• কবিতা

    কবিতা- গোপন কথাটি

    গোপন কথাটি
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    পুষ্পাঞ্জলির ফুল তার হাতে তুলে দিতে গিয়ে প্রথম ছোঁয়া।
    মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আড়চোখে প্রথম চোখাচোখি হওয়া।
    বাসন্তী রঙের শাড়িতে সরস্বতী মুখের কপালে ছোট্ট টিপ,
    কী এক আশ্চর্য সুন্দর ভাললাগার আবেশ অনুভব সেই প্রথম।

    সন্ধ্যার জলসায় পাশাপাশি বসে গান শুনতে শুনতে দুরুদুরু বুকে প্রথম মন দেয়া-নেয়া।
    খুশি আর লজ্জারাঙা এক চিলতে হাসির বিদ্যুৎ তরঙ্গের মধুর অনুভব সেই প্রথম।
    সেই প্রথম ঘুমহারা রাতে মন কেবলই জিজ্ঞেস করেছে মনকে,
    এ-ই কি তবে প্রেম ?
    মন বলে আমি মনের কথা জানিনা।
    তবে কেন মনের পাতায় উঁকি দেয় সেই একরাশ ঢেউ খেলানো শ্যাম্পু করা মেঘবরণ উড়ন্ত চুল,
    চঞ্চল দুষ্টু মিষ্টি ভীরু চোখের চাহনি!
    কেন মনে বাজে একটি কবিতার মতো নাম, তন্বী তন্বী তন্বী,
    আবারও প্রশ্ন জাগে মনে,
    এ-ই কি তবে প্রেম?

    এ তো সেই ই কবেকার হতাশার
    গোপন কথা।
    এ কথা শুধু সে জানে আর মন জানে। আর জানে শ্রীপঞ্চমী তিথি।
    তিথি আসে নক্ষত্রের পথ বেয়ে সময় বিচার করে,
    সঙ্গে আসে স্মৃতি, ফেলে আসা জীবনের সরণি বেয়ে।
    স্মৃতির বয়স বাড়েনা, বাড়তে নেই, কক্ষনো বাড়তে নেই।
    ওগো সময়, দোহাই তোমার তুমি সেখানেই থেমে থেকো অনন্ত অনন্ত কাল।

  • গল্প

    গল্প- ব্লাড সুগার

    ব্লাড সুগার
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    হরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। গজাদার পাড়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সন্ধ্যে সাতটা। সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো নলেন গুড়ের রসগোল্লা টপটপ ক`রে মুখে ফেলে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে খেয়ে পরম তৃপ্তিতে দোকানের জগে রাখা জল মুখ উঁচু করে খেয়ে মুখ নামাতেই চোখে পড়লো “মনসা”। গজাদার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
    মনসা, গজাদার বাড়ির রাত দিনের কাজের লোক। এক নম্বরের চুকলি বাজ। সারা পাড়ার সেরা সাংবাদিক। কোথায় কার কী হয়েছে কেন হয়েছে সেই হওয়াটা উচিৎ ছিল কিনা তার চুল চেরা বিশ্লেষণ না করতে পারলে রাতের ঘুমের তেরোটা।
    মনসার সেই ক্ষুরধার বিজ্ঞ সমালোচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা বৌদি অর্থাৎ গজাদার স্ত্রী । তার শোনবার প্রবল আগ্রহ মনসাকে আরও উৎসাহ দান করে এবং তার ফলস্বরূপ যেকোনো কাহিনী চমকপ্রদ রূপ ধারণ করে তিল থেকে তাল অতিক্রম করে তরমুজ আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হয়। তার পরিবেশন গুণে প্রতিটি কাহিনীই শুধু উপভোগ্য নয়, টিভি সিরিয়ালের পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত হয়ে উঠেই মহাশুন্যে বিলীন হয়ে যায়।
    মনসার দুর্ভাগ্য তার এই প্রবল ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভার সন্ধান কেউ পেলো না।
    মনসা চোখ পাকিয়ে অভিভাবকের সুরে বললো, “এটা কী হলো দাবাবু, তুমি মিষ্টি খেলে?”
    সর্বনাশ করেছে। এ কথা তেনার কাছে পৌঁছে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরেই শুরু হবে প্রলয় নাচন। শব্দবাণে কান ঝালাপালা। ওফ্ফ, শালা রক্তও বিট্রে করে। সেখানে সুগার ঢুকে বসে আছে। ডক্টর, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ইনসুলিন একেবারে ন্যাটাপ্যাচা জীবন।
    যে জীবন একটা রসগোল্লা খাবার অধিকার পায় না, সেই জীবনের কী দাম? গজাদার এখন এই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে উপায়ও নেই। প্রেস্টিজের ব্যাপার। তিন মাইল দূরে এসেও রেহাই নেই। ঠিক শ্যেনদৃষ্টি আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, তাও আবার যে সে নয় একেবারে মা মনসা। সর্পকুলের রাণী। কি আর করা, এই বয়সে মিছিমিছি মিছেকথা কইতে মন চায় না। তবুও উপায় নেই।
    -কী যা-তা বলছি, কোথায় মিষ্টি। এ-তো জল। অনেকটা হেঁটে জলতেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল তাই একটু জল খেলাম। মিষ্টি কোথায়?
    কী কপাল লিখন রে, বাড়ির কাজের লোকের কাছেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে, হায় হায় একেই বলে প্রাণের দায়।
    -আবার বাজে কথা বলে, নিজের চোখে দেখলুম চেটেপুটে রসগোল্লা খেলে, খেয়ে মিছেকথা কইতে নেই জানো না।
    -আরে কী আপদ, আচ্ছা এই কথা তো, মিষ্টি খেয়েছি, তাহলে তার দাম দিতে হবে তো? হেঁ হেঁ এ-ই দ্যাখ আমি গটগট করে চলে যাচ্ছি, কৈ আমার কাছে দাম চাইছে না তো।
    -এক জিনিসের কতবার দাম নেবে দোকানদার? সে তো আগেই দিয়ে দিয়েছো। আমাকে অত বোকা ঠাওরিও নি। চলো বাড়ি বৌদিকে গিয়ে সব বলছি। ছি ছি তুমি কেমন মানুষ গা। বৌদি বলে তোমাকে চায়ে পর্যন্ত চিনি দেয় না। গাদাগাদা দামী দামী ওষুধ চলছে, এদিকে তুমি নুকিয়ে নুকিয়ে নলেন গুড়ের, চলো বাড়িতে।
    গজাদার মনে হচ্ছিল এই রাস্তার মধ্যেই চুলের মুঠি ধরে দেয় ঘা কতক। কিন্তু মান বড়ো দায়। রাস্তায় এখন এর সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। অবিশ্যি বাড়িতেও পারা যাবে না। কেননা ঘর শত্রু মহিলা বিভীষণ ওর সহায়। তারও কারণ আছে। সবই স্বার্থের চাহিদা। মনসা না থাকলে আদরের বৌদি একেবারে কানা।
    লক্ষ্মীকান্তপুর না-কি যেন ঐ দিকেই কোথাও বাড়ি। মাঝেমধ্যে যখন সেখানে যায় তখন এখানে কী অবস্থা হয় সে তো দেখাই আছে। ফ্রিজ নির্ভর রান্নাঘর। বার করো আর কোনোরকমে কিছু একটা ঘেঁটেঘুঁটে ফুটিয়ে ফাটিয়ে ক’টা দিন চালিয়ে নেওয়া কেস।
    মনসা যখনই নিজের বাড়িতে যায় তখনই গজাদার ওনার মনে কু গায়। মনসা যদি আর না ফিরে আসে, কী হবে! চলবে কীভাবে! সব তো থেমে যাবে অচল হয়ে যাবে এ সংসার। কাজ কি কম? সকাল থেকে রাত অবধি কাজের শেষ নেই।
    মনসা বাজার দোকান কোথাও গেলে, মানে ওর অসাক্ষাতে তো প্রায়ই বলে।
    ভাগ্যিস মনসা ছিল, নইলে কি করে কি সামলাতুম বলো দেখি। ভগবান ওকে জুটিয়ে দিয়েছে।
    কথাটা অবিশ্যি ফেলে দেবার মতো নয়। ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে চারজনের ব্যস্ত সংসার। ছেলে আর বৌমা দুজনেই চাকরি করে। ওদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। টাকা দিয়েই খালাস।
    মনসা যখনই বাড়ি যাবার কথা বলে তখনই আতঙ্কে ভোগে কম বেশি সবাই। তবে গৃহিণীর দায়িত্ব যেন অলিখিত ভাবে সক্কলের থেকে বেশি। কারুর যেন কোনও অসুবিধে না হয়। কেউ যেন অভিযোগ করতে না পারে।
    -হ্যাঁ রে মনসা তাড়াতাড়ি চলে আসবি তো? তুই তো জানিস তুই না থাকলে আমি একা পেরে উঠি না।
    মনসা আস্বস্ত করে,
    -কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। সামান্য দু’চার দিনের কাজ। মিটিয়েই চলে আসবো বৌদি।
    দাবাবু গো নুকিয়ে নুকিয়ে মিষ্টি খেও না কো। তুমি অসুস্থ হলে বৌদির অশান্তি বাড়বে, বুঝেছো।
    গজাদার মাঝেমাঝে মনে হয়, মনসা ওদের মাইনে করা কাজের লোক নয়। এই সংসারের একজন সক্রিয় সংবেদনশীল সদস্য।
    বরঞ্চ ছেলে বৌমা যেন পেইং গেষ্ট। আছে থাকছে নিজেদের মতো। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, নিজস্ব চিন্তায় বিভোর। প্রয়োজনের বাইরে কথাবার্তাও হয় না আজকাল। হাসি ঠাট্টা গল্পের পাট কখন যে শেষ হয়ে গিয়েছে কে জানে। যেন মনে হয় একই বাড়িতে পাশাপাশি বাস করে দুটি আলাদা পরিবার।
    গজাদা ভাবে, কিন্তু কাউকেই কিছু বলে না।গৃহিণীকে তো নয়ই। গজাদা জানে এসব ওকে বলার কোনো মানেই হয়না। প্রথমত ও এসব কথার গুরুত্বই দেবে না। দ্বিতীয়ত মায়ের মন বুঝতে পারলেও স্বীকার করতে চাইবে না।
    সম্পর্ক আলগা হচ্ছে। ছিঁড়ে যাবে হঠাৎই একদিন আচমকা। সেদিন খুব বেশি দূরে নেই। সময় মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে খানিকটা দূরদর্শীও।
    মনসারও বয়স বসে নেই। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। গরীব গুর্বো ঘরের অশিক্ষিত মেয়ে। পনেরো বছর বয়সে যে ছেলেটার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল সে দু বছরের মাথায় মনসাকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে অন্য আর একটি মেয়ের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। মনসার স্বামী সহবাসের অভিজ্ঞতা কেবল এইটুকুই।
    স্বামীর থেকে পুত্র সন্তান ছাড়াও আরও দুটি উপহার সে পেয়েছিল। একটা টিনের ভাঙা ঘর আর বুড়ী মা।
    পুরাতন অতীতকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ত্যাগ করতে পারে মাত্র দু’জন।
    এক, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। দুই, স্বার্থান্বেষী আত্মসুখ অভিলাষী।
    এর পরেই শুরু হয় মনসার জীবন সংগ্রাম। বুড়ী শাশুড়ীর কাছে বাচ্চা রেখে কলকাতার বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ।
    সেই ছেলে এখন বিশ বাইশ বছরের যুবক। সাইকেল সারানোর দোকান দিয়েছে। অবিশ্যি সেটা তার মা’য়েরই অবদান। তারই উদয় অস্ত পরিশ্রমের ফল। তবে চুপিচুপি বলে রাখি, গজাদার অগোচরে বৌদির অবদান বড়ো কম ছিল না। তবে শর্ত ছিল তার এই কথা কাউকে জানানো যাবে না।
    গৃহিনীরা সংসারের চাবিকাঠির অধিকার নিশ্চয়ই পেয়ে থাকেন, কিন্তু সেখানে স্বাধীনতার পরিমাণ কতখানি তা অবশ্যই ভাবার বিষয়।
    যাই হোক, মনসার পেটে কথা না রাখতে পারার বদনাম অবশ্যই আছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে সে আশ্চর্য রকম ভাবে শর্ত পালন করেছিল। আসলে মনসা নয়, নিষ্ঠার সঙ্গে শর্ত পালন করেছিল মনসার মধ্যে থাকা একটি মা। সর্বংসহা কর্তব্যরতা মা।

    গজাদার অভিজ্ঞ মনের ভাবনা একদিন সত্যি হয়ে গেল। যৌথ উদ্যোগে রোজকার করা মোটা অঙ্কের টাকায় সাজানো ফ্ল্যাট কিনে, বয়স্ক মা বাবাকে পুরনো বাড়িতে রেখে দিয়ে অক্লেশে চলে গেল, হাসিমুখে হৈ হৈ করতে করতে। যাবার সময় পরিত্যক্ত বাবা মা-কে নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে মনুষ্যত্বের নিদারুণ পরিচয় রাখতে ভুল হলো না।
    মনসা’কেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল ওরা। নিজেদের নির্লজ্জ স্বার্থেই চেয়েছিল। কিন্তু মনসার তীব্র প্রত্যাখানে সেই আশায় ছাই পড়েছিল।
    মনসা বলেছিল,
    “যদিও তোমাদের মা বাবাকে, দাবাবু আর বৌদি বলে ডাকি, কিন্তু ওরাই আমার
    মা বাবা। যাদের ভালোবাসার আশ্রয়ে সবকিছু পেলাম তাদের সঙ্গে বেইমানি বিশ্বাসঘাতকতা করলে নরকেও ঠাঁই হবেনা।”
    সেদিন গজাদার মনসাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়েছিল নিদেনপক্ষে কপালে একটি কৃতজ্ঞতার পবিত্র চুম্বন। কিন্তু ইচ্ছেটা ইচ্ছে হয়েই মনের মাঝে রয়ে গিয়েছিল পরম যত্নে আমৃত্যু। রক্ত বিট্রে করে কিন্তু মিষ্টি মধুর সম্পর্কে অসুখ বাসা বাঁধতে পারে না, কিছুতেই না।

  • গল্প

    গল্প- রক্তের রঙ নীল

    রক্তের রঙ নীল
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    – মদন, নলেন গুড় পেলি?
    -মাথাটা গেছে দেখছি। বোশেখ মাসে নলেন গুড়?
    -ও হ্যাঁ, তাও তো বটে। যাক গে কী আনলি আখের গুড়?
    -হ্যাঁ
    -ধুস, কী কাজে আসবে ওটা;
    -রুটি দিয়ে খাবে। শোনোনি, “মার গুড় দিয়ে রুটি”
    -থাম হতভাগা। সেটা আখের গুড় নয়।
    -কোথাও লেখা নেই।
    -সবকিছু লেখা থাকে না। বুঝে নিতে হয়।
    -পরোটা চলবে?
    -হ্যাঁ, সেটা মন্দ নয়।
    -অম্বল হলে আমাকে দুষবে না। আগে থাকতে বলে রাখলুম। মনে থাকে যেন।
    -কতটা এনেছিস?
    -এক পোয়া।
    -এইটুকু, কী হবে ওতে?
    -খাবো তো দুজন, এক ক্যানেস্তারা আনবো?
    -কাল বাজার থেকে একটা তাল আনবি।আখের গুড় দিয়ে তাল খাবো।
    -আবার সেই বেতালা কথা। বোশেখ মাসে তাল হয়? আমের আচার চলবে? ঘরে দুটো কাঁচা আম আছে ।
    -চলবে মানে, হৈ হৈ করে চলবে। সঙ্গে পরোটা। খাবার পরে দুটো এন্টাসিড দিতে ভুলবি না। তাহলে কিন্তু অম্বল হলে তোর দোষ, মনে থাকে যেন। হ্যাঁ রে, অনেকদিন অরবিন্দ আসে না। দেখা হয় ওর সঙ্গে?
    -সত্যি বাপু, তোমাকে নিয়ে তো আর পারি না।
    -কেন, কী করলাম, আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার খোঁজ খবর নেবো না; সেটাও দোষের! এতো আচ্ছা মুশকিল। এরপর মনে হচ্ছে তোকে কিছুই আর জিজ্ঞেস করা যাবে না। -সত্যি করে বলো তো, তোমার মাথার ঠিক আছে তো?
    -কেন, কেন থাকবে না? যথেষ্ট ভালো আছে। অন্তত তোর চাইতে ভালো আছে।
    -ছাই আছে আর পিন্ডি আছে। সব ভুলে মেরে বসে আছে, ওনার নাকি মাথার ঠিক আছে? এই সেদিন বললুম, তোমার বন্ধু অরবিন্দ বাবু মারা গেছে। কাঁচ ঢাকা গাড়ি করে শ্মশানে নিয়ে গেল। বাজার থেকে ফেরার সময় দেখলুম। মনে নেই ?
    -ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই তো। মরে গেছে বেচারি। আসলে কী জানিস অনেক দিনের বন্ধু কি না, তাই ওর অমন চলে যাওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। অবিশ্যি ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিল কি না। বড্ড ভুগলো বেচারা। তবে ওর অন্যদিকে কপাল ভালো। ছেলে মেয়ে জামাই সব্বাই খুব চেষ্টা করেছে। কী বল, কি রে ভুল বলছি ?
    -সব্বাই আছে তাই করেছে। করেছে মানে তদবির তদারক করেছে। গাঁটের পয়সা তো কাউকে খরচ করতে হয়নি। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো। অরবিন্দ বাবু অঢেল রেখে গেছে। সবই তো ওরাই ভোগ করবে, সেটা বলো।
    -তোর মন খুব নিচু। ওরা অঢেল পাবে সেইটা চোখে পড়লো। ওদের সেবা যত্ন চোখে পড়লো না।
    -চা খাবে, সন্ধ্যে ছ’টা বেজে গেছে।
    -খাবো,
    -বিস্কুট না-কি মুড়ি?
    -অমন মুখ গমড়া ক`রে বলছিস কেন, রাগ করলি?
    – নাহ, ভাবছি,
    -কী?
    -আমি না থাকলে তোমার কী হতো, কে দেখাশোনা করতো তোমার?
    -এখন কে করছে? এখন যে করছে সেইই করতো। আরে বাবা এটাই ভবিতব্য। ললাট লিখন। এসব আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। কেউ খণ্ডাতে পারবে না। বিধিলিপি।
    -বিয়ে করোনি কেন? তোমারও ভরা সংসার হতে পারতো। বউ, ছেলেমেয়ে, বৌমা, নাতি নাতনি। কোলকাতার বুকে এতবড় বাড়ি, টাকা। নবাব পুত্তুর পাত্র। কিসের অভাব তোমার?
    -হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। এই সত্তর বছর বয়সে, যা যা, চা নিয়ে আয়।
    -আবার বাজে বকে, এখনের কথা হচ্ছে না। সময় কালের কথা বলছি।
    -সত্যি কথা শুনবি, ভয়ে করিনি।
    -কিসের ভয়?
    -মেয়েদের আমার খুব ভয়। সেই ছোটবেলা থেকেই।
    -কেন?
    -তখন আমি খুব ছোট বুঝলি। বিশাল বাড়ি। অনেক লোকজন। যৌথ পরিবার। হঠাৎ শুনলাম, ঠাকুর্দা মারা গিয়েছেন। যেতেই পারেন, বয়স হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরে কানাঘুষো শুনতে পেলাম, আমার ঠাকুমাই নাকি বাড়ির চাকরানিকে গয়না দেবার লোভ দেখিয়ে সরবৎ এ বিষ মিশিয়ে দিয়ে ছিলেন।
    বোঝ একবার! নিজের স্বামীকে লোক দিয়ে খুন করে দিলো।
    -সর্বনাশ, তারপর!
    -বড়ো বাড়ির ব্যাপার। লোক জানাজানি হলে পরিবারের মুখ পুড়বে। তাই সব ধামাচাপা।
    -ওরে বাপরে, বলো কী। এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। কিন্তু কেন?
    -সেটা আজও সঠিক জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি, ব্যাপারটা মহিলা ঘটিত।মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু নিজের স্বামীকে অন্য স্ত্রী লোকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবার অসম্মান সহ্য করতে পারে না।
    -পরকীয়া কেস?
    -অনেকটা তেমনই। যতদূর শুনেছি, ঠাকুর্দার স্বভাব চরিত্রে বেশ গোলমাল ছিল। নিজের শালী অল্প বয়সেই বৈধব্য পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। ওনার স্বামীকে না কি কে বা কারা যেন একটা বাগানবাড়িতে বাঈজী নাচের আসরের টোপ দিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করে ছিল। অনেকেরই সন্দেহ ছিল এ কাজ আমার ঠাকুর্দার। ঠাকুমা শুধু খুবই দজ্জাল প্রকৃতির ছিলেন এমন নয়, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একরোখা সাহসীও ছিলেন। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে সব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আবার ওদিকে আমার বাবা মা’য়ের ব্যাপারটাও বেশ রহস্যময়।
    -কী রকম?
    -সেবার মহালয়ার দিন আমাদের দুই ভাইকে মামার বাড়ি বর্ধমানে পাঠিয়ে দিলো মা।
    তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি আর ভাই এইটে। ভাবলাম ভালই হলো। পুজো মামার বাড়িতে কাটাবো। পুজো হয়ে গেল। সেদিন বিজয়া দশমী। প্রতিমা বিসর্জ্জনের আয়োজন চলছে। এমন সময় রামলাল দাদা, আমাদের বাড়ির পুরনো কাজের লোক এসে, আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
    -কেন, হঠাৎ?
    -আমাদের দুটো বাড়ি, জানিস তো। একটা এইটা। এই বাগবাজারে,
    -আর একটা ভবানীপুরে। যেটাতে তোমার ভাই থাকে।
    -ঠিক । আশ্চর্যের ব্যাপার দ্যাখ, মা আর বাবা দীর্ঘদিন যাবৎ আলাদা থাকতেন।
    বাবা এই বাড়িতে, মা ভবানীপুরের বাড়িতে। মানে উত্তর আর দক্ষিণ। বোঝাই যাচ্ছে দুজনের মধ্যে মিলমিশ মোটেই ছিল না।
    -কেন দোষ কার?
    -দোষ নীল রক্তের।
    -বুঝলুম না।
    -বাবা হঠাৎ করেই খুব ঘনঘন বেনারস যাওয়া শুরু করেছিলেন। নানান অছিলায়। আসলে, পরে জানতে পেরেছিলাম, ওখানের এক নামজাদা সুন্দরী বাঈজির প্রেমে পড়েছিলেন। মানে, হাবুডুবু বলতে যা বোঝায়। সেখানেই দেদার টাকা ওড়াচ্ছিলেন।
    মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে বাবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন।
    তাতে ফল হলো উল্টো।
    বাবা আরও বেপরোয়া লাগামছাড়া হয়ে গেলেন। দু’হাতে টাকা ওড়াতে শুরু করলেন সেখানে।
    মা বুঝলেন এইভাবে চললে পথে বসতে হবে। ছেলে দুটোর কী হবে ?
    তখনই নিয়েছিলেন সেই সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত।
    বাবাকে ভবানীপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সেদিন দুর্গা নবমী। নিজের হাতে মাংস লুচি খাওয়াবেন বলে। সে এক ভয়ংকর দিন। বাবা নতুন পোশাকে সাজগোছ করে উপস্থিত হলেন সেখানে। মা পরিপাটি করে নিজের হাতে পরিবেশন করে বাবাকে খাওয়ালেন। বাবার তখন খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখনই ঘটলো সেই বীভৎস ঘটনা। খাবার ঘরের মধ্যেই মা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে বাবাকে সজোরে জড়িয়ে ধরলেন। আর ছাড়লেন না। আলিঙ্গন বদ্ধ দুটো ভালোবাসাহীন সম্পর্কের দেহ দাউদাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
    -ইসস, কী ভয়ানক,
    -এই, পরোটা করবি কখন, কটা বাজে হুঁশ আছে?
    -চারটি তো মোটে পরোটা। ও আর কতক্ষণ। আরম্ভ করলেই শেষ। তাছাড়া একটু দেরী করেই করবো। গুড় দিয়ে খাওয়া কি না, গরম গরম না হলে ভালো লাগবে না।
    আচ্ছা একটা কথা বলছি, রাগ করো না।
    -রেগে যাবার মতো হলে রাগ হবে, বল।
    -রাগ ছাড়া আর কী করতে পারো বলো তো!
    -আসল কথা বলে ফ্যাল,
    -ময়ূরাক্ষীর কথা তোমার মনে আছে?
    -হঠাৎ একথা কেন?
    -ও তোমাকে সত্যিই ভালবাসতো গো।
    -আমি এখনো বাসি। তাতে কী!
    -ও কে কি তোমার বিয়ে করা উচিৎ ছিল না? দুজনেই দুজনকে ভালোবাসলে অথচ কোনও পরিনতি পেল না।
    -পরিনতি মানে? বিয়ে? ঘরসংসার ছেলেপুলে অসুখবিসুখ এইটা-সেইটা মনকষাকষি, ঝগড়াঝাটি, ন্যাটাঝামটা।
    প্রেম ভালবাসা সব ফুরুৎ , হা হা হা হা,
    শুনে রাখ, প্রেম ততক্ষণই মায়াময় যতক্ষণ সে থাকে আলগোছে।
    দিগন্তের সূর্যোদয়ের মতো আশ্চর্য সুন্দর। রঙিন। ঈশ্বরময়। পবিত্র। তাকে দেখেই সুখ। চোখে, অন্তরে নির্দ্বিধায় স্বপনদুয়ার খুলে তাতে আত্মস্থ হওয়ার নাম প্রেম।
    গৃহলক্ষ্মীর নামে গৃহবন্দী হলেই যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার অবসান একমাত্র বিচ্ছেদে। আমি এই পরিনতি চাই নি। তাই, পুরাতন প্রেম আজও ঢাকা পরেনি। সে রাতজাগা চাঁপা ফুলের মতোই তরতাজা সৌরভে আবিষ্ট।
    -শোনো, তোমার এইসব কাব্যকথায় আমি ভুলছিনা। তোমার বাপ ঠাকুর্দার যেসব ব্যাপারস্যাপার শোনালে তাতে আমি যা বুঝলুম, ওগুলো সব লম্পট, স্বৈরাচারী, কামুক পুরুষের অনিবার্য পরিণতি।
    মা ঠাকুমা যা করেছেন একদম ঠিক কাজ। আমি বলবো, বীরাঙ্গনা ছিলেন তারা।
    তাদের চরণে সহস্র প্রণাম।
    তুমি এইসব যথার্থ শাস্তিগুলো সামনে রেখে মেয়েরা ভয়ের কারণ প্রতিপন্ন করতে চাও।
    শোনো হে বড়ো বাড়ির দাম্ভিক নীল রক্তের বংশধর। তুমি আসলে মেয়েদের ভয় পাও না। ভয় পাও নিজেকে। ভয় পাও তোমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত তোমারই বংশধারা
    নীল রক্তকে। কি, ঠিক কি-না? কী হল কথা কইছো না যে? ওহ্ ঘুমিয়ে পড়েছো, ভালোই করেছো। আমিও যাই। পরোটা কটা ভেজে ফেলি গিয়ে, গপ্পো শুনে পেট ভরবে না।

  • রম্য রচনা

    রম্য- তুমি আর আমি শুধু

    তুমি আর আমি শুধু
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    সেই গানটা মনে আছে,
    ” তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভ`রে তুলবো,
    যত ব্যথা দুজনেই ভুলবো ”
    গায়ক শ্যামল মিত্র,
    মনে আছে?
    আচ্ছা, বলুন দেখি এখানে তুমি আর আমি বলতে কোন দু’জন কে বোঝানো হয়েছে? নিঃসন্দেহে বলা যায়, রোমান্টিক গান সুতরাং প্রেমিক প্রেমিকার ব্যাপার। এখানে বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কেউ না শুধুই ভালোবাসার কপোত-কপোতীদের মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।
    “যত ব্যথা দুজনেই ভুলবো”
    অর্থাৎ অন্য কারোর ব্যথায় ব্যথিত হবার কোনও দায় নেই। শুধুমাত্র দু’জন দু-জনের ব্যথায় ভোলিনি মলম বুলিয়ে ভুলিয়ে দেবো। দুনিয়া ভোগে যাক।
    এ-ই যে যুগলবন্দী ঘুপচি প্রেম, এর স্থায়িত্ব সম্মন্ধে কেমন যেন সন্দেহ জাগে, তাই না?
    তুমি আমার আমি তোমার মার্কা এই একবগগা প্রেম, ভ্যানিশ হতে খুব বেশি সময় নেয় না। তুমি আমির ন্যাকামি তখন ঘোর কাটিয়ে রণংদেহী। লাগ লাগ ভেলকি লাগ।
    এবার একঘেয়েমির পালা। সেই একঘেয়েমির দমবন্ধ দশা কাটাতে তৃতীয় কারোর উপস্থিতি চাহিদা তুঙ্গে উঠতে লেগেছে।
    সেইসময় ও-ই শ্যামল মিত্রের গান, মেশিনগান হয়ে বুকে শেল হয়ে বিধছে।

    বেশ, ধরা গেল ইচ্ছে হয়ে যে ছিল মনের মাঝারে সে সশরীরে এসে গেল এই ধরাতলে। এইবারে অনিবার্য ভাবেই যত প্রেম ভালোবাসা ভালোলাগা, উউম আউম চুউম চাউম সব গিয়ে জড়ো হলো সেই নবাগতের চারপাশে। এখন তাকে ঘিরেই যাবতীয় সব। ব্যথাও সেখানে সুখও সেখানে।
    তাহলে শ্যামল মিত্রের গানের সেই গদগদ বাণী “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর” তার কী হবে?
    খেলাঘর এখন তৃতীয় প্রাণীর কব্জায়। জীবনের খেলাঘর এখন রাতজাগা আঁতুড়ঘর।
    মনের লুকোনো কুঠুরিতে চাপা অনভিজ্ঞতার আক্ষেপ মাঝেমাঝেই সংলাপ হয়ে বেরিয়ে আসছে,
    “দু’একজন বয়স্ক কেউ থাকলে ভালো হতো। ওরা সব জানে বোঝে কিনা।”
    পুনরায় প্রমাণ হলো অভিজ্ঞতা বড়ই মহার্ঘ্য।
    জীবনে চলার পথে অপরিহার্য। ভালোবাসায় না হোক স্বার্থের চাহিদায় তো বটেই।

    “জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভ`রে তুলবো।”
    হায় রে, বাস্তব বড়ই কঠিন, নিষ্ঠুর। কপোত-কপোতীর মোহ ভাঙা জটিল হিসেবি মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দু-একটি অতি পরিচিত অবহেলিত ভাঙ্গাচোরা মুখের ছবি।
    “দেখা হয় নাই দুই পা ফেলিয়া ”
    হায় ভবিতব্য, যারা ছিল তারা নেই।
    যে ছিল না সে শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।
    অজানা ভবিষ্যৎ-এর দূত কাঁদছে।
    এখন গাওয়া যেতেই পারে গানের অন্তরা,
    “শুধু বলো তুমি কি গো জানতে
    যেতে যেতে এই পথ
    শেষ হবে কোনও মরুপ্রান্তে?”

  • গল্প

    গল্প- ভূতচতুর্দশীর ফাঁড়া

    ভূতচতুর্দশীর ফাঁড়া
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    সেদিন ভূতচতুর্দশীর মাঝরাত্তির। চারদিক মিশমিশে কালো অন্ধকার। চালতা গাছের ডালে সরু লিকলিকে বিদঘুটে আকৃতির লম্বাটে ঠ্যাং ঝুলিয়ে যে বসেছিল সে মামদোভুত।
    মদন, আজ বাজারে চিকেন বিক্রি করে বেশ ভালোই রোজগার করেছে। অন্যসময় মেরে কেটে হাতে থাকে শ তিনেক। আজ এক্কেবারে হাজার। সুতরাং মনে খুশির বান। সেই খুশি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে গিয়ে এতখানি রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি মদন।
    বাড়িতে বউ মেয়ে আর মা। সংসারে পুরুষ এই একজনই, মদন। বাড়িতে সবাই তাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলে। বিশেষ করে সাত বছরের মেয়ে মানু। সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা শেষ করে বাবার সঙ্গে খেলতে, গল্প শুনতে ভারী ভালো লাগে মানুর। ভুতের গল্প হলে তো কথাই নেই। মদন তাই পারতপক্ষে দেরী করে না, কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরে। কিন্তু আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
    আড্ডায় একবার জমে গেলে বেরিয়ে আসা খুবই মুশকিল। আসলে আড্ডা ব্যাপারটাই এমন। কেমন যেন নেশা লেগে যায়। সবকিছুই যেন মূল্যহীন অপাংক্তেয় হয়ে যায় এই জমে যাওয়া আড্ডার কাছে।
    আগামীকাল কালী পুজো। মানুর আবদার মেটাতে আতসবাজি কিনেছে মদন। তুবড়ি রঙমশাল ফুলঝুরি চড়কি। মানু নিশ্চয় এগুলো দেখবে বলে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। অভিমান করেছে বাবার ওপর।
    মদন জোরে জোরে পা চালিয়ে চলতে শুরু করলো। সামনের মাঠটা পেরোলেই বাড়ি।
    মাঠটা বড্ড অন্ধকার। জনমানবহীন। সঙ্গে আলো নেই। আন্দাজেই পথ পেরতে হবে। যদিও চেনা পথ তবুও অন্ধকার বাধা সৃষ্টি করবেই।
    ঠিকই তাই হলো। তাড়াতাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ সজোরে ঠোক্কর লাগলো।
    না না পায়ে নয়। কপালে। ঠকাস করে কী যেন একটা শক্ত মতন কপালে ঠুকে গেল।
    ব্যথা পায়নি তেমন কিন্তু বেশ অবাক হলো। মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো মদন কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। চালতা গাছ আছে ঠিকই কিন্তু তার কপালে আঘাত করতে পারে এমন কিছুই নেই। তাহলে কী হলো ব্যাপারটা?
    মদনের বুক ছ্যাঁক করে উঠলো। মনে পড়ে গেল মাঠের মাঝখানে এই চালতা গাছে বাস করে মামদো ভুত। তার ওপর আজ ভূতচতুর্দশী। মা, বউ দুজনেই আজ সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরতে বলেছিল বারবার।
    ঠিক তখনই একটা ভাঙা ভাঙা গলায় কে যেন বললো,
    “তোর কপালে যেটা ঠুকে গেল, সেটা আমার পায়ের বুড়ো আঙুল।”
    মদন হতবুদ্ধি হয়ে এলোমেলো তাকিয়ে বক্তার হদিস করতে না পেরে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে বললো, “কে তুমি?”
    উত্তর এলো,”আমি মামদো। মামদো ভুত।”
    মদনের শরীরে কাঁপুনি এলো। হায় হায়, আজ বুঝি রেহাই নেই। শেষমেশ ভুতের পাল্লায়।
    মদন আর কিছু ভাবতে পারে না। দে ছুট।ছুটে পালানোই বাঁচার একমাত্র পথ। মামদোও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও ছুট লাগালো তবে পায়ে পায়ে নয়, উড়ে উড়ে। উড়ছে আর বলছে,
    “দাঁড়া মদন কথা আছে। ভয় নেই। তোর ভালোর জন্যেই বলছি দাঁড়া নইলে মরবি।”
    মদন বুঝলো ভুতের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। তার চেয়ে কি বলতে চায় শোনাই যাক। যা আছে কপালে। মদন দাঁড়িয়ে পড়ে ভোঁস ভোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
    “বেশ, দাঁড়ালুম, নাও কী বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেলো আমার তাড়া আছে।”
    মামদো ফ্যাক ফ্যাক করে ভুতের হাসি হেসে বললো,
    “তাড়া আছে? কিন্তু তোর যে ফাঁড়া আছে। তার কী হবে?”
    মদন চোখ কপালে তুলে বললো,
    “ফাঁড়া! কিসের ফাঁড়া কেন ফাঁড়া?”
    মামদো আবারও একটু হেসে নিয়ে বললো,
    “আরে সেই কথা বলবো বলেই তো সন্ধ্যে থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছি। যদিও একথা তোকে জানাবার দায়িত্ব আমার নয়, তবুও কে জানে কেন মনে হলো তোকে সাবধান করে দিই। তাই বলছি শোন, তোর সামনে সাংঘাতিক বিপদ। এখন কী করে কী করবি তাই বল।”
    “আরে দূর মশাই কি বিপদ তাই জানলুম না, কী করবো মানে কী? একটু গুছিয়েগাছিয়ে বলো তো দেখি যাতে আমি সহজ করে বুঝতে পারি।”
    “শোন তবে ভালো করে। তোর কপালে ফাঁড়ার খাঁড়া ঝুলছে। তুই যদি আজ রাতে পথে ঘাটে রাত কাটাস তাহলে নির্ঘাৎ অপঘাতে মৃত্যু হবে তোর।”
    “এতো ভারী মুশকিল। তুমি কি আমাকে পাগল ভেবেছ না-কি সন্ন্যাসী? আমার ঘর পরিবার থাকতে হঠাৎ করে পথেঘাটে থাকতে যাবো কোন দুঃখের কারণে শুনি? আমি এক্ষুনি বাড়ি যাবো।”
    “তা নিশ্চয়ই যেতে পারিস কিন্তু তুই বাড়ি গেলে তোর বউ আজ রাতেই মরবে। এবার ভেবে বল কী করবি? বউয়ের মৃত্যুর কারণ হবি? যদি তাই চাস তবে যা ঘরে। বউ মো’লে তোর সংসার সামলাবে কে, বাচ্চা মেয়েটার কী হবে, এই বয়সে সে মাতৃহারা হবে শুধু তোর জন্যে। পাপের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে সারাজীবন, পারবি?”
    “ওরে বাবা, এতো একেবারে বিচ্ছিরি ব্যাপার। না না ধুস, এরকম হয় নাকি? সব মিথ্যে কথা। আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাবার জন্যে এইসব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছো।
    কি ঠিক কি-না?”
    “মোটেই না। ভুতেরা মিথ্যে কথা বলে না এসবই তোর ললাটলিখন। এই ভূতচতুর্দশী রাতে এমনই হবার ছিল তোর। যাকগে, এখন বল কী করবি? মানে, মরবি না-কি বউকে মারবি?”
    মদন মাটিতে উবু হয়ে বসে দু’হাতে মাথা চাপড়াতে লাগলো। সে কিংবা বউ যেই মারা যাকনা কেন, তাদের সাধের সংসার ছারখার হয়ে যাবে। বুড়ি মা, বাচ্চা মেয়ে, কে দেখভাল করবে তাদের? খুব কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু এখন কান্নাকাটি করলে সময় থেমে থাকবে না। রাত শেষ হবার আগেই একটা ফয়সালা করে ফেলা চাই নইলে মহাবিপদ। ছোট্ট মানু`র মুখ চোখের সামনে ভাসছে।
    হঠাৎ মদন বললো,
    “আচ্ছা মামদো ভুত ভাই, আমি শুনেছি যেখানে বিপদ আছে সেখানেই বিপদ মুক্তির উপায় আছে। তাই যদি সত্যিই হয় তাহলে নিশ্চয়ই এর থেকে বেরুনোর উপায় আছে।
    ওহে ভুত মশাই, সবকিছু আগাম জানিয়ে তুমি যখন এতো বড়ো উপকার করলে, তখন আরও একটু উপকার করে দাও বাবা মামদো। এই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা করে দাও ভাই আমার।”
    “না রে মদন পুরোপুরি মুক্তির উপায় নেই। কাউকে মরতেই হবে।”
    মদন এই কথায় খুব রেগে গেল, বললো,
    “ইয়ার্কি না-কি, মামদোবাজি পেয়েছো? মরতে হবে,‌ কেন মরতে হবে শুনি, এ কেমন ধারা বিচার, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ মরতে হবে, চালাকি পেয়েছো,, আমি মকদ্দমা করবো, তোমাকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়বো, ভুত ব’লে যা খুশি তাই করবে, দেশে আইন কানুন নেই ভেবেছো?
    রাগের মাথায় চিৎকার করে এতগুলো কথা বলে মদন হাঁপাতে লাগলো। মামদো তার এইসব কথা শুনে আবারও খানিকটা হেসে নিয়ে বললো,
    “ওরে মদন রাগ করে কী করবি বল। ভুত সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাছাড়া দ্যাখ, তোর কপালে তো আমি কিছু লিখিনি। যা লেখালিখি করবার সে সবই ঐ তেনাদের হাতে। আরে বাবা আমিও তো এককালে তোদের মতই ছিলুম। এখন মরে গিয়ে কর্মদোষে মামদো ভুত হয়ে গেছি আমার কী দোষ? যাক, মাথা ঠান্ডা করে শোন।
    ফাঁড়া কখনও বলেকয়ে আসেনা। তবু তো তোর কপাল ভালো রে, আমার থেকে সব জেনে নিয়ে পছন্দ মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিস। নইলে এতক্ষণে কী হতো একবার ভেবে দ্যাখ। শোন তুই বা তোর বউয়ের মৃত্যু যদি না চাস তাহলে তোর মা’কে মরতে হবে।”
    মদন আর্তনাদ করে ওঠার মতো বললো,
    “অসম্ভব, এ হতে পারে না। আমি নিজের প্রাণ বাঁচতে মা”কে হত্যা করার পাপ কিছুতেই করতে পারবো না। তারচেয়ে আমি মরবো সে-ও ভালো।”
    মদন হাউ হাউ করে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো। মামদো তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
    “দ্যাখ মদন, ফাঁড়া সর্বদাই নিষ্ঠুর নির্মম। সে ভালো মন্দের হিসেব রাখে না। ছোট বড়ো শিশু বৃদ্ধ জ্ঞান করে না। তাই তোর মেয়েকে…”
    মামদোর কথা শেষ হলো না। মদন একটা হেঁচকি তুলে ধপ করে পড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
    “আমার সব যাক, যথাসর্বস্ব যাক, ইহকাল পরকাল সব সব যাক শুধু আমার প্রাণের অধিক মানু থাক। সে বিনা এ জীবনের কী দাম। আমার মরণ ভালো। তাই হোক আমার মরণ হোক, ঈশ্বরের দেওয়া ফাঁড়ার অবসান হোক।”
    মামদো আবারও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
    “বেশ, তাহলে আরও একটা উপায় দিচ্ছি, এতে নিশ্চয়ই তোর আপত্তি থাকবে না। বরঞ্চ খুশিই হবি।”
    “কি উপায়?”
    “তোর সবচেয়ে বড়ো শত্রু যে তাকে মরতে হবে। কি রাজি?”
    মদন এখন একটু সামলে উঠেছে তবুও ধরা গলায় বললো,
    “সত্যি কথা বলতে আমার কোনও শত্রু নেই। আমার শত্রু বলতে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সে আমি নিজে। নইলে আমার ভাগ্যে এমন ভয়ানক ফাঁড়া লেখা হবে কেন? তবুও আমার অজান্তে যদি আমার কোনও শত্রু থেকেও থাকে, আমি কিছুতেই নিজের স্বার্থের কারণে তার মৃত্যু কামনা করতে পারি না। কেননা তা অমানবিক, অধার্মিকতা।”
    “তাহলে এখন কী করনীয়?”
    “হে মামদো, ভেবে দেখলাম আমার কর্মফল আমারই ভোগ করা উচিৎ। তাই আমি সারারাত পথেঘাটে থেকে অপঘাত মৃত্যুবরণ করতে চাই।”

    এখন কার্তিক মাস। হেমন্তের হিমেল বাতাসে গা শিরশির করে। হালকা শীতের পরশ।
    মামদো এবার মোলায়েম স্বরে বললো,
    “জানিস তো নিশ্চয়ই এই ভূতচতুর্দশী তিথি আমাদের মানে ভুতেদের বড় খুশির দিন। তাই মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম একজন মানুষকে আমাদের সেই খুশির একটু ভাগ দিয়ে যাবো। কিন্তু বড্ড বেকায়দায় পরলাম মানুষ খুঁজতে গিয়ে। প্রতি বছর এই ভূতচতুর্দশীতে পৃথিবীতে আসি আর মানুষ খুঁজে বেড়াই। আজও সন্ধ্যে থেকে অনেককেই পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝলাম, কেউ স্বার্থপর, কেউ নির্মম নির্দয়, কেউবা ভয়ানক লোভী এবং মিথ্যুক। একমাত্র তোর মধ্যেই স্নেহময় পিতা, দায়িত্ববান স্বামী, মাতৃভক্ত সন্তান, মানবিক ক্ষমাশীল অজাতশত্রু মানুষের উজ্জ্বল সন্ধান পেলাম।”
    মদন তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিয়ে বললো,
    “ওঃ তারমানে তুমি এতক্ষণ আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলে?”
    “পরীক্ষা না নিলে আসল নকল বুঝবো কেমন করে? তবে, পরীক্ষায় তুই পাশ।
    তাই তোর হাতেই দিয়ে যেতে চাই হীরে-জহরতের রত্ন ভান্ডার যা শতশত বৎসর ধরে আমি আগলে রেখেছি।”
    মদন অবাক হয়ে বললো,
    “আমি? মানে আমাকে দেবে! কিন্তু কেন?”
    “প্রতিজ্ঞা করে ছিলুম সত্যিকার মানুষের সন্ধান পেলে, তার হাতে সঁপে দেবো।
    কয়েক `শ বছর সেই মানুষ খোঁজার কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা হলো,
    মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। মানুষের মতো দেখতে আর মানুষ এককথা নয়।
    যাক এতদিনে আমার মুক্তি হলো। এই নে , যত্নে রাখিস। ভালো কাজে ব্যবহার করবি আর মনকে অহংকার মুক্ত রাখবি।

    মামদো ভুত বাতাসে মিলিয়ে গেল। মানুষ মদন ঐশ্বর্যের কলসি মাথায় নিয়ে ঘরমুখো হলো।

  • গল্প

    গল্প- অভিজ্ঞতা

    অভিজ্ঞতা
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    কলেজ থেকে ফিরছি। বাস কন্ডাকটর টিকিট চাইতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি পকেট ফাঁকা। অথচ তা হবার কথা নয়। মানিব্যাগে মানি থাকুক না থাকুক, বাস ভাড়ার পয়সা রাখতেই হয়। ওটা পাড়ানির কড়ি।
    সেই সময় বাস ভাড়া সম্ভবত পঁচিশ পয়সা বা তার আসপাশে কিছু একটা ছিল। এখন আর মনে নেই ।
    এ পকেট ও পকেট হাতড়ে বিফল হয়ে কন্ডাকটরকে বললাম
    “ভাই, কিছু মনে কোরো না। টিকিটের পয়সা দিতে পারবো না। আমার পকেটমারি হয়েছে। মানি শুদ্ধ মানিব্যাগ হাওয়া। স্যরি ভাই”
    মাঝ বয়সী কন্ডাকটর মুচকি হেসে বললো
    “কোনো ব্যাপার নয়। তুমি কলেজ ষ্ট্রীট নামবে তো? ভাড়া কালকে দিয়ে দিও।”
    ভীষণ রকম অবাক হলাম। ও আমাকে চেনে নাকি? অবিশ্যি প্রায় আড়াই বছর একই রুটে সকল বিকেল যাতায়াত করছি। হয়তো মুখ চেনা। যাইহোক এমন অযাচিত প্রস্তাব সাগ্রহে ধন্যবাদ সহযোগে গ্রহণ করলাম, নইলে শোভাবাজার থেকে কলেজ ষ্ট্রীট হেঁটে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
    তবে মজা লাগছিল এই কথা ভেবে, বাসে ধার বাকী কারবারের প্রথম খদ্দের সম্ভবত আমিই। কেননা বাসে টিকিট ফাঁকির গল্প অনেক শুনেছি কিন্তু ধার বাকী এক্কেবারে আনকোরা অভিজ্ঞতা।
    অবিশ্যি অবাক হবার আরও খানিক বাকি ছিল।
    গন্তব্যস্থলে নামতেই সেই কন্ডাকটর গলার স্বর খাটো করে বললো,
    “তোমার পকেট মারা হচ্ছিল সেটা আমি দেখেছি। স্টুডেন্টদেরও ছাড়েনা হারামখোর গুলো।”
    হতবাক হয়ে বললাম-
    “সে কী! তাহলে তখনই বললেন না কেন?”
    পানের ছোপ ধরা দাঁতওয়ালা মুখে অদ্ভুত এক হাসি ছড়িয়ে সে বললো
    “আরে ভাই, এই পথে আমাকে সকল থেকে রাত পেটের ভাত যোগাড়ের জন্যে দৌড়ে বেড়াতে হয়। চোর গুন্ডাদের সঙ্গে পেরে উঠবো না। ঘরে পরিবার আছে, তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।”
    বাস চলে গেল তার লক্ষ্যে। বাড়ি এসে ভাবছিলাম, আর মাত্র কয়েক মাস তারপরই কলেজের পাঠ শেষ হয়ে যাবে।
    কিন্তু জীবনের বাস্তব শিক্ষার বোধকরি কোনও শেষ নেই। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।

  • গল্প

    গল্প- বাঘের নাতি বাঘ

    বাঘের নাতি বাঘ
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

     

    বাঁদরিকে পেয়ারা গাছে বসে পেঁপে খেতে দেখে বাঘ বললে,
    কী হলো ব্যাপারটা। পেয়ারা গাছে পেঁপে আসে কোত্থেকে?
    বাঁদরি চিঁ চিঁ করে খানিকটা হেসে নিয়ে বললে,
    তোমার মাথা আমার মুন্ডু। বুদ্ধু তো বুদ্ধুই রয়ে গেলে। আরে বাবা, পেঁপে গাছের পেঁপে পেয়ারা গাছে বসে খাচ্ছি। এটা শেষ করেই পেয়ারার দফারফা করবো কিনা তাই।
    বাঘ বললে, আমাকেও খানকয়েক পাকা পাকা হলদে পেয়ারা দিস তো, খাবো।
    বাঁদরির হাত ফসকে আর একটু হলেই আধ খাওয়া পেঁপেটা পড়ে যাচ্ছিলো। কোনরকমে সেটা সামলে নিয়ে বললে,
    বলো কি! তুমি খাবে পেয়ারা? সব্বোনাশ করেছে।
    -কেন সর্বনাশ কেন ?
    – সব্বোনাশ নয় ; তুমি মাংস ছেড়ে ফলমূল খাওয়া ধরলে আমরা খাবো কী?
    – না রে না। আমি মাংস খাওয়া ছাড়িনি।মাংস আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বলেই ফোঁসফোঁস করে খানিকটা কেঁদে নিলে।
    -বাঁদরি কিছু একটা সন্দেহ করে তাড়াতাড়ি লম্ফঝম্প মেরে গাছের আরও খানিক ওপরে চড়ে গিয়ে বললো,
    দ্যাখো বাপু কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। তুমি সত্যিই বাঘ তো নাকি ছিনাথ বহুরুপী? শুনতে পাই সে নাকি বাঘ সাজতে ভারী ওস্তাদ। বাড়িশুদ্ধু লোককে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছিল। ওদের বাড়ির ছেলে মেজদা । সে নিজেকে খুব মাতব্বর মনে করতো। সেও ও-ই বহুরুপীর সাজা বাঘকে সত্যি বাঘ ভেবে ভয়ে সে কী কান্ড!
    `”আঁ আঁ করিয়া সেজ উল্টাইয়া চিৎ হইয়া পড়িলেন, আর খাড়া হইলেন না।” ঠাকুর্দার কাছে শুনেছিলাম।
    বাঘ বললে,
    হ্যাঁ রে ”সেজ” কী জিনিস ?
    বাঁদরি পাঠশালার গুরুমশাই এর মতো সবজান্তা মার্কা মুখ করে বললে,
    এ মা, তাও জানো না । সেজ মানে হলো পিদিম। ওতে তেল ঢেলে আলো জ্বালানো যায়।
    বাঘ হালুম করে অকারণ একটা হাড় কাঁপানো ডাক ছেড়ে নিয়ে বললো,
    না না। আমি সত্যিকার বাঘই বটে। চেয়ে দ্যাখ, এই আমার ল্যাজ। এক্কেবারে আস্ত। পাক্কা সাত হাত।
    ছিনাথ বহুরুপীর খড়ের ল্যাজ তো মেসোমশাই কাটারি দিয়ে কাটিয়ে দিয়ে ছিল। মনে নেই ?
    বাঁদরি গোলগোল চোখ বারকয়েক পিটপিট করে নিয়ে বললে,
    মনে আছে, তবে মেসো নাকি পিসে ঠিক মনে নেই। তুমিও জানো দেখছি গপ্পোটা, যাকগে বাদ দাও সে কথা। এখন ঠিকঠাক বলো তো তোমার মতলব মানে, কি বলে, ব্যাপার খানা কী?
    বাঘ সোজা হয়ে বসে, থাবা দিয়ে নাক চুলকে বললে,
    ব্যাপারটা হলো, গরু মোষের মোটকা মোটকা হাড়গোড় চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতগুলোর সব বারোটা বেজে গেছে।
    দু’চারটে খসে পড়েছে বাকিগুলো নড়বড় করছে। শুধু কি তাই, জ্বালা যন্ত্রণার ঠ্যালায় ভালো করে ঘুমোতেও পারছিনা। খিদে খুব। কিন্তু উপায় কী। দাঁত ছাড়া খাবো কীভাবে ? দুদিন জল খেয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু আর যে পারিনে।
    পাকা নরম পেয়ারা যদি কোঁৎ করে গিলে নেওয়া যায়, তাই বলছি,
    বাঁদরি এবার সরসর করে বেশ খানিকটা নিচে নেমে এসে বললো,
    কিন্তু আমি যেন কোথায় শুনেছিলাম, বাঘ না খেয়ে মরবে তবুও ঘাস খাবেনা…
    বাঘ মাটিতে পা ঠুকে বললো,
    আরে দূর, যত্তসব বাজে কথা। কেন খাবে না, ঠ্যাকায় পড়লে সব খাবে। ঘাস কি অখাদ্য নাকি কুখাদ্য? এই-যে আমি এদ্দিন ধরে যাদের খেয়েছি, খেয়ে বেঁচেছি, এতবড় বনবাদাড় সাফ করে ফেলেছি, তারা তো সব্বাই ঘাস পাতাই খেতো, তবে?
    বাঁদরি সব শুনে বললে,
    তবে আর কি; এইতো সমাধান হয়েই গেল। নাও, নিশ্চিন্ত মনে ঘাস পাতা খেতে শুরু করে দাও।
    বাঘ বিরক্তি দেখিয়ে বললে,
    বোকার মতো কথা বলছে দ্যাখো, আরে, ঘাস পাতা খেতে হলে তো চিবিয়ে খেতে হবে। চিবোতে গেলে দাঁতের দরকার। আমার সেখানেই যে অসুবিধে এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছিস না কেন?
    বাঁদরি পটপট করে গোটাকয়েক ডাঁসা পেয়ারা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে কচ কচ করে কামড় বসিয়ে বললে,
    বলছি কি আর সাধে, বলছি তোমার ভালোর জন্যেই।
    বাঘ কপাল কুঁচকে বললে,
    কী রকম? ঠিক বুঝলাম না তো!
    বাঁদরি আধ খাওয়া পেয়ারাটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললে,
    তুমি তো হাড়গিলে পাখি নও, যে গলাটা আকাশের দিকে করে কোৎ করে গিলে নেবে। তোমার কি সেই অভ্যেস আছে? গিলতে গিয়ে পেয়ারা যদি গলায় আটকে যায়, তখন কী হবে? দম আটকে মরবে যে। বাঘ হতাশ গলায় বললে,
    তাও তো বটে। জীবনের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। কী উপায় বলতো?
    -উপায় একটা ছিল, কিন্তু, সে কিছুতেই রাজি হবেনা। উহুঁ, নাঃ।
    বাঘ খানিক ভড়কে গিয়ে বললে,
    কী সব বলছিস, কিছুই বুঝছিনা।
    ঠিক তখনই বাঁদরির হাত ফসকে একটি বড় পেয়ারা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। বাঁদরি তাড়াতাড়ি গাছ থেকে মাটিতে নেমে সেটাকে কুড়িয়ে নিলে কিন্তু আর গাছে চড়ে বসলো না। মাটিতে বসেই ডাঁসা পেয়ারা খেতে খেতে বললো,
    সে অনেকদিন আগের কথা। ঠাকুর্দা কিংবা ঠাকুমা, কার কাছে যেন শুনেছিলাম,
    তোমাদেরই বংশের কে যেন, একবার মাংসের হাড় গলায় ফুটে মরতে বসে ছিল। সারসকে বলেছিল তার লম্বা গলা বাঘের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে হাড়খানা বের দিতে। কিন্তু সারসের সাহস হয়নি বাঘের মুখের ভেতর গলা ঢোকাতে। ক্যাঁক করে কামড় দিলেই তো সব ফর্সা।
    বাঘ তাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, সে এমন বেইমানি কখনোই করবেনা।
    বাঘ এতটুকু শুনেই বললো,
    হ্যাঁ রে বাবা জানি। আমার দাদু বাঘটা মোটেই ভালো ছিলো না। উপকারীর মর্যাদা দিতে জানতো না। নইলে এমন বেইমানি কেউ করে। ছি ছি। দাদুটা আমাদের বংশের কুলাঙ্গার। উপকারী সারসের গলা চিবিয়ে, চিরকালের জন্যে আমাদের নাম খারাপ করে দিয়ে গেছে। বড্ড বাজে ব্যাপার। ঠিকই বলেছিস, সেই থেকে কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না।
    কথা বলতে বলতে বাঘ একেবারে বাঁদরির নাগালের মধ্যে এসে গিয়েছে।
    জিভের গড়িয়ে আসা জল, সুরুৎ একবার টানাও হয়ে গেছে।
    থাবা বাড়ালেই বাঁদরি যাবে বাঘের পেটে।
    ঠিক তখনই বাঘের মাথায় কে যেন খুব জোরে আঘাত করলো।
    বাঘ, বাবা গো বলে রক্তারক্তি হয়ে ছিটকে পড়লো। আর সেই ফাঁকে সারস সাঁইসাঁই করে উড়ে গাছের মগডালে বসে চিৎকার করে বাঁদরিকে বললো,
    ওহে বোকা বাঁদরি, এখনো ওখানে বসে আছো কোন আক্কেলে? গাছে ওঠো শিগগিরই , নইলে মরবে।
    আচমকা ঘটনায় বাঁদরির সত্যিই আক্কেলগুড়ুম হয়েছিল। সারসের কথায় হুঁশ ফিরলো। তাড়াতাড়ি লম্ফঝম্প মেরে গাছের মগডালে সেও চড়ে বসলো।
    সারস বললো,
    এবার শয়তানের নাতি বুঝুক, সারসের নাতির লম্বা ঠোঁটের জোর কতো । হেঁ হেঁ হেঁ,
    কথাগুলো বলেই সে যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনই আবার সাঁইসাঁই করে উড়ে কোথায় চলে গেল, তার হদিশ কেবল সেইই দিতে পারবে।
    ঘটনার আকষ্মিকতায় বাঁদরির চোখ দুটো ততক্ষণে বড়ো বড়ো পেয়ারার চেহারাকেও হার মানাচ্ছে।

  • রম্য রচনা

    রম্য- বনাম প্যাটন ট্যাঙ্ক

    বনাম প্যাটন ট্যাঙ্ক
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের লোকেরা জানতো না একদিন ছেঁড়া প্যান্টের যুগ আসবে।
    ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে শরীরের অসভ্য জায়গা ঢেকে ঢুকে বুক চিতিয়ে বলবে- এই দ্যাখ, এটা তোর চাইতে দামী।
    প্যাটন ট্যাঙ্ক যুগের স্মার্ট লোকগুলো
    হঠাৎ ক্যাবলাকান্ত হয়ে গিয়ে ছেঁড়া প্যান্টের ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে থাকবে আর মনে মনে বলবে,
    একি? কেন?
    কানের পাশে ফিসফিস করে কেউ একজন এক কানে রিং দুল পড়ে পানমশলার থুথু জমানো মুখে উচ্চারণ করে যাবে,
    একেই বলে সভ্যতা,চাঁদু। ফ্যাশন সভ্যতা।

    সভ্যতা কী। সহজ কথায় বলতে গেলে,
    মিছরি- সোজা হাতে ধরে খাও কিংবা বাঁকা হাতে। স্বাদ একই থাকবে, মিষ্টি।
    পাড়ার জনদরদী মিশুকে মিঠু বৌদি পেখম তোলা ময়ূরের মতো সেজেগুজে, ঝর্ণার মতো কলকল করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বান্ধবী তনুকে বললো- জানিস, কালকে ইউ টিউবে দারুণ একটা রান্না শিখলাম।
    -কি রে? উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে।
    -উচ্ছের বিরিয়ানি
    -এ মা, উচ্ছে দিয়ে, ভালো হবে? স্বরে সন্দেহের তিতকুটে গন্ধ ।
    মিঠু বৌদি ঠোঁট বাঁকিয়ে চ্যালেঞ্জ নেবার ভঙ্গিতে বললো- হবে না মানে, ফাটাফাটি হবে। আমি তোকে করে খাওয়াবো।
    এসে গেল সেই চ্যালেঞ্জিং উচ্ছে বিরিয়ানি ডে। সন্ধ্যেবেলাই মিঠু বৌদি উড়ন্ত পাখির মতো উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে এক গামলা উচ্ছে বিরিয়ানি উপহার দিয়ে গেল।
    ডিনারের ব্যবস্থা পাকা। সুতরাং আজ তনুর রাতের রান্না নেই। সকালের চিকেন কারি ফ্রিজে রাখা আছে। গরম করে নিলেই হবে।

    যথাসময়ে ডাইনিং টেবিলে ইউ টিউবের বিশেষ বিরিয়ানি পরিবেশিত হলো। হায় হায়, এ কি হলো, ছি ছি ছি , এটা একটা খাদ্য! মানুষ খায়? গরুও ছোঁবে না।
    তনুর স্বামী ছুটে চলে গেল বেসিনে। ওয়াক থু ওয়াক থু করে ভালো করে মুখ ধুয়ে এসে বললো- তোমার সুন্দরী বান্ধবীকে বলে দিও। দুনিয়ায় বহু খাদ্য আছে, কিন্তু তার সবই মানুষের জন্যে নয়।
    ভাগ্যিস ঘরে খানিকটা মুড়ি ছিল। চিকেনকারি দিয়ে মুড়ি, খুব একটা মন্দ নয়।
    বোঝা গেল, যেখানে যা মানানসই সেটাই সভ্যতা। অন্যথায় ভোগান্তির একশেষ।

    প্যাটন ট্যাঙ্কের যুগে চোর আসতো রাতে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে।
    ধরা পড়লে রক্ষে নেই। বারোয়ারী ঠ্যাঙানি। মেরে লাট করে দেবে। শেষে কেউ একজন বীরপুরুষ কাঁচি দিয়ে মাথার চুল কোপচে খামচা করে কেটে, শেষ বারের মতো শাসানি দিয়ে ছেড়ে দেবে।
    যুগাবসানে চোর আসে দিনদুপুরের মধ্যিখানে। চুল নিজেই মেল পার্লার থেকে চোরছাঁট ছেঁটে তাতে ব্রাউন কালার লাগিয়ে দেবানন্দ স্টাইলে বেঁকে বেঁকে এসে ক্লায়েন্টের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে, গালে ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে, পেটের কাছে সেই জায়গায় দেশীগান ঠেঁসে ধরে বলে,
    কী আছে বের করে দে..শিগগির।
    ক্লায়েন্ট বেচারা কাঁপতে কাঁপতে ঘড়ি, ওয়ালেট, মোবাইল ফোন স্বহস্তে সর্বশান্ত হয়ে কেৎরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
    ছেঁড়া প্যান্ট স্টাইলিশ চোর যাবার আগে শেষ শাসানি দিয়ে গেল- বেশি বাড়াবাড়ি করলে দাদাকে বলে দেবো, ম্যাঁও সামলাতে পারবি না। তোর পুলিশ বাবা আমার জাঙ্গিয়া কেচে দেবে। যা ফোট।

    মলয় মল্লিক প্রতিদিনের মতো সেদিনও তার কাজের জায়গায় যাবেন বলে সদর দরজা খুলে বাইরে পা রেখেই চমকে এবং বমকে গেলেন। স্বাভাবিক।
    দরজার সামনে চাপচাপ রক্ত, মরা মুরগির ঠ্যাং, পালক ছত্রাকার হয়ে রয়েছে।
    একটি ছোকরা ছেলে, মোটা বেঁটে সাইজের কাঠের গুঁড়ির ওপর ফটাফট করে মুরগী কেটে বিক্রি করছে।
    মলয় মল্লিক রেগে কাঁই। মুরগী কাটা ছেলেটাকে তেড়ে গেলেন- আহাম্মক, আমার বাড়ির দরজায় মুরগী বেচার জায়গা বানিয়ে ফেললি? যাওয়া আসায় রাস্তা। যা খুশি তাই করবি, কী ভেবেছিস কী! হঠা,, হঠা সব এখন থেকে, এক্ষুনি সরিয়ে নে বলছি, নইলে..
    এইবারে মুরগী কাটা ছোকরা উঠে দাঁড়ালো। পরনে সেই ফ্যাশানের ছেঁড়াপ্যান্ট। গায়ে স্লিভলেস গেঞ্জি। সারাগায়ে রক্তের ছিটে। একেবারে নিখুঁত বুটিক ডিজাইন।
    -নইলে কী? বেশি ভাঁজবেন না। ব্যবসা করছি। কোনও চুরিচামারি করছি না। বেকার বাঙালির ছেলে। সৎ পথে করে খাচ্ছি। ব্যাগড়া মারবেন না।
    -শোনো শোনো, তোমাকে ব্যবসা করতে মানা করিনি। আমার দরজাটুকু ছেড়ে, যেখানে খুশি বসো।
    -দূর মশাই, দরজা দেখাচ্ছে। দরজা আপনার, তাই বলে কি কর্পোরেশনের ফুটপাতও আপনার? লে হালুয়া।
    কিচ্ছু সরবে টরবে না। যান তো, যা পারেন করে নিন। তারপর বুঝবেন আমি কে..
    লিখে রাখুন আমার নাম ডাব্বু। আট থেকে আশি সব্বাই একডাকে চেনে। দাদা এখানে বসতে বলেছে, ব্যাস। কোনও কথা হবেনা।
    ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গেছে। লাগদাই সিন। এসব ক্লাইম্যাক্স সিন দেখার রসিক পাবলিক প্রচুর ।
    মল্লিক মশাই এবার একটু নরম হয়ে বললেন- ঠিক আছে, বসো এখানেই বসো। ব্যবসা করো। কেউ তো মানা করছে না। তাই বলে মুরগী ? ঘরের সামনে! না না এটা কীভাবে সম্ভব? গন্ধে কেউ টিঁকতে পারবে এখানে? অন্য কিছু করো, ফুল বিক্রি করো।
    – হাসালেন দাদা। এই গুড্ডু বসে বসে ফুল বেলপাতা বেচবে ? হেঁ হেঁ,আপনি ফুলের গন্ধ শুঁকবেন? হেঁ হেঁ ,
    শুনুন স্যার, ছোটো মুখে একটা বড়ো কথা বলে রাখি, ভবিষ্যতে মিলিয়ে নেবেন।
    মা কালীর দয়ায় যদি এই মুরগির ব্যবসাটা জমে যায়, তাহলে আপনার পাশের বাড়িটাই আমি কিনবো। প্রতিবেশী। দুবেলা দেখা হবে।
    খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে আবারও বসে পড়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ করে মুরগী কাটতে শুরু করলো।
    মল্লিক মশাই রাগে ফুলছিলেন। মনে মনে বললেন- এটা যদি আমাদের সেই প্যাটন ট্যাঙ্কের জামানা হতো, তাহলে এক্ষুনি ও-ই মুরগির জায়গায় তোকে ফেলে ঘচাং ফু করে দিতাম শালা।

    কী আর করা যাবে। সেই প্যাটন ট্যাঙ্কও নেই তার দাপুটে গর্জনও নেই।
    এখন ফ্যাশনের ছেঁড়াপ্যান্টের মুখ ভ্যাংচানো দেখার যুগ। একটু মানিয়ে নাও গুরু। সহ্যশক্তি মহাশক্তি, মহাগুণও বটে। চিন্তা নেই। অনিয়ম টেঁকসই হয় না।
    দু’দিন বৈ তো নয়।

    (প্যাটন ট্যাঙ্ক একটি পুরাতন যুদ্ধাস্ত্র। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যবহার করে অসামান্য সাফল্য পেয়েছিল ভারতীয় বাহিনী)

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- বেনারসের রস

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    বেনারসের রস
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    একটা বিশাল হলঘর । তার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা অদ্ভুত দর্শন পিলারের উপর একটা বহুমূল্য হীরে রাখা আছে।
    সেই হীরে চুরি করতে হবে। কিন্তু সেই হীরে অবধি যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। অত সহজ নয় ব্যাপারটা।
    প্রত্যেক পদক্ষেপেই মৃত্যু হতে পারে , কেননা মেঝেতে ল্যান্ড মাইন পোঁতা আছে।
    মেঝেটা সাদা আর কালো টালি দিয়ে ঢাকা। কোন টালির তলায় মরণফাঁদ লুকিয়ে আছে কেউ জানেনা।
    কিছু টালি আছে নিরাপদ। কিন্তু চেনার উপায় নেই। সেই নিরাপদ টালির ওপর পা রেখে রেখে, সম্পুর্ণ আন্দাজে মানে কপাল ঠুকে এগিয়ে যেতে হবে সেই হীরের দিকে। রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য। একটু ভুলচুক হলেই মাইন ফেটে অবধারিত মৃত্যু ।
    দৃশ্যটা অমিতাভ বচ্চন অভিনীত একটি সিনেমার।
    কিন্তু কথা হলো বেমক্কা এই দৃশ্যের অবতারণা কেন ? সবুর করুন সব জেনে যাবেন ।

    নারায়নী , বেনারসে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন। সদ্যোজাত নাতনির মুখ দেখবেন বলে।
    দেখলেন। কী সুন্দর , কী সুন্দর । মা দুর্গার ছবি দেওয়া লকেট শুদ্ধ সোনার চেন নাতনির গলায় পরিয়ে দিয়ে চুমু খেয়ে আদর করলেন।
    বিনয় বাবুর চোখে জল। মুখে পবিত্র হাসি। বললেন,, দ্যাখো দ্যাখো কী সুন্দর হাসছে দ্যাখো।
    ওরে, এই ফোকলা মুখের ভূবণ ভোলানো হাসিটুকু দেখবো ব’লে ছুটে এসেছি। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন ,,
    বড়ো হও। অনেক অনেক বড়ো হও, মা আমার।

    পরের দিন সকালে , বেনারসী বেয়ান, নারায়ণী কে বললেন চলুন , বিশ্বনাথ দর্শন করে আসি , যাবেন?
    নারায়নীর খুব যে ইচ্ছে ছিল তেমন নয়। কেননা এর আগের বারে যখন এসেছিলেন তখন দর্শন করে গিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট মধুর নয়।
    সরু সরু গলি। গলির দুপাশে সার সার দোকান। নানান পশরা সাজানো। অসম্ভব ভীড়। সেই ভীড়ের মাঝে আচমকা হাজির হয়ে যায় ইয়া দশাসই বেপরোয়া পালোয়ান মার্কা ষাঁড় । সিং এর বহর দেখেই পিলে চমকে ওঠে।
    হাঁটার স্টাইল জমিদারের মতো। রাস্তা জুড়ে বসে থাকে মহারাজের মতো। খায় ভগবানের মতো , পরম আদরে ভক্তের প্রেম মিশ্রিত পবিত্র প্রসাদ।
    সেই প্রসাদ , উদরে রাত কাটিয়ে প্রভাতে কিংবা সন্ধ্যায় দেহ নিঃসৃত হয়ে বিপুল আকারে সশব্দে পথিমধ্যে যেখানে সেখানে পতিত হয়ে পড়ে থাকে।
    পথিক গন অবিচলিত ভাবে নিরুদ্বেগে সেগুলো পাশ কাটিয়ে নির্বিকার চলে যান। নিতান্তই স্বাভাবিক নিত্যকার ঘটনা।
    কিন্তু নারায়নী কোলকাতার বেহালার মেয়ে। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তার এবিষয়ে বিস্তর মানসিক ফারাক।
    তাই তাকে পথ চলতে হয় , ঐ অমিতাভ বচ্চনের সিনেমার মতো। সাবধানে , চোখ খোলা রেখে। একটু অন্যমনস্ক হলেই কেলেংকারী । পায়ে গোবরে মাখামাখি হয়ে বিদিকিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে।
    শুধু তো পা নয় শাড়ি বাঁচানোর ব্যাপারও আছে।
    শাড়ির নিচের দিকে ঐ জিনিস লেপ্টে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। তাই শাড়ি গুটিয়ে প্রায় হাঁটুর কাছ বরাবর।
    রাজকাপুর অভিনীত মেরা নাম জোকার ছবিতে একটা গান ছিল। সুপার হিট।
    এ ভাই জারা দেখকে চলো উপর ভী নেহি , নিচে ভী ডাঁয়ে ভী নেহি , বাঁয়ে ভী,,,,
    মনে মনে গুনগুন করতে করতে হাঁটলে নিরাপত্তা বোধ সজাগ থাকবে।
    তাই দেখে বেনারসী বেয়ান হেসে বাঁচেন না। বলেন ,,
    এ কি কান্ড। এইভাবে চললে তো রাত কাবার হয়ে যাবে।
    নারায়নী নাক সিঁটকে বলেন ,,,
    না রে বাবা ,, আমার বড্ড ঘেন্না করে।
    শুধু কি এই ? এরপর আছে বাইক যন্ত্রণা। সংকীর্ন গলির মধ্যে ভয়ংকর বিরক্তির কারণ এই বাইক।
    দুপাশে দোকান। সামনে দশাসই ষাঁড়। পিছনে বাইকের কর্কশ আওয়াজ।
    বিশ্বনাথের গলি তো নয় , যেন মহাভারতের চক্রব্যূহ । একবার ঢুকলে বেরিয়ে আসার জন্যে সাধ্যসাধনা করতে হবে ।
    প্রতি মুহূর্তে নারায়নীর মনে হচ্ছিল ,,
    হে বিশ্বনাথ , তুমি মাথায় থাকো। আমাকে রেহাই দাও। এই গলির যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্ত ক`রে দাও। আমি বাড়ি যাবো।

    মেয়ে ইন্দ্রাণী খুব খুশি। আনন্দে ডগমগ হয়ে বললো , মা তোমরা এসেছো খুব ভালো হয়েছে। হ্যাঁ গো মা , তোমরা এখন এখানে কিছুদিন থাকবে তো ?
    নারায়নী নাতনি কে, এ ডি অয়েল মাখাতে মাখাতে বললেন ,,,
    হ্যাঁ , কিছুদিন তো থাকতেই হবে। এতদূর থেকে এলুম। দু চার দিন না থাকলে হয়। তুইও একটু সামলে ওঠ।
    মেয়ে আস্বস্ত হয়ে বললো সেই ভালো। আমি তো এখন কিছুই করতে পারছি না। সব কাজ শ্বাশুড়ি একা হাতে করে।
    নারায়নী অবাক হয়ে বলেন ,,,
    সে কী ! তোদের কাজের লোক , কী যেন নাম? কুন্তী,,, সে কোথায় গেল ?
    শ্বাশুড়ি রান্নাঘরে ছিলেন। বেয়াই বেয়ান সেই কোলকাতা থেকে এসেছেন। আপ্যায়ন না করলে হয় ? কুটুম্বিতা জরুরি। তাই রান্নাঘরে ভীষণ ব্যাস্ত। পঞ্চব্যাঞ্জণের নিখুঁত আয়োজন।
    শেষের কথাটা কানে গিয়েছিল। বললেন ,,
    কুন্তীর কথা আরকি বলবো। সে ভেগেছে।
    বলেই মুচকি হাসলেন ।
    মেয়েরা মুচকি হাসিতে সর্বদাই রহস্যের গন্ধ পান। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
    নারায়নী , দুজনের চোখ মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন। কিছুই বুঝতে না পেরে বলেই ফেললেন ,,,
    কী ব্যাপার ?
    মেয়ে বললো,,
    ওসব শুনে তুমি কী করবে ? ওরা ওই রকমই, বাদ দাওতো।
    বাদ দাও বললেই কী বাদ দেওয়া যায় । কেমন যেন অন্যরকম স্মেল পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েদের মনে কৌতূহল বাসা বাঁধলে তার নিরসন না হওয়া অবধি ভাত হজম হবেনা। বিশেষ করে তাতে যদি স্ক্যান্ডালের গন্ধ থাকে।
    নারায়নী বললেন,, মানে প্রায় আবদার করে বললেন ,,,,
    শুনি না , কী ব্যাপার ?
    ইনু ( ইন্দ্রাণীর আদুরে নাম ) র শ্বাশুড়ি বেশ রসিক মানুষ । রসের কথা রসিয়ে বলতে পারেন । বললেন ,,,,
    আরে , ভেগেছে মানে নতুন নাগর জুটিয়ে তার সঙ্গে ভেগেছে।
    নারায়নী একটু কপাল কুঁচকে বললেন,,,
    যতদুর শুনেছিলাম ,,, মানে,, ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল না ?
    > ঠিকই শুনেছিলেন। তবে কী জানেন , ওর বরটারও একটা মেয়ের সঙ্গে নাকি লটঘট আছে ।
    ইনু মাঝখানে বলে উঠলো ,,,
    মেয়ে বলছো কেন , সেটাও তো একটা বউ।
    নারায়নীর ঠোঁটের কোণেও এবার দুষ্টু দুষ্টু মুচকি হাসি । বললেন,,,
    কী সব কান্ড রে বাবা । একটা সংসার করা বউ পালালো , আর একটা সংসার করা বরের হাত ধরে । লাও ঠ্যালা,,
    তিন জনেই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
    বেনারসী বেয়ান চোখ মোটকে চাপা গলায় বললেন ,,,
    জানেন তো আমাদের এই বেনারসে একটা প্রবাদ চালু আছে ,,,
    বেনারসে , সিঁড়ি , ষাঁড় আর রাঁঢ় থেকে সাবধান।
    আবারও বেদম হাসির ফোয়ারা ছুটলো ।

    বেনারসে এসে গঙ্গা আরতি দেখবেন না ?
    সে কী কথা ? চলুন চলুন,, খুব ভালো লাগবে। চলুন ।
    বেনারসী বেয়াই জোর তাগাদা দিলেন। কিন্তু বিনয় বাবুর তেমন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। বললেন ,,,
    না,, মানে,, শরীরটা ঠিক নেই। ঐ আসবার সময়ে ট্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়ে ,,
    > ও, হ্যাঁ , তাওতো বটে । ব্যাথা ট্যাথা কোথাও হয়েছে নাকি ?
    > হ্যাঁ , এই কোমরের কাছটা,,
    > এইরে যন্ত্রণা আছে নাকি ?
    > না,, তেমন কিছু নয়। তবে সামান্য একটু জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে ।
    > না না,, তবে তো অবহেলা করা চলে না, দাঁড়ান,, ডাক্তার কে একটা ফোন করি।
    বিনয় বাবু , অপ্রস্তুত হয়ে বললেন ,,,
    না না ,, আপনি ব্যাস্ত হবেন না। ও কিছু না। প্যারাসিটামল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
    > ও,, আচ্ছা ,, ঘরে কি প্যারাসিটামল আছে ? ওগো ,, একবার এদিকে আসবে ? তাড়াতাড়ি ।
    পড়ে গেলেন কীভাবে ? কী হয়ে ছিল কী?
    বিনয় বাবু পরলেন ফ্যাঁশাদে। সব কথা কী সবসময় সব লোককে বলা যায় ? নাকি সেটা শোভনীয় ?
    কীভাবে বলবেন জোরসে ছোটো বাইরে পেয়েছিল , বারবার টয়লেটে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে , হালকা হওয়া যায়নি। প্যান্টের চেন আটকে গিয়েছিল। তাকে সাহায্য করতে মিডল সিট থেকে তার স্ত্রী নিচে নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে গড়িয়ে পড়ে যান। তাকে ধরতে গিয়ে তিনি নিজেও পড়ে যান শুধু নয় প্যান্টের মধ্যেই কম্ম সেরে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলেন ।
    না না ধুস । এসব কেউ কুটুম বাড়িতে গল্প করে ? ছি ছি । প্রেশটিজের ব্যাপার।
    বিনয় বাবু , কথা উরিয়ে দিয়ে বললেন ,,
    না না ,, কিছু নয়। ওই একটু লেগে গিয়েছিল আরকি।
    বিষয় কে আরও হালকা করবার জন্যে বললেন , আরে বাবা বুড়ো হাড়ে এসব একটু আধটু হয়েই থাকে । বলেই হা হা ক`রে একাই হেসে উঠলেন। সেই কৃত্রিম হাসি তে প্রাণ ছিলোনা ।
    কিন্তু মজার কথা হলো , রিলে সিস্টেমের মাধ্যমে নারায়নী থেকে জামাই বাবাজী। জামাই বাবাজী থেকে ইনু। ইনু থেকে শাশুড়ী মা হয়ে শ্বশুর মশাই পর্যন্ত কথাটা রটে গিয়েছে । তবুও কেউ তা প্রকাশ করছেন না , নিতান্তই সৌজন্যের খাতিরে ।
    ভদ্রসমাজে এটাই রীতি , ভদ্রতা ।

    পরদিন দুপুরে সর্ষে ইলিশ দিয়ে ভাত খেতে খেতে পরম তৃপ্তির সাথে বিনয় বাবু বললেন বাহ চমৎকার। এখানে এমন ভালো ইলিশ পাওয়া যায় জানতাম না তো। দারুণ।
    বেনারসী শ্বশুর একগাদা হেসে মাছের কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন ,,,
    শুধু মাছের প্রশংসা করলে হবেনা মশাই । রাঁধুনির প্রশংসাও চাই ।
    বেনারসী শ্বাশুড়ি তৎক্ষনাৎ কথাটা লুফে নিয়ে বললেন,,,
    অবশ্যই । সকাল থেকে খেটেখুটে রান্না করলুম ,, তার একটা মূল্য নেই ?
    নারায়নী সেই কথায় সায় দিয়ে বললেন,,,
    ঠিকই তো। ইলিশ হোক বা যা-ই হোক , কাঁচা খেয়ে তো তারিফ করা চলেনা। তারিফ রান্নার। কী,, ঠিক কি-না ?
    বেনারসী শ্বশুর বাঁহাত দিয়ে ডাইনিং টেবিল চাপড়ে বললেন ,,
    ওয়েল সেড ম্যাডাম , ওয়েল সেড। চলুন , আজ সন্ধ্যারতি দেখতে যাবো সব্বাই মিলে। অবিশ্যি যদি মিষ্টারের শরীর ভালো থাকে ।
    নারায়নী , কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বললেন ,,,
    একদম । চলুন , সব্বাই যাবো।
    বেনারসী শ্বাশুড়ি বললেন ,,,
    না না,, ইনু বাচ্চাকে নিয়ে একা থাকবে কেমন করে। আমি যাবো না। তোমরা যাও। আমি তো বলতে গেলে প্রায় রোজই দেখি। ওনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। খুব ভালো লাগবে।

    খাওয়াদাওয়া শেষ করে , বিনয় বাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে পরলেন। এদিকে ওনাকে দেখতে না পেয়ে , নারায়নী একটু চিন্তিত হয়ে মেয়ে কে বললেন ,,,
    হ্যাঁ রে ইনু , তোর বাবা কোথায় গেল বলতো! তোকে কিছু ব’লে গিয়েছে?
    ইনু অবাক হয়ে বললো,,,
    কই,, না তো ! এই দুপুরবেলা,, কোথায় গেল?
    নারায়নী মাথা ঝাঁকিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন ,,
    ভালো লাগেনা বাবা। যত্তো ঝামেলা,, ওফ্ফ।
    ইনু হঠাৎ বললো , ও হ্যাঁ , মনে পরেছে। বাবা বলছিলো বটে , দুপুরে খাওয়ার পরে সকলকে চমকে দেবো।
    নারায়নীর চোখ গোলগোল হয়ে উঠলো ।
    বলিস কীরে? চমক! এ আবার কেমন কথা ! চমকে দেবার কী আছে , সারা জীবন ধরেই তো চমক আর ধমক দিচ্ছে । দ্যাখ কী খেল দেখায়। আর ভাল লাগেনা বাপু।
    নারায়নীর কথা শেষ হতেনা হতেই , হাতে সবুজ পাতায় মোড়া বড়ো আকারের একটা ঠোঙ্গায় গুচ্ছের খানেক বেনারসী পান নিয়ে হাসতে হাসতে বিনয় বাবু এলেন।
    নারায়নীর মেজাজ বিগড়ে ছিল। তারমধ্যে ওনাকে হাতে পানের খিলির ঠোঙ্গা নিয়ে হাসতে দেখে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। চিৎকার ক`রে বললেন,,
    কী ব্যাপার কী তোমার ,কাউকে কিছু বলা নেই , হুট ক`রে বাইরে চলে গেলে? অচেনা জায়গা,,, বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে শুনি,,।
    বিনয় বাবু সেসব কথায় কান না দিয়ে হঠাৎ নাচতে শুরু করে দিলেন , সঙ্গে গান,,,
    খাইকে পান বনাও রসওয়ালা
    খুল যায় বন্ধ আকল কা তালা।
    সেই নাচ গানের দাপটে সব্বাই সেখানে এসে হাজির। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দেখার পরে , বেনারসী বেয়ান, বেয়াইও নাচতে শুরু করে দিলেন। সঙ্গে তারস্বরে ডন ছবির গান। তাতে মিশলো অমিতাভ বচ্চনের নাচের স্টাইল।
    খাইকে পান বনাও রসওয়ালা,,,,
    নাচগান যেমন হঠাৎ শুধু হয়েছিল , তেমনই হঠাৎ করে শেষ হলো ।
    নারায়নীর ঠোঁটের আগায় মৃদু হাসির ঝিলিক বুঝিয়ে দিলো তিনিও খুব মজা উপভোগ করেছেন।
    বিনয় বাবু, সকলের হাতে ম ম করা গন্ধ ছড়ানো বেনারসী পান বিলোতে বিলোতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ,,
    যৌবনের বৃন্দাবন , বার্ধক্যের বারাণসী।
    জয় হোক জয় হোক বাবা বিশ্বনাথের।
    জয় হোক আমার নাতনির।
    নাতনির নরম মাথায় , পরম স্নেহের হাত রেখে আপ্লূত গলায় বললেন,,,,
    ওরে মা আমার , আবারও কতদিন পরে,
    মনে এতো সুখ , এতো আনন্দের অনুভূতি পেলাম।
    সে যে শুধু তোর জন্যে রে মা আমার ,, শুধু তোর জন্যে ।
    শেষের কথা গুলোর মধ্যে কেমন যেন মন পাগল করা আবেগ লুকিয়ে ছিল , তাই
    বিনয় বাবুর গলা সামান্য কেঁপে উঠল । সেই আবেগের দোলা ছড়িয়ে পড়লো সবখানে।
    সকলেরই চোখের কোল চিকচিক করছিল , আনন্দে ।।

  • রম্য রচনা,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- বেহালা টু বেনারস

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।। 

     

    বেহালা টু বেনারস
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    বেহালা টু বেনারস। এটাকি পাশের পাড়া, যাবো বললেই অমনি হুট ক`রে যাওয়া যায় ? সবেতে বাড়াবাড়ি ।
    ছেলে কুন্তলের মেজাজি মার্কা কথা শুনেও বিনয় বাবু বিনীত সুরে বললেন ,, আহা,,রাগ করছিস কেন ? এমন কিছু বিদেশবিভুঁই তো নয় । বেনারস। প্লেনে মাত্র কিছুক্ষণের ব্যাপার। ফস ক`রে চলে যাবো।
    টাকা একটু বেশি খরচ হবে , এ ই যা,, তা যাক। টাকা বড়কথা নয়। আসলে আমার আর তর সইছে না।
    শিগগির শিগগির যেতে হবে রে।
    নারায়নী দেবী এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন , এবার তিনি ঝলসে ওঠে বললেন,,, তর সইছে না , ফস ক`রে চলে যাবো,, আহা রে,, কী সখ,,
    খালি নিজেরটা বোঝে। আরও যে মানুষ আছে , তারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে সে দিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই ওনার।
    বিনয় বাবু বুঝলেন , টার্গেট তিনিই।
    তাই খানিকটা অবাক হয়েই বললেন,, মানে,, এ কথার মানে কী?
    নারায়নী দেবী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ছেলে কুন্তলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার নাকের কাছে তর্জনী তুলে তর্জন ক`রে বললেন,,, খবরদার যদি প্লেনের টিকিট কেটেছিস, দেখিস আমি কী করি। যাওয়া ঘুচিয়ে দেবো।
    বিনয় বাবুর অবাক হবার ঘোর কাটছে না। বললেন ,, আরে বাবা ব্যাপারটা কী ? প্লেনে কী হয়েছে ? অসুবিধে কী?
    নারায়নী আরও ক্ষেপে গিয়ে বললেন,,,,
    ন্যাকামি হচ্ছে ? যেন কিচ্ছুটি জানেনা । আমি হার্টের রুগী । ডাক্তার আমাকে নাগরদোলা চড়তে মানা করেছিল , মনে নেই?
    বিনয় বাবু চোখ কপালে তুলে বললেন ,,,
    বোঝো ঠ্যালা । তারপর নিজের কপালে চটাস ক`রে চাপর মেরে বললেন , কী সর্বনাশ,, নাগরদোলার সঙ্গে প্লেনের কী সম্পর্ক রে বাবা !
    নারায়নী ঘুসি পাকানো হাত তুখোড় বিপ্লবীর মতো আকাশে ছুঁড়ে বললেন,,, অবশ্যই সম্পর্ক আছে। ডাক্তার বলেছে নাগরদোলা চড়বেন না,,, এর মানে কী ?
    বিনয় বাবু ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখ গোলগোল ক`রে বললেন,,, কী ?
    নারায়নী দেবী দাপটে উত্তর দিলেন,,, মানে,, মাটি থেকে আকাশে , আকাশ থেকে মাটিতে ঘুরপাক খাওয়া যাবে না। নাগরদোলা চড়াও যা, প্লেনে চাপাও তা , একই। মাটি আকাশ , আকাশ মাটি । আমি নেই। আকাশে দম আটকে মরতে চাই না। যা হবার মাটিতে হোক। এই মাটিতে জনম আমার , যেন এই মাটিতেই মরি।
    বিনয় বাবু শুধরে দিতে উচ্চারণ করলেন ,,, ওটা মাটি নয়,, দেশ।
    নারায়নী হারবার পাত্রী নয় , বললেন,, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। দেশ। আরেবাবা দেশ আর মাটি একই। দেশের মাটি। দেশ মাটি , মাটি দেশ। বুঝেছ ?
    এবার হিটলার ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে বললেন ,,, দ্যাখো , বেশি চালাকি করবার দরকার নেই। খালি কথা ঘোরানোর ধান্দা ।
    তারপরেই ছেলের দিকে ঘুরে , তাকে সাক্ষী রাখার মতো ক`রে বললেন ,,, কুনু ( কুন্তলের ডাক নাম ) তুই বল , ডাক্তারের কথা অমান্য করা কি উচিৎ ? হার্টের ব্যাপার । কিছু কি বলা যায় , যদি একটা খারাপ কিছু হয়ে যায় ? তখন তোদেরই তো হ্যাপা পোহাতে হবে বল,,।
    হাসপাতাল,, ঘর,, হাসপাতাল,, ঘর,,, টাকার শ্রাদ্ধ , অশেষ ভোগান্তি ,,,,
    বিনয় বাবু আর বিনয় রাখতে পারলেন না। চিৎকার ক`রে বললেন ,,
    মূর্খতার একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিৎ । ডাক্তারের পরামর্শ । নিকুচি করেছে ডাক্তারের । ডাক্তার না ছাই। পরামর্শ তো তোমার হোমিওপ্যাথি হেঁপো মামার। উনি নাকি ডাক্তার ! দূর দূর,,, হোমিওপ্যাথি আবার ডাক্তার ।
    আগুনে ঘৃতাহুতি । রণং মূর্তি ।
    এই,, খবরদার বলেদিচ্ছি, মামা তুলে কথা বলবে না।
    ডাক্তার ইজ ডাক্তার । হোমিওপ্যাথি বলে হ্যালাফ্যালা করবেনা একদম।
    > একশোবার করবো । বেশ করবো। আমিও হাজারটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম গড়গড় করে বলে যেতে পারি। ডাক্তারি ফলাচ্ছে।
    বুড়িধারি মেয়েকে বলছে ,, নাগরদোলা চাপবে না , আইসক্রিম ছোঁবে না , ফুচকা খাবে না। ডাক্তার হয়েছে,, দূর দূর,, সামান্য একটুখানি সুগার বেড়ে গিয়েছিল সারাতে পারেনি ,, আবার বড়ো বড়ো কথা ।
    >সামান্য একটুখানি ? কি মিথ্যুক রে,,। দ্যাখ দ্যাখ কুনু,, তোর বাবা কিরকম মিথ্যেবাদী দ্যাখ একবার। চারশো পাঁচশো সুগার নাকি একটুখানি !
    এইবার মোক্ষম যুক্তির ঠ্যালায় , বিনয় বাবু চুপসে গিয়ে চুপ ক`রে গেলেন । সত্যিই তাই। দুবেলা ইনসুলিন নিতে হয়। খাওয়ার খুব ঝামেলা। এটা বাদ , সেটা বাদ। যাচ্ছেতাই জীবন। সবচেয়ে মুশকিল হলো , ডাক্তার যেগুলো খেতে বারন করেছে , সেই গুলোই বেশী ক`রে খেতে ইচ্ছে করে। অথচ উপায় নেই। নারায়নীর ত্রিনয়ন এড়িয়ে কিচ্ছুটি করার উপায় নেই । সর্বক্ষণ নজরদারি চালু আছে। আর সেই কারণেই স্ত্রী এখন স্বামীর চক্ষুশূল। অথচ তাকে ছাড়া চলে না। এ এক মহা গেড়ো। কাছে থাকলেও জ্বালা , না থাকলে মহাজ্বালা।
    কুনু,, আমি বলছি ,, এক্ষুনি যা, বেনারসের টিকিট নিয়ে আয় , প্লেনেই যাবো।
    বিদ্রোহিণী নারায়নী ঝংকার দিয়ে বললেন ,,
    কখনোই নয়। তুই ট্রেনের টিকিট নিয়ে আয়। সারারাত কুউউ ঝিক ঝিক ক`রে শুয়ে শুয়ে দুলতে দুলতে যাবো , আহঃ কী মজা ,, যা কুনু বেরিয়ে পড়। দেরী হয়ে গেলে টিকিট ফুরিয়ে যাবে বাবা। আর শোন ভালো কথা,, আজকের ট্রেন যদি না পাওয়া যায় , কালকের নিবি,, যা যা বেরিয়ে পড়,,।
    বিনয় বাবু শেষ চেষ্টা করার জন্যে বললেন,
    আমার কিন্তু কোমরে স্পন্ডালাইটিস আছে । সারারাতের ট্রেনের ঝাঁকুনি তে যদি ব্যাথা বেড়ে যায় , দেখাবো তখন মজা ।
    নারায়নী মুখ ভেংচে বললেন,,,,, ওরে আমার স্পন্ডালাইটিস রে। বয়সকালে অমন ব্যাথা সকলেরই হয়।ও জিনিস যাবার নয়। চিরসঙ্গী স্পন্ডালাইটিস ।
    __ কেন , তোমার ডাক্তার মামা কে বলোনা,, ঐ সর্বরোগ হরণকারী সাদা সাদা ঝাঁজালো গুলি গুলি মহৌষধি সাপ্লাই দিক।
    কুন্তলের এসব দেখা অভ্যেস আছে। সারাদিন , সারারাতেও এর মীমাংসা হবে না। তাই ঠান্ডা গলায় বললো৷,,
    তোমরা আগে নিজেদের মধ্যে ফয়সালা ক`রে নাও , কী করবে,,, তারপর আমাকে বোলো।
    কুন্তল চলে গেল।

    বিনয় বাবুদের একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রাণীর বিয়ে হয়েছে বেনারস এ। গতকাল রাতে জামাই ফোন ক`রে সুসংবাদটি দিয়েছে।
    ইনুর (ইন্দ্রাণীর আদুরে নাম ) মেয়ে হয়েছে । এইমাত্র।
    সেই সংবাদ শোনা মাত্রই বিনয় বাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন তিনি যাবেন বেনারস। নাতনীর মুখ দেখবেন। সুতরাং নারায়নীও গোঁ ধরলেন , তিনিও যাবেন।
    মেয়ের তিন মাসের গর্ভাবস্থায় গিয়েছিলেন। সেবার অবিশ্যি ছেলেও সঙ্গে ছিল। ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার অবস্থা ছিল অন্যরকম। হার্ট কিংবা সুগার নামক কোনও রোগ বালাই ছিলনা। হঠাৎই এই ছ মাসের ভেতর কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। মেয়েটার অতদূরে বিয়ে হবার কারণেই হয়তো। কি আর করা। ভালো মনমতো সুপাত্র পেলে , বাবা-মা এমন স্যাকরিফাইস তো করেই থাকেন। নতুন কথা কিছু নয়। তবু , মন মানে না। সেই পুরনো কথা মনে পড়ে। স্নেহ অতি বিষম বস্তু ।
    এ যাতনা মেয়ের বাবা মায়ের একান্ত পাওনা।

    জয় হলো তোমার ভোলা । কার সাধ্য তোমায় হারাবে।
    নাহ,,, এক্ষেত্রে ভোলার জয় হয়নি। বরঞ্চ উল্টোটাই হলো। জায়া র জয় জয়কার ।
    পরের দিনই রাতের ট্রেনে জায়গা পাওয়া গেল। তবে এ সি তে নয়। সেসব অনেক আগেই নো ভ্যাকান্সি হয়ে বসে আছে। অগত্যা সেকেন্ড ক্লাস।
    সেকেন্ড ক্লাস , থ্রি টায়ার । একটা আপার, একটা মিডল বার্থ।
    নারায়নী ব্যাজার মুখে বললেন ,,,
    হ্যাঁরে কুনু,,, এই নিচে একখানা পেলিনা, এতখানি ওপরে ওঠা , ওফঃ,, কী যন্ত্রণা বলো দেখি।
    এইতো ফাঁক পাওয়া গেছে। আরকি ছাড়া যায়। লোপ্পা ক্যাচ। বিনয় বাবু কথাটা টুক করে লুফে নিয়ে বললেন ,,
    এখন এসব কথা আসছে কেন ? আমার কথা তো তখন তেতো লেগেছিল , এবার কী মনেমনে আক্ষেপ হচ্ছে ? নাও, এবার গাছে চড়া প্রাকটিস করো।
    নারায়নী চুপ করে রইলেন বটে , কিন্তু তার চোখ মুখের চেহারায় অতৃপ্তির ছায়া স্পষ্ট ।

    কুন্তল বাবাকে ওপরে , আর মাকে মিডল সিটে শোবার পরামর্শ দিলো। বিনয় তৎক্ষনাৎ সেই প্রস্তাব খারিজ ক`রে বললেন,,
    অসম্ভব , আমি সুগার পেসেন্ট । বারবার উঠতে হয়। আমার লোয়ার হলেই ভালো হতো। যাক , হয়নি যখন , ঐ মিডিল দিয়েই চালিয়ে নেব।
    এবার ভোলার জয় হলো। অকাট্য যুক্তি। জজে মানবে। সুতরাং হাঁচড়পাঁচড় ক`রে নারায়নী মগডালে চড়ে গেলেন।
    চড়ে গেলেন নাকি চড়িয়ে দেওয়া হলো।
    কুন্তল বয়সের তুলনায় লম্বা বেশি। সিক্স ফুট প্লাস। সে মা কে খানিকটা বাস্কেট বল খেলায় ঝুরিতে বল ফেলে গোল করার ঢং-এ টং য়ে তুলে দিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,,
    সাবধানে নামিয়ে নিও। ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না। দেখো,, কেলেংকারী বাধিও না।
    বিনয় বাবু ছেলেকে আস্বস্ত ক`রে বললেন,,
    না না । চিন্তা নেই ।
    জামাই কে হোয়াটসঅ্যাপ ক`রে কোচ নাম্বার , সিট নাম্বার সব দিয়ে দিয়েছি। সেই এসে শাশুড়ি কে পাঁজাকোলা ক`রে নামিয়ে দেবে। কোনও চিন্তা নেই।
    ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। কুন্তল এ যাত্রায় যাবে না। ওর ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষা আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। ও ফিরে গেল। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

    মাঝরাত্তির হবে তখন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উর্ধশ্বাসে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। কামরার সাদা আলো গুলো সব নিভিয়ে দিয়ে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। নীল বাতির আবছা আলোয় কামরার এমাথা থেকে ওমাথা যেন মৃত্যুপুরী।
    আপার বাঙ্কে নারায়নী নাক ডাকছে। বিনয় বাবু মনে মনে গজরাচ্ছেন ,,, আশ্চর্য মহিলা যাহোক। এই দুলুনি খেতে খেতে কেমন নাক ডাকছে,,,
    ওফ্ফ বলিহারি যাই বটে,,।
    এই আক্ষেপের কারণ আছে।
    সব্বাই ঘুমোচ্ছে , শুধু ওনার চোখে ঘুম নেই । এই নিয়ে বার পাঁচেক মিডল বার্থ থেকে নেমেছেন আর উঠেছেন।
    ওনার সিটের নিচেই লোয়ার বার্থের যাত্রী ওনার এই বারংবার ওঠা নামায় যথেষ্ট বিরক্ত। তিনি আবার অবাঙালি। কিছুক্ষণ পরেই আবারও বিনয় বাবু নিচে নামলেন। এবার সেই অবাঙালি যাত্রী বিরক্ত স্বরে হিন্দি তে বললেন ,,,
    বারবার উপর নিচ কর রহে হেঁ আপ , কেয়া বাত হ্যায় জী। চ্যায়েন নেহি হ্যায় কা,,!
    বিনয় বাবুর হিন্দি তেমন আসেনা। তাই চ্যায়েন শব্দের অর্থ বুঝতে পারলেন না।
    তিনি সরল মনে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে পরিস্কার বাংলায় বললেন ,,,
    না না,, চেন তো আছে কিন্তু খুলছেনা।
    বিচ্ছিরি ভাবে আটকে গেছে । তারপর অনুনয় ক`রে বললেন ,,
    আপনি একটু হেল্প করতে পারেন ? আর যে পারছি না।
    ভদ্রলোক , জয় রামজি কী, ব`লে পাশ ফিরে শুলেন।
    হঠাৎ চোখ গেল ওপরে। নারায়নী উঠে বসে ড্যাবড্যাব ক`রে তাকিয়ে আছে। বিনয় বাবু অসহায় গলায় বললেন,,,
    এয়ারহস্টেস রা এব্যাপারে যথেষ্ট এক্সপার্ট।
    নারায়নী কোনও কথা না বলে গুটিগুটি ওপর থেকে নিচে নেমে আসার চেষ্টা করলেন। তাই দেখে বিনয় বাবু হা হা ক`রে বললেন,,,,,,
    আরে আরে করছো কী,,, পড়ে যাবে যে,,,
    কে কার কথা শোনে। নারায়নী তার জেদ বজায় রাখবেই। বিশেষ ক`রে ঐ এয়ারহস্টেস শোনার পরেই তার মাথায় আগুন জ্বলে গেছে । শয়তান ব্যাটাছেলে , সারাটা জীবন ধরে যার সেবা নিয়ে গেল , সে কিছু নয়,,,? বিমানসেবিকা ? বেইমান।
    যে ভয় করা হচ্ছিল ঠিক সেটাই ঘটে গেল এবার । নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে একেবারে গড়িয়ে গেলেন।
    বিনয় বাবু কোন রকমে দুহাত বাড়িয়ে জাপটে ধরতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। দুজনেই জরামরি করে ধরাস ক`রে মেঝেতে পরলেন।
    নারায়নী মা গোওও বলে আর্তনাদ করে উঠলেন। বিনয় বাবু হতবুদ্ধি হয়ে মেঝেতে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে অনুভব করলেন , তার শরীর থেকে গরম জলস্রোত বেরিয়ে এসে তার প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে ।

    সকালে বেনারস ষ্টেশনে জামাই বাবাজী এলেন বটে কিন্তু শাশুড়ী কে আর ওপর থেকে পেড়ে আনতে হলোনা । কেননা তিনি নিজে থেকেই খসে পরেছেন। আর খসে পরেছে নারায়নীর দুপাটি বাঁধানো দাঁত। সিটের নিচ থেকে অবিরাম হেসে চলেছে।

You cannot copy content of this page