-
গল্প- বনলতা
বনলতা
-পারমিতা চ্যাটার্জীহসপিটালে যাবে বলে সবে অরিত্র ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে একটা টোস্টে কামড় বসিয়েছে, এমন সময় মা হঠাৎ রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মায়ের ওরকম অগ্নিমূর্তির দিকে চেয়ে, অরিত্র বলল,”কি হয়েছে মা! প্রেশারটা আবার বাড়লো না কি! কিরকম যেন লাগছে তোমাকে?”
মা সেরকমই ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিলেন, “এক সপ্তাহ কেটে গেলো, আমরা মেয়েটাকে দেখে এলাম, এখনও তোমার কোনো সদুত্তর পেলামনা, প্রেশারের আর দোষ কি! আজও ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না, উনি বললেন, ওঁর মেয়ে খুব অপমানিত বোধ করছে, বারবার আমি ফোন করছি বলি, আসলে আমাদের আপনাদের পরিবারটাকে খুব ভালো লেগেছে তাই মেয়ে বেরিয়ে যেতে ফোন করলাম, একটা কিছু বলে দিন, আমি বলেছি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত দিদি, আমি আজই আপনাকে জানিয়ে দেবো, অন্তত মেয়েটার সাথে একবার কথা বলে তো দেখ।”
অরিত্র বুঝতে পারলো, যে কোনো মেয়ের পক্ষেই এটা খুব অসম্মানের, তাছাড়া যে মেয়েটিকে তারা দেখে এসেছে সে ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করে এম.ফিল করছে, দেখতেও অত্যন্ত সুশ্রী কিন্তু সে যা খুঁজছে তাতো নেই, তা কোনদিনও পাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে? একটু সময় নিয়ে বললো, “ঠিক আছে ওঁদের মেয়েকে বলে দাও একটা সময় দিতে, আমরা একটু কথা বলে নিতে চাই, যেদিন যেখানে বলবে আমি সেইমতন সময় অ্যডজাস্ট করে নেবো।”
উফ্ এই কথাটা বলতে তুই একসপ্তাহ লাগিয়ে দিলি! নে খেয়ে নে এবার।
অরিত্র দেখলো মুহূর্তে তার মায়ের গলার স্বর একদম বদলে গেলো, মনে মনে হাসিও পেলো।
খেয়ে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবলো, কি যেন মেয়েটার নাম ছিলো! ও মনে পড়েছে, ওর নাম ছিলো তিস্তা, হ্যাঁ তিস্তার মতই চঞ্চল সে, খুব সপ্রতিভ কিন্তু তার মন যে দখল করে বসে আছে সেই শান্ত স্নিগ্ধ কালো চোখের মেয়েটি, যার নাম বনলতা, ঠিক যেন জীবনান্দ দাসের বনলতা।
বনলতা তার পেশেন্ট হয়ে এসেছিল, তার স্বামী তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো, তার চিকিৎসা করতে করতে অজান্তে কখন যে তার মনটাকে সাথে করে নিয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি। সে জানেও না বনলতা এখন কেমন আছে! তার আর কোনো সন্তান হলো কি না! কিছুই জানেনা।
বনলতার প্রথম সন্তান জন্ম দেবার সময় থেকেই সে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল,
কারণ তার স্বামী তখন আমেরিকায় চলে গিয়েছিল তার কোনো এক কলিগকে সাথে নিয়ে।
বনলতা সন্তানসম্ভবা খবর পেয়েও সে কোনরকম খোঁজ খবর করেনি, এসেছিল একদম শেষ মুহূর্তে, বনলতার তখন জ্ঞান ছিলো না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, তারপর বনলতার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে একটা সই করতে হবে, সে কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, বনলতার প্রেশার খুব হাই এবং ই.সি.জি. রিপোর্ট বলছে হার্টের কন্ডিশন ও ভালো নয়। এমত অবস্থায় দু’জনকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব, তবু্ও আমরা চেষ্টা করবো।
বনলতার স্বামী মৃগাঙ্ক বলেছিল, “ডাক্তার আপনারা দেখবেন আমার স্ত্রীর যেন কোন ক্ষতি না হয়, ওর জীবনটা যেন বাঁচে।”
বনলতা একটা একটা করে দিন গুণ ছিল সন্তানের মুখ দেখবে বলে, সে যখন জানতে পারলো যে তার সন্তানকে বাঁচানো যায়নি তখন সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। খাওয়া পুরো বন্ধ করে দিল, কারুর সাথে কথা বলতো না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো শুধু। স্বামী বহু চেষ্টা করেও তাকে এক চামচ স্যুপ খাওয়াতে পারেনি, তখন তার ওপর ভার পরে বনলতকে সুস্থ করে তোলার।
তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, বনলতা সুস্থ হয়ে যেদিন স্বামীর হাত ধরে বাড়ি চলে যাচ্ছিল সে সেদিন তার চেম্বারের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, হঠাৎ দেখলো বনলতা পেছন ফিরে তাকিয়ে তার দিকে চলে যাচ্ছে আসতে আসতে কম্পাউন্ড পার হয়ে। যতদূর দেখা যায় দু’জন দু’জনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলো।
বনলতার সেই দৃষ্টির ভাষা সেদিন সে পড়তে পেরেছিল।
মনে মনে একটা গোপন আশাও পোষণ করে রেখেছিল হয়তো কখনও কোন একদিন সে আসবে! না বনলতা আর আসেনি। সে হয়তে সুখেই আছে তার কথা ভেবে এখন সে বর্তমানকে নষ্ট করতে পারেনা।
যে আসছে তার জীবনে, সে বনলতা নয়, সে তিস্তা , তিস্তাকে তিস্তার মতো করেই গ্রহণ করতে হবে, তারমধ্যে বনলতাকে খুঁজলে চলবে না।
দু’ একদিনের মধ্যে অরিত্রর মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো, অরিত্র কোনো পেশেন্টের ফোন ভেবে বেশ ভারিক্কি চালে ফোনটা ধরে উত্তর দিল, “ইয়েস ডাঃ অরিত্র ইজ স্পিকিং”
ওপার থেকে কলকল করে মহিলা শব্দের হাসির শব্দ ভেসে এলো, তারপর হাসি সামলে বললো, “আপনি তো আচ্ছা মশাই, ফোন করতে বললেন, আর চিনতেই পারছেন না! “
মুহূর্তের মধ্যে অরিত্রর শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো, বুঝতে পারার পর সেও সহাস্যে উত্তর দিল, “ও বুঝেছি, মনে হচ্ছে তিস্তা নদী, কিন্তু নদী তো খুব শান্ত হয়, কিন্তু আপনি যেভাবে নির্ঝরিণী ঝর্ণার মতন হাসি ছড়ালেন, তাতে আপনার নাম কোনো ঝর্ণার নামে হওয়া উচিৎ ছিলো”
ওপার থেকে আবার সেই কলকল শব্দ বেজে উঠলো, “আপনি তো খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন! আমার তো ধারণা ছিলো ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয়।”
ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয় এ অভিযোগ কিন্তু সত্য নয়, অনেক ডাক্তার সাহিত্য ও সংগীত চর্চাও করে থাকেন। তাছাড়া আমি কিন্তু মনের ডাক্তার, “দেখবেন আমি কিন্তু আপনার পেশেন্ট নই, আমার আবার মনের চিকিৎসা করতে যাবেন না যেন, আমি একদম সুস্থ মনের মেয়ে”
“হুম, সে তো বুঝতেই পারছি, তা বলুন কবে মহাশয়ার দেখা পাবো?”
“দেখা পাবার জন্য খুব উদগ্রীব বুঝি?”
“খুব না হলেও একটু উদগ্রীব তো বটেই”
“তাহলে তো আপনার নিজের মনের চিকিৎসাটা আগে করতে হয়”
“মানে!”
“মানে যাকে দেখার জন্য উদগ্রীব তাকে এই কথাটা বলার জন্য একসপ্তাহ সময় নিয়ে নিলেন”
‘না, এতোদিন ঠিক উদগ্রীব ছিলাম না। তবে আপনার সাথে কথা বলার পর হলাম”
“ও তাই বুঝি?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই, এবার বলুন কোথায় কবে দর্শন পাবো?”
“খুব তাড়া মনে হচ্ছে?”
“আরে বাইরে পেশেন্টরা ওয়েট করে আছে..”
“ও সরি সরি, কোথায় করা যায় বলুন তো?”
“আপনি যখন তিস্তা তখন গঙ্গার ধারে দেখা করাই ভালো, মানে আউটরমঘাট”
“গ্রেট আইডিয়া, তাহলে এই রবিবার আউটরমে এই সন্ধ্যা ছটা নাগাদ, আপনার অসুবিধা নেই তো?
“না না ঠিক আছে, রবিবার তো অফ ডে” “একদম ঠিক আছে, তাহলে এবার রাখি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, টা টা”
“হ্যাঁ টা টা”
ফোনটা রেখে দিয়ে অরিত্রর মনে একটা শিহরণ বয়ে গেলো, না মেয়েটা খুব সপ্রতিভ, দেখি কথা বলে, বিয়ে তো করতেই হবে। যাকে সে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছে, সে তো কোনদিনই তার হবেনা, তাই এই বন্ধন থেকে তাকেও মুক্ত হয়ে আসতে হবে।বনলতা এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, মৃগাঙ্ক অফিস যাবে তার খাবার দাবার গোছাতে রান্নাঘরে তাড়াতাড়ি মাছের ঝোলটা বানাচ্ছে, টিফিনের জন্য ফল কাটছে, স্যান্ডউইচ তৈরি করছে, এই তাড়াহুড়োর সময় আবার মৃগাঙ্কর ডাক দিলো তাকে ঘরে, সবই তো হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে এসেছে, আবার ডাকছে কেন কে জানে! সে আবার মা হতে চলেছে, মৃগাঙ্কর আদর ও যত্নে মাঝে মাঝে সে যেন
হাঁপিয়ে ওঠে। সবই করে যায় কিন্তু মনের কোণে প্রথম জীবনের সেই অপমানটা থেকেই গেছে। মৃগাঙ্ক হাজার চেষ্টা করেও তাকে ভাঙতে পারেনি।
ঘরে ঢুকতেই মৃগাঙ্ক তাকে কাছে টেনে নিলো, বনলতা অস্বস্তিতে পরে গেলো, “আরে কি করছো? রান্নাঘরে রান্নার মাসি আছেনা? “
“থাক তাতে আমার কি! সারাদিনের জন্য অফিস যাচ্ছি, এইসময়টা একটু কাছে থাকতে পারোনা?”
“তোমার রান্না টিফিন এগুলো তো সব দেখে দিতে হবে”
“হ্যাঁ, নিজের খাবারটা খেয়েছো তো?”
“হ্যাঁ, খেয়েছি”
“কি খেলে? দু’টো টোস্ট তাই না? চল আমার সাথে বসে এখন একটা ডিম সিদ্ধ খাবে”
“ওরে বাবা এখন আমি পারব না”
“পারব না বললে হবে? তুমি তো জানো এখন তোমার খাওয়ার কত প্রয়োজন? জানি আমি তোমার মনে জায়গা করতে এখনও পারিনি, হয়তো একদিন পারবো, আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু যে আসছে তার কথা ভেবে একটু খাও।’
বনলতার কোমল মনে মৃগাঙ্কর কথাগুলো খুব করুণ শোনালো, সে এগিয়ে এসে স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো, “কে বললো জায়গা করতে পারোনি?”
“সত্যি পেরেছি? মৃগাঙ্ক ওকে সবলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অজস্র আদরের চিহ্ন দিয়ে গেলো ওর কপালে, বুকে, গলায় চিবুকে, নিজের অজান্তেই যেনো বনলতা স্বামীর আদরে আজ শিহরিত হল,
খুব ভালো লাগলো তার, হাত ধরে বলল-“চল খাবে চল।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিবার আউটরমে তিস্তা আর অরিত্র একটা খুব আনন্দময় সন্ধ্যা কাটালো। দু’জনেই দু’জনের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো আর সিদ্ধান্ত নিলো তারা একসাথে পথ চলতে পারবে।
তিস্তা সত্যি একটা আনন্দের গতি সে মানুষকে বিস্বাদ থেকে নিমেষেই খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারে।
বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলো, একমাস বাকি।
এরমধ্যে দু’জনে মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতে লাগলো আর ফোনে তো রোজ রাতে প্রায় একঘন্টা ধরে কথা বলে যায়। প্রধান বক্তা তিস্তাই তার ঝরঝরে ঝর্ণার মতন অজস্র কথা অরিত্রর মনকে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শুধু মনের মধ্যে রাখা সেই ছবিটা যখন মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, অরিত্র নিজেই নিজেকে বলে, “কেন ভুলতে পারিনা তোমায়, কেন তোমার শান্ত দিঘির মতন চোখের দৃষ্টি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, মনটাকে এলোমেলো করে দেয়, যেখানেই থাকো, শুধু ভালে থেকো, তোমায় না ভুলেই আর একজনকে ডেকে এনেছি মনে, তাকেও ভালোবেসেছি, শুধু তুমি থেকে যাবে আমার নিভৃত মনের এককোণে একটা ছোট্ট জায়গা দখল করে, তাই থাকো আর কিছু তো করার নেই আমার”
মৃগাঙ্ক অফিস বেরিয়ে যাবার পর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে, বনলতা আনমনা হয়ে জানলা ধরে দাঁড়ায়, আজ মৃগাঙ্কর আদর তার মনকে স্পর্শ করেছে, মানুষ তো ভুল করেই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো সে আপ্রাণ করছে, তার এই প্রচেষ্টােকে সে সম্মান জানাবে। মৃগাঙ্কর সন্তানের সে মা হতে চলেছে, আগের সন্তান ছেলে ছিলো, যাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। এবার মৃগাঙ্ক বলেছে, “আমি তোমার মতন শান্ত স্নিগ্ধ মিষ্টি একটা বনলতা চাই।” জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার চলে আসার সময় অরিত্রর নির্নিমেষ দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে ছিলো অনেক না বলা কথা, তারও তো ছিলো অনেক কথা, কেউ কাউকে কিছু বলতে পারেনি, শুধু নীরব সুন্দর একটা অনুভূতি তার মনে এসে বারবার মনটাকে দখল করে বসে। হয়তো অরিত্র এতদিনে বিয়ে করে নিজস্ব সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, এরকম কত পেশেন্টই তো তার কাছে যাওয়া আসা করে, কে আর মনে রাখে বনলতা নামে কোন এক বিশেষ পেশেন্টের মনের না বলা অনুভূতির কথা!
তিস্তা আর অরিত্রর বিয়ের দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলো। সুখী দম্পতি বলতে যা বোঝায় ওরা তাই। ওদের মাঝখানে এখন এক ছোট্ট অরিত্র এসেছে, যার নাম তিস্তা দিয়েছে অভিজয়।
তবু মাঝেমধ্যে যখন রিমঝিম বৃষ্টিতে অরিত্রর ঘুম ভেঙে যায়, মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি, নিজের মনেই কবিতা বলে, “যেতে যেতে কেন তাকালে ফিরে, কি বলতে চেয়েছিলে সেদিন, না বলেই গেলে চলে।”
তিস্তার স্পর্শে তার চেতনা ভাঙে, নিজের মনের ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিস্তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কাজের ভিড়ে তোমাদের তেমন করে সময় দিতে পারিনা, চল একটু পাহাড়ের দিকে বেড়িয়ে আসি।”
তিস্তা তো এককথায় রাজি, বলে “তুমি ব্যাবস্থা কর আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”
মৃগাঙ্ক সেদিন অফিস থেকে ফিরে বনলতাকে কাছে টেনে বলে, “আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, বনলতার অবাক মুখের দিকে চেয়ে অরিত্র বলে, বেড়াতে যাবো আমরা সিকিমের দিকে, তোমার পছন্দ তো?” ছেলে মানুষের মতন ঘাড় দুলিয়ে তিস্তা বলে, “হ্যাঁ, খুব পছন্দ, কবে যাবো?”
“সামনের রোববার রওনা হব। তোমাদের গরমজামা সব ঠিকঠাক আছে তো? না হলে চল তোমার আর কথার কিছু গরমজামা কিনে নিই”
“না আমার সব আছে, কথার জন্য কিছু নিতে হবে।” কথা ওদের সন্তান, চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে, পুরো নাম কথাকলি।
বেরিয়ে পরে ওরা সিকিমের উদ্দেশ্যে।
সিকিমে খুব আনন্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃগাঙ্ক, বনলতা আর ছোট্ট কথাকলি। অনর্গল কথা বলে যায় বলে ওর নাম দেওয়া হয়েছে কথাকলি। ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে ওর বাবা মা।
মৃগাঙ্ক অনেকদিন পর বনলতাকে এতো হাসতে দেখে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “তোমার ভালো লাগছে তো বনো? “
বনলতা চোখ বুৃৃঁজে উত্তর দিল, “ভীষণ ভালো লাগছে”
“তাহলে, একটা…”
“এই মেয়ে আছে না!”
“ও তো এগিয়ে গেছে,” এই বলে আর দেরি না করে মৃগাঙ্ক একটা গাঢ় চুম্বন দেয় বনলতার ঠোঁটে।
যথারীতি কথা দেখে ফেলে আর বলে, “এ বাবা তুমি আমার মতন মাম্মাকেও কিসি দাও?”
অপ্রস্তুত মৃগাঙ্ক তাড়াতাড়ি বলে, “না না তোমার মাম্মার ঠেঁটটা একটু লেগেছিল তাই দেখছিলাম “
বনলতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “দেখলে তো?”
“তা কি করবো বলো, এমন রোমান্টিক জায়গায় একটু রোমান্স করবনা! তা কি হয়?”
অরিত্র ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে, আকাশটা পুরো হলুদ আর কমলা রঙে মেশানো এক অদ্ভুত সুন্দর রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে তিরতির করে এক নাম না চঞ্চল ঝর্ণা। তিস্তা সেদিন হলুদ আর কমলা মেশানো এক সুন্দর পোশাক পড়েছে, ভারি সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।
অরিত্র একহাতে তিস্তাকে গভীর আবেগে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আকাশটাও আজ তোমার রঙে সেজেছ” তিস্তা বললো, “তুমি একটু ভুল বললে, আমি আকাশের রঙে সেজেছি “।
অরিত্র বললো “আর ঝর্ণাটাকে দেখো তোমার মতন চঞ্চল গতিতে তিরতির করে নেমে আসছে,” তিস্তা হেসে অরিত্রকেও তার হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
দূর থেকে মৃগাঙ্ক দেখলো তাদের মতন এক দম্পতি সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে সেই অপরূপ দৃশ্যের রস গ্রহণ করছে।
মৃগাঙ্ক বনলতাকে বললো, দেখতো ওরা কেমন ছেলে নিয়েও দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আছে”
বনলতা বললো, “ওদের ছেলেটা আর একটু ছোটো, আর তোমার মেয়ের মতন হয়তো বিশ্বপাকা নয়”
“তা বলে এমন রোমান্টিক জায়গায় তোমাকে একটু আদর করবো না! আর তুমি তো কখনোই ওর মতন আমাকে জড়িয়ে ধরবেনা !”
বনলতা এগিয়ে এসে মৃগাঙ্কর কোমর জড়িয়ে ধরলো, “মৃগাঙ্ক অভিমান করে বললো, থাক জোর করে করতে হবে না”
বনলতা মৃগাঙ্ককে বললো, “তোমার কানটা একটু আমার কাছে নামিয়ে আনো”
“কেন কান ধরবে না কি?”
“আরে একটু নামাও না”
মৃগাঙ্ক কান নামিয়ে আনতেই বনলতা ওর কানে একটা কুটুস করে কামড় দিয়ে বলল, “রাত এখনও অনেক বাকি “
এবার মৃগাঙ্কর মুখ হাসিতে ভরে গিয়ে বনলতাকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে বললো, “না আমার বউটা দেখছি সত্যি খুব রোমান্টিক।”
হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রায় যখন ওদের কাছে এসে পড়েছে তখন মৃগাঙ্ক বলল, ” আরে দাঁড়াও দাঁড়াও এতো দেখছি ডাঃ অরিত্র সেন, যার চিকিৎসায় তুমি ভালো হয়েছিলে”
বনলতা একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো, তারপর বললো, “থাক ওদের আর বিরক্ত করো না, ওরা এখন নিজেদের মধ্যে একটু আনন্দ করছে, ছেড়ে দাও”
“কেন বনো, কতদিন পর দেখা হলো একবার কথা বলবেনা? আমি জানি চিকিৎসার সময় তোমরা দু’জন দু’জনের প্রতি দুর্বল হয়েছিলে, হয়তো কেউ কাউকে কিছু বলতে পারোনি, কিন্তু তোমার মনের কোণে এখনও ওর জন্য একটু জায়গা আছে তা আমি বুঝতে পারি, কথা বলো না একবার, কি এমন ক্ষতি হবে তাতে? আমি জানি তুমি এখন আমাকেই ভালোবাসো, তবু কারুর জন্যে যদি একটু জায়গা থাকে, তাতে তো কোন অপরাধ নেই’
বনলতা আরও কাছে এসে স্বামীকে সব ভুলে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললো, “তুমি এতো উদার, আজ আমি এক নতুন তোমাকে আবিস্কার করলাম, এতদিন হয়তো ছিলো, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তা মিলিয়ে গেলো।”
মৃগাঙ্ক অরিত্রর কাছে এসে বললো, “একটু বিরক্ত করলাম,”
অরিত্র ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, ওর চোখ চলে নিজের অজান্তেই বনলতার দিকে!
মৃগাঙ্ক আবারও বললো,”চিনতে পারছেন? আমার স্ত্রী বনলতা দীর্ঘদিন আপনার চিকিৎসায় থেকে সুস্থ হয়েছে, তাই আপনার কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ।”
হেসে অরিত্র বলল, “না না এতে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই, এতো আমার কাজ – আলাপ করিয়ে দিই – আমার স্ত্রী তিস্তা আর আমাদের ছেলে অভিজয়।”
পরস্পর ভদ্রতা বিনিময়ের পরে মৃগাঙ্কই বললো, “চলুন না এতোকাল পর যখন দেখাই হলো তখন একটু বসে চা খাওয়া যাক..”
তিস্তা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো – “হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, অনেকক্ষণ থেকেই মনটা চা চা করছিল, চলুন যাওয়া যাক।” তারপর কথার দিকে চেয়ে বললো – “এই বুঝি আপনাদের মেয়ে! কি নাম তোমার ?”
কথা তরতর করে বলে গেলো, “আমি তো ভীষণ কথা বলি তাই মা আমার নাম কথাকলি রেখেছে”।
কিছু দূর এগিয়ে একটা গুমটি মতন চা খাওয়ার স্টল সাথে সিঙারাও ভাজা হচ্ছে, আবার মোমো আছে।
ওরা সবাই চা সিঙারা খেতে খেতে গল্পে মশগুল হয়ে গেলো, বাচ্চাদের মোমো দেওয়া হলো।
চা খাওয়ার শেষে মৃগাঙ্ক তিস্তার সাথে কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের নিয়ে যেন ইচ্ছে করেই একটু এগিয়ে গেলো, পেছনে আসতে আসতে হাঁটতে লাগলো অরিত্র আর বনলতা।
ভেবে পারছিলনা কি কথা বলবে- শেষে অরিত্র বললো- “এখন সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছে, তবে অনেকদিন পর্যন্ত সব পাওয়ার মধ্যে একটা নীরব দৃষ্টি আমার মনে ভেসে উঠতো, যে দৃষ্টি যেন কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলতে পারেনি।
আর আপনার?”
“আমারও একটা শান্ত স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি মনের আয়নায় উঁকি দিতো, যে যাবার সময় ফিরে তাকালো কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেলো।
এখন তো আমরা দু’জনেই খুশি সংসারের আবর্তনে! কি তাইতো?”
“হ্যাঁ, মৃগাঙ্কর উদারতা আর অকৃত্রিম প্রেম আমায় ভরিয়ে দিয়েছে তবু মনের একটা ছোট্ট জায়গা একজনের দৃষ্টিটা রয়ে গেছে, থাকনা যেমন আছে, জোর করে তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করিনা বরং সযত্নে রেখে দিই।”
অরিত্র পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বনলতার দিকে তাকালো, তারপর বললো- তিস্তার খরস্রোতা ভালোবাসায় আমিও ভেসে যাই। তবু আমারও মাঝে মাঝে শ্রাবণের অঝোরে বৃষ্টি ধারার সাথে ফিরে আসে সেই শান্ত স্নিগ্ধ মুখটা যাকে চেষ্টা করেও ভোলা যায়না। আমারও মনে হয়, থাকনা মনের স্মৃতি কোঠায় একটা ছোট্ট স্মৃতি।”
আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এলো। যে যার পথে চলে গেলো অতীতকে পিছনে ফেলে বর্তমানের হাত ধরে।
সে রাতে অনেকক্ষণ অরিত্র যেন ইচ্ছে করেই তিস্তার সাথে রোমান্টিক মুহূর্ত কাটালো, হয়তো কিছু ভোলার জন্য, কিন্তু একথাও স্বীকার না করে পারলোনা যে তিস্তাকে সে খুউব ভালোবাসে।
মৃগাঙ্কর বাহুবন্ধনে বনলতাও আজ নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিল, সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলো মৃগাঙ্কর ভালোবাসা। আজ তারও মনে হলো একদিন মৃগাঙ্ক যত ভুলই করুক না কেন আজ সে বনলতাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেয়।
তিস্তা আর অভিজয় ঘুমিয়ে পড়ার পর অরিত্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো- একটু পরে ঘরে গিয়ে নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত ডায়েরিটা নিয়ে এসে একটা কবিতা লিখলো–
“তোমার আমার পথ গেছে বেঁকে
ভালোবাসা তবুও গেছে থেকে
জীবনের কোনো এক অজানা অদৃশ্য বাঁকে।
যেতে যেতে ফিরে একবার তাকালে,
কিছু না বলেই গেলে চলে।” -
সন্দেহবাতিক
সন্দেহবাতিক
-পারমিতা চ্যাটার্জীসুমনার আজ একটু দেরী হল অফিস থেকে ফিরতে। অটো থেকে নামার পর তার বাড়িতে যেতে আরও মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। ও এই পথটুকু হেঁটেই যায় রোজ। যাবার পথে একটা বড়ো সবজির আর ফলের দোকান আছে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সবজি আর ফল রোজ কিনে নিয়ে যায়। সকালে উঠে স্বামী অম্লান যেদিন লাগে মাছ চিকেন বা ডিম কিনে দেয়। ছেলে পিকু ডিম আর চিকেন ভালোবাসে মাছটা কিছুতেই খেতে চায়না। তাও রাতের খাওয়ারটা সুমনা রোজ নিজেই ওকে গল্প করে খাওয়ায়। তখন মাছ জোর করে খাইয়ে দেয়। আজ হয়তো পিকু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। রাতের খাওয়ারটা ও কিছুতেই কাজের মেয়ে শিপ্রার কাছে খেতে চায়না। অম্লানও অসন্তোষ প্রকাশ করে দেরি হলে, আর শাশুড়িমা অত কিছু বলেন না তিনি ভালোমানুষ নির্বিবাদী। বরং ছেলেকে বলেন- আগে মেয়েটাকে একটু জিরোতে দে তারপর না হয় জিজ্ঞেস করিস।
অম্লানের সবই ভালো কিন্তু দেরি হলেই কপাল কুঁচকে যায়। নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে- কেন দেরি হল?
– কাজ ছিল
– দেখো আমায় কাজ দেখিওনা
– তোমার অফিসে কি কাজের জন্য দেরি কখনও হয় না? আর তোমার এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
-আলবাত বাধ্য। কে পৌঁছে দিল অফিসের বস?
সেদিন সুমনা রাগের মাথায় বলে ফেলেছিল, দেখ নোংরামি কোর না। ছেলে বড়ো হচ্ছে। এখন অনেক সংযত হওয়ার প্রয়োজন।
-কিসের সংযত? মা অফিসের বসের সাথে নোংরামি করে বাড়ি ফিরবে, সেটা ছেলেরও জানার দরকার। সুমনা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, মুরোদ আছে একার রোজগারে সংসার চালানো? আর একবার যদি এধরনের নোংরা কথা বল..এগিয়ে এসেছিল সুমন কঠিন ভাবে। তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে সজোরে গালে চড় মারতে মারতে বলছে, মুরোদ দেখাচ্ছ আমায় তুমি মুরোদ দেখাচ্ছ? আমিও দেখছি তোমার কত সাহস বেড়েছে? বলে পায়ের চটি খুলতে যাচ্ছিল। ভয়ে সুমনার মুখ নীল হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় অম্লানের মা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কত জন্ম পাপ করলে যে তোর মত সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাই ভাবি, এক সন্তান তাও নুনে পোড়া।
এমনিতে অম্লান সুমনাকে যে অনাদর করে তা নয়।বাড়ির সব জিনিস সুমনার পছন্দে কেনে। কোনো একটা মুখ থেকে বার করলেই সেটা সাধ্যের অতিরিক্ত দাম দিয়ে হলেও ঠিক নিয়ে আসে। প্রতিদিন অফিস ফেরত সুমনার পছন্দের খাবার নিয়ে ঢোকে। বেশির ভাগ দিনই সুমনাই আগে ফেরে এক একদিন দেরি হয়ে যায়। তখনই ওর পাগলামো শুরু হয়। সন্দেহ করা.. সুমনার মনে হয় তখন ওর এটা একটা অসুখ। তাকেই দায়িত্ব নিয়ে এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
সুমনা ঝগড়ার সময় অনেকবার বলেছে, স্ত্রীকে বিশ্বাস করতে না পারাটা স্ত্রীকে অসম্মান করা, অপমান করা, আমি কেন দিনের পর দিন তোমার এই অসম্মান অপমান মেনে নেব? আমি এবার ডিভোর্স নেব।
অম্লান বলেছে, ডিভোর্স নেবে? আমি ছেলে দেবো না। সে কোর্ট ডিসাইড করবে তুমি বলার কে?
সেদিন মারধোরের পর সুমনা শাশুড়ির কাছে ঘুমায় পিকুকে নিয়ে। অম্লানের সাথে কথাবার্তা একেবারে বন্ধ। অম্লান অনেকবার চেষ্টা করেছে সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার কিন্তু সুমনার কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। কাল ওর খুব জ্বর ছিল। আজ অফিসেও যায়নি। সুমনা ডাক্তার ডেকেছে। ওষুধ এনে দিয়েছে। সকালের খাবারের জন্য স্যুপ বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু নিজে কাছে যায়নি। অম্লান রাগ দেখিয়ে খাবার খায়নি। সুমনা নির্বিকার, ও নিজে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে এসেছে।শাশুড়ি বললেন, তুই যা আমি দেখে নেব।
আজ সুমনা অবাক হয়ে গেল। তার এতোটা দেরি হয়েছে অথচ অম্লান একবারও তাকে ফোন করেনি! কি হল? জ্বরটা বেশি বাড়েনি তো? আজকাল খুব ডেঙ্গু হচ্ছে এদিকে। যদিও তার সবরকম টেস্ট হয়েছে কিন্তু রিপোর্ট এসেছে কিনা জানে না। তাছাড়া কেই বা রিপোর্ট আনাবে? কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। ভাবলঝ একবার ক্লিনিকে গিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে নেবে। কিন্তু এতো রাতে তো ক্লিনিক খোলাও থাকবেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা অন করে অম্লানকে ফোন করতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তার মনে হল পিছন থেকে কে এসে যেন তার মুখটা চেপে ধরেছে। সে কথা বলতে পারছেনা। তারা তাকে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে অম্লানের ফোনটা বেজে গিয়ে ওপার থেকে অম্লানের আকুল গলা শোনা যাচ্ছে, কি হল ফোন করলে কেন? তুমি কোথায়? উত্তর দিচ্ছনা কেন? অম্লান শুনল, কে একজন বলছে এই বরকে ফোন লাগিয়ে দিয়েছে। দাঁড়া তোর হচ্ছে… অম্লান এ কথা শুনে পাগলের মতো মাকে বললো, মা ও কোন এক বিরাট বিপদে পড়েছে। ও ফোন করেছিল, তারপর আমার কানে এইসব কথা এলো। অম্লান গায়ে প্রায় একশো দুইয়ের ওপর জ্বর নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মা পিছন থেকে বললেন, তুই একা কি করবি রে? আগে পুলিশে ফোন করে সব জানা।অম্লান পুলিশে ফোন করে সব বলল,
ও.সি. মি সুরজিত চ্যাটার্জী অম্লানকে বললো আপনি ফোনটা নিয়ে এখনি আসুন। ফোনটা কোথা থেকে এসেছিল সেটা দেখে ট্র্যাক করতে হবে।
অম্লান নীচে নেমে দেখল। একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছে। সে নিজেও তখন জ্বরে টলছে। ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল -বহুত জলদি চলিয়ে,পুলিশ স্টেশন-– কিছু হয়েছে দাদা?
– হ্যাঁ আমার স্ত্রী খুব বিপদের মধ্যে আছে..
– আমি খুব তাড়াতাড়ি পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছি। এই বাজারের আগেই যে ঝোপের মতো আছে ওখান থেকে আমি কয়েকটা ছেলের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আর একটা মহিলা কণ্ঠের গোঙানি। আমি একা আর কি করব ভেবে নিজেই যাচ্ছিলাম পুলিশ স্টেশনের দিকে। সত্যি এই শয়তানগুলোর জন্য দেশটা একেবারে বনজঙ্গল হয়ে গেছে। পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাতেই ড্রাইভারের মুখে সব শুনে আর ফোন ট্র্যাক করে ওসি মিঃ চ্যাটার্জী ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেলেন।অম্লান পৌঁছে দেখে সুমনাকে ওরা মাটিতে শুয়ে ফেলে, ওর গা থেকে কামিজটা প্রায় খুলে নিয়েছে আর সুমনা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তার মুখ গলা রক্তাক্ত। পুলিশ পেছন থেকে গিয়ে ধরে ফেলে চারটি ছেলেকে বাকি দু’জন ছুটে পালায়। ফোর্স ছোটে ওদের পেছনে।
অম্লান সুমনার কাছে গিয়ে নিজের জামা খুলে ওর শরীর ঢেকে দেয়। তারপর ওকে কোলে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ও তো নিজেই তখন জ্বরে আধমরা। সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, অম্লান আমাকে ছুঁয়ো না আজ আমি সত্যি সত্যি অপবিত্র হয়ে গেছি।
অম্লান কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কোনো অপবিত্রতা তোমায় স্পর্শ করেনি। তুমি আমার কাছে একইরকম পবিত্র আছো চল হাসপাতালে যেতে হবে। আগে সুস্থ হয়ে নাও।
ও.সি. মিঃ চ্যাটার্জী বললেন, একজন ওঁদের সাথে যাও। তা নইলে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম নেবে না, আমি এদের ব্যাবস্থা করছি।
তিনদিন পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুমনা ভাবছে অম্লান আর তো তাকে ঘরে নেবেনা। দাদা বাইরে থাকে, বাবা মা কেউ নেই সে কোথায় যাবে এবার? পিকুকে ছেড়েই বা থাকবে কি করে?
সিস্টার এসে ঘরে ঢুকল, সুমনা জিজ্ঞেস করল, সিস্টার আমার স্বামী কি এখানে আর এসেছে?
-হ্যাঁ, উনি তো এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। ওনার তো আজকেই ছুটি।
ছুটি তো কিন্তু যাবে কোথায়? অম্লান যে আর তাকে ঘরে নেবেনা। তাতে সে নিশ্চিত..তাহলে? ভাবতে ভাবতেই অম্লান ঘরে ঢুকল।
সুমনা তার সজল চোখ দু’টো তুলে তাকালো। অম্লান কাছে এসে বসে ওর মাথায় নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো, দূর বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি? কাঁদার কি হল? আজ তো আমরা বাড়ি যাবো।
– আমি কি করে বাড়ি যাবো?
-অম্লান ওকে দু’হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-কোথায় যাবে?
-আমাকে ছুঁলে? তোমার ঘেন্না করছে না?
-না, আমার কোনো ঘেন্না করছে না। তুমি এসব একদম ভাববে না কোনোদিন। যা ঘটেছে তা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আজ আমার যদি একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কিছু ক্ষতি হত। তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?
এত সেই অ্যাকসিডেন্ট নয়, কতগুলো নোংরা হাত আমার শরীর স্পর্শ করেছে। আমার নিজেকে নিজের অপবিত্র লাগছে।
-আমার লাগছেনা। ওরা তোমাকে যে প্রাণে মেরে ফেলতে পারেনি এটাই আমার পরম ভাগ্য। নাও চল, আর ছিঁচকাঁদুনির মতোন কাঁদতে হবেনা। বাড়িতে মা আর পিকু আমাদের অপেক্ষায় আছে।
সুমনা অম্লানের বুকে মুখ গুঁজে বলল- তুমি এত মহান?
– দূর আমি মহান টহান কিছু নই, আমি একটা সন্দেহবাতিক স্বামী।সুমনা একই রকম ভাবে ওর বুকে মুখ গুঁজে থেকে বলল- তুমি এরকমই সন্দেহবাতিক থেকো আর আমাকে এইভাবেই ভালোবেসে যেও।
-আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। সত্যি বলছি বিশ্বাস কর। আমার সমস্ত জীবন জুড়ে শুধু তুমি আর পিকু। কিন্তু আমি এই সন্দেহবাতিক আর থাকব না। আমি বুঝতে পেরেছি যাকে ভালোবাসা যায় তাকে বিশ্বাস করতে হয়। আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালেবাসো তাই ওভাবে মার খেয়েও আমার জ্বরের সময় আমার জন্য আড়াল থেকে সবই করে গেছ। ভালোবাসা না থাকলে তা সম্ভব হয় নাা।চল এবার আমরা আমাদের বাড়ি যাই..
অম্লান ওর হাতের দিকে নিজের হাতটা বারিয়ে দিয়ে গান গেয়ে উঠল– ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার হাতটা ধর তোমার কোমল বন্ধনে..– বাবা! তুমি রবীন্দ্রনাথের গানে কলম চালাচ্ছো?
– ভালোবাসা অনেক সাহস দেয় বুঝেছ?
-হ্যাঁ, বুঝেছি চল এবার। -
বদল
বদল
-পারমিতা চ্যাটার্জীবেশ তো চলছিল সুমেলার আর সৌরভের সংসারটা। রাগ অভিমান আবার ভালোবাসার মিষ্টি মধুর রস নিয়ে চলে গেলো তাদের জীবনের দু’টি বসন্ত।
সৌরভ ওকালতি পাশ করে উকিল হিসেবে বেশ নাম ডাক করে ফেলেছে। সন্ধ্যার পর থেকে তার চেম্বারে প্রচুর ভিড় হয়। উকিল হলেও সৌরভ খুবই রাবীন্দ্রিক মনোভাবাপন্ন। রবীন্দ্রনাথই তার জীবনের জীবনদর্শন । রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি কথার মধ্যে সে এক একটি দার্শনিক তথ্য খুঁজে পায়। এতোই গভীর ভাবনা তার। প্রত্যেক দোলে তার একটি গানের দল আছে যারা প্রায় সবাই সাংস্কৃতিক মনোভাবের, তাদের নিয়ে সে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়িতে প্রকৃতি ভবনের আমন্ত্রণে প্রোগ্রাম করতে যায়। স্ক্রিপ্ট সে নিজে লেখে, বাকিরা কেউ গান, কেউ নাচ, কেউ বা আবৃত্তি করে, পাঠে সে নিজে আর নয়না বলে তার এক যৌবনের প্রথম দিকের বান্ধবী দু’জনে মিলে থাকে। আর সুমেলা একটি আইটি সেক্টরে কাজ করে, রাজারহাটে তার অফিস।
সুমেলা গান বাজনা ভালোবাসলেও সৌরভের মতোন অতো উৎসাহী নয়। সে ভালোবাসে তার কাজকে, কাজই তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কি করে আরও ওপরে ওঠা যায়, কি করে নিজের প্রোজেক্টকে আরও সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করা যায় সেই নিয়েই চলে তার চিন্তা ভাবনা।
বসন্ত এসে গেছে, মানে সামনে দোল, সৌরভ রিহার্সাল শেষ করে রাত প্রায় এগারোটার বাড়ি ফিরলো। তখনও সে গুণ গুণ করে সুর ভাঁজছে, ” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়, করেছি যে দান “।
কাজের যে মহিলাটি আছেন মিনতি মাসি তাকে খাবার গরম করতে বলে সে ঘরে এলো।
এখন বসন্ত, রোমান্টিক সৌরভের মনেও বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ঘরে ঢুকে দেখে সুমেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করে চলেছে।
সৌরভ পেছন থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঠেকালো, এরকম সে প্রায় করে থাকে, সুমেলাও হাসিমুখে সৌরভের আদরে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। আজ হঠাৎ সে এক ধাক্কায় সৌরভকে সরিয়ে দিয়ে বললো- “দেখছো একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি, তুমি কি কিছুই বোঝোনা! “
সৌরভ চমকে উঠলো,” এরকম তো আমি করেই থাকি, আজ হঠাৎ তোমার এতো রাগের কারণ বুঝলামনা তো।”
-কি আবার হবে, কাজের সময় এখন, ভালো লাগছেনা তোমার আদিখ্যেতা,
এতো বাজে ভাবে কথা বলছো তুমি! তুমি না একজন শিক্ষিতা আইটি সেক্টরে চাকরি করা মেয়ে!
– তো? সবসময় কি আমাকে মার্জিত হয়ে থাকতে হবে না কি?
– সৌরভ তাও কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলতে গেলো,” বুঝতে পারছি, তুমি আজ খুব পরিশ্রান্ত, ওকে রেস্ট নাও, আমিও শুয়ে পড়লাম “।
সুলেমা বিছানাটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো প্লিজ।
মিনতি মাসি খুব কুণ্ঠিত হয়ে দরজার বাইরে থেকে ডাক দিয়ে বললো দাদা খাবেনি?
– ও হ্যাঁ যাচ্ছি, সুমেলা তুমি খাবে তো না কি?
– উফ্ এবার দেখছি বেডরুম আলাদা করে নিতে হবে, সমানে ডিস্টার্ব করে আমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করে দিচ্ছে, আমাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয় বুঝেছো! তোমার মতন চোর ডাকাত নিয়ে আমার কারবার নয়। আর আমি না খেয়ে থাকবোই বা কেন অতো আদিখ্যেতা আমার
নেই।
ও এতদিন তো ছিলো, হঠাৎ একদিনেই বদলে গেলো কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা, যাক তুমি তোমার কাজ কর, আমি খেয়ে নিয়ে অন্য ঘরে শুয়ে পড়ছি।
– বেশ তাহলে তো ভালোই হলো।
স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌরভ ওর কথা শুনে, কি এমন হল! হঠাৎ একদিনেই সব পাল্টে গেলো। সুমেলা কি কিছু বুঝতে পেরেছে! নাঃ বোঝার তো কথা নয়, সে তো সুমেলার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই চলে, মনের কথা বোঝার মতন অতো সময় তো ওর নেই- তাহলে!
অশান্ত মন নিয়ে সৌরভ শুতে গেলো কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। খালি মনে হচ্ছে অসম্ভব কাজের চাপে সুমেলা হয়তো রাগ দেখিয়ে ফেলেছে কিন্তু কাজ শেষ হলেই তাকে ডাকতে আসবে শুতে যাবার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ ছটপট করার পর সৌরভ উঠে দেখতে গেলো সুরেলা ঘুমিয়েছে না কি!
গিয়ে দেখলো সে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। তাও ভালো হয়তো ভীষণ ক্লান্ত, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে, এই আশা নিয়ে সেও গেলো শুতে কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়লো।
সকালে উঠে দেখলো সুমেলা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, অবাক হয়ে সৌরভ ভাবলো হঠাৎ একদিনের মধ্যে এতো পরিবর্তন!
দেখলো একটা ছোটো সুটকেসে কিছু জামাকাপড় গোছানো হয়েছে, সৌরভ জানতে চাইলো, “এগুলো কি সুমি? “
সুমেলা বেশ ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিল, “আমি অফিস ট্যুরে যাচ্ছি, ফিরতে কদিন সময় লাগবে।”
হ্যাঁ তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো..
– হ্যাঁ বলো আমিও শুনতে চাই, হঠাৎ এই বদলের কারণটা কি?
-আমি তোমার সাথে এতোদিন মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারলাম না..
-মানে!
-মানে তোমার ওই শান্তিনিকেতন, গানের আড্ডা, আমি জাস্ট বোর হয়ে গেছি, ফিরে এসে আমি ফাইনালি চলে যাবো।
-চলে যাবো মানে!
-মানে এখনকার দিনে এতো অ্যডজাস্ট করে চলার কোনো মানে হয়না, এতো মানিয়ে নিতে নিতে আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তুমি শুধু নিজের আনন্দ, নিজের ভালোলাগা নিয়ে ব্যাস্ত থাকো, কখনও কি জানতে চাও আমার ভালো লাগছে কি না?
সৌরভ অবাক হয়ে বললো ” তুমিও তো কখনও বলো নি, একবার বললেই আমি তোমার ভালোলাগাকেও নিশ্চয়ই প্রাধান্য দিতাম।”
-সব কিছু মুখে বলে হয়না সৌরভ, আমি অনেকবার তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি পাত্তাই দাওনি।
-মানছি তাহলে আমার ভুল হয়েছিল, তাবলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে!
-তাই যায় সৌরভ, যদি মনের কোণটা ফাঁকা থেকে যায় তাহলে সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করে যায়। তুমি তোমার স্মৃতি বউদির দুঃখে কাতর, তার গান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তোমার কতো চিন্তা ; তার অমন ভালোমানুষ স্বামী সে না কি স্মৃতি বউদির গানের জন্য কোনো চেষ্টাই করেনি, তাই বউদিকে তোমাকে ফাংশনে নিয়ে যেতে হয়, তার চোখের জলের মূল্য তোমার কাছে অনেক বেশি, আর আমি যে একজন ভালো বাচিক শিল্পী, আমার কবিতা বলা, শ্রুতিনাটক যে বন্ধ হয়ে গেছে, তারজন্য তুমি কতটুকু কি করেছো সৌরভ?
নিজের শখ পূরণের জন্য যেমন স্মৃতি বউদিকে তোমার হাত ধরতে হয়েছে তেমনি আমার গুণকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পী করার জন্য আমারই অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার এগিয়ে এসেছেন, আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমায় অনেক সুযোগ করে দিয়েছেন। তোমার যেমন চেম্বারের পর অনেকক্ষণ ধরে স্মৃতি বউদির গান না শুনে ওর সাথে সময় না কাটিয়ে রাত্রে ঘরে ফিরতে মন লাগেনা, তারপর ফিরে এসে একটু শুকনো আদর দিয়ে কোনরকমে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, একবারও ভাবোনা আমি কতটা বঞ্চিত হচ্ছি, একে তুমি ভালোবাসা বলো?
কিসের ভালোবাসা সৌরভ! কোনো ভালোবাসা আর অবশিষ্ট নেই। তোমার এই নিষ্প্রাণ ভালোবাসায় আমি ক্লান্ত, এতোদিন বুঝিনি, একদিন হঠাৎ আমার চোখ খুললো, যেদিন আমি অফিস থেকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে তোমাকে ফোন করলাম, সেদিন তুমি কতো বিরক্ত হয়ে বলেছিলে, ‘কি করে জ্বর বাঁধালে! ডাঃ চক্রবর্তীকে ফোন করে ডেকে নাও”, বলে তোমার কর্তব্য শেষ করে দিলে। রাতে এসেও আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেনা যে, আমি ওষুধ খেয়েছি কিনা! ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে তুমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লে, সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, স্মৃতি বউদির আকর্ষণ তোমার কাছে কতো তীব্র, আমি একটা মেয়ে হয়ে এ অপমানটা মেনে নেবো কেনো বলতে পারো? আমি স্বনির্ভর তাই নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিলাম।
সৌরভ দেখলো সুমেলা তার সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজ সে সত্যি বাধা দিতে পারছেনা, নিজের কাছে নিজেই এক চরম অপরাধী হয়ে গেলো, মুখ নীচু করে বসে থাকা ছাড়া আজ আর কিছু করার নেই তার। -
কিছু পলাশের নেশা
কিছু পলাশের নেশা
-পারমিতা চ্যাটার্জীদোলা আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার গ্রীলটা ধরে। কাল রাতে তিতিরকে রঞ্জন নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভীষণ একলা লাগছে নিজেকে।
আজ চারদিকে শুধু রঙের খেলা। ওইতো সামনের বাড়ীর ছাদটায় সামিয়ানা টাঙিয়ে দোল খেলার কি বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার অনেকের সাথে তারও নিমন্ত্রণ ছিল কিন্তু সে যায়নি। যার জীবনের ক্যানভাসটাই বেরঙা হয়ে গেছে সে আর রঙ খেলে কি করবে। সামনের বাড়ী থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, “রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস —
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।।
ফাগুন লেগেছে বনে বনে”–।
দোলার মনে পড়ছে বিয়ের পর রঞ্জন তাকে এসে বার বার রঙিন আবীরে ভরিয়ে দিচ্ছিল। তাই দেখে ওর ছোট ননদ বলেছিল তুই কি আজ শুধু দোলাকেই রঙ মাখাবি? আমদের কি ভুলেই গেলি?
রঞ্জন ছিল তার বন্ধু বহ্নির দাদা। সেই সুত্রে তাদের আলাপ আর প্রেম তারপর বিয়ে তারপর তিতিরের আগমন তাদের দিনগুলোকে আরও সোনলী আর রঙিন করে দিয়েছিল। প্রতি বছর রঞ্জনদের বাড়ীতে বেশ বড় করে রাধাকৃষ্ণের পুজো হয় তারপর দোল খেলা হত ওদের বাগানে। অনেক আত্মীয় বন্ধুর সমাগম হত। রঞ্জনের অনুরোধে প্রতিবার তাকে গান গাইত হত। ফাগুন লেগেছে বনে বনে এই গানটা যে সে কতবার মনে পড়েনা আর। একবার দোলাকে কাছে নিয়ে তাকে রঙ মাখাতে মাখাতে রঞ্জন গেয়েছিল, “একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনে।” সবাই কি হাসাহাসি তাই নিয়ে, রঞ্জন একটুও লজ্জা না পেয়ে উত্তর দিয়েছিল, আজ প্রেমের দিন নিজের বউয়ের সাথে প্রেম করবো না একটু? দোলা লজ্জায় লাল হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল।
আজ সেই সব স্মৃতি হয়ে শুধু বেঁচে আছে দোলার গোপন অন্তরে। কাল অবশ্য ওকে রঞ্জন বলেছিল অনেকবার চলোনা তুমিও, মা অনেকবার করে বলে দিয়েছেন তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য–।
– দোলা প্রশ্ন করেছিল কোন অধিকারে যাবো?
– তিতিরের মায়ের অধিকারে, আর তাছাড়া আমিই না হয় খারাপ, অন্যায় যা হয়েছিল আমার দিক থেকে কিন্তু আমার বাড়ীর লোকেরা তো সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসে। মা মাঝে মাঝেই তোমার কথা বলেন আর চোখের জল ফেলে বলেন আমার অমন লক্ষ্মী বউমাকে তোর জন্যেই বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হল। চলো না এবার প্লিজ-
বলে ওর হাত ধরতে গিয়েছিল-
– দোলা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় বলেছিল- আমি তোমার হাতের খেলনা নই রঞ্জন, যে তোমার ইচ্ছে হলেই বাড়ী থেকে বার করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে নেবে। আবার ইচ্ছে হলেই হাত ধরতে আসবে
তাহলে তিতিরও না হয় থাক তুমি তো একদম একা থাকবে?
– না তিতির ওর দাদু ঠাম্মা পিসি বাবার সাথে আনন্দ করুক আমার জন্য ওর শৈশবটা বেরঙা করবো কেন?
তারপরও রঞ্জন বলছিল, “আমার ভালোবাসায় ভরা রঙিন দিনগুলোকে কি একেবারেই ভুলে গেছ?” শুধু আমার অসভ্যতাটাই মনে করে রেখেছ?
– না ভুলব কেন? সেই স্মৃতিটুকু নিয়েই তো পথ চলছি। কিন্তু নিজের কপালের ওপর একটা কাটা দাগ দেখিয়ে বলল, এই অপমানটাও ভুলতে পারিনি। ওপরের আঘাতটা শুকিয়ে গেলেও ভেতরের ঘা-টা বড় দগদগে। ওটা কোনদিন শুকোবে বলে মনে হয়না।
এরপর আর রঞ্জন কোন কথা বলেনি মুখ নীচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল। বেরোবার আগে তার কপালের দাগটার দিকে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে দেখেছিল, দোলা লক্ষ্য করল ওর গভীর চোখদু’টোতে টলটল করছে জল।
ওরা চলে যাবার পর দোলা উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে পরেছিল কখন যে চোখে ঘুৃম নেমে এসেছিল টেরই পায়নি। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরে বলল, হ্যালো-
ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো রঞ্জনের,
দোলা?
– হ্যাঁ বল?
– ঘুমিয়ে পরেছিলে?
-হ্যাঁ
-এই তিতির তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়…
-দাও ওকে…
-মাম্মা আমার তোমার জন্য খুব মন খারাপ করছে। এখানে সবাই আছে শুধু তুমি নেই-
দোলা বুঝল এগুলো শেখানো কথা তা নইলে তিতির এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা।
দোলা তাও নিজেকে সংযত করে বলল- তুমি ঘুমিয়ে পড়ো সোনা অনেক রাত হয়ে গেছে।
– তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসেনা মাম্মা…
-এখানে সবাই বাপি মাম্মা দু’জনের সাথে এসেছে আমি শুধু তোমায় ছাড়া…
– এইতো আর দু’ এক দিন পরেই তো আমার কাছে আসবে আবার…
– কিন্তু তখন তো বাপি আমাদের সাথে থাকবেনা?
– তুমি বাপির কাছে থাকতে চাও?
-আমি দু’জনের সাথেই থাকতে চাই…
– আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়ো…
– ঘুমলে আমরা একসাথে থাকব তো?
– না সোনা তা আর হয়না…
– কেন হয়না মাম্মা?
– সে তুমি বুঝবেনা এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
আবার রঞ্জনের গলা —
– মেয়ের স্বার্থেও কি আমরা আর একবার এক হতে পারিনা…
– আমি খুব ক্লান্ত রঞ্জন আমায় একটু ঘুমতে দাও। বলে দোলা ফোনটা কেটে দিল।
সারা রাত আর ঘুমতে পারেনি কিছু খাওয়াও হয়নি।
আজ সারারাত ভেবেছে কখনও রঞ্জনের গভীর ভালোবাসার কথা কখনও বা তার নির্মম ব্যাবহারের কথা। তিতির যখন সবে দু’ বছরের তখন রঞ্জনের জীবনের আসে রনিতা। রনিতা রঞ্জনের অফিসেই কাজ করত কিন্তু রঞ্জনের চেয়ে অনেকটাই জুনিয়র ছিল। তার খোলামেলা পোশাক উচ্ছলতা অনেক পুরুষকেই আকর্ষণ করত। অফিস পার্টিতে মদ খেয়ে নাচ করতে সে বেশ অভ্যস্ত ছিল। রঞ্জনও একদিন বিরক্ত হয়ে এসে দোলাকে বলেছিল, কোথা থেকে যে এসব চিপ মেয়েগুলোকে আমদানি করে কে জানে?
এই একটা মেয়ের জন্য অফিসের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই চিপ মেয়েটার ফাঁদে রঞ্জন নিজেই সবচেয়ে বেশী আটকে গেল। এমন ভাবে আটকালো যে স্ত্রী সন্তান পরিবারের সবাইকে একদিকে ফেলে রমিতাকে নিয়ে মত্ত হয়ে গেল। সেদিন দোলার প্রতিবাদ চোখের জল সবকিছুই তার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছিল। গোপনে রনিতার সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও করেছিল। সেখান থেকে রনিতা ইচ্ছামত টাকা তুলে তার শখ মেটাত। দোলাকে খুব সামান্য টাকা ধরে দিত। প্রতিবাদ করলে বলত যার নিজের রোজগারের মুরোদ নেই স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে ওইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বেশী প্রতিবাদে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করতো না। একদিন এরকম এক ঝগড়ার সময় চড়ের পর চড় মেরে দোলার মুখ চোখ ফুলে গেল। পরদিন দোলা ঘর থেকে বার হতেই পারছিল না লজ্জায়। পরদিন শাশুড়ি দেখে বললেন বউমা একি অবস্থা? দাঁড়াও আজ বাড়ী ফিরুক আজ একটা হেস্তনেস্ত করব। শ্বশুরমশাই দেখে বললেন বউমা আমি এখনও বেঁচে আছি ওই ইতরটাকে কি ভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমিও দেখছি। কিন্তু সেদিন রঞ্জন বাড়ি ফেরেনি। অফিস কলিগকে ফোন করে ওরা জানতে পারে রঞ্জন রমিতাকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গেছে।
তারপর দোলা চাকরি খোঁজায় মন দেয়। বাড়ির তাতে মত দেয় একটা কিছু নিয়ে তো তাকে বাঁচতে হবে। পেয়েও যায় এক গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতার কাজ। সত্যি কথা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা চিরকাল তার পাশে ছিল আজও আছে।
পুরী থেকে ফিরে এসে রঞ্জন ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায়। যে মদকে সে ঘৃণা করত সেই রোজ মাঝরাতে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরত।
একদিন দোলা বলে ফেলেছিল, ভালোই হল তিতির বড় হয়ে দেখবে তার বাবা একটা মোদো মাতাল দুশ্চরিত্র লোক। মেয়ে রঞ্জনের বুকের পাঁজর ছিল। এইকথায় সে হঠাৎ মত্ত অবস্থায় উঠে দোলার চুলের মুঠি ধরে সজোরে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকে যায়, দোলার কপাল ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তখন। রক্ত দেখে তার নেশা ছুটে গেল তাড়াতাড়ি তখন ডেটল ব্যান্ডেজ খুঁজতে আরম্ভ করল। রঞ্জন বলেছিল স্যরি দোলা আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলামনা। দোলা রঞ্জনের হাত ছাড়িয়ে নিজের কপাল চেপে ধরে শ্বশুর শাশুরির দরজায় ঘা দেয়। তাঁরা তো ওর অবস্থা দেখে কেঁদেই অস্থির শাশুড়ি বললেন — এও ছিল আমার কপালে লেখা এমন ছেলে থাকার থেকে মরে যাওয়াও যে ভালো। শ্বশুরমশাই তাড়াতাড়ি ডেটল নিয়ে এসে জায়গাটা পরিস্কার করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই রক্ত বন্ধ হল না। রঞ্জন বরফ নিয়ে এলো শ্বশুর তাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, খবরদার তুমি ওর কাছে যাবার চেষ্টা করবেনা তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। উনি ছুটে নীচে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে তুলে নিয়ে গেলেন হসপিটালে। কি ভাগ্যিস আউটডোরে ডাক্তার পাওয়া গেল। দোলার কপালে তিনটে সেলাই পরলো। তার পরের দিন উকিল ডেকে এনে উনি ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করেন। রঞ্জন তখন কাকুতি মিনতি করতে থাকে তিতিরকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারবনা। উকিল সাহেব প্রশ্ন করল কি আর একবার সুযোগ দেবে নাকি?
তার হয়ে তার শ্বশুরই উত্তর দিলেন তোমার মতন একটা পশুর কাছে কিছুতেই এই বাপ মা মরা মেয়েটাকে রাখতে পারবনা। রঞ্জন কান্নায় ভেঙে পরে বলেছিল কিন্তু এটুকু শুধু করুন ওদের সমস্ত ব্যয়ভার আমার, দোলা চাকরি করতে কোনদিন ভালোবাসতনা আজ আমার জন্য ওকে চাকরি করতে হচ্ছে…
শ্বশুর কঠিন কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল সে কথা এখন আর না ভাবলেও হবে তাছাড়া আমি এখনও বেঁচে আছি।
একমাসের মধ্যেই এই ফ্ল্যটটা তাকে কিনে মনের মতন করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। দোলা তার মেয়ের হাত ধরে এ বাড়ীতে এসে ওঠে।
কৃতজ্ঞতায় ছলছল চোখ নিয়ে দোলা বলেছিল তুমি এতো করে দিলে বাবা?
– আজ থেকে তুই আমার বউমা নয় আমার মেয়ে।
তারপরই রঞ্জন বুঝতে পারে তার ভুল সে কি হারালো? রঞ্জন দেখল তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট শূন্য সে নিজের নাম অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নিল। আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলল যার নমিনি করল দোলাকে।এই নিয়ে রমিতার সাথে তার বিস্তর ঝগড়া হল। রঞ্জন নতুন চাকরি নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। তিতিরকে ও বাড়ীতে তার শ্বশুর মাঝে মাঝে এসে নিয়ে যেতেন। শাশুড়িও মাঝে মাঝে এসেই এ বাড়ীতে এসে দোলাকে দেখে যেতেন, ননদও আসত শুধু রঞ্জনের আসা একদম বারণ ছিল। আজ এই প্রথম রঞ্জন এসেছিল।
কাল রাত থেকে সে খায়নি দশটা বাজে এখনও পর্যন্ত এককাপ চা খেয়েও উঠতে পারেনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এককাপ চা আর দু’টো বিস্কুট নিয়ে বসল। ভাবল একটু পরে যা হোক একটু আলুভাতে ভাত করে নেবে।
সে বিছানায় শুয়ে পড়লো, আবার ঘুম আসতে লাগল কাল রাত জাগরণের ফল।
এমন সময় মনে হল দরজার বাইরে যেন অনেক লোকের কোলাহল তারপরই দরজায় বেশ কয়েকবার বেলের আওয়াজ। সে থমকে গেল কে এলো তার কাছে তো আসার মতন এখন কেউ নেই। ডোর আই দিয়ে দেখল তার শাশুড়ি মায়ের মুখ তখন সে নির্ভয়ে দরজা খুলল। একসাথে হুড়মুড় করে ঢুকে পরল সবাই শ্বশুর শাশুড়ি ননদ নন্দাই তাদের ছেলে সোহম সবশেষে তিতিরের হাত ধরে রঞ্জন । শাশুড়ি এসেই হাসিমুখে বলল আজ আমি আমার ঘরের লক্ষীকে নতুন করে বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছি।
দোলা অবাক চোখে তাকালো তার মনে হচ্ছিল সে কি স্বপ্ন দেখছে?
রঞ্জনের অনেক প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে মা। আমি জানি তোমার অভিমান ঘৃণা এতো সহজে যাবার নয়। তবু বলছি তিতিরের মুখ চেয়ে রঞ্জনকে আর একটা সুযোগ দাও। কাল দেখো নিজের কপালের কি অবস্থা করেছে।
দোলা জিজ্ঞেস করলো- “এ কি করে হল?” বললো- দোলার কপালের কাটা চিহ্নটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাই নিজের কপালটা ওইভাবে ঠুকে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছিলাম।
দোলা এতক্ষণে তাকিয়ে দেখল কপালে একটা ব্যান্ডেজ আছে ঠিকই কিন্তু তা রক্তে লাল হয়ে ভিজে গেছে। দোলা বলল স্টিচ হয়েছে? এখনও তো রক্ত বন্ধ হয়নি? আজ কোনো ডাক্তার পাওয়া গেলনা। সেকি তা বলে সারাদিন ধরে এই রক্ত পরে যাবে? আমি দেখছি বলে ছুটে পাড়ার একজন ডাক্তারকে ফোন করে বললো, “একজনের কপাল ফেটে খুব রক্ত পড়ছে , মনে হচ্ছে সেলাই দিতে হবে আপনি একটা কিছু যা হোক ব্যাবস্থা করুন।
– ঠিক আছে মা তুমি ব্যস্ত হয়োনা আমি দেখছি কি করা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার একটি ছেলে নিয়ে এসে ক্ষত পরীক্ষা করে দেখে বললেন- এ হে হে কি করে এভাবে কেটে গেল বাবা? রঞ্জন তখন আর কথা বলতে পারছেনা শুয়ে পড়েছে দোলার খাটে। কম্পাউন্ডার সেলাই করতে করতে বলল- পাঁচটা সেলাই পড়ছে বাবু?
– হ্যাঁ যা লাগে তাতো করতেই হবে। একটা টিটেনাসও দিতে হবে। তারপর ডাক্তার তার কাজ সেরে ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন, বলে গেলেন জ্বরও আসতে পারে কিন্তু।
রঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে পরল- দোলা দেখল রঞ্জনের দু’ চোখের কোল দিয়ে জল পড়ছে। দোলার মনে আছে রঞ্জনের ছুঁচ ফোটানোতে কত ভয় ছিল সে আজ নিঃশব্দে সব যন্ত্রণা সহ্য করল।
দোলা কাছে এসে ইতস্তত করছিল। ঘর থেকে ওদের একটু একলা থাকার সুযোগ দিয়ে সবাই বাইরে চলে এলো প্রসাদ ভাগ করার ব্যবস্থা করতে। যাবার আগে ওর ননদ কানে কানে বলে গেল তুই চলে আসার পর দাদা একবারও আবীর খেলায় অংশ নেয়নি। না কাউকে দিয়েছে না ওকে কাউকে দিতে দিয়েছে। জোর করলে বলতো আমার রঙ খেলার মানুষটা যদি কোনদিন ফিরে আসে তবেই আবার খেলবো। ওটা বোধহয় ও একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিল। আমাকে ধরে যে অত মারতো সেটাও কি ট্র্যাপে পড়ে? জানিনা রে সত্যি জানিনা, তবে অনুতাপ অনুশোচনায় যে তিল তিল করে দগ্ধ হচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। মাঝখানে তার শুধু এমন হল যে ভালো করে খেতো না ঘুমোত না খালি কাঁদতো।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর দোলা দেখল ও কুঁচকে শুয়ে আছে মনে হল ওর শীত করছে দোলা ওর গায়ে চাপা দিতে গেল তখন রঞ্জন ওর হাতটা ধরে কাছে এনে বলল, “বলো দোলা আমার প্রায়শ্চিত্ত কি হয়েছে”? দোলার চোখেও তখন জল ভর্তি সে তবু অভিমানে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রঞ্জন জোর করে ওর মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল-“একবার বলো”?
দোলার কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, “এর কি কোন প্রয়োজন ছিলো?”
আমি জানিনা ছিল কি না? কিন্তু কাল তোমার কাটা দাগটা আমায় ভীষণ আঘাত দিলো মনে হলো নিজে করে দেখি সেদিন কতোটা কষ্ট ওকে দিয়েছিলাম? তাই করে ফেললাম…
দোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল ওখানে চলো আসতে আসতে, সবাই অপেক্ষা করছে।
দোলার কাঁধে ভর দিয়ে রঞ্জন বেরোতেই তিতির আর সোহম ওদের দিকে আবীর ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হোলি হ্যায়— ওরা দু’জনেই হেসে ফেললো। আবার অনেক দিন পর ওরা রঙের আনন্দে মেতে উঠলো।
রঞ্জন দোলার দু’গালে কপালে গলায় আবীর মাখাতে মাখাতে গান ধরল-
একটুকু ছোঁওয়া লাগে একটুকু কথা শুনি…তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী…
দোলা লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। রঞ্জন কাছে এসে আবার ওর মুখটা আদর করে তুলে ধরলো, দোলা বাধ্য হল গান ধরতে- কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি।।
দোলা আর রঞ্জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওদের নন্দাই দু’টো পলাশের মালা দু’জনের হাতে দিয়ে বললো এবার তোমরা পরিয়ে দাও দু’জনের গলায়—–
সবাই আবার সমস্বরে বলে উঠল হোলি হ্যায়।। -
উমার ডায়েরি
উমার ডায়েরি
-পারমিতা চ্যাটার্জীবহুদিন পর উমা বসেছে এক পুরানো ডায়েরির পাতা খুলে,
সেখানে লেখা আছে অনেক কবিতা,
একসময় কিশোরী বয়েসের আবেগে অনেক কবিতা লিখে ফেলতো-
একবার স্কুলে কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল,
আজ তার মনে হল, আবার ডায়েরির পাতা খুলে লেখার কলমটা তুলে নি।
তখন লিখতো স্বপ্ন দেখার কবিতা, কিশোরী মনের আবেগ প্রবল কল্পনার কবিতা, বসন্তের কবিতা, শ্রাবণের কবিতা।
আজ লিখবে জীবনের কবিতা —
লিখতে গিয়ে কলমটা থেমে যাচ্ছে কেনো?
বুকে তার জমা হয়ে আছে কবিতার পাহাড়,
কলমে কেনো আসছেনা?
তবে কি তার কবিতারা সব হারিয়ে গেলো?
মনের প্রশ্ন মনেই রেখে কলমটা সরিয়ে রাখলো পাশে,
বিচিত্র জীবনের ছবি কবিতায় আনতে গেলে
তার স্বপ্নগুলো মুছে ফেলতে হবে,
যে স্বপ্ন সে আজও দেখে চলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে,
সে স্বপ্নরা পরিণতি না পেলে হয়তো জীবনের কবিতা তার কলমে আসবেনা -।
আগে স্বপ্নগুলোকে মনের ডায়েরি থেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে হবে,
কল্পনার মনটাকে মেরে ফেলে জীবনকে দেখতে হবে বাস্তবের আঙিনায় -।
সে কি পারবে? এই নির্মম বাস্তবতার ছবি আঁকতে?
যে বাস্তব তার স্বপ্নকে মুছে দিয়েছে, কল্পনার জালেক ছিন্ন করে দিয়েছে, তার ছবি আঁকতে?
বড়ো নিষ্ঠুর হয়ে যাবে যে সে লেখা,
তবু তাকে লিখতে হবে, বুকের জমা কষ্ট গুলোকে মুক্তি দেবার জন্য তাকে আবার কলম ধরতেই হবে।
জীবন শুধু কল্পনার নয়, আবেগের নয়, স্বপ্নের নয়, প্রেমেরও নয়,
জীবন এক বিশাল জলাভূমি, এখানে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে অনেক সাঁতার কাটতে হয়,
তবু ভালোবাসা থেকে যায় অধরা।
জীবন প্রতিমুহূর্তের ঘাত প্রতিঘাতের এক জ্বলন্ত ছবি,
তারমধ্যে আঁকতে হয় একটি ছোটো শান্ত নদীর বুকে নেমে আসা সন্ধ্যার কাব্য।
যে ছবিতে এগিয়ে চলেছে সুখ দুঃখ, আনন্দ, ব্যাথা, যন্ত্রণা, জয়, পরাজয় হাত ধরাধরি করে।
যে ছবিতে অশান্তির মধ্যেও থাকবে এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তির মুহূর্ত, যেখানে প্রতিদিনের দরজায় চৌকাঠে পা দিয়ে ভাবতে হবে, ” আজ কি রোদ উঠবে না বৃষ্টি পড়বে?
এই ছবি ধরেই জীবনের ছক এগিয়ে চলে পুরোনোকে পিছনে ফেলে নতুনের দিকে।
বৈচিত্র্যময় জীবন খোঁজে নতুনত্ব,
খুঁজতে গিয়ে অনেকে যায় হারিয়ে, অনেকে এসে পারে পৌঁছায়,
কিন্তু থামেনা কেউ, এগিয়ে চলে সবাই, তুমি, আমি সবাই চলেছি বৈচিত্রের খোঁজে,
পথটা আলাদা হলেও গন্তব্যটা একই।
হ্যাঁ উমা খুঁজে পেয়েছে তার কবিতা,
তার মরে যাওয়া স্বপ্নের নদীর মোহনা এখন জীবন নদীর সঙ্গমে মিলিত হয়েছে,
সে কলমটা তুলে নেয় আবার বহুদিন পর,
ডায়েরিটা নিয়ে লিখে চলে কবিতা, শুধু ছন্দটা পাল্টে গেছে, মানেটা পাল্টে গেছে, কিন্তু কবিতারা রয়ে গেছে অন্তর স্থলে। -
আমি সুভাষ বলছি
আমি সুভাষ বলছি
-পারমিতা চ্যাটার্জী
ভারতের অন্যতম জননায়ক হারিয়ে গিয়েছিলেন, হঠাৎ এতোদিন পর প্রকাশ পেলো, তিনি ছিলেন ভারতের প্রধম প্রধানমন্ত্রী। আজাদ হিন্দ সরকারের এই বীর যোদ্ধা কোথায় হারালেন, কে তাকে সরিয়ে দিলো কোন অন্ধকার কূপে? তা আজও অন্ধকারে। দ্বিখণ্ডিত স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র নেতারা জানালেন
প্লেন ক্র্যাশে এই মহান জননেতার মৃত্যু হয়েছে, তা যে ভিত্তিহীন তা পরে প্রমাণিত হয়। সেদিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল সেদিন আদৌ কোন প্লেন ক্র্যাশ হয়েইনি। তবে কোথায় গেলেন আমাদের সবার প্রিয় নেতাজী? এ প্রশ্ন আজও অজানা। হয়তো সাইবেরিয়ার কোন অন্ধকার জেলে তাঁর দিন কেটেছে, আমরা কেউ তা জানিনা। অপ্রকাশিত থেকেই গেলো মুখার্জী কমিশনের ফাইল, কিন্তু কেন? এর উত্তর পাওয়া যায়নি আমাদের তদানিন্তন রাষ্ট্র নেতাদের কাছ থেকে। আশ্চর্য দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ –
যে নেতার বীরত্বে ত্যাগে আমাদের এই স্বাধীনতা তাঁর অন্তর্ধানের কোন প্রশ্ন কারও মনে জাগলনা?
না কি সত্য প্রমাণিত হবার ভয় ইচ্ছা করেই জাগানো হয়নি? নেতাজী ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের হাল কে, তিনি বুঝেছিলেন অহিংস নীতি দিয়ে কোনদিন স্বাধীনতা আসবেনা আর ভারতবাসীকে থাকতে হবে ইংরাজ শাষকের জুতোর তলায় – তিনি প্রথম যুদ্ধের ডাক দিয়ে ভারতের যুবকদের তাজা রক্তকে উদ্বুদ্ধ করেন।কঠিন দৃপ্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান, ” তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো “।তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে হাজার হাজার যুবক বৃন্দ ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতার সশস্ত্র আন্দোলনে।
নিজের বাড়িতে নজরবন্দী থাকা অবস্থায় ছদ্মবেশে পালিয়ে যান সুদূর আফগানিস্তান হয়ে দুর্গম পথ অতিক্রম করে না খাওয়া না থাকার জায়গার কোন স্থিরতা, এক বিশাল পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যান জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দী ভারতীয় সেনাদের উদ্বুদ্ধ করেন জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। নেতাজি বিবেচনা করলেন তাঁকে পৌঁছাতে হবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানে যেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু,প্লেনে যাওয়া বিপদজনক তাই তিনি সাড়ে তিনমাস সমুদ গভীরে সাবমেরিনে যাত্রা করেছিলেন জাপানের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকেই শুরু হয় ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন নেতাজি। শুরু হয়ে গেলো আজাদ হিন্দ বাহিনীর সামরিক অভিযান। মাতৃভক্ত আজাদ হিন্দ সেনার দেশ মাতার শৃঙ্খল উন্মোচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের সর্বশক্তি দিয়ে। ১৯৪৩ শালেই স্বাধীন ভারতের হাতে চলে এলো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শাসনভার । ১৯৪৩ শালে পোর্ট ব্লেয়ারের মাঠে সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন আমাদের ঘরের মানুষ তথা দেশ বরেণ্য জননায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁর এই অদম্য সংগ্রামের কথা, সবই কি ভুলে যাবে ভারতবাসী?
নেতাজির এই অদ্যমতা কাঁপিয়ে দেয় ইংরাজ শাসনের ভিত কে।
অন্ন নেই, বস্ত্র নেই প্রবল শীতে একটা ভালো কম্বল পর্যন্ত নেই, ছিল শুধু স্বাধীন দেশের স্বধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের এক অদম্য প্রয়াস।আমাদের বাংলার ছেলে বীর সুভাষের সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, ” আমি সুভাষ বলছি ” আজও ভারত তথা বাঙালির হৃদয়ে কম্পন জাগিয়ে তোলে, এ কি ভুলে যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন আমাদের ঘরের ছেলে বীর সুভাষের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী। হাতের বাইরে চলে যায় দেখে রাতারাতি গোল টেবিলের বৈঠক ডেকে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ শালের দ্বিখণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সম্পূর্ণ আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হয় বীর নেতা সুভাষকে প্লেন ক্র্যাশের মিথ্যা ঘটনা রটিয়ে। যাঁর অদম্য বীরত্বে ত্যাগে সংগ্রামে আমাদের এই স্বাধীনতা, তাঁকেই সরিয়ে দেওয়া হয় কোন অজানা গন্তব্যে।
কি ভাবে কেটেছিল তাঁর জীবনের শেষ কটি দিন তা আজও প্রমাণ সাপেক্ষ, শুধু আমরা এটুকু জানি সুভাষ আর ঘরে ফেরে নি, কিন্তু কেন? এই কেনোর উত্তর আমরা কবে পাবো বা আদৌ পাবো কিনা তা আমাদের জানার বাইরে।
আজ এই বীর নেতার জন্মদিন, তাঁকে জানাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম, মনে মনে বলি তুমি ফিরে এসো নতুন রূপে, নতুন নামে, তোমাকে যে আজ আমাদের বড়োই প্রয়োজন, এই স্বাধীন ভারতের দুর্দশা, তুমি আর একবার দেখে যাও, স্বাধীন হয়েও আমরা পরাধীনতার নাগপাশে বন্দী।
আর একবার শোনাও তোমার সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, ” আমি সুভাষ বলছি “। -
নতুন ভোরের আলো
নতুন ভোরের আলো
-পারমিতা চ্যাটার্জীসূর্যের শেষ রেখাটা ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে,
দিনের আলোর রেখা নিভে গেলো আধারের অন্তরালে।
রাত বড়ো প্রিয় আমার,
অন্ধকারের অন্তরালে আমার একলা আকাশকে আমি খুঁজে পাই।
একটু পরেই তো ঝলমল করে উঠবে যত তারা,
ওরা আমায় ডেকে বলবে-
“ও মেয়ে আধার ঘরে সাঁঝাবাতি জ্বালবিনা?
আমি বলব- আমার সাঁঝবাতি যে তোমরা-
তোমরাই তো আমার নীরব মনের কোণে কোণে আলোর রেখা টেনে দিয়ে যাও,
সেই আলোই তো আস্তে আস্তে মিশে যায় এসে প্রথম ভোরের আলোর অন্তমিলে”।
সূর্য ওঠা ভোর নিয়ে আসে আর একটা নতুন দিন,
আর আমি সেই নতুন দিনের চৌকাঠ ধরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।
অপেক্ষায় থাকি আবার কখন আসবে রাতের অন্ধকার,
তারার ফাঁক দিয়ে ভেসে বেড়ানো মেঘের আঁচলে লিখে যাই জীবনের যত না বলা কথা –
যা কোনদিন কাউকে বলা হয়নি,
বলার অপেক্ষায় কেটে গেছে
জীবনের গোধূলি বেলা, কিন্তু হয়নি বলা, বলতে এসে বারবার শুধু ফিরে গেছি,
প্রত্যাখ্যানের ব্যাথা বেদনার সব কথাই লেখা আছে অদৃশ্য মেঘের আঁচলে,
না বলা কথাটা না বলাই থাক,
সামনে দিয়ে নদীটা শুধু বয়ে যাক।
“ও বৃষ্টি তুমি মেঘের আঁচল থেকে মুছে দিওনা আমার লেখা কথাগুলো।
তোমার অঝোর ধারায় ভেজা মনের অনেক কথা লেখা আছে সেই আঁচলে,
তুমি তাকে বাঁচিয়ে রেখো”।
রাতের কোলে মাথা রেখে স্বপ্ন দেখা কখন শেষ হয়ে যায়,
আবার আসে নতুন ভোরের আলো আর আমি আবার আজকে দিনের দরজা ধরে থমকে দাঁড়িয়ে যাই । -
এখানে সবুজ নেই
এখানে সবুজ নেই
-পারমিতা চ্যাটার্জীএখানে সবুজ নেই, গাছের রঙ ধূসর।
আকাশে নীল খুঁজে বেড়াই , ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ।
এখানে প্রকৃতি কাঁদে যন্ত্রের তাণ্ডবে।
এখানে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ ফেকাসে,
এখানে শুধু রক্তের লাল রঙ ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
এখানে প্রেম নেই, নেই কোন ভালোবাসা,
এখানে গৃহ আছে, সম্পদ আছে,শান্তি নেই।
এখানে ভালোবাসা লুটিয়ে পড়ে বেদনায়,
এখানে নারীর ভালোবাসায় পুরুষ খোঁজে শুধু খিদে,
পুরুষের ভালোবাসায় নারী খোঁজে প্রাচুর্য।
এখানে নারীর লজ্জা লুটিয়ে পড়ে ধর্ষকদের অত্যাচারে,
এখানে বিচারের বাণী কাঁদে নীরবে নিভৃতে।
এখানে মায়ের ভালোবাসায় লুকিয়ে থাকে স্বার্থ,
এখানে সন্তান চায় মাতৃস্নেহের মুক্তি।
এখানে সবুজ নেই , এখানে চাঁদ ঢেকে যায় ধোঁয়ার ধূসররঙের আড়ালে,
এখানে পূর্ণিমার রাত কাটে মদ আর হুইস্কির গ্লাসে,
বধূ কাঁদে একলা নীরব রজনীতে।
কাঁচ ঢাকা বারান্দায় রাখা পাতাবাহার কাঁদে নীরবতার ব্যাথায়;
ভালোবাসাহীন যন্ত্রণায় তারা চেয়ে থাকে উন্মুক্ত সূর্যের দিকে,
কাঁচের আড়ালে তাও রোদ আসে ঝাপসা।
এখানে বাজে না ভোরের ভৈরবী রাগ,
কোকিল ডেকে যায় বৃথাই গাছের আড়ালে,
কেউ শোনে না তার কুহু কুহু ডাক।
এখানে সবুজ হারিয়ে গেছে, হারিয়েছে প্রকৃতির রোমান্টিকতা।
এখানে নদীর তীরে নির্জনতার অভাব,
সাজানো কফি আর আইসক্রিম পার্লারের আড়ালে মৃদু হয়ে যায় বাদামওয়ালার ডাক।
এখানে সবই নকল, প্রকৃতির রং মুছে গিয়ে গড়ে উঠছে সাজানো বাগান,
নদীর স্রোতে সাঁতার আবদ্ধ হয়ে আছে সুইমিংপুলের বদ্ধতায়।
অভিমানে প্রকৃতি তাই নিয়েছে মুখ ফিরিয়ে,
বইতে বইতে নদী হারিয়েছে মোহনা।
আলোর তীব্রতায় জোছনা লুকিয়ে পড়ে।
একা মাঝি আর গায় না গান-
” ও মোর মন মাঝি তোর মনের মানুষ কই “?
এখানে স্রোত আটকে গেছে প্লাস্টিকের পাঁকে,
শোনা যায়না তাই সেই গান আর, ” ও মাঝি রে তোর নাও খানি একবার বেয়ে আন এই ঘাটে, আমি যে বধূ একলা দাঁড়ায়ে আছি তোর লাগি, তুই একবার নাও খানা আন না এই ঘাটে। “ -
সুখের ঘরের চাবি
সুখের ঘরের চাবি
-পারমিতা চ্যাটার্জীকিছু খুঁজে বেড়াচ্ছ বন্ধু?
হ্যাঁ আমি সুখ কিনবো বলে
একটি লটারির টিকিট কিনে
এই ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিলাম
সেই ঘরের চাবিটা হারিয়ে গেছে।
সে কী! সুখের ঘরের চাবি হারিয়ে ফেললে?
তোমার পূর্বপুরুষেরাও লটারি কিনেছিলেন
সুখ কিনবেন বলে, তারা কিনেও ছিলেন;
সবই বন্ধ ছিল ওই ঘরের মধ্যে,
তুমি সেই ঘরের চাবি হারিয়ে ফেললে বন্ধু?
না না ওই চাবি আমাকে পেতেই হবে;
এতো বিষণ্ণতা আমি সহ্য করতে পারছিনা,
আমাকে সুখের ঘরের চাবিটা খুঁজে বার করতেই হবে।
কত জন্ম ধরে লটারির টিকিট কিনে কত সুখ তারা
জমা করে রেখে গেছেন ওই ঘরের মধ্যে,
এতোদিনের পুরানো চাবি হারিয়ে ফেললে
আমি কি জবাব দেবো তাঁদের কাছে?
আমাকে আবার লটারির টিকিট কিনতে হবে।
যতই লটারি কিনে যাও বন্ধু, যে সুখ হারিয়ে ফেলেছ তা আর কোনদিন খুঁজে পাবেনা-।
কেনো কেনো পাবো না?
যে মন নিয়ে তারা লটারি কিনে সুখ কিনেছিলেন
সেই মনটাই তো হারিয়ে গেছে –
তাইতো এতোদিনের পুরানো চাবিটা হারিয়ে গেলো;
আর কি তাকে খুঁজে পাবে?
হাজারটা লটারি কিনলেও টাকা হয়তো পেলেও পেতে পারো কিন্তু সুখের ঘরের চাবিটা আর ফিরে পাবেনা-।
যা হারিয়ে যায় তা হারিয়েই যায়, তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়না ;
তাইতো আমাদের রবি কবি বলে গেছেন, “যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কতো আর”।
যে সুখ হারিয়ে গেছে তা লটারির টিকিট কিনে
কোনদিন আর ফিরে আসবেনা
আর বৃথা খুঁজে বেড়িয়ো না তোমার সুখের ঘরের চাবি। -
ছলনা
ছলনা
-পারমিতা চ্যাটার্জীঅপরাজিতা নামটা তার বাবার দেওয়া। একটু বড়ো হবার পর বাবা তাকে বলেছিলেন – “মা এই নামের মানে জানতো?” মানে হচ্ছে জীবনে সর্বক্ষেত্রে তুমি অপরাজিত থাকবে।
মেয়ে একগাল হেসে বলেছিল তখন – “হ্যাঁ বাবা আমি নিশ্চয়ই থাকবো।”
ছোট্ট বেলা থেকেই অপরাজিতার নাচে খুব আগ্রহ, গান শুনলেই সে আপনমনে তাল মিলিয়ে নেচে যেত। অপরাজিতার বাবা অনুপমবাবু মেয়েকে ছোট্ট থেকেই ভালো গুরুর কাছে নাচের জন্য ভর্তি করে দেন। এই নাচ নিয়েই তার উত্থান শুরু। সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে সে নাচ শিখেছে। নৃত্য শিল্পী হিসেবে যখন বেশ নাম করেছে তখনই সে নজরে পরে বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন নামকরা পরিচালকের। অপরাজিতার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন না, থাকলে হয়তো এত বড়ো পদস্খলন তার হতোনা।
সে নাচের জগত থেকে চলে আসে ঝলমলে রূপালী পর্দায়, এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম করে ফেলে।
বয়েসের দোষে জীবনে তার প্রেম আসে আর ভেসেও যায় এক মিথ্যা প্রেমের জোয়ারে।
সেই পরিচালকই ছিলেন তার প্রেমিক যে তাকে মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমপর্ব চালিয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন সে বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে। যখন এ কথা সে তার প্রেমিককে জানিয়ে বিয়ে করার কথা বলে তখনই ভালোবাসার মুখোশটা খুলে যায়। লোকটি সম্পূর্ণ রূপে তার সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় ইণ্ডাষ্ট্রিতে রটিয়ে দেয়, ও একটা দুশ্চরিত্রা…কার না কার সাথে কি সম্পর্কে প্রেগন্যান্ট হয়েছে এখন আমাকে ফাঁসাতে চাইছে, বলে কিনা আমাকে বিয়ে করতে? আমার ঘরে স্ত্রী, পুত্র সব আছে আমি কি করতে ওকে বিয়ে করতে যাবো?
এই ঘটনা অনেকে অবিশ্বাস করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অনেকে কিন্তু বিশ্বাসও করেছিল যারা এইরকম জালে ফেঁসেছিল, কিন্তু ক্যারিয়ার ও সম্মানের ভয়ে সবাই চুপ ছিল।
কিন্তু অপরাজিতা তো হারবার মেয়ে নয়। সে এক ঝটকায় সিনেমা জগত থেকে বেরিয়ে আসে আর বাবার বাড়িতে চলে আসে একদম একলা। শুধু সাথে ছিল বাপেরবড়ির পুরানো লোক রমলামাসী। একমাত্র মেয়ে সে বাবার বাড়ি তাই পুরোটাই তার। বাবার কিছু অর্থ তার জন্য রাখা ছিল, নিজেরও কিছু উপার্জিত অর্থ ছিল। তাই সম্বল করে সে জীবন যুদ্ধে নামে। একসময়ের নৃত্য শিল্পী তার ওপর অভিনেত্রীর তকমা গায়ে লেগেছে, বাড়ির একাংশে সে যখন একটি নাচের স্কুল গড়ে তোলে তখন ছাত্রী পেতে তার অসুবিধা হয়নি। সেই ছোট্ট স্কুলটি এখন বিখ্যাত এক নৃত্য অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়েছে।
এই সবে সে টিম নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে পারফর্ম করে যথেষ্ট স্বীকৃতি অর্জন করে এসেছে। সামনের মাসে তার কলকাতার এক বিরাট হলে প্রোগ্রাম। তাই ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যাস্ত।
এদিকে তার মেয়ে তিতাস এখন ক্লাস টেনের ছাত্রী এবার সি.বি.এস.সি. পরীক্ষা দেবে, মেয়েকে ও টিউশন থেকে এনে নিজে হাতে তার প্রিয় ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাইয়ে তবে নাচের মহড়ায় এসেছে।
আজ থেকে দু’বছর আগে তিতাসকে তার জীবনের চরম সত্যটা বলে দিয়েছে। কারণ সে মনে করে সত্য কখনও ঢাকা থাকেনা, একসময় তিতাস ঠিক জানতে পারবে আর তখন তার পক্ষে মেনে নেওয়াটা আরও অনেক কঠিন হবে। তিতাস তখন সবে ক্লাস এইটে পরে, সেসময় সে জানতে চায়, “মা আমার বাবা কি আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছে?”
সে উত্তর দিয়েছিল- “তিতাস তোমার বাবা মারা যায় নি, সে একজন ক্রিমিনাল তাই তার জায়গা এখন জেলে। হ্যাঁ, সব সত্য সেদিন সে মেয়েকে বলে, এবং পরিচালক মহাশয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কেস চলে, অবশেষে ডি.এন.এ. টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তার কন্যার বাবা কে? তখন বাধ্য হয়ে তাকে স্বীকার করতে হয়- “হ্যাঁ, এই শিশুটি আমার।” এখন শুনেছে দীর্ঘ চোদ্দবছর কারাবাসে থেকে সে মুক্তি পেয়েছে।
তিতাসের বয়স এখন পনেরো।
সে তো অপরাজিতা, কোন ছোট বেলায় বাবাকে কথা দিয়েছিল, বাবা আমি কোনদিন হেরে যাবো না সেই কথা সে রেখেছে।
আজ যখন সে ছাত্রীদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত তখন রমলা এসে তাকে বলে, “দিদি কেউ একজন তোমাকে ডাকছে।”
আমি একটু আসছি, বলে বাইরে এসে যাকে দেখল তাকে দেখার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলনা–“আচমকা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “আবার কি সুযোগ সন্ধানের জন্যে এসেছেন এখানে?”
“আমার তো অনেক শাস্তি হলো, এবার কি ক্ষমা পাবো?”
“ক্ষমা? যা করেছেন আপনি? তাতে সারাজীবন কোনো ক্ষমা হয়না। ভুলে গেছেন সেদিনের কথা, যেদিন ইণ্ডাষ্ট্রিতে একঘর লোকের সামনে আমাকে বেশ্যা বলে অপমানে জর্জরিত করে নিজের সন্তানের পিতৃত্বকে অস্বীকার করেছিলেন? আমি কোনদিন তা ভুলবো না। আপনি চলে যান এখুনি, আর কোনোদিন এখানে আসার সাহস দেখাবেন না তাহলে আমি আবার পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হবো।
নিঃশব্দে উঠে চলে যাচ্ছে একসময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অম্লান রায়।
অপরাজিতা দাঁড়িয়ে দেখছে, সে চলে যাচ্ছে, তার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা, তার সন্তানের বাবা।
চোখে কি কিছু পরেছে? হবে হয়তো, না চোখের জল এটা নয়।