• কবিতা

    কবিতা- আহ্বান

          আহ্বান
            – ঋজু

     

    বহুদিন হলো প্রচ্ছদে মিছিলের ছবি দেখে শুরু
    এবার একটা ‘উপসংহার’ বলে অধ্যায় খোলা হোক।

    দু’মলাটের মাঝে
    নিভু নিভু মলোটভ,
    ফাঁসির দড়ির নীচে হ্যান্ডবিল মোড়া কন্ডোম।
    তার ক্লিভেজে গড়ে ওঠা এ সরকার ও নদীমাতৃক তন্ত্র ন্যক্কারজনক
    সাংবাদিকতা হলদেটে-ধীক্কারজনক,
    এ পাগলামো আত্মঘাতী।
    এ শহরে মনুষ্যত্ব মৃত।
    এ শহরে সবকটা দাঁড়কাক বহিরাগত!

    এভাবে দুলে দুলে কবিতা পড়া চলে আজকাল!
    ক্রমে পুলিশ এসে ধরপাকড় করে নিয়ে চলে যায় গোটা ব্যারিকেড টা, যানচলাচল আবার স্বাভাবিক।
    আমাদের মনে আছে তারিখগুলো;আমরা লিখে রেখেছি।
    এসো আগুন-ঋষি, আমরা চুল্লি জ্বালাই এবার।
    আড়চোখে পশ্চাৎ মেপে নিক এবার
    সবাই সবার।

  • গল্প

    গল্প- একটি মা ও মেয়ের গল্প

    একটি মা ও মেয়ের গল্প
    – ঋজু


    ।‌। দৃশ্য-১ ।।

    প্রায় রোজই অনেক সকাল সকাল উঠে পড়ে রমা। তখনো বাইরেটায় কুয়াশার চাদর সরেনি, আকাশটা ফ্যাকাশে। জানালার শার্সিতে শিশির জমেছে। দু’একটা কাক ডাকছে বাইরে, শালিকরা তখনো জেগে ওঠেনি বোধ হয়। মোড়ের মাথায় আশুদা’র চায়ের দোকানে প্রাতঃভ্রমণকারীদের ফেরবার আগেই উনুনে আঁচ চড়ে তাই, অমন নিস্তব্ধতার ভেতরে একমাত্র জোরে শব্দ বলতে ঐ দোকানে কেটলির টিল্ক টিল্ক শব্দটুকুই।
    একটা বড়ো করে দম নিয়ে রমা উঠে বসে। আশীষ তখনো ওপাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে রোজকার মতো। পাশে তার শৈলজা। এই ন’বছরের সংসারজীবনে নিজের বলতে শুধু ও-ই। ওর ঘুমন্ত অমায়িক মুখটা দেখে বড়ো মায়া হয় রমার, চোখ পড়ে ছোট্ট গালটা আলতো হাঁ হয়ে আছে, ছোটো ছোটো আঙুলগুলো কাঁথার ওপরটা ধরে আছে‌। বড়ো ভালো লাগে পৃথিবীটা; কপালে একটা চুমু এ‌ঁকে দেয় রমা। তারপর ভীষণ যত্নে কাঁথার চারপাশটা দিয়ে আরো ঘিরে দেয় ওকে, বিছানার আলগা দিকটা কোলবালিশ দিয়ে ঘিরে দেয়, যাতে স্বপ্ন দেখে পাশ ফিরতে গিয়ে পড়ে ও না যায়। আরো কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করে ওর কাছে, বড়ো মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতে ইচ্ছে করে তার শৈলজাকে।
    নাঃ তা হয়ে ওঠে না-উঠতে হবেই। উঠেই প্রথম চোখ পড়ে জানালায়, ওর বড়ো শখের ছোটো ছোটো টবে ঐ লতানো ফুলগাছগুলো বেশ বাড়ছে রেলিং বেয়ে। আধো ঘুম চোখে চাদরটা গায়ে জড়াতে জড়াতে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনেটায় দাঁড়ায়। নাকের দু’পাশ দিয়ে তেল তেল ভাব; মুখের রঙটা আরো পাংশু লাগে। ঘর বলতে এই একটাই, তাতে এখনই আলো জ্বালা কিম্বা জানালা খোলার দুঃসাহসটা তার হয় না। ওরা ঘুমিয়ে আছে। তাই ঘুলঘুলির আলোতেই একবার আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেয় রমা, বুঝতে পারে না ভালো লাগছে না খারাপ। তবে সে এখনো যথেষ্ট যুবতী আছে; অনেকটা জীবন বাকি এখনো তার শৈলজার জন্য। বেশ অনেকটা সাবধানে বড়ো বড়ো চোখ করে আয়নায় দেখে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট টিপ বেছে পরিয়ে দেয় কপালে; আচমকা হেসে ওঠে নিজের এসব দেখে। আবার থামিয়ে দেয় নিজেকে, পাছে আশীষ জেগে ওঠে। এসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে এখনো অনেক কাজ। সারাটা বাড়ি ততক্ষণে ওলোটপালোট হয়ে পড়ে আছে। আশীষ দোকানে বের হবে, তার জন্য টিফিন গড়ে দেওয়াটা আবশ্যিক এবং প্রায় একটাতেই আগেভাগে ঝোলটা রেঁধে রাখতে হবে, যাতে আশীষ বাজার নিয়ে ফিরলেই মাছটুকু ভেজে ঝোলে ছেড়ে দিতে পারে তাড়াতাড়ি। শীতকাল,তাই তার স্নানের জন্য ডেকচিতে জল গরম করে থালা চাপা দিয়ে রাখতে হয় এবং এতসবের মধ্যেই নিজের স্নানটুকুও সেরে নেয় সে। ভাত ফোটার গন্ধ নাকে আসে, ততক্ষণে হয়তো সরা’টাও নাচানাচি শুরু করেনি, আবার একবার ছুটে আসতে হয় তাকে রান্নাঘরে ভাত নামাতে। তারপর ওপাশের ওভেনটায় বেশ কড়া করে বেড টী প্রস্তুত করে অবশেষে আশীষকে ঘুম থেকে ডাকতে যাওয়ার পালা।
    শৈলজাকে তখনো ডাকে না সে, অধিকাংশ দিন এই স্বামী-স্ত্রীর ভেতর যেটুকু সর্বনিম্ন প্রাতঃকালীন কথোপকথন হয়, তাতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। সে যাক, তাকেও তো জানতে হবে তার মায়ের কষ্টটা, বড়ো হতে হবে তো তাকেও। কিন্তু আনন্দের বিষয় এই যে, এই মাঘে ছ’য়ে পা দেবে তার শৈলজা। “এইতো… কে যেন বড়ো হচ্চে!…কে বড়ো হচ্চে বাবু! ওলে বাবালে!” বলে আদর করতে করতে বারান্দার মতো দেখতে জানালার ধারটুকুতে এসে বসে তার শৈলজাকে নিয়ে। ছোটখাটো অপুষ্ট চেহারা শৈলজার, মুখে বুলি ফোটেনি তখনো; হামা দিতেও পারে না ঠিকমতো। বেশ মনে আছে তার, সরকারী হাসপাতালের সিম্বলিক ফিনাইল গন্ধের লেবার রুমে দীর্ঘ সারাদিন ব্যাপী অসহ্য যন্ত্রণার পর তার জঠোর থেকে শৈলজার অবশিষ্ট দেহাঙ্গটুকুও বেরিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা পাওয়ার পর থেকে শৈলজার পিঠ চাপড়ে চাপড়ে অবশেষে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়ার মাঝের নীরব সময়টুকুতে মা হওয়ার আনন্দের চেয়ে তার কান্না শুনতে পাওয়ার উদ্বিগ্নতা বেশি ছিল। একজন নার্স সেসময় বলেছিল “মেয়ে হয়েছে দ্যাখো, কেমন ফুটফুটে লালপানা মুখখানা!” সেই সময় উপস্থিত প্রসূতিবিশেষজ্ঞের কপালের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ভাঁজটুকু রমার চোখ এড়ায়নি- অবশেষে অর্ধেক দিনের পর্যবেক্ষণেই ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন, “অ্যাবনর্মাল বেবি। ব্রেনের এপিথ্যালামাসে জল জমে আছে।” বেশ মনে আছে ডেলিভারির পরের সারাটা রাত সে একাই কাটিয়েছে, আশীষ সেই কোন বেলায় একবার দেখা দিয়ে গেছে; ব্যাস। আর একবার ও না।
    তখনো রমা শুধুই নিজের কথাই ভেবেছে। শ্বশুরবাড়ির মানসিকতা সে জানে, এদিকে নিজের মা’কে সে ছোট্টবেলায় হারিয়েছে, ওইদিকে ফেরবার পথটাও নেই। কি করবে এখন সে?
    বেশ মনে আছে তার শাশুড়ি মা তার শৈলজা কে নাম দিয়েছিল “মুখপুড়ি”! কতো রকম শাপ-শাপান্ত, “মাগীর বুকের দুধে ঈশ্বর বিষ ঢেলে দিন, ঐ শাকচুন্নী ও মরুক, আর ওই মুখপুড়ি-ও!”, সময়ের সাথে আশীষ বদলাতে থাকে, তারও মনে হতে থাকে, এই তিন বছরে সে একটুও চেনেনি আশীষকে। তখনও লোকের দোকানে কাজ করে; বাড়ি ফিরে অমনি সমস্তটা মায়ের কাছে। একপাতা টিপ চাইবার অবকাশটুকু নেই। এরকম আরো কত কিছু…সেসব দিন কি ভোলবার?
    এসব ভাবতে থাকলে ক্রমশ তার চোখ ছ্বলছ্বল করে ওঠে। আজকাল বোধ হয় তার শৈলজাও তার কষ্টগুলো বুঝতে শিখেছে, ওমনি জড়িয়ে ধরে মা’কে। শৈলজা বেলুন নিয়ে খেলতে বড়ো ভালোবাসে। অনেক বেলুন বেলুন বলে বলে অবশেষে বেলুনকে “ব্যেঁউ” বলতে পেরেছে। সে কি আনন্দ সেদিন মা-মেয়ের। কত আদর সেদিন, কত স্বপ্ন…”এইতো হচ্ছে, এবার পারবি, দেখিস…(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)ঠিকই পারবি।” আচমকা খিলখিল করে হেসে ওঠে রমা আনমনে। দু’হাতে শৈলজাকে একটু ওপরে উঠিয়ে নেয়, নাকে নাক ঠেকিয়ে খেলা করে। ততক্ষণে চারদিক হলদেটে হয়ে এসেছে। ওদের নীচের ফ্ল্যাটের চ্যাটার্জিদের বৌ’টি তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলগাড়িতে তুলে দিতে যায়। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগেই পিছু পিছু জলের পাত্র নিয়ে ছুটে আসে চ্যাটার্জিদের ছেলে। টাটা করতে করতে স্কুলগাড়িটি মিলিয়ে যায় দূরে। ফিরতি জুটির কাঁধে কাঁধ লাগে আলতো, ফিরে তাকায় একে অপরের দিকে, মুচকি হেসে দেয় বৌ’টি। আঁচল টেনে একটু পর্দা ঘেঁষে সরে আসে রমা, পাছে ওরা ওদের ঘরের দিকে তাকাতে ওকে দেখতে পেয়ে যায়; ওর শৈলজাকে। চ্যাটার্জিরা এই অ্যাপার্টমেন্টটার মালিক। বৃদ্ধ চ্যাটার্জিবাবু আগে নামকরা কার্ডিয়াক সার্জেন্ট ছিলেন। ছেলে-বৌমা দু’জনেই ডাক্তার। ফলতঃ ওদের মতো অতো সচ্ছল আর্থিক সঙ্গতি নেই রমাদের। গ্রামের বাড়িতে যখন থাকতো তখন লোকের দোকানে কাজ করত আশীষ, শহরে আসার পর এই বছরদুয়েক হলো দোকানঘরটা নেওয়া,সেই থেকে নিজের ব্যবসা নিজে সামলাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই চেহারার দীপ্তি কিম্বা বেশভূষা, কোনোটাই ওর সঙ্গে তুলনীয় নয়। আর, শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা ছেড়েই দেওয়া গেল; গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই তো…যাই হোক, সমস্তটাই মেনে নিতে পারে সে, তবে একটা বিষয় যেটা মানতে পারে না সেটা হল শৈলজাকে কেউ দয়ার কিম্বা ব্যাঙ্গের চোখে দেখলে। তাই, সবচেয়ে বড়ো কাঁটার মতো বিঁধে আছে গতবার দুর্গাপুজোর অঞ্জলীর দিনের ঐ ঘটনাটা। ও ভোলেনি কিছুই, ভোলা যায় না। এসব মনে করতে থাকলে ঐ লাইনটা রমার কানে বাজে,”বনুটা অসুস্থ তো বাবু, ও তো তোমার মতো হাঁটতে দৌড়াতে পারে না,ও কি করে খেলবে তোমার বলো?” আর তারপর শৈলজাকে আড়চোখে আপাদমস্তক একবার দেখে স্বামী-স্ত্রীর ওই মুখ বাঁকানো হাসিটাও। হয়তো আশীষের কাছে সেদিন একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়ে তাকিয়েছিল আশীষের দিকে, ভ্রূ কুঁচকে ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেদিন।
    সেই থেকে রমা এদের এড়িয়ে চলে। শৈলজাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, দাদাইয়ের মতো তুমিও স্কুলে যাবে একদিন।

    খেয়াল থাকে না, কখন বাজার থেকে ফিরে গেছে আশীষ, স্নানটাও সারা হয়ে গেছে তার। ধূপের মিষ্টি একটা গন্ধে সারাটা ঘর ভরে ওঠে; পূজোয় বসে গেছে ও। আজ বড়ো দেরী করে ফেললো রমা। আশীষ সচরাচর রেগে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ পাবার পরেও চুপ থাকার মানুষ নয়, রমা প্রথমটা একটু অবাকই হলো, তারপর চটজলদি শৈলজাকে বিছানায় রেখে হেঁসেলমুখো হলো।
    কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের টিফিন সাজিয়ে দিলো রমা। লাউয়ের চচ্চড়ি, রুটি আর ডিম সেদ্ধ। আশীষ এমনিতে রমা বা শৈলজার সাথে বেশি একটা কথাবার্তা বলে না, তবে অন্যদিন হলে এতক্ষণে রমা’র মা-বাবা পিতৃপুরুষ উদ্ধার করে দিতো মুখের ভাষায়; বলা বাহুল্য এর আগে যখনই এমন ঘটনা ঘটেছে, সবক্ষেত্রেই তার গায়ে হাত ওঠাটুকুই শুধু বাকি ছিল! আজ বিষয়টা একটু আলাদা। এর আগে কখনও যা হয়নি, আজ তা হয়েছে। আজ আশীষ রান্নাঘরে দেখতে গিয়েছিল কোনো কারণে। আশীষ তখন সকালের টিফিন শেষ করতে ব্যস্ত, চোখ থালার দিকে তখনো। রমা অবাক হয়ে আশীষকে দেখছে, সে নিজেও জানে এ ঘটনা নেহাৎ-ই অসম্ভব, মাঝে একবার তার মনে হলো বুঝি সে স্বপ্ন দেখছে তবু তার ভাবতে বেশ ভালো লাগলো বিষয়টা। খেতে খেতেই আচমকা চিবানো বন্ধ করে আশীষ একবার রমার দিকে কটকট করে চায়, “কিছু বলবে?” আচমকা কিছুটা থতমত খেয়ে যায় রমা। অন্যদিন হলে ওর গলাটাও রসকষহীন-ই থাকত, আজ সেটা পারলো না রমা। বেশ ভালোভাবেই বলল, “আরেকটা রুটি নাও না গরম গরম, তরকারি দিই আরেকটু? সেই কোন বেলায় ভাত খাবে তার ঠিক নেই! ফিরতে ফিরতে তো সেই রাত…”। আবার সেই আগের মত রাগ ও দোষারোপের দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখে নিল রমাকে, “সকাল থেকে এক পয়সা আয় নেই, আদিক্ষেতা যত!” তখনো বেশ কিছুটা তরকারি আর অর্ধেক রুটি থালায় পড়ে। আশীষ উঠে গেল। থালার দিকে তাকিয়ে রমা একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবলো, “মধ্যবিত্ত ফ্রীজের কখনো পুরো ঠাসাঠাসি ভর্তি থাকবার স্বপ্ন দেখতে নেই। বড়ো জোর সে এটুকুই কল্পনা করতে পারে যে, আজ অন্ততঃ পুরোপুরি ফাঁকা থাকবে না সে। এ আবার কোনো স্বপ্ন হলো নাকি! বরং স্বপ্নই দেখতে নেই।” তবে হ্যাঁ, আজ দিনটা সে তার নিয়মিত ডায়েরীতে বিশেষভাবে মার্ক করে রাখবে, যে, আজ কিছু ভালো হয়েছে। অন্যদিন সে বকা খায়, আজ আশীষ বকেনি একটুও। আসলে আজ লিখবে না, লিখবে কাল দুপুরে। প্রতিদিন দুপুরের অবসরে বসে বসে সে আগের দিনের ঘটনাগুলো নিয়ে ডায়েরি লেখে। অধিকাংশ দিন সে লেখা জুড়ে শুধু শৈলজা-ই থাকতো, আজ পৃষ্ঠার এতটুকু জায়গার ভাগ সে আশীষকেও দেবে। এমনিতে অফ সিজন, বেচারার ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। চিন্তায় থাকে…তাই হয়তো।
    আশীষ বেরিয়ে গেল। জানালা দিয়ে দেখল বাস ধরছে আশীষ। শৈলজাকে কোলে নিয়ে তার হাত টা ধরে, “টাটা করো বাবাইকে, টাটা করো…বলো টা-টা বাবাই…!”

    ।। দৃশ্য-৩ ।।*

    আজ শৈলজা একটি অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলো। আশীষ ভুলবশত তার ভেতরের লকারের চাবির ব্যাগটা ফেলে গেছে। জামাকাপড় কেচে সবে আধভিজে আঁচলটা কোমরে বেঁধে ঘরে আসছিল, দেখে তার শৈলজা “ব্যেঁউ ব্যেঁউ” করে হেসে হাততালি দিয়ে উঠছে আর, মা যেভাবে বেলুন ফোলায় সেভাবে চেষ্টা করছে সেই বেলুনটা ফোলানোর চেষ্টা করছে। অভ্যাস নেই, তাই, একটু একটু হাওয়া ঢুকছে, আবার ফড়ফড় শব্দ করে বেরিয়েও যাচ্ছে। “কি কচ্চে আমার শৈল মা, দেখি তো…” এগিয়ে আসতেই ওটা শৈলজা মা’কে দিয়ে দেয়। জিনিসটা হাতে পেতেই একবার শৈলজাকে দেখে নেয় আর, তাড়াতাড়ি ওর মুখ মুছিয়ে দেয়,”বেলুন না মাম ওটা…।”
    উত্তরে শৈলজা বলেছিল, “ব্যেঁউ নাঁ”। শৈলজা না জানলেও জিনিসটা চিনতে অসুবিধা হয়নি রমার। জিনিসটা আসলে কন্ডোম, যেটাকে দেখে ও বেলুন ভেবেছে। শৈলজা তখনো “ব্যেঁউ ব্যেঁউ” করছে আর কোলে নিয়ে খেলতে ইশারা করছে। লকারের চাবির ব্যাগটা পাশেই খোলা পড়ে ছিল, আরো কয়েকটা সেখান থেকে বেরিয়ে রয়েছে। শৈলজার কথায় কান না দিয়ে সে তাড়াতাড়ি পাশেই টেবিলটা থেকে তার চশমাটা নিয়ে আসে। সেটা চোখে গলাতে গলাতে ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়, কয়েকটি গর্ভরোধক বড়ির পাতাও আছে তাতে। আটটা বড়ি খাওয়া ও হয়েছে তার থেকে। দু’তিন বার ভালো করে নামটা পড়ে দেখে রোদে এসে,যাতে ভুলের কোনোরকম অবকাশ না থাকে। কিছুক্ষণের জন্য সবটা থমথমে হয়ে আসে। ব্যাগটা হাতে ধরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে রমা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। গায়ে বল পাচ্ছে না সে, ঠোঁট দুটো কুঁচকে আসছে। একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে সে সন্ধানকার্য্য জারী রাখে। আর সেভাবে কিছু পায় না, ভেতরের চেনটা বন্ধ করে পরের চেনটা খোলে। একটা গোলাপী তোয়ালে-রুমাল পাওয়া যায়। খুব ভালো করে গন্ধটা নেয়, পারফিউমটা মেয়েলি। রুমালের ভাঁজটা খোলে, গাঢ় লাল লিপস্টিক মোছার অবশেষ তাতে। নিস্তব্ধে একবার শৈলজাকে দেখে নেয় ও। বকা খেয়ে বাচ্চারা যেমন চুপ মেরে যায়, তেমনি একটা মুখোভঙ্গি করে বেডশীটের কোণের থেকে একটা সুতো ছিঁড়ে নিয়ে খেলছে মাথা নীচু করে। ওটা ও মুখে দিতে গেল। আচমকা ভীষণ চটে গেল রমা। এযাবজ্জীবনে যা সে কক্ষনো করে নি বা করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি, তেমনটা আজ হয়ে গেল তার হাত দিয়ে, আবেগবশত। শৈলজাকে পায়ে সপাটে একটা থাপ্পর মেরে বসল রমা,”সবটা তোর জন্য হয়েছে”… এই পৌনে ছয় বছরের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা শৈলজার এই প্রথম। সহ্য করার অভ্যাসটা নেই তার, ছন্দহীন ও এলোমেলো ভাবে যন্ত্রণায় কেঁদে কঁকিয়ে উঠলো শৈলজা। চারদিকের গোটা স্তব্ধতাটা মূহূর্তে চুরমার হয়ে এলো। পাশে দত্তদের বাড়ির ছাদ থেকে ক’টা পায়রা উড়ে পালালো ফড়ফড় করে।
    এতক্ষণে ঘোর কেটেছে রমার। শৈলজাকে এইবার বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে তার প্রতিবাদটা অনুভব করতে পারলো সে। এই প্রথমবার, তার নিজের শৈলজাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে যদিও নিষ্ফল, তবু মৃদু একটা প্রতিবাদ অনুভব করলো সে। মা’কে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলো কি তার শৈলজা? সে ভয় পেয়েছে এবং সবটা হয়েছে ওর ওই হঠকারী বোকামোর জন্য। অপরাধবোধে হাত-ঠোঁট কেঁপে উঠল রমার। নাকছাবিটার দু’পাশ দিয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়া চোখের জলের ধারা দু’টোয় মাঝ দুপুরের নির্মম রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠলো। এই ঘরটায় ভীষণ দম আটকে আসছে তার, সে নিজেও অনেকখানি ভয় পেয়েছে, ঘর ভেসে যাওয়ার ভয়। না তবে নিজের জন্য নয়, কোথায় যাবে সে তার শৈলজাকে নিয়ে-এই ভয়। সেটা সে নিজেও খুব ভালো ভাবে জানে। তবু, সে কি কোথাও এতটুকু নিজের জন্য ভেবে ফেলেছিল? আজ সকালটার পর? আশীষকে সে বিয়ের তিন বছর আগে থেকে চেনে। শুধু চেনে কেন? ওদের সম্পর্ক ছিল, ভালোবেসেছে সে। আশীষও ভালোবেসেছে তাকে… পাল্টে যাওয়ার আগে অবধি, যতটা বাসা যায়। তার শৈলজাকেও তো আশীষই দিয়েছে তার কোলে। শুধু শৈলজাই কেন? তাকেও তো আশীষই জন্ম দিয়েছে, মা হিসেবে। সে বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না সে আশীষকে আর ভালোবাসে না, শুধু শৈলজার লালনপালনের জন্য পড়ে আছে এখানে- সে কথা সে বলতে পারবে না।
    আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না সে, বিছানার পাশটা ধরে ঢলে পড়ে মেঝেতে, কেঁদে ফেলে হাউহাউ করে, দিশাহীন হয়ে। সে বুঝতে পারে না, এ তার কেমন ভালোবাসা যা অন্য ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবে না…
    কাছে টেনে ভীষণ জড়িয়ে ধরে শৈলজাকে।
    “মা ভীষণ খারাপ বলো সোনা? খুব পচা মা…”, একের পর এক চড় মারতে থাকে নিজের গালে। শৈলজা ততক্ষণে চুপচাপ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরেছে। আচমকা তার শৈলজার এই নিস্তব্ধ আলিঙ্গন রমাকে অবাক করে দেয়। মায়ের অভিমান হলে, মনখারাপ হলে সেটা ভোলানোর দায়িত্বটা যে তার-ই, সেটা তার শৈলজা বুঝে গেছে এইটুকু বয়সেই, এত শারীরিক প্রতিকূলতার পরেও। এতটা তো তার জন্য কেউ করেনি এর আগে… মূহূর্তে ভালো হয়ে গেল তার মনটা। বড়ো আনন্দ হলো মনে মনে, তার শৈলজা বড়ো হচ্ছে।

    দেখতে দেখতে বেলা বেশ বেড়েছে তরতরিয়ে। শীতের রোদ, তাই যথেষ্ট প্রখর হলেও জানালা দিয়ে তার যেটুকু ভগ্নাংশ ঘরে এসে পড়ে, তাতে বেশ কেটে যেত সারা দিন মা-মেয়ের চাঁদের হাট সংসারটা। সাড়ে বারোটা হবে। নীচের তলায় চ্যাটার্জি বাবু বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন; চেম্বার খুলেছেন। এবেলার মতো চেম্বার এখনই বন্ধ। এবার স্নান সারবেন উনি। তাই, রোজকার মতন আজো মেপে মেপে আধ বাটি সরষের তেল নিয়ে ছাদে এসেছেন। ওখানকার কলেই স্নান সেরে নেবেন। তারপর গা-মাথা মুছে গামছা মেলে, সূর্যপ্রণাম করে তারপর ছাদ থেকে নীচে নেমে আসবেন। জামাকাপড় কাচতে আজ দেরী হয়ে গিয়েছিল, তাই গামলা ভরে জামাকাপড় নিয়ে ছাদে পৌঁছেছে যতক্ষণে, ১২টা পেরিয়ে গেছে। এদের ছাদটা আদতে বিশালাকার। একটা সিঁড়ির ঘর আছে,যার একদিকে তিন-চারটে জলের ট্যাঙ্ক, একটা ট্যাপ আর ক’টা নারকোল গাছ যাদের পাতাগুলো ছাদে এসে পড়েছে। ওটা সামনের ছাদ। পেছনেও একটা ছ্যাতলাপড়া ছোট ছাদ আছে। ও ওখানে জামাকাপড় মেলে। এই ছাদটা ওদের ঘরের ছাদ। বাড়ির পেছন দিক হওয়ায় মেইন্টেনেন্স এবং চাকচিক্য দু’টিই কম। এদিকে সবসময়ই চিলেকোঠার পেছনের দেওয়ালটায় মদের বোতল জমা থাকে। চ্যাটার্জি বাবু পাশের বাড়ির দত্তদের ভাড়াটীয়াদেরকে দোষারোপ করলেও পাড়াশুদ্ধু সবাই জানে এ কাজ চ্যাটার্জি বাবুর ছেলের।
    ছাদ এবং রান্নাঘরের পেছনের জানালা- দু’টোকেই সে একটু এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। দত্তদের ছাদটা এদের থেকে একটু নীচু, তাই একতলায় ওদের ছাদহীন কলতলা কিম্বা, রান্নাঘর দিয়ে সমগ্র ঘরের ভেতরটা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। দত্তদের ওই ভাড়াটিয়া ছেলে চারটিকে দেখলে শৈলজা ভয় পায়-বোঝা যায়। এইতো গতবার পুজোতে, ওরা চারটে মিলে কতো চেষ্টা করল ওকে কোলে নেওয়ার, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সে কত ধ্বস্তাধ্বস্তি! স্বভাবে লাজুক বা খুঁতখুঁতে কোনোটাই না হলেও শৈলজা কিছুতেই গেল না। আশীষ বিষয়টা যে ভালো চোখে দেখছে না, সেটা বুঝতে পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দেয় ওরা! অকারণ ছোঁয়াছুয়ি রমার এমনিতে পছন্দ নয়, তারওপর শৈলজাকে কোলে নেওয়ার বাহানায় কেউ এতটা কাছে এসে পড়বে এবং, ইচ্ছাকৃত ভাবে কেউ তার পোশাকের ফাঁকফোকর দিয়ে তার ত্বকস্পর্শ করবে, সেটা তো মেনে নেওয়াই যায় না। সেই থেকে অকারণ জোরে নিঃশ্বাস টানাটাও ও অপছন্দ করে।
    ছাদজোড়া স্তব্ধতা। দু’চারটে কাক বসে আছে এই প্রখর রোদে। দত্তদের ছাদে ক্রিকেট খেলছে ছেলেচারটি। মাঝে মাঝে ওদের ছয়, চার বা উইকেট পড়া জনিত উল্লাসধ্বনি ভেঙে দিচ্ছে ছাদের নিস্তব্ধতাটা।কাদের বাড়ি পুজো হচ্ছে এখন, ঘন্টা নাড়ার টংটং আওয়াজটা আসছে। পাড়ার মোড়ে টাইমকলে জল এসেছে। জল বয়ে যাচ্ছে নর্দমা দিয়ে। সরসর আওয়াজটা হচ্ছে। একটা হলদে ট্যাক্সি এয়ারহর্ণ বাজিয়ে মোড় ঘুরলো। একটা বাসনওয়ালা বোধ হয় মোড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ওদের বাড়িটার সামনে দিয়ে- “বাসন…বাসন” আওয়াজ আসছে গলির অনেকটা ভেতর থেকে। ওদের এই ছাদে ওঠা সিঁড়িটা ভালোভাবে সিমেন্ট মাখানো নয়; দেওয়ালটাও না। ইট বেরিয়ে থাকে। ফাঁকফোকরে আরশোলা আর দু-তিনটে টিকটিকি থাকে। রোজকার মতন আজো, মাকড়সার জাল পড়ে কালচে হয়ে আসা হলদে বাল্বটা কেউ নেভায়নি। টিকটিক শব্দ করতে করতে একটা টিকটিকি সরে পড়লো কোথায়। দূরে কোথায় নামাজ পড়ছে এখন-“আল্লাহ-হু-আকবর…”।
    বড়ো ছাদে ওইকোণে চ্যাটার্জি বাবু ঝাপুস ঝুপুস করে জল ঢালছেন মাথায়। আজ সে শৈলজাকে কোলে করে এনেছে ছাদে। ঘরে টোপ খেয়ে খেয়ে জল পড়লেও রমা তার নিজের ও শৈলজার অন্তর্বাসটা ভেতরে মেলে দেয়; আগে চুরি গেছে কয়েকটা। আগে শুধু নিজেরটা ঘরে মেলত, এখন শৈলজারটাও, বিশেষত দুর্গাপুজোর ঐ ঘটনাটা থেকে।
    খেলার মাঝে বয়োকনিষ্ঠ ছেলেটি মাথা নেড়ে যে ইশারা করল বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেটিকে, তা রমার চোখ এড়ালো না। শৈলজা আবারো মুখ লুকিয়ে নিলো মায়ের শাড়িতে। জামাকাপড় মেলা প্রায় শেষের পথে। ছেলেগুলো এগিয়ে আসল এ’ছাদের দিকে, “কি বৌদি, দাদা আজ বাড়ি আছে নাকি?…কই জুনিয়র, খেলতে আসতে হবে তো আমাদের সাথে। সেঞ্চুরি হাঁকাতে হবে তো, নাকি?” জামাকাপড় মেলা শেষ না করে শৈলজাকে ও সরিয়ে নেয় অন্য কোলে। কটকট করে চেয়ে উত্তর দেয়, “না।” একটু না -রমার কাছে যায় ছেলেগুলো। একটা ছেলে ওপর চোখ দিয়ে দেখে আবার জানতে চায়, “দাদা আজ বাড়ি নেই বুঝি!” পেছনে দু’জন ব্যাঙ্গের হাসি হেসে ওঠে। আবার ও তেমন গম্ভীরভাবে কটকট করে উত্তর দেয় রমা, “তার প্রয়োজন পড়বে না।” বালতি নিয়ে পেছন ফিরে চলে যাওয়ার উপক্রম করে। এতক্ষণ চ্যাটার্জি বাবু ওকে দেখছিল। কয়েকটা মূহূর্ত রমার চোখে ওর চোখ পড়ল, চোখ এড়ালো না ভ্রু কোঁচকানোটা ও-রমার কেমন যেন খটকা লাগলো চোখটা মুখটা ওনার মুখ থেকে কিছুটা ‘নীচে’ নামিয়ে। আচমকা ভিজে কাপড় থেকে একটোপ ঠান্ডা জল খোপার নীচের আলগা ঘাড়ের কাছ বেয়ে পিঠে গড়িয়ে পড়তে চমকে উঠলো ও। তাড়াতাড়ি আঁচলটা গায়ে টেনে নীচে চলে গেল শৈলজাকে নিয়ে।

    ।। দৃশ্য-৪ ।।

    ডায়েরীটা খোলা পড়ে আছে বিছানায়। একটা পাতা ফাঁকা দিয়ে ও পরের পাতায় লিখতে শুরু করেছে সবে। লিখেওছে একটা লাইন, “এখনো অবধি আজ দিনটা গত ন’বছরে সবচেয়ে ভালোগুলোর মধ্যে একটা বলে গণ্য করার মতোই ভালো কেটেছে…”।
    পেনটা সেভাবেই পৃষ্ঠার ভাঁজে। ভীষণ যন্ত্রণা তলপেট সহ গোটা নিম্নাঙ্গে, সাথে রক্তবমি নিরন্তর। কলঘরের মেঝেতে নিথর বসে পড়েছে রমা। একেতে কুঁকড়ে রয়েছে যন্ত্রণায়, সাথে এই নিরন্তর বমির জন্য দুর্বলতা। এদিকে কান্না থামে না শৈলজার। কোনোরকমে সে ফোন করে আশীষকে। দ্বিতীয়বার ডায়েল করাতে আশীষ ফোন ধরে ও সবটা শুনে জানায় সে চ্যাটার্জি বাবুকে একবার ঘরে এসে দেখে যেতে বলছে। ফোনটা রেখে রমা নিজের দুর্বল, এই শীতেও ঘাম চপচপে শরীরটা উঠিয়ে নিয়ে শৈলজার কাছে আসে, হাঁফাতে হাঁফাতে কোনোরকমে বলে, “কাঁদিস না মা… কিচ্ছু হয়নি বাবাই, আছে তো মা…”
    কলিং বেলের আওয়াজে এর আগে কখনো এতটা চমকে ওঠেনি রমা। শৈলজার হাতের বালাটায় রমার আঁচল আটকে যায়। ও দু’হাতে রমাকে আঁকড়ে ধরতে চায় বোঝা যায়। কান্নাটা আরো বাড়ে, যেন সে যেতে দিতেই চাইছে না মা’কে। কোনোরকমে তাকে বুঝিয়ে অবশিষ্ট শক্তিটুকু একত্রিত করে কোনোরকমে নিজেকে টেনে-হিছড়ে দরজা অবধি আনে। দরজা খোলে।
    “আশীষ সবটাই বলেছে আমায়, এসো বৌমা এখানে বোসো। রমাকে কাঁধে ধরে বিছানায় বসায়। রমার তখন সে স্পর্শের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তিটুকু নেই। কোনোরকমে বিছানায় ঢলে শুয়ে পড়ে রমা। শৈলজা রমার হাত অবধি নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। ক্রমশ নিস্তেজ ও ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে রমা দেখতে পেল, শৈলজাকে চ্যাটার্জি বাবু কোলে তুলে নিয়ে বাইরের ঘরে চলে গেলেন। শৈলজা পিঠ চাপড়াতে শুরু করেছে ওনার, ওটুকুর বেশী প্রতিবাদ বোধ হয় ওর পক্ষে সম্ভব নয়; আগে হলে হয়তো সেটাও পারতো না ও। শৈশজার কান্না আরো জোরে শোনা যাচ্ছে, আর চ্যাটার্জি বাবুর মৃদু গলাটা- “সারাদিন তো খেললে মায়ের সাথে, এখন তো মায়ের শরীর খারাপ করেছে, এবার তো ডাক্তার আংকেলকে খেলতে হবে…।”…ক্রমে ধড়াস শব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে এলো একটু পর। শেষ আওয়াজ যেটুকু রমা শুনেছিল, সেটা হলো শৈলজার চিৎকার “ব্যেঁউ নাঁ…ব্যেঁউ নাঁ”, যেমন আওয়াজটাও সকালে কন্ডোম দেখে করেছিল মায়ের শেখানোর পর। দরজার নীচের ফাঁকটুকু দিয়ে শুধু একটা কাপড় মেঝেতে খুলে পড়ার ছায়াটুকু পড়লো, যেমন কাপড়টা তার বাবা পরে। বাকি যে আওয়াজটুকু বাইরে থেকে শোনা গেল, সেটা শৈলজার কান্না নাকি কান্নার নীচে চাপা পড়ে যাওয়া রমার আর্তনাদ, আমি ঠিক জানি না। বোধ হয়, শৈলজা জানে, ওর মনে থাকা ও অসহায়ভাবে মেনে নেওয়া শেষ দৃশ্যটায়, ওর মায়ের কাঁধে অন্য কারো থাবা বসেছে…
    আমি সেটাও জানি না।

    ।। দৃশ্য-৫।।

    দু’দিন পর সকালে নিয়মিত খবরের কাগজে পাঁচের পাতায় হেডলাইন এর নীচের কলামে বামদিক ঘেঁষে আরেকটি খবর ছাপলো :

    ‘মেয়েকে বিষ খাইয়ে ও নিজেও সেই বিষ পান করে আত্মহত্যার মা ও মেয়ের। স্বামী আশীষ তরফদারকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসাতে সে জানায় এ সম্বন্ধে তার কোনো ধারণিই ছিল না। সে রোজকার মতো সকালে দোকানে বের হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি মালিক কমলচরণ চ্যাটার্জি ও তার পরিবার ওদের সুখী দাম্পত্য জীবনের কথা জানিয়েছেন।…’

    ।। দৃশ্য-২ ।।

    শেষ রোগীটি ফিরে গেছে তখন সন্ধ্যে আটটা বাজে। ওপর আর চারপাশ দেখে আশীষ চ্যাটার্জি বাবুর চেম্বারে ঢুকলো। চোখের ইশারায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল ভেতর থেকে।

    –দেখুন, ব্যবসার হাল এমনিতে খারাপ নয়। সামনে পুজো, এখন খোদ্দেরের চাপ ও বেড়েছে…কিছু পুঁজি হলে…ইয়ে আরকি…

    –দ্যাখো বাপু, আমায় তোমার ব্যবসার গপ্পো দিতে এসো না। টাকার বন্দোবস্ত আমি করব, তুমি শুধু হ্যাঁ বললেই হলো।

    –কিন্তু রমা…

    –ওসবের জন্য তোমায় ভাবতে হবে না বলেছি তো…আর কথা বাড়িও না, নাহলে কিন্তু আমার বড়ো মেয়ে সবটা গিয়ে বলে আসবে রমাকে।

    — আ-চ্ছা, বেশ…তাই তবে।

    –কি হে, আমতা আমতা করছো কেন? বিয়েটা করছো তো, নাকি…?

    — না না, আপনি হলেন ভগবান। কিন্তু, টাকাটা এখনি হলে একটু…

    –সেরকম কথাটা তো ছিল না। তবু, চিন্তা কোরো না মাই সন। আমি আজি লাখ দুয়েকের ব্যবস্থা করছি। বাড়িতে সুন্দরী বৌ থাকতে কেউ টাকার চিন্তা করে? বোকা ছেলে কোথাকার!…

    –আমায় কি করতে হবে?

    –এই বড়িগুলো রাখো, ওদের খাবারে মিশিয়ে দিও। ব্যস, বাকিটা আমি দেখে নেবো। নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে যেও।

    ________

    পাদটীকা:–
    * দৃশ্য -১ র পর দৃশ্য-৩ টি ভুলবশত নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

    •বিঃ দ্রঃ- গল্পটিকে একটু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখতে অনুরোধ রইলো।

    ~ঋজু

  • কবিতা

    কবিতা- পৃথিবীটা উল্টো ঘুরছে

    পৃথিবীটা উল্টো ঘুরছে
    -ঋজু

    মনে মনে ছাপাখানার ক্যাশ বাক্স সমৃদ্ধ হচ্ছে দিনে দিনে।
    তক্ষশিলার তাকে তাকে চটী বই;
    ডেকরেশন বলতে ছাদ থেকে ঝুলন্ত খাঁচা;খাঁচায় বন্দী দাঁড়কাক।
    মনে মনে প্রতিদিন মিউজিয়ামগুলো পুড়ে মুছে যাচ্ছে-পূর্ববর্তী ইতিহাসের উত্তরাধিকারী ইনভেস্টমেন্ট আনছে পরবর্তী ইতিহাস।
    মনে মনে আসিফা-ট্যুইঙ্কেলদের ধ্বংসস্তূপে ঝরছে কবরের নিস্তব্ধতা।
    দেহে পোষাক বলতে শুধু চোখে বাঁধা কাপড়টুকু; বাকিটা ঘেমোগন্ধের, মেদময়, লোমশ, নরম, লতানো, ল্যাংটো মাংস।
    নিজেদের কুকুরত্বের দিব্যি কেটে মোমবাতি মিছিল চলছে চটকল থেকে চকলেট।
    হাঁটছেন একশো বছরের যুবক ও ট্রান্সপ্লান্ট করে স্তন-নিতম্ভ বড়ো করা মানসিক ভিখারীনিরাও।
    সারা পৃথিবীর মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে;
    যারা একদিন স্লোগান হতে পারতো-সেসব বিশাল ডানাওয়ালা থুরথুরে বুড়োগুলোকে এডিটরে নাচানো হচ্ছে মার্কেজের দুঃখিনী বেশ্যাদের সাথে।
    প্রতিদিন গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বামিয়ান।
    শ্রমিক পুঁজি গড়ছে; পুঁজি গড়ছে শ্রমিক,
    নিজেকে নিজে উৎপন্ন করছে সবাই-ই।
    নবজাতক ইনভেস্টমেন্ট
    মানুষ পণ্য চোখ ধর্ষক।
    মেরুদণ্ড ইনস্টলমেন্টের ফ্ল্যাটবাড়ি।
    হৃৎপিণ্ডে জড়ানো কন্ডোম।
    জি.এস.টি. লেগেছে আন্দোলনে।

    পৃথিবীটা উল্টো ঘুরছে…
    চলুন আগুন জ্বালাই।

  • কবিতা

    কবিতা- অন্তিম ভালোবাসাকে…

    অন্তিম ভালোবাসাকে…
    – ঋজু

     

    একটি তেইশ বছরের মেয়ের পায়ের কাছে
    লুটিয়ে পড়তে পারে না কি একবার, একবার ও- 
    এ গোটা কাব্য ও কাব্যবহির্ভূত প্রেম-সংসার?

    আমি চাই, ঘাড় ধরে নিয়ে এসে-

    অবশ্য যদি প্রেম-প্রাক্তন-পিরিয়ডস-পরকীয়া ও তার বাইরে,
    লিঙ্গ-যোনী-স্তন-দন্ত-দম্ভ-আঁধার ছাড়া
    যদি কিছু থাকে অবশিষ্ট দর্শন,ঘাড়
    তবে একবার,শুধু একবার
    দর্শন করাতে চাই সে নারীর পদযুগল-
    আমাদের ঐ প্রেম ও বিদ্রোহাত্মক সমস্ত পোশাক-আশাকের আন্তিগোনে;অন্তমিলে:

    দেখবে, ওরা বলবে, তুমি নির্লজ্জ, বেহায়া,
    তুমি ওদের চোখে-চোখ সেতু গড়ে, উঠে দাঁড়াবে শিরদাঁড়া টানটান রেখে।
    ওরা বলবে, তুমি নষ্ট, ভ্রষ্ট; বলবে বাজারে বিকোনো তুমি,
    স্মৃতি-সত্ত্বা ধুয়ে যাবার ভয়ে দীর্ঘকাল অস্নাত,ঘেমো গন্ধের কদাকার তোমার দেহখানি থেকে তুমি ছুড়ে ফেলে দেবে শেষ অন্তর্বস্ত্রটুকু ওদের মাথার কাছে।
    আরো ফুঁসে উঠে ওরা জোর গলায় তোমায় বলবে “চোওওওপ”
    তেমনই স্টোয়িক নিস্পলক অভিব্যক্তিতে অট্টহাসি হেঁসে উঠবে তুমি চন্ডালিকার মতো।
    দেখবে,ঝনঝন শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে ওদের রঙ-বেরঙের সার্সি-ব্যাঙ্গ-বিলাস;
    কনস্ট্যান্টিনোপল পতনের মতন,ক্রুসেডের ভয়ের মতন।
    ওরা অবাক হবে; কপালের ভাঁজগুলো ক্রমশ গাঢ় হতে হতে ঘাম জমবে আরো,
    ওরা শাপ-শাপান্ত করবে হেঁকে হেঁকে, “আজ থেকে তোমার হৃৎপিণ্ড অবেধ!”
    “Twenty-six men and a girl” গল্পটির মতন মেডুসীয় ভঙ্গিতে দুয়ার খুলে তুমি দাঁড়াবে চৌকাঠে, এক-পা, দু-পা
    তুমি এগোবে তোমার নিজস্ব বর্ন-গন্ধ-প্রতীতি-সত্ত্বার অলংকারে, নিরাবরণ হয়ে সাদাকালো মাইম ফুটপাতে;ভিড়ে, নাট্যমঞ্চে, কাব্যগ্রন্থে, মহাকাব্যে ,অসম্ভবে, অসীমে।
    ওরা আপ্তবাক্য পাঠের মতন নিজেদের আশ্বাস দেবে, সান্ত্বনা দেবে, “এ কোনো মহাকাব্যে হয়নি,এ অসম্ভব”
    তুমি প্রকাশ্য পৃথিবীতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে তোমার পোসাইডন প্রেমিক-ভালোবাসাকে।

    ওদের ভিতর যারা “এই ভালোবাসা অসম্ভব”এর অ্যানাসথেসিয়া মেখে মহাকাব্য লিখে এসেছে যুগ যুগ ধরে, এসব দেখে তাদের বুক কাঁপবে দুরদুর করে।
    আর যারা অ্যানাসথেটিক হয়ে থেয়েছে হেডিসের কয়েদির মতো,
    তারা তোমার মতো প্রেমিক-প্রেমিকা হতে চাইবে।।

  • গল্প

    গল্প- ভিক্ষা: একটি অসামাজিক বায়োপিক

    ভিক্ষা: একটি অসামাজিক বায়োপিক
    -ঋজু

     

    টাইম কল থেকে জল পড়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে ক্রমশ পুরু হয়ে। এভাবে রোজরোজ কলতলার মেঝেটায় পড়ে পড়ে বিরাট একটা ফাটল ধরেছে মাঝখানটায়; তবু পড়বে। কেউ নেই বন্ধ করার। নর্দমায় সাবান-ডিটারজেন্টের সাদা সাদা ফেনা; ভেতরের বাগদি পাড়ার রোগা রোগা ছেলেমেয়েগুলো স্নান সেরে গেছে; আর বোতল কলসি সব ভরে নিয়ে গেছে। ওদের বৌ’রা এদিকে আসে না স্নানে। দুটো মাথায় টুপি পরা মুরুব্বি গোছের লোক হনহন করে হেঁটে গলিটার ওপাড়ের কোথাও থেকে আচমকা বেরিয়ে রাস্তা পেরোলো। একটা ঠ্যাঙ খোঁড়া কালচে কুকুরটা রোজ রোজ এসব দেখে অভ্যস্ত; কলতলা থেকে ও পাশ দেয় ওদের। নর্দমার ধারে গিয়ে বসে-জল খাওয়ার বাহানায় লালা মেশায় সে জলে। ওটুকুই ওর গতি।
    সাড়ে বারোটা বেজেছে; এদিকটার সামগ্রিক শান্তি ভেঙে মসজিদে দুপুরের আজান, “আল্লা-হো-আকবর”। কাক বসে ছিল দু’টো ঐ গম্বুজটার ওপর। ফড়ফড় শব্দে ডানা ঝাপ্টে উড়ে চলে গেল।
    বড়ো বড়ো হরফে নামটা লেখা “শান্তি-নিবাস”।
    অনেক দূর থেকে থেকে অজয়-তিতাসা নামের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আসত এদিকটায়, অনেকটা রাস্তায় রাস্তা পেরিয়ে; লোকাল বাসে।
    দু’জনেই বিবাহিত বোধ হয়; তিতাসা তো অন্ততঃ…মেয়েটি সঙ্গে করে আনত চকোলেট, ডায়েরি এসব।
    মেয়েটি ছেলেটির কাপড়-জামা, কাজের ব্যাগ, জামার কাফ-কলার গুছিয়ে,
    নরম গোলাপি ঠোটপালিস চালিয়ে মুছে দিত সিগারেটের নিকোটিন জমা ঠোঁটজোড়ার প্রায় সবটুকু, সন্ধ্যে হবার আগেই মেয়েটির রুমালটি মেখে যেত নিজের ঠোঁটপালিশে।ফেরার পথে ওষুধের দোকান তার আগে। তারপর দৌড়ে যায় বাস-সেডে, টিকিট কাটে, লাইনে পা মেলায় তিতাসা, আর ফুটপাত ধরে লম্বা কমলাটে ছায়া ফেলে ফোনে মাতে অজয় ইত্যাদি।ঝনঝন শব্দ করে একটা পয়সাও নষ্ট করে না ওরা কক্ষনো এদিকটায়।

    সন্ধ্যে নামলে চাটুজ্যেদের বৌ বিলিতী আদবকায়দায় আপিস থেকে ফেরার পথে এদিকটায় ঘুরে আসে,
    মাঝে মাঝে বাঁকের ওদিকে মাইতিদের ব্লাউজের দোকানটা থেকে ঘুরে আসে।কি কেনে বোঝা যায় না।
    একদিন;পিছু নিয়েছিলাম…শুধু যায় আর দোকানদার বুড়ো টাকে বলে “৩৬,কালো দেবেন”
    একটা সিল-প্যাকেট ধরিয়ে দেয়; ও ব্যাগে নিয়ে নেয়।ব্যাগে চেন টানার সময়ও চোখে চোখে কিসব কথাবার্তা হয় তাকাতাকিতে।তেমনি বড়ো চারপাশ দেখে কানু কাকার দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে নেয় ব্যাগে।আর;পাবলিক টয়লেটের ওদিকটার অলিগলি থেকে “স্বাধীন সমবায় সমিতি”র কর্মচারীরা তালিম দিয়ে বের হয় কাজে, “বাবু,আজ যাবেন নাকি?”
    তার পেছনে থেকে টালি-চাল ঘর গুলোয় কালো আস্তরনপড়া হলদে হলদে ল্যাম্প জ্বলে;গোঙানি সোনা যায়।
    কানু কাকা চা খাওয়ায় একবার। ওদিকে ম্যানেজার সাহেব, মাইতি বাবুদের আড্ডা জমে সন্ধ্যে বেলায়,অনেক গল্পের ভিড় জমে। তাই চা নিয়ে সরে পড়তে হয়‌।তিনফুটের চা; দেহে কিছুটা প্রাণ আসে তারপর। উবু হয়ে বসি, বিঁড়িতে টান বসাই আর কান্ড দেখি।সাড়ে আটটার দিকটায় ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে-তাই সারাদিনের উপার্জন টুকু ব্যয় করে সেসময় একবার যাই পাবলিক টয়লেটে।
    লাগোয়া দেওয়ালের ফাটাফুটির ওপাড়ে চাটুজ্যেদের বৌ টাকে দেখতে…টয়লেটের মালিকও বুঝে গেছে বের হবার সময় আলতো হেসে পিট চাপড়ে দেয়।হারামজাদা বিশ্বাসই করে না, ওটা ওদেরই বৌ।
    তখন আমার পার্ট টাইম বয়ের কাজ শান্তি-নিবাসে ;সাব-মেনেজারবাবু বলেছিলেন অতিরিক্ত মাইনে দেবেন পয়লা আষাঢ়, চাটুজ্যের ছেলে-বৌ বিবাহবার্ষিকীতে খেতে এসেছিল রাতে। আমার চায়না মোবাইলটায় আবছা একটা ভিডিও-ও করেছিলাম; উল্টে বলে দিল “দিনে দুপুরে আফিম টানাটা বন্ধ কর। খুব লাল পড়ে না তোর?”
    ক্ষমা চাওয়ায় তারপর ওদের কাছে। সে দিন টা কি ভোলার? চাকরিটা চলে যায়।ফোনটাও কেড়ে নেয়।
    “এজন্যে তোকে রাখা? শালা এত ঢ্যামনা একটা দেহ বাগিয়ে রেখেছো আর ঘটে এতটুকু ঘিলু নেই? ভেন্টিলেশনটা নীচু করে কি জন্য বানানো নেমকহারামের বাচ্চা? লেডিস টয়লেটে সরাসরি ঢোকার জন্য?!!…যা, এবার যেখান থেকে এসেছিলি সেখানেই ফিরে যা; পচে মর আর দূর থেকে হাওয়ায় কখন কুর্তি উড়বে সে অপেক্ষা কর নাড়িয়ে নাড়িয়ে!”
    বলতে চেয়েছিলাম কিছু; থামিয়ে আবার বললেন, “পুলিশে দেয়নি তোর কপাল জোর!” জানতাম সাহসটা দিন দিন বাড়ছে। ছিল না আদতে; কিন্তু পেটের জ্বালা পড়লে যখন একটুখানির জন্যে অনেকটা আঁচড়ানো কামড়ানো দরকার পড়ে;সাহসটা এমনিই এসে যায় বোধ হয়।ভয় ছিল; এভাবে বাড়তে থাকলে একদিন সামলাতে পারবো তো নিজেকে?

    ফেরার পথে আফিম বড়ি কিনে ফিরি কানু কাকার থেকে।
    বাড়ি ফিরে লম্ফো জ্বালাই,চিকচিকে কাগজে কালো কালো বড়ি;আর তামাকের চোঙা।
    সারাটা পৃথিবী এমনই ধোঁয়া ধোঁয়া।
    তখন আমিই চাটুজ্যেদের বৌ- আমি ই ওপাশের ওষুধের দোকান-পাবলিক টয়লেট- সাদাকালো ছবি-চায়না ফোনের ফুটেজ-৩৬- কালিমন্দির-ঘন্টা ধূপ-ভাগ্যলক্ষী লটারি-গদির নীচে টাকা-শান্তিনিবাস-সমবায় সমিতি-আরো টাকা-আরো চাটুজ্যের ছেলে-বৌ- আরো আরো টাকা- পুরো শান্তিনিবাস-
    তি তা সা।
    ক্লান্তি-ক্রান্তি-কাশি…
    ভিজে প্যান্ট।।

    ঘটনাটা এইতো সেদিনের। দিনটা শনিবার। কুড়োনো ধূপ-মোমবাতি তে সেদিনও ভাগ্যলক্ষী অপ্রসন্ন। এমনিতে খারাপ দিন। শান্তিনিবাসের ওপরে সেদিন জ্বলজ্বলে একটা শালিক। কুকুরটাও কেমন নেতিয়ে রয়েছে সকাল থেকে। টাইমকলে আজ দেরীতে জল। সবে সবে বৃষ্টি হয়ে গেল তবু ফ্যাকাশে মেঘটা কাটে নি। কাদের মিছিল টিছিল হয়ে গেল। কত দাপাদাপি নতুন দিনের! কত ব্যারিকেড, মিডিয়া…. হঠাৎ,লালবাতি চেপে পুলিশ গাড়ি; অমনি ধরপাকড়। রাস্তা ফাঁকা মূহূর্তে।
    সমবায় সমিতির গলিগুলোর ভেতর থেকে আজো সাড়ে বাড়োটা বাজলো; “আল্লা-হো-আকবর…” ভেসে এলো।
    আজ তিতাসা অজয় সামনের পার্কটায়। চাপা গলায় তিতাসা ওর বুকে মাথা রেখে কিসব বকছে; আর আকাশের দিকে তাকিয়ে অজয় ধোঁয়া ওড়াচ্ছে নিয়মিত।
    সবশেষে বাজখাঁই গলায় একটা বিচ্ছিরি খাঁকারি শোনা গেল,”আরে এ তো আকচার ঘটে; এ আর এমন কি!” ফেলে দাও ওটা, ব্যাস, কেল্লা ফতে! আজি চলো ক্লিনিকে। আজ তো দুপুর দুপুর, সন্ধ্যের ভেতর হয়ে যাবে সবকিছু।”
    অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালো তিতাসা।
    -“আর কতোদিন অজয়? এভাবে অনেক তো হল… এবার প্লিজ…বিয়েটা…”
    -“দেখেছো তো? এই তোমাদের মেয়েদের সমস্যা …আর কমলিকা,ঈশান? ওদের? ওরা কোথায় যাবে?”
    ….

    অজয় উঠে চলে গেল একটু পর। তিতাসা তখনো আকাশের দিকে চেয়ে। উদাসীন।
    আজ মনে হয় সবকটা শখ মিটবে।
    আজ মনে হয়;অতোটা আঁচড়ে কামড়ে খেতে হবে না সবকিছুতে। আজ দেবতা প্রসন্ন।
    জানি না কেন, ওরা হাজার চেষ্টা করেও আমার মতো সর্বহারা হতে পারে না। তার জন্য আবার এতো আফশোস! যাকগে, আমার কি?
    জয় মা, জয় মা সিদ্ধেশ্বরী।
    একবার বড়ো যত্নে মাদুলিগুলো ছুঁয়ে দেখে নিলাম।
    আজ পিছু নেবো। নিতেই হবে। আজ না হলে কোনোদিন নয়। আজই…

    (শেষ দৃশ্য)

    কানু কাকার দোকানের এক কোনে তিতাসার লেদার ব্যাগটা পড়ে। ছিল অনেকটা দূরে; কাকা সরিয়ে রেখেছে ।সাড়ে ন’টা বাজে। আজ এ চত্ত্বরের সবকটা দোকানপাট বন্ধ। বৃষ্টি পড়ছে ছড়ছড় করে। রাস্তার পাশে জমা জল হূসহুস করে উড়িয়ে লাল-বাতি দেওয়া পুলিশগাড়ি চাটুজ্যেদের বাড়ি থেকে থানামুখে দৌড়োলো। চাটুজ্যের ছেলের মুখটাও দুপুরের তিতাসার মতোই পাংশু; ফ্যাকাশে মারা। ওরা অজয় তিতাসা দু’জনকেই পুলিশে দিয়েছে দু’টো ভিন্ন ভিন্ন কেসে।
    তাড়না খেয়ে একরকম ছিটকে পড়ি গলি থেকে পাজামার দড়ি হাতে। বৃষ্টি পড়ছে,তাই অগত্যা ফিরে আসতে হয় কানু কাকার দোকানে। আলোচনা শোনা যায়,কানু কাকার চায়ের ঠেকে;
    -“এটা আবার কোত্থেকে এসে জুটলো?”
    -“আর কোত্থেকে? তিতাসার ব্যাগ ঝেপে ক’টা টাকা পেয়েছিল;ব্যাস অমনি বাবু পাজামার দড়ি গুটিয়ে হাজির কোঠায়। এসব ভিখিরিগুলোর শালা নিয়ত ঠিক নেই। এত জোয়ান একখানা শরীর হাঁকিয়ে রেখেছে,দু’বেলা মুট খাটলে তো অবস্থা ফেরে; তা না। কে কবে কখন দেবে…আর যতটুকুই বা পেল,যাচ্ছেতাই!
    কাজবাজ না করে করে শরীরে মরচে পড়ে গেছে;ব্যাটার ছেলে কাজ পেলেও করবে না।
    তেমনি লাগাতে পারে নি যেমন; খেয়েছে তাড়ন! সারাদিন লটারি, লোকের জ্বেলে যাওয়া ধূপ আবার জ্বালিয়ে পুন্যি করার খেলা, ভিক্ষাপাত্র হাতে বসে বসে মা’বোনের বয়সী মেয়েদের ভাঁজ দেখা আর রাত হলে আফিম টানা। এই তো কাজ সারাদিনের। ভিখিরির দল সব…”
    শুনে আত্মসম্মানে লাইল; ভাবলাম একবার বলে উঠি,”কাজ কি তোর বাপ দেবে?’
    -“আরে মশাই রাখুন তো,ও একা ভিক্ষা করে,আর আমরা কেউ করি না? আপনি আমি এমনকি ঐ পুলিশ ও এসব করে;ওরা বড়োলোক বলে লম্ফো জ্বালিয়ে ব্যানার টানিয়ে ডেপুটেশন দিয়ে ভিক্ষা চায়;তাই এত প্রচার,হেডলাইনে আসে,খারাপ হয় না আর আমরা লম্ফো নিভিয়ে করি,তাই আমরা অশিক্ষিত,ছোটোলোক,অথচ কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন,এই আমরাই এসবে পার পেয়ে যাই আগে। এই যেমন ধরুন এই কানু’দা। এ অঞ্চলে কে জানে না যে ওলোক গাঁজা, আফিম সাপ্লাই দেয়;আমার আপনার মতন পুলিশ ও এসব জানে। ঘুষ খায়;না হলে কেস দেবে। এই সিস্টেমে সবচেয়ে বড়ো কোরাপশানটা এখানেই, যে,ওরা ৭৫০ স্কোয়ারফুটের ঘরের দলিলে লেখা থাকবে ১০০০ফুট। ২৫% “সুপার বিল্ড আপ” দেখিয়ে ১০০০ ফুটের দাম টাই নেবে ওরা;অথচ ৭৫০-এ ঐ ২৫% আপনি যোগ দিয়ে দেখবেন ওটা আদতে ৯৩৮ স্কোয়ারফুট হচ্ছে;১০০০ ফুটের অনেক কম। ওখানেই ওদের মুনাফা। আর যদ্দিনে আপনি এই অঙ্কটা বুঝবেন, আপনার ছেলের নাতনি তদ্দিনে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের গাড়িতে চেপে আপনার নাত-বৌ কে টাটা দিচ্ছে। এভাবেই সমাজে, মানুষে ওরা ওদের আইন ইনজেক্ট করে ভাইরাসের মতন।
    আরে দাদা আমরা এই চায়ের দোকানে বসে এসব গল্প করছি,আর যারা ওপরতলায় গদিতে বসে,তারা কি এসব জানে না ভাবছেন? হাবলা ভাবছেন?
    অথচ দেখুন কোনোরকম ভিক্ষাবৃত্তি অপরাধ বলে কোনোরকম আইনকানুন নেই। দেশে এরম কোটি কোটি জোয়ান ছেলে বসে আছে,আর তারপর যা হয়,’অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা’। কখনো এসব কেউ করবেও না। আরে ইন্ডাস্ট্রি একটা গড়লে তো অনেক সহকারী ইন্ডাস্ট্রি ও মদত পায়; এদের কাজবাজ জোটে; দুটো করে খায় এরা।না! সেখানে তো মুনাফা কম। আপনি আমি হলেও নিশ্চয়ই মুনাফাটাই আগে দেখতাম?”
    -“সে সব ঠিকাছে, বুঝলাম। তাবলে “বৌদি মালপো খামু” বললেই মালপো জোটে না কপালে। দেখুন ঐ অজয়কে মালপো দিয়েছে;তাবলে আমি আপনি আর পাঁচ জন ও সে মালপোর ভাগ পাবো;সে আশা সমাজ রাখলেও-ওরা কিন্তু ঐ ভিখিরিটিকে একটা দিন ও ভিক্ষে দেয় নি। ওটাই বোধ হয় প্রাইভেট আর পাবলিকের তফাৎ টা। তবে দাদা,এখন ওসব সবই আইনত অপরাধ নয়;কেউ বলতে পারে না,আজ এই বিষয়টা জানতে পারার পর বাড়ি গিয়ে রাতে কেউ আত্মক্রিয়া করবে না এবিষয়টা নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করে! তারপরও দেখুন সেদিন কিন্তু এই ভিখারিটাকে কেউ জেলে দেয় নি। সুযোগ করে দিয়েছে উপরন্তু। আজ,ওকে ভিক্ষে দিয়েছে তিতাসা;দেখেছি। অষ্টমীর দিন,লুচিভোগের সময় চাটুজ্যেবাবুও কি জানতো না,যে,এ টেবিলে থাকা অর্ধেক লোক আদতে লুচির চেয়ে তাঁর বৌমার পেটি আর দাপনাটা বেশি খাচ্ছে? আমাদের ভিক্ষা টা বোধ হয় ঐ প্রাইভেট এ ঢোকার জন্যই,না কি বলুন?
    -“বা ঐ প্রাইভেসির মুনাফা টুকু নিজের পকেটে ঢোকানোর…থোড়াই কেউ কিছু বলতে যাচ্ছে!”

    (অট্টহাসি)

  • চিঠি

    চিঠি- রাজকন্যে,তোমার জিয়ন কাঠি

    রাজকন্যে,তোমার জিয়ন কাঠি
    -ঋজু

     

    রাজকন্যে,

    মনে পড়ে তুমি বলেছিলে, আমার সবকটা বই তুমি নিজের সংগ্রহে রাখবে,পড়বে…
    এবারের ২৫ শে বৈশাখ আমার শেষ বইটি আসতে চলেছে।
    এবারেরটাও তোমায় নিয়েই। এখন জীবনানন্দের বনলতা বা,সুনীলের নীরার মতোন তুমিও চাইলেই বলতে পারবে “আমিও একজনের সবকটা কবিতা জুড়ে আছি”।
    হ্যাঁ গো,আমার সব কবিতায় উল্লিখিত ঐ “রাজকন্যে” নামটাতে তোমার অধিকারটা কখনো যায় নি;যাবেও না; যাক চাই ও না…
    না হয় তারপরে তোমাতে আগুনের দু’কদম বেশী অধিকার আমার চেয়ে; তোমার নতুন সংসারের তারাভাই বোন দের ও…
    বড়ো নিরুপায় লাগে রাতটা সুন্দর মনে হলে;বয়সের ওজন ক্লান্তি আনে মনে।

    মাঝে মাঝে কোনো মৌখিকতাহীন এমনই মৃদু অথচ নিরাপরাধ;অকারন দুপুরে তোমার অবয়বটা ইন্দ্রিয়গোচর হয় না; হাঁফিয়ে উঠি.. তোমার প্রিয় গানদুটো তুলবো বলে বেহালা কাঁধে পিঠ ঠেকাই দেওয়ালে।
    আচমকা লিখে ফেলি কতো কিছু আবোল তাবোল…

    জানো, এখন আমি আমার ঘর-বিছানা-টেবিল সব গুছিয়ে রাখতেও শিখে গেছি; নিয়ম করে ওষুধগুলো ও খাই। এখন ক্লিনশেভ রাখি যেমনটা তুমি চাইতে। রোজ জল দিই ক্যাকটাস গাছগুলোতে, প্রত্যেক শুক্রবার থিয়েটার দেখতে গিয়ে আমি, আমার জন্য দু’টো সিট বুকিং করাই…
    হয় না শুধু তোমার মতোন চীজ স্যান্ডউইচ; আর, বলা না কওয়া না…আচমকা কর্পূরের মতোন মহাবিশ্বের সবকটা নাম না জানা ধূলীকনার সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়া টা;ইচ্ছেমতোন ছুটি স্যাংশান করানো টা ও।

    নাঃ আমার কোনো পিছুটান নেই,তবু,আজকাল আর অঙ্ক ভালো লাগে না।
    বিকেলটা গড়ালে তবু,ছেলেমেয়েরা পড়তে আসবে ব্যাগ কাঁধে। বেশ কাটবে সন্ধ্যেটা ওদের নিয়ে। অন্ততঃ সে আশাটুকু রাখি ওদের হাসির কাছে। এভাবেই রাত বাড়বে।
    আর বেশী জাগতে পারি না; বয়েস হয়েছে,বোঝোই তো।তবু খাওয়াদাওয়া সেরে হাঁটতে আসি বারান্দাটায়। কতো চিঠি ছুড়ে দিই রোজ বারান্দায় থেকে তারাদের লক্ষ্য করে…
    “ওই? খেয়েছিস? কি খেলি আজ রাতে? একা খেলি?…” ইত্যাদি।
    পরদিন সকালে দেখি পৌরসভার সাফাইকর্মীরা মুখ টিপে হাসাহাসি করে। কি জানি কেন?

    বড়ো একটা উত্তর জানতে ইচ্ছে করে।
    আজো; কোনো বৈশাখের লোডশেডিং রাতে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখলে বিছানাটা জ্যোৎস্নায় এক্কেবারে ভিজে চুপচুপে;অবাক হয়ে চুপ মেরে যাবে তো আজো?
    আমি তো হই… আগের মতোনই ফোনের অপেক্ষা করি।জানি; তুমি ও দেখছো, চাঁদের ঐ কালো দাগটা।

    মনে পড়ছে বড্ডো একসাথে কাটানো প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে টা র কথা; বিশেষ করে আমাদের ঐ একে অপরকে নিয়ে লেখা কবিতার ঐ দু’টো লাইন…আর উল্টো পিঠে তোমার হাতের লেখায়, “প্রাপকের উদ্দেশ্যে, আজ যে শতাব্দী,সন,মাস,তারিখ,সময় ই হোক না কেন,আমরা একে অপরকে সেভাবেই ভালোবাসি। এটি পেলে নিম্নের নম্বর দুটিতে যোগাযোগ করুন।”
    বোতলবন্দী করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার সময়ও জানতাম আমরা সত্যি কথাই বলছি।আজ জানা আর মানা রা নিজেদের ভিতরকার সবকটা তফাৎ ভুলে মিশে একাকার হয়ে আছে।

    আমি ভালো আছি।
    ভালোবাসায় আছি; তুমি ও থেকো পারলে।
    মহাবিশ্বের যে প্রান্তেই থেকো, তুমি ও ভালো থেকো।                                                     -তোমার জিয়ন কাঠি             

                                                                          

                               

  • কবিতা

    কবিতা- ইওসটেটিয়া ওমনিবাস

    ইওসটেটিয়া ওমনিবাস
    – ঋজু

     

    যাকে ধরলো না মনে
    রটিয়ে দাও তার মুখে মিথ্যেবাদী কটুকথা।
    দেখবে তার সে মিথ্যেবাদী শিল্প
    হিপোক্রেসির তলায় জেহাদ হয়ে তোমার রাজধানী অবরোধ করেছে।

    ক্রুশবিদ্ধ করো সে জেহাদীদের;
    পিষে নিংড়ে ফ্যালো তাদের pair of anguish এর দাঁতে।
    গড়ো নিজের খাঁকি পোষাকী নেকড়ে বাহিনী;

    জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দাও ফুটপাতজোড়া ফসল।
    দেখবে তোমার খাঁকি বাহিনী, পোড়া-রুটির মতো মুখওয়ালা মৃত কৃষকদের মিছিলের নেতৃত্বে তোমার রাজপথ ঢেকে ফেলেছে।

    ওরা ক্ষুধার্ত; বুভুক্ষু।
    নাট্যাভিনয়ের দিব্যি কেটে এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল খোলো;আর…
    রূপকথায় মোড়া কন্ডোম বেচে হিপনোটাইজ করে রাখো ওদের।
    ওরা যেন কোনোদিন জানতে না পারে ওরা কি চেয়েছে;

    এমনই দুর্ভিক্ষ সাজাও খবরে -কাগজে,টিভিতে মগজে।
    টাকা কামাও আরো , সেই টাকায় গড়ে তোলো ভিক্টোরিয়া;

    নিউইয়র্ক; টাইম মেশিন।হয়ে গেলে শ্রমিকদের ছাঁটাই করে দিও।
    তারপর সেই টাইম মেশিনে চেপে তুলে আনো রানী মেরি আঁতিনয়েদ ও জার দ্বিতীয় নিকোলাস কে; সংসদ গঠন করো , আইনগ্রন্থে লিখে দাও:-
    “ধর্ষিতা ও ধর্ষক এর অস্তিত্ব সমাজে স্বীকৃত;
    “ধর্ষিকা” বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই,বা থাকা উচিত নয়।
    তাই আইনব্যবস্থা নারীর অসহায়তায় হস্তমৈথুন করবে-
    নচেৎ আইনকে ফাঁসি দেওয়া হবে।”
    ছোটোবেলার প্লেগ্রাউন্ড থেকে তুলে আনো ছোট ছোট আদম-ইভদের।
    ওদের মগজধোলাই করো; স্পষ্ট বুঝিয়ে দাও- একজন মেয়ে, অন্যজন ছেলে।
    ওরা মানুষ নয়; কেবলি মেয়ে ও ছেলে।
    দু’জনকে দাও পৃথক পৃথক স্বর্গ ও পাতালে দাসত্ব।

    দেখবে সহস্র কোটি সীতারা তোমার বাতানুকূল ঘরের ঝাঁ চকচকে মেঝে ফুঁড়ে উঠেছে তোমার সামনে।
    দেখবে শত-সহস্র ক্ষুধার্ত পোসাইডন রক্তসমুদ্র পাড়ে কাস্তে-হাতুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে-
    তোমার অ্যাটলান্টিস এর সবকটা স্তম্ভ চূর্ণ-বিচূর্ণ করবে বলে,
    দেখবে আঁধার থেকে শত-সহস্র প্রতিশোধিনী ধর্ষিতা, মেডুসা হয়ে ফুঁসছে; তোমার পোষা
    ধর্ষকদের লিঙ্গচ্ছেদ করবে বলে।
    তুমি তোষন চালাও; কারারূদ্ধ করো,
    দেখবে কারাগার ইস্তফা দিয়েছে; তোমার বিরুদ্ধে মলোটভ বেঁধেছে।
    তুমি তাদের মরতে ফেলে দাও নরকে-অনশনে; ফুটপাতে,
    দেখবে ক্ষুধায় ছটফট করে ফুটপাত, গিলে খাচ্ছে একনায়কদের ক্যাসল।

    তন্ত্র এবার সময় এসেছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আয়নায় নগ্ন দাঁড়াও।
    তন্ত্র এবার এসেছে সময়, স্রষ্টার কাছে মাথা নোয়াও।

You cannot copy content of this page