-
গল্প- একটি অবিশ্বাস্য চিঠি
একটি অবিশ্বাস্য চিঠি
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়ঘরের দরজা পুলিশ এসে ভাঙলো।
ফ্ল্যাটের মালিক, বাদল বাবু। এখন একাই থাকেন। ত্রিশ ঘন্টা অতিবাহিত। দরজা খোলেন নি। ডেকেও সাড়া পাওয়া যায় নি। কিছু গোলমাল নিশ্চয়ই। সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে প্রতিবেশী মন। জর্জরিত জীবন। উটকো ঝঞ্ঝাট কে আর গায়ে পড়ে নিতে চায়! যাদের কাজ তারাই করুক।
বাদল ব্যানার্জির দেহ, পাখায় ঝুলন্ত। ধরাধরি করে নামিয়ে খাটে শুইয়ে দেওয়া হলো, লাশ।
হ্যাঁ, লাশ। মরণের পরে ওই একটাই নাম।
লাশ কিংবা বডি।
নাম নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই। শুধুই লাশ।
পরনে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি। একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
কত হবে বয়স..হ্যাঁ, সত্তর তো বটেই। একাই থাকতেন ইদানীং।
স্ত্রীকে হারিয়েছেন অনেকদিন আগেই। তারপর থেকেই বাপ ছেলের সংসার।
বিশাল সাজানো গোছানো সুদৃশ্য ফ্ল্যাট। মাত্র কয়েক বছর আগেও গমগম করতো। কত মানুষের যাতায়াত। জন্মদিন পার্টি। নারী পুরুষের সমবেত রাতজাগা হুল্লোড়। আজ নিস্তব্ধ।
আনন্দ স্মৃতিগুলো কালের নিয়মে ইতিহাস হয়ে যায়। বেদনার জন্ম দেয়।
স্ত্রীকে হারানোর শোক তাকে ভেতরে ভেতরে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। যদিও, তা তিনি কখনও মুখে প্রকাশ করেননি। তবুও তার আচরণে আভাস পাওয়া যেতো সবই।
মন পোড়া গন্ধ বোধকরি গোপন থাকে না।
কিন্তু, ছেলের জন্যেই সব কষ্ট দুঃখ একপাশে সরিয়ে রেখে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অবিশ্যি তার কারণ একটা ছিল।
স্ত্রীর ভারি ইচ্ছে ছিল, তাদের একমাত্র সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
বাদল ব্যানার্জি সেই ইচ্ছে পুরনের বাসনায় জয়ী। তাদের একমাত্র ছেলে, আজ আই.এ.এস. অফিসার।
বাদল ব্যানার্জির লাশ এইমাত্র পুলিশ নিয়ে গেল লাশকাটা ঘরে।
আই.এ.এস. অফিসার ছেলে আর তার স্ত্রী এখনো এসে পোঁছোতে পারে নি। যদিও তারা খুব দূরে থাকে না। গাড়িতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। আসলে দুরত্ব বাধা নয়। অভাব হৃদয় নৈকট্যের। শিক্ষা বা পদমর্যাদা কাউকে জ্ঞানী করে না। সে একেবারেই অন্য বিষয়। মুখস্থ বিদ্যা শংসাপত্র দাবী করে, আর শংসাপত্র খুলে দেয় উপার্জনের উপায় পথ। জ্ঞান আসে অন্য পথ ধরে। মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের হাত ধরে।
মালতী কাঁদছিল। রিটায়ার্ড কর্নেল বাদল ব্যানার্জির মৃতদেহের পাশে একমাত্র ক্রন্দনরতা মানুষ, মালতী।
গেল দুবছর যাবৎ এই একলা হয়ে যাওয়া বৃদ্ধটির নিরলস সেবা করেছে। একেবারে মেয়ের মতো।
বিয়ে করে বউকে নিয়ে ছেলে তাকে একলা রেখে দিয়ে চলে যাবার পর, কর্নেল মাঝে মাঝেই বলতেন, আমার একটা মেয়ে থাকলে বড্ড ভালো হতো। আর কিছুই হোক না হোক খবরটা অন্তত নিতো। মায়ের জাত কি না। ফোনে হলেও খবর নিতো প্রতিদিন, নিয়ম করে।
বেঁচে আছি নাকি মরে ভূত হয়ে গেছি।
মালতী রাগ করতো। ধমকে বলতো, ওসব কথা বলতে মানা করেছি না? লোকে শুনলে কী বলবে বলো দেখি! তারা আড়ালে হাসবে না? বলবে, নিশ্চয়ই তোমার কোনো দোষ আছে, তাই ছেলে তার বউকে নিয়ে চলে গেছে।
সবাই খুঁত খুঁজতে ওস্তাদ। বুঝেছো? যে যাকে নিয়ে ঘর করে, সে জানে কে কেমন। ওসব কথা এক্কেবারে মুখে আনবে না। বুঝেছো?
কর্নেল অবাক হয়ে ভাবে, মালতী এইসব কায়দা শিখলো কোথায়। ওই তো বয়স। কত হবে? বড়জোর ত্রিশ।
ওর বরটা ভালো নয়। নেশা ফেশা ক’রে প্রায়ই মালতীর গায়ে হাত তুলতো। সংসারে মন ছিল না। শোনা যায় নাকি অন্য মেয়েমানুষ আছে। সেখানেই সবসময় পড়ে থাকে।
মালতীরা সব এমনই কপাল নিয়ে জন্মায়। দারিদ্র্যের অনেক জ্বালা।
এসব মেদিনীপুরের দেশের বাড়ির ঘটনা। মালতী কলকাতায় পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে। নইলে যা দিনকাল। হয়তো প্রাণটাই খোয়াতে হতো।
সেই থেকে মালতী এখানেই আছে। ভালোই আছে। মানে, এখন থেকে ছিল, হয়ে গেল। কর্নেল বাবু আর নেই। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হলেন। মালতী বাবা বলে ডাকতো। বলতো, তোমার তো মেয়ে নেই বলে মনে দুঃখ। সেই জন্যেই ওইইই ওপরওয়ালা তোমার মেয়ে করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিচ্ছু চিন্তা করবে না। আমি তো আছি।
সেদিন সকালে মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে ফোন এলো। পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে, শিগগির আয়, তোর মাতাল বর মরতে বসেছে। মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে।
মালতীর একটুও যাবার ইচ্ছে ছিল না। বর? সে তো তার কাছে কবেই মরে গেছে। মনের মরণই তো আসল মরণ। দেহ পোড়ালে ছাই।
কর্নেল বাবার কথা ফেলা যাবে না। বললেন, যা একবার। দেখা দিয়ে না-হয় চলে আসবি। ডেকেছে যখন, একবার যা।
তখন কী মালতী জানতো, ফিরেই এমন দৃশ্য দেখতে হবে ! তাহলে সে কী যেতো, ঐ বর নামক পাষণ্ডটার অকাল মৃত্যুতে, অকারণ বিধবা সাজার নাটকের নায়িকা হতে? কখনোই নয়।
একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। ঠিক তার পাশেই যত্নে রাখা একটি চিঠি ।
পুলিশ অফিসার খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন, সুইসাইড নোটটি। খুবই সাদামাটা, অথচ অদ্ভুত লেখা।
আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মরণ কখন কীভাবে আসবে জানা নেই। তাই নিজের পথ নিজেই স্থির করলাম। চললাম। আমার এই ইচ্ছামৃত্যু অবশ্যই আমাকে চিরশান্তি দান করবে। আমার এইই বিশ্বাস।
শেষ বারের মতো নিজের নাম লিখছি..বাদল ব্যানার্জিএবার পুলিশ অফিসার টেবিল থেকে চিঠিখানি তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন, এই চিঠি যার উদ্দেশ্যে লিখছি , প্রথাগত নিয়মে তার নাম বা পরিচয় দেওয়া উচিৎ।
কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। তবুও প্রবল অনিচ্ছা সত্বেও দায়বদ্ধতার কারণে লিখলাম, আমার ঔরসজাত সন্তানের প্রতি। সারাজীবন ন্যায় এবং সত্যকে অবলম্বন করে বাঁচতে শিখেছি।অন্যায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা, আমাকে আপস করতে শেখায়নি। সাদা এবং কালোর প্রভেদ স্বীকার করতে কুন্ঠা বোধ করিনি কখনও।
তবে এও জানি, দুর্বিনীতের সঙ্গে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকলে, তথাকথিত সাংসারিক সমৃদ্ধি, আয়েশি সুখ, বিনোদন শান্তি অনায়াস লব্ধ হতে পারতো। কিন্তু অন্তরআত্মার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে তা লাভ করে, প্রকৃত শান্তি লাভ হতো কী?
আমার মতো সৎ আদর্শে উজ্জীবীত মানুষের কাছে তা হতো জীবনমৃত্যুর সমান।
তাই আমি এবং তোমার পরলোকগতা মা, সহজ সরল সত্যের চড়াই উৎরাই ভাঙা বিধস্ত পাথুরে পথই বেছে নিয়েছি।
নিজের সুকর্ম দক্ষতায় যেটুকু সঞ্চয় এবং পেনসন আছে, তাতে করে নিশ্চিত আনন্দ সহকারে কেটে গেছে অসার- অবশিষ্ট জীবন। তাছাড়া মাথা গোঁজার একটা নিজস্ব ঠাঁই তো আছেই।
কখনও কোনোদিন কোনকারণেই কারোর কাছে হাত পেতে দয়া কিংবা অনুগ্রহ ভিক্ষা করিনি, সে আমার অহংকার।
যাক, যে কথা বলতে চাই,
তোমার কু-গর্ভধারিণী মা, আজ থেকে দুবছর আগে ঠিক আজকের দিনে, ওপারে চলে গিয়েছেন ।
আমিও এই দিনটাকেই বেছে নিলাম।
তিনি গিয়েছেন শোকে এবং রোগে।
আমি যাচ্ছি, আমার দায় দায়িত্ব এবং কর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার শেষে। বেঁচে থাকার অনীহা বোধ থেকে। স্ব-ইচ্ছায়, আনন্দ চিত্তে।
হয়তো অনেকেই পাপের প্রসঙ্গ তুলবেন। আমি বলি, মৃত্যুর ধরন দেখে মানুষের পাপপুণ্য বিচার না করাই শ্রেয়।
যদি নিতান্তই করতে হয়, তবে তা করা হোক, তার সারাজীবনের কৃতকর্মের ভিত্তিতে।
বিগত প্রায় দুবছর, আমি তোমার তোমার মুখও দেখতে পাইনি। আসলে তুমি মুখ দেখতে এবং দেখাতে লজ্জা বোধ করেছো।
এটাই স্বাভাবিক। যে সন্তান, একটা টেলিফোন করেও বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ বাবার খোঁজ খবর নেবার সময় বা সুযোগ পায় না, সে তার আপন গর্বে গর্বিত হয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারে, কিন্তু তার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার লজ্জা ঢেকে রাখতে পারে না।
যাই হোক, লোক মুখে প্রাপ্ত সংবাদে জানলাম, তোমাদের একটি সন্তান লাভ হয়েছে।
সত্য কিংবা মিথ্যা জানি না। কেন না, আমি বিশ্বাস করি, গঙ্গাজল যত পবিত্রই হোক, নলের মধ্যে দিয়ে তা শোভা পায় না।
তবুও, যদি ঈশ্বরের কৃপায় তা সত্যই হয়, তবে সেই নবসৃষ্টির প্রতি রইলো আমার আর তোমার পরলোকগতা জন্মদায়িনীর শুভকামনা। সে যেন মানুষ হয়ে উঠতে পারে। বিবেকবান মহৎই মানুষ। আদর্শবান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দায়িত্বশীল মানুষ।
অনেকটা সময় বাঁচলাম। এখন মনে হচ্ছে, বড্ড অকারণ বৃথাই এই বাঁচা। তাই ফিরতে চাই আপন ঘরে।
একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছি। সম্পর্ক।
বুঝলাম, সম্পর্ক, একটি স্বল্প সময়ের ভেজাল নাটিকা। আসলে, আমরা কেউই কারোর নই। সবাই আলাদা । যে যার মতন। কেউই কারোর মতন কিংবা পরিপূরক নই।
আর রক্তের সম্পর্ক যদি বলো। আমি মনে করি, তার কোনও সারবত্তা নেই। আত্মার সম্পর্ক না থাকলে, তা নিছকই সামাজিক লৌকিকতা ভিন্ন আর কিছুই নয়। অনেক সময় তা সামাজিকতাকেও উপেক্ষা করতে কুন্ঠিত বোধ করে না। যেমন জলজ্যান্ত উদাহরণ তুমি নিজে।
সবশেষে তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানাই । আমার সঞ্চিত ধনের সবটুকু, যার অর্থমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। আমার অন্তিম সময়ের সাথী। আমার কন্যাসমা মালতীকে আইনমোতাবেক দানপত্র করে দিলাম।
এই ফ্ল্যাট কেবলমাত্র তোমাদের বসবাসের জন্য ব্যবহার করার অধিকার দিলাম। বিক্রি বা ভাড়ায় দেওয়ার অধিকার দিলাম না।
আমার মৃত্যুর একবছরের মধ্যে তোমরা আমার আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই মোতাবেক কাজ না করলে, এই ফ্ল্যাটের যাবতীয় সত্ব, মালতীর হবে। এই বিষয় কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। এটাই শর্ত।
ওঃ হ্যাঁ, আর একটা কথা। তোমরা আমার পারলৌকিক কাজ ইত্যাদি করবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছ। যদিও আমি মনে প্রাণে এইসব অকারণ অর্থহীন সংস্কারে একেবারেই বিশ্বাস রাখি না । তবু্ও, মালতীর যদি ইচ্ছে জাগে- তবে তার নিজস্ব মানসিক শান্তির জন্য, সে তা করতে পারে। আমার ইচ্ছে না থাকলেও আপত্তি থাকবে না। শুধুমাত্র মালতীর স্বাধীন ইচ্ছেকে মান্যতা দেবার জন্য। ওর কাছে ঋণী রইলাম।
তোমাদেরকে দেবার মতো আর কিছুই আমার নেই, এমনকি আশীর্বাদ কিংবা অভিশাপও। সেসব রইল ঈশ্বরের বিচারাধীন। আমার কাজ শেষ।
চেষ্টা করো ভালো থাকার, ভালো রাখার।
ইতি, বাদল ব্যানার্জিপুলিশ অফিসার পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মনে মনে বললেন,
বদলাতে হবে। ধরাবাঁধা জীবনের অনেক কিছুই বদলাতে হবে ।
এতক্ষণে গর্বিত পুত্র আর পুত্রবধূর আসার সময় হলো । সব গল্প শেষ হয়ে যাবার পর। -
গল্প- শাস্তি
শাস্তি
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়রাতের শেষ গাড়ি। সারাটা কামরা এক্কেবারে শুনশান। নাসিরকে নিয়ে বড়জোর, না না, বড়জোর কেন? বেশ গোনা যাচ্ছে। সাকুল্যে সাতজন। একটি যুবতী। স্বভাবতই বাকিরা পুরুষ। নাসিরের চোখ বারবার ওই দিকেই যাচ্ছে ঘুরে ফিরে। কারণ আছে নিশ্চয়ই।
নাসির সুঠাম যুবক। মেয়েটি শুধু সুন্দরী নয়, যথেষ্ট পরিপাটি। রঙ করা বাদামি চুল। নীল জিনস আর সাদা শার্ট। শ্যামলা গায়ের রঙের সাথে চমৎকার মানানসই। আর শরীরের গড়ন। সত্যিই নাসিরের পক্ষে চোখ সরানো দায়। মনোলোভা যুবতীর কিন্তু নজর তার হাতে ধরা মোবাইলে। কিছু একটা চিবিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। সম্ভবত চুইংগাম।
অবশিষ্ট যাত্রীগণ নিতান্তই সাধারণ মানের। নাসির ওদের কাউকেই চেনে না। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সকলকেই চেনা চেনা মনে হয়। এদের কেমন যেন সকলেরই একইরকম পোশাক-আসাক। একইরকম অভিব্যক্তি। উদাসীন অথচ চিন্তিত। বাইরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে যেন হুহু ঝড়ের দাপাদাপি। চোখ ঢুলুঢুলু। ব্যর্থতার জীবন্ত লাশ। অনিশ্চিত বর্তমান। ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত মানুষগুলো সে ভাবনা থেকে পরিত্রাণ চায়, কিন্তু মুক্তি পায় না। তাই একরাশ বিরক্তি ছেয়ে আছে চোখে মুখে সর্বত্র।
মেয়েটি কিন্তু একেবারে ব্যতিক্রমী। সারা পৃথিবীতে চরম দুর্বিপাক ঘটে গেলেও, যেন তাতে তার ভারী বয়েই গেল। এমনই নিস্পৃহ আর তাচ্ছিল্যের বেড়া টপকে তার নাগাল পাওয়া, সত্যিই দুঃসাধ্য।ট্রেন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ষ্টেশনে থেমেছে, আবারও চলেছে। পুরনো যাত্রী গন্তব্যে নেমে গেছেন, নতুন যাত্রী এসেছেন।নাসির অবিরাম তাকেই যেন চোখে চোখে রেখেছে।
এক্ষুনি একটা ষ্টেশনে গাড়িটা থামলো, আর সেই যুবতী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় ট্রেন থেকে নেমে গেল। নাসির কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেন চলতে শুরু করে দিলো। জানালায় চোখ রেখে চলমান হরিণীর দিকে অপলক নয়নে চেয়ে রইল নাসির। দুজনের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে হারিয়ে গেল নাসিরের ভালোলাগা।
কিন্তু মনে গাঁথা হয়ে রইলো। এই নিঃশব্দে পা টিপে টিপে আসা ভাললাগা নাসিরের মনের এমন জায়গায় জায়গা করে নিলো, যা সহজে মুছে যাবার নয়।
চলমান ট্রেনের খোলা জানালায় চোখ রেখে নাসির ভাবছিলো, মেয়েটি একবারও তার দিকে তাকিয়ে দেখেনি। শুধু তার দিকে কেন, মোবাইল ফোন ছাড়া সে কোনও দিকেই তাকায়নি।
কী করছিল ও। চ্যাটিং? বয়ফ্রেন্ড আছে কী? আশ্চর্যের কী আছে। থাকতেই পারে। নিশ্চয়ই তাই। নইলে এতোখানি নিমগ্ন! দূর কীসব ভাবছি, নিজেকে নিজেই নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করলো। ট্রেন পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। নাসিরকে এখানেই নামতে হবে।আসা যাওয়ার পথের ধারে এমন কতই ভালোলাগা আসে। কিছুদিন বিরাজ করে। তারপর কোনও একসময় মিলিয়েও যায়। যত্নের অভাবে। চারাগাছটি যেমন যত্নের অভাবে শুকিয়ে যায় ফুল ফোটবার আগেই, তেমনই। মরা গাছে ভ্রমর গুনগুন করে না।
মাস তিনেক পরের ঘটনা। সেদিনও নাসিরুদ্দিন, ছোট করে নাসির, একইভাবে রাতের শেষ গাড়িতে ফিরছিলো। একইভাবে সেই যুবতী, একই পোশাকে, একইভাবে মোবাইলে চোখ রেখে বসেছিল।
নাসিরের মনে আছে, আগের দিন মেয়েটি কোন স্টেশনে নেমে গিয়েছিল।
ভালোলাগা কখনো কখনও মানুষকে উন্মাদ করে। চিন্তায় অপরিপক্কতা বা অপরিণামদর্শীতার ছাপ রাখে। এক্ষেত্রেও তেমনই হলো। সেই নির্দিষ্ট স্টেশনে মেয়েটি নামতেই, নাসিরও নেমে গেল। শুধু নেমে গেল না, সামান্য দূরত্ব রেখে মেয়েটির পিছু নিলো।
এ এক আশ্চর্য দিশাহীন চলা। অনেক রাত। অচেনা জায়গা। একটি যুবক, সম্পুর্ণ অজানা কারণে, সম্পূর্ন অচেনা একটি যুবতীর পিছু নিয়েছে। কেন? কোনও উত্তর নেই। কৌতূহল? কিন্তু কেন, কোন অধিকারে? অধিকারের সীমা বাঁধা আছে। লঙ্ঘিত হলে সামাজিক অপরাধের দায় বহন করতে হবে। নাসির কী এসব জানে না, না কি, ভালোলাগার কৌতূহল তাকে বেপরোয়া করে তুলেছে!
মিনিট সাতেক হাঁটা হয়ে গেছে। রেলগেট পেরিয়ে এই জায়গাটা মোটামুটি অন্ধকারই বলা যেতে পারে। স্টেশনের পাশের দোকানগুলো সবই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো, এখানকার জমাট অন্ধকারের কাছে নিতান্তই নিস্প্রভ।
রাত অনেক। রাস্তায় মানুষের চলাচল একেবারেই নেই। কয়েকটা পথ কুকুর এদিক ওদিক শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে। কেউ বা দুলকি চালে চলেছে খাবারের সন্ধানে।
একটা গলি। মেয়েটি ঢুকে গেল গলিতে। ডানদিকের দুটো চালাঘরের পরে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। খুবই সাধারণ সাদামাটা বাড়ি। তারই সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। গলির মুখেই দাঁড়িয়ে আছে নাসির।
মেয়েটি এইবার ঘুরে তাকালো নাসিরের দিকে।
মুচকি হেসে বললো, কৌতূহল তো মিটলো। কিন্তু বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? শেষ গাড়ি তো চলে গেছে। কী করবেন এখন?
এমন অপ্রস্তুতে কেউ পড়ে? ছি ছি। তার মানে মেয়েটি অনেক আগেই টের পেয়েছিল, তার এই অকারণ নির্লজ্জ পিছু নেওয়া। লজ্জা আর একরাশ অস্বস্তির কারণে গলায় কোনো শব্দ আসছিলো না।
সেই দুঃসহ মানসিক পীড়া থেকে মেয়েটিই তাকে মুক্তি দিলো বলা চলে। মৃদুস্বরে বললো, ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আমার কাছে আসুন।
ঠিকই, নাসির এখানে একেবারেই অপরিচিত মুখ। বহিরাগত। এই গভীর রাতে, মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়লে বিপদ অনিবার্য। অনেক আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু এখন উপায়?
নাসির কোনও রকমে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বললো, সত্যিই, খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার কোনও বদ উদ্দেশ্য বা…
মেয়েটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বোকার মতো কথা বলবেন না। আপনার এইসব ছেলেমানুষি কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন? যাইহোক, এখানে বেশীক্ষণ এইভাবে থাকা নিরাপদ নয়, সেটা কী আপনি বুঝতে পারছেন?
নাসির বুঝলো, মেয়েটি আসলে কী বলতে চাইছে। মেয়েটি ওর কোনও ক্ষতি চায় না। সেই প্রমাণ সে অনেক আগেই দিয়েছে। নইলে ইচ্ছে করলে এতক্ষণে চিৎকার করে পাড়ার লোকজন জড়ো করে, সে এক বিশ্রী ভয়ংকর কান্ড ঘটাতেই পারতো। শেষ ট্রেন চলে গেছে। এখন স্টেশনে ফিরে যাওয়া এবং সেখানে রাত কাটানো, সত্যিই বড্ড বেয়ারা অবস্থায় নাজেহাল হবার যোগাড়।মেয়েটি দরজায় খুব আস্তে-ধীরে তিনটি টোকা দিলো। কেউ একজন দরজা খুলে দিলো। একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিয়েই চলে গেছেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে। উনি সম্ভবত মেয়েটির মা।
-আসুন, ভেতরে আসুন।
এই ডাকের জন্যে নাসির মোটেই প্রস্তুত ছিল না। হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, -আমি? মানে..কেন ?
-এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। আগেই বলেছি। স্টেশনে এখন গেলে মস্তান, মাতাল অথবা ছিনতাইবাজদের পাল্লায় পরবেন। আসুন।নাসিরের নিজের গালে নিজে চড় খেতে ইচ্ছে করছিলো। কৌতুহলের সীমা থাকা উচিৎ। কিন্তু এইটা যা হলো, তাকে কি শুধুই কৌতূহল বলা চলে! নাকি আরও অন্যকিছু। যার ওপর মনের কিংবা মগজের খবরদারি খাটে না। সে চলে আপন পাগল পারা গতিতে। দুরন্ত আবেগে ছুটে চলে মোহানা পেরিয়ে একেবারে আকাশ ছোঁয়া উথাল-পাথাল সমুদ্রের বুকে নিজেকে বিলীন করে দিতে।
দুটি মাত্র ঘর। একটিতে মেয়েটি নাসিরকে এনে চেয়ারে বসতে দিলো। নিজে বসলো খাটের ওপর। চেয়ার একটাই।
– নিন, এবার বলুন। কিসের কৌতুহল? কী জানতে চান? তাছাড়া, জেনে হবেই বা কী? একটা মেয়ে, কখন, কোন অবস্থার তাড়নায় এত রাতে, একেবারে শেষ ট্রেনে বাড়ির রাস্তা ধরে, জানেন? আপনার কী এইটাই কৌতুহল? আশ্চর্য, অথচ দেখুন, আপনিও একইভাবে রাতের শেষ গাড়িতে ফিরছেন কিংবা কোথাও যাচ্ছেন। কই, তা নিয়ে তো কারুর কোনও মাথা ব্যথা নেই। অকারণ কৌতুহল নেই, তাহলে? কেন, আপনি ছেলে তাই? আপনারা নির্দ্বিধায় কৌতুহল মেটাতে মেয়েদের পিছু নিতে পারেন। লুকিয়ে চুরিয়ে তার ঠিকানা জেনে নিতে পারেন। সত্যি কথা বলতে, মনের কোণে অসুর বাসা বাঁধলে আরও অনেক কিছুই করতে পারেন, দৈহিক শক্তির জোরে।
কথা চলার ফাঁকেই, এক মাঝবয়সী মহিলা দুজনের জন্যে দু’টি প্লেটে কিছু খাবার রেখে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
-চলুন, হাত ধোবেন তো। আসুন।
নাসির বুঝতেই পারছে না, তার এখন কী করা উচিৎ। কী বলা উচিৎ। এমন অসম্ভব লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে কেউ কখনও পড়েছে কিনা জানা নেই। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায়ও নেই। সুতরাং কর্মফল ভোগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
নাসির এবার মনে মনে ভয় পেতে শুরু করেছে। মেয়েটি আসলে কী করতে চায়? হঠাৎ করে তার প্রতি এমন সহৃদয় হয়ে ওঠার কারণ কী? নাসির ভালো করেই জানে, সে ভুল করেছে। একটি অচেনা অজানা মেয়ের পিছু নিয়ে, তার বাড়ি পর্যন্ত আসা। মোটেই ঠিক হয় নি। এতটা বেহিসেবী কৌতুহলের খেসারত বোধহয় এবার চোকাতে হবে।
-কী ভাবছেন, আসুন।
-না, মানে, আমার ঠিক খাবার ইচ্ছে নেই। আপনি খান। আমি ঠিক আছি।
মেয়েটি হেসে বললো, লজ্জা করছে? যাক, সেটা আপনার আছে দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু, ব্যাপার কী জানেন, এইটুকু খাবার খেয়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে।
আমাদের তিনজনের জন্যে রান্না হয়। আমি, আমার শাশুড়ী আর আমার আট বছরের মেয়ের।
আপনি আসবেন তা তো জানা ছিলনা । এতরাতে নতুন করে রান্না করাও সম্ভব নয়। তাই, যা আছে ভাগাভাগি করে, একটাই তো রাত কী বলেন? আসুন, হাত ধুয়ে নিন।
আট বছরের মেয়ে। কথাটা কানে বাঁধলো নাসিরের। একে দেখে বোঝাই যায় না। কে জানে, সত্যি বলছে কিনা। যদিও তার কাছে অহেতুক মিথ্যে বলবেই বা কেন? কে সে? একেবারেই অনাহুত বহিরাগত, দোষী মানুষ। তাকে শাস্তি না দিয়ে, রাত্রিযাপন এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে।
নাসির চেয়ারে মাথা নিচু করে বসেই রইলো। এর চাইতে গুন্ডা, মাতাল, ছিনতাইবাজের পাল্লায় পড়া অনেক ভালো ছিল । এমন অপদস্ত মানুষ হতে পারে?
নাসিরের একবার মনে হলো, ছুটে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু গভীর রাত আর রাস্তার কুকুরগুলোর কথা মনে হতেই, সেই পরিকল্পনা আপাতত শিকেয় তোলা রইলো।সাকুল্যে দুটি ঘর। একটি শাশুড়ীর জন্য। অন্যটি, মা আর ছোট্ট মেয়েটির জন্য বরাদ্দ। আজ ওরা সবাই একটা ঘরেই জায়গা করে নিয়েছে। অন্যটি নাসিরের।
এতক্ষণ একসঙ্গে রইলো, অথচ ছেলেটার নামটাই জানা হয়নি। অবিশ্যি তার কোনও প্রয়োজনও নেই।
ঘুম আসছিল না। রাকেয়া অন্ধকার ঘরে তাকিয়েই শুয়ে রইলো। একটাই ভাবনা মাথা থেকে কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না। ছেলেটা ওর পিছু নিয়েছিল কেন? মতলব কিছু ছিল, নাকি নেহাৎ কৌতুহল? কী জানতে চায় ও। রাকেয়ার জীবনবৃত্তান্ত? ফেলে আসা দুঃসহ স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে চায়? কেন?
না-কি বয়সের বাচালতা। অকারণ ছটফটানি। যা তার জীবনেও ঘটে ছিল, আজ থেকে দশ বছর আগে।
বশিরকে ও ভালোবেসে ছিল। প্রথম প্রথম ভালোলাগা, তারপর..
তখন রাকেয়ার উনিশ। ট্রেনের কামরায় সেঁধিয়ে গিয়েছিল ফুরফুরে প্রেম। নিত্যদিন একসাথে যাওয়া, আসা। কর্মস্থলের সুবাদে। যদিও দুজনের কর্মক্ষেত্র ছিল আলাদা। কিন্তু পথ একই।
তারপরেই বিয়ের প্রস্তাব। সকলেই বোঝাতে চেষ্টা করলো। বিয়ে কোনও খেলা নয়। সারা জীবনের গাঁটছড়া। যতদূর খোঁজ খবর পাওয়া গিয়েছিল। তাতে রাকেয়ার বাবা মা মোটেই খুশী হতে পারেননি। একে অল্প রোজকার, তায় নেশার বহর খুব। রাকেয়া বলেছিল, কিচ্ছু ভেবো না। বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে ।
হয় না। স্বপ্ন আর বাস্তব একই পথে হাঁটে না। কল্পনার প্রলেপ বুলিয়ে বাস্তব দেখতে ভারী ভালো লাগে। কিন্তু, কল্পনার আলপনা ধুয়ে গেলেই বাস্তবতার কঠিন কর্কশ রূপ উলঙ্গ হয়ে যায়।পরিবারের সকলের অমতেই শুধু নয়, তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করে, চলে এসেছিল বশিরের হাতে হাত রেখে। পরম বিশ্বাসে। বশির সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় নি। এক বছরের মাথাতেই রাকেয়া গর্ভবতী হয়। বশির রাখতে চায় নি। কিন্তু রাকেয়ার জেদের কাছে, সে সাময়িক ভাবে মেনে নেয় ঠিকই, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার আচরণের পরিবর্তন হলো।
সংসারে নিয়ম করে টাকা দিত না। রাকেয়ার কোনও খোঁজ খবরই রাখতো না। প্রতিটি গর্ভবতী নারী মা হবার প্রাক্কালে তার স্বামীকে পাশে চায়। একটু আদর, একটু সহানুভূতি, একটু সাহস। খুবই কী বেশী চাওয়া?
বশির তখন অন্য ঘাটে প্রেমের নাও বেঁধেছে। সেখানেই এখন তার মন প্রাণ শরীর। সেখানেই মশগুল। পুরাতনের মোহ অস্তমিত।
শিশুকন্যা প্রসবের ভয়ংকর রকমের অপরাধে, তালাক দিয়ে চলে গেল, তার নতুন স্বপ্নের দেশে। নবজাতক ববিতা, বশিরের চক্ষুশূল। চক্ষুশূল রাকেয়াও। নবজাত শিশুকন্যা রাবেয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল রাকেয়া। না না, বশিরের জন্যে নয়। কেঁদে ছিল ভয়ে আগামীর আশঙ্কায়।
মাতৃত্বের সুখে, সন্তানের মুখ চেয়ে মায়েরা কতকিছুই হাসিমুখে মেনে নিতে পারে। ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। ঈশ্বরের আশ্চর্য সৃষ্টি, মা। চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবারও নতুন করে চাকরির সন্ধান করতে হবে।
পাশে ছিল কাদের সিদ্দিকী। রাকেয়ার শ্বশুর। রাবেয়াকে সস্নেহে আদর করতে করতে বলেছিলেন, ভয় কি রে মা? আমি তো আছিই। মরে তো যাই নি। আর আছে আমার দর্জির দোকান। আল্লার দোয়ায় দিন গুজরান ঠিকই হয়ে যাবে।
ও আমার ছেলে হ’য়েও, আমার কাছে থাকতে পারলো না। তুমি কিন্তু মেয়ে হয়ে, আমার কাছে থেকো।
মাত্র তিনবছর। কাদের সিদ্দিকী চলে গেলেন। সব মায়া কাটিয়ে.. চিরতরে। রাকেয়া আবারও পথে। একটাই লক্ষ্য। রাবেয়াকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। ভাগ্যিস, শ্বশুরের এই ছোট্ট ভিটে খানি ছিল। মাথায় ওপর পাকাপোক্ত ছাদ। অনেক সাহস যোগায়। নিশ্চিন্ত করে। লড়াই করার রসদ যোগায়।
আল্লার অসীম কৃপা। একটু চেষ্টা করতেই সেই পুরনো চাকরিটাই ফিরে পেয়ে গেল রাকেয়া।
মরুভূমিতে প্রাণসঞ্চারণের জলধারা। আর ভয় নেই। এবার লড়াই। নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। রাবেয়াকে মানুষ করার লড়াই।
এইসব কথা, ও’কে বলে কী হবে? একটা কাপুরুষ। তাছাড়া কী ! নইলে গভীর রাতে একাকিনী একটি মেয়ের পিছু ধাওয়া করে?
হ্যাঁ, চালাকি করে বলা ই যেতে পারে। তোমাকে ঠিক আমার বোনের মতো দেখতে। যে কিনা মাত্র একবছর আগে মারা গেছে।
হাঃ নাটক।অন্ধকার অচেনা ঘরে নাসিরের ঘুমহীন দুঃসহ কালরাত্রি যাপন। একি উদারতা নাকি শাস্তি? কোনও বিশেষ মতলব নেই তো? কে জানে, হতেও পারে। যদি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয়। তারপর লোকজন জড়ো করে যদি বলে, কাল রাতে বদ মতলব নিয়ে ঘরে ঢুকে ছিল। ধরা পড়ে কান্নাকাটি করছিলো। সারারাত তালাবদ্ধ করে রেখেছি, এইবার পুলিশ ডাকবো, আপনারা একটু সাহায্য করবেন প্লিজ। সর্বনাশ।
নাঃ, দরজাটা খোলা থাকাই ভালো। কাউকে বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসের প্রশ্নই নেই। তার জন্যেই তো এতকিছু। এসবের মূলে তো সে নিজেই। অপরাধী মন কেবলই অন্ধকার পথে হাঁটে।
বিছানা থেকে উঠে, দরজাটা খুলে দিলো। যাক, খোলাই আছে। তালাবদ্ধ করে নি। কিন্তু একি?
সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এতরাতে বাইরে কেন? তাহলে কী!
-একি বাবা, তুমি ঘুমোওনি?-না, মানে, মাসিমা ঐ নতুন জায়গা তো, তাই হয়তো ঘুম আসতে চাইছে না, কিন্তু মাসিমা আপনি এখনো জেগে! বাইরে..
ও কিছু নয়। আমার সুগার আছে তো, তাই রাতে বারেবারে বাইরে যেতে হয়। তাছাড়া, এই বয়সে ঘুমও কমে গেছে।
আসুন না মাসিমা। ঘরে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলে খানিকটা সময় কাটাই। আজ ঘুম আসবে না। আর আপনারও তো, মানে..
নাসির ভেবে নিলো এই ভদ্রমহিলার থেকেই কিছু জানা যেতে পারে। তাছাড়া, ইনি যে সত্যিকথা বলছেন তারই বা কী মানে আছে? হয়তো সময় মতো দরজা খুলে ফেলতেই, আচমকা মুখোমুখি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। কিছুই আশ্চর্যের নয়। ভদ্রমহিলাকে ঘরে এনে ওনার সঙ্গে আলাপ জমানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
মাসিমা ঘরে এসে চেয়ারে বসলেন। নাসির যথারীতি খাটেই।
-রাকেয়া আমার ছেলের বউ। মানে..
-আপনার পুত্রবধূ। জামাই কী করেন?-এসব কথা তুলতে ভালো আর ভালো লাগে না। সবই আমাদের কপাল। যদি জানতাম, ছেলেটা বড় হয়ে এইরকম কুলাঙ্গার, শয়তান, বেইমান তৈরী হবে, তাহলে কিছুতেই ওকে যত্নে লালন পালন করে বড় করে তুলতাম না। বিষ দিয়ে মেরে ফেলতাম। আমার বৌমা বড্ড দুঃখী, হতভাগী।
বিয়ের পরেই ঐ মেয়ে হলো। রাবেয়া। ওর একটাই ইচ্ছে। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে। তার জন্য দিনরাত এক করে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। ওভার টাইম কাজ করলে, কিছু বাড়তি রোজকার হয়। তাই মাঝেমধ্যেই ঐ শেষ গাড়িতে ফেরে। বারণ করলেও শোনে না। বলে, টাকার বড্ড দরকার মা। রাবেয়াকে অনেক অনেক বড়মানুষ করে তুলতে হবে। টাকা ছাড়া, তা কীভাবে সম্ভব হবে মা?
বিশ্বাস করো নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। লজ্জা করে। এমন ছেলে পেটে ধরলাম, যে এমন হীরার মতো বউকে তালাক দিয়ে, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে চলে গেল।
আমাদের কথা একবারও ভাবলো না। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু, তার বাপের মুখ দেখতে পেল না। অবিশ্যি অমন বাপের মুখ না দেখাই ভালো।
আসলে কী জানো, আমার বৌমা তো বেশি লেখাপড়া জানে না। খুবই গরীব ঘরের মেয়ে। অনটনের সংসারে ঘরে বসে থাকলে, অন্ন জোটে না। তাই কম বয়স থেকেই পথে বেরুতে হয়েছে। সেটা একরকম ভালোই। লড়াই করার জোর মনে মনে জোরালো, ধারালো হয়। যাক, বাদ দাও। তোমার কথা বলো কিছু, শুনি।-আমার কথা.. কী বলবো! এইরকমই দিন আনা, দিন গুজরান সংসার। বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন। একদিন অফিসের মধ্যেই, কাজ করতে করতেই স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। কোম্পানির মালিক, বলতে পারেন মানবিকতার খাতিরে, ওখানেই আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আসলে, আমিও ওভার টাইম পেলে ছাড়ি না। সেই কারণেই অনেক সময় শেষ ট্রেনে ফিরতে হয়।
-মেয়েদের পিছু নেওয়া, সেটাও কী তোমার ওভার টাইমের মধ্যে পড়ে?
-মাথা হেঁট করে বসে রইলো নাসির। আবেগের বশে এইরকম বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। কাউকেই কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাবে না, আসলে ও এইরকম বদ স্বভাবের ছেলে নয়।-দ্যাখো বাবা, দিনকাল তো সেই আগের মতো নেই। প্রয়োজনে মেয়েদের বাইরে বেরুতেই হয়। অথচ আজও কেন জানি না অনেকেই এই ব্যাপারটা সহজ করে নিতে চায় না।
আমি জানি না তোমার বোন বা দিদি কিংবা স্ত্রী আছে কি না, প্রয়োজনে তাদের পথে বেরুতে হয় কি না। তখন যদি তাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেউ করে? মানে তুমি যেমন করেছ। তোমার কেমন লাগতো, তুমি কী তাকে আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে আসতে? তার ভালো মন্দের কথা বিবেচনা করে, একটুও বিচলিত না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় তার সব অপরাধ ক্ষমা করে নিরাপদ আশ্রয়ের আয়োজন করতে?
নিশ্চিত করে বলতে পারি, করতে না। বরঞ্চ উল্টোটাই করতে। তাকে শাস্তি দিতে। অপমান করতে। এটাই স্বাভাবিক। এমন না হওয়াই আশ্চর্যের। তাই না?
আসলে কী জানো, মেয়েরা মায়ের জাত। স্নেহ মমতায় ভরা মন। তোমরা সেই ভালোবাসার জায়গাটাকে দুর্বলতা মনে করো।
আমার বৌমা আজ যা করলো, ওর ওপর আমার ভালোবাসা আরও অনেক অনেক বেড়ে গেল।
মায়েরা, বোনেরা, দিদিরা এভাবেই বারে বারে তোমাদের শিক্ষা দিতে চেয়েছে। তোমরা সেটাকে শান্তি মনে করে ভুল করেছ। তোমাদের পৌরষবোধ কিছুতেই অহংকার মুক্ত হতে চায় না। এই অকারণ অহংকার বোধ থেকেই জন্ম নেয় অপরাধ বোধ। তোমার নাম জানি না, জানতেও চাই না। শুধু বলবো, মানুষ হও। সেই হোক তোমার প্রকৃত পরিচয়। যে পরিচয় শুধু তোমার নয়, তোমার পরিবারের এমনকি দেশের মুখও উজ্জ্বল করবে। আসি বাবা। কিছু মনে ক’রো না। গায়ে পড়ে সুযোগ পেয়ে জ্ঞান দিলাম কিনা..
ভদ্রমহিলা ধীর পায়ে চলে গেলেন। রেখে গেলেন একরাশ ধিক্কার।
এখন কেবলই ভোরের আকাশের প্রতীক্ষা। আলো ফুটুক, নতুন আলো। জরাজীর্ণ অন্ধকারের হোক চির অবসান। -
অণু কবিতা- জানালা
জানালা
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়মন খারাপ হলেই
জানালা কাছে ডেকে নেয়।হৃদয়ের কপাট খুলে দিয়ে বলে
এই দ্যাখ, চলমান সুখ।চোখ থেকে মনের দুরত্ব কত!
মন থেকে মস্তিষ্কের?কবি জানে, তবুও কে জানে কেন
কবিতায় ফাঁক থেকেই যায়।আসলে কবি নয়, জানালা সব জানে
অনেক দূর পর্যন্ত, যতদূর মন যায়, যতদূর। -
অণু গল্প- এইতো হেথায়
এইতো হেথায়
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়আসবো আসবো করে সেও আসেনি। যাবো যাবো করে এরও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ আমন্ত্রণ ছিল উভয় পক্ষেই। তবুও..
আজ কথা আছে। আসবার। তার। কতদিন পর আজ অনেক আয়োজন। পরিপাটি সাজানো সারা বাড়ি। ও আসবে। বলেছে আসবে।
নিজেকেও সাজিয়ে তুলেছে বেশ। সেই তার কথা মনে করে। তার ভাললাগাগুলোকে একটু একটু করে তুলে নিয়েছে তার সারা অঙ্গে। সোনা রঙের শাড়ীতে কালো আর লালচে আলপনা। শাড়ী ব্লাউজের ম্যাচিং। ঢেউ খেলানো কালো চুলের সাথে একাকার।
মনে সাগরের উথাল পাথাল। দোতলার বারান্দায় মানি প্ল্যান্টের সবুজ পাতার আড়ালে বুলবুলি পাখির ব্যস্ত ওড়াউড়ি।
ফাগুন হাওয়ায় বাসন্তী সিল্ক পর্দা গুলোর ওডিসি নৃত্যে ওডিকলোন সুবাস। ফ্রিজে আইসক্রিম রাখতে রাখতে মন ভেসে যায় দূরে । অনেক দূরের ফেলে আসা সময়ের কাছে।ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর সামনের রাস্তায়, ছুটন্ত সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। সওয়ার দুজনে। অনন্ত সুখে হারিয়ে যাওয়া। চৈত্রের সন্ধ্যায়। গলে যাওয়া আইসক্রিমের টসটসে ফোঁটায় ভিজে যাওয়া শাড়ির কোল, রুমাল দিয়ে মুছে দেবার ওর সে কি আপ্রাণ চেষ্টা। হেসে বাঁচিনে। ব্যগ্র চোখে হতাশ গলায় অপাপবিদ্ধ সরলতার পরশ মাখা প্রশ্ন, কী হবে?
আবারও হেসে বাঁচিনে ।সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ও কি এলো?
এখন ঘড়িতে ঠিক রাত দুটো বেজে সাত মিনিট।
আতর জলে ডুবিয়ে রাখা বসরাই গোলাপ খানি, সে তুলে নিলো হাতে। পরম ভালবাসায় রেখে দিলো ওর হাসিমুখ ছবিটার পাশে । আইসক্রিমের পাত্রটাও সাজিয়ে রাখলো ওরই সামনে। তারপর তাকিয়ে রইলো খোলা দরজার দিকে।
ও আসবে । নিশ্চয়ই আসবে। ও মিথ্যে বলে না। ও মিথ্যে বলতে জানে না। ও আসবে।
রাত ঠিক দুটো বেজে সাত মিনিট। ওর প্লেনটা ঠিক এইসময়ই..মুহূর্তে আগুন। বিধ্বংসী সর্বগ্রাসী প্রলয় আগুন। সবশেষ। স্মৃতিটুকু ছাড়া।চোখের টসটসে ফোঁটায় ভিজে যাওয়া শাড়ির কোল। রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে ও ব্যগ্র চোখে অপাপবিদ্ধ সরলতার পরশ মাখা গলায় বললো, এইতো আমি, চেয়ে দ্যাখো। তোমার আমি।
আবারও মুগ্ধ চোখে, হেসে বাঁচিনে। -
রম্য- ভন্ড ভন্ডুল
ভন্ড ভন্ডুল
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়দেবতা বললেন, বৎস, তোমার সাধনায় আমি তৃপ্ত। বলো, কী বর চাও?
সাধক নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন …. প্রভূ , আমি ট্রাডিশন ভাঙতে চাই ।
দেবতা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন – মানে ?
সাধক স্মার্টলি বললেন , দেখুন প্রভূ , ওসব বর ফর অনেক পুরনো রদ্দি ব্যাপার । অনেকেই আপনার থেকে ঐসব নিয়েছে টিয়েছে , কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও বরই টেঁকেনি। শুধু তাই নয় , যাকে বর দিয়েছেন সেও গল্প হয়ে গেছে। দেখুন প্রভূ , মুখের ওপর বলছি , রাগ করবেন না প্লিজ , আমার অভিজ্ঞতা বলছে আপনারা বহুৎ ধড়িবাজ ।
বরের ভেতর কায়দা করে নানাভাবে নানান ফন্দিফিকির , ফাঁকফোকর ঢুকিয়ে রাখেন। গোড়ায় গোড়ায় কিচ্ছুটি বোঝা যায় না । বেশ ভালোই চলে । কিন্তু আল্টিমেটলি , নিটমুনাফা জিরো এবং নির্ঘাত অপঘাত মৃত্যু। তাই , আমি মনস্থির করেছি , কিচ্ছুটি নেবো না। উল্টে আপনাকে দেবো।
দেবতা কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেবে ? মানে আমাকে দেবে ? খুবই ভালো কথা।
কিন্তুু প্রশ্ন হচ্ছে , কী দেবে ? দেবার মতো কী আছে তোমার ? তুমি তো কপর্দকহীন অপদার্থ ভবঘুরে ,না চাল , না চুলো। দেহ আর ধুকপুকে প্রাণ টুকু ছাড়া তোমার আর আছে কী , দেবার মতো ? শোনো হে , তোমাকে আগেই জানিয়ে রাখছি । ঐদুটোর একটাও কিন্তু আমি নেব না। কেননা ওসবের দায়িত্ব যমরাজের। তুমি বসেবসে তাকেই ডাকো , আমি চললাম ।
সাধক পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন , তা বললে চলে প্রভূ। এতো সাধনা টাধনা করে , আপনার আসন টলিয়ে মর্ত্যে নিয়ে এলুম , সেকি শুধুমাত্র আপনার সুন্দরপনা মুখটা দেখেই ছেড়ে দেবার জন্যে?
দেবতা ত্রিশূল ঠুকে দাঁড়িয়ে গেলেন । আস্পর্ধা কম নয়। মুখে যা আসে বলে । এইসময় একটা মোক্ষম অভিসম্পাত ঝেড়ে দিলে কেমন হয়? নাহঃ থাক , আর একটু দেখা যাক , লোকটা কতদূর যেতে পারে , দেখা নিতান্তই প্রয়োজন।আপনারা বড্ড ভোগী হয়ে উঠেছেন । অবিশ্যি , সেটা আপনাদের দোষ নয়। এই মর্ত্যবাসীরাই নানান দামী দামী উপঢৌকন দিয়ে দিয়ে আপনাদের স্বভাব খারাপ করে দিয়েছে। নইলে আগের কালে তো শুনেছি , একটু আধটু ভক্তি টক্তি পেলেই খুশী হয়ে যেতেন । কী, ঠিক কিনা?
যাইহোক শুনুন প্রভূ, আমি আমার যত পাপপুণ্য , ভালমন্দ , ন্যায় অন্যায় , সুখদুঃখ , সব সবকিছুই আপনাকে নিবেদন করলাম।
আপনি খুশী মনে আমার এই দান গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন প্রভূ ।
দেবতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ , ভাবগতিক বোঝবার চেষ্টা করলেন তারপর বললেন ,
এই প্ল্যান , আগে থেকেই ভেঁজে রেখেছ , সেটা বেশ বুঝতে পেরেছি । কিন্তু বাছাধন , এইসব উজবুক মার্কা পরিকল্পনা আমাদের কাছে নস্যি । যুগ যুগ ধরে তোমাদের দেখা না দিয়ে, মেলামেশা না করে , কোনও রকম পাবলিসিটি ছাড়াই তোমাদের বশে রেখেছি , সেকি মনেকরো এমনি এমনি ? যাক, সেসব তুমি বুঝবে না। অবিশ্যি যত না বুঝবে , ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল ।
যতই জানবে , ততই অমান্যি করবে । ঠিক আছে , তুমি যা দিতে চাইছো , সবই নেবো। ভক্তের মনোবাঞ্ছা অপূর্ণ রাখবো না। কিন্তু , ওগুলোর সঙ্গে আরও কিছু নেবো।
সাধক , আমতা আমতা করে ঢোঁক গিলে বললেন, আর কী? আরতো কিছুই নেই । আপনি অন্তর্যামী। আপনার কাছে তো কিছুই গোপন নেই প্রভূ।
প্রভূ হেসে বললেন , সেই জন্যেই তো বলছি! দে.. তোর সবটুকু দে. .. ষোলো আনা জ্ঞান অজ্ঞান , বুদ্ধি দুর্বুদ্ধি , চাতুরী বোকামি , শঠতা সত্যতা , সর্বোপরি তোর মুখোশ , সবই দিয়ে দিতে হবে, পারবি?
সাধক ফ্যাকাসে মুখে বললেন – যাঃ চ্চলে! সবই যদি যায়, তাহলে থাকে কী? খাবো কীভাবে ?
দেবতা মুচকি হেসে বললেন , কেন , মুন্ডু দিয়ে খাবি। যেমন খাস। ওটা তো চাইনি । সেটা তো রইল যথাস্থানে।
সাধক , চোখ মুখ কুঁচকে হাঁ হাঁ করে উঠলো , না না প্রভূ, সে কথা নয়। বলি , খাওয়ার ব্যবস্থা হবে কীভাবে ?
দেবতা ত্রিশূল ঠুকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে , চোখ নাচিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বলতো? তোর আসল মতলব খানা কী?
প্রভূ, আপনার সঙ্গে জলের বোতল আছে ? বড্ড জল তেষ্টা পাচ্ছে ।
দেবতা , তার হাতে ধরা কমন্ডলু বাগিয়ে ধরে বললেন, নে,, পান কর। গলা তো শুকোবেই। পেটে পেটে বজ্জাতি বোঝাই।
স্বর্গের জল পান করে বেশ ঝরঝরে হয়ে সাধক হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদোকাঁদো গলায় গদগদ হয়ে বললেন , প্রভূ সবই তো বুঝতে পারছেন , কেন মিছিমিছি এই অধমের সঙ্গে লীলা করছেন প্রভূ।
দেবতা কিঞ্চিৎ নরম স্বরে বললেন , আচ্ছা বেশ , যা বলার আছে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে বল। আমি কিচ্ছুটি মনে করবোনা।
সাধকের মুখে চওড়া হাসি। বললেন , এইতো , এইনা হলে দেবতা। আহা! কী উদার , কী মহান ,
কী প্রেম…
হয়েছে হয়েছে , ভেজাল মাখন মাখানোর দরকার নেই । মতলব খানা খুলে বল দেখি।
তাহলে বলি, আপনি যেগুলো চাইলেন , তার মধ্যে কয়েকটি ছেড়ে দিন প্রভূ। কেননা ঐগুলা ভাঙিয়েই তো আমি ফুলেফেঁপে জয়ঢাক হয়ে উঠবো কিনা…
কোন গুলো ?
আপনি সব নিয়ে যান। শুধু ঐ , দুর্বুদ্ধি , চাতুরী , শঠতা আর মুখোশ খানি আমার জন্যে ছেড়ে দিন প্রভূ।
আর ছোট্ট একটি প্রার্থনা আছে প্রভূ।
আবার কী ?
মানে , এইযে আমার সবকিছু , মানে ঐগুলা বাদ দিয়ে আরকি , আপনার পায়ে নিবেদন করলুম , এই ব্যাপারটা আপনি একটু কায়দা করে লোকসমাজে যদি প্রচার করে দ্যান প্রভূ , বড়ই কৃতার্থ হই প্রভূ । মানে ,আপনাকে ব্র্যান্ডএম্বাসাডর বানিয়ে এগিয়ে যেতে চাই প্রভূ।
দেবতা , ত্রিশূল দিয়ে বগল চুলকে , চোখ ছানাবড়া করে বললেন ,ব্র্যান্ড এম্বাসাডর , সেটা কী?
সাধক, মাছি তাড়ানো ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বললেন, কিচ্ছু নয়। শুধু আমার যাবতীয় কাজে আপনার নাম আর ছবি ব্যবহার করবো। তাতে আপনারও প্রচার বাড়বে আর আমারও কেল্লাফতে হবে ।
জনমানসে আপনার নাম , কী বলবো প্রভূ , এখনো একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজ করে । দিব্যি করে বলছি প্রভূ , আপনার নামের তোড়ে , যদি একবার মন্ত্রী হয়ে বসতে পারি , আপনার নামে , পেল্লাই মন্দির , রাস্তা ঘাট এমনকি রেলস্টেশন পর্যন্ত বানিয়ে দেবো।
ইস্কুল কলেজ হাসপাতালও বানানো যেতে পারতো। কিন্তু ওসব করা আখেরে ক্ষতিই হবে। ঐ-যে আপনি বললেন , সেইটাই মোক্ষম যুক্তির কথা । যত জানবে , ততই কম মানবে ।যদি মান্যতাই না পেলুম , মন্ত্রী হয়ে কী লাভ ? আপনিই বলুন প্রভূ….দেবতা বললেন, ওরে শয়তান , তাই বলি বেটা মতলব বাজ , হঠাৎ কোথাও কিছু নেই , সটান গুহায় ঢুকে ঝপ করে বসে ধ্যান শুরু হয়ে গেল ? সাধনা ? ব্যাটা ভন্ড।
আমার নাম ভাঙিয়ে , ঢং করে সঙ সেজে সাধাসিধে ভালো মানুষ গুলোকে বোকা বানিয়ে তাদের সর্বনাশ করবি ? নিজের আখের গুছোবার ধান্দা করবি ? তুই কী ভেবেছিস , আমি তোকে এই জঘন্যতম কাজে সহায়তা করবো ? মুর্খ । তোর মতো শয়তান গুলোর জন্যেই আমার সুন্দর পৃথিবীটা নোংরায় ভরে গেল।
তুই জাহান্নামে যা। আমি চললুম । শোন , মানুষের জন্যে ভালো কাজ কর। তাদের পাশে অন্ধের যষ্টির মতো দাঁড়া। তাহলেই দেখবি , তুই মনে মনে যা চাইছিস , তারচেয়ে বেশী পেয়ে গেছিস।
ভুলে যাস কেন , সেই অমোঘ বাণী ….প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে
যবে মিলি পরস্পরে ,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
আমাদেরই কুঁড়েঘরে । -
রম্য- যুগের হাওয়া
যুগের হাওয়া
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়অমন খেঁকিয়ে উঠছো কেন বাপু। তোমায় তো কিছু বলিনি। তোমার গায়ে ফোস্কা পড়ছে কেন?
আকচার বুলি। কলতলার সকাল সাঁঝের মুখঝামটা ডায়লগ।
আচ্ছা , গন্ডারের গায়েও কী ফোস্কা পড়ে?
মুখপোড়া হনুমানের মুখ পোড়ে?
দুর মশাই , প্রবাদবাক্য গুলো সব গুলে খেয়ে হজম করে ফেল্লেন?
কানে দিয়েছি তুলো , পিঠে বেঁধেছি কুলো। মনে নেই ? সুতরাং কায়দা করে যতই গন্ডার , হনুমান বলে গালমন্দ করো , কিসসু হবে না।
পাঁঠার কি’বা পায়েস , কি’বা খিচুড়ি । সবসমান।
নদীর , সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটা আছে।
পানা পুকুরের সেসব থাকে কী ? পল্লীর বউ মেয়েরা দুবেলা সেই পুকুরের পাড়ে বসে বাসন মাজে। পি এন পি সি করে। সেই গরবেই সে ডগমগ। আমি ছাড়া গতি নেই। ভাব খানা এমনই।ভাবছেন কাদের কথা বলছি ? শুনুন,,,
পাড়ার নেতা । গবা দা। আগে অন্য একটা দলের জার্সি গায়ে মাতব্বরি করতো। তাদের সূর্য বর্তমানে অস্ত গেছে । তাই উদিত সূর্যের কিরণ মেখে , নতুন দলের পাড়াপতি। পানাপুকুর ।
জার্সির রঙ বদলেছে। কিন্তু স্বভাব ?
আবারও সেই প্রবাদবাক্য । স্বভাব যায় না মলে।
আচ্ছা , এইসব প্রবাদবাক্যের জন্মদাতা কে বা কারা বলুন তো ? যেই বা যারাই হোক , তাদের পায়ে , শতকোটি প্রণাম ।
আজকাল নেতাদের বিশেষ পোশাক থাকে।
এক এক দলের এক এক রঙের পোশাক। মুখে , প্যাকেটের পান জর্দার গন্ধ । কপালে রক্ত তিলক।
হাঁটাচলা জিরাফের মতো । চোখে মুখে হামবড়িয়া ভাব। সবজান্তা কয়লা ওয়ালা।রাজনীতি বোঝবার দরকার নেই। দল বুঝলেই হলো। যখন যেমন তখন তেমন , ব্যস, এই একটিই নীতি। হাওয়া বুঝে দিক নির্ণয় করো। হাওয়া নিশান হও। মোরগের ঘুরপাক। গিরগিটির রঙ বদল।
লজ্জা , ঘেন্না , ভয়, তিন থাকতে নয়।
আবারও সেই প্রবাদবাক্য। কেয়াবাৎ,, কেয়াবাৎ।বুদ্ধি আর কূটবুদ্ধি কী একই কথা ? চালাক, চতুর, বুদ্ধিমান , এই কথা গুলোর কী একই মানে ? না কি প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা অর্থ বহনকারী?
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। এ যুগে বীর শব্দের অর্থই পাল্টে গেছে। জোর যার মুলুক তার। বুক ঠুকে জোরসে বলো , হাম হ্যায় রাজা। ব্যস, প্রজারা নতজানু। কিছু ঠুনকো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আর মাতব্বরির সঙ্গে একটু ধর্মের সুড়সুড়ি। ভীড়ে ভীড়াক্কার। ধ্বজাধারী গড্ডালিকা প্রবাহ।
চলেছে….চলেছে…. চলেছে…বিনা পুঁজির কারবার। দলের মাতবর দের গায়ে গা ঘষো। হ্যাঁ য়ে হ্যাঁ , আর না য়ে না মেশাও। লবিতে ভিড়ে যাও। গোষ্ঠীতন্ত্রের ঢালাও কারবার।
এলাকা দখল করে দেদার জবরদস্তি অপারেশন চালাও।
শ্রদ্ধা ভক্তি নয়। ভয় করুক অমায়িক ভদ্র প্রকৃতির নিরীহ জনগণ। যেখানে ভয়, সেখানে জয়।
বোমা পিস্তলের যুগ। প্রতিবাদ করলেই লাশ ফেলে দাও। আইন রক্ষক নেতার চামচা। নেতা ই আসল বস। চেইন সিস্টেম। সর্বত্র রখরার নিপুণ বন্দোবস্ত।
রায় বেরুতে আড়াই যুগ। সাক্ষীসাবুদ লোপাট। মরে হেজে ভূত। হাজার হাজার পাতায় তদন্ত রিপোর্ট। চার্জশিট উই পোকার প্রিয় খাদ্য। শেষমেশ বেকসুর খালাস।
মার দিয়া কেল্লা। বোতল খোল। ধরা পড়লে তবেই চোর, নইলে সব ব্যাটাই সাধু। জয় হো ওওও। -
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( চতুর্থ ভাগ )
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব- ৯
সিকিমের পাহাড়গুলো বড়োই ভঙ্গুর। যখন তখন, যেখানে সেখানে ধ্বস নামে। মানগাং তাদের অন্যতম। সম্ভবত সেই কারণেই এখানে জনবসতি কম। জনবসতি কম বলেই, এখানকার সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি। প্রকৃতি এখানে নিষ্কলুষ। মন এখানে প্রজাপতি হতে চায়। সৌন্দর্যের মধু নিতে চায় উড়ে উড়ে, আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
গতকাল যেখানে ধ্বস নেমেছিল সেই জায়গা এখনো পরিস্কার করার কাজ চলছে। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
এখানের ধ্বসে, পাথরের ছোট বড়ো টুকরোর সাথে প্রচুর মাটিও ওপর থেকে নেমে আসে।
বড়ো বড়ো পাথরের চাঁইগুলোকে সরিয়ে দেওয়া গেছে, কিন্তু ছোট ছোট টুকরোগুলো, বৃষ্টি ভেজা মাটির সঙ্গে লেপটে আছে। কাদা প্রায় হাঁটুর সমান। তারই নিচে ডুবে থাকা পাথরগুলো দেখা যায় না। অন্তত পঞ্চাশ মিটার এলাকা এইরকম ভয়ঙ্কর ভাবে রয়েছে।
দপ্তরের কর্মীরা পুলিশের সহায়তায়, একটি একটি করে গাড়ি অতি সাবধানে এই রাস্তাটুকু পার করিয়ে দিচ্ছেন।
দইগোলার মতো কাদার ওপর দিয়ে কোনও রকমে একটি একটি করে গাড়ি ঐ ভয়ঙ্কর রাস্তাটুকু পার হয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচচ্ছে।
বাঁ দিকে গভীর খাদ। সেখানে গিয়ে পড়লে, সোজা কল্পিত স্বর্গলাভ নিশ্চিত।কয়েকটি গাড়ি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলে গেল। কিন্তু বিপদ হলো ওদের গাড়ির বেলাতেই।
কাদার নিচে ডুবে থাকা একটা পাথরে ধাক্কা লেগে গাড়ির চাকা গেল ঘুরে। তখনই সকলকে হতবিহ্বল করে গাড়ি চলে এলো একেবারে গভীর খাদের কিনারায়।
গাড়ির সামনের দিকের অংশ খাদের দিকে ঝুলে গেল। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে। অথবা আয়ুর জোর । পিছনের দিকের একটা চাকা, বেশ বড়ো একটা পাথরে আটকে গেল। তাই গাড়িটা যাত্রী সমেত খাদে গড়িয়ে যেতে গিয়েও, শেষ অবধি থমকে থেমে গেল।
গাড়ির মধ্যে নয়টি প্রাণী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে কাঠের পুতুলের মতো নিথর হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতিক্ষা করছে।
কিছু পরেই তারা অনুমান করলো, এ যাত্রা তারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, কিন্তু বিপদ কাটেনি। সামান্য নড়াচড়া তাদের বিপদে ফেলতে পারে। নীল মৃদু স্বরে বললো, ‘কেউ নড়াচড়া করবে না। যে যেখানে যেমন আছো, তেমনই থাকো।’
ড্রাইভার, নীলের কথায় সমর্থন জানিয়ে, ভাঙা বাংলায় বললো, ‘রাইট স্যার। একদম হিলবেন না। গাড়ি হিলিয়ে গেলে, নিচে চলে যাবে। জান কা খতড়া আছে বাবু।’
ততক্ষণে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা এসে গেছে। গাড়ির পিছনে ক্রেনের হুক লাগিয়ে টেনে তুলছে গাড়ি। খুবই সন্তর্পণে, ধীরে ধীরে গাড়ি আবার সেই রাস্তায় ফিরে এলো।
বিপদ কেটে গেছে। মানালি মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। মিসেস রায় প্রফেসরকে প্রবল বিক্রমে জাপটে ধরে আছেন। প্রফেসরের চোখ বন্ধ, কিন্তু
ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে, নাকি
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করছেন, তা তিনিই বলতে পারবেন।
গাড়ি রাস্তায় উঠে আসার পরেই, আবার চলতে শুরু করেছে। প্রফেসর এবার চোখ মেলে তাকালেন। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বিনয়ী কন্ঠে ধীরে ধীরে বললেন,
‘সামাল কে ভাইয়া, জান কা মামলা হ্যায়।’
ড্রাইভার হেসে বললো, ‘পাহাড় মেঁ এয়সা হোতি হ্যায় সাব। ঘাবড়াইয়ে নেহি । সামনে অর ভি খতরনাক জায়গা মিলেগি। ভরোসা রাখিয়ে। কুছ নেহি হোগা। ম্যয় হুঁ না।’আপাতত বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু মিসেস রায়ের মনে ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে। ওই যে ড্রাইভার বললো, সামনে নাকি আরও বিপদ আছে? ড্রাইভারের ওই, ম্যায় হুঁ না, কথায় কারো বিশ্বাস নেই। এইমাত্র যে কান্ড ঘটিয়েছো, তারপরে তোমাকে ভরসা করার কোনও মানেই হয় না। অথচ অনন্যোপায়, তাকেই নির্ভর করতে হবে, আগামী বেশ কয়েকদিন।
এর চাইতে অসহায় অবস্থা আর কি-ই বা হতে পারে?
মানালি মায়ের কোল থেকে মুখ তুলে হালকা স্বরে বললো, ‘গাড়িটা একটু দাঁড় করাও না, একটু নেমে জল খাবো।’
সম্ভবত জল খাওয়া উদ্দেশ্য নয়। সে তো গাড়িতে বসেই খাওয়া যায়।
আসলে মাটির মানুষ। মাটিতেই ভরসা, নির্ভরতা। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এত সামনে থেকে দেখে, সেই মাটির প্রতি টান গভীর হয়ে উঠেছে। একবার এখনই তাকে না স্পর্শ করলেই নয়।
মাটি। মানুষের জীবন ধারণের এক প্রধান উপাদান। মাটি, তুমি ছাড়া হ’লেই হৃদয় কম্পমান। মাটি, তোমাকে শতকোটি প্রণাম।
কথাটা বোধহয় সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, শুধু মুখ ফুটে বলছিলো না।
নীল তৎক্ষনাৎ হুকুমের সুরে বললো, ‘এই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। আমরা একটু নামবো।’
ড্রাইভার আরও মিনিট কয়েক পরে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো।
পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। প্রকৃতি এখানে আরও উদার। চারপাশ, যেদিকে চোখ যায়, পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। একটি ঝর্ণা, এলোচুল চঞ্চলা কিশোরীর মতন হেলেদুলে নাচতে নাচতে ওই দূরের পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসছে। তার ঝরঝর শব্দ, সরোদের ঝংকার তুলে ধ্যানমৌন পাহাড়ের ঘুম ভাঙাতে নিরলস চেষ্টায় নিমগ্ন।
পাইন কাঠের ছোট্ট বেঞ্চি। প্রফেসর আর মিসেস রায়, তাতে বসে পড়লেন। বুক ভরে নিলেন বিশুদ্ধ বাতাস। এখনো কেউই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি। জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলো সবাই। দারুণ ঠান্ডা জল। আবারও মেঘ ঘনিয়ে আসছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
চা দোকানী- একটি পাহাড়ি স্ত্রী লোক, তার পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা একটি বাচ্চা।
চলমান জীবন যুদ্ধের জলজ্যান্ত ছবি। এভাবেও বাঁচে জীবন। বুকে লড়াই আর স্নেহ মমতাকে পিঠে বেঁধে, সুখ অসুখের সীমানা পেরিয়ে, মৌন গম্ভীর ধূসর জীবনযাপন।
আরও পথ। সামনে আরও পথ। অজানা অচেনা। আস্থাহীন সারথি’র হাত ধরে, সুখের খোঁজে পথ চলা। কেবলই পথ চলা।পর্ব-১০
পাহাড়ি পথে গাড়ি চাপলেই সমতলের মানুষ কিঞ্চিৎ ভীতু হয়ে যান। পাকদণ্ডী পথে পাক খেতে খেতে গাড়ি যতই ওপর দিকে উঠতে থাকে। নিচের দিকে তাকালে, বুক কেঁপে ওঠে।
মৃত্যু ভয়, প্রতি মুহূর্তে জানান দেয়, জীবন কত মধুর, কত সুন্দর।
একে হারাতে চাই না। থাকো, থাকো, ওগো প্রাণ। শরীরের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকো দীর্ঘ সময়। আনন্দময় সুখী হয়ে।
যান্ত্রিক বিপর্যয়ের ভয় তো আছেই। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুরন্ত গাড়িগুলো, যতক্ষণ না পাশ দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে, আতঙ্ক কাটে না। বিশেষ করে গাড়ি যদি, খাদের দিকে থাকে।
আর, স্টিয়ারিং হাতে লোকটির প্রতি আস্থা যদি তলানিতে গিয়ে থাকে। তবে আতঙ্কের মাত্রা কোথায় পৌঁছাতে পারে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই নির্ঘাত ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
এদের ক্ষেত্রেও সেই একই অনুভূতি। তাই, পথে যেতে যেতে প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ-সুধা তেমন করে আকন্ঠ মুগ্ধতায় পান করা হয়ে উঠলো না। একটা ভয়ার্ত, দমবন্ধ ভাবনা থেকে কিছুতেই নিস্তার পাওয়া গেল না।ড্রাইভার হঠাৎ হিন্দিতে বললো। যার বাংলা তর্জমা করলে যা হবে, ‘ডান দিকের জানালার কাঁচগুলো বন্ধ করে দিন। নইলে, ঝর্ণার জলে ভিজে যাবেন। এখনই আমরা ঝর্ণার ভেতর দিয়ে যাবো। ভীষণ ঠান্ডা জল। বরফের মতো। এই ঠান্ডায় ভিজে গেলে, খুবই কষ্ট পাবেন।’
এর পরের কথাটি সত্যিই আতঙ্কিত হবার মতো।
‘ঝর্ণার জলে ওখানকার রাস্তায় হাল খুবই খারাপ। গাড়ি দুলবে। ভয় পাবেন না। সবাই শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে থাকবেন। নড়াচড়া করবেন না। কারণ রাস্তা শুধু ভাঙাই নয়, পিচ্ছিলও বটে।’
সকলেই বাক্যহারা। সকলেই সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ আগেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক ঘটনা এখনো মনের মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। এরপর আবারও যদি…
মিসেস রায় মনে মনে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি পূর্ণ ভ্রমণে আসার জন্য আক্ষেপ করছেন। আনমনে হাত ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট রুমাল বের করে আনলেন। পুঁটুলির মতো করে বাঁধা।
সেটি চোখ বুঁজিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন। ওটা মানালির দেওয়া সেই প্রসাদী ফুল।
দুর্গামাঈ কী জয়। বিপদ আপদে তার কথাই বড্ড বেশি মনে পড়ে।
প্রফেসর বিস্ফোরিত চোখে বললেন, ‘একেবারে ঝর্ণার মাঝখান দিয়ে?’
ড্রাইভার বললো, ‘ইয়েস স্যার। বো ঝোরা পাহাড়কে উপর সে সিধা রাস্তে পে গিড়তা।তেজ জাদা নেহি, লেকিন পানি কে কারণ দিক্কত হোতি হ্যায়। ডড় নেহি।’
আর একটু এগিয়েই ড্রাইভার বললো,
‘ওয়ো দেখিয়ে দূর সে বহৎ আচ্ছি লাগতি। ম্যায় ইঁহা গাড়ি রোক দেতা হুঁ। ফোটো খিঁচ লিজিয়ে।’
নীল বসে ছিল সেই জানালার ধারেই। দরজা খুলে সেই প্রথম নেমে গেল। অস্ফুটস্বরে বললো, ‘রিয়েলি ওয়ান্ডারফুল। নাইস।’
একে একে সবাই নেমে এলো গাড়ি থেকে। সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যের মনোহরণ রূপে, মোহিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে সহস্রবার জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যায়। এ-ই তো জীবন। এখানেই তো জীবন আর মরণের তফাৎ।
দূর থেকে যে নৃত্যরতা কিশোরী ঝর্ণটি দেখা যাচ্ছিলো এতক্ষণ। এ-ই সেই স্বর্গীয় নর্তকী। পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এলোমেলো অশান্ত দুরন্ত পায়ে সে ছুটে যেতে যায় কোন অজানার দেশে। অজস্র অজস্র জলকণা ধোঁয়ার মতো ছেয়ে ফেলেছে চারদিক। সাদা ফ্যানার স্রোত হু হু করে নেমে যাচ্ছে পাশের খাদে জলতরঙ্গ বাজাতে বাজাতে।
মুভি মুডে ছবি ধরা রইলো সকলের ক্যামেরায়। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু ছবি তো শুধুই ছবি। প্রাণসঞ্চার হলো কী তাতে? না। তাকে ধরা যায় না। সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মনের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেয়েছে যে, তাকে বন্দী করবে, এমন সাধ্য কার?গাড়ি এগিয়ে চললো। চিরকিশোরী রৌপ্যবর্ণা মাধুরিকে প্রেম চুম্বন দিয়ে, দূরে, আরও অনেকটা পথ বাকি। পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই। এই পথে পাহাড়ি ভাল্লুকের উপদ্রব আছে।
এখন পাহাড় যেন চারপাশ থেকে জাপটে ধরতে আসছে। কালচে পাহাড়গুলো এক-একটা বিশালাকার দৈত্যের মতন খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
এতো রূপ এরা পেলো কোথায়। কোন সে রূপকার, কেমন করে এমন হৃদয় হরণ সাজে সাজালো এদের?
হে প্রকৃতি। হে প্রকৃত দেবতা, তুমি তোমার অনির্বচনীয় সুখানুভূতি রংতুলির প্রলেপ বুলিয়ে দাও প্রতিটি মানুষের অন্তরে। ঘুচে যাক অমানিশার করাল ছায়া। প্রতিষ্ঠিত হোক প্রেমময় আলোকবর্তিকা। হয়ে উঠুক বিশাল আর সুন্দর।গাড়ি আরও কিছুদূর গিয়ে আচমকাই তার গতি কমিয়ে দিলো। ওরা সবাই গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে দেখতে পেল, একটা পাহাড়ি ভাল্লুক দুলকি চালে রাস্তার একপাশ দিয়ে চলছে।
ড্রাইভার বললো, ‘দেখিয়ে, ভালু আ গিয়া।’
তন্ময় অস্থির হয়ে বললো,’আরে ভাই, পাশ কাটিয়ে চলো না, ভাল্লুক আবার দেখার কী হলো?’
ব্রজেশ বললো, ‘এই শোন, তুই কখনো দেখেছিস, রাস্তা দিয়ে ভাল্লুক দুলকি চালে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে?’
তন্ময় চুপসে গেল। তবুও বললো, ‘না মানে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই..’
প্রফেসর বললেন, ‘আরে, যদি পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিৎ হতো, তাহলে ড্রাইভার তাই করতো।’
-‘রাইট স্যার। বো কভী ভি এট্যাক কর সকতা হ্যায়। বো আবভী জঙ্গল কা রাস্তা পরড় লেগা। সামনে যানা খতরনাক হো সকতী হ্যায়। ইয়ে বহৎ ডেঞ্জারাস জানবার সাব।’
সত্যিই তাই। ভাল্লুকটা বাঁদিকের পাহাড়ের বাঁকে জঙ্গলে ঢুকে গেল। এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল ড্রাইভার। জোরে গাড়ি চালিয়ে দিলো।
এখন আর কোথাও কালক্ষয় নয়। গাড়ি ছুটে চললো লাচেনের উদ্দেশ্যে ।পর্ব-১১
জীবন থেমে থাকে না, পরিবর্তন আনে। কালের নিয়মে। ফেলে আসা সময়, পিছুটান রেখে যায় স্মৃতির এলবাম।
কর্মময় ব্যস্ত জীবনে মায়ার বাঁধন। সঙ্গে আছে দায়দায়িত্ব, কর্তব্য আর অধিকার অনধিকারের বিচিত্র টানাপোড়েন।
তারই মাঝে খুঁজে ফেরে, হাতড়ে বেড়ায় মন, একটুকরো সুখের অঙ্গন। কে জানে সেই সুখের কী রঙ।চার বন্ধুর ইদানীং বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হয় না। জীবন জীবিকার তাগিদে সবাই ব্যস্ত।
ফোন আসে কখনো সখনো। কথা হয়।
কথা হয় ঠিকই, তবে সেই কথায় আগের মাত্রাহীন উচ্ছ্বলার উত্তাপ নেই। মাপকষা গতানুগতিক বাঁধাছকের নিয়মমাফিক কথপোকথন ।
তারুণ্য বড়ো ক্ষণস্থায়ী।
যতক্ষণ থাকে, তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
হারিয়ে যাবার পর যা থাকে, তা শুধুই গল্প।মানালি আর নীলের মাঝে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হয়তো এসেছিল। তবে তা ভালোলাগা।
তার বেশি কিছু নয়। হয়তো।
ভালোবাসা পরিনতি খোঁজে। পরিনতি চেয়ে থাকে ভবিষ্যতের দিকে।
জীবন তো গানিতিক নিয়মের দাসত্ব করে না। সে চলে তার নিজস্বতায়। তাইতো সব জীবন একই রকম নয়।মানালি এখন কানাডায়। ওর স্বামী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির সূত্রে আপাতত সেখানেই সেটেল্ড। কাজেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
ব্রজেশ গায়ক হতে চেয়েছিল। হয়নি। বাবা হঠাৎই মারা যাবার পর, পারিবারিক ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র সন্তান কি না।
তন্ময় শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতো। এখন নিজেই কোচিং সেন্টার খুলে, সেই স্বপ্ন পুরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
দীপেন হারিয়ে গেল। মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ বলে প্রেমের আঘাত, কেউ বলে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। হতাশা।
প্রত্যাশা কিংবা নিজস্ব যোগ্যতার প্রতি প্রবল বিশ্বাস, সে-ও তো প্রেম।নীল টিভি সিরিয়ালে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে। আশায় বুক বেঁধে আছে, একদিন নায়ক হবে। হয়তো হবে।
সুখের স্বপ্ন উড়ান, আর সুখের ঘরে বাস কিছুতেই এককথা নয়।রাত তখন কত জানা নেই। নীলের জানবার ইচ্ছেও নেই। নীলচে সুখ রিসর্ট ঘুমিয়ে পরেছে। কেবল বারান্দার কয়েকটি আলো, জ্বালা আছে।
জ্বালা আছে ‘নীলচে সুখ’ লেখা গ্লো-সাইনবোর্ড। বাকি সব অন্ধকার।
লনের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নীল।রুমার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
-‘একি, এখানেই এইভাবে সারারাত বসে থাকবে না কি! চলো, ঘরে চলো। উঠে এসো। চলো।’
রুমা, নীলের হাত ধরে টেন , তাকে তোলবার চেষ্টা করলো। পারলো না।
নীল, রুমার হাতটা চেপে ধরলো, অনুনয়ের সুরে বললো, ‘একটু বসবে, আমার কাছে। একটু সময়.. প্লিজ.. বসবে?’
রুমা হাই তুলে হালকা গলায় বললো, ‘ছেলেটা ঘরে একা ঘুমিয়ে রয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কাউকে দেখতে না পেলে কান্নাকাটি করবে, ভয় পাবে। প্লিজ, ঘরে চলো। তোমার সব কথা শুনবো, কাল সকালে। এখন শোবে চলো।’
নীল, রুমার চোখের দিকে তাকিয়ে, ওর মন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর সামান্য আওয়াজ করে হাসলো।
রুমা, নীলের মুখের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসেই বললো, ‘হাসলে যে, কী বোঝাতে চাইছো তুমি, আমি তোমায় এভয়েড করছি?’
– ‘তাই, বললাম কী?’
-‘ সব কথা উচ্চারণ করতে হয় না। অন্যভাবেও বুঝিয়ে দেওয়া যায়। যাক গে, কী বলবে বলো।’
নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘নাহ্ থাক,..’ -‘কেন! থাকবে কেন? বলোই না শুনি, নতুন করে প্রেম নিবেদন করবে নাকি? দেখো বাবা। কেন যে শুধু শুধু এইসব মাল ফাল খেতে গেলে, জানি না।’
নীল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঘরে চলো। ছেলেটা একা আছে।’কখনো কখনও মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়াও সুখ। এডজাস্টমেন্ট।
স্বপ্ন আর বাস্তব কিছুতেই মেলে না।
দুস্তর দূরত্ব এই দুয়ের মাঝে। দুরত্বের মাঝেই যন্ত্রণার ঘর। দিগন্তের স্পর্শ পাওয়া অবাস্তব। সে কেবলই দুরত্বের নির্মম মায়াজাল।মানালিকে নিয়ে ও যে কল্পনার আল্পনা আঁকেনি, এমন বললে নিতান্তই তঞ্চকতা করা হবে।
মানালির মনের কথা ওর জানা নেই। তবে আন্দাজ করতে পারে। হয়তো সেও, মনে মনে, নির্জন বৃষ্টি ভেজা মায়াবী চাঁদনী রাতের পাহাড়ি পথে, তার হাতের ছোঁয়া সুখস্মৃতি, এখনো যে অমলিন।স্মৃতি পিছুটান। তার হাত থেকে বোধকরি কারোরই রেহাই পাবার যো নেই।
মুশকিল সেখানেই, যখন অতীত, বর্তমানের ঘরে উঁকি দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। তার পালিয়ে বেড়াতেই সুখ। ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। আলতো পায়ে তার কেবলই নিঃশব্দ যাওয়া আসা। মনের আঙ্গিনায় আলোছায়ায় লুকোচুরি।
বাতাসে ফিসফিস করে কে যেন বলে,
‘আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো..’
মনের অতলান্ত গভীরে, নিভৃত একান্তে।
বড়ো জানতে ইচ্ছে করে।
ওগো সুখ, তোমার কী রঙ?
শেষ নাহি রে, শেষ কথা কে বলবে?।। সমাপ্ত।।
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( তৃতীয় ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব-৭
নীল আর মানালি চাঁদের আলোয় হেঁটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তায়। একটা বাঁক ঘুরতেই তারা দেখলো, পাহাড়ের কোলে একটা মন্দির। মন্দিরের চারপাশ বেশ আলো সাজানো। জেনারেটর ব্যবহার করা হয়েছে। আরও এগিয়ে গেল মন্দিরের কাছে। বেশ কিছু মানুষের ভীড়। সবাই স্থানীয়। সেখানেই হচ্ছে সেই ভজন গান। যা দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে মূর্তির দর্শন করলো। দুর্গা মূর্তি। পার্বতী। পর্বতেই যায় আবাস। প্রণাম সেরে ঘুরে দাঁড়াল। এবার ফিরতে হবে। লজ থেকে অন্তত মাইল খানেক দূরে চলে এসেছে ওরা। সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অচেনা অজানা জায়গা। কাউকে তেমন করে কিছু বলে আসা হয়নি। মানালির বাবা মা দুশ্চিন্তা করবেন, তাতে আশ্চর্যের কী! ঠান্ডাও এখানে অনেক বেশি।
ঠিক তখনই একজন সাধু গোছের লোক, তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাদা দাড়ি গোঁফ। মাথায় সাদা লম্বা চুল। সাদা ধুতি আর গায়ে একটা সাদা শাল। অনেকটাই বয়স হয়েছে। হাতে একটা পিতলের থালা, তাতে কিছু পাহাড়ি ফুল আর খেজুর কিসমিস। মৃদু হেসে বললেন, ‘দুর্গামাঈ আপকা ভালা করে। লিজিয়ে, পরসাদ লিজিয়ে।’
ওরা অযাচিত এই আহ্বানে একটু কুন্ঠিত বোধ করলো। তারপর আড়চোখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নির্বাক সম্মতিতে, বাড়িয়ে ধরা থালা থেকে ইতস্তত ভাবে যৎসামান্য প্রসাদ তুলে নিলো।
লোকটি অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে দুজনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন,
‘দুর্গামাঈ আপ দোনো কো সুখী রাখে, কুশল মঙ্গল রাখে। জয় দুর্গামাঈ।’
লোকটি ভীড়ের ভেতর চলে গেলেন।
ওরা ফেরার পথ ধরলো।
মন্দির চত্তরের বাইরে এসে, নীল বললো,
‘মানালি, তোমার কাছে রুমাল আছে?
মানালি অবাক হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ আছে, কেন?’
নীল দাঁড়িয়ে গেল। বললো,’গুড,দাও।’
মানালি হাতের ছোট ব্যাগের ভেতর থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো। নীল রুমালটা নিয়ে বললো, ‘এবার তোমার হাতের প্রসাদ আর ফুলগুলো এর মধ্যে রাখো।’ মানালি যন্ত্রচালিতের মতো তাই করলো।
নীল নিজেও তার হাতে ধরে রাখা ফুল, প্রসাদ রুমালের মধ্যে রেখে ভালো করে বেঁধে, মানালির হাতে ফেরৎ দিয়ে বললো,
‘নাও, যত্ন করে রাখো। এটা এখন আমাদের কৈফিয়ত কিংবা সাক্ষী যা খুশি বলতে পারো।’
মানালি কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে বললো,
‘তার মানে?’
-‘তার মানে লজে ফিরে গেলেই বুঝবে। কতরকম প্রশ্নের মুখে পরবে জানো? কোথায় ছিলি, কোথায় গেলি, এতো দেরি কেন? উরিব্বাস!
সব প্রশ্নের মুশকিল আসান, এই দুর্গা মা’য়ের প্রসাদ। কী? কিছু ঢুকলো মাথায়?’
মানালি হি হি করে হেসে বললো, ‘যাঃ খালি ফাজলামো।’
নীল বললো, ‘তোমার কোন কলেজ যেন?’ -‘রামমোহন, কেন?’
-‘ওই তো, সেই জন্যেই, পড়তে আমার মতো প্রেসিডেন্সিতে, দু-দিনেই বোলচাল, মগজ সব অন্যরকম গল্প হয়ে যেতো।’
-‘আরে রাখো তোমার প্রেসিডেন্সি। ওখানে কি-হয় না হয় সবাই জানে। আমার বোলচাল মগজ ঠিক জায়গাতেই আছে।’
-‘আরে আমারই সামনে, আমার কলেজের কুৎসা! না না এ অসহ্য।’
-‘ঠিক আছে, তুমি তোমার অসহ্যতা নিয়ে সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চললাম।’
মানালি সত্যিই গটগট করে অন্ধকারে মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো। নীল থতমত হয়ে পিছন থেকে বললো, ‘আরে, কী মুশকিল। আমি আসছি তো।’ মানালি সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে তার চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। নীল পিছন থেকে প্রায় ছুটে এসে মানালির হাত ধরে ফেললো।
মানালি একটুও সেই হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো না। শুধু মুখে কৃত্রিম বিরক্তি ভাব এনে বললো, ‘প্রেসিডেন্সি..’
মানালির নরম হাত, নীলের শক্ত মুঠোয় ধরা। সেটা কী মানালির নিরাপত্তার কারণে, সাবধানতা! নাকি আবেগ দূর্বলতা ! কারণ যাই হোক, এক আশ্চর্য সুন্দর সুখানুভূতি স্নিগ্ধ ঝর্ণার মতো বয়ে যাচ্ছিলো, দুজনের মনের গহীনে, যা অব্যক্ত।
নীল, হালকা ধমকের সুরে বললো,’অন্ধকারে ঐভাবে কেউ দৌড়োয়! আছাড় খেলে বুঝতে মজা।’
মানালি একটু সময় চুপ করে থেকে বললো,
‘অন্ধকার পাথুরে রাস্তায় চলতে আমরা ভয় পাই। আঘাত লাগার ভয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি, এই পথ আমাদের শিক্ষাও দেয়। জীবনের চলার পথ আলোকিত মসৃণ নয়। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে চলতে চলতে আলোর দিশা পেতে হয়। তাই না?’
রাস্তায় মাঝে মধ্যেই বড়ো বড়ো ভাঙা গর্ত। বৃষ্টির জলে টইটম্বুর। আকাশের ভাঙা চাঁদের প্রতিবিম্ব সেই জলে এসে পড়েছে। যেন এই মায়াময় নির্জনতায় ওদের দুজনকে দেখবে বলে, জলের নিচে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে। তিরতির করে বহে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়ায় সেই জল কেঁপে কেঁপে উঠছে, কাঁপছে প্রতিবিম্ব।
নীল, সেই কম্পমান চাঁদের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললো, ‘তোমার সাবজেক্ট যেন কী?’
মানালি কপাল কুঁচকে বললো, ‘ফিলোসোফি কেন?’
নীল হাসতে হাসতে বললো, ‘না, এমনিই..:
মানালি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, নীলের পিঠে চটাস করে একটা চাপড় মেরে বললো, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে না, অসভ্য ছেলে।’
নীল এইবারে হো হো করে হেসে বললো,
‘মাফ করো, জুলজির মাথায় ফিলোসোফি ঢুকবে না। হা হা হা।’
নীলের অমন প্রাণখোলা হাসি দেখে, মানালিও স্থির থাকতে পারলো না। সেই হাসিতে সেও যোগ দিলো। হা হা হা…
তাদের সেই সম্মিলিত নির্মল হাসি, প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো রাত সুন্দরী পাহাড়ের নিঝুম কোলে কোলে।
সুন্দরী সিকিম, নব যৌবনের উচ্ছ্বলতায় আরও সুন্দরী হয়ে উঠলো।কিন্তু, লজে অপেক্ষারতা মাতা সুন্দরী কী করেন সেটাই এখন দেখার।
পর্ব-৮
এখন রাত আটটা। ছোট্ট এই প্রায় জনমানবহীন পাহাড়ি গ্রামে মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতা। মিসেস রায় একা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ের আকুল প্রতীক্ষায়।
ছেলেগুলোকে জোর করেই পাঠিয়েছেন একটু এগিয়ে গিয়ে, যদি ওদের কোনও হদিস করা যায়, এই আশায়। একেই বলে উদ্বেগ। স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেরা ফিরে এলো। ওদের দেখা পায়নি। তবে অন্য খবর এনেছে। রাস্তা পরিস্কারের কাজ চলছে। আন্দাজ মতো কাল সকল নটার পরেই রাস্তা চালু হয়ে যাবে। যদি না আবারও নতুন করে ধ্বস নামে।
মিসেস রায় কথাগুলো শুনলেন বটে, কিন্তু বিশেষ উৎসাহ পেলেন বলে মনে হলো না।
শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে গেলেন।
প্রফেসর চোখ বুঁজে শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছিলেন। মিসেস রায়ের কথায় সে চেষ্টায় জল ঢেলে উঠে বসলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আরে..এতো মহা মুশকিল। আমি কী করলাম?’
মিসেস রায়ও একইভাবে বললেন,
‘তুমিই তো ওদের জোটালে। গায়ে পড়ে।’ -‘কেন? তুমিও সামনেই ছিলে। তুমি ওদের অফার, আই মিন প্রপোজাল দাওনি?
তাছাড়া এসব কথা উঠছে কেন? কোথায় কী রামায়ণ মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?’
-‘তুমি চুপচাপ ঘরে বসে আছো কেমন করে? এতখানি রাত হলো, এই ভয়ঙ্কর জায়গায় মেয়েটা একটা সামান্য পরিচিত ছেলের সঙ্গে, ওফ্ফ.. কী কুক্ষণে এখানে এসেছিলাম। আসা থেকে দুর্ভোগ পিছু নিয়েছে। যাক, তুমি একবার বাইরে বেরিয়ে দেখবে, নাকি আমিই যাবো?’
-‘কেন? ওরা গেলো তো..’
-‘ওরা ফিরে এসেছে। দেখা পায়নি। রাস্তা সারাইয়ের খবর এনেছে।’
-‘তাই নাকি, বেশ ভালো। সারাইয়ের কাজ কী হয়ে গেছে?’
-‘তোমার যাবতীয় মুখোরোচক প্রশ্নের পছন্দের উত্তর পাশের ঘরে গেলেই পেয়ে যাবে। যাও পাশের ঘরে যাও। জমিয়ে বসে সবকিছু ঠিকঠাক জেনে এসো, যাও।’
-‘তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? একটা কথা ব’লে রাখছি শোনো- আমি দীর্ঘদিন যাবৎ এইরকম তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছি। আমি চিনতে ভুল করি না। তুমি যা কল্পনা করছো, তা একেবারেই ভুল। নতুন জায়গায় একটু ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বেড়াতেই তো এসেছে। ঘরে শুয়ে বসে থাকার জন্য তো আসেনি। এটাই স্বাভাবিক। আমার সেই বয়স থাকলে, আমিও এইরকম গ্যাঁট হয়ে ঘরে বসে অকারণ বকবক করে সময় নষ্ট করতাম না। সে অভিজ্ঞতা তোমার যথেষ্টই আছে।’
মিসেস রায় বুঝলেন, এইভাবে বলা তার উচিৎ হয়নি। মানুষটা মনে মনে দুঃখ পেয়েছেন।পায়ে পায়ে খোলা জনলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে বেশি দূর দেখা যায় না। মনের মধ্যেও একরাশ দুশ্চিন্তার অন্ধকার। মায়ের মন, সন্তানের জন্য ব্যাকুল হবেই। অনিচ্ছা সত্বেও দু’একটা অবান্তর অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবেই। উচাটন বাগ মানে না।
প্রফেসর আড় চোখে মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে, পায়ে চটিটা গলিয়ে, বাইরে বেরুতে যাবেন ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে একটা সমবেত কোলাহল ভেসে এলো।
-‘ এই এসে গেছে। কোথায় গিয়েছিলি এতক্ষণ? বলে যাবি তো।’
প্রসেসর বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন,
‘মানালি তুমি মায়ের কাছে যাও। উনি তোমার জন্য খুবই চিন্তা করছিলেন। যাও।’
মানালি বাবার পাশ দিয়ে ঘরে চলে গেল। মিসেস রায় তখনও একইভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মানালি কাছে গেল না। সামান্য দূর থেকে আদুরে গলায় বললো, ‘মা, তুমি রাগ করেছো?’
মা তখনও একটুও নড়লেন না। শুধু নির্বাক নিশ্চলভাবে এক আশ্চর্য রকম চোখে মানালির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেই দৃষ্টিতে রাগ, স্নেহ, অভিমান আর স্বস্তির নিবিড় বন্ধন ছিল একাকার হয়ে। ছলছল চোখে বললেন, ‘মানালি এমন করিস কেন বল তো! কী পাস, আমাকে এমন করে কষ্ট দিয়ে।’
মানালি ছুট্টে গিয়ে মাকে জাপটে ধরে বললো, ‘আর কখনও হবে না মা। প্লিজ..’ কথা শেষ হলো না, গলা বুঁজে এলো।
বোধকরি এটুকুই যথেষ্ট ছিল। মমতার কাছে নত হওয়াই জগতের নিয়ম।
মা তার সন্তানকে সজোরে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে, অশ্রুসজল চোখে বললেন, ‘আমি যে বড়ো ভয় পাই মানালি, আমি যে বড্ড ভীতু।’ মানালি মা’য়ের বুকে মাথা রেখে বললো, ‘মা আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই! বিশ্বাস নেই মা?’
মা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বুকের মাঝে জমে থাকা পাথরগুলো যেন বুলডোজার দিয়ে ধাক্কা মেরে কেউ সরিয়ে দিলো, আর সেই সরে যাওয়া পাথরের ফাঁক গলে পবিত্র ঝর্ণার ধারা কুলকুল শব্দে নদীর পানে ছুটে গেল।
মায়ের অশ্রু ভেজা গাল নেমে এলো, মেয়ের মাথায়। মানালির ডাগর দুটি চোখেও টলমল করছে জল।
পাইন গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির জল, তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে ঝরছে ভিজে পাহাড়ের গায়ে, টপটপ, টপটপ।
পাশের ঘরে ব্রজেশ ভরাট উদাত্ত গলায় গান ধরেছে,
“এ তুমি কেমন তুমি
চোখের তারায় আয়না ধরো,
এ কেমন কান্না তুমি
আমায় যখন আদর করো..”পরদিন সবাই খুব সকালে উঠে পরেছে। ড্রাইভারের সঙ্গী এসে জানিয়ে গেছে। রাস্তা খুলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করেই রওনা দেওয়া হবে, লাচুন লাচেন-এর পথে।
নীল আর তার বন্ধুরা একটু আগেই সেই ধ্বসের জায়গা দেখে এসেছে। প্রফেসর ওদের সঙ্গে লজের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের কাছে ধ্বসের খুঁটিনাটি বিবরণ জানছেন।
এতক্ষণে জানা গেল, এই জায়গার নাম মানগাং। মনে রাখবার মতো জায়গা।মানালি আর মিসেস রায়ও রাস্তায় নেমে এলেন। এখন সবাই যাবার জন্য তৈরি। গাড়িটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ মানালি তার মাকে শিশুসুলভ সরলতায় বললো, ‘মা, একবার হাঁ করো।
মিসেস রায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন?’
-‘আহঃ, যা বলছি করো না। হাঁ করো।’
মিসেস রায় খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মেয়ের আদেশ পালন করতে, হাঁ করলেন।
মানালি সেই হাঁ-এর মধ্যে একটা কিশমিশ টুক করে ফেলে দিলো।
মিসেস রায় সেটাকে বারদুই চিবিয়ে নিয়ে, অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কী এটা?’
মানালি রুমালে বাঁধা গতরাতের দুর্গামাঈ-এর প্রসাদ মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘পাহাড় পার্বতীর প্রসাদ। সবাইকে দাও। বাবাকেও।’
মিসেস রায় তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তবুও রুমাল শুদ্ধ প্রসাদ কপালে ঠেকিয়ে নিয়ে, ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
তন্ময় বললো, ‘কাকীমা কালরাতে ওরা তো ওই মন্দিরেই গিয়েছিল। তারই প্রসাদ।’
প্রফেসর হেসে বললেন, ‘বাব্বা, এই পাহাড়ি জঙ্গলে মন্দিরও খুঁজে বের করে ফেললি তোরা।এ তো দস্তুরমত একটা আবিষ্কার বলা যেতেই পারে। নাঃ মানতেই হচ্ছে, তোদের ক্যালি আছে।’
মিসেস রায় প্রফেসরের মুখে একটা কিশমিশ দিয়ে দিলেন। প্রফেসর মুখে প্রসাদ নিয়ে, বালককের মতো মুঠো বদ্ধ হাত আকাশ পানে ছুঁড়ে চিৎকার করে বললেন, ‘দুর্গামাঈ কী জয়।’
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
মানালি আর নীল দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে, সেই হাসিতে যোগ দিয়ে, প্রফেসরকে নকল করে চিৎকার করে বললো, ‘দুর্গামাঈ কী জয়।’
ড্রাইভার বললো, ‘সবাই গাড়িতে বসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
সবাই গাড়িতে বসতেই, চলতে শুরু করলো গাড়ি। জানালা দিয়ে সবাই শেষ বারের মতো, প্রাণ ভরে দেখছিল, অখ্যাত আশ্চর্য সুন্দরী মানগাং-কে।
বিদায় রুপসী মানগাং। একটি মাত্র রাত। তাও অযাচিত আকস্মিক ঘটনায় অসহায় ভাবে তোমার ছোট্ট কোলে আশ্রয় নেওয়া। তোমার কাছে যা পেলাম, সারাজীবন মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে।গাড়ি মাত্র মিনিট পনেরো গড়িয়েছে। তখনই ঘটে গেল একেবারে ভয়াবহ ঘটনা। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। থাকার কথাও নয়।
চলবে……..
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( দ্বিতীয় ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব- ৪
সকালে ডেকে ঘুম ভাঙাতে হলো না। প্রবল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার দাপাদাপিতে ঘুম এমনিই ভেঙে গেল।
নীল ঘরের বাইরে এলো। পাহাড়ি বৃষ্টিকে আরও কাছ থেকে দেখবে বলে। বারান্দায় এসে দেখলো মানালি, একা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এক মনে তাকিয়ে আছে, পাহাড়ের গায়ে ঝরে পরা মুক্তোগুলোর দিকে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে আসা জলের কণায় ভিজে যাচ্ছিল ওর এলো চুল, শান্ত মুখ। মানালি যেন আশ্রয় দিচ্ছিল, প্রশ্রয় দিচ্ছিল অপরূপ প্রকৃতির ভালোবাসাকে। লালন করছিলো তাদের সর্বাঙ্গে।
-‘একি! মানালি!’
নীলের আচমকা ডাকে সামান্য চমকে উঠে পিছন ফিরে বললো, ‘ও, তুমিও উঠে পরেছো। দ্যাখো, কী সুন্দর বৃষ্টি। জানো, আমি জানতামই না বৃষ্টি এমন আশ্চর্য রকম সুন্দর। সিনেমায় দেখেছি, গল্পে পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম। সেগুলোর সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই।’ বলেই চট করে ঘুরে, নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার ভালো লাগছে না?’
সেই সময় মানালির হাত দু’টো মুঠো করে বুকের কাছে জড়ো করা ছিল। আর কাঁপছিল থরথর করে, ভিজে যাওয়া পাখির মতো।
নীল কিচ্ছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। এমন অপরূপ ক্ষণে সম্ভবত কথারা নির্বাসনে যায়। শুধু কথা বলে মন, সে কথারা ভেসে যায়, মন থেকে মনে, চোখ থেকে চোখে। সাক্ষী থাকে সময়, শুধুই সময়।
-‘কী ব্যাপার রে তোদের? ভোরবেলা এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টির জল গায়ে লাগাচ্ছিস। অসুখে পরবি যে। মিসেস রায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর। তৈরি হয়ে নে। গাড়ি এসে যাবে তো! বাবা নীল, তোমরাও যাও। রেডি হয়ে নাও। ওফ্ফ, হঠাৎ কিরকম বৃষ্টি আরম্ভ হলো বলো দেখি, সময় মতো বেরোতে পারলে হয়। দুর ছাই ভালোলাগে না।’
আওয়াজ শুনে তন্ময় বেরিয়ে এসেছে। পাশের ঘর থেকে প্রফেসরের ফরমায়েশ ভেসে এলো, ‘একটু চা পাওয়া যায় কিনা দ্যাখো না। ইন্টারকম কাজ করছে না।’
তন্ময়, করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। চায়ের তদারকি করতে।সবাই রেডি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। গাড়ি এলো ন’টায়। দেরির কারণ জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। অকাট্য যুক্তির সাজানো বাহানা তৈরিই আছে। সুতরাং সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। এখন বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশের যা অবস্থা , ভরসা করা যায় না। ব্যাগ গুছিয়ে সবাই বসতেই গাড়ি রওনা দিলো, লাচেন লাচুনের পথে।
যে ভয় ছিল, তাই হলো। বেশ কিছুদূর যাবার পরেই আবার বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি চললো। তবে খুবই ধীরগতিতে। দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু ওদের মনের মধ্যে ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইভাবে রিস্ক নেওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কেন না, বিপদটা তাহলেও একই থেকে যাচ্ছে। উপায় নেই। এগিয়েই যেতে হবে। জানালার কাঁচ সব বন্ধ। কাঁচগুলো সাদাটে হয়ে গেছে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য ভয়ার্ত নীরবতা বিরাজ করছে গাড়ির ভেতর। আরও কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার আর তার সঙ্গী, দুজনেই নেমে গেল নিঃশব্দে।
মিনিট খানেক অপেক্ষা করে, ব্রজেশ আর দীপেন নেমে গেল। প্রায় তক্ষুনি ফিরে এসে খবর দিলো। গাড়ি আর যাবে না। সামনের রাস্তায় বিরাট ধ্বস নেমেছে। রাস্তা বন্ধ।
মিসেস রায়, হতচকিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে, কী হবে এখন। এই পাহাড়ি রাস্তায় জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে নাকি, সর্বনাশ..’
বড়ো বড়ো চোখ ভয়ে আরও বড়ো হয়ে গেল। প্রফেসর চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেছেন। কারণ, মনে হয় উনি বুঝতে পেরেছেন চশমা চোখে খুঁজেও, এই বেমক্কা বিপদ থেকে বেরুনোর পথ পাওয়া দুষ্কর। অসহায় ভাবে নীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নীল, কিছু একটা ব্যবস্থা কী করা যায়, মানে এই ঝড়বৃষ্টিতে পাহাড়ি জঙ্গলে..’
নীল হঠাৎ লক্ষ্য করলো মানালি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে না জানি কী ছিল। নীল একলাফে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে গেল। তার সঙ্গ নিলো বাকি তিনজন। ওদের চলার ভঙ্গিতে দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট।
পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই, ওরা চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। এখন একটানা ঝিঁঝি পোকার কান্না ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। আলো কমে আসছে। সন্ধ্যা নামছে।পর্ব-৫
মিনিট দশেক এভাবেই কেটে গেল। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। গাড়িতে এভাবে কতক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকা যায়। ড্রাইভারটা গেল কোথায়? একেবারে নিপাত্তা। কিছু বলেওনি। নাকি বলবার প্রয়োজন বোধ করেনি? সে বিচার পরে করা যাবে।
আপাতত এই অবস্থা থেকে রেহাই পেলে হয়। ভাগ্যিস ছেলেগুলো সঙ্গে আছে। তবু খানিকটা ভরসা। খানিকটা কেন? এই মুহূর্তে ওরাই একমাত্র ভরসা।
ড্রাইভার সিটের দরজাটা খুলে গেল। একটা মুখ উঁকি দিলো। এটা ড্রাইভারের সঙ্গীটা। হিন্দি ভাষায় যা বললো, তার তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় সে খবর নতুন কিছু নয়। তবে একটা স্বস্তির কথা শোনালো। ওরা একটা লজে রাতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।
যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মিসেস রায়, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন, ‘ওফ্ফ। বাঁচালে বাবা। কিন্তু সেটা কতদূরে?’
-‘সামনেই নেমে আসুন। ব্যাগপত্র সব আমরা নিয়ে আসছি। আপনারা ওই লোকটার সঙ্গে যান।’ এটা তন্ময়ের গলা। বাকি ছেলেগুলোর গলাও পাওয়া যাচ্ছে।
বোঝা গেল ছেলেগুলো সব কিছু দেখেশুনেই এসেছে।একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকেই সরু খাড়াই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। পরপর পাশাপাশি দু’টো ঘর। ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বেলে ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন।
ঘরে একটা চওড়া চৌকি, তার ওপর একটা অতি নোংরা বিছানা পাতা। একটা কাঠের টেবিলের মাঝখানে বিয়ারের খালি বোতল। বোতলের মুখে একটা লম্বা মোমবাতি গোঁজা। বিদ্যুৎ নেই। রাত্রি যাপনের নিরুপায় আশ্রয়।
প্রফেসর পকেট থেকে লাইটার বের করে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন। আলোছায়ার ভূতুড়ে পরিবেশ।
ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ। একটা জানালা আছে, কিন্তু সেটা বন্ধ। বেশ বোঝা যাচ্ছে, এ ঘরে অনেকদিন কেউ প্রবেশ করেনি। ঘরের মেঝেতে ধুলো ভর্তি। নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়াও হয় না।
মানালি জানালাটা হাট করে খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বৃষ্টি ভেজা বিশুদ্ধ বাতাস, সরলবর্গীয় বৃক্ষের মনমাতানো গন্ধ নিয়ে হুহু করে ঘরে ঢুকে, সমস্ত মলিনতা ধুইয়ে দিলো।
প্রফেসর দেওয়ালের গায়ে আরও একটা দরজা দেখতে পেলেন। হাতল ধরে টান দিতেই খুলে গেল। প্রফেসরের ঠোঁটে হালকা খুশির ঝিলিক। ওটা বাথরুম।
যাক নিশ্চিন্ত। রাতেরবেলা বাথরুম সারতে অন্তত বাইরে যেতে হবে না। সত্যি বলতে কী ওরা এতকিছু আশাই করেনি। এই অচেনা অজানা অন্ধকার পাহাড়ের রাস্তায় রাত্রিবাস করতে হচ্ছেনা, এটাই সবচাইতে বড় পাওয়া। আর ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, এইসব কিছুই পাওয়া সম্ভব হতো না, যদি এই ছেলেগুলো না থাকতো।ছেলেগুলো ব্যাগগুলো নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পরেছে। সম্মিলিত গলার আওয়াজ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওরা এই আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনায় বেশ মজা পেয়েছে। নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে, বাড়তি পাওয়া রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটা বয়সের ধর্ম। অথচ, একই ঘটনায়, রায় দম্পতি দিশাহারা।
ড্রাইভারের সঙ্গী আবার এসে জানিয়ে গেল ।
কাল সকালে রাস্তা ঠিকঠাক হলে আবারও রওনা দেওয়া হবে। ততক্ষণ এখানেই থাকতে হবে।বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। আকাশ একেবারে পরিস্কার। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আকাশ ময় ঝলমলে তারাদের ভীড়। আর এই সদ্য স্নান সেরে ওঠা পাহাড় সুন্দরী, আরও রূপবতী রাজকন্যা হয়ে সেজে উঠেছে, চাঁদের রুপোলী আলোর ঝর্ণা ধারায়।
দূর থেকে একটা গান ভেসে আসছিল। মেয়েদের গলা।
নীল ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলো।
মানালি দেখতে পেয়ে পিছন থেকে ডাক দিলো, ‘নীল, কোথায় যাচ্ছো?’
নীল, মানালির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোথাও না, এমনিই এই সামনে একটু..’
কে জানে কেন, মানালি বললো, ‘আমিও যাবো।’
ওর এই বলার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা আবদার লুকিয়ে ছিল।
কিছু না ভেবেই নীল বললো, ‘এসো।’
মানালি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘মা আমি এক্ষুনি আসছি।’
মিসেস রায় ঘর থেকে সেই আওয়াজ পেয়ে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
মানালি সে কথার কোনও উত্তর দিলো না। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে রাস্তায় চলে এলো। ভিজে রাস্তার ওপর চাঁদের আলো। চারিদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। উঁচু নিচু পাকদণ্ডী পথে দুটি তরুণ তরুণী। এগিয়ে চলেছে সেই দূর থেকে ভেসে আসা গান অনুসরণ করে।
সঙ্গে আছে ঝিঁঝি পোকার তান আর একরাশ উচ্ছ্বাস ভাললাগা।পর্ব- ৬
মিসেস রায় প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। দেখলেন, মানালি আর নীল, অন্ধকার পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে চলেছে। একবার মনে হলো চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে, কোথায় যাচ্ছিস, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। কোথায় আর যাবে। এইতো এতটুকু জায়গা। সামনের রাস্তাটা যেটা দিয়ে ওরা এসেছে এখানে সেটাই একমাত্র চলাচলের পথ। ডানদিকে কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা। সেই দিকেই গেছে মানালিরা।
বামদিকে একটু গিয়েই পথ বাঁক নিয়েছে। তাই বেশি দূর দেখা যায় না। চোখ বাধা পায় পাহাড়ের গায়ে। ওই দিকেই লাচুন লাচেনের পথ। ধ্বস নেমেছে। কাল কী হবে কে জানে।
তন্ময় বাইরে এসে মিসেস রায়কে দেখে বললো, ‘এ কি কাকিমা, একা দাঁড়িয়ে কেন?’
-‘আর বলো কেন? মেয়েটা এই অন্ধকারে কোথায় গেল বলোতো? কোনও মানে হয়?’
তন্ময় আস্বস্ত করে বললো, ‘আহা, কাকিমা কেন চিন্তা করছেন? সঙ্গে নীল আছে। নো টেনশন। আসুন তো আমাদের ঘরে আসুন। স্যারকে ডাকুন।’ বলেই, নিজেই ডাকতে শুরু করে দিলো, ‘স্যার.. স্যার। প্লিজ বাইরে আসুন। কী একলা ঘরের মধ্যে বসে আছেন। আসুন আমাদের ঘরে। কাকিমাকে নিয়ে গেলাম।’
তন্ময় মিসেস রায়কে নিয়ে তাদের ঘরে এলো। দীপেন, ব্রজেশ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘এই তো কাকিমা আসুন আসুন। জমিয়ে গল্প করা যাক।’
ইতিমধ্যে প্রফেসরও এসে পরলেন। ওরা তালি দিয়ে হৈহৈ করে উঠলো।
এইবারে আসর জমবে। প্রফেসর বললেন, ‘না না, শুধু মুখে আসর জমে না। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা যায়, সঙ্গে একটু কফি?’
ব্রজেশ সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘এটা কোনও কথা হলো স্যার। এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।’
মিসেস রায় অবাক হয়ে বললেন, ‘এখানে এই জঙ্গলে কীভাবে কী ব্যবস্থা করবে!’
ব্রজেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘দেখুন তো কীভাবে কী করি।’ বলেই হুস করে বেরিয়ে গেল। ভাবখানা এমন, যেন নিউমার্কেট। চাইলে বাঘের দুধও মিলবে।
মিসেস রায় হতাশ গলায় বললেন, ‘দ্যাখো দেখি ছেলের কান্ড..’
প্রফেসর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আহা, তুমি ওমন করছো কেন? ওরা একটু আনন্দ ক’রে যা করে করুক।’
কিন্তু মা’য়ের মন। সদাই খিচখিচ করে। বললেন, ‘নীল আর মানালিটা থাকলে ভালো হতো। কেন যে হঠাৎ বাইরে গেল! কী জানি বাবা, বুঝি না।’
তারপরেই জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এ কি, জানালা খোলো নি কেন? খুলে দাও ওটা। বাইরের হাওয়া বাতাস আসুক।’
দীপেন ঝটপট জানালা খুলে দিলো। নির্মল ঠান্ডা হাওয়ায় ঘর ভরে উঠলো।
ঠিক তখনই ব্রজেশ হৈহৈ করে ফিরে এসে বললো, ‘আসছে.. হাতে গরম চিকেন চাউমিন, আর কফি।’
প্রফেসর আনন্দ মেশানো অবাক গলায় বললেন, ‘সেকি! পেলে কোথায়? এখানে এইসবের দোকান আছে নাকি, আশ্চর্য!’
ব্রজেশ ভ্রু নাচিয়ে বললো, ‘আছে স্যার, সব আছে। এই বাড়ির নিচের তলায় দুটো দোকান আছে। একটা মুদিখানা, আর একটা ছোট্ট রেষ্টুরেন্ট।’
প্রফেসর প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, ‘রেষ্টুরেন্ট?’
ব্রজেশ খানিকটা ভুল শুধরে নেবার মতো করে বললো, ‘না মানে, অর্ডার দিলে বানিয়ে দেয় আর কি। তাই রাতের খাবারের কথাও একেবারে বলে এলাম। চিকেন কারী আর রুটি।’
মিসেস রায় একটু কুন্ঠিত ভাবে বললেন, ‘আমাদের জন্যেও তাহলে..’
ব্রজেশ আস্বস্ত করে বললো, ‘বলে দিয়েছি। সকলের একই মেনু। যদিও আপনাদের জিজ্ঞেস না করেই..’
প্রফেসর ব্রজেশের পিঠে স্নেহের চাপড় মেরে বললেন, ‘ওয়েল ডান মাই বয়। মেনি মেনি থ্যাংকস টু অল অফ ইউ। তোমরা সঙ্গে না থাকলে যে কী হাল হতো, তা বেশ হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। কী বলো মিসেস রায়। ভুল বলেছি?’
মিসেস রায় সলজ্জ ভঙ্গিতে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। একশোবার। ছেলেগুলোর তুলনা হয় না। অন্তত আজকের যুগে।’
প্রফেসর একটু বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘থামো তো। এমন একটা সুন্দর পরিবেশে, অকারণ যুগ যুগান্তরের কথা ভালো লাগে। এখন এখানে যে কদিন বেড়ানো চলবে, চুটিয়ে আনন্দ করো। টিভি, খবরের কাগজ একদম বন্ধ। খালি দূর্নীতি, ধান্দাবাজী, জঘন্য পলিটিক্স ওফ্ফ, অসহ্য। সেসব থেকে এক্কেবারে শতহস্ত দূর।
তখনই একটি ছোট ছেলে। চাউমিনের প্যাকেটগুলো নিয়ে এলো।
ব্রজেশ সেগুলো টেবিলে রাখতে বলে আরও গোটাকয়েক মোমবাতি নিয়ে আসার জন্য বললো। ছেলেটা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
নাও, সবাই গরম গরম খেয়ে নাও। দ্যাখো আবার কেমন বানিয়েছে। মিসেস রায় সকলের হাতে একটা করে প্যাকেট তুলে দিলেন।
ঘরে হোক কিংবা বাইরে। খাবারের তদারকি করা থেকে পরিবেশন করার অলিখিত দায়িত্ব মেয়েদের হাতেই থাকে। সেটা শুধুই মানানসই নয়, খাদ্যের স্বাদও যেন বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়।
দেবী অন্নপূর্ণার কাছে, দেবাদিদেবকেও হাত পেতে দাঁড়াতে হয়।
ছেলে মেয়ে দু’টোর জন্যে, থাক.. যখন আসবে খাবে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। ভালো লাগবে খেতে তখন?
এই হলো মায়ের মন। খেয়ে নয়। সকলকে খাইয়ে তৃপ্তি। সকলের ভালো লাগাই তার ভালো লাগা। তার অপরিসীম আনন্দ বোধ। এখানেই সে জয়ী। অপরাজেয়। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। হে মাতৃরূপা প্রকৃতি, তোমাকে শতকোটি প্রণাম।খাওয়া পর্ব শেষ। এখন কফি পর্ব চলছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে তন্ময় খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, -‘আরিব্বাস কী দারুণ রে। এদিকে এতক্ষণ চোখ যায়নি কেন রে? এই দীপেন, ব্রজেশ এদিকে আয় একবার তাকিয়ে দ্যাখ। ফাটাফাটি।’
দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঢাকা সাদা চূড়ায় চাঁদের আলো লুটোপুটি খেলছে। রুপোর মুকুটে সেজে উঠেছে পর্বত রাণী।
প্রফেসর বিভোর হয়ে উদাস কন্ঠে বললেন,
‘অপূর্ব..অনির্বচনীয়.. সুন্দর।’
দীপেন মোহিত হয়ে, হঠাৎ উদাত্ত গলায় গান ধরলো,
“আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও,
আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধূলার ঢাকা..
ধুইয়ে দাওও..”
সেই গানে সকলেই গলা মিলিয়ে দিলো। তৈরি হলো সত্যিই এক স্বর্গের পরিবেশ।
বিদ্বেষ বিহীন শান্তিময় এমন স্বর্গীয় পৃথিবীতে অনন্ত কাল বেঁচে থাকা যায়।কিন্তু অশান্তি পিছু ছাড়ে না। ছেলে মেয়ে দু’টো এখনো ফিরলো না। দুজনেই মোবাইল ফোন লজে ফেলে গেছে। যোগাযোগ অসম্ভব।
চলবে…..
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ (প্রথম ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব-১
এখন মধ্যরাত। গ্যাংটকের `নীলচে সুখ’ রিসর্টের বাগান ঘেরা সবুজ ঘাসে ঢাকা লনের চেয়ারে বসে শরতের মেঘমুক্ত নীলাকাশ দেখছিল নীল।
তারাগুলো যেন একটু বড়ো লাগছে, এখান থেকে। হালকা হালকা ঠান্ডা।
দূরের পাহাড়গুলোর গাঢ় অন্ধকার কালো গায়ে দীপাবলির মতো ঝিকমিক করছে মন উদাস করা সুন্দরী আলোক সজ্জা।
অনেকটাই হুইস্কি খেয়েছে নীল। অনেকদিন পরে মদ খেলো নীল। কেন কে জানে হঠাৎই ইচ্ছে করলো।
সঙ্গে স্ত্রী রুমা, ছ’বছরের পাপুকে নিয়ে এখন ঘরে ঘুমে অচেতন। গাংটকে আসার পরিকল্পনা বা ইচ্ছে রুমারই। নীল বাধা দেয়নি। তবে এখানে আসতে নীলের মন চায় না। ভয় করে। স্মৃতি উসকে ওঠে। মানালি।মানালিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। নীলের মনে, মগজে, শরীরের প্রতিটি রোমকূপে সে আছে একাকার হয়ে। ওই দূরে মায়াবী অকাল দীপাবলির মতো। ধরা ছোঁয়ার বাইরে, আশ্চর্য আকর্ষণে মোহিত করে। মানালি।
এখানেই প্রথম দেখা। গ্যাংটক।
নীল তখন বি.এস.সি. ফাইনাল ইয়ার। সদ্য পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওরা চার বন্ধু প্ল্যান করলো কাছাকাছি কোথাও কয়েকদিনের জন্যে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। অনেক ঘেঁটেঘুঁটে পরীক্ষানিরীক্ষা তর্কাতর্কি শেষে সাব্যস্ত হলো গ্যাংটক। পাহাড় নদী ঝর্ণা, মানে এককথায়, কম বাজেটে স্বর্গের শোভা দর্শন। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে বাসে গ্যাংটক। এই রকমই ঠিক ছিল, কিন্তু জলপাইগুড়ি এসেই আচমকা প্ল্যানটা বদলে গেল।
বাসস্ট্যান্ডে, একজন প্রায় মধ্য বয়সী ভদ্রলোক সামনে এসে বললেন-‘ভাই, আপনারা কী গ্যাংটক যাবেন?’
পোশাক পরিচ্ছদ বা উচ্চারণ শুনে বোঝাই যাচ্ছিল, ইনি গাড়ির বা কোনও হোটেলের দালাল নন। দালালদের স্বার্থপর হিসেবি চোখ আর চোয়াল, দেখলেই বোঝা যায়। দালাল। দালালি, এক অদ্ভুত জীবন জীবিকার পোশাকি নাম।
দীপেন সবসময়ই খুব সাবধানী। সে ভদ্রলোকের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘কেন বলুন তো?’
ভদ্রলোক বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন,
‘মানে, আমরা ঐখানেই যাচ্ছি কিনা..’
দীপেন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনারা যাচ্ছেন যান, আমাদের যাওয়া..’
ভদ্রলোক হাত তুলে দীপেনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আহা, কী মুশকিল, আমার কথাটা আগে একটু দয়া করে শুনুন।’
ব্রজেশ চোখের ইশারায় দীপেনকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললো,’ না না, ঠিক আছে, বলুন কী বলবেন?’
ভদ্রলোক তার কথা শুরু করার মাঝেই তার পিছনে আরও দুজন এসে দাঁড়াল। একজন ভদ্রমহিলা, প্রায় ঐ ভদ্রলোকের মতই হবেন বয়সে। আর একটি কিশোরী বলা যায়! নাকি যুবতী? যে কিনা এদেরই বয়সী।
তিনজনকে একত্রে এক্কেবারে অন্যরকম লাগছে। বেশ একটা সুখী পরিবার যেমন হয়ে থাকে আর কি, তেমনই।
এবার ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি বলছি।
ব্যাপারটা হলো, আপনারা যদি গ্যাংটক যান তাহলে আমরা শেয়ারিং করে একটা গাড়ি ভাড়া করতে পারি। আপনারা চারজন, আমরা তিনজন। টাকাও কম লাগবে আর যাওয়াও নির্বিঘ্নে হবে। নইলে বাসের জার্নি, জানেনই তো। তাছাড়া সময়ও একটা ফ্যাক্টর। বাসে অনেক সময় নেবে। এবার আপনারা ভেবে দেখুন। অবিশ্যি, আপনাদের আপত্তি থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আপনারা ইয়াং ম্যান।বাঙালি। সঙ্গে থাকলে, যতই হোক বিদেশ বিভুঁইয়ে, একটু বাড়তি সাহস যোগায়।
দেখুন ভেবে। তবে, আমাদের কিন্তু গাড়ি নিতেই হবে, কেননা আমার এই মেয়ে, বেশিক্ষণ বাসে চাপতে পারে না। বমি করে।’
কিশোরী লজ্জা পেলো শুধু নয়, একটু অপ্রসন্ন অপ্রস্তুত হয়ে মায়ের কনুইতে সকলের নজর এড়িয়ে একটা মৃদু চিমটি কেটে দিলো। মুখে বললো, ‘মা, যা করবার তাড়াতাড়ি করো। এই রোদ্দুরে আর ভালো লাগছে না।’
কেউ লক্ষ্যই করেনি, নীল এতক্ষণ ওই মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে ছিল।
হালকা চাপা গায়ের রঙের সাথে মানানসই চাঁপাফুল রঙের শালওয়ার আর সাদা কামিজ। হালকা ঢেউ খেলানো এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল। সারারাতের ট্রেন জার্নির ধকলে কৃত্রিম সাজ মুছে যাওয়া মুখ, যেন ওকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে।
কম বয়স, সবসময়ই সুন্দরতার আধার। স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে তা আরও বিশেষ করে দাবী রাখে নিশ্চয়ই। এ প্রকৃতির খেলা।
নীলের মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠলো, না না, ওর কোনও কষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সেটা হবে চরম অমানবিকতা।
এমন মনে হবার কারণ জিজ্ঞেস করা নিতান্তই নিরর্থক। কেন না, ভালোলাগা কখন কীভাবে কোথা দিয়ে লখিন্দরের লৌহ কক্ষের ফাঁক খুঁজে ঢুকে পড়ে তা বোধকরি ঈশ্বরেরও অজানা।
‘ঠিক আছে, চলুন। একসঙ্গেই যাওয়া যাক।’ বলেই সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চল, যাওয়া নিয়ে কথা। অসুবিধের কী আছে। এ বরং ভালোই হলো, কী বলিস?’
বাকিদের মুখে কোনও কথা নেই। কেবল চোখে কিঞ্চিৎ অবাক চিহ্ন প্রকাশ পেলো।পর্ব-২
পাহাড়ি পথে গাড়ি ছুটে চলেছে। পাকাপোক্ত ড্রাইভার। এই রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি তার নখদর্পণে। তবুও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই নিরাপদে গাড়ি চালানোর নিয়ম এই পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথে। ডানদিকে খাড়াই পাহাড়। বামদিকে বিপদজনক খাদ। সামান্য একটু ভুলে, অনেক বড়ো মাশুল দিতে হতে পারে।
চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলা। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই তো এখানে আসা।
ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচার সাময়িক বন্ধন মুক্তি। ছুটি। কবির সেই লাইনটা মনে পড়ছে।
কাজের একপিঠে যেমন কেবলই ছোটা আর এক পিঠে তেমন কেবলই ছুটি।
পাহাড়ি ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা কান্না আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া, আর কোনও শব্দ নেই। এমন পরিবেশে চুপ করে প্রকৃতির নির্বাক মৌনতায় মজে থাকতেই মন চায়।
কথা নয়, কথা নয়। এসো নিঃশব্দতায় যাপন করি, যেটুকু আছে সময়।
এটা নীলের লেখা কবিতার লাইন। নীল বেশ ভালো কবিতা লেখে। ফেসবুক বন্ধুরা তো ওর নামের সঙ্গে ‘কবি’ পদবী জুড়ে দিয়েছে। নীলের হাসি পায়। তবে বাধা দেয়না। বুঝে নিয়েছে, ওটা অভ্যাস বশতঃ উচ্চারিত কথা। গুরুত্ব দেওয়া বৃথা।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনারা কী হোটেল বুকিং করে এসেছেন?’
তন্ময় বললো, ‘না না। খুঁজেখাঁজে একটা সস্তার হোটেল দেখে নেবো। আমাদের যাহোক একটা মাথা গোঁজার জায়গা হলেই চলে যাবে।’
ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বললেন, ‘তা ঠিক। তোমরা ছেলেছোকড়ার দল। তোমাদের আর অসুবিধে কীসের।’ তারপরেই হঠাৎ কুন্ঠিত গলায় বললেন, ‘তোমাদের তুমি বলে ফেললাম, কিছু মনে করলে?’
অসীম বললো, ‘না না কাকীমা। একদমই না। আমরা তো আপনার ছেলেরই মতো।’
-‘আমার ছেলে নেই, এই একটিই মেয়ে। এই বেড়াতে আসার দু’টো কারণ। এক তো আমার মেয়ের বায়না। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। বেড়াতে যাবো। তাই বেড়িয়ে পরা।
দ্বিতীয় কারণটা তুমিই বলো না..’কর্তার উদ্দেশ্যে বললেন কথা গুলো।
-‘হ্যাঁ, ঠিকই। সেটাও একটা কারণ নিশ্চয়। ব্যাপার হচ্ছে আমার এক বন্ধু এই বছরখানেক আগে আপার গ্যাংটকে একটা রিসর্ট লিজ নিয়েছে। প্রায়ই আসতে বলে। নানান কারণে হয়ে ওঠেনি। এই ফাঁকে সেটাও সেরে নেওয়া হবে। ওই জায়গাটা নাকি বেশ নিরিবিলি। মানে, ঘিঞ্জি নয়।
বেড়াতে এসে ঘিঞ্জি চ্যাঁচামেচি ভীড়, একদম ভালো লাগে না। তোমরা কী বলো? বেড়ানো মানে তো শুধু মনের আরাম নয়। চোখ কান নাকের আরামও তো চাই নাকি? বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন।’ ভদ্রমহিলা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘ওফফ, এখানেও তোমার মাষ্টারি শুরু করলে?’
বোঝা গেল ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন।
তিনি হাসি থামিয়ে হালকা গলায় বললেন,
‘ওহ্, আই এম স্যরি। ‘
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তোমরাও ইচ্ছে করলে সেখানেই উঠতে পারো।’
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। তোমাদের বাজেটের মধ্যেই হবে। সেটুকু অবশ্যই বলতে পারি। তবুও তোমরা ভেবে দ্যাখো।’
গাড়ি একটা খাবারের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভারের পরিচিত হোটেল। এখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে হবে।
গ্যাংটক পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যাবে।খেতে খেতে খুব বেশি কথাবার্তা হলো না ওদের মধ্যে। শুধুমাত্র এইটুকু জানা গেল। মেয়েটির নাম মানালি। বি.এস.সি. ফাইনাল ইয়ার। পরীক্ষা শেষ। এখন এরা আপাতত একই পথের যাত্রী।
পর্ব-৩
তখন বেলা গড়িয়েছে। মেঘলা আকাশ। এখানে যখন তখন বৃষ্টি নামে। অচেনা ভিনদেশী হাওয়ায় পাহাড়ের সোঁদাগন্ধ। দিন রাতের বালাই নেই, ঝিঁঝি পোকার অন্তহীন ক্রদন অব্যাহত। মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রা। একটা যাদুকরী প্রশান্তি ছড়িয়ে মনকে মাতাল করে তুলছে। চড়াই উৎরাই, পাহাড়ের ইইউ টার্ন । ভয়াবহ অথচ অপরূপা সৌন্দর্যের রাণীকে মনপ্রাণ ভরে দেখতে দেখতে চলে এলো গ্যাংটক।
গাড়ি থামলো সেই রিসর্টের সামনে। সুন্দর নিখুঁত একটি ডাকবাংলো। দুধসাদা রঙের বাড়ি। চারপাশ নানান রঙের ফুল দিয়ে সাজানো বাগান। সবুজ লন। বিরাট ছাতার নিচে পালিশকরা কাঠের চেয়ার টেবিল সাজানো। কারুকাজ করা বিশাল রেলিং গেট। ড্রাইভার গাড়ির হর্ন বাজাতেই ছুটে এলো একজন। দরজা খুলে গেল। বাংলোর মাথায় বিরাট গ্লোসাইনবোর্ড। তাতে নীল রঙের মোটা অক্ষরে লেখা ‘নীলচে সুখ’।ওদের একটা ফোর বেডের রুম। বেশ বড়ো এবং সাজানো। ওরা ব্যাগ খুলে সঙ্গে আনা জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।
তন্ময় বললো,’নীলচে সুখ। হায় হায়। এ সুখ টিঁকলে হয়!
দীপেন বললো, যা বলেছিস। লম্বা একখানা বিল ধরিয়ে দিলেই চিত্তির। বাজেট, জেড প্লেন হয়ে উড়ে যাবে। নীলচে সুখ, হুঁ.. হ্যাঁ রে নীল, সুখের কী কোনও রঙ হয়। নীলচে, লালচে?
নীল বললো, ‘হয় বৈকি। সুখ কী একরকম? নানান সুখের নানান রঙ। কারোর পেয়ে সুখ, কারোর পাইয়ে দিয়ে সুখ।’
তন্ময় বললো, ‘ও, তাই বুঝি। তাহলে হারিয়ে সুখ? তার কী রঙ ভাই, কালচে?’
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো। নীল হাসতে হাসতে বললো, ‘না রে ভাই, কালচের ওপর দুঃখের একচেটিয়া অধিকার। সেখানে সুখের প্রবেশ নিষেধ।আজ বিশ্রাম। কাল সকালে লাচুন লাচেন যাওয়া। সিকিমের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে এই দু’টি নাম সবার আগে। সকাল সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে বেরুতে হবে। তাছাড়া শরীর বেশ ক্লান্ত। রাতের খাবার খেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পরার তোড়জোর করছে। এমন সময় দরজায় টোকা।
তন্ময় দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে প্রফেসর প্রকাশ রায়। ওরা ঠিক পাশের রুমেই আছেন।
-‘আসতে পারি? মানে, একটু কথা ছিল,’
তন্ময় বললো, ‘নিশ্চয়, আসুন স্যার।’
প্রফেসর রায় কোনও অকারণ ভনিতা না ক’রে বললেন, ‘তোমাদের কালকের প্রোগ্রাম কিছু ঠিক করেছো?’
তন্ময় বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, আমরা কালকে লাচেন লাচুন যাবো ঠিক করেছি।’
স্যারের মুখ যেন খুশিতে ঝকমক করে উঠলো, বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল। কিন্তু তার জন্য তো গাড়ি দরকার। আগেই বুকিং করতে হয়। তক্ষুনি পাওয়া খুবই মুশকিল। দু’রাত তিনদিনের ব্যাপার। ওরা চুক্তিতে যায়। তোমরা তেমন কিছু ব্যবস্থা করেছো কী? শুধু তাই নয়, ওগুলো তো একেবারে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। তাই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এরা, এই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নেয়। তাই বলছিলাম, সেইসব ব্যবস্থা করেছো কী?’
কথাগুলো শুনে ওদের এক্সপ্রেশন একেবারে হাঁদারাম মার্কা হয়ে গেল।
দীপেন হতাশ গলায় বললো, ‘সর্বনাশ। আমরা তো এসব কিছুই জানিনা। কোনও ব্যবস্থাই করিনি। আমরা তো ভেবেছিলাম, একটা গাড়ি ধরবো, চলে যাবো। কিন্তু আপনি যা শোনালেন স্যার, এরপরে তো, কিরে কী করবি?’
তন্ময় বললো, ‘কী আর করা যায়। প্রোগ্রাম ক্যানশেল।’
সবাই হতাশ হয়ে বিছানায় ধপধপ করে বসে পরলো।
প্রফেসর রায় ওদের সকলের মুখগুলো দেখে নিয়ে বললেন, ‘এতো আপসেট হবার কিছু নেই। উপায় আছে। যদি তোমরা রাজি থাকো।’
নীল ঘরের বন্ধ জানালাটা খুলে দিতে দিতে বললো, ‘আপনারা কাল ঐ দিকেই যাচ্ছেন তো?’
এইবারে প্রফেসর চেয়ারে বসলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। বললেন, ‘আমি ব্যাপারটা কোলকাতা থেকেই সেরে এসেছি। ওখানে এজেন্ট আছে কিনা। আমার খুবই পরিচিত। আমি তিন জনের জন্য বুকিং করেছি। এখন তোমরা যদি বলো, তাহলে এখনই ওকে ফোন করে, চারটে সিট বাড়িয়ে নিতে পারি।’
তন্ময় অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘এখন কী আর হবে?’
প্রফেসর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘আরে বাবা সে দায়িত্ব আমার। আগে তোমরা বলো রাজি কিনা?’
নীল খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ রেখে বললো, ‘রাজি, আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার। ওখানে যাবো বলেই এখানে আসা। কোনও কিন্তু নেই। আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার, প্লিজ।’
প্রফেসর বিনয়ের সাথে বললেন, ‘না না, ওভাবে বলোনা প্লিজ। তোমাদের ভালো লেগেছে বলেই না, তাছাড়া মাঝরাস্তা থেকে একসঙ্গে এলাম, একই জায়গায় আছি, একসাথে সবাই বেড়াতে যাবো, এ তো মহা আনন্দের কথা, তাই না?’ প্রফেসর চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘ওকে, তাহলে এই কথাই রইলো। কাল ভোর পাঁচটায় ডেকে দেবো। ঠিক সাতটায় গাড়ি আসবে। গুডনাইট অল অফ ইউ।’
তন্ময়, দরজা বন্ধ করতে করতে বললো,
‘থ্যাংকস স্যার। গুডনাইট।’
দীপেন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বললো,
এখন আর কোনও কথা নয়। প্রবলেম সলভড। কাল ভোর পাঁচটায় ওঠা। গুডনাইট।’
ব্রজেশ এতক্ষণ শ্রোতার ভুমিকায় ছিল। এখন শোবার সময় গায়ে কম্বল টেনে নিতে নিতে হালকা স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘নীলচে সুখ।’
এই ছোট্ট একটি কথায় কেউ মুচকি হাসলো কিনা অন্ধকার ঘরে তা টের পাওয়া গেল না।চলবে……………..