• ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-৩)

    বাজীকর (পর্ব-৩) 
    -অযান্ত্রিক

     

     

    “রাজা হলো, দিল্লীর ফিরোজ শাহ মাঠের কিউরেটর। মাঠ বানান, পিচ তৈরি করা এইসব ছিল ওর কাজ। সেবার শীতের পোশাকের ব্যবসা করবো বলে আমি দিল্লী গেছিলাম মাল আনতে। আর আমার ক্রিকেট খেলার প্রতি টান যে ছোটো বেলার থেকেই সে তো জানোই। কাকতলীয় ভাবে আমি এক মহাজনের কাছে মাল নিতে গেছি, আর ঠিক তার পরের দিনই ভারত বনাম পাকিস্তানের টেস্ট খেলা। আমি মহাজনের কাছে একটু খোঁজ খবর নিতেই, উনি বললেন আমি আমার পুরো মাল যদি ওনার কাছ থেকে নিই তাহলে উনি আমায় একটা টিকিট ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। যদিও ওনার কাছ থেকে সব মাল নিলে, আমার একটু বেশী লাগতো তবে ভেবে দেখলাম টিকিটের দাম তার থেকে অনেক বেশী লাগতো। আমি আর সাত পাঁচ না ভেবে বললাম ঠিক আছে তাই হোক, ওনাকে পুরো অর্ডার বুঝিয়ে দিতেই উনি আমায় একটা পাঁচদিনের টিকিট দিলেন ক্লাব হাউজের। আমি খেলা দেখার উত্তেজনায় সেদিন সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না প্রায়। সকালে যথারীতি একটু সকাল সকাল টিকিট হাতে পৌঁছে গেলাম মাঠে। লাইন দিয়ে ঠিক সময় ভিতরে ঢুকতেই দেখি, একদম সামনের সারিতেই আমার বসার জায়গা। জীবনে প্রথমবার সামনে থেকে অতোবড় বড় খেলোয়ারদের সামনে থেকে দেখে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম আমি। খেলা শুরু হতেই আমি উত্তেজনার চরমসীমায় পৌঁছে গিয়ে একটু লাফালাফি করে ফেলি, কিন্তু পরক্ষণেই আশেপাশে লোকের বিরক্তি ভরা চাউনি দেখে নিজেকে সামলে নিতে থাকি। তারপর থেকে চুপচাপ বসে খেলা দেখতে শুরু করি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করি প্রত্যেকটা বল হওয়ার আগে কেউ যেন যেন আমার কানের কাছে এসে বলে যাচ্ছে, কত রান হবে কিম্বা আউট হবে কিনা, আর আশ্চর্যও হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে, যা বলছে ঠিক তাই হচ্ছে, চার বললে চার, এক রান বললে এক, আর নো রান বললে ডট বল। সব থেকে অবাক হলাম যখন দেখলাম কুম্বলের একটা বলের আগে সেই অচেনা স্বর বলল আউট আর ওমনি একজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে পিছনে ফিরে দেখি, আমারই বয়সই একটা ছেলে আমার ঠিক পিছনটায় বসে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমাকে তাকাতে দেখে হেসে হিন্দিতেই বললো “আমি রাজা“ আমি আর কিছু কথা বলার আগেই আমাদের খেলা দেখার জায়গায় কজন সম্মানীয় ব্যক্তি এসে পড়াতে সবাই হই হই করে উঠলো, মাঠের থেকে ক্যামেরাও আমাদের দেখাতে লাগলো মাঠে লাগানো বিশাল টিভিটাতে। আমিও নিজেকে টিভিতে দেখে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠলাম আমাকে দেখাচ্ছে কিন্তু আমার পিছনের ছেলেটাকে তো দেখাচ্ছে না। আমি পিছনে ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অথচ ক্যামেরা ওকে দেখতে পাচ্ছে না? আমি আমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করাতে তিনিও জানালেন আমার পিছনের সীটটা খালি। অথচ আমি স্পষ্ট দেখছি রাজা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি ছাড়া রাজাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, নিজের বোঝার উপরে নিজেরই আশ্চর্যও লাগলো, তাহলে কি আমি ভুত দেখছি? কিন্তু আমার ভয় লাগছে না তো। আমার এই ভাবনা চিন্তার মধ্যে সেই দিনকার খেলা শেষ হয়ে গেলো। আমি ক্লাব হাউজ থেকে বেরবার সময়ও দেখলাম উপর থেকে রাজা আমার দিকে তাকিয়েই হাসছে। সেদিন বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর কিছুতেই ঘুম আসছে না, তাই বাসার সামনে একটা ছোট্ট বারান্দার মতো জায়গায় এসে বসেছিলাম। তেমন কুয়াশাও ছিল না, কিন্তু তার মধ্যে আমার মনে হলো, রাস্তার ওপার থেকে কেউ যেন হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। আমি যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতে সেই ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেলো। বরাবরই আমার ভুত প্রেতাত্মায় খুব একটা বিশ্বাস নেই, তাই ভয়ও তেমন পাই না। আমি আবার ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, মনে হল কেউ যেন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ খুলে তাকাতেই দেখি, রাজা আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে, আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই সে “মা” বলে একটা কাগজ আমার হাতে দিলো । আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম ওটা ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দান কর্তৃপক্ষের দেওয়া একটা পরিচয় পত্র,তাতে রাজার ছবি দেওয়া, নাম লেখা রাজারাম চৌধুরি কিউরেটর আর তার নীচে একটা ঠিকানা লেখা। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখি ঘরে কেউ নেই। সেই রাতে আর ঘুম এলো না, সকালের আলো ফুটতেই আমি তৈরি হয়ে মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু মাঠের সিকিউরিটি বললো, সময়ের আগে মাঠে ঢুকতে দেবে না, তাই বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। গেটের ভিতর থেকে একজন উর্দি পরা লোক আমায় অপেক্ষা করতে দেখে খুব সন্দেহের চোখে দেখে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। তখন সবে একজন দু’ জন করে দর্শক এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। আমি ঐ উর্দি পরা ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জমালাম। একটু বাদে জানতে চাইলাম রাজার ব্যাপারে। ভদ্রলোক জানালেন উনি খুব ভালো চিনতেন রাজা রামকে। মাঠের কাজ করতো, খুব ভালো ছেলে ছিল, মা আর ছেলে কাছেই বস্তিতে থাকতো। কিন্তু কি যে হল, কি করে ও বেটিং-এর বদনেশায় পরলো কে জানে, এক্কেবারে শেষ হয়ে গেলো। আর দেখো ওর মা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে লোকের দরজায় দরজায় দু’টো খাবারের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। রাজার সাথে কি হয়েছিলো আমি জানতে চাইব ঠিক তখনই একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা আমার কাছে এসে হাত পাতলো। আর ঐ উর্দি পরা ভদ্রলোক আমাকে বললেন “এই দেখো আমি যার কথা বললাম সেই রাজারামের মা ইনিই, দেখছ ছেলের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। আমি কিছু বললাম না শুধু পকেট হাতড়ে দেখলাম একটা একশ টাকার নোট পেলাম সেটাই দিয়ে দিলাম ঐ ভদ্রমহিলাকে। আমাকে চমকে দিয়ে পরিস্কার বাংলায় সেই ভদ্রমহিলা বললেন ”ভগবান তোমার ভালো করুক বেটা” এর মধ্যে মাঠে ঢোকার গেট খুলে যাওয়াতে আমায় ঢুকে যেতে হলো। ক্লাবহাউজের দিকে যেতে যেতে একটা ছেলে আমার পিছনে পিছনে এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো “আপ রাজারামের দোস্ত আছেন না?” আমি “হ্যাঁ” বলতেই সে আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বললো “তব তো হামাদের ভি দোস্ত আছেন, চোলেন একসাথে বসে খেলা ভি দেখবে আর নিজেরাও খেলবে“ আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে, না বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না কেউ যেন জোর করে আমাকে দিয়ে হ্যাঁ বলিয়ে দিলো। খেলা দেখার জায়গায় গিয়ে ছেলেটা কাল রাজা ঠিক যেই জায়গায় বসেছিল ঠিক তার পাশের সীটটাতে বসলো। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। খেলা শুরু হতেই আমি বুঝতে পারলাম রাজা এসে ঠিক পিছনের খালি সীটটাতে এসে বসলো। ছেলেটা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো “হামার নাম নিরাজ শুক্লা আছে, দোস্ত তুমার নাম কি আছে?” আমি আমার নাম বলতে সে বলল, “নাম সে কি যায় আসে? রাজার দোস্ত তো হামার ভি দোস্ত, তবে এই বরিং খেলা দেখতে দেখতে আমরা নিজেরাই একটা খেলা খেলি?” আমি না বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ”ঠিক আছে” বলে ফেললাম, বুঝতে পারলাম আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। শুনে নিরাজ বলল “তো চলো বিনোদ ভাই, হামরাও খেলা শুরু করি। এটা খুব সহজ খেলা হচ্ছে, আন্দাজের খেলা, ধরেন সামনে যে ওভার বল হবে তাতে কোতো রান হবে বলতে হবে। ধরো হামি বললাম দশ রান হবে, তুমি বললে না কম হবে। ওভার শেষ হলে যদি দশ রান হয় তুমি আমায় দশ টাকা দিবে আর কম হলে আমি দশ টাকা তোমায় দেবো । চল শুরু করো “আমি আবার না বলতে যাচ্ছিলাম কারণ তখন পকেটে উড়ানোর মতো টাকা আমার ছিল না কিন্তু বলতে পারলাম না জানো! সেই আগের মতই সম্মতি জানিয়ে ফেললাম। আমাদেরও খেলা শুরু হলো, নিরাজ বললো, এই ওভারে দুই রান হবে, ওমনি রাজা আমার কানে কানে বলল না চার হবে। আর বিশ্বাস করবে কিনা জানি না হলোও চার রান। নিরাজ আমায় চার টাকা দিলো। তারপরের ওভারে বললো এই ওভারে যদি কেউ আউট হয় তাহলে পঞ্চাশ তুমি দিবে যদি না হয় তাহলে আমি একশ দিবো । আমি আগের মতই বললাম আউট আর বলতে বলতে পাকিস্তানের একজন আউট হয়ে গেলো। আর নিরাজ আমায় কথা মতো একশ টাকা দিলো। আমার পকেট থেকে একটা টাকাও খরচ হলো না বরং সারা দিনে নিরাজ প্রায় হাজার টাকা আমার কাছে হেরে গেলো, ভুল হলো বরং বলা উচিত আমাকে দিয়ে খেলানো রাজার কাছে। খেলা শেষ হয়ে বেরনোর সময় দেখলাম রাজা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতার হাসি হাসছে। নিরাজকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। এতগুলো টাকা হেরেও ওর কোন দুঃখ নেই, উল্টে আমাকে বললো, “সাচ মে বিনোদ ভাই, তুমি রাজারাম ভাইয়ের সাচ্চা দোস্ত আছো, রাজাভাই ভি কভি হারতা নেহি থা, জিন্দেগী মে একবার হারা আউর দুনিয়া সে বাহার চলা গ্যায়া। পার কাল ভাই কাল মেরা আউর এক দোস্ত কে ভি লিয়ে আসবো। ওহ একদম জ্যোতিষ আছে, যা বলে তাই হয়।“ আমিও অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম কালই দেখা যাবে। গেট থেকে বেরিয়ে এসে আমার মাথায় একটা চিন্তা এলো, এই টাকাগুলো জিতেছে রাজা আমি তো শুধু মাধ্যম, আর এই টাকাগুলোর আমার কোনো প্রয়োজনও নেই। তাহলে কোন ভাবে যদি এই টাকাগুলো রাজারামের মা এর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় খুব ভালো হয়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ আমি সকালের সেই উর্দিপরা ভদ্রলোককে খুঁজে বার করলাম। তারপর তার কাছ থেকে রাজারামের মায়ের ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে গেলাম রাজারামের বাড়ি। বাড়ি বলার চেয়ে ঝুপড়ি বলাই ভালো। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমি বাইরের থেকে রাজা রাজা বলে ডাকতেই সকালের সেই ভদ্রমহিলা “কউন হ্যাঁয়” বলে বাইরে বেড়িয়ে এলেন। তারপর আমায় দেখে আবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললেন “কউন হয় বেটা, রাজা সাথে কি কাম আছে?” আমি বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমায় চিনতে পারেননি। আমি বললাম, “আমি রাজার দোস্ত আছি। রাজা নেই?” উনি বাইরে বেড়িয়ে এসে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আমিও দেখলাম ওনাকে তুমি বললে বিশ্বাস করবে না সুনন্দদাদা ওনাকে দেখতে অবিকল আমার পিসির মত যিনি বেশ কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। উনি আমায় ঝুপড়ির ভিতরে নিয়ে বসালেন তারপর সকালের মত পরিস্কার বাংলায় বললেন “তুমি কে বাবা? তোমার কথা তো আমি রাজার কাছে কোন দিন শুনিনি। আমার কথা শুনে ঘাবড়ে যেও না আমি বাংলারই মেয়ে, ভাগ্যচক্রে এখানে এসে পড়েছি, কয়েকবছর আগে স্বামী গত হয়েছেন তারপর মাস ছয়েক আগে ছেলেটাও চলে গেলো। কিন্তু ও কোনোদিন বলেনি তো ওর কোন বাঙ্গালী বন্ধু আছে।“ আমি কোনো রকমে ওনার প্রশ্নের জাল এড়িয়ে ওনার হাতে টাকা কটা দিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখি রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে রাজা, আর ওর মুখটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পর দিন সকালে মাঠে যেতেই দেখি সেই উর্দিপরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক গেটের কাছে। আমাকে দেখতেই উনি বললেন “বেটা তুমি তো বললে তুমি রাজার দোস্ত আছো, কিন্তু তুমি যে রাজার দূর সম্পর্কের ভাই সেটা তো বলোনি।” আমি একটু হেসে বললাম আপনি জানলেন কি করে?” উনি বললেন “আজ সকালে রাজার মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো সেই বললো“ আমি কিছু বললাম না শুধু একটু হেসে মাঠের দিকে চলে গেলাম। ভিতরে দেখা হয়ে গেলো নিরাজের সাথে ও আজকে ওর বন্ধু অভিজিৎকে নিয়ে এসেছে। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সেদিনও আমি অনেক টাকাই জিতলাম রাজার সাহায্যে। আর সেই টাকাও দিয়ে এলাম রাজার মা’কে, সেদিন রাজার বাড়ি যেতেই রাজার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর কান্না জড়ানো গলায় বললেন জানো আমার ছেলেটা খুব ভালো ছিল, মাঠে কাজ করার সুবাদে প্রচুর বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয় ছিল ওর, তাদের কেউ ভালো ছিল কেউ খারাপ, আমার ছেলেটা সেই ভালো খারাপের ফারাক করতে পারল না। শেষ হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম বাড়িতে টাকা দিত খাওয়া পরার খবর রাখত। কিন্তু তারপর কি যে হলো, জুয়া খেলার নেশায় সব শেষ হয়ে গেল । একবারও আমার কথা ভাবলো না । আমি সেদিন ওনাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আবেগের বশে পিসি বলে ডেকে ফেললাম। সেদিন ফেরার পর রাতে আমাকে আবার দেখা দিলো রাজা আর একপ্রকার মিনতি করলো আমি যেন ওর মাকে আমার সাথে নিয়ে আসি তার জন্য যি আর্থিক সাহায্য লাগে ও সব করবে এই বাজি ধরার মাধ্যমে। শুধু আমায় একটাই কথা দিতে হবে আমি প্রয়োজন ছাড়া ওর সাহায্য পাব না আর সে প্রয়োজন যেন কোনো ভাবে প্রাচুর্য আর বিলাসিতার জন্য না হয়। তাহলে ও আমাকে কোনো সাহায্য করবে না। এতদূর বলে বিনোদ থামলো। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে চা এসে গেছিল। এবার বিনোদ চুপ করতে বউমা বললো শুধু বসে অপেক্ষা করলে চলবে একটু কিছু খেতেও তো হবে নাকি। একটু মুড়ি বাতাসা দিয়ে গেলাম খেয়ে নাও, আর সত্যি দাদা কাল তুমি না থাকলে কি যে হতো? কাল সারারাত আমরা দু’জনে চোখের পাতা এক করতে পারিনি, আমি তোমাকে যখন দেখা হোল তখনই বলতাম কিন্তু পাছে তুমি ভয় পাও তাই বলিনি, কাল তুমি যাকে দেখেছ সে রাজা” মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো বৌমা “বিনোদ কাল সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিল তোমার বাড়ি যায় নি“
    সুনন্দ একটু হেসে বললো, “সত্যি রে বিনোদ তুই আসল বাজীকর, যে নিজের লোভের সংযমের বাজি খেলে প্রতিবার আর জিতে যায়, তোর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেলো।“
    বলতে বলতে দরজা খোলার শব্দ হলো, আর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল বিনোদ। ভিতরে ঢুকতেই সুনন্দকে দেখে বিনোদ বলে উঠলো “আরে সুনন্দদাদা তুমি কখন এলে, তোমাকে একটা ভালো খবর দিই। জানো পিসি ভালো আছে ডাক্তার বলেছে ভয়ের আর কোন কারণ নেই, তুমি কাল যা উপকার করলে, তুমি আমার ভগবান।”
    সুনন্দ চমকে টুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, টুলটা খালি কেউ নেই। সুনন্দর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে ওর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেরলো “তাহলে এতক্ষন?”

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-২)

    বাজীকর (পর্ব -২)
    -অযান্ত্রিক

     

     

    “আজকে কি তুই বিপদে পরিস নি? তাহলে খেলতে অসুবিধা কোথায়“ জানতে চাইলো সুনন্দ।
    “আমার কাছে টাকা নেই গো দাদা, আর যা আছে সেটা দিয়ে খেললে অমৃতদা জানতে পারবে, আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাবো, তার থেকেও বড় কথা কাল সকাল হতেই চুড়ান্ত অশান্তি করবে, তাই তুমি ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।”
    বিনোদের কথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো সুনন্দর মাথায় “তাহলে একটা কাজ কর, তুই তোর নামে খেলিস না, আমার হয়ে খেল, যা জিতবি সেটা তোর, তোকে আর শোধ করার চিন্তায় থাকতে হবে না আর অমৃত জানতে পারবে না“ বললো সুনন্দ।
    “আমি জানতাম তুমি আমায় জুপিটারের হয়ে খেলতে বলবে, ওটা যে তোমার আই.ডি, সেটাও জানি গত সপ্তায় দিল্লীর খেলায় তুমি এগারো হাজার টাকা জিতেছ সেটাও জানি“ খুব নিঃস্পৃহভাবে বললো বিনোদ।
    “তাহলে কি বলছিস? খেলবি? আমার হয়ে জিতলে জেতার টাকা তোর, আর মিনিট দশেকের মধ্যে এন্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে, তারপর সুযোগ থাকবে না“ খুব উৎসাহ নিয়ে বললো সুনন্দ।
    বিনোদ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে ফোনটা কানে দিলো “মালতি, পিসি কেমন আছে? হ্যাঁ, চাপ নেই, ব্যবস্থা হয়েছে আমি আসছি একটু পরেই, তুমি ইঞ্জেকশনটা নিয়ে নাও” বলে সুনন্দর দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি রাজী, কিন্তু টাকাটা নগদ দেবে তো এখন?”
    “হ্যাঁ, হ্যাঁ সে আর বলতে, আমার কথায় ভরসা হচ্ছে না, এবার বলতো কলকাতায় কত লাগাবো?” উত্তেজিত হয়ে বললো সুনন্দ।
    বিনোদ একবার চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলো, সারা ঘরের আলোগুলো একবার আচমকা দপদপ করে উঠলো, আর সেই সঙ্গে পুরো ঘর একটা বিশ্রী গন্ধে ভরে উঠলো এই গন্ধ সুনন্দের চেনা। শ্মশানের গন্ধ, মরা পোড়ার গন্ধ এটা, আর সেটা বুঝতে পেরেই সুনন্দর বুকটা একটা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলো। আর তখনই “নন্দদা কলকাতার আজ রেট যতই বেশী থাক আজ কলকাতা হারছে। ব্যাঙ্গালোরে দশে কুড়ি দিচ্ছে, ওখানে ছয় হাজার লাগাও আর স্বপ্নের দলে যাদের নাম বলছি তাদের নিয়ে দল বানাও, তাড়াতাড়ি করো আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। সুনন্দ চমকে ওঠে, দেখলো কথাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলছে বিনোদ কিন্তু গলার স্বরটা বিনোদের স্বাভাবিক বিনোদের মতো নয়, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আছে হালকা, ফ্যাশফ্যাশে, পরিচিত আর বিনোদের চোখ দু’টো ভাটার মতো জ্বলছে ।
    সুনন্দ কোন প্রশ্ন করলো না, ঐ অপরিচিত স্বর যেমন বললো ঠিক তেমন করে গেলো। ওর সিলেকশন শেষ হতেই, এন্ট্রি বন্ধ হয়ে গেলো। আবার সে স্বর ভেসে এলো সুনন্দর কানে কিন্তু এবার স্বরে আদেশের ভাব খুব স্পষ্ট ”আমার টাকাটা দিয়ে দিতেই পারো, আমি যখন বলেছি তখন তুমি জিতবেই, বিনোদ কোনোদিন হারে না, চালাকির কোনো চেষ্টাও করতে যেও না, মাসিমা রান্নাঘরে রুটি করছেন আর উনি জানেনও না সিলিন্ডারের থেকে গ্যাস লিক করছে। আমি অপকার করা ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু শাস্তি এখনো দিতে পারি“
    “না না আমি এক্ষুণি টাকাটা দিচ্ছি, আমায় ভুল ভাবছিস তুই, একটু দাঁড়া আমি টাকাটা নিয়ে আসছি?” বলে বিনোদের কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করতে গিয়ে সুনন্দ দেখলো বিনোদের শরীর থেকে প্রচণ্ড তাপ বেরোচ্ছে আর চোখ দু’টো সেই লালই হয়ে আছে। সুনন্দ প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে, রান্নাঘরের এসে দরজা ঠেলে ঢুকতে গিয়ে দেখলো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, আর ভিতরে খুব জোরে রেডিও চলছে, সুনন্দ চিৎকার করে উঠলো, “মা..মা’ কিন্তু কোনো সাড়া এলো না। তার বদলে ওর ঘর থেকে বিনোদ বেড়িয়ে এসে দাঁড়ালো, “সুনন্দদা, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
    “দ্যাখ না মা দরজা খুলছে না, ঠিক আছে এক মিনিট“ বলে বিনোদের পাশ দিয়ে সুনন্দ নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে টাকাটা বার করে এনে বিনোদের হাতে দিলো।“ দাদা ট্রেলার দেখেই তোমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, পুরো সিনেমা দেখালে কি করতে গো? আমি যদি এখান থেকে অতো দূরে হওয়া খেলায় কি ঘটবে বলতে পারি তাহলে আমার থেকে এক হাত দূরে থাকা তুমি কি কি করবে একটু পরে সেটা জানতে পারবো না? আমি জানতাম তুমি টাকাটা নিয়ে ঘোরাতে, খেলা শেষ না হলে তুমি টাকা দিতে না, তাই এই নমুনা দিলাম, টাকাটার খুব দরকার দাদা” টাকাটা হাতে নিয়েই বললো সেই ফ্যাশফ্যাশে স্বর। “এই নে ভাই তোর টাকা, শুধু একটাই অনুরোধ আমায় ভুল বুঝিস না ভাই“ কাতর হয়ে বললো সুনন্দ। বিনোদ একটা শ্লেষের হাসি দিয়ে বললো “চিন্তা করো না দাদা, রাজার ভুল হয় না, এতো বছরে হয়নি, আজও হবে না“ সুনন্দর সে সব কথা কানে গেলো না , বিনোদ কে সরিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরের কাছে যেতেই দেখলো, মা ওর ঘরের দিকেই আসছেন।“ বাবু দেখ না, রান্না ঘরে বড্ড গ্যাসের গন্ধ বেরচ্ছে, বুঝতেই পারছি না কোথা থেকে আসছে” কথাগুলো সুনন্দর কানে যেতেই ধরে প্রাণ এলো যেন সুনন্দর, তার সাথে দুশ্চিন্তাটা বদলে গেলো একটা অজানা ভয়ে।
    “থাক, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তুমি আমার ঘরে গিয়ে বসো তো, আমি বাইরে থেকে রুটি আর তরকারী কিনে আনছি” বলে সুনন্দ মা’কে ঘরে একরকম জোরে করে ঢুকিয়ে দিল, “নন্দদা আমি আসি, আজ তুমি আমার যা উপকার করলে আমি জীবনে ভুলবো না, প্লীজ কাউকে কিছু বোলো না, জানোই তো” বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো বিনোদ “হ্যাঁ হ্যাঁ তুই আয়, আর পিসি কেমন থাকে কাল জানাস একবার’ কিছুটা আপদ বিদায় করার ঢঙ্গেই বলে উঠলো সুনন্দ। তার পর নিজের ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবীটা পড়তে পড়তে মাকে বললো, “তুমি বসো, আমি কানাইদার দোকান থেকে রুটি আর আলুর দম নিয়ে আসছি, রান্নাঘরে যেতে হবে না, আমি রান্নঘরের জানলা দরজা খুলে রেখে যাচ্ছি“
    কানাইদার দোকানে যেতে যেতে, ভাবতে লাগলো ওর সাথে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। বিনোদ তো ওর কাছেই দাড়িয়ে ছিল, তাহলে এসব ও করলো কখন? নাকি ও আগেই ঘটিয়ে রেখে ছিল ওর থেকে পয়সা বার করার জন্য। দোকানে বেশ ভিড় রয়েছে তাও কোনো রকমে অর্ডারটা দিয়ে, বাইরে এসে দাঁড়িয়ে মোবাইলে খেলার রেজাল্ট দেখবে বলে মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলো। ‘কি ব্যাপার, সুনন্দদা মাসিমার কি শরীর খারাপ তুমি রুটি নিতে এসেছ?” শুনে মুখটা তুলতেই দেখলো অমৃত দাড়িয়ে।
    “না না মার শরীর ঠিকই আছে, বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারের থেকে লিক করছে, এই রাতের বেলায় লোক পাব কোথায়, তাই মাকে বললাম আজ রুটি বাইরে থেকেই নিয়ে আসি। ছাড় ওসব কথা, তোর খেলার কি খবর“ জানতে চাইলো সুনন্দ।
    “আর খেলা, শালা আমার ব্যাড লাকটাও খারাপ মাইরি, কলকাতায় লাগালাম, ভালো রানও করলো কিন্তু ব্যাঙ্গালোর যা কেলান কেলাচ্ছে হয়তো দেখবে এক্ষুণি খেলা শেষ হয় যাবে” একরাশ হতাশা নিয়ে বললো অমৃত, আর তখন টিং করে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো অমৃতের ফোনে, ফোনে ম্যাসেজটা দেখে চরম বিরক্তি নিয়ে বললো, “বললাম না, শালা ডুবে গেলো, ভাগ্যিস বিনোদের কথায় কলকাতায় বেশী টাকা লাগাইনি, তাহলে আরও ডুবতাম, এই জুপিটার ব্যাটা কে, কে জানে? মালটা ভালো জিতলো। এ নির্ঘাত ওদের নিজের লোক।“
    “নন্দদা তোমার খাবার রেডি নিয়ে যাও“ দোকান থেকে একটা ছেলে এসে জানাল সুনন্দকে। “হ্যাঁ, চল নিচ্ছি, অমৃত এলাম রে ভাই beter luck next time“ বলে তড়িঘড়ি এগোতে লাগলো সুনন্দ, ওর ফোনেও একটা ম্যাসেজ এসেছে কিন্তু অমৃতের সামনে সেটা বার করে দেখার সাহস পাচ্ছে না সুনন্দ। রুটির প্যাকেট নিয়ে দোকান থেকে একটু এগিয়ে এসে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখল ম্যাসেজ এসেছে জিতবে কে থেকে, congratulation , you have won rs 13000 towards ZITBE KE with a bonus of rs 1000 is credited to your registered bank account“ দেখে সুনন্দ বুঝতেই পারছে না খুশী হবে কি হবে না,এতো অবিশ্বাস্য।
    ‘চলো নন্দদা আমারও হয়ে গেছে, একসাথেই যাই।“ পাশ থেকে এসে বললো অমৃত, “জুপিটার ব্যাটার ভাগ্য খুব ভালো, আজ যদি আমাদের বিনু খেলত তাহলে জিতত কিন্তু বিনুই। আমি রাগ করছিলাম ঠিকই কিন্তু জানো তো বিনোদকে আমি মনে মনে খুব শ্রদ্ধা করি। ওর মতন ক্ষমতা থাকলে আমরা কবেই ভেসে যেতাম, ও কিন্তু যায়নি। আর আমি অবাক হয়ে যাই ওর সংযম দেখে, তুমিও লক্ষ্য করে দেখবে ওর কোনো বদগুণ নেই, এমনকি কোনো বিলাসিতাও নেই। সব থেকে বড় কথা, হয়তো সেটা তুমিও জানো, এই বাজারেও টাকা পয়সার লোভ ওর নেই, ওর ঠিক যত টুকু দরকার ঠিক ততটুকুর জন্যই খেলে, যদিও কোন বোনাস বা বেনিফিট পায় সে টাকাটা ও মনিশদা বা এমন অনেককে দিয়ে দেয়। অন্তত টাকা পয়সার ব্যাপারে, ও যাকে যা কথা দেয় সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। আর শুনলে অবাক হয়ে যাবে, আমরা মস্তি করার জন্য টাকা লাগাই, আর বিনু ওর টাকার প্রয়োজনেই টাকা লাগায়। ঐ জন্যই হয়তো বিনু জেতে প্রতিবার, আর আমরা হেরে যাই। ছাড়ো ওসব, বাড়ি এসে গেছে, দেখো হয়তো মাসিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। বিনু যা বলে তাই হয়, এই সব ক্ষেত্রে, এবার বুঝলে তো, আজ যা এক্সট্রা টাকা পেলে সেটা বিনুকে সাহায্য করার পুরস্কার“ শেষের কথাগুলো কানে যেতেই সুনন্দ চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই ওর বুকের ভিতরটা আবার ধড়াস করে উঠলো। তড়িঘড়ি বাড়িতে ঢুকেই দেখল বসার ঘরে সোফায় মা ঘুমিয়ে পরেছে, ভাগ্যিস ঘরের একটা চাবি সুনন্দর সাথেই থাকে। দরজা বন্ধ করার শব্দ হতেই, মা বললেন “কি রে বাবু এলি? এতো দেরী হোল? তোর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার একটু চোখ লেগে গেছিল। নাহ্ এবার তোর একটা বিয়ে দিতেই হবে।“
    “নাও নাও অনেক হয়েছে আর অশান্তি বাড়াতে হবে না, চলো খিদে পেয়েছে, কাল অফিস বেরতে হবে তো নাকি আমায়?” কথাগুলো এড়িয়ে গিয়ে বললো সুনন্দ। খাওয়া সেরে, বিছানায় পিঠ দিয়েও সুনন্দর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, কি হচ্ছে এসব, এর ব্যাখ্যা জানা দরকারী। যদি কাল সকালে সম্ভব হয়, একবার বিনোদের বাড়ি যাবে, যদি লাগে তো ছুটি নিয়ে নেবে, বাড়ির গ্যাসের কাজটাও তো করাতে হবে। এই সব ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমে ডুবে গেলো সুনন্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরিই হল, ঘড়িতে দেখল প্রায় নটা বাজে, নাহ্ আজ আর অফিস যাওয়া হবে না, তখনই মনে পড়ল যাবেই বা কি করে বাড়ির গ্যাসের সমস্যাটা সমাধান না করে তো যাওয়াও যাবে না। সুনন্দ ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলো, গ্যাসের কাজ করার লোক মনিশদার কাছে আছে, যাই ওখানে গিয়ে বলে আসি যদি করে দিয়ে যায় এসে এখন, যাওয়ার পথে একবার বিনোদের পিসিকেও দেখে যাওয়া যাবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছাকাছি আসতেই বিনোদ আর বিনোদের বউয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। বিনোদই এগিয়ে এসে বললো “সুপ্রভাত, নন্দদা, কাল তুমি যা উপকার করলে তার জন্য আমি সারা জীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকলাম“ সুনন্দ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই বিনোদের বউ বললো “আমি কাল আপনার ভাইয়ের কাছে সব শুনেছি, আজকের দিন কটা মানুষ এমন ভাবে পাশে এসে দাঁড়ায়। আপনাকে একবার অন্তত পায়ের ধুলো দিতেই হবে আজ আমাদের বাড়িতে, পিসিও এখন অনেকটা সামলে উঠেছে, চলুন কোন আপত্তি শুনবো না, একটু চা জল খাবার খেয়ে তারপর আপনার ছুটি। আপনার বাড়ির রান্নার গ্যাসেও তো শুনলাম কিছু সমস্যা হয়েছে, তার মানে সকালে চা’ও খাওয়া হয়নি। চলুন.. চলুন” সুনন্দ ভেবে দেখলঝ প্রস্তাব খারাপ নয়, কালকের ব্যাপারটাও খোলসা করে নেওয়া যাবে বিনোদের কাছ থেকে, “আচ্ছা চলো, তোমাদের সাথেই যাই, যদি রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হয়, ফিরোজদার বাড়িও তো তোমাদের ওইদিকে, আরে যে মনিশদার দোকানের পাশে গ্যাসের কাজ করে ,ওকেও ধরে নিয়ে আসবো” বলে দু’পা এগোতেই কেউ যেন বলে উঠলো “হ্যাঁরে বিনু, তোর পিসি কেমন আছে এখন” সবাই পিছনে ফিরতেই দেখলো সাইকেলে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে পিছনেই আসছে ফিরোজদা। ফিরোজকে দেখেই সুনন্দ বললো, “ফিরোজদা যে! দেখা হয়ে ভালোই হলো, আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম গতকাল রাত থেকে খুব বিপদে পড়ে গেছি, বাড়ির গ্যাসের সিলিন্ডারের থেকে খুব গ্যাসের গন্ধ আসছে, ভয়ে মা’কে রান্না ঘরে ঢুকতে দিইনি, তুমি যদি একবার এখন গিয়ে দেখে দাও খুব ভালো হয়।“
    “সে আর তোমাকে বলতে হবে না, সকালে তুমি বেরবার পরেই আমি গেছিলাম, দেখে এসেছি, কিছু হয়নি শুধু রেগুলেটর লুজ হয়ে গেছিল। আমি বাজার থেকে তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলাম, মাসিমা বারান্দা থেকে দেখে ডাকলেন, গিয়ে করে দিয়ে এসেছি, আমাকে বলে দিলেন তোমার সাথে দেখা হলে বাড়ি চলে যেতে, তুমি নাকি চা জল খাবার খেয়ে বেরোওনি?” বললো ফিরোজ। ফিরজের কথা শেষ হতেই বিনোদ বললো “পিসি ভালো আছে গো ফিরোজ দাদা, জানো তো কাল সুনন্দ দাদা না থাকলে কি যে হতো কে জানে”
    ”থাক, আর ওভাবে বলতে হবে না; চলতো চায়ের জন্য প্রাণটা হাঁকপাঁক করছে একেবারে” বিনোদের পিঠে একটা আদরের চাপড় মেরে বললো সুনন্দ।
    “হ্যাঁ চলো তো চলো, তখন থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খালি কথা বলে যাচ্ছ” বিনোদকে তাড়া দিয়ে বললো বিনোদের স্ত্রী। ওর বলার ধরনে সবাই একসাথে হেসে উঠে বিনোদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলো।
    বাড়িতে ঢুকে বিনোদ সুনন্দকে নিয়ে বাইরের ঘরে বসাল। সুনন্দকে বসার চেয়ারটা এগিয়ে দিতে দিতে বিনোদ বললো “তুমি কেন এসেছ মনে হয় আমি আমি জানি, আমার পিসির খবর ছাড়াও কালকের ব্যপারটা, তোমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? তবে তুমি না এলেও আমি বিকালে যেতাম তোমার কাছে। আসলে এটা আমি তোমাকে বললেও কি ভাবে বলবো, অথবা তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না..“
    “সব যখন বুঝতেই পারছিস তখন আর এতো কিন্তু কিন্তু করে কোন লাভ নেই, তবে এই টুকু ভরসা রাখতে পারিস, আমি বিশ্বাস করি দেবতা যদি থাকেন তাহলে অপদেবতাও আছে, কারণ অন্ধকার আছে বলেই আলো আছে। তাই জানতে চাইছিলাম রাজা কে!” বিনোদের কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো সুনন্দ।

    চলবে….

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-১)

    বাজীকর (পর্ব-১)
    -অযান্ত্রিক

     

     

    “আজকে কলকাতা আর ব্যাঙ্গালোরের খেলায়, কার উপর টাকা লাগালি রে বিনোদ?” চায়ের গেলাসটা হাতে নিয়ে পাশের বেঞ্চিতে বসতে বসতে বললো সুনন্দ।
    “লাগাইনি কোনো টাকা, টাকাই নেই পকেটে, লাগাব কথা থেকে, তবে লাগালে কলকাতার উপর লাগাতাম, দেখলাম দশ টাকায় পনেরো টাকা দিচ্ছে, লেগে গেলে ভালো দাঁও হবে কিন্তু সুনন্দ দাদা” বেশ আগ্রহ নিয়েই বলল বিনোদ।
    “না ভাই, আমার ওসব বাজি লাগিয়ে কাজ নেই, অমন সাধও নেই, এমনিতেই পাথর চাপা কপাল, বাজিমাত করার মত ভাগ্যের জোরও নেই” হাসতে হাসতে বলল সুনন্দ।
    “এই যে, এই কথাটা একদম লাখ টাকার কথা বলেছ সুনন্দদা, বিনোদের মত ভাগ্য পাওয়া দুস্কর, শালা আমাদের একশোয় একটা লেগে যায় আর বিনোদের একটাই মিস হয়। তবে, তাতে দেখেছ ওর কিন্তু একটুও অহঙ্কার নেই। নাহলে এতো দিনে আমাদের এই উস্তিতে ও এতোদিনে কি না করে ফেলত, আমাদের সাথে এই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিত না,” সুনন্দর কথায় হাসতে হাসতে সায় দিয়ে বললো তীর্থঙ্কর।
    “তোমরা ওকে জিততে দ্যাখো কিন্তু কোন দিন লক্ষ্য করে দেখবে, বিনোদ কিন্তু খুব বেশী টাকা জেতে না, তার মানে বিনোদ বিনোদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে খেলে না, একটুও লোভ নেই কিন্তু ওর”। 
    তীর্থাঙ্করের কথার শ্লেষটুকু এড়িয়ে গিয়ে সুনন্দ বললো, “হ্যাঁ রে বিনু তুই তো আগে এসবের মধ্যে থাকতিস না, এর মধ্যে তুই এলি কি করে?”
    “ধুর, কি যে বলো না নন্দদা, ওসব কিছু না গো, আমি তো আন্দাজেই ঢিল ছুঁড়ি তোমাদের লাগে না, আমার ধারে কাছে লেগে লুগে যায়, এইটুকুই তীর্থাঙ্কর শুধু শুধু আমার পিছনে লাগে গো” একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গিয়ে বললো বিনোদ।
    উস্তির, শিবকালিতলা বাসস্ট্যান্ডের মনিশদার চায়ের দোকান হল এই ছেলেগুলোর আড্ডার জায়গা। বিনোদ কলকাতার একটা বেসরকারি সংস্থায় ডেলিভারির কাজ করে, তীর্থাঙ্করও বেসরকারিতেই কাজ করে, তবে ম্যানেজার, কলকাতাতেই। সুনন্দ একটা কোম্পানির এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট হেড। রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় এখানেই বাস থেকে নেমে কিছু কখন চায়ের আড্ডা চলে ওদের, মানে বিনোদ, তীর্থাঙ্কর, অমৃত, আর সুনন্দ। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তারপর যে যার বাড়ির দিকে চলে যায়। মনিশদার দোকানেই সাইকেল রাখা থাকে ওখান থেকে নিয়েই বেড়িয়ে পরে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিয়ে। আজ এখনো অমৃত আসে নি, আইপিএল চলছে আর উঠতি বয়েসের ছেলেদের আড্ডায় মেতে ওঠার জন্য এর চেয়ে ভালো বিষয় কিছু নেই। এরা সবাই ক্রিকেট খেলা অন্ত প্রাণ, আর এখন ইন্টারনেট আর টিভির দৌলতে যে আইনি জুয়া “জিতবে কে?” আর “স্বপ্নের এগারো” খেলা চলে এরা তাতেও প্রায় এক আত্মা বলা যেতে পারে। আজ এদের আড্ডা শুরুই হয়েছে , কলকাতা আর বেঙ্গালরের খেলা নিয়ে, আর তাতে কে কার উপর কত টাকা লাগিয়েছে আর সে কেন জিতবে সেটা নিয়ে চুলচেরা আলোচনাও চলছে চরমে। তীর্থাঙ্কর, বিনোদ, আর অমৃত তিনজনেই নিয়মিত খেলে থাকে, যদিও তাতে দোষের কিছু তো নেই এতো এখন সবাই খেলছে। তবে, আলোচনায় নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে বিনোদ নিয়মিত খেলে আর জিতেও যায়, তাই বলে তীর্থাঙ্করকে কম ভাবলে ভুল করবেন মাননীয় পাঠকবৃন্দ । তীর্থাঙ্করও খেলে, তবে জেতে কম, হারে বেশী। দুজনেই অল্প পয়সার বাজী ধরে, যাতে হেরে গেলেও বেশী কষ্ট না হয়, কিন্তু স্বপ্ন দেখে একদিন বিশাল একটা বাজী জিতে তারপর পায়ের উপর পা তুলে আরামে দিন কাটাবে, আর এই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে দিন কাটাতে হবে না । ওরা নিজেরা আলোচনা করলেও বিনোদ কোনোদিন বলে না কোন দলের উপর টাকা লাগিয়েছে, শুধু যখন ফলাফল বেরোয় তখন দেখা যায় বিনোদ জিতেছে কিছু টাকা। যদিও তাই নিয়ে কোনো মনোমালিন্য হয় না বন্ধুদের মধ্যে। শুধু কি ক্রিকেট? হকি, ফুটবল, ভলিবল মেয়েদের ক্রিকেট সব কিছুতেই ওরা বাজী ধরে যেতে থাকে, আর বিনোদ এই সব বাজিতে জিতেও যায়। ওদের আলোচনা চলাকালীন, বাস থেকে নেমে আসলো অমৃত, এসেই স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বললো, “কি ভাই লোগ সব আরাম আছে কিনা?” তীর্থাঙ্কর মাথা না ঘুরিয়েই বললো “আরে অমৃত যে আয় আয়, মনিশদা আরও একটা চা, শুধু চিনি বেশী, না হলে এক্ষুনি অমৃতবানিতে নাকানিচোবানি খেতে হবে“
    “চুপ কর, শালা, আসতে পারলাম না, পিছনে লাগা শুরু করে দিলো, বেটিং কিং বিনোদ, আজ কার উপর বাজী ধরলি ভাই একটু বল, আমি তো কলকাতায় একশো লাগালাম, দেখি কত আসে? নাকি পুরোটাই ডুবে যায়” বেঞ্চিতে একটা কোনা দখল করে বসতে বসতে বললো অমৃত।
    ‘আজ আমি খেলছি না গো দাদা, পকেট একদম খালি, আর আমি ধার করে খেলি না সে তো তুমি ভালোই জানো” অমৃতের কথার উত্তরে বললো বিনোদ।
    “তা বটে! জাঙ্গিয়ার আবার বুকপকেট, খেলছে জুয়া তার আবার প্রিন্সিপাল, পারিসও মাইরি, কত যে রঙ্গ দেখবো দুনিয়ায়, ওরে ভাই রে। এদিকে, আমি গত তিনটে খেলায় একটা টাকাও জিততে পারিনি এবার কালী পুজোয় মদের খরচা তুলবো কি করে, কে জানে?” বেশ চিন্তিত মুখেই বললো অমৃত।
    সুনন্দ হেসে বললো, “তাহলে তো ভালই হলো বলো, জিততে না পারলে মদ খাওয়াটা অন্তত আটকাবে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন, আমায় দ্যাখো, আমি মদ খাইও না টাকা লাগাবার দরকারও পরে না চিন্তাও নেই”
    “হ্যাঁ, সবাই তো তোর মতো গোপাল ঠাকুর হয় না, ভাই এই লক ডাউনে আমার ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ছয় মাস ধরে সত্তর পার্সেন্ট স্যালারি দিচ্ছে, এবার পূজ্যয় বোনাসও হয় নি। বাকি সব খরচ এদিক থেকে ওদিক থেকে ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই খরচটা কিছুতেই হচ্ছে না। আগে অফিসে কাজের বাইরে এদিক ওদিকে খেপ মেরে বাড়তি শখ শৌখিনতাগুলো করা যেতো, কিন্তু এখন করোনার চক্করে সেগুলোও বন্ধ। তাও মাঝখানে বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার খরচ দিচ্ছিল অফিস থেকে, ট্রেন চলছিল না বলে। এখন ট্রেন চলছে, আমাদের ম্যানেজার’খানাও শালা শকুন, যেই শুনেছে ট্রেন চলছে ওমনি বসকে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আর যাতায়াত খরচও বন্ধ” বেশ রাগের স্বরেই বলল অমৃত।
    “যা বলেছিস ভাই,” অমৃতের কথায় সায় দিয়ে বললো তীর্থাঙ্কর। “এই করোনা পুরো গুষ্টির কাঁথায় আগুন দিয়ে দিলো মাইরি, আগে ডাল ভাত জুটিয়েও শখ শৌখিনতা করা যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন এই লক ডাউনে নুন আনতেই পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাড়তি খরচের কথা ছেড়েই দে, এখন ‘স্বপ্নের দল কিম্বা জিতবে কে’ ছাড়া এই গরীব গুর্বো মানুষগুলোর কিছু করা অসম্ভব। বেশী টাকা লাগে না, কাজেই হেরে গেলেও খুব কষ্ট হয় না, সবাই তো আর বিনু নয়? সেই কবে থেকে বারোর জায়গায় ছয় হাজার টাকা মাইনে পাচ্ছে, কিন্তু বউ মা বাবা ছেলে পুলে নিয়ে সংসার চালিয়ে তো যাচ্ছে, সে তো এদের দৌলতেই। যাই বল, সেই বেআইনি সাট্টা মটকা এসব তো খেলছি না, না বউয়ের গয়না বেচে খেলছি “
    “সে তোর যুক্তি না হয় মানলাম, কিন্তু এটাও তো ঠিক এই খেলার ঠ্যালায় তোদের কষ্টের উপার্জনগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে” বললো সুনন্দ।
    “ সে তো বিড়ি খেয়ে, মাল খেয়েও বেড়িয়ে যায়, তবে তোমার কথাও ভুল নয়, সবসময় যে টাকা চলে যায় তাতো নয় ফিরে আসেও তো অনেক বার। ছাড়ো এসব নিয়ে আর চব্য করতে হবে না দেরী হয়ে যাচ্ছে, আজকাল বাবা একটু দেরী হলেই বড্ড ব্যস্তও হয়ে পড়ে, তারপর খুঁজতে না বেরিয়ে পড়ে“ বলে উঠে দাঁড়ালো বিনোদ।
    “কিন্তু, বিনু প্লীজ বল না কলকাতা জিতবে তো রে, নাহলে অনেকগুলো টাকা ডুবে যাবে” কাতর ভাবে বললো অমৃত, উঠে পড়া বিনোদের হাতটা টেনে ধরে।
    “এ মাহ্, আমি কি করে বলবো, বলো দেখি? আমি তো আর হাত গুনতে পারি না, যেটা বলি তোমাদের মতই আন্দাজে, তার উপর হাতে টাকা নেই, বলে আমি কোন খেলাতেই টাকা লাগাইনি, বিশ্বাস না হলে তীর্থাঙ্করকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো” নিজেকে বাচাবার একটা আর্তি ফুটে উঠলো বিনোদের গলায়।
    “ঠিক আছে, বলবি না তো? কাল যদি দেখি উইনার লিস্টে তোর নাম, তখনই বুঝতে পারবি কত ধানে কত চাল, মনে আছে তো এখনো হাজার দুয়েক টাকা আমি পাই তোর কাছে। আম্ফানে বাড়ি সারানোর জন্য দশ নিয়ে ছিলি, তারই দুই বাকি এখনো” বেশ প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বরেই বললো অমৃত।
    “এই দ্যাখো, ওসব এর মধ্যে আনার কোন দরকার আছে কি? বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করেছিলি তাই বলে এই ভাবে সবার সামনে অপদস্থ করার কোনো মানে হয়?“ খুব বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বললো সুনন্দ।
    “না না সত্যি, সেদিন অমৃতদা যদি সাহায্য না করতো, তাহলে আমাকে পুরো পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নীচে রাস্তায় বসে কাটাতে হতো। তার জন্য আমি আজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো, তবে অমৃতদা বাকি দু’হাজার আমি তোমাকে বলেইছিলাম সামনের মাসে মাইনে পেয়েই দিয়ে দেবো। ভুলে যাবো কেন? আর আজ পর্যন্ত একবারও কি আমি ডেট মিস করেছি? আর তুমি আমাকে কেন বিশ্বাস করছো না? সত্যি আমি আজ খেলছি না, জানিও না কে জিতবে? শুধু শুধু জোর করছো কেন?“ বলে বেশ ক্ষুণ্ণ হয়ে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বিনোদ।
    বিনোদকে বেড়িয়ে যেতে দেখে পিছন থেকে চীৎকার করে বললো অমৃত “মনে থাকে যেন কথাটা, বন্ধুর থেকে দরকারে হেল্প নিবি আর হেল্প করতে বললে যত নখরা..”
    “দ্যাখ অমৃত ও হয়তো সত্যি বলছে, আন্দাজেই ও বাজী ধরে, লেগেও যায় কাকতলীয় ভাবে। না লাগলেও ওর পয়সাই নষ্ট হয় কিন্তু একবার ভেবে দ্যাখ ওর আন্দাজে ভর করে তুই টাকা লাগালি আর টাকা জলে চলে গেলো, তাহলে বিনু নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাবে না? ওইজন্যই ও হয়তো বলতে চাইছে না” অমৃতের রাগের পরিপ্রেক্ষিতে কৈফিয়ত দিয়ে বললো সুনন্দ। “আমিও এগোই, ভেবেছিলাম বিনুর সাথেই চলে যাবো কিন্তু তোর চুলকানিতে ও আগেই চলে গেলো, এবার এতোটা রাস্তা একাই যেতে হবে“ বলে সুনন্দ সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। তীর্থাঙ্কর মোবাইলে একবার সময়টা দেখে বললো “না রে ভাই আমিও এগোই, নটা থেকে খেলা শুরু হবে তার আগে বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিতে হবে, তুইও বাড়ি যা আর বসে বসে বিড়ি চুষতে হবে না।”
    “হ্যাঁ চল আমিও এগোই” বলে অমৃত আর তীর্থাঙ্কর একসাথে বেড়িয়ে পড়লো, সেদিনকার মতো আড্ডাও ভেঙ্গে গেলো মনিশদার দোকানে।
    শিবতলা মোড় থেকে চণ্ডী মণ্ডপ হয়েই যেতে হয় বিনোদের আর সুনন্দর বাড়ি। চণ্ডীমণ্ডপ থেকে একটু এগিয়েই হল গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সাধারণত বিনোদ আর সুনন্দ ঐ রাস্তায় ফেরে, আজ চণ্ডীমণ্ডপ পার করতেই দেখল বিনোদ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনেই দাঁড়িয়ে, সাইকেল নিয়ে।
    “কি রে? তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে এলি, বাড়ি গেলি না?”
    “যাচ্ছিলাম তো, কিন্তু বউ ফোন করে বললো, পিসির খুব শরীর খারাপ পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে ওরা এখানেই পিসিকে নিয়ে আসছে, তাই আমি আর গেলাম না। আসলে পিসির কেউ নেই কোনো কুলে যা করতে হবে আমাকেই করতে হবে। ও তুমি ভেবো না, তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, তুমি এগোও, ওরা তো আসছে টোটোতে করে তাই দাঁড়িয়ে আছি।”
    “ওঃ ঠিক আছে, আমি এগোচ্ছি তাহলে, তবে কোন দরকার পরলে ডাকিস, তেমন হলে রাতে বউমা আর তুই আমার ওখানে চলে আসতেও পারিস, আমি অনেক রাত অব্ধি জেগে থাকি, তার উপর আবার আজ খেলাও আছে” বললো সুনন্দ।
    “ঠিক আছে নন্দদা, সে রকম হলে আমি তোমায় ফোন করে নেবো। ঐ যে পিসিকে নিয়ে এলো বোধ হয়, আমি ওদিকে এগোই তুমি বাড়ি যাও দাদা” বলেই স্বাস্থ্য কেন্দ্রর ভিতরের দিকে চলে গেলো বিনোদ।
    সুনন্দ সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো। সাইকেল নিয়ে যেতে সুনন্দ মাথায় ঘুরতে লাগলো আড্ডার সেই প্রশ্নটাই, সত্যিই কি বিনোদ জ্যোতিষ জানে? ও নিজে ওদের সামনে বললেও ও তো নিজেই ঐ জুয়ার নেশায় ডুবে আছে। নেহাত বেনামে খেলে বলে অমৃত, বিনোদ, তীর্থঙ্কররা জানতে পারে না। যাইহোক, বাড়ি ঢুকে হাত পা ধুয়ে চা খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বসলো। হাত ঘড়িতে দেখল প্রায় সাতটা বাজে এখনো খেলা শুরু হতে বেশ কিছুক্ষণ বাকি, ও ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো জিতবে কে, কি রেট যাচ্ছে, তখন তো বিনু বললোই কলকাতার দশ টাকায় পনেরো টাকা দিচ্ছে এখন কত হয়েছে। ওমা এতো ভালোই বেড়ে গেছে এখন দশ টাকায় পঁচিশ দিচ্ছে। বিনু তো বলছিলই কলকাতায় লাগাতে, তাহলে কি কলকাতায় ?
    ঠক ঠক ঠক ঠক দরজায় টোকার আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ল সুনন্দর, “মাসিমা, নন্দদা আছে?” বুঝতে পারলো মা দরজা খুলেছে, তাই প্রশ্নটা মাকেই করলো কেউ। সুনন্দ বেড়িয়ে দেখতে যেতে যেতে শুনলো মা বলছে, “বাবু, বিনু এসেছে দ্যাখ, তোকে খুঁজছে? হ্যাঁ আছে রে, ওর ঘরে যা।” আর তার সাথেই দরজা বন্ধ করার শব্দও পেল। সুনন্দ পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এসে “আরে বিনু, কি হয়েছে, বউমা কই?” জানতে চাইলো।
    “নন্দদা খুব বিপদে পড়ে তোমার কাছেই ছুটে এসেছি। পিসির স্ট্রোক হয়েছে, একটা ইঞ্জেকশান এক্ষুণি দিতে হবে, কিন্তু সেটার দাম ছয় হাজার কিন্তু ওতো টাকা আমার কাছে নেই, তুমি যদি আমায় কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারো? তাহলে পিসির প্রাণটা বাঁচাতে পারি, অমৃতকে বলেছিলাম ও আমাকে দেবে না বলে দিলো মুখের উপর” খুব কাতর স্বরে বললো বিনোদ।
    “আরে দেখছি, দেখছি, তুই একটু শান্ত হয়ে এসে বস তো আগে, আয় ঘরে আয় তারপর দেখছি কি করা যায়” বলে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো বিনোদকে।
    “এইভাবে তোমার কাছে টাকা চাইতে খুবই লজ্জা লাগছে আমার কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কাছে ওতো টাকা নেই, মায়ের দিব্যি করে বলছি, যত তাড়াতাড়ি পারি তোমার টাকা আমি শোধ করে দেবো“ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল বিনোদ। সুনন্দ অদ্ভুত ভাবে একবার তাকাল বিনোদের দিকে তারপর একটা লুব্ধ স্বরে বলল “টাকা তো তুই ইচ্ছে করলেই যোগাড় করতে পারিস, তোর লাগান দাঁও তো কোনোদিন ফস্কায় না। একটা বাজি খেললেই তো মুশকিল আসান।”
    কথাটা যেন তীরের মতো বিঁধে দিলো বিনোদকে। একটা আত্ম বিশ্বাসের হাসি দিয়ে বললো বিনোদ “তার মানে তুমিও বিশ্বাস করো, তাহলে ঠিকই বিশ্বাস করো, আমি খেলার আগে জেনে যাই কে জিতবে কিন্তু তার একটা শর্ত আছে, টাকাটা আমার নিজের হতে হবে, আর প্রয়োজনটাও তেমনই জরুরি হতে হবে, অন্যের টাকায় খেললে আমার পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। বলতে পারো গুরুর আদেশ।”

    চলবে………..

  • কবিতা

    কবিতা- নিপীড়ন

    নিপীড়ন
    -অযান্ত্রিক

     


    কামিজে আড়াল টানি, করা যাবে রাহাজানি,
    চোখ বাঁধা ধারা বলে বৈধ।
    ব্যাখ্যার বাহাদুরি,করে শৈশব চুরি
    সাবেকি পস্কো তুমি কই গো।

    আইনের ধারা মতে, চলে গিয়ে ভুল পথে,
    ছোঁয়া ছুঁই সব করা যাবে।
    মেয়ে হয়ে মেয়েবেলা,করে দিয়ে ছেলেখেলা,
    মিশে গেলে ?পতন উৎসবে।

    কাকু এসে টিপে দিলো,কামনার তাপ নিলো,
    ভালো বদ ছোঁয়া বেমানান।
    গ্রহ নিগ্রহ গীত,এখন সবই অতীত,
    প্রকাশ্যে ভোগ করে যান।

    ছুঁয়ে দিলে ভিড় বাসে, সে আর কি যায় আসে,
    মত ভেদে বিপদে পড়ছে সম্ভ্রম।
    কামিজ শাড়িতে চলা,ওদের ওটা ছলাকলা,
    অচিরেই হবে অবাধ সঙ্গম।

    কিন্তু হঠাৎ যদি, ক্ষেপে ওঠে ভরা নদী,
    ভেঙে দেয় ছুঁতে চাওয়া হাতটা।
    তখন সে রূপ দেখে, বলবে-বা তুমি কাকে?
    রাস্তায় নেমে গেলো জাতটা।

    কৈশোর হলে লাঞ্ছিত ,থাকলে আচ্ছাদিত,
    হাত জানে চেনা ছকে হাঁটা।
    হেনস্থা নজীরবিহীন, বলছে সহজ আইন,
    হতে হবে চোখ কান কাটা।

    ছুঁলে আড়াল থেকে, হবে নাকো আজথেকে,
    নিপীড়ন আইনী হদিশ।
    আমিও ভাবছি দেখে,বলব আমার মেয়েটাকে,
    কেউ ছুঁলে হাত ভেঙে দিস।

    ভাববি না বাবা কাকা, লজ্জাটা লোক দেখা,
    ধারা বলে ওটা কিছু নয়।
    নিজেকে বাঁচাবি নিজে,দিবি পেন ছুরি গুঁজে,
    কাপড় আড়ালে খোঁচা ,নয় অন্যায়।

  • কবিতা

    কবিতা- ছাব্বিশ

    ছাব্বিশ
    -অযান্ত্রিক

     


    রাজা কিংবা প্রজার খাতায় ,তন্ত্র বোঝায় দিক নির্দেশ,
    বশ্যতা যখন ফিকির শুধু, বোকা জনতা ,বোকা এই দেশ।
    পতাকা উড়ায় ভ্রান্ত বাতাস,পিষছে প্রজা শাসন যন্ত্রে,
    আমরা কিন্তু বুকে রেখে হাত,শপথ নিচ্ছি প্রজাতন্ত্রে।

    ছাব্বিশ দিলো চওড়া ছাতি, কিন্তু নীচে রক্তের ছাপ,
    শাঁখের করাত দিচ্ছে দেখো,এগিয়ে যাওয়ার সে অভিশাপ।
    বলছি দেখো সবাই রাজা ,নিজেই খুঁজে নিচ্ছি মরণ,
    চাপছি শুধু পেটের তাগিদ, বলছি না ঠিক কোনটা কারন।

    আমিও সেই সবার মতোই, পরছি বসে পংক্তি ভোজে,
    মধ্যবিত্ত মনটা কিন্তু কমদামে তেই স্বস্তি খোঁজে।
    শিরদাঁড়াটা হচ্ছে নরম ভুলটা দেখে বলছি হেসে,
    নতুন দিনের সূর্য দেখো উঠবে আবার আমার দেশে।

    যারা জানে ভাতের গন্ধ তাদের থালায় খেলছে বায়ু,
    নতুন দিনটা অনেক দূরে ,পৌঁছতে হয়তো ফুরাবে আয়ু।
    নকল রাজার আশ্বাসে তাই রোজ ছুঁটে যাই ত্যাগের মন্ত্রে,
    ফিরেও আসি শূন্য বুকে ভরসা থাকুক প্রজা তন্ত্রে।

    ভরসা বুলি আউড়িয়ে দিন ,যাচ্ছে যাক না যেমন যাবে,
    যাচ্ছি পুঁতে বাবুল গাছটা, কাঁটা ছাড়া ফুল ফুটবে কবে।
    রাত প্রতি রাত বিক্রি বাড়ে , বিবেক শরীর অন্ধকারে,
    তবুও বুকে তিনরঙা দিন ,অভিবাদনের সেলাম করে।

    রাজা পাল্টায় ,মন্ত্রী বদল,প্রজা চিরকাল একই থাকে,
    জনতা আজও পেষা মশলায় ,নিজেকে কেমন আটকে রাখে।
    হরেক কিসিম ফন্দি ফিকির ,বিভেদ গুলোও বিভ্রান্ত,
    আমি দেখছি বাড়ছে বয়স, হচ্ছে বুড়ো প্রজাতন্ত্র।

  • কবিতা

    কবিতা- ফিরবেনা

    ফিরবেনা
    -অযান্ত্রিক

     

     

    সব সেলামের ,কিছু গল্প থাকে,
    ভয়েতে ভক্তি , কিছু অল্প থাকে।
    দেখোন হাসির জানি বাজারটা খুব
    ফায়দা লোটার লোভ ,সেটাই অসুখ।
    ভুগছি আমি তুমি ,ভুগছে সবাই,
    ছেলেটা হারিয়ে গেছে ,ফিরবেনা তাই।

    ঢেকেছি মূর্তি ছবি,ঢেকেছি মালায়,
    অভিনয় জারি জুড়ী শাসন চালায়।
    মিছিলে হেঁটে হেঁটে প্রচারই করি,
    বোকা লোক ভাবে সেটা, প্রভাতফেরী,
    শিরদাঁড়া নেই আজ থাকে বাঁধা হাড়,
    ছেলেটা হারিয়ে গেছে ,ফিরবেনা আর।

    কেতাবি ধারণা বুলি মঞ্চের থেকে
    ছুঁড়ে দিই মিথ্যে জনতার দিকে।
    আমার ভক্তি শুধু ধরতে বাজার
    দেশকে মা বলে ডাকছিনা আর
    যেখানে ক্ষমতা দেখি সেই দিকে যাই,
    ছেলেটা হারিয়ে গেছে ,ফিরবেনা তাই।

    স্বাধীন অথচ বাঁচি বন্দী দশায়,
    প্রতিবাদী নাম বদলায় দ্রোহিতায়
    নেতা অভিনেতা খুনে ফারাকবিহীন,
    ঘন কালো রাত দেখে বলছি সুদিন।
    দেখি জানি বুঝি তবু চুপ যে সবাই
    ছেলেটা হারিয়ে গেছে ,ফিরবেনা তাই।

    ফিরছে না ,সেই ভালো ,ফিরলে মরণ
    আদপে দৈত্য সব দেবতা গরণ।
    জাত ভাষা ধর্মের বিভেদের পরে,
    লড়ে যাই নিজেরাই দেশখানা মরে।
    পাশে আছি বাঁশে আছি বলছি সবাই,
    ছেলেটা ছেড়েছে দেশ, ফিরবেনা তাই।

  • কবিতা

    কবিতা- তাপ্পি

    তাপ্পি
    -অযান্ত্রিক

     

     

    সে সব ছুটির দিনে ,
    পরিষ্কার মনে স্মৃতির মেঘ করে আসে,
    সকালের নাবিকেরা ,
    পসরা সাজায় রোজগারের বাজারের,
    একলা বারান্দায়,
    গতকালের শুকোতে দেয়া শাড়ি কাপড়,
    পা ছড়িয়ে বসে,
    যেন কলঙ্কিনী মেয়ে ,অবসর প্রাপ্ত প্রেমিকা।
    রাস্তার সাথে রয়েছে সাবেকি পরিচয়,
    ব্যাস্ত নাটার চায়ের দোকানে,
    বুদ্ধিজীবী ভিড় হাত নাড়ে,
    রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া প্রাক্তন প্রেমিককে,
    চায়ের পেয়ালায় জমায় দীর্ঘশ্বাস,
    ধোঁয়ার আড়ালে।
    চুম্বনের কথা ছিলো যৌবনে,
    এখন আর নেই,
    মেঘের চুমু থাকে না, কান্না থাকে,আর থাকে ভয়,
    পাছে বিচ্যুতির খাতিরে বন্ধ হয় দানা পানি।
    সান্নিধ্যের চুক্তিতে শেষ আছে ,
    অবশেষ নেই,
    কালকের কেমন আছো গুলো, আজ শুধু দ্যাখে,
    আছি কিনা, বেঁচে আছি কিনা,বিবাদের তালিকায়,
    সে সব ছুটির দিনে ভালোবাসা দেখা করতে আসে,
    আর কেউ আসে না।আরকেউ ভালো বাসে না।

  • কবিতা

    কবিতা- রঙের ফেরা

    রঙের ফেরা
    – অযান্ত্রিক

     

     

    ভোর কুয়াশার আড়ালে থেকে,
    বছর বাইশের অল্প রোজগেরে ছেলেটা,
    খবর কাগজ বিলির ছুতোয় দেখতে আসে,
    বারান্দায় শুকোতে দেয়া মেয়েটার লাল ওড়না,
    ও কি বিপ্লব ভালোবাসে নাকি উদ্দাম প্রেম!
    রক্তক্ষয়ী বিপ্লব কি কোনো প্রেমের গল্প নয়?

    দিনের বয়স বাড়লে, দলে দলে মাথা ছুটে যায় বাসায়,
    কালো ব্যাগ, খালি টিফিন বাক্স, বনগাঁ লোকাল, ভিড়,
    অথবা, পাখসাটে পালকের গান পাখিদের কিচিরমিচির,
    সব ওই চিতায় ওঠা সূর্যের লাল রঙের নিদাঘি ঘোষণা,
    এওকি নেহাতই ফেরার কথা, নাকি লাল রংপ্রিয়তা?
    সারাদিনের বাহারি রঙের মিশেলে, চাল আটা কিনে,
    বাসায় ফেরা প্রতিটি মানুষ কি রঙের কাছে ফেরা নয়,

    জানি এখনো রাত গভীর হলে, নিশাচর জীব,
    ঘুরে বেড়ায় পাড়ায় পাড়ায়, কাঁধে বন্দুক, মুখে
    গামছার পর্দা, লাল, লাল রক্তের রঙে, জানে,
    মুহূর্তের পট বদলে অলি গলি থেকে রাজপথে,
    লুটিয়ে পড়বে মাংসল শরীর, পরিচয় হীন দাবী হীন,
    সঙ্গী থেকে যাবে, গামছা আর তার লালচে আভা,

    ঘুমিয়ে পড়া চাদরের খুঁটে বেঁধে নিয়ে, চাহিদার ফর্দ,
    ফিরে আসছি মনের নিশুতি পাড়ায়, একা একা।
    এইতো পেরিয়ে এলাম নাটার চায়ের দোকান, শুনশান,
    আরেকটু এগোলেই বিধুদার মুদিখানা, এখন ঘুমন্ত,
    সকালে জাগবে, দৈনিক সরবরাহ দেহ ফিরে পাবে।
    হঠাৎ শিরশিরানী বাতাসের ভরে ভেসে আসে স্বর,
    “ওহে চরণ একখানা বিড়ি আর একটু আগুন হবে?”
    তোমরা শুনতে পাচ্ছো না? আমি কিন্তু শুনতে পাচ্ছি
    “কমরেড”

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক গল্প- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)

    পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)
    -অযান্ত্রিক

    মুখে জলের ছিটে লাগতেই জ্ঞান ফিরলো অরিত্রর। জ্ঞান ফিরতেই, উঠে বসে দেখলেন, অরিত্র নিজের ঘরের বিছানাতেই আছেন। মোহনা, মোহনা, মোহনা কোথায়? ও ঠিক আছে তো?
    “যাক ঘুম ভাঙলো আপনার মহারাজ” চেনা কণ্ঠের স্বরে ফিরে তাকাতেই অরিত্র দেখলেন চা-এর ট্রে হাতে ঘরে খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। আর খাটের থেকে একটু দূরে মেঝেতে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। অরিত্রও তার দিকে তাকাতেই সে বললো “অপরাধ মার্জনা করবেন হুজুর, অনেকক্ষণ আপনার জ্ঞান আসছে না দেখে আমিই গঙ্গা জল ছিটালাম।”
    “সে ঠিক আছে, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না, আর খামকা আপনি আমাকে হুজুরই বা বলছেন কেন?” অবাক হয়ে বললেন অরিত্র। “তুমি ওনাকে চিনবে না অরিত্র, উনি হচ্ছেন বংশী ও আমাদের সবার শীতলদাদা। উনি নিজেই আজ সকালে বংশীদের সাথে এসেছেন আমাদের সাথে দেখা করতে, উনি সব জানেন কাল রাতের ঘটনার ব্যপারে। উনি সব বলবেন, তুমি একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসে শুনবো” বললেন মোহনা। অরিত্র কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চা শেষ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বাথরুমে চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।
    একটু বাদেই খাবার টেবিলে ওরা দুজনে পৌঁছে দেখলেন, টেবিলের উপর বড় বড় পেতলের পাত্রে ফুলকো ফুলকো লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল বেগুন ভাজা, মিষ্টি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। দেখে অরিত্র চনমন করে উঠে বললেন, “বাবা এতো কিছু সকালে! যাক, দাও দাও পেটের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে কাল রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি, আর শীতলদাদা কোথায়, উনি খাবেন না?”
    “হ্যাঁ হ্যাঁ হুজুর, কেন খাবেন না তবে শীতল দাদা এসব খায় না , আপনি বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি” বলল বংশী।
    “ওমা দাদা বাবু থেকে হুজুর হয়ে গেলাম কি করে গো বংশী দাদা?” বললেন অরিত্র।
    “আজ্ঞে এই কারণে, হুজুর” শীতলদাদা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে অরিত্রও খেয়ালই করেন নি শীতল দাদার হাতে একটা বাঁধানো অয়েল পেন্টিং, আর তাতে সম্পূর্ণ রাজ পোশাকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে, যাকে অবিকল অরিত্রর মতই দেখতে। অরিত্রর চোখের সামনে আবার ভেসে উঠলো গতরাতের পুরো ঘটনা, আর এই সেই ছেলে যাকে মহারাজ নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে ছিলেন। “এই বাড়ি এতদিন আপনাদেরই অপেক্ষায় ছিল হুজুর, আজ পর্যন্ত বহুলোক এই বাড়ি কিনেছে কিন্তু ভোগ করতে পারে নি, কেউ এক রাতেই পাগল হয়ে গেছে নয়তো মারা গেছে। এই বাড়ি আর মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহের আত্মা এতদিন অপেক্ষা করছিল তার বংশজকে তুলে দেওয়ার জন্য। কাল বংশী ফিরে গিয়ে আমায় আপনাদের বিবরণ দিতেই আমি এই ছবিটা দেখাই, দেখাতেই ও জানায় আপনাকে অবিকল শৈল বিক্রম সিংহের ছেলে আদিত্য বিক্রম সিংহের মতো দেখতে। শুনে ভোরের আলো ফুটতেই চলে এসেছি হুজুর আমার শেষ দায়িত্ব পালন করতে..” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই হাঁপাতে লাগলো শীতলদাদা।
    “শেষ দায়িত্ব মানে, তুমি এসব কি বলছ শীতল দাদা” আঁতকে উঠলেন মোহনা।
    “হ্যাঁ, শেষ দায়িত্বই গিন্নিমা, কাল রাতে আপনারা যে নব্বধুর সাজে এই বাড়িকে দেখেছেন, সেই মোটা মোটা কার্পেট, ঝাড়বাতি আসবাব সে সব তুলে দিতে হবে বৈকি মহারাজের হাতে। ওটাই তো আমার দায়িত্ব, এত বছর ধরে যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এই প্রাসাদ, এই নিন গিন্নিমা চাবি। ঐ সিঁড়ির ঘরের চাবি সব অক্ষুন্ন আছে আজও। অরাও অপেক্ষায় আছে গত ষাট ষাটটা বছর।“ বলে একটা তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে অপূর্ব কারুকার্য করা একটা চাবি এগিয়ে দিলো মোহনার দিকে। মোহনা চাবিটা হাতে নিয়ে বললেন, “এখন দিচ্ছো দাও কিন্তু এর পরেও এসবের দায়িত্ব তোমাদেরই থাকবে শীতলদাদা”
    এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলেন অরিত্র, “এসব কি হচ্ছে আমায় একটু খোলসা করে কি কেউ বলবে? কি ব্যাপার বলো তো শীতল দাদা?”
    “তেমন কিছুই না হুজুর, এই প্রাসাদ বানিয়ে ছিলেন মহারাজ রবীন্দ্র বিক্রম সিংহ, তাও আমার দুই পুরুষ আগে, তখনও ইংরেজরা এদেশে আসেনি। তার ছেলে হলেন মহারাজা শৈল বিক্রম সিংহ, তিনিই যদিও প্রকৃত অর্থে এই প্রাসাদের শোভা বৃদ্ধি করেন। তিনি ছিলেন খুবই শৌখিন, কিন্তু প্রচণ্ড পরাক্রমী আর উনি ইংরেজদের একদম সহ্য করতে পারতেন না যদিও ইংরেজ সরকার ছলেবলে কৌশলে ওনার কাছ থেকে এই রাজ্য হাতিয়ে নিতে চাইছিল। তার ছেলে ছিলেন আদিত্য বিক্রম সিংহ, আমাদের ছোটো রাজা। রাজা হলেও তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ আর নরম প্রকৃতির। আর ঘটনা চক্রে, আমাদের ছোট রাজা এখানকার ইংরেজ শাসকের মেয়ের প্রেমে পরে যান। যদিও ঐ ইংরেজ অফিসার চাইতো কোনোভাবে বড়রাজা আর ছোট রাজাকে মেরে এই অঞ্চলের দখল নিতে। কিন্তু কোনো ভাবে সুবিধা করতে না পেরে, একটা চাল খাটিয়ে বড় রাজাকে দিয়ে ছোট রাজাকে বন্দি করালেন। ওনাকে বোঝালেন, যে ছোট রাজা নাকি বড় রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বড় রাজা যদিও খুব ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। উনি ছোট রাজা আর ঐ ইংরেজকে সামনাসামনি এনে ফয়সালা করতে দুজনকেই এক জায়গায় আনলেন। কিন্তু ঐ ইংরেজ অফিসার আসার সময় কিছু সৈন্য নিয়ে আসে লুকিয়ে। রাজবাড়িতে এসে, সাধারণ পোশাকে ছোট রাজাকে দেখে ঐ ইংরেজ অফিসার আবেগ সামলাতে না পেরে সত্ত্যি কথা বলে ফেলেন আর উত্তেজনায় ছোট রাজার ওপর গুলি চালিয়ে বসেন। সেইখানে ছোট রাজা আদিত্য বিক্রম সিংহের মৃত্যু হয়। রাগে, দুঃখে মহারাজ সেই সৈন্য সমেত ইংরেজ অফিসার আর তার মেয়েকে কচুকাটা করে ফেলে দেন জঙ্গলে। তার কিছুদিন পরেই সন্তান হারানোর শোকে যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ। সেই থেকে এ বাড়িতে কেউ থাকে না। কিনেছে বহু লোকেই কিন্তু বাস করতে পারে না কেউই।”
    মোহনা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন, শীতল দাদার কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন, “চলো বংশীদাদা, আমরা ঘরটা খুলে দেখি। তারপর না হয় আবার এই বাড়িটাকে আগের মতো করেই সাজানো যাবে, চলো..”
    মোহনা, শিতলদাদা, অরিত্র আর বংশী টেবিল থেকে উঠে সিঁড়ির ঘরের দিকে গেলো। সেই ঘরটার সামনে, মোহনা চাবিটা বংশিকে দিয়ে বললেন, “তুমিই খোলো বংশী দাদা” বংশী চাবিটা ফেরত দিয়ে বললো “এই বংশের লোক ছাড়া কারো হাতে যে এ তালা খোলে না গিন্নিমা, আপনাকেই খুলতে হবে” অরিত্রও এগিয়ে এসে তালায় চাবিটা ঢোকাতেই তালাটা নিজে নিজেই খুলে গেলো আর সে সাথে দরজাটাও অদ্ভুত একটা শব্দ করে খুলে গেলো। অরিত্র আর মোহনা ঘরে ঢুকে দেখলেন কাল রাতে যা যা আসবাব আর জিনিষ দেখেছে সব এখানে আছে আর দেওয়ালে আছে একটা ছবি হাতে আঁকা নয় ক্যামেরায় তোলা। অরিত্র ছবিটা হাতে নিয়ে বাইরে এসে দেখলেন ছবির ব্যক্তিটি আর কেউ নয় শীতল দাদা, তলায় লেখাও আছে নায়েব শীতল মজুমদার, জন্ম ১৮২২ মৃত্যু ১৯০১ আর তার পাশে আরও এক ভদ্রলোক নাম বংশী মজুমদার জন্ম ১৮৪২ মৃত্যু ১৯০১। অরিত্র আর মোহনা দুজনে চিৎকার করে ডাকলেন, “শীতল দাদা আ আ আ আ, বংশী দাদা আ আ আ আ”
    সারা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেদ করে চলে গেলো ডাকগুলো কোন সাড়া এলো না তার বদলে, বাড়ির বাইরে কয়েকটা গাড়ি এসে থামার শব্দ এলো, আর কেউ যেন দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল “হ্যালো, মিস্টার অরিত্র সোম, আপনারা কি বাড়িতে আছেন?” অরিত্রও এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
    একজন নীল রঙের ইউনিফ্রম পরা ভদ্রলোক নমস্কার করে জানালো, “স্যার, আমরা রিবিল্ট ইন্টারন্যাশানাল থেকে আসছি । আমাদের যদিও পরশু আসার কথা ছিল, কিন্তু রাস্তায় ধ্বস নামায় আটকে পরে ছিলাম। ফোনেও নেটওয়ার্ক ছিল না। আমদের সঙ্গে মোহনা সোমের এগ্রিমেন্ট হয়েছিলো হসপিটালিটি অ্যান্ড হাউজ কিপিং ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে। অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন। “
    অরিত্র পিছনে ফিরে মোহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানে?”
    তখনও টেবিলে আলুরদম লুচির থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক গল্প- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৩)

    পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৩)
    – অযান্ত্রিক

    অরিত্র ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দরজা বন্ধ করে উপরে উঠে এসে দেখলেন, মোহনা ভয়ে কুঁকড়ে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অরিত্র ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মোহনাকে। ভয়ে আতঙ্কে মোহনার সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আর মুখ দিয়ে গোঙানোর শব্দ হচ্ছে। “মোহনা, এই মোহনা, কি হয়েছে?মোহনা” অরিত্রর ডাকে আর ঝাঁকানিতে মোহনার একটু সম্বিৎ ফিরলো। “কি হয়েছে? অমন করছো কেন?”
    গলায় একরাশ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে, মোহনা বললেন, “অরিত্র.. অরিত্র আমাদের আজই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে, এই বাড়ি ভালো নয়..”
    “মানে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলে নাকি, কি হয়েছে একটু পরিস্কার করে বলবে?” মোহনাকে শান্ত করতে করতে বললেন অরিত্র।
    “তুমি নীচে যেতেই আমি একটু ওয়াশ রুমে গেছিলাম, ফ্রেশ হয়ে সেখান থেকে ফিরতেই দেখি একটা বছর পনেরোর মেয়ে দরজা দিয়ে ছুটে এসেই ঘরে এই দেরাজের ভিতর গিয়ে লুকালো, আমি এসে দেরাজ খুলে দেখি কেউ তো নেই । আর এই মেয়েটাকেই আমি দুপুরে স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি আর এখানে থাকব না প্লীজ চলো এখান থেকে” খুব ভয়ার্ত গলায় বললেন মোহনা।
    “ওসব কিছু না, তুমি অত্যাধিক ক্লান্ত তাই ওসব হেলুসিনেট করেছো” আশ্বাস দিয়ে বললেন অরিত্র, ”চলো রাতের খাবার খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”
    ঠিক তখনই, নীচে সদর দরজায় খুব জোরে ধাক্কানোর একটানা শব্দ হতে লাগলো। অরিত্র নীচে যাবে বলে উঠতেই মোহনা জড়িয়ে ধরে বললেন, “নানা তুমি একা যাবে না আমিও যাবো,” “/অরিত্র আপত্তি করলেন না। দুজনে দরজা খুলে বাইরে আসতেই, দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ ছাপিয়ে ওদের কানে এসে পৌঁছাল আরও একটা শব্দ ঢং ঢং ঢং, কোন দেওয়াল ঘড়ির শব্দ। কোনো ঘড়িতে যেন বারোটা বাজলো, মোহনা মোবাইলে দেখল সত্যিই বারোটা বাজে। কিন্তু সারাদিনে এ বাড়িতে ঘোরাঘুরিতে কোনো পেন্ডুলাম ঘড়ি তো চোখে পড়েনি! দুজনে দুজনের মুখ চাওয়াচায়ি করে তাড়াতাড়ি বাইরে করিডোরে আসতেই দুজনের বিস্ময়য়ের সীমা পরিসিমা থাকল না।
    দুজনেই দুজনের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখছে এ তো কিছুক্ষন আগে দেখা ঘরের সাথে কোন মিল নেই। কিছুক্ষণ আগেই যে ছবি মোহনার কল্পনায় ছিল সেটা বাস্তবে সামনে দেখবে মোহনা ভাবতেই পারছে না। দোতলার পুরো করিডোর জুড়ে যেখানে একটু আগেও ছিল ধবধবে সাদা মারবেলের মেঝে সেটা এখন মেরুন আর সোনালী কারুকার্য করা মন মুগ্ধকর বিদেশী কার্পেটে ঢাকা পরে গেছে। দেওয়ালে লাগানো হাল ফ্যশানের আলোগুলোকে সরিয়ে,জায়গা করে নিয়েছে চার মোমবাতির ছোটো ছোটো ঝাড়বাতি। করিডরের রেলিঙটাও সেজে উঠেছে বিদেশী ফুল আর অর্কিড রাখা পিতলের পটে। দু’টো সিঁড়িই ঢাকা আছে লাল রঙের গালচে দিয়ে, এক নজরে ওর দুজনেই হকচকিয়ে গেলো, এ কোথায় এসে পড়লো ওরা। মোহনা আরও ভয় পেয়ে খামচে ধরলো অরিত্র-র কাঁধ। অরিত্র নিজেও এমন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে যে কোনো কথা বলতে পারছে না। শুধু এক পা এক পা করে নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে নিজের অজান্তেই। সিঁড়ির সামনেটায়, যেখান থেকে নীচের পুরো হলঘরটা দেখা যায় সেখানে এসে দুজনেই একদম বাকরুদ্ধ হয়ে পরল। সেই খালি ড্রয়িংরুম এখন আর খালি নেই। ওদের পেতে রাখা ছোট ছোট কার্পেটের জায়গায় একটা বিশাল মোটা আর বড় কাশ্মীরি জাজিম জায়গাটাকে এক রাজদরবার করে তুলেছে। ছাদ থেকে মোটা পেতলের শেকলে ঝুলছে বিশাল এক ঝাড়বাতি যার আলো রাতটাকে একেবারে দিন করে ফেলেছে। আস্তে আস্তে দুলছে একটা দড়ি টানা পাখা। পাশে কোন একটা ঘরের থেকে নাচ গানের আওয়াজ আসছে। হলের ভিতরে উর্দি পরা বেয়ারা, সবাইকে পানীয় পরিবেশন করছে। অতিথিদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজনে যেন কোনো টাইম মেশিনে করে ইতিহাসের কোনো সময়ে পৌঁছে গেছে। অনেক সাহসে ভর করে, অরিত্র আর মোহনা নীচে নেমে এসে দেখলেন ঘরের দেওয়ালগুলো বড় বড় হাতে আঁকা তৈলচিত্রে ঢাকা পরে গেছে, ঠিক যেমনটা করার কথা মোহনা ভেবেছিলেন। দুজনেই দুজনের হাত আঁকড়ে ধরে দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে, অরিত্রর মনে হচ্ছে যেন একটা হিম শীতল রক্তের স্রোত নেমে আসছে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। অরিত্র আর মোহনা এমন তন্ময় হয়ে দেওয়ালে লাগানো ছবিগুলো দেখছিল যে ওরা লক্ষ্যই করে নি, যে এক জন বেয়ারা, ওদের দিকে এগিয়ে এসেছে। ওদের দিকে পানীয়র ট্রে-টা এগিয়ে দিয়ে “স্যার, আপনারা কি কিছু নেবেন?” বলতে চমকে উঠলেন দুজনেই। মোহনা বেয়ারার কথা শুনে ট্রে-র দিকে তাকাতেই দেখলেন, একটা সুক্ষ্ম কারুকার্য করা রুপোর গেলাসে লাল রঙের কোনো তরল আছে, ওয়াইন হতেও পারে। ওরা কিছু উত্তর দিচ্ছে না দেখে বেয়ারা জানালো, “খাবার ঘরে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে, আপনারা চাইলে গিয়ে খেয়ে নিতে পারেন।” অরিত্র-র ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ওরা যা দেখছে সেটা বাস্তব কোনও মতেই না, তবে কি কোন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? ওদের সাক্ষী রেখে, নাকি এই বাড়িটা ওদের কিছু জানাতে চাইছে।
    এমন ভৌতিক ঘটনার সামনাসামনি ওরা দুজনেই কোনোদিন হয়নি, তবে আধুনিক মননশীল চিন্তাধারায় কিছুতেই এই চোখের সামনে চলতে থাকা ঘটনার কোনো ব্যখ্যা করতে পারছেন না। অরিত্র ঠিক করলেন মোহনাকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়িটা ছেড়ে বেড়িয়ে যাবেন, কিন্তু পারলেন না। একজন সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে এলো, আর খুব বিনীত ভাবে জানতে চাইলো, “মাফ করবেন আমি একটু ওদিকে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করিনি, আপনাদের কোন আসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনারা খেয়েছেন? খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে।” অরিত্র ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন, আরে এই মুখ তো তার খুব চেনা, একটু আগেই দেওয়ালে টাঙ্গানো বিশাল ছবিটায় ওরা দুজনেই দেখেছেন। নীচে পরিচয়ও লেখা ছিল মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ, এই বাড়ির মালিক, অরিত্র বেশ বুঝতে পারলেন কাঁধের উপর মোহনার খামচে ধরা হাতের জোর আরও বাড়লো। মোহনাও খুব ভয় পেয়ে গেছে, এবার মোহনার নখগুলো মনে হয় বসে যাচ্ছে চামড়ার উপর, অরিত্রর নিজের অবস্থাও ভালো নয় সারা শরীর একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় ঝিমঝিম করছে। অরিত্র ওনাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই একজন লোক এসে জানাল মেজর টেশলা এসে পরেছেন, মহারাজ অরিত্রর দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে “মাফ করবেন” বলে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। বেশী দূর যেতে হলো না তার আগেই পুরোদস্তুর সামরিক পোশাকে এক ইংরেজকে ঢুকতে দেখল অরিত্র, সাথে একটা মেয়ে, বছর পনেরোর হবে। কিন্তু মেয়েটার মুখটা যেন দুঃখে, কষ্টে একদম লাল হয়ে আছে আর গালে আঙ্গুলের দাগও আছে। একটু কাছে আসতেই অরিত্রর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো, ওমা মেয়েটাকে দেখতে অবিকল মোহনার মতো। এটাও বুঝতে পারলেন মোহনা নিজেও চমকে উঠলো। ঐ ইংরেজ ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখে মাহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ আন্তরিক অভ্যর্থনা করে বললেন, “ওয়েলকাম মেজর টেশলা ওয়েলকাম, আই এ্যম ভেরী হ্যপ্প্যি টু শী ইউ হিয়ার..”
    “থ্যাঙ্ক ইউ রাজা, থাঙ্ক্যউ ফর দ্যা ইনভাইটেশন, লুক হামি, আমার লড়কিকে লিয়ে এসেছি, মিট মাই চাইল্ড ‘বেলা’, ইজাবেলা, হোপ ইয়উ ডোন্ট মাইন্ড। বাই দ্যা ওয়ে, হ্যভ ইউ ডান দ্যা জব?” জানতে চাইলো মেজর টেশলা
    “নো নো , নো ইস্যু এট অল, আমি আমার কাজ করেই রেখেছি এজ ইউ সেড, উপরেই রাখা আছে ছেলেটিকে “গো অপ স্তেয়ার অ্যান্ড গেট হিম“ বেশ সহজ ভাবেই বললেন রাজা শৈল বিক্রম সিংহ।
    “ওকে, ওকে, রাজা হামি উহাকে ব্যবস্থা করিয়ে এসে খানাপিনা করবে এনজয় করবে। উহাতে কোন আপত্তি নেই তো রাজা” জানতে চাইলেন মেজর টেশলা।
    “এজ ইউ উইশ, গো এন্ড গেট হিম, এইই কে আছিস মেজরকে সিঁড়ির ঘরে নিয়ে যা” বললেন মহারাজ আর তার কথায় দুজন তলোয়ার হাতে বরকন্দাজ মেজরকে সিঁড়ির ঘরে দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। মহারাজ আর অরিত্ররাও পিছন পিছন গেলো। ঘরের দরজা খুলতেই অরিত্র দেখল ঘরের ভিতরে একটা সুপুরুষ চেহারা ছেলে বসে আছে, আর সেই ছেলেটাকে হুবহু অরিত্র মতই দেখতে, অরিত্রর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তাহলে কি! কিন্তু ওর কিছু করার আগেই মেজর টেশলা তার কোমরে খাপ থেকে রিভলবার বার করে তাক করল ছেলেটার দিকে। ট্রিগারটা টানতে যাবে, ঠিক এমন সময় পিছন থেকে সিংহের মতো গর্জে উঠলেন মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ,
    “সাবধান মেজর, আমার রাজ্যে কাউকে শাস্তি দেওয়ার আগে, জানাতেই হবে অপরাধীর অপরাধটা ঠিক কি?”
    মেজরের হাতটা একটু কেঁপে গেল, রাগে অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল, দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,”দিশ নেটিভ লড়কা একটা ব্রিটিশ লড়কির সাথে প্রেম করিয়াছে, আর সেই অপরাধে উহাকে মরতে হবে।”
    “বাঃ, প্রেম করেছে তো, খারাপ কিছু তো করে নি, তার জন্য ওদের বিয়ে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু মেরে ফেলতে হবে এমন কথা কোথায় লেখা আছে? আর যদি মরতেই হয় তাহলে ছেলে মেয়ে দুজনকেই মরতে হবে, একা ছেলেটা মরবে সেটা তো হতে পারে না।” মুখে একটা ক্রূর হাসি নিয়ে বললেন মহারাজ। বলেই মেজর টেশলার মেয়ের দিকে ওনার রিভলবার তুলে ধরলেন। “অ্যান্ড মেজর ইউ নো ভেরী ওয়েল আই নেভার মিস এনি টার্গেট। ডু ইউ থিঙ্ক উই ইন্ডিয়ান্স আর ইয়োর স্লেভ, ইফ ইয়েশ দ্যন ইউ আর লিভিং ইন আ ফুলস ওয়াল্ড..’
    কথাগুলো যেন রাতের জঙ্গলে পশুরাজের গর্জনের মতো শোনাল, মেজর চমকে উঠলেন, কিন্তু পর মুহুর্তে দ্বিগুণ রাগে লাল হয়ে উঠলো তার চোখ মুখ। এমন ভাবে ছটফট করতে লাগলেন যেমন খাঁচায় বন্দি ইঁদুর করে। বিপদ বুঝতে পেরেই “নোওও” বলে চিৎকার করে ইজাবেলা দৌড়ে উঠে গেলো দোতলায় ঠিক যে ঘরটায় একটু আগেই অরিত্র আর মোহনা ছিলেন। ঠিক যেভাবে মোহনা দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগে। মহারাজ শৈল বিক্রম বললেন “এই কে আছিস ধরে নিয়ে আয় মেয়েটাকে, দেখিস যেন পালাতে না পারে। আর মেজর, ছেলেটাকে কিছু করার মনে রেখো, ছেলেটা কিন্তু মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহের ছেলে, তোমাদের একজনকেও এখান থেকে বেঁচে ফিরতে দেবো না।” কিন্তু মহারাজের কথা সেই রাগে অন্ধ শ্বেতাঙ্গের কানে গেলো না, নিমেষের মধ্যে গর্জে উঠলো তার হাতের বন্দুক। একটা গগনবিদারী আর্ত চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটি, বলির পাঁঠার মত ছটফট করতে করতে শান্ত হয়ে গেল রক্তের বন্যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে অরিত্র বুঝতে পারলেন কাঁধের উপর খামচে ধরা মোহনার হাতটা আলগা হয়ে গেল। চোখের নিমেষে ঘটনার গতি প্রকৃতি বদলে গেল দেখে অরিত্র কি করবে বুঝে উঠতে পারলেন না। পিছনে ফিরে দেখলেন মোহনা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। অরিত্র মোহনাকে জড়িয়ে ধরে তুলে যাবেন এমন সময় মহারাজের লোকেরা সেই মেয়েটাকে ধরে নিয়ে এলো ততক্ষণে মেজরকেও অন্য লোকেরা বেঁধে ফেলেছে। “এদের জন্য দু’টো কার্তুজ খরচ করার কোন মানে হয় না” বলে মহারাজ বন্দুক ছেড়ে একজনের হাতের থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিলেন মেজরের আর পরের কোপটা মেয়েটাকে দিতে যাচ্ছেন এমন সময় কেউ একজন এসে বলল “মহারাজ মেজর জনা কুড়ি সৈন্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন, গুলির শব্দে তারা ভিতরে আসছে” মহারাজ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন “আসতে দে, আর দেখিস একটাও যেন বেঁচে ফিরতে না পারে, বিরাজ, সবাইকে নিয়ে বাইরে গিয়ে দ্যাখো, আমি এটাকে সাবার করে আসছি” বলেই হাতে ধরা রক্তাক্ত তলোয়ারটা সোজা নামিয়ে দিলেন ইজাবেলার গলায়, সঙ্গে সঙ্গে ধড় থেকে মাথাটা ছিটকে এসে, পড়লো অরিত্রর পায়ের সামনে। বাইরে তখন অবিরাম গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার, মহারাজ তলোয়ার হাতেই বেড়িয়ে গেলেন বাইরে, তাজা গরম রক্তের স্রোতে ডুবে যেতে লাগলো অরিত্রর দুই পা। এতো চিৎকার, রক্ত দেখে চূড়ান্ত ভয়, উত্তেজনায় অরিত্রও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

You cannot copy content of this page