-
কবিতা- নিম্নবিত্ত
নিম্নবিত্ত
-অমল দাস
আমার হৃদয় একরে তোর অবিচ্ছেদ্য দখলদারি।
নিরুপায় নির্লিপ্ত আমি…
উচ্ছেদে উৎখাতে ব্যর্থ।
তবে কি! আদালতের দ্বারস্থ হবো?
জানি না! কেউ এসে জানান দেয় না..
আমার রক্ত এ প্রখর গ্রীষ্মেও ঠাণ্ডা,
আমার অস্তিত্বের বাজার চলছে মন্দা।
আমি যে নিম্নবিত্ত।
যুগ যুগ ধরে চলা শুনানির সর্ব শেষ প্রান্তে
আমি একা… তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত নিরুপায়
জানিনা কত দিনে এ নিঃশেষিত লাইন এসে থামবে
তখনো কি এ শ্বাস স্বমহিমায় চলবে…
না কি আত্মহাহাকার স্তব্ধ হয়ে-
আকাশ বাতাসে মিশে যাবে অসহায়?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে দেখব শেষ বেলা যায়
আমি যে নিম্নবিত্ত।
আমার অস্থি আর ধমনীতে তোর স্বৈরাচারী প্রভুত্ব
এ কি বংশানুক্রমিক রাজত্ব যার পতন নেই
তাজের নিদর্শন অক্ষয় থাকবে চিরকাল?
শহিদ মিনার কি ঝুঁকবে না!
হাওড়ার ব্রিজ কি ভেঙে পড়বে না!
যদি এ সত্যের জয় হয়! আমিও কি জয়ী হবো?
তোর অধিগত চিত্তজ্ঞান ফিরে পাবো?
আমি যে নিম্নবিত্ত!
-
ফরমান
ফরমান
-অমল দাস
তোরা জ্বালবি আগুন জ্বালনা দেখি, আপন ঘর গৃহস্থ জ্বাল;
অন্যেরটায় প্রমোদ করিস!নিজের লঙ্কায় দেখতো কেমন ঝাল।
নীল বিষাক্ত করলি সমাজ, এথা রক্তবীজের বহুত সম্মান;
তোরা বিরোধ কথা শুনতে নারি, দেখাস ঔদ্ধত্যের ফরমান।
রক্ত চক্ষু করনা যত পারিস! ফেল না ফেলবি কত লাশ;
পাছা একদিন পড়বে নালায়, পচবি আর ফুটবে সেথা ঘাস।
ওরে খয়রাতি আর ভিক্ষাবৃত্তে তোরা বেজায় কিনলি নাম,
আসলে পিছদুয়ারে ভরলি ঝোলা, আমরা মিটাচ্ছি যার দাম।
একি এক মগের মুলুক!সব পোশাকে তোদের ইচ্ছে মত রঙ,
আমাদের কৃষ্টিরা সব কৃচ্ছ্রসাধনে কক্টেল পাত্রে ঝুলছে বং।
শত্রুর মৃত্যু শোকে তোদের বুক ফেটে আসে আত্মহাহাকার;
যে প্রাণটা যায় তোদের নলে, ঢেকে দিস তার সর্ব সমাচার।
তোরা শিল্পী সবাই তবু শিল্প নেই, আছে উন নয়নে ভাঁওতা;
তোদের আগ্রহতে কুর্সি আর সময় বুঝে কোষাগারে মৌতা(ত)।
হয়তো পাঁচ বা আর এক দশক এ জমিতে আহ্লাদে কর চাষ
চষতে চুষতে মৃত্যু হবে! এখানেই বাড়বে ঘাটে নেওয়ার বাঁশ।
-
নির্লিপ্ত তট
নির্লিপ্ত তট
-অমল দাস
কলকল নদী আনন্দ লহরে উচ্ছ্বল উৎস-মোহনায়
অবহেলায় কাঁদে তট সুদীর্ঘ পথ সীমাহীন নির্লিপ্ততায়।
অপেক্ষার তপ্ত তাওয়ায় চরাচর পূর্ণ বিভাজ্য
পতনের ক্লান্তি আঁকে বুকে তটভূমি সাম্রাজ্য।
প্রহর গোনে একদিন স্তিমিত হবে ভাঙনের এই বেলা!
চাঁদের জঠর থেকে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়া খেলা
শিশির ভেজা গুল্মলতায় অট্টহাসি গোপন আঁতাতে,
প্লাবনে ডুবে শ্বাস জব্দ, তবু নেই শেষ-মরণ হাতে।
জেগে ওঠে! ক্ষয়ে যায় অহরহ, রুগ্ন অবসাদে-
বুভুক্ষু স্রোতের তৃপ্ত ভোজনের সামগ্রী নির্বিবাদে।
জলোগ্রাসে বাড়ন্ত চর- একদিন গতি হবে স্তব্ধ;
নদীও মুছবে শেষ ক্লান্তি অশ্রু- তটের সুখ উপলব্ধ।
-
বৃষ্টি তুমি ঝরো আমাতে..
বৃষ্টি তুমি ঝরো আমাতে..
-অমল দাস
গ্রীষ্মের প্রখর দহন চলিছে-
মম গহীন অন্তরে,
বৃক্ষছায় খুঁজে ফিরি রোজ-
সমাজ চলছে যন্তরে।
উত্তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত;
শিরায় তৃষ্ণা আগুন,
এখন কাল বৈশাখীর মাস;
বিরহে বিতাড়িত ফাগুন।
ত্বকের জ্বলন লু প্রবাহে;
প্রোটিন অভাবে ধুঁকছে,
ধূলিঝড় এসে ঢেকে দিয়ে যায়
নবীন সমাধি কে রুখছে……?
সৌর ত্রাস গিলে নিতে চায়;
শ্রান্তির দুপুর বেলা,
ঘামাচির এখন বড়ই সুখ;
রক্ত ক্ষরণের পালা।
ইতিহাসে নেই ঋতু খুঁজি না;
সবেতেই চৈত্র মাস,
বৃষ্টি তুমি ঝরো আমাতে..
রুখে দাও সবুজের বিনাশ।
-
বিলম্বিত লয়
বিলম্বিত লয়
-অমল দাস
নিলাদ্রি তরুণ প্রজন্মের নবীন সাহিত্যক। সাহিত্য রসনায় ও কাব্যিক চর্চায় বর্তমান কালে তার বিশেষ নাম ডাক হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ ইতিমধ্যে তার কয়েকটি কাব্য এবং গল্প গ্রন্থ প্রাকশিত হয়েছে যার ছয়শ-র অধিক পুস্তক পাঠক মহলে বিস্তার লাভ করেছে, এটা একজন সদ্যোজাত কবি সাহিত্যিকের মনোমুগ্ধকর উপলব্ধিও বটে এবং আগামীতেও তা জারি থাকবে এমনই আভাসপূর্ণ মনোবাঞ্ছা।
নিলাদ্রি বিবাহ করেনি, একক ভাবে জীবন অতিবাহিত করছে। বৈবাহিক সুখের লিপ্সা যে তার মধ্যে নেই বলা যাবে না, তা অন্তরে উষ্ণ জলের ন্যায় টগবগ করে ফুটতে থাকে একান্তে। বহু ললনা অন্তরের খড়কুটায় দেশলাই কাঠি মারলেও তা তড়িতে নিবারণ করে সংযত রয়েছে, তার একটাই কারণ উপার্জনের কোন হদিশ জোটাতে পারেনি সে বিশেষ ভাবে। চাকুরীর চেষ্টা করতে করতে ইদানীং বয়স কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছে, বা বেড়ে গেছে। এটা তো গামছায় বেঁধে রাখবার বস্তু নয়। তবু চাকুরী জোটাতে পারেনি। ছাত্রগৃহে শিক্ষকতা বিক্রয় করে, আর লোক সমাজে জীবনবীমা বিক্রয় করে, তার দিবানিশি যাপন হচ্ছে বাবা-মাকে নিয়ে। একাধিক শুভাকাঙ্ক্ষীই তাকে যুক্তি দিয়েছে যে বিবাহ একটা করলেই হবে সংসার আপনিই চলতে লাগবে। অতপর কন্যার যোগান কেউ করল না, সন্ধানও দিলনা। এটা ছাড়াও তার কেবল অহরহ মগজে জ্ঞান বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্ষান্ত হল না! মাঝে মাঝে খোঁটা দিয়ে বলতে লাগল “ওরে আমাদের ছেলে মেয়ের তো ক’দিন পরেই বিয়ে লাগবে! তুই এখনো করলি না! ওতে প্রদীপ কি আর জ্বলবে।” কেউ বললো “হ্যাঁ রে… সাহিত্যে ডুবে থাকলে শুধু হবে, না কি প্রজননের চিন্তাও করতে হবে! ধীর গতি হোক তবু বংশ গতি তো বাড়াতে হবে”। একটু চুপ থেকে কিনা আবার নতুন সংযোজন “হাওয়া চলে না স্রোত? মোমবাতি ধরে দেখব? ধরলেই সব জানা যাবে, এখন কি অবস্থা”? ইত্যাদি ইত্যাদি আশঙ্কা। যেন তারা বিয়ে করে তাদের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে স্বর্গ হতে ফিরিয়ে এনেছে। আর এই গো বেচারা নিজেকেই উদ্ধার করতে পারল না। যুক্তি তর্ক আগান বাগান থেকে এসে ঘুরত কিন্তু সমাধা বা সহযোগিতা মিলত না। কেবল যেখানে যেমন জলের মতন আকার ধারণ করে সবই সামাল দিয়ে আসত।
যারা সদোপদেশ দিয়েছে তাতে দুই ধরনের মর্মার্থ নির্গত হয়েছে বোধের প্রস্রবণ হতে, এক- বিবাহ কেবল বংশ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। দুই- বিবাহ যৌন সুখের ধন্বন্তরি মহৌষধি। কেউ আত্মিক সুখের কথা বললো না। কেউ অন্তরঙ্গ বন্ধু মেলবার কথা বলল না। কেউ সুখে দুঃখে জনম সাথীর কথা বলল না। কেউ স্বামী স্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে সংসারে সুখের স্বর্গ স্থাপন করবার কথা বলল না। কেবল বোঝানো হলো ও বস্তু ইঞ্জিন আর খনির মেলবন্ধন। এ সমস্তই নিলাদ্রি ভাবত কিন্তু কাউকে কিছু বলত না।
বলতে কি সে পারত না! পারত! কিন্তু নিলাদ্রি নিতান্তই ভদ্র তাই মুচকি হেসে চুপ থাকত।অভদ্র গোছের ছোকরা হলে যে ভুলিয়ে-ভাঁওতা দিয়ে এতদিনে একখান বিয়ে সে করতেই পারত তাতে সন্দেহ নেই। কারণ দুই চার জন ললনা তার উপর মেঘ ঘনিয়ে বৃষ্টি হয়ে ভিজাতে চায় নি তা নয়! সে কেবল ভবিষ্যত ভেবে ছাতা খুলে নিরুত্তর নিরাপদ রয়েছে এযাবৎ কাল।
তবে কয়েকদিন পূর্বেই হরিদ্বার বেরাতে গিয়ে ভগবানের কাছে চিন্তা সংকটে পতিত হয়েছিল ভীষণ ভাবে। প্রণাম সেরে সকলেই ভগবানের কাছে দাবী দাওয়া পেশ করে থাকে ইচ্ছা খুশি আদায়ের লক্ষ্যে। এটা কতদূর প্রতিপন্ন হয় জানা নেই, তবুও যেন এদাবী বংশানুক্রমিক এবং ন্যায্য। নিলাদ্রিও এই দাবী হতে বিচ্যুত হতে পারল না। কিন্তু ভাবল কি চাইবে! মাছের বাজার, আলুর দোকান, বইয়ের বাজার লেখার খাতা, বাবা-মা, অনেক ভেবে সে তার নিবেদন শোনাতে লাগল “প্রভু আমাকে একটি সুষ্ঠু সুশীল মননশীল জীবন সঙ্গিনী দিও আর কিছু চাইনা”। অতএব সেও চাহিদা ত্যাগ করে ব্যতিক্রমী হতে পারল না। সেও ঈশ্বরের নিকট লোভ সংবরণ করতে ব্যর্থ। সফল হবে বা কি করে! ইদানীং বিবাহ ধ্বনি যেন তার কানের সাথে দুলের আকারে ঝুলছে এবং মন্দিরের ঘণ্টার ন্যায় ঢংঢং করে বাজছে। এ সমস্ত তারই ফলন।
নবপ্রজন্মের অনান্য লেখকদের মতই নিলাদ্রিও সোশ্যাল মিডিয়ায়র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে তার পুস্তকের বিজ্ঞাপন হয়েছে অধিকতর এবং অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছেও বটে। এক কাপ চায়ে ঠোঁট সিক্ত করে আপন পেন খাতা নিয়ে কাব্য লেখবার আয়োজন করছে। তার আগে ভাবল ফেসবুটা একটু দেখেই নি সমস্ত দিনের আপডেট, তার পরেই লিখব। ফেসবুকে প্রবেশ করতেই তার অতিপরিচিত এক পাঠিকা বান্ধবীর অপরিসীম সুন্দর মুখখানির একটি আলোকচিত্র সামনে এসে থামল। এই চিত্র দেখা মাত্রই নিলাদ্রির অন্তর ভেদ করে শিরা উপশিরা হয়ে প্রেম উত্তেজনার রক্ত সমস্ত শরীরে উদ্দীপনা জাগিয়ে গেল। মনে হতে লাগল সে কি কেবল তার জন্যই! নয়তো খোলা মাত্র সম্মুখেই কেন? তার একক গৃহ নিমেষে বসন্ত কেবিন হয়ে গেল, আকাশে বাতাসে ফুল ঝরতে লাগল। রজনী গন্ধার সুবাস ভাবজগতে আলোড়িত করে তুলল। অন্তরে কেমন এক অবর্ণনীয় উদ্বেগ জাগরিত হলো। যদিও এই উদ্বেগ সুখানুভূতির। এটা যে প্রথম ঘটল সর্বাঙ্গে তা নয়, তবে আজ কিন্তু অন্যরকমই অনুভূতি। এই বান্ধবীটিকে সে অন্তর গহীনে লালল করে চলছে বহুকাল হতেই কিন্তু ঠোঁট ফুটিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে নি। বাক্যালাপ করে থাকে তার সঙ্গে, কেবল বাক্য বিলাপ হয়ে উঠলো না। খোঁজ কিছু নিয়েছে বটে তবে নিজ মনের খোঁজ তাকে দিতে পারে নি।
এই মাধুর্যপূর্ণ চিত্র দেখে হঠাৎ করে তার যেন আজ উমাকে বিশেষ মনে পড়ে গেল। বাস্তবে এই কন্যার সাথে উমার কতটা মিল আছে, বোঝার উপায় নেই। পিছে কোন শরৎ আছে কি জানা নেই। তবে তার রূপ, স্বল্পভাষী ব্যক্তিত্ব এবং বিচক্ষণ বোধ ও কথামৃতে উমাকে স্পর্শ করে যায়। আর যে দিক হতে এর উমার সাথে মিল রয়েছে তা হল বয়স। সেও উমার মতই অধিক বয়স করে নিয়েছে নিজের এবং কুমারী রয়েছে এযাবৎ কাল। যদিও উমা বিবাহিত তবুও কুমারী। আলকচিত্রের কন্যাও বিয়ে করেনি সে বলেছিল এবং এর কারণ নাকি উপযুক্ত ‘শরৎ’ তার লম্বা শক্ত পাটাতনের ন্যায় ললাটে জুটে ওঠেনি, ভাগ্যের কি পরিহাস!
নিলাদ্রি সদ্য গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘কলকাতার কাছে’ এবং ‘উপকণ্ঠে’ উপন্যাস দুটি পাঠ শেষ করেছে। এই গল্পকথাতেই উমার চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় এবং এই চরিত্রের সঙ্গে সে এতটাই আত্মিক গভীরতার বন্ধন সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে যে, আলোকচিত্রের কন্যাকে দেখতেই তার মনে হতে লাগল এই সেই উমা যাকে সে অন্তরে অন্তরে ভালবেসেছে গল্পের পরতে পরতে গিয়ে।
অতএব মনে মনে স্থির করল তার ভাবের উমাকে নিয়ে একখানা কাব্য লিখবে এবং তার বাস্তবের উমাকে উৎসর্গ করবে।
ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে রেখেই সে লিখতে মনোনিবেশ করল-
“আচ্ছা উমা তুমি কি জানো
তোমাকে যখনই আমি দেখি আমার অন্তর জ্বলে যায় প্রেমাগ্নিতে
এ আগুন তুমি কেন জ্বালো বলতে পারো?
কেন আমার রক্তে বসে তুফান তোল সাগর বেশে?
কেনই বা এই মুগ্ধ আনন তুলে ধর মুচকি হেসে…”
লেখার এই ভাবজগতের কাঁচের দেওয়ালটি হঠাৎ ভেঙে গেল মেসেঞ্জারের টুং আওয়াজে, সমস্ত নিঃশব্দতে নিমেষে যেন হুল্লোড় তুলে তাল পাকিয়ে গেল অনায়াসে। সে দেখল ‘একটি তারা’ ম্যাসেজ দিয়েছে। এই ‘একটি তারা’ নিলাদ্রির পরিচিতা একবিংশতির যুবতী পাঠিকা। ইতিপূর্বে কথোপকথন হয়েছে বহুবার।
সে লিখল- কবি! কাউকে পেলেন?
প্রশ্ন দেখে সহজেই অল্পবিস্তর অনুমেয় উপরিভাগে যা আলোচনা হয়েছে এও সেইরূপ। এই তরুণীর গভীর উৎসুক ধরা পড়ল প্রশ্নে- কি পেলেন? বা সে কি পাওয়ার কথা বলছে!
নিলাদ্রি উত্তর লিখলো– পেলেই সবার আগে তোমাকে জানাবো।
-জানতে চাইলাম তাই বললেন! কবে করে ফেলবেন জানবোও না!
-জানবে জানবে ‘লাভলি তারা’ ব্যাকুল হয়ো না।
-আমি যদি কারো সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিই! আগ্রহ করবেন?
-হুম বিষয়টা তো আগ্রহের! বলেই ফেলো।
-শুনুন আপনাকে একজন ভালোবাসে খুব
-সে… কলা গাছকেও মানুষ ভালোবাসে, তাই কি জড়িয়ে ধরে।
-আপনাদের সব কিছুতেই ভাবের কাব্য। আরে মশাই ধরবে-ধরবে, চিন্তা কেন করছেন?
কন্যা একবিংশতির হলেও বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল রেখেই চলছে এবং এই কথা চালাচালিতে আর বুঝতে বাকি রইল না যে এও সেই একই কাসুন্দি ঘাঁটছে।
নিলাদ্রি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল- কে শুনি নামই বা কি ?
- বৃষ্টি ! বৃষ্টি নাম।
- সে কে? আমার তো এই নামে চেনা নেই কেউ!
- আরে মশাই সবাই কি নিজের নামে আছে।
নিলাদ্রি একটু সংকোচে ভেবে বলল -তাহলে কি ?
- ঠিক পথেই যাচ্ছেন!
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে বোধ করি নিলাদ্রির আরও কিছু কথার অপেক্ষা করে নিজেই বলতে লাগল- আমিই বৃষ্টি। আমি আপনাকে ভালোবাসি।
নিলাদ্রি এখন ছত্রিশ, বৃষ্টি একুশ, তার থেকে পনেরো বছরের ছোট অর্থাৎ অসম প্রেম। সে ভাবল এটা ঠিক নয়। এছাড়া বৃষ্টি খুবই আধুনিক সমস্ত দিন কি যে আপডেট দিতে থাকে তাতে সে মাঝে মাঝে উষ্মা প্রকাশ করে বটে, অর্থাৎ অপছন্দে। আবার বয়সের অজুহাত দিয়ে কিছু বললে বৃষ্টি কিনা বলেই বসে “বয়স একটা নাম্বার মাত্র, আসল হল মন”। অন্যদিকে উমাতেও মন কিছুটা এঁটে আছে।
সুতারং সে অনেক ভেবে একটা উত্তর করল- ‘বৃষ্টি, আমি ভালোবাসি, তবে আমার শ্লেষ্মার সমস্যা আছে কিনা! তাই সাড়া জীবন সঙ্গে রেখে গাত্র গাহন করতে পারবনা !বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁপানি হতে পারে এবং মৃত্যু’।
বৃষ্টি দেখল! হয়তো খুব রাগলো, সামনে থাকলে মুখমণ্ডল দেখলেই বোঝা যেত রাগের পারদ কতটা চড়লো, গাল ক্ষোভে ফুলে কতটা টম্যাটোর মত রক্তিম হয়েছিল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে লিখল-“কবি তো! এমনই উদাসীন, কোন জগতে থাকেন কে জানে! ভেবে বললে খুশী হতাম।
নিলাদ্রিও আর সাড়া দিল না, কিন্তু তার বক্তব্যের জন্য লজ্জিত হল পরিচিত এক কন্যার নিকট। কেবল চশমাটা খুলে রেখে, চোখ রগড়িয়ে উপরে দেখল মাথা তুলে।
সেখানে তার সেই হরিদ্বারের ভগবান তখন উপস্থিত। সে একটা ছায়া দেখে চমকাল, কিছু বলতে পারল না, ভাবল নিজেরই ছায়া, বুঝল না তার ছায়া উর্দ্ধমুখী হবার নয়। ভগবান মৃদু হেসে বললেন –তুই একটা মদন, তোর দ্বারা হবেনা…………।
-
চার দেয়ালের গোপন কথা
চার দেয়ালের গোপন কথা
-অমল দাস
কাবেরী একটু সোজাসাপটা মুখের উপরেই কাট্কাট্ কথা বলে দেয়, সামনের জন কি ভাবল তাতে তার পরোয়া নেই। সে নির্ভীক অন্যায়ের সাথে আপস করতে শেখেনি। কলেজের বখাটে ছেলেটি যখন প্রেম নিবেদন করেছিল আর প্রত্যাখ্যাত হয়ে বলেছিল ‘দেখে নেবো!’ সে তাকে এক অমৃতবানী শুনিয়ে এসেছিল- “তুই কি দেখবি! আমি তোকে দেখে নেবো! তোর বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবো। আগে নিজেকে মানুষ তৈরি কর তারপর প্রস্তাব দে!”
এই রণং দেহি ভাব দেখে ছেলেটি আর কোন সাড়া দিতে পারেনি, চুপচাপ চলে গিয়েছিল সেদিন।
দুই বোন, বড় বোন রিমার বিয়ে হয়ে গেছে। কাবেরী ছোট থেকেই খুব চঞ্চল দুরন্ত। গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো, খেলাধুলা এমনকি শরীর চর্চায়ও যথেষ্ট পটু। পড়াশুনাতেও সে পিছিয়ে নেই বছর দুই আগে বাংলায় মাস্টার্স পাস করেছে। চাকরীর চেষ্টা করছে চূড়ান্ত সফল হয়নি এখনো। চব্বিশ পরগনার চম্পাহাটিতে বাড়ি। বাবা মহাদেব জোয়ারদার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আর্থিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল।
গত কয়েক দিন ধরে জোয়ারদার পরিবারে ছোট মেয়ের জন্য পাত্র দেখার ব্যবস্থা চলছে। মেয়ের এক প্রতিজ্ঞায় বড্ড চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল জোয়ারদার দম্পতির। কারণ বাবা মহাদেব জোয়ারদারকে পূর্বেই ফরমান জারি করে রেখেছে- “কোন পুরুষকে পণ আর উপঢৌকন দিয়ে যদি আমার বিয়ের বন্দোবস্ত করো তবে কিন্তু সে বিয়েতে আমি নেই। বরং সেই টাকা পয়সা আমায় দিয়ে দিও আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেবো। আর যাকে ভালো লাগবে তাকে বিয়ে করে ঘরে আনব।”
হ্যাঁ আনবে, পাত্র যদি বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে যেতে পারে তবে পাত্রী কাউকে বিয়ে করলে তাকেও ঘরে নিয়ে আসবে এমনই তার চিন্তাধারা। মহাদেব দম্পতি জানে ছোট মেয়ে কাবেরী যদি জেদ ধরে তবে তার কাছে নত হওয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। তাই অতি সাবধানী হয়ে পাত্র নির্বাচন করতে থাকে।
অবশেষে এক পাত্র নির্বাচন করা হল, গড়িয়াহাটে বাড়ি, সরকারী চাকুরীজীবী, নাম অনিমেষ পুরকায়স্থ, বয়স বছর বত্রিশ হবে। দেনাপাওনার কোন আব্দার নেই, মেয়ের বাবা যা ব্যবস্থা করবেন তাতেই রাজী। সেই মত মহাদেব বাবু খাট, বিছানা, আলমারি মেয়ের হাতে, কানে, গলায় স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এতেও কন্যা বেঁকে বসেছে। বাবা কেন নিজে থেকে এত কিছু দেওয়ার কথা বলে এসেছে। পাত্র কিছুই চায়নি সেটাও সে ভালো নজরে দেখছে না। যদি বিয়ের পর অযথা দাবী দাওয়া করে বসে। যদি শ্বশুর শাশুড়ি সবাই মিলে অত্যাচার করে! তাই সে আগে থেকেই একটু সাবধানী। পরিবারের সকলে মিলে কাবেরীকে আশ্বাস দেয় তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছে পাত্র ভালো সে যেন মিছিমিছি চিন্তা না করে। সেই মত সে বিয়েতে রাজী হয়।
বিয়ের দিন লোকজন আত্মীয় স্বজন উপস্থিত বেশ ভালোই সমস্ত কিছু চলছিল অগ্নিসাক্ষী রেখে সাতপাকের সময় কাবেরী বেঁকে বসে। তার দাবী সাত ফেরে নেওয়ার সময় পাত্র তার পিছনে ঘুরবে । বাড়ির সবাই বোঝানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি । সে ছাড়বার পাত্রী নয়, সব পাত্র পক্ষের মত হবে না কিছু তার মতও হবে । তার কথা “নিয়মটা তো ওভাবেই চলছে একটু এভাবে দেখা যাক না কেমন হয় । পাত্রের দেওয়া সিঁদুর নিয়ে যেমন আমি দায়বদ্ধ তেমনি পাত্রও আমার আঁচল ধরে ঘুরে দায়বদ্ধ হোক।”
পাত্র পক্ষের সবাই পাত্রীর আচরণে বিস্মিত। সকলের মধ্যেই একটা ছিঃ ছিঃ গুঞ্জন। বয়স-জ্যেষ্ঠ লোকজন ধর্ম ভীরুতা দেখিয়েও লাভ হয়নি। শেষ মেশ অনিমেষের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। সে রাজী হয় সাত ফেরের সময় পিছনে পিছনে ঘুরবে। এই ঘটনা দুই পরিবারের পরিচিত আত্মীয়দের চায়ের আসরে ‘হট নিউজ’ হয়ে উঠেছিল। কেউ গেল গেল রব তুলছিল তো কেউ বাহ্বা দিয়েছিল কাবেরীর এই পদক্ষেপকে ।
বিয়ের এই ঘটনায় অনিমেষের একটু রাগ হয়। তবে তার থেকেও তার বন্ধুরা বেশী আহত। মেয়ের জেদের কাছে কেন সে নত হল? ঠিক যেন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী। তাই সকলে মিলে অনিমেষকে ফুলশয্যার রাতে বিড়াল মারার যুক্তি দিল। অর্থাৎ এমন কিছু একটা করতে যাতে কাবেরীর মাথা একটু হলেও নত করা যায়। কিন্তু সে যে কি যন্ত্র তার কিছুই এখনও প্রকাশ ঘটেনি।
ছোট থেকে ওকে যারা চেনে তারাই জানে। ছোট বেলায় আম চুরি করার সময় বাড়ির মালিক তাড়াতে এলে ও উল্টে তাকে ইট নিয়ে তাড়া করত। ছিপ দিয়ে কারও পুকুরে মাছে ধরতে দেখে কেউ তাড়ালে পরক্ষণেই বড় জাল এনে ফেলে দিত পুকুরে । আর এই কর্মকাণ্ডের জন্য নালিশ শুনতে শুনতে বাবা মা’ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
বউভাতের রাত পরিচিতরা সকলেই আসছেন আলাপ করছেন, ও দিকে খাওয়া দাওয়ারর পর্বও বেশ নিয়ম মত চলছে, কোন রকম কোন গোলযোগ নেই বিয়ের রাতের মত। তবে কেউ কেউ একটু উস্কানি মূলক কথাও বলছেন “মেয়ের বাড়ি কি কাণ্ডটাই না হয়েছিল! দেখ এখানে কত শান্ত ভাবে হোল, পরে এই মেয়ে কদ্দুর কি ঘটায় দেখো!”
মহাদেব বাবু জামাই অনিমেষের হাত ধরে বলে ওঠেন- “বাবা মেয়ে তোমার হাতে দিলাম ওকে একটু খেয়াল রেখো। ও একটু স্পষ্টবাদী কিন্তু মনের দিক থেকে বেশ নরম। একটু মানিয়ে নিয়ে চলো এইটুকু দায়িত্ব তুমি নিও”।
অনিমেষও সেই মত শ্বশুর মশাইকে আশ্বাস দেয়- “আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা ওর কোন অসুবিধা হবে না এখানে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
কন্যা যাত্রীরা ফিরে আসবে তাই একে একে সকলেই কাবেরীর সাথে দেখা করে শুভরাত্রি জানিয়ে আসছে। দিদি রিমা বোনকে জড়িয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না-“শান্ত হয়ে চলিস সবাইকে মানিয়ে নিস…..”।
বলতে বলতেই পিছন থেকে জামাই বাবু বলে উঠেন- “এতোক্ষণ তো ভালোই কাটল! বিছানায় যেন ঝড় না…. উঠে… সাবধান…. ”।
শ্যালিকা-জামাই বাবু বলে কথা, তাই একটু মশকরা করেই নিলেন।
ফুলশয্যার ঘরটি রজনীগন্ধা, গোলাপ আরও বাহারি ফুলেফুলে সজ্জিত হয়ে সুরভিত হয়ে উঠেছে। সদ্য ঘরে কমলা আকাশী, সাদা দিয়ে করা রঙের সাথে বেশ এক অপূর্বতা ধারণ করেছে। অনিমেষের বন্ধুরা বেশ কিছু আপেল আঙুর লেবু কলা ইত্যাদি ফলও ফুলের সাথে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে।
রাত একটা বদ্ধ ঘরে খাটের মাঝখানে বসে কাবেরী, আর পাশে পা ঝুলিয়ে পাত্র অনিমেষ। লাজুক ভাব দু’জনার মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে গভীর ভাবে। হয়তো কে আগ কে আগে এই ভাবনায় মগ্ন হয়ে আছে দু’জনাই। অবশেষে নীরবতার দেওয়াল ভেঙে কাবেরী বলে ওঠে “আপনার আয়োজনের কোন অসুবিধা হয়নি তো সব ঠিক আছে?”
এতক্ষনে অনিমেষের ঘাটে জল এসে দাঁড়াল, যেন বদ্ধ ঘরে সবে মাত্র অক্সিজেন সরবরাহ হল। সে জড়তা কাটিয়ে বলে উঠলো -“হুম, সব ঠিক আছে তোমার বাড়ির কারও কোন অসুবিধা, কেউ কিছু বলে নি তো?”
-“না না কেউ কিছু বলেনি আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
দু’জন একে অপরের দিকে হালকা চাউনি দিতে থাকে। তারপর দু’জনেই লজ্জিত হয়ে ঠোঁটে মুচকি হাসি এনে মাথা নিচু করে দিল। কেউ কোন বাক্য খুঁজে পাচ্ছেনা! সব যেন রাতের আড়ালে ওদের একলা ছেড়ে পালিয়েছে।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিস্তব্ধতা ভেঙে অনিমেষ বলে ওঠে-“তোমায় একটা কথা বলি কিছু মনে করো না প্লীজ…।, আচ্ছা তোমার জীবনে কেউ কি কখন ছিল না?”
-“না, ছিল না।”
– “তোমার মত সুন্দরীর জীবনে সত্যিই কেউ ছিল না? না কি আড়াল করছো?”
– “কেন আড়াল করবো? তাও আপনার কাছে!”
– “তার মানে তুমি ভার্জিন! সতীচ্ছদ ঠিকই আছে এখনো?”
হঠাৎ এই অপ্রাসঙ্গিক অনৈতিক কথাটা হাসির ছলে বললেও খুবই কর্কশ লেগেছিল কাবেরীর। সেটা হয়তো অনিমেষ অনুভবই করতেই পারেনি।
কাবেরী একটু রেগেই বলল -“সে কথা আমি কখন বললাম?”
আবার মুচকি হাসতে হাসতে- “তুমি ভার্জিন অথচ সতীচ্ছদ ছিন্ন হয়ে গেছে তাহলে…. ?”
এই কথা কাবেরীকে আরও ক্ষুদ্ধ করেছিল সে একপ্রকার রেগেই বলে ওঠে “সতীচ্ছদ ছিন্ন হলেই কুমারীত্ব নষ্ট হয় বুঝি? এই ধারণা নিয়ে আপনি বেঁচে আছেন, এই শিক্ষা আপনি কোথায় পেলেন? আপনি কারও সাথে সহবাস করেন নি কখন?”
-‘রাগ করোনা! একটু আস্তে বল বাইরে শুনতে পাবে।(একটু ভীত হয়ে )…… না আমি করিনি কখনো!”
-“প্রমাণ দিন!”
-“প্রমাণ!মানে?” চমকে উঠে বলে অনিমেষ।
কাবেরী যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে –“মানে কিছুই না, আপনি দেখান আপনারটা ঠিক আছে কিনা দেখবো” ।
অনিমেষ লজ্জায় মাথা নত করলো, সারা শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। এমন পরিস্থিতির জন্য সে কোনভাবেই তৈরি ছিল না। চিন্তায় পড়ে গেল কার পাল্লায় পড়েছি! কোন পাপে, কি জানতে, কি জিজ্ঞাসা করে বসলাম? আর এখন কি বিপদেই না পড়েছি! অনিমেষের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
-“কি ভাবছেন ?… দেখান!” ঘোমটা মাথা থেকে ফেলে একটু মুডি ভাব নিয়ে বলে কাবেরী।
-“কি দেখে বুঝবে তুমি? বোঝার কোন উপায় আছে?” একটু ভীত শান্ত নমনীয় সুরে বলে ওঠে।
-“আছে অবশ্যই আছে, আপনারা পুরুষত্বের বড়াই করেন যে সম্পদ নিয়ে, তার বর্ধিত ত্বকের সঙ্গে যে উপ শিরাটি থাকে- আমি তো জানি সেটা সহবাসেই ছিন্ন হয়। দেখি আপনার সেটা ঠিক আছে কি না ! না কি আগেই দড়ি ছিঁড়ে সমুদ্রে জাহাজ ডুবিয়েছেন।
-“এটা কেমন কথা! ছিন্ন মানে তো এই নয় যে আমি ভার্জিনিটি নষ্ট করেছি বা জাহাজ ডুবিয়েছি । সে তো বহুকাল আগেই বাল্য কু-অভ্যাসের দোষে ছিন্ন হয়েছে।”
-“ও আচ্ছা! ছিন্ন! মানে আপনাদের বেলায় নয়……, শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই হয়….? সেটা বাল্য কু-অভ্যাসে হয়েছে…., আর আমাদের সে অভ্যাস থাকতে নেই তাই তো ….? আমরা রক্তে মাংসে তৈরি নই তাই না? আমাদের সাধ আহ্লাদ ইচ্ছা চাহিদা থাকতে নেই! থাকলেই সব শেষ। আপনারা দশ জনের সাথে শরীর ভাগ করলেও গঙ্গোত্রী গোমুখের পবিত্র জল! আর আমাদের মেয়েদের এক বারেই নর্দমার কীট। আমাদের হাজারো কারণ থাকে সতীচ্ছদ নষ্ট হওয়ার, তার মানে এই নয় ভার্জিনিটি শেষ । তবে আপনাদের ক্ষেত্রে কু-অভ্যাসে যদি না হয় তবে ওই একটাই পথ বাকি থাকে।”
কথা বেশ সশব্দেই হয়েছিল বাইরে থেকে কেউ শুনছিল কি না বোঝার উপায় নেই।
এর পর একটু থেমে গম্ভীর হয়ে আবার বলে ওঠে, আপনি যে মানসিকতা দেখালেন তাতে আর আপনার সাথে থাকা যাবেনা ।
কাবেরী ফোনটা হাতে নিয়ে… আমি ক্যাব ডাকছি এখনই বেরিয়ে যাবো। আর সারা জীবন আপনি কৈফিয়ত দিতে থাকবেন কেন বৌ বেরিয়ে গেল ফুলশয্যার রাতে ।
কাবেরী বিছনা থেকে নেমে দাঁড়াতেই অনিমেষ প্রবল অস্বস্তির মধ্যে পড়লো। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, এমন প্রসঙ্গ তুলে সেও লজ্জিত। আর এই রাতে যদি সত্যি সত্যিই ও বেরিয়ে চলে যায়! তাহলে সমাজে আর মুখ দেখানোর কোন উপায় থাকবে না। অতএব যা হোক করে কাবেরীকে শান্ত করতে হবে। অনিমেষ কান ধরে, নাক ধরে ক্ষমা চাইতে লাগল- “কাবেরী প্লীজ রাগ করোনা আমার ভুল হয়েছে, এই রাতে তুমি কোন আর অঘটন করোনা প্লীজ……………!”
অনিমেষের এই কাকুতি মিনতি বেশ ভালোই উপভোগ করছে কাবেরী। মনে মনে সে হাসছে ওর অসহায়তা দেখে। কিভাবে একজন শিক্ষিত পুরুষ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে এবং করুণ সুরে আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে অনুশোচনা প্রকাশ করছে। কাবেরী কোন রকম সাড়া না দেওয়ায় অনিমেষ আকস্মাৎ সামনে ঝুকে পায়ে ধরে মাফ চাইতে গেলে কাবেরী অসম্ভব লজ্জিত হয়ে পড়ে।
সে তৎক্ষণাৎ অনিমেষের হাত দুটো ধরে ফেলে – “এ আপনি কি করছেন? আপনি তো আমায় আরও লজ্জিত করে তুলবেন দেখছি! আমি কোথাও যাচ্ছি না! প্লীজ আপনি শান্ত হন… ভয় পাবেন না.. উঠে দাঁড়ান!” অনিমেষ উঠে দাঁড়াতেই “আমার দিকে তাকান, আমায় দেখুন.. একটু মজা করলাম আপনার সাথে, যাতে এই রাতটা আমাদের স্মরণীয় হয়ে থাকে।”
লজ্জা ও গ্লানিতে অনিমেষের সাড়া শরীরে চোরা ঘাম বইছিল, কাবেরীর নরম সুরে তা কিছুটা স্তিমিত হয়, সেই মুহূর্তটা অনিমেষের নাক মুখে বিনত বিনম্র ভাব ফুটে ওঠে।
কাবেরী অনিমেষকে একটা প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, “আপনি বড্ড ভালো মানুষ, যাদের পাল্লায় পড়ে আমাকে নত করতে চেয়েছিলেন- তাদের সকালে বুক ফুলিয়ে বলবেন বিড়ালটা আপনি মেরেই ফেলেছেন। অনিমেষের জড়তা হয়তো তখনও কাটেনি সে নির্বোধ বালকের ন্যায় কাবেরীর বাহুডোরে নিশ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
কাবেরী একটি চুমু দিয়ে অনিমেষকে ছেড়ে দিয়ে বিছনায় শুয়ে বলে ওঠে- “এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রাত রাগ করে চলে যাবে, রাতেরও তো কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে! আমাদেরও তো এগোতে হবে…..!”
-
ছন্দ পতন
ছন্দ পতন
-অমল দাস
যে শব্দগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুনামিতে গেছে ভেসে,
সে শব্দ আর স্বরলিপি নিয়ে ফিরবে না!
ফিরবে না আর জল ঝরে যাওয়া মেঘ
মাইলস্টোনে লেখা হবে না প্রাচীন শিলালেখ।
যে পাতাটি বৃন্ত সমেত পথের উপর মূর্ছে পড়ে,
সে পাতাটি সতেজ হতে পারবে না!
পারবে না কেউ মৃতদেহে অমৃত ঢেলে দিতে
মাংসাশীরা তৎপর সদা নিষ্পাপ গিলে নিতে।
যে শিলাটির ভাঙছে হৃদয় টুকরো নুড়ি রূপে,
সে শিলা তো বুক চিতিয়ে থাকবে না!
থাকবে না কথার রেশ যা মিথ্যে সুতোয় গাঁথা
অহংকারের আস্তরণে লুপ্তপ্রায় আত্মিক গভীরতা।
যে বিহগা মুক্তাকাশে মেলেছে স্বাধীন ডানা,
নিশান খুঁজে এ পথে আর আসবে না!
আসবে না যা শেষের পথে সমাজ অবক্ষয়ে
কোটিজন মূক-বধির তুচ্ছ প্রতিহিংসার ভয়ে।
যে তারাগুলি খসে গেছে শ্বাস ফেলেছে পিছে,
সে অভাগা আর নবীনালো দেখবে না!
দেখবে না বিছানায় চির নিভে যাওয়া চোখ
রেনেসাঁস কাঁধে, হুঙ্কার দেবে না নব লোক।
যে নদীটি ব্যথার পলি সয়ে হারিয়ে ফেলেছে বেগ,
সৃষ্টির সেই দিনের ছন্দে সে মাতবে না!
মাতবে না সে আনন্দে যার অন্তরে শোক কাটা
‘একলা চলো’ মিথ্যে শ্রুতি একলা যায় না হাঁটা!
-
বসন্তের উড়ো চিঠি
বসন্তের উড়ো চিঠি
-অমল দাস
ভালোবাসার উড়ো চিঠি দক্ষিণে বায় হাওয়ার টানে,
কে লিখেছে প্রেমের চিঠি সুর দিলো কে প্রেমের গানে?
কোন পলাশে ফাগুন লেগে শিমূলতলায় লাল সাজে,
কে ভাসালো প্রেমের আঁচল আবীর রাঙা মুখ লাজে!
কোন পিয়াসী পিয়াল বনে শুকনো পাতায় নূপুর পায়ে?
মঞ্জরী-মৌ গন্ধ মেখে, কোন মিষ্টি মেয়ে ঘুরছে গাঁয়ে!
কে ডাকে গো বন্ধু সখা কোকিল কুহে হিজল ছায়?
আর পারিনা বাঁধতে পরাণ অস্ত বেলায় দৌড়ে যায়।
ঐ যে তার নীল শাড়িতে মেঘ ফুলেদের নাও সাদা,
রূপে ওড়না সবুজ বক্ষ’পরে রোদ শিশিরের যৌনতা।
মন যে কেন ডুবকি মারে ছলাৎ ঘাটের ঢেউ খেলায়,
আড়াই প্যাঁচের গরম স্বাদে বসন্ত স্রোত শিব মেলায়।
ফড়িঙ ডানায় ফুরফুরে মন চাঁদ হাসিতে পাগলামি,
গোলাপ খামে উড়ছে হাওয়ায় এই চিঠিটা খুব দামী!
কে ছড়ায় গো কাগজীফুল কে উড়ায় এ প্রেম চিঠি?
সে কি বসন্তীয়া চোখাড়ালে? জেনো, প্রণয় সম্মতি।
শব্দ কতেক দিচ্ছে উঁকি আমার হৃদপুলকের বৃষ্টি জল,
যেথা ফাগুন চিঠির আনাগোনা মনকে বলি চলরে চল।
লিখছি বসে সমস্ত দিন আমি ভাবের ঘরে ভাব হারাই
রোজ রাত্রি সকাল সঙ্গোপনে চিঠির তুমির সঙ্গ চাই।
-
মুছে যায় চেনা মুখ
মুছে যায় চেনা মুখ
-অমল দাস
এখন আগুন ছুঁয়ে দহন দানে পূর্ণ হবে না প্রাণ,
সোঁদা গন্ধ মিটিয়ে বাতাস বইছে পচা মনুষ্যত্ব ঘ্রাণ।
লোটন পায়রা লুটে চলে যায় কোটর শূন্য রেখে,
আঘাতের ঘায়ে আঘাত রাতের কুয়াশা রাখে ঢেকে।
রক্তরজে জন্ম লভেও রক্ত পিপাসুর লোলুপ কলরব,
ধূলিতে লুটায় মৃত্যুর প্রেমে বেওয়ারিশ যত শব।
কেনা বেচার এই বিশ্ববাজার ত্রাসে নাভিশ্বাস ওঠে,
যা কিছু অহরহ ঘটনা বহুল তা স্বার্থ দেখেই ঘটে।
সূর্য হতে যে রঙগুলি নেমে আসে আলোর পথ বেয়ে,
যে যার মত বোতলে ভরেছে নেয়নি কেউ তা চেয়ে।
ঋতুচক্র সময় মেনে নেই সময় কলির চক্রে বাঁধা,
অত্যাচারের ভোগ গহ্বরে কাঁদে “নারী নরের আধা।”
চলার পথের চেনা গলিতে হারায় কাঙ্ক্ষিত কত সুখ
রোজ কত শত দেখা হয়ে যায়, মুছে যায় চেনা মুখ
বহু সমাধির হৃদয়ে সাজানো ভালোবাসা আজো অক্ষত
নব জনমে প্রেম শাশ্বত হয়ে যদি সেথা হয় সম্মত!
কাহিনীরা সব ভিড় করে থাকে যার চিত্রপট ফিকে
ডানা পিঁপড়ে উড়েই যায় আগুন আলো যেই-দিকে
জলপ্রপাতের মধুরিমা রূপ শিলা বুকে আঁকে ক্ষত
একে একে খরস্রোতে ভাসে চেনা মুখ ছিল যত।
-
অপরাধ লিখতে থেকো অনন্তকাল…
অপরাধ লিখতে থেকো অনন্তকাল…
-অমল দাস
দোষ গুণ ভাগ সব ধূলো মেখে আলনায় ঝুলছে
ডিটারজেন্টে ধুয়ে অভিযোগের দড়িতে টাঙিয়ে রাখো
রোদ লাগিয়ে যখন দু’হাজারি নোটের মত ফিরবে
চিত্রগুপ্তের রাজ্যপাট উৎখাত করে তোমায় বসাবো
তুমি অপরাধ লিখতে থেকো অনন্তকাল…
অভিযোগ থাক! বা না থাক প্রমাণ
শতক ধরে শীত দুপুরে লেপ চাদরে বিচার রেখো
ভাবাবেগের অনর্থক আঁকা জলছবিতে
নোনা জলের মলিনতায় কাজলের আস্তরণ হবে
দুঃসাধ্য কষ্টের কাঠগড়া পাঁচিল ভাঙবো না,
নির্বাক চেয়ে রবো..!
তুমি আমার অপরাধ লিখতে থেকো অনন্তকাল…
নির্বাসনে যাওয়ার আগে রক্ত কণাগুলি নিংড়ে নিয়ে
তোমার দোয়াতে যথাসম্ভব কালি ঢেলে যাবো
তুমি ল্যাবটেস্টে দেখে নিও বিষাক্ত জীবাণু আছে কিনা
ভেবো না! ছাঁকনিতে ছেঁকে দেবো
কোন রক্তবীজ মাটি ফুঁড়ে না আসে আমার অবর্তমানে।
আমার মৌন প্রতিবাদে প্রভাবিত
কিন্তু দোষ! তুমি নিশ্চিত নও..
তবুও তুমি অপরাধ লিখতে থেকো অনন্তকাল…