-
তোর সাথে
তোর সাথে
-দিপালী পালযদি কোনোদিন গরীব হয়ে যাস!
আরো শক্ত করে ধরবো তোর হাত।
সাথে থেকে লড়াই করবো দুজনে,
ভাগ করে খাব আতপ চালের ভাত।
ছাড়ব না তোকে চিন্তা করিস না-
পরিস্থিতি কে ভয় পাইনে মোটৈ,
ভাগ করে নেব সব দুঃখটুকুই-
মানিয়ে নেব যখন যেমন জোটে,
তোর জন্যই সবেতে সুখের গল্প বুনি-
তুই থাকলেই আনন্দে মনটা ভাসে,
ভালো লাগায় পৃথিবী যায় ছেয়ে-
তুই আছিস তাই বাঁচার স্বপ্ন আসে।। -
নিঃশব্দ মরন
নিঃশব্দ মরন
-দিপালী পাললাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল থোকা থোকা ফুটে আছে সবুজ পাতার গায়ে,
সাঁওতালী কিশোরী মেয়েটা সে ফুল কুড়িয়ে মালা বানিয়ে পরেছে গলায়!!
কালো রূপসী মেয়েটা ফুল ফুটলে খুব আনন্দ পায় চলে যায় গাছের কাছে–
পাশেই হলুদ রঙের ফুলে ভরা একখানা মিষ্টি রাধাচূড়া আছে।মেয়েটা গাছে বসা পাখীদের সাথে বিড় বিড় করে কথা কয় ,
ও পাখী দেখতো কেমন লাগছে আমায়??
পাখীদের রাজা ওকে হেসে হেসে বলে,
এই মেয়ে এদিকে এসো দেখো আর ও কতো ফুল পড়ে আছে গাছের তলে!!
লাগাও না কেনো তোমার ঐ কোঁচকানো সুন্দর কালো কুচকুচে চুলের খোঁপায়!!
সাঁওতালী মেয়েটা একথা শুনে ভ্রু কোঁচকায়,
মন লাগেনা,উড়ু উড়ু উদাস হয়ে চোখ বোজে-
আকাশের দিগন্তে মুখ তুলে সারাক্ষন কি মাটিতে যেন খোঁজে,
গাছের নিচে মাটির বুকে লালকৃষ্ণচূড়া আর হলুদ রাধাচূড়া মিলে মিশে অপূর্ব সে রূপ,,
সেই ফুলে মেয়েটি সাজে অপরূপ সাজ,লালে হলুদে সেজেছে ফুলের সাজ!!
ফুল যেন ওর জন্য ফুটেছিল গাছে-
এমনি ভাবেই রোজ মেয়েটি গাছের ফুল তুলে সাজে,,
মেয়েটা খালি ভাবে এ ফুলেরা কেনো এত সুন্দর দেখতে??
ফুল আর পাখীদের সাথে তার নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে,
একদিন কতগুলো লোক হঠাৎ এসে সে সুন্দর ফুলে ভরা গাছ দুটোকে গোড়া থেকে কেটে দিয়ে গেল,
ইট বালি ফেলে দিয়ে গেল কিছুটা দূরে পাঁচিলের গায়ে,
সবাই বলা কওয়া করে একটা ফ্ল্যাট বাড়ি উঠবে নাকি এই জায়গায়!
মেয়েটা অঝোরে ভীষন কাঁদলো সেদিন,
তারপর থেকে,
একটা পাখীও সেখানে আসেনা,
আর সেই মেয়েটা?
নাঃ সে দিকে একদম আসেনা আর,
ফুল নেই,পাখীরা নেই,মানুষ নেই,
বাঁচা হলনা জীবন কে ভালবেসে সবার সাথে পাশাপাশি রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়ার।। -
তিন পাগলের গল্প
তিন পাগলের গল্প
-দীপালী পালবাড়ি খুঁজছেন মৃগাঙ্ক বাবু,একটা বাড়ি কিনবেন,পৈতৃক বাড়িতেই এখন থাকেন।তিনভাই সবাই বিবাহিত, সবার বৌ, ছেলেপুলে আছে, দোতলা বাড়ি,একটা অবিবাহিত বুদ্ধিহীন বোনও আছে। মৃগাঙ্ক বাড়ি কিনবেন, বৌ আবদার করেছে বলে কথা।একদম নিজস্ব একটা বাড়ি চাই।এই ভাগের বাড়িতে কুড়ি বছর ধরে অনেক উপদ্রব,জ্বালাতন সহ্য করতে হয়েছে।এইবার নিজস্ব,একেবারে নিজস্ব একটা বাড়ি চাই।মৃগাঙ্ক বাবু তিনজন দালাল কে বলেছেন বাড়ি দেখানোর জন্য।তিনজনে ফোন করে করে প্রায় প্রতি রবিবার ই ডেকে নিয়ে গিয়ে বাড়ি দেখাচ্ছে কিন্তু একটা বাড়ি ও তার পছন্দ মতো হচ্ছেনা।কোনোটার জায়গার পরিমান খুবই কম ,কোনোটায় ঘরগুলো খুব ছোট ছোট ,কোনোটায় বা আলোবাতাস ঠিকমতো ঢোকেনা,আবার যেটা পছন্দ সই হয় সেটার আকাশ ছোঁয়া দাম।শনিবার বিকালে দালাল কেষ্ট ফোন করে বলল-“দাদা একটা দারুন দোতলা বাড়ি আছে , দাম মাত্র ত্রিশ লাখ টাকা, কাল বিকেল চারটের সময় আসুন দেখিয়ে দেবো”
“ইয়ে মানে তুমি কোথায় থাকবে?”
“আমি সতীশের মুদি দোকানের সামনে দাঁড়াবো,ঠিক চারটে,মনে থাকে যেন”
“আচ্ছা”
পরের দিন মৃগাঙ্ক বাবু কেষ্টর সাথে বাড়ি দেখতে গেলেন।
অনেকটা অলিগলি দিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে তা পার হয়ে প্রায় দু কিলোমিটার এগলি ওগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা পুরনো রংচটা বাড়ি দেখা গেল,কেষ্ট তার সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল -“ঐ যে মৃগ দা এসে গেছি,ঐ যে ঐ বাড়িটা,”
“আচ্ছা,,”
বাড়ির সামনে আসতেই সামনে একটা ছোট দু পাদানির সিড়ি, তার পাশে ডান দিকে তাকাতেই মৃগাঙ্গের হঠাৎ করে বমি পেয়ে গেল ,খানিকটা পানের পিকের আর চিবানো পানের স্তুপ ,,
ওয়াক আসছে এসব দেখে,সে বলে উঠলো”বাড়ির লোকগুলো কি নোংরা রে বাবা,ছিঃ”
দরজা খুলে দিল বছর পচিশের একটা ছিপছিপে চেহারার ছেলে,গায়ের জামাটা ভীষন নোংরা ,দেখলে মনে হচ্ছে জামাটা অনেকদিন কাচেনি।দাঁত গুলো একেবারে হলুদ,গায়ে বনমানুষের মতো ভটকা গন্ধ,
যাইহোক ছেলেটি তাদের কে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল,একতলার দুটো ঘরই অন্ধকার!
সমস্ত ঘরময় মাকড়সার জাল ভর্তি হয়ে আছে। দেখে মনেহচ্ছে যেন এখানে মানুষ নয় ভুতেরা বাস করে।ঘরের মধ্যে একটা বাজে গন্ধ,ঠিক যেমন পাখী বা বাঘের খাঁচায় যেমন গন্ধ থাকে ঠিক তেমনি একটা গন্ধ। মৃগাঙ্ক বাবু আর কেষ্ট দুজনে অবাক হয়ে চারিদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখছে আর ভাবছে “কি অদ্ভুত বাড়িটা।”
দুটি ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে আলো জ্বলছে।সেই ঘরে চুড়িদার পরা একটা বছর ষাটের মহিলা ও একজন টাকমাথা বছর সত্তরের বয়স্ক লোক দুজনে খাটের উপর বসে টিভি দেখছে, ছেলেটির বাবা মা বোধহয়।বুড়ো লোকটা খাটের পাশেই চেয়ার দেখিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ওদের বসতে বললেন,মহিলা টা এক দৃষ্টে টিভি দেখেই যাচ্ছে। অনেকক্ষন বসে থাকার পর মৃগাঙ্ক ও কেষ্ট মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো,কেষ্ট বলল”
আমাকে পটল মানে পরিমল দাস পাঠিয়েছে, মেসোমশায় এই ভদ্রলোক বাড়িটা কিনতে চায়”
লোকটা হঠাৎ খাটের উপর দাড়িয়ে বলল “আমার বাড়ি কিনতে চায় ,কি মজা!কি মজা!খুব ভালো খুব ভালো ,চলুন সব ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাই,ঘুরে ঘুরে দেখাই”।
এবার বৃদ্ধ ,বৃদ্ধা দুজনেই ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো দেখাতে লাগলো, রান্নাঘরে জলের বোতল আছে প্রায় দুশো টা সব বোতলে জল ভর্তি আর মেঝেতে ছড়ানো রয়েছে।মৃগাঙ্ক এমনটা দেখে খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেল।অবাক কান্ড!ওর যেন কেমন অদ্ভুদ ধরনের লাগলো। এতো গুলো বাড়ি দেখেছে এরকম ও আগে কখনও দেখেনি। যাইহোক মৃগাঙ্ক ও কেষ্ট ওদের সাথে ওপরের তলার গেল ঘরগুলো দেখতে গেল ,বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার পেছনে তার ছেলেটি আসছে ,কিন্তু দোতলার ঘরগুলো দেখে খুবই ঘেন্না পেলো সমস্ত ঘরে মাকড়সার বড় বড় জালের মধ্যে অজস্র মশা ,টিকটিকি,মাকড়শা,কীট পতঙ্গের মড়া ঝুলছে,
মৃগাঙ্ক আর দেরী না করে বলল”কি নোংরা আপনারা ঘরটা পরিস্কার করে রাখেন নি কেনো? ইস্ কি বাজে একটা গন্ধ বেরোচ্ছে”এই কথা শুনে লোকটি আর মহিলাটা খিল খিল করে হেসে বার ছয়েক হাততালি দিয়ে দুই হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল”এই জন্য তো কেউ আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনা,কেউ দেখতে এলেও কেনেনা,কিনতে হবেনা ,হা,হা,হা,হা….”।
মৃগাঙ্কের মুখের সামনে মুখ নিয়ে বৃদ্ধ হঠাৎ প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল “তোমার এতোবড়ো সাহস,আমার এতো পরিচ্ছন্ন বাড়িটাকে নোংরা বলছো,তোমাকে আজ দেখাব মজা বলেই মা,বাবা,ছেলে তিনজনে হাততালি দিয়ে হাহাহা করে হাসতে শুরু করল।
মৃগাঙ্ক বুঝে গেল এরা সব পাগল,কেষ্ট ও খুব অবাক হয়ে গেল,পাড়ার ছেলে পটল ওকে দুদিন আগে এই বাড়িটার সন্ধান দিয়ে বলেছে মালিকের সাথে কথা বলে রেখেছে ,আর শেষে কিনা একটা পাগলের বাড়ির ঠিকানা দিল। হঠাৎ বুড়ো আর বুড়ি দুজনে মৃগাঙ্কর হাত দুটো শক্ত করে টিপে ধরে বলল”তোমাদের বাড়ি দেখা হয়ে গেলেও যেতে দেবোনা আমরা আজ তোমাদের কাউকে ছাড়বো না,তোমাদের নাচ দেখবো, দেখাবো,গান গাইবো ,শুনবো তবে ছাড়বো”।
মৃগাঙ্ক এক ঝাপটা মেরে বলল “ছাড়ুন বলছি,কি অসভ্য লোক রে বাবা,ছাড়ুন পাগল কোথাকার!”কেষ্ট কে চেপে ধরেছে ওদের ছেলেটা,আর বলছে “তুমি একটা গান শোনাও আমাদের,,তোমাকে শোনাতেই হবে বুঝলে।”
কেষ্ট হাত জোড় করে চোখ মুখ কাঁচু মাঁচু করে বলল-“এবারের মতো ছেড়ে দাও বাবা পরে একদিন এসে অনেক গান শোনাবো,এই মৃগ দা চলো চলো,আমরা বাইরে বেরিয়ে যাই।”
মহিলাটা একথা শোনামাত্র নাক মুখ ফুলিয়ে সিংহের মতো গর্জন করে উঠল আর তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।দৌড়ে ওরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ওরা তিনজনে প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে ওদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল,তিনজনের গায়ে কি শক্তি রে বাবা,এবার মহিলাটা জোর গলায় গান শুরু করল, “আ,আ,আ,আ,আ,শঙ্কর ভোলা,,, পার্বতী রমনী ,,কৈলাস বাসীইইইইই”আর লোকটা ঘরময় খ্যামটা নাচ নাচতে শুরু করে দিল।দুম্ দুম্ করে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে দৌড়চ্ছে আর বলছে “ইউরেকা ইউরেকা পেয়েছি শিকার এবার পুড়িয়ে মাংস খাবো আর হাড় দিয়ে ডুগডুগি বাজাবো”।
মৃগাঙ্গর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল এই কথা শুনে ,কি যে করবেন বুঝতে পারছিলেন না কিছুই কেমন যেন হতভম্ভ হয়ে গেলেন ।এদিকে ওদের ছেলেটা একটা বড় থালা এনে বাজাতে শুরু করল আর নাচ শুরু করল সাথে বেসুরো গান ও গাইল “ডফলিওয়ালে ডফলি বাজা “
মৃগাঙ্ক প্রানপনে চিল্লাচ্ছেন “বাঁচাও ,বাঁচাও কে আছো আমাদের বাঁচাও,কেষ্ট তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলে?”
“আমি জানতাম না কিচ্ছু জানতাম না যে এরা সবাই পাগলের গুষ্টি- জোরে চিল্লান দাদা,কেউ যদি শুনতে পেরে আমাদের বাঁচায়,কি আশ্চর্য্য ফোন দুটোও ওরা কেড়ে নিয়েছে”
এদিকে লোকটা নাচছে আর দাঁত কিড়মিড় করে মৃগাঙ্কের চোখে বার বার ফু দিচ্ছে। অসহ্য লাগছে ওদের, ভয় ও পাচ্ছে, পাগল গুলো কি করবে ওদের নিয়ে কে জানে! বাপের জন্মেও এই রকম অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি ।কেষ্টর পা দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে, ছেলেটা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কেষ্টর মুখের সামনে নাড়িয়ে বলছে “তুমি পপ গান গাও,নাহলে তোমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবো”
কেষ্ট গলায় যতো জোর আছে সবটা দিয়ে জোর কদমে “বাঁচাও” বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলো।ঠিক ঐ সময় পাড়ার একজন সহৃদয় ব্যক্তি বিকেলে রাস্তায় হাঁটছিলেন মেদ ঝরানোর জন্য ,এরকম চিৎকার চেঁচামেচি শুনে উনি ফোন করে লোকাল থানায় খবর দিলেন। আগেও এরকম ঘটনা কয়েক বার ঘটেছে কিনা!
পুলিশ এসে শেষ মেষ ওদের সেই পাগল পরিবারের হাত থেকে বাঁচালো। মৃগাঙ্ক বাবু হাঁফ ছেড়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন কেষ্টর সাথে বাড়ি দেখতে আর কোনোদিন যাবেন না।বাবা,ঐ পাগল গুলোর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন এটাই বড় কথা। জীবনে পাগল তো অনেক দেখেছেন এমন সাংস্কৃতিক,অদ্ভুত পাগল কোনোদিনও চোখে পড়েনি।এবার থেকে ভালো করে না জেনেশুনে আর কারোর সাথে বাড়ি দেখতে যাবেন না,মনে মনে বললেন”জয় মা কালি,এ যাত্রা বড় বাঁচান বাঁচিয়ে দিলে মা”।। -
অতিথি
অতিথি
-দীপালী পালএকদিন জীবনের ঐ পারে
চলে যাবো মরণের পরে,
এ ঘরের চাবির মালিক হবে ,
অন্য কোনো কেউ!!
আমার যা কিছু রেখে যাবো —
তারা সব পাবে অন্য মালিকানা,
চলে তো যাবই একদিন
আজ আর কাল,
সঙ্গে নিয়ে যাবোনা কিছুই,
সব সুখ দুঃখের চিরতরে হবে অবসান–
যাবার পর মুহুর্তেই হয়তো কাছের বন্ধু,
আত্মীয় পরিজনেরা হবে শোকাতুর,
তারপর ধীরে ধীরে আমার
নামটা মুছে যাবে,
দরজার ঐ নেমপ্লেট থেকে,
জীবনের চঞ্চল গতি থেকে,,
এইভাবে সবকিছু হারিয়ে যাবে!!
হারোনোটাই একই গন্তব্য সকলের,
সময় হলে ফুরিয়ে যেতে হবে,
কিচ্ছু থাকবেনা,
আমিও ক্ষণিকের অতিথি একজন,
তাই মনে মনে ‘আমার’ বলে
কিছুই ভাবিনা আর।। -
“এক বৃদ্ধের আত্মকথা”
এক বৃদ্ধের আত্মকথা
– দীপালী পালশরীরে বার্ধক্য বাসা বেঁধেছে,
জীবনের লড়াই লড়তে লড়তে আজ আমি প্রবীণ,
চামড়া কুঁচকে গিয়েছে,হারিয়েছে সুগঠিত চেহারার সব জৌলুস।
জীবনসঙ্গিনীকে হারিয়ে আমি এখন পাথর প্রায়,,
একসময় ভেবেছিলাম মনটাকে সতেজ রাখবো,
হলোনা কিছুতেই হলোনা,
শোকতাপে হৃদয়টা ছাই হয়ে গিয়েছে।
ওষুধের উপরে বেঁচে আছি…
চাকুরিরতা বৌমা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে, ছেলেও তাই–
কাজের মেয়ে ললিতাই আমাকে সারাদিন দেখাশুনা করে..
শক্তিহীন আমি সকলের করুনার পাত্র হয়েছি এখন।
অথচ এই আমি একদিন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছি,
স্থির অবিচল ভাবে।
সংসারের ভারী চাকাটা ঘোরাতে ঘোরাতে,দশটা পাঁচটার ডিউটি করতে করতে,
কখন যে চুল পেকেছে,দাঁত পড়ে গেছে,
রক্তের জোর কমে গেছে, যৌবন নিজের অজান্তে বিদায় নিয়েছে !!
বুঝতেই পারিনি!
কতো জায়গায় ঘুরেছি পরিবারের সাথে। কতোআ…ন …ন্দ…ছিল…
আজ সেই স্মৃতিচারণ করে চোখের কোনটাভিজে যায়।
পরিচিত আত্মীয় বন্ধুদের মৃত্যু দেখে কখনও কখনও ভয় পেয়েছি ,ভেবেছি –“আমি ও তো ঐ পথের যাত্রী, একে একে কতো প্রিয় জন হারিয়ে গেল”।
আজ স্থবির জড় পদার্থের মতো বিছানা আঁকড়ে ধরে,
আমার ঘরের এককোনে কোনঠাসা আমি,
যেটুকু ভালবাসা পাই সেটুকু উপরিপাওনা ভাবি।
মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকি “হে ঈশ্বর মৃত্যু যদি দাও তবে হঠাৎ যেন আসে”
শুধু ভাবি “একদম জড় হয়ে গেলে,কতো মানসিক কষ্ট তাইনা”ঘরটাকে আর বিছানাটাকে সাজিয়ে রাখতে বলেছি কাজের মেয়ে ললিতাকে
বলেছি “আমি যতদিন আছি-এ ঘর যেন পরিপাটি থাকে–
ঠিক আমার স্ত্রী যেমন গুছিয়ে গাছিয়ে পরিপাটি রাখতেন,,
সারাদিন এই ঘর আর দেওয়াল দেখেই এ বৃদ্ধের দিন কাটে,গোছানো থাকলে পূরানো স্মৃতিচারণ করে আমার কাঁদতে সুবিধে হয়,
আমি কাঁদি আর আমার চার বছরের নাতনি তিতলি তার মিষ্টি সরল মুখখানা দুঃখি দুঃখি করে যখন আমাকে আদর করে বলে–“দাদু তুমি কেঁদোনা ,,আমার মাথাটা ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলে “দাদু তুমি কখনও কাঁদবেনা,আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি”
তখন এক মূহুর্তের জন্য এক অকৃত্রিম নিস্পাপ প্রেমের স্বাদ পাই,,
মনে হয় ,,এখন এই বার্ধক্যে এই খাঁটি প্রেমটুকু পাবার জন্য হয়তো এখনও বেঁচে আছি আমি।। -
“গাছের মুক্তি”
“গাছের মুক্তি”
-দীপালী পালফ্লাটের ঘরের ব্যলকনিতে টবের একটা লেবু গাছে,
ছোট ছোট দারুণ সুন্দর সবুজ রঙের ফল ধরেছে–
গাছের মালিক নিয়মিত গাছটিকে ভীষণ যত্ন করে,
বাড়ছে গাছটা, হেলে দুলে পুষ্টি পাচ্ছে রাসায়নিক সারে!!গাছটি বাঁচে টবের মাটির অল্প সীমার ঐ পরিসরে
বাগানের অসীম মাটি, জল, পেতে তার খুব ইচ্ছে করে–অনেক হাওয়া অনেক আলোর নির্মল তাজা মিষ্টি ঘ্রাণে,
গাছটা বাঁচতে চায় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে নিজের খুশি মনে–
বাগান ছাড়া আর কোথায় আছে মিষ্টি মিষ্টি পাখীর ডাক?
গাছের মালিক বলেই খালাস,” এই এভাবেই শান্ত থাক,
আমার ব্যলকনিতে তোলা জলে পাবি তুই অনেক সার,
ডালপালা ছাড়বি তুই ফলে ফলে হয়ে যাবি একাকার”গাছটা বলে “মাটি,আকাশই চাই, চাইনে সার চাইনে,
পারলে আমায় পুঁতে দিও তুমি সামনের খোলা বাগানে,
আমি মাটির কোলে মায়ের ঐ স্নেহের শান্তিআঁচল চাই,
তোমার ছোট আকারের টবে স্বাধীনতার স্বাদ কি পাই?
আমার শিকড় টেনে নেবে মাতৃদুগ্ধ মাটির পুষ্টিজল,
সূর্যালোক পাবো প্রকৃতি থেকে,জন্মাবে তাজা সতেজ ফল,,
আমায় মুক্তি দাও তুমি এবার রেখে এসো মাটির কাছে–
শেকড় ছড়িয়ে বাঁচার আনন্দ প্রকৃতি মার বুকে আছে।। -
“মুখোশের আড়ালে”
“মুখোশের আড়ালে”
– দীপালী পালগায়ে ময়ূরের পালক পরেছে হায়নার দল,
বিশ্বাসঘাতক মানুষ প্রসারিত করেছে পাখা,
উপরের চাকচিক্যে আকৃষ্ট সকলে নিশিদিন!
ভেতরের অবিশ্বাসী রূপটাকে যায়নাতো দেখা-বিশ্বাস অসহায় হয়ে গোপন কুঠুরিতে কাঁদে!!
নিভৃতে মাথার বালিশ তার কান্না দিয়ে ভেজায়-
রাতের আধো আলো বুঝতে পারে ঘাতকের রূপ,
শিকারী হায়নারা খোলস ছেড়ে সামনে দাড়ায়।চেনা কিংবা অচেনা অনিশ্চয়তা কঠিন সময়ে,
শহরের অলিতে গলিতে আছে কতো জানোয়ার !!
বিবেক হারিয়ে স্বার্থের লোলুপ গন্ধ মেখে থাকে–
কথার মাধূর্যে অভিনয়ে রোজ ধরছে শিকার!!সকালে মুখোশ ,ঝকঝকে ভদ্রবেশী লোক ওরা–
খুন করে কতো মানুষের মাথা থেঁতলেছে ইটে!!
ক্ষমতার স্তম্ভে পাওয়া গেছে রক্তের আষ্টে গন্ধ,
কতো মানুষের জমাট রক্ত আছে ওই কংক্রিটে!!রাস্তার দুপাশে দেখি কতোরকম মুখোশ পড়া,
মুখোশের রং থাকে লাল, কালো, সাদা, হলুদ ঘিয়ে-
বিশ্বাস নিঁখোজ হয়েছে অবিশ্বাসের বিষ ফাঁদে,
কিছু অট্টালিকা তৈরী হয় মানুষের রক্ত দিয়ে–কিছু লাশ আজও রয়েছে শুয়ে মাটির ভেতরে!!
বেওয়ারিশ হয়ে যারা শীতে কুঁকড়ে ছিল পথে–
গরীব প্রতিবাদ করলে তার ঠিকানা কবরে!!
কতো লোভী মুখ সাধু সেজে শুয়ে আছে ইমারতে!খুলে দিতে পারবে বিশ্বাসঘাতকদের মুখোশ??
সব স্বার্থের উপরে উঠে দেখো বিশ্বাসী আকাশ!
প্রাণ খুলে বাঁচতে পারতো তবে ভালো, সুজনেরা,
মানুষেরা খোঁজে আঁধারে একমুঠো স্বচ্ছ বিশ্বাস।। -
প্রেম তুমি বদলে যাবে ??
প্রেম তুমি বদলে যাবে ??
-দীপালী পালজীবন মানে তো স্রোত!!
সেতো স্রোতস্বিনী নদী-
খরস্রোতে নৌকো বাই,
তুমি সাথে থাকো যদি।বুড়ি হবো সাদা চুলে –
বয়সটা ছোঁবে আশি,
বদলাবে তুমি?আমি?
এই ভালবাসাবাসি?বুড়ো হলে প্রেম দেবে?
এখন যেমন দাও?
চাঁদের আলো মেখে-
অজস্র রঙ সাজাও,গল্প শেষে, ধুসর রং–
ইচ্ছেরা ধুলোয় মেশে,
প্রেম মরেনা কখনও!!
জ্বলে অবহেলা বিষে।বাঁচার ইচ্ছে তো হয়-
স্বচ্ছ ভাবনারা থাক,
জীবন ঢললেও সই-
চিন্তা অন্যমাত্রা পাক।আমি চোখের তারায়,
স্বপ্নের রঙ সাজাই-
চোখ বন্ধ করলেই,
সব রঙময় তাই।বুড়ো আকাশ আজও!!
বৃষ্টিতে রামধনু আঁকে-
বুড়ি চাঁদ রাতভর,
জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।স্রোতেরই বিপরীতে,
মৃত্যু মুখে যদি হারাই —
ইচ্ছে খুশি ভেলা ভাসিও,
দ্ধিধার অবকাশ নেই!!আকাশ তার চাঁদকে,
বুকেই লুকিয়ে রাখে-
বৃদ্ধা চাঁদ চিরকাল,
রামধনুর রং মাখে।।প্রেম তুমি বদলাবে?
ইচ্ছে হয় একটু জানি-
তুমি বড় রহস্যময়,
একরোখা অভিমানী। -
বাঘা তেঁতুলের গল্প
বাঘা তেঁতুলের গল্প
-দীপালী পাল
(অনেক পুরনো একটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা)ছোটবেলা থেকেই খুব দুষ্টু তেঁতুল,ঠাকুমা সাধ করে নাম রেখেছিলেন তেঁতুল।সেই নামটাই এখনও রয়ে গেছে কিন্তু গ্ৰামের স্কুলে ভর্তির সময় অবশ্য “সমীরন দে” নামেই ভর্তি করা হয়েছিল। তেঁতুলের বাড়ি সুন্দর বনের গোসাবা থানার পাখিরালয় গ্ৰামে।যেমন উঁচু লম্বা তেমন মোটাসোটা দেখতে,সাদাসিধে স্বভাবের জন্য গ্ৰামের আট থেকে আশি সবাই তাকে ভালবাসতো।ওদের বাড়ির কিছুদূরেই ভীষণ জঙ্গল, আর জঙ্গলের ওধারে নদী ছিল। খানিকটা দূরে দূরে চার পাঁচটা বাড়ি আবার কিছুটা ঝোপঝাড় ও জঙ্গল,তারই মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তা চলে গেছে একেবারে শহরের বাজার পর্যন্ত।
তেঁতুল ভালো মন্দ খেতেও খুব ভালবাসতো। হাফ কেজি মুরগির মাংস একা একবারে খেয়ে ফেলতে পারতো, গায়ে খুব শক্তি ,কারোর হাত মুচড়ে ধরলে সে আর ছাড়িয়ে যেতে পারতোনা। সে পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক,গ্ৰামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সদ্য স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরী পেয়েছে।
বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার সাইকেল চেপে সকালে যায় আর সন্ধ্যেতে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে বাবা মা কেউ বেঁচে নেই ,আছেন খালি এক বিধবা পিসিমা ,পিসিমা সাবিত্রীই রোজ রান্না বান্না করেন,মা বাবা মরা ছেলেটাকে সেই দশ বছর বয়স থেকে পিসিমাই মানুষ করেছেন। কিন্তু তেঁতুলের বিরাট চেহারার কারণে এখনও বিয়ে হয়নি , তার গায়ের রংটা মিশমিশে কালো , আর অনেকটা উঁচু লম্বা চেহারা বলেই তার কখনও বিয়ের সম্বন্ধ আসেনি আর তেঁতুল ও গ্ৰামের মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলাই পছন্দ করতো । খেতে খেতে একদিন পিসিমা বললেন “ওরে ও তেঁতুল বলি পঁয়তিরিশ বচ্চরের হইয়ে গেইলি এইবার ঘরেতে একটা সোন্দর বউমা নে আয়,আর কতো দিরি করবি রে বাপ”
তেঁতুল ভাতের গ্ৰাস মুখে দিয়ে পিসিমাকে বোললো”আমার কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়না,তুমি তো জানো বরং তুমি কাউকে পছন্দ করো পিসিমা”
“আমি করবো,ঠিক আছে বাপু , খোঁজ খপর নিতি হবে”
তেঁতুল সাধারনত রোজ সন্ধ্যে বেলা বাড়িতে ফেরে, কিন্তু একদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটা অসুস্থ লোককে নিয়ে সোরগোল পড়ে গেল, এক ডাক্তার বাবুর জন্য ওষুধ আনতে অনেক দূরে গিয়েছিল সে। রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছিল,এদিকে পিসিমা তো ছেলেটা ফিরছে না কেনো সেই চিন্তায় মাটির দাওয়ায় মুখে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন। পাশের বাড়ির নিধিরামকে ডেকে তেঁতুলকে ফোন করার কথা বললেন, তারপর জানা গেল যে তার আসতে বেশ রাত হবে। এ এলাকায় বেশী রাত হলে বাঘের ভয়ে কেউ বাইরে বেরোয়না। পিসিমা ফোনে ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন”সাপধানে,তাড়াতাড়ি আসিস বাপ,”
তেঁতুলের কাজকর্ম শেষ হল যখন তখন রাত প্রায় দেড়টা হবে, এদিকে অদম্য সাহসী তেঁতুল ম্যানগ্ৰোভ অরন্যের পাশ দিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাইকেলের প্যাডেলটা বেশ জোর দিয়ে চালাতে লাগলো,শুনশান রাস্তা , দূরে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় রাস্তা ঘাট সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি এসে রাস্তাটা একেবারে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে ,হঠাৎ খপাৎ করে লোমশ বিরাট একটা জন্তু তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ,তার ঘাড় কামড়ানোর চেষ্টা কোরলো,তেঁতুল মুহুর্তের মধ্যে বুঝতে পারলো তাকে বাঘ আক্রমণ করেছে, কিংকর্তববিম্যূঢ় হয়ে সে তাড়াতাড়ি বাঘের পা সজোরে চেপে ধরে এমন জোরে কামড়ে ধরলো ,যে বাঘটা তাকে মুহুর্তের জন্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হল তেঁতুল ও মাটিতে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে সাইকেল টাকে বাঘের উপর ঘোরাতে লাগলো। বিশালকায় তেঁতুলকে আবার বাঘ ধরল এবার তেঁতুল বাঘকে প্রচন্ড ঘুষি মারতে লাগলো, ক্ষতবিক্ষত হয়েও তেঁতুল বাঘের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো আর “বাঘ” “বাঘ” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতেই থাকলো এরমধ্যে ঐ গ্ৰামের কতকগুলো লোক চিৎকার শুনে বুঝে গেল কেউ নিশ্চই বিপদে পড়েছে তারা লাঠি আর মশাল নিয়ে রা রা করতে করতে চলে এলো,ভয় পেয়ে বাঘটা দৌড়ে নিমেষের মধ্যে তেঁতুলকে ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সবাই তেঁতুলকে গ্ৰামের এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে নিয়ে গেল,চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমন্ত গ্ৰাম একেবারে জেগে উঠল। সবাই তেঁতুলকে বোললো “অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে বাঘের পেটে হজম হয়ে যেতো তেঁতুলদা তুমি বলেই বাঘটার সাথে লড়াই করে বেঁচে এসেছো,তুমি সত্যি বীর পুরুষ ,বাব্বা তুমি কি সাহসী !!তুমি যে বেঁচে গেছো সেটাই বড় কথা”
এরপর তেঁতুলের সাহসী মানসিকতার কথা সারা গ্ৰামে ছড়িয়ে পড়ল লোকে তাকে নাম দিল “বাঘা তেঁতুল”।
পিসিমার চিন্তা হল তেঁতুলের ক্ষতগুলো নিয়ে ,কবে সারবে কে জানে এই চিন্তাই করতে লাগলেন। মাসখানেক ধরে পিসিমার সেবা যত্নে তেঁতুল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো।
পঞ্চায়েতের প্রধান হরিহর বাবু তেঁতুলের সাহসিকতায় আপ্লুত হয়ে তার একমাত্র বিবাহ যোগ্যা মেয়ের সঙ্গে তেঁতুলের বিয়ে দেবার কথা ভাবলেন ।
একদিন হঠাৎ হরিহর বাবু তেঁতুলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তেঁতুলের পিসিমার কাছে হাজির হলেন। পিসিমা বললেন “তেঁতুল বাড়ি আসলি আমি বইলবো আর ওর মতামত পালি আপনারে জানায় দেবো”। তার বিয়ের যোগ্য সুন্দরী গুণবতী মেয়েকে চেনে পাড়ার সকলে।
তেঁতুল বাড়ি আসতেই পিসিমা তেঁতুলকে বলল “ওরে মোর বাঘা তেঁতুল তোর জন্যি একটা টুকটুকে বউ নিয়ে আসবো এইবারে”
তেঁতুল মাথা নিচু করে বলল
“তুমি যা বলবে তাই হবে পিসিমা,কিন্তু সে কে জানতে পারি?”
“দোলা,পঞ্চায়েতের পেধ্যান হরিহর বাবুর মেইয়ে”
“আমি চিনি ওকে,তুমি কথা দিয়ে দিয়েছ”
পিসিমা ইচ্ছে করেই বললেন–
“হ্যা,”
তেঁতুলের ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি দেখা গেল আর বলল”তুমি যা করবে সেটাই হবে ,পিসিমা।” -
ঠাম্মা আর মাছ চোরের গল্প
ঠাম্মা আর মাছচোরের গল্প
-দীপালী পাল
(সত্য ঘটনা)আমি যখন আমার ঠাম্মাকে দেখেছি তখন তাঁর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। আজ তিনি বেঁচে নেই কিন্তু আজও ঠাম্মার কথা মনে পড়লে তাঁর একটা গল্প আমাদের প্রায়শঃই মনে পড়ে।
দেখতে খুব সুন্দরী ছিল আমার ঠাম্মা,গায়ের রঙ ছিল খুব ফর্সা,মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল ছিল,কপালে সবসময় সিদুঁরের বড় টিপ পরতেন আর সিথিঁ ভরাতেন সিঁদুর দিয়ে। সবসময় পান তার মুখে ভরা থাকতো,লাল লাল ঠোঁটে যখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন তখন অতি বড় শত্রু ও তাকে ভালোবেসে ফেলতো। কাউকে যত্ন করায় তার কোনো অলসতা ছিলনা।
সেই সময় বাংলাদেশে খুলনাতে বনেদী পরিবার হিসেবে আমার ঠাকুর্দার বাড়িটি বেশ সুখ্যাত ছিল।
আমার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই। বাবা ও সেজ জ্যাঠার পরিবারকে নিয়ে ঠাকুর্দা ঠাকুমা ঐ বাড়িতে থাকতেন।আমার মা এর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে।
দুই বিঘা জমির মধ্যে চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা ছিল ,বাড়িটি ছিল দোতলা ,আর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দুটো পুকুর ছিল,সেই পুকুরে প্রচুর মাছ ছাড়তেন আমার ঠাকুর্দা,দুটো পুকুরের মাছেই বাড়ির প্রতিদিনকার মাছ খাওয়ার কাজ হয়ে যেত,বাজার থেকে মাছ প্রায় কেনা হতনা বললেই চলে।
একবার ঠাকুর্দা পাড়ার কয়েকজন লোকের কাছ থেকে জানতে পারলেন কারা যেন পুকুরে মাছ চুরি করতে আসে,সেই কারণেই ঠাকুর্দা পাড়ার দু’জন লোক আর আমার বাবা ,জ্যাঠাকে নিয়ে ‘মাছ চোর’ধরার জন্য সারা রাত পুকুরের পাশে আম বাগানে লুকিয়ে বসে থাকলেন,অনেক রাতে চারজন চোর এলো,যেই কিনা পুকুরে জাল ফেলতে যাবে আমার ঠাকুর্দা তার দলবল কে নিয়ে চোরেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,তিন জন চোর ই দৌড়ে পালিয়ে গেল,কিন্তু একজন যার হাতে জাল ছিল তার পা গেল পুকুরের কাদামাটির মধ্যে আটকে,ব্যস সে ধরা পড়ে গেল।বছর পচিঁশের কালো ছিপছিপে দেখতে একটা ছেলে,সবাই কিল, চড় ,ঘুষি মেরে তাকে কাবু করে ফেলল,তারপর তাকে আটকে রাখা হল একতলার একটা ফাঁকা ঘরে।
ঠাকুমা সকাল বেলা নীচের ঘরে চোরটিকে দেখতে এলেন,জিজ্ঞেস করলেন–‘তুমি চুরি করো কেন গো বাছা,কতো মার খেলে,তোমার বাবা মা তোমায় শাসন করেনা বোধহয়,বুঝবে মজা,এখন সবাই মিলে তোমাকে থানায় নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেবে’
পুলিশের কথা শুনতেই চোরটি ঠাকুমার পা জড়িয়ে ধরে বলল—“মা ঠাকরুন,পায়ে পড়ি আপনার ,আপনারা আমারে পুলিশির হাতে তুলে দ্যান না,পুলিশ আমারে খুব মারবে,আমি সহ্য করতি পারবোনা,,তারপর আবার জেলে দিলে আমার অবস্তা এক্কেবারে খ্যারাপ হৈয়ে যাবে,ভুল হৈয়ে গেছে ক্ষমা কৈরে দ্যান”
চোরটা র জন্য ঠাকুমার মনে একটু দয়া হল,বললেন,,’দাঁড়াও কর্তাকে বলে দেখি,’
তারপর ঠাম্মার কথা মতো চোরটিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি,কিন্তু তাকে সারাদিন ঐঘরে আটকে রাখা হল,
ঠাকুমা মা আর জেঠিকে বললেন—-‘চোরটা সারাদিন কিছু খায়নি,বেচারা একটু নয় অপরাধ করেই ফেলেছে ওকে একটু খেতে দিলে কেমন হয়?’
ঠাকুমার কথা শুনে মা আর জেঠি বলল—“একটা চোরের উপর আপনার এ্যতো মায়া হচ্ছে!!”
ঠাকুমা করুণ মুখ করে বললেন”ও তো আমার ছেলের বয়েসি ও তো কোনো মায়ের ছেলে,বাচ্চা ছেলে কেমন করে আমার পা দুখানা জড়িয়ে ধরল বলো’
মা আর জেঠিমা একে অপরের দিকে চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো কেউ কোনো কথা বললো না,এরপর ঠাকুমা ডাল তরকারী ,রুই মাছ ঝোল সমেত চোরটিকে পেট পুরে খাওয়ালো,তা ও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে,পাছে কেউ জানতে পেরে ঠাকুর্দাকে বলে দেয় সেই ভয়ে,,,,
চোর ব্যাটাও তেমনি,সেও পালাবার চেষ্টা না করে পেট পুরে খাবার খেলো,তারপর ঠাকুমার পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে বলল,,,মা আপনি বড্ড ভালো মানুষ,আপনার মতো মানুষ আমি এই পেথ্যম দ্যখলাম”
বলেই চোরটি ঠাকুমার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল-“আপনারে আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কোনোদিন ও চুরি করবো না ”
তার কিছুক্ষণ পরেই ঠাকুর্দা এসে মাছচোরকে ছেড়ে দেয়,তিনি কোনদিন ও জানতে পারেন নি এসব কথা,
কিন্ত এই ঘটনার পর থেকে পুকুরের মাছ কোনোদিন ও আর চুরি হয়নি,
ঠাম্মা হয়তো আজ নেই বছর কুড়ি কিন্তু তার চোরকে যত্ন করার গল্পটা আজ ও আমার মা স্মৃতিচারণ করে ।।