-
গল্প- খুশী পরিবার
খুশী পরিবার
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়যৌথ পরিবার তো এখন বড় একটা দেখা যায় না। তবে প্রদীপদের পরিবারটা বড় পরিবারের তকমা লাগিয়ে রেখেছিলো অনেকদিন।
এখন নতুন প্রজন্মে ছেলেপিলেদের বিয়ে হচ্ছে… তারা একটু আধুনিক ভাবে হাতপা ছড়িয়ে থাকতে চায়…তাই ঘর চাই… তারপর ভালো চাকরীর সন্ধানে বাইরে যাওয়া চাই। আর করবেটাই’বা কি? ভালো পড়াশুনো করে তো আর যা হোক কিছু কাজ করা যায় না! বড়দার ছোটছেলে বাইরে চাকরী করে… আর বড়ছেলের বিয়ে হয়েছে…এবাড়িতেই থাকে। মেজদার এক মেয়ে আর এক ছেলে… দুজনেই বাইরে পড়তে গেছে। প্রদীপের দুই মেয়ে ছোট…পড়াশুনো করে।বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে সব ভালো পরিবারে। তারা সবাই ভালোই আছে।
বাড়ির সবাই মিলে একদিন ঠিক করলো… এই বিশাল পুরোনো বাড়ি মেরামত করা অনেক ঝামেলার…আর এই আগেকার স্টাইলের বাড়িতে বারান্দা, উঠোন এইসব করে জায়গার অপচয়। তাই বাড়ি সারানোর থেকে এবাড়ি ভেঙে নতুন প্ল্যানে বাড়ি করা হোক। প্রোমোটারের তৈরী ফ্ল্যাট ওরা চায় না। শুধু তিনতলা বাড়িটা আবার নতুন করে বানাতে চায়। এক একটা তলা মর্ডান প্ল্যান মাফিক বানাবে। তাতে বড় ডাইনিং কাম ড্রয়িংরুম… বড় বড় তিনটে করে বেডরুম, মর্ডান বাথরুম, কিচেন সবই হবে। টাকার অভাব ওদের নেই। নিজেরা চাকরী করে। এখন তো পরের প্রজন্মও দাঁড়িয়ে গেছে। আর ওরাও এই পুরোনো বালি ঝুরঝুরে, স্যাঁতসেঁতে আদ্যিকালের বাড়িতে থাকতে চায় না।
ভালো আর্কিটেক্টকে দিয়ে প্ল্যান বানিয়ে কন্ট্রাকে মিস্ত্রী লাগিয়ে বাড়ি বানানো শুরু হলো। নিজেরাও ওরা দেখাশুনো করলো। অবশেষে তিনতলা এক বিশাল বাড়ি তৈরীও হলো। তিনভাই নিজেদের সুবিধামত এক এক তলা নিলো। যদিও প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংসার। তাও সবাই মিলে কাছাকাছি থাকা। অনুষ্ঠান, পার্বণে পাঁচফোড়নের মত মিলেমিশে আনন্দ-খুশী উপভোগ করা।
বাড়ি তো বানানো হলো। কিন্তু গৃহপ্রবেশ তো করা চাই। এই অতিমারীর প্রবাহে.. অসুখ-বিসুখের কারণে বাইরের লোক ডাকা যাবে না। শুধু পরিবারের সবাই মানে ভাইরা, বোনেরা মিলিত হবে আর নিষ্ঠাভরে পুজোটা করে একটু খাওয়াদাওয়া। সত্যনারায়ণ পুজো সকাল সকালই হয়ে গেলো। এবার ভোজনের আয়োজন।
রান্নার জন্য বাজার ওরাই করে দিয়েছিলো। রান্না করতে এলো ওদের বহুদিনের চেনা এক উড়ে ঠাকুর আর তার জোগারে। এই রাধুনের হাতের রান্না না’কি অসাধারণ। উনুন ধরিয়ে বিশাল কড়াই বসিয়ে রান্না শুরু করলো রান্নার ঠাকুর।
খানিকবাদে খবর এলো উড়ে ঠাকুর গামছা পড়ে একবার যাচ্ছে…আর একবার আসছে….। তার যাওয়া আর আসার চক্করে রান্না মাথায় উঠলো। তাকে পেটখারাপের ওষুধ দিয়ে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা হলো। পরে একটু সুস্থ হলে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।
অগত্যা বাড়ির মহিলা আর পুরুষেরা রান্নায় হাত লাগালো। সে এক এলাহী ব্যাপার! বাড়ির দুই ছোটমেয়ে রিনি আর ঝিনি তো হেসে অস্থির… তারা দেখে তাদের দুই জ্যেঠু ভাত, ডাল, মাছ রান্না করছে। বিশাল কড়াই নামাচ্ছে। ওদের বাবাও চাটনী, তরকারি রাঁধছে!
রোজ তো বাড়ির মেয়েরাই রাঁধে। আজ তাদের ছুটি তারা শুধু বলে বলে দিচ্ছে।
তারপর খাওয়াদাওয়া, হৈ চৈ… মজা, ইয়ার্কি, একে অপরের পিছনে লাগা… ভাই, বোন, ভাইপো, বোনপো, ভাগ্নে-ভাগ্নী ফোঁড়নের সব উপকরণ মজুত। এর নামই “প রি বা র” বড় পরিবার, খুশী পরিবার। -
গল্প- বন্ধু তুই
বন্ধু তুই
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সেই কোন স্কুলবেলায় শ্রেয়ারা পাঁচবন্ধু সবসময় একসঙ্গেই থাকতো…সে ক্লাসরুমই হোক কিংবা খেলার মাঠ বা লাইব্রেরী। পাঁচ জনকে একসঙ্গে সবাই পাঁচফোড়ন বলতো। মনের যা কিছু কথা নিজেদের মধ্যে উজার করে বলতে না পারলে ওদের ভাতই হজম হতোনা। হা হা করে প্রাণখোলা হাসি ভেসে যেত স্কুল বিল্ডিংয়ের করিডোর ছাড়িয়ে…
স্কুল শেষ হলে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও তরী আর শ্রেয়া একসাথেই কলেজে ভর্তি হলো।
ওদের মধ্যের প্রাণের বন্ধনটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো শক্তপোক্ত হলো। দুজনের সব ব্যাপারেই দারুণ মিল। দুজনের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য ছিলো আর্থিক অবস্থার। শ্রেয়ার বাবা সামান্য একটা চাকরী করতেন। আর তরীর বাবা একজন অর্থশালী লোক… শহরে দু-চারটে বাড়ি, গাড়ি, আর্থিক প্রতিপত্তি সবই ছিলো। বিরাট ব্যবসায়ী উনি। কিন্তু ওনাদের স্বভাবে বা ব্যবহারিক প্রকাশে তা কখনোই বোঝা যেত না। আসলে সামান্য পুঁজি থেকে কষ্ট করে দাঁড়ানোর মর্ম তরীর বাবা আশুতোষবাবু বুঝতেন। আর ওনাদের মেয়ে তরীও খুব খোলামেলা স্বভাবের ভালো মেয়ে। অত বড়লোক হয়েও কোন গর্ব ছিলো না ওর। শ্রেয়ার সাথে প্রাণের বন্ধুর মত মিশতো। শ্রেয়ার যে কোনো অসুবিধায় কোনো শর্ত ছাড়াই সাহায্য করতো। অনেক সময় শ্রেয়া অনেক কিছু চেপে যেতো কিন্তু তরী ঠিক টের পেয়ে যেত।
পরিবারে বাবা-মা অনেকসময় যে কথাটা বোঝে না…বন্ধু তার সমবয়সী মন দিয়ে সেটা সহজেই বুঝে যায়। আর বন্ধুত্বের মধ্যে তো কোন শাসন, ধমক, ভয় নেই। তাই বন্ধুর কাছে মন খোলা যায় সহজেই।
সেই স্কুলবেলা থেকেই তরী বেশী করে টিফিন আনতো বন্ধুদের জন্য… শ্রেয়াকে জোর করেই একটু বেশী দিতো। আর শ্রেয়ার আনা রুটি-তরকারীই হোক কিংবা মুড়ি… সেটাও ভালোবেসে খেতো। শ্রেয়ার লজ্জা করতো… ওর নিজের টিফিন শেয়ার করতে। কিন্তু তরী বা অন্য বন্ধুরা এসব গ্রাহ্যই করতো না। কতবার এমন হয়েছে শ্রেয়া রেফারেন্স বই কিনতে পারেনি…তরী নিজের বইটা দিয়ে দিয়েছে। শ্রেয়া নিতে না চাইলেও শোনেনি…মুখ ভার করে থেকেছে। তখন শ্রেয়া বাধ্য হয়েই নিয়েছে। পরে তরী নিজের হাত খরচের টাকা থেকে আবার বই কিনে নিয়েছে। শ্রেয়া টাকা খরচ করে স্পেশাল কোচিং নিতে পারেনি…তরী নিজের গৃহশিক্ষকের নোটস ওকে অবলীলায় দিয়ে দিয়েছে। হিংসার ছিটেফোঁটাও নেই তরীর মনে।
এমন বন্ধুকে কী না’ভালোবেসে থাকা যায়? দুজনের বাড়িতেই দুজনের অবাধ বিচরণ ছিলো। এভাবেই দু’বাড়ির মায়েদের মধ্যেও একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো।
কলেজে বন্ধুদের জন্মদিন লেগেই থাকতো… ওরা ট্রিট দিতো…তরী শ্রেয়ার থেকে কম টাকা নিয়ে নিজে বেশী টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে দিতো গিফট কেনার সময়। সেবার বাকী বন্ধুরা জোর করলো শ্রেয়াকে “কি রে তোর জন্মদিনে খাওয়াবি না?”
তরী পাশ থেকে বললো-কেন নয়? নিশ্চয়ই পার্টি হবে…
শ্রেয়া পরে তরীকে বললো-ওদের মত অত দামী রেস্টুরেন্টে আমি খাওয়াতে পারবোনা… তুই তো জানিস! তুই কেন হ্যাঁ বললি?
তরী হেসে বললো- টেনশন নিস’না তো… আমি আছি না। আমি থাকতে প্রিয় বন্ধুর চিন্তা কি? আমি কি আমার বন্ধুত্বের সম্মানে ওদের একদিন খাওয়াতে পারবো না?
শ্রেয়া বললো-আমার জন্মদিনে তুই কেন খাওয়াবি?
তরী বললো-আমি তোর কেউ নই… তাই তো? আমার তোর উপরে কোনো অধিকার নেই…তাই তো? বলে মুখ ফোলালো। অগত্যা শ্রেয়াকে রাজী হতেই হলো…কেউ জানলো না… শ্রেয়ার হয়ে রেস্টুরেন্টের পুরো বিলটাই পে করলো তরী।
আসলে প্রতিমাসে তরী বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের হাতখরচ পেতো…কিছুটা খরচ করে বাকীটা জমাতো এইধরণের নানা কাজের জন্য।
মাঝেমধ্যে শ্রেয়া তরীকে বলতো-তোর কাছে আমার এত ঋণ… কি করে শোধ করবো!
তরী মিচকে হেসে বলতো-“আমার দাসী হ’ আর হাত-পা’টা ভালো করে টিপে দে… পরক্ষণেই বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে বলতো-ভালোবাসার মন দিয়ে কিছু করলে ঋণ হয় না…
কলেজে পড়াকালীন একবার তরী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো…টাইফয়েড, জ্বর… সেইসময় শ্রেয়া বন্ধুর পাশ থেকে একটুও নড়েনি।
আসলে “বন্ধু পারে হৃদয় দিতে…আর পারেনা কেউ”
দিন চলে গেছে…লেখাপড়া শেষে চাকরী, বিয়ে, বাচ্চার মা হওয়া…এখনও ওরা জড়িয়ে রয়েছে একে অপরকে। শ্রেয়ার বর অর্ণব ডাক্তার …ও মাঝেমধ্যে মজা করে অনুযোগ করে বলে —“তুমি তো আমার থেকেও তরীকে বেশী ভালোবাসো।” শ্রেয়া হেসে বলে –“তুমি একটা হিংসুটে দৈত্য।” যদিও অর্ণব ওদের বন্ধুত্বের সবটাই জানে… তাই বলে–“সত্যিই তরীর মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার…তোমার বন্ধুভাগ্যকে আমি হিংসাই করি… সে যতই তুমি আমাকে হিংসুটে বলো’না কেন!” তবে এখন কিন্তু অর্ণবই তরীদের ফ্যামিলির ডাক্তার… ওদের বাড়ির বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার চিকিৎসাই করে শ্রেয়ার বর অর্ণব। এতদিন বাদে তরীর মত এমন বন্ধুর জন্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগে শ্রেয়ার। পুজোয় নিজের ছেলেমেয়েকে দেওয়ার আগে তরীর বাচ্চাদের জন্যই দামী ড্রেসটা আগে কিনে রাখে শ্রেয়া। তরীর দুই মেয়ে জানে ওদের জন্মদিনে সেরা উপহারটা কিন্তু দেবে শ্রেয়া মাসিমনি… ইমলি, ঝিমলির যত আবদার এই মাসিমনির কাছে। ওদের নিজের মাসিমনির থেকে কোনো অংশে টান কম নেই শ্রেয়া মাসিমনির।
এখন আবার সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই স্কুলের পাঁচ বন্ধুর পুনর্মিলন হয়েছে… “পাঁচফোড়ন” কে একসাথে দেখা যাচ্ছে শপিং মলে,কফি-শপের আড্ডায়,গল্পে… এখনও ওদের প্রাণখোলা হাসির আওয়াজে আশেপাশের লোক ফিরে ফিরে তাকায়। না ওদের লজ্জা নেই তাতে। ওরা উচ্ছ্বল… ওরা চঞ্চল… ওরা বন্ধুত্বের দূত।
এখন আবার ওদের নতুন এক জিনিস শুরু হয়েছে। বর, বাচ্চাদের বাড়িতে জমা রেখে শুধু পাঁচজন মিলে কাছেপিঠে আউটিং এ যায়। দু’দিন ঘুরে,বেড়িয়ে, খেয়ে, গল্প করে নিজেদের মত সময় কাটিয়ে খুশী মনে বাড়ি ফেরে। ওদের হুল্লোড়, হাসির আওয়াজ তখন খোলা সবুজ মাঠ পেরিয়ে ভেসে যায় আকাশে বাতাসে ঠিক সেই স্কুলবেলার মতোই।।
-
গল্প-বিমলবাবু
বিমলবাবু
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়বিমলবাবু রিটায়ার করার পর রোজ সকাল বিকেল নিয়ম করে হাঁটেন পার্কের ভিতরের রাস্তা ধরে। রিটায়ারমেন্টের পরেই ডাক্তারের পরামর্শে আর নিজে সুস্থ থাকার তাগিদে শরীরটা একটু সচল রাখার চেষ্টা। যদিও বাজার, দোকান, ব্যাঙ্ক ও নানা দরকারী কাজে তাকে বেরোতেই হয়। এমনিতে বাড়িতে থাকার অভ্যেস তেমন নেই। বেরোবার জন্য খালি উসখুস করেন। আর কি’বা করবেন… বাড়িতে থাকলেই ছোটখাটো ব্যাপারে খিটিমিটি লেগে যায় বউয়ের সাথে। বউয়ের এমনিতেই বাতের ব্যথা…মেজাজটা সপ্তমে চড়ে থাকে। তারমধ্যেই ঘরের সব কাজ করতেই হয়… যদিও বাসনমাজা, ঘরমোছার লোক আছে। রান্নাটা উনি নিজেই করতে পছন্দ করেন। তাছাড়াও সংসারের সাতসতেরো কাজতো আছেই।
বিমলবাবুর একমাত্র ছেলে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকে… ওর সাথে বউ আর বাচ্চাও থাকে। বছরে ছুটিছাটায় আসে। বিমলবাবুর এক মেয়েও বিবাহিত… শ্বশুরবাড়ি দূরে। সেও খুব একটা আসতে পারেনা। অগত্যা কর্তা, গিন্নী বাড়িতে থাকেন। নাতি-নাতনীদের দেখতে ইচ্ছে করে। এখন ভিডিও কলিং-এ ভরসা। তাতে কি আর কাছে না থাকার কষ্ট কমে? খানিকটা একাকীত্ব আর মনখারাপেই কাটে ওনাদের। অসুখবিসুখ করলে তো আরো বিপদ! তাই খুব নিয়মেই থাকার চেষ্টা করেন ওনারা।
পার্কে একটু হেঁটে বেঞ্চে বসলেই দেখেন একটা ছোট্ট মেয়ে এসে দাঁড়ায়। খুব মিষ্টি মুখ মেয়েটার কিন্তু মুখটা বড় দুঃখী… গায়ের ফ্রকটাও মলিন। ওর হাতে দু’টো টাকা দেন…কখনো লজেন্স, বিস্কুটও কিনে দেন। ও না’কি পার্কের পাশের ঝুপড়িতেই থাকে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন “কি রে তুই লেখাপড়া করিস না?”
“করি তো… ওই এক দিদিমণি এসে আমাদের ফুটের বাচ্ছাদের পড়ায়… খেতে দেয় তো” বলে মেয়েটি। “একটা কবিতা শোনা তো” বলতেই মিষ্টি গলায় তিন চারটে ছড়া শোনায় মেয়েটি। অঙ্কের ছোট ছোট হিসেবও মুখে মুখে দিব্যি করে দেয়। ওকে দেখে বিমলবাবুর মনে হয় বেশ বুদ্ধিমতী… সুযোগ পেলে হয়তো বেশ ভালো হতো পড়াশুনোয়। মনটা খারাপ হয়ে যায় ভেবে।
“তোর নাম কি ” জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বলে “লক্ষ্মী”।বিমলবাবু মনে মনে ভাবেন “ফুটপাতের লক্ষ্মী “… সত্যিই কি কষ্টের জীবন যেখানে স্বয়ং মা লক্ষ্মীও উঁকি দিতে আসেন না ওদের জীবনে।
একদিন ফুটপাত ধরে হেঁটে ফিরছিলেন হঠাৎ দেখে লক্ষ্মী ওর কচি গলায় ডাকছে “ও দাদু ও দাদু” বলে। ভারী ভালো লাগে বিমলবাবুর। মেয়ের ঘরের নাতনীর মুখটা মনে পড়ে যায়। পাশে ওর মা দাঁড়িয়ে হেসে বিমলবাবুকে বললো “বাবু, আমার মেয়ে আপনার কথা খুব বলে, “ভালো দাদু” বলে ডাকে।”
“তুমি কি কাজ করো” জিজ্ঞেস করলে মেয়েটির মা জানায় –ও লোকের বাড়ি কাজ করে… লক্ষ্মীর বাবা নেই…ওর মাকেই রোজগার করতে হয়। তারপর দিনকাল ভালো নয়… মেয়েকে নিয়ে ফুটে থাকতে ভয় লাগে… কিন্তু কিই’বা করবে!”বর্ষাকালে বিমলবাবু হাঁটতে যাননি বেশ কিছুদিন। বর্ষায় ঘরে বসে থাকতে অসহ্য লাগে… তাও উপায় নেই। তবে ছোটবেলায় বৃষ্টি বেশ উপভোগ করতেন তিনি..কাদামেখে ফুটবল খেলা… তারপর পুকুরে চান করে কাদা তুলে তবে বাড়িতে ঢোকা। বাড়ি ফিরলে মা গরম চা আর মুড়ি, তেলেভাজা দিতেন। সেসময় বাড়ির চারপাশে গাছগাছালি ছিলো প্রচুর… বর্ষায় ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক শোনা যেতো। পুকুর পারের কদম ফুলের গাছটা ফুলে ভরে যেত এইসময়।
আর এখন এই বর্ষাটা বড্ড বাজে লাগে ওনার। রাস্তাঘাট পিছল, একটু বেশী বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। তাও কেনাকাটা করতে বেরোতেই হয়৷ তেমনি সেদিন দোকানে টুকিটাকি কিনে ফিরছিলেন পার্কের পাশের ফুটপাত ধরে। ওদের ঘরে উঁকি দিয়ে লক্ষ্মী বলে ডাকতেই ওর মা বেরিয়ে এসে বললো- বাবু,লক্ষ্মীর খুব জ্বর এসেছে। ঘরেও সমানে জল পড়ছে। বৃষ্টির জল লেগেই বোধহয়… ফুটিফাটা প্লাস্টিক চাপা দেওয়া ঝুপড়ি…চোখে জল এসে যায় বিমলবাবুর। বাচ্চাটা বড় মায়ায় জড়িয়েছে। উনি বলেন- ওকে নিয়ে আমার সাথে চলো…ডাক্তার দেখিয়ে তারপর আমার বাড়িতে থাকবে। যদি কিছু মনে না করো… আমার ওখানেই থাকতে পারো। তোমার মাসীমাকে একটু কাজে সাহায্য করবে। আর তোমার মেয়ের পড়াশুনোর দায়িত্ব আমি নেবো… ও খুব বুদ্ধিমতী।
ভেজা বর্ষায় ওদের আশ্রয় দিয়ে কোনো ভুল করেননি উনি। তাও ওর ছেলে -মেয়ে শুনে রেগে গেছে। বলেছে- রাস্তা থেকে যত উটকো লোক এনে ঘরে ঢোকাচ্ছো… এর ফল বুঝবে। এত বছর মানুষ দেখে অভিজ্ঞতায় মানুষ চিনতে ভুল হয়না বিমলবাবুর। ডাক্তারের ওষুধে দিব্যি ভালো হয়ে উঠলো লক্ষ্মী। একতলার সিঁড়ির নীচের ছোট্ট ঘরটাতেই মা-মেয়ে থাকে। মেয়েকে পাড়ার ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন বিমলবাবুর। ওকে নিজেও পড়া দেখিয়ে দেন। বেশ সময় কাটে ওর সাথে লেখা -পড়া -গল্পে। কচি গলায় দাদু – ঠাম্মা ডাকে মুখর হয়ে ওঠে বাড়ীটা। বিমলবাবুর ঘরে লক্ষ্মী আলো করে থাকে। বিমলবাবুর প্রতিভাদেবীও খুব খুশী সর্বক্ষণের সাহায্যকারী লক্ষ্মীর মা মালতীকে পেয়ে।
বুড়োবয়সে ওদের ভরসা মালতী আর লক্ষ্মী। মালতীও খুব বুঝদার, চটপটে মেয়ে… সব কাজ পারে… খুব সুন্দর রান্নাও করে।এমনকরেই দু’টো পরিবার একে অপরের ভরসায় আনন্দে বাঁচে।। -
কবিতা- তুমি আর আমি
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
তুমি আর আমি
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আমি তোমাকে পাত্তা দিচ্ছি,
অথচ তুমি পাত্তা পেতে চাইছো অন্য কারো।
কিন্তু সে তোমাকে চিনছেইনা।তুমি হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছো তাকে,
আমি হয়তো তখন তোমারই অপেক্ষায়।আমি প্রেমের চাদরে ঢাকতে চাইছি তোমাকে,
তুমি হয়তো তখন ব্যস্ত অন্য কোনো প্রেমে।আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছি তোমার দিকে,
তুমি তখন হাত পাতছো তার কাছে।
আমি তখন অপেক্ষায় তোমারই দরজায়।
আমি তাকিয়ে আছি তোমার দিকে।
তুমি আমায় দেখেও দেখছোনা।এমন করে কত ভালোবাসা,অপেক্ষার দিন কেটে যাচ্ছে।
তুমি যেন একবগ্গা জেদী ঘোড়া।
যত টেনে ধরছি সে মুখ আমার দিকে –
তত যেন তার জেদ বাড়ছে।
আমি যেন শুনতে পাচ্ছি,
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে
দূরে, বহুদূরে।কিন্তু দূর থেকেও ভালোবাসতে
আমার ভালো লাগে।
অনন্ত অপেক্ষায় থাকতে
আমার ভালো লাগে।
যেমন ভালো লাগে
অমলতাসের হলুদ ফুলের
গুচ্ছে প্রজাপতির খেলা দেখতে।
পাখীর কিচিরমিচির, খোলা আকাশে
ডানা মেলে উড়ে যাওয়া দেখতে।
হয়তো কিছুই পাবোনা জেনেও,
আমি শুধু তোমায় ভালোবাসবো,
তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
যেনো এমন ভালোবাসাও কিন্তু সহজ নয়।। -
কবিতা- নষ্ট প্রেমিক
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নষ্ট প্রেমিক
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়সে ছিলো এক সস্তা প্রেমিক,
নষ্ট প্রেমিক, ভ্রষ্ট প্রেমিক।
ছদ্মবেশী, মুখোশ ঢাকা, অবিশ্বাসী।
বেয়াক্কেলে ঘনিষ্ঠতায় বাড়ানো হাত।
কিন্তু সে মেয়ে তার চোখে
নিজেকেই খুঁজতে থাকে।
পায়নি খুঁজে — অনুভবী,আবেশী মন
থমকে থাকে।সময়ও তো পাল্টে গেছে
প্রতিদিনের জীবন খাঁজে।
শর্তবিহীন ভালোবাসা গুমড়ে মরে।ভালোবাসা,এতই কি আর সস্তা না’কি?
ভালোবাসা অনেক দামী।
তাইতো সে মেয়ে বিকোয় না প্রেম সস্তাদরে।
চায়ওনা সে সস্তা সে প্রেম হাতটি পেতে।সে মেয়ে যে নিজের মত —
বাইরে কঠিন, ভিতর কোমল।
তার হৃদয়ও কাঁদে বসে খুব একাকী।পাহাড় চিড়ে ঝর্ণার কল-কলধ্বনি।
তার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে
ভালোবাসার হীরের খনি।। -
কবিতা- উদ্বাস্তু
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
উদ্বাস্তু
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়পিছে পড়ে থাকে সাতপুরুষের ভিটে।
পিছে পড়ে থাকে ঘর, ভাতের হাঁড়ি,সংসার টুকিটাকি।
আর পড়ে থাকে স্মৃতি হাহাকার।
নাড়ি ছেড়া ব্যথা।
জীবনের টানে পার হয়ে চলে যায়
মানচিত্রের সীমানা।ওরা উদ্বাস্তু।
অনেক জখমী মন নিয়ে
ফিরেফিরে দেখে,
ফেলে আসা ভাঙা ঘরখানি।
ডাঙায় যে বাঘ, জলেও কুমীর।
কোথায় যে বাসা বাঁধবে আবার!
কেউ যে চায়না নিতে ওদের এই দায়।ওদের এখন শুধু সম্বল ক্ষুধা,পুষ্টিহীনতা।
আর ঘুণপোকা ধরা মনে টাটকা স্মৃতি।মাছি ভনভন ছোট্টো শরীর।
খিদে পেটে সরল চোখদুটো
শুধু খুঁজে চলে মাকে।। -
কবিতা- চিনে নিতে
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
চিনে নিতে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়চারপাশে এত মানুষ
কিন্তু কেউ মানুষ নয়,
সবাই মানুষের মত সেজে রয়েছে!
মাঝে মাঝে এমনও তো মনে হয় নিশ্চয়-
চারপাশে এত বন্ধু,
তাও কিন্তু কেউ বন্ধু নয়।
শুধু বন্ধুর মত দেখতে লাগে তাদের!এমনো তো হয়,
সত্যিকারের যারা বন্ধু,
তাদেরই চিনতে পারেনা মন।
হয়তো তাদের কাছে
কখনো পৌঁছনোই হয়না।
অথবা সত্যিকারের মানুষের
সামনে দাঁড়িয়ে সন্দেহ হয়–
চিনে নেওয়া হয়না প্রকৃত মানুষকে।। -
গল্প- নতুন সুখের দিন
নতুন সুখের দিন
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়নন্দিতার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। মনখারাপ লাগছে। খুব কান্না পাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। আবার এক সপ্তাহ বাদে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়… মনখারাপিটা খানিক কেটে যায়। তখন সবই ভালো লাগে। আসলে এই একলাজীবনে মনের কষ্টের কথা কাকেই’বা বলবেন? কেই’বা শুনবে?
শরীরটাও আজকাল বেঁকে বসেছে। নানা ব্যথা কাবু করে দিয়েছে জীবনকে। মনের ব্যথা… শরীরের ব্যথা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ওকে। তাও মাঝেসাঝে একটু হাঁটতে বেরোতো…করোনা কালে তাও বন্ধ…মনটা হাঁপিয়ে ওঠে।
উত্তরে ঘরের জানলাগুলো চেপে বন্ধ করে রাখা আছে…না’হলে শুধু এম্বুল্যান্স আর শববাহী গাড়ির সাইরেন বুকটা কাঁপিয়ে দেয়। মন বলে এরপর কার যাওয়ার পালা! ফোনে আত্মীয়বন্ধুর অসুখ, বিয়োগব্যথার খবরে মনটা বিচলিত হয়…ক্লান্ত হয়। কতদিন কারো সাথে দেখা হয়না…কারোর বাড়ি যাওয়াও হয়না… কেউ আসেওনা।
ঘরে একমাত্র কথা বলার লোক… সর্বক্ষণের সঙ্গী বিমলা…মাঝবয়সী মেয়েটি স্বামী পরিত্যক্তা…গ্রামে ওর ছেলে-বৌমা-নাতি আছে। তাদের জন্য টাকা জমায় ও… মাঝেসাঝে গিয়ে ওদের দেখে আসে…টাকা দিয়ে আসে। মায়ার টান… সবটুকু স্নেহ উজার করে দিতে চায়।
নন্দিতাও ওর বুকের ধন…বিদেশে থাকা সন্তানদের চিন্তায় থাকে। ওদের থেকে কিছুই চাওয়ার নেই…শুধু ওরা ভালো থাকলে নন্দিতাও ভালো থাকে।যদিও চিরকাল হাসিমুখেই থাকার চেষ্টা করে এসেছে নন্দিতা। কিন্তু ওই হাসির মধ্যেই যে কত বেদনা লুকোনো আছে… তার খবর কে রাখে? আসলে সংসার জায়গাটাই এমন… সেখানে যতই অন্যায়,অবিচার, দুঃখ, কষ্ট, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা, না পাওয়ার বেদনা মিশে থাক…সংসারে কেউ কিন্তু সেসব শুনতে বা বুঝতে চায়নি কোনোদিন…আসলে সংসার এমন একটা জায়গা যেখানে তুমি কতটা সেবা, যত্ন, কাজ, ক্ষমতা দিতে পারলে… সেটাই শুধু হিসেব হয়… বিনিময়ে তুমি কী পেলে সেটা বড় কথা নয়। আর সবাই শুধু মুখের হাসিটাই দেখতে ভালোবাসে। জলভরা দু’চোখ দেখলে অস্বস্তি হয় সবার…দুঃখ বিলাসিতা বলে এড়িয়েও যায় অনেকে। ছেলেবেলায় বাবার মুখে শোনা “দুঃখে যাদের জীবন গড়া…তাদের আবার দুঃখ কীসের?”
এই ছেলেবেলাটা কিন্তু ভারী অদ্ভুত! ভাবতে বসলে এখনো ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। সেসময় কারণে-অকারণেই হেসে গড়াগড়ি দিতো ও আর ওর বন্ধুরা। আর সেই হাসি চট করে থামতোই না…যতক্ষণ না কেউ ধমক দিতো! স্কুলে এমন কতবার হয়েছে ভাবলেও এখন মজা লাগে৷ একবার তো পাড়ার কাকুর দোকানে গিয়ে হাসাহাসি শুরু করতেই দোকানের বিশুকাকু এক ধমক দিয়ে বলেছিলো- “দুপুরে দু’মুঠো ভাত আর রাত্রিরে দু’খানা রুটি খেয়ে এত হাসি আসে কোত্থেকে?” এখনো কথাটা মনে আছে নন্দিনীর…এ বয়সে এসে বুঝতে পারে এই কথার মর্মার্থ … সত্যিই চারিদিকে তাকিয়ে আজ আর হাসি পায়না কোনো কিছুতেই।
যত বয়স বাড়ছে ততই যেন শরীরের ক্ষমতা কমে আসছে…আর মনটাও তত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা তো কবেই ছেড়ে চলে গেছে, সবসময় পাশে থাকা জীবন সঙ্গীও চলে গেছে চিরতরে … ছেলেমেয়েরাও অনেক দূরে।
টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি, শাড়ি-গয়না কোনোকিছুরই কোন অভাব নেই জীবনে কিন্তু মানুষের বড় অভাব… এই অসুখের পৃথিবীতে মনে শুধু ভয়… আর আপনজনকে কাছে পাবার ইচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় প্রখর তপ্ত রোদে পুড়ছে ও…একটুও ছায়া নেই…তৃষ্ণার্ত অথচ পিপাসার জল নেই। বড্ড কঠিন এই পথচলা।
তবে আজকাল কিছু হালকা ব্যায়াম, প্রাণায়াম করে ভালো আছে নন্দিতা। আর একাকিত্বকে উপভোগ করতে শিখছে ও। মোবাইলে সোস্যাল মিডিয়ায় জুড়ে থেকে বন্ধু পেয়েছে অনেক… বিভিন্ন ভিডিও, লেখা পড়ে দেখে সময় কাটে বেশ। এছাড়াও বই, গান আর টেলিভিশনে মনটাকে ভাসিয়ে রাখতে ভালো লাগে । আর বাড়ির বাগানের ফুলগাছগুলো ওর প্রাণ… নিজের সন্তানের মত পরিচর্যা করে ওদের…আর ওরাও ফুল ফুটিয়ে আনন্দ দেয় ওকে। আর কত প্রজাপতি, পাখী আনাগোনা করে সকাল থেকে…পাখীরা গান শোনায় ওকে। ইদানিং ওদের জন্যও দানাপানি আর জলের ব্যবস্থা রেখেছে ও। শুধুমাত্র নিজেকে ভালো রাখার জন্য এই শখগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে নন্দিতা আর অপেক্ষা করে আছে অসুখহীন সেই সুন্দর পৃথিবীর যেখানে মানুষ মানুষকে ছুঁতে পারবে সহজেই।
-
অণুগল্প- জীবনের রঙ
জীবনের রঙ
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়এখনতো অখন্ড অবসর বিশ্বনাথবাবুর। রিটায়ার করেছেন বারো বছর হয়ে গেলো … বউ মিনতিও চলে গেছে পরপারে…তিন ‘বছর হয়ে গেলো। এখন তিনি বড় একা। মিনতি থাকতে তিনি বোঝেননি যে শান্তশিষ্ট পত্নী তার জীবনের কতটা জুড়ে ছিলেন। মিনতি কতটা মায়ার বন্ধনে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন।
বিশ্বনাথবাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাইকেই লেখাপড়া শিখিয়েছেন…বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হায়দ্রাবাদে থাকে পরিবার নিয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুম্বাইয়ে। একমাত্র ছোট ছেলেই কলকাতায় ওনার সাথে থাকে। ছোট ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি…বিশ্বনাথবাবুর সংসার।ছোট ছেলে বাবাকে বাজারদোকান করতে দেয় না, বলে সারাজীবন অনেক খাটলে, ছোটাছুটি করলে… এখন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে এত কাজ আর করতে হবে না। তুমি শুধু খাও-দাও, ঘুমাও আর বেড়িয়ে বেড়াও।
বিশ্বনাথবাবু প্রথম প্রথম রিটায়ার করার পর অনেকটা সময় কীভাবে কাটাবেন বুঝতে পারতেন না। আগে দিনের একটা বড় অংশ অফিসেই কেটে যেত। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত হয়ে যেত। তারপর খাওয়াদাওয়া করে খবরের কাগজটা নিয়ে শুতে শুতেই ঘুম জড়িয়ে আসতো দু’চোখে। আবার ভোর হলেই উঠে দিনের নানা কাজ শুরু করতেন… সকাল সাত’টাতেই বেরিয়ে যেতেন… অনেক দূরের অফিস। বাড়ির লোকের সাথে ছুটির দিন ছাড়া কথা বলারই তেমন সময় পেতেন না।
এখন ওনার হাতে অনন্ত সময় কিন্তু ওনার আশেপাশে সবাই ব্যস্ত… ছুটে চলেছে। একা একা বসেবসে কত চিন্তাভাবনা আসে মাথায়। কখনো কখনো ছোটবেলার কথা মনে করেন…কত গল্প…ছোট বৌমা সামনে থাকলে তাকেই বলেন তাঁর সোনাঝরা সবুজ দিনের কথা। অল্পবয়সে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো… এখন পুরোনো পাড়া থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। ফোনে যোগাযোগ হয় তাদের সাথে। কিন্তু যেতে পারেন না।ছেলেমেয়েরাও রোজ দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। খুব দেখতে ইচ্ছে হয় ওদের।
আর ছোটনাতি পড়াশুনো, কোচিং, গিটার ক্লাসের ব্যস্ততার ফাঁকে দাদুর কাছে এলেই দাদুর মন খুশী হয়ে যায়। নাতির প্রাণচঞ্চল ভালোবাসায় দাদুর মনে, জীবনের সবুজ রঙের ছোঁয়া লাগে। সতেজ হন তিনি। একমাত্র তখনই বাঁচতে ভারী ভালো লাগে তাঁর। নয়তো নানা অসুখবিসুখ আর বিয়োগব্যথায় বাঁচার ইচ্ছেটা কমে যাচ্ছে আজকাল।
দুপুরে খাওয়ার পরে ইজিচেয়ারে এসে বসেন তিনি। তারপর বই, কাগজ পড়েন। একটু ঝিমুনি মত আসে তখন। তারপর বিকেলে খেলার সঙ্গী এলে দাবা খেলেন।
আজ ইজিচেয়ারে আধশোয়া বিশ্বনাথবাবু।চোখদুটো বোজা। টেবিলে দাবার বোর্ডটা পাতা। সামনের চেয়ারটা ফাঁকা। রোজ বিকেলের খেলার সাথী বিজন আর কোনোদিনও আসবেনা…চলে গেছে চিরতরে। মনটা আজ বড্ড খারাপ। সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে অন্ধকারের দীর্ঘ ছায়া। কে যেন ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলো–তাকিয়ে দেখেন ছোটনাতি প্রমিত।
-দাদান, চলো এক দান হয়ে যাক্।
-চলো,দাদুভাই।
কাঁপা হাতে সাদা-কালো ঘুঁটিগুলোকে সাজাতে থাকেন বিশ্বনাথবাবু।। -
অণু কবিতা- মান-অভিমান
মান-অভিমান
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়তুমি মুখ ফেরালেই
অভিমানী মন।
ফিরে দেখবার
কী’বা প্রয়োজন?মন কান্নায় ভিজুক,
হোক কিছু জল অপচয়।
জীবনে জীবন জড়ালে,
এমনই তো হয়!!কিছু কালো মেঘ
ছড়িয়ে পড়বে জানি।
কিছু ঝরাফুল,
খালি ফুলদানি।তবু কিছু মান-অভিমান
কারণে অকারণেই।
জানি মিঠে রোদ্দুর এনে দিতে
লাগে সেই তোমাকেই।।