• কবিতা

    কবিতা- এই নকল শহরে

    এই নকল শহরে
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    এ শহরে আর ঘরবাড়ি নেই,আছে শুধু নুড়ি
    ঘরে ঘরে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে কেবল বালি
    যারা পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে ছুড়ি নয়–বুড়ি
    সব পুরুষগুলো একটাও আসল নয় – জালি।

    ওরা সব স্বরচিত কুয়াশায় নিজেরে লুকায়
    নিরাময় খোঁজে কোনো সহৃদয় নারীর আঁচলে
    জৈবিক তাড়নায় মনুষ্যের সারিতে দাঁড়ায়
    ওদের স্বপ্নগুলো মুখ লুকায় ঝড়ে ও বাদলে।

    প্রচণ্ড উত্তপ্ত দিন, মার্তণ্ডের প্রকাণ্ড ভ্রূকুটি
    আড়ালে পৌরাণিকপশুরা খোঁজে মানুষের ত্রুটি
    শুধু অগ্নিসংযোগ বাকি, প্রস্তুত গ্যাসের উনুন
    মুরগির পথ চেয়ে বসে আছে পেঁয়াজ-রসুন।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- গোড়ায় গলদ

    গোড়ায় গলদ
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    বহুূদিন পর চন্দ্রাণীর সাথে ইন্দ্রাণীর দেখা। দু’জনেই একদা সহপাঠী এবং বর্তমানে শিক্ষিকা। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যালয়ে এবং জেলায়।
    দু’জনই উচ্ছ্বসিত।
    : কেমন আছিস রে চন্দ্রাণী? কেমন শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে! কোনো অসুখ-বিসুখ?
    : না রে, আমার অসুখ-বিসুখ, জ্বরজারি বড় একটা হয় না। কিন্তু একসাথে সংসার আর চাকরির দাবি মেটাতে গিয়ে হাড়মাস কালি হয়ে গেল।
    : সংসার! সে তো সবাইকে করতে হয়। আমাকেও তো রান্নাবান্না করে ছেলেকে নাইয়ে -খাইয়ে -পরিয়ে স্কুল পাঠিয়ে নাকে মুখে দুটো গুঁজে চাকরিতে আসতে হয়। তোর কাজের মাসি নেই?
    :নেই আবার? কিন্তু তাকে দিয়ে ক’টা কাজ হয়? ঘর ঝেটোনো, ঘরমোছা, বাসনমাজা, মাঝেমধ্যে দু’একটা কাপড়কাচা –এর বাইরে তো সে কুটোটি ভেঙেও দু’খানা করবে না।আর সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়। সে কি কম কাজ! সকালের বিছানা-মশারি তোলা, চা বানানো, জলখাবার, ছেলের স্কুলের টিফিন, রান্নাবান্না, ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে তবে নিজের স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। আর সে স্কুলও তো আঠাশ কিলোমিটার দূরে ধ্যাদ্দেরা গোবিন্দপুরে।
    : আর তোর উনি? উনি কী করেন?
    : উনি থাকেন ওনার কাজ নিয়ে। একে তো দেরিতে ওঠেন। তারপর চা খেয়ে টয়লেট সেরে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে ঠাকুরঘর। ওনাকে তো আবার ন’টার ট্রেন ধরে অফিসে যেতে হয়। কাজেই দম দেওয়া পুতুলের মতো আমাকেই…….
    : সে তো তোর গোড়ায় গলদ। আমার কিন্তু এত সব করতে হয় না। বিছানা- মশারি তোলা, ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুম করানো, স্নান করানো, জামাজুতো পরানো, রান্নার জন্য সব্জি- তরকারি কেটে দেওয়া এসব কাজ ছেলের বাবাই করে। আমার ভাই খুব একটা অসুবিধে হয়না।
    : সত্যি তুই ভাগ্যবতী। এমন বর ক’জনের হয়? কিন্তু তুই আমার গোড়ায় গলদের কথা বলছিলি না? কি গলদ রে?
    : কেন, চাকুরে ছেলেকে বিয়ে করিস নি? আমার মতো বেকার ছেলেকে বিয়ে করলে তোকে এতো খাটতে…
    : চলি রে, আমার বাস এসে গেছে। বলে হাঁটতে শুরু করে চন্দ্রাণী।

  • কবিতা

    কবিতা- রাখিকে

    রাখিকে–
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    রাখি, তুমি আমাকে রাখি পরাবে? কিন্তু কেন?
    আমার তো শ্যাম রাখি, না, কুল রাখি
    ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় দিন।
    একা একা জীর্ণ ঘরে বিদীর্ণ অন্তরে
    স্বপ্নকে কোলবালিশ করে শুয়ে থাকি।

    অজানা জ্বরের মতো দিনে দিনে বাড়ে যে আবেগ
    আমি তার হাতের পুতুল নই
    যদিও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
    আমার হৃদয়ের নিজস্ব চত্বরে
    তোমাকে ধরে রাখি।
    আর তোমার সর্বাঙ্গ থেকে
    তিল তিল করে সব তিল শুষে নিই
    আর সময়কে সময় দিই শুষে নিতে সমস্ত যন্ত্রণা।

    রাখি,আমার হাতে কোন্ সুতোয় রাখি বেঁধে দেবে?
    তোমার রাখির দর্শনক্ষম চোখ আছে তো?
    চোখের তলায় মন আছে?
    সে কি দাঁড়িয়ে থাকে পুরোনো পথের ধারে
    নবীনা প্রেমিকার মতো?

    রাখি, কৃষ্ণপক্ষ অনিবার্য হলে
    তোমার রাখির চোখে আলো জ্বলে?
    কৃষ্ণাঙ্গ রাত্রির শেষে নেমে আসে শ্বেতাঙ্গ সকাল?

  • কবিতা

    কবিতা- সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি

    সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    কে যেন দাঁড়িয়ে আছে প্যাকাটির বেড়ার ওধারে
    হাতে শাঁখা-পলা, পরনে সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি
    সামান্য কৃষক রমণী; মোটেও অন্নপূর্ণা নয়
    বিষাদের দেশে তার বসবাস–জীর্ণ ঘরবাড়ি।

    বিকেলের ক্লান্ত সূর্য পশ্চিম বালিশে মাথা রেখে
    দুূদণ্ড আলাপ সারে নবীনা প্রেমিকার সাথে
    প্রাক্ পূর্ণিমার চাঁদে খানিকটা বিষণ্ণতা থাকে
    যা অক্লেশে মুছে দিতে সক্ষম সূর্য নিজহাতে।

    সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি নয় প্রাক্ পূর্ণিমার চাঁদ
    তার যাত্রাপথে দাঁড়ায় না কোনো প্রেমিক সটান
    যে থাকে সেও এক জলুসহীন খসখসে মুখ
    হতভম্ব চেয়ে দেখে বাহুবলী এক চন্দ্রযান।

    জটায়ু পাখির মতো পথরোধ করে যদি মেঘ
    হালকা নীল ও ঘনকাজলে মেশানো একখানা
    একটুকরো স্বপ্নের মতো তাকে আবেগে জড়াবে
    তার বুকে হন্যে হয়ে খু্ঁজবে সে স্বর্গের ঠিকানা।

  • কবিতা

    কবিতা- ইচ্ছা

    ইচ্ছা
    -নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    জানালায় জ্যোৎস্নার হাতছানি;
    আড়ালে থেকে আমার চোখেমুখে আলপনা আঁকে
    মেঝেতে জাফরি বিছিয়ে বলে:
    তোর কি রে একাকীত্ব নাকি দুদণ্ড দূরভাষে
    বকবকম প্রেমিক পায়রা হতে ভালোলাগে?
    নাকি অক্লান্ত ঝিঁঝিঁর মতো তারস্বরে ভাঙা ঢেউ-
    কেবল ছড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে?

    আমি জানি যে জীবনে বেগ নেই,আবেগ নেই, স্থাণু
    সে জীবন পদেপদে মৃত্যুর কাছে নতজানু।
    তাই বলি,ওগো মমতাময়ী,
    খোলো দেখি একবার কনুইয়ের ভাঁজ
    কী লুকিয়ে রেখেছো তোমার জামার আস্তিনে!

    আমাকেও উড়তে দাও, ছড়িয়ে পড়তে দাও
    গোবিন্দে সমর্পিত উড়োখইয়ের আবেগে
    তোমার নবনীনিন্দিত সারাদেহে।

  • কবিতা

    কবিতা- কাব্যের খোঁজে

    কাব্যের খোঁজে
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    অলীক এক সমুদ্রের তীরে বসে
    একের পর এক ঢেউয়ের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম দেখি
    মনে হয় হাতে হাত কাঁধে কাঁধ সহস্র উন্মাদ
    দুশো বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজের খোঁজে
    ডুবুরি সেজেছে।
    ওদের নীলচোখে মৃত্যু বুঝি ঘাপটি মেরে আছে।

    ওরা নাকি কাব্য খোঁজে
    যদিও বহুদিন কেটে গেছে শব্দসহবাসে
    বে-আব্রু শব্দেরা সব রূপজীবী গণিকার বেশে
    নিজেরে হারিয়ে খোঁজে।
    কালের ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুছে গেছে নিজেদের রূপ
    হারিয়েছে সমস্ত সমীহ।

    সমুদ্র কি ফেরাবে সেই রূপ
    সচরাচর যেমন সে ফেরায়?

  • কবিতা

    কবিতা- সাধু সাবধান

    সাধু সাবধান
    -নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    নদ-নদী মানুষের পাশে থেকে থেকে
    দিনে দিনে অবিবেচক অকৃতজ্ঞ হয়েছে
    ততোধিক অকৃতজ্ঞ হবে একদিন
    পাতকুয়ো, নলকূপ, ইঁদারা সকল।সেদিন
    তৃষ্ণার জল পেতে রক্ত হবে জল।

    যেভাবে চলছে এখন জলের অপচয়
    সেদিন আর বেশি দূরে নয়
    যেদিন জীবনের সমস্ত সঙ্গীত সঞ্চারির পরে
    আচমকা থেমে যাবে অন্তরায়
    আমাদের অবস্থা হবে তৃষ্ণার্ত কাকটির মতো
    কুড়িয়ে বাড়িয়ে নুড়ি ফেলে ফেলে
    তুলে আনতে হবে
    ধরণী-কলসের দূরতম তলে
    জমে থাকা একবিন্দু জল।
    জলও হবে আমাদের অত্যধিক শ্রমের ফসল।

    অতএব বাঁচতে যদি চান
    সাধু,সাবধান।

  • কবিতা

    কবিতা- আমার ধারাপাত

    আমার ধারাপাত
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    এক এক্কে এক
    পৃথিবীটা কী সুন্দর! চক্ষু মেলে দেখ।
    দুই এক্কে দুই
    ইচ্ছে করে আকাশটারে হাত বাড়িয়ে ছুঁই।

    দু’য়ে একে তিন
    চাঁদের অনেক সঙ্গী থাকে,সূর্য সঙ্গীহীন।
    তিনে একে চার
    নিজের তেজে পার হয় সে দুঃখ-পারাবার।
    চার একে পাঁচ
    ভোর হলেই দোর খুলে দেখি আলোর নাচ।
    পাঁচ একে ছয়
    লেখাপড়া শিখলে হয় সকল দুঃখ জয়।
    ছয় একে সাত
    বিদ্যাবলে করা যায় সকল কিস্তিমাত।
    সাত একে আট
    সাবধানে পেরোতে হয় তাবৎ রাস্তাঘাট।
    আট একে নয়
    সৎপথে চলতে গিয়ে কেউ কোরো না ভয়।
    নয়ের পরে দশ
    মানুষ হয় মানুষের চরিত্রগুণে বশ।

  • কবিতা

    কবিতা- এই অমানিশা

    এই অমানিশা
    -নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

    এই অমানিশা নাহয় নাহোক শেষ
    অবিরাম দুঃখশোকে নিমগ্ন এ মন
    ঘন অন্ধকারেই এখন থাকে বেশ
    মিয়োনো মুড়ির মতো নিরীহ জীবন।

    নির্জন দ্বীপে বসে নিজেরে কুড়োই
    নিজেকে খনন করে মাঝেমাঝে দেখি
    রাহুগ্রাসে যদ্যপি ক্রমশ ফুরোই
    তবু দেখি ব্যথাগুলো সত্য নাকি মেকি।

    ব্যস্ত রাজপথে নেই জেব্রাক্রসিং
    প্রতিমুহূর্তেই অপমৃত্যুর ভয়
    জীবনকে উপহাস করে রাত্রিদিন
    ডুবুরি জীবন খোঁজে জলের তলায়।

    কতকাল দুঃখশোকে মগ্ন রবে মন
    আঁধার কি পেরোবে না রাতের উঠোন?

  • কবিতা

    কবিতা- যদিও আষাঢ় মাস

    যদিও আষাঢ় মাস
    – নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

    এখন আষাঢ় মাস, বর্ষার পূর্বাভাস
    বৃষ্টি হয় থেমে থেমে, রোদ ওঠে না।
    ধারাসারে বৃষ্টি হলে প্রকৃতিও কথা বলে
    নইলে কবির মুখে ভাষা জোটেনা।

    বৃষ্টি পড়ে ধারাসারে বাঙালির ঘরে ঘরে
    রান্না আজ ভাজাপোড়া খিচুড়ি -ইলিশ
    কবির টেবিলে খাতা, ব্যাঙেরা ধরেছে ছাতা
    একপাশে আছে পাতা বিছানা- বালিশ।

    এখনো ভরেনি খাল, ফোলেনি ব্যাঙের গাল
    ঝিলেতে তোলেনি মাথা শাপলা-শালুক
    তবু এক মেঘদূত কালি মেখে অদ্ভুত
    হাতে বন্ধকী নামা ছেঁড়া তমোসুখ।

You cannot copy content of this page