-
সন্দেহবাতিক
সন্দেহবাতিক
-পারমিতা চ্যাটার্জীসুমনার আজ একটু দেরী হল অফিস থেকে ফিরতে। অটো থেকে নামার পর তার বাড়িতে যেতে আরও মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। ও এই পথটুকু হেঁটেই যায় রোজ। যাবার পথে একটা বড়ো সবজির আর ফলের দোকান আছে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সবজি আর ফল রোজ কিনে নিয়ে যায়। সকালে উঠে স্বামী অম্লান যেদিন লাগে মাছ চিকেন বা ডিম কিনে দেয়। ছেলে পিকু ডিম আর চিকেন ভালোবাসে মাছটা কিছুতেই খেতে চায়না। তাও রাতের খাওয়ারটা সুমনা রোজ নিজেই ওকে গল্প করে খাওয়ায়। তখন মাছ জোর করে খাইয়ে দেয়। আজ হয়তো পিকু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। রাতের খাওয়ারটা ও কিছুতেই কাজের মেয়ে শিপ্রার কাছে খেতে চায়না। অম্লানও অসন্তোষ প্রকাশ করে দেরি হলে, আর শাশুড়িমা অত কিছু বলেন না তিনি ভালোমানুষ নির্বিবাদী। বরং ছেলেকে বলেন- আগে মেয়েটাকে একটু জিরোতে দে তারপর না হয় জিজ্ঞেস করিস।
অম্লানের সবই ভালো কিন্তু দেরি হলেই কপাল কুঁচকে যায়। নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে- কেন দেরি হল?
– কাজ ছিল
– দেখো আমায় কাজ দেখিওনা
– তোমার অফিসে কি কাজের জন্য দেরি কখনও হয় না? আর তোমার এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
-আলবাত বাধ্য। কে পৌঁছে দিল অফিসের বস?
সেদিন সুমনা রাগের মাথায় বলে ফেলেছিল, দেখ নোংরামি কোর না। ছেলে বড়ো হচ্ছে। এখন অনেক সংযত হওয়ার প্রয়োজন।
-কিসের সংযত? মা অফিসের বসের সাথে নোংরামি করে বাড়ি ফিরবে, সেটা ছেলেরও জানার দরকার। সুমনা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, মুরোদ আছে একার রোজগারে সংসার চালানো? আর একবার যদি এধরনের নোংরা কথা বল..এগিয়ে এসেছিল সুমন কঠিন ভাবে। তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে সজোরে গালে চড় মারতে মারতে বলছে, মুরোদ দেখাচ্ছ আমায় তুমি মুরোদ দেখাচ্ছ? আমিও দেখছি তোমার কত সাহস বেড়েছে? বলে পায়ের চটি খুলতে যাচ্ছিল। ভয়ে সুমনার মুখ নীল হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় অম্লানের মা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কত জন্ম পাপ করলে যে তোর মত সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাই ভাবি, এক সন্তান তাও নুনে পোড়া।
এমনিতে অম্লান সুমনাকে যে অনাদর করে তা নয়।বাড়ির সব জিনিস সুমনার পছন্দে কেনে। কোনো একটা মুখ থেকে বার করলেই সেটা সাধ্যের অতিরিক্ত দাম দিয়ে হলেও ঠিক নিয়ে আসে। প্রতিদিন অফিস ফেরত সুমনার পছন্দের খাবার নিয়ে ঢোকে। বেশির ভাগ দিনই সুমনাই আগে ফেরে এক একদিন দেরি হয়ে যায়। তখনই ওর পাগলামো শুরু হয়। সন্দেহ করা.. সুমনার মনে হয় তখন ওর এটা একটা অসুখ। তাকেই দায়িত্ব নিয়ে এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
সুমনা ঝগড়ার সময় অনেকবার বলেছে, স্ত্রীকে বিশ্বাস করতে না পারাটা স্ত্রীকে অসম্মান করা, অপমান করা, আমি কেন দিনের পর দিন তোমার এই অসম্মান অপমান মেনে নেব? আমি এবার ডিভোর্স নেব।
অম্লান বলেছে, ডিভোর্স নেবে? আমি ছেলে দেবো না। সে কোর্ট ডিসাইড করবে তুমি বলার কে?
সেদিন মারধোরের পর সুমনা শাশুড়ির কাছে ঘুমায় পিকুকে নিয়ে। অম্লানের সাথে কথাবার্তা একেবারে বন্ধ। অম্লান অনেকবার চেষ্টা করেছে সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার কিন্তু সুমনার কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। কাল ওর খুব জ্বর ছিল। আজ অফিসেও যায়নি। সুমনা ডাক্তার ডেকেছে। ওষুধ এনে দিয়েছে। সকালের খাবারের জন্য স্যুপ বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু নিজে কাছে যায়নি। অম্লান রাগ দেখিয়ে খাবার খায়নি। সুমনা নির্বিকার, ও নিজে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে এসেছে।শাশুড়ি বললেন, তুই যা আমি দেখে নেব।
আজ সুমনা অবাক হয়ে গেল। তার এতোটা দেরি হয়েছে অথচ অম্লান একবারও তাকে ফোন করেনি! কি হল? জ্বরটা বেশি বাড়েনি তো? আজকাল খুব ডেঙ্গু হচ্ছে এদিকে। যদিও তার সবরকম টেস্ট হয়েছে কিন্তু রিপোর্ট এসেছে কিনা জানে না। তাছাড়া কেই বা রিপোর্ট আনাবে? কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। ভাবলঝ একবার ক্লিনিকে গিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে নেবে। কিন্তু এতো রাতে তো ক্লিনিক খোলাও থাকবেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা অন করে অম্লানকে ফোন করতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তার মনে হল পিছন থেকে কে এসে যেন তার মুখটা চেপে ধরেছে। সে কথা বলতে পারছেনা। তারা তাকে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে অম্লানের ফোনটা বেজে গিয়ে ওপার থেকে অম্লানের আকুল গলা শোনা যাচ্ছে, কি হল ফোন করলে কেন? তুমি কোথায়? উত্তর দিচ্ছনা কেন? অম্লান শুনল, কে একজন বলছে এই বরকে ফোন লাগিয়ে দিয়েছে। দাঁড়া তোর হচ্ছে… অম্লান এ কথা শুনে পাগলের মতো মাকে বললো, মা ও কোন এক বিরাট বিপদে পড়েছে। ও ফোন করেছিল, তারপর আমার কানে এইসব কথা এলো। অম্লান গায়ে প্রায় একশো দুইয়ের ওপর জ্বর নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মা পিছন থেকে বললেন, তুই একা কি করবি রে? আগে পুলিশে ফোন করে সব জানা।অম্লান পুলিশে ফোন করে সব বলল,
ও.সি. মি সুরজিত চ্যাটার্জী অম্লানকে বললো আপনি ফোনটা নিয়ে এখনি আসুন। ফোনটা কোথা থেকে এসেছিল সেটা দেখে ট্র্যাক করতে হবে।
অম্লান নীচে নেমে দেখল। একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছে। সে নিজেও তখন জ্বরে টলছে। ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল -বহুত জলদি চলিয়ে,পুলিশ স্টেশন-– কিছু হয়েছে দাদা?
– হ্যাঁ আমার স্ত্রী খুব বিপদের মধ্যে আছে..
– আমি খুব তাড়াতাড়ি পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছি। এই বাজারের আগেই যে ঝোপের মতো আছে ওখান থেকে আমি কয়েকটা ছেলের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আর একটা মহিলা কণ্ঠের গোঙানি। আমি একা আর কি করব ভেবে নিজেই যাচ্ছিলাম পুলিশ স্টেশনের দিকে। সত্যি এই শয়তানগুলোর জন্য দেশটা একেবারে বনজঙ্গল হয়ে গেছে। পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাতেই ড্রাইভারের মুখে সব শুনে আর ফোন ট্র্যাক করে ওসি মিঃ চ্যাটার্জী ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেলেন।অম্লান পৌঁছে দেখে সুমনাকে ওরা মাটিতে শুয়ে ফেলে, ওর গা থেকে কামিজটা প্রায় খুলে নিয়েছে আর সুমনা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তার মুখ গলা রক্তাক্ত। পুলিশ পেছন থেকে গিয়ে ধরে ফেলে চারটি ছেলেকে বাকি দু’জন ছুটে পালায়। ফোর্স ছোটে ওদের পেছনে।
অম্লান সুমনার কাছে গিয়ে নিজের জামা খুলে ওর শরীর ঢেকে দেয়। তারপর ওকে কোলে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ও তো নিজেই তখন জ্বরে আধমরা। সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, অম্লান আমাকে ছুঁয়ো না আজ আমি সত্যি সত্যি অপবিত্র হয়ে গেছি।
অম্লান কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কোনো অপবিত্রতা তোমায় স্পর্শ করেনি। তুমি আমার কাছে একইরকম পবিত্র আছো চল হাসপাতালে যেতে হবে। আগে সুস্থ হয়ে নাও।
ও.সি. মিঃ চ্যাটার্জী বললেন, একজন ওঁদের সাথে যাও। তা নইলে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম নেবে না, আমি এদের ব্যাবস্থা করছি।
তিনদিন পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুমনা ভাবছে অম্লান আর তো তাকে ঘরে নেবেনা। দাদা বাইরে থাকে, বাবা মা কেউ নেই সে কোথায় যাবে এবার? পিকুকে ছেড়েই বা থাকবে কি করে?
সিস্টার এসে ঘরে ঢুকল, সুমনা জিজ্ঞেস করল, সিস্টার আমার স্বামী কি এখানে আর এসেছে?
-হ্যাঁ, উনি তো এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। ওনার তো আজকেই ছুটি।
ছুটি তো কিন্তু যাবে কোথায়? অম্লান যে আর তাকে ঘরে নেবেনা। তাতে সে নিশ্চিত..তাহলে? ভাবতে ভাবতেই অম্লান ঘরে ঢুকল।
সুমনা তার সজল চোখ দু’টো তুলে তাকালো। অম্লান কাছে এসে বসে ওর মাথায় নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো, দূর বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি? কাঁদার কি হল? আজ তো আমরা বাড়ি যাবো।
– আমি কি করে বাড়ি যাবো?
-অম্লান ওকে দু’হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-কোথায় যাবে?
-আমাকে ছুঁলে? তোমার ঘেন্না করছে না?
-না, আমার কোনো ঘেন্না করছে না। তুমি এসব একদম ভাববে না কোনোদিন। যা ঘটেছে তা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আজ আমার যদি একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কিছু ক্ষতি হত। তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?
এত সেই অ্যাকসিডেন্ট নয়, কতগুলো নোংরা হাত আমার শরীর স্পর্শ করেছে। আমার নিজেকে নিজের অপবিত্র লাগছে।
-আমার লাগছেনা। ওরা তোমাকে যে প্রাণে মেরে ফেলতে পারেনি এটাই আমার পরম ভাগ্য। নাও চল, আর ছিঁচকাঁদুনির মতোন কাঁদতে হবেনা। বাড়িতে মা আর পিকু আমাদের অপেক্ষায় আছে।
সুমনা অম্লানের বুকে মুখ গুঁজে বলল- তুমি এত মহান?
– দূর আমি মহান টহান কিছু নই, আমি একটা সন্দেহবাতিক স্বামী।সুমনা একই রকম ভাবে ওর বুকে মুখ গুঁজে থেকে বলল- তুমি এরকমই সন্দেহবাতিক থেকো আর আমাকে এইভাবেই ভালোবেসে যেও।
-আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। সত্যি বলছি বিশ্বাস কর। আমার সমস্ত জীবন জুড়ে শুধু তুমি আর পিকু। কিন্তু আমি এই সন্দেহবাতিক আর থাকব না। আমি বুঝতে পেরেছি যাকে ভালোবাসা যায় তাকে বিশ্বাস করতে হয়। আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালেবাসো তাই ওভাবে মার খেয়েও আমার জ্বরের সময় আমার জন্য আড়াল থেকে সবই করে গেছ। ভালোবাসা না থাকলে তা সম্ভব হয় নাা।চল এবার আমরা আমাদের বাড়ি যাই..
অম্লান ওর হাতের দিকে নিজের হাতটা বারিয়ে দিয়ে গান গেয়ে উঠল– ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার হাতটা ধর তোমার কোমল বন্ধনে..– বাবা! তুমি রবীন্দ্রনাথের গানে কলম চালাচ্ছো?
– ভালোবাসা অনেক সাহস দেয় বুঝেছ?
-হ্যাঁ, বুঝেছি চল এবার। -
বদল
বদল
-পারমিতা চ্যাটার্জীবেশ তো চলছিল সুমেলার আর সৌরভের সংসারটা। রাগ অভিমান আবার ভালোবাসার মিষ্টি মধুর রস নিয়ে চলে গেলো তাদের জীবনের দু’টি বসন্ত।
সৌরভ ওকালতি পাশ করে উকিল হিসেবে বেশ নাম ডাক করে ফেলেছে। সন্ধ্যার পর থেকে তার চেম্বারে প্রচুর ভিড় হয়। উকিল হলেও সৌরভ খুবই রাবীন্দ্রিক মনোভাবাপন্ন। রবীন্দ্রনাথই তার জীবনের জীবনদর্শন । রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি কথার মধ্যে সে এক একটি দার্শনিক তথ্য খুঁজে পায়। এতোই গভীর ভাবনা তার। প্রত্যেক দোলে তার একটি গানের দল আছে যারা প্রায় সবাই সাংস্কৃতিক মনোভাবের, তাদের নিয়ে সে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়িতে প্রকৃতি ভবনের আমন্ত্রণে প্রোগ্রাম করতে যায়। স্ক্রিপ্ট সে নিজে লেখে, বাকিরা কেউ গান, কেউ নাচ, কেউ বা আবৃত্তি করে, পাঠে সে নিজে আর নয়না বলে তার এক যৌবনের প্রথম দিকের বান্ধবী দু’জনে মিলে থাকে। আর সুমেলা একটি আইটি সেক্টরে কাজ করে, রাজারহাটে তার অফিস।
সুমেলা গান বাজনা ভালোবাসলেও সৌরভের মতোন অতো উৎসাহী নয়। সে ভালোবাসে তার কাজকে, কাজই তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কি করে আরও ওপরে ওঠা যায়, কি করে নিজের প্রোজেক্টকে আরও সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করা যায় সেই নিয়েই চলে তার চিন্তা ভাবনা।
বসন্ত এসে গেছে, মানে সামনে দোল, সৌরভ রিহার্সাল শেষ করে রাত প্রায় এগারোটার বাড়ি ফিরলো। তখনও সে গুণ গুণ করে সুর ভাঁজছে, ” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়, করেছি যে দান “।
কাজের যে মহিলাটি আছেন মিনতি মাসি তাকে খাবার গরম করতে বলে সে ঘরে এলো।
এখন বসন্ত, রোমান্টিক সৌরভের মনেও বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ঘরে ঢুকে দেখে সুমেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করে চলেছে।
সৌরভ পেছন থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঠেকালো, এরকম সে প্রায় করে থাকে, সুমেলাও হাসিমুখে সৌরভের আদরে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। আজ হঠাৎ সে এক ধাক্কায় সৌরভকে সরিয়ে দিয়ে বললো- “দেখছো একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি, তুমি কি কিছুই বোঝোনা! “
সৌরভ চমকে উঠলো,” এরকম তো আমি করেই থাকি, আজ হঠাৎ তোমার এতো রাগের কারণ বুঝলামনা তো।”
-কি আবার হবে, কাজের সময় এখন, ভালো লাগছেনা তোমার আদিখ্যেতা,
এতো বাজে ভাবে কথা বলছো তুমি! তুমি না একজন শিক্ষিতা আইটি সেক্টরে চাকরি করা মেয়ে!
– তো? সবসময় কি আমাকে মার্জিত হয়ে থাকতে হবে না কি?
– সৌরভ তাও কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলতে গেলো,” বুঝতে পারছি, তুমি আজ খুব পরিশ্রান্ত, ওকে রেস্ট নাও, আমিও শুয়ে পড়লাম “।
সুলেমা বিছানাটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো প্লিজ।
মিনতি মাসি খুব কুণ্ঠিত হয়ে দরজার বাইরে থেকে ডাক দিয়ে বললো দাদা খাবেনি?
– ও হ্যাঁ যাচ্ছি, সুমেলা তুমি খাবে তো না কি?
– উফ্ এবার দেখছি বেডরুম আলাদা করে নিতে হবে, সমানে ডিস্টার্ব করে আমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করে দিচ্ছে, আমাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয় বুঝেছো! তোমার মতন চোর ডাকাত নিয়ে আমার কারবার নয়। আর আমি না খেয়ে থাকবোই বা কেন অতো আদিখ্যেতা আমার
নেই।
ও এতদিন তো ছিলো, হঠাৎ একদিনেই বদলে গেলো কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা, যাক তুমি তোমার কাজ কর, আমি খেয়ে নিয়ে অন্য ঘরে শুয়ে পড়ছি।
– বেশ তাহলে তো ভালোই হলো।
স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌরভ ওর কথা শুনে, কি এমন হল! হঠাৎ একদিনেই সব পাল্টে গেলো। সুমেলা কি কিছু বুঝতে পেরেছে! নাঃ বোঝার তো কথা নয়, সে তো সুমেলার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই চলে, মনের কথা বোঝার মতন অতো সময় তো ওর নেই- তাহলে!
অশান্ত মন নিয়ে সৌরভ শুতে গেলো কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। খালি মনে হচ্ছে অসম্ভব কাজের চাপে সুমেলা হয়তো রাগ দেখিয়ে ফেলেছে কিন্তু কাজ শেষ হলেই তাকে ডাকতে আসবে শুতে যাবার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ ছটপট করার পর সৌরভ উঠে দেখতে গেলো সুরেলা ঘুমিয়েছে না কি!
গিয়ে দেখলো সে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। তাও ভালো হয়তো ভীষণ ক্লান্ত, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে, এই আশা নিয়ে সেও গেলো শুতে কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়লো।
সকালে উঠে দেখলো সুমেলা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, অবাক হয়ে সৌরভ ভাবলো হঠাৎ একদিনের মধ্যে এতো পরিবর্তন!
দেখলো একটা ছোটো সুটকেসে কিছু জামাকাপড় গোছানো হয়েছে, সৌরভ জানতে চাইলো, “এগুলো কি সুমি? “
সুমেলা বেশ ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিল, “আমি অফিস ট্যুরে যাচ্ছি, ফিরতে কদিন সময় লাগবে।”
হ্যাঁ তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো..
– হ্যাঁ বলো আমিও শুনতে চাই, হঠাৎ এই বদলের কারণটা কি?
-আমি তোমার সাথে এতোদিন মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারলাম না..
-মানে!
-মানে তোমার ওই শান্তিনিকেতন, গানের আড্ডা, আমি জাস্ট বোর হয়ে গেছি, ফিরে এসে আমি ফাইনালি চলে যাবো।
-চলে যাবো মানে!
-মানে এখনকার দিনে এতো অ্যডজাস্ট করে চলার কোনো মানে হয়না, এতো মানিয়ে নিতে নিতে আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তুমি শুধু নিজের আনন্দ, নিজের ভালোলাগা নিয়ে ব্যাস্ত থাকো, কখনও কি জানতে চাও আমার ভালো লাগছে কি না?
সৌরভ অবাক হয়ে বললো ” তুমিও তো কখনও বলো নি, একবার বললেই আমি তোমার ভালোলাগাকেও নিশ্চয়ই প্রাধান্য দিতাম।”
-সব কিছু মুখে বলে হয়না সৌরভ, আমি অনেকবার তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি পাত্তাই দাওনি।
-মানছি তাহলে আমার ভুল হয়েছিল, তাবলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে!
-তাই যায় সৌরভ, যদি মনের কোণটা ফাঁকা থেকে যায় তাহলে সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করে যায়। তুমি তোমার স্মৃতি বউদির দুঃখে কাতর, তার গান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তোমার কতো চিন্তা ; তার অমন ভালোমানুষ স্বামী সে না কি স্মৃতি বউদির গানের জন্য কোনো চেষ্টাই করেনি, তাই বউদিকে তোমাকে ফাংশনে নিয়ে যেতে হয়, তার চোখের জলের মূল্য তোমার কাছে অনেক বেশি, আর আমি যে একজন ভালো বাচিক শিল্পী, আমার কবিতা বলা, শ্রুতিনাটক যে বন্ধ হয়ে গেছে, তারজন্য তুমি কতটুকু কি করেছো সৌরভ?
নিজের শখ পূরণের জন্য যেমন স্মৃতি বউদিকে তোমার হাত ধরতে হয়েছে তেমনি আমার গুণকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পী করার জন্য আমারই অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার এগিয়ে এসেছেন, আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমায় অনেক সুযোগ করে দিয়েছেন। তোমার যেমন চেম্বারের পর অনেকক্ষণ ধরে স্মৃতি বউদির গান না শুনে ওর সাথে সময় না কাটিয়ে রাত্রে ঘরে ফিরতে মন লাগেনা, তারপর ফিরে এসে একটু শুকনো আদর দিয়ে কোনরকমে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, একবারও ভাবোনা আমি কতটা বঞ্চিত হচ্ছি, একে তুমি ভালোবাসা বলো?
কিসের ভালোবাসা সৌরভ! কোনো ভালোবাসা আর অবশিষ্ট নেই। তোমার এই নিষ্প্রাণ ভালোবাসায় আমি ক্লান্ত, এতোদিন বুঝিনি, একদিন হঠাৎ আমার চোখ খুললো, যেদিন আমি অফিস থেকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে তোমাকে ফোন করলাম, সেদিন তুমি কতো বিরক্ত হয়ে বলেছিলে, ‘কি করে জ্বর বাঁধালে! ডাঃ চক্রবর্তীকে ফোন করে ডেকে নাও”, বলে তোমার কর্তব্য শেষ করে দিলে। রাতে এসেও আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেনা যে, আমি ওষুধ খেয়েছি কিনা! ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে তুমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লে, সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, স্মৃতি বউদির আকর্ষণ তোমার কাছে কতো তীব্র, আমি একটা মেয়ে হয়ে এ অপমানটা মেনে নেবো কেনো বলতে পারো? আমি স্বনির্ভর তাই নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিলাম।
সৌরভ দেখলো সুমেলা তার সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজ সে সত্যি বাধা দিতে পারছেনা, নিজের কাছে নিজেই এক চরম অপরাধী হয়ে গেলো, মুখ নীচু করে বসে থাকা ছাড়া আজ আর কিছু করার নেই তার। -
কিছু পলাশের নেশা
কিছু পলাশের নেশা
-পারমিতা চ্যাটার্জীদোলা আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার গ্রীলটা ধরে। কাল রাতে তিতিরকে রঞ্জন নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভীষণ একলা লাগছে নিজেকে।
আজ চারদিকে শুধু রঙের খেলা। ওইতো সামনের বাড়ীর ছাদটায় সামিয়ানা টাঙিয়ে দোল খেলার কি বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার অনেকের সাথে তারও নিমন্ত্রণ ছিল কিন্তু সে যায়নি। যার জীবনের ক্যানভাসটাই বেরঙা হয়ে গেছে সে আর রঙ খেলে কি করবে। সামনের বাড়ী থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, “রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস —
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।।
ফাগুন লেগেছে বনে বনে”–।
দোলার মনে পড়ছে বিয়ের পর রঞ্জন তাকে এসে বার বার রঙিন আবীরে ভরিয়ে দিচ্ছিল। তাই দেখে ওর ছোট ননদ বলেছিল তুই কি আজ শুধু দোলাকেই রঙ মাখাবি? আমদের কি ভুলেই গেলি?
রঞ্জন ছিল তার বন্ধু বহ্নির দাদা। সেই সুত্রে তাদের আলাপ আর প্রেম তারপর বিয়ে তারপর তিতিরের আগমন তাদের দিনগুলোকে আরও সোনলী আর রঙিন করে দিয়েছিল। প্রতি বছর রঞ্জনদের বাড়ীতে বেশ বড় করে রাধাকৃষ্ণের পুজো হয় তারপর দোল খেলা হত ওদের বাগানে। অনেক আত্মীয় বন্ধুর সমাগম হত। রঞ্জনের অনুরোধে প্রতিবার তাকে গান গাইত হত। ফাগুন লেগেছে বনে বনে এই গানটা যে সে কতবার মনে পড়েনা আর। একবার দোলাকে কাছে নিয়ে তাকে রঙ মাখাতে মাখাতে রঞ্জন গেয়েছিল, “একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনে।” সবাই কি হাসাহাসি তাই নিয়ে, রঞ্জন একটুও লজ্জা না পেয়ে উত্তর দিয়েছিল, আজ প্রেমের দিন নিজের বউয়ের সাথে প্রেম করবো না একটু? দোলা লজ্জায় লাল হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল।
আজ সেই সব স্মৃতি হয়ে শুধু বেঁচে আছে দোলার গোপন অন্তরে। কাল অবশ্য ওকে রঞ্জন বলেছিল অনেকবার চলোনা তুমিও, মা অনেকবার করে বলে দিয়েছেন তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য–।
– দোলা প্রশ্ন করেছিল কোন অধিকারে যাবো?
– তিতিরের মায়ের অধিকারে, আর তাছাড়া আমিই না হয় খারাপ, অন্যায় যা হয়েছিল আমার দিক থেকে কিন্তু আমার বাড়ীর লোকেরা তো সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসে। মা মাঝে মাঝেই তোমার কথা বলেন আর চোখের জল ফেলে বলেন আমার অমন লক্ষ্মী বউমাকে তোর জন্যেই বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হল। চলো না এবার প্লিজ-
বলে ওর হাত ধরতে গিয়েছিল-
– দোলা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় বলেছিল- আমি তোমার হাতের খেলনা নই রঞ্জন, যে তোমার ইচ্ছে হলেই বাড়ী থেকে বার করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে নেবে। আবার ইচ্ছে হলেই হাত ধরতে আসবে
তাহলে তিতিরও না হয় থাক তুমি তো একদম একা থাকবে?
– না তিতির ওর দাদু ঠাম্মা পিসি বাবার সাথে আনন্দ করুক আমার জন্য ওর শৈশবটা বেরঙা করবো কেন?
তারপরও রঞ্জন বলছিল, “আমার ভালোবাসায় ভরা রঙিন দিনগুলোকে কি একেবারেই ভুলে গেছ?” শুধু আমার অসভ্যতাটাই মনে করে রেখেছ?
– না ভুলব কেন? সেই স্মৃতিটুকু নিয়েই তো পথ চলছি। কিন্তু নিজের কপালের ওপর একটা কাটা দাগ দেখিয়ে বলল, এই অপমানটাও ভুলতে পারিনি। ওপরের আঘাতটা শুকিয়ে গেলেও ভেতরের ঘা-টা বড় দগদগে। ওটা কোনদিন শুকোবে বলে মনে হয়না।
এরপর আর রঞ্জন কোন কথা বলেনি মুখ নীচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল। বেরোবার আগে তার কপালের দাগটার দিকে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে দেখেছিল, দোলা লক্ষ্য করল ওর গভীর চোখদু’টোতে টলটল করছে জল।
ওরা চলে যাবার পর দোলা উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে পরেছিল কখন যে চোখে ঘুৃম নেমে এসেছিল টেরই পায়নি। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরে বলল, হ্যালো-
ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো রঞ্জনের,
দোলা?
– হ্যাঁ বল?
– ঘুমিয়ে পরেছিলে?
-হ্যাঁ
-এই তিতির তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়…
-দাও ওকে…
-মাম্মা আমার তোমার জন্য খুব মন খারাপ করছে। এখানে সবাই আছে শুধু তুমি নেই-
দোলা বুঝল এগুলো শেখানো কথা তা নইলে তিতির এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা।
দোলা তাও নিজেকে সংযত করে বলল- তুমি ঘুমিয়ে পড়ো সোনা অনেক রাত হয়ে গেছে।
– তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসেনা মাম্মা…
-এখানে সবাই বাপি মাম্মা দু’জনের সাথে এসেছে আমি শুধু তোমায় ছাড়া…
– এইতো আর দু’ এক দিন পরেই তো আমার কাছে আসবে আবার…
– কিন্তু তখন তো বাপি আমাদের সাথে থাকবেনা?
– তুমি বাপির কাছে থাকতে চাও?
-আমি দু’জনের সাথেই থাকতে চাই…
– আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়ো…
– ঘুমলে আমরা একসাথে থাকব তো?
– না সোনা তা আর হয়না…
– কেন হয়না মাম্মা?
– সে তুমি বুঝবেনা এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
আবার রঞ্জনের গলা —
– মেয়ের স্বার্থেও কি আমরা আর একবার এক হতে পারিনা…
– আমি খুব ক্লান্ত রঞ্জন আমায় একটু ঘুমতে দাও। বলে দোলা ফোনটা কেটে দিল।
সারা রাত আর ঘুমতে পারেনি কিছু খাওয়াও হয়নি।
আজ সারারাত ভেবেছে কখনও রঞ্জনের গভীর ভালোবাসার কথা কখনও বা তার নির্মম ব্যাবহারের কথা। তিতির যখন সবে দু’ বছরের তখন রঞ্জনের জীবনের আসে রনিতা। রনিতা রঞ্জনের অফিসেই কাজ করত কিন্তু রঞ্জনের চেয়ে অনেকটাই জুনিয়র ছিল। তার খোলামেলা পোশাক উচ্ছলতা অনেক পুরুষকেই আকর্ষণ করত। অফিস পার্টিতে মদ খেয়ে নাচ করতে সে বেশ অভ্যস্ত ছিল। রঞ্জনও একদিন বিরক্ত হয়ে এসে দোলাকে বলেছিল, কোথা থেকে যে এসব চিপ মেয়েগুলোকে আমদানি করে কে জানে?
এই একটা মেয়ের জন্য অফিসের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই চিপ মেয়েটার ফাঁদে রঞ্জন নিজেই সবচেয়ে বেশী আটকে গেল। এমন ভাবে আটকালো যে স্ত্রী সন্তান পরিবারের সবাইকে একদিকে ফেলে রমিতাকে নিয়ে মত্ত হয়ে গেল। সেদিন দোলার প্রতিবাদ চোখের জল সবকিছুই তার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছিল। গোপনে রনিতার সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও করেছিল। সেখান থেকে রনিতা ইচ্ছামত টাকা তুলে তার শখ মেটাত। দোলাকে খুব সামান্য টাকা ধরে দিত। প্রতিবাদ করলে বলত যার নিজের রোজগারের মুরোদ নেই স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে ওইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বেশী প্রতিবাদে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করতো না। একদিন এরকম এক ঝগড়ার সময় চড়ের পর চড় মেরে দোলার মুখ চোখ ফুলে গেল। পরদিন দোলা ঘর থেকে বার হতেই পারছিল না লজ্জায়। পরদিন শাশুড়ি দেখে বললেন বউমা একি অবস্থা? দাঁড়াও আজ বাড়ী ফিরুক আজ একটা হেস্তনেস্ত করব। শ্বশুরমশাই দেখে বললেন বউমা আমি এখনও বেঁচে আছি ওই ইতরটাকে কি ভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমিও দেখছি। কিন্তু সেদিন রঞ্জন বাড়ি ফেরেনি। অফিস কলিগকে ফোন করে ওরা জানতে পারে রঞ্জন রমিতাকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গেছে।
তারপর দোলা চাকরি খোঁজায় মন দেয়। বাড়ির তাতে মত দেয় একটা কিছু নিয়ে তো তাকে বাঁচতে হবে। পেয়েও যায় এক গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতার কাজ। সত্যি কথা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা চিরকাল তার পাশে ছিল আজও আছে।
পুরী থেকে ফিরে এসে রঞ্জন ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায়। যে মদকে সে ঘৃণা করত সেই রোজ মাঝরাতে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরত।
একদিন দোলা বলে ফেলেছিল, ভালোই হল তিতির বড় হয়ে দেখবে তার বাবা একটা মোদো মাতাল দুশ্চরিত্র লোক। মেয়ে রঞ্জনের বুকের পাঁজর ছিল। এইকথায় সে হঠাৎ মত্ত অবস্থায় উঠে দোলার চুলের মুঠি ধরে সজোরে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকে যায়, দোলার কপাল ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তখন। রক্ত দেখে তার নেশা ছুটে গেল তাড়াতাড়ি তখন ডেটল ব্যান্ডেজ খুঁজতে আরম্ভ করল। রঞ্জন বলেছিল স্যরি দোলা আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলামনা। দোলা রঞ্জনের হাত ছাড়িয়ে নিজের কপাল চেপে ধরে শ্বশুর শাশুরির দরজায় ঘা দেয়। তাঁরা তো ওর অবস্থা দেখে কেঁদেই অস্থির শাশুড়ি বললেন — এও ছিল আমার কপালে লেখা এমন ছেলে থাকার থেকে মরে যাওয়াও যে ভালো। শ্বশুরমশাই তাড়াতাড়ি ডেটল নিয়ে এসে জায়গাটা পরিস্কার করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই রক্ত বন্ধ হল না। রঞ্জন বরফ নিয়ে এলো শ্বশুর তাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, খবরদার তুমি ওর কাছে যাবার চেষ্টা করবেনা তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। উনি ছুটে নীচে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে তুলে নিয়ে গেলেন হসপিটালে। কি ভাগ্যিস আউটডোরে ডাক্তার পাওয়া গেল। দোলার কপালে তিনটে সেলাই পরলো। তার পরের দিন উকিল ডেকে এনে উনি ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করেন। রঞ্জন তখন কাকুতি মিনতি করতে থাকে তিতিরকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারবনা। উকিল সাহেব প্রশ্ন করল কি আর একবার সুযোগ দেবে নাকি?
তার হয়ে তার শ্বশুরই উত্তর দিলেন তোমার মতন একটা পশুর কাছে কিছুতেই এই বাপ মা মরা মেয়েটাকে রাখতে পারবনা। রঞ্জন কান্নায় ভেঙে পরে বলেছিল কিন্তু এটুকু শুধু করুন ওদের সমস্ত ব্যয়ভার আমার, দোলা চাকরি করতে কোনদিন ভালোবাসতনা আজ আমার জন্য ওকে চাকরি করতে হচ্ছে…
শ্বশুর কঠিন কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল সে কথা এখন আর না ভাবলেও হবে তাছাড়া আমি এখনও বেঁচে আছি।
একমাসের মধ্যেই এই ফ্ল্যটটা তাকে কিনে মনের মতন করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। দোলা তার মেয়ের হাত ধরে এ বাড়ীতে এসে ওঠে।
কৃতজ্ঞতায় ছলছল চোখ নিয়ে দোলা বলেছিল তুমি এতো করে দিলে বাবা?
– আজ থেকে তুই আমার বউমা নয় আমার মেয়ে।
তারপরই রঞ্জন বুঝতে পারে তার ভুল সে কি হারালো? রঞ্জন দেখল তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট শূন্য সে নিজের নাম অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নিল। আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলল যার নমিনি করল দোলাকে।এই নিয়ে রমিতার সাথে তার বিস্তর ঝগড়া হল। রঞ্জন নতুন চাকরি নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। তিতিরকে ও বাড়ীতে তার শ্বশুর মাঝে মাঝে এসে নিয়ে যেতেন। শাশুড়িও মাঝে মাঝে এসেই এ বাড়ীতে এসে দোলাকে দেখে যেতেন, ননদও আসত শুধু রঞ্জনের আসা একদম বারণ ছিল। আজ এই প্রথম রঞ্জন এসেছিল।
কাল রাত থেকে সে খায়নি দশটা বাজে এখনও পর্যন্ত এককাপ চা খেয়েও উঠতে পারেনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এককাপ চা আর দু’টো বিস্কুট নিয়ে বসল। ভাবল একটু পরে যা হোক একটু আলুভাতে ভাত করে নেবে।
সে বিছানায় শুয়ে পড়লো, আবার ঘুম আসতে লাগল কাল রাত জাগরণের ফল।
এমন সময় মনে হল দরজার বাইরে যেন অনেক লোকের কোলাহল তারপরই দরজায় বেশ কয়েকবার বেলের আওয়াজ। সে থমকে গেল কে এলো তার কাছে তো আসার মতন এখন কেউ নেই। ডোর আই দিয়ে দেখল তার শাশুড়ি মায়ের মুখ তখন সে নির্ভয়ে দরজা খুলল। একসাথে হুড়মুড় করে ঢুকে পরল সবাই শ্বশুর শাশুড়ি ননদ নন্দাই তাদের ছেলে সোহম সবশেষে তিতিরের হাত ধরে রঞ্জন । শাশুড়ি এসেই হাসিমুখে বলল আজ আমি আমার ঘরের লক্ষীকে নতুন করে বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছি।
দোলা অবাক চোখে তাকালো তার মনে হচ্ছিল সে কি স্বপ্ন দেখছে?
রঞ্জনের অনেক প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে মা। আমি জানি তোমার অভিমান ঘৃণা এতো সহজে যাবার নয়। তবু বলছি তিতিরের মুখ চেয়ে রঞ্জনকে আর একটা সুযোগ দাও। কাল দেখো নিজের কপালের কি অবস্থা করেছে।
দোলা জিজ্ঞেস করলো- “এ কি করে হল?” বললো- দোলার কপালের কাটা চিহ্নটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাই নিজের কপালটা ওইভাবে ঠুকে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছিলাম।
দোলা এতক্ষণে তাকিয়ে দেখল কপালে একটা ব্যান্ডেজ আছে ঠিকই কিন্তু তা রক্তে লাল হয়ে ভিজে গেছে। দোলা বলল স্টিচ হয়েছে? এখনও তো রক্ত বন্ধ হয়নি? আজ কোনো ডাক্তার পাওয়া গেলনা। সেকি তা বলে সারাদিন ধরে এই রক্ত পরে যাবে? আমি দেখছি বলে ছুটে পাড়ার একজন ডাক্তারকে ফোন করে বললো, “একজনের কপাল ফেটে খুব রক্ত পড়ছে , মনে হচ্ছে সেলাই দিতে হবে আপনি একটা কিছু যা হোক ব্যাবস্থা করুন।
– ঠিক আছে মা তুমি ব্যস্ত হয়োনা আমি দেখছি কি করা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার একটি ছেলে নিয়ে এসে ক্ষত পরীক্ষা করে দেখে বললেন- এ হে হে কি করে এভাবে কেটে গেল বাবা? রঞ্জন তখন আর কথা বলতে পারছেনা শুয়ে পড়েছে দোলার খাটে। কম্পাউন্ডার সেলাই করতে করতে বলল- পাঁচটা সেলাই পড়ছে বাবু?
– হ্যাঁ যা লাগে তাতো করতেই হবে। একটা টিটেনাসও দিতে হবে। তারপর ডাক্তার তার কাজ সেরে ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন, বলে গেলেন জ্বরও আসতে পারে কিন্তু।
রঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে পরল- দোলা দেখল রঞ্জনের দু’ চোখের কোল দিয়ে জল পড়ছে। দোলার মনে আছে রঞ্জনের ছুঁচ ফোটানোতে কত ভয় ছিল সে আজ নিঃশব্দে সব যন্ত্রণা সহ্য করল।
দোলা কাছে এসে ইতস্তত করছিল। ঘর থেকে ওদের একটু একলা থাকার সুযোগ দিয়ে সবাই বাইরে চলে এলো প্রসাদ ভাগ করার ব্যবস্থা করতে। যাবার আগে ওর ননদ কানে কানে বলে গেল তুই চলে আসার পর দাদা একবারও আবীর খেলায় অংশ নেয়নি। না কাউকে দিয়েছে না ওকে কাউকে দিতে দিয়েছে। জোর করলে বলতো আমার রঙ খেলার মানুষটা যদি কোনদিন ফিরে আসে তবেই আবার খেলবো। ওটা বোধহয় ও একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিল। আমাকে ধরে যে অত মারতো সেটাও কি ট্র্যাপে পড়ে? জানিনা রে সত্যি জানিনা, তবে অনুতাপ অনুশোচনায় যে তিল তিল করে দগ্ধ হচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। মাঝখানে তার শুধু এমন হল যে ভালো করে খেতো না ঘুমোত না খালি কাঁদতো।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর দোলা দেখল ও কুঁচকে শুয়ে আছে মনে হল ওর শীত করছে দোলা ওর গায়ে চাপা দিতে গেল তখন রঞ্জন ওর হাতটা ধরে কাছে এনে বলল, “বলো দোলা আমার প্রায়শ্চিত্ত কি হয়েছে”? দোলার চোখেও তখন জল ভর্তি সে তবু অভিমানে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রঞ্জন জোর করে ওর মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল-“একবার বলো”?
দোলার কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, “এর কি কোন প্রয়োজন ছিলো?”
আমি জানিনা ছিল কি না? কিন্তু কাল তোমার কাটা দাগটা আমায় ভীষণ আঘাত দিলো মনে হলো নিজে করে দেখি সেদিন কতোটা কষ্ট ওকে দিয়েছিলাম? তাই করে ফেললাম…
দোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল ওখানে চলো আসতে আসতে, সবাই অপেক্ষা করছে।
দোলার কাঁধে ভর দিয়ে রঞ্জন বেরোতেই তিতির আর সোহম ওদের দিকে আবীর ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হোলি হ্যায়— ওরা দু’জনেই হেসে ফেললো। আবার অনেক দিন পর ওরা রঙের আনন্দে মেতে উঠলো।
রঞ্জন দোলার দু’গালে কপালে গলায় আবীর মাখাতে মাখাতে গান ধরল-
একটুকু ছোঁওয়া লাগে একটুকু কথা শুনি…তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী…
দোলা লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। রঞ্জন কাছে এসে আবার ওর মুখটা আদর করে তুলে ধরলো, দোলা বাধ্য হল গান ধরতে- কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি।।
দোলা আর রঞ্জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওদের নন্দাই দু’টো পলাশের মালা দু’জনের হাতে দিয়ে বললো এবার তোমরা পরিয়ে দাও দু’জনের গলায়—–
সবাই আবার সমস্বরে বলে উঠল হোলি হ্যায়।। -
উমার ডায়েরি
উমার ডায়েরি
-পারমিতা চ্যাটার্জীবহুদিন পর উমা বসেছে এক পুরানো ডায়েরির পাতা খুলে,
সেখানে লেখা আছে অনেক কবিতা,
একসময় কিশোরী বয়েসের আবেগে অনেক কবিতা লিখে ফেলতো-
একবার স্কুলে কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল,
আজ তার মনে হল, আবার ডায়েরির পাতা খুলে লেখার কলমটা তুলে নি।
তখন লিখতো স্বপ্ন দেখার কবিতা, কিশোরী মনের আবেগ প্রবল কল্পনার কবিতা, বসন্তের কবিতা, শ্রাবণের কবিতা।
আজ লিখবে জীবনের কবিতা —
লিখতে গিয়ে কলমটা থেমে যাচ্ছে কেনো?
বুকে তার জমা হয়ে আছে কবিতার পাহাড়,
কলমে কেনো আসছেনা?
তবে কি তার কবিতারা সব হারিয়ে গেলো?
মনের প্রশ্ন মনেই রেখে কলমটা সরিয়ে রাখলো পাশে,
বিচিত্র জীবনের ছবি কবিতায় আনতে গেলে
তার স্বপ্নগুলো মুছে ফেলতে হবে,
যে স্বপ্ন সে আজও দেখে চলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে,
সে স্বপ্নরা পরিণতি না পেলে হয়তো জীবনের কবিতা তার কলমে আসবেনা -।
আগে স্বপ্নগুলোকে মনের ডায়েরি থেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে হবে,
কল্পনার মনটাকে মেরে ফেলে জীবনকে দেখতে হবে বাস্তবের আঙিনায় -।
সে কি পারবে? এই নির্মম বাস্তবতার ছবি আঁকতে?
যে বাস্তব তার স্বপ্নকে মুছে দিয়েছে, কল্পনার জালেক ছিন্ন করে দিয়েছে, তার ছবি আঁকতে?
বড়ো নিষ্ঠুর হয়ে যাবে যে সে লেখা,
তবু তাকে লিখতে হবে, বুকের জমা কষ্ট গুলোকে মুক্তি দেবার জন্য তাকে আবার কলম ধরতেই হবে।
জীবন শুধু কল্পনার নয়, আবেগের নয়, স্বপ্নের নয়, প্রেমেরও নয়,
জীবন এক বিশাল জলাভূমি, এখানে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে অনেক সাঁতার কাটতে হয়,
তবু ভালোবাসা থেকে যায় অধরা।
জীবন প্রতিমুহূর্তের ঘাত প্রতিঘাতের এক জ্বলন্ত ছবি,
তারমধ্যে আঁকতে হয় একটি ছোটো শান্ত নদীর বুকে নেমে আসা সন্ধ্যার কাব্য।
যে ছবিতে এগিয়ে চলেছে সুখ দুঃখ, আনন্দ, ব্যাথা, যন্ত্রণা, জয়, পরাজয় হাত ধরাধরি করে।
যে ছবিতে অশান্তির মধ্যেও থাকবে এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তির মুহূর্ত, যেখানে প্রতিদিনের দরজায় চৌকাঠে পা দিয়ে ভাবতে হবে, ” আজ কি রোদ উঠবে না বৃষ্টি পড়বে?
এই ছবি ধরেই জীবনের ছক এগিয়ে চলে পুরোনোকে পিছনে ফেলে নতুনের দিকে।
বৈচিত্র্যময় জীবন খোঁজে নতুনত্ব,
খুঁজতে গিয়ে অনেকে যায় হারিয়ে, অনেকে এসে পারে পৌঁছায়,
কিন্তু থামেনা কেউ, এগিয়ে চলে সবাই, তুমি, আমি সবাই চলেছি বৈচিত্রের খোঁজে,
পথটা আলাদা হলেও গন্তব্যটা একই।
হ্যাঁ উমা খুঁজে পেয়েছে তার কবিতা,
তার মরে যাওয়া স্বপ্নের নদীর মোহনা এখন জীবন নদীর সঙ্গমে মিলিত হয়েছে,
সে কলমটা তুলে নেয় আবার বহুদিন পর,
ডায়েরিটা নিয়ে লিখে চলে কবিতা, শুধু ছন্দটা পাল্টে গেছে, মানেটা পাল্টে গেছে, কিন্তু কবিতারা রয়ে গেছে অন্তর স্থলে। -
আমি সুভাষ বলছি
আমি সুভাষ বলছি
-পারমিতা চ্যাটার্জী
ভারতের অন্যতম জননায়ক হারিয়ে গিয়েছিলেন, হঠাৎ এতোদিন পর প্রকাশ পেলো, তিনি ছিলেন ভারতের প্রধম প্রধানমন্ত্রী। আজাদ হিন্দ সরকারের এই বীর যোদ্ধা কোথায় হারালেন, কে তাকে সরিয়ে দিলো কোন অন্ধকার কূপে? তা আজও অন্ধকারে। দ্বিখণ্ডিত স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র নেতারা জানালেন
প্লেন ক্র্যাশে এই মহান জননেতার মৃত্যু হয়েছে, তা যে ভিত্তিহীন তা পরে প্রমাণিত হয়। সেদিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল সেদিন আদৌ কোন প্লেন ক্র্যাশ হয়েইনি। তবে কোথায় গেলেন আমাদের সবার প্রিয় নেতাজী? এ প্রশ্ন আজও অজানা। হয়তো সাইবেরিয়ার কোন অন্ধকার জেলে তাঁর দিন কেটেছে, আমরা কেউ তা জানিনা। অপ্রকাশিত থেকেই গেলো মুখার্জী কমিশনের ফাইল, কিন্তু কেন? এর উত্তর পাওয়া যায়নি আমাদের তদানিন্তন রাষ্ট্র নেতাদের কাছ থেকে। আশ্চর্য দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ –
যে নেতার বীরত্বে ত্যাগে আমাদের এই স্বাধীনতা তাঁর অন্তর্ধানের কোন প্রশ্ন কারও মনে জাগলনা?
না কি সত্য প্রমাণিত হবার ভয় ইচ্ছা করেই জাগানো হয়নি? নেতাজী ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের হাল কে, তিনি বুঝেছিলেন অহিংস নীতি দিয়ে কোনদিন স্বাধীনতা আসবেনা আর ভারতবাসীকে থাকতে হবে ইংরাজ শাষকের জুতোর তলায় – তিনি প্রথম যুদ্ধের ডাক দিয়ে ভারতের যুবকদের তাজা রক্তকে উদ্বুদ্ধ করেন।কঠিন দৃপ্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান, ” তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো “।তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে হাজার হাজার যুবক বৃন্দ ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতার সশস্ত্র আন্দোলনে।
নিজের বাড়িতে নজরবন্দী থাকা অবস্থায় ছদ্মবেশে পালিয়ে যান সুদূর আফগানিস্তান হয়ে দুর্গম পথ অতিক্রম করে না খাওয়া না থাকার জায়গার কোন স্থিরতা, এক বিশাল পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যান জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দী ভারতীয় সেনাদের উদ্বুদ্ধ করেন জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। নেতাজি বিবেচনা করলেন তাঁকে পৌঁছাতে হবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানে যেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু,প্লেনে যাওয়া বিপদজনক তাই তিনি সাড়ে তিনমাস সমুদ গভীরে সাবমেরিনে যাত্রা করেছিলেন জাপানের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকেই শুরু হয় ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন নেতাজি। শুরু হয়ে গেলো আজাদ হিন্দ বাহিনীর সামরিক অভিযান। মাতৃভক্ত আজাদ হিন্দ সেনার দেশ মাতার শৃঙ্খল উন্মোচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের সর্বশক্তি দিয়ে। ১৯৪৩ শালেই স্বাধীন ভারতের হাতে চলে এলো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শাসনভার । ১৯৪৩ শালে পোর্ট ব্লেয়ারের মাঠে সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন আমাদের ঘরের মানুষ তথা দেশ বরেণ্য জননায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁর এই অদম্য সংগ্রামের কথা, সবই কি ভুলে যাবে ভারতবাসী?
নেতাজির এই অদ্যমতা কাঁপিয়ে দেয় ইংরাজ শাসনের ভিত কে।
অন্ন নেই, বস্ত্র নেই প্রবল শীতে একটা ভালো কম্বল পর্যন্ত নেই, ছিল শুধু স্বাধীন দেশের স্বধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের এক অদম্য প্রয়াস।আমাদের বাংলার ছেলে বীর সুভাষের সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, ” আমি সুভাষ বলছি ” আজও ভারত তথা বাঙালির হৃদয়ে কম্পন জাগিয়ে তোলে, এ কি ভুলে যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন আমাদের ঘরের ছেলে বীর সুভাষের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী। হাতের বাইরে চলে যায় দেখে রাতারাতি গোল টেবিলের বৈঠক ডেকে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ শালের দ্বিখণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সম্পূর্ণ আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হয় বীর নেতা সুভাষকে প্লেন ক্র্যাশের মিথ্যা ঘটনা রটিয়ে। যাঁর অদম্য বীরত্বে ত্যাগে সংগ্রামে আমাদের এই স্বাধীনতা, তাঁকেই সরিয়ে দেওয়া হয় কোন অজানা গন্তব্যে।
কি ভাবে কেটেছিল তাঁর জীবনের শেষ কটি দিন তা আজও প্রমাণ সাপেক্ষ, শুধু আমরা এটুকু জানি সুভাষ আর ঘরে ফেরে নি, কিন্তু কেন? এই কেনোর উত্তর আমরা কবে পাবো বা আদৌ পাবো কিনা তা আমাদের জানার বাইরে।
আজ এই বীর নেতার জন্মদিন, তাঁকে জানাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম, মনে মনে বলি তুমি ফিরে এসো নতুন রূপে, নতুন নামে, তোমাকে যে আজ আমাদের বড়োই প্রয়োজন, এই স্বাধীন ভারতের দুর্দশা, তুমি আর একবার দেখে যাও, স্বাধীন হয়েও আমরা পরাধীনতার নাগপাশে বন্দী।
আর একবার শোনাও তোমার সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, ” আমি সুভাষ বলছি “। -
নতুন ভোরের আলো
নতুন ভোরের আলো
-পারমিতা চ্যাটার্জীসূর্যের শেষ রেখাটা ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে,
দিনের আলোর রেখা নিভে গেলো আধারের অন্তরালে।
রাত বড়ো প্রিয় আমার,
অন্ধকারের অন্তরালে আমার একলা আকাশকে আমি খুঁজে পাই।
একটু পরেই তো ঝলমল করে উঠবে যত তারা,
ওরা আমায় ডেকে বলবে-
“ও মেয়ে আধার ঘরে সাঁঝাবাতি জ্বালবিনা?
আমি বলব- আমার সাঁঝবাতি যে তোমরা-
তোমরাই তো আমার নীরব মনের কোণে কোণে আলোর রেখা টেনে দিয়ে যাও,
সেই আলোই তো আস্তে আস্তে মিশে যায় এসে প্রথম ভোরের আলোর অন্তমিলে”।
সূর্য ওঠা ভোর নিয়ে আসে আর একটা নতুন দিন,
আর আমি সেই নতুন দিনের চৌকাঠ ধরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।
অপেক্ষায় থাকি আবার কখন আসবে রাতের অন্ধকার,
তারার ফাঁক দিয়ে ভেসে বেড়ানো মেঘের আঁচলে লিখে যাই জীবনের যত না বলা কথা –
যা কোনদিন কাউকে বলা হয়নি,
বলার অপেক্ষায় কেটে গেছে
জীবনের গোধূলি বেলা, কিন্তু হয়নি বলা, বলতে এসে বারবার শুধু ফিরে গেছি,
প্রত্যাখ্যানের ব্যাথা বেদনার সব কথাই লেখা আছে অদৃশ্য মেঘের আঁচলে,
না বলা কথাটা না বলাই থাক,
সামনে দিয়ে নদীটা শুধু বয়ে যাক।
“ও বৃষ্টি তুমি মেঘের আঁচল থেকে মুছে দিওনা আমার লেখা কথাগুলো।
তোমার অঝোর ধারায় ভেজা মনের অনেক কথা লেখা আছে সেই আঁচলে,
তুমি তাকে বাঁচিয়ে রেখো”।
রাতের কোলে মাথা রেখে স্বপ্ন দেখা কখন শেষ হয়ে যায়,
আবার আসে নতুন ভোরের আলো আর আমি আবার আজকে দিনের দরজা ধরে থমকে দাঁড়িয়ে যাই । -
এখানে সবুজ নেই
এখানে সবুজ নেই
-পারমিতা চ্যাটার্জীএখানে সবুজ নেই, গাছের রঙ ধূসর।
আকাশে নীল খুঁজে বেড়াই , ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ।
এখানে প্রকৃতি কাঁদে যন্ত্রের তাণ্ডবে।
এখানে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ ফেকাসে,
এখানে শুধু রক্তের লাল রঙ ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
এখানে প্রেম নেই, নেই কোন ভালোবাসা,
এখানে গৃহ আছে, সম্পদ আছে,শান্তি নেই।
এখানে ভালোবাসা লুটিয়ে পড়ে বেদনায়,
এখানে নারীর ভালোবাসায় পুরুষ খোঁজে শুধু খিদে,
পুরুষের ভালোবাসায় নারী খোঁজে প্রাচুর্য।
এখানে নারীর লজ্জা লুটিয়ে পড়ে ধর্ষকদের অত্যাচারে,
এখানে বিচারের বাণী কাঁদে নীরবে নিভৃতে।
এখানে মায়ের ভালোবাসায় লুকিয়ে থাকে স্বার্থ,
এখানে সন্তান চায় মাতৃস্নেহের মুক্তি।
এখানে সবুজ নেই , এখানে চাঁদ ঢেকে যায় ধোঁয়ার ধূসররঙের আড়ালে,
এখানে পূর্ণিমার রাত কাটে মদ আর হুইস্কির গ্লাসে,
বধূ কাঁদে একলা নীরব রজনীতে।
কাঁচ ঢাকা বারান্দায় রাখা পাতাবাহার কাঁদে নীরবতার ব্যাথায়;
ভালোবাসাহীন যন্ত্রণায় তারা চেয়ে থাকে উন্মুক্ত সূর্যের দিকে,
কাঁচের আড়ালে তাও রোদ আসে ঝাপসা।
এখানে বাজে না ভোরের ভৈরবী রাগ,
কোকিল ডেকে যায় বৃথাই গাছের আড়ালে,
কেউ শোনে না তার কুহু কুহু ডাক।
এখানে সবুজ হারিয়ে গেছে, হারিয়েছে প্রকৃতির রোমান্টিকতা।
এখানে নদীর তীরে নির্জনতার অভাব,
সাজানো কফি আর আইসক্রিম পার্লারের আড়ালে মৃদু হয়ে যায় বাদামওয়ালার ডাক।
এখানে সবই নকল, প্রকৃতির রং মুছে গিয়ে গড়ে উঠছে সাজানো বাগান,
নদীর স্রোতে সাঁতার আবদ্ধ হয়ে আছে সুইমিংপুলের বদ্ধতায়।
অভিমানে প্রকৃতি তাই নিয়েছে মুখ ফিরিয়ে,
বইতে বইতে নদী হারিয়েছে মোহনা।
আলোর তীব্রতায় জোছনা লুকিয়ে পড়ে।
একা মাঝি আর গায় না গান-
” ও মোর মন মাঝি তোর মনের মানুষ কই “?
এখানে স্রোত আটকে গেছে প্লাস্টিকের পাঁকে,
শোনা যায়না তাই সেই গান আর, ” ও মাঝি রে তোর নাও খানি একবার বেয়ে আন এই ঘাটে, আমি যে বধূ একলা দাঁড়ায়ে আছি তোর লাগি, তুই একবার নাও খানা আন না এই ঘাটে। “ -
সুখের ঘরের চাবি
সুখের ঘরের চাবি
-পারমিতা চ্যাটার্জীকিছু খুঁজে বেড়াচ্ছ বন্ধু?
হ্যাঁ আমি সুখ কিনবো বলে
একটি লটারির টিকিট কিনে
এই ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিলাম
সেই ঘরের চাবিটা হারিয়ে গেছে।
সে কী! সুখের ঘরের চাবি হারিয়ে ফেললে?
তোমার পূর্বপুরুষেরাও লটারি কিনেছিলেন
সুখ কিনবেন বলে, তারা কিনেও ছিলেন;
সবই বন্ধ ছিল ওই ঘরের মধ্যে,
তুমি সেই ঘরের চাবি হারিয়ে ফেললে বন্ধু?
না না ওই চাবি আমাকে পেতেই হবে;
এতো বিষণ্ণতা আমি সহ্য করতে পারছিনা,
আমাকে সুখের ঘরের চাবিটা খুঁজে বার করতেই হবে।
কত জন্ম ধরে লটারির টিকিট কিনে কত সুখ তারা
জমা করে রেখে গেছেন ওই ঘরের মধ্যে,
এতোদিনের পুরানো চাবি হারিয়ে ফেললে
আমি কি জবাব দেবো তাঁদের কাছে?
আমাকে আবার লটারির টিকিট কিনতে হবে।
যতই লটারি কিনে যাও বন্ধু, যে সুখ হারিয়ে ফেলেছ তা আর কোনদিন খুঁজে পাবেনা-।
কেনো কেনো পাবো না?
যে মন নিয়ে তারা লটারি কিনে সুখ কিনেছিলেন
সেই মনটাই তো হারিয়ে গেছে –
তাইতো এতোদিনের পুরানো চাবিটা হারিয়ে গেলো;
আর কি তাকে খুঁজে পাবে?
হাজারটা লটারি কিনলেও টাকা হয়তো পেলেও পেতে পারো কিন্তু সুখের ঘরের চাবিটা আর ফিরে পাবেনা-।
যা হারিয়ে যায় তা হারিয়েই যায়, তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়না ;
তাইতো আমাদের রবি কবি বলে গেছেন, “যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কতো আর”।
যে সুখ হারিয়ে গেছে তা লটারির টিকিট কিনে
কোনদিন আর ফিরে আসবেনা
আর বৃথা খুঁজে বেড়িয়ো না তোমার সুখের ঘরের চাবি। -
ছলনা
ছলনা
-পারমিতা চ্যাটার্জীঅপরাজিতা নামটা তার বাবার দেওয়া। একটু বড়ো হবার পর বাবা তাকে বলেছিলেন – “মা এই নামের মানে জানতো?” মানে হচ্ছে জীবনে সর্বক্ষেত্রে তুমি অপরাজিত থাকবে।
মেয়ে একগাল হেসে বলেছিল তখন – “হ্যাঁ বাবা আমি নিশ্চয়ই থাকবো।”
ছোট্ট বেলা থেকেই অপরাজিতার নাচে খুব আগ্রহ, গান শুনলেই সে আপনমনে তাল মিলিয়ে নেচে যেত। অপরাজিতার বাবা অনুপমবাবু মেয়েকে ছোট্ট থেকেই ভালো গুরুর কাছে নাচের জন্য ভর্তি করে দেন। এই নাচ নিয়েই তার উত্থান শুরু। সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে সে নাচ শিখেছে। নৃত্য শিল্পী হিসেবে যখন বেশ নাম করেছে তখনই সে নজরে পরে বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন নামকরা পরিচালকের। অপরাজিতার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন না, থাকলে হয়তো এত বড়ো পদস্খলন তার হতোনা।
সে নাচের জগত থেকে চলে আসে ঝলমলে রূপালী পর্দায়, এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম করে ফেলে।
বয়েসের দোষে জীবনে তার প্রেম আসে আর ভেসেও যায় এক মিথ্যা প্রেমের জোয়ারে।
সেই পরিচালকই ছিলেন তার প্রেমিক যে তাকে মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমপর্ব চালিয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন সে বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে। যখন এ কথা সে তার প্রেমিককে জানিয়ে বিয়ে করার কথা বলে তখনই ভালোবাসার মুখোশটা খুলে যায়। লোকটি সম্পূর্ণ রূপে তার সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় ইণ্ডাষ্ট্রিতে রটিয়ে দেয়, ও একটা দুশ্চরিত্রা…কার না কার সাথে কি সম্পর্কে প্রেগন্যান্ট হয়েছে এখন আমাকে ফাঁসাতে চাইছে, বলে কিনা আমাকে বিয়ে করতে? আমার ঘরে স্ত্রী, পুত্র সব আছে আমি কি করতে ওকে বিয়ে করতে যাবো?
এই ঘটনা অনেকে অবিশ্বাস করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অনেকে কিন্তু বিশ্বাসও করেছিল যারা এইরকম জালে ফেঁসেছিল, কিন্তু ক্যারিয়ার ও সম্মানের ভয়ে সবাই চুপ ছিল।
কিন্তু অপরাজিতা তো হারবার মেয়ে নয়। সে এক ঝটকায় সিনেমা জগত থেকে বেরিয়ে আসে আর বাবার বাড়িতে চলে আসে একদম একলা। শুধু সাথে ছিল বাপেরবড়ির পুরানো লোক রমলামাসী। একমাত্র মেয়ে সে বাবার বাড়ি তাই পুরোটাই তার। বাবার কিছু অর্থ তার জন্য রাখা ছিল, নিজেরও কিছু উপার্জিত অর্থ ছিল। তাই সম্বল করে সে জীবন যুদ্ধে নামে। একসময়ের নৃত্য শিল্পী তার ওপর অভিনেত্রীর তকমা গায়ে লেগেছে, বাড়ির একাংশে সে যখন একটি নাচের স্কুল গড়ে তোলে তখন ছাত্রী পেতে তার অসুবিধা হয়নি। সেই ছোট্ট স্কুলটি এখন বিখ্যাত এক নৃত্য অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়েছে।
এই সবে সে টিম নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে পারফর্ম করে যথেষ্ট স্বীকৃতি অর্জন করে এসেছে। সামনের মাসে তার কলকাতার এক বিরাট হলে প্রোগ্রাম। তাই ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যাস্ত।
এদিকে তার মেয়ে তিতাস এখন ক্লাস টেনের ছাত্রী এবার সি.বি.এস.সি. পরীক্ষা দেবে, মেয়েকে ও টিউশন থেকে এনে নিজে হাতে তার প্রিয় ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাইয়ে তবে নাচের মহড়ায় এসেছে।
আজ থেকে দু’বছর আগে তিতাসকে তার জীবনের চরম সত্যটা বলে দিয়েছে। কারণ সে মনে করে সত্য কখনও ঢাকা থাকেনা, একসময় তিতাস ঠিক জানতে পারবে আর তখন তার পক্ষে মেনে নেওয়াটা আরও অনেক কঠিন হবে। তিতাস তখন সবে ক্লাস এইটে পরে, সেসময় সে জানতে চায়, “মা আমার বাবা কি আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছে?”
সে উত্তর দিয়েছিল- “তিতাস তোমার বাবা মারা যায় নি, সে একজন ক্রিমিনাল তাই তার জায়গা এখন জেলে। হ্যাঁ, সব সত্য সেদিন সে মেয়েকে বলে, এবং পরিচালক মহাশয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কেস চলে, অবশেষে ডি.এন.এ. টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তার কন্যার বাবা কে? তখন বাধ্য হয়ে তাকে স্বীকার করতে হয়- “হ্যাঁ, এই শিশুটি আমার।” এখন শুনেছে দীর্ঘ চোদ্দবছর কারাবাসে থেকে সে মুক্তি পেয়েছে।
তিতাসের বয়স এখন পনেরো।
সে তো অপরাজিতা, কোন ছোট বেলায় বাবাকে কথা দিয়েছিল, বাবা আমি কোনদিন হেরে যাবো না সেই কথা সে রেখেছে।
আজ যখন সে ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত তখন রমলা এসে তাকে বলে, “দিদি কেউ একজন তোমাকে ডাকছে।”
আমি একটু আসছি, বলে বাইরে এসে যাকে দেখল তাকে দেখার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলনা–“আচমকা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “আবার কি সুযোগ সন্ধানের জন্যে এসেছেন এখানে?”
“আমার তো অনেক শাস্তি হলো, এবার কি ক্ষমা পাবো?”
“ক্ষমা? যা করেছেন আপনি? তাতে সারাজীবন কোনো ক্ষমা হয়না। ভুলে গেছেন সেদিনের কথা, যেদিন ইণ্ডাষ্ট্রিতে একঘর লোকের সামনে আমাকে বেশ্যা বলে অপমানে জর্জরিত করে নিজের সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করেছিলেন? আমি কোনদিন তা ভুলবো না। আপনি চলে যান এখুনি, আর কোনোদিন এখানে আসার সাহস দেখাবেন না তাহলে আমি আবার পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হবো।
নিঃশব্দে উঠে চলে যাচ্ছে একসময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অম্লান রায়।
অপরাজিতা দাঁড়িয়ে দেখছে, সে চলে যাচ্ছে, তার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা, তার সন্তানের বাবা।
চোখে কি কিছু পরেছে? হবে হয়তো, না চোখের জল এটা নয়। -
অভিমান
অভিমান
-পারমিতা চ্যাটার্জীছোটবেলা থেকেই তুমি আমার হিরো ছিল রঙ্গনদা।দু’টো পাশাপাশি বাড়িতে অনেকটা এক পরিবারের মধ্যে আমাদের বড়ো হয়ে ওঠা। তুমি ছিলে অনেক মেধাবী এক ছাত্র, তুলনায় আমি ছিলাম নিতান্তই সাধারণ মানের ছাত্রী। তুমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তে, আমি তখন সিক্সের ছাত্রী। অঙ্ক ছাড়া আর সব সাবজেক্টই আমি ভালো ছিলাম। ছোট থেকেই ছিলাম সাহিত্য অনুরাগী, পড়ার বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে পাকা পাকা উপন্যাস পড়তাম। তখন থেকেই একজন উপন্যাসের নায়কের জায়গায় তোমাকে বসিয়ে আর নায়িকার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মনে মনে কল্পনার জাল বুনতাম। তুমি কখনও জানতে পারোনি আমার এই ভালোবাসার কথা। আমি তোমাকে বুঝতেও দিইনি। মনের কথা লুকিয়ে রাখার সংযম তখন থেকেই ছিল, খুব প্রবলভাবে। একদিন অঙ্কের নাম্বার কম হওয়াতে মা খুব বকছিলেন, তুমি শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে বললেকি হয়েছে কাকীমা? আমি ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি অঙ্ক। সেই থেকে তুমি আমায় অঙ্ক দেখাতে আরম্ভ করলে আর আমিও ধীরে ধীরে অঙ্কের ভয়টা কাটিয়ে উঠে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে তুমি চলে গেলে খরগপুর আই.আই.টি. তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমিও এগিয়ে চললাম একধাপ একধাপ করে। মাঝে মাঝে তুমি ছুটিতে আসতে তখন কিরকম যেন এক লজ্জা আর আড়ষ্টতায় তোমার কাছে যেতে পারতামনা- তুমি যখন আসতে বলতে যে কি রে? পরীক্ষা তো এসে যাচ্ছে, অঙ্কটা মন দিয়ে করিস কিন্তু। আমি প্রথমবিভাগে পাশ করা সত্বেও আর্টস নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি তখন পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছ। আমার দিকে চেয়ে অবজ্ঞার চোখে বললে- ফাস্ট ডিভিশন পেয়েও আর্টস নিলি কেন?
আমি বললাম- আমি যে সাহিত্য খুব ভালোবাসি। তুমি ঠোঁট উল্টে বললে, দূর তোর দ্বারা কিচ্ছু হবেনা।আমি নিরুত্তর থাকলাম। শুধু আমার এতোদিনের সাজানো ভালোবাসার রঙটায় যেন বেরঙা তুলির টান পড়তে লাগলো।
আমার সংযম আমার রুচি, আমার সম্মান তোমার কাছে একবারের জন্যেও ছোট করবোনা। এই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা। শুধু যেদিন তুমি চলে গেলে আর আমায় একবারের জন্যেও বলে গেলেনা। সেদিন সবার অলক্ষ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
কানাঘুষোয় খবর পেলাম, তোমার কোন এক সহকর্মীকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করতে চাইছো। এ নিয়ে তোমার সাথে কাকু কাকীমার মতান্তর চলছে।
তারপর একদিন আবার শুনলাম তোমার সহকর্মীনির সাথে তোমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তুমি নাকি আমাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি হয়েছো। দুই পরিবার কখন যে নিজেদের মধ্যে এরকম কথাবার্তা স্থির করে রেখেছে তা তুমি জানলেও আমার কাছে পুরোটাই অজানা ছিল।
আমি তখন পি.এইচ.ডি. করছি আর একটা কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছি।
কাকীমা যখন আমাকে এসে বললেন রঙ্গন তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তখন আমার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। সবকিছু নীরবে মেনে নিতে নিতে আমিও ক্লান্ত।
আমিও আর সংযমের বাঁধকে বেঁধে রাখতে পারলামনা। কাকীমাকে বললাম- তুমি তো আমায় মেয়ের মতো ভালোবাসো? তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো? তোমার মেয়ের সাথে যদি এমনটা হতো তুমি কি করতে? সব মতামত শুধু তোমার ছেলেই দেবে? কখনও প্রত্যাখ্যান, কখনও দয়া করে বিয়ে করতে চাওয়া… আমার কি সম্মান বলে কিছু নেই? আমি কি এতটাই ফেলনা যে কারুর দয়ার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে? আমাকে ক্ষমা কর কাকীমা, এ বিয়ে আমি করতে পারবনা।
তারপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, তোমার কোন খবর রাখিনি। নিজে এখন একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপক। কিন্তু বিয়েও করিনি, মনে মনে যে সেই ছোট্ট থেকে তোমাকে বরের আসনে বসিয়ে রেখেছিলাম। সে যতই বেরঙা হয়ে যাক, তবু তাকে ফেলে দিতে পারিনি।
হঠাৎ বদলির অর্ডার এলো। মালদায় কলেজে যেতে হবে আমাকে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে বহু পুরাতন মাসী রমলামাসীকে নিয়ে রওনা হয়ে পরলাম মালদার উদ্দেশ্যে।
ওখানে যে আমার জন্য এমন চমক অপেক্ষা করছে তা কি করে জানব?
মালদায় পৌঁছে যখন কাজের ভার বুঝে নেওয়ায় জন্য ডাইরেক্টরের ঘরে ঢুকলাম, দেখি তুমিও একজন ডাইরেক্টর। আমি আমার চমকে যাওয়ায় ভাবটাকে দমন করে কাজ বুঝে নিয়ে সেদিনের মতো সরকারি কোয়ার্টারে ফিরে এলাম।
কোয়ার্টারগুলো ভারী সুন্দর দিয়েছে। সামনে পিছনে সুন্দর বাগান। নানান রঙের ফুল ফুটে আছে, দিনের প্রায় শেষ তখন ক্লান্ত হয়ে বসে এককাপ চা নিয়ে ভাবছিলাম, কি প্রহসন? সেই তোমার আণ্ডারেই আসতে হল।
হঠাৎ গেট খুলবার শব্দে চমকে তাকালাম, দেখলাম গেট খুলে তুমি ঢুকছো। আমায় খুব স্বাভাবিক গলায় বললে- আমায় চা দিবিনা?
আমি তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে বললাম- মাসী একটু চা দিয়ে যাও না বাইরে।
তারপর বললে- রাতে কি খাবি?
বললাম- বাজার তো চিনিনা। তাই আজ মাসী বললো- চাল, ডাল একটু নিয়ে এসেছিলাম তাই একটু ফুটিয়ে নেবো।
-ও সব ঠিক করে ফেলেছিস তাহলে?
-আমি আজ রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-কোথা থেকে পাঠাবে?
-আমার কোয়ার্টার থেকে, অবশ্য আমার কোয়ার্টার খুব দূরে নয়। আমার রান্নার ছেলেটা বেশ ভালোই রাঁধে।তুই চাইলে ওখানে গিয়েও খেতে পারিস।
আমতা আমতা করে বললাম- তোমার ফ্যামেলি?
– ফ্যামেলি আর হল কোথায়?
– মানে?
– একজনের জন্য অপেক্ষা করছি এখনও..যদি সে কখনও রাজি হয় তবেই।
আমি বললাম- ও আচ্ছা..
– তুই এখনও একা কেন?
– আমার কথা বাদ দাও?
– এখনও অভিমান?
– কিসের অভিমান?
– আমার ওপর প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছিস আমায় প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু আমি জানতাম তোর ওই প্রত্যাখ্যান ছিল গভীর অভিমান থেকে। তোর মতো নীরবে যে এতবছর ধরে অপমান সহ্য করেও নিজেকে একা করে রেখে দেয়, কাউকে আসতে দেয়না সেই ভালোবাসার জায়গায়…এমন সংযমী গভীর ভালোবাসা আমি আর কোথায় পাবো রে? এখনও কি বলতে হবে আমার অপেক্ষা কার জন্য?
– আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা – দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর তুমি কাছে এসে দু’হাতে আমার মুখটা তুলে ধরে বললে- আর কত কাঁদবে তিথি? এবার তো একটু হাসো।
পূর্ণিমার চাঁদটাও সেদিন আকাশে যেন খুব জ্বলজ্বলে, জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে ”আমরা হাত ধরলাম দু’জনে দু’জনের ।