• রম্য রচনা

    শিয়ালের মহাসভা  

    শিয়ালের মহাসভা   

    -অমল দাস

     

     

    বিকেলের মাঠের শেষ প্রান্তে সূর্য প্রায় ডুবেছে কিন্তু তার বিদায় আলোর প্রলেপ দিগন্তের আকাশ রাঙিয়ে আছে এখনো। একটু আঁধার না হলে বেরনো সম্ভব নয়। তাই সকলেই যে যার মত নিজের বিচরণ ক্ষেত্রে অপেক্ষা অবসানের প্রহর গুনছে। ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এলো। হঠাৎ একটি কর্কশ কণ্ঠে ‘হুক্কা হুয়া’… আওয়াজ শোনা গেলো। দূরে যে বসত বাড়িগুলি ছিল সেখানে কয়েকটি ঘরে এই ডাক ধ্বনিত হওয়াতে তারা বুঝল যে, আজ শিয়ালের বুঝি কোন সভা আছে। যেমন ভাবনা তেমনই হলো। এই ডাকের পরই আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে আরও কয়েকটি শিয়াল বেরিয়ে এলো। নবান্নের ধান কয়েকদিন আগেই উঠেছে তাই চাষের মাঠগুলি প্রায় ফাঁকা। মাঠের মাঝে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় প্রকৃতির শোভা দৃষ্টি নন্দন হয়ে উঠেছে। এই মাঝ মাঠেই শিয়ালের দল গোল হয়ে বসেছে।

    যে এই সভার হুঙ্কার দিয়েছিল, সে ইদানীং একটু আমিত্ব প্রদর্শন করছে। ভালো মন্দ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। অনেক কানাঘুষো করে সে প্রচণ্ড ধূর্ত! দরিদ্র দুর্বল শিয়ালদের সঞ্চয় মেরে দিয়েই এমন ঢোল হয়ে উঠেছে। তাই আজকাল দয়া মমতা হারিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উত্তরসূরী ভাবে নিজেকে। তবে ঐ কথায় বলেনা “গায়ে মানে না আপনি মোড়ল!”

    অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিল তবুও আসতে হয়েছে, নয়তো ঘাটের জল শুকিয়ে যেতে পারে।

    “নেহাত অস্তিত্বের সঙ্কটে আছি তাই নয়তো এই শীতল হাওয়া খাওয়া বেহুদা সভায় কে আসে!” আসার পথে এমনটাই বলতে শোনা গেলো ফিসফিস করে, বাড়ুইপাড়ার একটি শিয়াল ঘোষপাড়ার অপর এক শিয়ালের কানে।

    সেও উষ্মা প্রকাশ করে বলল, যা বলেছিস ভাই সঙ্কটই বটে, একসময় জোর ছিল ঠ্যাঙে, দৌড়ে ঝাঁপিয়ে লুটেছি যেমন পেরেছি। আর আজ কি বৈধব্য দশা। একটা চুনোপুঁটিও পাতে পড়েনা!

    -“হুম সত্যিই কি দশা’ই না হলো আমাদের। আবার এই সভায় যাচ্ছি তার জন্যেও দেখিস কথা উঠবে! নিন্দুকেরা নিশ্চয়ই বলবে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।” এই বলে অপরজন নাকে সর্দি নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সভার দিকে এগোতে লাগলো।

     

    পূর্ণিমার চাঁদ তখন ঝকঝক করছে, পাশের জঙ্গল থেকে বাদুড়গুলো বেরিয়ে এসেছে,  তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে খোলা আকশে নেচে বেরাচ্ছে। ছোট ছোট গর্ত থেকে ইঁদুর বেরিয়ে সারা মাঠ চষে বেরাচ্ছে নির্ভয়ে। কারণ তারা জানে আজ শিয়ালের দল ব্যস্ত মিটিং মিছিলে। অতএব তাদের নজর এদিকে পড়বে না! ভয়ও নেই। আর পোকামাকড়ের তো অভাব নেই জ্যোৎস্না আলোকে স্নান করতে।  

    একে একে ঘোষপাড়া, তেলুপাড়া, বারুইপাড়া, চৌধুরীপাড়া, যাদবপাড়া, মিয়াঁপাড়া, মুখার্জীপাড়ার জঙ্গলের শিয়ালগুলি বাঙালপাড়ার মাঠে এসে জমায়েতে সামিল হলো। আশেপাশের আরও অনেক জঙ্গল থেকে এসেছিলো আরও কয়েকটি শিয়াল। সবাই একই জমিদারীর আওতায় পড়ে কিনা তাই!

    পুরো এলাকাটি “লুটে খাও জমিদারী” এস্টেটস্‌ হিসাবে পরিচিত। কিছুদিন পূর্বে জমিদার বদল হয়েছে। আগে এক বৃদ্ধ জমিদার এর তত্বাবধান করতেন। বয়েস হয়েছে হাঁটা চলাও বিশেষ করতে পারতেন না,কথাও কম বলতেন! তাই তাঁর রাজত্বের কোন অংশ কে কোথা থেকে মেরে পগারপার হচ্ছে বুঝতেও পারতেন না। বিরোধীরা গলাধিকরনের সুযোগ খুব একটা পেতেন না। নিরানব্বই শতাংশ ঘোটালা নিজের লোকজনেই করেছেন। কিন্তু অসমর্থ দুর্বল ও মৃদুভাষী হওয়াতে সব জেনেও কিছুই বলতে পারতেন না। তিনি উত্তরসূরী করতে পারলেন না নিজের সন্তানকে, যা অনেকেই ইতিপূর্বে করেছেন। তাই জমিদারী ধরেও রাখতে পারলেন না। যদিও তাঁর দলগত পছন্দের একটি বালক আছে, তবে সে অপক্ক অবোধ। সময় লাগবে! ও মানুষ করতে বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। এই দুর্বলতা ও অনিশ্চয়তার সুযোগে অবশেষে তাঁর সামন্তদের মধ্যে একজন ডাকনামওয়ালা পুরুষ উঠে এলেন, অধিকাংশ সামন্তদের সমর্থন নিয়ে। তিনি হৃষ্টপুষ্ট চওড়া ছাতার মানুষ! থুরি মানে চওড়া ছাতির(বর্ষার ছাতি নয়! বুকের ছাতি মানে বুকের পাটাতন)মানুষ। যেমনি তাঁর চলন, তেমনি তাঁর বলন, তেমনি তাঁর চিন্তাধারা।

    ক্ষমতা হাতে নিয়েই তিনি বুঝলেন জমিদারী সম্পদ সুরক্ষিত রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই কারণে তিনি পুস্তক পাঠে মন দিলেন এবং সমস্ত বিশ্ব অধ্যায়ন করে যেদিন চীনের ‘দ্যা গ্রেট ওয়াল’ সম্পর্কে জানলেন, সেই দিনই সমাধান সুত্র পেয়ে গেলেন। প্রথমেই তিনি ঘোষণা করলেন রাজপ্রসাদ লাগোয়া সম্পদের যত ভাণ্ডার আছে, যত বিভিন্ন ফলমূলের বাগান আছে, মৎস্য উৎপাদনের পুকুর আছে, তা সকলই নিয়ন্ত্রণে এনে পাঁচিল দ্বারা বেষ্টনী দেওয়া হবে। যেন শত্রু পক্ষ ‘এট্যাক’ না করতে পারে, বা ‘নির্মল সম্পদে’ ‘অস্বচ্ছ চশমা’ লাগাতে না পারে। অর্থাৎ অবাঞ্ছিত পশু পক্ষী, পোকামাকড়ও আর চাইলেই সম্পদ ভাণ্ডারে ঢুকে গন্ধ নিতে পারবে না।

     

    এই কারণেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল আশেপাশের সমস্ত বাঁকাচাঁদমুখো সুযোগ সন্ধানীর, যাঁরা রাজপ্রসাদের বাগানে ঢুকে লুটে পুটে চেটে ঘেঁটে আনন্দে দিন কাটান। সেই চিন্তায় চিন্তিত শিয়ালের দলও, বিভিন্ন পাড়ার শিয়াল যে যেমন পেরেছে তেমন ভাবেই এতো দিন ঐ এলাকায় ঢুকে নিজেদের খোরাক জুটিয়েছে। যদি পাঁচিল দেয় তবে তাদের উপায় কি? ঝোলা ফুলবে কি করে, বা পেট চলবে কীভাবে?

    রাতের আঁধারে জমিদারী বাগানে গিয়ে সেখানকার সাথীদের সাথে কয়েক বার কথা বলার চেষ্টা হয়েছে “তোমরা যারা আমাদের স্ব-জাতি, তোমরাও আমাদের ঝোল ঝালে সামিল হও না। সবাই মিলে না হয় ধর্না দেবো পাঁচিলের পাশে! আর হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি স্বচ্ছতা নষ্ট হবেনা! মানে পাঁচিল ঘেঁষে যাতে কেউ হিসি না করে সেদিক খেয়াল রাখা হবে। আফটার অল গ্রেট ওয়াল বলে কথা, ঐতিহ্য ”!  

    না… তবে কাজ হয়নি। তারা জানিয়েছে ‘মূর্খের দেশে থাকো তোমরা? এতদিন তোমাদের জ্বালায় আমরাও খেতে পারিনি, এখন তোমরা ভোগ করো ধুউ..ল্লা… আমরা এখানে মজা করি গিলে রসো..গুল্লা…।’

    বাঙালপাড়ার শিয়াল বলেছিল- “তবে রে, দেহামু মজা দাঁড়া! আমিও সারা এস্টেটে  ঢাক পিডাইয়া সংবাদ ছড়াইয়া দিমু তোরাও চোর”।

    -“কোন লাভ হবে না বলে!” জমিদারী বাগানের শিয়াল ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বলল। আরও যুক্ত করল একটু সুর দিয়ে, “এখানে পাঁচিল হবে দিনে…। আমাদের কাজ রাতে, দিনে তো আমরা সূর্যের আলোয় ঘুঁটে দেবো না, যে পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে ‘…মারতে!’ আর যদিও কিছু বোঝে জনগণমন কত্তারা! তা হলে বুঝবে পাহারাদাররাই এই কাণ্ড করতেছে। বুঝলে কি না..! এবার সরে পড়ো।”  

    বাঙালপাড়ার শিয়াল নিরাশ হয়ে ফিরেছিল এবং অন্য শিয়ালদের বোঝাবার চেষ্টা করেছে আসন্ন মহাবিপদে কথা, ঝাড়ে-বংশে নৌকা ডুবির কথা। তাই আজ চন্দ্রিমা রাতে মহাসভার আয়োজন।

     

    চারিদিকে ঝিঁঝিঁর শব্দে কান যায়-যায় অবস্থা, দু একটা ব্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করছে। একটি ভোঁদড় বাঁশের ডগায় উঠতেই সেটা নিচু হয়ে আসে। উপস্থিত সকলেই ভয় পেয়ে যায় কোন দত্যি বেরল বুঝি। কিন্তু না ভোঁদড় সে লাল জিভ বার করে বলল ‘চালিয়ে যাও! আমিও ভুক্তভুগি! আছি দূর থেকে সমর্থনে।’

    এই নিশুতি জঙ্গলে কোথা থেকে এসে একটা টিকটিকিও “ঠিক ঠিক” করে উঠলো।

    ইতিমধ্যে দূরে মসজিদের মাইক শোনা গেলো। মিয়াঁপাড়ার শিয়াল বলল, “তাহলে শুরু করা যাক ইন্‌সাল্লাহ! সাতটা তো বেজেই গেলো মিয়াঁ।”

    যাদবপাড়ার শিয়াল বলল- “তুম ক্যায়সে জানতে হো সাত বাজ গেলো? গলে মে ঘড়ি বাঁধকে ঘুমতে হো..?”     

    -মসজিদে ‘এসার’ আজান শোন-নাই মিয়াঁ! একটু গলা উচিয়ে উত্তর দিলো সে।

    বাঙালপাড়ার শিয়াল বলল, “তাইলে শুরু কইরা দি? কি বল ভাই সব!” তারপর  প্রত্যুত্তরের কোন অপেক্ষা না করেই বলল, “আচ্ছা চৌধুরীপাড়া তুমিই কও! তোমারে হইল গিয়া এই মঞ্ছের সবাপতি করলাম.. ঠিক আছে..! নেও শুরু কইরা দেও!”   

    চৌধুরীপাড়ার ধেড়ে শিয়াল(আসলে একটু বয়স হয়েছে তো তাই) গলা ঝেড়ে একটু   ক্ষখ্‌ ক্ষখ্‌ করে তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করল- “বন্ধুগণ! আমরা এখানে কেন  জড়ো হয়েছি আশা করি সবাই জানেন! তা আমাদের তো টিকে থাকতে হবে না কি? এতদিন তো চুড়ি ছ্যাঁচড়ামি করে কাটলো, এখন বুঝি তা হবার নয়! যদি সৎ-এর ঢং করে থাকতে পারেন তো চেষ্টা করে দেখুন। কিন্তু পুরনো অভ্যাস তো ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের একসাথ হোতে হবে, লড়াই করতে হবে জিততে হবে কি বলেন সকলে?”

    টিকটিকি মনে হয় দূর থেকে পরিহাস করেই আবার আওয়াজ দিলো “ঠিক-ঠিক।”  

    বাঙালপাড়ার শিয়াল বলতে লাগলো- “ভাইবন্ধুলোগ আমার গদি লাগবে না। আমি চাই এই নৈরাজ্য শেষ হোউক অনাচার শেষ হোউক। বাঁইচ্যা থাকতে হইলে, জমিদারীডা ঠিক রাখতে হইলে, আমাগো এক হইতে হবে! সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে আমাগো হাতে হাত মিলাইতেই হবে, আসো সবাই হাত মিলাই। আর ধ্বনি তুলি জয় লুট খাও’য়ের জয়।”    

    হাতের বন্ধন থেকে হাত সরিয়ে তেলুপাড়ার শিয়াল ঘোষপাড়ার শিয়ালের কানে শুধালো- “আচ্ছা উরা বললে যে বেঁচে থাকতে হবে বটে, তাহার লড়াই আছে! আর এখন কইতেছে সারবভমত্ত লড়াই.. ইটা কি বটে?’  

    এ কথা বাঙালপাড়ার কানে যেতেই আঙ্গুল তুলে নির্দেশ দিয়ে বলল, “এই মুখার্জীদা তুমি একটু বুঝাইয়া দেও তো সার্বভৌমত্বডা কি!”

    সে উত্তর দিল আজ্ঞে হুম! এই বলে আবার তেলুপাড়ার দিকে চক্ষু রেখে বলল,  “সার্বভৌমত্ব হলো সারবো আর ভৌ মারবো! মানে কাজ সেরে ভৌ আওয়াজ দিয়ে বেরিয়ে যাবো। কেউ বুঝবে না, ভাববে কুকুর এসেছিল।।” 

    একথা শুনে উপস্থিত পিঁপড়ে সাধারণ ও কীট পোকামাকড় সবাই হো.. হো.. করে হেসে উঠলো।

    হাসি থামিয়ে চৌধুরীপাড়ার শিয়াল উষ্মা প্রকাশ করে বলল- “কি সব মানে বার  করছেন মশাই সার্বভৌমত্ব হল সর্ব ভূমিতে আমিত্ব অর্থাৎ সব ভূমিতে অবাধ লুটে খাও। এটা যে করেই হোক রক্ষা করতে হবে।”  

    বাঙালপাড়া বলল- ভাইবন্ধুক্যাডারগণ তাইলে ঐ কথাই রইল, সক্কলে একসাথে লড়মু,  দরকার পড়লে সবাই মিইল্যা জমিদাররে টাইন্যা হিঁচড়াইয়া নামাইয়া আনমু। কাছা খুইল্যা দিমু! আর যাতে চেয়ারে বইতে না পারে হেই লাইগ্যা পাছা কামড়াইয়া ঘা কইরা দিমু। দরকার পড়লে আমি জমিদারী.., না.. না.. থুরি মিস্টেক হইছে! (লজ্জায় দাঁত দিয়ে জিভ কেটে) আমরা সবাই মিইল্যা জমিদারী সামলামু।

    একথা শুনে না না জনে উত্তর দিলো “তা ঠিক বটে”, “হ্যাঁ সাধু উদ্যোগ”, “সব ঠিক হ্যায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। 

    এমন সময় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই দুঃসাহসী বিস্ময় বালক জমির পাশের রাস্তা দিয়ে মোবাইলে মেসেঞ্জারে সদ্য কপালে জোটা গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে চ্যাটাইতে চ্যাটাইতে ফিরছিল। সে কাণ্ড কারখানা দেখে পূর্বের সততা ও সাহস নিয়েই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও শিয়ালদের স্পর্ধা উপলব্ধি করছিলো। সমস্ত নাটক শেষে সে বলল –“তাহলে এখানে সবাই জমিদার! তাই তো না কি?”   

    সবাই হকচকিয়ে যায়! ভীত হয়ে ভাবে এ সত্যবাদী আবার কোথা থেকে হাজির হলো।

    -“না মানে ইয়ে! এক অঞ্চলে একটাই তো জমিদার, এক দেশে একটাই রাজা হয় কিনা তাই জানতে ইচ্ছা হলো! তা তোমরা কি সবাই জমিদার? মাত্র একজনকে তো তোমরা মেনে নেবে না! কারণ তোমাদের সকলের রূপ যে এক।

    ভিড়ের মাঝ থেকে এক শিয়াল বলল- “সে আমরা দেখে নেব কীভাবে চালাতে হয়! তুমি মেলা ফ্যাচফ্যাচ করোনা তো যাও।”

    -“সে যাবো। বলছি… শুনেছি জমিদার ভদ্রস্ত পোশাক পরে, সিংহাসনে বসে। তা তোমরা তো সব উলঙ্গ, আলো দেখলেই ভয়ে গর্তে ঢুকে যাও, জমিদারী চালাবে কি করে? আমার তো বড্ড চিন্তা হয় ‘আফটার অল’ আমিও তো এই অঞ্চলের মানুষ! সবাই একবার ভেবে দেখো!” এই বলতে  বলতে সে দূরে আঁধারে মিলিয়ে গেলো, মোবাইলের আলোও ক্ষীণ হয়ে এলো।

    শিয়ালের দল একে অপরের মুখে চাইতে লাগলো! হয়তো অন্যের চোখে নিজের চেহার দেখার আয়না খুঁজতে লাগলো হন্যে হয়ে। তখন টিকটিকিও বলল “ঠিক ঠিক এটাও ঠিক”।    

     

     

  • কবিতা

    প্রতি অনুভূতি

    প্রতি অনুভূতি

    -অমল দাস

     

    প্রতি নিঃশ্বাসে ধরণী বিমুখ হওয়া,  

    প্রতি প্রশ্বাসে প্রাণতরী ফিরে পাওয়া।

    প্রতি পলকে ব্যক্ত অবর্ণিত ভাষা,

    প্রতি স্বপ্নে অনাবিল সুখের বাসা ।  

     

    প্রতি আশায় নিরাশা জুড়ে থাকে,

    প্রতি স্মৃতি একত্রে ছবি আঁকে।

    প্রতি চেতনায় চিন্তারা বসে থাকে ,

    প্রতি বেদনা সলিল সমাধি লুকিয়ে রাখে ।

     

    প্রতি বিশ্বাসে ঘাতক ঘিরে থাকে,

    প্রতি চাহিদা অপ্রাপ্তি শোক মাখে।

    প্রতি আবেগ হৃদয় দুর্বল করে ,  

    প্রতি আঘাত ক্ষত চিহ্ন তুলে ধরে।   

     

    প্রতি প্রেমে বিরহ উপমা থাকে,  

    প্রতি ঘটনা দুর্ঘটনা সাথে রাখে।

    প্রতি ভক্তি আস্থার মালা গাঁথে,

    প্রতি কান্না নিশাচর করে রাতে।

  • কবিতা

    ভাঙা গড়া

    ভাঙা গড়া

    -অমল দাস

     

     

    উপযাচক দু’টি বক রোদেলা সকালে আঙিনায় এসে

    চেয়েছে শুনতে পুরনো প্রেমের গল্প!

    বাইরে থেকে চকচকে দেখেছে, আসলে রাংতা মোড়া

    ভিতরে ঠাসা তামাক, ভালোবাসা ছিল অল্প।

     

    উৎসুক দু’টি শালিক আব্দারে নেচেছে উঠানময়

    চেয়েছে বিগত প্রণয় ধ্বনি শুনতে,  

    সুদূর পিয়াসী বেহাগী বাতাস বুঝেছিল মনের কথা

    তাদের বলে গেল চেয়োনা কিছু জানতে।  

     

    প্রজাপতি ডানা মেলে বর্ণময়ে ঘুরছে চারপাশ, গন্ধে 

    ভাবে.. ফুলে মুগ্ধ মধু নিঃশেষ এই বেলা!  

    কৌতূহলী জমায়েতের কোলাহল ফিরতি পথে, নিরাশ 

    ঘাস ফড়িং-এরও ভেস্তে গেলো খেলা।

     

    নীরক্ত ঘাস বিষাদে হলদে হয়ে নেতিয়ে আছে পাশে

    ফোঁটা জলের হিসাব রেখেছিল সমস্ত,  

    উপন্যাসের পাতায় কলম রেখেছিলাম বটে, আমি

    সিঁড়ি ভাঙা গড়াতেই ছিলাম ব্যস্ত।

     

    গরম তেলে ফুটেছিল প্রেম ঝুরঝুর হয়ে পড়েছে,

    তারা কার্বন হাওয়ায় ভাসছে নীল আকাশে,  

    সখা! তোমাদের রুক্ষ জমিতে বৃথাই খোঁজা জলতল

    মরীচিকা ঘুরে এসো কোনো এক অবকাশে।  

     

     

  • কবিতা

    নদী তুমি কার?

    নদী তুমি কার?

    -অমল দাস

     

     

     

    চিতায় পোড়া যন্ত্রণাগুলি খোঁজে মুক্তির দ্বার

    বসে, নাঙ্গা পথের ভাঙা চরে, শুধায় নদী তুমি কার ?

    যে নদীটি যাচ্ছে চলে, তার কষ্ট কি কেউ জানে?

    ধরার জ্বরা বইছে সে রোজ পাপীর পবিত্র ডুব স্নানে।

     

     

    বৃষ্টি ধোয়া ক্ষতের মাটি ছড়িয়ে যাচ্ছে যেথায়

    সমস্ত দিন দাপিয়ে প্রলয় কাঁদছে সেথা ব্যথায়

    কোন বিরহে ঝরছে আকাশ কেউ কি তা বোঝে!

    নালায় জলায় কপাল ঠুকে নদীর বুকই খোঁজে।

     

     

    হঠাৎ করে ভাঙল যে ঘর ঠুনকো আঘাত নিয়ে

    নকশি কাঁথায় চিত্র আঁকে চোখের পানি দিয়ে।

    বৈঠাঘাতেও ছলাৎ নদী! কেউ কি ভালোবাসে?

    জল থলিতে আসলো যে বীজ সে পা নাচিয়ে হাসে।

     

     

    সাদা পাতা দাগিয়ে কলম শোষণের রাবার ঘষাঘষি

    কথ্য ভাষা বিকিয়ে দিতে পাল্লা দরে জলের কষাকষি, 

    তৃষ্ণা মিটিয়ে বোবা নদী- শুধুই মূল্য খোঁজে তার

    উলঙ্গ ছোঁড়াও টোক্কা দিয়ে, শুধায় নদী তুমি কার?

  • কবিতা

    ইত্যবসায় তিন

    ইত্যবসায় তিন

    -অমল দাস

     

     

    রুগ্ন দুপুর ভগ্ন নূপুর লাল মেয়েটির পায়ে

    জ্বলছে গৃহ ঝুলছে কৃষক এ দেশেরই গায়ে

    উড়ছে ধূলো বইছে হাওয়া মাদল তালে শাল

    জঙ্গলের ওই নগ্ন মানুষ পরছে গাছের ছাল।

     

    খাতায় বসে হিসাব কষে অর্থনীতির সুদ

    ঝুলি পেতে এগিয়ে যেতে আমরা লুটে বুঁদ

    মদের নেশা বেকার পেশা ঝুঁকছে তরুণ দল

    চোখের মতই শুকনো পথে ভূগর্ভস্থের জল।

     

    কাঁপছে সমাজ লড়ছে লড়াই কথারই মন্থনে

    দেশ বিরোধী, এক পরিধির বন্দিত হয় গানে

    মিথ্যে গড়া ব্যর্থ পড়া স্বাস্থ্যরা নেই সুস্থ

    কার্তুজে-র চালক নয় মরছে কেবল দুঃস্থ।

     

    ভাঙছে ওরা ভাবছি মোরা চলছে যেমন চলুক

    সইছে যারা বলছে তারা কেউ তো কিছু বলুক

    যাচ্ছে ছিঁড়ে সভার ভিড়ে ইস্তে-হারের খাতা

    চরিত্রে সব মাসতুতো ভাই ফালতু বিরোধীতা।

     

    মরছে পশু পথের শিশু নাঙ্গা রাজার দেশে

    হাসছে বিদূর কাঁদছে সিঁদুর,‘নট’নৃত্যের বেশে

    রক্তে খেলা মৃত্যু মেলা মোম মিছিলের ঢল

    সলতে পুড়ে হচ্ছে ছাই, আগুন চাইছে জ্বল!

     

    ভাগের ভোটে উদার নোটে ভর্তুকিতে শেষ

    কম্মে ভাঁটা ধম্মে জোয়ার আমরা আছি বেশ

    রুইছি নিজ্‌ পতন বীজ ডাকছি সঘন দিন

    আর কত ভাগ পড়বে পাতে! ইত্যবসায় তিন।

     

     

  • কবিতা

    আমি চেয়ে দেখি..  

    আমি চেয়ে দেখি..  

    -অমল দাস

     

     

    তবু পাইনা! যা ছিল পাওয়া অধিকার,  

    তবু চাইনা! যা ছিল আমার উপহার।  

    তবু ভুলে আছি, যা তুলে রাখা যায়

    তবু রেখেছি আড়ালে আলোর ছায়ায়।

     

     

    যেন বিদগ্ধ আহ্লাদে শুয়ে পড়ে গোধূলি,

    যেন বিবর্ণ সিঁদুরাকাশে অ-সময়ের হোলি।

    যেন নীল সমুদ্রে আধোনিমজ্জিত অস্ফুট দ্বীপ

    যেন প্রত্যহ সুনামিতে, আজো জ্বলেনি প্রদীপ।

     

     

    কেন নিশ্ছিদ্র জঙ্গল ঘিরে রাখে আত্ম-সমাধি?

    কেন মালভূমি শিখলে বাঁধে হ্রদের পরিধি?  

    কেন ছুটে যায় দিগন্ত রেখায় অন্তিম শ্বাস?

    কেন জানি! বিশাল জনজাহাজে একমাত্র বাস।

     

     

    যদিও চাই নিয়ত লাভা রূপে উর্দ্ধে উদ্‌গত

    যদিও আবডালে আগাছা, সহস্র দাঁড়িয়ে উন্নত।

    তবুও লিখে রাখি দেখি যা অ-পলক স্বপনে,

    তবুও গানে বাঁধি যে শূল বিঁধে হৃদের গহীনে।

     

     

    আমি চেয়ে দেখি সাদা মেঘে উড়ন্ত ডানা

    আমি জানি! বিচরণে প্রকৃতির নেই মানা।

    আমি ক্লান্তিহীন! দুর্গম পথে পা সুধা সন্ধানে,

    আমি ভাসি প্রবাহিত নদীর প্রতিকূল-প্রবাহ টানে।  

     

     

  • কবিতা

    তমসার রঙ

    তমসার রঙ

    -অমল দাস

     

     

    আঁধারের চাদর গায়ে জড়িয়ে রাত্রির কোলে মাথা

    খননে খননে দিন যায় খুঁজি কি দিয়েছে বিধাতা।  

    শব্দেরা আমার এপারে সেপারে ধূমকেতু হয়ে পড়ে,

    কুয়াশা ঘেরা বৈভব আমার নিমপাতা দিয়ে গড়ে।

     

     

    কোন পুকুরেই মুক্ত ঝিনুক পাইনি আজও এখনো

    শুকনো কাঠের কণ্ঠে গান বলিনি কাউকে শোন,

    নিশীথের সাথে সহবাসে বহু যন্ত্রণার জনক হই

    অসম্পৃক্ত দ্রবণ ঘিরে আমি বিজারণ ব্যথা সই।

     

     

    রাতাকাশের আশকারা ডাকে মেরুজ্যোতির চমকে 

    শশীকাননের তপস্বী আমি কেমনে সঁপি এ মনকে।   

    শিশির বিন্দু জমেছে অনেক জল স্রোত তাতে হয়নি

    মানবত্ব এক স্বর্গীয় ফল সে মিষ্টতা ঠোঁটে পাইনি। 

     

     

    মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আয়ু রেখায় চলে মাঞ্জা

    আমার খামখেয়ালী ঋতু বোধনে পর্ণমোচীর ঝঞ্ঝা।    

    শিউলির ঘ্রাণ আসেনা ঘরে কুয়াশা দেওয়ালে বন্দী

    এ জীবন নয়… জীবনের সাথে বেঁচে থাকার এক ফন্দী!   

  • কবিতা

    নিথর

    নিথর

    -অমল দাস

    আগুনের এক ফাগুন আছে
    জ্বলনেও আছে জ্বালা,
    আমার উপহার নাওনি তুমি
    দিয়ে যেও শেষ মালা।

    জলের নীচেও তল আছে
    ডুবলেও আছে ভয়,
    এ খেলায় তোমায় জয় দিলাম
    আমি মেনে নিলাম পরাজয়।

    শ্রাবণের জলে প্রেম আছে
    নয়নে লবনের ধারা,
    সাঁঝবাতিতে রাঙিয়ো ঘর
    আঁধারে আমার পাড়া।

    বাতাসী দোলায় পুলক আছে
    শ্বসন অভাবে মৃত্যু,
    এ জগত তোমার মিত্র করিলাম
    আমি হলাম না হয় শত্রু।

    আবহে মধুর সুর আছে

    বহু সুরে আছে বিষাদ

    আমি তপস্বী ধ্যানে মগ্ন হব

    তুমি লুটে নিও প্রাসাদ

    সমুদ্রে নদীর মিলন আছে
    গভীরতায় নেই মোহনা,
    চুম্বনে আর কাটবো না ঠোঁট 
    নিথর আমারে ছুঁয়ো না।

     

     

  • কবিতা

    উপদ্রবের যন্ত্র’রা

    উপদ্রবের যন্ত্র’রা

    – অমল দাস

     

     

    তপ্ত আগুন জ্বালিয়ে যখন নিভতে চায়না মনের বাতি,
    ঘুম না আসা রাত্রি জুড়ে  সেইতো আমার জীবন সাথী।

    শুক্লা চাঁদের জোৎস্না মেখে খুঁজি তারে বালির চরে,

    যৌবনী স্রোত ঢেউ তুলে দেয় মন গহীনের সাগর পারে।

     

    মেঘ ভাসে ঐ নীলাকাশে নেই যে তার বসত ঘর

    আমি নিঃস্ব নায়ে বৈঠা হাতে চতুর্দিকে নেই তো চর।  

    কাশ ফুলের ঐ পাপড়ি ওড়ে মন খারাপের দুপুর বেলা

    সূর্য ঘুমায় রাতের কোলে একলা পথেই আমার চলা।

     

    উপদ্রবের যন্ত্র’রা রোজ সুর কেড়ে নেয় মন বীণার

    স্মরণ চাপা মরু তলে নেই তো উপায় তুলে আনার।

    আমার সমস্ত রঙ লাল গ্রহতে সবুজ যেথা চিহ্নহীন

    নিয়ন তারায় রাত্রি সাজে আমার নৈশ হৃদয় বর্ণহীন ।

     

    রোজ সকালে পাপড়ি ঝরা ফুলের মরণ মাটির’পরে

    মন যে ব্যাকুল বাতাস হয়ে খুঁজে নিতে চাইছে তারে।

    এক ক্ষুদ্র তারা আস্ফালনে সোহাগ চায় চাঁদের সাথে

    আমার স্বপ্ন সিঁড়ি দোদুল্যমান অজানা এক আতঙ্কেতে।

      

  • কবিতা

    প্রভাতী প্রেম

    প্রভাতী প্রেম

    -অমল দাস

     

     

    নয়ন মুদিয়া দেখিনু তাহারে

    রাঙিল প্রভাত কে মোর ঘরে!

    আসিতে বাহিরে স্পর্শিল চরণ

    শিশির ঘাস, শুধাইল কাহারে স্মরণ?

     

    প্রভাত তুলিয়া আলোর সুর

    বলে, হে প্রিয়া তুমি কতদূর ?

    বাতাস বলিল কানে, শোন কথা!

    কহো ভালোবাসি ভাঙ্গি নীরবতা।

     

    অম্বর কোলে বাহু তুলিলাম,

    মেঘা হাস্যে- ‘সবই শুনিলাম’!

    কহিল রবি, তাহারে কি ভালোবাসো?

    আমি অস্ফুটে, একবার কাছে আসো!

     

    নীল সুদূরী মম ধান্য ক্ষেত

    হরিৎ সমারোহে কাশের শ্বেত,

    কবুতর অভিলাষী পরবাসী

    কহে, লিখিয়া দাও তাহারে ভালোবাসি!

     

    শিউলির ঘ্রাণ মুগ্ধ করিয়া

    তুলসী পরশ শুদ্ধ করিয়া

    গাঁদা গোলাপ সাজিল একই সারে

    ডাকিও তাহারে কহিল সমস্বরে।

     

    নিকটে বেণুবন মৃদু নিত্যে

    ঊর্মি দোদুলে মম চিত্তে;  

    ধূলি মৃত্তিকার সোঁদা সোঁদা ভাব

    কহে, চাহিলেই মিটিবে অভাব।  

     

    কোয়েল দোয়েল আজি গানে গানে

    নদী বহে  বৈঠার কলতানে,  

    কহে শৈত্য জ্বালের রসের গুড়

    তাহারে স্থান দাও হৃদয়পুর।

     

    মিলিত সকলের সুর-সঙ্গীত

    মুক্তির নাহি কোন ইঙ্গিত

    পুলকিত মনে প্রণয় হাসি

    কহি লাজে, প্রভাতী ভালোবাসি।  

     

     

     

     

You cannot copy content of this page