• গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    রম্য- নগ্ন চরিত্

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

     

    নগ্ন চরিত্
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    দু পেগ হুইস্কির পর প্রতীক্ষায় নায়ক। হোটেলের লাক্সারি রুমে মক্ষি আসবে। হুইস্কির ট্রে রেখে যাবার সময় আব্বাস বলে গেছে।
    দরজায় ঠকঠক তিনবার। খুলে দিতে হবে দরজা। ইচ্ছে করলে রাতভর। বেপরোয়া আমেজের বাঁধভাঙ্গা বন্যা।
    খরচ একটু বেশি। পরোয়া নেই। সুখ চাই সুখ। বেপরোয়া দুরন্ত রঙিন শরীর সুখ।
    শরীর সুখ কেনা যায়। বিক্রি হয়। হাতবদল হয়। শুধু টাকা চাই, টাকা।

    আব্বাস এই হোটেলের রুমবয়। খদ্দেরদের কাছে সুখ বেচার করিৎকর্মা দোকানদার। নরকের জলজ্যান্ত দূত। অন্ধকারের যাত্রী।

    স্বভাব গুণে কিংবা দোষে, যার যে জিনিসের অভাব বোধ, তা-ই পেতে আকুল হয় মন। খিদে। এ খিদে সাংঘাতিক খিদে। না খাওয়া অবধি নিস্তার নেই। ছটফটানি, আকুলিবিকুলি । তার ওপর পেটে মাল পড়লে তো কথাই নেই। আগুন দ্বিগুণ। দাউদাউ লেলিহান লালসার দাবানল।

    দুরছাই এতো দেরি কেন , আব্বাস, জলদি করো বাপধন, এসব ব্যাপারে অপেক্ষা টপেক্ষা ধাতে সয় না। যাও,, মক্ষি লাও , সাথ মে চিকেন তন্দুরি। সব খাউঙ্গা। জি ভর কে। যাও, জলদি করো।

    হা হা, শালা , বউ জানে তার স্বামী সি আই ডি তে ডিউটি করে । 

     ধুস,বোকার মাদুলি। শালী জানেই না,সে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ইনফর্মার কাম ফটোগ্রাফারের কাজ করে।
    জানবার দরকার কী? কিচ্ছুটির তো অভাব রাখা হয়নি। না চাইতেই সকল ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া , ঘোরাঘুরি , বিউটি পার্লার , ফ্যাশনের স্মার্টফোন , জমকালো চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের পোশাক,, আবার কী চাই ! হেঁ হেঁ ব্বাবা,, স্বামীর কর্তব্যের খুঁত খুঁজে পাবেনা ।
    দশম বিবাহবার্ষিকী পালন হয়ে গেছে।
    পুরাতন প্রেম এখন বিশ্রামে আছে।
    তাছাড়া , সত্যি কথা বলতে কী,, ওয়াশিং মেশিনে কাচা , আর নতুন আনকোরা শাড়ির মধ্যে তফাৎ তো থাকবেই। একটা অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া। অদ্ভুত ভাললাগা। অস্বীকার করার উপায় নেই প্রিয়ে।
    সামাজিক ইজ্জতদার আদমি। অনেককিছুই খুল্লামখুল্লা করা যায় না।
    পর্দা হ্যায় , পর্দা হ্যায় । পর্দে কে পিছে…

    শাল্লা,, বুজরুকি ভরঙের জগৎ। ঠাটবাট বজায় রাখো শিবের বাবাও সন্দেহ করবেনা।
    ভুয়ো মালের জমানা।
    আই এ এস,
    আই পি এস থেকে সি বি আই , সি আই ডি, ডাক্তার, সব ভুয়ো।
    গাড়ির মাথায় নীল বাতির চড়কি ভেঁপু।
    হঠ যাও,, ভি আই পি, আ রহা হ্যায়।
    হাঃ হাঃ,,
    আসল নকল একাকার হয়ে গেল রে, একাকার হয়ে গেল।
    গোয়েন্দা এজেন্সিতে টু পাইস ফালতু কামাই করার মাওকা আছে ।
    পার্টি বুঝে ছোটখাটো ব্ল্যাকমেইল করে টুকটাক আদায় করা যায় ।
    আরে বাবা উবরি না থাকলে , বাড়তি ফুর্তির রসদ কোত্থেকে জুটবে শুনি ।
    হিসেব ক’রে ফুর্তি জমে না । বেহিসেবি লটরপটর স্বর্গসুখের সমান। উবরি চাই উবরি। টানকে মতিলাল,,,।
    দেব রাজ ইন্দ্র , সন্ধ্যেবেলা স্বর্গে বসে কী করে ?
    বাতি জ্বেলে গীতা পাঠ করে ? ধুস…
    সোমরস ঢুকু ঢুকু সঙ্গে অপ্সরাদের উদোম নেত্য।
    চালাও পানসি।
    তবে কি-হয় , মানে,, এইসব উৎপটাং কাজ করতে করতে , স্বভাবের বারোটা বেজে যায়।
    মা কালির দিব্যি। একদম বারোটা বেজে পাঁচ,
    কিন্তু , একটু রিস্ক তো নিতেই হবে পাঁচু ।
    নইলে এই মাল খাওয়া , হোটেলের ঘরে মক্ষি নিয়ে ফুর্তিফার্তা , জুটবে কোত্থেকে শুনি ।
    না না, বিশ্বাস করো , এসব একেবারেই ছিল না। মাইরি ।
    পাক্কা ডালভাত জীবন। বউ ছাড়া নো এন্টারটেইনমেন্ট। বউ, মাই ডারলিং,,
    ও-ই যে মেয়েটা বাড়িতে কাজ করতো , মালতী। ওর ফিগার, ওফ্ফ, কী দারুণ। ভাবা যায় না। কিন্তু না, আড়চোখে একটু আধটু দেখা ছাড়া অন্য কিচ্ছুটি নয়।
    এই চোখ ছুঁয়ে বলছি ।
    কিন্তু , ও-ই যে বললুম । স্বভাবের মধ্যে একটু একটু করে উইপোকা’র বাসা বাঁধলে দেবতাও হড়কে যায়। মানুষ তো কোন ছার।

    সেদিন, রান্নাঘরে, পেছন থেকে আচমকা, মালতীর , আয় আয় ক`রে ডাকা কোমর , জাপটে ধরতেই হুলুস্থুল কান্ড।
    মালতীর বেমক্কা আর্তনাদে , পাড়া শুদ্ধ লোকের কাছে , প্রেস্টিজ টিউব ফটাশ পাংচার। বউয়ের চোখে আগুন , মুখে হরপা বান।
    পালাবার পথ নাই , নাইরে ,
    তোর যম আছে পিছে ।
    মুখপোড়া হনুমান হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে, নায়ক তখন কুঁইকুঁই কুত্তা ।
    মনে খিস্তির বান চলছে ,,,
    আরে , সায় নেই চুপচাপ সরে যা,, চ্যাঁচামেচি করে কী প্রমাণ করতে চাইলি ? সতীপনা, সতীসাধ্বী সাজছে । কী ক্ষতি হতো , একটু
    ইমু ইমু করলে ? ওরে , অত দেমাগ ভালো নয়। জগতে কিছুই টেঁকসই নয়। সব ধ্বসে যাবে।
    সময় গেলে ছিবড়ে হয়ে পড়ে থাকবি।
    ষাঁড়ও ছোঁবে না।
    উত্তেজনা , ডিপ ফ্রিজে কেৎরে শুয়ে পড়ে রইলো । জারিজুরি ভ্যানিশ। মাঝখান থেকে,
    মালতী মোটা মাল হাতিয়ে নিয়ে কেটে গেল ।
    মুখ বন্ধের ভরতুকি । সামাজিক কেচ্ছা ঠেকানোর মোক্ষম দাওয়াই । টাকা । আক্কেলসেলামি। টাকায় কি না হয়?
    সেই থেকে বউ , আর রিস্ক-এর মধ্যে নেই । প্রমাণ হয়ে গিয়েছে , স্বামী , লুজ কারেক্টার ।
    এখন , বুড়ী কেতোর মা , মালতীর জায়গায় বহাল। বউয়ের ভাবখানা এমন , যেন বলতে চাইছে ,
    নে, এবার কী করবি কর। গুনগুন ক’রে গানের সুর ভাঁজছে,
    এ নদী এমন নদী , জল চাই একটু যদি ,
    দু হাত ভরে শুখনো বালু দেয় আমারে,,
    নায়কের ওপর থেকে বিশ্বাস ভ্যানিস।
    এইজন্যেই ঘরে ছুঁড়ি ঢোকাতে নেই । পুরুষের নোলা , সাপের চেয়েও বিষাক্ত।
    শিয়ালের মতো ধূর্ত , বেড়ালের মতো ছোঁকছোঁকে।
    সব পুরুষ সমান । ডবকা মেয়ে দেখলে,
    গাল দিয়ে নাল গড়িয়ে পড়ে।
    ঘি , কিছুতেই আর ঘরে আনবো না । আগুন দিয়ে কী গলাবি গলা ।
    কিন্তু ভদ্রমহিলা এটা জানেন কি, পুরুষের অনেক রাস্তাই খোলা !
    ঘরে মাংস না থাকলে রেস্তোরাঁ খোলা আছে। ঘরের কফিতেই যদি পরিপূর্ণ তৃষ্ণা মিটতো , তাহলে কেউ কফিশপে যেতোনা ।
    পকেটে রেস্তো থাকলেই হলো। বাড়তি খরচ তাই বাড়তি রেস্তো। নো রিস্ক , নো গেইন।
    ইচ্ছে থাকলেই হবে ? নাহী চাঁদু ।
    সাহস চাই সাহস ।

    ন টা বেজে গেছে । আব্বাসটা কী করছে ?
    দুর,, ভাল্লাগে না।
    নায়ক অস্থির হয়ে ইন্টারকম তুলতে যাবে , ঠিক তখনই দরজায় টোকা। ঠক ঠক ঠক। গুনে গুনে তিন বার। এই সেই প্রতিক্ষার ঈঙ্গিত।
    মক্ষি হাজির।
    নেশায় টলমল পা। দরজা খুলে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্সরার দিকে তাকিয়ে নায়কের নেশায় আচ্ছন্ন চোখ প্রায় কপালে।
    এ কী,,, তুমি,,, তুমি কীভাবে,, এখানে ??
    মালতী , ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে চটুল ভঙ্গিতে বললো,
    কেন , আসতে নেই ? আমি তো তোমার পছন্দই। রান্নাঘরে জাপটে ধরার কথা ভুলে গেলে নাকি ? তাহলে ?
    সেই মালতী , আর এই মালতী ? এ যে আরও প্রাণঘাতি। মনে অশ্বমেধের ঘোড়া দৌড়চ্ছে।
    নরক মনের বিশাল লোহার কড়াইয়ে তেল গরম হয়ে ফুটছে ,, টগবগ টগবগ টগবগ ।
    মালতী নিজেকে আরও খোলামেলা করে , বিছানায় কাম মোহিনী শরীর বিছিয়ে দিয়ে, সুর করে বললো ,,,
    এসো,, প্রাণভরে সখ মিটিয়ে নাও।
    স্বর্গসুখ,, ভোগ করো। এসো।

    ঠিকই বলেছে মালতী ।
    স্বর্গসুখ ভোগকরো। ঠিক । কেনা সুখের আবার বাছবিচার কী? এসো,, আদিম হও।
    ভুয়ো ভাললাগা , শরীর ধুলেই পরিষ্কার।

    হালকা নীলচে আলোয় , মালতী এখন কামাতুর ভুয়ো নায়কের , নগ্ন নায়িকা । রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত।।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- ট্রাডিশন যখন যেমন

    ট্রাডিশন যখন যেমন
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

    সকাল সাতটা। মেঝেতে বাবু হয়ে বসে, জানালার গরাদেতে হাত আয়না ঠেসান দিয়ে দাঁড় করিয়ে, গালে সাবান ঘষে ব্লেড লাগানো রেজার দিয়ে দাড়ি কামান নন্দুবাবু। তারপর বাজার।
    সকাল আটটায় রান্নাঘরের সামনে ধরাস করে ফুট দেড়েক সাইজের কাৎলা কিংবা রুই ফেলে দিয়ে কলতলায় চলে যান চান সেরে নিতে।
    ইতিমধ্যে স্ত্রী কমলা, সেই মাছের ঝোল আর ভাত, তরকারি, ভাজা ইত্যাদি রান্না করে, অপেক্ষায় আছেন।
    কত্তা চান সেরে দেওয়ালে টাঙানো যাবতীয় ঠাকুর দেবতাদের প্রণাম ঠুকেই খেতে বসবেন। আপিস আছে। ভীষণ চাপ। ট্রামের মান্থলি টিকিট করা আছে। বাদুড়ঝোলা নিত্যকার জীবনের যন্ত্রণা।

    সন্ধ্যে ছটা। নন্দুবাবু। বাড়ি ফিরে, কলতলায় হাতমুখ ধুয়ে ধুতি পড়ে চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়বেন। স্ত্রী কমলা একটু মুড়ি চানাচুর, কিংবা দুটো গরম রুটি একটু হালুয়া, সঙ্গে এককাপ চা। কত্তার টিফিন। সন্ধ্যে সাতটায় রেডিওতে বাংলা সংবাদ। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন পল্লীমঙ্গল অনুষ্ঠান চলছে। কত্তার কান, চোখ, মুখ সব একসঙ্গে চলছে।

    গিন্নির ফুরসৎ নেই। রাতের খাবার বানাতে হবে। ছেলে মেয়েরা পড়ছে। শাশুড়ির জ্বর এসেছে। রাতে কত্তা ঘুমিয়ে না পড়লে, বলতে হবে, শ্বশুরের কাশির ওষুধটা ফুরিয়ে গেছে। ইলেকট্রিক বিল জমা দেবার কালই শেষ তারিখ।

    সেদিন গিয়েছে কালের অতলে। এখন, নন্দুবাবুর উত্তরাধিকারী মিঃ কুন্তল ব্যানার্জি। অটো সেভারে মসৃণ করে দাড়ি কামিয়ে, সেলফোন তুলে বাপিকে মাছের অর্ডার দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। ফ্রিজে রাখা মাছ সব্জি ইত্যাদি বের করে নিয়ে গিয়েছে মানুদি। রান্না করার লোক।
    মিসেস ব্যানার্জি এখনো শুয়ে আছেন। গতকালের নাইট পার্টির ধকল। হ্যাংওভার।
    ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে, ওয়াড্রব থেকে স্যুট বের করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বেঁধে নিয়ে চলে এলো ডাইনিং টেবিলে। ব্রেকফাস্ট সাজানো আছে। ঝটপট খেয়ে সোজা ড্রাইভিং সিট। হর্ন দিয়ে চলে গেল। তাড়া আছে। আজকের ডিরেক্টরস মিটিংটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট।

    রাত নটা। দু’ পেগ হুইস্কির সাথে চিকেন পকোড়া কিংবা হ্যাম স্যান্ডউইচ। টিভিতে নিউজ বুলেটিন। মিসেস ব্যানার্জির পলিটিক্যাল মিটিং আছে। মানুদি খবরটা জানিয়ে দিয়ে, আজকের মতো চলে গেল।ওর ডিউটি আবার কাল শুরু হবে।
    পেরেন্টসের দায়িত্ব যথাযথ মর্যাদায় দেওয়া আছে ওল্ডএজ হোমে। ছেলে দেরাদুন স্কুলে। উইন্টার ভ্যাকেশনে আপার্টমেন্টে আসে কিছু দিনের জন্য।
    সব ব্যবস্থা এবশোলিউটলি ও কে। নো প্রবলেম। শুধু একাকীত্ব বোধ মাঝেমধ্যে,
    নইলে নাথিং, নো প্রবলেম, নো..

  • রম্য রচনা

    রম্য- দর্পণে আত্মারাম

    দর্পণে আত্মারাম
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ করে ফিরেই, দাঁতে নিমপাতা কাটো, আগুনের তাপ নাও, লোহা স্পর্শ করে বিশুদ্ধ হও। জানাই তো আছে নিশ্চিত, অতৃপ্ত আত্মা ঘুরঘুর করছে এখনো, এখানেই আশপাশে। এইতো ছিল আপনজনের দেহ। ভালোবাসার আকুল প্রত্যাশায় মোড়া। তাহলে! সেই দেহস্থ আত্মা অতৃপ্ত, বোঝা গেলকীভাবে?
    এইতো কথার মতো কথা।
    আরে বাবা, নিজের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি চলে না। নিজের লোক। রক্তের সম্পর্ক। কোথায় ছিলে বাপধন? কাজ গুছিয়ে সরে পড়েছো। এখন রেড সিগনাল দপদপ করছে। অনুশোচনা?
    পাপী শরীর। জ্ঞানপাপী মন।
    কর্তব্যনিষ্ঠার পাঠ মুখস্থ, কন্ঠস্থ, মগজস্থ। শুধু পালনের অনীহা।
    জীবিতকে ভয় নেই। সে বাৎসল্য বোধে মৃয়মান। কিন্তু, মৃত ভয়ানক। জীবিতের লৌকিক। মৃতের অলৌকিক।
    ক্ষমতা বড়ো লোভনীয়। শুধু নিজের জন্যে। অন্যের ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। কর্তব্যপালন-ধর্ম, নিজের প্রতি। অন্যের প্রতি বর্জনীয়। অন্ধকার মনে সাপের বাসা। দেহ পুড়লেই স্মৃতি বিলুপ্ত নয়। দেনা পাওনার হিসেব, চুটকি মেরে নিকেশ হয়ে যায় না।
    অশৌচ দেহ, অশৌচ মন।
    ভেক ধরো, সাজো। নিখুঁত অভিনয়ে প্রমাণ করো তোমার কর্তব্যপরায়ণতা।
    মালসায় হবিস্যি রাঁধো। মুখ ব্যাজার করে ঘি মাখিয়ে আলো চাল সেদ্ধ ঢোঁক গিলে নাও। মাত্র তো ক’টা দিন। খোঁচা খোঁচা চুল দাড়ি, হাঁটু পযন্ত ট্যাঁং টাঁং করা জ্যালজেলে ধুতি, উত্তরীয়র, গলায় ঝুলোনো লোহার চাবি। বগলে কুশাসন। লোকাচার শেষ। তারপর..
    তন্ত্রধারকের দুর্বোধ্য দেবপুঁথি উচ্চারণকে আরও দুর্বোধ্য ক’রে হয়ে যাও শুচি শুদ্ধ।
    বিগ সাইজ পারশে মাছ সহযোগে সবান্ধবে সেরে ফ্যালো অন্তিম কর্ম।
    আহা.. উনি পারসে বড্ড ভালোবাসতেন। ব্যস। নিশ্চিন্দি। আর ভয় নেই। ভাবনা নেই। ঝাড়া হাত পা। আত্মা তৃপ্ত। পরমাত্মার জয়জয়কার কেত্তন। বুক ফুলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি।

    কোথাও কী কোনও ফাঁক রয়ে গেল? দ্যাখনদার লোকাচার কেরামতিতে? মন মোমবাতি বাতাসে দুলছে। সারারাত বিনিদ্র এপাশ ওপাশ।
    অর্ধাঙ্গিনীর শাস্ত্রসম্মত সাবধানী উপদেশ, বাৎসরিক কাজে পুষিয়ে দেওয়া যাবে ‘খন। গয়া কিংবা হরিদ্বার। একটু বেড়ানোও হয়ে যাবে। ঘুমোও দেখি। যথেষ্ট করেছো, আবার কী!

    মৃত বড়ো ভয়ংকর। জীবিত নিরীহ। বাৎসল্য বোধে টইটম্বুর।
    কোথায় যেন মন্দ বাতাস বইছে। কে যেন কু গাইছে। একটা খিকখিক তাচ্ছিল্য হাসির শব্দ। ফিসফিস করে, কানের পাশে পরিচিত কন্ঠ, শ্রদ্ধাহীন শ্রাদ্ধ- হায় রে গর্ভজাত আদরের সন্তান আমার, হায়..
    কে! কে? ও.. তু…মি.. বিশুদ্ধ আত্মা!

  • রম্য রচনা

    রম্য- সাঁড়াশী জিন্দাবাদ

    সাঁড়াশী জিন্দাবাদ
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    গঙ্গা সাগর মেলায় লাখো সাধুবাবা হাজির। হাজির লাখো লাখো পুণ্যার্থী। মানুষের চাওয়ারও শেষ নেই দুঃখেরও শেষ নেই। শেষমেশ ভরসা সাধুবাবা।
    মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা সাধুবেশী সাধকের পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ কান্না।
    বাবা এই বয়সে স্বামী আমার অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে, আমাকে দুরছাই করছে বাবা, আমি কী নিয়ে বাঁঁচবো বাবা।
    বাবা গাঁজার ছিলিমে সুখটান দিয়ে বললো, আরে দুর বেটি। ভয় কী। সাহস কর। রুখে দাঁড়া। মনকে সাঁড়াশী কর। কামড়ে ধর। সাঁড়াশীর কাছে সবাই জব্দ।

    সাঁড়াশী। কেন জানিনা, খুব কম বয়স থেকেই এই যন্ত্রটির প্রতি আমার বিশ্বাস আস্থা প্রগাঢ়। অনেক সময় একে আমার অস্ত্র বলে মনে হয়।
    সাঁড়াশী আক্রমণ। অর্থাৎ এমন ভাবে সজোরে চেপে ধর, যা ছাড়িয়ে পালানো প্রায় অসম্ভব। সাঁড়াশী জেরায় জেরবার হয়ে আচ্ছা আচ্ছা প্রভাবশালীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছে দুঁদে উকিল। কিন্তু, দেখলে মনে হবে, ওটা নিতান্তই সাদামাটা একটা রান্নাঘরের আর পাঁচটা সাধারণ রান্নাবান্নার সাহায্যকারী একটি বস্তু। কিন্তু কী সাংঘাতিক এর ক্ষমতার বহর, না না শুধু ক্ষমতার কেন, নামের মাহাত্ম্য, সেকি কম?
    আমার তো মনে হয় নামের মস্তানিতে সাঁড়াশী সেরা। কেননা শক্তপোক্তর কথায় যদি আসা যায়, তাহলে তো রান্নাঘরের হামানদিস্তে, শিলনোড়া, তারা-ও কম যায় না। কিন্তু সাঁড়াশীর কাছে ওদের কেমন যেন ম্রিয়মাণ মনে হয়। মনে রাখতে হবে, কুটিরশিল্প কারখানার ( পড়ুন রান্নাঘর ) সেরা যন্তর সাঁড়াশী।

    একজন প্রৌঢ়া মহিলা, সামান্য মানসিক ভারসাম্যহীন। পাড়ার দুষ্টু ছেলেপিলের দল দেখতে পেলেই চিৎকার করে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, সাঁড়াশী.. ব্যাস, আর যায় কোথায়। মহিলা মুখে যা আসতো তাই বলে গালমন্দ করতো। ছেলেরাও প্রৌঢ়ার ক্ষাপামি দেখে ভারি মজা পেত। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে বারবার উচ্চারণ করতো, সাঁড়াশী..সাঁড়াশী.. প্রৌঢ়ার মেজাজ আর কন্ঠস্বর আকাশ বিদীর্ণ করতো, কিন্তু মজা পাওয়া কিশোরগুলোর মন হয়তো বা পাথর দিয়ে গড়া, অথবা সাঁড়াশী শব্দের এমন মজাদার মাহাত্ম্য গুণ তাদের এমন পাগল করে তুলতো, যেখানে হৃদয় নামক বস্তুটি কিছুমাত্র নরম হতে পারতো না।
    এই গেল নাম মাহাত্ম্য।

    সাঁড়াশী হৃদয় লোক, আরও ভয়ংকর। অনেকটা বাংলা সিনেমার কমল মিত্র টাইপ। ধরলে আর রেহাই নেই। তা সে উত্তম কুমারই হোক কিংবা সুচিত্রা সেন।
    “নিজে রোজকার ক’রে তারপর বড়ো বড়ো কথা বললে ভালো হয় না কী?” ব্যাস, হয়ে গেল। এইকথা শোনার পর কোন লায়েক ছেলে-মেয়ে নিজের মান খুইয়ে বাপের কাছে থাকবে? চললো তারা আজন্মের আস্তানার মায়া কাটিয়ে কেরিয়ার গড়ার পথে। চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট।
    এককথার ধাক্কায় বাড়ি থেকে দূর করে দিতে একটুও দয়া মায়ার ধার ধারত না। বেড়িয়ে যাও মানে, বেড়িয়ে যাও। এ কথার আর নড়চড় হবে না। ওদিকে স্ত্রী কেঁদে ভাসাচ্ছে। যতই হোক মায়ের প্রাণ। ডুকরে কেঁদে বলছে, ওগো একি করলে, ছেলে যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
    সাঁড়াশী হৃদয় বাপের কোনও হেলদোল নেই। নাইটগ্রাউন গায়ে চাপিয়ে ফুরফুরে চুরোট দাঁতে চেপে, ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ভাব খানা এমন, যেন কিছুই হয়নি। হতে পারে না। আর হলো তো ভারি বয়েই গেল। একটা বেপরোয়া হিটলারি মনোভাব। আমার কথাই শেষ কথা। ফাইনাল সিদ্ধান্ত। কেউ নাক গলাতে এসো না। লাভ হবে না। ইয়ে বাত নেহি, সাঁড়াশী কা ফান্দা হ্যায়।

    সাঁড়াশীর কাজ, শক্ত করে চেপে ধরা। দারুণ শক্ত। নির্দয়তার চরম নিদর্শন। সাঁড়াশী আলগা হয়ে গেলেই, ধপাস।
    পপাত ধরণী তল। ছত্রাখান হয়ে চিত্তির।

    কলেজে পড়া ছেলে। পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী নয়, যতটা বন্ধুবান্ধব, ফুর্তি আর অপ্রয়োজনীয় এদিক ওদিকে উড়ুক্কু মন। এককথায় পয়সাওয়ালা বাপের কু-পুত্তুর। সেদিন সারারাত বাড়ি ফিরলো না। মা কেঁদেকেটে একসা।
    ওগো ছেলেটা আমার কোথায় গেল? এমন তো কখনও হয় না। যত রাতই হোক বাছা আমার বাড়ির বাইরে ক্কখনো রাত কাটায় না।
    একি হলো গো?
    ছেলের ছাইপাঁশ গিলে বাড়ি ফেরার কথাটা এখানে উহ্য রইলো।
    বাপ কিন্তু চুপচাপ। খানিক পরে একটি কথাই উচ্চারণ করলো, চিন্তার কিচ্ছু নেই, সকাল হলেই ঠিক ফিরে আসবে। যাবে কোথায়, যাবার কি কোনও জায়গা আছে? তোমার বেয়াক্কেলে আদরে সে জাহান্নামে গেছে।
    গর্ভধারিণী অশ্রুসিক্ত হয়ে অনুযোগ করলো, তুমি কি পাষাণ ?
    সাঁড়াশী হৃদয় বাপ নির্লিপ্ত মেজাজে চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশে তারা দেখলেন। কিছু গুনগুন করে সুর ভাঁজলেন না।

    পরদিন সকালেও, ছেলে এলো না। এলো একটা ফোন৷ ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, এখনই দশ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে রাখুন।
    ফোনটা বাবা ধরে ছিলেন। কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, দশ লাখ কেন, একটি পয়সাও পাবে না। কুলাঙ্গারটা তোমাদের কাছেই যতদিন পারে থাক। রাখতে না পারলে ফেরত পাঠিও। যদিও ওকে ফেরত নেবার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।
    ফোন কেটে গেল না। ওপ্রান্তের সব কথাই ভেসে আসছিলো, অচেনা কন্ঠ, কী সাংঘাতিক বাপ মাইরি তোর। মিলিটারি! তোর সব প্ল্যান খতম। নকলি কিডন্যাপ নাটক ফিনিশ। এবার যা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা।
    এবার ছেলের সুমধুর বাণী, শালা, বাপ তো নয়, সাঁড়াশী। কেবল চিমটি কেটে ধরতে পারে, ওফঃ।
    এবার ফোন কেটে গেল। বাপ আবারও চুরটে অগ্নি সংযোগ করলেন। অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, হতচ্ছাড়া…

    আলগা দিলেই হাতছাড়া। ওহে কড়াই বাছাধন, সাঁড়াশীকে গরম দেখিও না। যত গরমই হও সাঁড়াশী কান ধরে নামিয়ে আনবে। বুঝতে পেরেছো? জোরসে ধরো হেঁইও। এ-যুগে সাঁড়াশীই শেষ কথা। মোক্ষম দাওয়াই। সুতরাং, সেই সাধুবাবার জুতসই নিদান ।
    মনকে সাঁড়াশী করো। কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। যুগের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হলে, টিঁকে থাকতে হলে, বলো, সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।
    সাঁড়াশী জিন্দাবাদ।।

  • কবিতা

    কবিতা- হে অনন্ত তোমাকে

    হে অনন্ত তোমাকে
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    এসো, মনের আগুনে মন পোড়াই।
    একটু জ্বালা, তাতে কী!
    এসো, আলোকিত করি
    বাঁশিতে মূর্ছনা তুলি, ভৈরবী কিংবা
    বসন্তবাহার অথবা..

    কর্ণ দান দিয়েছে, রক্তাক্ত বক্ষদেশ
    ঈশ্বরের কপটীয় ছল।
    কুন্তীর মনভাঙা অশ্রু, অতীত নিষ্ঠুর
    নিষ্পাপ ধর্ম নয়, একলব্য, অভিমন্যু যথা।

    হে কেশব, এসো মাধব,
    মাধবীকুঞ্জ নয়, এসো সখা
    মনের আগুনে মন পোড়াই,
    কথা রাখো চক্রপাণি, অধর্ম বিনাশ
    যুগে যুগে নিরন্তর।
    অতঃপর…
    শিখি পাখায়, ভালবাসার প্রলেপ বিলাই ।

  • রম্য রচনা

    রম্য রচনা- একান্ত গোপনীয়

    একান্ত গোপনীয়
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে।
    লাথি না খেলে ঢেঁকি কর্ম করে না। এটাই চিরাচরিত অপরিহার্য পদ্ধতি। অর্থাৎ স্বর্গে লাথালাথি করার নির্দয় বিধির প্রচলন আছে।
    না ভাই আমি নেই। মানে আমি স্বর্গে যেতে চাই না। লাথি খাওয়া আমার ধাতে সইবে না। কেন না, আমি নিশ্চিত জানি, আমি ঢেঁকি।
    মেজাজি সংসারের ম্যাও সামলাতে সামলাতে, এখন একটা পুরোদস্তুর জবরদস্ত জগদ্দল ঢেঁকি হয়ে গেছি। চাল কুটতে হলো বেলা।
    বেলা হোক কিংবা বেলা শেষ হোক। আমি নেই। স্বর্গ মাথার ওপর ছিল, আছে, থাকুক।
    তাহলে নরক?
    নরকভোগ ? প্রশ্ন-ই নেই । ওখানকার ব্যাপারস্যাপার নাকি অতি ভয়ংকর। বেধরক আড়ংধোলাই থেকে গরম তেলের কড়াইয়ে ছ্যাঁ কলকল ভাজা, কিছুই নাকি বাদ নেই। পাগলও নিজের ভালো বোঝে, আর আমি তো হাড় সেয়ানা।
    জেনেশুনে ননসেন্স হওয়ার প্রশ্ন-ই নেই।
    ভেবেই পাচ্ছি না, মরতে এই মর্তে জন্মের প্রয়োজন কী ছিল?
    খাওয়া, ঘুম, যেন-তেন প্রকারেণ উপার্জনের ফন্দিফিকির, আর বংশ বৃদ্ধি। এই তো আজীবনের কর্মসূচী। হ্যাঁ, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বলতে, নির্বিচারে অন্যকে বিনামূল্যে বংশদণ্ড প্রদান।
    আচ্ছা..স্বর্গ, নরক, মর্ত্য, সব জায়গাই যদি গোলমেলে গোত্রের হয়, তাহলে থাকি কোথায়, যাই কোথায়? বাঁচি কোথায়, মরি কোথায়?
    এ-তো ভারি মুশকিলের ব্যাপার হলো দেখছি।
    সেই কারণেই মনের কোণায় শাঁকচুন্নির নাকে সুরের আগুন প্রশ্ন, জন্মালুম কেন?
    পাঁচুদা সবজান্তা সব্জিওয়ালা। বললো- দ্যাখ ভেলো, মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিসনি। কেউ নিজের ইচ্ছেয় জন্মায় না। সব্বাই অন্যের ইচ্ছের ফসল। সেই ফসল ভালবাসার হতে পারে। স্লিপ ক’রেও হতে পারে। যেভাবেই হোক, যে জন্মালো তাতে তার কোনও হাত নেই। শুধু ভোগ আর ভোগান্তি আছে। লড়াই আছে। জোর সে বোলো..
    লড়াই লড়াই লড়াই চাই..
    লড়াই ক’রে বাঁচতে চাই।
    মোবাইল ফোনে রিংটোন বাজছে,
    ‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে..’
    স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে নাম, মিলি,
    ভেলোর আঠারো বছরের বসন্ত হৃদয়ে কোয়েল ডাকছে, ও আমার মিলি সোনা..
    স্পিকারে একরাশ পলাশ প্রেমের রঙ ছড়িয়ে ভেলো বললো, হ্যালো,
    ও প্রান্তের দখিনা বাতাস মেশানো মৃদু মিঠে স্বর,
    কী করছো?
    সিঁড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে, ভেলোর ফিসফিস উত্তর- কিছু না, ছাদে আছি,
    ওপ্রান্তে ব্যকুলতা ভরা মিঠে ধমকানি,
    -এমা কেন? সন্ধ্যেবেলা কেউ ছাদে থাকে ফাগুনের শিশির, ঠান্ডা লেগে যাবে তো !
    -লাগুক, কিচ্ছু হবে না। ঘরে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় না। এই বেশ..কেউ নেই, নিরিবিলি। ভেলো আরও একবার ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলো। নাঃ, কেউ নেই। বাবা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। একমাত্র ছোট বোনটা। মহা ফাজিল। যে কোনও সময় পা টিপে টিপে ওপরে উঠে আসতে পারে। যদি দেখে ফেলে টুক করে মা’কে লাগিয়ে দেবে। ব্যাটা চুকলি-খোর নম্বর ওয়ান।
    সত্যি, কী কপাল মাইরি। হায়রে স্বাধীনতা বলে কি কিছুই থাকতে নেই এই জীবনে ! কিছুই তো না। শুধু চুপিচুপি একান্তে নিজের প্রিয় মানুষের সঙ্গে একটু মনের কথা শেয়ার করা। গতানুগতিক কেতাবী ছকের বাইরে একটু অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া। প্রাণ মন ভেজা আঁধারি সোঁদালি গন্ধ মেশানো স্বপ্ন সন্ধানী গল্প। সেখানেও কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। দূর দূর এ-ই কী জীবন? সাধে কী আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না, অনেক জ্বালা রে ভাই।
    সেদিন কোচিং কেটে বিকেলবেলা মিলি আর আমি একটু নিউমার্কেটের আসেপাশে আঙুল ধরাধরি করে অকারণ হাঁটছিলাম। ব্যাস, পড়ে গেলাম ফ্ল্যাটতুতো কাকিমার চোখে। কী সাংঘাতিক দৃষ্টি মাইরি। অত ভীড়ের মধ্যেও ঠিক চোখ গেছে। দৃষ্টি তো নয় শ্যেনদৃষ্টি । ঠিক আছে বাবা। দেখেছিস বেশ করেছিস। মায়ের কাছে গিয়ে সাতকাহন গপ্পো মারবার কী দরকার ছিল ? মায়ের কানে খোড়কে গুঁজে, আমার সর্বনাশ না করলে চলছিলো না ?
    জানেন তো মিসেস মল্লিক, আজকে তো নিউমার্কেট গিয়েছিলাম। পরশু ননদের মেয়ের জন্মদিন, ওই কিছু উপহার টুপোহার নিলাম আর কি। ভেলোর সঙ্গে তো দেখা হলো, ও বলেনি কিছু? সঙ্গে তো একটা মেয়েও ছিল, ওরই বয়সী। কী যেন নাম? বলেছিল, ভুলে গেছি। বললো তো ওর বন্ধু। হাতে হাত রেখে দু’জন গটমট করে হেঁটে যাচ্ছিল। বেশ লাগছিলো কিন্তু ওদের।
    কী ডেঞ্জারাস মহিলা রে বাবা। ভাবা যায় না। অথচ ওনার সঙ্গে একজন পুরুষ ছিল, যাকে কস্মিনকালেও এই ফ্ল্যাটের আনাচে-কানাচেতেও কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। তার সঙ্গে গতরে গতর লাগিয়ে হ্যা হ্যা করে হাঁটছিলে, কই, সেকথা তো উচ্চারণ করলে না, বেমালুম চেপে গেলে।
    জিও কাকি জিও। যেদিন হাঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবো না, সেদিন বুঝবে ঠ্যালা। সোজা কাকুর কাছে পর্দা ফাঁস করে দেবো। বদলা আমিও নিতে জানি , মনে রেখো।
    কী ভাগ্যি কথাটা বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছোয় নি। মাই সুইটহার্ট মাদার, ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্ব দেয় নি, এই যা রক্ষে। শুধু তাই নয়- মা ওই মেয়ে বিভীষণ আমার বোনকেও বারণ করে করে দিয়েছিল, বাবার কাছে যেন এসব ফালতু কথা বলা না হয়।
    সেই থেকে মিলির সঙ্গে মেলামেশায় আরও গোপনীয়তা চালু করতে হলো। সন্ধ্যের ছাদ, সেই গোপনীয়তার মোক্ষম জায়গা ।
    অবিশ্যি অচিরেই বোঝা গেল, আমি একটি গোদা আহাম্মক। মিলির সঙ্গে প্রেমালাপ সাঙ্গ করে ফুরফুরে মেজাজে নিচে নামতেই, মা শান্ত গলায় বললো- শোন ভেলো, ফাগুনের চোরা ঠান্ডা। সন্ধ্যেবেলা ছাদে গিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করার দরকার নেই। যা বলবার, শোনবার এই ঘরে বসেই করবি। দ্বিতীয়বার যেন বলতে না হয়।
    আয়নায় নিজের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। লাল নাকি কালি বর্ণ ধারণ করেছিলো। তখনও একবার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। হে ফ্ল্যাটের মেঝে দুফাঁক হও। আমাকে সপাটে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছড়ে ফেলো। থেঁতলানো তরমুজ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকি।
    ধরণীতে কিছুই টেঁকসই নয়। সবই মায়ার খেলা।
    সময়ের সাথে সাথে মিলি মিলিয়ে গেল। রয়ে গেল স্মৃতি। কাউকে বলা যাবে না। রেখে দিতে হবে মন সিন্দুকের কম্বিনেশন চাবির গোপন অন্তরালে। নিঃশব্দে।

  • কবিতা

    কবিতা- ভালোবাসার দিন

    ভালবাসার দিন
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    ভালবাসো বা নাই বাসো
    আজ ভালবাসার বরাদ্দ দিন।

    গোলাপ দামী অথবা বাড়ন্ত!
    চকলেট খেতে হয়, উপহার,,
    চুম্বন আর আলিঙ্গন মেখে।

    গেল বছর হকদার ছিল অন্য জন
    এবছর তুমি, প্রাণসখা কিংবা প্রাণসখি।
    বদল তো হতেই পারে, চঞ্চল মন। কিন্তু,
    তারিখ বদল হবেনা ভালবাসার ক্যালেন্ডার
    এবং নির্ধারিত নাম।

    শুধু বদলে যায় ভালবাসার মানব মানবী,
    স্বার্থপরতার মিথ্যে টানাপোড়েনে।

    এসো সেলিব্রেশনে মাতি, নাটুকে,
    হুজুগ বৈ তো নয়, এসো আদর করি,
    অভিনয়ে আপত্তি কী?
    আজ, ভালবাসার বরাদ্দকৃত রঙচঙে দিন।

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- বীজমন্ত্র

    বীজমন্ত্র
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    ভালো থেকো..
    বললেই কী ভালো থাকা যায়?
    শর্ত আছে না,
    ভালো রাখার শর্ত; পুরণ করেছিস?
    না? হায়, তবে হলো না।
    বীজ বপন কর, তবে তো ফসল,
    ভালোবাসার, ভালোরাখার আনন্দ ফসল।
    নে, এইবারে ভালো থাক
    এইভাবে আজীবন,
    ভালো রাখাই ভালো থাকার বীজমন্ত্র ।।

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- যখন প্রতিবাদ

    যখন প্রতিবাদ
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    কপালে চিতা জ্বলছে
    বুকে পাথরের স্তুপ।
    এখানে সূর্য আগুন ঝরায়
    সমুদ্র এসিড।
    রোবসপিয়র এখনো জীবিত
    গিলোটিন পরাস্ত মিথ্যা চাতুরীর কাছে।
    প্রতিটি গৃহের কোনায় কোনায়
    দানা বাঁধছে যুদ্ধ।
    ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে
    এবার পদপিষ্ট হও রোবসপিয়র,
    কিষাণ দল হাঁটছে, চোয়াল শক্ত করে
    ভয় বেড়ালকে দেখিও, ওরা বাঘের বাচ্চা।

  • গল্প

    গল্প- সাপের বিষ

    সাপের বিষ
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    এক:–
    সরু গলির লাইটপোস্টের নিচে, ক্যাজুয়াল প্রেম।
    নিত্য সন্ধ্যায়, উঠতি যুবক যুবতীর মুচমুচে আলাপন। স্বপ্নের আঁতুড়ঘর। ভালোলাগা সময়কে আনাড়ি হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টা। প্রেমের কানামাছি লুকোচুরি খেলা।
    দুটি নব্য কচি হৃদয়ের লাজুক ইন্দ্রিয়বিলাসী
    কাছাকাছি আসা।
    হয়তো ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা। তারপর হারিয়ে যাওয়া, কোন সে অচিন পাখির দেশে। খবর রাখে না লাইটপোস্ট। শুধুই সাক্ষী থেকে যায়, নির্বিকার।

    গলিটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে সন্ধ্যের পরে। লুকোনো প্রেমের আলতো ছোঁয়া শিহরণ, শরীর থেকে শরীরে। মন থেকে মনে, হয়তো প্রাণেও।
    আবেগ ময় আলো আঁধারি নির্জনতায়, প্রেম এখানে স্বপ্ন মধুর, মায়াময়।
    ক্লান্তিহীন হৃদয়ের ক্ষণিকের সময় যাপন।
    মৃদু কথার ফিসফিস, মান-অভিমান, রাগ, সাময়িক বিচ্ছেদ।
    আবার, দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়।
    সব কথার, ঈঙ্গিতের, ভীরু স্পর্শের একমাত্র নির্বাক সাক্ষী, ঐ টিমটিমে আলো ছড়ানো সাঁঝবাতি লাইটপোস্ট।

    লাইটপোস্টের নিচে চলে নিরন্তর আলো আঁধারের হাসিকান্না খেলা। একজোড়া কপোত-কপোতী যায়, আবারও আসে নতুন জোড়া। লাইটপোস্ট নির্বিকার সাক্ষী। সাক্ষী আরও একজন, কাদু পিসি।
    লাইটপোস্টের ঠিক উল্টো দিকেই কাদু পিসির টালির চালাঘর। ছোট্ট একটি জানালা। সন্ধ্যের মুখে জানালার নড়বড়ে কপাট বন্ধ করে দেয় পিসি, মশার জ্বালায়।
    কিন্তু, সেই ভাঙা নড়বড়ে কপাটের গায়ের এলোমেলো অজস্র ছ্যাঁদা, বাইরের প্রায় সবকিছুই ঘরের ভেতর থেকে দেখতে খুবই সাহায্য করে। পিসি সেই সুযোগ পুরো মাত্রায় উপভোগ করে শুধু নয়, কাজেও লাগায়।
    কাদু পিসি। মাঝবয়েসী মহিলা। পেশায় আয়া। তবে ইদানীং আর সেই কাজে মন নেই। বড্ড ঝক্কি সামলাতে হয়। অন্য পথে সহজে আয়ের সন্ধান পেয়ে গেছে কাদু।
    তারই ঘরের সামনে, লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সাঁঝ বেলায় প্রেম সঙ্গোপনে আসা উঠতি যুবক যুবতীরাই ওর আয়ের বর্তমান উৎস।

    সময় বুঝে গুটিগুটি পায়ে কাদু পিসি এসে দাঁড়ালো নব্য যুবা প্রেমিক প্রেমিকার সামনে। কপালে মৃদু ভাঁজ তুলে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা এখানে কী করছো বাবা?
    ছেলেটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো- কিছুনা , মাসিমা, এমনিই গল্প করছি।
    কাদু মুচকি হেসে বললো- মাসিমা নয় পিসি।
    কাদু পিসি। এখানে সবাই আমাকে এই বলেই ডাকে। তারপরেই, নিজের টালির চালাঘর খানা দেখিয়ে বলে, এই ঘরখানা আমার। একলাই থাকি। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বললো,
    চলো, আমার ঘরে চলো। তোমাদের আমার বেশ ভালো লেগেছে। এসো, ঘরে বসে দুটো কথা বলি তোমাদের সঙ্গে, এসো।
    কিছু কিছু ডাক আছে, যা উপেক্ষা করার ইচ্ছে থাকলেও তা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
    রুপকথার নিশি ডাকের মতো। মায়াবী ছলনার হাতছানি। রেহাই পাওয়া ভারী মুশকিল।
    এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাদু পিসির সঙ্গ নিলো।
    সাক্ষী রইলো লাইটপোস্ট।

    স্বাভাবিক ভাবেই খুবই সাদামাটা ঘর। একটা চৌকিতে বিছানা পাতা। পাশে একটা চেয়ার। ঘরের ভেতরেই আরও একটা দরজা। সেটা পেরিয়ে এলেই, একপাশে কলঘর, অন্যপাশে রান্নার জায়গা।
    রান্নাঘরের দেওয়ালে একটা জানালা।
    সেটা বন্ধই ছিল। পিসি জানালার কপাট খুলে দিলো। আশ্চর্য! জানালায় শিক বা গরাদ নেই। বিলকুল খোলা। অনায়াসে সেখান দিয়ে যে কেউ বাইরের ঝোপঝাড়ের জঙ্গল পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে কিংবা বেড়িয়ে যেতে পারে।
    ছেলে মেয়ে দু’টি, নিজেদের মধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে নিলো।
    সেই তাকানোর মধ্যে লুকিয়ে ছিল কিছু প্রশ্ন।
    পিসি বলছিল, একাই থাকে। তাহলে এমন ভাবে জেনেশুনে ঘরের মধ্যে এমন একটি উন্মুক্ত নিরাপত্তাহীন জায়গা কেন করে রেখেছে। নাকি, তার দিক থেকে ভয়ের কোনও কারণ নেই, এমন নিশ্চয়তায় বিভোর হয়ে আছে?
    জানালার কপাট বন্ধ করতে করতে পিসি, হাসি মুখে বললো,
    তোমরা যা ভাবছো, তেমন হবার কোনও সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
    প্রথমত, আমার এই ভাঙা ঘরে এমন কোনও দামী জিনিস নেই, যার লোভে কেউ এসে, তার মূল্যবান সময় নষ্ট করবে।
    রইলুম বাকি আমি। হা হা হা হা.. আমাকে দেখে কী তোমাদের মনে হচ্ছে, এই বয়সের শরীরে, সেই জৌলুশ কী আছে, যাকে হরণ করবার জন্য কেউ এত কষ্ট করবে? হা হা হা হা..তাছাড়া, জানালা বন্ধই থাকে সবসময়। ওদিকটায় ঝোপঝাড় ভর্তি। বড্ড মশার উপদ্রব। অবিশ্যি বাঁদিকে একটুখানি গেলেই রাস্তা।
    ওরা কথা গুলো শুনতে শুনতে ভাবছিল, পিসি, অকারণে কেন এই কথাগুলো শোনাচ্ছে? কেউ-ই তো কিছুই জানতে চায়নি। তাহলে?
    পিসি বললো- থাক ওসব কথা। এসো, বিছানায় বসো। তোমাদের একটু চা করে দিই।
    ওরা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো- না না পিসি। একদম নয়। আমরা কেউই চা খাই না। তারচেয়ে আপনি বসুন, আপনার সঙ্গে একটু গল্প করি।
    পিসি একগাল হেসে বললো- ঠিকই বলেছো। তোমাদের ডেকে নিয়ে এলুম, গল্প করবো বলেই তো। কিন্তু কী হয়েছে জানো, আমার আজকে
    ডাক্তার দেখাবার দিন। কাজেই আমাকে একবার,
    ছেলেটি বললো, বেশ তো, আপনি অবশ্যই যান। আমরা না হয় আবারও একদিন আসবো। আজ চলি।
    পিসি ব্যস্ত হয়ে বললো,না না, সেকি! যাবে কেন? তোমরা এখানেই বসে গল্পসল্প করো, আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চলে আসবো।
    গলার স্বর একদম কম করে, প্রায় ফিসফিস করে বললো- তোমরা থাকো। কেউ আসবে না। কেউ বিরক্ত করবেনা। নিশ্চিন্তমনে দুজনে থাকো।
    আমি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিয়ে যাবো। যাতে কেউই কিছুই বুঝতে না পারে।
    যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো- ওই দ্যাখো, একদম ভুলে গেছি, তোমাদের নাম-ই তো জানা হয়নি..
    ছেলেটি বললো, আমি অয়ন, আর ও নয়না।
    বেশ, খুব ভালো, আচ্ছা অয়ন, একটা কথা, মানে, তেমন কিছু নয়। বলছিলাম যদি কিছু মনে না করো, আমার দু’ হাজার টাকার নোটটা তোমার কাছে রেখে, আমাকে শ পাঁচেক টাকা দিতে পারো? মানে, ডাক্তারখানায় টাকার ভাঙানি পাওয়া যায় না কিনা তাই।
    অয়ন প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে, পিসিকে দিয়ে বললো, এই নিন রাখুন । না না দু হাজার টাকার নোট আপনার কাছেই থাক। পরে না হয়, ফিরিয়ে দেবেন। আলাপ যখন হলো, তখন, আসা যাওয়া তো থাকবেই।
    -হা হা হা হা। বেশ বেশ, তাই হবে। আর হ্যাঁ শোনো, ভালো কথা, আমি যাবার পরেই ঘরের আলো নিভিয়ে দেবে। কেউ আসবে না বা ডাকবে না। তবুও, সাবধানের মার নেই, কেউ ডাকাডাকি করলে, ভুলেও সাড়া দিও না।
    আমি দরজায় তালা লাগিয়ে যাবো, আমিই এসে খুলবো। ততক্ষণ তোমরা..
    কথাটা শেষ করলো না। অদ্ভুত একটা মুখ ভঙ্গিমা করে, এমন ভাবে তাকালো, যার মধ্যে মিশে আছে আদিম প্রবৃত্তির নিকৃষ্ট ঈঙ্গিত।

    দুই:–

    কাদু পিসি দরজা বন্ধ করে চলে যাবার পরেই, অয়ন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
    ওকে খুবই গম্ভীর আর সিরিয়াস লাগছিলো।
    গোড়া থেকেই এই মহিলাকে একেবারেই ভালো লাগেনি অয়নের।
    কথায়, চোখের চাহনিতে কেমন যেন চাতুরীর আভাস। মতলব বাজ, সেয়ানা।
    অয়ন, জানালাটা সামান্য একটু ফাঁক করে, বাইরেটা দেখে নিয়ে, উত্তেজিত, তবুও গলার স্বর নামিয়ে, ফিসফিস করে বললো- নয়না, এসো, দু’জন মিলে বাড়িটা ভালো করে সার্চ করি।
    নয়না, এতক্ষণ নীরব শ্রোতা দর্শক হয়েই বসে ছিল। অবাক হয়ে বললো- কেন? কিসের সার্চ।
    অয়ন নয়নার চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বললো- সেকি, বুঝতে পারছো না? এই মহিলা অত্যন্ত চতুর। এবং আমার মনেহ য় ইনি আরও অনেক কুকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। দেরি করে লাভ নেই। এসো, কাজে লেগে যাও।
    আমি যা সন্দেহ করছি, তাই যদি সত্যি হয়,তাহলে এই ঘরেই তার কিছু প্রমাণ অবশ্যই পাওয়া যাবে।
    নয়না অবাক হয়ে বললো- একি! তুমি হঠাৎ গোয়েন্দা হয়ে গেলে না কি?
    অয়ন একটু বিরক্ত স্বরে বললো- বাজে কথা না বলে, যা বলছি তাই করো।
    দু’জন মিলে ঘরের আনাচে কানাচে তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলো।
    একসময় অয়নের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলো। রান্নাঘরে রাখা মশলার কৌটো থেকে বেড়িয়ে এলো, ব্রাউন সুগারের দুটো প্যাকেট। আর একটা কৌটো থেকে হেরোইনের একটা প্যাকেট।
    টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া গেল, বিদেশি কোম্পানির তৈরি, হট সেক্সি ছবি দেওয়া, ডজন খানেক কন্ডোম। আর চৌকির নিচে রাখা কয়েকটা মদের খালি বোতল।
    নয়না ঘামতে শুরু করেছে। গলা বুঁজে আসছে। ভয়ে ঠোঁট কাঁপছে। কোনও রকমে কাঁপা গলায় বললো- এখন কি হবে?
    অয়ন বুঝতে পারছে, নয়না আতঙ্কিত হয়ে গেছে। ওকে সাহস যোগানো দরকার।
    নয়নাকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে, ফিসফিস করে বললো- নয়না, প্লিজ বি স্টেডি। ভয় কী? আমি তো আছিই তোমার সঙ্গে।
    তারপর, হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো-
    নয়না শোনো। খুব ভালো করে মন দিয়ে যা বলছি শোনো।
    নয়না প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো- আমার বড্ড ভয় করছে অয়ন। আমরা ফেঁসে গেছি। আমরা একেবারে বন্দী। ওই মহিলার মনে কী আছে জানি না। তবে, আমাদের সাথে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত।
    অয়ন নয়নার ঠান্ডা হয়ে ওঠা হাত, নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে বললো- কিচ্ছু ফেঁসে যাইনি। ওর পাতা ফাঁদে আমরা পা রাখিনি। আমি অনেক আগেই ওর মতলব বুঝতে পেরেছিলাম।
    যাই হোক, শোনো। আমরা একদমই বন্দী নই। রান্নাঘরের গরাদ ভাঙা জানালাটা, ওই মহিলা তখন ইচ্ছে করেই আমাদের দেখিয়েছিল।
    ও চেয়েছিল, এই ফাঁকা নির্জন ঘরে, তুমি-আমি, উল্টোপাল্টা কাজকর্ম শেষ করে, যাতে ওই ভাঙা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাই।
    ডাক্তারখানা, দু হাজার টাকার নোটের গল্প। সব বানানো। ওর তো পাঁচশো টাকা পাওয়া হয়েই গেছে।
    নয়না, ভয়মিশ্রিত গলায় বললো- কিন্তু ওইসব মাদক, আরও সব!
    অয়ন হালকা হেসে বললো- ওইসব, যারা ওর ফাঁদে পা রাখে, তাদের জন্যে। আরে বাবা একটু ভেবে দ্যাখো না। কোথায় পাবে? এমন সুবিধে পাবে কোথায়? নিরিবিলি নিরুপদ্রপ ফাঁকা ঘর। হাতের কাছে নেশার জিনিস আর কথাটা উচ্চারণ না করে, নয়নার দিকে তাকিয়ে, টিক ক’রে একটা চোখ টিপে, ইশারায় বুঝিয়ে দিলো।
    নয়না চোখ সরিয়ে নিয়ে, মাথা নিচু করে বললো- যা-ই বলো, ভুলটা কিন্তু আমাদেরই। আমাদের কিন্তু এইরকম নির্জন জায়গায় গলির মধ্যে এসে দাঁড়ানো উচিৎ হয়নি। এটা তুমি মানবে কি না আমি জানি না। আমরা তো কোনোদিন এখানে এভাবে আসিনি। তাহলে, আজ এলাম কেন? হ্যাঁ, এটাও ঠিক, আমরা জানতাম না, এখানে আমাদের জন্য এইরকম একজন জঘন্য মানুষ ফাঁদ পেতে বসে আছে, এবং আমরা তার শিকার হবো। কিন্তু অয়ন, খুব ভালো করে ভেবে বলো তো, আমরা কী একটু বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলিনি? বিপদ অন্য জায়গা থেকে, অন্য ভাবেও আসতে পারতো। আমরা একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে হঠকারিতা করে ফেলেছি। ভুল আমাদের।
    অয়ন তার ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বললো- ইয়েস, রাইট ইউ আর। আই এম ভেরি স্যরি নয়না।
    নয়না চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো- ওফ, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না। চলো, পালাই।
    অয়ন, সাহস যোগাতে নয়নাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো- ঠিক আছে। চলো। মহিলা অবশ্য তাই চেয়েছিল। সুতরাং, আমরা চলে গেলে, ও কিছুই সন্দেহ করবে না।
    তারপর অয়ন নয়নাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে, কাঁধের ওপর চাপ দিয়ে বললো- আমি এই বদমায়েশ মহিলাকে ছাড়বোনা। এর শেষ দেখে ছাড়বো। চলো..

    তিন:–

    পরদিন দুপুরে ওরা একটা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসলো। কফি আর কিছু স্ন্যাকসের অর্ডার দিলো। আজ দুজনকেই বেশ গম্ভীর লাগছে।
    গতকালের ঘটনা, ওদের ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছে, সেটা ভালো রকম বুঝতে পারা যাচ্ছে।
    নয়নাই প্রথম মুখ খুললো, জানো, কাল রাতে একদম ঘুমোতে পারিনি। বারবার ওই বিশ্রী ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। কিছুতেই ভুলতে পারছি না, এইরকম একটা সাংঘাতিক ভুল করলাম কেমন করে!
    অয়ন অপরাধীর মতো মুখ করে নিষ্প্রাণ গলায় বললো- এগজ্যাক্টলী। একে মতিভ্রম ছাড়া আর কিই বা বলা যায়। তারপরেই হঠাৎ স্বর চড়িয়ে বললো, তবে দেখে নিও, আমি কিন্তু ওকে ছাড়বো না।
    নয়না তাচ্ছিল্যের সুরে বললো- কী করবে, পুলিশকে জানাবে? অত সহজ নয়। পুলিশের কাছে যেতে হিম্মৎ লাগে। আছে? কী বলবে পুলিশকে? আমরা ওই অচেনা মহিলার ঘরে গিয়েছিলাম নেমন্তন্ন খেতে? হুঃ..
    কিল খেয়ে কিল হজম বোঝো? যদি বোঝার মতো মগজ থাকে, তাহলে চুপচাপ হজম করে যাও। স্রেফ হজম, বুঝেছো?
    -কার হজমের গোলমাল হলো?
    -আরে শ্রীজিতদা। আপনি, আসুন আসুন, বসুন।
    অয়ন আর নয়না দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে, শ্রীজিতদার হাতে হাত মিলিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলো।
    শ্রীজিত চট্টোপাধ্যায়। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক।
    এই ক্যাফেটেরিয়ায় প্রায়ই আসেন।
    এখানেই ওদের আলাপ। তবে সেটা আর শুধুমাত্র আলাপের পর্যায়ে নেই। অনেকটাই হৃদ্যতা তৈরী হয়েছে এতদিনে। তার কারণ অবশ্য শ্রীজিত নিজে।
    তাদের মধ্যে বয়সের এবং সামাজিক মর্যাদায় যথেষ্ট তফাৎ থাকা সত্বেও, শ্রীজিতের অহংকার শূন্য নির্ভেজাল বন্ধুত্ব, ওদের মাঝে অনাবশ্যক কাঁচের দেওয়াল তৈরী হতে দেয়নি। ওকে দেখে বোঝাই যায় না, এই মানুষটা এতো ভালো ভালো হিট ছবি তৈরী করেন। ঈশ্বরের আশ্চর্য কারসাজি। প্রতিভা বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়। তার প্রকাশ কাজে।
    শ্রীজিতদাকে দেখেই, ক্যাফেটেরিয়ার ম্যানেজার আব্দুল কাদির কাউন্টার ছেড়ে ছুটে এলেন।
    আদাব দাদা। ভালো আছেন তো? কী খাবেন বলেন- শ্রীজিত, নয়না আর অয়নকে জিজ্ঞেস করতে, তারা জানালো, ইতিমধ্যেই তারা কফি আর স্ন্যাকসের অর্ডার করেছে। সেই শুনে শ্রীজিত বললো- তাহলে আমারও একই অর্ডার রইলো।
    আব্দুল হাসিমুখে তার জায়গায় ফিরে গেল।
    -এইবারে বলো তোমাদের খবর কী?
    দুজনেই একেবারে চুপ। শ্রীজিত অভিনয়ের কারবারি। সুতরাং তার পক্ষে বডি ল্যাংগুয়েজ বুঝতে পারা কঠিন নয়। আন্দাজ করলেন কিছু একটা সমস্যা। যেটা এরা বলতে কুন্ঠিত বোধ করছে। ব্যাপারটা হাল্কা করার জন্য বললেন,
    আচ্ছা যাই হোক, তোমরা কেমন আছো বলো?
    অয়ন হালকা গলায় বললো- দাদা আপনি এসে, মানে.. আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে।
    শ্রীজিত দুই ভ্রুর মাঝে লম্বাটে ভাঁজ তুলে বললেন- কী ব্যাপার বলো তো? তোমাদের খুব টেন্সড লাগছে। কিছু ঝামেলা না কি? আপত্তি না থাকলে, বা আমাকে বলার মতো হলে, নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো।
    নয়নার চোখে জল। রুমাল দিয়ে চেপে ধরলো।
    শ্রীজিত বুঝতে পারলেন, নিশ্চয়ই কোনও সিরিয়াস ব্যাপার। কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে উনি খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন- নয়না এখানে মানে এই পাবলিক প্লেসে, আমার উপস্থিতিতে এমন কিছু করো না, যাতে আমাকে বিব্রত হতে হয়, প্লিজ।
    নয়না তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললো- স্যরি দাদা, রিয়েলি ভেরি স্যরি। আমার এরকম করা উচিৎ হয়নি।
    কিন্তু বিশ্বাস করুন দাদা, কী বলবো, এমন নিদারুণ অসম্মান.. মানুষের চরিত্র এত খারাপ! এতো নির্লজ্জ হতে পারে, কখনও চিন্তাও করতে পারি না। যদিও ভুল আমাদেরই।
    শ্রীজিত এসব কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। খুবই স্বাভাবিক। অবাক হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হলো না।

    কফি আর স্ন্যাকস এসে গেছে। শ্রীজিত বললেন,
    নাও, এগুলো খেয়ে, চলো বেড়িয়ে পড়ি।
    অয়ন সামান্য অবাক হয়ে বললো- কোথায়?
    শ্রীজিত কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন- কাছেই, একটা শুটিং লোকেশন দেখতে যাবো। তোমরাও চলো। কাজও হবে আর তোমাদের সমস্যার কথাও শোনা যাবে। কী, আপত্তি নেই তো?
    নয়না সঙ্গে সঙ্গে বললো- মোটেই না। কোনও আপত্তি নেই। এতো আমাদের সৌভাগ্য। আপনার সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটাতে পারবো।
    -ভেরি গুড, চলো।
    ক্যাফেটেরিয়ার পাশেই শ্রীজিতের গাড়ি পার্ক করা ছিল। গাড়ি ছুটে চললো গঙ্গার দিকে, শুটিং লোকেশনের উদ্দেশ্যে।

    চার:-

    শহরের মধ্যেই এমন চমৎকার মনোরম নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জায়গা, আশ্চর্যজনক অনাদরে পড়ে ছিল অনেকদিন।
    যেন হঠাৎ এক জাদুকরের ছোঁয়ায়, অবহেলিত পাষাণ মূর্তি, মনোলোভা রূপবতী রাজকন্যা হয়ে উঠেছে।
    কুলকুল করে বহমান গঙ্গা নদী। ভেসে চলা মাঝিমাল্লার নৌকো। মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস। পাখিদের কিচিরমিচির ওড়াউড়ি। সবুজ ঘাস আর গাছে ছাওয়া সারা অঞ্চল, যেন রূপরাণী নববধূ বেশে সেজেছে।
    এইখানের বাতাসে মন শান্ত, পবিত্র হয়ে যায়।
    নয়না বিমোহিত হয়ে একটিই শব্দ উচ্চারণ করলো- বাহঃ।
    অয়ন বললো- এখানে আগেও এসেছি, কিন্তু তখন এমন সুন্দর করে সাজানো ছিল না। বড্ড নোংরা, এলোমেলো ছিল।এখানে আসতে ভালো লাগতো না। এখন খুব ভালো লাগছে।
    শ্রীজিত চিত্র পরিচালকের দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বললেন- ঠিকই বলেছো। সত্যিই খুব সুন্দর জায়গা। নৌকোও নিশ্চয় ভাড়ায় পাওয়া যাবে। ঠিক আছে ।
    নয়না শ্রীজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-
    শ্রীজিতদা, আপনি কী নতুন কোনও ছবি করার কথা ভাবছেন?
    শ্রীজিত সিগারেট ধরিয়ে বললেন- হ্যাঁ, এবার একটা অন্য রকম ছবির কথা ভাবছি।
    অয়ন বললো- অন্যরকম বলতে?
    -অন্যরকম বলতে, আজকের সমাজের কিছু জলন্ত সমস্যা। যেমন মনে করো, এই যে তোমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু। তোমাদের চোখে অনেক স্বপ্ন। তোমরা হয়তো নিজেদের প্রস্তুত করছো, আগামী দিনে সেই রঙিন স্বপ্নগুলোকে সত্যি করে তুলবে বলে।
    কিন্তু এমন যদি হয়, যে এই সমাজের কিছু নোংরা মানুষ, তোমাদের সেই স্বপ্ন, ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলো। অথবা, তোমরা নিজেরাই, নিজেদের প্রতি সৎ থাকতে পারলে না। তুচ্ছ মোহের ফাঁদে আটকে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেললে।
    অর্থাৎ, সমাজের প্রতিটি স্তর নির্ভেজাল সৎ হবে, এমনটি হয়তো প্রত্যাশা করাই যায়। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। সবকিছুই কিছুতেই তোমার মনের মতো হবে না। হতে পারে না। যদি হতো, তাহলে পৃথিবীর চেহারা একেবারে অন্যরকম হতো।
    আসলে কী জানো। সুশ্রী আর কুশ্রী, সাদা আর কালো, এই দুটি রূপই আমাদের মধ্যে বসে আছে। তোমাকেই নির্ণয় করতে হবে, প্রকৃতপক্ষে তোমার লক্ষ্য কী। একটু আগে বলছিলে না? এই জায়গায়টা আজকে খুব সুন্দর, অথচ এখানে কিছুদিন আগেও আসতে ভালো লাগতো না;
    তার মানে, এখানকার সৌন্দর্য ছিল অন্তরালে। চাপা পড়া। মলিনতা দূর হতেই, প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হলো।
    নয়না বললো- তাহলে আপনি বলতে চাইছেন । সকলের মধ্যেই ভালো মানে সাদা দিকটা থাকেই। শুধুমাত্র সঠিকভাবে নিজেকে পরিচালনা করার অদক্ষতার কারণেই কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হয়।
    – এগজ্যাক্টলী। দুনিয়ায় কেউ দুরাচারী হয়ে জন্ম নেয় না। আবার ধোয়া তুলসীপাতা হয়েও নয়।
    অথচ সমাজে আমরা এদের সকলকেই দেখতে পাই।
    তোমার জীবনের চলার পথ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তোমারই হাতে। চয়েস ইজ ইওয়োরস।
    তোমার মধ্যে থাকা ছুরিটা জীবন নিতেও পারে আবার দিতেও পারে। ডাক্তার কিংবা ডাকাত।
    কথাটা শেষ করেই শ্রীজিতদা হা হা.. করে খুব জোরে হেসে বললেন- যাক গে, বাদ দাও।
    এবার তোমাদের কথা বলো।
    অয়ন বললো- আচ্ছা দাদা, আপনার এই ছবি কী ক্রাইম বেসড?
    -দ্যাখো সমাজের কালো দিক দেখাতে হলে, অবশ্যই অপরাধ জগৎ সামনে এসেই যাবে।
    নারীপাচার, ড্রাগস, নানান দুর্নীতি, মস্তানি, দাদাগিরি, এইসবের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ। কেউ বাদ যাবে না।
    আরও একটা ভীষণ স্পর্শকাতর ব্যাপার অবশ্যই থাকবে। সেটা হলো, এই তোমাদের মতো বয়সের যুবক যুবতীদের, সমাজের কিছু স্বার্থপর বেয়াদব মানুষ, নানান কায়দায় প্রলোভন দেখিয়ে বিপথগামী করে তোলে। বয়সের দোষ কিংবা মোহান্ধতা বা বেহিসেবী কাম উত্তেজনা। স্যরি টু সে। প্লিজ ডোন্ট টেক ইট ফ্রম রং এঙ্গেল।
    দ্যাখো হুল্লোড় সাময়িক আনন্দ অবশ্যই দেয়। কিন্তু তার পরিণতি হয় মারাত্মক।
    সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে কেউ কেউ ফিরে আসতে হয়তো পারে। মনের জোরে। অনেকেই হারিয়ে যায় চিরতরে। অন্ধকারে।
    আর ভয়ের কথা কী জানো? এই নরকের হাতছানি কিংবা ফাঁদ, যাই বলো, সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই সমাজেরই আনাচে কানাচে। এক্কেবারে আমাদের গা ঘেঁষে। যারা চিনতে পারে তারা সেই মায়াবী খেলা থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
    আসলে তারাই প্রকৃত সাহসী, লড়াকু।
    চলো, অনেক বকবকানি হয়েছে, একটু কোল্ড ড্রিঙ্কসের খোঁজ করা যাক, চলো।

    পাঁচ:–

    কোল্ড ড্রিংকের খালি বোতল ট্রে-তে নামিয়ে রেখে শ্রীজিত চট্টোপাধ্যায় গম্ভীরমুখে বললেন- বলো কী! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। ভাই অয়ন, আমি তোমার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। কিন্তু পাশাপাশি একথাও বলবো, যে কেউ, অজানা অচেনা মানুষ, তোমাদের ঘরে নিয়ে যেতে চাইলো, আর তোমরাও সাতপাঁচ না ভেবে, তার ঘরে ঢুকে গেলে! এটা.কী বলবো..চরম নির্বুদ্ধিতার কাজ হয়েছে।
    ওরা মাথা নিচু করে, ওদের খালি হয়ে যাওয়া বোতলগুলো নামিয়ে রাখলো।
    তারপর অয়ন বললো- দাদা আমাদের এই ব্যাপারটা কিন্তু শুধু আপনাকেই বললাম। আর কেউ জানে না। মানে আমরাই জানাইনি।
    শ্রীজিত সিগারেট ধরিয়ে বললেন- ঠিকই করেছো। কী বলতে? তোমরা একটা বিরাট কাজ করে ফেলেছো? কেউ বিশ্বাস করতো না। উল্টে তোমাদেরই নানাভাবে হেনস্তা হতে হতো।
    তোমাদের কী ধারণা? ঐ মহিলা নিজের জোরে এই ধরনের অসামাজিক অপরাধ মূলক কাজ বিনাবাধায় বুক চিতিয়ে করে যাচ্ছে?
    মোটেই নয়। এর পিছনে অনেক মাথাভারি মাতব্বররা জড়িয়ে আছে।
    টাকার খেল। ভাগ-বাটোয়ারা। টপ টু বটম দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। প্রতিবাদ করলে মারা যেতে হবে।
    এরা অনুভূতিহীন, অজ্ঞ, অশিক্ষিত।
    টাকা ছাড়া কিচ্ছু চেনেনা। তোমাদের মতো ইয়াং গ্রুপই ওদের টার্গেট।
    তবে একটা কথা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি-
    ওঝার মরণ সাপের বিষে। জেনে রাখো, ঐ মহিলাও এই নিয়মের বাইরে নয়।
    আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার চলো ফেরা যাক।

    সন্ধ্যে হয়ে আসছে। গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সূর্য ঢলে পড়েছে। গোলাপি আভায় ছেয়ে গেছে, আকাশ, নদীর জল। পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান।
    দিন শেষের সন্ধিক্ষণে প্রকৃতি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে ওঠে।
    অয়ন আর নয়নাও প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হঠাৎই আরও গম্ভীর হয়ে গেল।
    সেদিনের অপমানের জবাব দিতে না পারা পর্যন্ত শান্তি নেই।
    শ্রীজিতদা-কে সবকথা বলার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। শ্রীজিতদা হয়তো একটা কোনও উপায় করে দেবেন। ঐ মহিলাকে শাস্তি দেবার ব্যাবস্থা করবেন। কেন না, শ্রীজিতদা খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইচ্ছে করলেই এইরকম জঘন্য প্রকৃতির লোকজনকে নিমেষে শায়েস্তা করতে পারেন।
    কিন্তু উনি যা বললেন, তাতে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারা গেছে, উনি কিছুই করবেন না।

    ধর্মের নাকি কল আছে? আর সেটা নাকি বাতাসে নড়ে! কে জানে হতেও পারে হয়তো। অন্তত এই মুহূর্তে অয়নের তেমনই মনে হচ্ছে।
    তখন সকাল ন-টা হবে। অয়ন ফোন করলো নয়নাকে।
    -আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?
    নয়না অবাক হয়ে বললো- কেন? কী ব্যাপার?
    বোঝা গেল নয়না কাগজ পড়েনি ।
    -শোনো, জবর খবর। সেই মহিলা, ক’দিন আগে যার খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই ধুরন্ধর কাদু পিসি। কাল রাতে খুন হয়ে গেছে।
    কে বা কারা, ওকে সাপের বিষ ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে রেখে গেছে।

    নয়না নির্বাক। শুধু শুনলো। একটাও কথা বললো না। শুধু শ্রীজিতদার একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল।
    ওঝার মৃত্যু সাপের বিষে।

You cannot copy content of this page