বারংবার দরজা দিয়া নিকটস্থ পথের পানে দেখিতেছে । অবশেষে তাহার প্রতীক্ষার অবসান হইল । তাহার ভালবাসার মানুষটি দৃশ্য হইল । হেনা ছুটিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িতে সকাল ১০ টা বাজিয়াছে । হেনার ঘরে ঢুকিয়া কালু দেখিল , একজন হাড় জিরজিরে ব্যক্তি খাটিয়ায় শুইয়া রহিয়াছেন । কালুর বুঝিতে অসুবিধা হইল না যে ইনিই হেনার পিতা । তাহাকে নিকটে ডাকিয়া হেনার পিতা বলিলেন , ” বাবা একবছর বন্যায় আমার ঘরবাড়ি সকলই ভেসে যায় । সেই বান হেনার মা কেও নিয়ে যায় । আমি ছোট্ট হেনাকে বুকে করে নিয়ে এখানে চলে আসি । হেনার মুখ থেকে তোমার কথা শুনে আমি শান্তি পাই । ” হেনা কালুর জন্য জল এবং চা লইয়া আসিল । কালু তাহা তাহার হাত হইতে লইল । বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন , ” বাবা এই বৃদ্ধের একটি কথা রাখো , তুমি পাপের পথ থেকে ফিরে হেনাকে নিয়ে সুখে সংসার করো । ” কালু সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িল । হেনা লজ্জিতা হইয়া দূরে সরিয়া গেল । কালু বৃদ্ধের নিকট হইতে উঠিয়া হেনার নিকট গিয়া বলিল , ” হেনা , তোমার বাবাকে ডাক্তার দেখিয়েছো ? ” হেনা বলিল , ” হ্যাঁ । ” কালু বৃদ্ধের নিকট বিদাই লইয়া , হেনার মুখপানে চাহিয়া বলিল, ‘ আজ আসি। ‘
তিন-চার দিন অতিবাহিত হইয়াছে । কালু , বিলুর পার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছে । অপরাহ্নের অন্তিম সূর্য অস্তমুখি হইয়াছেন । হেনা কাঁদিতে কাঁদিতে বিলুর আড্ডায় প্রবেশ করিল । তাহাকে দেখিয়া কালু উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল , ” কি হয়েছে হেনা ? ” সে পূর্ববৎ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ” বাবা ……..। ” কথার অবশিষ্টাংশটি সে আর বলিতে পারিল না । তাহার কন্ঠ শোকে জড়াইয়া গেল । কালু বলিল , ” চল , আমি যাচ্ছি । ” যাইবার পূর্বে সে বিলুকে উদ্যেশ্য করিয়া বলিল , ” আমাকে ক্ষমা করো , আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারবো না । আমার এখন অনেক কাজ । তোমার উপকারের প্রতিদান পেয়ে গেছো । ” কালুর মুখ হইতে উক্ত কথা শুনিয়া বিলু বলিল , ” বেইমান , শেষে কিনা অন্নদাতাকে ছেড়ে যাবি । সেদিন তোকে রাস্তা থেকে তুলে এনে কি ঐ মেয়েটা মানুষ করেছিল ? ” কালু বলিল , ” মানুষ তো করোনি বরং অমানুষ করেছো । আমার জায়গায় তোমার নিজের ছেলে হলে কি ডাকাত মস্তান বানাতে পারতে ? আমাকে তুমি ব্যবহার করেছো । ” কালুর তীব্র বাক্যবানের নিকট বিলু হার মানিল । কোথা হইতে তাহার সুবিবেকের উদয় হইল , তাহার স্বর পরিবর্তীত হইল । সে বলিল , ” আমার তো ছেলেই রইল না , সে বোধ হয় আমাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারল না । তাই হয়তো জন্মের মুহূর্তে হাসপাতালে তার মায়ের সঙ্গেই আমাকে ছেড়ে গেল । ঠিক আছে যা সুখে সংসার কর । মাঝে মাঝে এসে এই বুড়োকে দেখে যাস । ” ” তোমার কথা মনে রাখবো ” বলিয়া হেনার হাত ধরিয়া কালু বাহির হইয়া গেল ।
হেনার গৃহে পৌঁছাইয়া কালু দেখিল , বৃদ্ধের নিথর দেহটা খাটিয়ায় পড়িয়া আছে । সে নিকটবর্তী কিছু লোক জোগাড় করিয়া শব দেহ লইয়া শ্মশান অভিমুখে চলিল । হেনা কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার পশ্চাৎ অনুসরন করিল । কিছুদূর গিয়া কালু দেখিল হেনা পশ্চাতে আসিতেছে । কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার চক্ষু যুগল লাল হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে ।হেনার পিতার সৎকার সমাপন হইতেই কালু হেনার হাত ধরিয়া বলিল , ‘ চল । ‘৭
হেনাকে সাথে করিয়া কালু যখন আপন জন্মভিটায় আসিয়া উপস্হিত হইল তখন মধ্যাহ্নের সূর্য অল্প পশ্চিমে ঝুঁকিয়াছে । ঘরে ঢুকিয়া কালু দেখিল তাহার পিতা খাটিয়ায় শুইয়া রহিয়াছেন । অস্থি নির্গত-চক্ষু কোটরাগত তাহার শরীর দেখিয়া কালু বুঝিল দীর্ঘ অনাহার তাহার পিতার শরীরে প্রভাব বিস্তার করিয়াছে । তাহাকে দেখিয়া চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” বাবা কালাচাঁদ এসেছিস ! ” তাহার চক্ষুর কোটর উছলাইয়া অশ্রু নির্গত হইল । কালাচাঁদ বলিল , ” বাবা , সেই মহিলা কোথায় ? ” চন্দ্রকান্ত বলিলেন , ” সে একমাসও এই ঘরে থাকেনি , অভাবের বাতাস দেখে চলে গেছে । ” কালাচাঁদ আর কিছু জানিতে চাহিল না । চন্দ্রকান্ত হেনার প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” এ কি আমার পুত্র বধূ ? ” কালাচাঁদ সম্মতি প্রকাশ করিতে ঘাড় নাড়িল । সে পিতার জীর্ণ চেহারার প্রতি চাহিয়া ভাবিল , তাহার জীবন যখন জোয়ারের জলে উপর দিকে উছলাইয়া উঠিতেছে পিতার জীবন তখন ভাঁটার টানে সমুদ্রের অতলে বিলীন হইবার জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছে । সে হেনার প্রতি চাহিয়া বলিল , ” বাবাকে প্রণাম করো । ” হেনা শ্বশুরকে প্রণাম করিল । চন্দ্রকান্ত কালাচাঁদকে বলিলেন , ” বাবা , আমাকে ধরে নিয়ে ঐ পুরানো সিন্দুকটার কাছে চলতো । ” কালাচাঁদ পিতার নির্দেশ মান্য করিল । তিনি পুত্রকে সিন্দুক খুলিতে বলিলেন । কালাচাঁদ সেটি খুলিতেই তাহার পিতা তাহার মধ্যে ঝুঁকিয়া একটি লাল বর্নের শালুর পুটুলি বাহির করিয়া বলিলেন , ” বৌমা এদিকে এসো । ” হেনা তাহার সম্মুখীন হইতেই সেই পুটুলিটি তাহার হাতে দিয়া বলিলেন , ” আজ থেকে এগুলো তোমার । আমার মা তোমার শ্বাশুড়ীকে দিয়ে গেছিলেন । তোমার শ্বাশুড়ী তো বেঁচে নেই তাই তার কাজ আমাকেই করতে হলো । ” হেনা শ্বশুরের হাত হইতে পুটুলিটি লইয়া পুনরায় সিন্দুকে রাখিয়া দিল । চন্দ্রকান্ত হেনার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” আমার তো মা দিন গুনতিতে পড়েছে । আমি ভাঁটার টানে হারিয়ে যাবো । তোমারা তখন জোয়ারের জলে চান করতে ভুলো না । ” কথাটি শেষ হইতেই চন্দ্রকান্ত বুকে হাত রাখিয়া বসিয়া পড়িলেন । ঊর্ধপানে মুখ করিয়া অস্ফুটে বলিলেন , ” বাবা কালাচাঁদ , ঐদেখ স্বর্গ থেকে তোর মা আমাকে ডাকছে । ” কালাচাঁদ তাৎক্ষণিক জ্ঞান শূন্য হইয়া ‘ ডাক্তার- ডাক্তার ‘ বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল , কিন্তু তাহার পিতার খড়ের চালা গৃহে কোনো ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটিল না ।
-
বিনয় অবিনয়
বিনয় অবিনয়
-চিন্ময় মহান্তী
সেদিন শহরে কাজ সারতে সারতে দুপুর দুটো বেজে গেল । বাড়ি ফিরতে গেলে বাসে প্রায় দু’ ঘন্টা লাগবে । অগত্যা মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নেওয়াই বাঞ্ছনীয় চিন্তা করে ঢুকে পড়লাম ফুটপাথের একটি অনামী হোটেলে ।
হাত ধুয়ে যথারীতি চেয়ার দখল করে বসে ভাতের প্লেট আসার অপেক্ষা করছি , এক ভদ্রলোক এসে আমার ঠিক বিপরীত মুখী চেয়ারটা দখল করে বসলেন । সার্ভ বয় ততক্ষনে আমার প্লেটটি দিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো , ” স্যার মাছ দেবো না মাংস ? ” মাংসটা আমি খাবার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি টিভিতে মাংস নিয়ে ভাগাড় কান্ডের খবর দেখার পর থেকেই । মনে মনে স্থির করেছি এবার থেকে মাংস না মেনুতে মাছ রাখবো , তাই আর বিশেষ ভাবিত না হয়েই স্ট্রেটকাট বললাম , ” ভাই মাছই নিয়ে এসো । ” আমার অর্ডার পাওয়ার পরই ছেলেটি চলে গেল । ক্ষনিক পরেই ফিরে এলো একটা বড় ট্রের উপর প্লেটে হরেক মাছ সাজিয়ে , কি মাছ নেই তাতে গলদা-শোল-পাবদা ইত্যাদি আরো কি সব মাছ । ট্রেনে- বাসে হকারেরা যেরকম অনর্গল হরেক মালের দাম আউড়ে যায় সেও সেরূপ মাছের দাম আউড়াতে লাগলো । আমি তাকে থামিয়ে বললাম , ” ভাই সব চাইতে কম দাম কোন মাছের ? ” সে বিনীত ভাবেই উত্তর দিল , ” স্যার কাটাপোনা , পনের টাকা । ” আমি তাকে বললাম , ” তাহলে ওরই এক পিস দাও । ” ছেলেটি যথারীতি আমাকে মাছটা দিয়ে চলে গেল ।
আমার বিপরীতে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ আমাদের কথা বার্তা শুনছিলেন । তিনি এমনভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন যে তা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন অন্য গ্রহের কোনো জীব দেখছেন । ভদ্রলোকটির ভাতের প্লেট আসতে আমি তার দৃষ্টি থেকে নিষ্কৃতি পেলাম । সার্ভ বয় তাকে জিজ্ঞেস করলো , ” স্যার আপনাকে কি মাছ দেবো না মাংস ? ” ভদ্রলোক তারদিকে তাকিয়ে বললেন , ” সব চাইতে ভালো মাছ যেটা আছে নিয়ে আয় । ” ছেলেটি ফিরে যেতেই আমি ভদ্রলোকটির মুখের প্রতি চাইলাম , সাজ পোশাক ঠিকই আছে একেবারে সাহেবি ঢঙ , যা গায়ের রংটাই একটু কালো ; ওটা ফর্সা হলেই গোরা সাহেবদেরকেও বোধহয় উনি হার মানিয়ে দিতেন ।
ভদ্রলোক পকেট থেকে সেলফোন বার করে অপরপ্রান্তের কারও কথাতে সায় দিয়ে শুধু ‘ হুঁ-হুঁ ‘ বলে যাচ্ছিলেন । ছেলেটি অভ্যাস মতো মাছের প্লেট ভর্তি ট্রে নিয়ে হাজির হলো । ভদ্রলোক কথা বলতে বলতেই আঙ্গুল দিয়ে ট্রের প্রতি নির্দেশ করতেই ছেলেটি একটি গলদার প্লেট তার সামনে রাখলো । তিনি ফোনে হঠাৎ বলে উঠলেন , ” কি বললে ? আজ নিরামিষ , বার পালন করছো ।” কথার ধরন ধারনে মনে হলো হয়তো তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন । ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন , ” এই এটা নিয়ে যা , আজ নিরামিষ । ” ছেলেটি চুপচাপ মাছের প্লেটটা ট্রেতে তুলে নিয়ে গেল ।
ভদ্রলোকটি ফোনে এপ্রান্ত থেকে যা বলছিলেন সবই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম । ইচ্ছা না থাকলেও যেহেতু আমি তার বিপরীতের চেয়ারে তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই শুনতে হচ্ছিল । তার ফোনে বলা , ” কি বললে ? আজ নিরামিষ , বার পালন করছো ” কথাটি শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম । মনে মনে ভাবলাম – ওনার স্ত্রী কি ফোনেও গন্ধ পান স্বামী কি খাচ্ছে , কি খাচ্ছে না ! উনি তো একবারও মাছ খাওয়ার গল্প বলেন নি, শুধু ‘ হুঁ ‘ দিয়ে যাচ্ছিলেন । ব্যাপারটা অচিরেই আমার কাছে জলের মতো হয়ে গেল যখন তিনি ‘ রাখছি ‘ বলে ফোনটা টেবিলে নামালেন । আমি লক্ষ্য করলাম ফোনের স্ক্রিনে কোনো আলো নেই । কারো সাথে কথা বলার পর ফোন রাখলে ফোনের স্ক্রিন লাইট কিছুক্ষন জ্বলে থাকে সাথে সাথেই নিভে যায় না । বুঝলাম পুরোটাই ভাঁড়ামি , আমার কাটাপোনা খাওয়াকে কিঞ্চিৎ হেয় করার জন্যই হয়তো ভদ্রলোকটির এরূপ উদ্দ্যোগ । কিন্তু ভেবে পেলাম না এতে উনি কি সুখ লাভ করলেন । যেহেতু তার আক্রমণ পরোক্ষে তাই আমি নীরব রইলাম । মনের মধ্যে একটি বিনয়ের ভাব এনে মনে মনে বললাম , ” এতে ওনার কোনো দোষ নেই , ওনার স্বভাবের দোষ । ”
প্লেটের ভাত শেষ হতেই ভদ্রলোকটি সার্ভ বয়কে ডেকে বললেন , ” ভাত নিয়ে আয় । ” ছেলেটি ভাত নিয়ে এসে তার প্লেটে যেই দু’ হাতা দিয়েছে অমনি তিনি চিৎকার করে উঠলেন , ” এক হাতা বললাম আর তুই দু’হাতা দিয়ে দিলি , বাড়তি একহাতা কে খাবে ? ” তিনি কখন বলেছিলেন তিনিই জানেন । ছেলেটি কাচুমাচু করে বিনয়ের সঙ্গে বলল , ” ভুল হয়েছে স্যার , একহাতা সরিয়ে রেখে দিন , দাম দিতে হবে না । ” আমি ততক্ষণে উঠে হাত ধুচ্ছি , না হলে হয়তো আমাকে সাক্ষী হতে হতো । আমাকে পাশ কাটিয়ে হোটেলের মালিক তখন ভদ্রলোকটির কাছে পৌঁছে গেছেন । তিনি ছেলেটিকে জোর ধমক দিয়ে বললেন , ” কানে কি কম শুনছিস ? ” ছেলেটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ততক্ষণে মালিক ফিরে এসেছেন ক্যাশে । আমি খাবারের দাম মিটিয়ে একবার ভদ্রলোকটির প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , প্লেট পরিষ্কার । আঠারো- উনিশ বছর বয়সী সার্ভ বয় ছেলেটির চোখে আমার চোখ পড়ে গেল , সেও হয়তো ওটাই লক্ষ্য করছিল -
বদল
বদল
-চিন্ময় মহান্তী১
তখনও মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় হয় নাই । বৃদ্ধ কানাইলাল উঠানের আমগাছটির তলে টুল পাতিয়া বসিয়া বাটিতে খানিক সরিষার তৈল লইয়া সারা গাত্রে ঘষিয়া ঘষিয়া মাখিতেছেন । তাহার বড় খোকা নিমাই একটি চৌকো প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকিতেছে দেখিয়া কানাইলাল তাহাকে তাহার নিকটে ডাকিয়া জানিতে চাহিলেন , ” বড় খোকা তোর হাতে ওটা কি ? ” বড় খোকা কাঁচুমাঁচু করিয়া উত্তর দিল , ” একটা ভালো মোবাইল কিনলাম বাবা , তোমার বৌমা অনেকদিন থেকে চাইছিল । ”
” আচ্ছা । তোর মোবাইলে তার চলছিল না । ইস্পেশাল চাই । দাঁড়া বুঝবি , কালবৈশাখীতে গরমের ধানশিষ সব সাদা দেখাচ্ছে । সংসারে টান পড়লেই বুঝবি ! ” বলিয়া রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধ কানাইলাল গামছাটি কোমরে কষিয়া বাঁধিয়া লইয়া স্নানের নিমিত্তে রায় পুষ্করিণীর অভিমুখে চলিলেন । নিমাই বাপের উপদেশে যে বিরক্ত হইয়া ঘরে ঢুকিল তাহা যে কেহ তাহার মুখ দেখিলেই বুঝিতে পারিতেন । ঘরে ঢুকিয়া প্যাকেটটি তাকে রাখিয়া সে ধেড়ে গলায় ডাকিল , ” বিনতা , ও বিনতা , বলি একবার এদিকে এসো । ” তাহার স্ত্রী রন্ধনগৃহ হইতে বলিল , ‘ যাই । ‘
” আরে তাড়াতাড়ি আসবে তো । ” বলিয়া নিমাই ঘর মধ্যস্থিত একটি চেয়ারে ধপ্ করিয়া বসিয়া পড়িল । তাহার স্ত্রী আঁচলে হাত মুছিতে মুছিতে ঘরে ঢুকিয়া নিমাইয়ের নিকট গিয়া বলিল, ‘ বলো । ‘ নিমাই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল , ” তোমার কথা মতো মোবাইল কিনতে গিয়ে আজ বাবার কাছে কথা শুনতে হলো । তুমি কি জানো না সংসারটা চাষের উপর নির্ভর । ফালতু বিলাসিতা আমাদের চলে না । ” নিমাইয়ের কথার ঝাঁজ শুনিয়া মনে হইল , কেহ সর্পের লেজে পা দিয়াছে আর সর্পটি ফোঁস ফোঁস করিয়া তাহার পায়ে চোট মারিয়া আপনার আত্মরক্ষা করিতেছে । বিনতা অধোবদনে নিমাইয়ের কথার ঝাঁজ হজম করিতেছিল । এমত সময় তাহাদের একমাত্র কন্যা বিনি আসিয়া কাঁধ হইতে ব্যাগটি নামাইয়া পিতার রক্ত চক্ষু দেখিয়া কিছু বলিতে সাহস করিল না । সে নত মস্তকে বাহির হইয়া গিয়া তাহার কলেজ পড়ুয়া ভগ্নী রিনির নিকট গিয়া তাহার হাত হইতে শামুকগুলি লইয়া সস্নেহে বলিল , ” নে নে আমিও ছড়িয়ে দি । এতোগুলো তুই একা ছাড়াতে পারবি না । ” রিনি দিদির মুখপানে একবার চাহিয়া পুনরায় আপন কর্মে মগ্ন হইল । বিনির আবদারে বিনতা যে স্বামীর নিকট একটি ভালো ফোনের আবদার করিয়াছিল তাহা গোপন করিয়া নিমাইয়ের বাক্য ঝাঁজ সহ্য করিয়া লইয়া সে পুনরায় রন্ধন গৃহে প্রবেশ করিল । নিমাই ক্রোধে গজগজ করিতে করিতে অবগাহনের উদ্দেশ্যে রায় পুষ্করিণীর অভিমুখী হইল ।
বৃদ্ধ স্নান সমাপন করিয়া আসিয়া গামছাটি উঠানের বেড়ায় মেলিয়া দিয়া আমগাছটির তলে পূর্বস্থিত টুলটিতে বসিয়া গৃহের প্রতি মুখ করিয়া উচ্চস্বরে ডাকিলেন , ” কই রে নিতাই একবার এদিকে আয় তো । ” নিতাই , কানাইলালের কনিষ্ঠ পুত্র । সে ঘর হইতে পিতার ডাক শুনিতে পায় নাই । দাদুর ডাকে পিতা আসিতেছেন না দেখিয়া নিতাইয়ের কন্যা রিনি শামুকগুলি দিদির হেফাজতে দিয়া পিতাকে ডাকিতে গেল । নিতাই একটি খাটিয়ায় শুইয়া গান শুনিতে শুনিতে প্রাতের ক্ষেতকর্মের ক্লান্তি উপশম করিতেছিল । দাদুর তলব হইয়াছে ইহা কন্যার নিকট শুনিয়া সে তড়িঘড়ি উঠিয়া পিতার নিকট গিয়া তাহার তলবের কারণ জানিতে চাহিল । কানাইলাল পুত্রের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” এবার থেকে সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব তুই রাখ । ” নিতাই বিস্মৃত হইয়া পিতার এরূপ সিদ্ধান্তের কারণ জানিতে চাহিল । কানাইলাল এক পুত্রের নিকট আরেক পুত্রের অপরিমিত ব্যয়ের কথা সবিস্তারে বলিলেন । সমস্ত শুনিয়া নিতাই বলিল , ” কিন্তু বাবা , এখনই এরূপ আচরনে দাদা মনক্ষুন্ন হবে । ” বৃদ্ধ পুত্রের যুক্তি মানিতে সম্মত হইলেন না । অগত্যা নিতাই পিতার প্রস্তাবপত্রে শীলমোহর লাগাইয়া পুনরায় আপন কক্ষে প্রবেশ করিল । পিতা এবং পুত্রের সমস্ত বাক্যালাপ বিনতা রন্ধনশালা হইতে কান পাতিয়া শুনিতেছিল । স্নান সারিয়া নিতাইয়ের বধূ মিনতিকে রন্ধনগৃহাভীমুখে আসিতে দেখিয়া বিনতা খুন্তি লইয়া রন্ধনে ব্যস্ত রহিয়াছে এইরূপ একটি ভাব করিল । তাহার এই অভিনয় যদি কোনো নামী অভিনেত্রী দেখিতেন তিনিও পরাজয় স্বীকার করিয়া লইতেন ।
মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করিয়া সকলেই উঠিয়া পড়িয়াছে । দুই বধূ এঁটো বাসন লইয়া পুষ্করিণীর ঘাটে ধুইতে গিয়াছে । বৃদ্ধ কানাইলাল তাহার কক্ষের দেওয়ালে টাঙানো আপন বধূর ফোটোটির দিকে তাকাইয়া বিড়বিড় করিয়া বলিতেছেন , ” জানো কমলা তোমার বড় খোকা আজ আর আমার বাধ্য নেই । সে স্বাধীন হয়েছে । এখন আর কোনো কাজ করতে সে আমার অনুমতি নেয় না । ” বৃদ্ধের এই বিলাপ তাহার স্বর্গগতা স্ত্রী শুনিতে পাইলেন কিনা বলিতে পারি না । কিন্তু একজন শুনিতে পাইল সে নিতাইয়ের কন্যা । সে কিছু একটা বলিতে দাদুর নিকট আসিতেছিল কিন্তু দাদু মনকষ্টে রহিয়াছেন বুঝিয়া দরজা হইতেই প্রস্থান করিল ।২
পৃথিবীর বক্ষে আঁধার নামিয়া আসিতেছে । পাখিরা আপন আপন বাসায় ফিরিয়া আসিতেছে । গৃহাভিমুখী গবাদিপশুর খুরের ধূলি শান্ত বাতাসে পাক খাইতে খাইতে কোথায় বিলীন হইয়া যাইতেছে । বৃদ্ধ এখনো কক্ষ ছাড়িয়া বাহির হন নাই । গৃহের সকল সদস্যই একবার করিয়া দরজা হইতে গোপনে আড়ি পাতিয়া দেখিয়া লইয়াছে , তিনি তাকিয়ায় হেলান দিয়া কিছু একটা ভাবিতেছেন । কেহ কিছু বলিতে সাহস করে নাই । অবশেষে গৃহের গুমোট ভাব কাটাইতে রিনি হস্তক্ষেপ করিল । সে দাদুর নিকট গিয়া বলিল , ” দাদু চা খাবে এসো । ” বৃদ্ধ চিন্তার ঘোর কাটাইয়া রিনিকে বলিলেন , ‘ চল । ‘ তিনি বাহিরে আসিয়া বারান্দায় বসিয়াই দুই পুত্রকে তলব করিলেন । দুই পুত্র আসিয়া তাহার নিকটে বসিল । রিনি দাদুর জন্য চা লইয়া আসিল । রিনির হাত হইতে চায়ের পেয়ালাটি লইয়া বৃদ্ধ নিমাইয়ের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” বড় খোকা তুই সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব তোর ভাই কে বুঝিয়ে দে । ” নিমাই পূর্বেই বুঝিয়াছিল ইহাই তলবের মুখ্য কারণ। সে স্নান সমাপন করিয়া আসিয়া যখন আপন কেশ প্রসাধন করিতেছিল তখনই তাহার স্ত্রী আসিয়া উক্ত ব্যাপারে নিতাইয়ের সহিত তাহার পিতার আলোচনাটি সবিস্তারে বর্ননা করিয়াছে । কিন্তু ইহা বলে নাই যে নিমাইয়ের ভ্রাতা ইহাতে আপত্তি করিয়াছিল, পিতা তাহার আপত্তি না মঞ্জুর করিয়াছেন । তখন হইতেই নিমাইয়ের মনে ভ্রাতার প্রতি একটি বিরাগ জন্মাইয়াছে । যাহা সে ভ্রাতার নিকট প্রকাশ করে নাই । পিতার আদেশ মতো নিমাই সংসারের সমস্ত হিসাব , খাতা খুলিয়া বুঝাইয়া দিল। নিতাই দাদার মুখপানে চাহিয়া দেখিল তাহার বদন শুষ্ক দেখাইতেছে , যাহার উপর অপমানিত হইবার একটি স্পষ্ট রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু পিতার মুখপানে চাহিয়া সে দাদাকে সহানুভূতি দেখাইতে সাহস করিল না। এ স্থলে নিজ হাতে সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখিবার একটি সুপ্ত বাসনা যে তাহার অন্তরে রহে নাই তাহা বলিলে নিতান্তই মিথ্যা বলিতে হইবে। যৌথ সংসারে থাকিয়া আপন কর্তৃত্ত্ব ফালাইতে কে না চাহে ! নিতাইও যে অনুরূপ তাহা উক্ত সময় তাহার বদন অবলোকন করিলে যে কেহ সম্যক অনুধাবন করিতে পারিতেন।
হিসাব বুঝাইয়া দিয়া নিমাই আপন কক্ষে প্রবেশ করিয়া হস্তে মস্তক স্থাপিত করিয়া শুইয়া পড়িল তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে বিনতাও প্রবেশ করিয়া নিচু স্বরে বলিল , ” কি গো শুয়ে পড়লে যে ? ” নিমাই সেইরূপ শুইয়াই বলিল , ” তোমার কথা শুনতে গিয়েই এমন অপমানে পড়তে হলো। ”
” আমি কি অন্যায়টা করেছি শুনি। তোমার মেয়েই তো সেদিন বললো , ‘ মা , বাবাকে বলো না একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিতে নইলে আমার বান্ধবী মহলে সন্মান একেবারে ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে , ‘ আমি তো তাই এতো জেদ করে বসলাম। ” নিমাই নরম স্বরে বলিল , ” তুমি তো জানো আমাদের সংসারে দুটো মেয়েই বড় হয়ে উঠছে , তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে ; তুমি মেয়েকে তো এটা বোঝাতে পারতে। ” নিমাই নরম স্বরে কথা বলিতেছে দেখিয়া বিনতার বাক্যের অগ্রগতি হইল , সে বলিল , ” যৌথ সংসার থেকে মেয়েকে সব কিছু দিয়ে না রাখলে যখন একার সংসার হবে তখন কি দিতে পারবে! যত পারবে মেরে মুরে জমিয়ে নেওয়া আর সখ মিটিয়ে নেওয়াই ভালো। এত উদার হলে এযুগে চলে না। ” বিনতা তাহার স্বামীর কর্ণে যেরূপ মন্ত্রনা প্রবেশ করাইতে লাগিল তাহা আদি মহাকাব্যে বর্নিত মন্থরা দাসীও করিত কিনা বলা দুরূহ। নিমাই স্ত্রীর এইরূপ বাক্যে কিঞ্চিৎ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল , ” তুমি তো আগে এমন বলতে না ইদানীং হঠাৎ …..” বিনতা এত তাহার স্বামীর প্রশ্নের অসমাপ্ত অংশ না শুনিয়াই জবাব দিল , ” অনেক তো সাধু সেজে দেখলাম , এই সংসারে শুধুই খেটেই গেলাম , নিজের কোনো সখ আল্হাদই মেটাতে পারলাম না। আর যেই মেয়ের সখ মেটাতে গেলাম অমনি তোমার বাবা তোমার হাত বেঁধে দিলেন। তাহলে আর সংসারের কথা ভেবে কি লাভ ! তার থেকে নিজের আখের গুছানো ভালো নয় কি ! ” নিমাই কি বুঝিল পত্নীর বাক্যের সমর্থনে শুধু ‘ হ্যাঁ ‘ শব্দটি উচ্চারণ করিয়া চুপ করিল । তাহাকে দেখিয়া এইরূপ লাগিতেছে যে , মধ্যাহ্ন ভোজোনের পূর্বের সেই ক্রুদ্ধ সর্প স্ত্রীর সম্মুখে অপমান নামক একটি লাঠির ঘায়ে নিহত হইয়া শুষ্ক রজ্জুবৎ পড়িয়া রহিয়াছে ।
বারান্দা হইতে ছোট বৌ , বিনতাকে উদ্দেশ্য করিয়া ডাকিল , ” দিদি আটা মাখা হয়ে গেছে , রুটিগুলো করে নি এসো । ” তাহার ডাক শুনিতে পাইয়া বিনতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাহিরে আসিয়া বলিল , ‘ চল । ‘ নিমাই সেইরূপ শুইয়া থাকিতে থাকিতে নানান চিন্তা করিতে লাগিল । একবার ভাবিল , আগামী কল্যই পৃথক হইয়া যাইবে কিন্তু বিবাহযোগ্যা কন্যা এবং আপন ভাঁড়ারে সঞ্চিত শূন্য অর্থরাশির কথা মনে পড়িতেই সে সিদ্ধান্ত বদল করিয়া লইল । স্ত্রীর কথাকে মান্যতা দিয়া সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইল যে যৌথ সংসারে থাকিয়া কিছু অর্থ সঞ্চিত করিবে । তাহার স্ত্রী বিনতা রন্ধনগৃহ হইতে ডাকিল , ” বিনি মা , তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয় , খেয়ে নে । ” তিন বাপ ব্যাটা পাশপাশি খাইতে বসিল কিন্তু অদ্যকার পরিবেশ পূর্বের অনান্য দিন হইতে পৃথক বলিয়া দৃশ্য হইল ।৩
বৃদ্ধ কানাইলালের সংসারের সেইদিনের গুমোট পরিবেশ কাটিয়া একটি স্বাভাবিক ছন্দ আসিয়াছে । নিমাই আপনার অন্তরে অপমানের আগুন জ্বালাইয়া রাখিয়াও মুখে একটি শীতলতার প্রলেপ লাগাইয়া আপন সিদ্ধান্ত চরিতার্থ করিবার মতলব করিতেছে । দুই ভাই মিলিয়া ক্ষেত হইতে গরুর গাড়িতে করিয়া ধান আনিয়া খামারে পলুই নির্মান করিতেছে । দুই বধূও রন্ধনের ফাঁকে মধ্যে মধ্যে তাহাদের সহিত হাত লাগাইতেছে । ইহা দেখিয়া কাহারও বুঝিবার ক্ষমতা নাই যে কয়েকদিন পূর্বেই ইহাদের সংসারে একটি ঠান্ডা লড়াই হইয়া গিয়াছে ।এই বৎসর গরমে ধান একেবারে ভালো হয় নাই , চাষের খরচ ওঠাই মুশকিল , ইহা গ্রামের সকলের মুখে মুখে আলোচ্য বিষয় হইয়াছে । বৃদ্ধ কানাইলাল আমগাছটির তলে বসিয়া পলুইয়ের দিকে চাহিয়া বিষন্ন হইয়া তাহার কনিষ্ঠ পুত্রকে ডাকিলেন । পুত্র তাহার নিকটে আসিয়া বলিল , ” বলো বাবা । ” বৃদ্ধ পুত্রের প্রতি চাহিয়া শুষ্ক কন্ঠে বলিলেন , ” সংসারের খরচ একটু ভেবে চিন্তে করিস বাবা , দেখেছিস তো ধানের কি অবস্থা , বর্ষার ধান না হওয়া পর্যন্ত একটু টেনে টুনে চলতে হবে । নাতনি দুটো বিয়ের যোগ্যা হয়ে উঠেছে সেটা মাথায় রাখিস । তোর দাদা যদি দশ হাজার টাকা দিয়ে মোবাইল না কিনতো তাহলে ঐ টাকায় মাস তিনেক সংসার চলে যেতো । ” ‘ ঠিক আছে বাবা ‘ বলিয়া পিতাকে সমর্থন করিয়া নিতাই উঠিয়া যাইতে গিয়া দেখিল তাহার দাদা দুই বস্তা ধান সাইকেলে লইয়া কোথায় যাইবে বলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, সে নিকটে আসিতেই নিমাই বলিল , ” দে টাকা দে , ধান ভানাতে নিয়ে যেতে হবে ।” নিতাই কড়চা হইতে একটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া দিল । নিমাই সাইকেল ঠেলিয়া বাহির হইয়া গেল ।
দুই বস্তা ধান লইয়া সাইকেল ঠেলিতে ঠেলিতে নিমাই পাড়ার মুদি দোকনে হাজির হইল । পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী একটি বস্তা খুলিয়া অর্ধেক ধান ওজন করিয়া দিল । দোকানদার সুযোগ বুঝিয়া চলতি বাজার দর অপেক্ষা কিঞ্চিত স্বল্প মূল্য প্রদান করিতেই নিমাই বলিল , ” দাম কম দিচ্ছো যে । ” দোকানদার টাঙি মচে তা দিতে দিতে বলিল , ‘ ‘ খুচরো ধান দিলে একটু কম দাম নিতে হবে । ধানের ধুলো বাদ যাবে তার উপর সটেজ আছে । ” নিমাই স্পষ্ট বুঝিল দোকানদার প্রদর্শিত কারণের সহিত স্বল্প মূল্যের কোনো সম্পর্ক নাই । তথাপি মনে মনে ভাবিল , ” দোকানদার দু পয়সা মেরে আর কি করবে আমি তো অনেকটাই পেলাম । তা ছাড়া চিৎকার করলে লোক জানা জানি হয়ে যাবে । ” সে টাকা গুছাইয়া লইয়া ধান ভানানোর নিমিত্তে কলের উদ্দেশ্যে চলিল । দোকানদার গোঁফে তা দিতে দিতে বিড়বিড় করিয়া বলিল , ” তোরা যদি সংসার বধ না করিস তো আমি বড়লোক হবো কি করে । ” অল্প কয়েকটা টাকায় মোহিত হইয়া সংসারের যে এক বৃহৎ ক্ষতি করিয়া দিল তাহা অষ্টম ফেল নিমাই অনুধাবন করিতে পারিল না ।
ধান ভানাইয়া ঘরে ফিরিয়া অতি সন্তর্পনে চারিদিকে চাহিয়া নিমাই দেখিল পিতা এবং ভ্রাতা কেহই ঘরে নাই । এই সময় উভয়েই স্নান করিতে যায় তাই এই সময়টিকেই সে গৃহে প্রবেশের মোক্ষম সময় স্থির করিয়া প্রবেশ করিয়াছে । সাইকেল হইতে চালের বস্তা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখিয়া সে আপন কক্ষে প্রবেশ করিল । তাহার স্ত্রী তাহাকে ঢুকিতে দেখিয়া একটি মগে করিয়া জল লইয়া আসিল । স্ত্রী হাত হইতে জলের মগ লইয়া জল পান করিয়া পুনরায় সে মগটি স্ত্রীর হাতে দিল । বিনতা মগটি লইয়া রন্ধনগৃহে যাইতে উদ্যত হইতেই নিমাই তাহার হাত ধরিয়া বলিল , ‘ দাঁড়াও । ‘ পকেট হইতে কড়কড়ে দুইটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া স্ত্রীর হাতে দিতেই বিনতা স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া মৃদু হাসিয়া নোট দুইটি বালিশের ওয়াড়ের খোলে রাখিয়া বাহির হইয়া গেল । নিমাই খাটিয়ায় শুইয়া পড়িল । তাহার বিবেক আসিয়া মনের দরজার কড়া নড়িয়া প্রশ্ন করিল , ” তুই তো এমন ছিলিনা নিমাই তাহলে আজ কেন এমন প্রতারনার আশ্রয় নিলি ? ” নিমাই ব্যক্তিগত চাহিদার দোহাই দিয়া আপন পিতাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া শান্তি পাইল ।
বৃদ্ধ কানাইলাল স্নান সমাপনান্তে প্রাত্যহিকের ন্যয় অদ্যও তাহার প্রিয় আমগাছটির ছায়ায় টুল পাতিয়া বসিলেন । রন্ধনে বিলম্ব রহিয়াছে এই সংবাদ তিনি নাতনি রিনির নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন । দাদার পশ্চাতে পশ্চাতে নিতাইও বাহির হইয়াছিল । একটি ব্যাগ হাতে সে প্রবেশ করিল । পিতার প্রতি চাহিয়া দ্রুত ঘরে ঢুকিয়া গেল । বৃদ্ধ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ স্পষ্ট বুঝিলেন নিতাই তাহাকে কিছু গোপন করিল । তিনি বুঝিলেন অর্থের হিসাব হস্তান্তর ফলপ্রসূ হয় নাই । সন্দেহের বশবর্তী হইয়া তিনি নিতাইকে তলব করিলেন । সে আসিতেই তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে বলিলেন , ” কি ওটা ? লুকিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলি । ” নিতাই আমতা আমতা করিয়া বলিল , ” তোমার নাতনির জন্য একটা চুড়িদার নিয়ে এলাম , দু’ দিন পর কলেজে কি একটা পোগ্রাম আছে ,সবাই নতুন পোশাক পরবে বলছিল তাই । ” বৃদ্ধ বলিলেন , ” ওর তো অনেক ভালো পোশাক রয়েছে, তারপরও ……”
” না , মানে …”
” ছিঃ ! তোকে ভালো ভেবেছিলাম । শেষে তুইও অবুঝের মতো কাজ করলি । আসলে তোরা হাতে টাকা থাকলেই খরচ করার জন্য ছটফট করিস । দে যা টাকা পয়সা আছে আমার হাতে দে । তোদের কাউকে আমার বিশ্বাস নেই । ”
নিতাই অধোবদনে ঘরে ঢুকিয়া সংসার খরচের জন্য সঞ্চিত অর্থ আনিয়া পিতার হস্তে সমর্পন করিল ।
বৃদ্ধ কানাইলাল সেই অর্থ লইয়া আপন কক্ষে ঢুকিয়া স্ত্রীর ফোটোটির নিকট গিয়া বিলাপের স্বরে বলিতে লাগিলেন , ” কমলা আমি তোমার দুই ছেলেকেই মানুষ করতে পারিনি কমলা । ওরা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে । তোমার সাজানো সংসারের ভালো মন্দ বোঝালেও বুঝতে চায় না কমলা । ” তাহার দুই চক্ষু অশ্রু সিক্ত হইল । রিনি দাদুকে ভোজনের নিমিত্ত ডাকিতে গিয়া দেখিল , তিনি কাঁদিতেছেন । সে সদ্য কলেজ হইতে আসিয়াছে তাই কান্নার কারন অনুধাবন করিতে না পারিয়া , আপন ওড়না দিয়া দাদুর অশ্রু মুছিয়া বলিল , ‘ চলো দাদু খেয়ে নেবে । ‘ বৃদ্ধ রিনির সহানুভূতিতে পুলকিত হইয়া কিছু একটা বলিতে গেলেন -তাহার দুই ওষ্ঠ ফাঁকা হইল কিন্তু কোনো বাক্য বাহির হইল না , শুধু দুইটি চক্ষু চাহিয়া রহিল । রিনি উচ্চস্বরে ডাকিল , ” বাবা …….বাবা ………। ” -
হরিশ
হরিশ
-চিন্ময় মহান্তীহরিচরণ ও শ্যামলী দুই জনের অভাবের গৃহে যেদিন পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জোৎস্না আপন অপরূপ মায়া মন্ত্র লইয়া উপস্থিত হইল ,সেই দিন দম্পতির সকল অভাব যেন পূর্ণ হইয়া উঠিল , আনন্দ বাঁশির সুরে মাটির গৃহখানি নৃত্য মগ্ন হইল । পরম স্নেহে হরিচরণ নাম রাখিলেন ‘ হরিশ ‘। নামটি বর্তমান যুগে পুরাতন হইলেও হরিচরণের মনে ধরিয়াছে , তাহার ও গৃহিণীর নামের অাদ্যক্ষর জুড়িয়া তিনি অনেক ভাবিয়া নামখানি স্থির করিয়াছেন । নামকরণ পর্ব সমাপন হইলে পুরোহিত উপযুক্ত দক্ষিনা পাইয়া আশীর্বাদ করিয়া বিগলিত হৃদয়ের সহিত গৃহ অভিমুখে চলিয়া গেলেন ।
সেইদিনের ছোট্ট হরিশ ক্রমে বড় হইয়া উঠিতেছে । আধো- আধো মধুর কথা পরিস্ফুট হইতেছে । কখনো কখনো পুলকিত হইয়া হাসিলে শ্বেত পদ্মের ন্যায় শুভ্র দন্ত বাহির হইয়া পড়ে , তাহা দেখিয়া দম্পতির হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া খুশির ঝরনা ধারা বহিয়া যায় ।
আজ কি একটা কাজ লইয়া হরিচরণ গ্রামের বড় বাড়ি গিয়াছিলেন । সেখান হইতে ফিরিয়া গায়ের গেঞ্জিটা খুলিতে খুলিতে বলিলেন -” ওদের ছেলেটাকে প্রাইভেট ইস্কুলে ভর্তি করেছে , আমাদের খোকার মতোই বড় হয়েছে , আমাদের খোকাকেও ভর্তি করবো । ” শ্যামলী কোনও উত্তর করিলেন না, তিনি জানেন এমন অভিলাষ তাহাদের পূর্ণ হইবার নহে । আকাশ কুসুম কল্পনা করিয়া মরিবার ইচ্ছা তাহার নাই। পূর্বেই বড় বাড়ির বধূর কাছ হইতে তথ্য লইয়াছেন -” বিস্তর খরচ ।” শুনিয়া স্বপ্নটাকে মনের অতলে চাপা দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন । আজ স্বামীর মুখ হইতে অনুরূপ ইচ্ছা শুনিয়া তাহার চোখের কোণা হইতে দুই ফোঁটা গলিত মুক্তা ঝরিয়া ভূমে পতিত হইয়া শুকাইয়া গেল , তাহা কাহারও দৃষ্টি গোচর হইল না । ‘ কই গো একটু জল দাও ‘- বাক্যটি কানে পৌঁছাই বা মাত্র সম্বিত ফিরিয়া আসিল ,ঘটিতে করিয়া জল আনিয়া দিলেন । নিজেকে ঠিক রাখিতে না পারিয়া -পূর্বেই যে তিনি ভাবিয়াছিলেন এবং বিস্তর খরচের কারনে তাহা তাহাকে বলেন নাই ,আজ তাহা বলিয়া ফেলিলেন । ঘটির জল এক টানে পান করিয়া ঘটিটি নামাইয়া একটি অক্ষমতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া হরিচরণ বাহির হইয়া গেলেন । শ্যামলী নিজ রন্ধন কার্যের নিমিত্ত শুষ্ক পত্র কুড়াইতে গেলেন ।
হরিশ পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করিল । ইতিমধ্যেই সে মায়ের মুখ হইতে শুনিয়া অনেক ছড়া মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে । সরল অক্ষর শিখিয়া যুক্ত অক্ষর লিখিতে শিখিতেছে । হরিচরণ তাহার কচি আঙ্গুল ধরিয়া গ্রামের সরকারী স্কুলের অভিমুখে চলিলেন । স্কুলে পৌঁছাইয়া ভর্তির কাগজ পত্রে সই করিয়া ছেলেকে শ্রেণীকক্ষে বসাইয়া নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরিতেছিলেন । পথে হরিচরণের শুভাকাঙ্খী বন্ধু মনীষের সহিত দেখা হইয়া গেল । মনীষ দীর্ঘদিন হইল চাকরি সূত্রে কলিকাতায় থাকেন । কোনও এক বড় কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করেন , কি পদ হরিচরণ তাহা জানেন না আর জানিবার ইচ্ছাও কখনো প্রকাশ করেন নাই । দুই জনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মনীষ জিজ্ঞাসা করিলেন -‘ কোথায় গিয়েছিলি ?’ উত্তরে হরিচরণ বলিলেন – ‘ এই তো গাঁয়ের ইস্কুলে , ছেলেকে ভর্তি করতে ।’ ছেলেকে ভর্তি করার কথাটা মনীষের প্রশ্নে না থাকিলেও হরিচরণ পরবর্তী প্রশ্ন এড়াইতে আগাম বলিয়া দিলেন । শুনিয়া মনীষ প্রীত হইয়া বলিলেন -” আচ্ছা , ছেলেকে ভালো করে পড়াশুনা করা , বড় হলে আমি যে কোম্পানীতে চাকরি করি সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব ।” কথাটা শুনিয়া হরিচরণ আনন্দিত হইলেন । শ্যামলীর ইচ্ছে যে ছেলেকে বড় কোনও সরকারী চাকুরে করা সেই কথাটা চাপিয়া গেলেন । মনে মনে ভাবিলেন যদি কখনো তাহা সম্ভব না হইয়া ওঠে তাহা হইলে হাসির পাত্র হইয়া উঠিবেন । তিনি যে দরিদ্র , আর দরিদ্রের স্বপ্ন প্রকাশ্যে বাহির করিলে তাচ্ছিল্য ব্যতীত কিছুই জোটেনা । মনীষ -‘ আজ একটু তাড়া আছে , পরে দেখা হবে ‘ বলিয়া চলিয়া গেলেন । হরিচরণও আপন গৃহাভীমুখে চলিলেন । আজ ছেলেকে লইয়া পুনরায় স্বপ্ন বুণিতে আরম্ভ করিলেন ।
স্কুল -কলেজের পাঠ সম্পন্ন করিয়া হরিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইল । খরচ বাড়িতে লাগিল, যাহা সম্পূর্ণরূপে প্রদান করিতে হরিচরণ অসমর্থ হইতেছিলেন । ইতিপূর্বের খরচ তিনি বহু কষ্টে চালাইয়া আসিয়াছেন , সাথে হরিশও কিছু কিছু বৃত্তি পাইয়াছে । কিন্তু বর্তমান বিস্তর খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে । শ্যামলী স্বামীর চিন্তিত মুখ দেখিয়া তাহার শেষ অলঙ্কারটুকুও বন্ধক দিতে হরিচরণের হাতে অর্পণ করিয়াছেন । হরিচরণ প্রথমে অস্বীকার করিলেও –” ছেলে চাকরি করলে কত গহনা গড়িয়ে দেবে ” শ্যামলীর মুখের এই কথাতে আশা পাইয়া রাজি হইয়াছেন। বাবার কষ্ট দেখিয়া হরিশ কিছু ছেলে মেয়ে জোগাড় করিয়া টিউশন আরম্ভ করিয়াছে । চারিদিক হইতে টাকা গুছাইয়া হরিশের পড়াশুনা চলিতেছে ।
ভাল নম্বর পাইয়া পাশ করিয়া হরিশ চাকুরীর চেষ্টা করিতেছে । দুই দিন আগে জানিয়াছে ,সে একটা সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় পাশ করিয়াছে । সাক্ষাৎকার পর্ব ভালো ভাবে হইলেই চাকুরী । খবরটা চাউর হইতেই সম্বন্ধ আসিতে লাগিল । হরিশ বিবাহে রাজি নয় বলিয়া অনেককেই ফিরাইয়া দিয়াছে । খবরটা কানে যাইতেই মা বলিলেন – ” শোন বাবা আমার তো অনেক বয়স হলো , এবার মা লক্ষ্মী ঘরে নিয়ে আয় ।” মায়ের আদেশ শুনিয়া ,মায়ের কষ্ট হইবে ভাবিয়া হরিশ রাজি হইয়া গেল । মা খুশি হইয়া মনে মনে বলিলেন – ‘ পাগল ছেলে ।’
হরিচরণের গৃহ সকাল হইতে ব্যস্ততা মুখর হইয়া উঠিয়াছে ।
মুকুন্দপুর হইতে হরিশের সম্বন্ধ আসিবে । শ্যামলী রন্ধনশালা হইতে নড়িবার অবকাশ পাইতেছেন না । মুকুন্দপুরের বড় বাড়ির সম্বন্ধ বলিয়া কথা । ওনারা বলিয়াছেন ছেলে দেখিয়া ওনাদের পছন্দ ,বাড়ি তো করিয়া লইবে । ওনারা অনেক বড় মনের মানুষ ,আর ওনাদের গৃহের মেয়ে তাহাদের গৃহে বধূ হইয়া আসিবে ভাবিয়া শ্যামলী মনে মনে গর্ব বোধ করিতেছেন । একটা চকচকে গাড়ি আসিয়া হরিচরণের উঠানে দাঁড়াইল । হরিচরণ দেখিলেন গাড়ি হইতে কয়েকজন সুবেশ পুরুষ ও সুবেশী মহিলা বাহির হইলেন । হরিচরণ তাঁহাদের লইয়া ভেতরের ঘরে বসাইলেন । শ্যামলী একমুখ ঘোমটা টানিয়া জল ও চা পরিবেশন করিয়া খাবার সাজাইবার নিমিত্তে চলিয়া গেলেন । যতক্ষনে খাবার আসিল ততক্ষণে বিবাহের সমস্ত কথা হইয়া গেল । খাবার খাইয়া রন্ধনের প্রশংসা করিয়া তাহারা চলিয়া গেলেন ।পাঁচদিন পর । হরিশ সাজিয়া গুজিয়া তৈরী হইয়া মা বাবার সহিত মেয়ে দেখিতে বাহির হইয়া গেল । মুকুন্দপুরে আসিয়া যখন পৌঁছাইল তখন বড় বাড়ির সমস্ত আয়োজন সমাপন হইয়াছে । তাহাদের বসাইয়া, বাড়ির কর্তা গৃহিণীর উদ্দেশ্যে বলিলেন – ‘মেয়েকে নিয়ে এসো ।’ মেয়ে আসিল সাথে চা জলও । হরিশ দেখিল পূর্ণিমার চন্দ্র যেন এই গৃহে আসিয়া গৃহের ঔজ্বল্য বাড়াইয়া দিয়াছে । এই রূপ সে আগে কোথাও দেখিয়াছে বলিয়া মনে করিতে পারিল না । রূপের চ্ছটায় সে এতটাই ভাসিয়া গেল যে হাতের গরম চা শীতল হইয়া তেমনি রহিয়া গেল । একটি মাত্র কথাই জিজ্ঞাসা করিল -‘ তোমার নাম কি ?’ মিষ্টি গলায় উত্তর আসিল -‘ পূর্ণিমা ‘ । মেয়েটি লাজুক বদনে অন্তঃপুরে চলিয়া গেল । হরিশ রূপের সহিত নামের সাযুজ্য খুঁজিতে বিশ বাঁও জলে ডুবিয়া গেল । অবশেষে বিড়বিড় করিয়া বলিল – ” নামের সঙ্গে রূপ যথাযথ হয়েছে ।” মায়ের কানে কানে বলিল -‘ পছন্দ ‘ । হরিচরণ শ্যামলীর ইঙ্গিতে বুঝিলেন ছেলের পছন্দ হইয়াছে । উভয় পক্ষ স্থির করিলেন ছেলে চাকুরী পাইবার পর বিবাহ সম্পন্ন হইবে ।
কিছু দিন পর চাকুরীর সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হইল । হরিশ উৎকণ্ঠা লইয়া দিন যাপন করিতে লাগিল । এক একটি মুহূর্ত কাটাইয়া ওঠা যেন দায় হইয়া উঠিতে লাগিল । অবশেষে ফল পাইল তাহার চাকুরী হইয়াছে , বর্ধমানে পোস্টিং । খবর শুনিয়া হরিচরণ মিষ্টি কিনিবার নিমিত্তে কিছু টাকা গ্রামের বড় বাড়ি হইতে ঋণ করিয়া লইয়া আসিয়া মিষ্টি কিনিয়া গ্রামের সমস্ত লোককে বিতরণ করিলেন । শ্যামলীর চোখ হইতে কয়েক ফোঁটা জল বাহির হইয়া পড়িল , এ অশ্রু আনন্দের । দীর্ঘ কয়েক বৎসর যে স্বপ্ন তিনি পুষিয়া রাখিয়াছিলেন আজ তাহা পূর্ণ হইল ।
পরের দিন হরিশ মা বাবাকে প্রণাম করিয়া চাকুরীস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হইল । মা ডাকিলেন – ‘ দুগ্গা দুগ্গা ।’মুকুন্দপুর হইতে বিবাহের তোড়জোড় আরম্ভ করিয়া দিলেন । বাবার চিঠি পাইয়া হরিশ ছুটি লইয়া গৃহে উপস্থিত হইল । বিবাহের শুভ দিনে সানাইয়ের সুরে হরিচরণের গৃহ ও সারিডি গ্রাম মুখর হইয়া উঠিল । রজনীগন্ধা ফুলে সজ্জিত গাড়িতে চড়িয়া হরিশ বিবাহের উপলক্ষে রওনা হইয়া গেল । চারিদিকে উৎসুক জনতা চাহিয়া দেখিল ,সেদিনের ছোট্ট হরিশ আজ বৌ আনিতে যাইতেছে ।
ভোরবেলায় যখন হরিশ বৌ লইয়া গ্রামে আসিল তখনো গ্রাম সম্পূর্ণ জাগে নাই । যাহারা জাগিয়াছে তাহারা বৌ দেখিয়া অভিভূত হইয়া বলিতে লাগিল – ” আহা কি রূপ , হরিশের নজর আছে বলতে হয় ।” দুর হইতে শ্যামলী এইরূপ কথোপকথন শুনিয়া শান্তি পাইলেন । এ শান্তি কতকালের জন্য তাহা একমাত্র অন্তর্যামীই জানিতে পারেন । নব বধূকে প্রথা অনুযায়ী দধি খাওয়াইয়া ,নিজের কাপড়ের খুঁট দিয়া মুখ মুছাইয়া , প্রদীপ ও শঙ্খ ধ্বনি দিয়া বরণ করিয়া লইলেন । বিবাহের সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ হইল । হরিশের ছুটিও শেষ হইয়া আসিল । হরিশ মায়ের নিকট বৌকে রাখিয়া চাকুরিতে যোগদান করিতে চলিয়া গেল ।
ইতিমধ্যে হরিচরণের গৃহে প্রমীলার আবির্ভাব হইয়াছে । সে নিত্য আসিয়া নব বধূর সহিত গল্প জমাইয়া থাকে । শ্যামলী নব বধূকে জানাইয়া দিয়াছেন প্রমীলাকে গ্রামের লোক কুটিলা বলিয়া ডাকিয়া থাকে । কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে তাহারা তাড়াইতে পারেন না । প্রমীলা নব বধূর সহিত সেই গল্প জমাইয়া থাকে যাহাতে কচি মস্তিষ্কে বিস্তর প্রভাব পড়িয়া যায় । গল্পে গল্পে শুধু স্বামীর সহিত বাহিরে থাকি বার যে আনন্দ , তাহা বর্ণনা করিয়া বধূর মস্তিষ্কে অল্প অল্প করিয়া বিষ ঢালিতে থাকিল । ঊনিশ বৎসর বয়স্ক মস্তিষ্কে সেই বিষ ক্রমে অলক্ষ্যে ছড়াইয়া পড়িল। শাশুড়ীর সহিত খুট খাট নিত্য হইয়া উঠিল । প্রলয় যখন আসিয়া উপস্থিত হইয়া থাকে তখন কেহ তাহারে রুধিয়া রাখিতে পারে না ।
হরিচরণ কড়া রৌদ্রে সমস্ত ক্ষেতের জল দেখিয়া আসিয়া দাওয়ায় বসিয়া বলিলেন – ‘ শ্যামলী জল দাও ‘ । শ্যামলী কি একটা কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন , বৌমাকে বলিলেন – ‘ বৌমা একটু জল দিয়ে দাও তোমার বাবাকে ‘। প্রসাধনে ব্যস্ত বৌমা ভিতরের ঘর হইতে তীব্র ঝাঁঝাল স্বরে বলিল -‘ কেন আপনি পারছেন না ‘। এই ছাড়াও আরো দুই একটি কটু কথা শুনাইয়া দিল । শ্যামলী আর সহিতে না পারিয়া দুই একটি কথা তিনিও শুনাইয়া দিলেন । বধূ দরজার খিল তুলিয়া দিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল । বৃদ্ধ হরিচরণের আর জল পান করা হইল না । তিনি দরজার কড়া নাড়িয়া ভীত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন – ‘ দরজা খোল মা ‘। কিন্তু বধূ তাহাতে প্রথমটায় কর্ণপাত না করিলেও কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলিল । হরিচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন -” তুমি কি হরিশের চাকুরীস্থলে থাকতে চাও ?” বধূ চোখের জল মুছিয়া সম্মতি জানাইল । পরদিন বৃদ্ধ চিঠি লিখিলেন – ” বাবা হরিশ তুমি তোমার বৌকে নিয়ে গিয়ে শান্তিতে থাকো ।”
চিঠি খুলিয়া পড়িয়া হরিশ বুঝিল কিছু একটা গন্ডগোল ঘটিয়াছে । সে দেরি না করিয়া গৃহের অভিমুখে রওনা হইল । কি ঘটিয়াছে তাহা চিন্তা করিতে করিতে কখন যে পৌঁছাইয়া গেল তাহা বুঝিতে পারিল না । গৃহে আসিয়া যখন পৌঁছাইল তখন সন্ধ্যা নামিয়াছে । কাঁধ হইতে থলেটা নামাইয়া রাখিল , দেখিল গৃহের পরিবেশ থমথমে হইয়া রহিয়াছে । সে মা বাবার নিকট জানিতে চাহিল কি ঘটিয়াছে , কিন্তু তাহারা কিছুই বলিলেন না । সারা রাত্রি বধূর মুখ হইতে মায়ের নিন্দা শুনিয়া তাহার আর ঘুম আসিল না । সে জানে তাহার দেবী মা কখনোই অন্যায় করিতে পারেন না , এ তাহার বধূ কেন ,কেহ বিশ্বাস করাইতে সমর্থ হইবে না । কিন্তু বিশ্বাস না করিলেও বধূর মন রাখিতে বিশ্বাস করিয়াছি এইরূপ ভান করিয়া রহিল । সকালে উঠিয়া বধূ তাহার ব্যবহার্য যাহা কিছু ছিল সমস্ত গুছাইয়া লইল । হরিশ মা বাবাকে প্রণাম করিল ,ঠিক যেমনটা চাকুরিতে যোগদান করিতে যাইবার পূর্বে করিয়াছিল । মা বাবা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন – ‘ সুখে থেকো ।’ উহারা দুইজনে বাহির হইয়া গেল । যত দূর চোখে দেখিতে পাইলেন বৃদ্ধ দম্পতি চাহিয়া রহিলেন । বধূ একটি বারের জন্যও পিছন ফিরিয়া চাহিল না । হরিশ একবার পিছন ফিরিয়া দেখিয়া পুনরায় সন্মুখে চাহিয়া চলিয়া গেল । শ্যামলীর নিষ্পলক চোখ হইতে দরদর করিয়া জল বাহির হইয়া পড়িল । বক্ষ হইতে কেহ যেন হৃৎপিন্ড উপড়াইয়া লইয়া চলিয়া গেল , তাহার এইরূপ মনে হইতে লাগিল । পৃথিবীর সকল রঙ তাহার চোখে ধূসর ঠেকিতে লাগিল । হরিচরণ আপন সহধর্মিণীকে নানা প্রকার বাক্য প্রয়োগ করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন । এই বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকিলেন , পৃথিবীতে কে কাহার ! তাহার দীর্ঘ জীবনের হিসাবে একটা যে ভুল রহিয়া গিয়াছিল তাহা আজ বুঝিতে পারিলেন । বড় বাড়ি হইতে আসিলেই সকলের মন যে বড় নাও হইতে পারে তাহার উদাহরণ সদ্য দেখিলেন ।
হরিশ ধীরে ধীরে স্ত্রৈণ হইয়া উঠিয়াছে। মনের প্রবল ইচ্ছা থাকিলেও মা বাবাকে দেখিতে আসিবার ক্ষমতা সে হারাইয়া ফেলিয়াছে । দুই বৎসর হইল সে সারিডি গ্রামে আসে নাই । বৃদ্ধ হরিচরণ নিজেকে সহায়হীন ভাবিয়া সংসারের দৈনিক হাটমশলার খরচ চালাইবার জন্য একটি দুগ্ধবতী গাভী পালন করিয়াছেন । তাহারই খোরাক জোগাড় করিতে মাঠে গিয়াছিলেন । মাথা হইতে ঘাসের বস্তাটা সশব্দে উঠানে ফেলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন শ্যামলী শুইয়া আছেন । হরিচরণ জানিতে চাহিলেন -‘ তোমার কি হয়েছে ?’ শ্যামলী উত্তরে বলিলেন -‘ শরীর খারাপ ।’ এমতবস্থায় শ্যামলীর দুই দিন কাটিল । হরিচরণ গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের নিকট হইতে ঔষধ লইয়া আসিয়াছেন , কিন্তু তাহাতে কোনরূপ উন্নতি হয় নাই । মনে মনে অশুভ চিন্তা করিয়া হরিচরণ তাহাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়া দিলেন । ডাক্তার আসিয়া রুগী দেখিয়া অনতিদূরে হরিচরণকে ডাকিয়া বলিলেন – ” আপনার স্ত্রীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে , লাস্ট স্টেজ , কিছু করার নাই ।” ডাক্তার চলিয়া গেলেন । হরিচরণ ইহাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া লইতে পারিতেছেন না । হু হু করিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিল , কিন্তু পাছে শ্যামলী টের পান তাহা ভাবিয়া কাঁদিতেও পারিলেন না । এযাবৎ কোনও দিন তিনি তাহার অর্ধাঙ্গিনীকে কষ্ট দেন নাই আজও তাহা পারিলেন না । শ্যামলী হরিচরণের মুখ দেখিয়া বুঝিলেন তিনি আর বাঁচিবেন না । ইঙ্গিতে তাহাকে কাছে ডাকিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলিলেন – ” এক বার খোকাকে আসতে বলো , বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।” হরিচরণ মৃত্যু পথ যাত্রী শ্যামলীর কথা রাখিতে গ্রামে গেলেন । ভাবিয়া পাইলেন না কি ভাবে দ্রুত খবরটা হরিশকে জানাইবেন । হরিশ যবে তাহার বৌ লইয়া চলিয়া গেল সেইদিন হরিচরণ তাহার হাতে একখানি ফোন দেখিয়াছিলেন কিন্তু সেইদিন এতটাই শোক পাইয়াছিলেন যে ফোন নম্বর লইতে ভুলিয়া গিয়াছেন । অগত্যা কলগা হাতড়াইয়া ছেলের চাকুরীস্থলের ঠিকানা লেখা ছেঁড়া খাতা খানি বাহির করিয়া চিঠি লিখিলেন – ” বাবা হরিশ তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা তোমাকে দেখে যাওয়া ।”
চার দিন হাসপাতালের বিছানায় শুইয়া শ্যামলী ভাবিতে লাগিলেন এই বুঝি তাহার ছেলে আসিল । কিন্তু তিনি ছেলেকে দেখিতে পাইলেন না । হরিচরণও পত্নী শোকে বিহ্বল হইয়া দুর্বল হইয়া যাইতে লাগিলেন । হঠাৎ চারদিনের দ্বিপ্রহরে পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়া হরিচরণের ভালবাসার শিকল কাটিয়া শ্যামলী চলিয়া গেলেন। ডাক্তার আসিয়া নাড়ি দেখিয়া বলিলেন -‘ গত হয়েছেন ।’ আজ হরিচরণ চিৎকার করিয়া কাঁদিলেন । তাহার কান্না দেখিয়া কষ্ট পাইবার কেহ রহিল না । হরিচরণের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া গেল ।
পিতার চিঠিখানি পড়িয়া হরিশ আর নিজেকে সম্বরণ করিতে পারিল না । সে প্রবল প্রতাপ লইয়া বৌয়ের নিকট কথাটা পাড়িল । হরিশের এরূপ মূর্তি সে আগে কখনো দেখে নাই । ভীত হইয়া সেও হরিশের সহিত যাইতে চাহিল । দুই জনে যখন গ্রামের পথে ঢুকিল তখন দেখিল গ্রামের পথ জুড়িয়া খই ছড়ানো । হরিশ বুঝিল ………………। তাহাদের দেখিয়া ষাটোর্ধ্ব ভবেশ খুড়ো বলিলেন -” বাবা তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হইল না ।” কথাটা হরিশের বক্ষে তীরের ফলার মতোই বিঁধিল । হরিশ ও তাহার বৌ শ্মশান অভিমুখে চলিল । যখন শ্মশানে আসিয়া পৌঁছাইল তখন তাহার মাকে চিতার উপর শুয়াইয়া দেওয়া হইয়াছে । হরিশ সেমতাবস্থায় মায়ের পা জড়াইয়া হু-হু করিয়া কাঁদিতে লাগিল । তাহার মায়ের মৃত্যুর কারণ হিসাবে নিজের বৌকে দোষী সাব্যস্ত করিতে লাগিল । পূর্ণিমাও স্থির রহিতে পারিল না , শাশুড়ীর ভালোবাসার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত তাহার মনে পড়িতে লাগিল । সেও চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল । সমস্ত শ্মশানময় সেই কান্নার রোল পাক খাইতে লাগিল । চেতনার অমাবস্যা নিঃশেষ হইয়া যখন পূর্ণিমা আসিয়া উপস্থিত হইল তখন অনেক দেরি হইয়া গিয়াছে ।
-
আসবে সুদিন
আসবে সুদিন
-চিন্ময় মহান্তীআজও পরাণ একলা কাঁদে নীল দিগন্ত বুকে
স্বপ্নগুলো পথ চলে ঐ হতাশার গন্ধ শুঁকে !
গরীবত্ব রুটি খোঁজে ডাস্টবিনের ঐ ভিড়ে
আলোক যখন রোশনাই দেয় অহং রজনী নীড়ে ।চাইনিজ প্লেটে মুখগুলো যখন বিলাস চর্বনে বসে ,
দীনতার তখন পেটের আগুন এখনো জলে রসে ।
রাত কেটে যায়-দিন কেটে যায় ,আয়াস সুখের ভিড়ে ;
হতাশা তখন পথ হাতড়ায়…শাপলা জড়ানো নীড়ে ।হায়রে দীন ! বিধির বীন বাজবে কবে ওরে ?
সূর্য তোদের ঝুপড়ি ঘরে উঠবে কোন ভোরে ?
নতুন সকাল দেখবি কবে ? নতুন আশার ডোরে ,
দুর্বিষহ হতাশ জীবন দেখবিনা কবে ওরে ?তোদের অন্নে পুষ্ট হলো যাদের স্বপ্নভূমি ,
তারাই তোদের ফেলছে ছুঁড়ে রসাতে স্বার্থভূমি ।
ওরে দীন… আসবে সুদিন , কবে বলতে পারিস ?
দীর্ঘপথ পেরিয়েও সেই প্রথম মোড়েই আছিস ।সূর্য একদিন উঠবেই ওরে তোদের ঝুপড়ি ঘরে ,
হয়তো সেদিন অনেক দূরে , আসবেই সেদিন ওরে ।
বিধাতা সেদিন লিখবে ভাগ্য , নাচবি তালে তালে
সপ্তসুরের ঝরনা ধারা বইবে জীবন ঢালে । -
পরিণতি
পরিণতি
-চিন্ময় মহান্তী
১
হাতের কালশিটে দাগটাতে পুরাতন ঘি বোলাতে বোলাতে রমা তাকিয়ে ছিল খড়ের চালার দিকে। ক্ষণিক পূর্বেই তার নেশাগ্রস্ত স্বামী চেলা কাঠ দিয়ে সোহাগ করেছিল হাতে , তার স্মারক হতে একটি যন্ত্রনা থেমে থেমে উঠছিল ।
একগুচ্ছ পুঁই শাক হাতে উঠানে দাঁড়িয়ে বিনু কাকিমা ডাক দিলেন , ‘ রমা -ও রমা , কই গেলি ? নে কয়টা শাক নিয়ে এলুম। ‘ বিনু কাকিমা রমার বাপের ঘরের মেয়ে আর সেই সূত্রেই রমার সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা একটু বেশি। রমা বিনু কাকিমার ডাক শুনতে পেয়েই তড়িঘড়ি বাম হাতের কালশিটে দাগটা আঁচল দিয়ে ঢেকে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা পিঁড়ি আগিয়ে দিয়ে বলল ,” বসুন কাকিমা। ” বিনু কাকিমা বললেন , ” না রে রমা অনেক কাজ পড়ে আছে , নে-নে শাক কটা রাখ দিকিনি। ” রমা তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিল বিনু কাকিমার দিকে। তিনি শাক কটা রমার হাতে দিয়ে বললেন , ” কই মনাকে দেখছিনে ? ” মনা , রমার স্বামী ; তার পুরো নাম মনতোষ কিন্তু সেই যে ছোটোবেলায় তার মা আদর করে মনা বলে ডাকত সেই থেকেই সে গ্রামের লোকের কাছে মনা নামেই পরিচিত হয়ে আছে। বিনু কাকিমার মুখ থেকে অনাগত সম্ভাব্য প্রশ্ন শেষ করতে রমা উত্তর দিল , ” এই তো এই মাত্রই মুড়ি খেয়ে ক্ষেতে গেল , আজ ট্রাক্টরে চাষ দেবে তো তাই। ” এইখানে রমা যে অতি সুকৌশলে মিথ্যা অভিনয় করল তা প্রৌঢ়া বুঝতে পারলেন না। বিনু কাকিমা আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার অবকাশ না পেয়ে বললেন , ” আচ্ছা , আসি রে। ” রমা সম্মতি জানাল। বিনু কাকিমা পশ্চাৎমুখী হতেই সে বাম হাতটির দিকে তাকিয়ে দেখল , আঁচলের ঢাকা ঠিকঠাকই আছে।
রমা আজ পর্যন্ত স্বামীর সমস্ত অত্যাচার গোপন করে এসেছে। বিশেষত বিনু কাকিমার কাছে কখনো কিছু বলেনা। তিনি রমার বাপের বাড়ির গ্রামের মেয়ে , জানতে পারলে সেই খবর রমার বাবা মা জানতে পেরে বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট পাবে ভেবে রমা এই পথ অবলম্বন করেছে। এছাড়াও অপর একটি কারণ আছে , কোলের ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে স্বামীর সকল অত্যাচার সহ্য করে চলেছে। হায়রে অবলা নারী! সহ্য কোনো কোনো সময় প্রশ্রয় হয়ে উঠে অত্যাচারের মাত্রাকে অধিকতর তীব্র করে তোলে এবং তার পরিণতি ভয়াল আকার ধারন করে ।
২
দুপুর গড়িয়ে সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। রমা বারান্দায় মাটির দাওয়ার উপর বসে আছে। তার অবিন্যস্ত চুলগুলি হালকা বাতাসে এলোমেলো উড়ছে । কোলের সন্তানটি রমার কোলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মানুষটা সেই যে চেলা কাঠ দিয়ে সোহাগ করে গেল এখনো ফিরল না। তারই আগমনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে রমা। ভাতের হাঁড়িটা ফ্যান ঝরতে সেই যে উপুড় করেছে এখনো তেমনই রয়েছে। তার উপর কিছু মাছি ভনভন করে উড়ে উড়ে বসছে। বাসের বেড়াটা টপকে একটা বিড়াল ঢুকে পড়ল ঘরে , সেদিকে রমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ঘরের ভেতরে কিছু গড়ানোর একটা শব্দ উঠল। বিড়ালটা ম্যাও ম্যাও করে কেঁদে উঠল। রমা সেটাকে তাড়াতে উঠে গিয়ে দেখল হাঁড়ির ভাত মাটির উপর পড়ে রয়েছে , হাঁড়িটি একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে কোলের ছেলেটিকে একটি খাটের উপর শুইয়ে , পড়ে থাকা ভাতগুলি হাঁড়িতে কুড়াতে লাগল।
হঠাৎ বাইরে একটা শোরগোল শোনা যেতে রমা শকড়ি হাতেই বাইরে বেরিয়ে দেখল , তাদের উঠানে প্রচুর মানুষের ভিড়। সে কৌতুহলী হয়ে ভিড় ঠেলে দেখল তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে শুয়ে রয়েছে। রমা হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্বামীর বুকে। হৃদপিন্ডটার কাছে কান রেখে সে কোনো স্পন্দন অনুভব করতে না পেরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে সে বার বার বলতে লাগলো , ” তুমি যদি নেশা না করে বড় রাস্তায় হাঁটতে তাহলে হয়তো আজ এই পরিণতি হতো না ! বারবার নিষেধ করলে শুধু আঘাত করে গেলে ! ” রমার বাড়ির উঠানের ভিড়টা ক্রমে পাতলা হতে শুরু করল। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো কোলের শিশুটির কান্না।