• গল্প

    অভিমান

    অভিমান
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

    ছোটবেলা থেকেই তুমি আমার হিরো ছিল রঙ্গনদা।দু’টো পাশাপাশি বাড়িতে অনেকটা এক পরিবারের মধ্যে আমাদের বড়ো হয়ে ওঠা। তুমি ছিলে অনেক মেধাবী এক ছাত্র, তুলনায় আমি ছিলাম নিতান্তই সাধারণ মানের ছাত্রী। তুমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তে, আমি তখন সিক্সের ছাত্রী। অঙ্ক ছাড়া আর সব সাবজেক্টই আমি ভালো ছিলাম। ছোট থেকেই ছিলাম সাহিত্য অনুরাগী, পড়ার বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে পাকা পাকা উপন্যাস পড়তাম। তখন থেকেই একজন উপন্যাসের নায়কের জায়গায় তোমাকে বসিয়ে আর নায়িকার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মনে মনে কল্পনার জাল বুনতাম। তুমি কখনও জানতে পারোনি আমার এই ভালোবাসার কথা। আমি তোমাকে বুঝতেও দিইনি। মনের কথা লুকিয়ে রাখার সংযম তখন থেকেই ছিল, খুব প্রবলভাবে। একদিন অঙ্কের নাম্বার কম হওয়াতে মা খুব বকছিলেন, তুমি শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে বললেকি হয়েছে কাকীমা? আমি ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি অঙ্ক। সেই থেকে তুমি আমায় অঙ্ক দেখাতে আরম্ভ করলে আর আমিও ধীরে ধীরে অঙ্কের ভয়টা কাটিয়ে উঠে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে তুমি চলে গেলে খরগপুর আই.আই.টি. তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমিও এগিয়ে চললাম একধাপ একধাপ করে। মাঝে মাঝে তুমি ছুটিতে আসতে তখন কিরকম যেন এক লজ্জা আর আড়ষ্টতায় তোমার কাছে যেতে পারতামনা- তুমি যখন আসতে বলতে যে কি রে? পরীক্ষা তো এসে যাচ্ছে, অঙ্কটা মন দিয়ে করিস কিন্তু। আমি প্রথমবিভাগে পাশ করা সত্বেও আর্টস নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি তখন পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছ। আমার দিকে চেয়ে অবজ্ঞার চোখে বললে- ফাস্ট ডিভিশন পেয়েও আর্টস নিলি কেন?
    আমি বললাম- আমি যে সাহিত্য খুব ভালোবাসি। তুমি ঠোঁট উল্টে বললে, দূর তোর দ্বারা কিচ্ছু হবেনা।

    আমি নিরুত্তর থাকলাম। শুধু আমার এতোদিনের সাজানো ভালোবাসার রঙটায় যেন বেরঙা তুলির টান পড়তে লাগলো।
    আমার সংযম আমার রুচি, আমার সম্মান তোমার কাছে একবারের জন্যেও ছোট করবোনা। এই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা। শুধু যেদিন তুমি চলে গেলে আর আমায় একবারের জন্যেও বলে গেলেনা। সেদিন সবার অলক্ষ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
    কানাঘুষোয় খবর পেলাম, তোমার কোন এক সহকর্মীকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করতে চাইছো। এ নিয়ে তোমার সাথে কাকু কাকীমার মতান্তর চলছে।
    তারপর একদিন আবার শুনলাম তোমার সহকর্মীনির সাথে তোমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তুমি নাকি আমাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি হয়েছো। দুই পরিবার কখন যে নিজেদের মধ্যে এরকম কথাবার্তা স্থির করে রেখেছে তা তুমি জানলেও আমার কাছে পুরোটাই অজানা ছিল।
    আমি তখন পি.এইচ.ডি. করছি আর একটা কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছি।
    কাকীমা যখন আমাকে এসে বললেন রঙ্গন তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তখন আমার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। সবকিছু নীরবে মেনে নিতে নিতে আমিও ক্লান্ত।
    আমিও আর সংযমের বাঁধকে বেঁধে রাখতে পারলামনা। কাকীমাকে বললাম- তুমি তো আমায় মেয়ের মতো ভালোবাসো? তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো? তোমার মেয়ের সাথে যদি এমনটা হতো তুমি কি করতে? সব মতামত শুধু তোমার ছেলেই দেবে? কখনও প্রত্যাখ্যান, কখনও দয়া করে বিয়ে করতে চাওয়া… আমার কি সম্মান বলে কিছু নেই? আমি কি এতটাই ফেলনা যে কারুর দয়ার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে? আমাকে ক্ষমা কর কাকীমা, এ বিয়ে আমি করতে পারবনা।
    তারপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, তোমার কোন খবর রাখিনি। নিজে এখন একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপক। কিন্তু বিয়েও করিনি, মনে মনে যে সেই ছোট্ট থেকে তোমাকে বরের আসনে বসিয়ে রেখেছিলাম। সে যতই বেরঙা হয়ে যাক, তবু তাকে ফেলে দিতে পারিনি।
    হঠাৎ বদলির অর্ডার এলো। মালদায় কলেজে যেতে হবে আমাকে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে বহু পুরাতন মাসী রমলামাসীকে নিয়ে রওনা হয়ে পরলাম মালদার উদ্দেশ্যে।
    ওখানে যে আমার জন্য এমন চমক অপেক্ষা করছে তা কি করে জানব?
    মালদায় পৌঁছে যখন কাজের ভার বুঝে নেওয়ায় জন্য ডাইরেক্টরের ঘরে ঢুকলাম, দেখি তুমিও একজন ডাইরেক্টর। আমি আমার চমকে যাওয়ায় ভাবটাকে দমন করে কাজ বুঝে নিয়ে সেদিনের মতো সরকারি কোয়ার্টারে ফিরে এলাম।
    কোয়ার্টারগুলো ভারী সুন্দর দিয়েছে। সামনে পিছনে সুন্দর বাগান। নানান রঙের ফুল ফুটে আছে, দিনের প্রায় শেষ তখন ক্লান্ত হয়ে বসে এককাপ চা নিয়ে ভাবছিলাম, কি প্রহসন? সেই তোমার আণ্ডারেই আসতে হল।
    হঠাৎ গেট খুলবার শব্দে চমকে তাকালাম, দেখলাম গেট খুলে তুমি ঢুকছো। আমায় খুব স্বাভাবিক গলায় বললে- আমায় চা দিবিনা?
    আমি তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে বললাম- মাসী একটু চা দিয়ে যাও না বাইরে।
    তারপর বললে- রাতে কি খাবি?
    বললাম- বাজার তো চিনিনা। তাই আজ মাসী বললো- চাল, ডাল একটু নিয়ে এসেছিলাম তাই একটু ফুটিয়ে নেবো।
    -ও সব ঠিক করে ফেলেছিস তাহলে?
    -আমি আজ রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
    -কোথা থেকে পাঠাবে?
    -আমার কোয়ার্টার থেকে, অবশ্য আমার কোয়ার্টার খুব দূরে নয়। আমার রান্নার ছেলেটা বেশ ভালোই রাঁধে।তুই চাইলে ওখানে গিয়েও খেতে পারিস।
    আমতা আমতা করে বললাম- তোমার ফ্যামেলি?
    – ফ্যামেলি আর হল কোথায়?
    – মানে?
    – একজনের জন্য অপেক্ষা করছি এখনও..যদি সে কখনও রাজি হয় তবেই।
    আমি বললাম- ও আচ্ছা..
    – তুই এখনও একা কেন?
    – আমার কথা বাদ দাও?
    – এখনও অভিমান?
    – কিসের অভিমান?
    – আমার ওপর প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছিস আমায় প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু আমি জানতাম তোর ওই প্রত্যাখ্যান ছিল গভীর অভিমান থেকে। তোর মতো নীরবে যে এতবছর ধরে অপমান সহ্য করেও নিজেকে একা করে রেখে দেয়, কাউকে আসতে দেয়না সেই ভালোবাসার জায়গায়…এমন সংযমী গভীর ভালোবাসা আমি আর কোথায় পাবো রে? এখনও কি বলতে হবে আমার অপেক্ষা কার জন্য?
    – আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা – দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর তুমি কাছে এসে দু’হাতে আমার মুখটা তুলে ধরে বললে- আর কত কাঁদবে তিথি? এবার তো একটু হাসো।
    পূর্ণিমার চাঁদটাও সেদিন আকাশে যেন খুব জ্বলজ্বলে, জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে ”আমরা হাত ধরলাম দু’জনে দু’জনের ।

  • কবিতা

    সেদিনের ভালোবাসা

    সেদিনের ভালোবাসা
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    মনে কি পড়ে তোমার
    প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা-?
    মনে পড়ে? সেই সোনালী বিকেলের নিভে যাওয়া আলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা দুজন–
    কি জানি কি হয়ে দুজনের–
    প্রাণে বেজে উঠেছিল না বলা কথার সুর –
    কিছু বলতে চাই কিন্তু পারছিনা বলতে-
    মনের কথা থেকে যাচ্ছে মনের গোপনে —
    অবশেষে এলো সেই কালবৈশাখীর সন্ধ্যা —
    উত্তাল হাওয়ার উদ্যমতার মাঝে প্রথম ধরলাম হাত তোমার —
    মনে পড়ে সেদিনের প্রথম স্পর্শের অনুভূতি?
    কখন কি করে যেন হারিয়ে গেলাম দুজনে
    ভালোবাসার প্রবল উচ্ছাসে–।
    সামান্য চাকরি– সামান্য মাইনে সাথে গোটা দুই টিউশানি–
    ভালোবাসায় আড়াল হল অর্থের দীনতা –।
    কিছু না ভেবেই বেড়িয়ে পড়লাম নির্জন সমুদ্র সৈকতে —
    মনে পরে?
    কি তুমুল উত্তেজনা —
    ছোট্ট ঘর নিয়েছিলাম ভাড়া–
    আক্ষেপ ছিল না তাতে–
    ছোট্ট একফালি জানলা দিয়ে দেখতাম
    সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস —
    আছড়ে পড়ছে ঢেউ জানলার সামনে–
    সমুদ্রের হাওয়ায় হাওয়ায় এলোমেলো মন–
    কাছে এলো দুজনের–
    কত কথা, কত গান, কত মন জানাজানি, কত কানাকানি —
    তারই মধ্যে হারিয়ে গেলাম দুজন দুজনের একাত্ম বন্ধনের ডোরে–।
    আজও কি মনে আছে সেদিনের রাতের কথা–?
    জানি তুমি হারিয়ে ফেলেছ রোজকার একঘেয়ে সংসার যাত্রায়–
    আমি যে আজও রোমান্টিক — শুধু তোমায় নিয়ে–
    এখনও তো একই আছে সেই কালো হরিণ চোখের বিহ্বলতা —
    এখনও তো পিঠ ভরা তোমার কালো চুলের রাশি —
    কোথাও তো কোন তফাৎ নেই —
    তবে? তবে আজ কেন জোছনা মিথ্যে লুটোপুটি খায় আমাদের শয্যায়?
    বল না কেন?
    কেন এত বদলে গেল?
    ভালোবাসা সে তো একই আছে–
    কবিতা? সেও তো আছে বুকের মাঝের খাতাটায় বন্দী হয়ে–
    এখনও হারায়নি ছন্দ তার-
    আজও তো শ্রাবণের বৃষ্টি ঝড়ে পরে–
    তবে কিসে এত বদল হল বল না সুনয়না?
    আর একবার কি যাবে না কি সমুদ্র সৈকতের সেই ছোট্ট ঘরটায়-?
    চল না যাই আর একবার — দেখে আসি দুটি সদ্য বিবাহিত যুবক যুবতীর এলেমেলো ভালোবাসার স্মৃতির কোণটা—
    চল না সুনয়না আর একবার ফিরে যাই আমাদের পুরানো ফেলে আসা স্মৃতি ঘেরা সমুদ্রের তীরে সেই ছোট্ট ঘরটায়–
    হয় তো আবার ফিরে পেতে পারি দুজনে দুজনকে–
    এখনও যে হয়নি বলা সেই না বলা কথাটা–
    এবার হয়েছে সময় সে কথা বলে যাবার–
    চল না যাই আর একবার শুধু — শেষ কথাটা বলব তোমার কাছে– বালুকাবেলার নীরব নির্জনতায়–।।

  • গল্প

    আদর্শ

    আদর্শ
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    গল্পের প্লটটা অনেকদিন আগের একটি মেয়ের কথা- সে সময় মেয়েরা জন্মালে বাড়িতে বেজে উঠতো না মঙ্গল শঙ্খ।
    দীপালীকা ছিল ওর নাম কালিপুজোর দিন চতুর্দিক যখন প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত ঠিক তখনই আঁতুড় ঘর থেকে একটি সদ্যোজাত শিশুর কান্না ভেসে আসে, দাই বেরিয়ে এসে খবর দিল উদগ্রীব পিতাকে,  মেয়ে হয়েছে গো।
    পিতা সুধাময়ের মুখে হাসি উঠল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন- মেয়ের মা ভালো আছে তো?
    দাই অবাক হয়ে জবাব দিল,-হ্যাঁ। মেয়ে হয়েছে শুনে কোন বাপের মুখ যে এমন হাসিতে ভরে যেতে পারে এরকমটা সে দেখে অভ্যস্ত নয়।
    সুধাময়ের মা ঘর থেকে বের হলেন গম্ভীরমুখে- মাকে দেখে সুধাময় হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল- মা সুখবর আছে তো। মিষ্টি নিয়ে আসি?
    – সুখবর? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে খোকা?
    – কেন?
    – হয়েছে তো একটা মেয়ে তারজন্য আবার মিষ্টি?
    – তার মানে? আজ দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোর দিন তোমার ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী স্বয়ং এলেন তার তুমি তাকে তাচ্ছিল্য করছো?
    – হ্যাঁ, তুমি ওই নিয়ে খুশি থাকো শান্তিতে থাকো, আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ে না–
    – হ্যাঁ মা এতেই আমার শান্তি আমার মুক্তি। ওর নাম রাখলাম দীপালীকা।
    – তা নাম তো তুমি যাই রাখো ওর পাঁচ ছ’বছর বয়েস হলেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেব।
    – না মা তা হবেনা। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পথ দেখিয়েছেন। আমি সেই আলো থেকে আমার মেয়েকে বঞ্চিত করবনা। ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল বেথুনে পড়াশোনা করবে।
    – কি বলছিস তুই?( দুু’কান চাপা দিয়ে বললেন) এ কথা শোনাও পাপ..
    – তাহলে আমি সেই পাপ কাজটাই করব।
    – এতে তোর পূর্বপুরুষরা তোকে ক্ষমা করবেন না। কেন তুই একটা মেয়ের জন্য অভিশাপ কুড়োবি?
    – এতে যদি আমার অভিশাপ লাগে তো সেই অভিশাপ মাথায় করে নেব। ও একটা মেয়ে নয়,ও আমার মেয়ে। আমি ওকে আমার আদর্শে গড়ে তুলবো।
    মায়ের আদেশ অমান্য করে? এতে তুই শান্তি পাবি?
    – হ্যাঁ মা এতেই আমি শান্তি পাবো। এক্ষেত্রে যদি নিজের আদর্শকে অস্বীকার করে আমার মেয়েকে তোমাদের অন্ধ কুসংস্কারের অন্ধকার গলিতে ঠেলে দিই তাহলে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি সারাজীবন অশান্তিতে জ্বলে পুড়ে মরবো। কিন্তু আমার অর্জিত আদর্শে যদি আমার মেয়েকে আমি গড়ে তুলতে পারি, তাতেই আমার পরম শান্তি মা পরম শান্তি। এরপরও যদি তুমি আমাকে এ নিয়ে আর একটা কথাও বলো তাহলে এই দীপান্বিতার সন্ধ্যাবেলায় দাঁড়িয়ে বলছি, তুমি তোমার ছেলের মরামুখ দেখবে। এ দেশের শত শত মেয়ের কান্না তোমার চোখে পড়েনা? ছোট্ট মেয়েগুলোকে বৈধব্যের কঠোর নিয়মে ফেলে তোমরা কি আনন্দ পাও? না.. তুমি যদি বলো আমি মাতৃ আদেশ লঙ্ঘন করছি। তবে হ্যাঁ আমি তাই করছি। সবক্ষেত্রে অন্যায় মাতৃ আদেশ মেনে নেওয়া যায়না। তোমার আদেশ রক্ষা করতে গেলে, আমি নিজের আত্মজার প্রতি চরম অপরাধ করবো। তাতে আমি শান্তি পাবো না মা। তারচেয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়াই ভাালো। আর যদি বিদ্যাসাগরের আদর্শে আমার আত্মজাকে গড়ে তুলতে পারি। তাতেই পাবো আমি পরম শান্তি, পরম মুক্তি।

  • কবিতা

    কল্পনা

    কল্পনা
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    চলতে চলতে ক্লান্ত পা দুটো থমকে দাঁড়িয়ে পরে জীবনের চৌকাঠ ধরে–।
    চেয়ে দেখি শেষ বিকেলের ছায়া নেমেছে জীবন আঙিনায় —।
    অসময়ে কোথা থেকে এলো এমন বসন্তের বাতাস–?
    এলোমেলো করে দিল নিঃসঙ্গ জীবনের খাতাটাকে–।
    যা খুঁজে এসেছি এতদিন ধরে– সে যে আপনি এল জীবনে?
    ভয় হয় বড়ো ভয় হয় নতুন করে বেদনার রঙ মাখতে–।
    নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখি পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা যাচ্ছে ডুবে-
    আকাশের রক্তাভ রঙ ছড়িয়ে পড়ছে আমার মুখে–
    বলতে কি পারব অনাহূত অতিথিকে —
    যা বলতে চেয়েছি এতদিন ধরে–।
    না বলাই থাক–
    শুধু নদী তুমি জেনে রাখো– আমার নিঃসঙ্গ নৈশব্দের মাঝে কেউ আছে–

    দীপালীকার প্রদীপ জ্বালাতে– হয়তো কেউ আছে আমার শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে–
    জানিনা– হয়তো সবই আমার না পাওয়া মনের কল্পনা –।
    তবু থাক এই কল্পনাটুকু আঁকা মূর্ত জীবনের প্রতীক হয়ে–
    সেটুকুই আমার সান্ত্বনা —।।

  • অণু গল্প

    ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা

    ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    রুমির আজ মনটা বড়ো খারাপ — সবাই ভাইফোঁটা দিচ্ছে — ঘরে ঘরে বেজে উঠছে শঙ্খ উলুধ্বনি –।
    তার বাড়িতেও তার ননদরা এসেছে — তাদের ভাইকে ফোঁটা দিতে — সেই শুধু বঞ্চিত এই উৎসব থেকে–।
    অথচ তারও কিন্তু দাদা আছে– তার একমাত্র দাদা– কিন্তু সম্পর্কের ভাঙনে আজ সে বহুদূরে –।
    মনে মনে ভাবে — ” দাদা তোর কি আজকের দিনেও একবার মনে পড়েনা ছোট্ট বোনটাকে– ফিরে তাকাস কোনদিন ফেলে আসা সেই স্মৃতিমধুর দিনগুলোতে “–?
    – আমি এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই ভাইফোঁটার সেই উৎসব মুখর দিনগুলো –মনে পড়ে তোর? মামারা সবাই আসত হাতে মায়ের জন্য শাড়িতে প্যাকেট নিয়ে– আর আমি বায়না করতাম- কিছুতেই দাদাকে আমি খালি হাতে ফোঁটা নিতে দেবোনা– আমারও জামা চাই —
    আর তুই বলতিস– মা যে ভাইদের জন্য সব জামাকাপড় কিনেছে – তুই কেন আমায় খালি হাতে ফোঁটা দিবি–?
    – আমার বিয়ে হোক তবে তো দেব- মায়ের তো বিয়ে হয়েছে তাই দিচ্ছে –
    — তুই তখন হেসে আমায় আদর করে বলতিস– আমারও চাকরি হোক, তোকে খুব সুন্দর জামা কিনে দেব দেখিস– এবার শুধু চকোলেট নে–
    আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলতাম — ও তুই এখনও চাকরি করিস না রে দাদা? তুই বড়ে হ, দেখবি এত্তো বড়ো চাকরি করবি-
    — আর আমি তখন আমার বোনটিকে খুব সুন্দর জামা কিনে দেব–।
    কোথায় হারিয়ে ফেললাম বল তো আমরা সেই সোনার দিনগুলো –?
    কি করে তুই আমাকে এত ছোট মনের ভাবলি রে দাদা– এতদিনেও বোনকে চিনলি না ? বাবার বাড়িতে আমি অধিকার দেখাবো?– এ কথা আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি–।
    তুচ্ছ একটা বাড়ির জন্য সম্পর্কটাই ভেঙে দিলি?
    তুই জানিস না আমি আজও দেওয়ালে — তোর নামে ফোঁটা দিয়ে তবে জল খাই– ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা। –
    এই অধিকার টা তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবিনা– যতদিন বাঁচব আমি দেওয়ালেই তোকে ফোঁটা দিয়ে যাবো–। যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস — জানি তুই খুব অসুস্থ- আমার জীবনও একটা সূতোয় ঝুলছে, যে কোন মুহূর্তে সুতোটা ছিঁড়ে যেতে পারে– তখনই সম্পর্কের সুতোটা সত্যি ছিঁড়ে যাবে– সেদিন আর দেওয়ালে ফোঁটা দেওয়ার জন্যেও কেউ থাকবেনা–।প্রার্থনা করি তুই সুস্থ হয়ে ওঠ–।
    আমি আমার আজকের দিনের কাজটা সারি– তোর নামে দেওয়ালে ফোঁটা দি– ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা —-।

  • গল্প

    আধুনিকতা

    আধুনিকতা
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    ঘরে ঢুকেই খাটের ওপর ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে, রিমলি শয্যায় গা এলিয়ে দিল। ধরিত্রী দেবী ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করলেন, ‘এতো রাত অবধি তুমি কোথায় ছিলে?’
    -‘আমি তোমাকে উত্তর দিতে বাধ্য নই মা আমার কাজ ছিল।’
    -‘কি কাজ সেটাই জানতে চাইছি তুমি তো কোনো মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজ করো না। সে যোগ্যতা তোমার নেই তাহলে কি এমন কাজ যে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরতে হলো। তাও স্বাভাবিক অবস্থায় নয়!’
    -‘মা, প্লিজ যুগটা অনেক এগিয়ে গেছে এই আধুনিক যুগের সাথে তুমি পরিচিত নও এই নিয়ে কথা না বলাই ভালো..’
    -‘তা তোমার মতে আধুনিকতা মানে রাত বারোটা অবধি মদ খেয়ে বেলেল্লাপনা করা? এটাকে আধুনিকতা বলে না!’
    ‘আধুনিকতা মানে পুরাতন মানুষের সৃষ্টি কিছু সংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করা, আধুনিকতা মানে মানবিক হওয়া, অন্যের দুঃখকে নিজের মনে করে ভাগ করে নেওয়া। আধুনিকতা মানে স্বনির্ভর হওয়া, স্বামী বা বাবার কাছ থেকে ভিক্ষা করে টাকা ওড়ানো নয়। অত্যাচারী স্বামীর অপমান সহ্য করেও তার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো নয়। স্বামীর অপমানের ভাত না খেয়ে নিজের রোজগারের ওপর নির্ভর করা পরাধীনতা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। যা আমি করেছি আমি, একজন স্বনির্ভর মহিলা একটা সরকারি কলেজে পড়া তোমার আধুনিক বাবা আর ঠাকুমার এই হুকুমটা মেনে নিইনি। আমার চাকরি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে আমার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তার প্রতিবাদ করা। আমি নিজের রোজগারের ভাত খেয়েও তোমার ঠাকুমার শেষ অবধি তাঁর সেবা করে গেছি। আমার মানবিকতার বোধ থেকে একে আধুনিকতা বলে।’
    -‘মা, প্লিজ আমার বাবা আমায় যুগপোযোগী করে গড়ে তুলছেন। তুমি এই যুগের সাথে পরিচিত নও। তুমি তোমার পুরানো ধ্যান ধারণা নিয়ে থাকো আমায় জ্ঞান দিওনা।’
    -‘তোমার যুগের আধুনিকতা কি বাবার কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা হাতখরচ ভিক্ষা করে নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা করা? এরপর একদিন যদি খবরের কাগজের হেডিংয়ে তোমাদের নাম দেখা যায় অমুক শিল্পপতির মেয়ে মদ্যপ অবস্থায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরছিল। সে সময় — কিছু সমাজবিরোধী তার ইজ্জত লুটে নিয়ে তাকে মাঝপথে ফেলে দিয়ে গেছে তখন তোমার এই উচ্ছৃঙ্খল আধুনিকতার দাম দিতে পারবে তো?’
    -‘,মা প্লিজ আমি খুব টায়ার্ড তুমি প্লিজ এখন যাও তোমার কলেজের স্টুডেন্টদের লেকচার দিও, আমাকে নয়।’
    ধরিত্রী দেবী চলে আসেন তাঁর ঘরে। ভাবেন এ কোন পথে যাচ্ছে তাঁর একমাত্র আত্মজা? কি এর পরিণতি উচ্ছৃঙ্খল বাপের রক্তটাই বইছে ওর ধমনীতে! এর থেকে তাকে মুক্ত করা কি সম্ভব?
    এর বেশ কয়েকমাস পরে একদিন খবরের কাগজ দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী এতো তাড়াতাড়ি ফলে যাবে ভাবতেই পারেন নি।
    তাঁর দু’চোখে জলের ধারা তিনি যে মা! এ সত্যটা অস্বীকার করবেন কি করে? তিনিও তো ব্যার্থ হয়েছেন মেয়েকে এই উচ্ছৃঙ্খল আধুনিকতার শিকার থেকে মুক্ত করতে।এ দায় তিনি এড়াবেন কি করে?’
    ছুটে যান নার্সিংহোমে। স্তব্ধ মেয়ের মাথায় হাত রেখে হাত রাখতেই, সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মা তার মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘কিছু হয়নি। এটা একটা দুর্ঘটনা, সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছো। এবার থেকে জীবনের চলার পথটা বদলে ফেল সত্যি আধুনিক হও মনে প্রাণে আধুনিক কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হয়োনা।’
    বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর স্বামী দাঁড়িয়ে আছে, তাঁকে দেখে হাতজোড় করে বললেন- আমায় ক্ষমা করো। এবার থেকে মেয়ের ভার তুমি নাও আমি হেরে গেলাম..’
    -‘সে তো নেবো। মায়ের দায়িত্ব তো অস্বীকার করতে পারিনা। সেটা আমার আধুনিকতায় বলেনা। ওকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনাটাই আমার দায়িত্ব। তা আমি করবো। সে তুমি বললে বা না বললেও করবো।’
    -‘আর আমায় ক্ষমা করতে পারবে?’
    -‘না, পারবো না। ইচ্ছাকৃত অপমান আর অত্যাচারী স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে আমি অপারক নিজেকে অসম্মানিত হতে দিতে পারবোনা এটা আমার আধুনিকতা।’

  • কবিতা

    বন্ধু আমি ভালো আছি

    বন্ধু আমি ভালো আছি
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    বন্ধু ভেবেছিলাম তুমি হারিয়ে গেছ অনেকদূরে —
    তোমার জীবন খাতা থেকে হয়তো বা আমার অস্তিত্বটাই মুছে গেছে–
    প্রথম যৌবনের উচ্ছলতায় ভালোবেসে ছিলে এক বেকার কবিকে–
    কবিতা লেখা যার নেশা — চায়না কোনো বন্দী অফিসের বাবু হয়ে থেকে নিজের অস্তিত্বকে গলা টিপে মেরে ফেলতে-
    তাইতো তুমি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলে নিশ্চিত সংসারে জীবনের দিকে–
    ইঞ্জিনিয়ার বর তোমার– কে না চায় একটা সুন্দর সংসার?
    না না আমি তোমায় দোষ দিচ্ছিনা–
    কে বা চায় বল পয়সাওলা ইঞ্জিনিয়ার বরের আকর্ষণ ছেড়ে এক কবিতা পাগল মনের সাথে নিজেকে জড়াতে–
    তাই তুমিও এক নিমেষে সে বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে পারি দিলে সাগর পার হয়ে বিদেশের মাটিতে–
    কবির সাথে প্রেম করা যায়, তার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা যায়– ফাগুন পূর্ণিমার রাতে তার দেওয়া পলাশের মালা খোঁপায় জড়ানো যায়–
    কিন্তু ঘর বাঁধা –? না তা কি সম্ভব —
    ভালোই হয়েছে — এত দুঃখ দিয়েছিলেন বলে
    আমার সৃষ্টির দরজা খুলে গেছে অনন্ত প্রকৃতির কাছে–
    নিত্য নতুন সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই ভুলে থাকতে চাই আমার স্মৃতিকে– আমার প্রেমকে, আমার বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাকে–।
    তাহলে এতদিন পর আবার কেন চিঠি লিখলে বন্ধু?
    তোমার চিঠি হাতে নিয়ে আমি বসে আছি নিঃসঙ্গ নিঃশব্দ বারনদায়– ভাদরের বৃষ্টি ঝরছে– সুন্দর একটা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে —
    চিঠিটা খুলতে ভয় পাচ্ছি —
    এলোমেলো ভাবনারা মনকে জুড়ে বসে আছে —
    চিঠিটা খুললে যদি আমার এতদিনের সৃষ্টি সব কবিতা ছন্দ হারিয়ে ফেলে?
    তবে আমি কি নিয়ে বাঁচব?
    অনেকদিনের ভালোবাসার ফুলটা যে এখনও ফুটে আছে হৃদয়ের অন্তরালে সঙ্গোপনে –
    যা আমি নিভৃতে নীরবে জলের ছিটে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি– সেটুকুও কি কেড়ে নেবে বলে এই চিঠি দিলে বারো বছর পর–?
    তবু চিঠিটা খুলে ফেললাম —
    একি? এ কি লিখেছ বন্ধু?
    তুমি ভালো নেই — কেন? ভালো থাকার জন্যেই তো তুমি একদিন আমাদের ভালোবাসাকে দুহাতে সরিয়ে ছুটে গিয়েছিলে নিশ্চিত সংসারের আশ্রয়ে –
    তবে কেন আজ তুমি ভালো নেই বন্ধু?
    তুমি লিখেছ– আমি নাকি এখন আমি অনেক বড় কবি–
    তাই? আমি জানিনা তো আমি কখন এত বড় কবি হয়ে গেলাম?
    তুমি ভালো থাকবে শুধু আমার কবিতার মধ্যে –
    তাই আবার ফিরে আসতে চাও ছিঁড়ে ফেলা ভালোবাসার সুতোটা বাঁধতে–
    তা কি আর হয় বন্ধু? যা ছিঁড়ে যায় তা ছিঁড়েই যায়, তাকে কি আর বাঁধা যায়-?
    মাঝখানে যে বড় গিঁট থেকে যাবে– সে গিঁট তো আর খোলা যাবেনা বন্ধু —
    তুমি ভালো থাকো তোমার মতন করে–
    আর আমি?
    আমি তো ভালোই আছি–
    হ্যাঁ ভালোই আছি–
    নিত্য প্রবাহমান নদীর মতন আমি বয়ে যাই —
    প্রতিদিনের নতুন ভোরের আলোয় আমি জেগে উঠি–
    নিত্যনতুন পাখীরা আমার প্রতিদিনের সঙ্গী —
    আমি ভালোই আছি–
    আমার মন এখন যাযাবর–
    ছুটে বেড়াই পাহাড় থেকে পারাবারে চখাচখির মেলায়-
    দিক থেকে দিগন্তরের আকাশ – সবুজের মিলনপ্রান্তে —
    নদী থেকে সরবরের মাছরাঙা আর গাঙচিলের আলিন্দে–
    প্রতিদিনের ফুটে ওঠা লাল পলাশের বনে বনে–
    আমি যে আর কোনো বন্ধনে বাঁধা পরতে পারবোনা বন্ধু —
    তাই বলছি আবারও তুমি ভালো থেকো —
    আমি তো ভালোই আছি–।।

  • গল্প

    আমরা বাঙালী

    আমরা বাঙালী 
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    আজ মহাষ্টমী, অয়ন্তিকা অঞ্জলি দিয়ে আসার সাথে সাথে তার শাশুড়ি মা তাকে বললেন চা করো তো তাড়াতাড়ি ! রূপুটা একদম উপোস করে থাকতে পারেনা। লুচিগুলোও ভাজতে আরম্ভ করতে হবে! অয়ন্তিকারও খুব খিদে পেয়েছিল  কিন্তু কি করবে এটা শ্বশুরবাড়ি। মা বলে দিয়েছিলেন, সব মানিয়ে নিতে হয়। সে চায়ের জল একদিকে বসিয়ে, অন্যদিকে লুচির কড়াই বসিয়ে দিল।  কমলা মাসী বলল, আমি লুচি বেলে দিচ্ছি।

    ভাগ্যিস অভ্র এখন বাড়ি নেই! সে থাকলে ঠিক প্রতিবাদ করতো মায়ের এই ব্যাবহারের। অভ্রের ভালোবাসার জন্যেই হয়তো সে সব মানিয়ে নেয়। পুজোর দিনে অশান্তি হতো একটা, শান্তিপ্রিয় অয়ন্তিকা তা চায়না।
    সবাইকে চা আর লুচি ভেজে দিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিল খাবার টেবিলে। ওর শ্বশুরমশাই বললেন- তুমি এবার নাও মা! তোমারটা না আনলে আমি খেতে পাচ্ছিনা।
    শাশুড়ি মা বললেন- এ আবার কি আদিখ্যেতা?
    – আদিখ্যেতা নয় এটা মানবিকতা। তোমার মেয়ে যেমন না খেয়ে থাকতে পারেনা, তেমন এই মেয়েটাও কিন্তু না খেয়েই কাজ করে যাচ্ছে।
    অয়ন্তিকা তাড়াতাড়ি বলল- বাবা আমি ঠিক আছি আপনি খান। আমি বসছি এখুনি!
    ওদের খাওয়া শেষ হতে না হতেই অয়ন্তিকার স্কুলের জীবনের বন্ধু নাজমা এলো, বিয়ের সময় আসতে পারেনি তাই। হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে।
    অয়ন্তিকা পরিচয় করিয়ে দিতেই নাজমা প্রণাম করতে গেল।শাশুড়ি দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন- থাক থাক!

    আগে মিষ্টির বাক্সটা হাতে নিয়েছিলেন পরে সেটা অচ্ছুতের মতো ফেলে দিলেন টেবিলের ওপর।
    নাজমাকে ঘরে এনে বসানোর পর নাজমা বলল- আমি আজ যাইরে, বুঝতে পারছি তোর অবস্থা!  পরে একদিন বাইরে কোথাও দেখা করবো।

    অয়ন্তিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল- আজকের দিনে কিছু না মুখে দিয়েই চলে যাবি?
    – না রে আর এখানে কিছু খাবোনা! যখন বাপেরবড়ি যাবি আমায় খবর দিস, মাসীমার হাতে নারকোল নাড়ু খেয়ে আসবো। জলভরা চোখে সে প্রাণের বন্ধুকে বিদায় জানালো।
    সেদিনই বেড়াতে বেরিয়ে রূপু পরে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত পায়। অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে।  হাসপাতাল থেকে বলল- এখুনি ব্লাডের দরকার! কিন্তু ‘ও’ পজিটিভ ব্লাড এখানে নেই। পুজোর সময় কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।
    অভ্র হতাশ হয়ে পড়ল- কি করা যাবে এবার?
    অয়ন্তিকার হঠাৎ নাজমার কথা মনে পড়ল! নাজমা কয়েকটা এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত।
    অয়ন্তিকার ফোন পেয়ে নাজমা ছুটতে ছুটতে এলো,ডঃ কে গিয়ে বলল- আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ ডাক্তার  আপনি ইমিডিয়েট রক্ত দিতে শুরু করুন।
    নাজমার দেওয়া রক্তে অবশেষে রূপুর প্রাণ রক্ষা পায়।
    রক্ত দিয়ে নাজমা যখন বেরিয়ে আসছে, তখন অভ্র তাড়াতাড়ি এসে বলে – আপনি চলুন আগে কিছু খাইয়ে আনি! আপনি তো টলছেন!

    নাজমা বলল- এখানে অবশ্য খাওয়ালে ছোঁয়া ঠেকার ব্যাপারটা থাকেনা।
    অভ্র হাতজোড় করে বলে- দেখুন আমার মায়ের হয়ে আমি আপনার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি! আমি বাড়িতে থাকলে আপনাকে এত অপমানিত হতে হতো না।
    — আচ্ছা আচ্ছা চলুন খাওয়াবেন বললেন যে?
    – হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন – এই অয়ি এসো–
    অয়ন্তিকা ইতস্তত করে বলল- বাবা মা!
    – আরে তোমাকে আসতে বললাম এসো না! সবসময় সবার কথা ভাবলে হয়না, কখনও কখনও নিজের কথাও ভাবতে হয়। ওঁরা খেয়ে নেবেন। কিন্তু ইনি সবে রক্ত দিয়ে এসেছেন! এঁর খাওয়াটা অনেক বেশি জরুরি।
    খাওয়ার পর বেরিয়ে আসার সময় অভ্র বাবা মায়ের জন্যে কিছু কিনে নিল।
    ওদের আসতে দেখে অয়ন্তিকার শাশুড়ি এগিয়ে এসে নাজমার হাতদুটো ধরে বলল- তোমার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবনা!
    – কিছু শোধ পাওয়ার জন্য আমি কিছু করিনি মাসীমা! একজন মানুষকে বাঁচানো আমার কর্তব্য বলে মনে করি তাই করেছি।
    অয়ন্তিকার শ্বশুর মশাই এগিয়ে এসে বললেন – আজ কিন্তু ওর রক্ত আর রূপুর রক্ত মিলেমিশে গেল! আসলে কি বল তো? মানুষের রক্তের রঙ একটাই হয়, আর সে রঙটা লাল!
    মা জানো আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের জন্মদিন পালন করি, তাঁদের গান গাই, কবিতা বলি। সবই আসলে একটা হুজুকে দাঁড়িয়ে গেছে। সবার বলতে ভালো লাগে আমার পঁচিশে বৈশাখ অমুক জায়গায় প্রোগ্রাম আছে, ওখানে আমায় গানে গাইবার জন্য ডেকেছে! কিন্তু তাঁদের আসল যে মূল্যবোধ, তাঁদের জীবনের যে দর্শন আমাদের দিয়ে গেছেন  যা হল মানবিকতা বোধ। মানুষের একটাই ধর্ম, যা হল মানবিকতার ধর্ম। তা আমরা ক’জন জানি বা মানি তা হাতে গোনা যায়, এই হল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই বলে গেছেন,”বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন, বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন-
    “এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান”।।

  • কবিতা

    ভালোবাসা কারে কয়

    ভালোবাসা কারে কয়
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

    কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো এসেছিলে আমার জীবনে–
    বঞ্চিত জীবন অঙ্গনে তুমি ছিলে এক ঝলক বসন্তের ফাগুন রাঙা আকাশ —
    আমার শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিধারা–
    আমার শরত আঙিনায় একমুঠো শিউলি?
    ভেসে গিয়েছিলাম জোয়ারের স্রোতে তোমার সাথে–
    মানতে পারিনি সমাজের বাধানিষেধ —
    সব প্রাচীর ডিঙিয়ে হাত ধরেছিলাম তোমার —
    কখন যে হাতটা ছেড়ে গেলে — বন্ধন কেটে গেল–
    জানতে পারলাম না–।
    বুঝলাম যা আমার নয় তা দূরে থাকাই ভালো–
    দুটো নদী সমান্তরাল পথে বয়ে যেতে পারে–
    একই মোহনায় মিশে যায়না–
    রেখে যায় ভাঙা নদীর পারে কিছু বিচ্ছিন্ন স্মৃতির টুকরো –।
    অসহায় অবসাদগ্রস্থ মন আকুল হয়ে খুঁজে বেড়ায় ভালোবাসার আশ্রয় —
    দিনশেষে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বসে পড়ে চেনা গাছের ছায়াটায়–।
    সেই যদি ফিরে আসতেই হয় চেনা গাছের ছায়ায় তাহলে মিথ্যা ভালোবাসার প্রবঞ্চনায়
    ক্ষণিকের এই মোহতে জীবনে অবাঞ্ছিত আবর্জনা এনে কি লাভ?
    এর উত্তর জানা নেই —
    মানুষ ভালোবাসার চায়–
    ভালোবাসাহীন জীবনের মরুভূমিতে একটু জলের রেখা দেখলেই প্রবল তৃষ্ণায় ছুটে যায়–
    কিন্তু ওই যে কবির সেই বিখ্যাত গানের লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয়-
    -“ভালোবাসা কারে কয়— একি কেবলই যাতনাময়”।।

  • কবিতা

    শেষ উপহার

    শেষ উপহার
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    একলা শ্রাবণ রাতে মনে পরে অনেক কথা–
    লেখা আছে সেই কথা পুরানো ডায়েরির পাতায়–
    ডায়েরিটা হয়েছে জীর্ণ —
    পাতাগুলো মলিন ধূসর —
    তবু লেখাগুলো যায়নি মুছে–
    ছেঁড়া ছেঁড়া পাতায় তারা আজও রয়ে গেছে–
    শ্রাবণের স্মৃতি রোমান্থনে আজও আছে বেঁচে
    ছেঁড়া ডায়েরির পাতার কোণে–
    হয়তো একদিন যাবে ছিঁড়ে
    ডায়েরির পাতাগুলো যাবে উড়ে সময়ের ঝড়ে।
    কে যেন কবিতা শোনাত সেদিন–
    সেই স্বর এখনও রয়েছে কানে–
    সে কি ভুলে গেছে সেই কবিতার স্মৃতি –?
    সে কি জানে দীর্ঘ বিচ্ছেদে আমি হারিয়ে
    গেছিলাম বিস্মৃতির অন্ধকারে —
    ডিপ্রেশনের কালো পর্দা সরিয়ে
    আবার এসেছি ফিরে নিজের সত্তাকে পেয়েছি খুঁজে হৃদয়ের গভীর অন্দর থেকে–
    লিখে চলি কবিতা একলা আনমনে–
    শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে যায় মন–
    ভুলে যায় মন বিচ্ছেদ বেদনার রঙ–।
    সেকি জানে আমার কবিতা আজ কণ্ঠে নেয় বহু কবিতা প্রেমিক–?
    সে কি জানে অজান্তে এ তারই দান–
    তারই দেওয়া বিচ্ছেদ বেদনায়
    কলম আমার লিখে চলে কবিতা–।
    শেষ অনুরোধ যদি রাখি তার কাছে সে কি রাখবে
    শ্রাবণের শেষ অনুরোধ আমার–?
    একদিন এমনই শ্রাবণের ঘন বর্ষায়
    নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে যাকে বলেছিল
    আমি তোমায় ভালোবাসি–।
    শেষ অনুরোধ আমার এই শ্রাবণের
    যদি সে কণ্ঠে নেয় আমারই লেখা একটি কবিতা–
    এই হবে তার কাছ থেকে পাওয়া আমার প্রথম এবং শেষ উপহার।।

You cannot copy content of this page