• কবিতা

    কবিতা- তোমার মধ্যে থাকবো মিশে

    তোমার মধ্যে থাকবো মিশে
    – উজ্জ্বল দাস

     

     

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    তোমার সঙ্গে ঝগড়া করবো।
    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    তোমার মনের পাহারা দেবো।
    যাত্রাপথের মালিক হবো।
    কেউ যদি বা ঢুকতে চেয়ে
    মনের পাঁচিল বেয়ে ওঠে-
    তার সঙ্গে কুস্তি লড়ে।
    একাই তাকে হারিয়ে দেবো।

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    নীল আকাশের সূর্য হবো
    সূর্য হয়ে তোমার শরীর
    আলোয় আলোয় ছুঁয়ে দেবো।
    অন্ধকারকে ঢেকে রেখে
    একা একা দেখবো তাকে
    বিকেল হওয়া আটকে দেবো
    আটকে দেবো সন্ধ্যেটাকে।

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    তোমার চোখের কাজল হবো।
    কাজল হয়ে লেপ্টে গিয়ে
    পলক বেয়ে পড়বো ঝরে।
    তোমার রন্ধ্রে বাঁধবো বাসা
    মনের মত কপাল ছোঁবো।
    কপাল ছুঁয়ে উষ্ণতাটা
    এক নিমেষে বাড়িয়ে দেবো।

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    হবো তোমার ফুচকা ওয়ালা।
    ফুচকাগুলো তোমায় দিয়ে
    তোমার জিভের সঙ্গ নেবো।
    তোমার থেকে পয়সা নিয়ে
    তেঁতুল জলে থাকবো মিশে,
    মানতে যদি না চাও তুমি
    কলঙ্ক বা থাকবো বিষে।

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে
    তোমার গায়ের গন্ধ হবো।
    গন্ধ হয়ে অগ্নি কোনে
    নৈঋতের সু-গন্ধ নেবো।
    সবার যখন ঘ্রাণ শক্তি
    তোমার পানে আসবে ধেয়ে
    সবার ঘ্রানের বাঁধা হয়ে
    হাওয়ার ধুলোয় মিশে যাবো।

    এবার যুদ্ধে জিতে গেলে…

    “থাক না, এবার আমি বলি”,

    তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যাবো
    যুদ্ধে গিয়ে আসবো জিতে।
    নীলাভ ওই জামার সাথে
    হবো তোমার গ্যালিস ফিতে।

    থাকবে তুমি থাকবো আমি
    ছেঁড়া জামার বোতাম হয়ে।
    তোমায় আমি, আমায় তুমি
    অভ্যাসেতে থাকবো দুজন,
    মনের খবর পড়ে নিয়ে
    তোমার মধ্যে থাকবো মিশে।।

    তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যাবো
    যুদ্ধে গিয়ে আসবো জিতে।

     

  • গল্প

    গল্প- ঊন পঞ্চান্ন

    ঊন পঞ্চান্ন
    – উজ্জ্বল দাস

     

     

    কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে টলতে টলতে তিনি ঢুকলেন। পুজোয় বসবেন। কি মূর্তি বা কোন ঠাকুরের পুজোতে বসবেন সেটা জানেন না অবিনাশ বাবু। সে যাই হোক, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কোন একজন হবেন নিশ্চয়ই। মদ্দাকথা কাজ হলেই হলো। মানে ঠাকুরও ঘুষ খায় তাহলে! এটা বুঝেছে অবিনাশ সিনহা। ছেলেটার মাথা একদম গেছে ইদানিং। একটুও কথা শুনছে না। এই উনিশেই বিয়ে পাগলা হয়ে উঠেছে। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে একটা জালি মেয়ের খপ্পরে পরে কি যাতা অবস্থা। বলছে আজ- কালই নাকি ওকে পিঁড়ি কিনে দিতে হবে। সেই পিঁড়িতে বসেই বিয়ে করবে ছেলে।

    ষাটোর্ধ্ব কাঁপা বুড়ি, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট হবে, কপালে লাল তিলক কেটে, বোম বোম করতে করতে ঘর ভরতি লোকের মাঝে কাঁপতে কাঁপতে এসে ধমাস করে বসে পড়লো মাটিতে। সে কি গোঙানি। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, সে এক ভয়ানক চেহারা। চার দিকে ধুপ ধুনো তে ঘরে ধোঁয়ায় ধোঁয়া। সঙ্গে দুটো চ্যাংকা ছোঁড়া। তাদের দুজনেরই গায়ে উত্তরীয় আর পরণে ধুতি। ধুতি গুলো যে কোন এক সময়ে সাদা রঙেরই বানানো হয়েছিলো সেটাও বোঝবার জো নেই। আর বুড়িমার চ্যালা বলে কথা। বাবারে সে কি রোয়াব তাদের। ওদের গায়ের গন্ধে যেন ধুনোর গন্ধই চাপা পড়ে যাচ্ছে।

    অবিনাশ সিনহা বেশ বুঝতে পারছে বাইরে কেন বড় বড় করে লেখা আছে

    “শিশুদের প্রবেশ নিষেধ”।

    মনে মনে ভাবছে “শালা জমপেশ জায়গায় এসেছে। হেঁ হেঁ এবার ঐ মেয়েটা মানে পত্রালী না চৈতালি হাড়ে হাড়ে মজাটা টের পাবে বাপধন। কার ছেলের পেছনে লেগেচো জানো না তো!”

    (দুই)

    হু হু হু হু করে ধুনোর ধোঁয়া বেড়ে চলেছে। চার দিকে মুহুর মুহু উলুধ্বনি দিচ্ছে সকলে। চ্যাংকা গুলো সজোরে কাঁপা বুড়িকে বাতাস করে যাচ্ছে। একজন একটা বাজখাঁই আওয়াজের কাঁসর দমাদ্দম পিটিয়ে চলেছে প্রাণপণে। আর বুড়ি ততক্ষণে ভরে পড়েছে। সঙ্গে গোঙানি।সে কি নাকের আর গলার আওয়াজ। নাসিকা গর্জন যেন কামানের গোলার মতো বেরোচ্ছে। হুর র র র র র……ফুর র র র র দুনিয়া কাঁপানো চিরবিরোনি আওয়াজ। পুরোনো কড়ি বড়গার বাড়ি। নিচু নিচু খড়খড়ির জানালা। কেঁপে কেঁপে উঠছে সব, বাপরে। সব কটাই আলতো করে ফাঁক করা আছে। যাতে কেউ ধোঁয়ায় কষ্ট পেলে জানলা দিয়েই তাকে তৎক্ষণাৎ সটাং বাইরে ফেলে দেওয়া যায়।

    হেঁ হেঁ এ যে সে বুড়ি নয় স্বয়ং কাঁপা বুড়ি বলে কথা।

    অবিনাশ সিনহা তো আনন্দে আত্মহারা। মনে মনে ভাবে লে হালুয়া এতো টাও তো ভাবেনি। এ যেন পুরো চেঙ্গিজ খাঁ। আপিসের বিকাশ বাবু ভালো একটা পাত্তা দিয়েছে বটে। এবার একে একে সবাই তাদের সমস্যা বলবে, আর কাঁপা বুড়িও মন্ত্রপুত মাদুলি, মন্ত্রপুত টোটকা দিয়ে সব সমাধান করবে। আর যদি কাউকে কিছু নিয়ে আসতে বলে থাকে তো সেগুলো দিলেই বুড়িমা মন্ত্র পড়ে দেবে। সেগুলো যেভাবে কাজে লাগাতে বলা হবে সে ভাবে ব্যবহার করলেই ব্যাস, কেল্লাফতে।

    “ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না
    যার তার লগে ডেটিং করে আমায় চেনে না”

    ওমা একিরে বাবা। ধর্মের স্থানে এসব আবার কি। অবিনাশ বাবু তাকিয়ে দেখে এক ছোঁড়ার মোবাইলে বেজে উঠেছে হঠাৎ। আর বুড়িমা চোখ বড় বড় করে যেই তাকিয়েছে ছোঁড়া তো ভয়েই মরে। তবে কথা গুলো সবই শোনা গেল সেই মোবাইলের স্পিকারে।

    –হ, হল ল।

    –বলতাসি আপনেগো কবে আইবেন।

    –কেডা কয় কেডা।

    –বেহালা থিকা হালায় দুকানদার কইতাসি। ওই ধুপ, ধুনা আর মিষ্টির লোইঘা কিসু বাকি আসিল।

    –অস্যা। অহন সেম্বারে আসি। কাল বেহালায় সেম্বার আসে। যহন জামু, কথা কইমু।

    বলে ফোন টাকে কেটে দিলো। আবার বাজখাঁই কাঁসর টা নিয়ে উন্মাদের মতো পেটাতে শুরু করলো। অবিনাশ বাবু বুঝলো এই চ্যাংকা ছোঁড়াটা হলো আসলে বিকাশ বাবুর মতো পারচেজ ম্যানেজার। উফ্ফ! কি ডেডিকেশান। তাই এর সঙ্গে বিকাশ বাবুর আলাপ। তবেই না বিকাশ বাবু এখানকার পাতা দিতে পারেন।

    (তিন)

    পালানো কেস নিয়ে প্রথমেই একজন মহিলা তার নাম নাকি ঝাঁসি মিষ্টিরানি। বুড়িমার কাছে এসে, সে তো কেঁদে কেটে একসা। কি! না, তার নাকি মেয়ে পালিয়েছে। এক হপ্তা ধরে বুড়িমাও কিছু করতে পারেনি। এবার বুড়িমা বলেছে আসল অস্ত্রটা ছাড়বে। সেই আশায় ঝাঁসি দেবী থানায় ডাইরি ও করেননি। আচ্ছা বেশ। আরো কটা দিন দেখে নাকি তারপর পুলিশে খবর দেবেন। কারণ এই সমস্ত অপহরণ বা পালিয়ে যাওয়া কেস গুলোতে পুলিশকে জানালে নাকি বুড়ির ওষুধ আর কাজ করে না। ওটা ডবল ধামাকা হয়ে যায়। আর তাতে কিনা মেয়ে, পাচার ও হয়ে যেতে পারে বিদেশে। সে তো আরো ভয়ের ব্যাপার। তা এখন সেই ঝাঁসি দেবীর জন্য ওষুধ তৈরি করে দেবে বুড়িমা।

    ঝার- ফুঁক- তুক -তাক, অনেকক্ষণ ধরে করে একটা হরলিক্স এর শিশিতে কিছু কালো কালো গোল মরিচ আর একটু জল মিশিয়ে তাকে দেওয়া হলো। আর বলা হলো সেটা যেন বড় বাথরুম থেকে মানে ই-য়ে করে এসে একদম কেউ ছুঁয়ে না ফেলে। বুড়িমা তো ঠক ঠক করে খুব কাঁপছে। হাত থেকে এই বুঝি শিশি পরে যায় পরে যায়। যাই হোক, সেই ঝাঁসি দেবী তো কাঁদতে কাঁদতে একটা ছোঁড়ার হাতে তিনশো এক টাকা দক্ষিণা স্বরূপ গুঁজে দিয়ে ঘর থেকে চুপ চাপ অশ্রু বিসর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। আগে বাড়ি গিয়ে ওই জল সারা বাড়িতে ছিটিয়ে দিতে হবে। আর পাশের বাড়ির লোকজন যাদেরকে সন্দেহ হয়, তাদেরকে ও একটু ওই মন্ত্রপুত জল শুকিয়ে দিলেই চলবে। ব্যাস এটাই বুড়িমার চরম অস্ত্র। নাহলে পুলিশেই ভরসা রাখতে হবে এর পর। তবে এ নাকি অব্যর্থ মহৌষধ।

    (চার)

    এর পরে যার লাইন তিনি বছর পঞ্চান্নর এক জন প্রেমিক ভদ্রলোক। নাম ঝিনকা চিকু চন্দ। নাদুস নুদুস চেহারা। চশমা পরিহিত ভদ্রলোকের সখ টি ষোলআনা। সে আবার বশীকরণের জন্য মাস দুয়েক ধরে হত্যে দিয়ে পরে আছে বুড়িমার দরজায়। কাজও নাকি বেশ এগোচ্ছে তরতরিয়ে। তার দাবী হচ্ছে একটা মাল কিছুতেই পোটছে না, রোজ একই বাসে অফিস যাবার সময় দেখা হয়। কিন্তু ওই টুকুই, ব্যাস। প্রথম প্রথম নাকি একটুও তাকাতো না, হপ্তা খানেক হলো সিট খালি থাকলে পাশেও এসে বসছে। স্বভাবতই বুড়িমার ওপর তার বিশ্বাস এখুন তুঙ্গে। মহিলার ওপর আকৃষ্ট হওয়ার একমাত্র কারণ হলো তার নাকি কালো পিঠে মস্ত বড় আঁচিল আছে। সেটাই নাকি ঝিঙ্কু বাবুকে আকৃষ্ট করেছে। তা ভালো কথা।

    তাকে গতবার বলা হয়েছিলো শাড়ির আঁচল বা দোপাট্টার এক টুকরো সুতো, যেন তেন প্রকারেণ নিয়ে আসতে হবে। আর সেটা যদি একবার বুড়িমা পড়ে দেন তো আর দেখে কে। সেই নাদুস ভদ্রলোক তো খুব উত্তেজনায় ফুটছে।

    এবার বুঝি পটলো বলে।
    এবার বুঝি পটলো বলে।

    তার কথায় যেই নাকি গত শুক্রবার এসে পাশের সিটে বসেছে ব্যাস কায়দা করে সেই সুতোয় টান। আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলো আর….কি। মোটা ধুমসো মহিলা তেড়ে ফুঁড়ে এসেছিলো দাঁত বের করে। যাইহোক সে যাত্রায় বুড়িমার ওপর অগাধ ভরসা রেখে একটু মুচকি হাসাতেই রক্ষা পেয়েছিলেন। নাহলে কানের দু ইঞ্চি নীচে যা জোর খেতো না মাইরি ঝিঙ্কু চন্দ। এই যাত্রায় বেঁচে গিয়ে বুড়িমার ওপর বিশ্বাসের বহর হুর হুর করে ইলাস্টিকের মতো বেড়ে চলেছে।

    এবার কাঁপা বুড়িমা স্বযত্নে চুরি করে আনা সুতোটায় মন্ত্র পড়বেন বলে তৈরি। আবার নাসিকা গর্জন শুরু। অবিনাশ বাবু মনে মনে ভাবছে জিও গুরু, মানে কথা, এমন একজনের সন্ধান কেন যে বিয়ের আগে পায়নি। উফফ তাহলে তো সেই ফাটাফাটি দেখতে মেয়েটাকেই বশীকরণ করা যেত। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ হাত ফস্কে বেহাত হয়ে যেত না।

    পুরনো চটকে যাওয়া প্রেম নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্কই হয়ে পড়েছিলেন অবিনাশ বাবু। এমন সময় হাতের ওপর একটা সজোরে পায়ের চাপে সম্বিৎ ফিরলো। তাকিয়ে দেখেন ঝিঙ্কু বাবু মাটিতে পরে গোঁ গোঁ করে গোঙাচ্ছে, খেয়ালই করেনি অবিনাশ বাবু। ওরে বাবা! একি রকম ওষুধ। বুড়িমা ঝিঙ্কু বাবুর এতো বড় দশাসই চেহারাটার ওপর চড়ে বসে তর্জন গর্জন করছেন আর স্যাঙাত গুলো লম্ফ ঝম্ফ করে দেদার মজা লুটছে সঙ্গে বাজখাঁই কাঁসর টা যার পর নাই জোরে পিটিয়ে চলেছে। বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ, কপালে ঘন ঘন হাত ঠেকিয়ে চলেছে। কেউ কেউ দেয়ালেও জোরে জোরে মাথা ঠুকে ভরপুর আশীর্বাদ নেবার চেষ্টা করে চলেছে।

    এই সব কান্ড দেখে অবিনাশ বাবুর এবার একটু ভয় ভয় হলো। তাকেও এই বয়সে মারধর করবে নাকি কে জানে। মাল পটাতে এসে যদি কেউ মার খায় তাহলে ছেলের মাল হটানোর জন্য কি না করতে পারে। এই সব ভেবে একবার ভাবলো পালিয়ে যাবে। নাকি শেষ দেখেই যাবে। এমন সময় আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় সাহস করে নড়ে বসলেন। আর ঝিঙ্কু বাবু কোনো রকমে এইয়া বড় শরীর টাকে নিয়ে কাঁপা বুড়ির মন্ত্রপুত সুতোখানা একটা মাদুলিতে পুড়ে চড় চাপড় খেয়ে বেজায় আনন্দে সারা গায়ে ব্যাথা নিয়ে নড়তে নড়তে তিনশো এক দিয়ে ধম্ম স্থান ত্যাগ করলেন।

    (পাঁচ)

    এবার এলেন অদ্ভুত দর্শন ভদ্রলোক গোবর্ধন গুছাইত। ছেলের ঘাড় টাকে সপাটে ধরে বুড়িমার পায়ের কাছে বসালেন। সে কি ধমক চমক ছেলের ওপর। ওরে বাবারে বাবা। ছোট্ট ছেলে এমন করলে হয় নাকি। তার বক্তব্য–

    “ছেলে নাকি পড়ে না
    বিছানা থেকে নড়ে না।।
    সারাদিন হোয়াটস অ্যপ
    লেখাপড়ায় পুরো গ্যাপ।।

    সাথে দোসর ফেসবুক
    ছেলে বড় উজবুক।।
    বাবা মাকে মানে না
    কিল চড় ও থামে না।।”

    নালিশ শেষে গোবর বাবু, থুড়ি থুড়ি, গোবর্ধন বাবু ছেলের পাশে বসলেন। বসতে না বসতেই কাঁপা বুড়ির ইশারায় কাঁসর বাজানো থামিয়ে চ্যাংকা ছোঁড়া টা সজোরে একটা চড় গোবর বাবুর বাঁ কানের নীচে কষিয়ে দিয়েই আবার এক পা তুলে বাজখাঁই কাঁসর টা নিয়ে কাজে লেগে পরলো। উরি শালা, কেলো করেছে। অবিনাশ বাবু তো দৃঢ় বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে তার কপালেও নির্ঘাত ক্যালানি আছে। পালাবে কিনা ভাবছে কারণ তার ও ছেলেকে নিয়েই সমস্যা।

    বেচারা গোবর বাবু তো থাবড়া খেয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলেছে । এদিকে বাপকে খামোখা ক্যালাচ্ছে দেখে আহাম্মক ছেলের তো আনন্দ আর ধরে না। কাঁপা বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে এবার শুরু করলো,

    –তোকে এই ধম্মস্থানে কাব্যি কত্তে কইছি!!

    –না বুড়িমা।

    –থালে কবিতা কইসিস ক্যান।

    –ভুল হয়ে গেছে বুড়িমা।

    –আমি বুড়ি?

    –আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে না বুড়িমা।

    –ছেলেকে সামলাইতে পারিস না ক্যান।

    –আচ্ছা আজ্ঞে, মানে….

    এই সব আবোল তাবোল দেখে তো অবিনাশ বাবুর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয় হয় আরকি। এই বয়সেও প্যান্টটা একটু ভিজে ভিজে ঠেকছে। হলদে পায়জামা পরে এলে হয়তো ভালো হতো, অন্তত ইয়ে টিয়ে হয়ে গেলে…..
    পালানোর রাস্তা আছে কিনা এদিক ওদিক চোখ চালাচ্ছে। হঠাৎই মনে হলো ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সোজা বাসে উঠে বাড়ি মুখো হয়ে ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে যদি এ যাত্রায় পার পাওয়া যায়। এখানে বসে থাকলে কপালে নির্ঘাত চড় থাপ্পড় সঙ্গে তিনশো এক। হাত পা কাঁপছে এবার। বুড়ি কাঁপছে না অবিনাশ বাবু কাঁপছেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। বাকি সবার কি অদ্ভুত অভিব্যক্তি। কারুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পৃথিবী রসাতলে গেলেও ওরা কাঁপা বুড়ির স্বপক্ষে। চ্যাংকা গুলো ভুলেই গেছে রাত না দিন, ধুতি গুলো জায়গা মতো আছে কিনা সেটাও হয়তো বা মনে নেই।

    (ছয়)

    এই সব ভাবতে ভাবতে মনে মনে একটু শক্তি সঞ্চয় করেছে সবে, ঠিক তক্ষুনি কাঁপা বুড়ি হয়তো বুঝে গেছে যে এ মাল পালানোর চেষ্টা করছে। হেই হেই বলে এক হুঙ্কার দিয়েই আবার কাঁপা শুরু করেছে। অবিনাশ বাবু তো বেজায় ফাঁপরে। আশ্চর্য্য তো। এইবার, হ্যাঁ এইবার চরম শক্তি সঞ্চয় করেই এক লম্ফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অবিনাশ বাবু। কোনো রকমে এদিক ওদিক মেপে দরজার ছিটকিনি টাও খুলে ফেলেছে। যেই না বাইরে পা রেখেছে ব্যাস…. প্রপাত ধরনী তলে। মস্ত বড় উঁচু চৌকাঠে পা আটকে আছড়ে পড়লো মাটিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চ্যাংকা এসে জাপটে ধরে পাঁজা কোলে করে তুলে পাশেই শুয়ে দিলো, দিয়েই চোখে মুখে জলের ঝাপটা আর ঝাপটা। একটু আধটু চোখ মেলে তাকাতেই প্রশ্ন ধেয়ে এলো–

    –পালাইতে চিলি ক্যান।

    –(খুব ভয়ে ভয়ে) আজ্ঞে না মানে একটু ইয়ে করতে ইয়েতে যাচ্ছিলাম মানে ভাবছিলাম….

    –আঃ…তা বললেই হতো। তা যা, ঐ যে ডান দিকে।

    অবিনাশ বাবু কোনো রকমে উৎপটাং হয়ে পরে যাওয়া শরীর টাকে তুলে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট দরজা দেখতে পেয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢুকে গেলেন। বাইরে তো চ্যাংকা টা পাহারা দিচ্ছে। শালা দুধের ছেলে তুই তুই করে কথা বলে, সাহস কি!

    এইবার ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে নিলেন অবিনাশ বাবু। টিম টিম করে জ্বলছে একটা নাইট বাল্ব। চৌবাচ্ছায় জল পরে বয়ে চলেছে। পাশেই দুটো ইট পাতা। বাঁ দিকটা করে একটা নোংরা কমোড, দেখে মনে হয় কেনার পর আর কোনো দিন পরিষ্কার হয়নি। আর ঠিক তার ওপরেই একটা ঘুলঘুলি, একটু চেষ্টা করলে একটা মানুষ গোলে যেতে পারবে। সেখান থেকে একটু খানি দিনের আলো বাথরুমে ঢুকছে। সেই দেখেই অবিনাশ বাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। সোজা কমোডের ওপর উঠে দাঁড়ালেন আর ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে মুখটা গলিয়ে দিলেন। দিনের আলোয় মনটা বেশ ফুরফুরিয়ে উঠলো। যেন গলা ছেড়ে গাইতেই যাচ্ছিলেন

    “এই এতো আলো এতো বাতাস আগে দেখিনি”

    না বাইরে ছোঁড়া টা পাহারায় আছে ভেবে উত্তেজনা সম্বরণ করলেন। এবার শ্যাওলা পরা স‍্যাঁত স্যাঁতে দেওয়াল টাকে জাপটে ধরে গোলে যাবার চেষ্টা করতেই কড় কড় মর মর করে একে বারে কমোড ভেঙে মাটি থেকে উপড়ে মেঝেতে পরে গেলেন। আর তার পর যা হওয়ার তাই আর কি। সারা মেঝেতে টিম টিমে আলোয় দেখা গেলো ইয়ে টিয়ে ছড়িয়ে একাকার। আর অবিনাশ বাবুর গায়ে-মুখে-হাতে-বুকে-পেটে সে তো বলাই বাহুল্য।

    এতো জোর আওয়াজ হতেই দরজায় দুমাদ্দুম ধাক্কা পরলো। সারা গা ভরতি ইয়ে টিয়ে নিয়ে যখন কোনো ক্রমে বেরোলেন তখন বাইরে গোটা দশ জোড়া উৎসাহী চোখের ভিড়। কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। কেউ আর সাহস করে অবিনাশ বাবুকেও ধরছে না। যেন বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে সোজা মেইন দরজা দিয়ে বুক ফুলিয়ে বাইরে এসেই দে ছুট।
    দুটো স্টপেজ টানা দৌড়ে বাড়ি এসে বাথরুমে ঢুকেতে গিয়েই ছন্দ পতন। কি রকম!!

    ঘুমটা গেলো ভেঙে বৌয়ের হাঁক ডাকে। চমকে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঘুম থেকে উঠেই এই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা ভেবে হাসতে লাগলেন। বিছানায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে সত্যি টা যাচাই করে নিলেন আদৌ সেখানে কিছু হয়ে গেলো নাকি! হাসতে হাসতে বুঝতে পারলেন সত্যি যে ইয়ে পেয়েছে এবার। তাই সোজা ইয়েতে গিয়ে ঢুকলেন।

    আর হ্যাঁ শুনুন- পাঠকদের ও বলিহারি, এই গল্পটা পড়ে এখনো ভাবছেন গল্পের নামটা এমন কেন দিলাম। বিশ্বাস করুন ওটাও স্বপ্নে পাওয়া। ঊন_পঞ্চান্ন কতোর পিঠে কতো আমিও জানি না। আপনারা একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি!

    ~সমাপ্ত~

  • কবিতা

    কবিতা- ইচ্ছে পলক

    ইচ্ছে পলক
    – উজ্জ্বল দাস

    তোর চোখ থেকে একটু কাজল দিবি?
    একটা নদী আঁকবো আমি।
    তোর নাকছাবিটা আমায় দেনা
    একটা মন রাখবো তাতে, রং দেবো বাদামী।।

    তুই যদি চাস
    তোর ঠোঁট পালিশের কালার হবো।
    দিনে রাতে ঠোঁটের তিলের
    নিয়ম করে পাহারা দেবো।

    তুই যদি চাস
    তোর চোখের তারায় বাসা বাঁধবো।
    সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি
    চোখের তারা থাকবে জেগে,
    একটা পলক খসবে যখন
    খেয়াল করে তাকিয়ে থেকে
    হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক,
    মনে করে চাইবো তোকে, তোকেই চাইবো।

  • কবিতা

    কবিতা- কাঠের ব্যালকনি

    কাঠের ব্যালকনি
    -উজ্জ্বল দাস

     

     

    বসন্তের ভেজা গন্ধে আজ আমি মাতাল
    ঠিক, ঠিক যেমন তোর শরীরের সোঁদা,,,
    না না থাক, লজ্জা করছে।

    তুই বললি চল, আজ বাউন্ডুলে হই।
    আমি বললাম নানা বরং একটু চলনা-
    বসন্তের ফুলে আগুনের তাপ নিয়ে আসি
    তোর সেই ছেঁড়া ক্যানভাসটা নিয়ে আসিস বুঝলি।

    একটা ফাটা স্টাইলিশ হাফ প্যান্ট পরে বসলাম
    ওই কাঠের ব্যালকনিটার ওপরে রাখা চেয়ারে।
    আর তুই আবছা অন্ধকারে ডুব দিলি আমার মধ্যে।
    ওই ভিজে অন্ধকারে দেখলাম-
    তুই ভিজে গেছিস পুরো পুরো পুরোটা।।
    আমাকে তোয়ালে করে মুড়ে ফেলেছিস তোর মধ্যে।
    তোর কি লজ্জা করে না।
    ছাড় বলছি, ছেড়ে দে আমায়।

    জিভটা বের করে নিলাম সজোরে।
    এত জোরে আওয়াজ হলো,
    দুটো রাত জাগা পাখি, ডানায় শব্দ করে উড়ে গেলো।
    উফফ তুই পারিস বটে।

    টিপ টিপ বৃষ্টি টা পরেই চলেছে।
    তোর সোঁদা গন্ধে না না,
    বসন্তের ভেজা গন্ধে আমি মাতাল হয়ে বসে রইলাম,
    কাঠের ব্যালকনিতে।

  • কবিতা

    কবিতা- শেষ চিঠি

    শেষ চিঠি
    – উজ্জ্বল দাস

     

     

    পোস্টম্যানটার শেষ চিঠিটা যত্নেই ছিলো রাখা
    শেষের সেদিন বড়ই মধুর ভাবতে ছিলাম এক।।
    বোঝার আগেই কখন যেন তোমায় ভালবেসে
    আজও যখন ভাবি, উঠি মনের কোণে হেসে।।

    সেদিন হাতের লেখায় আলাপ, নীল কালিতেই প্রেম
    তখনও কিন্তু হয়নি শুরু হোয়াটস অপের গেম।।
    হাতেই লেখা দিস্তা কাগজ পাতার পরে পাতা
    প্রেম প্রণয়ে উঠতো ভরে স্কুলের ফেয়ার খাতা।।

    ছিলাম তোমার কাছে আমি পাড়া গ্রামের ছেলে
    শহুরে তুমি, চলন বলন, তবু, আমার কাছেই এলে?
    শেষ চিঠিতেই হঠাৎ জোরে দমকা হাওয়া নিয়ে
    চার বছরের প্রেমের ইতি টানলে দাঁড়ি দিয়ে।।

    কি জানি কি মধুর নেশায় ছিলাম তোমায় মেখে
    “শুভ সকাল” আজকে হলে জানতাম ঘুম চোখে।।
    ভাগ্যি সেদিন ছিলোনা এসব পেনের কালি বিনে
    নইলে তুমি ঘুম চোখেতেই হৃদয়ে দিতে ভেঙে।।

    পোস্টম্যানের সেই খোলা চিঠি আজও পড়ি দুখে
    হোয়াটস অপে আজ ঘোচে প্রেম হয়তো বাসি মুখে
    এমন অনেক নাজির এখন গিনিস বুকে খ্যাত
    পিওন কাকু আজ রিটায়ার, চিঠিরা মর্মাহত।।

  • কবিতা

    কবিতা- বাগদেবীর আরাধনা

    বাগদেবীর আরাধনা
    -উজ্জ্বল দাস

     

     

    একটু জ্ঞান, একটু বিদ্যে চেয়েছিলাম ছোটবেলা থেকে।
    বদলে পেলাম কিছু সই করা কাগজ।
    স্কুল থেকে বেরোনোর পর, মাস্টার মশাই বললেন

    “আপদ বিদেয় হয়েছে”।

    হ্যাঁ মা আমি পাশ করেছি, ডিগ্রি পেয়েছি
    এটা ওটা সেটা,
    আরো আরো আরো অনেক কিছু পেয়েছি।
    দুহাতে কামিয়েছি। নাম-যশ-খ্যাতি।

    আজ কেন যেন মনে হয় নাহ-
    না পেলাম বিদ্যা, না এলো অর্থ।
    না তৈরি হলো বোধ, না হলো বুদ্ধি।
    শুধু বসন্ত পঞ্চমীতে ছেলে মেয়ের হাতেখড়ি দিয়ে বললাম

    “আমি হতে পারিনি তো কি হয়েছে , ওদের মানুষ করো মা”

    শিশুকাল থেকেই ওদের যুদ্ধে পাঠিয়ে দিলাম।
    ছোট্ট ছোট্ট হাত পা গুলোতে ওরা হারিয়ে ফেললে শৈশব।
    ওদের মাথায় পুরে দেওয়া হলো সাদা কাগজের বস্তা পচা স্তুপ।

    বলা হলো “প্রথম হতে হবে”।

    প্রথম হলো। ক্লাস বাড়লো ক্রমশ।
    আরো তির গতিতে আমার টাকা পয়সা ধংস করে করে,
    তৈরি হলো একজন বিরাট চাকুরে।
    অনেক অর্থ, অনেক রোজগার।

    কলার টা তুলে বললাম

    –“হে বাগদেবী, কি তৈরি করলাম দেখলে।”

    আমার আর কোন কাজ নেই, আমি মুক্ত- আমি মুক্ত।

    আমার বাসস্থানের চতুর্দিকে ফুল ফলে ভরা,
    কলকাকলিতে ভরা।
    কি ভালো ভালো লোক চারপাশে।
    আমি এখন সত্তর।
    আমার পরনে রাজকীয় ধবধবে সাদা জামা কাপড়-
    বাদশাহী খানাপিনা-
    নিয়মিত ডাক্তার-
    নিয়মিত পথ্য-
    হুঁ হুঁ প্রচুর খরচ।

    সারাক্ষন ইস্ত্রি করা সাদা পরিয়ে রাখে এরা সবাইকে।
    শেষ দিনে যাতে পাল্টাতে না হয়।
    এটা একটা বৃদ্ধাশ্রম । রাজকীয় বৃদ্ধাশ্রম।

    হেঁ হেঁ, হে বাগদেবী! কেমন অঞ্জলি দিলাম বলো।
    মানুষের মত মানুষ করতে পেরেছি।
    আমি এখন একজন গর্বিত বাবা।

  • কবিতা

    কবিতা- শেষ অব্দি তুমি

    শেষ অব্দি তুমি
    -উজ্জ্বল দাস

    আজকে আবার ইচ্ছে করে নতুন করে প্রেম করি।
    ভালোবাসার শহরকটাকে আজ-
    নতুন করে জড়িয়ে ধরি।
    এই শহরেই প্রথম প্রেম আর প্রথম বিচ্ছেদ,
    এই শহরেই সম্পর্কদের প্রথম ব্যবচ্ছেদ।

    এই শহরেই তোমার চোখে প্রথম দেখা রং
    এই শহরেই প্রথম দেখা শীতের ভেজা ঢঙ।
    এই শহরেই জানতে চাওয়া প্রথম তোমার নাম
    এই শহরেই পূর্ণ হওয়া প্রথম মনস্কাম।

    এই শহরেই হাত বাড়িয়ে হাতের তালু ছোঁয়া
    এই শহরেই কৃষ্ণচূড়ার ডালটা ভিজে নোয়া,
    এই শহরেই প্রথম বারের তোমায় ছুঁতে চাওয়া
    এই শহরেই সেই ঘটনার সাক্ষী দমকা হাওয়া।

    নগর ভেজা সকাল বেলায়, ঠোঁট ছুঁয়ে যায় চা পেয়ালায়-
    শীতের বেলায় রোদ্দুর এসে বসে।
    ভিজে আকাশ আজ সারাদিন , চোখও যেন নতুন রঙ্গিন
    এমন কদিন পাই বা বারো মাসে!!

    এই শহরেই আজ রাতদিন অনেক গপ্পো হবে
    নন্দন বা ভিক্টোরিয়া গড়ের মাঠের পাশে

    মিষ্টি করে বলবে তোমায় এসে,
    ভীষণ ভালোবেসে।।
    “এখনো তোমায় ভালোবাসি আমি
    কিন্তু আমি আর কাঁদি না, ঘুচেছে পাগলামি।।”

  • কবিতা

    কবিতা- চেনা রিংটোন

    চেনা রিংটোন
    -উজ্জ্বল দাস

     

     

    মুঠো টেলিফোনে ব্যস্ত শহর, হাজার কথার জলছবি
    ব্যস্ত থাকাটা ফ্যাশন এখন, উচ্চ-হাসি মুলতুবি।
    সারাক্ষন তো ফোনেই কাটে, আঙ্গুলের ফাঁকে নিকোটিন
    যে ফোনটা রোজ আসতো, তার আসা আজ, বেশ কঠিন।।

    মন ভরে না বাহারি কথায়, পোশাকি ছোঁয়া বর্বরতায়
    মাতব্বরি, গন্ডি বিহীন, চরিত্ররা- জাস্ট নগ্নতায়।।
    নষ্ট মনে কষ্ট করেও পাহাড় প্রমান আড়ম্বর
    যে ফোনটা আজ আসে না, তাকেই ভাবি নিরন্তর।।

    যে ফোনটা আসতে চেয়ে বারে বারেই ইশারা চোখ
    সেটা যে আসলে চাইনা আমি, যতই পুড়ে দগ্ধ হোক।
    যে ফোনটা শুরু হলে থামতে কখনো চাইতো না,
    সে ফোনটা চুপ করেছে বিষ ছুঁয়েছে যন্ত্রনা।।

    হাজার মনের কাছাকাছি যেই গিয়েছি, থমকে পা
    সেই রিংটোন বেজেছে কানে বুক ফাটলেও, মুখে-রা না।
    সাঁঝবাতির সঙ্গে যেদিন দৌড়ে ছিলাম এক আকাশ,
    সেদিনও কিন্তু ফোন আসেনি, সেদিনও বয়নি সু-বাতাস।।

    ডাকছে আমায়, উড়ছে কাগজ,ভাসছে চোখে ক্যানভাসটা
    সকাল, বিকেল অপেক্ষাতেই আজও আছে অভ্যাসটা।
    একটা তারা খসলে আজও, চোখ বুজে চাই ফোন বাজুক
    বাজেনি সে আর, হয়নি শব্দ, চুপ করে গেছে জ্বলনটা।।

    তবু ওদিকের ধ্বনি বারে বারে কানে বাজে উলু ঘন্টারা
    থেমে গেছে ঝড় এসে বারে বার, গগন ভেদী শব্দরা।
    আজও একবার চেয়ে চেয়ে দেখি জং পরে গেছে মনটাতে
    হঠাৎ আওয়াজ, বেজে ওঠে কানে, ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে।।

    দেখি চোখ মেলে সে ফোন বেজেছে
    বেঁচে আছে নাকি আজ কথা?
    মনে মনে ভাবি, আর কিছু নেই,
    যে গেছে চলে যাক না সে-
    কেন বাজা আর, ভেবে ভেবে সার,
    আজ জয়ী হোক ব্যস্ততা।
    তবু ফোন ধরি, কয়েক প্রহর
    চুপ করে থাকি, কি চায় সে!
    করে চিৎকার মুখ করে ভার
    “মুক্তি দিলাম” জানায় সে।।
    আজ বাদে কাল তার পরিণয়
    হয়েছে যে ঠিক অগত্যা।
    হাতটা আমার ছেড়েছে কবেই
    পেয়েছে সুখের গন্ধ আজ
    লাল টিপ পরে অন্য বাসর
    সুখে নাকি ওর ভরছে ঘর ।
    চেনা রিং টোন বাজেনি কখনো
    শুনতে পাইনি দ্বিতীয় বার।।

  • কবিতা

    কবিতা- অঙ্গীকার

    অঙ্গীকার
    -উজ্জ্বল দাস

     

     

    আমার মন খারাপের রাতের পাশে থাকতে হবে-
    থাকবি তো তুই?
    নিঝুম রাতের রং বদলটা চিনতে হবে
    আসবি তো তুই?
    অন্ধকারের তারা গুলো গুনতে হবে-
    গুনবি তো তুই?
    অবাক লেখায় ডাইরি খানা ভরতে হবে-
    ভরবি তো তুই?
    ডাইরি খানার শেষ পাতাটা খালি রাখিস-
    রাখবি তো তুই?
    রাখিস কিন্তু–

    সেই পাতাটা খালি রাখিস
    ভরবো আমি।
    আমার পাওয়া যন্ত্রনা টার অজানা এক রঙ-
    পাতার পরে পাতা যখন উঠবে ভরে,
    লিখবো আমি শেষ পাতাটা নিজের মতন করে।
    রং বদলটা কষ্ট দেবে ঠিক, দম বন্ধ করে।
    অসীম পাওয়া না পাওয়া টাও মানতে হবে
    মানবি তো তুই?

    সেদিন যখন সাদা কাপড় তুলসী পাতায় সেজে
    নরম গদির পাল্টে যাওয়া শক্ত কাঠের ফালি
    থাকবে সাথে বনমালির সাজানো এক ডালি,
    ধুপ ধুনোর গন্ধ যখন আসবে না আর নাকে
    বলবি কাকে রেগে গিয়ে ঘেন্না করি তোকে!
    লিখতে যদি না পারি সেই শেষ পাতাটার লেখা
    কষ্ট পাসনা, পরের জন্মে হয়তো হবে দেখা।।

  • গল্প

    গল্প- একটি রাত

    একটি রাত
    -উজ্জ্বল দাস

     

     

    ডান দিক, ডান দিক, ডান দিক। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আর একটু, আর একটু বাঁ দিকে, হ্যাঁ হ্যাঁ একটু নিচে। এই এই এই…হ্যাঁ এই খানটা। উফফ একটু জোরে জোরে দেনা বাবা। ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে চুলকে দে, উফফ। আহহহহ আহহহহহহ।

    (এক)

    বাড়িটা থমথমে করছে। ডানদিকে বড়মামা, মাটিতে মাথায় হাত দিয়ে বড় মামীমা বসে। মেজমামারা এসে ঢুকবে এক্ষুনি জানালো টেলিফোনে। মা বারবার বাথরুমে যাচ্ছে। বাবা সারাক্ষণ একে ওকে ফোন করে চলেছে। যেন এই বুঝি কোনো খবর এলো। টালিগঞ্জ থানায় একটা ডায়েরি করে পিসেমশাই সদ্য জানালো যে খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশ ফোন করবে। ছবিও দিয়ে এসেছে একটা।

    মেয়েটা হঠাৎই বিকেলের পর বাড়ি ফেরেনি। ছোট্ট মেঘলা এখন বছর পঁচিশের সুন্দরী তরুণী। বন্ধুদের সঙ্গে দুপুর বারোটা নাগাদ বেরোবে সেরকমই কথা ছিলো। এখন রাত সোয়া এগারোটা বাজে। কিন্তু মেয়ের কোনো খবর না পেয়ে সবাইকে জানায় ওর বাবা সৌরিন্দ্র বাবু। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না! থানায় খবর দেওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি। মেয়ে বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিলো না কিছুতেই, বাবা জোর করে বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ের কথা চালিয়ে যাচ্ছিলো। তাতে আবার মেয়ে কিছু করে বসলো কিনা, এইসব জল্পনা চলছে।

    মা রিতা দেবী খামোখা বাবাকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে আবার একবার বাথরুমে চলে গেলো। “আজ তোমার জন্যই সব হলো, পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও বিয়ে দিতে যাচ্ছিলে। যাও এবার ঠ্যালা বোঝো”। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে থমথমে ঘরটাতে সবার চাহনি। এই বুঝি কোনো খবর। বড়মামা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মেজমামারা এসে গেছে।

    – কোনো খবর আছে দাদা?

    – নাহ্ রে। আয় বস। এই তো থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। দেখা যাক। তবে সবাই বলছে হাসপাতালগুলোতেও একটু খবর নেওয়া দরকার। কি করবো কিছুই বুঝতে পরছি না।

    – তাহলে চলো সময় নষ্ট না করে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আশপাশের হাসপাতালগুলো যাবো। আর তিন্নি যখন আছে ও একটু সামলে নেবে বাড়ি।

    আবার কলিং বেলের আওয়াজ। আবার সব চুপ। যেন ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার জোগাড়। দরজা খুলতেই দেখা গেলো পাশের বাড়ির হরেন জ্যেঠু এসেছে। এসে সটান সোফায় বসে পড়লেন বছর সত্তরের বৃদ্ধ। বসেই মস্ত একটা হাই তুলতে তুলতে বললেন “আচ্ছা তোমরা হাসপাতালগুলো দেখলে না? বারবার করে বললাম, ওখানে গিয়ে মর্গগুলো দেখতে। আমার ভায়রা ভায়ের শ্বশুরের বন্ধুকে তো শেষ অব্দি মানিকতলার মর্গেই পাওয়া গেছিলো। সে যা অবস্থা পচা গলা, চেনাই যাচ্ছিলো না নাকি। দেখো এখন প্রায় রাত একটা বাজে কাল ভোর হতেই সব মর্গগুলোতে একে একে চলে যাও। তোমরা চিন্তায় আছো দেখে আমার আবার ঘুম আসছে না।“

    সবাই সবার মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলো। উপায় নেই তাই। বয়স্ক মানুষের যেচে পরে গালভরা মন্দগুলোও শুনতে হয় অসময়ে। কোনো চ্যাংড়া হলে এতক্ষণে চড়িয়ে দিত বড়মামা। “টিং টং, টিং টং” আবার বেল বাজলো। “আবার কে?” বলতে বলতে বড়মামা দরজাটা খুলতেই হরেন জ্যঠাইমা এসে হাজির।

    – কই গো, ঘুমুবে না। একুনো বসে রয়েচো যে। তা বাবা তোমরা খপর কিছু পেলে? নাকি বাড়ি বয়ে কেউ খপর দেবে সেই আশায় রয়েচো।

    মেঘলার মা পায়চারি করছিলেন। নির্বিকার জবাব দিলেন..

    -না মাসিমা, এখনো কোনো খবর পাইনি। চেষ্টা করছি।

    -কেন তোমরা তো আবার আমাদের কতায় কান দাও না বাপু আমাদের উনি যখন বলতেছেন যে হাসপাতাল, মর্গ এগুলো দেকো, তা না। বাপু যাও না। কথা শুনতে হয় বড়দের।

    – না মাসিমা আপনারা বরং গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমরা খবর পেলেই জানিয়ে আসবো।

    -যাচ্ছি যাচ্ছি, আর তাইরে দিতে হবে নেকো। আচ্ছা রিতা মা, ওই যে ছেলেটি আসতো তোমাদের বাড়ি, তা সে মেয়ের বয় না গাল কি একটা ফেন্ড। তেনার চঙ্গে আবার পাইলে টাইলে গেলো কিনা..

    বড়মামা মুখের কথাটা একপ্রকার কেড়ে নিয়েই বললো,

    -পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেও আপনাদের নেমন্তন্ন মার যাবে না মাসিমা। আমি নিজে হাতে আপনাদের গিলিয়ে মানে ওই মানে খাইয়ে আসবো। আপনাদের বয়স হয়েছে। গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর কত চিন্তা করবেন আমাদের নিয়ে। বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

    একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই পাশের বাড়ি হরেন জ্যেঠু আর জ্যঠাইমা নড়তে নড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন এক রাশ নিস্তব্ধতা। চলে যেতে সবাই একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।

    (দুই)

    এবার একটু সবাই শান্ত হয়ে বসে কি কি করা যায় আলোচনা শুরু করে দিলো। সমস্ত আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খবর নেওয়া হয় গেছে। পুলিশে খবর দেওয়া আছে। খবর পেলেই জানাবে। হাসপাতালগুলো কাল ভোর বেলা থেকেই যাওয়া শুরু করবে সব। একদিকে বড়মামা আর পিসেমশাই আর অন্য দিকে মেজমামা সৌরিন্দ্র বাবুকে নিয়ে বেরোবে। মামীমা, মা তিন্নি সব বাড়িতে থাকবে। এইসব আলোচনা করে সবার চোখগুলো একটু লেগে লেগেও আসছে এবার।

    বাইরে গাড়ির হর্নে যেন নিদ্রাভঙ্গ হলো সবার। দরজায় এসে দাঁড়ালেন মেঘলার কাকা কাকিমা আর বছর সতেরোর মেয়ে ঐন্দ্রিলা। ঢুকেই এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। এটা সবার জীবনেই ঘটে থাকে। কর্পোরেটের একজন উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক খুব সাবলীল ভাবে সবার সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করলেন। ঠিক কি হয়েছে। কি করা উচিত এই সমস্ত। আর ঐন্দ্রিলা মায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে কিছু একটা তর্ক করে চলেছে সমানে। তার বাংলা মানে করলে এরকম দাঁড়ায়।

    – দেখো মা তোমায় কি বলতে হবে, না বলতে হবে সেটা কি সব সময় আমরা শেখাতেই থাকবো?

    – তুমি চুপ করো। আমি জানি মেঘলা প্রেম করতো। সেই ছেলেটার সাথে যে ভাগবে, একদিন সেটা আগেই জানতাম কিন্তু আমি দিদিকে (মেঘলার মা) কিছুই জানাই নি।

    – তা তুমি যখন এতটাই সিওর, জানাওনি বা কেন।

    – ইচ্ছে করেই বলিনি কারণ আমাদের স্ট্যাটাসের নয় ওরা বা তাতে ওরা কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে দিন পনেরো আগে মেঘলাকে দেখে আমি ঠিক যেটা ডাউট করেছিলাম সেটাই সত্যি।

    -হোয়াট ডু ইউ মিন মম?

    -আই মেন্ট এক্সাক্টলি হোয়াট ইউ নো।

    -রাবিশ! তুমি কি বলতে চাইছো? দিদিয়া প্রেগনেন্ট? তাই পালিয়ে গেছে?

    -এক্সাক্টলি তাই।

    “আহঃ স্টপ ইট”। বলে একপ্রকার রেগে গিয়েই বাবা ধমক দিলো মা আর মেয়েকে।

    (তিন)

    ভোর পাঁচটা।
    দিনের আলোয় সবদিক দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সবাই তৈরি হবে বেরোনোর জন্য। কানের কাছে

    ক্রিং,, ক্রিং,, ক্রিং,, ক্রিং,, করে টেলিফোনটা সজোরে বেজে উঠলো। সবার মনেই একটা অনুকম্পা। খবর কিছু একটা তো আছেই। নাহলে এভাবে এত সকালে কেই বা ফোন করবে! কাল সারাদিনের ধাক্কায় সৌরিন্দ্র বাবু অনেকটাই মুহ্যমান। তাহলেও উপায় নেই। বাড়ির ফোন, আর কে বা ধরবে?

    ফোনটা তুলে হ্যালো বলতে, ওদিক থেকে শোনা গেলো..

    – আমি টালীগঞ্জ থানার ও.সি কথা বলছি। একটু সৌরিন্দ্র বাবুর সাথে কথা বলানো যাবে?

    – আমি ই কথা বলছি। বলুন স্যার।

    – আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারবেন এক্ষুনি একবার হাওড়া সিটি হাসপাতালে চলে যান। ওখানে কাল সন্ধ্যা বেলা একজন গঙ্গায় আত্মহত্যা করেছে। দেখে আসুন আপনাদের মেয়ে মেঘলা চ্যাটার্জী কিনা। লাশটা আইডেন্টিফাই করতে হবে। হাওড়া নিমতলা ঘাটের পাশেই…

    -আচ্ছা আমরা চিনি। এক্ষুণি বেরোচ্ছি অফিসার..
    বলে ফোনটা অবচেতন মনে পাশেই ফেলে রেখে দিলেন সৌরিন্দ্র বাবু। হতাশ হয়ে বসে পড়লেন সোফার হাতলে। চারদিক থমথম করছে। কাকে কি বলবেন বুঝে ওঠার আগেই বড়মামা গিয়ে ফোনটা তুলে “হ্যালো হ্যালো” বলতে অন্য দিকের জোরালো গলার উপদেশটা শুনেই ফোনটা কেটে দিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। এদিকে বাড়ির সবাই তাকিয়ে আছে খবরের অপেক্ষায়।

    বড়মামা ভগ্নিপতিকে আর ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাবার সময় জানিয়ে গেলো যে হাওড়া বড় বাজারের কাছে কোনো একটা হাসপাতালে এক্ষুণি যেতে হবে। সেখানে গিয়ে গঙ্গা থেকে তুলে আনা একটা লাশ নাকি আইডেন্টিফাই করার আছে। মেঘলার মতো বয়সী কেউ কাল গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করেছে। একদম চেনা যাচ্ছে না। তবে বড় মামার বিলক্ষণ মনে হচ্ছে তেমন কিছুই হবে না। এহেন খবরে বাড়ির সকলেরই কান্নার রোল, হা হুতাশ তুলেছে এক প্রকার। তিন্নি আর ঐন্দ্রিলা ছাদে চলে গেছে এসব শুনে। মেঘলার মা আবার কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন। মামীমারা পাশাপাশি মাটিতে বসে। কাকু কাকিমা চুপচাপ নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু কথা বলে চলেছেন। তাহলে কি পাশের বাড়ির হরেন জ্যাঠাই সত্যি হলো অবশেষে।

    হাসপাতালে পৌঁছে মর্গের সামনে অপেক্ষায় সবাই। কখন খোলা হবে মর্গ। আরো আধ ঘন্টা কেটে গেল। সৌরিন্দ্র বাবুর মুখ ক্রমেই আরো ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ভাগ্যের জোরে যেন এখানে ভাগ্নিকে না পেতে হয় মামারা সেই প্রার্থনাই করে চলেছে।

    অবশেষে মর্গের দরজাটা খোলা হলো। প্রবল ঠান্ডায় চারদিকে বরফের ভোটকা গন্ধে ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ছে। আর দু’টো পরিবার অপেক্ষা করছিলেন। ঢক করে ডালাটা খুলতেই ট্রে-টা বেরিয়ে এলো। পচা গলা একটা লাশ। চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। স্বযত্নে তাকে মর্গের ভেতরে রেখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চেহারা, উচ্চতা দেখে মেঘলাই মনে হচ্ছে। হরেন জ্যেঠু থাকলে না দেখেই হয়তো “হ্যাঁ” বলে দিতেন। সে যাই হোক। আরো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য জামাইবাবুকে ডাকা হলো। সৌরিন্দ্র বাবু কাঁপতে কাঁপতে এসে দেখলেন। বার বার তাকালেন। অস্ফুটে বলে উঠলেন “হ্যাঁ এই তো আমার মা, আমার মামনি… মামনি”।

    ডুকরে কেঁদে উঠে বেড়িয়ে গেলেন। বড় মামা, মেজমামা এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছে সব শেষ। কি এমন হলো যে মেয়েটা এমন কিছু করে বসলো। হায়রে কি কপাল। জামাইবাবু কমাস ধরেই মেয়ের বিয়ে দেবার তোড়জোড় করবে বলে ভাবছিলো। তাতেই কি এরকম হলো, কে জানে। তিন জনেই মর্গের বাইরে রাখা একটা লোহার মরচে পড়া বেঞ্চে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। এবার সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে, থানায় গিয়ে কথাও বলতে হবে। তারপর ডেড বডি ছাড়বে। তারপর একে একে ফুল, মালা, খাট…উফফ। হাসপাতালের বাইরের টেলিফোন বুথ থেকে মেঘলার কাকাকে ফোন করে সব জানানোর কথা ভাবছে বড় মামারা। কি ভাবে বলবে, দিদিকেই বা কি জানাবে। একি সর্বনাশ হয়ে গেলো। বড়মামা উঠে গেলো জামাইবাবুর পাশে মেজমামাকে রেখে। টেলিফোন বুথ থেকে বাড়িতে সব জানানো হলে তারপর এক এক করে কাজে হাত দিতে হবে।

    (চার)

    সৌরিন্দ্র বাবুকে হঠাৎ মেজমামা কনুই দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। “ও দেখুন জামাইবাবু”।

    -হু! কি হলো।

    -দেখুন না ভালো করে।

    -ওই ওই, মেঘলাকে ওনারা ওদের মেয়ে বলে দাবি করছেন। তাহলে!!

    -মনে? সেকি? ও কি তবে মামনি নয়? চলো তো দেখি।

    মর্গের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। অন্য একটা পরিবার অসম্ভব কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মেঘলা বলে যে ডেড বডিটা ওঁরা আইডেন্টিফাই করেছিলেন আসলে ওটা মেঘলা নয়। মেঘলা কখনোই পায়ের তোড়া বা হাতে ট্যাটু করেনি। ওই চিহ্ন আর গয়না দেখে খুব সহজেই বোঝা গেলো যে ওটা মেঘলা নয়। মুহূর্তে সৌরিন্দ্র বাবুর অশ্রু, আনন্দাশ্রুতে পরিণত হলো। অন্তত যার গেলো তার গেলো বটে কিন্তু এখনো তো ভাবাই যায় মেঘলা মা ভালো আছে।

    ওদিকে বড়মামা ততক্ষণে ফিরে আসছে ফোনে কথা বলে। এসে দেখলো জামাইবাবু আর মেজমামা দু’জনে যেন একটু সহজ। হাসি হাসি মুখ। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে ফোন করেও কিছু বোঝা যায়নি। দিদি বলেছে এক্ষুণি বাড়ি ফিরে আসতে। ওরা নাকি ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিলো সব। জামাইবাবু আর ভাইয়ের থেকে সবটা শুনে ওদের হাসির কারণটা যদিও বুঝতে পারলো তথাপি জরুরি ভাবে বাড়িতে ফিরতে বলার কারণটা কেউই বুঝে উঠতে পরলো না। অগত্যা বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

    (পাঁচ)

    প্রায় সাড়ে নটা বাজে।
    বাড়িতে ঢোকার মুখেই যেন মুহূর্তে পাল্টে গেল মানসিক টানাপোড়েন। খোলা হয়েছে দীর্ঘ সাত বছর ধরে বন্ধ থাকা ঘর। এসব কি! কোনো উৎসব হচ্ছে নাকি বাড়িতে। সবাই মিলে একসাথে কূটনো কুটতে বসে পড়েছে। দেখতে দেখতে মেঘলার কাকা হাতে করে সবার জন্য কচুরি মিষ্টি নিয়ে ঢুকলেন। বড়মামা, মেজমামা, সৌরিন বাবু ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারছে না কিছু।

    “আরে কেউ তো কিছু বলো” বলেই চোখটা গেলো বাঁদিকের এতদিন বন্ধ হয়ে থাকা ঘরটার দিকে।

    অবাক হয়ে তাকিয়ে সৌরিন্দ্র বাবু দেখলেন নিজের মা’কে। প্রায় সাত সাতটা বছর পর। সঙ্গে তিন্নি, ঐন্দ্রিলা কত্ত গল্প করছে, কত্ত প্রশ্ন তাদের। কেউ তাদের দিদাকে, কেউ ঠাম্মিকে ফিরে পেয়েছে। যেন এক নতুন মানুষ এসেছে বাড়িতে। মা বড় ছেলের দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিয়ে আনন্দ পাচ্ছেন। একটু এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো মায়ের কাছে। কেনই বা এমন জরা জীর্ণ চেহারা হয়েছে মায়ের। পেছন থেকে উত্তর এলো “এসবের উত্তর তোমাদের আমি দেবো বাপি।“

    -মেঘলা! মা, কোথায় চলে গেছিলি মা আমাদের ছেড়ে? কেন একটা খবর দিসনি মামনি? কি দোষ করেছি আমরা সোনা! কাল সারা রাত কোথায় ছিলি মা? মাকেই বা আজ হঠাৎ এভাবে, আমার তো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

    -দাঁড়াও। সবাই বসো শান্ত হয়। সব জানাবো।

    ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হয়েছে মায়ের মানে ঠাম্মির ঘরে। কেউ কেউ এতক্ষণে কিছুটা জানলেও পুরোটা জানা হয়নি কারুর। শুরু করলো মেঘলা।

    -দাদু মারা যাবার ঠিক পর পরই তুমি আর কাকাই মিলে বছর সাত আট আগে যখন এই বাড়িটার দখল নেবে বলে ঠাম্মিকে একটা ছোট্ট চালা ঘরে নির্বাসন দিলে তখন আমি নিতান্তই ছোট। তখন থেকেই ব্যপারটা আমায় ভীষণ কষ্ট দিতে শুরু করে। কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথা শুনবে না বলে আমি তখন কিছুই বলতে পারিনি। তুমি আর কাকাই মিলে ঠিক করলে তোমাদের মা’কে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। আর মাসে মাসে পাশের পাড়ার গাড়ি চালক সমীর কাকুকে দিয়ে দু’জনে মিলে তিনশ তিনশ, ছশ টাকা পাঠিয়ে তোমাদের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আচ্ছা কাকাই বলতে পারো আজ ছ’শ টাকায় কি হয়? তিন্নি বা ঐন্দ্রিলার হাত খরচ কত? বলতে পারো মেজমামা?

    বাবা, কাকু দু’জনেই মাথা নিচু করে বসে আছে।

    -তাই আমি আর সমীর কাকু মিলে গত দু’বছর ধরে প্রত্যেক মাসে দেখা করে আসতাম আর আমার টিউশনি করার টাকা থেকে হাজার টাকা করে দিয়ে এসেছি এতদিন। কাল হঠাৎ ঠাম্মির কাছে যখন যাই, দেখলাম জ্বরে ঠাম্মির গা পুড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড শরীর খারাপ। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। খাওয়ার কিছু নেই। আমি মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করি, আর সমীর কাকু ডাক্তার ডাকতে যায়। অনেকক্ষণ পর যখন একটু ওষুধ পড়লো তখন ঠাম্মি আস্তে আস্তে সুস্থ হতে শুরু করলো। কিন্তু সেই অবস্থায় আমি ঠাম্মিকে একা ফেলে চলে আসতে পারিনি। সমীর কাকু ফিরে আসার সময় ওনার ফোন নম্বরটা দিয়ে বলেছিলেন “দরকার হলে ফোন করিস, তোর বাবা মা বা কাকু কাকিমা কেউই গত সাত বছরে একবারও আসেননি।“ এভাবেই আমি আর ঠাম্মি রাতটা অনেক কষ্টে কাটালাম একসাথে। আর তোমরা জানতে আমি বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে বেড়িয়েছি।

    ব্যতিব্যস্ত হয়ে মা বলে উঠলো “একটা ফোন তো অন্তত করবি মা।“

    বলে চলে মেঘলা…

    -মা তুমিও বলিহারি। একবারও বাপিকে বলোনি ঠাম্মিকে ফিরিয়ে আনতে। বাপি, আজ আমি একটা দিন বাড়ি ফিরিনি তাতেই তোমাদের এত চিন্তা, এত কষ্ট, নিজের মায়ের কথা যদি একটু ভাবতে তাহলে বুঝতে পারতে ঠাম্মি কি করে এতগুলো বছর অনাহারে, অনিদ্রায় কিভাবে কাটিয়েছে তাও নিজের সন্তান, নাতি নাতনিদের ছেড়ে। তাই তোমাদেরকেও একটু বোঝানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো, ফোন করে খবর না দেওয়ার এটাও একটা কারণ। আজ থেকে ঠাম্মি এখানেই থাকবে বাপি। আমার সাথে।

    সারা ঘরে একরাশ নীরবতা। কেউ কোন রকম প্রতিবাদ করতে সাহস পেলো না। তাদেরও বয়স হচ্ছে। কে জানে তাদের এই দিন দেখতে হবে কিনা। দুঃখ, দৈন্যতা, একাকীত্ব, শেষ জীবনের এমন সঙ্গী কজন ভাবতে সাহস পাবে।

    এদিকে তিন্নি একমনে ঠাম্মির ইনস্ট্রাকশন মেনে তার তার পিঠ চুলকে চলেছে,

    ডানদিক, ডানদিক, ডানদিক আর একটু নীচে নীচে। আহা আহা আহ…পরম শান্তিতে ঠাম্মি চৌকির ওপর পা দু’টো ছড়িয়ে সব কিছু ফিরে পাওয়ার আনন্দে অঝোরে চোখের জল ফেলে চলেছে।। এ যেন আবার এক নতুন জন্মদিন, যেন নবজন্ম।

You cannot copy content of this page