-
গল্প- অশুভ যাত্রা
অশুভ যাত্রা
– বিশ্বদীপ মুখার্জীখবরের কাগজে প্রকাশিত রাশিফলে আমার বিশ্বাস নেই। তাও অভ্যাসবশত রোজ একবার দেখেই নিই। আজ সকালে উঠে দেখলাম আমার রাশির নিচে লেখা আছে- যাত্রা শুভ নয়। এক্ষেত্রে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, আজ আমাকে বেরোতেই হবে। অফিসের কাজে যেতে হবে ভুবনেশ্বর। রাতের ট্রেনে টিকিট, হাওড়া থেকে। তবে যাত্রার বিষয় কোনও অশুভ খবর যদি শুনে বা পড়ে নেওয়া হয়, তাহলে মনটা খুঁতখুঁত করে বৈকি। আমারও করছিল। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাকে যেতেই হবে।
সারা দিন কাজের ব্যস্ততার মাঝে সকালে পড়া খবরের বিষয় বেমালুম ভুলে গেলাম। সন্ধ্যাতে বাড়ি ফিরে, ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম হাওড়া স্টেশনের দিকে। থার্ড এ.সি-তে টিকিট ছিল। গিয়ে বসে পড়লাম নিজের সিটে। আশেপাশের সহযাত্রীদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার। যথা সময় ট্রেন ছাড়লো। শুতে এখনও প্রায় ঘন্টা খানেক দেরি। তাই সময় কাটানোর জন্য একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।তখন হয়তো প্রায় মধ্যরাত। আমি শুয়েছিলাম আপার বার্থে। বিকট ঝাঁকুনি এবং বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। ঝাঁকুনির কারণে আপার বার্থ থেকে সজোরে পড়লাম নিচে এসে। কপালে, হাতে, পায়ে যে আঘাত লাগলো সেটা বলাই বাহুল্য। যতক্ষণে নিজেকে সামলাবো, আরও দু’ চারজন পড়লো আমার ঘাড়ে এসে। কম্পার্টমেন্টে জ্বলছিল নাইট বাল্ব। তাই কে কোথায় আছে সেটা বোঝা কঠিন। মানুষের চিৎকার, কান্না ভেসে এলো কানে। আমার উপর যে দু’ তিনজন পড়েছিলেন তাদেরকে ঝাঁকিয়ে দেখলাম। কোনও সাড়া শব্দ পেলাম না। তারা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, কি তাদের নিথর দেহকে আমি ঝাঁকিয়ে চলেছি, বুঝতে পারলাম না। বুঝবার মতো সময়ও ছিল না আমার কাছে। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। শুধু অ্যাক্সিডেন্ট বললে ভুল বলা হবে, বিকট অ্যাক্সিডেন্ট। তাও আমি বেঁচে আছি? বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম। না, আমি জীবিত, এখন পর্যন্ত মৃত্যু আমায় আলিঙ্গন করতে পারেনি। কপালের চোটটা বেশ গভীর, সেখান থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষয় হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে বাঁধলাম। কোনও ক্রমে নিজের পিঠের ব্যাগ খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। যাক গে.. কী বা ছিল ওতে? কিছু জামা প্যান্ট আর কিছু টুকটাক জিনিস। প্রাণে বেঁচে গেছি, এটাই কি কম? কম্পার্টমেন্ট থেকে বাইরে বেরোবার জন্য জানালা ভাঙ্গতে হলো না। বেশ কিছু জানালার কাঁচ ভেঙ্গে প্রায় গুঁড়া হয়ে গেছে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে জীবিত লোকেরা বেরোচ্ছে বাইরে। তাদের মধ্যে বহুজনের কন্ঠে এখনও চিৎকার, আর্তনাদ। তাদের সাথে সাথে আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। দু’ পাশে খোলা মাঠ, মাঝে পড়ে আছে লাইনচ্যুত আমাদের ট্রেন। সময় দেখবার জন্য প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গেলাম। কিন্তু পেলাম না। মোবাইল হয়তো সেই কম্পার্টমেন্টেই পড়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্যুৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো এই বীভৎস দুর্ঘটনার ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমার চারিপাশে হাহুতাশ করা লোকেদের ভিড়। ঈশ্বরই জানেন কখন সাহায্যের হাত এগিয়ে আসবে এদের দিকে। এই খোলা মাঠে বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। যে কোনও মুহূর্তে ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে পারে। কোনও আশ্রয়ের আশায় গুটিগুটি পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম অজানা গন্তব্যের দিকে। কপালে বাঁধা রুমালটা এতক্ষণে রক্তে পুরো ভিজে গেছে। হাতে, পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা, সাথে অল্প মাথাও ঘুরছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তাও হেঁটে যাচ্ছি মনের জোরে। বেশ কিছুটা এগোবার পর ছোট এক ভাঙ্গা পোড়ো বাড়ি পেলাম। বিদ্যুতের আলোর কারণে বাড়িটা চোখে পড়লো আমার। সোজা এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। মানুষ বলতে বাড়িতে কেউ নেই। কোনও রকম বিষাক্ত সরীসৃপ আছে কি না, সেটা বলা সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে প্রার্থনা করলাম, এতবড় দুর্ঘটনার হাত থেকে যখন জীবন রক্ষা করেছ, তখন কোনও সরীসৃপের দংশনে প্রাণ নিও না। কোনও রকমে সেখানে বসে ভোরের অপেক্ষা করা শুরু করলাম।
ভোরের আলো যখন অল্প অল্প ফুটতে শুরু করেছে ঠিক তখনই নিজের পাশ থেকে একজনের গলার আওয়াজ পেলাম।
‘এত রাতে আপনি এই বাড়িটা খুঁজে পেলেন?’
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। একজন এগিয়ে এলো আমার দিকে। দেখে মনে হলো বয়স আমারই মতো হবে। তবে মাথায় চুল কম, মুখটা একটু গোল। তারও মাথা ফাটা, অঝোরে রক্ত ঝরে যাচ্ছে সেখান থেকে। আমার পাশে এসে বসলো সে। আমায় বলল – ‘সারা রাত আমি খোলা মাঠেই বসে রইলাম। ভিজলাম বৃষ্টিতে।’
তার জমা কাপড় যে পুরো ভেজা সেটা আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম।
আমি বললাম – ‘আকাশের অবস্থা দেখে বুঝে গিয়েছিলাম যে বৃষ্টি হবে। এক নিরাপদ আশ্রয় দরকার ছিল। তাই পায়ে ব্যথা নিয়েও কোনও রকমে এগিয়ে এলাম।’
‘আর নিরাপদ! কপাল যদি নিরাপদের মানে বুঝতো তাহলে এতবড় কান্ড ঘটতো না।’ ভদ্রলোক বললেন আমায়।
‘আপনি কপালে কিছু বাঁধেননি কেন? অনেক রক্ত বেরোচ্ছে তো।’
আমার কথায় মুচকি হেসে তিনি বললেন – ‘আপনি তো মাথায় রুমাল বেঁধে আছেন। তাও তো রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।’
ঠিকই বলেছে সে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে। শরীরটা খুবই দুর্বল লাগছে। কতক্ষণ এই অবস্থায় থাকতে পারবো জানি না। এত রক্ত বেরোবার পরেও আমি জ্ঞানহীন কেন হয়ে যাইনি সেটাই রহস্য।
সেই লোকটা বলল – ‘আমার নাম প্রভাত মাঝি। বাড়ি কোলকাতার শ্যামবাজারে। ভাড়া বাড়ি। বাড়িতে আমার বৌ আর দু’ বছরের এক ছেলে আছে। শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ে একটা বড় ওষুধের দোকান আছে, ‘নিউ লাইফ মেডিক্যাল হল’। সেখানেই সেলসম্যানের কাজ করি। এক দরকারি কাজে পুরী যাচ্ছিলাম। একাই। টিকিট পাইনি, তাই জেনারাল কম্পার্টমেন্টেই যাচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ এই ঘটনা ঘটে গেল।’
আমি বেশি কথা বলতে পারছিলাম না। শরীরটা খুবই দুর্বল লাগছিল। ডান দিকে ঘাড় ঘোরাতে দেখলাম, সারা মাঠে লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকেরা চলে এসেছে। আলোও ফুটে গেছে বেশ ভালোই। বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই, আকাশের মুখ কিন্তু এখনও ভার।
‘আসি আমি।’ কথাটা বলে প্রভাত বাবু চলে গেলেন।
কোথায় গেলেন সেটা খেয়াল করলাম না আমি। অতি শীঘ্রই আমার নিজের চিকিৎসার দরকার ছিল। কোনও ক্রমে এগোলাম মাঠের দিকে। ট্রেনের দুর্দশা দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। বেশ কিছু কম্পার্টমেন্ট একে অপরের ঘাড়ে চড়ে আছে। কম্পার্টমেন্টের ভিতর থেকে মৃত দেহ বের করার কাজ চলছে। আশেপাশে বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সও চোখে পড়লো আমার। হঠাৎ দেখলাম দু’ চারজন ছুটে এলো আমার দিকে।
‘আপনি এখানে কী করছেন। আপনার তো দেখছি ভালোই চোট লেগেছে। তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সে উঠুন।’
আমাকে নিয়ে ওরা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাতে যাবে ঠিক সে সময় দেখলাম এক জেনারাল কম্পার্টমেন্ট থেকে বের করা হলো এক মৃত দেহকে। দূরত্ব আমার থেকে খুব বেশি হলে দশ হাত। মৃত দেহ দেখে আমি অবাক। মৃত দেহকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আমার সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সে দিকে। এত…. এত…. প্রভাত মাঝি। শরীর এমনিতেই দুর্বল ছিল অত্যধিক রক্তক্ষয়ের কারণে, জ্ঞানশূন্য হওয়ার জন্য প্রভাত মাঝিকে মৃত অবস্থায় দেখাটা যথেষ্ট ছিল।জ্ঞান ফিরল এক সরকারি হাসপাতালে। মাথায় পট্টি বাঁধা আমার। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলাম, সকাল দশটা বাজে। কিছু চিন্তা করার আগেই প্রভাত মাঝির চেহারাটা আমার মুখের সামনে ভেসে উঠল। জীবন্ত আর মৃত চেহারা। তাহলে কি প্রভাত মাঝি দুর্ঘটনার পরেই মারা গিয়েছিলেন? তাহলে আমার সাথে কথা বলল কে? কেই বা আমাকে তার ঠিকানাটা দিলো? হঠাৎ আমার শিড়দাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। যেটা আমি ভাবছি, সেটা কি সত্যি? সে নিজের ঠিকানা আমায় দিতে এসেছিল, যেন আমি তার মৃত্যুর খবর তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারি? আমিই কেন? সেখানে তো আরও অনেকেই ছিল। এই প্রশ্নের জবাব হয়তো আমি কোনও দিন পাবো না। কিন্তু শ্যামবাজারে আমি তার বাড়ি পাবো কী করে? হঠাৎ মনে পড়লো ‘নিউ লাইফ মেডিক্যাল হলে’র কথা। সেখানে খবর দিলে তার বাড়ির লোকেরা খবর পেয়ে যেতে পারে। না, আমাকে যেতেই হবে শ্যামবাজার।
কিছু অবাস্তব ঘটনা যখন নিজের সাথে ঘটে, তার রেশ প্রায় সারা জীবন থেকেই যায়। এই ঘটনাটা আমি হয়তো কোনও দিন ভুলবো না। এই দুর্ঘটনার ফলে খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘রাশিফলে’ কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
সমাপ্ত।
-
অণুগল্প- নবজাত
নবজাত
– বিশ্বদীপ মুখার্জীকাজের মাসিকে বদলেছি কিছু মাস হলো। নতুন কাজের মাসি বেশি কথা বলে না। সব সময় মুখে অদ্ভুত বিষণ্ণতার ছাপ। কারণটা জানতে পারলাম মাসির মুখেই। কারণ জেনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। মাসির ধর্ষিতা মেয়ে নাকি মা হয়েছে। জন্ম দিয়েছে এক কন্যা শিশুকে। তারপর থেকেই শুরু হয় গ্রামের লোকেদের উৎপাত। সেই শিশুটিকে নাকি বিক্রি করে দিতে হবে। খদ্দেরও নাকি আছে। দাম রাখা হয়েছে কুড়ি হাজার। সেই শিশুটি পাপ। গ্রামে থাকলে গ্রামের অকল্যাণ হবে। তাই তাকে সেই গ্রাম থেকে চিরবিদায় দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদি শিশুটিকে গ্রাম থেকে বিদায় না করা হয়, তাহলে সমস্ত পরিবারকে সেই গ্রাম ত্যাগ করতে হবে। পরিবার বলতে মাসি, তার স্বামী এবং তার ধর্ষিতা মেয়ে। তাহলে সেই ছোট্ট শিশুটির ভবিষ্যৎ কী হবে? কোনও নিষিদ্ধ পল্লী? বড় হয়ে নিজের শরীর বেচে পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে তাকে? তারপর হয়তো তার অজানা বাপ কোনও দিন নিজের মেয়ের শরীরের সাথে খেলা করবে? সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল আমার। মাসি চলে যাওয়ার পর সারা রাত চিন্তা করলাম। পরের দিন মাসির হাতে টাকার মোটা অংক গুঁজে দিয়ে বললাম – ‘তুমি গ্রাম ছেড়ে দাও। সেই শিশুর ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতে। তার ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের।’
সমাপ্ত।
-
গল্প- মাতৃভাষা
মাতৃভাষা
– বিশ্বদীপ মুখার্জীআগেই বলে দিই, গল্পটা লেখার উদ্দেশ্য কোনও ভাষাকে অপমান করা নয়, বরং নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা। ভাষা নিজেই এত মহান হয় যার অপমান হতেই পারে না।
— — — — — — — — —জয়ন্ত সেই চেহারাটাকে খুব ভালো করে চিনতো। বেলঘরিয়া থেকে বিধাননগর রোড স্টেশন যাওয়ার সময় প্রায় রোজই তার সাথে দেখা হতো। না, কোনও দিনই তার সাথে কথা হয়নি। রোজ যাতায়াত করতে গিয়ে মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল আর কি। ছেলেটার বয়স আন্দাজ তিরিশের কাছাকাছি। মাথায় চুল কম, গায়ের রঙ বেশ ময়লা। বিধাননগর রোড স্টেশনে নেমে তাকে আর দেখতে পেতো না জয়ন্ত। হয়তো হারিয়ে যেত ভিড়ের মধ্যে।
জয়ন্তর বাড়ি নবদ্বীপে। রাস পূর্ণিমার উপলক্ষ্যে সে ছুটি নিয়েছে নিজের অফিস থেকে। ব্যান্ডেল স্টেশনে সে বসে আছে নবদ্বীপের ট্রেন ধরার জন্য। হঠাৎ একজন এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলো – ‘ভাই সাহেব, মিথিলা এক্সপ্রেস কিতনে নম্বর প্ল্যাটফর্ম পর আয়েগী?’
একটা বেঞ্চিতে বসে আছে জয়ন্ত। ঘাড় হেঁট করে একাগ্রচিত্তে দেখে যাচ্ছে নিজের মোবাইল। প্রশ্নটা কানে আসতে ঘাড় উঠিয়ে দেখলো সে। এ তো সেই ছেলে যাকে প্রায় বেলঘরিয়া স্টেশনে দেখে সে। সেই ছেলেটা হয়তো জয়ন্তকে চিনতে পারেনি। এর আগে কোনও দিন জয়ন্তকে লক্ষ্যই করেনি হয়তো।
ছেলেটা আবার সেই প্রশ্নটা করলো। জয়ন্ত একটু আগেই শুনেছে যে মিথিলা এক্সপ্রেস দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। কিন্তু সে চুপ করে থাকলো।
‘আপকো পতা হ্যায় য়া নেহি?’ ছেলেটা বেশ বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করলো এবার।
জয়ন্ত দেখলো তার হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ। মিথিলা এক্সপ্রেসে চড়ে কোথাও যাবে হয়তো।
‘নিজের পিছন দিকের প্ল্যাটফর্মে যান, গাড়ি ওখানেই আসবে।’ জয়ন্ত বলল তাকে।
‘মতলব? ম্যায় কুছ সমঝা নেহি।’ সে হয়তো বাংলা জানে না।
ইতিমধ্যেই ট্রেন ঢুকে গেছে প্ল্যাটফর্মে। জয়ন্তর পাশে একজন দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই উত্তর দিলেন – ‘মিথিলা এক্সপ্রেস দো নম্বর পর আ গয়ি হ্যায় ভাই সাহেব।’
ছেলেটা পিছন দিকে তাকালো। জয়ন্তকে এক অশ্রাব্য গাল দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়লো দু নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। জয়ন্ত পুনরায় নিজের মোবাইলে মনোনিবেশ করলো।
খানিক পর সেই ছেলেটিকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা ভদ্রলোকটি জয়ন্তর পাশে এসে বললেন – ‘আপনাদের মতো লোকেদের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের অন্য রাজ্যে এতো বদনাম।’
জয়ন্ত লোকটার দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল – ‘আমার নাম জয়ন্ত হালদার। আপনার?’
‘আমার নাম? আমার নাম জেনে কী করবেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আপনার উত্তরটা আপনাকে দেবো।’
‘আমার নাম বিপ্লব চক্রবর্তী।’ ভদ্রলোক নিজের নাম বললেন।
জয়ন্ত ভালো করে তাকে দেখলো। মাঝ বয়সী লোক। ভদ্র বাড়ির বলেই মনে হলো জয়ন্তর।
জয়ন্ত বলল – ‘আপনি তো বাঙালি। শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয় সেই ছেলেটিকে হিন্দীতে উত্তর দেওয়াটা ঠিক হতো? ছেলেটাকে আমি বহুবার দেখেছি। তার বাড়ি যেখানেই হোক না কেন, থাকে এখানেই। হয়তো কোলকাতায় কোথাও কাজ করে সে। সে আমাকে বাংলাতে প্রশ্নটা করতে পারলো না? এখানে থেকে কাজ করবে, অথচ এখানকার ভাষা শিখবে না। সেটা কি সম্ভব? দেখুন, আমি কোনও ভাষার অপমান করতে চাই না। ভাষা নিজেই এত মহান হয়, যার অপমান সম্ভব না। ব্যাপার হলো নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা। আমরা বাঙালি হয়ে যদি নিজের ভাষাকে বাঁচাবার চেষ্টা না করি, তাহলে কি অন্য কেউ করবে?’
খানিক বিরতি নিয়ে জয়ন্ত আবার বলল – ‘আপনি অন্য কোনও রাজ্যে গিয়ে বাংলাতে প্রশ্ন করুন তো.. জবাব পাবেন? এমন কি দক্ষিণ ভারতে নাকি কেউ হিন্দীতেও আপনাকে উত্তর দেবে না। কোনও এক মহাপুরুষ বলে গেছেন মশাই, “কোনও জাতিকে শেষ করতে গেলে সব থেকে আগে তার ভাষাকে শেষ করতে হয়”। আপনি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে আসুন। দেখবেন আস্তে আস্তে বাংলা ভাষা সেখান থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাকে জীবিত রাখার কর্তব্য শুধুমাত্র আমার নয়, আপনারাও, সমস্ত বাঙালির। নাতো সে দিন দূর নয় মশাই, যে দিন পশ্চিমবঙ্গে থেকে আমাদের অন্য ভাষায় কথা বলতে হবে। এখানে থাকতে গেলে অল্প হলেও বাংলা শিখতে হবে.. এই কথাটা কি খুব ভুল? যদি নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচাতে চান, তাহলে এগিয়ে আসুন, সাহসী পদক্ষেপ নিন। না হলে হারিয়ে যাবে আমাদের মাতৃভাষা, যার স্থান আমাদের জীবনে আমাদের মায়ের তুল্য। চলি, আমার ট্রেন আসছে।’
কথা শেষ করে জয়ন্ত নিজের ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। বিপ্লব চক্রবর্তী অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।সমাপ্ত।
-
গল্প- সে দিনের কথা
সে দিনের কথা
– বিশ্বদীপ মুখার্জীবিগত এক বছরে কুড়িজন লেখকের বই প্রকাশ করে ফেলেছে তিলোত্তমা প্রকাশনী। পাবলিশিং হাউস হিসেবে বেশ নাম ডাকও হয়েছে। এক বছর আগে অংশুমান এবং তার বন্ধু রুদ্র মিলে শুরু করেছিল ‘তিলোত্তমা প্রকাশনী’। তখন অংশুমান বলেছিল রুদ্রকে – ‘আমরা আজ পর্যন্ত নিজের কোনও একক বই প্রকাশ করতে পারলাম না রুদ্র। কারণ, আমাদের কাছে অর্থ নেই। আজকাল ভালো লেখার মূল্য কেউ দেয় না। যদি তোর কাছে টাকা থাকে, তাহলে নিজের লেখা বই আকারে নিজের হাতে দেখতে পাবি। সেল্ফ পাবলিশিংএর যুগ এটা।’
‘তাহলে কি আমাদের স্বপ্ন কোনও দিন পুরো হবে না?’ বিষাদে ভরা কন্ঠে রুদ্র জিজ্ঞাসা করেছিল।
খানিক চিন্তা করে অংশুমান বলেছিল – ‘হবে ভাই, হবে। তবে এখন না, একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। আগে অন্যের স্বপ্নপূরণ করে দিই, তার পর নিজেদের চিন্তা করবো।’
‘অন্যের স্বপ্নপূরণ মানে?’ ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি রুদ্র।
তখন তাকে নিজের প্ল্যানটা বুঝিয়েছিল অংশুমান। আজকের দিনে এমন বহুলোক আছে যারা টাকার বিনিময়ে নিজের লেখা বই আকারে দেখতে ইচ্ছুক। যুগটাও সেল্ফ পাবলিশিংএর। এটা একটা এমন ব্যবসা যাতে অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ করা যেতে পারে। বই প্রকাশ পাবে লেখকের টাকায়। প্রকাশকের জায়গায় নাম থাকবে অংশুমান আর রুদ্রর পাবলিশিং হাউসের। বই বিক্রি হলে লাভের অংশ বাড়বে, আর যদি নাই বিক্রি হয় তাহলেও চিন্তা করার বিশেষ কিছুই নেই। কারণ, যেখানে পুঁজি লাগেনি সেখানে চিন্তা থাকে না।
লেখকদের ভিড় উপচে পড়েছিল। কিন্তু এখানেও মাথা ঘামিয়ে কাজ করেছিল অংশুমান। সে গল্প নির্বাচন করতো। প্রত্যেক লেখকের গল্প প্রকাশ করা হতো না। অংশুমান গল্প বুঝতো ভালো। এমন গল্প সে প্রকাশ করার অনুমতি দিতো যে গুলোর বাজারে বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও থাকে। ভালো বই প্রকাশ পেতে থাকলো তিলোত্তমা প্রকাশনী থেকে।
‘টাকা থাকলেই যে আপনার বই আমরা প্রকাশ করে দেবো, এটা ভাববেন না। আগে ভালো লেখা লিখুন।’ বহু নতুন লেখক আছে যাদের অংশুমান এই একই কথা বলেছে।প্রথমবার কোনও বড় নাম করা লেখকের বই প্রকাশ করতে চলেছে তিলোত্তমা প্রকাশনী। দিব্যেন্দু বন্দোপাধ্যায় আজকের দিনে নাম করা লেখক। তাঁর নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে কোলকাতা প্রেস ক্লাবে। সকাল থেকে অনেক কাজ। বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু আজ কিছুতেই নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছে না অংশুমানের। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকালো সে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সে দিনও তো আকাশে মেঘ ছিল। হ্যাঁ, সে দিন। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। সে দিনের সকলটাও ঠিক এমনই ছিল। কিছু মাস হয়েছিল তিলোত্তমা প্রকাশনী কে লোকেরা চিনতে শুরু করেছিল। চার – পাঁচজন লেখকের বইও প্রকাশ করে ফেলেছিল তিলোত্তমা প্রকাশনী। সকালে ঘুম থেকে উঠে সামনের চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়েছিল অংশুমান। কেউ একজন তার পাশে এসে বসলো।
‘নমস্কার। আপনি কি অংশুমান ভট্টাচার্য? তিলোত্তমা প্রকাশনীর কর্ণধার?’
অংশুমান ভালো করে দেখলো লোকটাকে। মাঝ বয়সী লোক, এক মাথা কাঁচা – পাকা রুক্ষ চুল, গায়ের রঙ ময়লা বললেই চলে। পরনের জামাকাপড়ও যে খুব পরিস্কার তা নয়। এক নজর দেখে যে লোকটার প্রতি ভক্তি আসবে না মনে সেটা বলাই বাহুল্য। অংশুমানের মনেও কোনও প্রকারের ভক্তি জাগেনি লোকটাকে দেখে। রীতিমত ভ্রুকুটি করেই তাকালো তার দিকে। জবাব দিলো – ‘হ্যাঁ, আমি অংশুমান ভট্টাচার্য।’
লোকটা অকারণ দাঁত বের করে একগাল হাসলো। দাঁতের অবস্থা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অংশুমান।
‘আজ্ঞে, আমার নাম প্রফুল্ল সরকার। ওই টুকটাক লেখালিখি করি আর কি। আপনার নাম শুনেছি আর বেশ কিছু পত্রিকায় আপনার লেখাও পড়েছি। বেশ ভালো লেখেন আপনি।’
অংশুমান মুখ ঘুরিয়েই ‘ধন্যবাদ’ জ্ঞাপন করলো। লোকটার কাছে ছিল এক কাপড়ের ব্যাগ। সেটা থেকে এক মোটা রেজিস্টার খাতা বের করলো সে।
‘এতে আমার লেখা এক গল্প আছে। বলতে পারেন উপন্যাস। একবার পড়ে দেখতে পারেন।’
‘আপনি কি নিজের এই উপন্যাস কে প্রকাশিত করতে চান?’ জিজ্ঞাসা করলো অংশুমান।
হাসি মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল প্রফুল্ল সরকারের। শুকনো মুখেই বলল – ‘বেশ কিছু প্রকাশকের কাছ থেকে ঘুরে এলাম। সবাই তো টাকা নিয়ে বই ছাপায়। আমার কাছে টাকা নেই তাই কেউ গল্পটা পড়েও দেখলো না।’
‘আমরাও তাই করি সরকার বাবু।’ কথা শেষ করে চায়ের দাম মিটিয়ে এগিয়ে গেল অংশুমান।
‘আপনারা তো সাহিত্যিক মানুষ। লেখালিখি করেন। ভালো লেখার জন্য পড়ারও তো প্রয়োজন। আপনি না হয় পড়ার জন্যই নিয়ে যান।’
অংশুমান তাকালো প্রফুল্ল সরকারের দিকে।
‘অংশুমান বাবু, আমি আপনাকে বলছি না যে আমার গল্পটা প্রকাশ করুন। আমি অতি সাধারণ মানুষ। দিন আনি দিন খাই। টাকা দিয়ে বই ছাপানোর ক্ষমতা আমার নেই। আপনাদের মত দুয়েক জন যদি লেখাটা পড়ে ভালো বলে, তাহলে এতেই আমার শান্তি, এতেই আমার তৃপ্তি।’
অংশুমান আর কথা বাড়ায়নি। তাকে কাজে বেরোতে হবে। প্রফুল্ল সরকারের হাত থেকে রেজিস্টার খাতাটা নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।
চায়ের দোকানে অংশুমান রোজ সকালে যায়। কিন্তু তার পর থেকে কোনও দিন আর প্রফুল্ল সরকারের দেখা পায়নি সে।
‘কোথায় গেল লোকটা?’ মনে মনে ভাবতো অংশুমান।
প্রায় দু মাস পর সময় হলো অংশুমানের প্রফুল্ল সরকারের রেজিস্টার খাতাটা খুলে দেখার। অংশুমান আর রুদ্র যাচ্ছিল ছুটি কাটাতে রাজস্থান। ট্রেনে লম্বা যাত্রা। সাথে কোনও গল্পের বই থাকলে যাত্রাটা মন্দ কাটবে না। হঠাৎ প্রফুল্ল সরকারের কথা মনে পড়ল অংশুমানের। ছোট কোনও বইয়ের বদলে মোটা খাতাটাই ব্যাগে ঢোকালো অংশুমান। পড়তে শুরু করলো প্রফুল্ল সরকারের লেখা উপন্যাস ‘সে দিনের কথা’। না, রাজস্থান সফরে বিশেষ কোথাও ঘুরতে যায়নি অংশুমান। অধিকাংশ সময় হোটেলে বসে সেই উপন্যাসটা পড়ে যেত সে। যত পড়তো, ততই যেন গল্পের গভীরে ঢুকে যেত সে। অদ্ভুত সুন্দর লেখা। বেশ কিছু বই অংশুমান আর রুদ্র প্রকাশ করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই, কিন্তু এমন লেখা তারা কোনও দিন পায়নি। উপন্যাসটা মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেল অংশুমান। রাজস্থান থেকে ফেরার সময় খাতাটা রুদ্রের হাতে দিয়ে অংশুমান বলল – ‘এই উপন্যাসটা পড়ে দেখিস। আমরা যদি এই উপন্যাসকে না ছাপি তাহলে এর লেখকের সাথে অন্যায় করা হবে।’
‘এত মোটা উপন্যাস? কম করেও কুড়ি ফর্মার বই হবে।’ বলল রুদ্র।
‘হুম, তা হবে। কিন্তু লেখক টাকা দিতে পারবে না। লোকটা গরীব। স্মার্ট ফোনের যুগেও হাতে লেখে সে।’
‘কিন্তু এত ইনভেস্টমেন্ট করবে কে?’ রুদ্র জিজ্ঞাসা করলো।
‘আমরা করবো। গল্পটা দুর্দান্ত। ভালো চলবে মার্কেটে। এমন লোকেদের এগিয়ে নিয়ে আনা দরকার রুদ্র। পকেটে টাকা থাকলে আর হাতে কলম থাকলেই লেখক হওয়া যায় না। আজকাল সবাই এটাই ভেবে নিয়েছে যে পকেটে টাকা থাকলেই লেখক হওয়া যায়। যাই লিখুক, প্রকাশনীকে টাকা দিলেই তারা লেখা প্রকাশিত করে দেবে। আজকাল চারিদিকে এটাই হচ্ছে। লেখার মান দিনে দিনে পড়ে যাচ্ছে রুদ্র। আজকের দিনে প্রফুল্ল সরকারের মত লেখকেরা তলিয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। সাহিত্যকে রসাতলে যাওয়ার আগে বাঁচাতে হবে। প্রফুল্ল সরকারের মত লেখকদের এগিয়ে আনতে হবে।’
‘তার ফোন নম্বর আছে?’
‘না, তবে গল্পের শেষে তার ঠিকানা আছে। আমি সেই ঠিকানাতে যাবো।’গিয়েছিল অংশুমান। কোলকাতা ফিরে আসার পরের দিনই গিয়েছিল প্রফুল্ল সরকারের বাড়িতে। আগরপাড়ায় বাড়ি প্রফুল্ল সরকারের। ছোট একতলা বাড়ি। বাড়ি খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না অংশুমানের। এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা ছাড়া মাঝ বয়সী এক মহিলার সাথে দেখা হলো অংশুমানের। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এরা প্রফুল্ল সরকারের মা, বাবা এবং স্ত্রী। প্রফুল্ল সরকারের খোঁজ করতে তার স্ত্রী বলল – ‘আপনি কি তার বন্ধু?’
‘না, মানে আমি তার বন্ধু নয়। বেশ কিছু মাস আগে প্রফুল্ল বাবু আমার কাছে একটা গল্প নিয়ে আসেন। গল্পটা এত দিনে পড়ার সময় পেলাম আমি। সে বিষয়ে ওনার সাথে কথা ছিল আর কি।’ একটু ইতস্তত করে অংশুমান বলল।
‘আপনি কি অংশুমান বাবু?’ আবার প্রশ্ন করলো প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী।
প্রফুল্ল সরকার তার মানে নিজের বাড়িতে অংশুমানের বিষয় চর্চা করেছে।
‘হ্যাঁ, আমিই অংশুমান ভট্টাচার্য।’
অংশুমানকে ঘরে বসতে দিয়ে চা করে নিয়ে আনলো প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী। প্রফুল্ল বাবুর মা এবং বাবা কিছুই বলছেন না, শুধু অবাক নয়নে দেখে যাচ্ছেন অংশুমানকে।
প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী বলল – ‘অনেক দিন আপনার অপেক্ষা করেছিল। আমাকে বলতো যে গল্পটা যখন আপনি পড়তে নিয়েছেন তখন আপনার ভালো নিশ্চই লাগবে। আমরা অতি গরীব মানুষ বাবু। তার কাছে টাকা দিয়ে বই বের করার ক্ষমতা ছিল না। লেখা তার শখ ছিল। কাজ থেকে ফিরে এসে প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত লিখে যেত। এই নিয়ে আমার সাথে অশান্তিও কম হয়নি। শুধু বলতো, ”আমার গল্প এক না এক দিন কারোর না কারোর পছন্দ নিশ্চই হবে।” নিজের গল্পকে ছাপা অক্ষরে দেখতে কে না ভালোবাসে? বহু পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছে। সব জায়গায় টাকা চায়। কোথাও দেড় শো তো কোথাও দু শো। কোথাও কোথাও তো আবার বলতো যে দু তিনটে পত্রিকা নাকি কিনে নিতে হবে। ওতো ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের কাছে দেড় – দু শো টাকার মূল্য অনেক। সারা দিন মন খারাপ করে থাকতো সে। আপনাকে ওই লেখাটা দেওয়ার পর একটু আশা জেগেছিল তার মনে। চলা ফেরা খুব একটা বেশি করতে পারতো না। তাই আর যেতে পারেনি আপনার কাছে। আপনার অপেক্ষায় ছিল।’
ভিতর ঘর থেকে বেশ কিছু খাতা নিয়ে এলো প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী। সবগুলোতেই প্রফুল্ল সরকারের লেখা ছোট বড় গল্প। বেশ কিছু ছোট গল্প পড়ল অংশুমান। সত্যি, অপূর্ব লেখা। প্রফুল্ল বাবুর কলমে যেন জাদু আছে।
‘তিনি কোথায় এখন?’ অংশুমান জিজ্ঞাসা করলো।
খানিক চুপ থাকার পর মহিলাটি বলল – ‘সে আর নেই। একমাস হলো সে মারা গেছে।’
চমকে উঠল অংশুমান। নিজের কানে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
‘বহুদিনের অসুস্থ সে। কিডনী রোগে আক্রান্ত। তার ইচ্ছে ছিল যাওয়ার আগে যেন দেখে যেতে পারে তার লেখা কোনও বই বেরিয়েছে। তার শেষ ইচ্ছেটা আর পুরো হলো না।’
কথাটা বলে কেঁদে ফেলল প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী। অংশুমান অনুভব করলো নিজের চোখেও দু ফোঁটা জল।প্রায় এক বছর হয়ে গেল। আজ দিব্যেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের মত বিখ্যাত লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। তিলোত্তমা প্রকাশনীর জন্য আজকের দিনটা গর্বের। কিন্তু বিন্দুমাত্র গর্ব হচ্ছে না অংশুমানের। তার গর্ব তখন হতো যখন সে প্রফুল্ল সরকার কে এমন খ্যাতি দিতে পারতো। অংশুমান যদি ঠিক সময় সেই গল্পটা পড়তো তাহলে মৃত্যুর আগে একটা বই লিখেই নাম করতে পারতো সেই দরিদ্র লেখকটা। সে ছাপাবে, প্রফুল্ল সরকারের প্রতিটি গল্প সে প্রকাশ করবে। প্রফুল্ল সরকারের প্রতিটি বই তার মৃত্যুর পর প্রকাশ পাবে। তাকে এই কাজটা করতেই হবে। প্রফুল্ল সরকারের লেখাকে জনসমূহের সামনে আনতেই হবে। ‘সে দিনের কথা’ উপন্যাসটা সে প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী কে দিয়ে এসেছিল। সেটা ফেরত আনতে হবে।
নিজের বাড়ি থেকে বেরোল অংশুমান। তার গন্তব্য এখন প্রেস ক্লাব নয়, তার গন্তব্য এখন প্রফুল্ল সরকারের বাড়ি।সমাপ্ত।
-
কবিতা- শূন্য হৃদয়ের আর্তনাদ
শূন্য হৃদয়ের আর্তনাদ
– বিশ্বদীপ মুখার্জীজীবনটা হয়তো আরও ভালো হতে পারতো
পেতে পারতাম কারোর নিখুঁত ভালোবাসা,
যার দু’ চোখে দেখতাম নিজের ছবি
যার কোলে মাথা রেখে
তৃপ্তির গভীর সাগরে যেতাম ডুবে।
তার একটা নরম স্পর্শ
মনকে রোমাঞ্চিত করে তুলতো….
তার ভালোবাসাকে রাখতাম আঁকড়ে ধরে,
মনের গভীরে।
জীবনটা হলো মরুভূমি….
চারিদিকে ক্যাকটাসের কাঁটা
প্রতিনিয়ত হৃদয়ে করে গভীর ক্ষত,
ভালোবাসা মরীচিকার ন্যায়
দূর থেকে দেয় দর্শন….
কাছে গিয়ে শুধু শুনতে পাই
শূন্য হৃদয়ের আর্তনাদ।
এটাই হয়তো আমার নিয়তি….
দুর্ভাগ্য আমার নিয়তির সাথে আলিঙ্গনবদ্ধ। -
গল্প- ন্যুডিটি অফ ওয়ার
ন্যুডিটি অফ ওয়ার
– বিশ্বদীপ মুখার্জী১
দুপুর দু’টো। নিজের চেম্বার থেকে নিচে নেমে এলো ডক্টর সায়ন্তন গাঙ্গুলী। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের গাড়ির দিকে এগোলো ঠিকই, কিন্তু গাড়িতে বসলো না সে। কারোর অপেক্ষা করছে। সায়ন্তন খানিক পরেই দেখতে পেল মেঘনাকে। দ্রুত গতিতে মেঘনা এগিয়ে আসছে তার দিকে।
সায়ন্তনের কাছে এসে মেঘনা বলল – ‘সরি সায়ন্তন। দেরি হয়ে গেল। কাজ হয়ে গেছে?’
সায়ন্তন নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা খাম বের করে মেঘনার হাতে দিলো। খাম খুলে ভিতর থেকে একটা কাগজ বের করে ভালো করে পড়ার পর সেটাকে পুনরায় খামে ঢুকিয়ে হাসি মুখে সায়ন্তনকে বলল – ‘থ্যাংক ইউ সায়ন্তন। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
সায়ন্তনের মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত কন্ঠে সে বলল – ‘একবার ভালো করে, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে হতো না, মেঘনা?’
‘অনেক চিন্তা করেছি রে। সত্যি বলতে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। খারাপ লাগছে পার্থর জন্য। ছেলেটা আমায় ভালোবাসে খুব। দুর্ভাগ্য যে আমি কোনও দিনই ওর হতে পারলাম না। কাজটা যদি সফল হয় তাহলে এত বছর পর মাথাটা হালকা হবে। এত দিন মাথায় আর মনে যেন হিমালয় পর্বত নিয়ে ঘুরছিলাম। এবার আসি রে। দেরি হয়ে গেল তোর।’
‘কোথায় যাবি বল, ছেড়ে দিচ্ছি তোকে।’ বলল সায়ন্তন।
‘না সায়ন্তন। আমার সাথে থাকিস না বেশি। বিপদে পড়বি।’
কথা শেষ করে এগিয়ে গেল মেঘনা। সায়ন্তন দেখতে থাকলো তাকে।২
………..ট্যাক্সিটা যখন মেঘনার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন প্রায় রাত একটা। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনও মেয়ে হলে এত রাতে একা ট্যাক্সিতে যেতে হয়তো ভয় পেতো। কিন্তু মেঘনার মধ্যে ভয় নামক কোনও অনুভূতি কাজ করে না। নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো তার। মদ্যপান করার অভ্যাস খুব একটা নেই মেঘনার। কিন্তু সেই রাতে মেঘনা করেছিল মদ্যপান। প্রায় এক ঘন্টা টানা মদ্যপান করে গেল সে। মাঝে নিজের মোবাইলটা একবার দেখেছিল সে। সন্ধ্যা থেকে পার্থ প্রায় পঞ্চাশ বার ফোন করেছিল তাকে। ফোন তোলেনি সে। ইচ্ছাকৃত নিজের মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। পার্থকে সে বিশ্বাস করতে পারে? বিগত আট বছরের সম্পর্ক তাদের। দু’জনে একই খবরের কাগজে কাজ করে। এই আট বছরে তাদের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু চিরকালই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে মেঘনা। সে পার্থকে কোনও দিনই বিয়ে করতে পারবে না। পার্থকে সে বহুবার বলেছে – ‘তুমি অনেক ভালো মেয়ে পাবে পার্থ। বিয়ে করে নিজের সংসার গুছিয়ে নাও। আমার অপেক্ষা করো না। আমার অপেক্ষা করে লাভ নেই।’
‘একটা কথা বলো মেঘনা। তুমি কি কোনও দিন বিয়েই করবে না?’ জিজ্ঞাসা করেছিল পার্থ।
‘না।’
‘তোমার যদি জেদ থাকে তাহলে আমারও জেদ আছে। তোমার বিয়ে না করার জেদ, আর আমার তোমাকেই বিয়ে করার জেদ।’নিয়ম মত দিন এগিয়ে গেছে। দিনে দিনে মেঘনা পার্থর জন্য এক রহস্যময় চরিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। দু’একবার মেঘনাকে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল পার্থ। উত্তরে মেঘনা বলেছিল – ‘সময় অসুক। সব জানতে পারবে।’
তার পর থেকে পার্থ আর এ বিষয়ে কোনও কথা বলেনি মেঘনাকে। শুধু সে দিনের অপেক্ষা করে যাচ্ছে সে, যে দিন মেঘনা সম্পূর্ণ ভাবে তার হবে।মেঘনার ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই বেজে চলেছে কলিং বেলটা। মাথা ভারী হয়ে আছে তার। কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না সে। কোনও রকমে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো, সকাল ছ’টা।
‘কে এলো এত ভোরে?’ মনে মনে বেশ বিরক্তই হলো সে।
দরজা খুলে দেখে সামনে পার্থ দাঁড়িয়ে।
‘কী ব্যাপার তোমার বলো তো মেঘনা? কাল সন্ধ্যে থেকে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি, তুলছো না কেন? কি ভাবো, আমার চিন্তা হয় না?’
দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে পার্থকে ভিতরে ঢুকবার রাস্তা করে দিয়ে মেঘনা বলল – ‘কাজে ছিলাম একটা।’
পার্থ ভিতরে ঢুকলো।
‘এমন কী কাজ যে একবারও আমার ফোন রিসিভ করা যায় না? মেঘনা, তুমি কি কাল রাতে ড্রিংক করেছিলে? মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।’
চুপ করে থাকলো মেঘনা। মেঘনাকে চুপ করে থাকতে দেখে পার্থ বলল – ‘ঠিক আছে। জবাব দিতে চাও না যখন, দিতে হবে না। এখন চলো আমার সাথে, বেরোতে হবে এক্ষুনি।’
‘কোথায়?’ মেঘনা জিজ্ঞাসা করলো।
‘জানি, তোমার কাছে কোনও খবর নেই। অরুণ দেবনাথের নাম শুনেছো?’
‘কে অরুণ দেবনাথ? ও হ্যাঁ, মনে পড়লো। সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার তো?’
‘হ্যাঁ, সেই। কাল রাতে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’
‘কী! আত্মহত্যা? হঠাৎ?’ চমকে উঠল মেঘনা।
‘জানা যায়নি এখনও। ভোর পাঁচটা নাগাদ ডায়মন্ড হারবার রোডে তার ফার্ম হাউস থেকে পুলিশ তার ডেড বডি উদ্ধার করেছে। পুলিশ এখনও সেখানেই আছে। আমরা আগে সেখানে যাবো, তার পর পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে বাকি খবরটা নেবো।’ পার্থ নিজের কথা শেষ করলো।
‘পার্থ, আমার শরীরটা যে ভালো নেই একেবারে। যেতে পারবো না আমি।’
মেঘনার কোথায় পার্থ খানিক ভ্রুকুটি করে তাকালো তার দিকে।
‘বুঝতে পারছি। হ্যাং ওভার। বেশ, তাহলে আমিই যাই।’ পার্থ বলল।
‘তাড়া আছে? একটু বসতে, চা করে দিতাম।’
‘না থাক। তুমি বরং রেস্ট নাও। সময় পেলে ফোন করবো। রিসিভ করো কিন্তু।’
পার্থর ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার সময় মেঘনা তাকে জিজ্ঞাসা করলো – ‘আজ সন্ধ্যায় কি তুমি ফ্রী আছো?’
‘কেন বলো তো?’
‘এখানে এসো একবার। দরকার আছে।’পার্থর চলে যাওয়ার পর সোফাতে খানিক চুপ করে বসে রইল মেঘনা। তার পর সেখান থেকে উঠে নিজের বেড রুমে গেল। বেড রুমের এক কোণায় এক কাঠের টেবিলের উপর রাখা আছে তার ভ্যানিটি ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে ভালো করে দেখে সেটা বেশ কিছু টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সে।
‘না, এটার আর প্রয়োজন হবে না।’ মনে মনে ভাবলো সে।
কী একটা কারণে মনটা বড় অস্থির করছে তার। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না সে। কখনও ঘরময় পায়চারি করছে, কখনও নিজের বিছানার নিচে রাখা এক ছবিকে বারবার দেখছে। বেলা এগারোটা নাগাদ মেঘনা ফোন করলো একটা।
‘থ্যাংক ইউ সায়ন্তন। তুই না থাকলে কাজটা হতোই না।’
পুরনো স্মৃতির ভিড় মেঘনার মস্তিষ্ককে চঞ্চল করে তুলছিল বারবার। একটা শব্দ তার ছোট বেলাকে বীভৎস করে তুলেছিল। পরবর্তী কালে সেই শব্দটা সে যেখানেই শুনেছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে তার। “ক্লিক” এক এমন শব্দ যাকে আমি ঘেন্না করি।’ মেঘনা বলেছিল একবার পার্থকে।
পার্থ আশ্চর্য হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল। মেঘনার সেই একই উত্তর – ‘সময় এলে সব জানতে পারবে।’দুপুরের দিকে পার্থ একবার ফোন করেছিল।
‘অরুণ দেবনাথের কাছে একটা প্রাইভেট রিভলভার ছিল। সেটা দিয়েই নিজেকে গুলি করেছেন তিনি। কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। বহু বছর তো বিদেশে ছিলেন। লন্ডনে একটা ফ্ল্যাট আছে তার। এই কিছু দিন হলো কোলকাতা এসেছিলেন। কারোর সাথে কোনও শত্রুতা আছে বলে তো জানা যায়নি। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাক, কত দূর কী হয়।’
পার্থর কথাগুলো চুপচাপ শুনে গেল মেঘনা। শেষে বলল – ‘আজ সন্ধ্যায় আসছো তো?’
‘যাবো মেঘনা। যাবো নিশ্চই।’৩
……….পার্থ বলেছিল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আসবে সে। তার আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে মেঘনা। সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে সাজানো আছে একটা বেশ দামী বিলেতি মদের বোতল, দু’টো কাঁচের গ্লাস। সামনের দেয়ালে টাঙিয়ে দিলো একটা ছবি। প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ পার্থ এলো। যাবতীয় সরঞ্জাম দেখে তো সে অবাক।
‘কী ব্যাপার মেঘনা?’
পার্থর হাত ধরে মেঘনা তাকে সোফাতে বসালো। নিজে বসলো তার পাশে। হালকা নীল রঙের স্লিপ লেস নাইটিতে দেখতে অপূর্ব লাগছে মেঘনাকে। পার্থর আরও কাছে এসে মেঘনা বলল – ‘তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই পার্থ। হয়তো নিজের হুঁশে থাকলে সে কথাগুলো তোমায় বলতে পারবো না। তাই এই সরঞ্জাম করা।’
কথা শেষ করে পার্থকে একটা পেগ বানিয়ে দিলো মেঘনা। নিজেও নিলো একটা পেগ। পেগে এক চুমুক দিয়ে মেঘনা বলল – ‘আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা যে কতটা অটুট সেটা আমি জানি পার্থ। তুমি চাইলেই এক ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে পারতে। কিন্তু তুমি সেটা করলে না। অপেক্ষা করে গেলে আমার, আজও অপেক্ষাই করে যাচ্ছ। কিন্তু আমি নিরুপায় পার্থ। আমি যে তোমায় ভালোবেসেও বিয়ে করতে পারবো না। কেন পারবো না তার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। আজ অবধি সেই কারণগুলো তোমায় বলিনি। কিন্তু আজ বলবো।’
কথা শেষ করে বাকি পেগটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল মেঘনা। পার্থর গ্লাসও ফাঁকা। পরের পেগ বানিয়ে মেঘনা বলল – ‘পার্থ, তোমাকে ভালোবেসেও চিরকাল তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। কিন্তু আজ সে দূরত্ব রাখবো না পার্থ। তোমার যেটা পাওয়ার, তুমি ঠিকই সেটা পাবে।’
কথার শেষে পার্থর দিকে আরও একটু এগিয়ে এলো মেঘনা। নিজের বাঁ হাত দিয়ে পার্থর গলা জড়িয়ে তার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গিয়ে মেঘনা বলল – ‘আজ আমি তোমার পার্থ, আজ আমি তোমার।’ মেঘনা নিজের ঠোঁট রেখে দিলো পার্থর ঠোঁটের উপর।বিলিতি মদের বোতলটা অর্ধেক থেকে বেশি খালি হয়ে গেছে। মেঘনা আর পার্থ এখনও বসে আছে সোফাতে। মেঘনা নিজের সমস্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে পার্থর শরীরের উপর। হঠাৎ পার্থর নজর গেল সামনের দেয়ালের দিকে। দেয়ালে টাঙানো আছে একটা ছবি।
‘এই ছবিটা তোমার কাছেও আছে বুঝি?’ পার্থ জিজ্ঞাসা করলো মেঘনাকে।
‘হুম, আছে। ফেমাস ছবি- ন্যুডিটি অফ ওয়ার। ছবিটা সে সময় কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল। পরে অনেক কপি তৈরি করা হয় সেই ছবিটার। অনেকের বাড়িতেই এই ছবিটা দেখতে পাবে তুমি।’
মেঘনা সোফা থেকে উঠে ছবিটার দিকে এগোলো। ছবিটা হাতে নিয়ে পুনরায় ফিরে এলো সোফাতে।
‘ছবিটা আমি নিজের কাকার বাড়িতেও দেখেছি।’ ছবিটা মেঘনার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে পার্থ বলল।
‘ছবিটা তুমি বহুবার দেখেছো হবে পার্থ। আরও একবার দেখো। ভালো করে দেখো। কিছু দেখতে পাচ্ছো ছবির মধ্যে, কিছু খুঁজে পাচ্ছো ছবির মধ্যে?’
পার্থ মেঘনার দিকে একবার তাকিয়ে ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালো। কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকার পর বলল – ‘নতুন কিছুই পাচ্ছি না মেঘনা।’
‘ছবিতে কী দেখছো বলতো?’ মেঘনা জিজ্ঞাসা করলো।
‘একটা যুদ্ধক্ষেত্র, আশেপাশে সৈনিক, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি মেয়ে….’
‘পুরোটা বলো, ভালো করে।’ পার্থর কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল মেঘনা।
‘পুরোটা বলো মানে? ঠিকই তো বলছি।’ বলল পার্থ।
‘না পার্থ, পুরোটা বলো। যেমন, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি মেয়ে নয়, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি নগ্ন মেয়ে। যার বয়স বারো বছর। অসহায় একটি মেয়ে। কিছুক্ষণ আগেই যার বাপ মা মারা গেছে। কতগুলো নৃশংস সৈনিক ধেয়ে এসেছিল তার দিকে। ছিঁড়ে খেতে চেয়েছিল তার সমস্ত শরীরকে। মেয়েটি কোনও রকমে সেখান থেকে পালায়। গায়ে একটা সুতোও নেই তার। সে দৌড়াচ্ছে, পাগলের মত দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তার কোনও ঠিক নেই। হঠাৎ সে দেখলো সামনে থেকে কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটি মেয়ের কাছে এসে মুচকি হাসলো। মেয়েটির নগ্ন দেহতে কোনও কাপড় চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেনি সে। তার হাতে ছিল একটা ক্যামেরা। তাই দিয়ে সেই অসহায় নগ্ন মেয়েটির একটা ছবি তুলে নিলো সে। তার পর সে চলে গেল। পার্থ, ঘটনাটা ১৯৯১ সালের। গল্ফ ওয়ার চলছিল সে সময়। মেয়েটির পরিবার তখন থাকতো কুয়েতে। সে যুদ্ধে মেয়েটি খুইয়েছিল নিজের মা, বাবা আর ছোট্ট ভাইকে। কোনও রকমে মেয়েটি ইন্ডিয়া আসে। তখন অনেক ভারতীয়রাই ফিরে এসেছিল নিজের দেশে। সেই ভিড়ে মেয়েটিও ছিল। যে ভালো মানুষটা মেয়েটিকে ইন্ডিয়া নিয়ে আসে, মেয়েটি তার সাথেই থাকতে শুরু করে। লোকটা বিয়েথা করেনি। ভাগ্যবশত সেও ছিল বাঙালি। কোলকাতার কাছে একটা জায়গায় থাকতো সে। পরবর্তী কালে সেই মেয়েটিকে লোকটা অ্যাডাপ্ট করে। মেয়েটি একটু বড় হয়ে জানতে পারলো যে তার সেই নগ্ন ছবিটি নাকি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছবিটি মেয়েটির চোখেও পড়লো। সাথে সে দেখলো ছবির সাথে যুক্ত নোংরামি। ছবিটি তখন বিখ্যাত। মোনালিসার মত প্রায় অধিকাংশ বাড়ির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। মেয়েটির বাড়িতেও সেই ছবিটা ছিল। এক দিন মেয়েটি আড়াল থেকে দেখতে পেল তার তথাকথিত বাবা সেই ছবিটাকে নিজের কাছে নিয়ে মেয়েটির নগ্ন শরীরের দিকে অপলক তাকিয়ে হস্তমৈথুন করছে। তার সেই মেয়েটির শরীরের দিকে কোনও দিনও নজর ছিল, মেয়েটি জানতো না। হয়তো লোকটা জানতে দেয়নি। নিজের বাসনাকে হয়তো সে চেপে রেখেছিল। হয়তো ভয় ছিল যে, যাকে মেয়ে বলে এই সমাজের সামনে স্বীকার করেছে, তার প্রতি এমন ভাবনা মনে নিয়ে আনা মানে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা। তাই ছবি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া ভালো।’
এতটা এক নাগাড়ে বলে থামলো মেঘনা। পার্থ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটা পেগ বানিয়ে সেটা নিমেষে গলাধঃকরণ করে মেঘনা পুনরায় বলতে শুরু করলো – ‘মেয়েটি নিরুপায় ছিল। সেই লোকটাকে ছেড়ে সে যেতই বা কোথায়? আগে সে লোকটাকে শ্রদ্ধা করতো, এবার ভয় পেতে শুরু করলো। অর্ধেকটা জীবন তার ভয়েই কেটে গেল। মেয়েটির রাগ হলো সেই ফটোগ্রাফারের উপর। সে নগ্ন মেয়েটিকে একটা কাপড় দিতে পারলো না, তার নগ্ন ছবিকে বাজারে বিক্রি করতে পারলো। ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার’, বিখ্যাত ছবি। অরুণ দেবনাথের সব থেকে বিখ্যাত ছবি হয়তো।’
‘কিন্তু তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।
পার্থর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মেঘনা বলল – ‘আমি সব জানি পার্থ, সব জানি। কারণ, সেই মেয়েটি আমি।’
পার্থর চোখ বড়বড় হয়ে গেল। বিস্ময়ে কন্ঠরোধ হয়ে গেল তার।
‘আমাকে প্রায় পুরো দুনিয়া নগ্ন দেখেছে পার্থ। অনেকেই হয়তো আমার ছবি দেখে নিজের মনের সুপ্ত বাসনা মিটিয়েছে। যার জন্য এটা হলো, সে দিনে দিনে আরও বিখ্যাত হতে লাগলো। বিশ্ব জুড়ে নামডাক অরুণ দেবনাথের। কী করে সহ্য করি আমি সেটা?’
‘তুমি কি বলতে চাও অরুণ দেবনাথ যে আত্মহত্যা করলো….’
‘হ্যাঁ পার্থ। অরুণ দেবনাথের আত্মহত্যার মুখ্য কারণ আমি। ইন্ডিয়াতে এসে আমি যেখানে থাকতাম সেখানে প্রায় আমার বয়সী এক ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমার বয়সী বলা ভুল হবে, আমার থেকে কিছু বছরের ছোট সে। ছোট ভাইয়ের মত ছিল সে। সারা দিন ঘরের খাটাখাটুনির পর বিকেলের দিকে একটু সময় পেতাম তার সাথে দু’টো কথা বলার। সে জানতো আমার ইতিহাস। সে এটাও জানে, ন্যুডিটি অফ ওয়ারের সেই মেয়েটি কে? যে দিন সে ডক্টর হলো সে দিন আমার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। তখন তাকে আমি প্ল্যানটা বলিনি। প্ল্যানটা তাকে বললাম অরুণ দেবনাথের ইন্ডিয়া ফিরে আসার পর। ওর থেকে শুধু মিথ্যে একটা ব্লাড রিপোর্ট দরকার ছিল। সে রাজি হয়নি। অনেক কষ্টে তাকে রাজি করালাম। তোমাকে তার বিষয়ে কিছুই জানতে দিইনি। লম্বা বিদেশ যাত্রার পর যখন অরুণ দেবনাথ ফিরে আসে, তখন সময় হলো নিজের কাজ হাসিল করার। এক রাতে, একটা বারে গিয়ে পরিচয় করলাম অরুণ দেবনাথের সাথে। সেই বুড়োর ফার্ম হাউস পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না আমায়। বুড়োর রস কম না। রাত ন’টা থেকে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত পাগলের মত ভোগ করলো আমায়। আমি দিলামও নিজেকে ভোগ করতে। শেষে যখন বুড়ো হাঁপিয়ে গেল, তখন দিলাম আমি নিজের আসল পরিচয়। যেন আকাশ থেকে পড়লো সে। আর তার পর যেটা হলো….’
‘কী হলো তার পর?’ উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।
‘একটা রিপোর্টের জেরক্স কপি বুড়োটার মুখে ছুঁড়ে মেরে বললাম, “শোন, তুই যার শরীরকে নিয়ে এতক্ষণ ধরে ভোগ করলি, সে এক এইচ.আই.ভি. পেশেন্ট। মানে আমার এডস আছে। তার মানে সংক্রমণে এবার তুইও এসে গেলি। এবার পুরো দুনিয়াকে কৈফিয়ত দে, বিশ্ব বিখ্যাত ফটোগ্রাফার অরুণ দেবনাথ এইচ.আই.ভি. পেশেন্ট। ভেবে দেখ, তোর মান-সম্মান কোথায় মিশে যাবে। এখনও মনে পড়ে সে দিনের কথা, যে দিন তুই আমার নগ্নতাকে ইনক্যাশ করেছিলিস। আমি তো আজ না হয় কাল মরেই যাবো। কিন্তু নিজের মৃত্যুটা একবার চিন্তা করে দেখ। লোকেরা থুতু ফেলবে তোর লাশের উপর। প্রতি মুহূর্তে আমি মরেছি অরুণ বাবু। লোকেদের বাড়িতে দেখেছি আমার নগ্ন ছবি শোভা পাচ্ছে। বিখ্যাত ছবি, ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার’। হয়তো আজকের দিনের জন্যই আমি বেঁচে ছিলাম। আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে ব্লাড রিপোর্টটা দেখে নে। তুই মর, আমি চলি।” আমি বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে খুব ড্রিংক করলাম। এত বছরের পর মনটা হালকা লাগছিল। পর দিন, মানে আজ তুমি এখানে এসে খবর দিলে যে অরুণ দেবনাথ আত্মহত্যা করেছে। এবার বুঝলে পার্থ, কেন আমার ‘ক্লিক’ শব্দটার উপর এত ঘৃণা। ওই একটা শব্দ আমার নগ্ন শরীরকে প্রকাশ্যে এনেছে। ওই একটা শব্দর জন্য আমি নগ্ন হয়ে লোকেদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। ওই একটা শব্দের জন্য আমার সৎ বাপ আমার ছবি দেখে হস্তমৈথুন করেছে।’
মেঘনা উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। তাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো পার্থ। চেষ্টা করলো মেঘনাকে শান্ত করার।
ঘরে খানিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল। মিনিট পাঁচেক পর পার্থ বলল – ‘যদি তোমার বলা কথাগুলো সত্যি হয়, তাহলে আমি তোমায় এক সাজেশন দেবো। তুমি আজ রাতেই এই শহর ছেড়ে চলে যাও। তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পুলিশ যে কোনও সময় তোমার কাছে আসতে পারে।’
মুচকি হাসলো মেঘনা। বলল – ‘পুলিশ আমাকে পাবে না পার্থ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো মেঘনা। রাত প্রায় বারোটা বাজে।
‘তুমি চলে যাও পার্থ। রাতে তোমার এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আশেপাশে কেউ জেনে গেলে মুশকিল হবে। আজ আমি টেনশন ফ্রী। যার যা প্রাপ্য, তাকে আমি সেটা দিতে পেরেছি। এটাই আমার জন্য অনেক।’
প্রায় জোর করেই পার্থকে নিজের ফ্ল্যাট থেকে বের করলো মেঘনা। পার্থ জানতো যে মেঘনার মানসিক অবস্থা ভালো না। যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না তার। কিন্তু অবশেষে তাকে মেঘনার জেদের সামনে হার মানতেই হলো।
পার্থর চলে যাওয়ার পর সেই ছবিটার দিকে খানিক অপলক তাকিয়ে রইল মেঘনা। তার দু’ চোখ জলে ভেজা। কিছুক্ষণ পর ছবিটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল সে। একবার, দু’বার, তিনবার। চারিদিকে ছিটিয়ে পড়লো অজস্র কাঁচের টুকরো।
কাঁচের একটা টুকরোকে হাতে উঠিয়ে স্থির দৃষ্টিতে খানিক সে দিকে তাকিয়ে রইল মেঘনা। মুচকি হেসে মনে মনে বলল – ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার।’৪
………পরদিন সকাল থেকে পার্থ অনবরত মেঘনার মোবাইলে ফোন লাগাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই ফোন লাগছে না। হঠাৎ পার্থর কাছে তার অফিসেরই একজনের ফোন এলো।
‘খবর পাস নি পার্থ?’
‘কী খবর?’
‘অদ্ভুত রিপোর্টার তুই। খবর রাখিস না, তাও আবার মেঘনার?’
‘কী হয়েছে মেঘনার?’ মনটা চঞ্চল হয়ে গেল পার্থর।
‘যা, ওর ফ্ল্যাটে যা। মেঘনা কাল রাতে সুইসাইড করেছে। একটা ভিডিও করে গেছে সে। সেই নাকি অরুণ দেবনাথের আত্মহত্যার মুখ্য কারণ। কারণটাও নাকি সে ভিডিও’তে বলে গেছে। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা রে, সত্যি। তুই জানতিস না?’শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইল পার্থ। কথাগুলো যেন বহু দূর থেকে তার কানে ভেসে আসছে।
সমাপ্ত।
-
কবিতা- সমুদ্র সৈকত
সমুদ্র সৈকত
– বিশ্বদীপ মুখার্জীএকজনকে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে
তুমি চললে সমুদ্র সৈকতে।
সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ হয়ে
আমি আসবো তোমার কাছে,
করবো তোমায় স্পর্শ,
তুমি করতে চাইবে আলিঙ্গন আমায়
কিন্তু পাবে না আমাকে।
চলে যাওয়া ঢেউয়ের দিকে
তুমি তাকিয়ে থাকবে অপলক,
এই আশায় হয়তো আবার ফিরে আসবে সে।
রাতে যখন শুয়ে থাকবে বালির উপর
অসংখ্য তারা মিটমিট করে
তাকিয়ে থাকবে তোমার দিকে….
তুমি সেই অজস্র তারা-দের নিয়ে
আঁকতে চাইবে আমার
চোখ, মুখ, নাক….
কিন্তু পারবে না তুমি।
শীতল হাওয়ার স্পর্শে তুমি খুঁজবে আমাকে
পাগলের মতো, নিজের চারিদিকে….
অল্প নিরিবিলি পেলেই চিৎকার করে ডাকবে
আমার নাম…. একবার, বারবার,
চোখে হয়তো থাকবে কিছুটা জল।
সেই জলের কারণেই তুমি দেখতে পারবে না,
যে সমুদ্রের তীরে আছ তুমি দাঁড়িয়ে….
সেই সমুদ্রের মাঝেই ডুবে যাচ্ছি আমি,
শেষ বারের মত দূর থেকেই তোমার
দু’ চোখের গভীরতা দেখে,
সাগরের লোনা জলকে আলিঙ্গন করে। -
কবিতা- বালির মহল
বালির মহল
– বিশ্বদীপ মুখার্জীঝড় কেন?
হাওয়ার অল্প ধাক্কাও বালির মহলকে
নিমেষে শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
কিছু কিছু মুহূর্ত গুলোকে গিলে ফেলে সুমদ্রের ঢেউ….
দিনের শেষে পড়ে থাকে শুকনো পাতা,
যে এক সময় ছিল সবুজ..
সৃষ্টির নিয়মে আজ খুইয়েছে নিজের অস্তিত্ব।
আজ সেই আমার সঙ্গী,
আজ আমিও সৃষ্টির নিয়মে অস্তিত্বহীন।
স্বপ্ন দেখেছিলাম সুন্দর এক মহলের,
যেখানে ভালোবাসা ডানা মেলে
উড়ে বেড়াবে চারিদিকে..
যেখানে কর্তব্যের স্থান হবে স্বার্থের ঊর্ধ্বে।
সেই মহল নিছকই যে বালির
পারিনি বুঝতে সেটা আমি।
হাওয়ার এক ঝাপটা দিলো করে নিঃশেষ
সেই বালির মহল কে।
যে হাওয়ার শীতল স্পর্শে হতাম রোমাঞ্চিত,
সে হাওয়ারই শিকার হলো আমার স্বপ্নের মহল।
আজ চারিদিকে দেখি বন্ধ দরজা,
খোলা আকাশের নিচে আমার আশ্রয়….
আগলে রেখেছি নিজের স্বপ্নের মহলের শেষটুকু,
এটাই আমার চিরসঙ্গী,
আমি আর কিছু স্মৃতির ভগ্নাংশ। -
গল্প- অবশেষে
অবশেষে
– বিশ্বদীপ মুখার্জীছাদে এক কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছিল বিউটি। অজস্র তারায় ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশটা। এই অসংখ্য তারার মাঝেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে তার মা। ছোট বেলায় তাকে মা বলতো, যে মারা যায় সে আকাশের তারা হয়ে যায়। এই ধারণাটাই তার মনে বাসা বেঁধে নিয়েছিল। ইচ্ছে আছে আজকের রাতটা ছাদেই থেকে যাওয়ার। কি জানি, কেন আজ বহু পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে আসছে? কিছু ভালো স্মৃতি, কিছু মর্মান্তিক। যত দিন মা ছিল, জীবনটা বেশ সুন্দর গতিতে এগোচ্ছিল। কিন্তু সে আর কত দিন? তখন কতই বা বয়স হবে তার? প্রায় দশ বছর। মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে চিরকালের মত বঞ্চিত হয়ে গেল সে। মাতাল বাপকে নিয়ে তার সংসার। বেঁচে থাকা যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল তার জন্য। একটু বড় হতে না হতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে পারলো সে। শুরুতে এই অনুভূতির বিষয় কিছুই বুঝতে পারতো না সে। সে জানতো না কেন পাড়ার বিল্টুদা’র সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে। বিল্টুর পাড়াতেই এক সাইকেল মেরামতের দোকান আছে। সুযোগ পেলেই ছুটে আসতো শ্রেয়ার কাছে।
এক অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিল সে। হঠাৎ যেন সে সংবিৎ ফিরে পেল। কী তার আসল নাম? বিউটি না শ্রেয়া? সে কি সত্যিই নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে? এক মর্মান্তিক ইতিহাস। যেটা মনে না করাই ভালো। কিন্তু তাও তো মনে পড়ছে সে সব কথা। নিজের মনকে আজ কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। কাঠের বেঞ্চিতে উঠে বসলো সে। কিছুক্ষণ বসার পর ছাদময় শুরু করলো পায়চারি করা। কিসের একটা আওয়াজে চমকে উঠল সে। ছাদের এক কোণায় লোহার এক পুরনো আলমারি রাখা আছে। কেউ যেন সেই আলমারি থেকে লাফিয়ে কোথাও উধাও হয়ে গেল। কাঠবেড়ালি হবে হয়তো। রাতে কি দেখা যায় কাঠবেড়ালি? ঠিক জানে না বিউটি। তবে কাঠবেড়ালি চিরকাল তাকে আকৃষ্ট করে। অদ্ভুত স্ফূর্তি সেই প্রাণীর। কাঠবেড়ালির মত স্ফূর্তি যদি তার হতো তাহলে হয়তো সেই দিনটা তাকে দেখতে হতো না। কোনও না কোনও ভাবে ঠিক নিজেকে সেখান থেকে বের করে আনতো সে। আজ আকাশে চাঁদ ওঠেনি। চাঁদ ছিল না সে দিনও। ছিল না আকাশে একটা তারাও। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের রাতে একরাশ কালো মেঘ নেমে এসেছিল শ্রেয়ার জীবনে। রাত তখন ন’টা বাজে প্রায়। তার বাবা তখনও ফেরেনি। মজুরের কাজ করতো সে। সাতটা- সাড়ে সাতটা মধ্যেই ফিরে আসে সে। সাথে থাকে দেশি মদের এক বোতল। শ্রেয়া জানতে পারলো তার বাবা নাকি দেশি মদের ঠেকেতে বসে আছে। ঠেকটা বাড়ি থেকে বেশ দূর। বেশ অনেকটা অন্ধকার পথ পেরিয়ে যেতে হয়। মনে সাহস এনে সে দিকে আসতে আসতে পা বাড়ালো শ্রেয়া। কিন্তু মদের ঠেক থেকে নিয়ে আসতে পারলো না নিজের বাবাকে। ঠেকের মালিক বলল – ‘ও এখন যাওয়ার অবস্থায় নেই। রাতটা এখানেই থেকে যাক। কাল সকালে পাঠিয়ে দেবো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রাতে দু’ জন থাকে এখানে।’
আবার সে অন্ধকার পথ বেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া। উফ্ফ…. কি রাত ছিল সেটা! ক’ জন ছিল? এখনও মনে আছে শ্রেয়ার, ছ’ জন। ছাদের এক ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি। হঠাৎ শরীরটা কেমন কেঁপে উঠল তার। সেই কথাগুলো এখনও তার কানে বিষাক্ত তীরের মত বেঁধে – ‘তুই পাপিষ্ঠা, তুই পতিতা। কী পেলি নিজের শরীর বিক্রি করে?’
এমন বিষাক্ত কথা আর কেউ না, বলেছিল তার বাবা। বাবার শেষ কথা ছিল – ‘আর কোনও দিন এ বাড়িতে পা রাখবি না।’
অভিমানী শ্রেয়া আর কোনও দিন পা রাখেনি সেই ভিটেতে। শ্রেয়া থেকে বিউটি হলো সে। এক বারও মনে ইচ্ছে জাগেনি যে, আবার ফিরে যাই।
তত দিনে সে ভালোবেসে ফেলেছিল বিল্টুদাকে। ঘটনার পর বিল্টুও পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেত। বিল্টু ইংরিজির কিছু শব্দ আয়ত্ত করেছিল। তার মধ্যেই একটা শব্দ ছিল ‘ভার্জিন’। সেই শব্দটাই সে ব্যবহার করেছিল শ্রেয়ার কাছে, যখন শ্রেয়ার সাথে তার শেষ দেখা হয়। বিল্টু বলেছিল – ‘সব ছেলেরই ইচ্ছে থাকে, তার বৌ যেন ভার্জিন হয়। কিন্তু তুই তো আর ভার্জিন রইলি না। তোর শরীরকে তো আগেই অন্য কেউ ভোগ করে নিয়েছে।’
প্রতি উত্তরে কিছুই বলতে পারেনি শ্রেয়া। শ্রেয়া জানতো সে কোনও দিনই ন্যায় পাবে না। পুলিশ, আদালত তার বাবা কোনও দিনই করতে পারবে না। তাকে এবার নিজের দুর্ভাগ্যের বোঝা কাঁধে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। দেখা যাক, নিয়তি কোন দিকে নিয়ে যায়।নিয়তি দিলো তাকে নতুন জীবন, দিলো তাকে নতুন নাম, নতুন পরিচয়। রুক্মিণী মাসি প্রথম দিনই তাকে দেখে বলেছিল – ‘মেয়েটা কে দেখতে খুব সুন্দর। আজ থেকে তার নাম হবে, বিউটি।’
নিজের এই জীবনকে মেনে নিয়েছিল বিউটি। কোনও দোষ না করেই যখন সে সমাজের নজরে পতিতা, তখন না হয় পতিতা হয়েই জীবনযাপন করা যাক। এতে অপরাধ কোথায়?আজ কাজ করার ইচ্ছে খুব একটা নেই বিউটির। ছাদেও এখন আর থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। নিচে রুক্মিণী মাসির চোখের সামনে গেলেই কোনও না কোনও গ্রাহক তার কাছে পাঠিয়ে দেবে। এই মুহূর্তে রুক্মিণী মাসির চোখের আড়ালে থাকাই ভালো। ছাদে পায়চারি করতে করতে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো বিউটি। কারোর যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেল সে। খুবই চেনা আওয়াজ। রুক্মিণী মাসির সাথে কথা বলছে সে। রুক্মিণী মাসি তাকে বলছে- ‘কিছু মাস আগেই একটা খুব সুন্দর জিনিস এসেছে। কিন্তু রেট হাই।’
‘রেটের চিন্তা করবেন না আপনি। জিনিস যদি ভালো হয়, তাহলে রেটও ভালো পাবেন। আমার মনের মত যদি হয়, তাহলে রেটের থেকে বেশিও পেতে পারেন।’
‘হে হে হে হে। আপনাদের মত লোকেদের জন্যই তো আমাদের মত গরীবদের পেট চলে। দাঁড়ান, দেখি ঘরে আছে কি না।’
সিঁড়ির আড়াল থেকে নিচের দৃশ্যটা দেখছিল বিউটি। সে পরিস্কার দেখতে পেল রুক্মিণী মাসির সাথে যে কথা বলছে সে বিল্টু। এই ছেলেরাই নাকি ভার্জিন বৌয়ের কথা বলে। পরনের জামা কাপড় দেখে তো মনে হয় এই কিছু মাসে বেশ ভালোই টাকা উপার্জন করেছে সে। বিউটির এটা বুঝতে সময় লাগলো না যে রুক্মিণী মাসি তারই কথা বলছে। না, সে কিছুতেই যেতে পারে না বিল্টুর সামনে। এই বিল্টুই এক দিন বড় বড় প্রেমের কথা বলেছিল। বহু রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাকে। যখন শ্রেয়ার কঠিন সময় এলো, তখন এই বিল্টুই তাকে ‘ভার্জিন’ কথাটা বলেছিল। না, আজ বিল্টুর ফুর্তি আর শারীরিক সুখের জন্য সে নিজের শরীর দিতে পারবে না। বিল্টু ফেরত গিয়ে কোনও না কোনও ভাবে এ কথাটা ছড়িয়েই দেবে যে শ্রেয়ার নতুন নাম বিউটি। বিউটি জানে না তার বাবা এখন বেঁচে আছে কি না। যদি বেঁচেও থাকে, তাহলে এই খবরটা শুনে বেঁচে থাকা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাবে। না, সে কিছুতেই যেতে পারে না বিল্টুর সামনে। কিন্তু লুকোবার জায়গাও তো নেই কোত্থাও। সে জানে, ঘরে তাকে না পেয়ে রুক্মিণী মাসি ঠিক ছাদে আসবে তাকে খুঁজতে। নিচে নামলেও সব থেকে আগে তাকে বিল্টুর সম্মুখীন হতে হবে। কোনও উপায় না পেয়ে সে উল্টো পায়ে ছাদের দিকেই ছুটল। খানিক পরেই শুনতে পেল রুক্মিণী মাসির আওয়াজ।
‘বিউটি, এই বিউটি! কোথায় মরে গেলি রে মুখপুড়ি?’
ছাদে উঠে এলো রুক্মিণী মাসি।
‘আমি যাবো না মাসি।’
‘যাবি না মানে? মোটা খদ্দের এসেছে। হাতছাড়া করবো নাকি?’
‘তুমি আমার কাছে অন্য খদ্দের পাঠাও। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওর কাছে আমি যাবো না।’ দু’ হাত জোর করে মিনতি করলো বিউটি।
‘মাগীর ঢ্যামনামো দেখো। সহ্য হয় না। চল মাগী।’
রুক্মিণী মাসি এগিয়ে এলো বিউটির দিকে। বিউটি এক পা- এক পা পিছনে সরে যাচ্ছে। রুক্মিণী মাসি এক লহমায় ঝাঁপিয়ে পড়লো বিউটির উপর। নিজের মুঠোতে বিউটির চুল ধরে হিঁচড়তে হিঁচড়তে নিয়ে চলল।
‘মাসি ছেড়ে দাও। পায়ে পড়ি তোমার। ছেড়ে দাও মাসি।’ আর্তনাদ করতে থাকে বিউটি।
বিউটির আর্তনাদ রুক্মিণী মাসির কানে যায় না। নিজেকে ছাড়াবার শেষ চেষ্টা করলো বিউটি। কোনও ক্রমে রুক্মিণী মাসির হাতে এক কামড় দিয়ে কোমরে এক ধাক্কা দিলো বিউটি। ধাক্কাটা হয়তো একটু জোরেই দিয়ে ফেলেছিল সে। নিজের টাল সামলাতে না পেরে রুক্মিণী ছিটকে গিয়ে পড়লো ছাদের এক কোণায়। পুরনো এক লোহার আলমারি সেখানে বিরাজমান। যতক্ষণে রুক্মিণী মাসি নিজেকে সামলাতে পারবে, তার মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল সেই লোহার আলমারিতে। দু’ রকমের বিকট আওয়াজ বেরোল। প্রথম আওয়াজ আলমারিতে রুক্মিণীর মাথা ঠোকার এবং দ্বিতীয় আওয়াজ বেরোল তার গলা দিয়ে। চকিতে ভয়ে শিউরে উঠল বিউটি।
‘এ কী হয়ে গেল? কোনও অনর্থ ঘটেনি তো?’ কথাটা ভেবে সে দিকে ছুটে গেল। আলো আঁধারির মধ্যে দেখতে পেল রুক্মিণী মাসি মাটিতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। বিউটি তার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। মাথার নিচে হাত দিতেই হাতে এলো রক্তের ধারা। বেশ কয়েক বার নিথর পড়ে থাকা রুক্মিণী মাসিকে ঝাঁকালো বিউটি। লাভ হলো না। মাথার পিছন থেকে ক্রমাগত রক্তপাত হয়েই চলেছে। বলাই বাহুল্য কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। কী হবে এবার? চারিদিকে জানাজানি। পুলিশ আসবে, উঠিয়ে নিয়ে যাবে তাকে। তার কি প্রমোশন হলো? পতিতা থেকে খুনি? না, ‘খুনি’ উপনামটা বিউটি নিজের নামের সাথে লাগাতে নারাজ। এই মুহূর্তে ছাদে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা কি কেউ মানবে? কেউ কি মানবে এটা নিছকই এক এক্সিডেন্ট? না, কেউ মানবে না সেটা। কিছুক্ষণ পরেই ছাদে ভিড় বাড়বে। রুক্মিণী মাসিকে নিচে না পেয়ে অনেকেই হয়তো ছাদে তাকে খুঁজতে আসবে। আচ্ছা, বিল্টু কি এখনও নিচে অপেক্ষারত? নানা প্রশ্ন যেন এক সাথে ভিড় করে এলো তার মস্তিষ্কে। কোনও প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর তার কাছে নেই। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছল বিউটি। সিদ্ধান্তটা ঠিক না ভুল, সেটা ভাবারও তার কাছে অবকাশ নেই। কেউ বিউটির দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে ‘খুনি’ বলুক এটা সে চায় না, তাই তাকে এই কাজটা করতেই হবে। ধীর কদমে সে এগিয়ে গেল রেলিংএর দিকে। মস্তিষ্ক একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে এখন একেবারেই ঠান্ডা। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে এখন তার মায়ের ছবি। এখন সে বিউটি নয়, এখন সে শ্রেয়া। নিজের মায়ের শ্রেয়া, যে নিজের মায়ের কোলে মাথা রেখে শোবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। রেলিংএর কাছে গিয়ে শ্রেয়া দাঁড়ালো। তাকালো একবার নিচের দিকে। রাস্তায় বেশ কিছু লোকের ভিড় এখনও। আকাশের দিকে তাকালো শ্রেয়া। অজস্র তারা মিটমিট করছে। হয়তো এদের মধ্যেই কোথাও আছে তার মা। শ্রেয়া মনে মনে বলল- ‘আমি তোমার কাছে যেতে চাই মা। শুতে চাই তোমার কোলে মাথা রেখে। কত দিন শুইনি বলতো? আমাকে গ্রহণ করবে মা? আমার মত পতিতাকে গ্রহণ করবে তো?’সমাপ্ত।
-
কবিতা- আমি বোবাই ভালো
আমি বোবাই ভালো
– বিশ্বদীপ মুখার্জীকিছু কিছু দম বন্ধ হওয়া মুহূর্তগুলোকে
জ্বলন্ত পাঁজরের খাঁচায় বন্দি করে
রেখে দিয়েছি,
অনবরত অক্সিজেনের সাথে বহু মাত্রায়
চূড়ান্ত নোংরামি শরীরে প্রবেশ করে
বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে করছে নির্মূল।
তবুও এমন তালা এঁটে রেখেছি নিজের মুখে
যার চাবিকে দিয়েছি খুইয়ে,
বোবা হয়ে থাকাই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
কেউ যেন সেই তালার চাবিকে খুঁজে বের করার
চেষ্টা না করে….
তালার আড়ালে লুকিয়ে আছে
অজস্র চিৎকার, বুক ফাটা অসংখ্য আর্তনাদ।
যে দিন এগুলো আসবে প্রকাশ্যে,
আমি হবো দেশদ্রোহী….
আমি একাই গান্ধীর তিন বাঁদর,
না দেখবো, না শুনবো আর না বলবো।
এখন বেঁচে থাকার এটাই মূলমন্ত্র….
আমাকে বাঁচাতে হবে,
মূক হয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে
আমাদের প্রাণপ্রিয় এই ভারত মাতাকে।*জয় হিন্দ*