• গল্প

    গল্প- নেফিলিম

    নেফিলিম
    – প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)
    দুই পাশে জঙ্গলে ঘেরা সরু রাস্তাটা দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলছিলো রুদ্রশেখর বাবুর দামী ইটিওস গাড়িটা। মাঝে মাঝেই এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমির ওপর দিয়ে চলার সময় অল্প বিস্তর ঝাঁকিয়ে উঠছিলো পেছনের সিটে বসা মদ্যপ রুদ্র বাবুর ভারী শরীরটা, আর সেটাই ছিলো তার যত বিরক্তির কারণ। ঠিক তখনই তিনি জড়িয়ে যাওয়া গলায় কাঁচা খিস্তি ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন ড্রাইভার সুরেশের নামে, যেন সব দোষ একমাত্র সুরেশেরই! আর গালিগালাজ করবেন নাই বা কেন, এত পয়সা খরচ করে বারে গিয়ে রঙিন তরল সেবন করার ফসল তার এই নেশা, এখন গাড়ির ঝাঁকুনিতে এত অল্প সময়ে তন্দ্রাচ্যুত হলে চলবে কেমন করে?

    সুরেশের তার নেশাগ্রস্ত মালিকের এমন ব্যবহার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তার অবশ্য রুদ্র বাবুর দ্বারা উচ্চারিত প্রতিটা খিস্তির জন্য একই প্রত্যুত্তর, “বুরা মত মানিয়ে সাব, রাত বহুত হো গায়া হে, ইস লিয়ে পাক্কা সড়ক ছোড়কে আপকো ইস রাস্তা সে ঘর লে যা রাহা হু….”
    অবশ্য সুরেশের কথা এক বর্ণও মিথ্যা নয়। এমনিতেই সময়টা শীতকাল। তার ওপর এটা কলকাতা নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের এই মফঃস্বল শহরে ঠান্ডার দাপট এমনিতেই বেশি। এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। এই গতিতে চলতে পারলে, আর এক ঘন্টার মধ্যেই লোকালয়ে পৌঁছতে পারবে তারা।

    রুদ্রশেখর বাবুদের মত মাঝ বয়সী বিপত্নীক ধনাঢ্য মানুষদের জীবনে চলার পথে একাকীত্ব দূরীকরণের একমাত্র সহায় হয়ে ওঠে মদ্যপান, আর এই কথাটা বুঝেই এই মফঃস্বল শহরগুলিতেও রমরমিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে ডান্স বারগুলো। তবে মদ্যপান লোকে নিজের বাড়িতেও করতে পারে, কিন্তু স্বল্প পোশাক পরা সুন্দরী নারীদের মৃদু মধুর আলিঙ্গনের স্বাদটা বোধহয় এই বারগুলিতেই ভালো পাওয়া যায়! তাই সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনেই সন্ধ্যা হলে যেন তর সয় না রুদ্র বাবুর, সাজসজ্জা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি সুরেশকে গাড়ি ছোটাতে বলেন বারের উদ্দেশ্যে। সেখানে দুই হাতে পয়সা ওড়ান তিনি, অধিকাংশ দিনেই ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় তার। সেখান থেকে পাকা রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে আরো বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়, এটাই হল ফিরতি পথে এই জঙ্গলে ঘেরা পাথুরে রাস্তাটা বেছে নেওয়ার কারণ।

    এমন সময় হঠাৎ একটা বিকট শব্দ করে থেমে গেল গাড়িটা! নেশাগ্রস্ত রুদ্র বাবু আবারো সুরেশের উদ্দেশ্যে খিস্তি প্রয়োগ করে, চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কিরে, হঠাৎ গাড়ি থামালি কেন, হ্যাঁ?”
    সুরেশ সেই কথার কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না, সে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। তারপর মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে, গাড়ির ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে চিন্তিত মুখে কি যেন পরিদর্শন করতে লাগলো। তারপর তার মালিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “সাব, ইঞ্জিন জাদা গরম হো গায়া হে, থোড়া সা পানি লাগেগা…”
    রুদ্র বাবু তার ভারী হয়ে আসা চোখের পাতাদু’টিকে কোনো মতে খুলে একবার চেয়ে দেখলেন তার চারিপাশটা। গাড়ির সামনের সিটদু’টির পেছনে রাখা জলের বোতলগুলি সম্পূর্ণ ফাঁকা। জলের কোনো চিহ্নমাত্র নেই গোটা গাড়িতে। যাহ, বাবা মস্ত বড় ঝামেলায় পড়া গেল তো! সুরেশ ব্যাপারটা আগেই বুঝেছিলো, সে করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপ কুছ দের কে লিয়ে গাড়ি মে ওয়েট কিজিয়ে সাব। পাশ হি জঙ্গল কে কিনারে এক নদী হে, মে ওয়াহা সে পানি লেকে আতা হু…..”
    এই বলে গাড়ির পেছনের ডিকি থেকে জলের খালি পাত্রটা বার করে, সে জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

    দুই পাশের জঙ্গলের ভেতরে সারি সারি শাল সেগুন গাছগুলির মাথার ওপর গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে মেঘমুক্ত নৈশ আকাশে। চাঁদের রূপালী আলো পড়ে যেন এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি হয়েছে চারিদিকে। এই জনমানবশূন্য বনভূমিতে মাঝে মাঝে কোনো রাত জাগা পাখির কর্কশ ধ্বনি আর শেয়ালের চিৎকার ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না। রুদ্র বাবুর এবার নেশা কেটে গিয়ে বেশ ভয় ভয় করতে লাগলো। এই শীতের রাত্রেও তার কপালে জমে উঠলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি হাতল ঘুরিয়ে গাড়ির পাশের জানলাটা খুলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। বুঝতেও পারলেন না, যে একটা সুদীর্ঘ লম্বা হাত মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে, একটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললো গাড়ির দরজাটা!

    জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত পায়ে নদীর উদ্দেশ্যে চলতে চলতে, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুরেশ। সে যেন এই নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে ভেতর থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠের চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে! আরো একবার, আরো তীব্র গতিতে যেন শব্দটা ধাক্কা মারলো তার কানের পর্দায়! সেই মুহূর্তে পেছন পানে ঘুরে রাস্তার দিকে ছুটতে শুরু করলো সুরেশ, এই চিৎকার দুটি যে তার মালিকের গলার, তা একটুও বুঝতে ভুল হয়নি তার! নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দ্রুততম গতিতে ছুটে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এসে, একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে থরথর করে কেঁপে উঠলো সে….চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি বিশাল দৈত্যাকৃতি চেহারার নগ্ন পুরুষের দেহ, যেন সাধারণ মানুষের দু’গুণ উচ্চতা তার শরীরের! তার পেশীবহুল ডান হাত দিয়ে সে রুদ্রশেখরের গলা ধরে তাকে তুলে ধরেছে সম্পূর্ণ শূন্যে! ভেসে আসছে একটি মৃদু গর্জনের আওয়াজ, আর তার সাথেই মৃত্যুর আগে একবার শেষ চিৎকার করে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল অসহায় রুদ্রশেখরের দামী ধুতি পাঞ্জাবীতে আবৃত স্থূল শরীরটা!

    (২)
    ট্রেন থেকে ‘চন্দ্রকোনা রোড’ স্টেশনে নামতেই, বুকের ভেতরটা আরো একবার হুহু করে উঠলো সন্দীপের। সন্দীপ বর্মন, বছর তিরিশের সুদর্শন যুবক। কলকাতার অন্যান্য সাধারণ মেধার যুবকদের মতই ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা একটি অখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ। তারপর নেহাৎই স্মার্টনেস আর কথাবার্তায় অগাধ ইংরাজি শব্দ প্রয়োগের খাতিরে সল্ট লেকের একটি আই. টি. কোম্পানিতে চাকরি।

    ওই এক চেহারাটা বাদ দিয়ে, জীবনে সব কিছুই খুব গড়পরতা সন্দীপের। তার বাবা কাজ করতেন একটি প্রাইভেট ফার্মে, এখন রিটায়ার করেছেন। পেনশন পান নামমাত্র। এখন তাদের সংসার চলে মূলতঃ তাদের একমাত্র ছেলে সন্দীপের আয়ে। শহরের অন্যান্য সুদর্শন ছেলেদের মত, তারও আছে অসংখ্য নারী হৃদয়ে বিচরণ করার নেশা। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার পরও মুড়ি মুড়কির মত প্রেমিকা বদলানোটা তার কাছে রোজকার কথা। জীবনটাকে দিনের বেলায় অফিসের বসের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হয়ে, আর রাতে মদ আর নারীদেহের সাথে একাত্ব হয়েই কাটিয়ে দেবে ভেবেছিলো সে, যতদিন না এই গড়পরতার মাঝে একদিন হঠাৎ প্রবেশ করলো এক সাময়িক চমকের অনুভূতি!

    পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা গ্রামের ধনী ব্যবসায়ী রুদ্রশেখর মিত্রের একমাত্র মেয়ে দেবারতীর সাথে তার বিবাহের সম্বন্ধটা একদিন তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে আসে! দুই পক্ষেরই একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার পর কথা পাকা হয়। বিয়ের দিন অবধি স্থির হয়ে যায়। সন্দীপ যেন হাতে চাঁদ পায়, শ্বশুরের এত ধন সম্পত্তির মালিক হলে সারা জীবন বসে খেতে পারবে সে! শুধু দোষের মধ্যে হল মেয়ের গায়ের রং একটু কালো, তবে তাতে কি বা আর আসে যায়! সে তো শুধু তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তার বাপের পয়সায় জন্য, সেই বা কৌনসা ওই কালো মেয়ের কপালে সিঁদুর পরিয়ে অন্যান্য সুন্দরীদের সান্নিধ্যে আসার থেকে অধিকারচ্যুত হচ্ছে? বিয়েটা তো আগে হোক, তারপর সে আবার পুরোদমে চালাবে তার কৃষ্ণলীলা!

    কিন্তু হায়! এই বিপত্তি যে কপালে ছিল, তা কি সে কখনো জানতো? আর দু’সপ্তাহ পরেই তার বিয়ে, আর আজ সকালের ফোনেই এলো তার হবু স্ত্রীর কান্নায় ভেঙে পড়া আতঙ্কিত গলা, “বাবা আর বেঁচে নেই, সন্দীপ!….কাল রাতে একটি বার থেকে গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে, জঙ্গলের মাঝে রাস্তার ধারে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে তাকে…..”
    আরো কত কিছু বলে চলল দেবারতী, সে সব কথা সন্দীপের কানেও গেল না। কি সর্বনাশের কথা! বুড়োটা মরার আর সময় পেল না! বিয়েটা হয়ে গেলেও তো মরতে পারতো! তারপর আবার খুন! মানে বিয়েটা প্রায় বছরখানেকের জন্য কেঁচিয়ে গেল, আর কি! তবুও মুখে নানান সান্তনার কথা বলে চলল সে দেবারতীকে, আর অফিস থেকে অনেক কষ্টে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে সে পাড়ি দিলো চন্দ্রকোনার উদ্দেশ্যে। যাই হোক, দেরি হলে হবে, তবে ওই পয়সাওয়ালা বাপের মেয়ের সাথে বিয়েটা কিছুতেই মিস করা যাবে না!

    (৩)
    সহদেবের সদ্য বিধবা বৌটার শরীরের প্রতি গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ অনিমেষ বাবুর অনেক দিনের লোভ। রাজমিস্ত্রির কাজ করতো সহদেব, শুকনো গাছের ডালের মত ছিল তার চেহারা। কিন্তু তার স্ত্রী ভাগ্য ছিলো অসাধারণ, নাহলে অমন কুচ্ছিত তালপাতার সেপাই কখনো মালতীর মত এমন ডাগর বউ জোটাতে পারে! সেই সহদেব একদিন কলকাতার কোন কাজ থেকে ফেরার পথে, অসাবধানতার বশে লাইন পারাপার করতে গিয়ে রেলে কাটা পড়লো! তা যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, আপদ বিদায় হয়েছে, এমনই ভাবেন অনিমেষ বাবু।

    পঞ্চান্ন বছর বয়স হলেও, বিপত্নীক অনিমেষ বাবুর শরীরে পৌরুষ এখনো অক্ষুণ্ণ আছে। মেদহীন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী মানুষটি এখনো ভোর হলেই দৈনিক ডন মুগুর ভাজেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! এককালে তিনি এই গ্রামের মোড়ল ছিলেন, তাছাড়া বাপ ঠাকুরদার রাখা জমি জমা আর সম্পত্তিও যথেষ্ট আছে তার, যে তিনি বাকি জীবনটা আরামেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। কত সহস্র বার তিনি আকারে ইঙ্গিতে মালতীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন তার মনের গোপন ইচ্ছা। তাকে যে তিনি রানী করে রাখতে পারবেন, এই কথাও ব্যক্ত করতে কোন ভুল হয়নি তার। কিন্তু সেই হারামজাদী শুনলে তো তার কথা! সে বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করে খাবে তাও ভালো, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও কোনো পরপুরুষের সাথে শোবে না! আহা রে, এখনো মালতীর বুকের দিকে তাকাতেই অনিমেষ বাবুর হৃদপিণ্ডটা কেমন যেন মুষড়ে ওঠে!

    তবে গতকাল ঘটে যাওয়া রুদ্রশেখর বাবুর অপমৃত্যুর খবরটা শুনে বেশ ভড়কে গিয়েছেন অনিমেষ বাবু। রীতিমত দম আটকে আসার ফলে মৃত্যু! এই গ্রামে নাকি কোন এক অশরীরি দানবের উপদ্রব হয়েছে! তাকে নাকি রুদ্র বাবুর ড্রাইভার সুরেশ নিজে চোখে দেখেছে তার মালিককে খুন করতে! যদিও বা সুরেশের কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তবুও মৃতদেহের গলা থেকে যে হাতের ছাপ পেয়েছেন পুলিশেরা, অত বড় হাত নিঃসন্দেহে কোনো মানুষের হতে পারে না! তাই এই বিষয়ে পুলিশ মুখ না খুললেও, গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্কের রেশ! কলকাতা থেকে ছুটে এসেছে রুদ্র বাবুর হবু জামাই, সন্দীপ! কেউ যেন সন্ধ্যার পর আর বাড়ি থেকে বের হতে চায়না!

    আতঙ্কিত মনে এই সব কথাই ভেবে চলেছিলেন অনিমেষ বাবু, এমন সময় তার চোখ চলে গেল তার শোবার ঘরের পেছনের জানলার বাইরে। তার বাড়ির পেছনেই আছে একটি বেশ বড় পুকুর, এই জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সেটা। এর জন্য নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করেন তিনি, কারণ অধিকাংশ দিনই এই জানলা দিয়েই গ্রাম্য মহিলাদের ওই পুকুরে স্নান করার দৃশ্য দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে তার মন। তবে এখন রাত সাড়ে নটা বাজে। এই সময়ও তিনি চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলেন, বেশ কয়েকটা এঁটো বাসন নিয়ে পুকুর পারে হাজির হল মালতী! বাবা, মেয়েছেলেটার সাহস আছে বলতে হবে! মুহূর্তের মধ্যেই অনিমেষ বাবুর মনে থাকা সকল আতঙ্কের অনুভূতি যেন কোথায় উবে গেল, তার হৃদযন্ত্র আরো দ্রুত বেগে বেজে উঠলো! আজ যেভাবেই হোক তাকে গ্রাস করতেই হবে মালতীকে, মনে এই অভিসন্ধি নিয়ে তিনি আলতো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পুকুর ঘাটে এলেন।

    আচমকা নিজের কোমরে কোন পুরুষের হাতের রোমশ স্পর্শ পেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠলো মালতী। কিন্ত অনিমেষ বাবু তার সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরেছেন মালতীকে, তার পায়ের দাপাদাপিতে পুকুরের সিঁড়িতে রাখা বাসনগুলি ঝনঝন শব্দে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। অনিমেষ বাবু এক ধাক্কায় মালতীকে নিচে ফেলে দিলেন, তারপর হ্যাঁচকা টানে খুলে নিলেন তার পরণের কাপড়খানি। একটুও সময় নষ্ট না করে, তার একটি অংশ ছিঁড়ে তিনি বেঁধে ফেললেন মালতীর মুখ। শায়া ও ব্লাউজ পরিহিতা মালতী পুকুর পারে মাটির ওপর এই অবস্থায় পড়ে ছটফট করতে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই তার শরীরের ওপর নেমে এলো অনিমেষ বাবুর শরীরের সম্পূর্ণ
    ওজনটা!

    কিন্তু সেই মুহূর্তে, অনিমেষ বাবুর মনে হল, দু’টি রোমশ পেশীবহুল সুদীর্ঘ পুরুষের পা যেন এসে দাঁড়ালো ঠিক মালতীর মাথার কাছে। আতঙ্কিত হয়ে মালতীর বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে সেদিকে তাকালেন অনিমেষ বাবু! তারপর বিস্ফারিত চোখে সেই দশ বারো ফুট লম্বা অতিকায় উলঙ্গ দানবটির দিকে চেয়ে থেকে, তিনি ধীরে ধীরে উঠে পড়লেন মালতীর শরীর থেকে। তার শরীরের সকল কামোত্তেজনা উবে গিয়ে, তার জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো আসন্ন মৃত্যুর আতঙ্কের রেশ। নিমেষের মধ্যেই সেই অতিপ্রাকৃত অশরীরিটি তাকে তুলে ফেললো শূন্যে, তারপর তার দেহটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো পুকুরের জলের মধ্যে।

    জলের ভেতর থেকে শ্বাস নেওয়ার জন্য তার মাথা তোলা মাত্রই দানবটি ঝাঁপিয়ে নামলো পুকুরের জলে। তার এতটাই দীর্ঘাকৃতি চেহারা, যে মাঝ পুকুরের জলও যেন তার হাঁটুর অনেকটাই নীচে! ততক্ষণে মালতী উঠে পড়েছে মাটি থেকে, খুলে ফেলেছে নিজের মুখের বাঁধন। কোনো মতে সে আতঙ্কিত চোখ দিয়ে চেয়ে দেখলো, যে ওই দীর্ঘকায় অবয়বটি পুকুরের মাঝে তার দুই পা দিয়ে চেপে ঘরেছে অনিমেষ বাবুর গলা! অপার ক্ষিপ্ততায় সে অনিমেষ বাবুর মাথাটা ঢুকিয়ে রেখেছে জলের নীচে। জলের ভেতর থেকে বুদবুদ উঠছে! কিছুক্ষণের মধ্যে, তার ভেতর থেকে অনিমেষ বাবুর দাপাদাপির চিহ্নটা ধীরে ধীরে থেমে গেল….আর এতটা দেখার পর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মালতী!

    (৪)
    গত পরশু দিন রুদ্র বাবু, আর গতকাল অনিমেষ বাবু! এই দু’জনেরই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে শিহরিত হয়ে উঠেছে গোটা চন্দ্রকোনা গ্রামের মানুষজন। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শীরা একই দানবিক চেহারার কোনো অতি প্রাকৃত পুরুষমূর্তিকে হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করেছে। আজ সকালে জল থেকে অনিমেষ বাবুর ফুলে ফেঁপে ওঠা কদর্য মৃতদেহটি বার করার পর, পুকুর পারে জমে উঠেছে আতঙ্কিত গ্রামবাসীদের ভিড়। এই ক্ষেত্রেও এখনো কিছুই বলেনি পুলিশ। তবে অনিমেষ বাবুকে যে জলের ভেতর ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই চাপ স্পষ্ট তার মৃতদেহে। ঘাড়ের দুইধারে নীলচে কালসিঁটের দাগ এই কথার প্রমাণ। তাছাড়া, তিনি ভালো সাঁতার জানতেন, তাই শুধুমাত্র জলে পড়ে গিয়ে ডুবে মরা তার পক্ষে অসম্ভব!

    সেই আতঙ্কিত জনতাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে সন্দীপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর লাশ মর্গে চালান করার উদ্যোগ করতে লাগলেন পুলিশ। তাছাড়া, সুরেশ আর মালতীকেও আরো জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আবারো থানায় ডেকে পাঠালেন তারা। বলাই বাহুল্য, তাদের দেখা ওই অতি প্রাকৃত দানবটির গল্প বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন না তারা, আবার লাশদুটিকে পরীক্ষা করার পর সম্পূর্ণ রূপে উড়িয়েও দিতে পারছেন না তাদের কথা। কিছুক্ষণ পর জনতার ভিড় অনেকটা হালকা হলে, চিন্তিত মুখে সন্দীপ তার হবু শ্বশুর বাড়ির পথ ধরলো।

    রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কাদের যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ তার কানে গেল, “কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! ঠিকই হয়েছে, আঠেরো বছর আগে করা সেই পাপের শাস্তি হল দু’জনের….”
    বেশ অবাক হয়ে পেছন ফিরে চাইতেই সন্দীপ দেখলো, যে দু’জন অতি সাধারণ চেহারার লোক রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে এই কথাবার্তা বলছে। কৌতূহলী চিত্তে সন্দীপ এগিয়ে গেল তাদের দিকে, তারপর তাদের জিজ্ঞাসা করলো,
    “কে তোমরা? আর কোন পাপের কথা বলছিলে তোমরা, যার শাস্তি এই দু’জনকে পেতে হয়েছে?”

    সন্দীপকে দেখে বেশ হকচকিয়ে গেল দু’জন, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় একজন বলে উঠল,
    “আজ্ঞে বাবু…এই গ্রামের দক্ষিণ দিকে যে চার্চটা আছে, আমরা তার দারোয়ান….”
    “বুঝলাম, কিন্তু আঠেরো বছর আগে কোন পাপ করেছিলেন এই দু’জনে, সে কথা তো বললে না!”
    সন্দীপের এই কথা শুনে দু’জনেই ভয়ার্ত চোখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ ধরে। তারপর আরেকজন ব্যক্তি অত্যন্ত বিনয়ের সুরে বলে উঠলো,
    “আমরা জানি নে, বাবু….আমরা গ্রামের খেটে খাওয়া গরিব লোক। আমরা নিজের মুখে সে কথা বলতে পারবো না, ক্ষমা করে দিন আমাদের…. তবে….”
    “তবে কি? আমি জানতে চাই কোন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছিলে তোমরা দু’জনে”, কড়া গলায় বলে উঠলো সন্দীপ।
    “সেই কথা জানতে চাইলে, আজ সন্ধ্যা বেলা আপনি ওই চার্চে চলে যান…সেখানে ফাদার এডওয়ার্ড-এর সাথে দেখা করুন….আমাদের থেকেও তিনি আরো ভালো করে আপনাকে বলতে পারবেন সব কথা!”, এই কথা বলে সন্দীপকে অবাক করে, সেই স্থানে আর একটুও না দাঁড়িয়ে হনহন করে কেটে পড়লো ওই দুই ব্যক্তি!

    বাড়ি ফিরে কেমন যেন গুম মেরে রইলো সন্দীপ। যদিও বা এই গ্রামের মানুষ মরলে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই, তবুও সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সত্যিই খুব রহস্যময়। বিশেষ করে, আঠেরো বছর আগে কি এমন কাজ করেছিলেন এই দু’জনে, যার জন্য আজ তাদের মরতে হল! আর কেই বা মারছে তাদের? সেটা কি কোনো মানুষ নাকি অন্য কিছু! একটু ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো তার মন, নাহ্, এখন যে তার ওই চার্চের ফাদারের সাথে দেখা না করলেই নয়!

    (৫)
    সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আকাশের বুকে জমেছিলো পুরু মেঘের প্রলেপ। ঘন ঘন গুরুগম্ভীর শব্দের সাথে রাতের অন্ধকারকে ফালা ফালা করে ঝিলিক দিয়ে উঠছিলো বজ্র বিদ্যুতের তীব্র অলোক রশ্মি! চার্চের একটি অন্ধকার কক্ষে বসেছিলো সন্দীপ। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে, কাউকে কিছু না বলেই চলে এসেছে সে এখানে। বেশ পুরোনো আমলের তৈরি সুবিশাল কক্ষটি, চারিদিকে যীশুখ্রিস্টের নানান ছবি, মূর্তি ও ক্রস চিহ্ন বিরাজমান। একদিকে তিন চারটে মোমবাতি জ্বলছে, মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে আসা ঝড়ো হাওয়ায় তরতর করে কেঁপে উঠছে তাদের অগ্নিশিখা। সেই কম্পমান অনুজ্বল আলোয় আরো রহস্যময় মনে হচ্ছে সামনের ইজি-চেয়ারে বসে থাকা ফাদার এডওয়ার্ডকে।

    বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি হবে। লম্বা শীর্ণকায় অতীব ফর্সা চেহারা, মুখে সাদা দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল, পরণে পাদ্রীদের শুভ্র বসন। সন্দীপের এখানে আসার কারণ শুনে প্রথমে তিনি চিন্তিত মুখে কি যেন ভাবলেন। তারপর গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, “দেখুন, আমি জানি না যে সেই সব কথা আপনাকে বলা ঠিক হবে কি না….কিন্তু আপনি যখন এই ঝড় জলের রাতে এখানে এসেই পড়েছেন, তখন আপনাকে নিরাশ করবো না!”
    উত্তেজনা বুকে নিয়ে সন্দীপ একাগ্র চিত্র চেয়ে রইলো তার দিকে, তার হাই পাওয়ারের চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হতে লাগলো অদূরে রাখা মোমবাতিগুলির কম্পমান অগ্নিশিখা। কোথাও যেন একটা বাজ পড়লো, আর তার সাথেই বলতে শুরু করলেন তিনি।

    “আগেই জানতে পেরেছেন, যে এই ঘটনাটা ঘটে আজ থেকে আঠেরো বছর আগে। সেই সময় এই চার্চে কর্মরত ছিলেন লিসা গোমস নামক এক নান। দেখতে ছিলেন অসামান্য সুন্দরী, কিন্তু খুব একটা মিশুকে ছিলেন না তিনি। কেউ কেউ বলতেন তিনি অবিবাহিত, আবার কেউ বলতেন তিনি বিধবা। চার্চের কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাকি সময়টা ব্যস্ত থাকতেন বাইবেল তথা খ্রিস্টান ধর্ম সম্বন্ধিত পড়াশোনায়। মনে হত আমাদের সকলকেই এড়িয়ে চলতেন তিনি, যেন সবসময়ই আমাদের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে চান। অবশ্য কেন তিনি এমন করছেন, তার কারণটা পরে একটু হলেও পরিষ্কার হয়ে উঠেছিলো আমাদের কাছে!”

    কিছুক্ষণ থেমে, কম্পিত গলায় আবার বলতে শুরু করলেন ফাদার, “সকলেরই একটি ধারণা হয়ে উঠেছিলো, যে এই মহিলার সান্নিধ্য অশুভ! হয়তো তিনি Witchcrafty বা Satanism এর সাথে যুক্ত, কোন অশুভ শক্তির ছায়া যেন সর্বদা বিরাজ করতো তার চারিপাশে, তাই যতজন তার খুব নিকটে থেকেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন অমঙ্গল ঘটেছে! তিনি থাকতেন এই গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি ভাড়া বাড়ির একতলায়। বাড়ির মালিক সপরিবারে থাকতেন ওপরে। কিন্তু তার থাকার এক মাসের মধ্যেই হঠাৎ সর্পাঘাতে মারা গেল সেই পরিবারের দশ বছরের ছোট্ট ছেলেটা! তার শোকে তার মা গলায় দড়ি দিয়ে হলেন আত্মঘাতী! আর স্বামী একাকীত্বের যন্ত্রণা না ভুলতে পেরে মদ ধরলেন, তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যু হয় তার! শুধু তাই নয়, তার বাড়িতে যে মহিলা ঝি-এর কাজ করতো, কিছু দিনের মধ্যেই সে নাকি উন্মাদে পরিণত হয়ে নিজেই নিজের স্বামীর বুকে ছোড়া চালিয়ে দেয়!”

    “চার্চের কাজ আর পড়াশোনা ছাড়াও, তিনি এই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ইংরাজি পড়াতেন। এই বাচ্চাগুলোর সাথেও নাকি ঘটতে শুরু করলো নানান অঘটন। কেউ হল ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখার শিকার, কারোর বা নানান অজানা রোগে ভুগে মৃত্যু হল। গ্রামের মানুষজনের কুনজরে পড়লেন তিনি, সকলে মনে করলো যে তিনি হলেন ডাইনি! পুলিশ ডেকে তাকে গ্রাম ছাড়া করতে চাইলো গ্রামের লোক, কিন্তু এই সকল অঘটনগুলোর সাথে তার প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকার কোনো প্রমাণ নেই, তাই পুলিশ এই বিষয়ে কোন সাহায্য করলেন না গ্রামের লোকেদের।”

    “আর ঠিক এই মুহূর্তে গ্রামের সকলের রোষের আগুনে যেন ঘি ঢাললেন আপনার হবু শ্বশুর মশাই, রুদ্রশেখর বাবু। কানাঘুষো শোনা যায় যে স্ত্রী বিয়োগের পর, তার নাকি অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয় লিসার সাথে। সেই কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেন লিসা। তাই পয়সার লোভ দেখিয়ে তখনকার মোড়ল অনিমেষ বাবুকে দলে টানলেন তিনি। গ্রামের সকল অশিক্ষিত মানুষদের বোঝানো হল, যে এমত অবস্থায় লিসাকে শেষ করে দেওয়াই শ্রেয়! সেই মত পরিকল্পনা মাফিক, ওরা এক রাত্রে লিসার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলো, বাড়ির মালিকের সপরিবারে মৃত্যুর পর সেখানে একাই থাকতেন তিনি। পরদিন সেই বাড়ি থেকে লিসার বীভৎস দগ্ধ মৃতদেহটিও আবিষ্কৃত হয়!”

    আরেকবার কোথাও যেন বাজ পড়লো, আর তার সাথেই এই ঘটনার ভয়াবহতার কথা কল্পনা করে শিউরে উঠলো সন্দীপ। “জানি আপনি এই যুগের ছেলে…ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন না…তবুও….”, ফাদার এডওয়ার্ড-এর কথাটা সম্পূর্ণ বলার আগেই বলে উঠলো সন্দীপ,
    “কিন্তু যদি সে কথা মেনেও নিই, তাহলেও তো এই সমীকরণের সমাধান হচ্ছে না ফাদার! লিসার প্রেতাত্মাকে কিন্তু কেউ খুন করতে দেখেনি, কোনো দানবিক চেহারার পুরুষকে সকলে দেখেছে হত্যাকারী হিসাবে, তার সাথে লিসার কি সম্পর্ক?”
    অনেকক্ষণ ভেবে ক্ষুব্ধ গলায় ফাদার বললেন, “এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, সন্দীপ বাবু….তবে ওই বিশালাকায় দানবিক মূর্তির ছায়া নাকি এর আগেও এই গ্রামের কয়েকজন মেষ পালক আর কাঠুরেরা ওই জঙ্গলের শেষে, যেখানে লাল মাটির তৈরি বেশ কিছু খাদ আর গুহা আছে, সেখানে দেখেছে! হয়তো সেখানে গেলেই আপনি পাবেন আপনার প্রশ্নের উত্তর!”

    ততক্ষণে বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে সন্দীপ বিদায় নিলো ফাদারের কাছ থেকে। আজ যেন তার মন মানছে না কোনো সতর্কতা, আসন্ন বিপদের কথা জেনেও যেন সে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যেতে চায় এই রহস্যের জট খুলতে।

    (৬)
    বৃষ্টি মুখোর এই রাতের অন্ধকারে গোটা জঙ্গলটাকে যেন মনে হচ্ছিলো কোনো স্বপ্নলোকের প্রেতপুরী। হুহু করে জলের ঝাপটা নিয়ে তীর বেগে ছুটে আসা ঝড়ো হাওয়ার দাপটের সাথে আছে স্যাঁতস্যাঁতে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। এক নাগাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া শুধু মাঝে মাঝে শোনা যায় মাটির ওপর পড়ে থাকা ভিজে গাছের পাতার ওপর কারোর মচ মচ পদধ্বনি। দুরু দুরু বুকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সন্দীপ। রাত থাকতে থাকতে তাকে যে পৌঁছতেই হবে এই বনাঞ্চলের শেষে ওই পাহাড়ি গুহাগুলির কাছে। সেখানেই হয়তো কোন এক গহ্বরের ভেতর লুকিয়ে আছে তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর! কে এই হত্যাকারী দানব? কেনই বা সে লিসার হয়ে আঠেরো বছর পূর্বে ঘটা সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চাইছে এক এক করে সকল অপরাধীদের হত্যা করে? এই সব ভাবতে ভাবতেই সন্দীপ হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেল জঙ্গলের শেষ প্রান্তে, যেখানে প্রকৃতি তার অমোঘ শৈল্পিক কারুকার্যে সৃষ্টি করেছেন লাল মাটি আর পাথরের তৈরি এই অসংখ্য ছোট বড় গুহাগুলিকে।

    অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলো জ্বালিয়ে সন্দীপ তার চারিপাশে চেয়ে দেখতে লাগলো। এখানে অজস্র গুহা গহ্বর আছে, এগুলির মধ্যে সে কি ভাবে খুঁজে পাবে সেই অজানা হত্যাকারীর ঠিকানা! এমন সময় তার টর্চের আলো গিয়ে পড়লো অনতিদূরে, একটি সুবিশাল গুহার মুখে। তার ভেতর থেকে যেন আলোর ঝলকানি প্রতিফলিত হচ্ছে একটি যীশু খ্রিস্টের ক্রস চিহ্ন থেকে! দৃশ্যটা বেশ অদ্ভুত লাগলো সন্দীপের। সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল সেই গুহার পানে। গুহার কাছে এসে, তার ভেতর টর্চের আলো ফেলে আরো বেশি চমকে উঠলো সে, এটাতো একটা কবর! একটা খ্রিস্টান কবর! যেন খুব সদ্য তৈরি করা হয়েছে সেটা, এখনো যেন কাঁচা আছে সেখানকার সিমেন্ট বালি! ভালো করে টর্চের আলো ফেলে, সেই ক্রস চিহ্নের নীচে পাথরের ফলকে লেখা নামটা এবং সেই ব্যক্তির মৃত্যুর তারিখটা দেখে আবার শিহরণের পালা সন্দীপের! সেখানে লেখা আছে:

    “লিসা গোমস, জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি’ ১৯৭০, মৃত্যু: ২৮ নভেম্বর’ ২০১৮”

    আজ তো পয়লা ডিসেম্বর’ ২০১৮! এ কি ভাবে সম্ভব! তার মানে লিসার মৃত্যু হয়েছে মাত্র তিনদিন আগে! কিন্তু ফাদার এডওয়ার্ড যে বললেন, আঠেরো বছর আগেই মারা গিয়েছেন লিসা! তার মানে কি তিনি মিথ্যা কথা বললেন? বেশি কিছু ভাবার আগেই পেছন থেকে কারোর হেঁটে আসার পদশব্দের ধ্বনি শুনে সচকিত হয়ে পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো সন্দীপ। একটি অস্পষ্ট নারীর অবয়ব যেন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে তার দিকে! আতঙ্কে সন্দীপের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটি হিমেল স্রোত বয়ে গেল! কে ওটা! কে? ওটা কি লিসার প্রেতাত্মা! ধীরে ধীরে এক পা দু’পা করে পিছু হটতে লাগলো সন্দীপ। তারপর গুহাটির পাথুরে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলো সে। তবুও কম্পিত হাতে ধরে রাখা টর্চের আলোটা ফেলার চেষ্টা করলো সে ওই নারীমূর্তির গায়ে! সেই অশরীরি নারীর গায়ে আলো পড়ার পর যেন আরো বেশি চমকে উঠলো সন্দীপ, অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে উঠলো,

    “দেবারতী….দেবারতী, তুমি…এখানে, এই সময়!”

    (৭)
    “হ্যাঁ সন্দীপ, আমি….এখানে, এই সময়….নিশ্চয় খুব অবাক হচ্ছো আমাকে দেখে! আজ সন্ধ্যা বেলা তোমার পেছনে লোক লাগিয়ে যখন জানতে পারলাম যে তুমি চার্চের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছো, তখনই বুঝলাম যে তুমি এখানে আসবেই! আর তাই তো আমিও এখানে এই সময় চলে এলাম….”, ঠোঁটের কোণে একটি বাঁকা হাসি নিয়ে বলে উঠলো দেবারতী।
    সন্দীপ মুখে কিছু বলতে পারলো না, শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো দেবারতীর দিকে। অগত্যা সেই আবার বলে উঠলো, “তোমার কি মনে হয়, সন্দীপ? লিসা গোমস কি সত্যিই একজন ডাইনি ছিলেন? তিনি কি Satan এর আরাধনা করতেন? কেনই বা যারা তার সান্নিধ্যে বেশি সময় কাটিয়েছিল, তাদের সবার সাথেই কোনো না কোনো অঘটন ঘটেছে?”

    সন্দীপকে আবারও চুপ করে থাকতে দেখে, বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে হেসে উঠলো দেবারতী, তারপর বললো, “না সন্দীপ, না…তিনি কোনো শয়তানের আরাধনা করতেন না, ওসব মিথ্যা রটানো কথা!”
    অস্ফুট কণ্ঠে সন্দীপ বলে উঠলো, “তাহলে…ওই অঘটনগুলো….”
    তার কথা শেষ না হতেই দেবারতী বললো, “তোমার হয়তো এই কথাগুলো কোন কল্প-বিজ্ঞানের গল্প বলে মনে হবে, তবুও এটাই সত্যি! বলছি, শোনো…”

    “পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকেন, জন্ম থেকেই যাদের মস্তিষ্কে চলা চিন্তা ভাবনা এবং অনুভূতিগুলি থেকে উৎপন্ন হয় Negative বা Dark Energy! কোন কারণে তারা এই ভাবে জন্ম নেন, সেই কথা আমরা কেউ জানি না! তবে এটা বুঝতে পারি, যে কোনো সাধারণ মানুষ যদি উপরোক্ত মানুষদের সান্নিধ্যে বেশি সময় ধরে থাকেন, তাহলে তাদের এই নেগেটিভ এনার্জির প্রভাবে নানা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এমন কিছু অঘটন, যার সঠিক কারণ আমরা কোনোদিন খুঁজে বার করতে সক্ষম হবো না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই ধরণের Psychic Attack এর ক্ষেত্রে, নেগেটিভ এনার্জি সম্পন্ন ব্যক্তিটির শুধুমাত্র নিজেকে সকলের কাছ থেকে দূরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করার উপায় থাকে না!”

    অপার বিস্ময় বলে উঠলো সব্দীপ, “তার মানে লিসা গোমস ছিলেন তেমনই এক নেগেটিভ এনার্জি সম্পন্না মহিলা!”
    “শুধু লিসা গোমস নন”, সন্দীপকে আরো অবাক করে বলে উঠলো দেবারতী, “আমি নিজেও তেমনই এক নেগেটিভ এনার্জি সম্পন্না নারী!”
    বাকরুদ্ধ সন্দীপকে বলেই চললো সে, “একটি শিশুর জন্ম থেকে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হন তার মা। কিন্তু আমার জন্মের তিন মাসের মধ্যেই, যে মা আমাকে সর্বদা বুকে করে আগলে রাখতেন, তিনিই একদিন রাত্রে হার্ট-ফেল করে মারা গেলেন। ঘটনাটা খুবই অস্বাভাবিক, কারণ এর আগে এই সংক্রান্ত কোনো অসুখ তার ছিলো না!….পরে যখন প্রথম স্কুলে গেলাম, দেখতাম যে অন্যান্য কোন ছেলেমেয়ে আমার সাথে মিশতে চাইতো না। কারণ যারাই আমার সাথে বন্ধুত্ব পাতায়, হয় তারা কোনো না কোনো রোগে ভুগে কষ্ট পায়, নাহলে তাদের প্রিয়জনদের হারানোর মত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়….এমনকি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, বাড়ির পোষা কুকুরটা, দু’মাস ধরে যে সবসময় আমার পাশে পাশে থাকতো, সেও একদিন কোন অজানা রোগে মুখ দিয়ে রক্ত বার হয়ে মারা গেল!”

    “মায়ের মৃত্যুর পর বুঝতে পারতাম যে বাবা আমাকে একদম পছন্দ করেন না। আমার উপস্থিতিতে সবসময়ই কেমন যেন বদ মেজাজি হয়ে ওঠেন, ছোট খাটো বিষয়ে সকলকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে থাকেন। তিনি একাকীত্বে ভুগতে শুরু করলেন, মদ এবং বাজারে মেয়েমানুষদের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে লাগলেন … একটু বড় হয়ে ওঠার পর আমার পরিচয় হল লিসা ম্যাডামের সাথে! তিনি বাড়িতেই আমাকে ইংরাজি পড়াতে আসতেন। তার সম্বন্ধে সকল কথা আমি তখন থেকেই শুনি, বুঝতে পারি যে আমার জীবনের সাথে অনেক মিল আছে তার জীবনের! আশ্চর্যজনক ভাবে, একমাত্র তিনিই আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। আমরা নিজেরা একে অপরের এত কাছাকাছি এতদিন ধরে থাকলেও, না তো আমার কোনো ক্ষতি হয়েছে, না তো তার। বুঝতে পেরেছিলাম, যে যেহেতু আমরা দু’জনেই নেগেটিভ এনার্জি সম্পন্না, তাই আমাদের দু’জনের মধ্যে কারোর ওপর অন্যের নেগেটিভ এনার্জি কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না!”

    “রাগে ঘৃণায় বিদ্বেষে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠেছিলো, যখন ওই বাড়িতেই বাবা লিসা ম্যাডামকে নিষ্ঠুর ভাবে ধর্ষণ করলেন। সেই ঘরের দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি, কিন্তু তখন মাত্র বারো বছর বয়স! বাপের বিরুদ্ধে কথা বলার কোন সাহস জুগিয়ে উঠতে পারলাম না। শুধু এতেই ক্ষান্ত হলেন না বাবা, তিনি ওই বাড়িতেই অনিমেষ বাবুকে ডেকে লিসা ম্যাডামের মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে চাইলেন। গ্রামের মানুষজনের মধ্যে তার ডাইনি হওয়ার মিথ্যা কথা রটানোর পরিকল্পনা করলেন। ম্যাডামের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারার কথা বললেন। সেই রাত্রে সব কথা গোপনে শুনে আমি ম্যাডামকে তা জানিয়ে দিই। কোনো এক বিশ্বস্ত লোকের সাহায্যে, ম্যাডামের মতই দেখতে, এমন একটি নারীর লাশ হাসপাতালের মর্গ থেকে নিয়ে আসা হয়। তারপর সেটাকে তার বেডরুমে রেখে, আমরা বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে এই জঙ্গলে পালিয়ে আসি। পরদিন, সকলে ওই আগুনে পোড়া লাশটিকে দেখে মনে করে যে লিসা ম্যাডামের মৃত্যু হয়েছে!’

    (৮)
    “এরপর থেকে এই জঙ্গলের গুহাই হয়ে ওঠে ম্যাডামের বাসস্থান। গ্রামের কোনো মানুষ এদিকে খুব একটা আসেন না, ওনার সকল দরকারি জিনিসপত্রের যোগান দিতাম আমি….এতদিন আমরা সাধারণ মানুষের ওপর এই এনার্জির কুপ্রভাবের কথা জেনেছি, বুঝতে পারিনি এর অন্যান্য ব্যবহারগুলির কথা! বুঝতে পারিনি, এই নেগেটিভ বা ডার্ক এনার্জির সাহায্যেই আমাদের সামনে খুলতে পারে এক অন্য জগৎ বা Parallel Universe এর রাস্তা!…. হ্যাঁ, সন্দীপ, তুমি নিশ্চয় Wormhole এর সম্বন্ধে শুনেছো, যা হল এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তা! এই ধরণের শত শত ওয়ার্মহোল আমাদের চারিপাশেই আছে, কিন্তু সাধারণ অবস্থায় তাদের ভেতরের যাত্রাপথের মুখ থাকে বন্ধ। কিন্তু নেগেটিভ এনার্জির সাহায্যে এই সুড়ঙ্গমুখ খোলা সম্ভব, যা করতে পেরেছিলেন লিসা ম্যাডাম! হয়তো এই ক্ষমতাকেই Parapsychology র ভাষায় বলা হয় Psychokinesis!”

    সন্দীপের যেন কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না, সে শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো দেবারতীর দিকে। আবার বলতে শুরু করলো দেবারতী, “এবার নিশ্চয় জানতে চাও, কে ওই দানবিক হত্যাকারী, তাই তো? এর জন্য আমাদের মনে করতে হবে, বাইবেলে বর্ণিত সহস্র বছর পূর্বে ঘটা একটি ঘটনার কথা। Sons of God নামক কিছু অতি-প্রাকৃত ফেরেশতা (Angel) ঈশ্বরের সাথে বিরোধিতা করে স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে আসেন। পৃথিবীর সাধারণ নারীদের সাথে সহবাস করে, তারা বংশবৃদ্ধি করা শুরু করেন। এই ফেরেশতাদের ঔরসজাত যে সন্তানদের জন্ম দিতেন সাধারণ নারীরা, তারা কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তারা ছিলেন এক প্রকারের বৃহতাকার দানব, যাদের বলা হত Nephilim. কিন্তু এই পাপের শাস্তি হিসাবে ঈশ্বর ওই ফেরেশতাদের Tartarus নামক একটি অন্ধকার জগতে নির্বাসিত করেন। নেফিলিমরাও মারা পড়েন তার দ্বারাই সৃষ্ট পৃথিবী ব্যাপি একটি বন্যায়!”

    “লিসা ম্যাডাম তার নেগেটিভ এনার্জি দিয়ে এমনই এক টারটারাস-এর সাথে এই জগতের সংযোগকরী ওয়ার্মহোল-এর রাস্তা খুলে দেন। যার ফলে সেখান থেকে তার কাছে হাজির হন এমনই এক ফেরেশতা! এবং তার সাথে মিলিত হয়ে, তিনিও জন্ম দেন এক নেফিলিমকে! তার জন্মাবার সাথেই সেই ফেরেশতা নিজের জগতে ফিরে যান, আর তার পর থেকে ম্যাডাম সযত্নে প্রতিপালন করতে থাকেন এই নেফিলিমকে।….তিন দিন আগেই একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যাডাম, কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে দিয়ে কথা দেওয়ান, যে তার এই সন্তানের সাহায্যেই আমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে গ্রামের সকলের ওপরে, যাদের জন্য তিনি ধর্ষিত হয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন এই জঙ্গলের গুহায় লুকিয়ে বসবাস করতে!”

    বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে উঠলো সন্দীপ, “তার মানে তুমি….তুমি….”
    তার কথা শেষ না হতেই মুখে একটি ক্রুর হাসি খেলে যায় দেবারতীর, সে বললো, “হ্যাঁ, আমি!…আমিই সেদিন বাবার গাড়ি থেকে জলের চিহ্নটুকুও সরিয়ে রেখেছিলাম, যাতে ওই জঙ্গলের মাঝের রাস্তায় তাদের গাড়ি বিকল হয়ে গেলে বাবাকে নেফিলিম দ্বারা হত্যা করানো যায়!….আমিই পরদিন রাত্রে বাড়ির জলের পাম্পের লাইন কেটে দিই, যাতে মালতীকে রাতের এঁটো বাসন গুলো মাজতে পুকুর ঘাটে যেতে হয়। জানতাম আমি, তাকে দেখে সেখানে অনিমেষ বাবু আসবেনই, আর সেই সুযোগে তাকেও নেফিলিম দ্বারা হত্যা করানো যাবে! এভাবেই, যে সকল গ্রামবাসীরা লিসা ম্যাডামের সাথে হওয়া ওই অন্যায়ের সাথে কোনো ভাবে যুক্ত ছিল, তাদের সকলকে একে একে নেফিলিমের শিকার বানাবো আমি….হা হা হা হা!”

    সন্দীপের হঠাৎ মনে হল, যেন একটা বিশালাকার ছায়ামূর্তি তার বড় বড় পা ফেলে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সেই গুহার ভেতরেই এগিয়ে আসছে! যেন তার পদশব্দে কম্পিত হয়ে উঠছে গোটা ধরিত্রীতল! দেবারতী একবার জ্বলন্ত চোখে পেছন পানে ঘুরে দেখলো, তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে সন্দীপকে চিৎকার করে বলে উঠলো, “তোমার কি মনে হয় সন্দীপ? তোমার পেছনে লোক লাগিয়ে তোমার হাজারও নারীসঙ্গের কথা জানতে পারিনি আমরা? তোমার মত দুশ্চরিত্র লম্পট ছেলের সাথে কখনো বিয়ে করতে চাই আমি? বাবা শুধু আমার মত কালো অপয়া মেয়েকে বাড়ি থেকে দূর করতে চাইছিলেন তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে, আর আমিও তার মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারিনি! তোমার মত পুরুষেরা বাবা আর অনিমেষ বাবুর দলেই পড়ো…আর এখন তো তুমি এই সব কথা জেনে গেলে, তাই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমি বাকি গ্রামবাসীদের ওপর প্রতিশোধ নেবো কি করে বল? হা হা হা হা”

    সন্দীপ অস্ফুট কণ্ঠে যেন কিছু একটা বলতে চাইলো, কিন্তু আতঙ্কে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। হঠাৎ দেবারতীর পেছন থেকে অন্ধকারের মাঝে দৃশ্যমান হল কামানের গোলার মত দু’টি জ্বলন্ত চোখ….একটি সুবৃহৎ রোমশ পুরুষালি হাত এগিয়ে এলো সন্দীপের কাছে….মুহূর্তের মধ্যে সেটা তার গলা ধরে তার বলিষ্ঠ শরীরটাকে তুলে দিলো সম্পূর্ণ শূন্যে…শোনা গেল নেফিলিমের ক্ষিপ্ত চাপা গর্জনের আওয়াজ….সেই দীর্ঘদেহী দানবটির পাশে তার অর্ধেকেরও কম উচ্চতার অধিকারিণী দেবারতীর হিংস্র হাসিমুখটা দেখতে দেখতেই দম আটকে অন্ধকার নেমে এলো সন্দীপের দুচোখের সামনে!

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    ভৌতিক গল্প- নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো

    নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো
    প্রলয় কুমার নাথ

     

    (১)
    এই কাহিনীর পটভূমি হল ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত বঙ্গদেশে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম, নাম নারায়ণগঞ্জ। কয়েকশো ঘর প্রজা এবং স্থানীয় জমিদারের পরিবারটি নিয়ে সুজলা সুফলা এই গ্রামে সুখ শান্তি এবং সমৃদ্ধি ছিলো সর্বদা বিরাজমান। সেই সময় অখিলেশ চৌধুরী ছিলেন জমিদার বাড়ির কর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং দানশীল ব্যক্তি, তাই প্রজাদের মধ্যে ছিলো না কোনো দুঃখ কষ্ট। সেই যুগেই অখিলেশ বাবু ছিলেন নারীশিক্ষার পক্ষে, তাই তার একমাত্র কন্যাসন্তান, মণিমালার গ্রামের স্কুলের গন্ডি পার হয়ে গেলে, তিনি তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠিয়েছিলেন।

    কলকাতার কলেজে বিদ্যার্জনের সময় থেকেই মণিমালার আলাপ হয় তার এক সহপাঠী সুদর্শন যুবকের সাথে, নাম শুভময় ব্যানার্জী। স্থানীয় এক উচ্চবিত্ত পরিবারের এই একমাত্র বংশধরটি খুব ছোটবেলাতেই নিজের মা বাবাকে হারিয়েছিলো। ক্রমে মণিমালার সাথে শুভময়ের সম্পর্ক প্রণয়ের রূপ নিতে থাকে, এবং তারা বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। অখিলেশ বাবুরও শুভময়কে জামাই হিসাবে খুব পছন্দ হয়, তাই খুব ধুমধামের সাথে তিনি চার হাত এক করার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান সময়ে বিয়ের পর এই প্রথম বার শুভময় কিছুদিনের জন্য তার শ্বশুরালয়ে এসেছে, নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। তাই জমিদার বাড়িতে আনন্দ উৎসব এবং নতুন জামাইকে দেখার জন্য গ্রামবাসীদের ভিড় লেগেই আছে।

    সেদিন সকালে মণিমালা তার স্বামীর জলখাবারের জন্য সবে আসন পেতে লুচির পাত্রটি সামনে রেখে তাকে ডাকতে যাবে, এমন সময় বাড়ির উঠোনে কেমন যেন একটা কোলাহলের আওয়াজ শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলো তার মন। কৌতূহলী হয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সে নিচে নেমে দেখলো, সেখানে বাড়ির সকলেই উপস্থিত, এমনকি শুভময়ও। সকলের আকর্ষণের কেদ্রবিন্দু হল এই বাড়ির এক কাজের মেয়ে, হৈম। গায়ের রং কালো হলেও এই আঠেরো বছরের যুবতীটির দৈহিক গঠন বেশ আকর্ষণীয়। সে যেন হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে জমিদার গিন্নির উদ্দেশ্যে বলে চলেছে, “না গো কত্তামা, কত্ত খোঁজা হল তাকে!…পাশের জঙ্গলের ভেতর, দীঘির ধারে, নদীর পারে, ধানক্ষেতের মাঝে, এমনকি আশপাশের দু-একটা গাঁয়েও লোক পাঠানো হয়েছিলো…কিন্তু কোত্থাও পাওয়া গেল না তাকে!”

    মণিমালা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কার কথা বলেছিস তুই হৈম? কাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
    হৈমর হয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে তাকে উত্তর দিলেন স্বয়ং অখিলেশ বাবু, “আমার এক প্রজা শিবেনের বউ প্রতিমাকে! কাল সন্ধ্যের পর থেকে নাকি তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
    “সে কি!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো মণিমালা, ঠিক এমনই সময় তার চোখ গেল তার স্বামী শুভময়ের দিকে। সে যেন হাঁ করে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে হৈমর দিকে। এটা দেখে খুব অস্বস্তি লাগলো মনিমালার, কারণ তার বুঝতে বাকি রইলো না যে শুভময়ের মন প্রতিমার নিখোঁজ হওয়ার খবরের দিকে নেই, সে যেন হৈমর শরীরটাকে পা থেকে মাথা অবধি জরিপ করতেই ব্যস্ত।

    কিন্তু হৈম বোধহয় তা আন্দাজ করতে পারেনি, সে সরল মনে বলেই চলল, “খুব অভাগী ছিলো প্রতিমা দিদি, জানেন তো কত্তামা। শিবেন দাদার সাথে বিয়ের দু’বছর ঘুরতে চললো, এদিকে এখনো ওদের কোনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি…এই নিয়ে সারাদিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কথা শোনাতো ওকে, বলতো নাকি ওর শরীরে খুঁত আছে, ও বাঁজা! সেই দুঃখেই কি ঘরছাড়া হল প্রতিমা দিদি!”
    “আহা রে!” বলে উঠলেন জমিদার গিন্নি, “আমার তো মনে হয়, দোষ ওর কিছু নেই! অমন তালপাতার সেপাই-এর মত চেহারা শিবেনটার, দেখলেই মনে হয় দোষ যদি কিছু থাকে তা শিবেনের, প্রতিমার নয়!”

    শুভময় এখনো কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে হৈমর দিকে। আর সহ্য হল না মণিমালার, সে কোনরকমে এই কথোপকথনের ইতি টেনে, জলখাবারের অছিলায়, হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো শুভময়কে নিজের ঘরে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে, ক্রোধে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে, শুভময়ের সামনে এক ঝটকায় নিজের শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে দিলো নিজের সেমিজ পরিহিত সুডৌল স্তনযুগলের ওপর থেকে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, “নাও দেখো, চোখ ভরে দেখো…কার শরীরটা বেশি সুন্দর বল…আমার না হৈমর? ছি ছি, বাড়ির জামাই হয়ে লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে একটা কাজের মেয়েকে দেখে অমন ভাবে চেয়ে থাকতে পারলে তুমি!”

    শুভময় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলো মণিমালার এই ব্যবহারে, সে দুই একবার ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করলো, “না না মণি…আমি তো…আমি তো শুধু…” কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও যেন সেটা তার মুখে এলো না!

    (২)
    রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে গোটা নারায়ণগঞ্জ গ্রাম। কোনো ঘরেই জ্বলছে না কোনো কুপির আলো, ভেসে আসছে না কোনো মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ। শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে গ্রামের রাস্তায় ঘোরা কুকুরগুলো বা পেছনের জঙ্গলে নৈশভোজে ব্যস্ত শেয়ালগুলোর ক্রন্দনধ্বনি। গ্রামের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি মাটির বাড়ির দরজা ঠেলে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো এক যুবতী। চাঁদের হালকা আলো এসে পড়লো তার দুই চোখের ওপর, যা এই মুহূর্তে গাঢ় রক্তবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। যেন কোনো অকল্পনীয় অমোঘ আকর্ষণের বশীভূত হয়ে সে তীব্র গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো গ্রামের শেষ প্রান্তে, শ্মশানের রাস্তা ধরে।

    মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কোনো রাতপাখির কর্কশ ডাক, সাথে যুবতীর পায়ের নুপুরের মৃদু নিক্কন ধ্বনি। শ্মশানে যেন তার জন্যই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল এক দীর্ঘদেহি পুরুষ! তার কাছে আসতেই যুবতী নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরলো পুরুষটির দেহটিকে, তার নিঃশ্বাসের গতিবেগ হল আরো দ্রুত। শ্মশানের ছাইভস্মে ভরা মাটির ওপর খসে পড়তে লাগলো যুবতীর শাড়ি এবং সকল অন্তর্বাস। রাতের অন্ধকারের মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গেল দু’টি শরীর। নারীর শরীরের ওপর বিচরণ করে শুরু হল পুরুষের চিরাচরিত পরিশ্রম। দু’জনের মৃদু সুখপ্রাপ্তির শব্দে মুখরিত হল শ্মশানের আকাশ বাতাস।

    “কত্তাবাবুউউউ…”
    পরদিন সকালে গ্রামের জেলে হারান পালিতের এই মর্মভেদী কণ্ঠস্বরে সচকিত হয়ে বাড়ির উঠানে ছুটে এলেন অখিলেশ বাবু। মাছ ধরার জাল এবং সকল সরঞ্জাম মাটিতে ফেলে তখন বিস্ফারিত চোখে হাঁপাচ্ছে হারান। ততক্ষণে বাড়ির বাকি সকলেও ছুটে এসেছে উঠোনে।
    “কি রে হারান…অমন করছিস কেন… কি হয়েছে?” বলে উঠলেন অখিলেশ বাবু।
    “বাবু…বাবু গো…আজ সকালে নদীতে যাচ্ছিলাম মাছ ধরার জন্য। শ্মশান দিয়ে গেলে অল্প সময়ে লাগে, তাই সেদিক দিয়ে চলেছিলাম”, কম্পিত গলায় বলতে শুরু করলো হারান, “কিছুটা গিয়েই সেখানে একটা ঝোপের পাশে দেখলাম আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা পড়ে রয়েছে…কি যেন নামটা…হ্যাঁ, হৈম! শরীরে একটা সুতো অবধি নেই!…হৈম আর বেঁচে নেই বাবু, কেউ ওর সুখ নিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে কাল রাতে!” আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হারানের সর্বশরীর।

    সেখানে উপস্থিত বাড়ির সকলের মাথার ওপর যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেল।

    (৩)
    প্রতিমার নিরুদ্দেশ হওয়া এবং হৈমর এই নিদারুণ পরিণতির জন্য যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা গ্রামে। এর মধ্যেই এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় থানা থেকে অপরাধীর সনাক্তকরণের বিষয়ে এখনো কিছুই জানানো হয়নি। তবে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ইতিমধ্যেই পেয়েছে গ্রামের মানুষ, সেটা হল যে হৈমর শরীর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে তাকে কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি। সেই রাত্রে সে নিজের ইচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে, এবং তারপর তাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে!

    হৈমর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই, পরের সপ্তাহে এই অনুরূপ আরেক যুবতীর হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক জোরালো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। এই গ্রামে সুশীল নাপিতের বহু পুরুষের বাস। তার স্ত্রী বাতাসীকে গ্রামের সকলেই চেনে। নাপিত পরিবারের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের থেকে একটু বেশিই সুশ্রী সে। সেদিনও সে জমিদার বাড়িতে এসেছিলো বাড়ির মহিলাদের নখ কেটে পা ঘষে আলতা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। হৈমর মত সেও যে শুভময়ের নজরে পড়েছে, এটাও টের পেয়েছে মণিমালা!

    কিন্তু তখন কি আর কেউ বুঝেছিলো, যে সেই হবে এই গ্রামের ‘নারীখেকো’-র পরবর্তী শিকার। পরদিন সকালেই তারও সম্ভোগ করা মৃত শরীরটা আবিষ্কৃত হয়েছে গ্রামের পেছনের জঙ্গলের ভেতর থেকে। স্থানীয় এক কাঠুরে প্রথম দেখতে পায় বাতাসীর নগ্ন মৃতদেহটিকে, এবং সেই কথা জানায় জমিদার বাড়িতে। এই ক্ষেত্রেও পুলিশের একই বক্তব্য, বাতাসী স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে, অতঃপর তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে!

    দেখতে দেখতে কেটে গেল আর একটি সপ্তাহ। তবে এখনো ‘নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো’-র কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ। নায়েব মশাই-এর মেয়ে কল্পনা মণিমালার ছোটবেলার বান্ধবী। খুব অল্প বয়সেই পাশের গাঁয়ের এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলের সাথে বিবাহ হয় তার। তার স্বামী আপাততঃ কলকাতার কলেজে ডাক্তারি পাঠরত। মণিমালা আর শুভময়ের আসার খবর পেয়ে, ছেলেবেলার বান্ধবী এবং তার স্বামীর সাথে দেখা করতে বাপের বাড়ি এসেছে কল্পনা। পরীক্ষা এবং পড়াশোনার চাপে তার স্বামী আসতে পারেননি। তবে গ্রামে ফিরে এখানে ঘটে চলা নারীহত্যাগুলির কথা শুনে সেও যথেষ্ট ভীত-ত্রস্ত।

    জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় সকলের সাথে কথা হচ্ছিলো কল্পনার। শুভময়ের সাথে তার আলাপ আগেই হয়েছে। তবে এই আনন্দের মুহূর্তগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা বিভীষিকা দানা বেঁধে আছে সকলের মনে। কল্পনা অখিলেশ বাবুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “আসলে উনি বলছিলেন, যে এই গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করা উচিত। আপনার কাছে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইতে বলেছিলেন, কাকাবাবু।”
    অখিলেশ বাবু হেসে বললেন, “এতো অতি উত্তম প্রস্তাব। তুমি শুধু তাকে বোলো ডাক্তারিটা ভালোভাবে পাশ করে ফিরতে, বাকি সকল ব্যবস্থা আমিই করে দেবো…”

    এমন নানা কথার মাঝে, আবার মণিমালার চোখ চলে গেল শুভময়ের দিকে। এবারও সে যেন নিজের দৃষ্টি দিয়ে গোগ্রাসে গিলে খেতে চাইছে কল্পনাকে। স্বামীর এই চরিত্রহীনতা যেন দিনে দিনে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো মণিমালার কাছে। সেই মুহূর্তে সে অন্য কাজের অছিলায় বৈঠকখানা থেকে প্রস্থান করলো। শুভময়ও বোধহয় বিষয়টি আন্দাজ করেছিলো, তাই সেও উঠে এলো তার স্ত্রীর পিছু পিছু। মণিমালা আর নিজের মুখে কিছু বললো না শুভময়কে, তবে গোটা দিনটা যেন গুম মেরে রইলো তার প্রতি।

    শেষ রাত্রের ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিলো মণিমালার চোখ থেকে। খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেল তার। সে বিছানায় উঠে বসে অবাক হয়ে দেখলো, যে তার পাশে শুভময়ের শোবার জায়গা ফাঁকা! এমন সময় এই ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে কার যেন ওপরে উঠে আসার পদশব্দ শোনা যাচ্ছে! ওপরে এসে সে যেন এই ঘরের দিকেই ক্রমাগত এগিয়ে আসছে! সাত পাঁচ ভেবে, মণিমালা তৎক্ষণাৎ বিছানায় নিজের জায়গায় শুয়ে ঘুমানোর অভিনয় করতে লাগলো। কপালের ওপর হাত রেখে তার ফাঁক দিয়ে আধবোজা চোখে তাকিয়ে রইলো ঘরের দরজার দিকে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শরীরে সেই ঘরে প্রবেশ করলো শুভময়। সে ঘরে প্রবেশ করে আলতো করে পালঙ্কে উঠে শুয়ে পড়লো নিজের জায়গায়। কৌতূহল আর উত্তেজনায় ঘুম আসছিলো না মণিমালার চোখে। এমন সময় জানলা থেকে একটি দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে উড়িয়ে দিলো ঘুমন্ত শুভময়ের পিঠের ওপর থেকে চাদরখানি। চাঁদের আলোয় সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো মণিমালা। শুভময়ের পিঠ এবং ঘাড়ের চারিপাশে বেশ কিছু স্থান কেটে ছড়ে গিয়েছে। খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে এর কারণ হল কোনো মেয়েমানুষের নখের আঁচড়!

    (৪)
    পরের দিন সকাল বেলায় আবার গোটা গ্রামের ওপর যেন নেমে এসেছে শোকের কালো ছায়া। নায়েব মশাই-এর মর্মভেদী চিৎকারের মাঝে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জমিদার বাড়ির সকল সদস্য। তার কারণ, গতকাল রাত্রে এই গ্রামের অজানা নারীভুকের কাম-পিপাসার শিকার হয়েছে তার একমাত্র মেয়ে কল্পনা। আজ ভোরে প্রাতঃক্রিয়া সারার জন্য পুকুরপারে যায় গ্রামের জনৈক ব্যাক্তি। সেই সেখানে সর্বপ্রথম খুঁজে পায় কল্পনার বস্ত্রহীন মৃতদেহটি। এই ক্ষেত্রেও সে নিজেই গভীর রাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে যায় আততায়ীর সাথে সঙ্গমের ইচ্ছা নিয়ে। শরীরী খেলা মিটে যাওয়ার পর তাকেও হৈম এবং বাতাসীর মত গলা টিপে হত্যা করে আততায়ী!

    নায়েব মশাই জমিদার বাড়ির একটি থামের সাথে মাথা কুটতে কুটতে উন্মাদের ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠলেন, “কত্তাবাবু, যেভাবেই হোক এই শয়তানকে ধরার ব্যবস্থা করুন…তাকে শাস্তি দিন, কত্তাবাবু…শাস্তি দিন তাকে…”
    এই পরিস্থিতি যেন আর সহ্য হচ্ছিলো না মণিমালার। সে শুভময়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের ঘরে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমি জানি এইসবের পেছনে তোমার হাত আছে, শুভময়!…কারণ কাল রাতেই আমি তার প্রমাণ স্বচক্ষে দেখেছি!…ছি! ভাবতেই লজ্জা লাগছে আমার, যে আমি তোমার মত একজন নিকৃষ্টতম অপরাধীকে একদিন ভালোবেসেছি!…তবে আর নয়, আমি নিজেই তোমার অপরাধের কথা সকলকে বলবো, তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেই মুছবো নিজের সিঁথির সিঁদুর…”

    কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মণিমালা। অত্যন্ত শান্ত অবিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়, “হয়তো তোমাকে সব কিছু খুলে বলার সময় চলে এসেছে, মণি! তুমি কি ভাবছো, যে হৈম, বাতাসী আর কল্পনা…এদের দিকে আমি চেয়ে থাকতাম কারণ তাদের দেহের প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করতাম? নাহ্…এদের দিকে আমি চেয়েছিলাম কারণ এই তিনজনেরই ওই নিদারুন পরিণতির আগের দিনগুলিতে এদের শরীরের চারিপাশে এক অতি-প্রাকৃত পিশাচিনীর ছায়া আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি!”

    বিস্ফারিত চোখে শুভময়ের দিকে চেয়ে রইলো মণিমালা। সে বলেই চললো, “আমার জীবনের কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে গোপন করেছিলাম আমি, তবে আজ সব কিছু খুলেই বলবো। তুমি তো জানো, যে খুব ছোটবেলায় আমি মা বাবাকে হারাই। আমি যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না তাদের মৃত্যুটা। মরণের পরও তাদের নিজের কাছে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। তাই গোপনে যোগাযোগ করেছিলাম একজন তান্ত্রিকের সাথে। তার সাহায্যেই সিদ্ধ হয়েছিলাম নানা তন্ত্রবিদ্যায়। তবে এতে মা বাবার আত্মার সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছা ব্যর্থ হলেও, আমার মধ্যে জন্মেছিলো অশুভ অতি-প্রাকৃত শক্তিদের প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, যারা কোনো কারণ বশতঃ এই ইহলোক থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়নি!”

    “তাই সেদিন যখন বুঝলাম যে প্রতি সপ্তাহে এক একটি যুবতী ওই আততায়ীর শিকার হচ্ছে এবং এবার কল্পনার পালা, আমি গতকাল রাতে ঘুমোতে পারলাম না। নায়েব বাড়ি এই মহলের অনতিদূরেই, তাই তুমি ঘুমোবার পর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নজর রাখছিলাম সেই দিকে। দেখলাম যে সঠিক সময়ে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কল্পনা। আমি ছুটে গিয়ে তার পিছু নিলাম। তার পথ আগলে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললাম।”

    “কিন্তু সেই মুহূর্তে তার শরীরটা সম্পূর্ণরূপে সেই অজানা অশরীরির কবলে। খোলা চুল, রক্তবর্ণ নিষ্পলক দৃষ্টি, মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একটি চাপা গর্জনের আওয়াজ…কল্পনার এই রূপ আমি কখনো দেখিনি। সে অকল্পনীয় পৈশাচিক শক্তি দিয়ে আমায় দূরে ঠেলে ফেলে দিলো। মাথায় চোট পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে উপলব্ধি করলাম যে পিঠে এবং ঘাড়ের চারিপাশে অসহ্য যন্ত্রনা। বুঝতে পারলাম আমায় না মেরে, শুধুমাত্র আমার শরীরে নখের আঁচড় দেওয়ার পেছনে কল্পনার শরীরে ভর করা এই পিশাচিনীর একটাই উদ্দেশ্য…সকলের সন্দেহের দৃষ্টি আমার দিকে আনা!”

    মন্ত্রমুগ্ধের মত স্বামীর কথাগুলো শুনছিলো মণিমালা, এবার অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “তার মানে কোন গুপ্ত তন্ত্রবিদ্যার সাহায্যে ওই অশরীরিকে প্রবেশ করানো হচ্ছে এক একটি মেয়ের শরীরে, যাতে তারা নিজেই শয়তানটার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়! কিন্তু কে করছে এই কাজ? আর এটা কি ধরণের তন্ত্রসাধনা?”
    “কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি, মণি…আজকের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি!” দৃঢ় কণ্ঠে বললো শুভময়।

    (৫)
    শুভময়ের পা ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো শিবেন। তাদের চারিপাশে চারজন শক্ত-সামর্থ চেহারার লেঠেল দাঁড়িয়ে। তাদের প্রহারে শোচনীয় অবস্থা শিবেনের। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “ক্ষমা করে দিন…ক্ষমা করুন আমায় ছোট বাবু। আমি গ্রামের সকলের কাছে মিথ্যা কথা বলেছিলাম, যে প্রতিমা নিখোঁজ হয়েছে। আসলে আমার শরীরে খুঁত ছিলো, ছোট বাবু…বিছানায় কখনই সুখ দিতে পরিনি আমি প্রতিমাকে।”

    “এদিকে ও সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও ওর মাথায় আসছে বাঁজা হওয়ার অপবাদ, তাই সেই রাত্রে ওর সাথে আমার খুব ঝগড়া বাঁধে। ও বলছিলো যে আর এই অপবাদ নিজের ঘাড়ে নেবে না, সকলকে জানিয়ে দেবে আমার নপুংসক হওয়ার কথা। তাই বাধ্য হয়েই ওকে গলা টিপে খুন করি আমি সেই রাত্রে! তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দিই ওর লাশটাকে। সকালে ও নিখোঁজ বলে সকলের সামনে মায়া কান্না কাঁদি…কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ওর লাশটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি!”

    “যাও গিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও”, লেঠেলদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো শুভময়। ওরা শিবেনকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল, শুভময়ের মুখে ছেয়ে গেল চিন্তার রেশ।

    সেদিন ছিলো গ্রহণের রাত্রি। শ্মশানের এক কোণে, একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একাকী ডাকিনী সাধনায় বসেছে শুভময়। শ্মশানের ভূমির বেশ কিছুটা স্থানের জঙ্গল সাফ করে গোবর জল লেপে দেওয়া হয়েছে। একটি কালো কাপড় পেতে তার ওপর মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে ছাগলের টাটকা কলিজা এবং মাংস। অপর একটি পাত্রে আছে সুগন্ধি দেশি মদ। ধুপ-ধুনোর সাথে ছাগলের চর্বির তেল দিয়ে জ্বালানো হয়েছে প্রদীপের মিটিমিটি আলো। অন্ধকার রাত্রে দক্ষিণ দিকে মুখ করে সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ডাকিনী মন্ত্র জপ করছিলো শুভময়, তার কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।

    নিস্তব্ধ রাতের মাঝে হঠাৎ একটি মৃদু নারী কণ্ঠে নিজের নামটি শুনে চমকে উঠলো শুভময়। চোখ খুলে দেখলো, যে একটি অপরূপ সুন্দরী নগ্ন নারী তার সামনেই শুয়ে আছে, মুখে মৃদু হাসি। ক্রমে উঠে দাঁড়ালো সেই নারী, ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তার আরো কাছে। তার ঠাণ্ডি হাতের স্পর্শ পেলো শুভময় নিজের বুকে, পিঠে এবং পুরুষাঙ্গে। মেয়েটি হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “কিরে ভোগ করতে চাস না আমায়? আমি কি সুন্দরী নই…হাহাহাহা!”

    তবুও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে একমনে মন্ত্র জপ করতে লাগলো শুভময়। এবার একটি হাড় হিম করা আর্তচিৎকারে শুনতে পেলো সে। সেই সুন্দরী রমণী কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আশেপাশের শুকনো পাতার ওপর কাদের যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তারা যেন দল বেঁধে শুভময়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। রাতের শ্মশান মুখরিত হয়ে উঠলো ক্রমাগত বিকট চিৎকারের আওয়াজে, সাথে ভয়ঙ্কর কিছু প্রেতমূর্তি একজোট হয়ে শুভময়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো। সকলেরই রক্তবর্ণ জ্বলন্ত চোখ, অর্ধদগ্ধ কঙ্কালসার বীভৎস শরীর। তারা নিজের দুই হাত দিয়ে নিজেদের মুণ্ডুগুলিকে একটানে নিজেদের ধর থেকে ছিঁড়ে ফেললো, তারপর নিজেদের মস্তক হাতে করে কবন্ধগুলি গোল করে ঘুরতে লাগলো শুভময়কে ঘিরে। তবুও অপার সাহস বুকে করে মন্ত্র জপ করে চললো শুভময়।

    কিছুক্ষণ পর সকল প্রেতমূর্তিগুলি যেন আগের মতই হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। শুভময় চোখ খুলে দেখলো, যে তার সামনে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ উলঙ্গ এলকেশী নারী দাঁড়িয়ে আছে। সে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে রাখা মদ আর মাংসের দিকে। শুভময় বুঝতে পারলো যে অবশেষে ডাকিনী তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। সে ওই নারীকে মদ আর মাংস অর্পণ করলে, সে খুশি হয়ে বলে উঠলো, “তোর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়েছি আমি। বল, তোর জন্য কি করতে হবে আমায়?”

    (৬)
    গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে রাতের অন্ধকারে ডাকিনীর পিছু পিছু এগিয়ে চলছিলো শুভময়। অবশেষে তারা গ্রামের পুব কোণে একেবারে জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছলো। এই স্থানে খুব একটা জনবসতি নেই। ঝোপঝাড়ের মাঝে রয়েছে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। তার ভেতর থেকে মিটিমিটি জ্বলছে কুপির আলো। সেই দিকে আঙুলের ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল ডাকিনী। অতি সন্তর্পণে শুভময় এগিয়ে গেল সেই দিকে। এই বাড়ির মালিককে গ্রামের সকলেই চেনে, কারণ সে হল এই গ্রামের পাঠশালার বহুদিনের শিক্ষক, সুকুমার পন্ডিত। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের সুকুমার বহু বছর ধরে বিপত্নীক। রোগা কালো কুৎসিত চেহারার মানুষটি সকল গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধার পাত্র তার ছাত্র পড়ানোর দক্ষতার গুণে।

    শুভময় কুঁড়ে ঘরটির পেছনের খোলা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ রাখলো ঘরের ভেতরে। ঘরের ভেতর খাটিয়ার ওপর বসে মদ্যপান করছে সুকুমার। খাটিয়ার নীচে মেঝের ওপর চোখ পড়তেই শিউরে উঠলো শুভময়। সেখানে রাখা রয়েছে একটি উলঙ্গ নারীর লাশ। পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে তার সর্বশরীরে লাগানো হয়েছে কোনো অজানা দ্রব্যের প্রলেপ। লাশটি আর কারোর নয়, শিবেনের মৃত স্ত্রী প্রতিমার!

    ওদিকে মদের নেশায় অনর্গল বকে চলেছে সুকুমার, “কি ভেবেছিলিস তোরা? আমি কুৎসিত, বিপত্নীক, দরিদ্র…তাই কি আমার প্রেম করার কোনো অধিকার নেই? আমার মনে কি জাগতে পারে না নারীসঙ্গের লোভ? অনেক আশা করে তোদের তিনজনের কাছে এক এক করে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম আমি…কিন্তু তোরা আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলি! আমায় অপমান করে বললি নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখতে! এত অহংকার তোদের!…এখন বুঝেছিস তো, তোদের কি অবস্থা করলাম আমি!…এখন বাকি রইলো শুধু একজন, সেও আমার প্রণয় নিবেদনকে অস্বীকার করেছিলো, পরের সপ্তাহে তার পালা…হাহাহা!”

    পরদিন সকালে বাড়ি ফিরলে, মণিমালা উদগ্রীব হয়ে শুভময়ের কাছ থেকে জানতে চাইলো গতকাল রাত্রের সকল ঘটনা। শুভময় তাকে এক এক করে সব কথা বলে শেষে বলে উঠলো, “তন্ত্রশাস্ত্রে একটি ভয়ঙ্কর অনিষ্টকারী সাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রয়োগ করেছে সুকুমার পন্ডিত। একে বলা হয় ‘কাম পিশাচিনী’ সাধনা!”

    “যে সকল নারী পুরুষের দেওয়া শারীরিক সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েই কোনো অপঘাতে মারা যায়, তাদের আত্মার মুক্তি হয় না। পুরুষের সাথে সম্ভোগ করার অতৃপ্ত বাসনার ফলে তারা প্রেতযোনিতে প্রবেশ করে ‘কাম পিশাচিনী’-তে পরিণত হয়। এরা সর্বদা সেই অপেক্ষায় থাকে, কখন কোনো পুরুষ এই সাধনা করে এদের ডেকে পাঠিয়ে প্রবেশ করাবে অপর কোনো জীবন্ত নারীর শরীরে। এই প্রেতাত্মার প্রকোপে সেই নারী নিজের ইচ্ছায় নিজের শরীরকে তুলে দেবে সাধকের হাতে!…এই ক্ষেত্রে এই পিশাচিনী হল প্রতিমার অতৃপ্ত আত্মা, এবং সুকুমার তাকে একে একে প্রবেশ করিয়েছে হৈম, বাতাসী আর কল্পনার শরীরে! সে নিশ্চয় সাধনার জন্য প্রতিমার দেহটিকে সেই রাত্রে নদীর জল থেকে সংগ্রহ করেছিলো!…কিন্তু সহবাসের শেষে মুহূর্তের মধ্যে নারী শরীর থেকে কাম পিশাচিনী বিদায় নেয়, ফিরে আসে নারীর নিজস্ব সত্তা। তাই এই তিনজন যাতে সুকুমারের কীর্তিকলাপ সকলের কাছে ফাঁস করতে না পারে, তাই ভোগ করার পর এদেরকে একে একে খুন করেছে সুকুমার!…যতদিন প্রতিমার মরদেহ অবিকৃত থাকবে, ততদিনই সে সাধনার ফলে এই অপরাধ চালিয়ে যাবে!”

    আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শুভময়ের দিকে তাকিয়ে কম্পিত গলায় বলে উঠলো মণিমালা, “সুকুমারকে তুমি পুলিশের হাতে তুলে দাও!”
    “নাহ, আপাততঃ নয়”, বলে উঠলো শুভময়, “এই সপ্তাহের শেষেই ওর খেলা সমাপ্ত করার ব্যবস্থা করতে চাই আমি, শুধু জানতে হবে ওর চতুর্থ শিকার কে হতে চলেছে!”

    (৭)
    দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে পরবর্তী ছয়টি দিন। কল্পনার মৃত্যুর পর আজ এক সপ্তাহ পূরণ হতে চলেছে। সেদিন সকালে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো মণিমালা। অদূরে আরামকেদারায় সকালের চায়ের কাপ হাতে বসেছিলো শুভময়। হঠাৎ সশব্দে কাপ সমেত চা নীচে পড়ে গেল শুভময়ের হাত থেকে। সচকিত হয়ে মণিমালা আয়নার সামনে থেকে চোখ সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, যে সে বিস্ফারিত চোখে আরষ্ঠ হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

    মণিমালা ছুটে আসতে গেল শুভময়ের কাছে, কিন্তু সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আরো দূরে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কারণ, তার চোখে মণিমালা শুধু একা নয়, একটি কুচকুচে কালো অতি-প্রাকৃত অবয়ব যেন নিজের দুই বহু দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মণিমালাকে! এ আর কেউ নয়, সেই কাম পিশাচিনী!
    “আজ রাতে তুমিই হতে চলেছো সুকুমারের চতুর্থ শিকার, মণি!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়।

    কিছুক্ষণ আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইলো মণিমালা, তারপর কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এই কথা জানতাম আমি…শুধু চক্ষুলজ্জার খাতিরে তোমাকে বলে উঠতে পারিনি। বিয়ের কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে কিছুদিনের ছুটিতে এখানে আসার পর, পাঠশালার একটি বাচ্চার হাত দিয়ে সুকুমার আমাকে প্রেমপত্র পাঠায়! তাকে যে শুধু আমি অস্বীকারই করিনি, বরং তাকে এই বাড়িতে ডেকে বাবা চরম অপমান করেন। বলেন যে অন্য কারোর সাথে এমন কাজ করলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দেওয়া হবে! এরই প্রতিশোধ নিতে চায় সুকুমার!”
    কান্নায় ভেঙে পড়লো মণিমালা, শুভময় কুঞ্চিত ললাটে কি যেন ভেবেই চললো।

    সারাদিনের চিন্তা-ভাবনার মাঝে মধ্যরাতে দুইচোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো শুভময়ের। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার তন্দ্রা কেটে গেল, যখন মনে হল যে মণিমালা তার পাশ থেকে উঠে অতি সন্তর্পণে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে!
    “দাঁড়াও, কোথায় যাচ্ছ তুমি?” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।
    মণিমালা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো…সেই একই রক্তবর্ণ চোখ, হিংস্র চাহনি, খোলা চুল, ঠোঁটের কষ দিয়ে লালা ঝরছে, মুখ দিয়ে চাঁপা গর্জনের শব্দ!
    “আমাকে যে যেতেই হবে তার কাছে…সে যে আমায় ডাকছে আমার দেহের আগুন নেভাবে বলে…আমাকে আটকানোর সাধ্য কোনো মনিষ্যির নেই!”, হুঙ্কার করে উঠলো মণিমালার শরীরে বসা পিশাচিনী।
    “মানুষের সেই সাধ্য না থাকলেও ডাকিনীর তা আছে!” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।

    ঠিক সেই সময় সশব্দে খুলে গেল ঘরের দরজাটা, আর অন্ধকারের মধ্যে সেই কৃষ্ণবর্ণ এলকেশী নগ্ন নারীর অবয়বটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ঘরের ভেতর। তাকে দেখে চমকে উঠলো মণিমালা রূপী পিশাচিনী। তারপর একটি বিকট হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে গেল তার কাছে। ডাকিনী নিজের ডান হাত প্রসারিত করে ধরে ফেললো মণিমালার গর্দন। শুরু হল দুই অতি-প্রাকৃত মানবীর মধ্যে অকল্পনীয় সংগ্রাম। তবে শুভময়ের পরিকল্পনাই সফল হল, কাম পিশাচিনীর থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ডাকিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিমালার শরীরটা তুলে ফেললো সম্পূর্ন শূন্যে। নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে, মণিমালার হাঁ করা মুখ দিয়ে কালো ধোঁয়ার মত বেরিয়ে এলো পিশাচিনীর প্রেতাত্মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের খোলা জানলা দিয়ে বিদায় নিলো সে। অতঃপর অদৃশ্য হল ডাকিনী। মণিমালার অচৈতন্য শরীরটা ঢলে পড়লো শুভময়ের কোলে।

    পরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে এলো মণিমালার, তখন আবার জমিদার বাড়ির আঙিনা লোকে লোকারণ্য। আজ ভোরেও গ্রামের জঙ্গলের সীমানায় একটি ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাত্ব মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই লাশ কোনো যুবতীর নয়, তা হল গ্রামের সুপরিচিত সুকুমার পন্ডিতের! কেউই বুঝে উঠতে পারছে না যে কে তাকে এভাবে হত্যা করলো।

    ওদিকে শুভময় মণিমালার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “কাম পিশাচিনী সাধনার প্রধান শর্তই হল, যে প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে এই পিশাচিনীকে কোনো না কোনো নারীর দেহে প্রবেশ করিয়ে, সাধককে তার সাথে সহবাস করতে হবে। কোন একটি সপ্তাহে তা কোনো ভাবে না করতে পারলে, সাধকের শর্তভঙ্গের অপরাধের শাস্তি হিসেবে এই পিশাচিনীই হবে সাধকের হত্যাকারিণী!…যা এই ক্ষেত্রে ঘটেছে!”
    একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মণিমালা আঁকড়ে ধরলো তার স্বামীর সুঠাম বুকের ছাতিটাকে।

    (সমাপ্ত)

  • গল্প

    সম্প্রদান

    সম্প্রদান
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

    (১)
    বিছানায় শায়িত সুপর্ণা দেবীর মাথার কাছে বসেছিলো তার একমাত্র ছেলে, বিভাস। ষাটোর্ধ্ব সুপর্ণা দেবীর আছে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। তাই গতকাল সকালে হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন গৃহকর্মরত সুপর্ণা দেবী। বাড়ির একমাত্র পুরোনো চাকর, শম্ভুর সহায়তায় তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানকার সেবা শুশ্রূষার পর এখন অনেকটাই শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়েছেন তিনি।

    কলকাতা থেকে দূরে অবস্থিত এই কুলডিহি গ্রামের নাম করা বনেদি পরিবারের গৃহকর্ত্রী হলেন সুপর্ণা দেবী। তাদের পারিবারিক পাট আর তাঁতের ব্যবসার উপার্জনের জন্য একসময় এই গ্রামের মধ্যে স্বচ্ছলতা আর আভিজাত্যের শিখরে ছিলো তাদের পরিবার। তবে এখন সেই সবই হল ইতিহাস। আস্তে আস্তে ব্যবসার আয় তলানিতে গিয়ে থেকেছিলো। আর তা সম্পূর্ণরূপে হাতবদল হল, যখন পাঁচ বছর আগে, স্বামীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র ছেলে বিভাস ব্যবসার পাট চুকিয়ে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলো চাকরির উদ্দেশ্যে।

    বিভাস কলকাতার একটি নামী সংস্থায় এইচ.আর ম্যানেজার পদে কর্মরত। তাই গত কয়েক বছর ধরে এই বাড়িতে একাই থাকেন সুপর্ণা দেবী। বিভাস কলকাতাতেই নিজের বাসস্থান বেছে নিয়েছে, এখন এই গ্রামের সাথে বা পৈতৃক বাড়ির সাথে তার খুব একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নেই। মাকেও সে অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছে তার কাছে, কিন্তু সুপর্ণা দেবী কিছুতেই তার স্বামীর ভিটের মোহ ত্যাগ করতে পারেননি। মায়ের অসুস্থ হওয়ার সংবাদ পেয়ে বিভাস আজই এসেছে তাকে দেখতে।

    তবে সুপর্ণা দেবী জানেন, যে বিভাসের এই পৈতৃক বাড়িতে না থাকতে চাওয়ার পেছনে তার কর্মস্থল কলকাতায় হওয়াটাই একমাত্র কারণ নয়…এই গ্রামের সাথে যে তার একমাত্র সন্তানের অনেক বেদনা, অনেক হাহাকার ভরা না পাওয়ার জ্বালা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে!

    “এই বয়সেও বাড়ির সব কাজ নিজের হাতে কেন করতে যাও, মা? যদি তোমার কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে…”
    বিভাসের শশব্যস্ত কণ্ঠে করা এই প্রশ্নে যেন কানই দিলেন না সুপর্ণা দেবী, প্রত্যুত্তরে তিনি মৃদু হেসে নিজের শীর্ন হাতটি বিভাসের এলোমেলো চুলের মধ্যে চালনা করে বলে উঠলেন, “বড্ড রোগা হয়ে গিয়েছিস বাবা…ওখানে কি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস না?”
    বিভাস যেন বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে চলছিলো, ঠিক এমন সময় হঠাৎ কি মনে পড়ায়, সুপর্ণা দেবী ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “শোন বাবা, শম্ভুর বয়স হয়েছে তো, তাই এখন সে আর বাজারের ভারী ব্যাগ টেনে আনতে পারে না। যা না বাবা, তুই বাজারটা সেরে আয়…আজ একটু পাঁঠার মাংস আনিস, অনেকদিন তো আমার হাতের রান্না খাসনি…”
    বিভাস উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “সে কি মা! এই অবস্থায় তুমি রান্না করবে! ওসবের দরকার কি, আমি কোনো হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসি…”

    কিন্তু তার মায়ের সেই এক জেদ, এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়েছেন। নিজের হাতে রান্না করে ছেলেকে পাত পেরে না খাইয়ে একেবারে শান্তি নেই তার। অগত্যা বিভাসকেই থলে হাতে বাড়ি থেকে বেরোতে হল বাজারের উদ্দেশ্যে।

    (২)
    এবার প্রায় বছর খানেক পর বিভাস এসেছে তার পৈতৃক বাড়িতে। বাজারটা এই বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। চারিদিকের প্রাত্যহিক সতেজ সবুজ স্নিগ্ধতার মাঝে, গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলছিলো বিভাস। চারিদিকে দুচোখ মেলে চেয়ে সে একটা কথাই ভেবে চলেছিলো, যে ধীরে ধীরে কতটা বদলেছে তাদের এই গ্রাম? নাহ, তেমন খুব একটা নয়। সেই মাঠ, গাছপালা, পুকুরঘাট, বাঁশঝাড়, দূরের ঝোঁপের ভেতর থেকে আসা মোরগের ডাক, কিংবা জেলেপাড়ার গোয়ালঘরগুলো থেকে আসা গরুর হাম্বা রব…সব কিছু যেন আগের মতই আছে। কিন্তু এই চেনা পরিবেশের মাঝেও নিজেকে খুব অচেনা লাগে বিভাসের, কারণ তার জীবন যে আর আগের মত নেই!

    হাঁটতে হাঁটতে পথের মাঝে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বিভাস। তার অনতিদূরে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে একটি জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি। এই কবছরের মধ্যেই বন্য গাছপালার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে সেটার নানা জায়গা থেকে খসে পড়েছে সিমেন্ট বালির প্রলেপ। বিভাস একদৃষ্টে চেয়ে রইলো বাড়িটার দিকে। তার হাত থেকে বাজারের থলেটা কখন নীচে পড়ে গেল, তা খেয়ালই হল না তার। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সে বাড়িটার দিকে, কিন্তু মনের ভেতর ফেলে আসা স্মৃতির সরণী বেয়ে সে যেন ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে লাগলো বেশ কয়েক বছর আগে!

    এখনো তুলিকার মতই বিভাসের হৃদয়ের বেশ কিছুটা জায়গা অধিকার করে আছে তাদের এই ছোট্ট একতলা বাড়িটা। সেই তুলিকা, যাকে গ্রামের স্কুলে যাওয়ার পথে এক ঝলক দেখার জন্য কতদিন নিজের কলেজ কামাই করে তাকে ওই পথের ধারে অশ্বথগাছটির পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে! তেমন ডানা কাটা পরীর মত চেহারা ছিলো না তুলিকার, তবুও কি মোক্ষম আকর্ষণ ছিলো তার দুই কাজল কালো চোখের মধ্যে! এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা সাধারণ গ্রাম্য মেয়েটিই যে কখন প্রবেশ করেছিলো এই সুদর্শন যুবকটির হৃদয়ের গভীরে, তা নিজেও জানতো না সে। সকলের অজ্ঞাতে নিজের মনের অনুভূতিগুলো দিয়ে সাজিয়ে সেই প্রথম তার প্রেমপত্র লেখা তুলিকার উদ্দেশ্যে, আর হঠাৎ করে একদিন সেটা তার হাতে গুঁজে দিয়েই দুরদুর দৌড়! সেই সকল ছেলেমানুষির কথা এখনো সুস্পষ্ট বিভাসের মনে।

    তুলিকার বাবা সোমেশ বাবু ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার তার। এদিকে বিভাসের পরিবার বরাবরই গ্রামের গণ্যমান্য পরিবার হওয়ার মর্যাদা পেলেও, সেই সময় তাদের প্রাচুর্যে যথেষ্ট ভাঁটা পড়েছে। তাই দুই পরিবারের মধ্যে তেমন কোনো বিভেদ না থাকায় তুলিকাও সায় দিয়েছিলো বিভাসের ইশারায়। মুখে কিছু না বললেও, নিজের পড়ার বইয়ের মধ্যে সযত্নে গচ্ছিত রেখেছিলো বিভাসের দেওয়া প্রেমপত্রটিকে।

    এরপর থেকেই এই বাড়িতে অবাধ আনাগোনা বিভাসের। এখনো তার মনে পড়ে, সেই বার কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে, তুলিকার মা, শীলা দেবী বিভাসকে গুনে গুনে পাঁচটা রসগোল্লা জোর করে খাইয়ে ছিলেন নিজের সামনে বসিয়ে। তারপর প্রসন্ন চিত্তে বিভাসের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠেছিলেন, “তোমার ভালো হোক, বাবা…জীবনে আরো উন্নতি করো, ভালো চাকরি পেয়ে মা বাবার মুখোজ্জ্বল করো!”
    ওপাশ থেকে গদগদ গলায় সোমেশ বাবু বলে উঠেছিলেন, “বিভাস আমাদের হীরের টুকরো ছেলে, এ গাঁয়ের গর্ব!…শুনলি তুলি, এবার থেকে ওকে বলে রাখছি, এখানে নিয়ম করে এসে তোকে অঙ্ক আর ইংরাজিটা দেখিয়ে দিয়ে যাবে…আর তুমিও বাবা, এটাকে নিজের বাড়িই মনে করবে, কেমন!”

    তুলিকা কোনো উত্তর দেয়নি সেই কথায়। শুধু বিভাস লক্ষ্য করেছিলো, যে সেই ঘরের দরজার পর্দার বাইরে থেকে গর্বে আর খুশিতে ভরা একজোড়া কাজল কালো চোখ যেন এতক্ষন পর লজ্জিত হয়ে নিচের দিকে চাইলো। সেই দিন থেকেই যেন তার তুলিকাকে আরো কাছ থেকে পাওয়া শুরু হল। কত শীতের দুপুরে এই বাড়ির ছাদেই মাদুরের ওপর সে পড়াতে বসেছে তুলিকাকে। পড়ার ফাঁকে, সকলের অলক্ষে, বিভাস মাঝে মাঝে তুলিকার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তো। বাড়ির পেছনের নিমগাছটা থেকে ডেকে উঠতো সেই কোকিলটা, হীমেল হওয়ার স্রোতে ফরফর করে উড়ে যেত বীজগণিতে ঠাসা অঙ্ক বইয়ের পাতা। বিভাস আলতো করে জড়িয়ে ধরতো তুলিকার হাতটাকে, তারপর মৃদু স্বরে বলে উঠতো, “তুলি আমায় কথা দে, যে সারা জীবন এবাবেই আমার পাশে থাকবি…”
    তুলিকা শুধু খিলখিল করে হেসে উঠতো, তার পাতলা ঠোঁটের দুইপাশ থেকে বেরিয়ে পড়তো মুক্তের মত গজদন্ত জোড়া…সেদিকে তাকিয়ে থেকে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত বিভাসের দুই চোখে।

    (৩)
    হঠাৎ জামার বুকপকেটের ভেতর থেকে তারস্বরে মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায় চিন্তায় ছেদ পড়লো বিভাসের। ফোনটা কানে দিয়েই সে বলে উঠলো, “হ্যাঁ শ্রী…বলো…”
    ফোনের ওপার থেকে নারীকণ্ঠের আওয়াজ এল, “এই যে মশাই, বাড়ি পৌঁছে কি একটা ফোনও করতে নেই? মামণি কেমন আছেন সেই খবরটাও বুঝি জানাতে নেই?…কি ভাবো কি তুমি, হ্যাঁ? আমার বুঝি চিন্তা হয় না?”

    শ্রী ওরফে শ্রীময়ীর সাথে বিভাসের আলাপ মাস্টার্স করার সময় থেকে। কলকাতার যে কলেজ থেকে বিভাস এম.বি.এ পাশ করে, আইনের স্নাতক শ্রীময়ীও সেখান থেকে এম.এস.ডাব্লু পাশ করে। সেই সূত্রে দুজনের আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব। শ্রীময়ীর তরফ থেকে সেই বন্ধুত্ব কখন যে প্রণয়ের রূপ ধারণ করেছে, তা সে নিজেও জানে না। অসামান্য সুন্দরী সুশিক্ষিতা শহুরে মেয়ে শ্রীময়ী, এখন একটি বেশ বড় এন.জি.ও-তে উঁচু পদে কর্মরতা। তাই বিভাসও অসম্মতি প্রকাশ করেনি তার প্রণয় নিবেদনের প্রস্তাবে। এই বছরের শেষের দিকেই দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, এই কথা দুজনের পরিবারের সকলেরই অবগত।

    “মা এখন অনেকটাই সুস্থ শ্রী, তোমার কোনো চিন্তা নেই…আর আমি একটু হলেই ফোন করতাম তোমাকে…”, শ্রীময়ীকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো বিভাস। কিন্তু তাতেও খুব একটা আশ্বস্ত হল না সে। আরো কত কি যে অনর্গল বলে গেল মেয়েটা, তা যেন বিভাসের কানেই গেল না। সে শুধু তার কথায় ক্রমাগত ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘আচ্ছা’ ইত্যাদি বলে কিছুক্ষন পর কথা শেষ হলে মোবাইলটি পকেটে চালান করলো। তারপর পেছন ঘুরে, পথের ওপর থেকে থলেটি তুলে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল বাজারের দিকে। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে তার, কি জানি আবার মা চিন্তা করবে নাকি!

    ভাত, মাংস সহ নিজের হাতে রাঁধা আরো নানাবিধ সুস্বাদু পদে ছেলের পাত সজ্জিত করে, বিভাসকে খেতে ডাকলেন সুপর্ণা দেবী। মেজেতে আসনের ওপর বসে নিঃশব্দে ভাত খাচ্ছিলো বিভাস, পাশে বসে সুপর্ণা দেবী একটি হাতপাখা দিয়ে হালকা করে হাওয়া করে চলেছিলেন। হঠাৎ তাকে অবাক করে বিভাস বলে উঠলো, “তুলিকাদের বাড়িটায় আর কেউ থাকে না, না মা?”
    ছেলের মুখে তুলিকার নামটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলেন সুপর্ণা দেবী, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না, সোমেশ বাবুর মৃত্যুর পর আর কদিনই বা বেঁচে ছিলো শীলা, তুই বুঝি জানিস না?”
    বিভাস চুপ করে রইলো, সুপর্ণা দেবী বলে চললেন, “কিন্তু আজ হঠাৎ ওই হতভাগীর নাম মুখে আনছিস কেন বাবা? ভুলে যা ওকে…শ্রীময়ী খুব ভালো মেয়ে…কবে যে তোকে আমি তার সাথে সংসারী হতে দেখবো, বাবা? তোদের চার হাত এক হওয়া না দেখা অবধি যে মরেও শান্তি পাবো না আমি…” শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের দুই চোখ চেপে ধরলেন সুপর্ণা দেবী।

    সামনে রাখা মাংসের ঝোল দিয়ে মাখা ভাত সমেত কাঁসার থালাটার দৃশ্য যেন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো বিভাসের চোখে জমা জলের প্রলেপের ভেতর থেকে। স্মৃতির ছায়াপথ ধরে সে যেন আবার ক্রমশ পিছিয়ে যেতে লাগলো অতীতের সেই দুর্বিষহ দিনটার দিকে।

    (৪)
    “আমার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, বিভাসদা!”, বিস্ফারিত দুই সজল চোখ মেলে উত্তেজিত কণ্ঠে সেদিন বলে উঠেছিলো তুলিকা, “ছেলেটা সরকারি চাকরি করে…মা বাবা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চান না এই সম্বন্ধটাকে!”
    তুলিকাদের বাড়ির পেছনের ঝোপ ঝাড়ে ভরা বাগানে বিভাসকে ডেকে, সে এই কথাই বলে উঠেছিলো আকুল কণ্ঠে। কিছুক্ষন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বিভাস, তুলিকা ছুটে এলো তার আরো কাছে। তারপর তার বুকে থাকা জামার অংশটাকে খামচে ধরে বলে উঠেছিলো, “কিছু করো, কিছু করো বিভাসদা…আমি যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা!” তুলিকার চোখের জলে ভেসে গিয়েছিলো বিভাসের বুক।

    আর দাঁড়িয়ে থাকেনি বিভাস। সেদিনই তুলিকার হাত ধরে সে সটান চলে গিয়েছিলো সোমেশ বাবু আর শীলা দেবীর সামনে। স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো তার সাথে তুলিকার সম্পর্কের কথা। খুব অবাক হয়েছিলো সে এটা দেখে, যে এই কথা শুনে সেদিনকার সেই খুশি আর গর্বে ভরা সোমেশ বাবুর মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো বিদ্বেষ আর ক্রোধের আভা! সম্পূর্ন অচেনা এক কণ্ঠে তিনি বলে উঠেছিলেন, “তোমার লজ্জা করেনা গুরুজনদের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কথা বলতে? কত টাকা উপার্জন করো তুমি, যে তুলিকে বিয়ে করতে চাও?”
    তুলিকা কিছু বলতে চেয়েছিলো সেই সময়, কিন্তু সোমেশ বাবুর রক্তচক্ষুর সামনে কোন সাহস জোটাতে পারলো না সে। চোখের জল চেপে রেখে সে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলো সেই ঘর থেকে। ঠিক সেই সময় শীলা দেবীও যেন অন্য রূপ ধরেছিলেন, চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, “ভেবেছিলাম তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে, তাই তুলিকে কয়েকটা পড়ার বিষয় দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে এই বাড়িতে আসতে বলতাম…কিন্তু তোমার পেটে পেটে এই বদ বুদ্ধি! শেষে মেয়েটাকে ফুঁসলিয়ে…”
    স্ত্রীর কথা শেষ না হতেই আবার গর্জে উঠেছিলেন সোমেশ বাবু, “তোমরা গ্রামের গণ্যমান্য পরিবার হতে পারো.. কিন্তু এখন তোমাদের কি অবস্থা, তা আমরা জানিনা ভেবেছো? কি দেখে আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবো শুনি? যাও চলে যাও এখান থেকে…আর কখনো যেন তোমাকে এই বাড়িতে না দেখি আমি…”

    নাহ, এরপর আর সত্যিই কখনো ওই বাড়িমুখো হয়নি বিভাস। না তো আর কখনো সে তুলিকার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু যেদিন তুলিকাদের বাড়ি থেকে সানাই-এর সুর ভেসে আসছিলো, সেই আওয়াজ যেন অসহ্য মনে হচ্ছিলো বিভাসের কানে। গোটা দিনটা নিজেকে ঘরের ভেতর বন্ধ করে রেখেছিলো বিভাস। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েও দরজা খোলেনি সে। চোখের জলে ভেসে গিয়েছিলো বিছানার চাদর। তবুও মনে মনে একটা কথাই সে বলে গিয়েছে, “তুলিকা যেন সুখী হয়…সে যেন আমাকে ভুলে নতুন স্বামী আর সংসার নিয়ে খুশি থাকে!”

    এরপর থেকে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই তুলিকার সাথে। সে যে এখন কোথায় কিভাবে আছে, তাও জানে না সে। নিজের চেষ্টায় ভালো ফলাফল নিয়ে স্নাতক হবার পর, বিভাস কলকাতার একটি নামী কলেজে ভর্তি হয় এম.বি.এ কোর্সে। সেখান থেকেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে জুটে যায় এই চাকরিটা। নিজের সকল পিছুটান ফেলে সে দৌড়োতে থাকে নিজের কেরিয়ারের পেছনে, ছিন্ন করে দেয় এই গ্রামের সাথে তার সকল সম্পর্ক, কারণ এই স্থানের আকাশে বাতাসে যে শুধুই তুলিকার স্মৃতি জড়িয়ে আছে! তার আলাপ হয় শ্রীময়ীর সাথে, জীবনটা যেন এক অন্য মোড়ে ঘুরতে থাকে।

    (৫)
    শীতের দুপুরের মিঠে রোদ প্রবেশ করছে সুসজ্জিত কফি-শপটির জানলার কাঁচের সার্সির ভেতর থেকে। গতকাল দুপুরেই মাকে দেখে বিভাস কুলডিহি থেকে কলকাতা ফিরে এসেছে। আজকে শনিবার, বিভাস আর শ্রীময়ীর দুজনের অফিসেই আজ হাফ-ডে। তাই শ্রীময়ীর আব্দার রক্ষার্থে তার সাথে বিভাসের এই কফি-সপে দেখা করতে আসা।

    গোলাপী টপ, জিন্স, খোলা চুল এবং যথাকিঞ্চিত প্রসাধনীতেও কি অপরূপ সুন্দরী লাগছে আজ শ্রীময়ীকে। এখানে উপস্থিত একাধিক সুদর্শন পুরুষেরই নজর যে তার দিকে রয়েছে, এই কথা বুঝতে পারে বিভাস। কিন্তু সেদিকে যেন শ্রীময়ীর কোনো খেয়ালই নেই। সরল, হাসিখুশি মেয়েটি যেন বিভাসকে একদিনও না দেখে থাকতে পারে না, তাই আজ তাকে পেয়ে নিজের স্বভাব অনুযায়ী আনন্দ এনং উচ্ছাসের সাথে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। শ্রীময়ীকে নিয়েই বিভাস এগিয়ে যেতে চায় ভবিষ্যতের পথে, তাই নিজের অতীত সম্পর্কে সে আজ অবধি তাকে কিছুই বলেনি।

    কফিটা শেষ হতেই বিভাসকে নিয়ে তড়িঘড়ি উঠে পড়লো শ্রীময়ী। তারপর কফির বিল মিটিয়ে এসেই রাস্তা থেকে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো দুজনে। তারপর যখন সে ট্যাক্সি-চালককে আলিপুরের উদ্দেশ্যে যেতে নির্দেশ দিলো, তখন বেশ অবাক হল বিভাস। তার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠলো শ্রীময়ী, “কি কান্ড বলো দেখি! তোমাকে কাছে পেয়ে অফিসের একটা ছোট্ট কাজের কথা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো গো!”
    “কি কাজ?”, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো বিভাস।
    শ্রীময়ী মৃদু হেসে আলতো করে বিভাসের হাত ধরে বলে উঠলো, “চলো না…তুমিও তো আছো আমার সাথে…নিজেই দেখতে পাবে!”

    আলিপুরের বেলভিডিয়ার রোড দিয়ে চলছিলো ওদের ট্যাক্সিটা। কিছুক্ষন পর চালককে থামতে বলে, নিজেই ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বিভাসকে নিয়ে নেমে পড়লো শ্রীময়ী। এবার যেন আরো অবাক হওয়ার পালা বিভাসের, কারণ এখন সে বুঝতে পেরেছে, যে শ্রীময়ীর গন্তব্যস্থল হল সামনেই অবস্থিত আলিপুরের মহিলা সংশোধনাগার! সেখানকার গেটের সামনে এসে, দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলটিকে নিজের অফিসের পরিচয়পত্র দেখিয়ে অল্প কিছু কথা বলে উঠলো শ্রীময়ী। এরপরই কনস্টেবলটি তাদের বেশ খাতির করে এনে বসালো জেলার সাহেবের অফিস ঘরে। বোঝায় যাচ্ছে, যে শ্রীময়ীর আগে থেকেই জেলারের সাথে এপইন্টমেন্ট নেওয়া ছিলো।

    বিভাস যেন এখনো বুঝতে পারছে না, যে শ্রীময়ী কোন প্রসঙ্গে এত কথা বলে চলেছে রাশভারী চেহারার জেলারটির সাথে। কথাপ্রসঙ্গে সে বলে উঠলো, “তাহলে স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমরা একবার দেখা করতে চাই ওই মেয়েটির সাথে..”
    জেলারের সম্মতিতে একজন কনস্টেবল এসে বিভাস আর শ্রীময়ীকে নিয়ে চললো দুই পাশে জেলের কুঠুরির সারির মাঝ বরাবর একটি সরু রাস্তা দিয়ে। একটি জেলের কক্ষের সামনে এসে থামলো তারা, তারপর কনস্টেবলটি চলে গেল। সামনের লোহার গারদের ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে এক সাদা শাড়ি পরিহিতা নারীকে, যে সেই অন্ধকার ভরা জেলের কুঠুরির ভেতর মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়ে বসে আছে।

    “তুমি তো জানই, আমি যে এন.জি.ও-তে কাজ করি, তার মূল লক্ষ্যই হল সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের সামনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া…এই মেয়েটিও এমনই এক অভাগিনী। নিজের অত্যাচারী স্বামীকে হত্যা করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। তাই ওকে আইনি সাহায্য দেওয়ার জন্যই আমাকে অফিস থেকে পাঠিয়েছে এখানে…ওহ, বাই দা ওয়ে, মেয়েটির তাম তুলিকা চৌধুরী…’, এক নাগাড়ে বিভাসের উদ্দেশ্যে বলে গেল শ্রীময়ী।

    তাদের কথা শুনে, জেলের ভেতর বসা মেয়েটি মুখ তুলে তাদের দিকে চেয়ে দেখলো। ঠিক সেই সময় যেন একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল বিভাসের সর্বশরীর দিয়ে। উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে উঠলো তার দুই পা। দুই চোখের সামনে যেন নেমে এলো একরাশ কালো অন্ধকার। দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নিতে নিতে, সে পেছনের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অতি কষ্টে। এতদিন পর সে তুলিকাকে এখানে, এই পরিস্থিতিতে দেখবে…এটা যে সত্যিই ছিলো বিভাসের কল্পনাতীত!

    (৬)
    স্তম্ভিত হয়ে বিভাস শুধু চেয়ে রইলো তুলিকার দিকে। এ কি চেহারা হয়েছে তার! অনেকটাই রোগা হয়ে গিয়েছে তুলিকা, কতদিনের অবহেলায় এলোমেলো রুক্ষ একমাথা চুল ঢেকে রেখেছে তার মুখের অনেকটা অংশ, অযত্নে তার দুচোখের তলায় গাঢ় কালির প্রলেপ! তার আধ-ময়লা শাড়িতে আবৃত শীর্ণ দেহটি উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জেলের দরজার কাছে। সেও একদৃষ্টে চেয়ে আছে বিভাসের দিকে, চোখে একরাশ লজ্জা এবং যন্ত্রণা। যেন কোন মন্ত্রবলে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে বিভাস, তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তুলিকার সাথে কাটানো অতীতের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিচ্ছবিগুলি! কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করে বিভাস…নিজের অজান্তেই কখন যে ভিজে গিয়েছে তার দুচোখের পাতা! শ্রীময়ী যেন কিছু বুঝতে না পারে!

    শ্রীময়ীর সাথে কথোপকথনের মাঝেই তুলিকার জীবনের এক একটা দুর্বিষহ মুহূর্তের কথা পরিস্কার হয়ে উঠতে থাকে বিভাসের কাছে। বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই তুলিকার কাছে পরিস্কার হয়ে ওঠে, যে তার স্বামী সরকারি চাকুরে হওয়ার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলো তাদের সকলের কাছে। আদপে সে ছিল এক সরকারী সংস্থায় কর্মরত ঠিকা-শ্রমিক মাত্র!
    “কিন্তু তবুও আমি ওকে নিয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলাম, কারণ আমি বিয়ে করেছিলাম একজন মানুষকে, তার চাকরিকে নয়!”, জেলের দরজার লোহার রডগুলোকে চেপে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলো তুলিকা, “কিন্তু সেই সুযোগও ঈশ্বর দিলেন না আমায়! আমার প্রতি কোন অনুভুতি ছিলো না মানুষটার…মদ্যপ অবস্থায় পণের পয়সা চেয়ে প্রতিনিয়ত ওর হাতে অত্যাচারিত হতে হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো আমার!…সেদিন যখন রান্নাঘরে আমার চুলের মুঠি ধরে আমার মাথাটা দেওয়ালের অপর সজোরে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল সে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না আমি…কাছেই রাখা লোহার সাঁড়াশিটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম ওর মাথায়!”

    শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তুলিকা। বিভাসের মনে হল, যেন এখনই ছুটে যায় তার কাছে, তাকে বুকে জরিয়ে ধরে যেন বলে ওঠে, “তুই কোন অপরাধ করিসনি তুলি, উচিৎ শাস্তি দিয়েছিস তুই লম্পটটাকে!” কিন্তু শ্রীময়ীর সামনে কিছুই বলতে পারলো না সে! যেন তার হয়েই শ্রীময়ী বলে উঠলো, “তুমি কোন চিন্তা করো না, তুলিকা…একবার যখন আমাদের সংস্থা তোমার সম্বন্ধে জানতে পরেছে, আমরা আপ্রান চেষ্টা করবো যাতে তুমি খুব তাড়াতাড়ি এখান ঠেকে মুক্তি পাও। ওহ, আমার সম্বন্ধে তো আগেই জেনেছো, তাই তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই…উনি হলেন বিভাস মজুমাদার, আমার হবু স্বামী…” শেষের কথাগুলো সে বললো বিভাসকে উদ্দেশ্য করে।

    তুলিকা নিস্প্রভ চোখে শুধু চেয়ে রইলো বিভাসের দিকে, তারপর ম্লান হেসে তাকে নমস্কার জানালো। বিভাস বুঝতে পারলো, যে তার সাথে অতীতের সম্পর্কের কথা বলে তুলিকাও আঘাত করতে চায় না শ্রীময়ীকে। সেদিনের পরেও আরও বেশ কিছুদিন বিভাস একান্তে গিয়েছিলো আলিপুরের এই মহিলা সংশোধনাগারে, তুলিকার সাথে দেখা করতে। জেলের লোহার গারদের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে, তুলিকার দুই হাত চেপে ধরে সে চিৎকার করে বলেছিলো, “তুই শুধু একবার নিজে মুখে বল তুলি, সারা জীবনভর আমি অপেক্ষা করবো তোর এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য…আমি শ্রীকে সব কথা খুলে বলবো…ওকে বলবো, যে তোকে ছাড়া আর কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়…”
    বিভাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিভাসের ঠোঁটে আঙ্গুল রাখে তুলিকা, “না বভাসদা, না…আমার মত একজন অভাগীর জন্য শ্রীময়ীর জীবনটা নষ্ট হতে পারে না, কিছুতেই না…আমারা মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা বুঝতে পারি, বিভাসদা, সে তোমাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসে! তুমি ওকেই গ্রহন করো বিভাসদা, সুখে থেকো ওর সাথে…” সজল চোখে হাস্যজ্জল মুখে বলে ওঠে তুলিকা।

    বিভাসের মনে হয়, যেন একটা পাথর ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে তার বুকের ওপর! দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিবারই বিভাসকে ধরতে হয়েছে জেলখানা থেকে ফিরতি পথ।

    (৭)
    আর মাসখানেক পরেই বিভাসের সাথে শ্রীময়ীর বিয়ের দিন স্থির হয়ে গিয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যেই সুরু হয়েছে আনন্দ উৎসব এবং সুভেচ্ছা নিবেদন। সকলের আনন্দের মধ্যেই বিগত কয়েকদিন সম্পূর্ণরূপে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে বিভাস। একবার তার মনে হয়েছে নিজের সুখ শান্তির কথা, তুলিকার কথা…আবার পরমুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে শ্রীময়ীর সরল সুন্দর মুখের প্রতিচ্ছবি। এই দোদুল্যমান টানাপোড়েনের মধ্যে জর্জরিত হয়ে, সে সুধু একটা কথাই ভেবেছে, এরপর যদি শ্রী কখনো জানতে পারে তার সাথে তুলিকার সম্পর্কের কথা, তখন সে তাকে ক্ষমা করবে তো? সাময়িক ভাবে শ্রীকে আঘাত না দেওয়ার তার এই অভিসন্ধি শেষ মুহূর্তে তিনটে জীবনকেই ছারখার করে দেবে না তো? নিজের মনেই এই কথা ভেবে শিউরে উঠেছিলো বিভাস!

    ইদানিং সে বেশ কয়েকবার শ্রীময়ীর সাথে দেখা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে, শ্রীময়ী তাকে ফোনে জানিয়েছে যে সম্প্রতি অফিসের একটি কাজে তাকে কলকাতার বাইরে বেরতে হয়েছে। এক বুক জ্বালা নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে বিভাস। নিজের অফিসের কাজেও মন বসাতে পারেনি সে। বার বার ইচ্ছা করেছে তুলিকার সাথে দেখা করার। কিন্তু সেও যেন আর চায়না বিভাসের সাথে দেখা করতে, শ্রীময়ীর জন্য সে নিজের স্বার্থত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এমনই একদিন সকালে অবাক হল বিভাস যখন শ্রীময়ী তাকে নিজে থেকেই ফোন করে ডেকে পাঠালো সেই পূর্বপরিচিত কফি-সপে।

    তুলিকার অমতেই তার সাথে অতীতের সম্পর্কের কথা আজ খুলে বলতে হবে শ্রীময়ীকে, মনে মনে এই অভিসন্ধি নিয়েই উদ্ভ্রান্তের মত কফি-সপে পৌঁছয় বিভাস। আজ শ্রীময়ী শাড়ি পড়ে এসেছে, তার সাজপোশাকে আজ যেন এক অন্য রকম শান্ত স্নিগ্ধ আবেশ। কম্পিত হাতে চেয়ারটা সরিয়ে শ্রীময়ীর সামনে বসতে বসতে বিভাস দুরু দুরু বুকে ভাবতে থাকে কিভাবে সে সুরু করবে সব কথা। সব কিছু ঠিক ঠাক হওয়ার পর, হয়তো এতে কতটা আঘাত পাবে শ্রী! কিন্তু আজ যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে শ্রীময়ীকে, সেই হাসি খুশি ভাবটা, সেই উচ্ছাসে ভরা অনর্গল কথা বলে যাওয়ার স্বভাবটা যেন উধাও হয়েছে তার ভেতর থেকে। যেন তার প্রতিমূর্তি জুড়ে আজ এক অনন্য বুদ্ধিদীপ্ত রাশভারী ব্যাক্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। তাকে সব কথা বলতে চেয়েও বলতে পারে না বিভাস, তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে।

    বিভাসকে অবাক করে বলে ওঠে শ্রীময়ী, “আমি জানি, তুমি কি বলতে চেয়েও পারছো না, বিভাস!”
    বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে বিভাস, শ্রীময়ী বলতে থাকে, “পুরুষের মন বোঝা আমাদের মেয়েদের কাছে তেমন কঠিন কাজ নয় বিভাস। সেদিন তুলিকার উপস্থিতিতে তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই আমি অর্ধেক আন্দাজ করে ফেলেছিলাম তোমার মনের কথা। আর বাকি ইতিহাসটা জানতে পারলাম গতকাল, তোমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে…মামণির কাছ থেকে! হ্যাঁ বিভাস, আমি মিথ্যা কথা বলেছিলাম তোমাকে যে গত দুই আমি অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম, আসলে এই সময় আমি গিয়েছিলাম তোমার গ্রামে, তোমার ফেলে আসা অতীতের সমস্ত অজানা কথার অনুসন্ধানে…”

    এক ফোঁটা জল গরিয়ে পড়লো শ্রীময়ীর চোখ থেকে, সে বিভাসের হাতদুটোকে আঁকড়ে ধরে আস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “ছি! বিভাস, তুমি এতটা নীচ, এতটা স্বার্থপর মনে করেছিলে আমায়! শুধুমাত্র তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার আর তুলিকার জীবনটা নষ্ট করে দেব আমি! না, আমি কিন্তু এতটা খারাপ নই, বিভাস!” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো শ্রীময়ী, বিভাসের সমস্ত শরীর যেন অবস বলে মনে হল!
    চোখের জল মুছে, হাসিমুখে বলে উঠলো শ্রীময়ী, “আমি কথা দিচ্ছি বিভাস, বিচারকের সামনে তুলিকার পক্ষের উকিল হয়ে আমি নিজে লড়বো, ওকে বের করে আনবোই জেলের ওই অন্ধকার কুঠুরি থেকে…তাহলেই স্বার্থক হবে আমার ওকালতির পড়াশোনা, আমার মনুষ্যত্ব!”

    বিভাস এখনো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, তার মনে হল যেন স্বয়ং ধরিত্রী দুই ভাগ হয়ে গিয়ে তার বুকের ওপর থেকে ভারী পাথরটিকে নিজের গর্ভে টেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে..

    (৮)
    এর পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। শ্রীময়ী উকিল হিসাবে সত্যিই সাফল্য অর্জন করেছে। সে আদালতে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে, যে তুলিকা যা করেছে তা কোন অপরাধ নয়। সে পরিকল্পিত ভাবে তার স্বামীকে খুন করেনি। যা করেছে, পরিস্থিতির চাপের শিকার হয়ে করেছে, নিজেকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য করেছে। তাই বিচারক যথেষ্ট দয়াপরবশ হয়েই তুলিকাকে শুধুমাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। আজ তার সেই কারাবাসের মেয়াদের শেষ দিন।

    সংশধনাগারের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিভাস আর শ্রীময়ী। গেটে লাগোয়া কনস্টেবল তালা খুলে দিলো, ধীর পায়ে গেটের বাইরে প্রবেশ করলো তুলিকা। বিভাসের বুকে খুশি আর মিলনের সুর বেজে উঠলো, তুলিকা এগিয়ে এলো তাদের কাছে। শ্রীময়ী হাসি মুখে তুলিকার হাতটি ধরে রাখলো বিভাসের হাতের ওপর, তারপর আবার সেই আগের উচ্ছাসে ভরা গলায় বলে উঠলো, “আজ আমার কর্তব্য শেষ হল, বিভাস…তুলিকাকে ফিরিয়ে দিলাম তোমার কাছে…তুলিকার মা বাবা বেঁচে নেই, তাই ধরে নাও ওর নিজের দিদি হিসাবে আমিই ওকে ‘সম্প্রদান’ করলাম তোমার কাছে…সুখে রেখো আমার বোনকে, কেমন?”

    বিভাস আর তুলিকা তাকিয়ে দেখলো শ্রীময়ীর দিকে, দুজনেরই চোখে বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতা। শ্রীময়ী আলতো হাতে তুলিকাকে ঠেলে দিলো বিভাসের দিকে, বিভাস নিজের প্রসারিত দুই বাহুর মাঝে জরিয়ে ধরলো তুলিকাকে। তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে শ্রীময়ী পেছন ঘুরে ফিরতি পথ ধরলো। এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল চেপে রেখেছিলো সে, এখন আর তার অশ্রুধারা মানলো না কোন বাধা। তবুও মনে মনে বলে উঠলো সে, “ভালবাসা যে শুধু নিজের সুখ খোঁজার নাম নয়…সেটা যে অন্যকে সুখে রাখারও আরেক নাম…ভালবাসার আরেক নামই যে ত্যাগ!”

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    মল্লিক বাড়ির গুপ্তধন

    মল্লিক বাড়ির গুপ্তধন
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)
    কলকাতা শহরের বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করে পুলিশ মহলে বেশ নাম করে ফেলেছে গোয়েন্দা গৈরিক সেন, এবং তার একমাত্র সহকারী তথা খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন ওরফে টুসু। সেদিন এক পরিচিত আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলো গৈরিক আর টুসু। ফিরতি পথে, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে এসে হঠাৎ নিজের বাইক থামলো গৈরিক। পেছনে বসে থাকা টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
    – কি গো গেরোদা, থামালে কেন? কি হল?
    গৈরিক নিজের হেলমেটটা মাথা থেকে খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
    – আমার পাশের ওই ব্যাংকটাতে একটু কাজ আছে। তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি…
    গৈরিক চলে গেলে, টুসু সময় কাটানোর জন্য নিজের মোবাইল ফোনটা বার করে ডেটা অন করার সাথে সাথেই তার বন্ধুদের হাজারো হোয়াটসআপ মেসেজ এসে ভিড় করল তার ফোনে। সে মেসেজগুলো এক এক করে পড়ে দরকার মত প্রত্যুত্তর দিতে লাগলো।

    বেশ কিছুক্ষণ পর গৈরিক বেরিয়ে এলো সেই ব্যাংকের গেট থেকে, তবে তার সাথে ওই ছেলেটা আর মেয়েটা কে? টুসু একটু ভালো করে ওদেরকে দেখেই চিনতে পারলো! গৈরিকের আগের একটি কেস চলাকালীন টুসুর পরিচিতি হয়েছিলো এই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির সাথে। ছেলেটির নাম শৈবাল এবং মেয়েটির নাম লিলি।

    গৈরিক বলে উঠলো,
    – বুঝলি টুসু, শৈবালেরও এই ব্যাংকেই একাউন্ট আছে আমার মত, তাই আজ ওদের সাথে ব্যাংকে দেখা হয়ে গেল।
    কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শৈবাল হঠাৎ মৃদু হেসে বলে উঠলো,
    – তবে গৈরিকদা, আপনারা যে এখানে শুধু ব্যাংকের কাজেই এসেছেন আর গোয়েন্দাগিরির জন্য নয়, এই কথাটা কিন্তু খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না…
    টুসু এই কথা শুনে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
    – ঠিক বুঝলাম না তো কথাটার মানে! এখানে আবার গোয়েন্দাগিরি করার আছেটাই বা কি?
    লিলি অবাক হয়ে বললো,
    – সে কি! নিশ্চয় কিছুদিন ধরে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখনি, ঐন্দ্রিলা..তাই বোধহয় জানো না, যে এই তো, কাছেই একটা বেশ পুরোনো বনেদী বাড়ি আছে, মল্লিক বাড়ি…সেখানে নাকি বেশ কিছুদিন ধরে কোন এক ভূতের আনাগোনা শুরু হয়েছে!
    টুসু কপালে চোখ তুলে বললো,
    – সে কি!

    এবার শৈবাল বলে উঠলো,
    – শুধু কি ভূত! সকলে বলছে যে ওই বাড়িতে নাকি গুপ্তধনও লুকনো আছে!
    টুসু বিস্ময়ে আর কথা বলতে পারলো না।
    লিলি আবার বলে উঠল,
    – কে জানে ওখানে কি আছে বাবা! আমার তো এই সব পুরোনো দিনের বাড়িগুলো দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে!
    ওরা আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই চলে গেল। টুসুর খুব ইচ্ছা করছিলো, যে একবার সেই মল্লিক বাড়ি গিয়ে এই ভূত আর গুপ্তধনের ব্যাপারে আরো বেশি করে খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু বিধি বাম, সেই বাড়ির থেকে কেউ তো আর তাদের ডেকে পাঠায়নি, তাহলে তারা সেখানে যাবেই বা কি করে! অগত্যা, টুসু আবার গৈরিকের বাইকের পেছনে চেপে বসল, নিজের বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। গৈরিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল টুসুর মনোবাসনা, এবং সেটা জেনে, সে হেলমেটের ভেতরে মুচকি মুচকি হাসছিল।

    (২)
    তবে ঈশ্বর যেন টুসুর মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন। কারণ সেদিন বিকালেই, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গৈরিকের জরুরি তলব এলো টুসুর কাছে। টুসু তখন সবে দুপুরের ভাত ঘুম দিয়ে উঠেছিলো, ঠিক তখনই গৈরিক ওকে ফোন করে বললো, “তাড়াতাড়ি একবার আমার অফিসে চলে আয়, বাকি কথা এখানেই হবে…” এই বলে সে ফোনটা দিল কেটে।

    উফ, কোন মানে হয়? ভাবল টুসু, গেরোদাটা সত্যিই মানুষকে এত সাসপেন্স-এ রেখে যে কি সুখ পায়, তা কে জানে! অগত্যা হুটোপাটি করে কোন ভাবে টুসু তখনই পৌঁছে গিয়েছিল রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিত তার গেরোদার “সেন’স আই” নামক গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে। গৈরিক তাকে দেখেই বলে উঠলো,
    – আসুন ম্যাডাম, আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম…
    টুসু রাগী গলায় বলে উঠল,
    – ন্যাকামি না করে, বলো তো কিসের জন্য ডেকে পাঠালে আমায়…

    গৈরিক বেশ প্রফুল্লতার সাথে বলে উঠলো,
    – এখনই তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে রে, টুসু! আমাদের একবার মল্লিক বাড়িতে যেতে হবে!
    আনন্দে উত্তেজনায় টুসুর মুখটা লাল হয়ে উঠলো। সে অধৈর্য গলায় উৎসাহের সুরে বলে উঠলো,
    – কেন, সেখান থেকে কেউ বুঝি ডেকে পাঠিয়েছে আমাদের? ওই ভূত আর গুপ্তধনের রহস্যভেদ করার জন্য?
    গৈরিকের মুখটা কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেল সেই কথা শুনে, তারপর সে বললো,
    – শুধু ভূত বা গুপ্তধনই নয় রে, টুসু…একটা মৃত্যুর রহস্যও আমাদের ভেদ করতে হবে!
    টুসু এই কথা শুনে চরম উত্তেজনায় যেন আর কথা বলতে পারলো না।

    তাই, গৈরিকই বলে চললো,
    – হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস তুই, ওদের বাড়ি থেকে শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক নামক এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলেন আমাকে। তিনি আমাদের তাড়াতাড়ি ওই বাড়িতে একবার যেতে বললেন। ওখানে নাকি সুজয় বলে একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছে আজই সকালে, সেটা যে খুন কি না, তা তারাও ঠিক জানেন না! তবে ওখানে গেলে, বেশ কিছু কথা তিনি আমাদের বলতে চান, যা কিনা ফোনে বলা সম্ভব নয়!
    টুসুর যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছিল না গৈরিকের কথাগুলো, সে তখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল তার গেরোদার দিকে চেয়ে। এবার গৈরিক বেশ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
    – নে নে, আর দাঁড়িয়ে থাকিস না…তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাদের…এখান থেকে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট কিন্তু বেশ কিছুক্ষণের পথ!

    (৩)
    আজ বিকালে কলকাতার রাস্তা-ঘাটে যেন একটু বেশিই যানজট। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে এসে, ট্রাফিক পুলিশের গ্রীন সিগন্যালের আশায় গেরোদার দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের পেছনে বসে থাকতে টুসুর যে কি বিরক্তি বোধ হচ্ছিল, তা কি বলবো। সত্যিই, তার গেরোদার বলা “বেশ কিছুক্ষণ লাগবে” কথাটা যে আদপে প্রায় দুই ঘন্টায় পরিণত হবে, এই কথা যেন টুসু আগে কখনো ভেবেই দেখেনি। বিকাল পাঁচটায় গৈরিকের রাসবিহারীর অফিস থেকে বেরিয়ে যখন ওরা সন্ধ্যা সাতটার সময় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের সেই মল্লিক বাড়ির কাছে পৌঁছলো, তখন টুসু গোয়েন্দাগিরি শুরু করার পক্ষে যথেষ্টই ক্লান্ত।

    তবে সেই মল্লিক বাড়ির প্রথম দর্শনেই যেন টুসুর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এমন চেহারার জমিদার বাড়ি টুসু গৈরিকের আগের কেসগুলিতে অনেক দেখেছে। কলকাতার মত এত জন-প্রাচুর্যে ভরা শহরেও, এই পাঁচ মহলা দোতলা পুরনো আমলের তৈরি বাড়িটি যেন অন্য আশে-পাশের সকল বাড়ি ঘর থেকে একটু বেশিই দূরত্বে অবস্থিত। বিশাল বড় সিংহ-দ্বার আর বড় বড় থামওয়ালা এই বাড়িটার চারিদিকে বেশ বড় আমবাগান। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি মার্বেলের তৈরি জলের ফোয়ারা, কিন্তু এখন আর সেটা সচল অবস্থায় নেই। ভেতরের উঠোনের এক ধারে দুর্গা-দালান, তার চারিপাশে একটানা দোতলা বাড়িটার সারি সারি ঘর। এখনো অবধি পুরোনো কলকাতার সেই ল্যাম্প পোস্টগুলোও আছে তার চারি পাশে। তবে বাড়িটা অবশ্য যে দেখাশোনা বা মেরামতির অন্তরালে আছে, তা কিন্তু নয়। এমন বাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা “রহস্য রহস্য” ভাব জাগে মনে।

    বাড়িতে ঢোকার পর বাড়ির চাকর ওদের এনে বসালো নিচের বৈঠকখানায় একটি ঘরে। পরমুহূর্তেই সেই ঘরে প্রবেশ করলেন লম্বা, সুপুরুষ এবং আভিজাত্যে পরিপূর্ণ চেহারার অধিকারী এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। সেই ভদ্রলোক গৈরিক আর টুসুকে নমস্কার জানিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
    – নমস্কার মিস্টার সেন, নমস্কার ঐন্দ্রিলা! আমি হলাম শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক, আপনাদের রহস্য-ভেদের অনেক গল্পই আমি পড়েছি খবরের কাগজের পাতায়, সেই জন্যই আজ আমি আপনাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি!
    ওরাও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে। না জানি, কোন রহস্যের সূত্রপাত ঘটাতে চলেছেন তিনি!
    ঠিক সেই সময় সকলের জন্য কফি, চানাচুর এবং বিস্কুটের ট্রে হাতে হাজির হল বাড়ির চাকর।

    ওদের সবার কফির ধূমায়িত মাগ হাতে নেওয়া হয় গেলে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলতে শুরু করলেন,
    – বুঝতেই পারছেন মিস্টার সেন, আমাদের এই পরিবার এই অঞ্চলের মধ্যে বেশ পুরনো। এখানেই আমাদের সাত পুরুষের বাস।
    টুসু অবাক হয়ে বলে উঠলো,
    – আপনারা নিশ্চয় এখানকার জমিদার ছিলেন, তাই না?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটি ম্লান হেসে বললেন,
    – হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, ঐন্দ্রিলা…আমাদের এক পূর্বপুরুষের ছিল বিশাল বড় আমদানি রপ্তানির ব্যবসা, যার মুনাফা থেকেই তিনি এই অঞ্চলের জমিদারি কিনেছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে…যাই হোক, সে সব অনেক প্রাচীন কথা, এখন শুধু এই বাড়িটাই যা পড়ে আছে, জমিদারির আর কিছুই নেই। এখন আপাততঃ এই এতবড় বাড়িতে থাকি শুধু আমি আর আমার দাদা নিত্যপ্রসাদ মল্লিকের পরিবার পরিজনেরা। বাকি সকলেই যে যার মত কেটে পড়েছে অন্যত্র। তবে, দাদা এই মুহূর্তে খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, তাই আমার সাথে তিনি এখন এখানে থাকতে পারছেন না।

    গৈরিক বলে উঠলো,
    – হুম, বুঝলাম, তবে শুনেছি নাকি এই বাড়িটা ঘিরে কোন ভূত আর গুপ্তধনের গল্প আছে স্থানীয় মানুষদের মনে…
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
    – বলবো, আপনাদের সেই সব কথা বলার জন্যই তো একটু কষ্ট দিয়ে ডেকে পাঠালাম। কারণ ফোনে এতকিছু বলা যেত না…
    কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, যেন ভেবে নিলেন কোথা থেকে বলা শুরু করবেন, তারপর আবার মুখ খুললেন,
    – আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা। সেই সময়, আন্দাজ ১৯১৬ সালে, আমাদের এক পূর্বপুরুষ, রমণীমোহন মল্লিক ছিলেন এখানকার ডাকসাইটে জমিদার। যেমন ছিল তার রূপ, তেমনই ছিল তার অর্থবল। শুনেছিলাম যে, রাজস্থানের কিষানগড়ের সেই সময়কার রাজা, মহারাজ ভানুপ্রতাপ সিংহ ছিলেন এই রমণীমোহনের বিশিষ্ঠ বন্ধু। যে সময় ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ের সিংহাসনে বসেন, সেই সময় তার রাজ্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল একটি খড়ার প্রভাবে। তখন রমণীমোহন তাকে অনেক আর্থিক সাহায্য করেন, তার কিষানগড়কে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। এরপর, একবার নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠান রমণীমোহন মল্লিককে, আর রমণীমোহনও খুব খুশি মনে রওনা হন রাজস্থানের উদ্দেশ্যে, তার বন্ধুর এই বিশেষ দিনে তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।

    এইটুকু বলে কিছুক্ষণ থেমে একবার দম নিয়ে, আবার বলতে শুরু করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু,
    – ভানুপ্রতাপ সিংহের জন্মদিনের খুশিতে তার রাজ দরবারে নাচ দেখানোর জন্য ডাকা হয় সেই সময়কার কিষানগড়ের সবচেয়ে সুন্দরী বাইজি, রূপমতীকে। এই রূপমতী ছিল ভানুপ্রতাপ সিংহের বাঁধা মেয়ে মানুষ, কিন্তু তারই প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন রমণীমোহন, আর রূপমতীও যেন একটু বেশিই সহৃদয় ছিল এই সুদর্শন বাঙালি জমিদারের প্রতি! তারপর এক দিন রাত্রে, রূপমতীকে নিয়ে এই কলকাতায় পালিয়ে এলেন রমণীমোহন…লোকের মুখে শোনা কথা, রূপমতী নাকি তার সাথে কোন এক মহা মূল্যবান বস্তু নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে! এবং সেটিকে সে রেখে দিয়েছিল এই বাড়ির নিচের তলার একেবারে উত্তর কোণে অবস্থিত তার ঘরে, তবে সেটা যে কি, তা আমরা এখনো কেউ জানি না। সেদিন থেকেই রটে গেল যে এই বাড়িতে নাকি গুপ্তধন আছে!…কিন্তু, এর কিছুদিনের মধ্যেই রূপমতী বোঝে, যে তার জন্য রমণীমোহনের মনে কোন ভালোবাসা নেই, আছে শুধু তাকে ভোগ করার বাসনা! সে কোনদিনই রূপমতীকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দেবে না, তাকে দেওয়া রমণীমোহনের সকল কথাই ছিল মিথ্যা! তাই, একদিন ক্ষোভে দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে রূপমতী!…এর কিছুদিনের মধ্যেই ডাইরিয়া আর রক্তবমি হয়ে হঠাৎ মৃত্যু হয় রমণীমোহনের। আর এর পর থেকে, এই বাড়ির সম্বন্ধে, গুপ্তধনের কথার সাথে সাথেই রটে যায় রূপমতীর প্রেতাত্মার গল্প! অনেক পুজো আর্চা করে রূপমতীর ঘরের দরজা সারাজীবনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    গৈরিক হঠাৎ বলে উঠলো,
    – রূপমতীর ঘরে রাখা সেই গুপ্তধন খোঁজার চেষ্টা কি কেউ করেছিল আগে?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু বললেন,
    – না, সেরকম চেষ্টা কেউই করে নি, কারণ সত্যি কথা বলতে ওই ঘরে ভূতের ভয়ে এই বাড়ির কেউ কখনো যেতেই চায়নি… আর তাছাড়া, এই গুপ্তধনের সুত্র হিসাবে রমনীমোহনের মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটা ধাঁধা আছে… তিনি বলে গিয়েছিলেন, যে এই পরিবারের যে সদস্য বুদ্ধি করে এই ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারবে, সেই হবে সেই গুপ্তধনের মালিক! কিন্তু, আমাদের বাড়ির তেমন কেউই সেই ধাঁধার কোন মানে বার করতে পারেনি!
    টুসু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
    – কোথায় লেখা আছে সেই ধাঁধাটা…একবার দেখান…
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু মৃদু হেসে বললেন,
    – উনি লিখে তো গিয়েছিলেন উনার এক পুরনো ডাইরির পাতায়, কিন্তু সেটা নিয়ে আসার কোন দরকার নেই, কারণ এতদিন শুনে শুনে আমার সেটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। শোনো, বলছি…

    “পূর্ণতারার বেশে বানি,
    কলানিধির রঙে জানি,
    বুঝিতে যাহার পারিবে মন,
    তাহারই হইবে সকল ধন।”

    (৪)
    টুসু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো সেই ধাঁধাটার সম্বন্ধে। শেষের দু’টো লাইন তো যে কেউ পড়ে বুঝতে পারবে, যে সেই জমিদার বলতে চেয়েছেন যে আগের দুটো লাইনের অন্তর্নিহিত অর্থ যে বুঝতে পারবে, সেই হবে এই গুপ্তধনের মালিক। কিন্তু মুশকিল তো এই আগের দু’টো লাইন “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” নিয়ে। এই দু’টি বাক্যের মানে যে টুসুর একটুও বোধগম্য হচ্ছে না! ঠিক এমন সময়, গৈরিক প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো,
    – ধাঁধার কথা না হয় বুঝলাম, শ্যামাপ্রসাদ বাবু। তবে আপনি এই কথাও বলেছিলেন, যে এই বাড়ির কোন ছেলে নাকি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে…

    শ্যামাপ্রসাদ বাবুর সুন্দর ফর্সা মুখটা যেন বেদনায় ভরে উঠলো, তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,
    – হ্যাঁ গৈরিক বাবু, সেটাই তো সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা এই বাড়ির। আসলে, বেশ কয়েক মাস ধরে এই বাড়ির একটা ঘরে সুজয় বোস নামক একটি ছেলে ভাড়া থাকছিলো। সে ছিল আমার দাদার ছেলে বসন্তের বন্ধু। সুজয় আর বসন্ত একসাথেই পদার্থবিদ্যা নিয়ে এম.এস.সি. করেছে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। তারপর দু’জনেই এই কলকাতার একটি বেশ বড় রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করবার সুযোগ পায়। সুজয়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের একটি মফস্বল গ্রামে, তাই সে আমাদের বাড়িতে ভাড়া থেকে নিজের রিসার্চের কাজ করতো। কিন্তু…

    এবার যেন কিছু বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু। গৈরিক বলে উঠলো,
    – কি হল? থামলেন কেন, বলুন…
    অস্ফুট স্বরে শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলে উঠলেন,
    – ছেলেটা খুব ভালো ছিল জানেন মিস্টার সেন, আমাকে “কাকাবাবু, কাকাবাবু” বলে খুব সন্মান করতো, তাছাড়া পড়াশোনায়ও খুব ভালো ছিল। অতবড় একটা রিচার্স প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করার সুযোগ পাওয়া যে মুখের কথা নয়, এ নিশ্চয় আপনি বুঝতেই পারছেন। কিন্তু তার একটা দোষ ছিল…ছেলেটা ছিল ভীষণ জেদি। সে যবে থেকে শুনেছিলো ওই রূপমতীর ঘরের ভূতের গল্পের কথা, তবে থেকেই সে সমানে আমার কাছে আব্দার করে চলেছিলো, তাকে সেই ঘরের চাবি দেওয়ার জন্য। সে সায়েন্সের ছাত্র, ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তাই তার খুব ইচ্ছা একবার ওই ঘরে ঢুকে প্রমাণ করে দেওয়ার, যে ওখানে কিচ্ছু নেই!…তাই, কয়েকদিন আগে, একরকম বাধ্য হয়েই আমি রূপমতীর ঘরের চাবিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম…আর সেটাই ওর জীবনের কাল হয়ে গেল!

    টুসু অধীর আগ্রহে বলে উঠল,
    – কি হয়েছিল তারপর? সুজয় কি ওই ভূতের ঘরে গিয়েছিলো?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
    – হ্যাঁ ঐন্দ্রিলা, সে গিয়েছিলো, তারপর আবার অক্ষত শরীরে হাসিমুখে বেরিয়েও এসেছিলো সেই ঘর থেকে। কিন্তু সেই ভূতের প্রকোপ শুরু হল তার পর দিন থেকেই! সুজয়েরও জমিদার রমনীমোহন মল্লিকের মত ডাইরিয়া আর রক্তবমি হওয়া শুরু হল…আমরা ওকে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম, কিন্তু কোন ফল হল না! এত অল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তাররা ওর অসুস্থতার সেরকম কোন কারণই বার করতে পারলেন না, এবং আজ সকালেই খবর এল, যে সেই তরতাজা ছেলেটা আর আমাদের মধ্যে নেই!
    একবার নিজের সুদৃশ্য সোনালী ফ্রেমের চশমাটা খুলে, নিজের দুই চোখ মুছলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, তারপর কান্না ভেজা গলায় বললেন,
    – ছেলেটা এই কটা দিনে যেন এই বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছিল, গৈরিক বাবু…কেনই বা ওই ঘরে যাওয়ার ভূত চাপল ওর মাথায়, আর এ কি হয়ে গেল!
    টুসু যদিও বা ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তবুও ওর কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগলো এই কথা শুনে। সত্যিই তো, একটা জোয়ান ছেলের এই নিদারুণ পরিণতির কি কারণ হতে পারে? তাও আবার তার মৃত্যুটাও হয়েছে সেই লম্পট জমিদারের মতই!

    গৈরিক আবার প্রসঙ্গ পাল্টে, শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো,
    – সুজয়কে হত্যা করা বাদ দিয়ে, রূপমতীর প্রেতাত্মার এই বাড়িতে উপস্থিতির আর কোন প্রমাণ কি পেয়েছিলেন আপনারা?
    এবার যেন আরো ভয় পেয়ে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে তিনি বললেন,
    – দাঁড়ান গৈরিক বাবু, আপনি সেই সব কথা একবার এই বাড়ির লোকেদের মুখ থেকেই শুনে নিন…
    এই বলে তিনি সেই বাড়ির চাকরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন,
    – যাও, একবার অপর্ণা দিদিমণি আর শ্রীতমা দেবীকে ডেকে নিয়ে আসো তো…এই বাবুরা ওদের সাথে কিছু কথা বলতে চান…
    এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে প্রবেশ করলো দুইজন নারী। একজন হল বছর পঁচিশের এক সুন্দরী তরুণী, এবং অন্য জন হল এক সাধারণ চেহারার মাঝ বয়সী মহিলা। সেই অল্প বয়সী তরুণী এবার শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
    – কি গো বাপি, ডাকছিলে আমাকে…
    আর সেই মাঝ বয়সী মহিলাও বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে।

    শ্যামাপ্রসাদ বাবু এবার ওদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন,
    – আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ও হল আমার একমাত্র মেয়ে অপর্ণা। আর আপনাকে তো বলেই ছিলাম গৈরিক বাবু, যে আমার দাদা এখন মুমূর্ষ এবং শয্যাশায়ী, তার স্ত্রী গত হয়েছে প্রায় দুই বছর হল। তাই তার সারা দিনের দেখাশোনার জন্য আছেন ওই শ্রীতমা দেবী…উনি এই বাড়ির আয়া।
    তারপর তিনি অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবীকেও গৈরিক আর টুসুর পরিচয় দিয়ে বললেন,
    – ওনাদেরকে একবার বলো, যে এই বাড়িতে তোমরা কি কি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছো…
    সবার প্রথমে মুখ খুললো অপর্ণা, সে বেশ আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
    – আমার ঘরও এই বাড়ির নিচের তলায়…ওই ভূতের ঘরের কয়েকটা ঘর পরে…ওই ঘরে কোন অশরীরি শক্তির উপস্থিতির কথা সব থেকে বেশি আমিই উপলব্ধি করেছি, গৈরিক বাবু!
    গৈরিক বেশ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো,
    – বেশ, কি কি উপলব্ধি করেছেন তা একটু শুনি, অপর্ণাদেবী।
    অপর্ণা ভয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে উঠলো,
    – প্রায় রাতে ওই ঘরে কারোর চলা ফেরার আওয়াজ শুনতে পাই আমি…আর মাঝে মাঝে তো হালকা হালকা নুপুরের ধ্বনিও ভেসে আসে ওই ঘর থেকে!

    ওর কথা শেষ না হতেই শ্রীতমা দেবী আরো আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
    – আমি তো চব্বিশ ঘন্টা এই বাড়িতেই থাকি গৈরিক বাবু, কি বলব বলুন, নেহাত পেটের দায়ে এই কাজ করা, নাহলে কি থাকতাম এই ভুতুড়ে বাড়িতে! হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম, এই কিছুদিন আগে রাত্রে একদিন ঘুম আসছিলো না, তাই বাড়ির নিচের তলার বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। বুঝতেই পারিনি, যে মনের ভুলে কখন ওই অভিশপ্ত ঘরটার কাছে চলে এসেছি! তবে বুঝতে পারলাম তখন, যখন কানে সেই নুপুরের শব্দর সাথে সাথে, কি যেন একটা ভাষায় একটা হালকা গানের আওয়াজও ভেসে এল! আমি সাহসে বুক বেঁধে একবার ওই ঘরের বন্ধ দরজার দুই পাল্লার ফাঁকে চোখ রাখলাম…অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম…স্পষ্ট দেখলাম যে, ওই ঘরের ভেতর একটা ছায়ামূর্তি এই দিক থেকে সেই দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…আমি তো কোন মতে রাম নাম করতে করতে দে ছুট!…পরে জেনেছিলাম, যে ওই গানের ভাষা ছিল রাজস্থানী! মানে, যে ভাষায় গান গেয়ে ওই বাইজি রাজ দরবারে নাচ দেখাত, আর কি!

    টুসু আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইল, এদিকে অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী যেন দু’জনেই এক সাথে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
    – এই বাড়িতে কিছু আছে, গৈরিক বাবু…আমাদের সকলের উপলব্ধি কখনো ভুল হবে না…কিছু তো একটা আছেই এই বাড়িতে!

    ঠিক এমন সময় সকলের চিন্তার ঘোর কাটিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর মোবাইল ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে কেমন যেন বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভ্রু। ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কানে রেখে হঠাৎ স্থান কাল পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি,
    – আপনাকে তো বলেই দিয়েছি, যে আমি বা দাদা এই বাড়ি বিক্রি করতে রাজি নই, তাহলে কেন বার বার ফোন করে বিরক্ত করেন আপনি…না অত লাখ টাকা দিলেও নয়…কি বলছেন, আপনি কি আমায় থ্রেট করছেন নাকি মশাই…ঠিক আছে, আমার বাড়িতে ভূত আছে কি পেত্নী আছে, তা আমি বুঝে নেব, আপনার কি?
    এই রকম কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কাটলো কিছুক্ষণ, তারপর তিনি ফোনটা নামিয়ে রেখে, ঘরের বাকি সবাই-এর দিকে চেয়ে লজ্জিত গলায় বললেন,
    – কিছু মনে করবেন না, মিস্টার সেন…আসলে এই প্রমোটার-টার ফোন আসলেই মাথাটা গরম হয়ে যায়!
    গৈরিক জিজ্ঞাসা করলো,
    – যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে জানতে চাই, যে কে এই প্রমোটার আর কি চাইছে সে?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন,
    – এই বদমাশটার নাম হল ঘনশ্যাম তিওয়ারী। ওর নজর আছে আমাদের বাড়িটার ওপর। দিনরাত শুধু আমাকে বলে বাড়িটা বিক্রি করার কথা, বলে নাকি ভালো দাম দেবে সে আমায়। তারপর এখানে একটা বহুতলী ফ্ল্যাট বানাবে…কি আস্পর্ধা দেখুন, বলছে যে ওই ভূতের বাড়িতে আপনারা আর ক’দিনই বা থাকতে পারবেন!…আমি তো স্পষ্ট ওকে মানা করে দিয়েছি…
    টুসু দেখল, যে গৈরিকের মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল এই কথা শুনে। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
    – ঠিক আছে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু, বুঝলাম আপনাদের সব কথা। তবে এই কেসটাকে নিতে গেলে কিন্তু এই বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে।
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু মিষ্টি হেসে বললেন,
    – সে আর বলতে, গৈরিক বাবু, এই বাড়িতেই আপনাদের থাকার সমস্ত বন্দোবস্ত আমি আগে থেকেই করে রেখেছি!

    (৫)
    মল্লিক বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিকের একেবারে কোণে যে বড় ঘরটা রয়েছে, সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গৈরিক আর টুসুর। টুসুর একটু ভয় ভয়ই লাগছিল এই বাড়িতে তার প্রথম রাত কাটাতে। তবে যখন পাশের বিছানাতেই তার গেরোদা রয়েছে, আর যাই হোক, ভূত এই ঘরে ঢুকে তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই টুসু দেখল, যে তার গেরোদার বিছানা শূন্য, সে মনে মনে ভাবলো, যাহ বাবা, এত সকাল সকাল গেরোদা গেল কোথায়!…কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলো গৈরিক, সে বেশ গম্ভীর মুখে সেই ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
    – কি গো, এত সকালে কোথায় গিয়েছিলে?
    গৈরিক সংক্ষেপে বলে উঠলো,
    – এই বাড়িটার আশে পাশের চারদিকটা একটু ঘুরে দেখে এলাম…
    টুসু বেশ অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,
    – ও আচ্ছা, তা যাওয়ার আগে বুঝি আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যেতে নেই?
    গৈরিক মুচকি হেসে, গলায় কৃত্রিম উত্তেজনার ভাব এনে বলে উঠলো,
    – আজ সকালে তো সেরকম কিছুই হয় নি, কিন্তু কাল রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি যা দেখলাম…ওরে বাপ রে!
    টুসু উত্তেজনায় চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
    – ও মা, সে কি! কি দেখেছ তুমি কাল রাতে? বলো না…
    এবার গৈরিক আর ঠাট্টা ইয়ার্কি না করে, বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
    – অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী কাল যা বললো, তা কিন্তু ভুল কথা নয় রে টুসু…ওই কারোর চলা ফেরা করার শব্দ, নুপুরের আওয়াজ, রাজস্থানী গান…এই সব কাল আমিও শুনেছি ওই ভূতের ঘরের দরজার বাইরে থেকে! এই কথা ঠিক, যে কিছু না কিছু অদ্ভুত জিনিস কিন্তু ঘটছে ওই ঘরের ভেতর!
    এবার টুসু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
    – আর সেই ছায়ামূর্তি? তাকে দেখতে পেয়েছ তুমি?
    গৈরিক কোন উত্তর দিল না সেই কথার, কি যেন ভেবে চলল সে নিজের মনে।

    ঠিক সেই সময়, ওদের ঘরে এল ফর্সা, রোগা, মাঝারি উচ্চতার, বছর ছাব্বিস সাতাশের এক যুবক। সে হাসিমুখে ওদেরকে বলে উঠলো,
    – গুড মর্নিং গৈরিক বাবু আর ঐন্দ্রিলা, আপনাদের জুটির প্রশংসা তো আমি অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি। ও বাই দা ওয়ে, আমি বসন্ত মল্লিক…আমাকে কাকাবাবু আপনাদের ডেকে পাঠাতে বললেন ব্রেক ফাস্ট-এর জন্য…
    ওর কথা শেষ না হতেই গৈরিক ওকে বলে উঠলো,
    – গুড মর্নিং বসন্ত বাবু, একটা কথা বলুন, এই সুজয় বলে ছেলেটা তো আপনার খুব ভালো বন্ধু ছিল, আপনারা এক সাথেই রিসার্চের কাজ করতেন…ওর মৃত্যুর পেছনে কি আপনার কারোর ওপর কোন সন্দেহ হয়?
    বসন্ত সকাল সকাল এই প্রশ্ন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তাও সে একবার ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
    – কেন, আপনাদের কাকাবাবু বলেন নি, যে ওই বাইজির ঘর থেকে কি সব ভৌতিক আওয়াজ পাওয়া যায়…ওটা একটা অভিশপ্ত ঘর…আমাদের সকলের বারণ সত্ত্বেও সুজয় ওই ঘরে ঢুকেছিল, তাই হয়তো ওকে এই ভাবে মরতে হল!
    গৈরিক এবার দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,
    – সেই ভূতের আওয়াজ আমি গতকাল রাতে পেয়েছি, আর আজকে রাতেও একবার পেতে চাই, বসন্ত বাবু…কিন্তু তার আগে, আপনি একবার আপনার কাকাবাবুকে গিয়ে বলুন, যে সুজয়ের মতই, আমরাও একবার ওই রূপমতী বাইজির ঘরে ঢুকতে চাই, তাই সেই ঘরের চাবিটা যেন আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়!
    বসন্তের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে চম্পট দিল সেখান থেকে। কিছুক্ষম পর, সেই বাড়ির চাকর এসে কাঁপা কাঁপা হাতে গৈরিককে দিয়ে গেল সেই অভিশপ্ত ঘরের চাবি!

    অনেক দিনের পুরোনো মরচে পড়ে যাওয়া তালাটা খুলে, একটা বিকট শব্দ করে যখন গৈরিক সেই বাইজির ঘরের দরজার পাল্লা দু’টো খুলে ফেলল, তখন টুসুর হৃদ স্পন্দন একটু হলেও দ্রুত হয়ে উঠেছিলো! ঘরটা মাঝারি আকারের। তার ভেতরে ঘুলোর আস্তরণ আর মাকড়সার জাল দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো, যে এই ঘরে কত দিন কেউ পা মাড়ায়নি। ঘরের ভেতরে ছোট খাটো আসবাসপত্রের মধ্যে চোখে পড়ে একটা অবহেলিত সুবৃহৎ সেগুন কাঠের খাট। ধুলো ভর্তি ছেঁড়া তোষক আর চাদর এখনো রয়েছে তার ওপর। এর ওপরই বোধহয় রূপমতীর মৃতদেহটা পড়ে ছিল কোন এক কালে!…ভয়ার্ত চিত্তে ভাবল টুসু…আর তাছাড়া একটু দূরেই রাখা রয়েছে একটি তালা লাগানো লোহার সিন্দুক…এর মধ্যেই নিশ্চয় সে নিজের গহনা-গাটি রেখে দিতো, আবার ভাবল টুসু! কিন্তু সেই ঘরে সব চেয়ে দেখার মত বস্তু হল রূপমতীর একটা তৈলচিত্র, এত বছর পর, এত ধুলো বালি জমে গিয়েও, তার সৌন্দর্যে যেন একটুও ভাটা পড়ে নি! কে জানে, কে এঁকে ছিল এই ছবিটা, কিন্ত এই কথা ঠিক, যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলো এই বাইজি! টুসু এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিল রূপমতীর রূপ দেখে, যে সে বুঝতেও পারলো না, যে গৈরিক সেই খাটের নিচ থেকে কি যেন একটা রূপোর মত জিনিস তুলে নিয়ে, গম্ভীর মুখে, সেটাকে নিজের পকেটে চালান করলো! কিছুক্ষণ পর ওরা দু’জনেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

    সেদিন সন্ধ্যে বেলায় টুসু মল্লিক বাড়ির দোতলায় বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে উদাস মনে রূপমতীর কথা ভেবে চলেছিলো, এমন সময় তার কাছে এলেন শ্রীতমা দেবী। তিনি ফিস ফিস করে টুসুকে বলতে লাগলেন,
    – শোনো ঐন্দ্রিলা, তোমাকে একটা কথা বলি…তুমি যেন আবার পাঁচ কান করো নাকো…
    টুসু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
    – কি কথা বলুন তো?
    শ্রীতমা দেবী একবার দুই পাশটা দেখে নিয়ে, আবার ফিস ফিস করে বলে উঠলেন,
    – এই সুজয় ছেলেটা কিন্তু খুব একটা চরিত্রবান ছিল না…শ্যামাপ্রসাদ বাবু ওর সম্বন্ধে কিছুই জানেন না…জানো, কয়েকদিন আগে আমি গোপনে দেখেছিলাম, যে এই সুজয় আর বসন্তের মধ্যে সে কি ঝগড়া!
    টুসু বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো,
    – কেন? কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ওদের মধ্যে?
    শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
    – আরে, বসন্ত নাকি কোন ফাঁকে দেখে ফেলেছিল, যে সুজয় নাকি অপর্ণার সঙ্গে…

    কিন্তু সেই সময় হঠাৎ পেছন থেকে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে চুপ করে গেলেন শ্রীতমা দেবী। সেই পদ-ধ্বনি আর কারোর নয়, স্বয়ং গৈরিকের। গৌরিক বেশ খোস মেজাজেই শ্রীতমা দেবীকে বলে উঠলো,
    – সুজয় আর বসন্তের ঝামেলার কথা না হয় বুঝলাম, শ্রীতমা দেবী…কিন্ত আপনি এবার আমাকে একটা কথা বলুন, আজ দুপুরে আপনি বাড়ি যাওয়ার নাম করে ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন এই বাড়ি ছেড়ে?
    শ্রীতমা দেবী ভয়ার্ত মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অগত্যা, গৈরিকই বলে উঠলো,
    – ঠিক আছে আমিই বলে দিই…বুঝলি টুসু, আমি আজ দুপুরে আবার সেই ব্যাংকে গিয়েছিলাম একটা কাজে…বেরনোর সময় দেখলাম, যে গুটি গুটি পায়ে শ্রীতমা দেবী বেরিয়ে এলেন পাশেই অবস্থিত প্রমোটার ঘনশ্যাম তিওয়ারীর অফিস থেকে! তা আপনার সেখানে যাওয়ার হেতু কি, শ্রীতমা দেবী?
    শ্রীতমা দেবী ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে, সেই মুহূর্তে সেখান থেকে কেটে পড়লেন!

    (৬)
    রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও, গৈরিক আর টুসু বেশ উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপমতীর ঘরের বাইরে, সেই ঘরের তালা বন্ধ দরজার কাছেই। সেই রাজস্থানী ভাষায় মেয়েলি কণ্ঠের গুঞ্জন আর নুপুর পায়ে কারোর নৃত্য করার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে! গৈরিক টুসুকে অবাক করে ছুটে গেল দরজার কাছে, তারপর ক্রমাগত দরজায় বারি মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
    – রূপমতী ম্যাডাম, আমাদের কাছে কিন্তু এই ঘরের চাবি আছে, আমরা এখনই এই ঘরের দরজা খুলে ভেতরে আসছি! এই বাড়িতে এলাম আর দেখে যাবো না, যে আপনার কত সুন্দর রূপ ছিল!
    কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত আওয়াজ! টুসু ছুটে গিয়ে চাবিটা দিয়ে সেই ঘরের তালা খুলতে উদ্যত হলে, গৈরিক তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
    – ওই ঘরের ভেতর এখন আর কাউকে পাবি না…তবে সত্যিই যদি ওই সুন্দরীকে দেখতে চাস তাহলে আমার সাথে আয়!

    এই বলে গৈরিক ছুটতে লাগলো একতলার বারান্দা দিয়ে, যেতে যেতে মোবাইলে স্থানীয় থানার ওসির নাম্বারটা ডায়াল করে কানে রাখলো ফোনটা। তার পেছনে পেছনে ছুটে চললো টুসু! ওরা সোজা মল্লিক বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে একেবারে বাড়ির পেছনে, জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত একটি জায়গায় এসে, একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই, পেছনের একটা ভাঙা দেওয়ালের কাছ থেকে আসতে লাগল সেই নুপুরের আওয়াজ, তবে সেই গান কিন্তু এখন আর হচ্ছে না!…একটা ছায়ামূর্তি যেন সেই পোড়ো দেওয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে এই অন্ধকারে…সে একটু কাছে এলেই গৈরিক ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো তাকে, এক টানে খুলে নিল তার মুখে জড়ানো চাদর…টুসু অবাক হয়ে দেখলো, যে সেই “রূপমতী” আর কেউ নয়, এই বাড়ির ছেলে বসন্ত!…এক হাতে সে ধরে আছে দু’টো রূপোর নুপুর, আর অন্য হাতে ধরা তার স্মার্টফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনে এখনো দেখা যাচ্ছে, যে মিউজিক প্লেয়ার-এ পস করা আছে একটি রাজস্থানী গানের টিউন!…এমনই সময় বাড়ির কাছেই শোনা গেল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ।

    পুরো টিম নিয়ে থানার ও.সি. এবং মল্লিক বাড়ির সকলেই সেখানে হাজির হলে, গৈরিক সকলকে নিয়ে গেল সেই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে। তারপর নিজের মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে, সেই দেওয়ালের নিচের দিকে, কয়েকটা আগাছাকে পা দিয়ে সরিয়ে দিতেই, সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! দেওয়ালের গোড়ার দিকে, ওই ঝোঁ
    ঝোপের পেছনে, আছে একটি ছোট সুড়ঙ্গের মুখ, তার ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি! এর পর গৈরিকের নির্দেশে ওরা সবাই তখনই ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে, রূপমতীর ঘরে। তারপর গৈরিকের কথায়, চারজন পুলিশ কনস্টেবল সেই ঘরের সেগুন কাঠের খাটটিকে সরিয়ে ফেলতেই, সবাই আবার অবাক হয়ে গেল। যে জায়গায় খাটটা রাখা ছিল, ঠিক তার নিচে একটা বেশ বড় ফাটল, তারও নিচ দিয়েও নেমে গিয়েছে সিঁড়ি। কাছেই রাখা আছে একটি কাঠের চাকতি, যার রংটা পুরো ঘরের মেজের রং-এই! বোঝাই যাচ্ছে, যে সেই ফাটলের মুখের ওপর এই কাঠের চাকতিটি খাঁজে খাঁজে আটকে যাওয়ার পর, খুব একটা কেউ বুঝতেই পারবে না, যে এই ঘরের নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে!

    গৈরিক শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
    – এই ঘরের নিচে থাকা সুড়ঙ্গের অপর মুখ বাড়ির বাইরে, ওই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে, যা আপনারা একটু আগেই দেখে এসেছেন…এই ব্যাপারে না আপনি জানতেন, না রূপমতী, না বাড়ির অন্য কেউ…শুধু জানতে পেরেছিল বসন্ত! আর এই পথ দিয়েই সে বাইরে থেকে তালা বন্ধ ঘরটির ভেতরে ঢুকতো প্রায় রাতে…আর ওই নুপুরের ধ্বনি আর রাজস্থানী গানের আওয়াজের মত সস্তা বাজার চলতি পন্থাগুলো দিয়ে, সে যে কিভাবে আপনাদের ভয় দেখাতো, তা আর নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না!
    বসন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, শ্যামাপ্রসাদ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
    – কিন্তু কেন করতো ও এই সব?
    গৈরিক মৃদু হেসে বলে উঠল,
    – বসন্ত আর সুজয় রিসার্চের কাজ করতো তেজস্ক্রিয় ধাতু পোলোনিয়াম নিয়ে…এই কথা আমি ওদের রিসার্চ প্রতিষ্ঠান থেকে খোঁজ নিয়েই জানতে পেরেছি। ওদের রিসার্চ গাইড আমাকে বলেন, যে বেশ কিছুদিন থেকে ল্যাবে আনা পোলোনিয়াম-এর অধিকাংশই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…এবং এই পোলোনিয়াম-এরই একটি টুকরো যখন আমি আজ সকালে এই ঘর থেকে পেলাম, আর বাড়ির পেছনের ওই সুড়ঙ্গটাকেও আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে বাড়ির চার পাশটা দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তখন আর আমার বুঝতে বাকি রইল না, যে বসন্তই ল্যাব থেকে পোলোনিয়াম চুরি করে, এই সুড়ঙ্গের পথে এসে সেগুলোকে রূপমতীর ঘরে লুকিয়ে রাখতো, ভূতের ভয়ে যাতে এই কথা আর কেউ জানতে না পারে। আর সেই ভয়কে আমাদের মনে আরো জোরালো করতে, সে আজকের মতই, প্রায় রাতে ওই পথ দিয়েই এই ঘরে ঢুকে এই ভাবে “ঘুমার” নাচন দেখাত…হা হা হা…তবে আমি আসার পর হয়তো সে চুরি করা মালের পুরোটাই সরিয়ে ফেলেছে এই ঘর থেকে, শুধু ভুল বশতঃ ফেলে রেখেছিল সেই ধাতুর একটি ছোট টুকরো! এই ধাতুকে এখন বিভিন্ন দেশে স্মাগল করা হচ্ছে, মূলতঃ নিউক্লিয়ার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর নিউক্লিয়ার অস্ত্রে এর ব্যবহারের জন্য…তবে, বসন্ত ল্যাব থেকে চুরি করে এই ঘরে লুকিয়ে রাখা পোলোনিয়াম কাদেরকে বেচতো, সেই কথা তার মুখ থেকে বার করার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের…আমার নয়!

    একটু থেমে, বসন্তের দিকে চেয়ে, আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
    পোলোনিয়াম এমনই একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু, যা থেকে আলফা রশ্মি নির্গত হয়। এই আলফা রশ্মি মানুষের চামড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে না। তাই খুব একটা সুরক্ষা ছাড়া খালি হাতে এই ধাতুকে ধরলে তেমন কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে এই ধাতুর জলে দ্রাব্য কিছু লবন যেমন পোলোনিয়াম সাইট্রেট বা পোলোনিয়াম নাইট্রেট যদি মানুষের খাবারের সাথে তার শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত! আর সুজয়ের পোস্ট-মোর্টেমে সেই কথাই উঠে এসেছে, আমার বলে দেওয়া কিছু স্পেশাল টেস্ট করে!…সুজয়কে আপনি কেন খুন করলেন বসন্ত বাবু?
    বসন্ত মাথা নিচু করে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
    – আমার অজান্তে, এই ঘরে ঢুকে ও দেখে ফেলেছিল এখানে রাখা ওই ধাতু…ওর আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে নি…ও আমার কাছ থেকে অনেক টাকা চাইছিলো মুখ বন্ধ রাখার জন্য। তাই সেদিন রাতেই আমি সবার চোখের আড়ালে ওর খাবারের মধ্যে পোলোনিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে দিই…
    ওর কথা শেষ না হতেই, অপর্ণা চিৎকার করে ছুটে গিয়ে সটান এক থাপ্পড় কষালো বসন্তের গালে! সেদিনই এরেস্ট করা হল বসন্তকে। ঠিক তখনই শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
    – আমার অসুস্থ স্বামীর অপারেশনের জন্য আমি দুই লাখ টাকা ধার করি ঘনশ্যাম তিওয়ারীর কাছ থেকে, সেই টাকা আমি তাকে মাসে মাসে শোধ করে যাচ্ছি….আজকে বিকালে সেই জন্যই গিয়েছিলাম তার অফিসে…আর অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য আমার যে ছিল না, তা এখন আপনার বুঝতেই পারছেন!

    (৭)
    এতক্ষন পর টুসু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
    – কিন্তু গেরোদা, সেই ধাঁধা আর সেই গুপ্তধন…
    গৈরিক এবার একটু মৃদু হেসে বললো,
    – এর জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা আর জীববিদ্যা থেকে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। রাজস্থানের কিষানগড়ে মহারাজা সাওন্ত সিংহ নামক এক রাজা ছিল। তার দরবারে গান গাওয়া এবং কবিতা আবৃতি করার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া নামক এক সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে আসেন সেই রাজার সৎ মা। সাওন্ত সিংহ তার প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ অবধি করেন। ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৪-এর মধ্যে, সেই রাজ দরবারের বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদ, রাজা সাওন্ত সিংহ-কে শ্রীকৃষ্ণের রূপে আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে শ্রীরাধিকার রূপে চিহ্নিত করে, তাদের অনেক ছবি আঁকেন। এই বিষ্ণুপ্রিয়াকে লোকে বলতো “বানি থানি”, রাজস্থানী ভাষায় যার অর্থ হল “প্রসাধনী আর অলঙ্কারাদিতে সুসজ্জিতা সুন্দরী নারী”।

    একটু থেমে একবার দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
    – এবার আসি ধাঁধায়… শ্রীরাধিকার এক হাজার নামের মধ্যে একটি হল “পূর্ণতারা”, “বানি” হল এখানে “বানি থানি” আর “কলানিধি” হল “চাঁদের” প্রতিশব্দ…তার মানে “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” কথাটার অর্থ হল: নিহাল “চাঁদের” রঙে আঁকা “রাধার” বেশে “বানি থানি”-র ছবি। শুনুন সকলে, এই ঘরের দেওয়ালে আটকানো এই তৈলচিত্রটি কিন্তু রূপমতীর নয়, এটা বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদের আঁকা রাধার বেশে “বানি থানি”-র ছবি, যার আর্থিক মূল্যর থেকেও তার ঐতিহাসিক বা নান্দনিক মূল্য অনেক বেশি…ওটাই হল আপনাদের বাড়ির আসল গুপ্তধন যার কথা জমিদার রমণীমোহন মল্লিক এই ধাঁধার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন! আমার বিশ্বাস, যেহেতু “বানি থানি” বাইজি থেকে রাজার স্ত্রী হয়ে উঠেছিল, তাই সেই ছিল রূপমতীর অনুপ্রেরণা, আর তাই এই ছবিটাকে সে এখানে নিয়ে আসে সুদূর রাজস্থানের কিষানগড় থেকে। সে নিজেও চেয়েছিল বাইজি থেকে রমণীমোহনের স্ত্রী হয়ে উঠতে, কিন্তু সেটা বোধহয় তার ভাগ্যে ছিল না!

    টুসুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে ভাবলো, যে সাধে কি আর লোকে বলে, “অতি বড় সুন্দরী না পায় বর!”

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    গুপ্তধন

    গুপ্তধন
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

    (১)
    কলকাতার একটি হাসপাতালের নামী কার্ডিওলজিস্ট, ডা: সুকল্যাণ বর্মণের চেম্বারে ভীত ত্রস্ত হয়ে বসেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব অসীম বাবু।

    অসীম বাবুর কুড়ি বছরের ছেলে শুভাশিস গত এক দুই দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি। শুভাশিসের হৃদয়ে জন্ম থেকেই একটি ফুটো বিরাজমান, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় Atrial Septal Defect. ছোটবেলা থেকেই বেশ কয়েকবার নানা শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে হয় তাকে, তারপরই তার দেহে ধরা পড়ে এই ভয়াবহ রোগ। তবুও ওষুধপত্রের ওপর নির্ভর করে জীবনের বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত করলেও, দুই দিন আগেই মাত্র কুড়ি বছর বয়সী এই যুবকের হৃদ-যন্ত্র সাময়িক ভাবে বিকল হয়ে যায়। সেদিন থেকেই সে ভর্তি এই হাসপাতালে।

    ছেলেকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন অসীম বাবু। তাকে নিয়ে সে তার অনেক স্বপ্ন। তাই তো নিজে একজন সামান্য একটি বেসরকারী সংস্থার কর্মচারী হয়েও, যথাসাধ্য পয়সা খরচা করে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন একটি নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। অসীম বাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় চার বছর আগে, তার পরিবার বলতে শুধু ছেলে শুভাশিস এবং তার বিরাশি বছরের বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবু। এদের নিয়েই উত্তর কলকাতার একটি রঙ চটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে সংসার তার।

    ছেলেকে নিয়ে নানা চিন্তায় ভোগেন অসীম বাবু। হৃদয়ের ওই রোগটা ধরা পড়ার শুভাশিসের কিছু মনস্তাত্বিক সমস্যাও শুরু হয়েছে।

    “জানো তো বাবা, তুমি আর দাদুকে ছাড়া এই বাড়িতে আমি মাঝে মাঝেই আরেকজন ব্যক্তিকে দেখতে পাই…সে সবসময় তোমার আশে পাশেই ঘোরে…কি যেন একটা কথা বলতে চায় তোমাকে!”

    প্রতিনিয়ত ছেলের এই কথাগুলো তার মনের নিরর্থক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিলেও, একবারের জন্যও যে তার গা ছমছম করে ওঠেনি, এমন নয়!

    “অসীম বাবু, আমার মনে হয় এভাবে আর শুভাশিসকে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না…”, ডা: বর্মণের কথায় চিন্তার ঘোর কাটলো অসীম বাবুর, “এবার কিন্তু সার্জারিটা না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে আপনার ছেলের!”

    “আপনি তো জানেনই স্যার, ওই সার্জারির জন্য দরকার দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা! কিন্তু আমার যা অবস্থা তাতে…”, সংকুচিত মুখে বলে উঠলেন অসীম বাবু, তবে কথাটা শেষ করার আগেই কান্নায় আটকে গেল তার গলা।

    “আমি জানি অসীম বাবু, কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও যে দেখতে পাচ্ছি না!” অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলেন ডা: বর্মণ, “ছেলেকে বাঁচাতে গেলে আপনাকে যে ভাবেই হোক টাকাটা জোগাড় করতেই হবে! সত্যি কথা বলতে গেলে এই যাত্রাই যে আমরা শুভাশিসকে বাঁচাতে পারবো, এটাই ছিলো আমাদের কল্পনাতীত! কয়েক ঘন্টার জন্য তো মনে হয়েছিলো যে সে আমাদের ছেড়ে চলেই গিয়েছে! কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবে তারপরই আবার ওঠানামা করতে লাগলো ই.সি.জি-র স্থির হয়ে যাওয়া লাইন! এই ধরণের Near Death Experience কিন্তু খুব কম পেশেন্টদেরই হয়…”

    তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই চেম্বারে প্রবেশ করলেন একজন নার্স। তিনি জানালেন যে শুভাশিসের জ্ঞান ফিরেছে, এবং সে তার বাবার সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অগত্যা এই আলোচনার ইতি এখানেই টানতে হল। অসীম বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন তার ছেলের বেডের উদ্দেশ্যে।

    (২)
    চিকিৎসার জন্য দরকারী হাজারো সরঞ্জামের মাঝে, বিছানায় শুয়ে বড় বড় চোখ মেলে শুভাশিস চেয়েছিলো তার বাবার পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। অসীম বাবু জল ভরা চোখে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন শুভাশিসের উস্কোখুস্কো চুলের মাঝে।

    “খোকা…কেমন আছিস খোকা?” কম্পিত গলায় বলে উঠলেন অসীম বাবু।

    “আমি আবার সেই লোকটাকে দেখেছি, জানো তো বাবা!”, উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিলো শুভাশিস।

    এই সময় ছেলের মুখে সবার আগে এই কথা শোনা একেবারেই আশা করেননি অসীম বাবু। তিনি শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন শুভাশিসের মুখের পানে। কেন জানি না, তার মন তাকে বার বার বারণ করতে লাগলো এবারও তার এই কথাগুলো নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে।

    “কি দেখেছিস তুই, খোকা?” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন অসীম বাবু।

    “প্রথমে মনে হল একটা মস্ত বড় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে একা একা চলেছি আমি…চারিদিকে ঘোর অন্ধকার!” উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো শুভাশিসের কন্ঠ, “কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম সুড়ঙ্গের ওই প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো আলো! আমি যেন দু’চোখ হাত দিয়ে ঢেকে আরো জোর কদমে ছুটে চললাম সেই দিকে। এরপর বুঝতে পারলাম ওই আলোর কারণ, যা আসছে সুড়ঙ্গের অপর মুখ থেকে। আমি এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম সুড়ঙ্গের বাইরে!…সেখানে তখন রৌদ্রজ্বল দিন, আমি যেন একটা জঙ্গলের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি…”

    কিছুক্ষণ থামলো শুভাশিস। অসীম বাবু অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ছেলের এই কল্পনা শক্তি দেখে। সে আবার বলতে শুরু করলো।

    “সেই জঙ্গলের চারিধারে বড় গাছপালা থাকলেও, তার মাঝে আছে একটা জলাভূমি। পেছনে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটি পুরোনো আমলের তৈরি বিশাল বড় বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সেই জলাভূমির মাঝে একটি সরু আলের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তিনি! ঠিক যেমনটা আগে দেখেছি..লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা, কাঁধে একটা ঝোলা!…আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে তিনি বললেন…”

    “কি বললেন তিনি তোকে, খোকা!” চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।

    “বললেন যে, এই যাত্রায় তোমাকে তোমার বাবার কাছে ফেরত পাঠালাম। তবে বারবার কিন্তু তা করা যাবে না। তাই ফিরে গিয়ে তোমার বাবাকে বোলো এই স্থানে আসতে, কারণ এখানেই আমি লুকিয়ে রেখেছি এমন একটি ‘গুপ্তধন’-কে, যা শুধু তোমার বাবারই প্রাপ্য! তার সাহায্যেই তিনি যোগাতে পারবেন তোমাকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলার খরচ!…ব্যাস, এরপর আর কিছুই দেখতে পেলাম না আমি!”, এতটা বলে থামলো শুভাশিস।

    এই শীতের দুপুরেও আতঙ্ক আর উত্তেজনায় অসীম বাবুর সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠলো। তিনি কম্পিত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “সেটা কোন জায়গা, খোকা? ওই ব্যক্তিই বা কে? আর কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তিনি গুপ্তধন?”

    “তা তো আমি জানিনা, বাবা!” অসীম বাবুকে নিরাশ করে শুকনো গলায় বলে উঠলো শুভাশিস।

    (৩)
    পরদিন সন্ধ্যা বেলায় সাত পাঁচ নানা কথা ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন অসীম বাবু। পয়সার অভাবে বাইক কেনা হয়নি, ভরসা শুধু সেই আদ্দিকালের সাইকেলটা। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, বৃষ্টি এলো বলে, ঝোড়ো হাওয়াও বইতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ ধরে। তাই অল্প সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি একটা শর্টকাট রাস্তা ধরলেন। অন্য সময় হলে তিনি হয়তো এই রাস্তাটা ধরতেন না, কারণ এটা দিয়ে যেতে গেলে একটি ছোটখাটো শ্মশানের মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। মূলতঃ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের প্রিয়জনদের শেষ কার্য সমাপন করবার জন্য এখানে আসেন।

    চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে, এদিকে হঠাৎ করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। তার মাঝেই কাকভেজা হয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছিলেন অসীম বাবু। বৃষ্টির জলের ঝাপটার সাথে কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ আসতে লাগলো তার নাকে। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, এবং তাতেই তিনি দেখলেন যে রাস্তার ওপাশে একটি আধপোড়া চিতা সাজানো রয়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই জ্বালানো হয়েছিলো মৃতদেহটিকে, এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে আশে-পাশের লোকজনেরা কেটে পড়েছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন অসীম বাবু, আরো দ্রুত গতিতে তিনি ঘোরাতে লাগলেন সাইকেলের প্যাডেল।

    ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকবার গর্জে উঠলো বজ্রবিদ্যুৎ, আর তার আলোতে পাশের চিতাটির দিকে তাকাতেই ভয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু। তাল সামলাতে না পেরে সাইকেল সমেত পড়ে গেলেন নীচে কাদাজলের মধ্যে। উঠে দাঁড়িয়ে দু’চোখ কোঁচলে আরেকবার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি চিতাটির দিকে…নাহ, এটা তার দেখার ভুল নয়! ওই তো, এখনো আধ-পোড়া মৃতদেহটা সটান উঠে বসে আছে কাঠগুলির ওপর! ধীরে ধীরে তার কালো ঝলসানো মুখমন্ডলটা যেন ঘুরে যাচ্ছে অসীম বাবুর দিকে…পোড়া ভ্রুর দুই ফাঁকের ভেতর চক্ষু কোটরে দৃশ্যমান তার সাদা মণিহীন চোখ!

    ভয়ে অসীম বাবুর স্বরযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ যেন বন্ধ হয়ে এলো, তিনি কোনো রকমে চিতাটির দিকে পেছন ফিরে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে একটি গাছের গায়ে এসে হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা খেলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি পেছন ফিরে চেয়ে দেখলেন, যে মাটিতে চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে তার দিকেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অর্ধ-দগ্ধ মৃতদেহটি। আতঙ্কের চোটে গাছটির গায়ে শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে সিঁটিয়ে রইলেন অসীম বাবু। ততক্ষণে এক লাফে মৃতদেহটি একেবারে তার সামনে চলে এসেছে।

    “মাগো!”, বলে তীব্র আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করলেন অসীম বাবু, পোড়া মাংসের গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠলো। ঠিক সেই সময় এক অচেনা পুরুষকণ্ঠের গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো তার কানে, বলা বাহুল্য তা বেরোচ্ছে সেই মৃতদেহটার মুখ থেকেই!

    “এখনো কি তুই অবিশ্বাস করবি যে আমি সব সময় তোর আশেপাশেই আছি? এখনো কি তোর ছেলের মুখ থেকে শোনা কথাগুলোকে উড়িয়ে দিবি কিশোর মনের নিছক কল্পনা ভেবে? তুই কি চাস না, যে সে সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠুক?”

    “কে তুমি? কেন সাহায্য করতে চাও আমায়? কোন ‘গুপ্তধন’ লুকিয়ে রেখেছো তুমি আমার জন্য? কোথায় গেলে পাবো আমি সেটা?”, চোখ বন্ধ রেখেই কম্পিত গলায় চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।

    “এই সকল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আসে ইতিহাসের পাতায়! অতীতের কারাগারে যে বন্দি হয়ে রয়েছি আমি! সেখানেই এতো বছর ধরে আগলে রেখেছি সেই ‘গুপ্তধন’-কে। তার সাহায্যে সুস্থ করে তুলতে হবে তোর একমাত্র বংশধরকে, আর মুক্তি দিতে হবে আমায়! সেই বিপুল ধন-সম্পত্তি শুধু যে তোর, কারণ আমি হলাম তোরই এক পূর্বপুরুষ!”

    এই কথা শুনেই বিস্মিত হয়ে চোখ খুললেন অসীম বাবু। কিন্তু ততক্ষণে তার সামনে আর কেউই দাঁড়িয়ে নেই! বৃষ্টির তেজও অনেকটা ধরেছে। অদূরেই পড়ে রয়েছে তার সাইকেলখানা। সাইকেলের ওপর বসে আরেকবার চিতাটির দিকে তাকালেন তিনি। সেখানেও কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে পারলেন না তিনি। তাহলে এতোক্ষণ ধরে তিনি যা দেখলেন, যা শুনলেন, সবটাই কি তার মনের ভুল!

    (৪)
    সেদিন বাড়ি ফিরে সম্পূর্ণ ভেজা শরীরেই অসীম বাবু এগিয়ে গেলেন তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবুর ঘরে। ঝড় বৃষ্টি হবার দরুণ এখন বোধহয় লোড-শেডিং চলছে। অন্ধকার ঘরে ছোট্ট একটা কুপি জ্বলছে। নিজের বিছানায় শান্ত চিত্তে শুয়ে রয়েছেন বৃদ্ধ।

    “বাবা!” অসীম বাবুর ডাক শুনে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন কালীপদ বাবু।

    “বাবা, ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে অনেকবার যে প্রশ্ন করেও তোমার মুখে কোনো সদুত্তর পাই নি, সেই প্রশ্নই আবার করতে এসেছি! কারণ সেটা যে আজ আমার জানার খুব দরকার, বাবা…দরকার তোমার একমাত্র নাতীকে বাঁচানোর জন্য!” কান্নায় ধরে এলো অসীম বাবুর গলা। এরপর তিনি তার পিতার কাছে সব কথা এক এক করে খুলে বলতে শুরু করলেন। সব শুনে কালীপদ বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তার ছেলের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে।

    “তোমার বংশ পরিচয় কি, বাবা? তোমার পিতা মাতার নাম কি? কোথায় থাকতেন তারা? কেন তাদের একটিও ছবি এতো বছরেও আমার চোখে পড়েনি…বলো, আজ তোমাকে উত্তর দিতেই হবে এই প্রশ্নগুলোর!”, উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন অসীম বাবু।

    জানলার বাইরে থেকে আসা হাওয়ার দাপটে কেঁপে উঠলো কুপির অগ্নিশিখাটি, আলো আঁধারের এক অদ্ভুত রহস্যময়তা খেলে গেল কালীপদ বাবুর মুখে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন কালীপদ বাবু, তারপর ধরা গলায় বলে উঠলেন, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে আমার কাছেও নেই রে! এতদিন তোর খারাপ লাগবে ভেবে কিছু বলিনি, কিন্তু আজ আর কোনো কিছু গোপন করবো না!…আমি যে নিজেও জানিনা আমার পিতৃ মাতৃ পরিচয়, কারণ আমি যে শৈশব থেকে বড় হয়েছি কলকাতার এক অনাথ আশ্রমে!”

    গোটা আকাশটা যেন ভেঙে পড়লো অসীম বাবুর মাথায়, তিনি স্তম্ভিত মুখে শুধু চেয়ে রইলেন বৃদ্ধের দিকে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে চললেন কালীপদ বাবু।

    “সেই অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের মুখেই শুনেছি, নদীয়ার বীরনগর গ্রামের এক জঙ্গল থেকে আমাকে খুঁজে পায় এই আশ্রমেরই এক কর্মচারী। তখন কতই বা বয়স হবে আমার, দু-তিন মাস! সারা গ্রামে খোঁজ নিয়েও সে আমার পরিবারের কারোর হদিস পায় না। বাধ্য হয়েই সে আমায় কলকাতা নিয়ে এসে আশ্রমের হাতে সঁপে দেয়। এখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা। তারপর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরিটা পাবার পর, অনেক কষ্টে এই বাড়িটা তৈরি করলাম। বিয়ে করলাম, তুই এলি আমাদের কোলে…”

    আরো কত কিছু নিজের মনেই বলে চললেন কালীপদ বাবু, সে সব কথা যেন অসীম বাবুর কানেই ঢুকলো না। তিনি শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নদীয়ার বীরনগর গ্রাম! তার মানে সেখানে গেলেই কি আমি পাবো আমার সকল প্রশ্নের উত্তর?”

    ঠিক তখনই তার চোখ চলে গেল অদূরে, ঘরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে কুপির কম্পমান আলোয় তার আর কালীপদ বাবুর ছায়া ছাড়াও আরেকটি তৃতীয় পুরুষমূর্তির ছায়া বিরাজমান! মনে হল যে যেন অসীম বাবুর এই নিজের উদ্দেশ্যে করার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!

    (৫)
    পরদিন অসীম বাবু শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে রাত নটা নাগাদ পৌঁছলেন বীরনগর স্টেশনে। শুভাশিসের দেখা সেই জঙ্গল, জলাভূমি আর পরিত্যক্ত বাড়িটার বর্ণনা দিতেই, একজন স্থানীয় লোক বলে উঠলেন,
    “ওহ বুঝেছি…আপনি বোধহয় সেন বাড়ির কথা বলছেন! দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ওরা এখানকার জমিদার ছিলো। এখন ওদের বংশধরেররা সব অন্যত্র বসবাস করে। তাই ওই বাড়িতে এক বুড়ো কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ থাকে না… তা আপনি সেখানে কেন যেতে চান মশাই? জায়গাটা ভালো নয়, বুঝলেন!”

    এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি অসীম বাবু, শুধু সন্দিগ্ধ লোকটির কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন স্টেশন থেকে সেন বাড়ি যাওয়ার পথ-নির্দেশটা। শীতের রাতে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে তিনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলেন গ্রামের শেষ প্রান্তে, একেবারে সমস্ত লোকালয়ের চিহ্নের অগোচরে।

    এই চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাঁচ মহলা জমিদার বাড়িটিকে। এখন এখানে আর তেমন কেউ বসবাস করে না, করার পরিস্থিতিও নেই। সামনের গেটের ওপরের সিংহের মূর্তিটা যেন এখনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে অসীম বাবুর দিকে। অধিকাংশই ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এই বাড়িটার কোথাও এতটুকু সিমেন্ট-বালি আস্ত নেই, তা কবেই খসে গিয়ে বুকের পাঁজরের মত বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো ইঁটের সারি। বিশাল বড় উঠোনের চারিপাশে দোতলা বাড়িটার অধিকাংশ ঘরেরই ছাদ ধসে পড়েছে। সামনের পরিত্যক্ত ঠাকুর দালানটি কত বছর ধরে হয়তো বঞ্চিত ঢাকের আওয়াজ থেকে।

    “কাকে চায়!”, পেছন থেকে হঠাৎ এই কথা শুনে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। কুপি হাতে, চাদর গায়ে আর মাথায় মাংকি টুপি পরিহিত এক বৃদ্ধ ব্যক্তি এগিয়ে এলো তার দিকে। এই হল এখানকার কেয়ারটেকার, বুঝলেন অসীম বাবু।

    “আসলে বড্ড মুশকিলে পড়েছি, মশাই”, কাকুতির স্বরে বলে উঠলেন অসীম বাবু, “এই গ্রামে এসেছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়িতে, ফিরতি পথে রাস্তা ভুল করে এখানে চলে এসেছি। এখন তো শেষ ট্রেনটারও ছাড়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে ফিরতেও পারবো কিনা সন্দেহ…যদি কিছু মনে না করেন, আজকের রাতটা কি এই বাড়িতে থাকা যাবে?”

    সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অসীম বাবুর দিকে, তারপর কুপির আলোয় তার মুখটা ভালো করে দেখে বললেন, “ঠিক আছে, আসুন!”

    রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে এই জমিদার বংশের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে চলড়ছিলো সেই কেয়ারটেকার। এমনই কথা প্রসঙ্গে সে বলে উঠলো, “আসলে কি জানেন মশাই, এই সব পয়সাওয়ালা মানুষদের পরিবারে কোনো না কোনো পাপ লেগেই থাকে। সেটা কোন সাল ছিলো যেন…হ্যাঁ, ১৯৩৮, তখন এই পরিবারের কর্তা রায়বাহাদুর কৃষ্ণমোহন সেন ছিলেন এই গোটা গ্রামের জমিদার। বলাই বাহুল্য, তিনি ছিলেন ইংরেজদের নেওটা। তার স্ত্রীর নাম ছিলো চারুলতা দেবী। শোনা যায়, যে এই মা ঠাকরুণের কোন এক দূরসম্পর্কের ভাই নাকি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের দলে! কি যেন নাম ছিলো তার…হ্যাঁ, নিমাইচন্দ্র মিত্র। একবার দলের বেশিরভাগ লোক ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে, নিমাই নাকি এখানে পালিয়ে আসে এখানে। এখানেই কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকে সে, তার নাকি শারীরিক সম্পর্কও হয় এই বাড়ির এক সুন্দরী কাজের মেয়ের সাথে।”

    “তারপর?”, উত্তেজনার পারদ চড়া কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন অসীম বাবু।

    “তারপর আর কি! কৃষ্ণমোহনের কোনো এক বিশ্বস্ত লোক নাকি নিমাই-এর অনুপস্থিতিতে তার ঘর থেকে চুরি করে আনে বেশ কিছু চিঠিপত্র, যা থেকে কৃষ্ণমোহনের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিমাই-এর বিপ্লবী হওয়ার কথা! তিনি কিন্তু মাথা গরম করলেন না, শুধুমাত্র চুপিসারে সেই কথা জানিয়ে দিলেন ইংরেজদের কাছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, নিমাই-এর অজান্তেই পুলিশরা তাকে ধরতে এসে বিফল হলো, কারণ সেদিন রাত থেকে নিমাই হল নিরুদ্দেশ! সেদিন থেকে আজ অবধি আর কেউ তার কোনো খোঁজ খবর জানে না! কি অদ্ভুত কান্ড বলুন দেখি!”

    একটা মস্ত বড় পাথর যেন ধীরে ধীরে টলে উঠতে শুরু করেছে অসীম বাবুর বুক থেকে, তাও নিজের সকল উত্তেজনা যথাসম্ভব লুকিয়ে, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আর সেই কাজের মেয়েটির কি হয়েছিলো, যার সাথে নিমাই-এর শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়?”

    “আরে সে আরেক অভাগী, বুঝলেন মশাই”, বলতে লাগলো বৃদ্ধ কেয়ারটেকার, “তার পরিবারে ওই এক মাতাল বাপ ছাড়া আর কেউ ছিলো না। সেই বাপ বলেছিলো, এক রাতে প্রসব করতে গিয়ে মা আর সন্তান দু:জনেরই মৃত্যু হয়েছে। সৎকারের পয়সা না থাকায় দু’জনকেই গ্রামের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে!…অবশ্য এই সব কথা আমার ঠাকুরদার মুখে শোনা, তিনিও ছিলেন এখানকার এক কর্মচারী…যাক গে, এবার শুয়ে পড়ুন মশাই, রাত অনেক হল।”

    বৃদ্ধ সেই ঘর থেকে চলে গেলে, বিস্ফারিত চোখে অসীম বাবু মনে মনে বলে উঠলেন, “না, আর যাই হোক না কেন, সেই সন্তান মরেনি। হয়তো মেয়েটির মৃত্যুর পর, তার মাতাল পিতা এই অবৈধ সন্তানটির দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে, তাকে ফেলে এসেছিলো এই গ্রামের কোনো জঙ্গলে! তারপর সকলকে তার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়…আর সেই সন্তানই হল আমার বাবা!”

    জল ভরা চোখে অসীম বাবু আবার দেখলেন দেওয়ালের গায়ে পড়া সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির ছায়াটিকে! এবারও সে যেন তার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!

    (৬)
    রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিরে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে শেয়ালের চিৎকার এবং নাম না জানা কোনো রাতপাখির ক্রন্দন ধ্বনি! পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চুপিসারে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। তারপর সন্তর্পণে বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। তার সামনে দিয়েই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সেই অশরীরি ছায়ামূর্তি। তাকে অনুসরণ করতে করতে অসীম বাবু পৌঁছলেন বাড়িটির পেছনে, জঙ্গলের ভেতর।

    ছায়ামূর্তিটি এখন অগ্রসর হচ্ছে সেই জলাভূমির মাঝ বরাবর সেই সরু আল দিয়ে, চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার অবয়ব। অসীম বাবুও ছুটে এগিয়ে গেলেন তার পিছু পিছু। কিন্তু সেই আলের কিছুটা পথ অতিক্রম করেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। এই অবস্থায় অবাক হয়ে অসীম বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিকে চাইতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে, কেউ যেন সজোরে তাকে পেছন থেকে এক ধাক্কায় ঠেলে ফেলে দিলো পাশের জলাভূমির ভেতর!

    জলাভূমিটার জলের গভীরতা খুব বেশি না হলেও, অসীম বাবুর মনে হল কোনো এক অপার্থিব শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই জলকাদার আরো গভীরে। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে কি এই সব কোনো অশরীরির প্রতারণা? সেই প্রেতাত্মা কি তাকে মিথ্যা ‘গুপ্তধন’-এর লোভ দেখিয়ে এত দূরে নিয়ে এলো, তাকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে? কিন্তু কেন? চারিদিকে ঘন কালো জল, নাকে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! এবার কি করবে সে? কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে?

    হঠাৎ, তার দু’চোখের অন্ধকারের সামনে একটি অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠলো…পাশ্ববর্তী জমিদার বাড়ির একটি ঘর! তবে সেই ঘরের অবস্থা এখনকার মত নয়! চারিদিকে সাজগোজ আর আভিজাত্যের রমরমা। সেই ঘরের বিছানার উপর শুয়ে আছে এক যুবক! ঠিক যেমনটা শুভাশিস বলেছিলো তেমনই দেখতে তাকে…’লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা’…তার মানে এই কি সেই নিমাই!

    ঠিক এমন সময় সেই ঘরের দরজায় তীব্র কড়াঘাতের আওয়াজ শোনা গেল। সেই শব্দ শুনে, ঘুম থেকে উঠে গিয়ে নিমাই ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা খুললো। সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন এক সুন্দরী সুসজ্জিতা নারী। অবাক কণ্ঠে নিমাই বলে উঠলো, “চারু দিদি, তুমি? এই সময়!”

    চারুলতা দেবী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো, “পালাও ভাই, পালাও!…উনি কোনো ভাবে জানতে পেরে গিয়েছেন তোমার বিপ্লবী হওয়ার কথা! আজ রাতে বাইজী বাড়ি থেকে মদ্যপ অবস্থায় ফিরে তিনি নিজে মুখে বলে ফেলেছেন আমাকে সেই কথা! আরো বড় উপাধি পাওয়ার লোভে তিনি সেই কথা জানিয়ে দিয়েছেন ইংরেজদের! আজ রাতেই ইংরেজ পুলিশরা তোমায় ধরতে আসছে, ভাই! এতক্ষণে বোধহয় গোটা বাড়িটাকে নিঃশব্দে ঘিরে ফেলেছে তারা…”

    এই কথা শুনে আর কোনো কথা না বলে সেই ঘর থেকে ছুটে বেরোতে উদ্যত হল নিমাই। ঠিক সেই সময় চারুলতা দেবী বলে উঠলেন, “দাঁড়াও ভাই…আমি জানি, এই সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকতে গেলে তোমার অনেক পয়সার প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থা আমি করেছি…গরিব মানুষদের ঠকিয়ে আদায় করা তাদের রক্ত জল করা এই পয়সার কিছু তো কাজে আসুক এই দেশের কাজ!…এই নাও আমার গহনার বাক্স! এতে যা সোনা আছে তা যদি এই দেশকে স্বাধীন করার কাজে লাগে, তাহলে আমি গর্বিত হবো…বন্দে মাতরম!”, এই বলে তিনি শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা গয়নার বক্সটি ধরিয়ে দিলেন নিমাই-এর হাতে।

    দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো নিমাই-এর চোখ থেকে, তিনি মাতৃসম দিদির পায়ে নমস্কার করে বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর গহনার বাক্সটিকে নিয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছিলো নিমাই। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলো না সে, কারণ ইংরেজ পুলিশেরা সত্যিই চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে তাকে। মাঝেই দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের চিৎকার এবং গুলিবর্ষণের আওয়াজ। নিমাই সেই জঙ্গলের মাঝে থাকা জলাভূমির আল বরাবর গহনার বক্সটি নিয়ে ছুটে চললো। কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নাহ, শেষ রক্ষা বোধহয় হবে না। আজ সে কোনো মতেই এই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে পারবে না। ইংরেজদের হাতে তাকে ধরা পড়তেই হবে, তারপর অকথ্য অত্যাচার করে তারা তার মুখ থেকে বার করে নেবে দলের অন্যান্যদের সম্পর্কে আরো খবর! নাহ, এ কিছুতেই হতে দেবে না নিমাই…কিছুতেই না!

    গহনার বাক্সটা এক হাত দিয়ে ধরে, ওপর কম্পিত হাতটা দিয়ে যে বার করলো কোমরে গোঁজা গোপন পিস্তলটি! তার কাছে যে বেশি সময় নেই, যদি এই গহনাগুলো তার কাছ থেকে পুলিশ পায়, তাহলে যে তার চারু দিদিকেও তাকে সাহায্য করবার জন্য গ্রেফতার করবে তারা! সেটা কিছুতেই হতে দেবে না সে। বিদ্যুৎ বেগে পিস্তলটি বার করে নিজের কানের পাশে লাগিয়ে গুলিবর্ষণ করে মৃত্যুবরণ করলো নিমাই! রক্তাক্ত অবস্থাতেও দুই বহু দিয়ে গহনার বাক্সটিকে আঁকড়ে ধরে সে শেষবারের মত বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর সেই অবস্থাতেই সে ঝাঁপ দিলো জলাভূমির ভেতর!

    (৭)
    এতটা দেখেই নিজের দুই হাতে কোনো এক অদ্ভুত বস্তুর স্পর্শ পেয়ে চিন্তার ঘোর কেটে গেল অসীম বাবুর। কাদাজলের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সেটা যেন একটি মানুষের অবয়ব। শুধুমাত্র শরীরের হাড় কঙ্কালের ওপর যেন শক্ত কালচে চামড়া দিয়ে ডাকা একটা পুরোনো দেহাবশেষ! নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তিনি সেই মরদেহটিকে নিয়ে আলের কাছে শক্ত মাটির ওপর সাঁতরে এলেন। সেটাকে ডাঙ্গার ওপর তুলতেই আতঙ্কে কেঁপে উঠলো তার বুক!

    এটা তো একটা মমি! তার পূর্বপুরুষ বিপ্লবী নিমাইচন্দ্র মিত্রের মমি! শরীরের কাঠামো এক থাকলেও সংকুচিত হয়েছে শরীরের মাংসপেশী! কুচকুচে কালো চামড়ায় ঢাকা দেহাবশেষটির মুখের আকৃতি এখনো স্পষ্ট, এখনো বোঝা যাচ্ছে তার ডান কানের পাশে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ক্ষতচিহ্নটি! এবং বলা বাহুল্য, আজও সে একই ভাবে দু’টি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার দিদির দেওয়া গহনার বক্সটি! তাহলে এটাই হল সেই ‘গুপ্তধন’!

    চোখে জল এসে গেল অসীম বাবু। তিনি যেটুকু পড়াশোনা করেছেন, তাতে হয়তো তার স্পষ্ট ধারণা নেই, যে যখনই কোনো মানব শরীর জলাভূমি বা ‘Bog’-এর ভেতর পতিত হয় তখন সেখানকার জলের ‘Humic Acid’, কম তাপমাত্রা এবং ‘Oxygen’-এর অনুপস্থিতির জন্য তাতে পচন ধরে না। দেহাবশেষটির ভেতর থেকে মাংসপেশী বা হাড়ের পরিমাণ কমে গেলেও তার আকৃতি অবিকৃত থাকে। শুধুমাত্র শরীরের চামড়াটি গভীর ভাবে ‘Tanned’ হয়ে গিয়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রঙ ধারণ করে। আমরা মমি বলতেই হয়তো মিশরের কথা ভাবি, তবে সেই মমিগুলো ছিলো মানুষ দ্বারা করা ক্রিয়াকলাপের ফল। কিন্তু প্রকৃতি যে নিজেও এক অতুলনীয় মমি-কারিগর, সেই কথা প্রমান করে দেশ বিদেশের জলাভূমি থেকে পাওয়া এই মমিগুলি, যাদেরকে বলা হয় “Bog Mummies”.

    সেই রাতেই জঙ্গলের ভেতর শুকনো ডাল পালা জমা করে, তাতে লাইটারের আগুন জ্বালিয়ে তিনি সৎকার করলেন তারই পুরপুরুষের আশি বছর পুরোনো এই দেহাবশেষটিকে। তিনি জানেন যে সেই গহনার বাক্সে যে সোনা আছে, তা দিয়ে তার ছেলের হার্ট সার্জারির খরচাপাতি খুব সহজেই চালাতে পারবেন তিনি।

    ভোরের সূর্য পুব আকাশে দেখা দিয়েই তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে, সেন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এখন যে তাকে কলকাতা গিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। সেদিনের কলকাতাগামী প্রথম ট্রেনের জানলার ধারের একটি সিটে বসেছিলেন তিনি। ট্রেন ছেড়ে দিলো, ধীরে ধীরে মুছে গেল বীরনগর স্টেশনের সকল প্রতিচ্ছবি। নিজের ব্যাগের ভেতর রাখা গহনার বাক্সটিকে দুই হাত দিয়ে উপলব্ধি করতে করতে, নিজের সেই অচেনা বিপ্লবী পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাভরে তিনি বলে উঠলেন, “বন্দে মাতরম!”

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    পাতাল ঘরের অশরীরি

    পাতাল ঘরের অশরীরি
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)
    সালটা ১৯৪৭। গোটা দেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে এত কাল ধরে চলে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধজয়ের দামামা। দেশভাগের রণক্ষেত্র লাল হতে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষদের বুকের তাজা রক্তে। হিন্দু মুসলমান আজ একে অপরের প্রধান শত্রু। ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে চলেছে জমিদারি প্রথা। অতীতের বংশ গৌরব আর আভিজাত্যের ইতিহাস বুকে নিয়ে, আজ এই সকল বনেদী পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা সাধারণ মানুষের সমান।

    এমনই এক পরিবার হল পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, মোহনপুরের রায়চৌধুরীরা। স্বর্গীয় ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী ছিলেন এখানকার দাপুটে জমিদার। এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের আরো চার পাঁচটি গ্রাম জুড়ে ছিলো তার জমিদারি। মৃত্যুকালে তিনি তার সকল বিষয়সম্পত্তি সমান ভাবে ভাগ করে দিয়ে যান তার দুই ছেলে, ফণীভূষণ আর শশীভূষণের মধ্যে। তবে বড় ছেলে ফণীভূষণ সংসারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির, যাকে বলা হয় এই অভিজাত বংশের কলঙ্ক। বাপের জমিদারির ওপর উদাসীন ফণীভূষণ অবিবাহিত অবস্থাতেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তাই বর্তমানে এই পরিবারের কর্তা হলেন ষাটোর্ধ্ব বিপত্নীক শশীভূষণ।

    শশীভূষণের একমাত্র ছেলে অমূল্যভূষণ ছোটবেলা থেকেই মা বাবার কাছ থেকে দূরে বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। কয়েকমাস হল সে সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিষয়সম্পত্তি যেটুকু আছে তা খুব খারাপ নয়, তবে জমিদারি থেকে আর তাদের তেমন আয় হয় না। তাই অমূল্যের ইচ্ছা দেশে ফিরে ওকালতি শুরু করার। তবে তার এখানে ফেরার পেছনে আরেকটি কারণও আছে।

    বাঁশবেড়িয়া নিবাসী ধনী ব্যবসায়ী সুকুমার মিত্র মহাশয় হলেন ফণীভূষণের ছাত্র জীবনের বাল্যবন্ধু। পরবর্তী ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, একদিন হঠাৎ করেই এই বাড়িতে আগমন ঘটে সুকুমার বাবুর। নিজের পুরোনো বাল্যবন্ধুকে এত দিন পর দেখে খুব খুশি হন ফণীভূষণ। তার যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখলেন না তিনি। পরে অবশ্য সকলেই বুঝতে পারলো, সুকুমার বাবুর আগমনের প্রকৃত হেতু। তিনি চান তার একমাত্র মেয়ে, পারুলকে এই বাড়িতেই পাত্রস্থ করতে। অবিবাহিত ফণীভূষণ বন্ধুর এই আব্দার শোনালেন ভাই শশীভূষণের কাছে। দুই পক্ষেরই মতের মিল থাকায়, স্থির হয়ে যায় যে অমূল্যর পড়াশোনা শেষ হলেই তাকে দেশে ফিরে এসে বিবাহ বন্ধনে অবন্ধ হতে হবে পারুলের সাথে।

    এখনো সঠিক ভাবে এক সপ্তাহই হয়নি, পারুলকে বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে অমূল্য। মা বাবার জন্য মন কেমন করার সাথে সাথেই, কেমন যেন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে পারুলের এই বাড়িতে। মাত্র আঠেরো বছর বয়সী পারুল হল অসামান্য সুন্দরী। তাই ফুলশয্যার রাত থেকে আজ অবধি অমূল্য যেন তাকে চোখে হারায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই সে জরি পাড় ধুতি পরে, গায়ে আতর মেখে ঘুরঘুর করতে শুরু করে বিছানার কাছে।

    তবুও যেন দিনের বাকি সময়টা, যখন অমূল্য ওকালতির কাজে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়, তখন এই বাড়িতে থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করে পারুলের। এতবড় পাঁচ মহলা বাড়িতে লোকসংখ্যা কত? সে, তার স্বামী, শ্বশুরমশাই এবং এক দু’জন চারক বাকর! বাড়ির যেদিকে সে তাকায়, সেদিকেই যেন খা খা করে ওঠে! অতীতের প্রাচুর্যের তপবন যেন আজ পরিণত হয়েছে কোনো জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে!

    (২)
    এই বাড়ির পেছনে বেশ বড় আমবাগান, তার একপাশে বাঁধানো পুকুরঘাট। শীতের দুপুরের সময়টা ঘুম আসেনা পারুলের। এই সময় অমূল্যও বাড়ি থাকে না। তাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া হতেই সে রোদ পোয়াতে চলে আসে পুকুরঘাটে। তারপর পাথরের সিঁড়িতে আরাম করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে এক মনে তাকিয়ে থাকে সামনের শ্যাওলায় ভরা পুকুরের সবুজ জলের দিকে। কিংবা কখনো কখনো এলোমেলো ভাবে ওল্টাতে থাকে কোনো গল্পের বইয়ের পাতা। কিন্তু পড়ায় মন বসে না। ছেলেবেলার কথা, বাবা মায়ের কথাই মনে পড়ে বেশি। তারপর সূর্য অস্ত যেতেই সে তড়িঘড়ি ফিরে আসে পড়ন্ত আলোয় দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ির ভেতরে।

    এমনই একদিন দুপুর বেলায় বেশ আনমনা হয়ে পারুল পুকুরঘাটে বসে তাকিয়ে ছিলো জলের দিকে। এমন সময় পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরলো তার,

    “ওমা আমার কি হবে! নতুন বউ নাকি? তা এমন ভর দোপর বেলা একলা একলা এই পুকুরপারে বসি থাকতে হয় বুঝি?”

    পারুল চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখে এক মাঝ বয়সী মহিলা, সাধারণ সাদা শাড়ি পরণে, এক হাতে একটা মাটির কলসী নিয়ে তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে।

    “আ…আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না…”

    “ওমা তোমি আমারে চিনবা কেমনে, নতুন বউ! তুমি এ গাঁয়ের নতুন মানুষ, এই অল্প কডা দিনে আমাদের চিনবা কি করে!…আমার নাম চাঁপা, গো চাঁপা…এই গাঁয়েই আমার বাস।”

    মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসে পারুলের দিকে। এক কালে যে খুব সুন্দরী ছিলো এই মহিলা, তা তার সাজগোজ বিহীন চেহারা আর সাধারণ পোশাকের ভেতর থেকেই ফুটে উঠছে। মহিলা প্রসন্ন চিত্তে বলে ওঠে, “বাহ, কেমন লক্ষী ঠাকরুনের মত বউ হয়েছে আমাগো ছোট দাদাবাবুর!”

    পারুল নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় চোখ নিচু করে, মহিলা পুকুরের জলের দিকে এগিয়ে যায় কলসীটাকে নিয়ে। পারুল জিজ্ঞাসা করে, “তা চাঁপা মাসি, তুমি কি রোজ এই পুকুর থেকেই জল নিতে আসো? কই, আগের কটা দিন তো দেখিনি তোমাকে? আর তুমি আমাকেই বা চিনলে কেমন করে?”

    “ওমা, ছোট দাদাবাবুর বৌভাতে যে আমরা সারা গাঁ খেয়ে গেলুম গো, তা তোমারে চিনবো না? তুমি হয়তো আমারে খেয়াল করো নাই…আর কিছু দিনের জন্য আমি যে কুটুম বাড়ি গিয়েছিলুম গো ভিন গাঁয়ে, তাই জল নিতে আসি নাই”, প্রত্যুত্তরে বলে মহিলা।

    এরপর থেকে পারুল আর চাঁপার বেশ ভাব হয়ে গেল। দু’জনেই প্রতিদিন দুপুরে পুকুরঘাটে এসে গল্পগুজব করে। চাঁপার বাড়ি এই গ্রামেই, অনেক ছোটবেলায় তার এক বৃদ্ধের সাথে বিবাহ হয় কৌলীন্য প্রথা রক্ষার্থে, আর তারপর তার বিধবা হতেও বেশি সময় লাগেনি। এই গ্রামের পূবদিকের একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে সে থাকে। বাপের রেখে যাওয়া অল্প কিছু জমিজমার ফসল আর কয়েকটি পোষ্য গরু ছাগলের দৌলতে তার পেট চলে যায়।

    একদিন কি মনে হতে হঠাৎ চাঁপা পারুলকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাগো নতুন বউ, তোমাগো ওই অত্ত বড় বাড়িডায় থাকতে কখনো ভয়ডর লাগে না তো?”

    পারুল বেশ অবাক হয়ে ওঠে এই কথা শুনে। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “কেন বলো তো মাসি? ভয় করবে কেন শুনি?”

    চারিদিকের পরিবেশকে থমথমে করে মহিলার মুখে নেমে আসে এক আতঙ্কের ছাপ, “ও ছাড়ো তাহলে…লোকের মুখে শোনা কথা কখনো সত্যি হয় নাকি…”

    আরো অবাক কণ্ঠে বলে ওঠে পারুল, “কি ছাড়বো শুনি? কি কথা লোকে বলে, মাসি? বলো…বলতেই হবে তোমায়…”

    “ও থাক বাছা, আমি এখন উঠি, কেমন?…এই সুয্যি ডুবলো বলে…”, প্রসঙ্গ পাল্টে কলসীটাকে কাঁখে করে তড়িঘড়ি উঠে পড়ে মহিলা।

    (৩)
    সেদিন রাতে ঘুম এলো না পারুলের। অমূল্যর কামোত্তেজিত আলিঙ্গনের মাঝেও এক নিথর ভোগ্যবস্তুর মতই নিস্তেজ হয়ে তার শরীর পড়ে রইলো বিছানার ওপরে। বিষয়টা অমূল্যও লক্ষ্য করে একটু অবাক হয়েছিলো, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সে পারুলকে। গভীর রাতেও দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না পারুল। ওপাশে অমূল্য নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, এদিকে পারুল তাকিয়ে আছে পাশের খোলা জানলার বাইরে, রাতের আকাশের দিকে।

    “তার মানে কি সত্যিই এই বাড়িতে এমন কিছু আছে, যাকে ভয় পাওয়াই উচিত! কোন কথা বলতে চেয়েছিলো চাঁপা মাসি? লোকের মুখে শোনা কথাটাই বা কি?”, এই প্রশ্নগুলোই ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিলো পারুলের মাথায়।

    তাই পরদিন দুপুরে পুকুরপারে চাঁপাকে পেয়ে পারুল নাছোড়বান্দা। আজ চাঁপাকে বলতেই হবে গতকাল সে কোন কথা বলতে চেয়েছিলো পারুলকে। উপায় না দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মহিলা। শীতের দুপুরের হিমেল হাওয়ায় এদিক ওদিকে উড়তে লাগলো তার রুক্ষ কেশরাশী। যেন বলতে গিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো তার ঠোঁটদুটি।

    “এ গাঁয়ের লোকেরা বলে, যে তুমার জ্যাঠা শ্বশুর নাকি যে সে লোক ছিলেন না! ছোটবেলা থেকেই তেনার জমিদারির কাজে মন ছিলো না গো…তেনার ওঠা বসা ছিলো এই গাঁয়ের শ্মশানে বাস করা তান্ত্রিকদের সাথে!…তেনাদের দীক্ষা নিয়েই নাকি পিশাচসিদ্ধ হয়েছিলেন তোমার ফণীভূষণ বটঠাকুর!”

    “পিশাচসিদ্ধ!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

    “হ্যাঁ গো হ্যাঁ”, বিস্ফারির চোখ মেলে বলে উঠলো চাঁপা, “সকলে বলে, তোমাগো বাড়ির নীচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে, যেখান গিয়ে গেলে একটি ‘পাতাল ঘরে’ পৌঁছনো যায়…সেখানেই করতেন তিনি এই সব তন্তর মন্তর!”

    “তারপর?”, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

    “তারপর আর কি? সকলে বলে যে তিনি নাকি মন্তর বলে কোন এক প্রেতাত্মাকে নিজের বশে করেছিলেন! কিন্তু তাকে মুক্তি দেওয়ার আগেই হঠাৎ মারা গেলেন তোমার জ্যাঠা শ্বশুর! আর সেই আশরীরি আজ অবধি বন্দী হয়ে আছে তোমাগো বাড়ির ‘পাতাল ঘরে'”, এতটা বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো মহিলা।

    একটা অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু করে উঠতে লাগলো পারুলের বুক!

    (৪)
    সেদিন রাতে বিছানায় তার শরীরটা ভোগ করতে এলেই, এক ঝটকায় স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় পারুল। বিরক্ত হয়ে অমূল্য কিছু বলে ওঠার আগেই, স্বয়ং পারুল নিজেই বলে উঠলো,
    “আপনার জেঠামশাই, শ্রী ফণীভূষণ রায়চৌধুরী কি তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন?”

    এমন দুর্বল মুহূর্তে এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ে অমূল্য। তবুও সে জানতে চায় এমন প্রশ্ন করার কারণ কি। পারুল তাকে খুলে বলে চাঁপার কাছ থেকে শোনা সমস্ত কথা। মুহূর্তের মধ্যে সকল কামোত্তেজনা উধাও হয়ে যায় অমূল্যের মধ্যে থেকে। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
    “জেঠু যে তেমন কোনো গুপ্তবিদ্যা শিখেছিলেন, সেই কথা কিছু কিছু আমিও শুনেছি…কিন্তু ওই পাতাল ঘরের কথা, বা তার ভেতর কাউকে আবদ্ধ করে রাখার কথা!…নাহ, এইসব তো কখনো শুনিনি আমি!…তাছাড়া ছোটবেলা জেঠুকে দেখেছিই বা কতটুকু, পড়াশোনার খাতিরে এই বাড়িতে থাকাই হয়নি তেমন…কে না কে কি বললো, আর তুমি আজকালকার মেয়ে হয়ে বিশ্বাস করলে সেই কথায়?”

    সেই রাতে আর বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। পারুল অমূল্যর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই তার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়েছিলো। অমূল্যও আর বেশি জোরাজুরি করেনি পারুলকে।

    তবে সেই রাত্রে দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না অমূল্য। তখন বোধহয় রাত এগারোটা হবে। বিছানায় উঠে বসলো অমূল্য। শীতের রাত্রির নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে গোটা বাড়ি জুড়ে। পাশের খোলা জানলা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে পারুলের ঘুমন্ত মুখের ওপর। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, এই মুহূর্তে তার প্রতি খুব একটা আকর্ষণ উপলব্ধি করতে পারলো না অমূল্য। সে ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে, আলতো হাতে ঘরের দরজা খুলে শয়ন কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো। দ্রুত পায়ে ছুটে চললো তার বাবার ঘরে।

    শশীভূষণের ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। অমূল্য জানে, যে তার বাবা অনেক রাত ধরে মদ্যপান করে, তারপর ঘুমোতে যান। সেই ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো অমূল্য। কাঁচের টেবিলের ওপর রাখা রঙিন তরলের সকল সরঞ্জাম নিয়ে সেগুন কাঠের আরাম কেদারায় বসেছিলেন শশীভূষণ। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখলেন অমূল্যর দিকে। তার কিছু বলার আগেই অমূল্য বলে উঠলো,
    “এই সময় তোমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি, বাবা…কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর যে এখনই না পেলে নয়…”

    “কি প্রশ্ন আছে তোমার?”, গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন প্রৌঢ়।

    “বাবা, এই কথা জানি যে জেঠু তন্ত্র মন্ত্র শিখেছিলেন! কিন্তু আমাকে বলো, এই বাড়ির নিচে কি কোনো গুপ্তকক্ষ আছে? সেখানে কি কোনো অশরীরিকে তন্ত্রমতে বন্দী করে রেখেছেন তিনি?”, চিৎকার করে বললো অমূল্য।

    চমকে উঠলেন শশীভূষণ, উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো তার দু’চোখের মণি। আতঙ্কের বশে তার হাতে ধরে রাখা কাঁচের পাত্র সমেত হুইস্কির অবশেষটুকু সশব্দে ছড়িয়ে পড়লো ঘরের মেঝের ওপর!

    (৫)
    “বৌমাআআআ….বৌমাআআআ….”

    ঘুমের মধ্যেই একটি অস্ফুট পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ কানে গেল পারুলের। “কে…কে ডাকে আমায়?”, ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো পারুল।

    “আমি তোমার জ্যাঠা শ্বশুর, বৌমা…স্বর্গীয় ফণীভূষণ রায়চৌধুরী!”, অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে প্রত্যুত্তর এলো সেই পুরুষকণ্ঠের।

    ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। সে দেখলো সে গোটা ঘরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে এক দীর্ঘদেহী পেশীবহুল পুরুষের অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার চোখের সামনে। ঠিক তার বিছানার সামনেই তার দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরণে কাপালিকদের লাল রঙের ধুতি। আবার শোনা গেল সেই অশরীরি কণ্ঠস্বর,
    “তুমি সঠিক জেনেছো, বৌমা…আমারই একটা ভুলের জন্য সে এতবছর ধরে বন্দী হয়ে আছে এই বাড়ির ‘পাতাল ঘরে’!…তার মুক্তি না হলে যে আমারও মুক্তি নেই, বৌমা…যাও, তাকে মুক্ত করো বৌমা, তাকে মুক্ত করো!”

    “কিন্তু সেই ‘পাতাল ঘর’ কোথায়? কিভাবে পৌঁছবো আমি সেখানে?”, চিৎকার করে উঠলো পারুল।

    “এই বাড়ির একতলার পূবদিকের প্রথম ঘরটাই ছিল আমার শয়নকক্ষ। এই ঘরে, আমার পালঙ্কের নীচেই পাবে সেই সুড়ঙ্গমুখে ঢোকার রাস্তা। তবে সেখানে ঢোকার আগে, আমার ঘরে রাখা সিন্দুকের ভেতর থেকে ‘পাতাল ঘরের’ দরজায় লাগানো তালার চাবির গোছাটা যেন নিয়ে যেতে ভুলো না!”, বলে উঠলেন ফণীভূষণ।

    “কে সেই অশরীরি? কাকে আবদ্ধ করে রেখেছেন আপনি ওই ঘরে? বলুন, আমার কথার জবাব দিন…”, আবার জানতে চাইলো পারুল।

    কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না ফণীভূষণ। শুধু তার মর্মভেদী কন্ঠস্বর শোনা যেতে লাগলো, “মুক্ত করো তাকে, বৌমা…মুক্ত করো!” পারুল দেখলো যে তার দেহটা স্থির থাকলেও, ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে তার মুন্ডুটা।কিছুক্ষণের মধ্যেই পারুলের দিকে মুখ করে সম্পূর্ণরূপে পেছনে ঘুরে গেল তার মুন্ডুটা! পারুল ভয়ার্ত দৃষ্টে চেয়ে দেখলো, যে ছবিতে দেখা তার মুখের সাথে এই মুখের কোনো পার্থক্য নেই, শুধু এই ক্ষেত্রে তার চক্ষু কোটরদুটি ফাঁকা!

    একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো! দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নিতে নিতে সে বিছানায় পাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হল, অমূল্যর জায়গা ফাঁকা! কোথায় গেল সে? কিন্তু সেই মুহূর্তে, অমূল্যর চিন্তার থেকে বেশি তাকে ভাবাচ্ছিলো স্বপ্নে শোনা ফণীভূষণের কথাগুলো। তার মানে তো চাঁপা ঠিক কথা বলেছে তাকে! সাহসে বুক বেঁধে মনে মনে সংকল্প নিলো সে, যেভাবেই হোক তাকে যেতে হবে সেই ‘পাতাল ঘরে’! মুক্ত করতেই হবে সেখানে বন্দী অশরীরিকে! বিছানা থেকে উঠে পড়ে পারুল, দ্রুত পায়ে এই ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে চলে ফণীভূষণের ঘরের উদ্দেশ্যে।

    রাতের অন্ধকারে, ফণীভূষণের ঘরের ভেজানো দরজা খুলে চোরের মত ভেতরে ঢুকে পড়লো পারুল। ফণীভূষণের মৃত্যুর পর বহুদিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে এই ঘর। তবে বাড়ির বহুদিনের পুরোনো চাকরটির গুণে আজও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরের চতুর্দিক। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, পারুল ছুটে গেল অদূরে একটি টেবিলের ওপর রাখা সিন্দুকটার দিকে। সৌভাগ্যজনক ভাবে তাতে তালা দেওয়া নেই। মুহূর্তের মধ্যে তার ডালা খুলে ‘পাতাল ঘরের’ দরজার তালার চাবির গোছাটা বার করে নিতে খুব বেশি সময় লাগলো না পারুলের।

    সেই মুহূর্তে তার মনে হল, যেন কোনো অপার্থিব শক্তি এসে ভর করেছে তার দেহে। নাহলে সেই ঘরের অত ভারী পালঙ্কটির পায়া ধরে, এক ধাক্কায় সেটাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া তার মত মেয়েমানুষের কম্ম নয়! এরপরই সে নিজেই অবাক হয়ে গেল…পালঙ্কের নীচে মেঝের সাথে খাঁজে খাঁজে বসানো রয়েছে একটি লোহার ডালা। তার হাতলের একটি অংশে চাপ দিতেই সেটি খুলে গিয়ে বিকশিত করলো একটি আঁধারে ভরা সুড়ঙ্গপথের মুখ, যার ভেতর দিয়ে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি!

    আর একটুও সময় নষ্ট না করে, হাতে চাবির গোছাটা নিয়ে, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত পারুল অগ্রসর হতে লাগলো সেই সিঁড়ি দিয়ে। চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার, ওপরে ঘরের ভেতর চাঁদের আলো যেটুকু পড়েছিল, সেটাও এখানে নেই। তবে এই সুড়ঙ্গপথ যে বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, এমন কিন্তু নয়। খুব বেশি ধুলোবালি বা অপরিচ্ছন্নতা এখানে নেই, বোঝাই যাচ্ছে যে নিয়মিত এই পথ ধরে কারোর যেন যাওয়া আসা আছে! সিঁড়ির সারি শেষ হয়ে এলে, পারুল হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছলো একটি সমতল জায়গায়। তার সামনেই রয়েছে একটি ঘরের তালাবন্ধ দরজা। চাবির গোছাটা ধরে সেদিকে এগিয়ে এলো পারুল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে, সেই ঘরের দরজার তালাটা হাত দিয়ে উপলব্ধি করে, এক এক করে চাবিগুলো ব্যবহার করে খোলার চেষ্টা করতে লাগলো তালাটা। এক সময় তার প্রচেষ্টা সফল হল, সশব্দে খুলে গেল তালাটা। সেটাকে দরজার হাতল থেকে খুলে নিয়ে, এক ঝটকায় পারুল সশব্দে খুলে ফেললো সেই ঘরের দরজাটা!

    সেই ঘরের ভেতর অগ্রসর হয়ে, জমাট অন্ধরারের মধ্যে সামনে চোখ রাখতেই যেন তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। সে অস্ফুট স্বরে নিজের মনেই বলে উঠলো, “একি!…এটা তো…এটা তো…”

    (৬)
    “ওই ঘরে কোনো অশরীরিকে আবদ্ধ করে রাখা নেই, খোকা…ওখানে বন্দী করে রাখা রয়েছে তোর আমার মতই একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষকে!”, কম্পিত গলায় শশীভূষণ বলে উঠলেন অমূল্যর উদ্দেশ্যে।

    বিস্মিত চোখে বাপের দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। তিনি বলেই চললেন, “ভালো হল তুই নিজে মুখেই এই কথা তুললি, খোকা…কারণ আমি নিজেই চাইছিলাম এই বিষয়ে তোদের বিস্তারিত জানাতে। দগ্ধে দগ্ধে মরছিলাম এতদিন এই পাপের কথা চাপা রেখে। শুধু কোন মুখে এই কথা তোদের জানাবো, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না এত দিন ধরে!”

    “সেই সময় তোর ঠাকুরদা ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী বেঁচেছিলেন। তোর জ্যাঠামশাই, মানে আমার দাদা, ফণীভূষণের সবে মাত্র মৃত্যু হয়েছে। এমন সময় এই বাড়ির কাজ থেকে ছুটির জন্য অনুরোধ করে এক অকালবিধবা সুন্দরী কাজের মেয়ে। পরে জানা যায় যে সে ছিলো অন্তঃসত্ত্বা! এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। কয়েকবছর পর, একটি দু’বছরের ছোট্ট ছেলেকে কোলে করে এই বাড়িতে প্রবেশ করলো এক বৃদ্ধ। সে বলে, যে এটি হল তার মেয়ের সন্তান, যে এই বাড়িতেই কাজের জন্য নিযুক্ত ছিল। ছেলেটির নাম সোমেশ্বর। দু’দিন আগেই কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যু হয়েছে সেই মেয়েটির, তবে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তার শেষ ইচ্ছা ছিলো, যে তার সন্তান যেন পায় উপযুক্ত পিতৃপরিচয়…সেই জন্যই তাকে এই বাড়িতে এনেছে সেই বৃদ্ধ…তার কারণ হল, ছেলেটির পিতা হল ফণীভূষণ!”

    এতটা বলে থামলেন শশীভূষণ, বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। আবার বলতে শুরু করলেন তিনি।

    “কিন্তু বাবা তার কথা তো কানে তুললেনই না, বরং সেই বৃদ্ধকে এবং বাচ্চাটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। বৃদ্ধ যাওয়ার আগে চীৎকার করে জানিয়ে দিয়ে গেল, যে জমিদার বাড়ির এই কেচ্ছা সে গ্রামের সকলকে জানিয়ে দিয়ে যাবে!…তবে বাড়ির ফটকের বাইরে বেরোতে পারলোনা তারা, তার আগেই বাবার নির্দেশে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো চারজন লেঠেল!…লাঠির আঘাত মাথায় লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। বেঁচে যায় ছেলেটি।”

    “তাকেও মারতে চলেছিলেন বাবা, কিন্তু আমি তার পা ধরে সেই যাত্রায় রক্ষা করলাম দাদার রেখে যাওয়া শেষ চিহ্নটাকে!…তবে বাবা আমাকে কথা দেওয়ালেন, যে এই অবৈধ সন্তানটি যেন এই বংশের বিষয়সম্পত্তির কোনো অংশের উত্তরাধিকার না পায়! তাকে প্রাণে বেঁচে থাকতে গেলে, সকলের চোখের অলক্ষ্যে থাকতে হবে!…আমি জানতাম দাদার তন্ত্রমন্ত্র করার গুপ্তকক্ষের ঠিকানাটা, তাই সেদিন থেকেই ছেলেটিকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য আমি রেখে এলাম সেখানে। বাড়ির এক বিশ্বস্ত চাকরের দ্বারা তার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হল…তবে বাবার মৃত্যুর পরও কেন জানিনা, তাকে দেওয়া কথা ফেলতে পারলাম না আমি। জনসমক্ষে আনতে পারলাম না দাদার সন্তানকে!…তবে আজ আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ সোমেশ্বরকে দিয়ে যেতে চাই আমি!”

    এতক্ষণ শোনার পর প্রথম মুখ খুললো অমূল্য, “কে ছিলো সেই মৃত কাজের মেয়েটি, যে জেঠুর সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিলো?”

    “চাঁপা…গাঁয়ের লোকেরা তাকে চাঁপা বলে ডাকতো!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন শশীভূষণ।

    ঠিক সেই সময় শশীভূষণের ঘর থেকে শোনা গেল একটি কান ফাটানো আর্তচিৎকার, আর সেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তীব্র আওয়াজ!

    (৭)
    ‘পাতাল ঘরে’ ঢুকে পারুল ছুটে গেল সেই দীর্ঘদেহি সুপুরুষ যুবকটির দিকে, যাকে এতকাল ধরে এই ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, একমুখ দাড়ি এবং মলিন বেশভূষা পরিহিত যুবকটি উবু হয়ে বসে ছিলো ঘরের মেঝের ওপর। সেও যেন খুব আশ্চর্য হল এই রাতের অন্ধকারে পারুলকে দেখে।

    “আপনি তো কোনো অশরীরি নন…আপনি একজন মানুষ!…আমাদের মতই মানুষ!…কে আপনি? বলুন কে?”, চিৎকার করে ওঠে পারুল।

    থরথর করে কেঁপে উঠলো যুবকের ঠোঁটদুখানি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। শুধু অস্ফুট কণ্ঠে নিজের নামটা বলে উঠলো সে, “স…সোমেশ্বর!” সেই মুহূর্তে পারুল সেই যুবকের হাত ধরে তাকে বার করে আনলো সেই ঘর থেকে, তারপর তাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে বেরিয়ে এলো বাড়ির বারান্দায়।

    “ও যেই হোক না কেন, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে যে এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে, পারুল!…দেখো না, বাবাও যেন এই বুড়ো বয়সে দয়ার সাগর হয়ে উঠেছেন, বলছেন কিনা এখন প্রায়শ্চিত্ত করবেন!…দিয়েছি বুড়োর মাথায় পিস্তলের বাঁটের এক ঘা, এখন সে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে নিজের ঘরে, যার দরজা আমি বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছি!…হাহাহাহা!”

    কথাগুলো শুনে সচকিত হয়ে পারুল সামনে তাকিয়ে দেখলো, যে নিজের জেঠতুতো দাদার দিকে পিস্তল বাগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অমূল্য, মুখে পৈশাচিক হাসি! অমূল্যের এই ধুর্তামির সাথে নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে রইলো পারুল। তারপর আচমকা সোমেশ্বরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিয়ে দৌড়ে উঠে গেল বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে, সোজা ছাদের উপর। অমূল্যও পেছন থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে আসতে লাগলো তাদের পেছন পেছন।

    ছাদে উঠে কার্নিশের দিকে অগ্রসর হতেই দু’জনে বুঝলো, যে আর পালাবার কোনো জায়গা নেই! ওরা দু’জনেই পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো, যে হিংস্র মুখে সোমেশ্বরের দিকে পিস্তল তাক করে সেদিকেই এগিয়ে আসছে অমূল্য। একটি বিকট হাসি হেসে পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দিতে গেল অমূল্য, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিলো সোমেশ্বর! ঠিক সেই মুহূর্তে, অমূল্যের সামনে খোলা ছাদের মাঝে রাতের বাতাসের ধূলিকণাগুলো মিলেমিশে সৃষ্টি করলো এক নারীর আবছা অবয়বকে! ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো অমূল্য, পিস্তলটি পড়ে গেল তার হাত থেকে! পারুল জানে, এই অশরীরি আর কেউ নয়…সোমেশ্বরের মৃত মা, চাঁপা!

    নিজের ছেলেকে এই বন্দী দশা থেকে উদ্ধার করার জন্যই সে অশরীরি হলেও বন্ধুত্ব করেছিলো পারুলের সাথে। এই ‘পাতাল ঘরে’ কি আছে, সেটা জানার কৌতূহল সৃষ্টি করেছিলো সে পারুলের মনে। আর আজ এই মুহূর্তেও নিজের ছেলেকে মৃত্যুর মুখে থেকে সেই উদ্ধার করতে এসেছে!

    ধীরে ধীরে চাঁপার অপার্থিব দেহটি এগিয়ে চলেছে অমূল্যর দিকে, আতঙ্কে কম্পিত পায়ে সে এক পা দুই পা করে পিছিয়ে চলেছে। অমূল্য বুঝতেও পারলো না, সে ছাদের বিপরীত দিকের কার্নিশের কতটা নিকটে চলে এসেছে সে! কিন্তু চাঁপার প্রেতাত্মা তখনও একই গতিতে অগ্রসর হতে লাগলো তার দিকে…আর নিজের শরীরের ভার সামলাতে পারলো না অমূল্য…তাল সামলাতে না পেরে, শেষ আর্তচিৎকার করে তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল তার দেহ…নিচে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে গেল অমূল্যর রক্তাক্ত শরীরটা!…সেই মুহূর্তে চাঁপা পেছন ফিরে তাকালো আতঙ্কিত সোমেশ্বর আর পারুলের দিকে, মুখে প্রসন্নতার হাসি। এরপরই একটা দমকা হাওয়ার বাতাসের সাথেই চিরবিদায় জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল চাঁপার অবয়ব!

    (৮)
    এক মাস পরের ঘটনা:
    ———————————
    মাথায় লাগা আঘাতটা থেকে এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন শশীভূষণ। নিজের ছেলের জায়গাতেই তিনি বসিয়েছেন সোমেশ্বরকে। এখন সমস্ত বিষয় সম্পত্তির ভার তার ওপর। শশীভূষণ নতুন করে এই বাড়িতে পারুলকে ফিরে পেতে চান, সোমেশ্বরের স্ত্রী হিসাবে। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিনের জন্য ভেঙে পড়েছিলো পারুল, এখন সেও মত দিয়েছে সোমেশ্বরের সাথে নতুন করে বাঁচার। তবুও মাঝে মাঝে তার একটা কথাই মনে হয়:

    “অশরীরিদের কথা মনে হলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, যে তারাও মানুষের বন্ধু হতে পারে! আমাদের সাহায্য করতে পারে! আর সর্বোপরি, এই রক্ত মাংসে গড়া মানুষদের প্রবৃত্তিও অশরীরিদের থেকে আরো কত বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে!”

  • গল্প

    ঘাতক ত্রিকোণ

    ঘাতক ত্রিকোণ
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)


    গোয়েন্দা গৈরিক সেনের বাজারটা এখন খুব একটা ভালো চলছে না। ইতিপূর্বে কলকাতার বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করায় তার পুলিশ মহলে বেশ নাম ডাক হয়েছে, এই কথা ঠিক, কিন্তু ইদানিং কালে তেমন কোনো পছন্দসই কেস তার হাতে জুটছে না। অবশ্য কিছু ছোট খাটো চুরি ছিনতাই-এর কেস ইতিমধ্যেই তার কাছে এসেছিলো, কিন্তু সে নিজেই সেগুলিতে মাথা ঘামাতে অস্বীকার করেছে। তাই রাসবিহারী মোড়ের একটি বহুতলীতে অবস্থিত তার “সেন’স আই” নামক অফিস ঘরটা হয়ে উঠেছে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্প-গুজব করার আখড়া। বলাই বাহুল্য, তার মধ্যমণি হয়ে বিরাজমান গৈরিকের একমাত্র এসিস্ট্যান্ট তথা আদরের খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন, ওরফে টুসু।

    এমনিই একটি শীতের সন্ধ্যা বেলায় টুসু এবং তার বান্ধবীরা গৈরিকের সাথে মেতেছিলো আড্ডায়। টুসুর বান্ধবীদের গৈরিকের প্রতি অপার কৌতূহল, তবে সেটা তার গোয়েন্দাগিরির থেকেও বেশি তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি। তার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা, সে বিয়ে কবে করবে…এই ধরণের নানা প্রশ্নবাণে মাঝে মাঝেই জর্জরিত হয়ে ওঠেন আমাদের গোয়েন্দা মশাইটি। আর তা হবেই বা না কেন, অমন ধনী পরিবারের একমাত্র সুদর্শন ছেলে, তাও আবার প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা… এমন বঙ্গসন্তানের অবিবাহিত থাকাটাই খুব বিস্ময়কর। টুসুর এমন বান্ধবীরাও আছে, যারা ক্রমাগত তাকে বলে চলেছে গৈরিকের সাথে তাদের একটা ‘সেটিং’ করিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু টুসু জানে যে তার জেঠতুতো দাদাটি এই সবে ফাঁসবার পাত্র নয়। সে এড়িয়েই চলে এমন আবদারগুলিকে।

    বেশ কিছুক্ষন আগে সুইগির ছেলেটা সকলের জন্য পিৎজা দিয়ে গেল। আর তার সাথে সকলের জন্য ধূমায়িত কফির কাপও রেখে গিয়েছে এই অফিসের একমাত্র চাকর রঘুদা। ওরা মহা আনন্দে তা সাবাড় করে ফেলেছে প্রায়, এমন সময় আবার হন্তদন্ত হয়ে অফিসঘরে প্রবেশ করলো রঘুদা। তার হাবভাব দেখেই তার কিছু বলার আগে বলে উঠলো গৈরিক, “কেউ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে তো? যাও, পাঠিয়ে দাও…”
    রঘুদা চলে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই ঘরের প্রবেশ করলো বছর বাইশ তেইশের এক তরুণ। বেশভুষা এবং মাথায় চুল যথেষ্ট এলোমেলো, দেখেই মনে হচ্ছে কি যেন এক অস্থিরতা দানা বেঁধেছে তার মনে।

    সে এসে সকলকে নমস্কার জানানোর সাথে সাথেই টুসুর বান্ধবীরা বুঝে গেল, যে এখন এই ঘরে হাসি মজাক না হয়ে নিশ্চয় কোনো জরুরি কথাবার্তা চলবে। তাই তারা সকলে একে একে বিদায় নিলো। তারা চলে গেলে, ছেলেটি বেশ চিন্তিত কণ্ঠে গৈরিককে বলে উঠলো, “নমস্কার গৈরিক বাবু, আমি শশাঙ্ক…শশাঙ্ক মুখার্জি। সিটি কলেজের বি.এস.সি থার্ড ইয়ারের ছাত্র। আসলে, আমি জানি না আপনাকে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়ার সামর্থ আমার আছে কিনা….”
    “আরে দাঁড়ান মশাই”, হাস্যকৌতুক স্বরে বলে উঠলো গৈরিক, “এখনো তো আপনার সমস্যার কথাটাই শোনা হল না, এরই মধ্যে পারিশ্রমিকে চলে গেলেন!”
    শশাঙ্ক যেন একটু অপ্রস্তুত হল এই কথাই, তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “মিস্টার সেন, আমার সমস্যাটা আমাকে নিয়ে নয়। আমার গার্লফ্রেন্ড শ্রীপর্ণাকে নিয়ে। ও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ে। ফিজিওলজি অনার্স…একটি আত্মহত্যার প্ররোচনার কেসে আজ সকালেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাকে!”

    টুসু বললো, “স্ট্রেঞ্জ, পুলিশ কেন এমন করতে গেল! আপনি আমাদের সব কিছু খুলে বলুন, মিস্টার মুখার্জি!”
    শশাঙ্ক ম্লান মুখে বলে উঠলো, “কিছুদিন আগে খবরের কাগজে এই বিষয়টা নিশ্চয় পড়েছিলেন আপনারা, যে সিটি কলেজের এক অধ্যাপক, ডাঃ অরূপ মজুমদারের বিরুধ্যে রেপ এটেম্পট-এর অভিযোগ এনেছেন সেই কলেজেরই এক ছাত্রী….”
    মৃদু হেসে গৈরিক বলল, “হ্যাঁ পড়েছি। আর নিশ্চয় সেই মেয়েটিই হল আপনার গার্লফ্রেন্ড শ্রীপর্ণা, রাইট?”
    “হ্যাঁ, মিস্টার সেন, শ্রীপর্ণাই হল সেই মেয়ে…গত দুই দিন লো-প্রেসার নিয়ে কলকাতার একটি নামী হাসপাতালে ভর্তি হন ডা: মজুমদার। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে, যে তার দুটি কিডনিই ফেল করেছে। তার হৃদ-স্পন্দনের গতিও হয়ে ওঠে অনিয়মিত। গতকাল দুপুরেই সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ডা: মজুমদার!”

    কিছুক্ষন থেমে নিজেকে একটু ধাতস্ত করে নিলো শশাঙ্ক, তার পর আবার বলতে শুরু করলো, “আসলে ওই রেপ এটেম্পট-এর কেসে অরূপ বাবুর সত্যিই কোনো দোষ ছিলো না, গৈরিক বাবু। আমি মানছি, সব দোষ ছিলো শ্রীপর্ণার। সে প্রথমে ভেবেছিলো যে সেদিন কলেজের শেষে স্যারের চেম্বারে একা গিয়ে, তাকে হালকা সিডিউস করলেই আসন্ন টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতাতে পারবে! কিন্তু স্যার যখন তার এই আচরণে একটুও গললেন না, তখন ও রাগের মাথায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, কলেজে সেই সময় সকলকে ডেকে বলে, যে স্যারই তাকে নিজের চেম্বারে একা ডেকে এনে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন! তার কথা সকলে বিশ্বাসও করে, এবং স্যারকে কলেজ থেকে কিছুদিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। তিনি হতাশায় ভেঙে পড়েন।”

    ঘৃণায় মুখ সংকুচিত করে বলে উঠলো টুসু, “বাহ, আশা করি আপনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন আপনার প্রেমিকার চরিত্রের কথা! এমন অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে অধ্যাপক পদে কর্মরত কোনো সম্মানীয় পুরুষের পক্ষে আত্মহত্যা করা খুব স্বাভাবিক, এবং তা হলে শ্রীপর্ণার উপযুক্ত শাস্তিও পাওয়া উচিত! কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করলেন কিভাবে?”
    “অরূপ স্যারের হাই ব্লাড-প্রেসারের সমস্যা ছিল। তিনি তার জন্য একটি ওষুধ খেতেন, যার প্রধান উপাদান হল ‘Amlodipine’. পুলিশের বক্তব্য, যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের রাতে, তিনি এই ওষুধের সাথেই ‘Clarithromycin’ নামক একটি এন্টি-বায়োটিক খুব বেশি মাত্রায় খেয়েছিলেন। এবং তার এই নিদারুণ পরিণতি হল এই দুটি ড্রাগের এক সাথে কাজ করে সৃষ্টি করা বিষক্রিয়ার ফল! কলেজ থেকে সাসপেন্ড হয়ে, হতাশায় ভেঙে পড়ে তিনিই নিয়েছেন এই ভাবে নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত, কারণ ফিজিওলজির অধ্যাপক হওয়ায়, তার কাছে এই দুটি ড্রাগের সমবেত বিষক্রিয়ার কথা অজানা নয়।”

    এতক্ষন পর মুখ খুললো গৈরিক, “তাহলে তো বলতে হবে, যে উচিৎ শাস্তি হয়েছে আপনার বান্ধবীর। তা আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারবো বলুন?”
    “আমি মানছি, গৈরিক বাবু, যে শ্রীপর্ণা সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছিলো। বেশ কিছুদিন ধরে ওর বাবা হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় পড়ে ছিলেন, পড়াশোনা কিছুই হয়নি সেই সময়। তাই হয়তো….কিন্ত, তারপর সে নিজেই অরূপ স্যারের কাছে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সকলের সামনে নিজে মুখে নিজের পাপের কথা প্রকাশ করার কথা বলে। স্যার তাকে ক্ষমাও করে দেন। তাই আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবো না, যে স্যার এরপরেও হতাশায় ভেঙে পড়ে এমন পদক্ষেপ নেবেন…আমার মনে হয়, যে অরূপ স্যারের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে, গৈরিক বাবু! সেটাই খুঁজে বার করতে হবে আপনাকে! আর বাঁচাতে হবে শ্রীপর্ণাকে!”

    গৈরিক এরপর কোনো কথা বললো না, শুধু কুঁচকে উঠলো তার প্রশস্ত কপালের চামড়া! অনেক দিন পর, আবার উত্তেজনায় বুক কেঁপে উঠলো টুসুর…তার মানে আবার সত্যিই কোনো রোমহর্ষক কেস এসে হাজির হল তার গেরোদার সামনে!

    (২)


    বেহালার পর্ণশ্রীতে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি অরূপ বাবুর। বাড়িটার সামনে বেশ বড় একটি লোহার গেট, তা দিয়ে ঢুকতেই নাম না জানা নানা ফুলগাছের সমাহার। বাড়িটার পেছন দিকে ও দুই পাশে বেশ বড় বাগান, তাতে ভর্তি আম, নারকেল, পেঁপে, কাঁঠাল, সজনে প্রভৃতি নানা গাছের সারি। গৈরিক আর টুসু বসে ছিলো এই বাড়ির এক তলার বৈঠকখানার একটি ঘরে। অরূপ বাবুর সংসারে আছেন শুধুমাত্র তার স্ত্রী উর্মি দেবী। মাত্র দুই বছর আগে তাদের বিবাহ হয়। সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী এই উর্মি দেবী, যদিও বা আজ তার চেহারায় সদ্য স্বামীকে হারানোর শোক খুব স্পষ্ট।

    নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পর, গৈরিক সরাসরি প্রশ্ন করে উঠলো উর্মি দেবীকে, “আপনার কি মনে হয়, কলেজের ওই ঘটনাটির জন্যই কি এই ভাবে নিজেকে শেষ করে দিলেন আপনার স্বামী?”
    “সঠিক ভাবে বলতে পারবো না”, সজল চোখে গৈরিকের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “তবে তিনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন ওই ঘটনার পর। শুধুমাত্র একটা প্রশ্নপত্রের লোভে, একটা নির্দোষ মানুষকে এই ভাবে ফাঁসানো…ছি!…ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে আমার! সমগ্র নারী জাতির কলঙ্ক ওই মেয়েটা….”, উত্তেজিত কণ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি, “আমার কপালটাই খারাপ জানেন…সেই কোন চোদ্দ বছর বয়সে বাবাকে হারালাম। মা বিয়ে করলেন এমন একজনকে, যার চোখে পিতৃসুলভ স্নেহের চেয়ে নিজের ছোট্ট শরীরটার জন্য যৌনতায় ভরা লোভই বেশি দেখেছি। বাধ্য হয়েই মা আমাকে ভর্তি করে দেন বোর্ডিং স্কুলে!…আর এখন, স্বামীকেও হারালাম!”

    উর্মি দেবী কিছুটা শান্ত হলে আবার বলে উঠলো গৈরিক, “অরূপ বাবু তার ওষুধ পত্রগুলিকে কোথায় রাখতেন, উর্মি দেবী?”
    “সেগুলো সব তার পড়ার ঘরের টেবিলের এক পাশে রাখা থাকে। তবে এখন অবশ্য সেই সব কিছু পুলিশের হেফাজতে।”, বললেন উর্মি দেবী।
    “তবুও, একবার দেখা যাবে সেই ঘরটা?”, জানতে চাইলো গৈরিক।
    “আসুন”, দুই চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন উর্মি দেবী। তারপর গৈরিক আর টুসুকে বাড়ির দোতলায় অবস্থিত অরূপ বাবুর স্টাডি রুমের ভেতর নিয়ে এলেন তিনি। বেশ বড় সাজানো গোছানো ঘরটি, চারিদিকে বইয়ে ভর্তি সো-কেস। মাঝে একটি বড় সেন্টার টেবিল। এখানেও বই পত্র রাখা রয়েছে, রয়েছে পেন-স্ট্যান্ড, টেবিল-ল্যাম্প এবং অরূপ বাবুর ল্যাপটপ। টেবিলের এক পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের ফাঁকা বাস্কেট, তার যা যাবতীয় ওষুধ পত্র সব এখানেই রাখা থাকতো, জানালেন উর্মি দেবী।

    “আচ্ছা উনি না হয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতেন, কিন্তু ওই এন্টি-বায়োটিকটা তো আপনারা কেউই ব্যবহার করতেন না, তাহলে ওটা তিনি কখন কিনে আনলেন, সেই ব্যাপারে কোনো আইডিয়া আছে আপনার”, এই বাড়িতে এসে এই প্রথম মুখ খুললো টুসু।
    “না ভাই, মানুষটা খুব চাপা স্বভাবের ছিলো। নিজের দরকারের সমস্ত জিনিসপত্র নিজেই জোগাড় করতে পছন্দ করতেন তিনি, এই বিষয়ে তাকে এই বাড়ির কাজের মেয়ে রাধাকেও কখনো কিছু বলতে শুনিনি আমি। তবে এটুকু দেখেছি, যে তিনি এই টেবিলেই রাখা কৌটো থেকে ওই হাই-প্রেসরের ওষুধগুলো সকাল, বিকাল এবং রাত…দিনে তিনবার করে খেতেন”, উর্মি দেবীর কথা শেষ হতেই সেই ঘরে কফির ট্রে হাতে নিয়ে হাজির হল একটি বছর তিরিশের মহিলা। সাদামাটা চেহারা, ময়লা গায়ের রঙ। বোঝাই যাচ্ছে, যে এই হল রাধা। উর্মি দেবী সকলের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

    মেয়েটি সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে চলে যাওয়ার আগে, গৈরিক তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তা তুমি কি চব্বিশ ঘন্টা এই বাড়িতেই থাকো নাকি, রাধা?”
    “না বাবু, রাতের বেলা নিজের বাড়ি চলে যায়। আসলে বাপের শরীরটা খুব একটা ভালো নয় বাবু, রাত্রে বুড়ো মানুষটাকে একা ফেলে রাখতে মন চায় না। সকাল থেকে বিকাল অবধি এই বাড়িতেই থাকি।”, এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল রাধা।
    “আচ্ছা, অরূপ বাবুর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনে কি এই বাড়িতে বাইরের কেউ এসেছিলো?”, হঠাৎ কি মনে হতে উর্মি দেবীকে জিজ্ঞাসা করলো টুসু।
    “সকালের দিকে তো নয়”, একটু চিন্তা করে বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “কলেজ থেকে সাসপেন্ড হয়ে তো তিনি সর্বক্ষণ বাড়ির এই ঘরেই বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন। তবে বিকালের দিকে আমি একটু বাইরে বেরিয়ে ছিলাম, টুকটাক কেনাকাটা ছিল তাই। সন্ধ্যার পর বাড়ির কাছে এসে দেখলাম, যে দেবাশিস বাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে স্টার্ট দিতে বললেন….”

    তার কথা শেষ না হতেই কৌতূহলী কণ্ঠে বলে উঠলো টুসু, “আচ্ছা, এই দেবাশিস বাবুটা কে?”
    “ভারী নচ্ছার লোক, ভাই”, বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “তিনি সোদপুরের একজন প্রমোটার। আসলে সোদপুরে আমার স্বামীর এক দূরসম্পর্কের মামার পৈতৃক ভিটে আছে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। মৃত্যুর আগে, একমাত্র বংশধর হিসাবে পুরোনো আমলের এই বাড়িটিকে তিনি ওনার নামে দিয়ে যান। সেটাকে ভেঙে সেই স্থানে একটি ফ্ল্যাট তৈরি করতে চান এই দেবাশিস গোস্বামী। কিন্তু মামার এই শেষ স্মৃতিটাকে এই ভাবে হারাতে চাইছিলেন না আমার স্বামী। সেই জন্য জোঁকের মত ওনার পেছনে লেগে ছিলেন এই দেবাশিস বাবু!”
    গৈরিক কিছুক্ষন চিন্তিত মুখে কি যেন ভেবে চলল, তারপর বলল, “এই প্রমোটারের অফিসের ঠিকানা কি আপনার কাছে আছে, উর্মি দেবী?”
    “এই রে, আমি তো কখনো সেখানে যাই নি, তবে সোদপুরের ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’ বলে ইন্টারনেটে সার্চ করলে, আশা করি অবশ্যই পেয়ে যাবেন তার অফিসের ঠিকানা।”

    ঠিক এমন সময় নিচ থেকে রাধা উর্মি দেবীকে ডেকে বললো যে লন্ড্রি থেকে লোক এসেছে পয়সা নিতে। উর্মি দেবী একটু বিরতি চেয়ে নীচে চলে গেলে, টুসুর মোবাইলেও এলো কলেজের কিছু পড়াশোনা সংক্রান্ত তার বান্ধবীর একটি জরুরি ফোন। সেই ঘরে ফোনের নেটওয়ার্কটা ঠিক ভাবে না আসায়, টুসু সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে যথাসম্ভব কম কথা বলে আবার ঘরে ফিরে এলো। মুহূর্তের মধ্যে তার যেন মনে হল, যে গৈরিক কোনো একটি সাদা কাগজের টুকরো বিদ্যুৎবেগে নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করলো। এমন সময় নিচের কাজ সেরে আবার ঘরে প্রবেশ করলেন উর্মি দেবী।

    গৈরিক মজা করে হেসে বলে উঠলো, “আপনার রাধা কিন্তু বেশ ফাঁকিবাজ হয়ে উঠেছে!” এই বলে সে হাতের একটি আঙ্গুল টেবিলের ওপর ঘষে বোঝাতে চাইলো যে তাতে কত ধুলো জমেছে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে উর্মি দেবী ম্লান হেসে বললেন, “এতে ওর কোনো দোষ নেই, গৈরিক বাবু। এই কয়েক দিনে আমার যা মানসিক অবস্থা হয়েছিলো, আমাকে সামলাতেই ওর গোটা দিন লেগে যাচ্ছিলো।”

    অরূপ বাবুর বাড়ি থেকে ফিরতি পথে, টুসুর অবশ্য খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো, যে গৈরিক একটু আগে নিজের পকেটে ওটা কি ঢোকালো, কিন্তু সে জানে যে এখন এই সংক্রান্ত কোনো কথাই তাকে বলবে না তার গেরোদা। অগত্যা কিছু না বলাই ভালো।

    (৩)


    পরদিন সকালেই গৈরিক আর টুসু পৌঁছে গিয়েছিলো সোদপুরে অবস্থিত ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’-এর অফিসে। সোদপুর স্টেশন থেকে অনতিদূরে, এই সংস্থারই তৈরি একটি বহুতলী ফ্ল্যাটের নীচে এই অফিস। গুগল করে খুব সহজেই পাওয়া যায় এই ঠিকানা, বোঝাই যাচ্ছে, যে এই দেবাশিস গোস্বামী হলেন সোদপুরের বেশ বিত্তশালী প্রমোটারদের মধ্যে একজন। বেশ সাজানো গোছানো অফিস ঘরে তিনি ছাড়াও কাজ করে আরো দুজন কর্মচারী।

    দেবাশিস বাবুর বয়স আন্দাজ বিয়াল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মধ্যে, বেশভূষায় শৌখিনতার ছাপ। দেখতেও যথেষ্ট সুপুরুষ তিনি। তবে এহেন গোয়েন্দা এবং তার সহকারীর আগমনে যে তিনি খুব একটা খুশি হননি, সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। বেশ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই, অন্য কাজের তাড়া দেখিয়ে তিনি প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সারলেন। এরপর গৈরিক তার উদ্দেশ্যে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “উর্মি দেবীর কথামত আপনি সেদিন সন্ধ্যায় অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে যান। সেখানে গিয়ে তার সাথে আপনার ঠিক কি কি কথাবার্তা হয়?”

    বেশ ভরাট গমগমে পুরুষালি কণ্ঠে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “শুধু সেদিন নয়, ওনার জীবিত কালে প্রায়ই আমি ওনার সাথে দেখা করতে যেতাম। কারণটাও নিশ্চয় ওনার স্ত্রী আপনাদের জানিয়েছেন। সেদিনও এই উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম, যে টাকার অঙ্কটা একটু বাড়িয়েও যদি ওনাকে ওই বাড়িটা আমাকে বিক্রি করতে রাজি করাতে পারি…কিন্তু তিনি তার কলেজের ওই ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই খুব ডিপ্রেসড ছিলেন। আমার কথায় রাজি হওয়া তো দূরের কথা, তিনি আমাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন!”

    “সেকি! এতো খুব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি, মশাই!”, ব্যাঙ্গের সুরে বলে উঠলো গৈরিক, “আপনার মত মানুষকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া! সত্যিই অরূপ বাবুর সাহস বলিহারী!…আচ্ছা, আপনি নিশ্চয় ওনার স্টাডি রুমে বসেই ওনার সাথে কথা বলেছিলেন?”
    “হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?”, উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু।
    সেই কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো গৈরিক, “আচ্ছা, ওনার সাথে কথা বলার সময় কোনো মুহূর্তে কি আপনি ওই ঘরে একলা কিছুক্ষন কাটিয়েছিলেন?”
    “উনি পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে একবার ওয়াশ-রুমে গিয়েছিলেন, তখন ওই ঘরে আমি একাই ছিলাম….কিন্ত খুব আশ্চর্যের বিষয় তো, এই সব কথা আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?”, বিরক্ত হয়ে বললেন দেবাশিস বাবু।

    গৈরিকের হয়ে, এবার মুচকি হেসে উত্তর দিলো টুসু, “বিষয়টা বোঝা সত্যিই কি খুব কঠিন, মিস্টার গোস্বামী? অরূপ বাবুর মামার বাড়িটা পাওয়ার পথে উনিই ছিলেন অপনার জন্য সবচেয়ে শক্ত কাঁটা, ওনাকে কোনো ভাবে সরিয়ে দিতে পারলে, উর্মি দেবীর মত একজন ভেঙে পড়া একলা মহিলাকে ভয় দেখিয়ে বাড়িটা বিক্রি করতে রাজি করানোটা আপনার পক্ষে কোনো ব্যাপারই নয়!…আর আপনি নিজে মুখেই স্বীকার করলেন, যে আপনি ওই ঘরে কিছুক্ষনের জন্য একা ছিলেন। এই সুযোগে ওনার প্রেসারের ওষুধের কৌটোর মধ্যে একই রকম দেখতে এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দেওয়াটা কি খুব কঠিন কাজ? জানতেন আপনি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ওই কৌটো থেকে ওষুধ বার করে খেতে চলেছেন…”

    “মুখ সামলে কথা বলো!”, টুসুর কথা শেষ না হতেই গর্জে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “মনে রেখো, তুমি তো কোন ছাড়, তোমার দাদার মত এই সব শখের গোয়েন্দারা আমার হাতের নস্যি!”
    টুসুও কিছু একটা চিৎকার করে বলতে চলেছিলো, কিন্তু গৈরিক তাকে থামিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনার হাতের নস্যি আপনার হাতে হাতকড়া পরাতে পারবে কিনা, তা তো প্রমান হবে ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে পাওয়া ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্টে! চল টুসু, আপাততঃ এর কাছে আমার আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই…”, এই বলে টুসুর সাথে অফিস ঘর থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতেই, পেছন থেকে উন্মাদের ভঙ্গিতে আবার চিৎকার করে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “হ্যাঁ, যান যান…আমাকে ফিঙ্গার-প্রিন্ট দেখাতে আসবেন না! যদি দেখাতে চান, তো গোপাল নন্দীকে দেখান! কারণ আমার আসার আগে সেও সেদিন এসেছিলো অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে, ওই ঘরে বসেই কথাবার্তা বলছিলো ওরা…শুধু কথাবার্তা বললে ভুল হবে, গালিগালাজ আর তর্কবিতর্ক চলছিলো দুজনের মধ্যে…”

    গৈরিক কৌতূহলী হয়ে আবার পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো দেবাশিস বাবুর দিকে মুখ করে, তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “কে এই গোপাল নন্দী?”
    নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “গোপাল বাবু হল অরূপ বাবুর কলেজের একই ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরির এক এসিস্ট্যান্ট। কিছুদিন আগে অরূপ বাবু নাকি প্রমান করে দেন, যে সরকারের পয়সায় ল্যাবের কাজের জন্য যে সকল জিনিসপত্র আসে, তার বেশির ভাগটাই এই গোপাল নন্দী আত্মসাৎ করে। তারপর তা চড়া দামে অন্যত্র বেচে দেয়। এর ফলে গোপাল বাবুর চাকরি চলে যায়, কয়েক মাসের জন্য জেলও খাটতে হয় তাকে। ওই ঘরে গিয়ে ওদের কথা যেটুকু শুনেছিলাম, তাতে বুঝেছিলাম যে সেই দিনই বোধহয় জেল থেকে ছাড়া পায় গোপাল। তবে আমি আসার পরই আর অরূপ বাবুর সাথে কোনো কথা না বাড়িয়ে সে কেটে পরে ওখান থেকে। তাই প্রতিহিংসার বশে, প্রেসারের ওষুধের মধ্যে এন্টি-বায়োটিক মিশিয়ে দেবার মত সুযোগ বা জ্ঞান কিন্তু তারও ছিলো, মিস্টার সেন!”

    এরপর দেবাশিস বাবুর সাথে আর বেশি কথা বাড়ায়নি গৈরিক। গোপাল নন্দীর বাড়ির ঠিকানা দেবাশিস বাবুর জানার কথা নয়। অগত্যা গৈরিক আর টুসু ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’ থেকে বেরিয়ে রওনা হল সেই থানার উদ্দেশ্যে, যেখানে গোপাল বাবুর বিরুদ্ধে ওই চুরির কেস রেজিস্টার করা হয়েছিলো।

    (৪)


    আমা স্ট্রিট থানা থেকে গোপাল নন্দীর ঠিকানা জোগাড় করে সেদিন বিকালেই গৈরিক আর টুসু পৌঁছে গিয়েছিলো গড়িয়াহাটে অবস্থিত তার ছোট্ট একতলা বাড়িতে। সত্যিই মানুষটার বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুব সঙ্গিন। ক্ষণিকের লোভের বশবর্তী হয়ে চাকরি হারিয়ে, জেল খেটে স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছে বেচারা।

    “হ্যাঁ, সেদিনই সকালে জেল থেকে ছাড়া পাই আমি”, কালো হৃষ্ট-পুষ্ট বেঁটে চেহারার গোপাল নন্দী বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে হাত পা নাড়িয়ে বলে উঠলো, “তারপর সেদিন বিকালেই অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে যাই আমি। তাকে জিজ্ঞাসা করতে যাই, যে তার মত লাখ টাকা মাইনে তো আমার নয়, তাহলে আমি যদি বাঁকা পথে দু-পয়সা ইনকাম করেই থাকি, তাতে তার কোন পাকা ধানে মই পড়লো?”
    “তার মানে এভাবেই বেশ ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়ে যায় আপনাদের দুজনের মধ্যে, তাই তো?”, জিজ্ঞাসা করলো টুসু।
    “প্রথমে তা নয়। তার কাছে গিয়ে সবার প্রথমে আমি নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাওয়ার অভিনয় করি! ভেবেছিলাম, যে এই ভাবে তার কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা ধার নিতে পারবো। বুঝতেই পারছেন, এখন সংসারের যা অবস্থা… কিন্তু তিনি এক পয়সাও আমাকে দিতে রাজি হলেন না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন! তখন আমি নিজের আসল রূপ ধরলাম, ওনার সাথে শুরু হল ঝগড়াঝাঁটি! আমার তো মনে হচ্ছিলো ওই শালাকে জন্মের মত শেষ করে দিতে…”, চিৎকার করে উঠলো গোপাল।

    “আর সেই জন্যই আপনি ওনার কোনো অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে ওনার প্রেসারের অসুধের কৌটোর ভেতর ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দিলেন, তাই তো? আপনি যখন সিটি কলেজের ফিসিওলজি ডিপার্টমেন্টের ল্যাবে কাজ করতেন, তখন এই বিষয়ের ওপর কিঞ্চিত জ্ঞান আপনার নিশ্চয় আছে। তাই, এই দুটি ড্রাগের সমবেত বিষক্রিয়ার কথাও আপনার অজানা নয়!”, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক।
    এই কথা শুনে পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো গোপালের মুখ, সে দুই হাত জোর করে কেঁদে উঠলো, “না বাবু, না! রাগের মাথায় অরূপ বাবুকে খুন করার কথা আমার মাথায় এসেছিলো মাত্র, কিন্তু ওই সব ওষুধপত্র মিশিয়ে দেওয়ার কথা কখনো ভেবে দেখিনি, বাবু! সে সুযোগও আমার ছিলো না, কারণ যতক্ষণ আমি ওই বাড়িতে ছিলাম, তিনি আমার সামনেই ছিলেন…তবে…”
    “তবে কি? এই বিষয়ে কি আপনার অন্য কাউকে সন্দেহ হয়?”, জিজ্ঞাসা করলো টুসু।

    নিজেকে কিছুটা শান্ত করে তিনি বলে উঠলেন, “দেখুন দিদি, সঠিক ভাবে বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয়, যদি অরূপ বাবু আত্মহত্যা নাই করে থাকেন, তাহলে ওই ওষুধ মিশিয়ে তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য কিন্তু আরও একজনের থাকতে পারে… সে হল ওনার বাড়ির কাজের মেয়েটা, কি যেন ওর নামটা… হ্যাঁ, মনে পড়েছে… রাধা!”
    অবাক হয়ে টুসু বলে উঠলো, “সে কি! আপনার এমন মনে হওয়ার পেছনে কারণ?”
    “মেয়েটা খুব একটা ভালো নয়, দিদি”, ফিসফিস করে বলে উঠলো গোপাল, “লোক মুখে শোনা কথা, অরূপ বাবুর সাথে ওনার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হত সে! আমি সেদিন যখন ওনার বাড়ি পৌঁছলাম, সেই সময়ও ওনার স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। বাড়ির নীচ থেকেই রাধা আর অরূপ বাবুর মধ্যে একটা কথা কাটাকাটির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো। অরূপ বাবুর পাড়ার অনেকেই বলে, যে রাধার বর একটি ওসুধের দোকানে কাজ করতো। এখন যদিওবা সে অন্য মেয়ের সাথে কেটে পড়েছে, তবুও তার কাছ থেকেই রাধার ওই দুটি ওষুধের সম্পর্কে জানা খুব একটা অসম্ভব নয়, তাই না?”

    টুসুর যেন মনে হল, যে তার মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে গেল! এ বলছে ও দোষী, তো ও বলছে এর ওপর আমার সন্দেহ। সত্যিই বড্ড জটিল এই কেসটা, এখনো তো বোঝাই যাচ্ছে না যে অরূপ বাবুর মৃত্যুটা আত্মহত্যা নাকি খুন, তো খুনিকে সনাক্ত করা অনেক দুরের কথা। যাই হোক, আর অল্প কিছু সাধারন কথাবার্তার পর ওরা দুজনে বেরিয়ে এলো গোপাল নন্দীর বাড়ি থেকে।

    (৫)


    পরের দিন সকাল থেকে গৈরিক নিজের কি যেন একটা ব্যক্তিগত কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলো, তাই গোটা দিন আর এই কেস নিয়ে একটুও এগোনো গেল না। এই ধরণের পরিস্থিতি টুসুর জন্য সত্যিই খুব অস্বস্তিকর। প্রতিটা কেসের শুরু থেকে যতক্ষন না তার গেরোদা আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারছে, ততক্ষণ বোধহয় গৈরিকের থেকেও আরো বেশি আহার নিদ্রাহীনতায় ভোগে টুসু। কবে যে সে নিজেও তার গেরোদার মত এমন জটিল সব কেসের সমাধান করতে পারবে!

    সেদিন বিকালে কলেজের পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়ে টুসু গিয়েছিলো টালিগঞ্জে, তার এক বান্ধবীর বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। নবীনা সিনেমার সামনে তখন বিশাল ভিড়, কোন একটি ডিটেক্টিভ সিনেমার আজ ফার্স্ট ডে ইভিনিং শো। টুসুও ভাবছিলো, টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বে কি না, এমন সময় তার চোখ চলে গেল রাস্তার ওপাশে। সেখানে একটি বহুতলী আবাসনের ভেতর থেকে যে বেরিয়ে রাস্তায় এলো, তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল টুসু…এ তো রাধা! টুসু লক্ষ্য করলো, যে সেই বহুতলীর দোতলায় আছে কোনো অফিস ঘর। একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করতেই, এই সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তার আলোতেই সে দেখতে পেল, যে সেই অফিসঘরের বাইরের দেওয়ালে আটকানো ব্যানারের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে ‘মা সারদা আয়া সেন্টার’।

    টুসু ছুটে গেল রাস্তার ওপারে, রাধার কাছে। তাকে এখানে দেখে রাধাও যেন বেশ আশ্চর্য হয়েছে। টুসু হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি গো…তুমি এখানে? এই সময়?”
    রাধা মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বলে উঠলো, “আসলে আজকে তো মাসের সাত তারিখ, দিদি…তাই এখানে এসেছিলাম মাইনে নিতে।”
    এই বার টুসুর কাছে পরিষ্কার হল ব্যাপারটা, ওরা দুজনে এক সাথে হাঁটতে লাগলো পাকা রাস্তা দিয়ে। টুসু বলে উঠলো, “আচ্ছা, তো তোমাকে এই আয়া সেন্টার অরূপ বাবুর বাড়িতে নিয়োগ করেছে বুঝি?”
    “হ্যাঁ দিদি, তবে এখানকার নিয়ম হল যে যারা আমাদের কাজে লাগাচ্ছেন, তারা সরাসরি আমাদের মাইনে দিতে পারবেন না। প্রতি মাসে তারা পয়সা দেবেন এখানে, আর আমাদের এখানে এসে মাইনে নিয়ে যেতে হবে।”, প্রত্যুত্তর দিলো রাধা।

    এবার প্রসঙ্গ পাল্টে টুসু তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “একটা কথা সত্যিই করে বলো তো রাধা, তোমার কি অরূপ বাবুর সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিলো?”
    এই কথা শুনে মাথায় বজ্রপাত ঘটার মত চমকে উঠলো রাধা, তারপর একবার ঢোক গিলে বলে উঠলো, “কে..কেন, এই কথা কে বললো আপনাদের?”
    “যেই বলে থাকুক না কেন, সত্যিটা কিন্তু আমাদের জানানো তোমার নিজের পক্ষেই ভালো, রাধা”, বিজ্ঞের মত বলে উঠলো টুসু।
    এবার যেন একটু ভেঙে পড়লো রাধা, রাস্তার পাশে থাকা একটি বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। টুসুও নাছোড়বান্দা, সেও গিয়ে বসলো তার পাশে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রাধা, “কি করবো বলুন দিদি? এই কটা টাকা মাত্র মাইনে, বাড়িতে অসুস্থ বাপ। তার চিকিৎসার পেছনেই পুরোটা ঢেলে দিতে হয়… বৌদির অনুপস্থিতিতে দাদাবাবুই আমায় মাঝে মাঝে ওই প্রস্তাব দিতেন। বেশ কিছু পয়সা কড়িও দিয়েছিলেন ওর জন্য!…কিন্তু ইদানিং কেমন যেন একটা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, কাজ সেরেও পয়সা বাকি রাখতে শুরু করলেন। আর সেই দিন তো গোপাল বাবুর আসার আগে এই নিয়েই আমাদের মাঝে খুব কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো!”

    “আর সেই জন্যই কি রেগে গিয়ে তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করলে, সুযোগ বুঝে তার প্রেসরের ওষুধের মধ্যে ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দিয়ে?”, কড়া স্বরে বলে উঠলো টুসু।
    রাধা আঁতকে উঠলো এই কথা শুনে, “না, দিদি, এ কি বলছেন আপনি! এই কাজ আমি কখনো করতে পারি না, কখনো না! হ্যাঁ, সেদিন ওই উপরি পাওনা নিয়ে আমার ঝগড়া হচ্ছিল দাদাবাবুর সাথে, কিন্তু আমি জানতাম যে একদিন তিনি আমার সব টাকা মিটিয়েই দিতেন!”
    এই কথা শুনে বেশ নিরাশ হল টুসু, কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ক্লান্ত গলায় সে বললো, “ঠিক আছে, না হয় মানলাম তোমার কথা। তবে তোমার কি মনে হয়, যদি অরূপ বাবু আত্মহত্যা না করে থাকেন, তাহলে কে তাকে মারতে চাইবে?”

    এবার যেন আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো রাধার ঠোঁটদুটি। সে দুই হাত দিয়ে টুসুর হাতটিকে আঁকড়ে ধরে বলে উঠলো, “দিদি গো, সত্যিই বলছি আমি! ওই বাড়িটা ভালো নয়! ওই বাড়ির ওপর ভূত প্রেতের ছায়া আছে, বিশ্বাস করুন আমার কথা! নিজে চোখে দেখেছি আমি…আগে রাত্রে ওই বাড়িতেই থাকতাম আমি। বেশ কয়েক বার রাত্রে বাগানের ভেতর একটা সাদা পোশাক পরা আবছা পুরুষের ছায়ামূর্তিকে স্পষ্ট দেখেছি আমি! এ আমার চোখের ভুল নয় গো, সেই জন্যই ওই বাড়িতে রাতে থাকা বন্ধ করে দিলাম আমি, বাপের অসুস্থতার বাহানা করে! উর্মি বৌদি এই সব কথা বিশ্বাস করেন না, তাই সেদিন ওনার সামনে আপনাদের এই কথা আমি বলিনি।”
    টুসু অবাক হয়ে শুনছিলো রাধার কথা, তারপর সে বলে উঠলো, “তো তোমার মনে হচ্ছে যে ভূত এসে তোমার দাদাবাবুর প্রেসারের ওষুধের কৌটোয় এন্টি-বায়োটিক রেখে গিয়েছে, তাই তো?”
    রাধা যেন সেটাই মনে প্রানে বিশ্বাস করে, সে তখনও সেই সাদা পোশাকের প্রেতাত্মাকেই হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করে গেল। এই সব শুনতে শুনতে টুসুরও কেন যেন গা ছমছম করে উঠলো। এদিকে রাতও বেশ হয়েছিল, অতঃপর ওরা একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যে যার রাস্তা ধরলো।

    ফিরতি পথে অটোতে বসে, এই কেসটার ব্যাপারে ভেবে টুসুর যেন মাথা ঘুরে গেল। প্রথমে সন্দেহের তীর অরূপ বাবুর নিজের ওপরই, তারপর দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী, রাধা এবং সবশেষে এই ‘ভূত’! নাহ, গেরোদাকে আজ রাতেই ফোন করে বলতে হবে সব কথা। তবে একটা বিষয় বেশ রহস্যময়, ওই বাড়িতে ভূত থাকুক না থাকুক, কিছু তো একটা নিজের চোখে দেখেছেই রাধা! কি সেটা?

    (৬)


    পরদিন সকালেই গৈরিক আর টুসু হাজির হয় ‘মা সারদা আয়া সেন্টার’-এর অফিসঘরে। উদ্দেশ্য, রাধার সম্বন্ধে আরো ভালো ভাবে খোঁজ খবর নেওয়া। এক কামরার ছিমছাম অফিসঘর। হিসাবপত্র রাখার জন্য রাখা হয়েছে মাত্র একজন কর্মচারীকে। এই সংস্থার মালকিন হলেন ডা: মহুয়া সেনগুপ্ত। মহুয়া দেবী পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তার নিজের একটি ছোট খাটো মানসিক রোগীদের হাসপাতালও আছে খিদিরপুরে। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথেও তিনি যুক্ত, আর এই আয়া সেন্টারটির মূল উদ্দেশ্যই হল সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জীবিকা উপার্জনের একটি সুস্থ উপায় বার করে দেওয়া।

    খুব একটা অসামান্য সুন্দরী না হলেও, বেশ চটকদার চেহারা মহুয়া দেবীর। বেশভূষাতেও খুব আধুনিকা তিনি। তার চেম্বারে বসেই তার সাথে গৈরিক আর টুসুর কথা হচ্ছিলো মূলতঃ রাধাকে নিয়ে। কিছুক্ষন আগেই বেয়ারা এসে সকলের জন্য ধূমায়িত কফির কাপ আর বিস্কিটের প্লেট রেখে গিয়েছে। তাতে একবার আলতো করে চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন মহুয়া দেবী, “মা মারা মেয়ে, অভাবের সংসার। বাবার হার্টে ব্লকেজ ধরা পড়েছে। খুব ছোটবেলাতেই বিয়ে হয়েছিলো তার, তবে সেই বরও তাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে পালালো। এমনই দুঃখের জীবন রাধার। আমি চেয়েছি, যে মেয়েটা যেন সৎ পথে একটু খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।”
    “কিন্তু আপনি কি জানেন, যে এই মেয়েটার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অরূপ বাবুর সাথে, যার মৃত্যুর কিনারা করতেই নেমেছি আমরা”, বলে উঠলো টুসু।
    “এর জন্য কি রাধা দায়ী? নাহ, নিশ্চয় এমন কাজ করার জন্য অরূপ বাবুই তাকে উস্কেছিলেন! আসলে, মেন আর পলিগ্যামাস ফ্রম দেয়ার ভেরি বার্থ…ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও বাইরের কোনো হতকুচ্ছিত মহিলার ওপরও এদের নজর থাকে! সেদিক থেকে দেখতে গেলে, শ্রীপর্ণা যে কাজটি করেছে, তা করা উচিত ছিলো রাধার…”, পুরুষ জাতির ওপর যেন সকল রাগ একসাথে উগরে দিলেন মহুয়া দেবী।

    টুসু মুচকি হেসে বলে উঠলো, “সেই প্রতিবাদ কিন্তু করেনি রাধা, বরং অরূপ বাবুর এই অশালীন শারীরিক চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে পয়সার লোভে। তার সাথে ঝগড়াঝাঁটি তখন করেছে, যখন অরূপ বাবুকে নিজের শরীর বিক্রি করার উপযুক্ত দাম সে পায়নি! এই সম্বন্ধে আপনি কি বলতে চান, মহুয়া দেবী?”
    মহুয়া দেবী আবার রাগত কণ্ঠে কিছু একটা বলতে চলেছিলেন, এমন সময় গৈরিক তাকে থামিয়ে, প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো, “আচ্ছা, আপনি তো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। এই মেয়েটার মানসিক অবস্থার সম্পর্কে কি ধারণা আপনার?”
    “মানে? ঠিক বুঝলাম না তো!”, প্রত্যুত্তরে বললেন মহুয়া দেবী।
    “মানে, সে আমাদের জানিয়েছে, যে রাত্রে ওই বাড়ির বাগানে নাকি কোন অশরীরি পুরুষকে দেখেছে সে!”, বললো গৈরিক।

    এই কথা শুনে এমন ভাবে চমকে উঠলেন মহুয়া দেবী, মনে হল যেন সেই অশরীরি পুরুষ এই মুহুর্তে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। “এই ব্যাপারে তো কোনো দিন কিছু বলেনি সে আমাকে”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি, “ঠিক আছে পরে যেদিন এখানে আসবে, সেদিনই ওকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে!”
    “ঠিক আছে, আমরা আজ তাহলে আসি। খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে কথা বলে, পরে না হয় আবার দেখা হবে”, এই বলে তাকে নমস্কার জানিয়ে টুসুকে নিয়ে সেই আয়া সেন্টারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো গৈরিক।

    ততক্ষনে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। নবীনা সিনেমার কাছটায় এখন খুব একটা ভিড় নেই। তবে সেই ডিটেক্টিভ সিনেমাটার পোস্টার দেখে বোঝা গেল, যে কিছুক্ষনের মধ্যেই আজকের দুপুরের শো শুরু হবে। গৈরিক যেন টুসুর মনের কথা বুঝে ফেললো, সে নিজের ওয়ালেট খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে টুসুকে বললো, “যা দেখি, কাউন্টার থেকে দুটো টিকিট কেটে আন।”
    টুসু হাসি মুখে এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। টিকিট কেটে ফেরার পথে দেখলো, যে গৈরিক কানে ফোন গুঁজে কার সাথে যেন কথা বলছে, “বাহ, ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্ট রেডি হয়ে গিয়েছে! তা কি বেরোলো রিপোর্টে? কার কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল সেখান থেকে….”
    টুসু দেখলো, যে এরপর ফোনের অপর প্রান্তের বক্তার কথাগুলো শুনে গৈরিকের উৎফুল্ল ভাবটা কেটে গেল। কেমন দৃঢ় হয়ে উঠলো তার চোয়াল, গম্ভীর মুখমণ্ডলে ছেয়ে গেল কোনো অজানা চিন্তার রেশ!

    (৭)


    গত দুই দিন ধরে গৈরিকের কোনো পাত্তা নেই। এদিকে কেসটাও যে কোন পথে এগোচ্ছে, সেটাই বুঝতে পারছে না টুসু। কি জানি বাবা, গেরোদা এই অদ্ভুত কেসটার কোনো সমাধান করতে পারবে তো? এখনো তো এটাই বোঝা গেল না, যে অরূপ বাবুর মৃত্যুটা কি হত্যা না আত্মহত্যা। তিনি মৃত্যুর আগে নিজে মুখে কিছুই বলে যাননি। এখনো পুলিশের হেফাজতে আছে শ্রীপর্ণা। ইতিমধ্যে তার সাথেও একবার সে আর গৈরিক দেখা করতে গিয়েছিলো থানায়, যদিও বা সেখান থেকেও অরূপ বাবুর মৃত্যু-রহস্যের কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি টুসু। এদিকে, মানুষেরা সব একে একে দোষ ঠেলছে ভূতের ওপর!

    এমনই সব চিন্তা নিয়ে মাথা ভার করে সেদিন দুপুরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলো টুসু, ঠিক এমন সময় বেজে উঠলো তার মোবাইল ফোনটা। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়েই, বেশ উৎসাহের সাথে টুসু বলে উঠলো টুসু, “হ্যাঁ, গেরোদা, বলো….”
    খুব সংক্ষেপে প্রত্যুত্তরে বললো গৈরিক, “ঝটপট তৈরি হয়ে বেহালায় অরূপ বাবুর বাড়িতে চলে আয় দেখি…”
    ব্যাস আর কিছু বলতে হল না গৈরিককে, তার গলার এই স্বর টুসুর খুব চেনা। তার মানে আজকেই হতে চলেছে এই নাটকের যবনিকা পতন! উত্তেজনায় যেন টগবগ করে ফুটতে লাগলো টুসুর শরীরের সকল রক্তবিন্দু!

    অরূপ বাবুর বাড়ি পৌঁছে টুসু দেখলো, যে তার বৈঠকখানার ঘরে এই নাটকের বাকি সকল চরিত্রই জমায়েত হয়েছে। রয়েছেন স্থানীয় থানার ওসি সাহেব, উর্মি দেবী, রাধা, দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী, শশাঙ্ক, এমনকি শ্রীপর্ণাকেও থানা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অদূরে বসে থাকা মহুয়া দেবীকে দেখেও বেশ আশ্চর্য হল টুসু, তার মানে তার সাথেও এই কেসের কোনো সম্পর্ক আছে, এটা তো তার মনেই হয়নি! কিন্তু মহুয়া দেবীর পাশের চেয়ারে যে সম্ভ্রান্ত চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোকটি বসে আছেন, তিনি কে? তাকে তো এর আগে কখনো দেখেনি টুসু!

    কিছুক্ষনের মধ্যেই বলতে শুরু করলো গৈরিক, “সবার প্রথমেই বলি, যে এই কেসটা হাতে নিয়ে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম, যে আর যাই হোক না কেন, অরূপ বাবু কিন্তু আত্মহত্যা করেননি। কারণ তা করার মত আরো সহজ উপায় তার হাতের কাছেই ছিলো। গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়তে পারতেন, বা নিদেনপক্ষে একগুচ্ছ ঘুমের ওষুধও গলাধঃকরণ করতে পারতেন…কিন্তু এই দুটি ড্রাগের বিষক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে…নাহ, নিজে মরতে হলে এত মাথা কেউ খাটাবে না! অরূপ বাবুকে খুন করা হয়েছে! সেই ক্ষেত্রে, শ্রীপর্ণা তার মৃত্যুর সাথে কোনো ভাবে জড়িত নয়!” হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো শ্রীপর্ণা, শশাঙ্ক তাকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের ভেতর।

    আবার বলতে শুরু করলো গৈরিক, “দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী এবং রাধা…এই তিনজনেরই অরূপ বাবুকে হত্যা করার মোটিভ ছিলো। এরা তিনজনেরই হাসপাতালে ভর্তি হবার আগের দিন অরূপ বাবুর সাথে বচসা হয়, তাদের হাতে সুযোগও ছিলো তার প্রেসারের ওষুধের কৌটোয় ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দেওয়ার। কিন্তু নাহ, আমার তদন্ত অনুযায়ী, এরা তিনজনই নির্দোষ। না তো এরা কেউ খুন করেছে অরূপ বাবুকে, না তো এদের কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে!” এই কথা শুনে এরা তিনজনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

    “তাহলে খুনি কে, গেরোদা?”, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো টুসু।
    “এবার দেখ ম্যাজিক”, প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলে উঠলো গৈরিক, “খুনি নিজের মুখেই স্বীকার করবে তার অপরাধের কথা!” এই বলে গৈরিক হাতের আঙ্গুল দিয়ে দুই বার তুড়ি বাজালো, আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই ঘরের পেছনের খোলা দরজার পর্দা সরিয়ে দুই জন কনস্টেবল এক সাদা পোষাক পরিহিত সুপুরুষ যুবককে সেই ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। একেও তো আগে কখনো দেখেনি টুসু! ভদ্রলোকের চেহারা সুন্দর হলেও কেমন যেন মরা মরা তার চোখের দৃষ্টি, নিরুদ্বেগ মুখের চাহনি, মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো চুল এবং গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো রাধা, “আরে! এই তো সেই লোকটা যাকে মাঝে মাঝে এই বাড়ির বাগানে দেখতে পেতাম রাতে! ওকে ওভাবে দেখে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিলাম!”

    কিন্তু এর পরে যে ঘটনা ঘটলো, তা দেখে আরও চমকে ওঠার পালা টুসুর। এই নবাগত লোকটিকে দেখে কেমন যেন মুখ চোখের ভাব বদলে যেতে লাগলো উর্মি দেবীর। তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো, উত্তেজনায় যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো তার সর্বশরীর। সকলকে অবাক করে তিনি একটা বিকট চিৎকার করে ছুটে গেলেন সেই যুবকটির দিকে, তারপর সারা বাড়ি কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, “সায়ন্তন…সায়ন্তন আমি তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি, সায়ন্তন! যে মানুষটা তোমাকে মেরে ফেলেছে, তার প্রেসারের ওষুধের মধ্যে এন্টি-বায়োটিক মিশিয়ে আমিও তাকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছি! বলো, তোমার আত্মা শান্তি পেয়েছে কি না, বলো…বলো না…”
    সকলকে আরো অবাক করে সায়ন্তন নামক সেই যুবকটিও অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “হ্যাঁ উর্মি, এত দিন ধরে মরেও শান্তি পাচ্ছিলাম না আমি, অরূপের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনায় প্রতি মুহূর্ত ঘুরে বেড়িয়েছি এই বাড়ির প্রতিটি কোণে… এবার মুক্তি পাবো আমি…মুক্তি!”

    ঠিক সেই মুহূর্তেই উর্মি দেবী জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন সেই যুবকটির গায়ে। গৈরিকের ইশারাতে কনস্টেবলরা ওই যুবককে তখনই সেই ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল। উর্মি দেবীর জ্ঞানহীন দেহটিকে পাশে রাখা সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হল। সকলে যেন অবাক হয়ে এতক্ষন ধরে একটি যাত্রাপালার শেষ দৃশ্য দেখছিলো, এবার উদগ্রীব হয়ে উঠলো গৈরিকের ব্যাখ্যা শোনার জন্য!

    (৮)


    “তুই বোধহয় সেদিন দেখে ফেলেছিলিস, টুসু”, বলতে শুরু করলো গৈরিক, “যে আমি সেদিন ওপরের ঘর থেকে একটি কাগজের টুকরো নিজের পকেটে চালান করি। সেটা ছিলো একটা ওষুধের দোকানের বিল। যাতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা ছিলো ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেটের নাম, দাম এবং কেনার তারিখ যা কিনা অরূপ বাবুর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিন আগে। এছাড়াও, এই ওষুধটার সাথে আরেকটি বস্তুও ওই দোকান থেকে কেনা হয়েছে একই সময়ে…সেটা হল একটি গ্লাভস। সেই দোকানে একটু খোঁজ নিজেই জানতে পারলাম এই দুটি দ্রব্যের ক্রেতা আর কেউ নয়, স্বয়ং উর্মি দেবী। দোকানের সিসিটিভি ফুটেজেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো তাকে।”

    “অরূপ বাবুর সম্বন্ধে কলেজ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে তিনি পি.এইচ.ডি করেছেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আরো কয়েকটা তথ্য। প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। অরূপ বাবুর মত, সেটাই ছিল পি.এইচ.ডি-র ফাইনাল ইয়ার আরো একজন গবেষকের জন্য…এবং তিনিই হলেন এই সায়ন্তন বাবু…মানে ডা: সায়ন্তন চক্রবর্তী! আর ঠিক সেই সময়ই এম.এস.সি-র প্রথম বর্ষে সেখানে ভর্তি হন উর্মি দেবী। এই তিন জনের মধ্যে শুরু হয় এক সম্পর্কের টানাপোড়েন। উর্মি দেবী আর সায়ন্তন বাবু একে অপরকে ভালোবাসতেন, কিন্তু উর্মি দেবীর প্রতি অরূপ বাবুর প্রেম ছিলো এক তরফা!”

    “এদিকে ডক্টরেট ডিগ্রি হাসিল করেই অরূপ বাবু অধ্যাপনার চাকরি জুটিয়ে ফেলেন। সায়ন্তন বাবু ছিলেন তখনো বেকার। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না অরূপ বাবু, কারণ সায়ন্তন বাবু ছিলেন বেশ স্বচ্ছল পরিবারের সদ্য মাতৃ পিতৃহারা একমাত্র বংশধর। উর্মি দেবী তার সাথেই বিয়ে করার কথা ঠিক করলেন। ঠিক এই সময়ই মোক্ষম চালটা চাললেন অরূপ বাবু!”, এতটা বলে গৈরিক হঠাৎ তাকালো মহুয়া দেবীর পাশে বসা সেই অচেনা বয়স্ক ভদ্রলোকটির দিকে, তারপর বললো, “কি ডক্টর শতদল মজুমদার, বাকি অংশটা বরং আপনার মুখেই শুনি…”

    সেই ভদ্রলোক এবার নতমুখে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমি ছিলাম সায়ন্তনের পরিবারের বহুদিনের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। ওরা সকলেই ছিলো আমার চিকিৎসার অন্ধ-ভক্ত। কিন্তু একটা দোষ আমার ছিলো, নারী শরীরের প্রতি আসক্তির দোষ। বিয়ে করিনি, তাই সেই চাহিদা পূরণ করতে যেতে হত বাজারের মেয়েদের কাছে। অরূপের সায়ন্তনের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল, তাই সে চিনতো আমাকে। জেনে ফেলেছিলো আমার নিষিদ্ধ-পল্লীতে যাওয়ার কথা। এমনই একটি মেয়েকে পয়সা খাইয়ে, সে তার সাথে আমার সঙ্গম দৃশ্যের কিছু অশ্লীল ছবি আয়ত্ত করে। অরূপ সেগুলো দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করে, বলে যে যেভাবেই হোক সায়ন্তনের সাথে উর্মির বিয়েটা আমাকে ভেঙে দিতে হবে!”

    “আর তাই যখন সাধারণ কোনো কারণ বশতঃ সায়ন্তন বাবু শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, আপনি তার ব্লাড টেস্ট করিয়ে একটি ফেক রিপোর্ট নিয়ে আসেন, যাতে বলা ছিলো যে সায়ন্তন বাবু ব্লাড ক্যানসারের লাস্ট স্টেজের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন! তিনি দেবতার মত বিশ্বাস করতেন আপনাকে, তাই এই কথাই মনে নিলেন। অপর কোনো চিকিৎসকের কাছে গেলেন না”, বলে উঠলো গৈরিক।

    “হ্যাঁ”, বললেন শতদল বাবু, “সেই মুহূর্তে সায়ন্তন এতটাই ভেঙে পড়লো, যে নিজেই উর্মির সাথে বিয়ে ভেঙে দিতে চাইলো। সে জানতো, যে এই কথা জানার পরও উর্মি তাকে ছাড়তে চাইবে না, তাই সে অরূপকে গোপনে ডেকে উর্মির সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে নিজে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজেকে এই পৃথিবীর অল্প কিছুদিনের অতিথি মনে করে, সে চাইলো না উর্মির সাথে বিয়ে করে তার জীবনটা নষ্ট করতে। আমিই তাকে গোপনে একটি বাড়ি ভাড়া জোগাড় করে দিলাম। এর মধ্যেই কেটে গেল এক বছর। উর্মির কাছে সায়ন্তনের কোনো হদিস ছিলো না, এর মধ্যেই অরূপ তাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেটে পড়া এক বিশ্বাসঘাতক প্রমান করতে সফল হল উর্মির কাছে। বেশ কিছুদিন আপত্তি করেও, শেষে উর্মি রাজি হল অরূপকে বিয়ে করতে।”

    “বাকিটা আপনার মুখ থেকে শুনবো, মহুয়া দেবী”, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক। বিন্দুমাত্র অসম্মতি প্রকাশ না করে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন মহুয়া দেবী, “এই পরিস্থিতিতে, আসন্ন মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে, ডিপ্রেশনে ভুগে সায়ন্তন বাবু একটি ভয়ঙ্কর মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেন, সাইকোলজির পরিভাষায় যাকে বলে ‘Cotard Delusion’. এই রোগে একজন মানুষ সশরীরে বেঁচে থাকলেও, তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে সে মৃত! সে নিজেই নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, নিজেকে মনে করে একজন অশরীরি! তাই বাধ্য হয়েই শতদল বাবু সায়ন্তন বাবুকে আমার মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রথম দেখাতেই আমি সায়ন্তন বাবুর প্রতি আকৃষ্ট হলাম, মনে প্রানে তাকে ভালোবেসে ফেললাম!”

    “এর পর আমি ধীরে ধীরে সায়ন্তন বাবুর আরো কাছে আসতে শুরু করলাম। অনেক কষ্টে, বার বার ওনার কাউন্সেলিং করে জানতে পারলাম যে উনি মনে করেন যে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ওনার মৃত্যু হয়েছে। আমি গোপনে ওনার ব্লাড টেস্ট করলাম, কিন্তু সেখানে এই রোগের চিহ্ন মাত্র পেলাম না! বুঝতেই পারলাম, যে তিনি আসলে এক ভয়ানক প্রতারণার শিকার! যেহেতু এই বিষয়ে শতদল বাবু আমায় নিজে থেকে কোনো বিষয় বলেননি, আমি কাজে লাগলাম ওনার নারী দেহের প্রতি অতিমাত্রায় কামনা বাসনাকে। একদিন মদের নেশায়, আমার উলঙ্গ শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করলেন সব কথা।”

    “আর তখন আমি ঠিক করলাম, যেভাবে সায়ন্তন বাবুর সাথে প্রতারণা করে তাকে এই মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হল, আমিও একই ভাবে অরূপ বাবু আর উর্মি দেবীর সুখের সংসার ছারখার করে দেবেন। এই মানসিক রোগের পেশেন্টরা ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে তাদের প্রতি, যারা তাদের মৃত হওয়ার কথা অস্বীকার করে। তাই আমি সব সময় তার সামনে এই কথা মেনে নেবার অভিনয় করলাম, যে তিনি মৃত! কিন্তু তাকে বোঝাতে লাগলাম, যে তার মৃত্যুর কারণটা ব্লাড-ক্যানসার নয়, অরূপ বাবু গোপনে খুন করেছেন তাকে! মানসিক ইনস্টেবিলিটি থাকার কারণে তিনি মেনেও নিলেন এই কথা। এই প্রক্রিয়াকে সাইকোলজির পরিভাষায় বলা হয় ‘Memory Manipulation’.”

    “কাকতালীয় ভাবে, সেই সময় অরূপ বাবু নিজেই আমার আয়া সেন্টারে যোগাযোগ করলেন একটি কাজের লোকের খোঁজে। আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম! রাধাকে পাঠালাম তাদের বাড়িতে। ওর থেকেই প্রতিনিয়ত ওনার পরিবারের ছোট বড় সকল খবরাখবর পেতে লাগলাম। তবে রাধাকে কখনো জানতে দিইনি আমার অভিসন্ধির কথা….প্ল্যান মাফিক, আমি বেশ কয়েকদিন রাতে সায়ন্তন বাবুকে নিয়ে যেতাম অরূপ বাবুর বাড়ির বাগানে। জানতাম আমি, যে উর্মির ভালো ঘুম হয়না, তাই কোনোদিন সে তার চোখে পড়বেই। আর হলও তাই! রাতের অন্ধকারে প্রতিনিয়ত সাদা পোশাকে সায়ন্তন বাবুকে দেখে উর্মির মনে হল যে এটা তার প্রেতাত্মা! এদিকে আমার শেখানো বুলিই সায়ন্তন বাবু আওড়াতেন উর্মি দেবীর সামনে, যে তাকে অরূপ বাবু গোপনে খুন করেছেন…তার প্রতিশোধ চাই! বোধহয় এমনই কোনো দিন রাধাও দেখে ফেলেছিলো সায়ন্তন বাবুকে।”

    “আমার উদ্দেশ্য সফল হল, উর্মি দেবীর মধ্যে দুটি সত্তা কাজ করতে লাগলো। একটিতে ছিলো তার নিজের স্বামীর প্রতি কর্তব্যবোধ এবং আনুগত্য, এবং অপরটিতে জাগ্রত হল পুরোনো প্রেমিকের এই নিদারুণ পরিণতির জন্য স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা। তিনি হলেন ‘Dissociative Identity Disorder’ নামক মানসিক রোগের শিকার। হয়তো এর জন্য দায়ী তার ছোটবেলায় বাবাকে হারানো, সৎ বাবার দ্বারা যৌন নিগ্রহ তথা পরিবারকে ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে থাকার ট্রমাগুলি। আর এই দ্বিতীয় সত্তার অধীনে এসে তিনি কি করেছেন, তার প্রমান তো আপনার কিছুক্ষন আগেই পেলেন।”

    এতক্ষন পর আবার বলতে শুরু করলো গৈরিক, “যেহেতু উর্মি দেবী হাতে গ্লাভস পরে ওই প্রেসারের ওষুধের কৌটোতে এন্টি-বায়োটিক রেখেছেন, তাই ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্টে একমাত্র অরূপ বাবু ছাড়া আর কারোরই আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেই দিনই দ্বিতীয় সত্তার অধীনে এসে, সুযোগ বুঝে তিনি করেছিলেন এই কাজ। ফিজিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করার ফলে ওই দুটি ড্রাগের বিষয়ে তার কিছু অজানা ছিলো না। গ্লাভসটাকেও এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তবে মানসিক দোলাচলের অস্থিরতায়, ওষুধের বিলটা এই ঘরের গার্বেজের মধ্যেই ফেলে রাখলেন। আর রাধাও এই কয়দিন গার্বেজগুলিকে বাইরে ফেলার সুযোগ পায়নি, সেই কথা তো আমরা আগেই শুনেছি।”

    “এবার বলি, আমি এত কিছু জানতে পারলাম কি ভাবে। খিদিরপুরে মহুয়া দেবীর মানসিক রোগের হাসপাতালে গোপনে খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারলাম একটি অদ্ভুত কথা। এখানে নাকি এক সুদর্শন পুরুষ বেশ কিছু দিন ধরে ভর্তি আছেন, মহুয়া দেবী নাকি তাকে নিজের কোন এক আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। তাকে নাকি মাঝে মাঝে রাত্রি বেলায় এখান থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান ডিনার খাওয়াতে!…সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো রাধার দেখা সেই অশরীরি পুরুষের কথা! ওই হাসপাতালেরই বিভিন্ন কর্মচারীদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে সায়ন্তন বাবুর সম্পর্কে আরো তথ্য অর্জন করলাম, পেলাম তার আসল ও নকল ব্লাড-টেস্টের রিপোর্ট গুলিও। সেখান থেকেই উঠে এলো শতদল বাবুর নাম। তারপর অবশ্য শতদল বাবু আর মহুয়া দেবীর মুখ থেকে বাকি কথা বার করার কৃতিত্বটা অনেকটা পুলিশ মহলেরও!”

    সেদিনই পুলিশ গ্রেফতার করলো শতদল বাবু আর মহুয়া দেবীকে। মুক্তি পেল শ্রীপর্ণা। সাথে উর্মি দেবী আর সায়ন্তন বাবুকেও কোনো মানসিক রোগের হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বাড়ির বাগানের একটি ঝোঁপের ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া গেল গ্লাভসটাকেও। এরপর দেশের বিচার ব্যবস্থা উর্মি দেবীর মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে করা এই অপরাধকে কি চোখে দেখে, বা তাকে কি শাস্তি দেয়, সেদিকেই এখন চোখ থাকবে সকলের!

    অরূপ বাবুর বাড়ি থেকে ফিরতি পথে টুসু গৈরিককে বলে উঠলো, “প্রেমে ব্যর্থতার মত সাধারণ বিষয়ও যে মানুষের কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনে, এই কেস তার প্রমান। উর্মি দেবী, সায়ন্তন বাবু আর অরূপ বাবুর সম্পর্ক সত্যিই ‘ঘাতক ত্রিকোণ'”
    গৈরিক একটা সিগারেট ধরিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিলো, “হুমম, তবে ঘাতক ত্রিকোণ কিন্তু একটা নয়… মহুয়া দেবী, সায়ন্তন বাবু আর উর্মি দেবীর সম্পর্কের ত্রিকোণটাও কিন্তু যথেষ্টই ঘাতক, বুঝলি টুসু!”
    টুসু উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলো, “সত্যিই গেরোদা, কিসের সাহায্যে যে তুমি এই জটিল কেসটার সমাধান করে উঠতে পারলে, সেই কথাই ভাবছি!”
    গৈরিক সম্পূর্ণ ফেলুদার স্টাইলে সিগারেটে সুখটান দিয়ে, আঙুলে তুড়ি মেরে বলে উঠলো, “মগজাস্ত্র!”

    (সমাপ্ত)

  • গল্প

    লাজবন্তীর কথা

    লাজবন্তীর কথা
    -প্রলয় কুমার নাথ

    (পর্ব-১)

     

     

    আজও কি গিলবো নাকি কয়েকটা?
    দুরুদুরু বুকে, ঘুমের ওষুধের ট্যাবলেটের কৌটোটা হাতে নিয়ে ভাবতে বসলো সোনালি। আজও কি বিছানায় শুয়ে, এদিকে ওদিকে ছটফট করতে হবে? চোখ বন্ধ করলেই কি সেই অজানা ছবিটা দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে উঠবে চোখের সামনে? আর কতদিন….আর কতদিন তাকে সহ্য করতে হবে, একটু শান্তিতে ঘুমোতে না পারার এই জ্বালা? দু চোখ বুজলেই, কেন ওই দৃশ্যটা বার বার ভেসে আসে চোখের সামনে? কি মনে করিয়ে দিতে চায় সেটা সোনালিকে? এই সব প্রশ্নের উত্তর সোনালি আজ অবধি পায়নি। কৌটোটা খুলে দুটো ঘুমের ওষুধ হাতের তালুর ওপর ঢাললো সোনালি। তারপর সেদুটিকে মুখে ঢুকিয়ে জলের বোতলের ছিপি খুললো। বিছানায় বসে দুহাতের মাঝে মুখ ঢুকিয়ে একবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। বায়োকেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পাঠরতা সোনালি জানে, যে মানব শরীরে এই ওষুধটি রোজ ব্যবহার করার কুফল কতটা, কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। আর যাইহোক, কিছুক্ষন সাময়িক শান্তি তো দেবে সেটা, কিছুক্ষন তো দু চোখের পাতা এক করতে পারবে সে, কিছুক্ষনের জন্য তো ঝাপসা হয়ে আসবে সেই রোজকার দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবিগুলি!

    রোজকার মতোই সকাল দশটা নাগাদ, রাজাবাজারের মোড়ে বাস থেকে নামলো সোনালি। গন্তব্য রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। এই জায়গাটা একদম ভালো লাগে না সোনালির। সবসময়ই যেন চারিদিকে মারামারি, হৈহট্টগোল আর ট্রাফিকের যানজট। এখানে একটা দুর্গন্ধও পাওয়া যায় সবসময়। সোনালি দেখল যে তার বান্ধবী সুচেতাও নাকে রুমাল চেপে ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সোনালি ওকে ডাকলো,
    – এই সুচি, দাঁড়া একটু……আমিও আসছি….
    সুচেতা ওকে দেখতে পেয়ে নাক থেকে রুমাল সরিয়ে মিষ্টি হেসে নিজের চলার গতি মন্থর করলো। তারপর সোনালি ওর কাছে এলে জিজ্ঞাসা করল,
    – কি রে কাল রাতে কি ঘুম হয়েছে? নাকি সেই এক অবস্থা?
    সোনালি ম্লান মুখে বলল,
    – এই ইনসমনিয়া বোধহয় আমার আর পিছু ছাড়বে নারে সুচি, কালও খেতে হলো ঘুমের ওষুধ…….ওই একটু হয়েছে কোনোরকমে…..
    – আর ওই স্বপ্নটা?
    – ওটা ঠিক স্বপ্ন নয় রে সুচি, স্বপ্ন মানুষ দেখে ঘুমিয়ে পড়ার পর, কিন্তু আমি ঐ দৃশ্যটা দেখি চোখ বন্ধ করলেই রে, হয়তো একটু তন্দ্রা এসেছে…….ঠিক তেমন সময়।
    – সে যাই হোক, সেটা কালও দেখেছিলিস কি?
    সোনালি কোনো উত্তর দিলো না সেই কথার, শুধু একবার ম্লান হাসলো। সুচেতা পেয়ে গেল তার প্রশ্নের উত্তর। পরমুহূর্তেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য সে বলল,
    – ওরে বাপ রে, ঘড়ির দিকে চোখ আছে? দেখ দশটা পঁচিশ! সাড়ে দশটায় এ.কে.জি-র ক্লাস…….এক মিনিট দেরি হলে আর ঢুকতে দেয়না…..চল, চল……

    সোনালি বরাবরই পড়াশোনায় খুব ভালো ফল করে এসেছে। শ্রীরামপুরের আকনা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী সে। স্কুলের এক থেকে পাঁচজনের মধ্যে তার নাম প্রতিটা ক্লাসেই থেকেছে। তারপর শ্রীরামপুর কলেজ থেকে কেমিস্ট্রি ওনার্স। সেখানেও তার কলেজের মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল তার প্রাপ্ত নম্বর। এরপর প্রথম মেধা তালিকাতেই সে পড়ার সুযোগ পায় বায়োকেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। সোনালি বরাবরই ইচ্ছা গবেষক হওয়ার, আর এখানে সেটার পরিপূর্ণ সুযোগ। ব্যাংকে উচ্চ পদে কর্মরত তার বাবাও যথেষ্ট উন্নত-মনস্ক, তিনি সবসময়ই চেয়েছেন যে তার মেয়ে যেন জীবনে অনেক বড় হয়, সে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কখনো কারোর গলগ্রহ হয়ে সে যেন দিনপাত না করে। খুব অল্প বয়সেই সোনালি তার মা কে হারায়, তাই বাবাকেই ছোটবেলা থেকে তার বাবা এবং মা, এই দুজনেরই সম্পূর্ন দায়িক্ত পালন করে আসতে দেখেছে সে। নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবতী মনে করত সে, সবই তো ঠিকঠাক হয়ে আসছিল তার জীবনে এতদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই, প্রায় একবছর ধরে, তাকে দেখা দিচ্ছে এই দুরূহ সমস্যাটা যার কোনো ব্যাখ্যা সে আজ অবধি পায়নি।

    দুটো পরপর টানা ক্লাস, প্রতিটা এক ঘন্টা করে। এখন ক্লাসে বেশ অমনোযোগী হয়ে উঠেছে সে, সেটা নিজেই বুঝতে পারে সোনালি। কোনো কিছুই আর যেন তার মাথায় ঢুকছে না, সবসময় যেন একটা ক্লান্তি আর ঝিমুনি ভাব বিরাজ করছে ওর সর্বশরীরে। পড়াশোনার বাইরেও তো লোকে আরো কতকিছু করতে আসে কলেজে, এই যেমন ক্লাস চলাকালীন, সুচেতা এ.কে.জি-র দিকে কম আর তন্ময়ের দিকে বেশিই চেয়ে আছে, যেন সবসময় চোখের ঈশারাতে কথা হচ্ছে ওদের দুজনের মধ্যে……এমন প্রেম পিরিতি তো সেও করতে পারে কোনো সুপুরুষ নবযুবকের সঙ্গে। কিন্তু কই, তার তো এসব কিছুই ভালো লাগে না। এক বার তাকিয়েও দেখে না ক্লাসের ছেলেগুলোর দিকে। সবসময়ই যেন নিজের সেই সমস্যাটা নিয়ে ব্যস্ত সে…..ধুর, ভালো লাগে না কিছু!

    দ্বিতীয় ক্লাসটির অধ্যাপক ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই ক্লাসটা ক্লাবে পরিনত হল। এরপর বোধহয় ক্লাস নেই খুব একটা, বেশিরভাগ ছেলে মেয়েরাই ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ল বেরোবার তাগিদে। কেউ বাড়ি ফিরবে, কেউ বা তার প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে যাবে কোনো পার্কে, কেউ বা যাবে সিনেমায়……এই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল সকলের মধ্যে। সোনালির গন্তব্য শুধুই তার বাড়ি। সে ব্যাগ গুছিয়ে ওঠার আগেই সুচেতা ওর কাছে এসে বলল,
    – সোনু শুনেছিস, আজ নাকি সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে একটা সেমিনার আছে দুপুর তিনটে থেকে।
    সোনালি ওর কথায় খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বলল,
    – হুম……
    সুচেতা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
    – ওফ……শুনছিস তুই? আজ সেখানে একজন খুব ইয়াং গবেষক স্পিচ দিতে আসছেন………ড: তুষার মল্লিক……..যাবি নাকি?
    – নাহ, তুই গেলে যা, সুচি…..
    সুচেতা মুচকি হেসে বলল,
    – আর টপিকটা যদি হয় “দা ডার্ক সাইড অফ আনকনসিয়াস মাইন্ড: ইন্টারপ্রিটেশন এন্ড এনালাইসিস”……..তাহলেও যাবি না?
    একবার সুচেতার দিকে তাকিয়ে ভাবলো সোনালি। যে ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে চলেছেন সেই গবেষক, তা সোনালির সমস্যার সাথে অনেকটাই মেলে। সত্যিই তো, এতদিন ধরে শুধু ঘুমের ওষুধ খেয়ে গেছে সে, কখনো তো কোনো সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করার কথা ভাবেনি! আজকাল এসবেও নাকি বেশ লাভ হয়েছে অনেক মানুষের। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার…….এই সব সাত পাঁচ ভেবে সেখানে যেতে রাজি হলো সোনালি।

    সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমটাকে আজ খুব ভালো করে সাজানো হয়েছে। রাখা হয়েছে সারি সারি চেয়ার শ্রোতাদের জন্য। মস্ত বড় স্টেজে গন্যমান্য অতিথিদের বসার জায়গা, সেখানে রাখা নতুন জলের বোতল আর ফুলদানি, প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য প্রজেক্টরের পর্দা, বলার জন্য মাইক্রোফোন আর তার সাথে বড় দুটো সাউন্ড বক্স……..এসবের পরিপাট্যেও কোনো কমতি নেই। আসতে আসতে শ্রোতায় ভরে গেল গোটা হল ঘর। সুচেতা আর সোনালি সামনের দিকেই বসেছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হলো অনুষ্ঠান। প্রথমেই সাইকোলজির হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট-এর সাথে প্রবেশ করলেন বাকি সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকারা। তারা তাদের আসন গ্রহল করলে, হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট একটি ছোটো ভাষণ দিয়ে শ্রোতা দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আজকের সেমিনারের মূল বিষয় বস্তু। এর সাথেও ড: তুষার মল্লিকের উজ্জ্বল কেরিয়ারের সম্বন্ধেও দু চার কথা বললেন। এর পর শ্রোতাদের মধ্যে থেকেই এক জন করে করে ছাত্র ছাত্রীদের স্টেজে ডেকে নেওয়া হলো স্টেজের সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সোনালি আর সুচেতা অধীর আগ্রহে বসে ছিল ড: তুষার মল্লিককে দেখার জন্য।

    অবশেষে স্টেজে উঠে সকলকে নমস্কার জানালেন একজন সুপুরুষ যুবক। লম্বা, ফর্সা চেহারা, ঢেউ খেলানো চুল, লম্বা মুখ, টিকলো নাক এবং চোখে রিমলেস চশমা। ইনিই হলেন ড: তুষার মল্লিক, সে কথা ঘোষণা করলেন হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। সোনালি হা করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে, কোথায় যেন…..এর আগে কোথায় যেন…….সে দেখেছে এই ভদ্রলোকটিকে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না সে। সে মস্তিষ্কে আরো চাপ দেওয়ার চেষ্টা করল, যেন কয়েকটা আবছা ছবি দেখতে পাচ্ছে সে ওই পুরুষটির, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও স্পষ্ট হচ্ছে না তা কিছুতেই! জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সোনালি, এই এ.সি ঘরেও ঘেমে উঠল সে। এমন সময় সুচেতা ওকে কুনুইয়ের গুঁতো মেরে বলল,
    – কি রে…..ওঠ……যা……তোকেই তো হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট ডাকছেন তুষার বাবুকে ফুলের তোড়া দেওয়ার জন্য……
    অগত্যা কম্পিত শরীরে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো সোনালি। ওপরে উঠে ফুলের তোড়াটা ট্রে থেকে নিয়ে দিতে গেল তুষারবাবুকে………কিন্তু, হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল সোনালির! উন্মাদের মতো, ফুলের তোড়াটা নিচে ফেলে দিয়ে, রাগে গর্জন করতে করতে চিৎকার করে ছুটে গেল সে তুষারবাবুর দিকে। তারপর তার জামার কলার ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
    – তোকে শেষ করে দেবো আমি…….শেষ করে দেবো…….কিছুতেই বাঁচতে দেবো না আমি তোকে………কিছুতেই না……চিনতে পারছিস আমি কে?…….কি রে চিনতে পারছিস?……আমি লাজবন্তী……..সেই লাজবন্তী রে………সেই লাজবন্তী!

                                                                    (পর্ব-২)

     

    সোনালির এই অদ্ভুত আচরনে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন তুষার বাবু। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা অবধি করলেন না। এই অবাক করা দৃশ্য দেখে হৈ-হৈ করে উঠল শ্রোতার দল, তাদের মধ্যে কারোর কারোর বেশ মনোরঞ্জনই হচ্ছিল এই দৃশ্য দেখে। তারা আবার আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। স্টেজের সমস্ত অধ্যাপকরা ছুটে এলেন সোনালি আর তুষার বাবুর দিকে, সুচেতাও ছুটে চলে এলো স্টেজের ওপরে। ওরা সবাই এসে দেখল, ততক্ষনে শিথিল হয়েছে, তুষার বাবুর জামার কলার ধরে থাকা, সোনালির দুই হাতের মুঠো। সে আসতে আসতে চোখ বন্ধ করে টাল সামলাতে পারল না, হয়তো পড়ে যেত নিচে, কিন্তু সেই সময়ই তুষার বাবু তার বলিষ্ঠ দুই বহু দিয়ে আঁকড়ে ধরে ফেললেন সোনালির দেহ। চিৎকার করে তিনি বললেন,
    – কেউ একটু জল নিয়ে এসো…….তাড়াতাড়ি……

    সোনালির যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে সায়েন্স কলেজের লেডিজ কমন-রুমে। সেখানে একটা বেঞ্চের ওপর শুয়ে আছে সে। তার চারিদিকে কলেজের অন্যান্য ছাত্রীরা কৌতূহলী মুখে চেয়ে আছে তার দিকে। সুচেতাও তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালি চোখ মেলে উঠে বসলেই, সুচেতা বাকি সব মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল,
    – দেখেছিস তো সবাই…..ও ঠিক আছে……এখন তোরা সব যা, আশা করি, ওকে হাজার প্রশ্ন করে আরো অসুস্থ করে তুলতে চাইবি না কেউই……
    বাকি ছাত্রীরা চলে গেলে, সুচেতা সোনালির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
    – এখন কোনো প্রবলেম হচ্ছে না তো আর তোর……আর একটু জল খাবি?
    সোনালি করুন চোখে সুচেতার দিকে তাকিয়ে বলল,
    – সুচি……সুচি, কি হয়েছিল রে আমার? কি করছিলাম আমি? কি বলছিলাম, হ্যাঁ?……. কেন জ্ঞান হারালাম আমি?
    ভয়ার্ত কণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোনালি। সুচেতা কৌতূহলী স্বরে সোনালিকে জিজ্ঞাসা করল,
    – তুই কি ড: তুষার মল্লিককে আগে কোথাও দেখেছিস?
    সোনালি আতঙ্কে সুচেতার বুকের সালোয়ার খামচে ধরে বলল,
    – মনে করতে পারছি না…….মনে করতে পারছি না রে, কিছুই মনে করতে পারছি না…..
    সুচেতা ওকে আবার সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করল,
    – এছাড়া…….তুই তুষার বাবুর জামার কলার ধরে বলেছিলিস যে তুই নাকি তাকে বাঁচতে দিবি না………
    সোনালি এবার ছুটে গিয়ে কমন রুমের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল, সুচেতা তখনই বলে উঠল,
    – তুষার বাবুকে খুঁজে লাভ নেই রে সোনু, এখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বাজে……সেমিনার অনেক্ষন আগেই শেষ হয়ে গেছে, তিনি চলে গেছেন……তবে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে তোর একটা খোঁজ অবশ্যই নিয়েছিলেন…….
    সোনালি আবার ছুটে এলো কমন রুমের মধ্যে, তারপর পাগলের মতো সুচেতাকে ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
    – আর কি বলেছিলাম আমি তখন……বল সুচি, বল…..আর কি বলেছিলাম আমি?
    – তুই বলেছিলিস যে তোর নাম হলো লাজবন্তী!
    সোনালি কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইল। সুচেতা আবার জিজ্ঞাসা করল,
    – কে এই লাজবন্তী, সোনু?……..কে এই লাজবন্তী?
    জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোনালি বলে উঠল,
    – জানিনা…….আমি কিছু জানিনা রে……..কিছু জানিনা আমি……
    সুচেতা এবার ওর কাছে এগিয়ে এসে ওর দু কাঁধ ধরে ফিসফিস করে বলল,
    – সোনু, আমার মন বলছে…….এতদিন ধরে তোর সাথে যা কিছু ঘটে চলেছে, তোর সেই সব ঘুমহীন রাত্রির জ্বালা যন্ত্রনা, সেই অদ্ভুত দৃশ্যগুলো……..হোক না হোক…..এগুলো কোনোভাবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে জড়িয়ে আছে……সোনু, তোকে খুঁজে বার করতেই হবে, এই লাজবন্তী কে ছিল……তোকে করতেই হবে এই লাজবন্তীর রহস্যের সমাধান……
    অধৈর্য হয়ে সোনালি বলল,
    – কে বলবে আমায়, যে এই লাজবন্তী কে ছিল, বল?…….কে করবে এই রহস্যের সমাধান?
    সুচেতা একটু মৃদু হেসে বলল,
    – তুই তো এই “লাজবন্তী” নামটা আগে কখনো বলিসনি……তোর হঠাৎ তুষার বাবুকে দেখেই কেন মনে পড়ে গেল এই নামটার কথা?…….তাই আমার মতে, তোকে যদি এই বিষয়ে সব থেকে বেশি কেউ সাহায্য করতে পারেন, তা হল খোদ তুষার বাবু……
    সোনালি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সুচেতার দিকে, সুচেতা আবার বলে উঠল,
    – তোর কোনো চিন্তা নেই, সোনু…….আজকে উনি যখন আমায় তোর কথা জিজ্ঞাসা করেন, তখনই আমি তার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রেখেছি, আর তাকে বলেও রেখেছি যে কালই আমি তোকে তার কাছে নিয়ে যাব……..

    পরদিনই ওরা কলেজ কমাই করে ড: তুষার মল্লিকের বাড়িতে গেল। তুষার বাবুর বাড়িটা ভবানীপুরে, ইন্দিরা সিনেমা হলের খুব কাছেই। বেশ বড় সেকেলে আমলের দোতলা বাড়ি। দরজার গায়ে বড় বড় ইংরাজি হরফে লেখা “ড: তুষার মল্লিক, এম.বি.বি.এস, এম.ডি – সাইকিয়াট্রিস্ট।” তার পেশেন্ট দেখার চেম্বারটি বাড়ির নিচের তলায়। তবে আজ সেখানে কেউ নেই। বোঝাই যাচ্ছে যে উনিও বেশ অভিভূত হয়ে সোনালি আর সুচেতার অপেক্ষায় আছে। তবে আজ সোনালি আর সুচেতার সাথে, সুচেতার বয়-ফ্রেন্ড তন্ময়ও এসেছে সেখানে। ডোর-বেল বাজাতেই, দরজা খুললেন স্বয়ং তুষার বাবু। সাদা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে আছেন তিনি, মুখের দাড়ি চকচকে করে কমানো, মাথার চুল পরিপাটি করে ব্যাক-ব্রাশ করা। তাকে যেন আজ, আগের দিনের থেকেও, আরো বেশি সুপুরুষ লাগছে। সোনালির যেন চোখ সরছিল না তার দিক থেকে। এটা বুঝতে পেরে সুচেতা আর তন্ময় নিজেদের মধ্যে একবার চোখ টিপে মুচকি হেসে উঠল।

    ওরা সবাই একসাথে গিয়ে বসল তুষার বাবুর চেম্বারের ভেতর। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরটি, চারিদিকের সো-কেসে মধ্যে কতই না মনোরোগবিদ্যার বই রাখা রয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ির কাজের লোক সকলের জন্য কফির ট্রে নিয়ে হাজির হল। কাঁচে ঢাকা টেবিলের ওপর পেপার-ওয়েটটা একবার নাচিয়ে, সবার আগে নীরবতা ভাঙলেন খোদ তুষারবাবু, বললেন,
    – তোমরা সাইকোএনালিস্ট সিগমান্ড ফ্রেউড-এর নাম শুনেছ?
    ওরা সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। তুষারবাবু আবার বলতে লাগলেন,
    – ফ্রেউড-এর মতে, মানুষের মনের তিনটে স্তর আছে। এই মুহূর্তে চলাকালীন সমস্ত মনের ভাবনা, যা আমরা বিচার বিবেচনা করে প্রমান করতে পারি, তা থাকে আমাদের কনসিয়াস মাইন্ড-এ……….এরকমই পূর্বের কোনো স্মৃতি, যা দরকার হলে আমার আবার নিজের মগজে নিয়ে এসে বিচার বিবেচনা করে প্রমান করতে পারি, তা থাকে আমাদের প্রিকনসিয়াস মাইন্ড-এ……..
    ওরা স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগল। তুষারবাবু বলে চললেন,
    – আর আমাদের মনের সবথেকে বড় স্তরটা হলো আনকনসিয়াস মাইন্ড, যার মধ্যে এমন কোনো স্মৃতি জমা হয়ে থাকে যা এই মুহূর্তে আমাদের বিচার বিবেচনার বাইরে বলে মনে হয়………তবে যে পরিস্থিতিতে সেই স্মৃতিগুলো আমাদের মনে জমেছে, সেই পরিস্থিতিতে আবার ফিরে গেলে, তা মনে পড়লেও পড়তে পারে…….
    একটু থেমে তিনি সোনালিকে বললেন,
    – আমার মনে হয় তোমার আনকনসিয়াস মাইন্ড-এ এমনই কোনো স্মৃতি লুকিয়ে আছে, যার রহস্যভেদ করতে গেলে আমার দরকার যেকোনো একটা ক্লু……যার সাহায্যে আমি তোমাকে সেই জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, যেখান থেকে তোমার মনে ওই স্মৃতিগুলির সৃষ্টি হয়েছে……..তবে তার জন্য তোমাকে আমার থেরাপির মধ্যে আসতে হবে……..বলো, তুমি কি রাজি?
    কিছুক্ষন ভেবে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, সোনালি কম্পিত গলায় বলল,
    – হ্যাঁ……আমি রাজি!

                                                                 (পর্ব-৩)

    কথাটা বলার পরেও একবার সুচেতার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সোনালি। সুচেতা চোখের ইঙ্গিতে ওকে আশ্বাস দিয়ে, তুষারবাবুকে জিজ্ঞাসা করল,
    – অবশ্যই মিস্টার মল্লিক, আমরা তো সকলেই চাই, যে এতদিনের এই মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাক সোনালি……..আর তাছাড়া, আমাদের জানতেই হবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে কি সম্পর্ক ওর…….তবে আপনার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, মিস্টার মল্লিক, আপনার থেরাপির মধ্যে গেলে, ওর কোনো ক্ষতি হবে না তো?
    তুষারবাবু একটা মিষ্টি হেসে বললেন,
    – এ কথা মানতেই হবে যে, যেকোনো ধরনের ট্রিটমেন্টের যেমন এফেক্ট আছে, তেমন সাইড-এফেক্টও আছে, এখন আমাকে বুঝতে হবে আমার কোনটা দরকার…….সারা জীবন ধরে ঘুমোনোর আগে ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলির সম্মুখীন হওয়া, নাকি থেরাপির মধ্যে এসে তার সাইড-এফেক্টে জর্জরিত হওয়া…….
    সোনালি হঠাৎ অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠল,
    – তুই আর উনাকে কিছু বলিস না রে, সুচি……..আর বাধা দিস না উনাকে……..আমার যা হওয়ার তা হবে, কিন্তু নিজের মনের ভেতর লুকোনো সমস্ত স্মৃতি আমাকে উদ্ধার করতেই হবে………আমাকে জানতেই হবে এই “লাজবন্তী”-র সাথে কি সম্পর্ক আমার….এর জন্যে যদি আমাকে মরতেও হয় আমি রাজি আছি……এরকম ভাবে রোজ মরে মরে বেঁচে থাকার চেয়ে, একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো…….
    দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোনালি। সুচেতা ওর কাছে এগিয়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিতে লাগল, তারপর তুষারবাবুর দিকে তাকিয়ে, সে দৃড় গলায় বলল,
    – আপনি শুরু করুন, মিস্টার মল্লিক……….

    তুষারবাবু ওদের পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের, শুধুমাত্র ঢোকা আর বেরোবার জন্য একটা দরজা আছে মাত্র। কিন্তু কোনো জানলা নেই সে ঘরে, অর্থাৎ বাইরের আলো প্রবেশ করার কোনো জায়গাই নেই সেখানে। এমনকি এই ঘরে কোনো লাইটের ব্যবস্থাও নেই, আছে শুধু একটা এ.সি। চারিদিকের কালো রং করা দেওয়ালগুলো যেন ঘরের জমাটে অন্ধকারটাকে আরো গাঢ় করে রেখেছে। সে ঘরে কোনো আসবাসপত্র নেই, আছে শুধু পেশেন্টের জন্য একটি বেড, আর কয়েকটি চেয়ার। বোঝাই যাচ্ছে, এই মূহুর্তের বাইরের জগতের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে বঞ্চিত হয়ে, শুধুমাত্র নিজেই নিজেকে খোঁজার আদর্শ জায়গা এটা। তুষারবাবু সোনালিকে বললেন ওই বেডে গিয়ে বসতে, আর সুচেতা আর তন্ময়কে কাছে রাখা চেয়ারগুলি দেখিয়ে দিলেন, তবে মুখের ইশারায় জানালেন, যে তার ট্রিটমেন্ট চলাকালীন কোনো সাড়াশব্দ করা চলবে না। এরপর তিনি একটা ওষুধের স্ট্রিপ থেকে একটা ট্যাবলেট বার করে সোনালির কম্পিত হাতে দিলেন। তারপর বললেন,
    – ভয় নেই, এটা একটা মাইল্ড ট্রানকুইলাইসার, এটা খেলে তোমার সাময়িক এংসাইটি কিছুটা হলেও কমবে…….
    সোনালি কোনো কথা না বাড়িয়ে মুখে পুড়ল সেটা……অবশ্য, ঘুমের ওষুধ খেয়ে খেয়ে তার যা অবস্থা হয়েছে, এখন আর কোনো ওষুধ খেতেই কোনো ভয় পায়না সে………
    তুষারবাবু আশ্বাসের সুরে বললেন,
    – তুমি এখন এখানে একটু রেস্ট নাও…….আমি আধঘন্টা পর থেকে শুরু করব…….
    ওষুধটা খাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব চলে এলো সোনালির সর্বশরীরে। সে আর নিজের শরীরের ভার সহ্য করতে না পেরে শুয়ে পড়ল বেডের ওপর। আসতে আসতে যেন, তুষারবাবু, সুচেতা আর তন্ময়ের দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে আসছে ওর চোখের সামনে থেকে, একটা প্রগাঢ় অন্ধকার ছায়া যেন সেটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে, ঠিক সেভাবে, যেভাবে আগুন ধূলিসাৎ করে দেয় কোনো ফটোগ্রাফ কে। অন্ধকার……চারিদিকে অন্ধকার……এ কোথায় চলে এলো সোনালি? সে চিৎকার করে এর বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে ওই ওষুধটার গুনে! কই, ঘুমের ওষুধ খাবার পর তো এরকম কখনো মনে হয়নি সোনালির। তাহলে আজ কি হলো তার?

    সেই অশেষ অন্ধকার জগতের মধ্যে ক্রমাগত হাস-ফাঁস করে উঠছিল সোনালি। এমন সময় হঠাৎ যেন দূরে একটা আলোকের ছোট বিন্দু দেখতে পেল সে, কানে এল তুষারবাবুর পুরুষালি গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর,
    – সোনালি…..সোনালি, তুমি ঠিক আছো?
    মাদকের নেশার মতো চরম আছন্নতার ঘোরে সোনালি বেশি কিছু বলতে পারল না, শুধু বলল,
    – হ….হুম….
    আবার তুষার বাবুর গলার আওয়াজ পেল সে,
    – কোথায় আছো তুমি এখন?
    সোনালির অস্ফুট গলার আওয়াজ শোনা গেল,
    – জানি না…….জানি না…….
    – চারিদিকে তাকিয়ে দেখো…….কিছু দেখতে পাচ্ছ কোথাও?
    – অন্ধকার……চারিদিকে অন্ধকার……শুধু….
    – শুধু?
    জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোনালি বলে উঠল,
    – শুধু একটা আলোর গোলা……একটা বিন্দু থেকে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সেটা…….বড়……আরো বড়…….
    – ভালো করে বোঝার চেষ্টা করো, সেই আলোর গোলাটা কিসের আকার নেওয়ার চেষ্টা করছে……
    কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইল সোনালি, তারপর আছন্নতার মাঝেই যেন আরো উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল সে। সুচেতা ওর দিকে এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু তুষারবাবু তাকে বারন করলেন। তিনি নিজেই বললেন,
    – কি হলো সোনালি? কি দেখছো তুমি?
    উত্তেজনায়, আতঙ্কে সোনালি চোখ বন্ধ করেই বলে চলল,
    – ওই আলোটা আসতে আসতে একটা মেয়ের রূপ নিয়েছে……মেয়েটা…..মেয়েটা ছুটে আসছে আমার দিকে…..কাছে……আমার আরো কাছে চলে এলো সে…….কিন্তু……একি!…….একি দেখছি আমি!
    তুষারবাবু কৌতুহলী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
    – কে সোনালি……কে সেই মেয়েটি?
    সবাই কে অবাক করে দিয়ে সোনালি বলল,
    – আমি……আমিই হলাম সেই মেয়েটি……নিজেকে দেখতে পাচ্ছি আমি!
    সেই ঘরে উপস্থিত সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

    এরপর বিস্ময়ে হতবাক সুচেতা, তন্ময় আর তুষারবাবুকে সোনালি, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্য সবিস্তারে বলে চলল……
    একটা রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে সে, তার শরীর যেন ক্ষতবিক্ষত, পরনের কাপড়টিও শতচিত্র, চুলগুলো এলোমেলো, কপালের সিঁদুরের টিপ কখন ঘেঁটে গিয়েছে, ঠোঁটের কোষ দিয়ে ঝরছে একটা সরু রক্তের রেখা, ক্ষতবিক্ষত পায়ের পাতা দিয়ে বয়ে চলেছে রক্তের ধারা…….রাস্তাটার চারিদিকে যেন মারামারি খুনোখুনি হয়েই চলেছে, কারা যেন সবাইকে ধরে খুন করেছে বড় বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে চার-খার করে দিচ্ছে সমস্ত দোকান পাট, একটা দোকানের সাইন বোর্ড যেন তার মাথাতেই ভেঙে পড়ত আরেকটু হলে। সে চেয়ে দেখল ভাঙা বোর্ডটির এক ধারে লেখা আছে “মানিকগঞ্জের সেরা বস্ত্র প্রতিষ্ঠান”……..কারা যেন ছুটে আসছে তার পেছনে পেছনে, পুরুষের কয়েকটা গলা বলছে, “দেখো, বো ভাগ রহি হে উধর……পাকরো উসে”……..সে জোরে, আরো জোরে ছুটতে লাগল, কিন্তু পেছনের নরখাদকগুলো যেন তার কাছে……কাছে…..আরো কাছে এসে পড়ল……..
    ব্যাস, এই অবধি দেখে চিৎকার করে চোখ মেলে তাকালো সোনালি…..বিস্ময়ে আতঙ্কে আঁকড়ে ধরল তুষারবাবুর চওড়া বুকের ছাতিটাকে। পরমুহূর্তেই হুঁশ ফিরে পেয়ে সে ছুটে গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকোলো সুচেতার পিঠে।
    তুষারবাবু দৃড় কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,
    – আমি আমার ক্লু পেয়ে গিয়েছি, সোনালি………মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের একটা জায়গায় নাম……
    তারপর তিনি সোনালির চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
    – তোমার পাসপোর্ট আছে তো?

                                                                     (পর্ব-৪)

    সোনালি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তুষারবাবুর দিকে তাকিয়ে, একবার মাথা দুলিয়ে, একটা সম্মতি-সূচক ইঙ্গিত করল। হঠাৎ তন্ময় বিরক্তি ভরে বলে উঠল,
    – এত অবধি তো ঠিক ছিল…….তোর কিছু মানসিক প্রবলেম হচ্ছে, তুই তার জন্যে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে এসেছিস……..কিন্তু এর জন্যে সেই বাংলাদেশে ছোটা…….দিস ইস রিয়েলি এবসার্ড!
    সবাই তন্ময়ের দিকে তাকালো এবার। তন্ময় আবার বলতে লাগল,
    – দেখ সোনালি, আমার তো মনে হয় এগুলো তোর মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়……
    সুচেতা এবার ক্রুদ্ধ গলায় তার প্রেমিককে বলে উঠল,
    – বাহ, তন্ময়, বাহ…….এতক্ষন আমাদের সাথে থেকে তুমি এই কথা বুঝলে? শোনো, এ কথা ঠিক যে অনেক মানুষই একটু বেশি কল্পনা-প্রবন হন, কিন্তু তারা একেবারেই মানসিক দিক থেকে অসুস্থ নন। আমরা তো অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কথা শুনেছি, তারা অন্য মানুষদের থেকে বেশি কল্পনা করতে পারেন বলেই আজ সেই জায়গায় আসতে পেরেছেন……..কিন্তু তারা কি সোনালির মত অহরাত্রদিন এত কষ্ট পেয়ে চলেছেন? নাহ…….সোনালির ব্যাপারটা আলাদা…..আমার মন বলছে, অনেক দৃড় রহস্যের জট লুকিয়ে আছে ওর এই স্মৃতিগুলির মধ্যে…..
    তন্ময় যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল,
    – আচ্ছা মানলাম……..মানলাম, যে সোনালির কেসটা আলাদা…….কিন্তু আজ তো সকলের কাছে সেটা পরিষ্কার হয়েই গেল…….ও নিজেকে “লাজবন্তী” বলেছিল, রাইট? আর আজ ও নিজেকেই নিজের স্মৃতির মধ্যে দেখতে পেয়েছে……তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে যে কোনো একটা সময়ে ও লাজবন্তী নামক একটা মেয়ে হয়ে জন্মেছিল..…..ব্যাস, প্রবলেম সল্ভড……..
    এতক্ষন ধরে চুপ করে সবকিছু শুনলেও, এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল সোনালি,
    – কিছু সমাধান হয়নি রে তন্ময়…….কিছু সমাধান হয়নি…….অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো আমি খুঁজে পাচ্ছিনা…….আমি যদি গত জীবনে লাজবন্তী হয়ে জন্ম নিয়েই থাকি, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কত মানুষ তো কতবার জন্মায়, মরে, আবার জন্মায়……..কিন্তু শুধুমাত্র আমাকেই কেন এই আগের জন্মের স্মৃতিগুলো দিবারাত্রি এত কষ্ট দিয়ে চলেছে…….কেন?
    আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সোনালি, দু হাতে মুখ ঢেকে আবার সেই বেডে বসে পড়ল সে। এতক্ষন পর মুখ খুললেন তুষারবাবু, বললেন,
    – এর কারন হল, নিশ্চয় আগের জীবনে তোমার কোনো কাজ……কোনো ইচ্ছা বা কোনো উদ্দেশ্য……সেই জীবনে সম্পূর্ন হতে পারেনি, তাই সেই স্মৃতিগুলো বার বার বিচ্ছিন্ন ভাবে তোমার চোখের সামনে ভেসে এসে তোমাকে মনে করাতে চাইছে সেই কাজ, ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যটাকে এই জন্মে পূরণ করতে…….
    এবার সুচেতা বলে উঠল,
    – তাছাড়া, এই লাজবন্তীর জীবনে কিন্তু আপনিও জড়িয়ে আছেন তুষারবাবু, নাহলে সোনালি সেদিন নিজেকে “লাজবন্তী” বলে, আপনাকে বাঁচতে দেবে না, একথা কখনোই বলত না……
    এবার সোনালি আর তুষারবাবু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল একে অপরের দিকে।
    তন্ময় তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠল,
    – বেশ, তুই রহস্যের জট খুলতে বাংলাদেশ কেন, যে দেশে ইচ্ছা যা…….কিন্তু বাড়িতে কি বলবি তা একবারও ভেবে দেখেছিস?
    তুষারবাবু এ কথা শুনে কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
    – ওর বাড়ির লোককে যা বলার তা বলবে খোদ সাইকিয়াট্রিস্ট, ডাক্তার তুষার মল্লিক……
    বিস্ময়ে ওরা তিনজন এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল, তুষারবাবুর কথা শুনে!

    দমদম এয়ারপোর্টে সোনালি আর তুষারবাবুকে সেদিন ছাড়তে এসেছিল সুচেতা। সোনালির বাবা তুষারবাবুর কথা শুনে কোনই আপত্তি করেননি তার সাথে সোনালির বাংলাদেশ যাত্রায়। উপরন্তু, তিনি যে নিজের মেয়ের মানসিক যন্ত্রণার কথা এতদিন বুঝতে পারেননি, একথা বলে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। হয়তো, তুষারবাবুর সাথে কথা বলে, তিনি বুঝেছেন যে তার ওপর সত্যিই ভরসা করা যায়। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগের মুহূর্তে, সোনালি সুচেতাকে বলল,
    – তুই আমার জন্য অনেক করেছিস, সুচি…….এখন শুধু একবার ভগবানের কাছে বল যে, যে উদ্দেশ্যের জন্য আমি সেই অচেনা জায়গায় পাড়ি দিতে চলেছি, তা যেন সফল হয়…….আমি যেন সেই সমস্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর সেখানে গিয়ে পাই, যেগুলো এতদিন ধরে দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার চোখের সামনে ভিড় করে আছে…..
    সুচেতা কোনো কথা বলল না আর, শুধু একবার জড়িয়ে ধরল সোনালিকে। তুষারবাবু বললেন,
    – চলো সোনালি, আমাদের কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে…..

    ওদের বিদায় পর্ব শেষ হবার কিছু পরেই, সোনালি আর তুষার গিয়ে পাশাপাশি বসল ফ্লাইটের সিটে। সোনালির মনে হল, আজ যে তাকে এই অজানা অচেনা মানুষটার পাশে বসে এতদূরে পাড়ি দিতে হবে, এ কথা কি স্বপ্নেও ভেবেছিল সে? মানুষের ভাগ্য তাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসে, তা কেউ জানে না। এই যেমন এই মানুষটাকে তো সে প্রথম দেখেছে সবে দুদিন মাত্র আগে, তাহলেও তাকে কত চেনা চেনা লাগছে……এ কি করে সম্ভব? কি ভূমিকা ছিল এই মানুষটার লাজবন্তীর জীবনে? লাজবন্তী কি কখনো তাকে ভালোবেসে ছিল? আর যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সে সেদিন এমন উত্তেজিত হয়ে কেন বলেছিল, যে এই মানুষটাকে সে আর বাঁচতে দেবে না?………এই একই প্রশ্নগুলো হয়তো তুষারবাবুর মনেও চলছিল। হঠাৎ সোনালি দেখল যে তুষারবাবুর একটা হাত স্পর্শ করল তার হাতকে, ধীরে ধীরে শক্ত হলো তার হাতের মুঠো, তার নিঃশ্বাসের বেগ হল আরো দ্রুত, কেঁপে উঠল তার ঠোঁট……. সোনালি অবাক হয়ে চেয়ে দেখল তুষারবাবুকে। তার চোখ যেন সোনালির চোখ ছাড়া আর কিছুই চেনে না, যেন কত কথা ওদের শুধু চোখ দিয়েই বলা হয়ে গেল। তার মানে কি তুষারবাবুও কিছু মনে করতে পেরেছেন, কি সম্পর্ক ছিল তার লাজবন্তীর সাথে? নাকি, তিনি লাজবন্তীকে না চিনলেও, চেনেন শুধু সোনালিকে……যেন তিনিও বলতে চাইছেন যে সোনালি শুধু তার……শুধুই তার!

    ফ্লাইটে করে কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় দেড় ঘন্টা। তারপর সেখানকার শাহজালাল এয়ারপোর্টে সমস্ত ভেরিফিকেশন শেষ করে, ওরা সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে এল মানিকগঞ্জের একটা হোটেলে, তাতে সময় লাগল আরো আড়াই ঘণ্টা। হোটেলের রুমটা আগেই বুক করা ছিল, সিঙ্গল রুম তবে দুটো আলাদা বিছানা…….. তাই ঘরের চাবি পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তাদের। কিছুক্ষন ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার পরই হোটেলের ছেলেটা ওদের দুপুরের খাবারের জন্য ডেকে গেল। হোটেলের নিচের তলায় একটা বিশাল বড় ডাইনিং রুম, সেখানেই লাঞ্চ বা ডিনার পরিবেশন করা হয় হোটেলের সমস্ত বোর্ডারদের। সোনালিদের বোধহয় লাঞ্চ করতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল, এখন তারা ছাড়া আর অন্য কেউই খাবার টেবিলে বসে নেই। খাবার মেনু খুবই সাধারন কিন্তু আকর্ষনীয়…….ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, সর্ষে ইলিশ, চাটনি, পাঁপড়। হোটেলের ছেলেটা খাবার পরিবেশন করতে করতে তুষারবাবুকে বলল,
    – জানেন তো স্যার, আপনাদের মত আরেকজন কাপেলও আমাদের হোটেলে এসেছে কলকাতা থেকে কাল রাতে…….
    সোনালির মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, তবুও তারা ছেলেটাকে জানাল না তাদের আসল পরিচয়। ছেলেটা বোধহয় জানেনা, যে ওদের ঘরটা এক হলেও, বিছানাটা আলাদা। ছেলেটা বলেই চলল,
    – কালকে রাতেই সেই ভদ্রলোক আর তার মিসেস-এর সাথে অনেক কথা হচ্ছিল আমার………
    তারপর সে তাদের আরো কাছে এসে মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল,
    – জানেন তো স্যার, উনি বলছিলেন যে উনার মিসেস-এর নাকি কিসব স্বপ্ন দেখার ব্যামো আছে…….
    সোনালি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
    – মানে?
    ছেলেটি ফিক করে হেসে বলল,
    – তিনি বলছিলেন যে তারা এই বাংলাদেশে আগে কখনো আসেননি, কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই, তার মিসেস নাকি, এই কাছেরই একটা পুরোনো রাজবাড়ির ছবি, তার ঘুমের মধ্যে প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছেন। তাই তাদের কোনো এক সাইক্রিয়াটিস্ট নাকি এখানে এসে ঘুরে যেতে বলেছেন………সেই রাজবাড়িতেই তো তারা গেল কিছুক্ষন আগে……….পাগলের প্রলাপ…..কি বলেন স্যার, হা হা হা……..
    আতঙ্কে শিউরে উঠল সোনালি……..তার মানে, আরেকটি মেয়েও আছে, যে তার মতই মানসিক যন্ত্রণার শিকার। দুরু দুরু বুকে সোনালি ভাবতে লাগল, হোক না হোক, এই মেয়েটিরও নিশ্চয় কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে তার নিজের অতীতের সাথে। তার সাথে এখনই একবার দেখা করা উচিত। এই রহস্যের জট যেন আরো গাঢ় হয়ে আসছে! এক ধাক্কায় ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে সোনালি কাঁপা কাঁপা গলায় তুষারবাবুকে বলল,
    – ওরা যেখানে গেছে, আমাকেও সেখানে নিয়ে চলুন!

                                                                      (পর্ব-৫)

    এই কথা শুনে, অবাক চোখে তুষারবাবু তাকালেন সোনালির দিকে। তারা খাওয়া ছেড়ে উঠে যাচ্ছে দেখে, হোটেলের ছেলেটি তাড়াতাড়ি তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
    – কি হল…..কি হল, ম্যাডাম…..আপনাদের খাবার পছন্দ হয়নি বুঝি!
    সোনালি তার দিকে তাকিয়ে দৃড় গলায় বলল,
    – যে জন্য ওই দম্পতি এখানে এসেছে, আমরাও ঠিক সেই জন্যই এখানে এসেছি……আর বাকি রইল খাওয়ার কথা, তাহলে শুনে রাখো, আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা সেদিন থেকেই চলে গিয়েছে যেদিন থেকে আমারও, ওই মেয়েটির মতই, চোখের সামনে অনেক অজানা প্রশ্নের প্রতিচ্ছবি প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে……আমারও, ওই মেয়েটির মতোই, এখন জীবনে একটাই উদ্দেশ্য……তা হল সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজে পাওয়া……….
    তারপর সোনালি তুষারবাবুর হাত ধরে টেনে, অধৈর্য হয়ে বলল,
    – চলুন, চলুন সেই রাজবাড়িতে…….ওর সাথে আমাকে ওখানেই দেখা করতে হবে, আর দেরি করবেন না প্লিজ…….
    এই বলে সোনালি তীরবেগে তুষারবাবুকে সেখান থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে বিস্ময়ে হতবাক সেই ছেলেটা চিৎকার করে উঠল,
    – দাঁড়ান ম্যাডাম, যাবেন না…..যাবেন না ওখানে……..ওটা একটা ভূতুড়ে জায়গা ম্যাডাম, কিছুদিন আগেই ওখানকার একটা বুজে যাওয়া কুয়ো থেকে, একটা অনেক বছরের পুরোনো মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যাবেন না ওখানে ম্যাডাম, যাবেন না……

    সেই রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষটা খুব একটা দূরে নয় সোনালিদের হোটেলটা থেকে। রিকশা করে সেখানে যেতে লাগল বড় জোর পনেরো মিনিট। সেই জায়গাটার কাছে আসতেই, সোনালি দুরু দুরু বুকে চেয়ে দেখল একবার ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেই রাজবাড়িটার দিকে। এখন ওখানে আর কেউ বসবাস করে না, করার পরিস্থিতিও আর নেই। সেই প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী এই বাড়িটা, এক কালে যে সাত-মহলা ছিল তা দেখে ভালোই বোঝা যায়। সামনের গেটের ওপরের সিংহের মূর্তিটা যেন এখনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে সোনালির দিকে। অধিকাংশই ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এই বাড়িটার কোথাও এতটুকু সিমেন্ট-বালি আস্ত নেই, তা কবেই খসে গিয়ে বুকের পাঁজরের মত বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো ইঁটের সারি। সোনালি ছুটে গেল সেই বাড়িটার ভেতরে, একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিশাল বড় উঠোনটাতে। এর চারিপাশে, দোতলা বাড়িটার অধিকাংশ ঘরেরই ছাদ ধসে পড়েছে। সামনের পরিত্যক্ত ঠাকুর দালানটি কত বছর ধরে হয়তো বঞ্চিত ঢাকের আওয়াজ থেকে। শিহরিত হয়ে সোনালি ভাবল, তাহলে কি এই বাড়িটাতেই আছে তার রহস্যের সমাধান? তার অতীত কি কখনো জড়িয়েছিল এই বাড়ির সাথে? যদি ওই প্রাচীন দেওয়ালে কান পাতে সোনালি, তাহলে কি সে পাবে শুনতে সেই ফেলে আসা দিনের পুরোনো স্মৃতির আর্তনাদ!

    ঠিক এরপরেই ওর চোখ চলে যায়, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা সেই দম্পতির দিকে। সোনালি দেখল, ভদ্রলোকটি তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তার স্ত্রী বাড়িটা দেখতে দেখতে অনেকটাই দূরে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটি…….আতঙ্কিত মনে সোনালি ভাবল, তার মানে কি ওই মেয়েটা এখানে এসে কিছু মনে করতে পেরেছে? আর দেরি করল না সোনালি, সে সটান গিয়ে কৃত্রিম ভাবে মৃদু হেসে তার স্বামীকে বলল,
    – নমস্কার দাদা, আসলে আপনারা যে হোটেলে এসেছেন, আমরাও সেখানে উঠেছি, ওই হোটেলের ছেলেটার কাছ থেকেই শুনলাম আপনার স্ত্রীর সমস্যার কথা……..আসলে ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে, তাই আমরাও চলে এলাম……ও, বাই দা ওয়ে, আমি সোনালি……
    ভদ্রলোকও তাকে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বেশ করুন কণ্ঠেই বললেন,
    – নমস্কার, আমি শচীন…..শচীন মুখোপাধ্যায়। ওই যে……..আমার মিসেস, সায়নী……আসলে ওর এই মেন্টাল প্রবলেমটার জন্যই আমাদের এখানে আসা…..
    এতক্ষনে তুষারবাবুও চলে এসেছেন তাদের কাছে। সোনালি তাকে দেখিয়ে বলল,
    – আর উনি হলেন ডা: তুষার মল্লিক…….আমার বিশিষ্ট বন্ধু।
    তুষারের সাথে শচীনের আলাপ হলে সোনালি আবার কৃত্রিম ভাবে হেসে শচীনবাবুকে বলল,
    – তা একবার আলাপ করিয়ে দেবেন না আমায়, আপনার মিসেস-এর সাথে?
    শচীনবাবু একবার ম্লান হেসে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সায়নীকে চিৎকার করে বললেন,
    – সানু……শুনে যাও একবার এদিকে……দেখো তোমার সাথে কারা আলাপ করতে এসেছেন!

    সায়নী যেন একটু চমকে উঠল তার স্বামীর ডাক শুনে। তারপর পেছন ঘুরে একবার তাকালো তাদের দিকে। সোনালি অবাক হয়ে দেখল, যে সায়নী বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তুষারবাবুর দিকে। হটাৎ যেন তার চাহনিটা কেমন পাল্টে গেল। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে লাগল তার সর্বশরীর। একটা করুন আর্তনাদ করে উন্মাদের মত ছুটে আসল সে তুষারবাবুর দিকে। এক ঝটকায় সায়নী ধরে ফেলল তুষারবাবুর দুই হাত, তারপর চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
    – আমায় ক্ষমা করে দাও বীরেন্দ্র!……ক্ষমা করে দাও আমায়!…..অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে…..অনেক বড় ভুল…….
    বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সোনালি ছুটে এল সায়নীর কাছে। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল সায়েন্স কলেজের সেমিনারের সেই দিনটার কথা, সেদিন তো সে নিজেও এভাবেই ছুটে এসেছিল তুষারবাবুর কাছে! এই রহস্যের জালে ওর যেন মাথা ঘুরতে লাগল, দুজন নারী একজনই পুরুষকে দেখে গত জন্মের স্মৃতি স্মরণ করতে পারছে, তফাৎ শুধু একটাই, একজনের মনে সেই পুরুষটির জন্য আছে আক্রোশ আর অন্যজনের মনে আছে অনুশোচনা! এই জটিল অঙ্কের সমাধানের কোনো হদিসই কি কখনো পাবেনা সে? সোনালি ছুটে এসে চিৎকার করে সায়নীকে জিজ্ঞাসা করল,
    – কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি সায়নী……বলো!….বলো কি মনে পড়ছে তোমার?
    সায়নী এবার ঘুরে গেল সোনালির দিকে, তারপর করুন কণ্ঠে বলল,
    – তুইও আমায় পারলে ক্ষমা করে দিস, লাজু……ক্ষমা করে দিস! আমি তোদের সকলের কাছে অপরাধী রে, লাজু……খুব ভুল হয়ে গেছে আমার…..খুব ভুল করে ফেলেছি আমি, তোদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, ইমতিয়াজ খান-এর সাথে হাত মিলিয়ে!
    সোনালি কৌতুহলী হয়ে সায়নীকে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
    – কে এই ইমতিয়াজ খান……বলো, সায়নী, বলো……আর কে এই বীরেন্দ্র? আর কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছো তুমি?
    কিন্তু সায়নী আর কিছুই বলতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল সোনালির বুকে। ভয়ে তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলেন শচীনবাবু!

    সকলের ডাকে কিছুক্ষন পরেই হুঁশ ফিরে পেল সায়নী। কিন্তু ওকে কোনো কথা জিজ্ঞাস করে লাভ হল না কারোর, কারন কিছুক্ষন আগেই ও যা করেছে বা যা বলেছে, তার কিছুই মনে নেই এখন ওর। এ আর কি নতুন কথা, ভাবল সোনালি, তার সাথেও তো ঠিক এরকমই হয়েছে। তারপর আর কোনো কথা বাড়ায়নি তারা চারজন একে অপরের সাথে। বিনা বাক্যবয়ে ফিরে এসেছিল সবাই হোটেলে, ঢুকে পড়েছিল যে যার নিজের ঘরে।

    রাতে বিছানায় শুয়েও অন্যদিনের মতো ঘুম আসছিল না সোনালির। বীরেন্দ্র…….লাজবন্তী……ইমতিয়াজ খান……ওই রাজবাড়ি…….বার বার এই চারটে শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর চোখের সামনে। কি ভাবে জড়িয়ে আছে এই চারজন একে অপরের সাথে? এই চারজনকে দিয়ে কোন সমীকরন তৈরি করলে করা যাবে এই ধাঁধার সমাধান! হঠাৎ সোনালি যেন তার চোখের সামনে সেই পুরোনো দৃশ্যটা দেখতে পেল……সেই ধ্বংস আর নরহত্যা লীলায় ছারখার হওয়া রাস্তাটা দিয়ে ছুটে আসছে সে……না,না, সে নয়……….ছুটে আসছে অসহায় লাজবন্তী! তার পেছনে ধেয়ে আসছে নিশাচর পুরুষের দল, চিৎকার করে বলছে তারা, “পাকরো উসে”……হঠাৎ ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লাজবন্তী। তার সামনে এই পুরুষের মূর্তিটা কার? এক দৃষ্টিতেই বোঝা যায় যে এ হল কোনো মুসলমান পাঠান। বলিষ্ঠ শরীর, খালি গা, গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, পরনে লুঙ্গি, মুখে ভর্তি দাড়ি অথচ গোঁফের লেশ মাত্র নেই…….আর তার হাতে খোলা তরোয়াল। লাজবন্তীকে দেখে দাঁত বের করে পৈশাচিক উল্লাসে হেসে উঠল সেই পুরুষ, যেন কতদিনের ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ পেয়েছে কোনো হরিণ সাবকের সন্ধান। লাজবন্তীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নিজের লুঙ্গির গিট খুলতে শুরু করল সে। তাকে দেখে ভয়ে আৎকে উঠে দুই পা পিছিয়ে এল লাজবন্তী!

                                                              (শেষ পর্ব)

    আচমকা, পেছনে পড়ে থাকা একটা মৃতদেহের কাছ থেকে একটা ধারালো চাকু খপ করে তুলে নিল লাজবন্তী, তারপর সামনে ঘুরে, কম্পিত হাতে সেটিকে ওই যুবকের দিকে এগিয়ে, চিৎকার করে বলে উঠল সে,
    – খবরদার!……খবরদার, ইমতিয়াজ খান…..এক পাও আর এগিয়ে আসবে না তুমি!
    এই কথা শুনে আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইমতিয়াজ। তারপর বিদ্রুপের গলায় তাকে বলে উঠল,
    – কি ভেবেচিলিস, হ্যাঁ? তোর ওই বীরেন্দ্রবাবু তোকে সত্যিই ভালোবাসেন? বাঁচাতে আসবেন তিনি তোকে? উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তোকে এই দেশ থেকে?
    বিস্ময়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে লাজবন্তী শুনতে লাগল এই কামোত্তেজিত পাঠান পুরুষটির হিংস্র উল্লাসের ধ্বনি, সে বলেই চলল,
    – তোর বীরেন্দ্রবাবু তো সেই কখনই তার স্ত্রীকে নিয়ে কেটে পড়েছেন কলকাতার উদ্দেশ্যে…..জমিদারি রক্ত বইছে তার শরীরে, তোর মত এমন হাজার মেয়েমানুষের সাথে তার ফুলশয্যা হয় প্রতি রাতে…….কিন্তু তার মানে কি তাদের ভালোবেসে বিয়ে করবেন তিনি?……নাহ…….আজ আমি তাকে প্রান নিয়ে এই দেশত্যাগ করতে দিয়েছি শুধুমাত্র একটাই শর্তে, এবং তাতে তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন এই দেশ ছেড়ে!

    প্রতারণার ফাঁদে পড়ে, লাজবন্তী বিহ্বল চোখে ইমতিয়াজের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
    – কি সেই শর্ত? বলো ইমতিয়াজ…..কি সেই শর্ত?
    কুচ্ছিত দাঁতগুলি বার করে আবার হেসে উঠে ইমতিয়াজ বলে উঠল,
    – এখনো বুঝতে পারছিস না তুই?…….আজ থেকে তিনি আমায় ভার দিয়েছেন তোকে ভোগ করার……হা হা হা…..আজ থেকে আমি মজা লুটবো তোর…..আমি!…আমি!
    এই বলে ইমতিয়াজ ঝাঁপিয়ে পড়ল লাজবন্তীর গায়ের উপর, এক টানে খুলে নিল তার শরীর আঁচল। আর বেশি দেরি করল না লাজবন্তী, সে সটান তার হাতের চাকুটাকে নিজের কাছে ধরে চালিয়ে দিল নিজের বুকের ওপর। চমকে উঠে ইমতিয়াজ তাকিয়ে দেখল, যে রক্তাক্ত অবস্থায় লাজবন্তী লুটিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। একবার শুধু রাস্তার মাটি আঁকড়ে ধরে চরম যন্ত্রনায় বলে উঠল লাজবন্তী,
    – এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ আমি নেব, বীরেন্দ্রবাবু,……আমার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার প্রতারণা করার শাস্তি আমি আপনাকে দেবই…..এই জন্মে না হলেও পরের জন্মে…..আমি আপনাকে বাঁচতে দেব না, বীরেন্দ্রবাবু…..বাঁচতে দেব না!
    কিছুক্ষনের মধ্যেই শিথিল হয়ে গেল লাজবন্তীর শরীর!

    এতটা দেখে আতঙ্কে আঁতকে উঠে, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে যাওয়ার পর, বিছানায় বসে পড়ল সোনালি। তার মানে, আগের জন্মে তুষারবাবুই ছিলেন বীরেন্দ্র! আর গত জন্মে লাজবন্তীর সাথে তার এই প্রতারণার জন্যই, তাকে প্রথম দেখার পর, আক্রোশের ভরে সোনালি তাকে বলে উঠেছিল যে, “আমি তোকে বাঁচতে দেব না”! পাশের খাটে সেই ঘুমন্ত মানুষটার দিকে একবার চেয়ে দেখল সোনালি। একি ভগবানের বিধান? গত জন্মে যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল সে, এই জন্মে তাকেই নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলল? একবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে…….না, আর যাই হোক……এমন প্রতারকের সাথে কিছুতেই এক ছাদের তলায় আর রাত্রিবাস করবে না সে…….কিছুতেই না…..এই ভেবে সটান নিজের রুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল সোনালি। হঠাৎ সে শুনতে পেল, পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে উঠল কোনো এক মেয়ে। আরে……এটা তো সায়নীর গলা! সোনালি ছুটে গেল সেই ঘরের দিকে, সেই ঘরের বন্ধ দরজার ওপর আছড়ে পরে কড়া নাড়তে লাগল সে। কিছুক্ষন পরেই, আতঙ্কিত মুখে দরজা খুলে দিলেন শচীনবাবু।

    সোনালি ছুটে গেল তার ঘরের ভেতর, দেখল যে বিছানার ওপর বসে বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে, উত্তেজনায় ক্রমাগত জোরে শ্বাস নিয়ে চলেছে সায়নী। সোনালি তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
    – কি হয়েছে সায়নী?
    সায়নী সোনালির দু হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল,
    – আমি ঘুমের মধ্যে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, সোনালি……সেটা আমার নিজেরই গলার আওয়াজ……
    সোনালি কৌতুহলী হয়ে বলল,
    – কি বলছিল সেই আওয়াজ?
    একটু দম নিয়ে সায়নী বলে উঠল,
    -বলছিল যে, “আজ রাতের গাড়িতেই কলকাতার উদ্দেশ্যে পালানোর পরিকল্পনা করেছে ও আমার সাথে, সাথে নেবে বাড়ির সমস্ত টাকা পয়সা আর সোনা দানা………আর ওই মেয়েছেলেটাকেও আমাদের সাথে নিয়ে পালাবে বলেছে সে……..স্টেশনে যাওয়ার জন্য বাড়ির পেছনের কুয়োটার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে ওর জুরিগাড়ি…….তোমাকে কাকে কি করতে হবে আর কাকে কি বলতে হবে, তা নিশ্চয় আমাকে আর শিখিয়ে দিতে হবে না তোমায়, ইমতিয়াজ!……আর তা করতে পারলেই আমি তোমার, তোমার বাঁদি হয়ে থাকব আমি সারা জীবন, নিকাহ করব আমি তোমাকে!…….আর তোমার উপরি পাওনা হবে ওই মেয়েমানুষটা, আজ রাতের জন্য……..হা হা হা হা!”

    ব্যাস, সোনালি দূরে সরে এল সায়নীর কাছ থেকে। তার যেন জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ে গিয়েছিল! এমন সময় শচীনবাবু বলে উঠলেন,
    কাল রাতেই আমার কথা হচ্ছিল আমার এক বন্ধুর সাথে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। সে অনেক গবেষণা করেছে বাংলাদেশের জমিদার বংশগুলি নিয়ে। সে বলছিল যে, ওই রাজবাড়িটার সর্বশেষ জমিদার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্রপ্রতাপ রায়চৌধুরী, তার স্ত্রী হলেন সুরবালাদেবী। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়, একটি রাতের পর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের কারোর। আর, ইমতিয়াজ খান ছিল সেই সময়ের স্থানীয় মুসলমান দলের নেতা। তবে, স্ত্রীর থেকেও বীরেন্দ্রবাবুর টান ছিল কোন এক স্থানীয় বাইজির প্রতি, তবে তার নাম কেউ জানে না।
    এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল সোনালি,
    – সেই বাইজির নাম ছিল লাজবন্তী!

    এতক্ষনে কোলাহলের আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে সায়নীদের রুমের ছুটে এসেছেন তুষারবাবুও। সোনালি বলে চলল,
    – বীরেন্দ্র তার স্ত্রী সুরবালাকে উপেক্ষা করে ভালোবাসতেন বাইজি লাজবন্তীকে। তাই, সুরবালা ঈর্ষা করতেন লাজবন্তীকে, সহ্য করতে পারতেন না তার স্বামীকেও। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়, এক রাতে বীরেন্দ্র ঠিক করেন যে তিনি এই দেশ ছেড়ে সুরবালা আর লাজবন্তীকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন কলকাতায়। কিন্তু তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন সুরবালা। তিনি এই কথা জানিয়ে দিলেন ইমতিয়াজ খানকে। সুরবালারই পরিকল্পনা মতো, স্টেশনের উদ্দেশ্যে ঠিক রওনা হওয়ার আগেই, ইমতিয়াজ তার দলবল নিয়ে এসে খুন করে বীরেন্দ্রকে। তার লাশটাকে ফেলে দেয় ওই রাজবাড়ির একটা কুয়োর মধ্যে। এদিকে বীরেন্দ্রর কথামত লাজবন্তী এই রাজবাড়িতে এসে আর তাকে খুঁজে পায় না। তাকে ধাওয়া করে ইমতিয়াজের দলবল। সুরবালারই শেখানো মিথ্যা কথা ইমতিয়াজ লাজবন্তীকে বলে, বলে যে বীরেন্দ্র নাকি লাজবন্তীকে ইমতিয়াজের হাতে সঁপে দিয়ে, সুরবালাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। সবশেষে, ইমতিয়াজের দ্বারা আসন্ন ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে, লাজবন্তী নিজেই শেষ করে দেয় নিজেকে।
    একটু থেমে একবার দম নিয়ে নিল সোনালি। তারপর আবার বলল,
    – লাজবন্তীর উদ্দেশ্য ছিল বীরেন্দ্রর প্রতারণার প্রতিশোধ নেওয়া আর সুরবালা হয়তো মৃত্যুর আগে বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ভুল, তাই তিনি ভুগছিলেন অনুশোচনার জ্বালায়। তাই এই দুজনকেই পরের জন্মে, অতীত জীবনের স্মৃতিগুলির দ্বারা এত মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। গত জন্মে আমি ছিলাম লাজবন্তী, তুষারবাবু ছিলেন বীরেন্দ্রপ্রতাপ রায়চৌধুরী আর সায়নী ছিল সুরবালাদেবী!

    সোনালি ছুটে এগিয়ে গেল তুষারবাবুর দিকে, তারপর তার বুকের পাঞ্জাবী খামচে ধরে জিজ্ঞাসা করল,
    – আমি জানতাম!…..আমার বীরেন্দ্রবাবু কখনোই প্রতারনা করতে পারেন না আমার সাথে……তিনি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন তার লাজবন্তীকে…….আগের জন্মে আপনাকে না পেলেও, এই জন্মে আবার আপনার লাজবন্তী আপনার কাছে ফিরে এসেছে বীরেন্দ্রবাবু, আপনি কি তাকে গ্রহণ করবেন না?
    কোনো কথা বললেন না তুষারবাবু, শুধু সোনালির গালদুটিকে আঁকড়ে ধরে ঠোঁট রাখলেন তার ঠোঁটের ওপর। আর এই দৃশ্য দেখে, হাসিমুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল সায়নী আর শচীনবাবু। সেই সময়ই, জানলার ফাঁক দিয়ে প্রথম ভোরের আলোটা এসে পড়ল ওদের চারজনের গায়ে, যেন আকাশ থেকে সূর্যদেব বলে উঠলেন,
    “একটা নতুন সকাল দিলাম তোমাদের সবাইকে, সকল পিছুটান ফেলে এবার এগিয়ে যাও নতুন জীবনের পথে।”

    (সমাপ্ত)

  • গল্প

    পরকীয়া ২

    পরকীয়া ২
    -প্রলয় কুমার নাথ

    (১)

    অতীতের পৃথিবীর কোনো এক অজানা কোণে অবস্থিত, একটি ছোট্ট জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে নেমেছে রাতের অন্ধকার। পাথরের দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরগুলির ওপর চাঁদের আলো পড়ে সৃষ্টি করেছে এক মায়াবী জগৎ। প্রতিটি ঘরেই নিভে গিয়েছে আলোর জন্য জ্বালিয়ে রাখা অগ্নিকুন্ড, শোনা যাচ্ছে না কারোর কথা বার্তার আওয়াজ। নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন গোটা গ্রাম। মাঝে মাঝে শুধু শোনা যায় নিশাচর শেয়াল কুকুরের ডাক তথা রাতপাখিদের কর্কশ ক্রন্দন ধ্বনি। পশ্চিম দিক থেকে বইতে শুরু করেছে একটি ঠান্ডা হাওয়ার দাপট যা সমানে কাঁপিয়ে তুলেছে এই বাড়ির খোলা জানলার পাইন কাঠের পাল্লাগুলিকে। তবে সেদিকে কোন খেয়াল নেই, এই ঘরের চুণ ও মাটির প্রলেপে আবৃত পাথুরে মেঝের ওপর পাখির পালক দিয়ে তৈরি চাটাই-এ শায়িত এক নারী পুরুষ জুটির। এই মধ্যরাতেও, শরীরী ক্রিয়ায় মত্ত এই দম্পতির চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই।

    দীর্ঘদেহী পুরুষটির সুঠাম দেহ ক্রমাগত ওঠানামা করছিলো তার নিচে শায়িত নগ্ন নারীদেহটির ওপর। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিলো দুজনের সুখানুভবের মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রুত বেগে নিঃশ্বাস নিতে নিতে নারী দেহের ওপর থেকে এক পাশে ঢলে পড়লো পুরুষটি। তারপর বেশ কয়েকটি মুহূর্ত স্তব্ধ থাকার পর, হঠাৎ ক্ষিপ্ত চিতা বাঘিনীর মত নারীটি আবার জাপটে ধরলো পুরুষটির দেহটিকে। পুরুষটির পুরুষ্ঠ ঠোঁটের যতটা কাছে সম্ভব নিজের মুখটাকে নিয়ে গিয়ে, কোনো এক দুর্বোধ্য ভাষায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো নারীটি, “আর একটা রাত…..শুধু মাত্র আর একটা রাতই আমি কাটাতে পারবো তোর সাথে!”
    উদ্বেগহীন গলায় বলে উঠলো পুরুষটি, “জানি….পরশু দিন সকালেই তোকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে হবে আমাকে, যেখান থেকে আর তোর কাছে ফিরে আসা কখনই সম্ভব হবে না আমার পক্ষে!”

    উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো নারীটি, “কিন্তু আমি যে পারবো না রে…..পারবো না তোকে ছেড়ে একটা রাতও কাটাতে! আমি যে বাকি তিনজনের মত নই, যারা শুধুমাত্র আচার আচরণের খাতিরেই কিছুদিনের জন্য বাধ্য হয়েছিলো তোর বিছানায় আসতে! আমি যে তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি রে…..তোকে ছাড়া বাঁচবো কি করে আমি!”
    পুরুষের গলায় বিস্ময়ের স্বর, “একি বলছিস তুই? তুই তো সব কিছু জেনে শুনেই……”
    আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে নারীটি, “হ্যাঁ, তুই যে এই পৃথিবীতে মাত্র কিছুদিনের অতিথি, এই কথা আমার অজানা নয়! তা জেনেই আমি তোর শয্যা সঙ্গিনী হয়েছি! কিন্তু এখন যে আমি তোকে কিছুতেই হারাতে চাই না রে!…..কাউকে কেড়ে নিতে দেবো না তোকে আমার কাছ থেকে!”
    “তা অসম্ভব!”, গর্জে উঠলো পুরুষটি, “জেনে রাখিস, আমার মেয়াদ মাত্র আর এক দিন!”
    “না, অসম্ভব নয়…..কারণ তার উপায় আমি আগে থেকেই বার করে রেখেছি!”, মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিলো নারীটি।

    এই বলে সেই মুহূর্তে সে পুরুষটির পাশ থেকে উঠে, ছুটে চলে গেল সেই ঘরের এক কোণে। তারপর সে পাথরের দেওয়ালের গায়ে খাঁজ কাটা তাক থেকে তুলে নিলো একটি মাটির কলস। সেটার মুখের ঢাকনা সরিয়ে, তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাস্যোজ্জল মুখে বার করে আনলো একটি চারপেয়ে ছোট্ট প্রাণীকে! জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেয়েটির দুই আঙুলের মাঝে ধরে থাকা সুন্দর সোনালী ছোপ ছোপ চামড়াধারী সেই ছোট্ট প্রাণীটার গায়ের ওপর। অপার বিস্ময়ে সেদিকে চেয়ে বলে উঠলো পুরুষটি, “এটা তো…..এটা তো একটা বিষাক্ত ব্যাঙ!”
    “ঠিক তাই….বিষ!….এই প্রাণীটার বিষ প্রায়শয় কেড়ে নেয় কত মানুষের প্রাণ, তাই না?”, উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠলো মেয়েটির দুই কাজল কালো চোখ! সে বলেই চলল, “কিন্তু এই বিষ দিয়েই আমি যে বাঁচাতে চলেছি তোর প্রাণ!”

    সেই রাতের অন্ধকারকে খান খান করে দ্বিখণ্ডিত করে সেই ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির শয়তানী হাসির রেশ!

    (২)

    আমাকে ভুলে যাননি তো? আমি মহেশপুর গ্রামের সেই হতভাগ্য জমিদার শিলাদিত্য চৌধুরী! নিজের বন্ধু-পত্নীর রূপের ওপর লালসা যার জীবনটাকে ঢেকে দিয়েছে Fregoli Delusion এর অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায়! নন্দিনীকে হারাবার পর থেকে এভাবেই কেটে গিয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। শুনেছিলাম অন্যত্র বিবাহ হয়েছে তার, ব্যাস এর থেকে বেশি তার সম্বন্ধে আর কোন খোঁজ খবর নেই আমার কাছে। হয়তো খুব সুখেই আছে সে, তাই তার খোঁজ নেওয়ার কোন দরকারও বোধ করি না আমি।

    আজ একটি বিভীষিকাময় নিকষ কালো মৃত্যুর ছায়া ঘনীভূত এই জমিদার বাড়ির মোসাহেব খানার একটি ঘরে। সন্ধ্যার ঝড় জল আর বজ্রপাতের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে, সেখান থেকেই ভেসে আসছে এই বাড়ির এক সদ্য মাতৃহারা তরুণ কর্মচারী, সুবলের মর্মভেদী হাহাকার! দুই সপ্তাহ ধরে আন্ত্রিকে ভুগে কিছুক্ষণ আগেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে এই বাড়ির দীর্ঘদিনের এক বিধবা রাঁধুনি, সরমা! আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম কলকাতা থেকে ডাক্তার ডেকে এনে তাকে সুস্থ করে তুলতে, কিন্তু ভাগ্যের লিখন পরিবর্তন করার ক্ষমতা বোধহয় চিকিৎসা শাস্ত্রেও লেখা নেই!

    খবর পেয়েই আমি দ্রুত পায়ে ছুটে এসেছিলাম সরমার ঘরে। অন্ধকার ঘরের এক পাশে একটি কুপি জ্বলছে। মাঝে মাঝে তীব্র ঝড়ো হাওয়ার দাপটে দপ দপ করে কেঁপে উঠছে তার শিখা। ঘরটি ভরে ছিল বেশ কিছু চাকর বাকরের ভিড়ে। সকলেরই মুখে আতঙ্ক এবং শোকের ছায়া। আমাকে এই ঘরে ঢুকতে দেখে সকলেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে। শুধু দড়ির খাটিয়ার ছোট বিছানাটার ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো সরমার শীর্ণকায় মৃতদেহটি। আর তার বুকের ওপর মুখ গুজে এখনো কেঁদে চলেছে সুবল।

    আমি গিয়ে সুবলের কাঁধে হাত রাখতেই, সে মৃত মায়ের বুক ছেড়ে হাউ মাউ করে জড়িয়ে ধরলো আমার দু’টি পা। আমি তার দুই কাঁধ ধরে নিচ থেকে উঠিয়ে, তাকে তার মায়ের পাশে বসালাম। তারপর নিজেও তার পাশে বসলাম। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “মা তো আর রইলো না, কত্তা বাবু….এবার!…..এবার কি হবে আমার!”
    আমি আশ্বাসের সুরে বললাম, “তোর কোন চিন্তা নেই, সুবল….এই বাড়িতে আগে তোরা যেমন থাকতিস, এখনো থাকবি। আমি আছি তো!…..আর শোন, মা বাবা তো চিরকালটা বেঁচে থাকেনা, বল!…..যা, যা দেখ দেখি নায়েব মশাই দাহ করার সমস্ত ব্যবস্থা করে উঠতে পারলেন কি না।”
    সুবল চোখ মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।

    কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও মৃতদেহের পাশ থেকে উঠতে যাবো, এমন সময় মনে হল, যে একটি বরফের মত ঠান্ডা হাত যেন চেপে ধরলো আমার ডান হাতের পাতা! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে চাইতেই আতঙ্কে শিউরে উঠলাম! কারণ যে হাতটা আমার হাত চেপে ধরেছে, সেটা আর কারোর নয়, সদ্য মৃত সরমার! আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ঝটকায় নিজের হাতটা সেই হিম শীতল স্পর্শ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে গেলাম ঘরের দরজার দিকে, কিন্তু সেই ঘর থেকে বেরোনোর আগেই সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজার দুই পাল্লা! আমি দরজার গায়ে আছড়ে পড়ে তা খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম, ঠিক এমন সময় সেই চেনা পুরুষকণ্ঠের ডাক ভেসে এলো পেছন দিক থেকে!

    “বৃথা ভয় পেয়ে পালানোর কোন দরকার নেই, শিলাদিত্য!……তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে!”

    শশধরের গলার স্বর চিনতে এতটুকু দেরি হল না আমার! আমি পেছন ঘুরে, কুপির আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, যে বিছানার উপর উঠে বসে নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সরমার দেহ। রক্তের মত লাল হয়ে উঠেছে তার দুই চোখ। সম্পূর্ণরূপে শশধরের কণ্ঠস্বরে সে বলে চলল, “নাহ, আমি সরমা নই, শিলাদিত্য!…..তার মরদেহে ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় নেওয়া, তোর পুরোনো বন্ধু শশধর আমি, নিশ্চয় চিনতে পেরেছিস আমায়!”

    একটি দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে মুহূর্তের মধ্যে নিভিয়ে দিলো কুপির আগুন। দুম দাম করে কেঁপে উঠলো ঘরের জানলার পাল্লাগুলি। এই আঁধারের মধ্যেই আবার শোনা গেল শশধরের কণ্ঠস্বর, “জানি আমার দেওয়া অভিশাপে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তোর জীবন! কিন্তু ততোধিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমিও, কারণ যতদিন তোর জীবনে এই অভিশাপ থাকবে, ততদিন আমিও মুক্তি পাবো না এই পৃথিবী থেকে!……তাই, খুব তাড়াতাড়ি তুই এমন একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হবি, যার ওপর নির্ভর করবে আমার দেওয়া অভিশাপ আমি ফিরিয়ে নেবো কি না! তৈরি থাকিস কিন্তু!”

    আমি কিছু একটা বলতে চলেছিলাম, কিন্তু তার আগেই শিথিল হয়ে বিছানায় ঢলে পড়লো সরমার দেহ। আলগা হয়ে গেল দরজার পাল্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ার শক্ত ভাব! ঠিক তখনই দরজা ঠেলে বেশ কিছু লোকজনের সাথে সেই ঘরে অবাক হয়ে প্রবেশ করলেন নায়েব মশাই, শংকর বাবু। তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, “কত্তা বাবু, আপনি এই মরার ঘরে, অন্ধকারের মধ্যে দরজা বন্ধ করে করছিলেন কি!…..আমি লোক নিয়ে এলুম লাশ শ্মশানে নিয়ে যেতে……”
    আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না তাকে, শুধু বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে!

    (৩)

    “চিকিৎসা বিজ্ঞান অশরীরী বা অতি-প্রাকৃত বিষয়গুলিকে কখনই মান্যতা দেবে না, মিস্টার চৌধুরী,” ঠোঁটের কোণ থেকে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন ডাঃ নবারুন হালদার, “আপনার সকল অলৌকিক অভিজ্ঞতাগুলোর নানা রকমের গাল ভরা নাম দেবে সাইকোলজির ভাষায়!”
    আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে, যা ধীরে ধীরে কলকাতার এই অতি প্রাচীন মানসিক রোগের হাসপাতালের লম্বা খোলা জানলার লোহার শিকগুলির ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরে।

    নবারুন বাবুর কাছে আমি বেশ কিছু বছর ধরে চিকিৎসাধীন। কলকাতার মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ নামডাক আছে তার, এবং বর্তমানে এই হাসপাতালের বেশ উচ্চপদে কর্মরত তিনি। যদিও বা লৌকিক অলৌকিকের এই জটিল মায়াজাল থেকে আমাকে এখনো উদ্ধার করতে পারেননি তিনি, তবুও এই মিষ্টভাষী সদা হাস্যময় সুদর্শন মানুষটিকে বন্ধুরূপে পেয়ে নিজের একাকিত্ব দূর করতে পেরে যথেষ্ট উপকৃত আমি। তাই আমি দরকারে অদরকারে মাঝে মাঝেই তার সাথে দেখা করতে আসি এই হাসপাতালে উপস্থিত তার চেম্বারে। আজও তেমনই একটা দিন।

    বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর কিছু একটা বলতে চলেছিলাম আমি, এমন সময় বাইরে থেকে একটা কোলাহলের আওয়াজ পেয়ে আমাদের দু’জনেরই চিন্তার ঘোর কেটে গেল! দু’জনেই ছুটে সেই চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এলাম। শব্দটা আসছে এই হাসপাতালের পেছনের দিক থেকে, যেখানে বিভিন্ন মানসিক রোগীদের ভর্তি করে রাখা হয়। সেদিকে ছুটে যাওয়ার পথেই আমাদের দেখা হয়ে গেল বেশ কয়েকজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সাথে, যারা দোতলার বারান্দায় উদ্বিগ্ন চিত্তে জটলা বাঁধিয়ে বসেছে। তাদের কাছে পৌঁছতেই গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন ডাঃ হালদার, “কি হয়েছে কি? এখানে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছো কেন তোমরা?”

    “সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, স্যার…… আজ সকাল থেকে অলোকেশ বাবুকে…… মানে আসামী অলোকেশ বসুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”, কুণ্ঠিত গলায় বলে উঠলো একজন কর্মচারী।
    মুহূর্তের মধ্যেই পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো নবারুন বাবুর মুখ, অস্ফুট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, “সে কি!”
    ঠিক তখনই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো আর একজন কর্মচারী, সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ক্ষমা করে দিন, স্যার! বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে আমার! কাল আমারই দায়িত্ব ছিল অলোকেশ বসুর সেলে রাতে পাহারা দেওয়ার। তিনি বার বার কান্নাকাটি করতে লাগলেন কাল রাতে, বললেন হাতে পায়ের লোহার চেনগুলোকে খুলে দিতে। হাতে পায়ে খুব ব্যাথা করছে, ঘা হয়ে গিয়েছে। একটু শান্তিতে ঘুমতে চান তিনি। মানুষটার ওপরে বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল, স্যার…… তাই আর না করতে পারিনি। সারাদিন বাড়িতে খাটা খাটনি করার পর মাঝরাতের দিকে দুই চোখ একটু বন্ধ হয়ে এসেছিল আমার……হে ভগবান, তখন কি আর জানতাম, যে সেই সুযোগে……”

    “মায়া পড়ে গিয়েছে! রাবিশ! ওই জঘন্য ক্রিমিনালটার ওপর তোমার মায়া পড়ে গিয়েছে!…… তুমি জানো না, যে কত বড় ভুল করে ফেলেছো তুমি! এরপর গোটা পুলিশ মহলের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে এর জন্য!”, গর্জে উঠলেন ডাঃ হালদার। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটি। “যাও, যাও হাসপাতালের চারিদিকে খুঁজে দেখো তাকে পাও কি না……আর ওনার স্ত্রীর কাছে খবর পাঠাও, বল এখানে এসে আমার সাথে দেখা করতে। আর আমাদেরও স্থানীয় থানায় একটা টেলিফোন করে দিতে হবে! আসুন মিস্টার চৌধুরী, আসুন……”, ব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলেন নবারুন বাবু।

    থানায় খবর দেওয়া হয়ে গেলে, আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না আমি। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে এই অলোকেশ বসু? আর কেনই বা তার আকস্মিক নিরুদ্দেশ হওয়ায় এত হুলস্থুল বেঁধে গিয়েছে এই হাসপাতালে?”
    ডা: হালদারের মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠলো একটি চাপা আতঙ্কের চাপ। তিনি বলে উঠলেন, “প্রায় সাত আট মাস আগেকার ঘটনা। এই কলকাতা শহরের বুকে ঘটে চলেছিল একের পর এক মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছিল, তারা প্রায় সকলেই এখানকার গৃহহীন গরিব মানুষজন, যারা বাধ্য হত রাতে বিভিন্ন ওলি গলি বা রাস্তার ধারে শুয়ে ঘুমোতে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হল খুনের প্রক্রিয়া! হত্যাকারী যেন সপাটে তাদের বুকে বসিয়ে দিয়েছে কোন ধারালো অস্ত্র। তারপর তাদের প্রাণ থাকা অবস্থাতেই, তাদের বুক চিরে ছিঁড়ে বার করে নিয়েছে কম্পমান হৃৎপিন্ডটাকে!”
    এই দৃশ্যের ভয়াবহতা নিজের চোখের সামনে কল্পনা করে ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি।

    “পরপর চারজনকে একই ভাবে খুন হবার পরও অপরাধী ধরা পড়ছে না জেনে যখন পুলিশ প্রশাসন চোখে সর্ষের ফুল দেখছেন, তখনই পঞ্চম ব্যক্তিটিকে খুন করার সময়, সেই রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্য গোপনে দেখে ফেললো এক পথচারী ভিক্ষুক। সে পরদিনই সেই কথা পুলিশের কাছে গিয়ে জানায়। তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আঁকা হয় হত্যাকারীর ছবি। এবং বলা বাহুল্য, সে আর কেউ নয়, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রীমান অলোকেশ বসু। সেদিনই খানা তল্লাশি করা হয় অলোকেশ বাবুর বাড়িতে। তার পরিবারে আছেন শুধু তার স্ত্রী এবং দুই বছরের মেয়ে। কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন তার বিধবা মা। তার বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন পুলিশের লোকেরা! একটি অদ্ভুত দেখতে প্রাচীন যুগের পাথরের তৈরি পাত্রের মধ্যে ভস্মীভূত অবস্থায় পড়ে রয়েছে খুন হওয়া হতভাগ্য মানুষগুলির হৃদপিণ্ডের অবশেষ!”, এতটা বলে একটু থামলেন ডা: হালদার।

    কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি, “সেদিনই গ্রেফতার করা হয় অলোকেশ বসুকে। সকলের মনে হয়েছিলো, হয়তো তিনি অভ্যাস করতেন কোন গোপন তন্ত্র বিদ্যা, কিন্তু তাকে জেরার পরই বোঝা গেল, যে তার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়! আদালত থেকে রায় দেওয়া হল, যে যতদিন না তিনি সুস্থ হচ্ছেন, তাকে এখানে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখতে।”
    এতটা বলার পর, হঠাৎ সেই ঘরে প্রবেশ করলো আরেকজন নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী। সে বলে উঠলো, “স্যার, আপনার কথামত আমরা অলোকেশ বসুর স্ত্রীকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।” “পাঠিয়ে দাও”, প্রত্যুত্তরে বললেন নবারুণ বাবু।

    ঠিক সেই মুহূর্তে, একটি কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে, বিধ্বস্ত চেহারায় একজন মহিলা প্রবেশ করলেন ডা: হালদারের চেম্বারে। তার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি। পাঁচ বছর পর, এই প্রথম দেখা হল আমার নন্দিনীর সাথে!

    (৪)

    “আর পারছি না আমি……পারছি না আর!”, চিৎকার করে উঠলো নন্দিনী, “নিয়ে যান আমাকে এখান থেকে……নিয়ে যান!”, কান্নায় ভেঙে পড়ে দু’হাতের মুঠো দিয়ে আমার বুকে থাকা জামাটাকে খামচে ধরে বলে উঠলো সে। সেদিন ওই মানসিক রোগের হাসপাতালে আমরা একে অপরকে চিনতে পারলেও, ডা: হালদারের সামনে না চেনার অভিনয় করেছিলাম। অলোকেশ বাবুর নিখোঁজ হওয়ার খবরটা শুনে আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকেনি নন্দিনী। আমিও কোন জরুরি কাজের অছিলায় বেরিয়ে এসেছিলাম ডা: হালদারের চেম্বার থেকে। তারপর ফিরতি পথেই নন্দিনী আমায় নিয়ে আসে তার বাড়িতে। এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয় অলোকেশ বাবুকে।

    “তুমি তো আমার অক্ষমতার কথা জানো, নন্দিনী…..তারপরেও আমার সাথে চলে যেতে চাইছো!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম আমি। সে এবার উন্মাদিনীর মত চেপে ধরলো আমার জামার কলার, “চাই না…..চাই না আমি শারীরিক সুখ, চাই না! আমি শুধু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই, শিলাদিত্য বাবু!…..এই বাড়িতে যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!…..যে মানুষ নৃশংস ভাবে একের পর এক মানুষকে হত্যা করে, তাদের শরীর থেকে হৃদপিন্ড ছিঁড়ে এনে এই বাড়িতেই কোন শয়তানের উদ্দেশ্যে আহুতি দিতে পারে, তার বাড়িতে আর একটি মুহূর্তও কাটাতে চাই না আমি!…..ওনার গ্রেফতারের পর আমি হয়তো আত্মহত্যা করে শেষ করে দিতাম নিজেকে, কিন্তু তা পারলাম না শুধু ওর মুখ চেয়ে…..” এই বলে পাশের বিছানায় ঘুমন্ত শিশুকন্যাটির দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করলো নন্দিনী।

    অনেক কষ্ট করে তখনকার মত শান্ত করতে পারলাম আমি তাকে। হঠাৎ একটা চাপা কৌতূহল উপলব্ধি করলাম আমি, বললাম, “তুমি কখনো জানতে চাওনি, কেন তোমার স্বামী করতেন এই ঘৃণ্য কাজ?”
    সে বিদ্বেষ মেশানো গলায় বলল, “বিছানায় উপভোগ্য সামগ্রী ছাড়া আর কোন কিছুই মনে করতেন না তিনি আমাকে! আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন দরকার বোধ করেননি তিনি কখনো! মাঝে মাঝে আমিও উপলব্ধি করতাম তিনি গভীর রাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান। এছাড়া চিলেকোঠার ওই ঘরে গোপনে কিছু করেন। মাঝে মাঝে সেখান থেকে শুনতে পেতাম কোন এক অদ্ভুত ভাষায় তার কথা বার্তার শব্দ! কাঁচা মাংস পোড়ার আঁশটে গন্ধও আসতো নাকে! কিন্তু ওই ঘরে যাওয়ার কোন অনুমতি ছিল না আমার!”

    এই বাড়িটা বেশ বড় এবং পুরোনো আমলের বনেদি ধাঁচে গড়া, যদিও বা তা মহেশপুরের জমিদার বাড়ির ধারে কাছেও আসে না। আমি আর নন্দিনী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম চিলেকোঠার ঘরটি দেখার অভিপ্রায়ে। বিশেষতঃ, সেই প্রাচীন পাথরের পাত্রটি, যার ওপর অলোকেশ বাবু হৃদয়গুলিকে ভস্মীভূত করতেন, সেটাও এখনো রাখা আছে সেখানে, সেটা দেখাই আমার কৌতূহলের মূল কারণ।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো নন্দিনী, “তবে, কি জানেন, আমি শাশুড়ি মায়ের কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় নাকি মাঝে মাঝে কোন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত আমার স্বামীর! যদিও বা, এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলতে চাইতেন না তিনি…..তবে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই দু’টো অদ্ভুত শব্দ বলে উঠতেন তিনি! এছাড়াও, খানা তল্লাশি করার সময় তার ডায়েরির বেশ কয়েকটা পাতায় লেখা একটি অদ্ভুত ছড়ার হদিস পায় পুলিশ, যার অর্থ তারা আজ অবধি বার করতে পারেননি!”
    “কি শব্দ? আর ছড়াটাই বা কি?”, বিস্ময়ের পারদ চড়া কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
    প্রত্যুত্তরে বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কে জোর খাটিয়ে বলে উঠলো নন্দিনী, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে! শব্দ দু’টি হল ‘ইকসিপৎলা’ এবং ‘ৎলেনামাকাক’!……আর সেই ছড়াটা হল:
    উত্তরের ধূমায়িত আয়নার মন,
    চায় তার সর্বদা সূর্যের তাপ,
    একপেয়ে জাগুয়ারের দশম স্বর্গে ভ্রমণ,
    সমাপ্ত করবে অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপ।”

    (৫)

    নাহ, বহুবার ভেবেও আমার ভোঁতা মস্তিস্ক কোনই অর্থ উৎপন্ন করতে পারলো না ছড়াটার। আয়না চাইছে সূর্যের তাপ! আবার একপেয়ে জাগুয়ারই বা স্বর্গে যাবে কি করে! অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপই বা কি! বোঝাই যাচ্ছে, যে অলোকেশ বাবু কোন এক গুরুতর রহস্য ধাঁধার মাধ্যমে লিখে রেখেছিলেন তার ডায়েরির পাতায়। এর সাথে কি কোন সম্পর্ক আছে তার দ্বারা করা নরহত্যাগুলির? চোখের সামনে যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম আমি! আর ওই দু’টো শব্দ তো উচ্চারণ করাই দায়!

    “আচ্ছা, ওই প্রাচীন পাথরের পাত্রটি কোথা থেকে পেয়েছিলেন তিনি?” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই নন্দিনীকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
    “ওনার প্রাচীন এন্টিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করার বাতিক ছিলো। শাশুড়ি মায়ের মুখে শুনেছিলাম, ধর্মতলার একটি কিউরিও দোকানের মালিকের সাথে বেশ ভাব ছিলো ওনার। সেখান থেকেই নাকি তিনি কিনতেন এই ধরণের সামগ্রী!” বলে উঠলো নন্দিনী।

    আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম চিলেকোঠার সেই ঘরের দরজার বাইরে। অলোকেশ বাবু গ্রেফতার হবার পর থেকে এই ঘরের চাবি থাকে নন্দিনীর কাছে। তালা খুলে, দরজার হাতল ধরে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবো, ঠিক এমন সময় এই বাড়ির নিচের তলা থেকে ভেসে এলো একটি বাচ্চা মেয়ের আকস্মিক চিৎকার করার আওয়াজ। আমি অবাক হয়ে চাইলাম নন্দিনীর দিকে। সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলো, “মনে হয় মাধুর…..মানে আমার মেয়ে মাধুরীর ঘুম ভেঙে গিয়েছে……ঠিক আছে, আপনি ওই ঘরে গিয়ে পাত্রটিকে দেখুন, আমি একবার নিচে গিয়ে মাধুকে দেখে আসি!” আমার সম্মতিসূচক সারা পেয়ে নন্দিনী হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথ ধরলো। আমি এগিয়ে গিয়ে ওই ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

    সময়টা দুপুর বেলা হলেও, এই ঘরের মধ্যে যেন অন্ধকার রাত্রি বিরাজমান। একটা স্যাঁতস্যাঁতে অদ্ভুত গন্ধ চারিদিকে। খুব অদ্ভুত ভাবে ওই একটি দরজা বাদ দিয়ে আর কোন জানলা বা দরজা নেই এই ঘরে। এখানে ঢোকা মাত্রই একটি কর্কশ আওয়াজ করে নিজে থেকেই ভেজিয়ে গেল দরজার দুই পাল্লা। এই ঘরের এক কোণে থাকা ঘুলঘুলি দিয়ে যেটুকু আলো আসে, সেটার সাহায্যেই আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ঘরটির বিভিন্ন আসবাসপত্র। বেশিরভাগই রয়েছে কিছু প্রাচীন যুগে পাথরে খোদাই করা মূর্তি, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, কিছু পুরোনো দিনের বই এবং তৈলচিত্র। তবে ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা রয়েছে সেই বস্তুটি যাকে দেখার জন্যই আমি ছুটে এসেছি এই ঘরে।

    ঠিক যেন পাথরের ওপর একটি মস্ত বড় ঈগল পাখির শরীর খোদাই করা আছে। অনবদ্য শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার চোখ, ঠোঁট এবং শরীরে উপস্থিত পালকের প্রতিটি সূক্ষ্ণ কারুকাজ! তার পিঠের উপর উপস্থিত একটি বেশ বড় গর্ত! আমি এগিয়ে গেলাম বস্তুটির খুব কাছে। মেঝেতে উবু হয়ে বসে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম সেটাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে! এখনো একটা আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তার চারিপাশে, গর্তটির ভেতরের দেওয়ালে লেগে রয়েছে ছাই ভস্ম!

    “তোনা!……তোনা!……ইসৎলি!…….ইসৎলি!”

    হঠাৎ একটা অপার্থিব কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি! এতক্ষণ ধরে পাত্রটির কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখছিলাম আমি, এবার মাথা তুলে সামনের দেওয়ালের দিকে চাইতেই একটা হিমশীতল স্রোত যেন বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া জুড়ে! দেওয়ালের গা জুড়ে একটা মানুষের অবয়ব ধীরে ধীরে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে! যেন মাকড়সার মত দেওয়ালের গায়ের সাথে আটকে আছে সে! এবার দেওয়াল থেকে এক লাফে সে নেমে এলো নীচে। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ভরে উঠলো গোটা ঘরের বাতাস। সম্পূর্ণ সাদা, মণিহীন নিষ্পলক চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল এই অদ্ভুত পোশাক পড়া, অর্ধনগ্ন ছায়ামূর্তিটি! মনে হল যেন ধীরে ধীরে সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছে…..আমার খুব কাছে!…..আর একটু হলেই স্পর্শ করবে আমার বুক! আবার কোন দুর্বোধ্য ভাষায় শোনা গেল তার হাড় হিম করা কণ্ঠস্বর:

    “চালচিউয়াৎল!…….চালচিউয়াৎল!”

    আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা না করে আমি ছুটে গিয়ে একটানে দরজা খুলে, সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর সটান বাইরে থেকে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে, মেঝেতে বসে হাঁপাতে লাগলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন ভেতর থেকে কোন ভয়ঙ্কর ধাক্কায় কেঁপে উঠলো পুরোনো দিনের দরজার পাল্লা দুটি। তার সাথেই শোনা যেতে লাগলো আবার ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলোকে! নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি তর তর করে দ্রুত গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। নাহ, এই বাড়িতে কোন অশুভ শক্তি আছে! এখানে নন্দিনীকে আর এক মুহূর্ত রাখা যাবে না! তাকে আমি আমার বাড়িতেই নিয়ে গিয়ে তুলবো!

    আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে এই বাড়ির একতলায় নন্দিনীর ঘরে ঢুকে তাকে এই সমস্ত কথা বলতে যাবো, এমন সময় দেখলাম যে সে বিছানায় বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আমার পায়ের শব্দ শুনে, সে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, সশব্দে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে! তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, “মাধুকে এই বাড়ির কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, শিলাদিত্য বাবু!……সেই সময় ওর কান্নার শব্দ পেয়ে নীচে এসে দেখি ও বিছানায় নেই!…..তারপর সারা বাড়ি খুঁজলাম ওকে, কিন্তু কোথাও পেলাম না…..কোথাও না!”
    আমি কিছুই বলতে পারলাম না তাকে, শুধু তার দ্রুত হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি উপলব্ধি করতে লাগলাম নিজের শরীর দিয়ে!

    আবার অনেক কষ্টে শান্ত করলাম নন্দিনীকে। অলোকেশ বাবুর ওপর তার কোন টান নেই, তাই তার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সে। কিন্তু তার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা, তার দুই বছরের ফুটফুটে মেয়ে মাধু……তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটানো খুব কষ্টকর নন্দিনীর পক্ষে! সে উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠলো, “আমি মাধুকে ছাড়া বাঁচবো না, শিলাদিত্য বাবু…..ওকে আমার কাছে নিয়ে আসুন!…..যেখান থেকে হোক ওকে ফিরিয়ে আনুন আমার কাছে!”
    “শুধু তোমার মেয়েকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনা নয়, নন্দিনী…..তোমার স্বামীর সমস্ত ক্রিয়াকলাপের রহস্যভেদও করতে হবে আমাকে!….কিন্তু এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না তোমার, কারণ ওই চিলেকোঠার ঘরে হয়তো কোন অশরীরিকে আবদ্ধ করে রেখেছেন তোমার স্বামী!…..তার কাছেই হয়তো তিনি নিবেদন করতেন ওই ভস্মীভূত হৃৎপিণ্ডগুলি! কিন্তু যতক্ষণ না এর সম্বন্ধে বিশদে জানতে পারছি…..”

    “না শিলাদিত্য বাবু, আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলেছি! আমি আমার মেয়েকে না নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোবো না!…..এমনিতেই তো মরে মরেই বেঁচে আছি আমি, আর কোন অশরীরির হাতে মৃত্যুভয় নেই আমার!”, আমার কথা শেষ করার আগেই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো নন্দিনী। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোন মতেই রাজি করানো গেল না। অগত্যা তাকে বিদায় জানিয়ে আমিই বেরিয়ে এলাম সেই বাড়ি থেকে। যাবার আগে নন্দিনীর কাছ থেকে নিয়ে এলাম সেই কিউরিওর দোকানের ঠিকানা, যেখান থেকে অলোকেশ বাবু ওই প্রাচীন সামগ্রীগুলিকে কিনেছিলেন।

    (৬)

    কলকাতার মধ্যে বেশ প্রসিদ্ধ এই কিউরিও দোকানটি। পুরনো আমলের তিনতলা বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখে তেমন কোন সাজসজ্জার আড়ম্বর চোখে পড়ে না। শুধুমাত্র সদর দরজার ওপর ঝোলানো আছে একটি বেশ পুরোনো সাইন বোর্ড। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, যে দেশ বিদেশের বহু প্রাচীন বস্তু মজুত আছে সেখানে। মূর্তি, মুখোশ, শিলমোহর, অস্ত্রশস্ত্র, পাত্র, পোশাক ইত্যাদি আরও কত কিছু, মনে হয় যেন যেন সদ্য ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে সেগুলো। তবে সেই সব জিনিসের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না। সেখানে ঢুকতেই স্বয়ং অভিজাত চেহারার মাঝ-বয়সী দোকান মালিক আমায় সমাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। ভদ্রলোক হাসিমুখে জানতে চাইলেন, যে আমি কি কিনতে ইচ্ছুক। আমি সরাসরি তাকে জানালাম আমার আসার কারণ, আর সেই কথা শুনে তার হাস্যজ্জ্বল মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল।

    আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে, অনিচ্ছা সত্বেও বলে উঠলেন তিনি, “দেখুন, আপনি যে পাত্রটার কথা বলছেন, সেটা আমি আনিয়েছিলাম সুদূর মেক্সিকো থেকে। সেখানে নাকি প্রাচীন কোন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের খননকার্যের সময় পাওয়া যায় সেটা। তবে এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না ওটার সম্বন্ধে! সেখানকার যে ব্যবসায়ী আমাকে সেটা বিক্রি করেন, তিনি এখন মারা গিয়েছেন। অলোকেশ বাবুও বা ওই পাত্রটিই কেন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন এখান থেকে, সেটাও আমি জানি না!….. আপনি যদি এখান থেকে কিছু কিনতে ইচ্ছুক হন তাহলে ঠিক আছে, নাহলে……”

    এই কথা শুনে আমি আর কথা বাড়ালাম না তার সাথে, তাকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলাম দোকান থেকে। সেই দোকান থকে বেরিয়ে আসতেই মনে হল, যে বাতাসের স্রোতের মাঝে একটি পরিচিত অদৃশ্য পুরুষ কণ্ঠ যেন ফিসফিসিয়ে আমার কানে কানে বলল, “তোর পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে, শিলাদিত্য! এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে সক্ষম নয়, হয়তো তার উত্তর খুঁজে পাবি ইতিহাসের পাতায়!”

    (৭)

    কলকাতা শহরের সুশোভিত চওড়া সড়কে ঝরে পড়ছে অস্তমিত সূর্যের মিঠে রোদ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি এলোমেলো ভাবে হেঁটে চলেছিলাম এই রাস্তা থেকে সেই রাস্তা ধরে। নিজের ধুলো মাখা চটিজুতা আর মলিন বেশভূষা দেখে নিজেকেই যেন চিনতে পারছিলাম না আমি! কোথায় গেল মহেশপুরের সেই বৈভব, সাজসজ্জা, আমাকে ঘিরে মোসাহেবদের ভিড় বা জুড়ি গাড়ি চেপে কোন বাইজির মেহেফিলে যাওয়ার সেই মুহূর্তগুলো? এই শহরে যে কেউ চেনে না আমায়, এখানে যে কেউ কারোর জন্য নয়! আমার হাতে যে বেশি সময় নেই! কোথায় গেলে পাবো আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে এই রহস্যের জট খোলার সুযোগ?

    মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো আমার…..ঠিক এমন সময় চোখ চলে গেল রাস্তার ধারে একটি সুবিশাল ঐতিহ্যশালী ইমারতের দিকে, যার বুকে স্পষ্ট ইংরাজি অক্ষরে লেখা আছে “ন্যাশনাল লাইব্রেরি”! এখানে গেলে কি পাবো আমি সকল প্রশ্নের উত্তর? একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি! আমি উন্মাদের মত ছুটে গেলাম সেইদিকে। তারপর গ্রন্থাগারের গেটের দারোয়ানের কাছে বিস্তর অনুরোধ করে এবং কিঞ্চিৎ পয়সা খাইয়ে জোগাড় করলাম ভেতরে ঢোকার অনুমতি। কোনদিকে না তাকিয়ে আমি সোজা ঢুকে পড়লাম এই গ্রন্থাগারে একটি সুবৃহৎ কক্ষের ভেতর। ছিমছাম নিস্তব্ধ আবহাওয়ার মাঝে রাশি রাশি বইয়ের সারি চারিদিকে। তার মাঝেই জায়গা মতো বসে একাগ্রচিত্তে পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে আছেন বেশ কিছু পাঠক পাঠিকা! মনে পড়ে গেল, যে এই পড়াশোনাকেই আমি জীবনভর অবহেলা করে এসেছি, যার ফলে পর পর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে তবে কোনমতে বি.এ. পাশ করতে পেরেছি! নিজের প্রতি হীনম্মন্যতায় আমার চোখে জল এসে গেল!

    এমন সময় সেখানকার গ্রন্থাগারিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। তবে তার কিছু বলার আগেই আমি ঝড়ের গতিতে তাকে একের পর এক সব কথা খুলে বললাম, হাত জোড় করে অনুরোধ করলাম যে আমাকে ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলি এবং ওই প্রাচীন পাত্রটির সম্বন্ধে সকল অজানা তথ্য খুঁজে বার করার সুযোগ করে দিতে! আমার কথা তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হল কি না জানিনা, তবে ঠিক আমার পেছন থেকে কেউ যেন গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

    “এই শব্দগুলি ‘নাহুৎল’ (Nahuatl) ভাষায় বলা হয়েছে, আর ওই পাত্রকে বলা হল ‘কুয়াউহক্সিকালি’ (cuauhxicalli)!”

    আমি চমকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম একজন ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে, যিনি এই কথাগুলির বক্তা! এতক্ষন তিনি আমার খুব কাছেই বসেছিলেন, তাই তিনি শুনেছেন গ্রন্থাগারিককে বলা আমার সকল কথা! মৃদু হেসে বলে উঠলেন সেই ব্যক্তি, “নমস্কার, আমার নাম শ্রীযুক্ত সুধাময় পাত্র, আমি স্থানীয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।” এতক্ষণ পর যেন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পেলাম আমি! উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছিলো আমার বুক, মুখে যেন কিছুই বলতে পারলাম না আমি! শুধুই বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

    সুধাময় বাবু চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে পাশে থাকা বইয়ের সারির মধ্যে ঢুকে গেলেন, তারপর বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর বের করে আনলেন একটি বহুদিনের পুরোনো বই। “আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন এই বইয়ের ভেতর’, আমার সামনে বইটি রেখে বললেন তিনি! বইটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমি…….বড় বড় অক্ষরে তার প্রথম পাতায় নামকরণ করা রয়েছে: “The History of Aztec Civilization” (এজটেক সভ্যতার ইতিহাস)! আমি এলোমেলো ভাবে বইটার পাতা উল্টে দেখতে লাগলাম, কিন্তু এই স্বল্প সময়ে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। তাই নিজের মুখেই বলে চললেন সুধাময় বাবু, খুলতে লাগলো একের পর এক অজানা রহস্যের জট!

    “আন্দাজ বারশো থেকে পনেরোশো শতকের মাঝে মেক্সিকোর বুকে গড়ে উঠেছিল এই এজটেক সভ্যতা, যেখানে ব্যবহার করা হত এই নাহুৎল (Nahuatl) ভাষা। সারা বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে সেখানে চলতো কিছু বর্বরতম ভয়ঙ্কর প্রথা!…..এদের দ্বারা পুজিত নানাবিধ দেবতার মধ্যে একজন হলেন ‘তেজকাৎলিপোকা’ (Tezcatlipoca), যাকে সন্মান জানাতে পালন করা হত ‘টক্সকাৎল’ (Toxcatl) অনুষ্ঠান।”

    “এই অনুষ্ঠানে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করা শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হত সবচেয়ে সুদর্শন এক নবযুবককে। এক বছর ধরে তাকেই এই দেবতা রূপে পুজো করতো সাধারন মানুষ, তাকে মনে করা হত এই দেবতার মনুষ্যরূপ, বা ‘ইকসিপৎলা’ (Ixiptla). যেহেতু শাস্ত্রমতে এই দেবতার চারজন স্ত্রী আছেন, তাই অনুষ্ঠানটি হওয়ার এক মাস আগে এই যুবকটির সাথেও চারজন যুবতীকে বিবাহ দেওয়া হত! সে তাদের সাথে নিজের ইচ্ছামত সহবাস করার অধিকার অর্জন করতো।”

    “তারপরেই আসতো অনুষ্ঠানের ভয়াবহ দিনটি! সেই দিন এই যুবককে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে ওই দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত! তাকে একটি পাথরের স্তবকের ওপর হাত পা বেঁধে শুইয়ে দেওয়া হত, এবং ‘ৎলেনামাকাক’ (Tlenamacac) নামক গোত্রের এক পুরোহিত একটি ফ্লিন্ট-এর তৈরি চাকু দিয়ে তার বুক ছিরে হৃৎপিণ্ডটিকে কম্পমান অবস্থাতেই ছিঁড়ে বার করে এনে তা আগুনে আহুতি দিত ওই ‘কুয়াউহক্সিকালি’ (cuauhxicalli) নামক পাত্রে! তবে এই কাজ করার আগে, সেই পুরোহিতকেও নিজের শরীরের জিব, কান বা যৌনাঙ্গ কেটে রক্ত বা ‘চালচিউয়াৎল’ (Chalchiuatl) উপহার দিতে হত দেবতার উদ্দেশ্যে!”

    “তারা মনে করতো, যে হৃৎপিণ্ড বা ‘তোনা’ (Tona) হল সূর্যের তেজের একটি অংশ বা ইসৎলি (Istli), যা নরবলির মাধ্যমে সূর্যের কাছে ফেরত পাঠিয়ে পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধি করা হচ্ছে!…..এই বিভীষিকা এখানেই শেষ নয়! এরপর মৃতদেহটির মুণ্ডচ্ছেদ করে, তার থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তা পরিধান করে নৃত্য করতো পুরোহিতরা! কাটা মুণ্ডুটিকে মন্দিরের একটি skull rack-এ গেঁথে রাখা হত, এবং মৃতদেহের শরীরের বাকি অংশের মাংস ভক্ষণ করতো এই অনুস্থানের সকল অংশ-গ্রহনকারীরা! এর সাথেই, পরের বছরে আবার যাকে বলি দেওয়া হবে, তার নামও ঘোষণা করা হত এই অনুষ্ঠানে।” থামলেন সুধাময় বাবু।

    নিঃশ্বাস বন্ধ করে, আমি এতক্ষণ শুনছিলাম এই নিদারুণ বর্বরতার কথা। তিনি বলা শেষ করতেই আমি তাকে বলে উঠলাম সেই অদ্ভুত ছড়াটার কথা, যা অলোকেশ বাবু তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন। সেটা শুনেই তিনি মৃদু হেসে বলে উঠলেন,

    “এটার অর্থ বুঝতো গেলে এজটেকদের বিষয়ে আরো কয়েকটা কথা জানতে হবে! ‘তেজকাৎলিপোকা’-কে ‘উত্তর দিকের দেবতা বা ধূমায়িত আয়নাও’ (Smoking Mirror) বলা হয়। ‘তার সর্বদা সূর্যের তাপ চাই’ মানে হল, যে তার উদ্দেশ্যে সর্বদা নরবলি দিয়ে হৃৎপিন্ডগুলিকে আহুতি দিতে যেতে হবে।”

    “এজটেকদের পুরান অনুযায়ী ‘জাগুয়ার’ হল এই দেবতার বাহন, বা বলা যেতে পারে তার আর এক রূপ। এই বিশ্বের সৃষ্টির সময় এই দেবতার একটি পা খেয়ে নেয় সিপাৎলি নামক এক সামুদ্রিক দানব, তাই সে ‘একপায়ে’! এছাড়াও এরা মনে করে ‘স্বর্গের’ তেরোটি স্তর আছে, যার ‘দশম’ স্তরে বাস করেন এই দেবতা। আরো জানতে হবে, যে এজটেকদের ক্যালেন্ডারে কুড়ি দিন করে ‘আঠেরোটি’ মাস আছে, যার ‘পঞ্চম’ মাসে পালিত হত এই অনুষ্ঠানটি।”

    “এখানে ‘একপেয়ে জাগুয়ার’ বলতে কিন্তু ওই দেবতাকে বোঝানো হচ্ছে না, বোঝানো হচ্ছে সেই দেবতারূপী মানুষটিকে। শুধুমাত্র তাকেই যদি সেই দেবতার কাছে ‘দশম স্বর্গে’ পাঠানো যায়, অর্থাৎ বলি দেওয়া যায়, তাহলে ‘সমাপ্ত হবে অষ্টাদশীর পঞ্চম শাপ’ অথাৎ পরবর্তী ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আর অন্য কাউকে বলি দেওয়ার দরকার হবে না!”, যথার্থ ব্যাখ্যা দিলেন সুধাময় বাবু।

    ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। গ্রন্থাগার বন্ধ হওয়ার সময়। সুধাময় বাবুর এজটেকদের সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তার দিকে। তারপর হঠাৎ কি মনে হতে, আমি তাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে, দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলাম সেখান থেকে!

    (৮)

    মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে, মাঝ রাতের দিকে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর। হঠাৎ একটি তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। আওয়াজটা এসেছে বাড়ির সদর দরজার দিক থেকে! সে রাতের অন্ধকারের মধ্যে পড়ি মরি করে ছুটে গেল সেদিকে। তার আন্দাজ মতোই হাট করে খোলা রয়েছে দরজার দুই পাল্লা, ভাঙা অবস্থায় রয়েছে ভেতরের ছিটকিনিটা! অর্থাৎ এখনই কেউ এই বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে! সেই মুহূর্তে তার মনে হল একটি পুরুষের ছায়ামূর্তি যেন নিজের কাঁধের ওপরে কিছু নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে ওপরে চলে যাচ্ছে! আর তাকে চিনতে বাকি রইল না নন্দিনীর, সেও সেই ছায়ামূর্তির পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো, আর চিৎকার করে উঠলো, “অলোকেশ!…..দাঁড়াও…..দাঁড়াও, অলোকেশ!”

    মুখ বাঁধা অবস্থায় মাধুকে কাঁধে নিয়ে অলোকেশ ছুটে গিয়ে ঢুকে গেল চিলেকোঠার ঘরে! তারপর ভেতর থেকে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করতে গেলে, নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নন্দিনীও দরজায় ধাক্কা মেরে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো মাধুর শরীর, ওদিকে অলোকেশ ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো সেই ঘরের দরজা। এরপর সে একটি বিকট শব্দ করে কুৎসিত হাসি হেসে বলে উঠলো, “ঠিক আছে, ঘরের ভেতর ঢুকেই যখন পড়লে, তখন মাধুকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার দৃশ্যটা না হয় নিজের চোখেই দেখবে!”
    “তুমি…..তুমি মাধুকে মারতে চলেছো!….অলোকেশ, মাধু আমাদের একমাত্র সন্তান…..তুমি কি করে…..”, আতঙ্কিত গলায় বললো নন্দিনী।
    “কি করবো বলো, আর যে অন্য কাউকে জোগাড় করতে পারলাম না আজকে!”, দাঁত বের করে হাসতে লাগলো অলোকেশ।

    “কিন্তু…..কিন্তু তুমি এমন কেন করো, অলোকেশ? এইভাবে কোন মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করে কি লাভ হয় তোমার?” চিৎকার করে ওঠে নন্দিনী।
    “তাহলে তোমাকে সব কিছু খুলেই বলি আজ” এই বলে অলোকেশ নন্দিনীকে বলতে লাগলো এজটেকদের দ্বারা পালিত ‘টক্সকাৎল’ অনুষ্ঠানের সমস্ত বিবরণ! তারপর নন্দিনীর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, “তুমি নিশ্চয় ভাবছো, যে আমার সাথে কি সম্পর্ক এই প্রাচীন প্রথার, তাই তো? তাহলে শোনো……..”

    “হয়তো কোন পূর্বজন্মে আমিই ছিলাম তেমনই এক হতভাগ্য শত্রুপক্ষের সৈন্য যাকে এজটেকরা এই অনুষ্ঠানে বলি দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলো, প্রথা অনুসারে তার এক মাস আগে আমার সাথে বিবাহ দেওয়া হয় চারজন যুবতীকে। এমনই এক যুবতীর সাথে আমার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ট হয়ে উঠলো, সে আমাকে ভালোবেসে ফেললো। সে চাইতে লাগলো, যে আমাকে যেন তাকে হারাতে না হয়! পরিকল্পনা মাফিক, যে গোপনে লোক পাঠালো সেই পুরোহিতের বাড়িতে, যে দুই দিন পরেই আমাকে বলি দিতে চলেছে! তার দ্বারা জোগাড় করা এক প্রকার বিষাক্ত ব্যাঙ-এর বিষ তারা মাখিয়ে দিয়ে এলো সেই চাকুটার ফলার ওপর, যেটা দিয়ে সে আমার বুক চিরে হৃদপিন্ড বার করতে চলেছে!”

    “আগেই বলেছি, নরবলি দেওয়ার আগে, সেই পুরোহিতকে নিজের শরীরের কোন অংশ একই চাকু দিয়ে কেটে দেবতাকে নিজের রক্ত উপহার দিতে হয়! সেই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মাফিক, সেই বিষাক্ত চাকু দিয়েই সে তার জিব কেটে রক্ত উপহার দিতে যায় দেবতাকে! ব্যাস, তার রক্তে সেই বিষ মিশে গিয়ে, আমাকে বলি দেওয়ার আগেই, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। সেই অনুষ্ঠানের বাকি কর্মকর্তারা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তারা মনে করলেন, যে দেবতা আমাকে বলি হিসাবে নিতে অস্বীকার করলেন, তাই মৃত্যু হল পুরোহিতেরই! ব্যাস, মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম আমি!”

    “কিন্তু কাজ অসমাপ্ত রেখে সেই পুরোহিতের আত্মা শান্তি পেল না। সে আমাকে অভিশাপ দিলো, যে যতদিন না আমাকে হত্যা করে, আমার বুক চিরে হৃৎপিন্ডটি দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হচ্ছে, ততদিন আমাকেই বিভিন্ন মানুষকে একই ভাবে বলি দিয়ে তাদের হৃৎপিন্ডকে আহুতি দিতে হবে এই পাত্রে। ওই পুরোহিতের প্রেতাত্মাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমি, সে এখনও এই ঘরেই উপস্থিত!”

    “প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারতাম না আমি, এই দুঃস্বপ্নগুলোকে দেখেই চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যেত আমার, উচ্চারণ করতাম অসংলগ্ন কিছু এজটেক শব্দ! কিন্তু সেই কিউরিওর দোকানে এই পাত্রটি দেখে সব কথা মনে পড়ে গেল আমার। তাই সেটাকে কিনে আনলাম এই বাড়িতে! সেদিন থেকেই বুঝতে পারলাম যে এই পুরোহিতের প্রেতাত্মার রোষ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল, আমাকেই প্রতিনিয়ত একটি করে মানুষের হৃদয় আহুতি দিতে হবে এই পাত্রে। এই বিষয়টাই ধাঁধার আকারে লিখেছিলাম আমি ডায়েরির পাতায়।”

    নন্দিনী চিৎকার করে ছুটে এলো মেঝেতে পড়ে থাকা মধুর কাছে, তারপর সে বললো, “না অলোকেশ, না…….মাধুকে হত্যা করতে কিছুতেই দেবো না আমি তোমাকে…..কিছুতেই না!” নন্দিনী মাধুকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে, অলোকেশ ছুটে এসে এক ঝটকায় তাকে কেড়ে নিল নন্দিনীর কাছ থেকে। নন্দিনী তাকে বাধা দিয়ে চাইলে, সে সপাটে তার চুলের মুঠি ধরে তাকে নিক্ষেপ করলো ঘরে দেওয়ালের গায়ে। নন্দিনী গিয়ে আছড়ে পড়লো সেদিকে, দেওয়ালের গায়ে সশব্দে মাথা ঠুকে গিয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে সে ঢলে পড়লো ঘরের মেঝেতে!

    আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অলোকেশ নিজের পকেট থেকে বার করলো একটি বাঁকানো ছোরা! তারপর উদ্যত হল সেটা ছোট্ট মাধুর বুকে বসানোর জন্য!….কিন্তু যে মুহূর্তে তার সেই হাতটি মেঝের ওপর শোয়ানো মাধুর শরীরের ওপর নেমে আসতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ভেঙে, সেই ঘরে প্রবেশ করলাম আমি! মাধুর শরীর স্পর্শ করার আগেই আমি ছুটে গিয়ে ধরে ফেললাম ছোরাটির তীক্ষ্ণ ফলাটিকে! আমার হাত কেটে টিপ টিপ করে রক্ত ঝরতে লাগলো মাধুর বুকের ওপর!

    “কে রে তুই? ওহ, বুঝেছি! নন্দিনীর সেই নপুংসক নাগর, জমিদার শিলাদিত্য চৌধুরী বুঝি? অনেক শুনেছি তোর কথা!”, গর্জে উঠলো অলোকেশ।
    “মাধুকে ছেড়ে দিন, মিস্টার বাসু…..ভুলে যাবেন না সে আপনার সন্তান!”, প্রত্যুত্তরে বলে উঠলাম আমি। অলোকেশ অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। এক টানে ছোরাটিকে সরিয়ে নিলো আমার হাতের ভেতর থেকে! আমি আবার চিৎকার করে বলে উঠলাম, “আপনার যদি কাউকে হত্যা করতেই হয়, তাহলে আমি আছি তার জন্য…..আমাকে মেরে আমার হৃৎপিন্ড উৎসর্গ করুন আপনার দেবতার কাছে…..কিন্তু মাধুকে ছেড়ে দিন!…ওকে ছাড়া যে নন্দিনী বাঁচবে না!”
    “বাবা, এখনো এতো দরদ তোর নন্দিনী আর মাধুর প্রতি!….ঠিক আছে, যেমন তুই বলিস!”, একটি পৈশাচিক হাসি হেসে বলে উঠলো অলোকেশ, “নে, চিৎ হয়ে শুয়ে পর দেখি মেঝের ওপর…..আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই!”

    আলোকেশের কথামত মাধুর শরীরের পাশে শুয়ে পড়লাম আমি! ছোরাটি হাতে নিয়ে আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো সে! মনে মনে ভাবলাম, এমনিতেই তো অভিশপ্ত জীবন আমার, লাভ কি আর বেঁচে থেকে! ক্ষতি কি, যদি নিজের জীবন দিয়ে মাধুকে নন্দিনীর কোলে আবার ফিরিয়ে দিতে পারি! মৃত্যভয়ে চোখ বন্ধ করে নেবার নেওয়ার আগে স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে অলোকেশের পেছনে লোভাতুর মুখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে সেই অর্ধ-নগ্ন পুরুষের অবয়বটি! আবার কানে আসছে সেই দুর্বোধ্য শব্দগুলো! তার মানে এই হল সেই পুরোহিতের প্রেতাত্মা, সে অপেক্ষা করছে কখন আমার হৃদয়টিকে পাশে রাখা পাত্রে আহুতি দেবে অলোকেশ। আর আতঙ্ক সহ্য করতে না পেরে বন্ধ করে নিলাম দুই চোখ……অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ছোরাটির তীক্ষ্ণ ফলা এসে গেঁথে যাবে আমার পাঁজরের ভেতর!

    হঠাৎ অলোকেশের কণ্ঠের একটি তীব্র আর্তচিৎকার শুনে অবাক হয়ে চোখ খুললাম আমি! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, যে এই ঘরে ওই পুরোহিত বাদেও উপস্থিত হয়েছে আরেকজন অশরীরি, যে নিজের অপার্থিব হাত দিয়ে ধরে আছে অলোকেশের ছোরা ধরা হাতটিকে! সে আর কেউ নয়, আমার বাল্যবন্ধু, শশধর!……শশধরে অবয়ব এক ঝটকায় অলোকেশের দেহটিকে তুলে দিলো শূন্যে!…..আর তারপর তার হাতে ধরে থাকা ছোরাটাই সপাটে গেঁথে গেল অলোকেশের বুকের ভেতর!…ফিনকি দিয়ে ঝরে পড়লো তার রক্তধারা! মৃত্যুযন্ত্রনায় শেষ চিৎকার করে উঠলো সে! শূন্য থেকে নিচে পতিত হল তার রক্তাক্ত দেহ!

    ঠিক তখনই তার কাছে ছুটে এলো সেই অর্ধ-নগ্ন পুরোহিতের অবয়বটি, নিজের অপার্থিব হাতের হ্যাঁচকা টানে সে অলোকেশের হৃৎপিন্ডটি বার করে আনলো তার বুক চিরে!….কম্পমান হৃদয়টাকে সে ছুড়ে দিলো পাশে রাখা ওই পাত্রের ওপর! সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো পাথরের পাত্রটিতে! সেই আগুনের তাপে সশব্দে বিস্ফারির হল পাত্রটি, এক নিমেষের মধ্যে ঘরের মেঝেতে পড়ে রইল শুধু ছাই আর পাথরের টুকরো। তার সাথেই অদৃশ্য হয়ে গেল পুরোহিতের প্রেতাত্মা, পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পেল সে।

    ততক্ষণে নন্দিনীর জ্ঞান ফিরে গেছে। সে মেঝে থেকে মাধুকে তুলে নিয়ে, তার মুখের বাঁধন খুলে, তাকে কোলে নিয়ে ছুটে এলো আমার কাছে। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি, নন্দিনী ডুকরে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো আমায়। প্রসন্নতার স্বরে বলে উঠলো শশধরের আত্মা, “আমার নেওয়া পরীক্ষায় তুই পাশ করেছিস, শিলাদিত্য! নারী যে শুধু পুরুষদের ভোগ্যবস্তু নয়, শারীরিক সম্পর্ক না রেখেও যে কোন নারীকে নিজের জীবনের থেকেও ভালোবাসতে পারে কোন পুরুষ…এই কথাগুলিই তোকে দিয়ে প্রমাণ করাতে চাইছিলাম আমি। তুই জানিস, যে নন্দিনীর শরীরটাকে পেতে তুই সক্ষম নোস, তবুও তুই নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচতে চলেছিলিস মাধুকে, যে তোর নিজের সন্তানই নয়…..শুধুমাত্র নন্দিনীকে সুখে রাখার জন্য! সত্যিকারের ভালোবাসা এ ছাড়া আর কি!”

    “তাই আজ আমি তোকে মুক্ত করলাম আমার দেওয়া অভিশাপ থেকে। আজ থেকে আর সঙ্গমকালে নন্দিনীর মধ্যে আমাকে খুঁজে পাবি না তুই। শারীরিক এবং মানসিক, উভয় রূপেই নন্দিনী শুধু তোর! সুখে রাখিস নন্দিনীকে…..আর মাধুকে দিস নতুন পিতৃপরিচয়!….আজ থেকে আমি মুক্ত রে শিলাদিত্য, মুক্ত আমি!”, স্বস্তির সুরে বলে উঠলো শশধরের প্রেতাত্মা। তারপর আমার, নন্দিনী আর মাধুর চোখের সামনে ধীরে ধীরে সেই ঘরের বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল তার অবয়ব, আর কখনো ফিরে না আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে!

    সেই মুহূর্তে শুনতে পেলাম ভোরের প্রথম পাখির ডাক, সূর্যের হালকা নরম রশ্মি প্রবেশ করলো সেই ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে। নতুন একটা সকালের সাথেই শুরু হল আমার, নন্দিনীর আর মাধুর নতুন এক জীবন!

    (সমাপ্ত। গল্পটিতে উল্লিখিত এজটেক সভ্যতার সমস্ত তথ্য যথাসম্ভব সঠিক দেওয়ার চেষ্টা করেছি।)

  • গল্প

    পলাশগড়ের পিশাচ

    পলাশগড়ের পিশাচ
    -প্রলয় কুমার নাথ

    (১)
    কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি পড়া থেমেছে। তবে ধুলো ওড়ানো ঠান্ডা হাওয়ার দাপট এখনো আছে। চারিদিকে নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে, পলাশগড়ের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িটা তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন একটা দৈত্যপুরী, দাঁত বার করে গিলে খেতে আসছে। সাইকেল আরোহী যুবকটি একবার চেয়ে দেখলো সেদিক পানে। তার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠলো একটা বিষয় লক্ষ্য করে……এত বছর আগে পরিত্যক্ত বাড়িটার দোতলার একটি ঘরে আলো জ্বলছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল, যে কিছুদিন আগেই তো কোন এক শহুরে বাবু কিনে নিয়েছেন এই বাড়িটাকে! যাক বাবা, তাহলে আর ভয়ের কোন কারণ নেই, তিনিই হয়তো জ্বালিয়েছেন ওই আলো। জমিদার বাড়ির পাঁচিলের সামনে একটি সরু গলি দিয়ে যেতে যেতে, সাইকেলের ব্যালান্স সামলে, একবার নিজের সস্তা হাতঘড়িটা থেকে বহু কষ্টে সময়টা দেখে নিলো সেই যুবক। রাত এগারোটা দশ……নাহ, আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে, মনে মনে ভাবলো সে।

    জমিদার বাড়িটাকে পিছু ফেলে, সেই সরু গলি ছেড়ে এবার পাকা সড়কে ঢুকে পড়ল সাইকেল আরোহী যুবক। আবার একটা হালকা ভয়ের আমেজ যেন দানা বেঁধে উঠল তার বুকের ভেতর। এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। অবশ্য এই শীতের রাত্রে এই অজ পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এই রাস্তাটার দুই পাশে কোন মানুষের বসতি নেই, এখানকার জমি বেশ জঙ্গলাকীর্ণ। তার ভেতর থেকেই বোধহয় কোন রাত জাগা পাখি কর্কশ সুরে ডেকে উঠলো। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাকও আসছে কানে। যুবকটি আরো দ্রুত গতিতে সাইকেলের পেডাল ঘোরাতে শুরু করলো। হঠাৎ যেন তার মনে হল, সামনের একটা বড় অশ্বত্থ গাছের পেছন থেকে কেমন যেন একটা খসখস শব্দ আসছে…….ঠিক যেন শুকনো পাতার ওপর কারোর সন্তপর্ণে চলার শব্দ!……একটু পরেই সে নিশ্চিত হয়ে উঠল, যে কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে ওই গাছের পেছনে!……এই অন্ধকার রাতেও যেন একটা ছায়ামূর্তির অবয়ব স্পষ্ট চোখে পড়ল তার…..কিন্তু…..কিন্তু একি কোন মানুষের দেহাকৃতি? নাকি কোনো বন্য পশুর? কে ওটা? কে!

    তীব্র আতঙ্কের বশে, কম্পমান হাতে আর সাইকেলের ব্যালান্স রাখতে পারল না সেই যুবক। সাইকেল সমেত হোঁচট খেয়ে পড়ল সে রাস্তার ওপর। কোনো পশুর হিংস্র চাপা গর্জনের শব্দ এখন স্পষ্ট এলো তার কানে…..সে রুদ্ধশ্বাসে সাইকেলটাকে দূরে সরিয়ে ফেলে, রাস্তার ওপর কোন মতে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে লাগলো……নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পা চালাতে লাগলো…..জোরে, জোরে…..আরো জোরে……যতক্ষণ না সে বুঝতে পারলো, যে সেই পৈশাচিক ছায়ামূর্তিটা একটা হিংস্র গর্জন করে, পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার কাঁধের ওপর………

    (২)
    এই ঘটনার একদিন আগে:
    ————–
    সেদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, বিছানায় বসে নিজের কোলে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল অমলেন্দু। সে একটি নামী তেল এবং খনিজ পদার্থের কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট জিওলজিস্ট পদে কর্মরত। সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের এই পলাশগড় গ্রামের একটি পার্বত্য অঞ্চলে মাটির নিচে তেলের খোঁজ পেয়েছে তার সংস্থা, এবং এখানেই তারা গড়ে তুলতে চায় তাদের আরেকটি শাখা। আর যেদিন থেকে অমলেন্দুর ওপর সেই দায়িত্ব চাপানো হয়েছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে কলকাতার এই শহুরে বাবুটির পলাশগড়ের মত এই গন্ডগ্রামে পড়ে থাকার নরক যন্ত্রনা। সে জানে, যে কর্মজীবনের বেশ কয়েকটা বছর তাকে এখানেই কাটাতে হবে, তাই তার উচিত একটা উপযুক্ত বাসস্থান খোঁজার। এমনই সময় যখন নাম মাত্র দামে সে পেয়ে গেল এই গ্রামের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী জমিদার বাড়িটিকে, তখন আর সে পিছপা হয়নি।

    এখানে কোন দৈনিক খবরের কাগজের সংস্থান এখনো করে উঠতে পারেনি অমলেন্দু, তাই বাধ্য হয়েই প্রতিদিন সকালের সেই অভ্যাস মেটাতে সে চোখ রাখছে তার ল্যাপটপে বিভিন্ন খবরের সাইটগুলোতে। তবে ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, যে তার ডঙ্গলের নেটওয়ার্ক এখানে খুব খারাপ নয়! এই বাড়িতে সে বাদে আছে আর দুটি মাত্র প্রাণী: এক, বাড়ির বৃদ্ধ চাকর সুখেন এবং দ্বিতীয় জন হল অমলেন্দুর বোন মধুরিমা, যে কিছুদিন হল কলেজের পরীক্ষার পর, দাদার এই নতুন কেনা বাসস্থানে নিছক কৌতূহলী হয়েই বেড়াতে এসেছে। এছাড়াও প্রমীলা বলে একজন মাঝবয়সী বিধবা ভদ্রমহিলা এই বাড়িতে দু’বেলা এসে রান্নার কাজ করে দিয়ে যান।

    কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সুখন প্রবেশ করলো সেই ঘরে, আর তার পেছনে পেছনে সেখানে উপস্থিত হল একটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী সুন্দরী মেয়ে। জিন্স আর টপ পরিহিত চেহারায় বেশ আধুনিকতার ছাপ। সুখেন কিছু বলার আগেই, অমলেন্দু মেয়েটিকে দেখে বিন্দুমাত্র বিস্মিত না হয়ে বলে উঠল,
    – আপনি নিশ্চয় শ্রাবন্তী, রাইট?
    মেয়েটি ম্লান হেসে উত্তর দিলো,
    – হ্যাঁ……আর আপনি নিশ্চয় অমলেন্দু সেন, তাই তো?
    এরা দুজনে একে অপরকে আগে থেকেই চেনে, এই কথা বুঝে সুখেন আর বেশি কিছু না বলে সেই ঘর থেকে চলে গেল। অমলেন্দু মৃদু হেসে বলল,
    – আমি যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না…..আপনি সেদিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে কেনই বা হঠাৎ আমার কাছ থেকে এই বাড়ির ঠিকানা নিলেন…..আর কেনই বা এখানে আসতে চাইলেন…….এনিওয়়ে, আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন….বসুন….বসুন…..
    এমন সময় দাদার ঘর থেকে একজন অচেনা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে, মেয়েলি কৌতূহল সংবরণ না করতে পেরে সেখানে ছুটে এলো মধুরিমা।

    শ্রাবন্তীর সাথে মধুরিমার আলাপ পর্ব শেষ হলে, শ্রাবন্তী বলে উঠল,
    – অমলেন্দু বাবু, আমার মত একজন অচেনা মানুষকে এই জায়গার ঠিকানা এবং এখানে আসার অনুমতি দেওয়ার জন্য সবার প্রথমে আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ!
    এই বলে কিছুক্ষণ থামলো সে, মধুরিমা আর অমলেন্দু দু’জনেই তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইল। এবার বেশ উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠলো শ্রাবন্তী,
    – এবার যে কথাগুলো আমি আপনাদের বলতে চলেছি, সেগুলো বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার..তবে আমি কিন্তু এক বর্ণও মিথ্যা কথা বলতে চাইনা আপনাদের!
    এরপর সে মধুরিমার দিকে চেয়ে বলে উঠল,
    – আমিও তোমার মতো একজন সাধারণ মেয়ে, মধুরিমা…..কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে প্রতিনিয়ত কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, যার অর্থ আমি এখনো খুঁজে পাচ্ছি না!
    মধুরিমা কৌতূহলী হয়ে বলল,
    – কি ঘটনা ঘটে আপনার সাথে?
    শ্রাবন্তী অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল,
    – একটা স্বপ্ন!…..একটা অদ্ভুত স্বপ্ন রোজ রাতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার……বিশ্বাস করো….এই বাড়িটা…..এই বাড়িটারই ছবি আমি দেখতে পাই সেই স্বপ্নে! আর তখনই একটা ভয়……একটা অদ্ভুত মৃত্যুভয় যেন জাঁকিয়ে ওঠে আমার বুকের ওপর…..যেন এই বাড়ির সামনে থেকেই অন্ধকারের মধ্যে কেউ একটা ছুটে আসছে আমার দিকে!……শোনা যাচ্ছে তার হিংস্র গর্জন!……সে যেন…..যে যেন এই মুহূর্তের ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় আমার শরীরের ওপর!

    এবার অমলেন্দু বুদ্ধিদীপ্ত গলায় বলে উঠল,
    – আর তাই, যখন আমি ফেসবুকে নেহাৎ কৌতুকের জন্যই, আমার এই নতুন বাসস্থানের কয়েকটা ছবি আপলোড করি……সেগুলো কোনোভাবে আপনার চোখে পড়ে, তাই তো?
    শ্রাবন্তী বলে উঠল,
    – হ্যাঁ, আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, তবে আপনার প্রোফাইল অনুযায়ী, আপনি যে কলেজ থেকে ছ-বছর আগে পাস আউট, আমিও একবছর আগে সেখান থেকেই গ্রাজুয়েশন করেছি, তবে আমার বিষয় সাইকোলজি……তাই আপনার আর আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকা অস্বাভাবিক নয়। তেমনই কেউ একজন আপনার ওই এলবামটাকে শেয়ার করেছিল……ছবিগুলো দেখেই চমকে উঠি আমি! সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারি, যে এই তো আমার স্বপ্নে দেখা সেই বাড়ি! তখনই আপনার সাথে যোগাযোগ করে জানাই আমার এখানে আসার ইচ্ছার কথা!
    একটু থেমে বেশ অপ্রভিত স্বরে বলে উঠল শ্রাবন্তী,
    – আপনাদের কাছ থেকে ব্যস কয়েকদিনের সময় চেয়ে নিচ্ছি আমি…..এই ক’দিনের মধ্যেই এই বাড়িতে থেকে আমায় খুঁজে পেতে হবে আমার সেই দুঃস্বপ্নগুলির উত্তর!
    ওরা দুজনেই ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল শ্রাবন্তীর দিকে!

    (৩)
    বর্তমান সময়ে:
    ——–
    সেদিন সকালে তখনো মধুরিমার ঘুম ভাঙেনি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে, বাড়ির সামনে খোলা মাঠের সবুজ সতেজতাকে অনুভব করার জন্য, সেখানেই দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল অমলেন্দু আর শ্রাবন্তী। দূরের রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছিল প্রমীলা। হঠাৎ গ্রামের একটি অল্পবয়সী ছেলে ছুটে এলো তার কাছে…তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে কি যেন বলতে শুরু করলো তাকে। সেই কথা শোনা মাত্র একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো প্রমীলা!…..তারপর পেছন ফিরে উন্মাদের মত ছুটতে শুরু করলো সেই পথ ধরেই!……ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগায়, প্রমীলার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে, তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো অমলেন্দু আর শ্রাবন্তী!

    ওরা বাড়ির সামনের সেই সরু গলিটা ছাড়িয়ে সেই পাকা সড়কে প্রবেশ করলো। সেখানে রাস্তার এক ধারে তখনো পড়ে রয়েছে একটি দুমড়ে যাওয়া সাইকেল! সেটাকে পাশ কাটিয়ে, সেই গ্রাম্য ছেলেটির নির্দেশ অনুসারে প্রমীলা ঢুকে পড়লো পাশের জঙ্গলের ভেতর। অমলেন্দু আর শ্রাবন্তীও তাদের অনুসরণ করলো। একটু ভেতরে যেতেই দেখা গেল বেশ কিছু গ্রামবাসীর একটা জটলা। সেই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়েই, একবার চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো প্রমীলা! অমলেন্দু আর শ্রাবন্তীও ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনে….. তারপর সেখানকার দৃশ্য দেখে একটা তীব্র চিৎকার করে শ্রাবন্তী অমলেন্দুকে জড়িয়ে ধরে, তার বুকে নিজের চোখ ঢাকলো! অমলেন্দুরও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আতঙ্কে……..ওদের সামনেই পড়ে আছে এক যুবকের ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ! তার শরীরের বেশিরভাগ অংশই যেন কেউ প্রবল আক্রোশে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে! বেরিয়ে পড়েছে দেহের ভেতরে থাকা হাড় কঙ্কাল! জমাট বাধা রক্তে ভেসে যাচ্ছে সেখানকার মাটি!

    এমন সময় পাশ থেকে একজন বয়স্ক গ্রামবাসী কপাল চাপড়ে বলে উঠল,
    – হায় ঈশ্বর……হতভাগীর ছেলেটাই ছিলো তার একমাত্র সম্বল……আর তারও কিনা আজ এই অবস্থা হল!
    অমলেন্দু কোন মতে বলে উঠল,
    – এ…এ….এটা প্রমীলাদির ছেলে!
    সেই বয়স্ক মানুষটি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল,
    – হ্যাঁ বাবু…..হ্যাঁ……গতকাল ও পাশের গাঁয়ে গিয়েছিল, কোন এক বাড়িতে পুরোহিতের কাজ করতে…..ওরা বামুন কিনা……তারপর আর রাত্রে বাড়ি ফেরেনি বাবু…ওই হতভাগীর ঘরের পাশেই আমার ঘর……সারারাত ধরে ছেলের চিন্তায় ঘুমোতে পারেনি সে…….সকালে বলল, যে খুড়ো, আমি কাজে যাচ্ছি…..ছেলেটা হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়েছে, তাই কালকে বাড়ি ফিরতে পারেনি…..আজকে ঠিক ফিরে আসবে…….
    কথা শেষ করতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সেই লোকটি। পরক্ষণেই তার মুখে ফুটে উঠলো ঘোর আতঙ্কের চাপ। সে বিস্ফারিত চোখে বলল,
    – সেই একশো বছর আগেকার নরখাদক আবার জেগে উঠেছে, বাবু……আবার জেগে উঠেছে সে!
    এতক্ষনে শ্রাবন্তী নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
    – কে? কে সেই নরখাদক? কার কথা বলছেন আপনি?
    কম্পিত গলায় সেই লোকটি বলে উঠল,
    – প….প…..পিশাচ, দিদিমণি, পিশাচ!……প…প….পলাশগড়ের পিশাচ!

    (৪)
    কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় থানা থেকে লোকজন এসে ঘটনাস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে প্রমিলার ছেলের দেহাবশেষ। এখনো অবধি এই হত্যার সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছে পুলিশ। তারাও বেশ ধন্দে পড়ে গেছে এই নৃশংস ঘটনার সম্মুখীন হয়ে, কারণ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, যে এটা কোন মানুষের কাজ নয়। ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছে নরমাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে! এদিকে এই অঞ্চলে তো বাঘ ভালুকের উপস্থিতিও কেউ উপলব্ধি করেনি কোনোদিন! তাহলে কে করলো এই কাজ? প্রমীলার জ্ঞান ফিরলেও, সে এখন চরম মানসিক শকের মধ্যে আছে। পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে সে, এক ফোঁটা জলও বেরোয়নি তার চোখ থেকে! স্বভাবতই, এক অজানা বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পলাশগড় গ্রামে!

    অমলেন্দুর নতুন বাসস্থানে বসেই তাদের কথা হচ্ছিল এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষজনের সাথে। তাদের মধ্যে আছেন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান, রঘুপতি বাবু। এমন সময় সেই ঘরে প্রবেশ করলো এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ শ্বেতাঙ্গ যুবক। বলিষ্ঠ চেহারার গঠন, কানের নীচ অবধি রাখা খয়েরি চুলের জুলফি এবং নীলাভ চোখের মণি বিশিষ্ট এই বিদেশী যুবক যে কোন নারীর মন জয় করে নিতে পারে এক নিমেষে। শ্রাবন্তী লক্ষ্য করলো, যে এই যুবককে দেখা মাত্র চাপা লজ্জা আর খুশিতে নিচু হয়ে গেল মধুরিমার নজর, আনন্দে রক্তাভ হয়ে উঠলো তার ফর্সা গাল! তবে যুবকটি যে প্রমীলার ছেলের এই নিদারুণ পরিণতির কথা শুনেছে, তা তার উদ্বিগ্ন মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে! তাকে দেখেই অমলেন্দু ইংরাজিতে বলে উঠলো,
    – আরে স্যামুয়েল যে…..এসো ভাই এসো…….
    এই বলে স্যামুয়েলকে বসতে দিয়ে, অমলেন্দু শ্রাবন্তীকে বলে উঠল,
    – ও হল স্যামুয়েল উইলসন……আমরা হামেশায় শুনে থাকি যে কেউ উচ্চশিক্ষা বা চাকরিসূত্রে বিদেশে গেছে, কিন্তু বিপরীতটা খুব কমই দেখি, তাই না? স্যামুয়েল হল তেমন একজন, যে ব্রিটেন-এ জন্মেও ভারতের প্রতি আকৃষ্ট……ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেছে কয়েকদিন আগেই……এই বাড়ি সম্পর্কিত কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কয়েকদিন আগে এখানে আসে ও…..আর সেদিন থেকেই আমার আর বোনের সাথে ওর আলাপ….যদিও বা এই বাড়ি বা জমিদার বংশ সম্বন্ধিত কোন তথ্যই আমি ওকে দিতে পারিনি…..

    শ্রাবন্তী কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্যামুয়েলের দিকে, কিন্তু পরমূর্তেই গত রাতে ঘটা সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কথা ভেবে, সে সেই বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল,
    – আপনি তখন বললেন, যে একশো বছর আগেকার নরখাদক জেগে উঠেছে! এই কথার মানে কি?
    সেই ভদ্রলোকের হয়েই যেন বলে উঠলেন রঘুপতি বাবু,
    – এই গ্রামে আমার সাত পুরুষের বাস, দিদিমণি…..তাই আমিই বলছি শুনুন! সেটা বোধহয় ১৯২০ সাল হবে……আমার ঠাকুরদার বয়স তখন পনেরো কি ষোলো বছর। তার মুখেই শুনেছি সেই কথা……সেই সময়ও ঠিক একই ভাবে এই গ্রামের বেশ কিছু গ্রামবাসী শিকার হয় এই অজানা নরখাদকের! এই গ্রামেরই বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া যেতে থাকে সেই সব অসহায় মানুষগুলির ক্ষতবিক্ষত আধ খাওয়া মৃতদেহগুলো!
    এই কথা শুনে যেন একটা চাপা আতঙ্কের স্রোত বয়ে বয়ে গেল শ্রাবন্তীর শিরদাঁড়া দিয়ে! রঘুপতিবাবু বলেই চললেন,
    – টানা দুই – তিন বছর ধরে চলেছিলো এই হত্যালীলা…. তবে একটা বিষয় সকলেই লক্ষ্য করছিল, যে প্রায় সব কটা মানুষকেই এই ভাবে খুন করা হয় গতকালের মতই শীত কালের রাত্রিগুলোতে! অন্যান্য সময়ে কিন্তু কখনই কোন মানুষের প্রতি হানা দেয়নি এই শয়তান!
    অমলেন্দু বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
    – এই শয়তান বলতে আপনি ঠিক কার কথা বলতে চাইছেন রঘুপতিবাবু?

    কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন রঘুপতিবাবু,
    – পিশাচ, বাবু……পিশাচ! সেদিনের মত আজও আবার এই গ্রামের প্রতি পিশাচের নজর লেগেছে! গ্রামের একজন দু’জন নাকি অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলো তার ছায়া……সে না মানুষ, না কোন বন্য পশু!……তবে অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলজ্বল করে ওঠে তার দুই চোখে জমে থাকা নরমাংশের প্রতি লোভ!

    কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর স্যামুয়েল ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে উঠল,
    – আপনি যে সময়টার কথা বলছেন, সেটা আপনাদের দেশের স্বাধীনতার বেশ আগেকার কথা। সেই সময় নিশ্চয় এই গ্রাম, এই বাড়িরই জমিদার বংশের শাসনের আওতায় ছিল……তারা কি কোন চেষ্টা করেছিলেন এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের হাত থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে?
    রঘুপতি বাবু বলে উঠলেন,
    – না, বাবু……আসলে যে সময় এই ঘটনাগুলি ঘটতে শুরু করে, সেই সময় থেকেই এই জমিদার পরিবারের ওপর নেমে আসে পতনের ঝড়……এই পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যেই ক্রমাগত দ্বন্দ্বে বিদ্ধস্ত হয়ে উঠেছিল সেই সময়, তাই আর গ্রামবাসীদের বাঁচানোর চেষ্টা করার কোনো ফুরসৎ পায়নি তারা!
    শ্রাবন্তী বেশ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,
    – আমি জানতে চাই এই বংশের ইতিহাসের কথা….. আপনি যা জানেন, তা দয়া করে বলুন!
    কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলতে লাগলেন রঘুপতি বাবু,
    – সেই সময় এই বংশের প্রধান পুরুষ ছিলেন জমিদার চন্দ্রমোহন রায়। তার ছিল দুই ছেলে: রাজেন্দ্র মোহন এবং মৃগাঙ্ক মোহন। ছোট ছেলের জন্মের পরই চন্দ্রমোহনের পত্নী বিয়োগ হয়। রাজেন্দ্র ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, তাকে আমেরিকার রুশো শহরে ডাক্তারি পড়তে পাঠান রাজেন্দ্র মোহন। ডাক্তারি পাশ করে তিনি এই দেশে ফিরে আসেন আমেরিকার এক মেমসাহেবকে বিয়ে করে। সেই বিদেশিনী মহিলার নাম ছিল এমিলি। নিতান্ত অখুশি হয়েও তাকে পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নেন চন্দ্রমোহন।

    কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি,
    – কিন্তু সমস্যা শুরু হয় চন্দ্রমোহনের মৃত্যুর পর, মৃগাঙ্ককে নিয়ে……ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় তিনি ছিলেন তার দাদার বিপরীত, এবং এই দুই ভাইয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক কোনোদিনই ছিল না। সেই সময় রাজেন্দ্রই ছিলেন দন্ডমুন্ডের কর্তা……আর এমনই একদিন পাশের গ্রামের এক আদিবাসী মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসাবে এই বাড়িতে নিয়ে প্রবেশ করেন মৃগাঙ্ক! সেই মেয়েটির নাম ছিল রমাবতী। এই সময় রাজেন্দ্র যেন ভুলে যান নিজের প্রেম কাহিনীর কথা……তিনি সম্পূর্ণ রূপে রমাবতীকে এই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন! দুই ভাইয়ের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠে বিবাদ……এবং তা ঘোরতর শত্রুতার রূপ নেয়, যখন এক বৃষ্টি মুখরিত দিনে, সকালবেলায় গ্রামের পুকুরে ভেসে ওঠে রমাবতীর লাশ! নিজের প্রেমিকাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে মৃগাঙ্ক, তার মনে স্থির বিশ্বাস জেগে ওঠে, যে রমাবতীর মৃত্যুর পেছনে রাজেন্দ্রই দায়ী!

    শ্রাবন্তী অধৈর্য হয়ে বলল,
    – তারপর? তারপর কি হল মৃগাঙ্কর?
    আবার নিজের মস্তিষ্কে জোর খাটিয়ে বলে উঠলেন রঘুপতিবাবু,
    – তারপর হঠাৎ একটি রাতের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান মৃগাঙ্ক! তার কি হয়েছিল তা কেউ জানে না……তবে লোকমুখে ফেরে, যে তাকে নাকি, গ্রামের জঙ্গলের শেষে নদীর ওপারে, কোন এক বৈষ্ণবদের আখড়ায় দেখা গিয়েছিল একবার! যদিও বা এই বিষয়ে পরে আর তেমন কোন খোঁজ খবর নেয়নি কেউ……এরপর বোঝা যায়, যে শরীরে জমিদারি রক্ত বইলেও, বাবা হতে অপারগ রাজেন্দ্র! সেই শোকে দুঃখেই বোধহয় এক রাত্রে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। এরপর এমিলিও এই সব কিছু ত্যাগ করে আমেরিকায় ফিরে যান। এখানেই শেষ হয়ে যায় এই বংশ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, যে এই পরিবারের সাথে ওই অজানা নরখাদকের কোন সম্পর্কই নেই……..

    এবার সেখানে উপস্থিত সকলকে অবাক করে চিৎকার করে বলে ওঠে শ্রাবন্তী,
    – সম্পর্ক আছে…..সম্পর্ক আছে, রঘুপতিবাবু…… কারণ এই বাড়ির সামনে থেকে ছুটে আসা সেই নরপিশাচটারই আবছা প্রতিচ্ছবি আমি এতদিন ধরে রোজ রাত্রে ঘুমের ঘোরে দেখে এসেছি!……তাই যদি আমার স্বপ্নগুলোর কোন অর্থ থেকে থাকে, তাহলে এই বাড়ির সাথে নির্ঘাত কোন সম্বন্ধ আছে ওই বিভীষিকার…..আর এটাই আমাকে খুঁজে বার করতে হবে…..হবেই!
    এই কথা শুনে যেন সকলের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে যায়!

    (৫)
    সেদিনও নিস্তব্ধ শীতের রাত্রের ঠান্ডা আমেজে ঘুমিয়ে ছিলো গোটা পলাশগড় গ্রাম। আজ আমাবস্যা…….যেন কোনো অশরীরি আতঙ্কের কালো ছায়া ছেয়ে রয়েছে গোটা গ্রামের ওপর। গত রাত্রে ঘটা সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গ্রামের কোন মানুষ আর ভুলে করেও বাড়ির বাইরে নেই এই সময়। গ্রামের এক প্রান্তে বেশ কয়েক ঘর দরিদ্র কৃষকদের বাস। এখনো এই মানুষগুলো ঘরের সাথে শৌচাগার গড়ে তুলতে পারেনি। এমনই একটি কুঁড়ে ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে ছিল মা, বাবা এবং তাদের বারো বছরের ছোট্ট মেয়ে। হঠাৎ কানে বাপের গলার আওয়াজ আসতেই ঘুম ভেঙে গেল মেয়েটির! আবারও সে স্পষ্ট শুনতে পেল, যে বাবা যেন তাকে বাড়ির বাইরে থেকে ডেকে বলছে,
    – মা…..মা রে……একবারটি বাইরে এসে আমারে দেখ, মা……আহ, বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে পায়ে……তোর বাপেরে লতায় কেটেছে, মা…..
    ধক করে উঠল মেয়েটির বুক……সত্যিই তো, তার বাপ তো বিছানায় নেই! তার মানে কি সে রোজকার মত প্রকৃতির ডাকে ঘরের বাইরে বেড়িয়েছে আর সেখানেই কি তাকে সাপে কেটেছে! আর অপেক্ষা না করে, ঘুমন্ত মাকে না ডেকেই, ভেজানো দরজা ঠেলে বাবাকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে যায় মেয়েটি………..কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ফিরে এসে, বিছানায় মেয়েকে না দেখে অবাক হয়ে যায় তার বাবা! সে সত্যিই ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল শৌচকর্ম করতে। কিন্তু এত রাত্রে তার মেয়ে গেল কোথায়! সেও কি একই কাজ করতে বাইরে গেছে?

    হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে, বাইরে গিয়ে এক দুবার মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলো সে, তার স্ত্রীও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে এতক্ষনে। বাড়ির পাশেই যে জঙ্গলাকীর্ন স্থানে তারা শৌচকর্ম করে, সেখানে গিয়েও অনেক্ষন খুঁজলো তারা মেয়েটিকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে……..ঠিক এমন সময় মেয়ের গলার একটি তীব্র আর্তচিৎকার যেন খান খান করে ভেঙে দিল সেই রাতের নিস্তব্ধতা! কম্পিত বক্ষে স্বামী স্ত্রী দুজনে ছুটে গেল তাদের মেয়ের কন্ঠস্বর অনুসরণ করে…….আরেকবার! আরেকবার শোনা গেল তার চিৎকার!……..আরো জোরে……আরো জোরে পা চালাতে লাগলো ওরা দুজন……কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল গ্রামের পূবদিকের একটি আধবোজা পুকুরের কাছে!…..কিন্তু সেখানকার দৃশ্য দেখে তাদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল!

    তাদের মেয়ের রক্তাক্ত নিথর দেহের টুঁটি তখনো কামড়ে ধরে আছে একটা অদ্ভুত চেহারার জীব! রাতের অন্ধকারের মধ্যে তার অবয়বের অস্পষ্ট আবছায়া দেখে তাকে না তো কোন মানুষ মনে হচ্ছে, না কোনো পশু! শুধু আগুনের গোলার মত জ্বল জ্বল করছে তার হিংস্র চোখ দুটি! এই দৃশ্য দেখে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় লোকটির স্ত্রী!……..এবার সেই ছায়ামূর্তি যেন মেয়েটিকে ছেড়ে তাকিয়ে দেখল, অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা, আতঙ্কে আরষ্ঠ তার বাপের প্রতি!…….একটা চাপা হিংস্র গর্জন করে উঠল সে!…..কিন্তু লোকটির দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে একবার যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেই বিভীষিকা…….তার কারণ, লোকটির হাতে ধরে থাকা হ্যারিকেনের জ্বলন্ত অগ্নি শিখা! হঠাৎ পেছন ফিরে লাফ দিয়ে, দূরে বনঝোপের মধ্যে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল সে! শুধু পরে রইল একটি বাচ্চা মেয়ের আধ খাওয়া মৃতদেহ, তার অজ্ঞান মা, এবং বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়া তার বাপ!

    (৬)
    পরদিন সকালে, গ্রামের সকলের কাছেই ছড়িয়ে পড়ল সেই অজানা আততায়ীর হাতে তার দ্বিতীয় শিকারের এই মর্মান্তিক পরিণতির কথা! মেয়েটির বাবার দেখা সেই অদ্ভুত প্রাণীটির বর্ণনা শুনে, নানা লোক তাকে নানা ধরণের বন্য পশুর তকমা লাগাতে শুরু করেছে। আগেরবারের মত, এই দ্বিতীয় ঘটনাটার ক্ষেত্রেও অক্ষমতার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। আতঙ্কের বশে, এই গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র বসবাস করার কথাও ভাবছে অনেক গ্রামবাসী। সেদিনকার মত, আজকেও বেশ উদ্বিগ্ন চিত্তে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে স্যামুয়েল। এমন সময়, হঠাৎ কোথা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো এই বাড়ির চাকর সুখেন। সে অমলেন্দু, শ্রাবন্তীকে, স্যামুয়েল আর মধুরিমাকে বলে উঠল,
    – দাদাবাবুরা!…..দিদিমণিরা!……এই দু’টো মানুষের এমন অবস্থায় জন্য যে দায়ী, তাকে ধরে ফেলেছে গ্রামের লোক……তাকে দেখতে হলে চলুন আমার সাথে!
    ওরা বেশ অবাক হয়ে, আর কোন কথা না বাড়িয়ে, ছুটে গেল সুখেনের নির্দেশানুসারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সেই গ্রামের শেষে শ্মশানে এসে হাজির হল। কিছুটা ভেতরে ঢুকতেই, ওরা অবাক হয়ে দেখলো, যে একজন জটা-জুটোধারী লাল পোশাক পড়া তান্ত্রিক গোছের বৃদ্ধ লোককে খুব নির্মম ভাবে প্রহার করার পর, একটি বটগাছের গুড়ির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে! কোনো মতে অর্ধ-চেতন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় বাঁধন থেকে ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে! তার চারিধারে গ্রামের লোকের ভিড়…….তার মধ্যে রয়েছেন রঘুপতিবাবুও। অমলেন্দুদের দেখে তিনি উৎসাহের সাথে বলে উঠলেন,
    – আসুন আপনারা…..আসুন…..দেখুন একবার এইসব কার কারসাজি…….দেখুন একবার!

    শ্রাবন্তী অবাক হয়ে বলে উঠলো,
    – অপনারা কি করে বুঝলেন, যে এই হত্যাগুলির পেছনে আছে এই তান্ত্রিক?
    রঘুপতি বাবু জোরের সাথে বলে উঠলেন,
    – এই শয়তানটা তন্ত্র সাধনা করে…..পিশাচ নামায় সে প্রতিদিন রাত্রে! ও যবে থেকে এই গ্রামে এসেছে, তবে থেকেই শুরু হয়েছে ওই অদ্ভুত জীবটির আনাগোনা!… নিঃসন্দেহে এই সবের পেছনে ওরই হাত আছে!…..তাই আমরা সব গ্রামের মানুষরা ঠিক করেছি, যে ওকে এই গ্রাম ছাড়া করবো…..পুলিশের হাতে তুলে দেবো ওকে…
    এই কথা শোনার সাথে সাথে, গ্রামের বেশ কয়েকজন মাতব্বর গোছের যুবক আবার চড় থাপ্পড় লাগাতে শুরু করলো সেই গাছে বাঁধা লোকটির গায়ে। সেই মুহূর্তে শ্রাবন্তী ছুটে গেল তার কাছে, আর সেই লোকটির গায়ে আর কারোর হাত তুলতে বাধা দিয়ে, সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
    – পাগল হয়ে গেছেন আপনারা!…..একটা বয়স্ক মানুষের ওপর ভিত্তিহীন সন্দেহ করে এই ভাবে অন্যায় অত্যাচার করছেন!…..কি প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে, যে এইসব ওর কারসাজি? এখনো অবধি এটাই বোঝা গেল না যে ওটা কি ধরণের প্রাণী…..আর এরই মধ্যে আপনারা খুঁজে পেয়ে গেলেন তার সৃষ্টিকর্তাকে! ব্যাপারটা কি এতোই সহজ? আপনাদের কি মনে হয়, পুলিশ এসে আপনাদের কথা বিশ্বাস করবে? কখনই না…..তারা আপনাদেরই একটি অসহায় মানুষকে অত্যাচার করার জন্য গ্রেফতার করবে!…..তাই, ভালো চান তো এখনই ওকে ছেড়ে দিন…..ছেড়ে দিন ওকে!

    সকল গ্রামবাসীই অবাক হয়ে গেল শ্রাবন্তীর এই আচরণে! তবে তারা শহরের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মান্য করেই চলে, তাই খুব বেশি বিবাদে না গিয়ে, লোকটির বাঁধন খুলে তাকে ছেড়ে দিলো সবাই। গাছের গা ঘেষে অসহায় ভাবে মাটিতে বসে পড়লো লোকটি। তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে উঠল,
    – এই কথা ঠিক…..এই কথা ঠিক, যে আমি পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক……তবে আমি এই শক্তিকে কাজে লাগাই জনগণের মঙ্গল কামনায়……কিন্তু…..কিন্তু রোজ রাতে যে নরমাংস লোভী জীবটা দেখা দিচ্ছে…..সে কোন সাধারণ জীব নয়……তার শক্তি আমার থেকে আরো বেশি……সে আমার ক্ষমতার বাইরে…….তার সম্বন্ধে আমি সব কথা জানি……সব জানি আমি!…..সে তোমাদের মধ্যেই থাকে……তোমাদের আশে পাশেই ঘুরে বেড়ায় সব সময়, কিন্তু তোমরা তাকে চিনতে পারো না!…..তার ক্ষিদে কখনো শেষ হবে না…..এই গ্রামকে ধ্বংস করে দেবে সে…..ধ্বংস করে দেবে!
    এই কথা শুনে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে উঠলো সকলে। রঘুপতিবাবু বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলেন,
    – কে সেই জীব? বলো আমাদের…..কার কথা বলতে চাইছো তুমি!
    প্রহারের বেদনায় জর্জরিত কণ্ঠে লোকটি বলে উঠলো,
    – বলবো না…..কিছুতেই বলবো না…..মরে গেলেও না! তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করেছো…..আমাকে মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছো…..তার শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাদের! তোমাদের একে একে সকলকে মরতে হবে ওই জীবের হাতে…..সকলকে……হাহাহাহা!

    (৭)
    না, কোনো ভাবেই আর কোন কথা বার করা যায়নি ওই তান্ত্রিকের মুখ থেকে। ওরা সকলেই যে যার বাড়ির ফিরতি পথ ধরেছিল। লোকটি শ্মশানের সেই বটগাছের নিচেই চুপ করে বসে হাঁপাতে লাগলো। জমিদার বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগে অমলেন্দুদের কাছে হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো গ্রামের এক তরুণ যুবক। তাকে দেখে অমলেন্দু বলে উঠলো,
    – শ্রাবন্তীর কথামত, তোমাকে যে নদীর ওপারে পাশের গ্রামে সেই বৈষ্ণবদের আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম, সেখানে গিয়েছিলে তো তুমি?
    ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,
    – হ্যাঁ বাবু, হ্যাঁ……সেই কথা বলতেই তো এলাম…….প্রায় একশো বছর আগেকার ঘটনা, তাও যতটা পেরেছি খোঁজ খবর নিয়েই এসেছি!
    অমলেন্দু নিজের ওয়ালেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোট বার করে ছেলেটির হাতে দিয়ে, বলে উঠলো,
    – বলো কি জানতে পারলে সেখান থেকে…….

    ছেলেটি টাকাটা পেয়ে বেশ খুশির সুরে বলে উঠলো,
    – দেখুন বাবু, ওই আশ্রমের সবচেয়ে বড় গোঁসাই-এর সাথেই কথা বলে এসেছি আমি! তার বক্তব্য, যে সেই সময়, একদিন সকালে নদীর পারে একজন সুদর্শন যুবকের অচৈতন্য দেহ দেখতে পায় আশ্রমের কিছু লোক। সম্ভবত ইনিই ছিলেন এই জমিদার বংশের মৃগাঙ্ক মোহন! তারা তাকে আশ্রমে নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলে, কিন্তু তার মাথায় লাগা একটি আঘাতের জন্য পূর্বেকার সমস্ত স্মৃতি ভুলে যান তিনি!…. .কিন্তু….. কিন্তু
    শ্রাবন্তী কৌতূহলী হয়ে বলে ওঠে,
    – কিন্তু কি?
    ছেলেটি বলেই চলে,
    – কিন্তু এরপর মৃগাঙ্ক মোহনের সম্পর্ক তৈরি হয় সেখানকার এক সুন্দরী বৈষ্ণবীর সাথে! মেয়েটি গর্ভে তার সন্তান আসে!…..এর কিছুদিনের মধ্যেই কোন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মৃগাঙ্ক মোহন!…..এদিকে গর্ভবতী মেয়েটির সাময়িক অসহায়ত্বের কথা ভেবে, সেই আশ্রমে তাকে সন্তানের জন্ম দেওয়া অবধি থাকতে দেওয়া হয়। একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় সে। কিন্তু তারপরই অবৈধ সন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে তাকে আশ্রম থেকে বহিস্কার করা হয়! ছেলেকে নিয়ে চলে যায় সে সেখান থেকে…..তারপর সেই মা ছেলের যে কি হয়েছিল, তা আর জানা নেই কারোর!
    অমলেন্দু লক্ষ্য করলো, যে এই কথা শুনে শক্ত হয়ে এলো শ্রাবন্তীর চোয়াল, তার কপালের চামড়ায় দেখা দিলো চিন্তার রেখা!

    (৮)
    আবার আরেকটি শীতের রাত তার বিভীষিকাময় কালো চাদর বিস্তার করেছে গোটা গ্রামের ওপর। আবার সকলকে গুনতে হচ্ছে আতঙ্কের প্রহর। না জানি, এবার গ্রামের কার পালা! কার শরীরের রক্ত মাংস মেটাবে এই নরপিশাচটার জঠরের জ্বালা! নিস্তব্ধ গোটা গ্রামে শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে শেয়াল কুকুরের ভীত আর্তনাদ! সেই রাত্রে মধুরিমার ঘুম আসছিলো না। তার শুধু মনে পড়ছিল স্যামুয়েলের কথা! কিছুক্ষণ আগে যদিও বা ফোনে অনেক কথাই হয়েছে তার সাথে, তবুও যেন তাকে নিজের আরো কাছে পাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল মধুরিমার! বিছানাটা যেন বড্ড খালি খালি লাগছে তার স্যামুয়েলকে ছাড়া……আজ যদি সে এই বিছানায় তার পাশেই থাকতো! ভাবতেই কামোত্তোজনায় হৃদ-স্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পেল তার!……ঠিক এমন সময় হঠাৎ বাড়ির সদর দরজা খোলার একটা হালকা আওয়াজ কানে আসতেই, যেন চিন্তার ঘোর কেটে গেল মধুরিমার! সে কৌতূহলী হয়ে সন্তপর্ণে দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসে, চোখ রাখল বাড়ির বাইরের রাস্তার দিকে……সেখান দিয়ে চুপি চুপি হেঁটে যাচ্ছে এক ছায়ামূর্তি! সেই সরু গলিটা পার করে, যে রাস্তাটা ধরলো সে……মধুরিমা খুব ভালো করেই জানে, যে সেটা হল শ্মশানে যাওয়ার পথ!

    গাঁজার নেশাটা যেন একটু বেশিই করে ফেলেছে, এই কথাই মনে হচ্ছিল শ্মশানের সেই বট গাছের নিচে বসে থাকা তান্ত্রিকের। মাথাটা বেশ জোরেই ঘুরছে এখনো……এমনিতেই শীতের রাত্রের ঘুটঘুটে অন্ধকার সারা শ্মশানময়, তার ওপর আবার চোখের দৃষ্টিশক্তিটাও ঠিক মত কাজ করছে না নেশার ঘোরে!……কিন্তু সেই আবছা দৃষ্টি দিয়েও সে যেন দেখতে পেল, যে দুটো জ্বলন্ত আলোর বিন্দু যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে সামনের ঝোঁপের আড়াল থেকে!…….চমকে উঠে দুই চোখ কচলে নিলো সে…..নাহ, এখন আরো স্পষ্ট আর বড় লাগছে ওই অলোক বিন্দু দুটিকে! এমন সময় সেই সুপরিচিত চাপা গর্জনের আওয়াজ এলো তার কানে……বুঝতে বাকি রইল না, যে ওই দুই আলোক বিন্দু হল তার সামনেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকা সেই নরপিশাচটার দুই চোখ!

    পরের দিন সকাল বেলায়, যখন সুখেনের মারফত অমলেন্দু, শ্রাবন্তী আর মধুরিমা জানতে পারলো, যে সেই অতি প্রকৃত জীবের তৃতীয় শিকার হয়েছে, তাদের গতকাল শ্মশানে দেখা সেই তান্ত্রিক……..তখন বিস্ফারিত চোখে, আতঙ্ক আর ক্রোধ মেশানো স্বরে শ্রাবন্তীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলো মধুরিমা,
    – গতকাল রাত্রে তুমি চুপি চুপি শ্মশানে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে কোথায় গিয়েছিলে, শ্রাবন্তী? আমি নিজে চোখে তোমাকে দেখেছি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে!……বলো, আমার কথার জবাব দাও……..
    শ্রাবন্তী চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল মধুরিমার দিকে!

    শ্রাবন্তীকে নিরুত্তর দেখে, অমলেন্দুর উদ্দেশ্যে আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো মধুরিমা,
    – আমি জানি ওর কাছে কোন উত্তর নেই রে দাদা… .. কারণ ওই…..ওই হল সেই নরখাদক পিশাচিনী…..ওই সব স্বপ্ন-টপ্ন সব মিথ্যা কথা ওর…..মনে করে দেখ, দাদা ও যবে থেকে এই বাড়িতে এসেছে, তবে থেকেই এই গ্রামের হত্যালীলা শুরু হয়েছে……ওকে পুলিশের হাতে তুলে দে, দাদা…..আমাদের সকলকে মেরে ফেলার আগে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দে!
    ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায়, চিৎকার করে মুখ খুলল শ্রাবন্তী,
    – হ্যাঁ মানছি…..মানছি আমি কাল রাতে শ্মশানে গিয়েছিলাম, আর ওই তান্ত্রিকের সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম……কারণ আমার মনে হয়েছিলো, যে সকালে রাগের বশে সকলের সামনে সে মুখ না খুললেও, রাতে হয়তো আমার কাছে একান্তে ওই নরখাদক জীবটার সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলবে…..কিন্তু আমি সেই জায়গায় পৌঁছনোর আগে…..পৌঁছনোর আগেই সে ওই জীবটার শিকার হয়……হ্যাঁ, অমলেন্দু বাবু, আজ সকালে এই গ্রামের লোকেরা ওই ব্যক্তির যে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখেছে, তা আমি কাল রাতেই সেখানে গিয়ে দেখতে পাই! কিন্তু সেই সময়….সেই সময় তার দেহাবশেষের ধারে কাছে কাউকেই দেখতে পাইনি আমি….কাউকেই না!
    এই বলে আর কোন কথা না বাড়িয়ে, সেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল শ্রাবন্তী। মধুরিমা নিজের বিস্ফারিত চোখের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে! বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অমলেন্দু!

    (৯)
    মধুরিমার সন্দেহের জালে জড়িয়ে গিয়ে এই বাড়ির পরিবেশটাকে কেমন যেন গুমোট লাগতে শুরু করেছে শ্রাবন্তীর। তবে যে যাই বলুক না কেন, এই রহস্যের সমাধান না করে সে কিছুতেই এখান থেকে ফিরে যাবে না, তাতে যদি ওই পিশাচটার হাতে প্রাণ দিতে হয়…….তাতেও রাজি আছে সে! এই বদ্ধ ঘরের আবহাওয়া থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার জন্য, সেদিন বিকালে একবার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ছিল শ্রাবন্তী। বিকাল বেলায় সেই নরখাদকের আক্রমণের কোন ভয় নেই, এই কথা সে জানে। বাড়ি ফিরে এসে, হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পেছনের বাগানে! সেখানে ঝোঁপের আড়ালে, একটি আমগাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মধুরিমা আর স্যামুয়েল! মনে একটি অজানা কৌতূহল হওয়ায়, শ্রাবন্তী পা টিপে টিপে চলে গেল সেই স্থানের খুব কাছে……তারপর নিকটবর্তী আরেকটি গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে লাগলো এই দুজনের কথাবার্তা!

    মধুরিমা স্যামুয়েলকে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল, স্যামুয়েল ইংরাজি বাংলা মিশিয়ে বলে উঠলো,
    – কি করছো কি, মধুরিমা……ছাড়ো আমায়……এখুনি তোমার দাদা অফিস থেকে চলে আসবে! সে যদি আমাদের এই অবস্থায় দেখতে পায়! মনে হয় না সে কখনো আমার মত একজন বিদেশীর হাতে তোমাকে তুলে দিতে চাইবে……….
    মধুরিমার আলিঙ্গন বিন্দুমাত্র শিথিল হল না, সে সেই অবস্থাতেই বলে উঠলো,
    – দাদা যদি মত না দেয়, তাহলে তার অমতেই তোমার সাথে চলে যাবো আমি! স্যামুয়েল……যেদিন থেকে আমি তোমাকে দেখেছি, সেদিন থেকেই শুধু তোমার হয়ে গিয়েছি! তুমি কি কিছুই বোঝো না! কেন এলে বলো তো তুমি! সুদূর ব্রিটেন ছেড়ে কেন এলে এখানে! কেন এলে আমার চোখের সামনে!
    স্যামুয়েল এবার মধুরিমার দুই কাঁধ আলতো করে ধরে বলে উঠলো,
    – জানো তো মধুরিমা, শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্যই আসিনি আমি এখানে…….আসলে এই গ্রামটা আমাকে খুব টানে! কারণ এটাই ছিল আমার পূর্বপুরুষের ভূমি!
    অবাক হয়ে মধুরিমা বলে উঠলো,
    – তোমার পূর্বপুরুষেরা এখানে থাকতেন! মানে?

    স্যামুয়েল ম্লান হেসে বলে উঠলো,
    – হ্যাঁ, ঠিক তাই! রাজেন্দ্র মোহনের হৃদ রোগে মৃত্যুর পর, তার স্ত্রী এমিলির সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখনকার এক ব্রিটিশ অফিসারের সাথে…..তার নাম ছিল হেনরি উইলসন। এই গ্রামের জমিদারির দায়-দায়িক্ত তার কাঁধেই ছিল সেই সময়। কলঙ্ক রটে যাওয়ার ভয়ে, তিনি এমিলিকে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটেনে চলে যান। সেখানে তাদের একটি পুত্রসন্তানও হয়। তিনিই হলেন আমার ঠাকুরদা……তবে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান ইমিলি! এই কথা এই গ্রামের লোকেরা না জানলেও, জানে আমার পরিবার! তাই এই গ্রামের প্রতি আমার এত টান!
    মধুরিমার মুখে খেলে উঠলো একটি বাঁকা হাসি, সে স্যামুয়েলকে আরো শক্ত বন্ধনে আবৃত করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
    – আজ রাতে……আজ রাতে বারোটা নাগাদ, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, আমি কিন্তু গ্রামের পুবদিকে নদী পারে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, স্যামুয়েল…..আমায় কথা দাও তুমি আসবে!
    স্যামুয়েল ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
    – কিন্তু সেই নরখাদক……সেই পিশাচ…….
    মধুরিমা কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে উঠল,
    – একটা গোটা রাতে তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য, আমি ওই পিশাচের হাতে বলি হতেও রাজি, স্যামুয়েল…..প্লিজ, বলো…..বলো তুমি আসবে……
    একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে স্যামুয়েল বলল,
    – ঠিক আছে……আসবো!

    এইটুকু শুনেই সেখান থেকে লুকিয়ে কেটে পড়লো শ্রাবন্তী……মনে মনে সমস্ত ঘটনাগুলিকে একই সুতোয় গেঁথে চলেছিল সে এতদিন ধরে, বাকি ছিল শুধু একটা সূত্র পাওয়া! আজ সেটাও পেয়ে গেল সে! আর দেরি নেই এই পিশাচের রহস্যের জট খুলতে!

    (১০)
    সেই নরখাদকের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে, এই গ্রামে বিভীষিকার কালো ছায়া নিয়ে হাজির হয়েছে চতুর্থ রাত্রি! চারিদিকে অন্ধকারের কালি মেখে অপার নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে আছে গোটা পলাশপুর গ্রাম। পরদিনই, আবার না জানি পাওয়া যাবে কার মৃত্যুসংবাদ! বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, মধুরিমা চুপি চুপি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে! তারপর দ্রুর পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেল গ্রামের পূর্ব দিকে অবস্থিত নদীর পারে! সেখানে এসেই খুশিতে ভরে উঠলো তাই বুক, কারণ সেখানে স্যামুয়েল তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো! মধুরিমা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্যামুয়েলকে, কিন্ত সেই মুহূর্তেই তাকে অবাক করে এক ঝটকায় অনতিদূরে সরিয়ে দিলো স্যামুয়েল! তারপর হিংস্র স্বরে বলে উঠলো সে,
    – বড্ড ভুল করেছো আমাকে ভালোবেসে, মধুরিমা……বড্ড বোকামির কাজ করে ফেলেছো তুমি……নিজের মৃত্যুকে নিজেই ডেকে এনেছো আজ রাতে!
    মধুরিমা অবাক হয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
    – মানে? এসব কি বলছো তুমি!
    মধুরিমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো স্যামুয়েল,
    – মানে?…….মানে, এই গ্রামের সেই নরখাদক আর কেউ নয়, মধুরিমা…..আমি……আমিই হলাম এই “পলাশগড়ের পিশাচ”! হাহাহাহা……

    আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মধুরিমা সেই রাতের অন্ধকারে দেখলো, যে একটা চাপা গর্জন করে উঠলো স্যামুয়েল!……তার সমস্ত শরীরের আকৃতি যেন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করলো!…..ভাঁটার মত জ্বলে উঠলো তার দুই কোটরে ঢোকা চোখ!…..তার সুন্দর মুখশ্রী বদলে গিয়ে ধারণ করল এক হিংস্র শেয়াল এবং কুকুরের মুখাকৃতির সংমিশ্রনের রূপ!.…. ঠোঁটের সামনে বেরিয়ে এলো দুটো তীক্ষ্ণ কুকুরদন্ত!……ধীরে ধীরে আয়তনে বৃদ্ধি পেতে লাগলো তার শরীরের!……ছিঁড়ে যাওয়া জিন্স আর টি-শার্ট-এর ভেতর থেকে উন্মোচিত হল একটি সুবৃহৎ দানবিক চেহারা, যার শরীরে মাংসপেশির নাম মাত্র নেই, আছে শুধু হাড়-পাঁজরের ওপর শুষ্ক চামড়ার আস্তরণ! যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার পেটের ভেতরে থাকা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো!

    একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে দু-পা পিছিয়ে এলো মধুরিমা। আবার একটা হিংস্র গর্জন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল এই দানব! কারণ মধুরিমার পেছনেই এখন জ্বলন্ত মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে অমলেন্দু!…… আরেকবার ভয়ঙ্কর গর্জন করে, পিছু ফিরে লাফিয়ে উঠে পালাতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ল এই নরপিশাচ…..কারণ তার বিপরীত দিকেও একটি উজ্জ্বল রূপোর বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবন্তী!…..আর দেরি না করে, নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সেই তীক্ষ্ণ বল্লমের ফলাটিকে এক ঝটকায় সে বিঁধিয়ে দিল হতভম্ব পিশাচটির বুকে, সোজা তার হৃদপিণ্ডের ভেতর! ঠিক যেন মা দুর্গা ত্রিশূল হাতে বধ করলেন মহিষাসুরকে! …….রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে মৃত্যুযন্ত্রনায় চেঁচিয়ে উঠলো এই “পলাশগড়ের পিশাচ”! ফিনকি দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো তার বুক থেকে! মাটিতে পড়ে গিয়ে, কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল তার দেহ!

    আতঙ্কে মধুরিমা দুহাত দিয়ে তার দাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো! ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে শ্রাবন্তী দেখলো, যে আবার ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হল এই মৃত পিশাচটির দেহ….কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের সামনে পড়ে রইল উলঙ্গ স্যামুয়েলের রক্তাক্ত মৃতদেহ! ওরা অবাক হয়ে দেখলো, যে আশে পাশের বনঝোপের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে সারি সারি জ্বলন্ত চোখ জোড়া!…..শ্রাবন্তী বলে উঠল,
    – স্যামুয়েলের রক্তের গন্ধে এখানে ছুটে এসেছে গ্রামের শেয়ালগুলো, ওরা ওদের খিদে মেটাক!…..এই লাশটাকে এখানেই ছেড়ে যেতে হবে আমাদের। কাল সকালে গ্রামবাসীরা জানবে, যে স্যামুয়েলই হল এই পিশাচের চতুর্থ এবং শেষ শিকার! নাহলে পুলিশ আমাদের সমস্ত কথা অবিশ্বাস করে, স্যামুয়েলের খুনের দায়ে হাতে হাতকড়া লাগাবে আমাদের!
    এই বলে স্যামুয়েলের বুকে বিঁধে থাকা রূপোর বল্লমটা এক টানে বার করে নিল শ্রাবন্তী, তারপর ঠিক ফোল্ডিং ছাতার মত সেটাকে ছোট করে ভরে নিলো অদূরে পড়ে থাকা নিজের হ্যান্ড-ব্যাগে!

    (১১)
    সেদিন রাত্রে ঘুম এলো না কারোর চোখে। বাড়ি ফিরে হতবাক অমলেন্দু আর মধুরিমাকে বলতে শুরু করলো শ্রাবন্তী,
    – আমি যা বলতে চলেছি, তার মধ্যে কিছুটা আছে আমার আন্দাজ, এবং বাকিটা ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং অলৌকিকতা!…… যখনই আমি শুনি, যে রাজেন্দ্র মোহন আমেরিকার রুশো শহর থেকে এমিলিকে বিবাহ করে এনেছিলেন, সন্দেহটা আমার তখনই হয়। এখনও আপনারা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন, যে সেই সময় (অর্থাৎ ১৯২০ সালের কাছাকাছি), রুশো শহরের বেশ কিছু মানুষও এই একই ভাবে কোন নরপিশাচের হাতে মারা পড়ে। তাদের ধারনা, যে প্রবল নিচু তাপমাত্রায়, যখন সেখানকার জনগণের কাছে খাবার ফুরিয়ে যেত, তখন বাধ্য হয়েই কেউ কেউ হয়ে উঠতো নরমাংশভোগী! আর ঠিক এই সময়ই তাদের শরীরে প্রবেশ করতো এক ভয়ানক অপদেবতা, যার নাম হল “ওয়েন্ডিগো” (wendigo)!

    এর ফলে তারা প্রতি শীতের রাত্রে এই ভয়ানক পৈশাচিক রূপ ধারন করে মানুষ শিকার করতে বেরতো, এতে সাহায্য করতো তাদের অন্যের স্বর নকল করার অদ্ভুত ক্ষমতা!…..একবার শরীরে এই অপদেবতা বাসা বাঁধলে, হাতের সামনে অন্যান্য খাবার থাকলেও, নরমাংশের খিদে যেন তাদের কখনো মিটতো না! এরা ভয় পায় আগুনকে। এছাড়াও, কোন ওয়েন্ডিগো বা এই জাতিয় পিশাচকে মারতে গেলে লাগে রূপোর অস্ত্র, যা দিয়ে ছেদ করতে হয় তাদের হৃদপিণ্ডকে! সেটা আমি আগে থেকেই আঁচ করে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম ওই রূপোর ফোল্ডিং বল্লমটাকে……..সেই সময়, ওই শহরের মানুষদের বাঁচাতে, ওয়েন্ডিগোদের চিহ্নিতকরণ করে এমন ভাবেই হত্যা করছিলেন ওয়েন্ডিগো-হান্টাররা!

    – যাইহোক, আমার বিশ্বাস এমিলিও ছিলেন এমন এক ওয়েন্ডিগো! তাকে হয়তো চিনে ফেলেছিলেন ওয়েন্ডিগো-হান্টাররা…… তাই, তিনি রাজেন্দ্র মোহনকে প্রেমের জালে জরিয়ে, তার সাথে চলে এলেন ভারতের এই পলাশগড়ে। এখানে এসেও বেশ কিছু বছর ধরে শীতের রাত্রিগুলিতে চালাতে লাগলেন এই হত্যালীলা। অপুত্রক রাজেন্দ্র মোহনের হৃদ রোগে মৃত্যুর পর, যতদিন না এমিলি হেনরির সাথে ব্রিটেনে পাড়ি দিলেন, ততদিন ধরে চলতে থাকলো তার এই পৈশাচিকতা!……এদিকে আদিবাসী হওয়ার ফলে রমাবতী হয়তো জানতেন কোন গুপ্ত তন্ত্র-বিদ্যা, তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন এমিলির আসল রূপ! তাই একদিন তাকে হত্যা করে পুকুরে ভাসিয়ে দিলেন এমিলি। সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায়, তাকে শুধু হত্যাই করলেন তিনি, কিন্তু তার মাংশ ভক্ষন করলেন না!

    – মৃগাঙ্ক মোহন ভাবলেন, যে এটা তার দাদার কাজ। তিনি প্রেমিকার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, রাজেদ্র মোহনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এমিলি বোধহয় ততদিনে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন রাজেদ্র মোহনকে…… তাই, যে রাতে মৃগাঙ্ক মোহন তার দাদাকে মারতে যাবেন, সেদিনই এমিলি তার পৈশাচিক রূপ ধারণ করে আক্রমন করলেন তাকে! মৃগাঙ্ক প্রান ভয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো জমিদার বাড়ি থেকে……তার পেছন পেছন মূর্তিমান বিভীষিকার মত ছুটে আসতে লাগলেন এমিলি! কিন্তু দৈবক্রমে গ্রামের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রানে বেঁচে গেলেন মৃগাঙ্ক, কিন্তু মাথায় চোট পেয়ে তিনি হারিয়ে ফেললেন স্মৃতিশক্তি! তারপরে সেই বৈষ্ণব আশ্রমে ঘটা ঘটনার কথা আপনারা জানেন……শুধু জানেন না এটাই, যে মৃগাঙ্ক মোহনের সেই পুত্রসন্তানই হলেন আমার ঠাকুরদা!……হ্যাঁ, এই কথা আমাদের পরিবারের সকলেই জানে, যে আমার ঠাকুরদার বাবা ছিলেন খুব ধনী কিন্তু নিঃসন্তান। একদিন এক অসহায় বৈষ্ণবী তাকে একটি পুত্র সন্তান দত্তক দিয়ে যান, তারপর আর তার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি!

    – তবে আমার ঠাকুরদা যে সেই সন্তানই ছিলেন, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম তখনই, যখন মৃগাঙ্ক মোহনের এমিলি দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সেই রাতের কয়েকটা দৃশ্য ভেসে আসতে থাকে আমার স্বপ্নের মধ্যে! পূর্বপুরুষের কিছু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা, পরবর্তী প্রজন্মগুলির কারোর মনে জীনগত ভাবে জেগে ওঠার এই ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় “epigenetic transmission of transgenerational trauma”! ঠিক একই রকম ভাবে, স্যামুয়েলও যেহেতু এমিলির বংশধর, তার মধ্যেও জেগে উঠতে শুরু করলো এই “ওয়েন্ডিগো-র” নরমাংশলোভী মনোভাব! সেও আবার এখানে এসে জাগিয়ে তুলল একশো বছর আগে এমিলির দ্বারা শুরু করা হত্যালীলা! কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, আমার বা স্যামুয়েলের আগের দুটি প্রজন্ম ছিল শুধুমাত্র এই ঘটনাগুলির জেনেটিক বাহক, তাদের মধ্যে কিন্তু এক্সপ্রেসড হয়নি এই ক্যারেক্টার-গুলি!

    – রমাবতীর মতই, তন্ত্র-বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায়, সেদিন ওই তান্ত্রিকও চিনে ফেলেছিলো স্যামুয়েলের আসল রূপ। কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রতি রাগের কারনে, তিনি চাইলেন যে স্যামুয়েল আরও গ্রামের মানুষদের হত্যা করুক! হয়তো ভেবেছিলো সে, যে স্যামুয়েলের কথা সবার কাছে ফাঁস না করে দেওয়ার জন্য তাকে অন্তত মারবে না স্যামুয়েল। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমান করে, স্যামুয়েল তাকেই বানালো তার তৃতীয় শিকার! এতে তার খিদে যেমন মিটলো, তেমনই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিল তার আসল রূপের এক চিহ্নিতকারী! আর বাকি দুটো মানুষকে মারার পেছনে ছিল শুধুমাত্র তার নরমাংশের খিদে মেটানোর উদ্দেশ্য! আর অমলেন্দু বাবু, আমার কথামত মশাল হাতে ওই নদীর পারে গিয়ে, আপনি আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছেন এই পিশাচকে মেরে আপনার বোনকে বাঁচাতে।

    এতটা কথা একসাথে বলার পর চুপ করে হাঁপাতে লাগলো শ্রাবন্তী। অমলেন্দু আর মধুরিমা এখনও বিহ্বল চোখে তার দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এমন সময় পুব আকাশের ঈশান কোনে দেখা গেল উদিয়মান সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি।

    (সমাপ্ত – “ওয়েন্ডিগো-র” সম্বন্ধে বিশদে জানতে দেখতে পারেন নিচে দেওয়া লিংক: https://www.ranker.com/list/wendigo-facts/lyra-radford)

You cannot copy content of this page