-
গল্প- রুম নাম্বার ২০৫
রুম নাম্বার ২০৫
– মুনমুন রাহাঅন্ধকারের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে । কামরার বেশির ভাগ মানুষই নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুম নেই কেবল মিতুলের চোখে। মনটা কেমন ভারি ভারি লাগছে । বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর থেকে। মিতুলের সেই কবেকার ইচ্ছে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবে । বিয়ের আগে হবু বর অরিত্রকে সে নিজের ইচ্ছা জানিয়েছিল , অরিত্র তখন সম্মতি ও দিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর । এক তো অরিত্র অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছে না। আর দুই নম্বর হল অরিত্রর মা। তিনি ছেলের বিয়ের জন্য জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করে বলে এসেছেন একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বৌ আগে জগন্নাথের শ্রী চরণে মাথা ঠেকিয়ে আসবে। আর কি করার মিতুলরা তাই সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে পুরী চলছে হানিমুনে। বন্ধুদের এই নিয়ে খিল্লির শেষ নেই। এই তো কালকেই পৌষালি বলছিল ,
“মিতুরে, তুই ও শেষে দীপুদার প্রেমে পড়লি? দীপুদা অর্থাত বাঙালির প্রিয় তিনটি জায়গা, দীঘা , পুরী , দার্জিলিং।”
যদিও অরিত্র বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুইজারল্যান্ড যাবে। তবু যেন সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে না যাওয়ার দুঃখটা কিছুতেই মিতুলের পিছু ছাড়ছে না।পুরী তে পা দিয়ে মিতুলের মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। পুরীতে মিতুল আগেও এসেছে তবে অরিত্রর সাথে জগন্নাথ দর্শন , সি বিচে হাতে হাত রেখে হাঁটা , বিশাল সমুদ্রতে অরিত্রর সাথে হারিয়ে যাওয়া , বড় কোন ঢেউ আসলে অরিত্রর মিতুল কে আগলে রাখা এসব কিছুই মিতুলের কাছে চেনা পুরীকে অচেনা স্বপ্ন নগর করে তুলেছে । কেবল হোটেল রুমে মিতুলের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর। সমুদ্রের বেশ কাছে। পাঁচ তারা হোটেলটার সুইমিং পুল , বার , রেস্টুরেন্ট সব কিছুই বেশ বিলাস বহুল। মিতুলরা রুমটাও পেয়েছে সি ফেসিং। হোটেলটা পুরো ভর্তি তারপরও এত কম নোটিশে মিতুলরা যে এমন একটা ঘর পাবে তা আশা করে নি মিতুল। তাই প্রথম দিন রুম টা দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছিল মনটা। কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে মিতুলের। মনে হয় কেউ যেন আছে যাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। সবসময় কেউ যেন তার সাথে সাথে সর্বক্ষন ঘুরছে। বিশেষ করে অরিত্র আর মিতুলের একান্ত হওয়ার মূহুর্ত গুলোতে যেন বেশি বেশি করে অচেনা অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মিতুল।
প্রথম দিন রাতে অরিত্র নব বিবাহিতা স্ত্রী মিতুল কে কাছে টেনে নেয় । মিতুলও অরিত্রর স্পর্শে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। অরিত্র মিতুলের উন্মুক্ত পিঠে , কোমরে , গলায় নিজের ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগে । মিতুলও অরিত্রর আদরের উষ্ণতায় ক্রমে বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনই মিতুলের মনে হয় তার গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ থাকায় প্রথমে মনে হয় অরিত্রর নিঃশ্বাস হয়তো। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হয় অরিত্রর মুখ মিতুলের কোমোর বেয়ে নীচে নামছে তবে তো অরিত্রর নিঃশ্বাস মিতুলের ঘাড়ে পরা সম্ভব নয়! ভয় পেয়ে যায় মিতুল ছিটকে ওঠে অরিত্রর কাছ থেকে। অরিত্র অবাক হয় মিতুলের ব্যাবহারে। মিতুল অরিত্রকে তার অসস্তির কথা বললে অরিত্র বিশ্বাস করে না। বলে এ নিশ্চয়ই মিতুলের মনের ভুল। তেমন কিছু হলে অরিত্রও নিশ্চয়ই অনুভব করত। সে রাতে অরিত্র মিতুলর মিলন পর্ব অসমাপ্ত রয়ে যায়। ভীত মিতুল কে বুকে টেনে নিয়ে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে। মিতুল কিন্তু অরিত্রর বুকের মাঝে চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারে কেউ যেন তাদের খাটের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতি কেন অরিত্রর হচ্ছে না কে জানে? কেটে গেল আরও দুটো দিন। এই অনুভূতি পিছু ছাড়ল না মিতুলের।
খুব ভোরে মিতুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আধ ফোটা আলোয় রাতের ভীবিষিকা ম্লান হয়ে আসে। মিতুল মনকে বোঝায় অরিত্র ঠিকই বলেছে , এসব অবাস্তব অনুভূতি মিতুলের মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়।
সান রাইস দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় । মিতুল দেখে অরিত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিতুল আর তাকে ডাকে না। ঠিক করে একই যাবে সান রাইস দেখতে। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলে মিতুলের মনের অলৌকিক অনুভূতি গুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। মনে হতে থাকে যেন দুটো অদৃশ্য চোখ তার উপর দৃষ্টিপাত করে চলেছে অনবরত। মিতুল কোন রকমে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। সে প্রথমে যায় হোটেলের রিসেপশনে। সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। একজন বয়স্ক লোক আর দুজন স্টাফ। মিতুল বয়স্ক লোকটির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর তাকে জানায় মিতুল রুম চেঞ্জ করতে চায়। এবং সেটা আজই দরকার হলে এখনই । মিতুলের গলার স্বরে এতটাই উত্কন্ঠা ছিল যে বয়স্ক লোকটি মাথা তুলে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে ,
“কেন ম্যাডাম এত তাড়া কিসের? রুমে কিছু অসুবিধা হলে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সমাধান করার। ”
মিতুল বলতে গিয়েও থেমে যায় যদি অরিত্রর মতো এই লোকটিও অবিশ্বাস করে ! মিতুল বলে,
” আমি বললাম তো আমি ঐ রুমে থাকব না । আমাকে রুম পাল্টে দিতেই হবে। ”
মিতুলের আচরণে ভদ্রলোক খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর কি যেন ভেবে বলেন,
” কোন রুম ?”
” ২০৫ ”
কথাটা শুনে ভদ্রলোক কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
” ঠিক আছে ম্যাডাম আমি দেখছি কি করা যায়। তবে যদি এখানে অন্য রুম না পান তবে অন্য কোন হোটেলের ব্যবস্থা করুন।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই হোটেলের মালিক এসে উপস্থিত হলো। মিতুল আর ভদ্রলোকের কথা কানে যেতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলল,
” কি যা তা বলেছেন অমল বাবু? আর ম্যাডাম আপনাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দি আমাদের পক্ষে এখন অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। হোটেল ভর্তি। আপনারা চাইলে অন্য হোটেলে যেতেই পারেন তবে আপনাদের পাঁচ দিনের অ্যডভান্স কিন্তু ফেরত পাবেন না।”
মিতুল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চলে এলো সমুদ্রের ধারে। সূর্য দেব ততক্ষণে আকাশে উঁকি দিয়েছেন। মিতুলের আর সান রাইস দেখা হলো না । তবু সে হোটেলে ফিরল না। সকালের নরম আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মনে অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে পড়ছে বয়স্ক ভদ্রলোকের ২০৫ রুম নাম্বার শুনে আঁতকে ওঠার কথা। ম্যানেজারের কথা চাপা দেওয়ার প্রয়াস। মিতুল এখন নিশ্চিত এই অনুভূতি তার মনের ভুল নয় কিছু নিশ্চয়ই আছে ঐ রুমে। কিন্তু কি আছে রুম নাম্বার ২০৫ এ !” কি রে , খুব চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে? ”
হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে যেতে মিতুল মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় এক জটাজুটো ধারীকে যার পরনে কেবল কৌপিন, গলায় রকমারি পাথরের মালা চোখ গুলো টকটকে লাল, কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। তিনি আবার বললেন,
” ভেবে কিছু হবে না। জানতে হবে ! তোকেই জানতে হবে কি চায় সে ! আমি তোকে শুধু সাহায্য করতে পারি।”
মিতুলের বুঝতে বাকি রইলো না সাধু কি সম্পর্কে কথা বলছেন। মিতুল হাত জোড় করে বলল,
” দয়া করুন বাবা । আমি আর এইসব সইতে পারছি না অজানা আতঙ্কের সাথে অজানা অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত । আমার এই অস্বস্তি এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করছে না। এমন কি আমার স্বামী ও নয়। ”
” কেউ বিশ্বাস করবে না রে । যে জীবন দিয়ে অনুভব করে বিশ্বাস কেবল তার জন্মায়। এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা তাবিজ দিচ্ছি এটা গলায় পরবি আর একটা পাথরের মালা দেব সেটা হাতে নিবি। তারপর সেই অশরীরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি। তবে মনে রাখিস তখন যেন আর কেউ না থাকে তোর সাথে। তাকে রাত বারোটার পরেই ডাকা ভালো। ভয় পাবি না । আমার বিশ্বাস সে তোর সাথে কথা বলার জন্যেই তোর পিছু ধরেছে। ক্ষতি করার হলে এতদিন করে দিত। ”
এই বলে সাধু মালা আর তাবিজ মিতুলের হাতে দিয়ে যেযন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই চলে গেল। ভোরের নরম আলো কেটে উজ্জ্বল রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। মিতুল ধীর পায়ে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা হল । হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিল সাধুর দেওয়া সেই তাবিজ আর মালা।রাত বারোটা। মিতুল দেখল অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কদিন মিতুল কিছুতেই অরিত্রর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। যতবার মিতুল অরিত্রর কাছে আসার চেষ্টা করেছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে মিতুলর কাছে আর মিতুলও ছিটকে সরে এসেছে অরিত্রর কাছ থেকে। মিতুল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ঘড়িতে ১২-৩০ । মিতুল উঠে বসল। অদৃশ্য অশরীরীর সাথে বোঝাপড়া করার সময় এসে গেছে। সে যে ঘরেই আছে তা মিতুল জানে তার অনুভূতি দিয়ে। মিতুল হাতে সাধুর দেওয়া মালাটা নিল আর গলায় পড়ল তাবিজটা তারপর চলে গেল বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ধীর গলায় বলতে লাগলো ,
” তুমি কে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। জানতে চাই কেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ঘুরছো তুমি? ”
একবার , দুবার কোন উত্তর নেই। মিতুল আবার বলল তার কথা গুলো। তিনবারের বার সাড়া পেল মিতুল। সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসলো। মিতুল চোখ খুলে দেখল একটা আবছা ছায়া। যেন কোন মানুষ কে সে অনেক গুলো কুয়াশার পর্দার ভিতর থেকে দেখছে। তারপর শোনা গেল তার রক্ত হিম করা ফ্যাঁসফ্যাঁসে এক গলার আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে কথা গুলো আসছে।
” আমি এসেছি তোমার ডাকে। তুমি ঠিক বলেছ আমি তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আছি। তবে তার উদ্দেশ্য তোমার ক্ষতি নয়। আমার মুক্তি। ”
মিতুলর ভয়ে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবু সে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে। বলে,
” বেশ, বল আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?”
” আমি নীলা। ছয় মাস আগেও এই হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিলাম। নতুন কাজ ভালোই লাগছিলো আমার। মন দিয়ে নিজের কাজ করতাম। কত নতুন মানুষর সাথে পরিচয় হতো রোজ। বেশ কাটছিল দিন গুলো। তবে দিন গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠল আকাশের সাথে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর। আকাশ এই হোটেলের ম্যানেজার। আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস ক্রমে মজবুত হল । অন্তত আমার কাছে । আকাশ আমাকে আরও কাছে পেতে চাইল। আমি আপত্তি করিনি। কয়েকদিন পরেই যার সাথে বিয়ে তাকে আপন করে নিতে আমার দ্বিধা বোধ কাজ করে নি। আকাশ আর আমি মাঝেমাঝে মিলিত হতে লাগলাম। বিয়ে তে আকাশ আপত্তি করে নি কিন্তু দেরি করছিল। আমি তাড়া দিতে লাগলাম। আমার আর এই ভাবে মেলামেশা ভালো লাগছিল না। আমি সংসার বাঁধতে চাইছিলাম। একদিন আমি জানতাম পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ছুটলাম আকাশের কাছে। বললাম আর দেরি নয় আমাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে যে আসছে তার জন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে নেওয়া দরকার। আমাকে অবাক করে আকাশ বলল ,
” বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? এ বাচ্চা যে আমার তার প্রমাণ কি? আমি মানি না। আর তুমি ভাবলে কি ভাবে যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? তোমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ে কে আমি কখনও বিয়ে করব না। যে মেয়ে আমার সাথে শুতে পারে সে তো অন্য পুরুষের সাথে ও শুতে পারে! ” তারপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসে আকাশ বলল,
” তাই ভালো কথা বলছি এইসব বাচ্চার ঝামেলা হটাও। কালই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করো। তারপর আমাদের সম্পর্ক যেমন চলছিল চলবে। আর ঢাক ঢাক গুর গুর নয় সোজাসুজি সওদা। তুমি আমাকে শরীর দেবে বদলে আমি তোমাকে কর্ম ক্ষেত্রে উপরে উঠতে সাহায্য করবো। ”
আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার সন্তানকে কিছুতেই মারব না। ঠিক করলাম আকাশ কে এর উচিত শিক্ষা দেব। দুদিন পর আকাশকে ফোন করে বললাম তাকে আমি সাতদিন সময় দিলাম। সে যদি আমাকে অস্বীকার করে তবে আমি মালিক পক্ষের সাথে এই নিয়ে কথা বলব। বলব কিভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকাশ আমাকে ব্যবহার করেছে । আরও বললাম দরকার হলে পুলিশের কাছেও যাব। বাচ্চা হওয়ার পর ডি এন এ টেষ্ট করলেই পুলিশ বুঝতে পারবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না। কেটে গেল দুটো দিন। আমি কদিন হোটেল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। আকাশের সাথেও তাই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। এদিকে আমার বাড়িতে সব কিছু জানতে পেরে যায়। সমাজের ভয়ে বাড়ির লোক আমাকে চাপ দিতে থাকে বাচ্চা নষ্ট করতে। আমিও আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়। তাই অশান্তি তখন আমার নিত্য সঙ্গী। আমি সমাজ সহ পরিবারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত । চার দিনের দিন ফোনটা এল আকাশের কাছ থেকে। বলল নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। তবে তার বিয়ে নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমাকে একান্তে ডাকল সে। আকাশের কথা মতো রাত আটায় আমি গেলাম হোটেলে। আকাশ আমাকে প্রথমে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসতে দিল তারপর আমাকে কিছু একটা ড্রিঙ্ক দিল। সেটাতে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল। আমার কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল।
তারপর আকাশ বলল ,
” আমাকে ফাঁসাবি না ? এই বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাবি তো ! দেখ এবার না থাকবি তুই আর না থাকবে তোর বাচ্চা। ”
একটা লোহার রড সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিল। সেটা দিয়ে মারতে লাগলো। আমার পেটে , মাথায়, মুখে। আমি ককিয়ে উঠছিলাম কিন্তু বাধা দিতে পারছিলাম না। এক সময় আমার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আকাশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার লাশকে সামনে রেখে সে একটা সিগারেট ধরাল । হোটেলে তখন কিছু রুমের কাজ চলছে। আকাশ বোধ হয় কিছু মিস্ত্রীকে আগে থেকেই টাকা খাইয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে আমর লাশটা নিয়ে আসা হলো এই ২০৫ রুমে। এই ঘরে মেরামতের কাজ চলার জন্য ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না আমার লাশ লুকাতে। মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হলো আমার লাশ ও আমার ব্যাগ যা আমি সাথে এনেছিলাম। তারপর মিস্ত্রীরা সুন্দর করে ইট বালি সিমেন্টের প্রলেম ঢেলে দিলো তাতে। মুছে দিল আমার হত্যার সকল প্রমাণ। আমার পরিবারের কাছে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি পেল না । ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর বড় অমানবিক হয় মিতুল । তাই তো আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে মিলিত হতে দিইনি। আমি মুক্তি চাই। আকাশের শাস্তি চাই। ”এতক্ষন কথা বলার পর এবার একটু থামলো নীলা। মিতুলের আর এই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভয় করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মিতুল বলল,
” না নীলা সব ছেলেরা এক রকম হয় না। আমার স্বামী অরিত্র খুব ভালো মানুষ। তবে তোমাকে আমি মুক্তি দিতে চাই। শাস্তিও দিতে চাই আকাশ কে। কিন্তু কি করে হবে ! আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কেন মানবে আমার কথা ? ”
” প্রমাণ আছে। প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। আমি এখানে আসার দিন ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আকাশ যদি বিয়ে নিয়ে কোন বাহানা করে অথবা আমাকে নোংরা প্রস্তাব দেয় তবে সেই ভিডিও আমি পুলিশ কে দেখাব। আমার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে আমার মার্ডার হওয়ার ভিডিওটা পেয়ে যাবে। ”
এই বলে আবাছা ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।মিতুল কে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আকাশ কে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নীলা ঠিকই বলেছিল তার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে সব কিছু রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিতুল কিভাবে এই হত্যার কথা জানল সেই উত্তরটা পুলিশ কে দিতে পারেনি মিতুল। অরিত্র প্রথমে মিতুলের পুলিশ ডাকা নিয়ে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিতুলর কথা মতো সব প্রমাণ পাওয়া গেলে বেশ অবাক হয়ে যায় সে। তারপর মিতুলের মুখ থেকে নীলার সব কথা জেনে মিতুলের কাছে ক্ষমা চায় সে মিতুল কে অবিশ্বাস করার জন্য। নীলার সৎকারের ব্যবস্থা নীলার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে মিতুলরা আজ বেরিয়ে পড়ল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
গাড়ি তে যেতে যেতে অরিত্র বলে
“এই হানিমুনটাতো মাটি হলো এবার গিয়েই সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থা করব । ”
মিতুল বলে ,
” একটাই শর্ত, হোটেল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ করে নেবে। ”
” সে আর বলতে ! এবারে না হয় জগন্নাথের কৃপা ছিল। আর ভুল করি !”
অরিত্রর বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে মিতুল। এতদিন পরে মিতুলর মুখে প্রাণ খোলা হাসি দেখে হাসি খেলে যায় অরিত্রর ঠোঁটেও। -
গল্প- পসেসিভ
পসেসিভ
-মুনমুন রাহাঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল পৌলমী । ছোট্ট বারান্দা থেকে রাতের সীমাহীন বিশাল আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগছে। মনটা এই অসীমতায় ছড়িয়ে দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস টানল সে। অন্য দিন পৌলমীর মনের সব ঝড় এতেই কমে যায়। কিন্ত আজ তা হল না। আসলে আজকের মনের ঝড়টা বেশ বড় আকার ধারন করেছে। এই ঝড় এত তাড়াতাড়িই বোধহয় বিলীন হওয়ার নয়।
‘পসেসিভ’ কথাটাতে আগে বেশ গর্ব অনুভব করত পৌলমী । বিয়ের পর পর যখন আত্মীয়রা বা বন্ধুরা এক মুখ দুষ্ট হাসি নিয়ে বলত, ” তোর বর তোকে নিয়ে ভারী পসেসিভ”, তখন বেশ ভালোই লাগত পৌলমীর। কিন্ত আস্তে আস্তে সলিলের পসেসিভনেসটা সন্দেহ বাতিকে পরিবর্তন হয়েছিল। বিয়ের নতুনত্ব কাটতে না কাটতেই এই বাতিকের জেরে হাঁপিয়ে উঠেছিল পৌলমী। অফিসের কোন পুরুষ কলিগ দরকারে ফোন করলে সন্দেহ , কোন অনুষ্ঠান বা পার্টিতে কোন পুরুষের সাথে হেসে কথা বললে সন্দেহ। পাড়া প্রতিবেশিরদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ছিল না। প্রথম প্রথম পৌলমী সলিল কে বোঝাত। চাকরি সলিলও করে তাই তার বোঝা উচিত অফিসের কলিগ কাজের জন্য ফোন করতেই পারে , সেখানে নারী পুরুষের পার্থক্য হয় না। আর তাছাড়াও সমাজে থাকলে সামাজিকতাও করতে হয়। বন্ধু , আত্মীয় এদের সাথে সম্পর্ক রাখাও এক প্রকারের সামাজিকতা । কিন্ত সলিলকে হাজার বুঝিয়েও কাজ হয় না।
একবার পৌলমী অফিস থেকে সবে ফিরেছে , সলিল তখনও ফেরে নি। পৌলমীর শাশুড়িমা গেছেন গুরুদেবের আশ্রমে । এমন সময় সলিলের জাঠতুত ভাই সমীর এসে হাজির। পৌলমী যথা সম্ভব অথিতি আপ্যায়ন করেছে । এদিকে কিছুক্ষণ পরেই সলিল এল অফিস থেকে , এসে পৌলমী আর সমীরকে বাড়িতে একা দেখেই মুখ ভার করে চলে গেল ঘরে। তারপর রাতে পৌলমী ঘরে আসতেই সমীর আর পৌলমীকে নিয়ে নানা বাজে কথা বলতে লাগল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার , সব কিছু শুনেও পৌলমীর শাশুড়ির মত হল, এ নাকি তার ছেলের বৌয়ের প্রতি ভালবাসা । সেদিন রাতে পৌলমী ঠিক করেছিল সকালে উঠেই চলে যাবে বাপের বাড়ি। কিন্ত সকালে উঠে আর যেতে পারে নি সে , কোথায় যেন সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা তাকে পিছু টেনেছিল। তবে সেদিনের পর থেকে সলিলকে সে আর কিছু বোঝাতে যেত না। পৌলমীর মনে হয়েছিল সলিলের এই অসুখের চিকিৎসা তার দ্বারা সম্ভব নয়।
এসব কিছুর পরেও সমাজের শৃঙ্খলতায় আর সম্পর্কের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পৌলমী সলিলের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে চার চারটে বছর। আজ ভারী খুশি ছিল পৌলমী । ডাক্তার যখন তার প্রেগনেন্সি কনফার্ম করে তখন হঠাৎই মনের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। বুকের ভিতর একরাশ খুশি আর হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্টটা নিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছিল সে। অনেকদিন পর অপেক্ষা করেছিল সলিলের জন্য। প্রথম খবরটা তাকেই দিতে চেয়েছিল সে। কিন্ত জীবনের পথে সব সময়ই যে সাজিয়ে রাখা হিসাব গুলো মিলে যায় তা কিন্ত নয়!
পৌলমীর ক্ষেত্রেও তা হল না। সলিল অফিস থেকে ফিরেই , বিনা ভূমিকায় শুরু করল,
” কি , তোমার ফস্টিনস্টি মিটল? কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারব না ? অফিসে হাফ ডে নিয়ে বাইরে ফুর্তি করে বেরাবে? আজ হাতেনাতে ধরে ফেলেছি !
খুব দুজনে হেসে ফুচকা খাওয়া হচ্ছিল! তাই না ! সাথে সাথেই তোমার অফিসের শর্মিলাদিকে ফোন করে জেনেছি , ব্যাক্তিগত দরকার আছে বলে হাফ ডে করে বেরিয়ে পড়েছিলে অফিস থেকে! তা এমন কতদিন চলছে !!”
পৌলমী এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল। এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। পৌলমী আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরতেই দেখা হয় ঋষির সাথে । ঋষি পৌলমীর কলেজ ফ্রেন্ড। ঋষির বৌও প্রেগনেন্ট । ঋষি তার বৌয়ের রিপোর্ট দেখাতে এসেছিল ডাক্তারকে। একাই এসেছিল।
পৌলমীকে ওখানে দেখেই গুড নিউজ আন্দাজ করে সে। আর দুই বন্ধুর গুড নিউজ সেলিব্রেট করতেই এই ফুচকা ট্রিট। ঠিক কলেজের মতো । আর সেটাই কোনভাবে দেখেছে সলিল তাই এই আস্ফালন। সলিলের কথা বলা এখনও থামে নি। পৌলমীর চোয়ালটা ক্রমেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে খবরটা দেওয়ার জন্য এতক্ষন অপেক্ষারত ছিল সে, সেটা আর দিতে ইচ্ছা করছে না। আজ আর কোন সাফাই দিতেও মন সরছে না তার। তার জায়গায় মনের ভিতর অন্য চিন্তা বাসা বাঁধছে। খুব ইচ্ছা করছে সীমাবদ্ধতার গণ্ডিটা এক লাফে পেরিয়ে যেতে। আজ পৌলমীর সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।সকালে উঠে পৌলমীকে না দেখতে পেয়ে সলিল খুব একটা বিচলিত বোধ করে নি। কাল রাতের অশান্তিটা এখনও চলছে তার মনের ভিতর। এত বড় অভিযোগের পর পৌলমীর চুপ করে থাকাটা সলিল নিজের ভাবনার সত্যতার প্রমাণ বলে মনে করে। কিন্ত সন্ধ্যার সময় যখন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে যে পৌলমী তার বাপের বাড়ি যায় নি , তখন একটু বিচলিত হয়ে পড়ে সে। সলিলের মা পৌলমীর মাকে ফোন করেছিলেন মেয়ের কার্য কারিতা সম্পর্কে জানিয়ে দুটো কথা শোনাবেন বলে আর তখনই জানতে পারেন সেখানে পৌলমী নেই। সলিল এরপর অন্তত দশবার ফোন করেছে পৌলমীকে কিন্ত কোন উত্তর নেই। তাতে আরও রেগে গেছে সলিল । আজ বাড়ি ফিরলে পৌলমীকে দেখে নেবে সে , এইভেবেই রাগে ফুঁসছে ।
বেশ কিছুক্ষণ পর পৌলমীর ফোন থেকে একটা ম্যাসেজ ঢোকে সলিলের ফোনে ,
“সলিল , তোমার সাথে চার বছর সংসার করে আমি উপলব্ধি করেছি যে , অতিরিক্ত পসেসিভনেস কখনও গর্বের হয় না বরং অপমানের হয়। তোমার আমার প্রতি বিশ্বাসের কমতি আছে বলেই না আমাকে নিয়ে পসেসিভ হওয়ার এত বাড়াবাড়ি ! যাক সেসব কথা , আমি আজ অন্য কিছু বলতে চাই। আমি অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিচ্ছি খুব তাড়াতাড়িই। আমি অনেক চেষ্টা করে সব সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি তোমার খাঁচা থেকে । হ্যাঁ , খাঁচাই বটে , যেখানে নিজের মতো বাঁচা যায় না , কারও নজর বন্দি হয়ে থাকতে হয়, যেখানে পদে পদে অবিশ্বাস আর সন্দেহের কাঁটা সেটা কি খাঁচার থেকে কম কিছু !
আগেও যে মনে হয় নি তা নয়, তবে , লোকে কি বলবে ! সমাজ আমাকে কি ভাবে দেখবে! এমন নানা প্রশ্ন উঠেছিল মনে আর সেই ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্ত না , আজ আমার আর সেসব ভয় করছে না । আমি যে আর একা নই তাই মনের সাহসটাও বেড়ে গেছে। হ্যাঁ , আমি মা হতে চলেছি। জানি, পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার! তবে এই সন্দেহটা থাক । তুমি সারা জীবন এই সন্দেহের আগুনে তিল তিল করে জ্বলতে থাক । এটাই তোমার শাস্তি। একে যদি তোমার সন্তান বলে মনে কর তবুও তাকে তুমি কাছে পাবে না , আর যদি অন্য কারও সন্তান ভাব তবুও পরাজয় তোমারাই হল । উভয়ক্ষেত্রেই হার তোমার। আমাকে আর অযথা ফোন করো না । আর জানার চেষ্টাও করো না আমি কোথায় আছি বা ভবিষ্যতে কোথায় থাকব । ডিভোর্স পেপার ঠিক সময় পৌঁছে যাবে তোমার কাছে ।”ম্যাসেজটা পরে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে সলিলের। একবার মনে হচ্ছে পৌলমীর গর্ভের সন্তান তারই , আজই তাকে খুঁজে নিয়ে আসবে সে কিছুতেই যেতে দেবে না নিজের সন্তান কে নিজের থেকে দূরে । আবার মনে হচ্ছে সেই লোকটার কথা যার সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছিল পৌলমী । মনে পড়ছে আগের রাতে হাজার অভিযোগেও পৌলমীর চুপ করে থাকা ! সলিলের ভিতরটা জ্বলতে থাকে । নিজের বোনা সন্দেহের চোরাবালিতে ক্রমেই ডুবতে থাকে সে । নিজের মনের সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণতা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।
-
গল্প- কাছের মানুষ
কাছের মানুষ
– মুনমুন রাহা
সূর্য দেব আজ যেন তার সমস্ত তেজ নিয়ে উপস্থিত হয়ে গেছেন সকাল সকাল। মাথার উপরের ছাতাটা কোন কাজই করছে না। শরীরের চামরাটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য অন্তরার কেবলমাত্র শরীরটাই নয় জ্বলছে তার বুকের ভিতরটাও। রোজ রোজ আর অপমান সহ্য হচ্ছে না তার। মাত্র তিন মাসের বিবাহিত জীবনেই হাঁপিয়ে গেছে সে। যদিও সমস্যাটা তার স্বামীর সাথে নয়। তার শাশুড়িমা অলোকা দেবীর সাথে । বিয়ের পর থেকে হাজার চেষ্টা করেও ভদ্রমহিলার মন পায় না অন্তরা । অথচ উঠতে বসতে অন্তরার কাজের , রূপের, গুনের , চাকরির কেবল দোষ ত্রুটি ধরে যান ভদ্রমহিলা । মাঝে মাঝে মনে হয় কৃষ্ণা বৌদির দেখানো পথ অবলম্বন করতে। কৃষ্ণ বৌদি এই পাড়াতেই থাকে। স্বভাবটা ভারি মিষ্টি। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। কৃষ্ণা বৌদি প্রায়ই যায় অন্তরাদের বাড়ি । একদিন বাড়িতে কেউ নেই দেখে অন্তরাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে , নতুন বৌ মুখ কালো করে ঘুরছে কেন? অন্তরাও সেদিন কৃষ্ণা বৌদিকে তার সমস্যার কথা বলে । সব শুনে সেদিনই কৃষ্ণা বৌদি বলে , অন্তরার স্বামী বিতানকে সব কিছু জানিয়ে মানে মানে অন্তরার আলাদা সংসার পাতাই ভাল।
কথাটা শুনে আলাদা সংসার পাতার যে লোভ হয় নি অন্তরার তা নয়। কিন্ত ঐ যে বাবা মায়ের শিক্ষাটা মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মনে হল যাক বয়স্ক বিধবা মানুষটার জীবনে ছেলে বিতান ছাড়া আছে কে! দেখা যাক আর একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে । কিন্ত এখন মনে হচ্ছে অনেক হয়েছে , রোজ রোজ অশান্তির থেকে আলাদা থাকাই ভাল। অভিমান , আর কষ্ট গুলো বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকেছে। এমন সময় চেনা ডাকটা কানে এল,
” অন্তরা , এই অন্তরা । ”
হ্যাঁ ঠিক, কৃষ্ণা বৌদির গলা। গেট থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকছে। অন্তরা কাছে যেতে জিজ্ঞেস করল ,
” কি গো আজ এত সকাল সকাল চাকরিতে যাচ্ছ যে ! ”
ম্লান হেসে অন্তরা বলে ,
” এই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি , অফিসে গিয়ে তো একটু শান্তিতে থাকতে পারব। বাড়িতে তো তার উপায় নেই। ”
কৃষ্ণা বৌদি জোর করে হাত ধরে নিয়ে যায় ঘরে । তারপর বলে ,
” চুপ করে বোস । মুখ দেখেই বুঝেছি কিচ্ছু খাসনি। আমি খিচুড়ি করেছি চুপচাপ খেয়ে তারপর যাবি অফিসে। ”
অন্তরার আপত্তিতে কোন কর্ণপাত না করে কৃষ্ণা বৌদি একবাটি খিচুড়ি এনে দেয়। তারপর নরম সুরে বলে ,
” আজ আবার কি হল রে ?”অন্তরার চোখ বেয়ে জল হয়ে নেমে এল গলার কাছে জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অন্তরা বলে ,
” কৃষ্ণা বৌদি তুমি তো জান , বিয়ের পর থেকে আমি কম কিছু সহ্য করি নি। ভালবেসে বিয়ে করেছি বলে আমাকে উঠতে বসতে কম কথা শোনায় না আমার শাশুড়ি । আমাদের হানিমুনে যাওয়া নিয়েও কত কাণ্ড করল , আমারা যেই অফিসের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলাম সেই তার শরীর খারাপ। আমি তো প্রথমে সত্যিই ভেবেছিলাম। কিন্ত ঐ যে সত্যি কথা চাপা থাকে না । তাই তোমার কাছেই গল্প করল, যে এটা তার আমাদের একসাথে না ঘুরতে যেতে দেওয়ার প্ল্যান। আর ভাগ্যিস তুমি আমাকে বললে সে কথা ! না হলে তো আমার শাশুড়ি মায়ের স্বরূপ জানতেই পারতাম না।
শুধু তাই আমাকে দিয়ে ইচ্ছা করে ঘরের যাবতীয় কাজ করান , যাতে আমার অফিসের দেরি হয়ে যায়। চাকরিটা না থাকে। তুমি তো সবই জানো। তোমাকেই তো বলে এসব ।
আজ কি বলছে জানো, বলে আমার নাকি চরিত্রের ঠিক নেই। আমি অফিসে যাই ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে। আজ আমিও মাথার ঠিক রাখতে পারে নি কৃষ্ণা বৌদি । শুনিয়ে দিয়েছি দুকথা। কতদিন আর মুখ বুজে থাকব বলো তো ! আমার এমনই কপাল বাপের বাড়িতেও বলতে পারি না সব কিছু। এক তো নিজে দেখে বিয়ে করেছি তার উপর বাবা মাকে আর নিজের সমস্যার মধ্যে জড়াতে চাই না। ওদেরও তো বয়স হচ্ছে। ”
কৃষ্ণা বৌদি অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,
” আমি তো আগেই বলেছিলাম আলাদা সংসার পাত। বিতান কে বল হয় তোকে অথবা মাকে রাখুক তার জীবনে। ”
” আসলে বিতান ওর মাকে বড্ড ভালবাসে গো তাই , মানে ওর কথা ভেবেই এতদিন কিছু বলি নি। কিন্ত আজ তোমার কথা মানতেই ইচ্ছা করছে। দেখি অফিস থেকে ফিরে আসি, বিতানকে বলব সব কিছু। সত্যিই এবার মুক্তি চাই। আজ তো রাগ করে শুধু ডাল ভাত রান্না করে চলে এসেছি ।”
” বেশ করেছিস। আমি তো তোকে অনেকদিন বলেছি বেরিয়ে আয় । শোন অন্তরা তুই আমার বড় কাছের মানুষ, তোকে বড় ভালবাসি বলেই বলছি , তোর শাশুড়ি আমার কাছে তোর নামে কম নিন্দা করে নি রে । তোকে তো আমি বলেছি সবই । তোদের নাকি বংশ খারাপ, তোর বাবা মা নমস্কারীতে কম দামী জিনিসপত্র দিয়েছে। বিতানের সাথে তোকে মানায় না এমন কতো কিছু। আমার তোর নামে এসব শুনতে ভাল লাগে না। তাই বলছি , তিনটে মাস তো সহ্য করলি এবার নিজের মতো করে সংসার কর। ”
অন্তরা নিজের কাজে বেরিয়ে যায়। কিন্ত অফিসে গিয়ে থেকে শরীরটা খুব একটা ভাল লাগছে না। সে ঠিক করল বাড়ি চলে যাবে। মনের ভিতরটাও কেমন যেন একটা খচখচ করছে। রাগের মাথায় শুধু ডাল ভাত রান্না করাটা কেমন যেন একটা অপরাধ বোধে ভোগাচ্ছে । হাজার হোক একটা বয়স্ক মানুষ দুপুর বেলা খাবে তো ! তার বাবা মায়ের শিক্ষা , নিজের কর্তব্য নিজের কাছে। সাতপাঁচ ভেবে অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো অন্তরা।
বাড়িতে গিয়ে বেল দেওয়ার দরকার বা ইচ্ছা কোনটাই হল না। তার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে । অন্তরা ভিতরে ঢুকেই বুঝল কেউ এসেছে যার সাথে তার শাশুড়ি অন্তরার নামেই কিছু বলছেন বেশ জোর গলাতে।
” ভাগ্যিস তুমি আছো । তাই তো জানতে পারলাম আমার বৌয়ের কৃতি কলাপ। ছিঃ ছিঃ ভালোবাসার বিয়ে, এখনও বছর গড়াল না এর মধ্যেই অন্য পুরুষের সাথে লটঘট! আমার ছেলেটার কথা একবার ভাবল না !”
অলোকা দেবীর বোধহয় চোখের জল মুছতে সময় নিলেন। এরমধ্যেই শোনা গেল আর একটা খুব পরিচিত গলার আওয়াজ।
” আর কি বলব মাসিমা , সে দৃশ্যের কথা আমি মুখে আনতে পারব না আপনার সামনে । বলেছিলাম না বংশটাই খারাপ। আমার তো অনেক পরিচিত লোকজন আছে ওখানে তাই যখন শুনলাম বিতান বিয়ে করেছে ঐ উত্তর পাড়ার দিকে তখনই খোঁজ করে খবর এনেছি। ঐ মেয়ের চরিত্র বিয়ের আগেও ভাল ছিল না। আর ওর বাবা এক নম্বরের কৃপন। বললাম না আপনাকে নমস্কারীর শাড়ি গুলো কেমন যেন পুরোন পুরোন। পরে তো আপনার বৌমাই আমাকে বলেছে , শাড়ি গুলো সব চৈত্র সেল থেকে কেনা। দেখুন মাসিমা , আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপনার সম্পর্কে কুকথা শুনতে মন চায় না। কিন্ত বাবাঃ , আপনার বৌমা তো আপনার সম্পর্কে নিন্দে করা ছাড়া কিছু জানে না। আমি তো বলি এমন বৌ থাকার থেকে না থাকা ভাল। দূর করে দিন তো ছেলের জীবন থেকে ।
যাকগে , একটু খিচুড়ি এনেছিলাম আপনার জন্য। আপনার বৌমা কি রান্না করেছে তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে যাই। আপনি যে আমার বড় কাছের মানুষ। খাবেন কিন্ত। ”
” আর মা রান্না! আজ তাকে দুটো সত্যি কথা বলেছি না! ঐ যে তার চরিত্র তুলে কথা বলেছি বলে তেজ করে সে ডাল ভাত রান্না করে গেছে। সবই আমার পোড়া কপাল। ভাগ্যিস তুমি ছিলে মা। ”
অন্তরা এতক্ষন সবটাই খুব অবাক হয়ে শুনছিল । তার এত কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি এসব কি বলছে । নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তার । আর সহ্য হল না ,এবার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। বলে ,
” আরে বাবা , এইটুকুই! আরও কিছু কথা কৃষ্ণা বৌদিকে জিজ্ঞেস করো মা ! আজকে যে আমি কিছু রান্না করি নি তোমার খাওয়ার অসুবিধা হবে , কৃষ্ণা বৌদি কেমন করে জানল ? বল , বল কৃষ্ণা বৌদি কি করে জানলে ? বলবে না ? তাহলে আমিই বলি , কারণ সেটা আমার কাছ থেকে জেনেছে। আমাকে সকালে ডেকে ভালবেসে খিচুড়ি খাইয়ে জেনেছে সংসারে কি হল , তারপর তোমার নামে কত নিন্দে করল আমার সাথে মিলে । আবার এও পরামর্শ দিল যে আমার উচিত এবার বিতান কে নিয়ে আলাদা থাকা । হ্যাঁ , আমিও তোমার মতোই ভরসার মানুষ মনে করে সংসারের সব কথা বলি যে কৃষ্ণা বৌদিকে।
আমার চরিত্র তুলে কথা বলেছিলে বলে খুব রাগ হয়েছিল সকালে তোমার উপর। সেটা শুনে কৃষ্ণা বৌদিতো আকাশ থেকে পড়ল। কিন্ত এখন বুঝতে পারছি আমার নামে চরিত্রহীনের আপবাদটা কে দিয়েছে। আচ্ছা কৃষ্ণা বৌদি , তুমি কবে আমাকে কার সাথে দেখেছ গো । আমাকে একটু বলতো ! আর কি করতে দেখেছো সেটাও বল ।”
কৃষ্ণা বৌদির তখন পালাই পালাই অবস্থা একবার ঢোক গিলে বলে ,
” কে জানে হয়তো ভুল দেখেছিলাম। আমার চোখের কি ঠিক আছে !”
অন্তরার শাশুড়ি অলোকা দেবী বেশ হতবাক। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না । অন্তরা আবার বলে ,
” আমার তো এটাও সন্দেহ হচ্ছে তোমার চোখের দৃষ্টির সাথে কানটাও মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা শোনে । আচ্ছা মা , তুমি কি আমাদের হানিমুনে যাওয়ার নাম শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। মানে নাটক করেছিলে!”
অলোকা দেবী রেগে আগুন। বলেন,
” কি যা তা বলছো ? আমাকে কি ভাব তুমি ? আমি কি মানুষ নয়? তোমরা দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে সদ্য বিয়ে করেছ বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করেছ আর আমি তাতে ব্যাগরা দেব ইচ্ছা করে! তোমার কথা যদি ছেড়েও দি , আমি আমার ছেলের ভাল লাগা খারাপ লাগার মূল্য দেব না? কত আশা করে ছেলেটা টিকিট কেটেছিল বেড়াতে যাবার আর আমি মিথ্যে অসুখের অভিনয় করে তাকে যেতে দেব না ? ”
অন্তরা হেসে বলে ,
” আমি বলছি না , এই যে আমার আর তোমার শুভাকাঙ্খী , কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি বলেছে । আরও বলেছে এসব কথা তুমিই বলেছ তাকে ! ”
” কৃষ্ণা , এসব বলেছি আমি ? কেন এরকম মিথ্যা বলেছো আমার নামে ? আমার তো এখন বৌমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বৌমার নামেও আমার কাছে মিথ্যে বলেছো। ”
কৃষ্ণা বৌদি নিজের পিঠ বাঁচাতে বলে ,
” দেখুন মাসিমা , আপনার আর অন্তরার ব্যাপারে আমাকে টানবেন না । আপনাদের সংসার আপনারাই বুঝুন। ”
বলে আর দাঁড়ায় না কৃষ্ণা হনহনিয়ে বেরিয়ে পরে সে। অলোকা দেবী এখনও বিস্মিত। বলে ,
” মানুষ এমনও হয় ! আমি তো অগাত বিশ্বাস করতাম কৃষ্ণাকে। তার মুখের হাসিতে আর ভাল ব্যবহারে তাকে আপন মনে করে সব কথাই বলতাম। আর তার এই ফল ! ”
অন্তরা বলে ,
” আমিও তো তাই করেছিলাম। কিন্ত আজ কৃষ্ণা বৌদির ভাল মুখোশের আড়ালে নোংরা চেহারাটা দেখলাম। অবশ্য ভুল আমরাও করেছি। নিজের ঘরের কথা বাইরের লোককে আপন মনে করে বলাটাও হয়তো ভুল হয়েছিল আমাদের। এবার থেকে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাতে চেষ্টা করব । তাহলে আর কোন কৃষ্ণা বৌদি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না । ”“আচ্ছা কৃষ্ণার এমন করে লাভ কি হল ” বলেন অলোকা দেবী,
” আসলে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের লাভের থেকে অন্যদের ক্ষতিতে বেশি সন্তুষ্ট হয়। এদের লোকের ঘরে আগুন লাগিয়েই আনন্দ। ”
” যাক , আমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে এটাই বড় কথা । তবে একটা শিক্ষা হল , সংসারে থাকতে গেলে হয়তো আবার মনোমালিন্য হবে । কিন্ত তা মেটানোর দায়িত্ব আমরা দুজনেই নেব , তাই না বৌমা ! ” বলেন অলোকা দেবী ।
অন্তরা হেসে বলে ,
” একদম ঠিক। আমাদের সমস্যা আজ থেকে শুধু আমাদেরই । দরকার নেই আর কোন কাছের মানুষের। ”
-
গল্প- পিতৃত্বের দাবি
পিতৃত্বের দাবি
-মুনমুন রাহা
” দেখ তোমার ঐ মালিটার তাকানো আমার একদম ভাল লাগে না । কেমন করে যেন আমার তিন্নির দিকে তাকায়। তুমি ওকে বিদায় করার ব্যাবস্থা কর।”
” তোমার এই সবাই কে সন্দেহ করাটা বন্ধ কর তাহলেই দেখবে সব ঠিক আছে। “
” বিশ্বাস কর এবার আমার মনের ভুল নয় গো । প্রতিবার কি ভুল হয়? আর তুমি জান না তিন্নি আমাদের কত ধৈর্য্যর ফল ?”
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে অনামিকা। তমাল আর অনামিকার বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তিন্নি আসে ওদের জীবনে । এর আগে অনামিকার পাঁচ বার মিসক্যারেজ হয়। শেষের দিকে তো অনামিকা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারের এই সন্তান হারনো তার আর তমালের জীবনের গতিটা যেন থামিয়ে দিয়েছিল। তিন্নির ছোট দুটো হাত ধরেই তারা ফিরেছিল জীবনের ছন্দে ।
তমালের বাগানের বড় সখ । অফিসের চাপে সেই ভাবে নজর দিতে পারছে না গাছ গুলোতে তাই একটা মালি খুঁজছিল । পেয়েও গেল । নাম চরণ দাস । তার সাথে আবার কদিনের মধ্যেই বেশ ভাল আলাপ হয়ে যায় চার বছরের তিন্নির। প্রথম প্রথম অনামিকা কিছু বলে নি কিন্তু আজকাল তার নানা রকম সন্দেহ হচ্ছে মনে।
তমাল অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে । এসে দেখে চরণ তিন্নির ঘরে বাইরের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে । তমাল গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে । জিজ্ঞেস করতে বলে সাদা গোলাপ গাছে ফুল এসেছে তিন্নি দেখবে বলেছিল তাই সে খুঁজছিল তাকে । কথাটা কেমন বিশ্বাস হয় না তমালের। তবু তখন কিছু বলে না সে । আরো একদিন তমাল লক্ষ করল সকাল বেলা চরণ কি যেন কথা বলছে তিন্নির সাথে । পরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে মালি কাকু তাকে জিজ্ঞেস করছিল তিন্নি তার সাথে তার বাড়ি যাবে কিনা ?
না আর রিস্ক নিতে পারে না তমাল। আজকাল কত কিছুই তো হচ্ছে ।
তার বাগানের ফুলের থেকে তার ফুলের মত মেয়ে তিন্নি তার কাছে অনেক বেশি দামী । তাই সেদিনই চরণ দাসকে একমাসের মাইনে সহ বিদায় দেয় সে । যাওয়ার আগে চরণ দাস তার সাথে দেখা করতে চায় । বলে —” বাবু আমি তো মালি তাই একটা কথা বলি। পরের বাগানের ফুল দিয়ে কখনও নিজের বাগান সাজানো যায় না । আর সাজালেও সে ফুল বেশিদিন থাকে না ।”
” কি বলতে চাও তুমি ? “
আর দাঁড়ায় নি চরণ দাস। চরণ দাসের কথা গুলো যেন হঠাৎই তমাল কে পিছিয়ে নিয়ে যায় চার বছর আগে তিন্নির জন্মের সময়। বহুদিন ধরে ভুলে থাকা কথা গুলো মনে পড়ে যায় তমালের।
যখন অনামিকার শরীরে নয় মাস ধরে তাদের সন্তান বেড়ে ওঠে তখন তমাল আর অনামিকা দুজনেই অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সেই সন্তান কে নিয়ে । আগের পাঁচ বারের মতো ভগবান তাদের সন্তান কে কেড়ে নেয়নি। তারপর সঠিক দিনে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই অনামিকা ভর্তি হয় নার্সিংহোমে । তমাল অধীর আগ্রহে তখন অপেক্ষারত তাদের সন্তানের জন্য।
ওটি থেকে ডাক্তার এসে খবর দেয় তাদের এক কন্যা সন্তান হয়েছিল বটে কিন্ত বেশিক্ষণ সে থাকে নি এই পৃথিবীতে । এদিকে অনামিকার যা অবস্থা এই খবর হয়তো তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে ।
তমালের তখন নিজেরই পাগলের মতো অবস্থা । এক তো ভগবানের নিষ্ঠুর পরিহাস অপরদিকে অনামিকার জীবন । যখন কি করবে কোন দিকে দিশা পাচ্ছে না তখন হঠাৎই অসিত বলে একটি ছেলে আসে তার কাছে । বলে সে নাকি সব কিছুই জানে তার ব্যাপারে এবং আরও বলে একটি বাচ্চা আছে যার বাবা নেই । মা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে । এখন অসিত তাকে তমালের হাতে তুলে দিতে পারে কিছু অর্থের বিনিময়। ডাক্তারবাবু অবশ্য সবটাই জানতেন । কারণ তিনিও কিছু অর্থ দাবী করেন ।
সব কিছু সামলে আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা টা তাদের আদরের তিন্নি । তারপর সব কিছুই যেন চাপা পরে যায় তিন্নির ভালবাসার কাছে । ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো দিয়ে যখন তমালের হাতের আঙুল গুলো চেপে ধরত ছোট্ট তিন্নি,তখন তমালের মনে হত এ তার ছাড়া আর কারো সন্তান হতেই পারে না ।
তিন্নির যত আবদার তার বাবার কাছে । মেয়েরও সব আবদার মাথায় করে রাখে তমাল । ছোট্ট পায়ে হামা দিতে দিতে, টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কেটে গেছে চারটে বছর। এই এত বছর পর চরণের কথায় তমালের মনে পরে পুরোন কথা গুলো । কিন্ত চরণ কেন বলল এমন কথা কে জানে!
চরণ বাড়ি ফিরতে তার বৌ তুলসী জিজ্ঞেস করে—-
“কি গো আর কত দিন পর আনবে আমাদের কমলি কে ? “” একটু অপেক্ষা কর , আনব ,আমাদের কমলি আমাদের কাছেই ফিরবে । কাউকে দেব না । আমার যত অভাবই হোক কমলি আর বিমলির বাবা তাদের মুখে ঠিক খাবার তুলে দিতে পারবে ।”
আজ সকাল থেকে তিন্নির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না । সকালে সে বাগানে খেলতে গিয়েছিল সেই থেকে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না । অনামিকার অবস্থা ভাল নয় বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । নার্সিংহোমে ভর্তি করে তমাল চলল চরণের কাছে । তার মন বলছিল চরণের তিন্নিকে লুকিয়ে দেখা , তার বাড়ি যাওয়ার কথা বলা এবং শেষ দিনের তাকে দেওয়া উপদেশ এমনি এমনি নয়। পুলিশকে খবর দেয় সে । পুলিশ ও যাচ্ছে তার সাথে ।
” আমি বাবার কাছে যাব “
” কেন মা তোমার এখনে ভাল লাগছে না? এই দেখ তোমার বোন বিমলি। ও আর তুমি যে যমজ। দেখ তোমাদের এক রকম দেখতে না ! “
“এতক্ষন তো থাকলাম মালি কাকু এবার আমার বাবার জন্য মন কেমন করছে । অফিস থেকে এসে আমায় খুঁজবে তো ?”
” তোমার মা তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে খাও মা। “
না কিছুই খায় নি মেয়ে টা । বাবার কাছে যাবে এই বায়না করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে । তুলসী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দাই চম্পা বলেছিল তার পেটে দুটি প্রান বাড়ছে। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যাথা উঠলে চম্পা কে খবর দেয় চরণ । কিন্ত চম্পা তুলসীর অবস্থা দেখে পরামর্শ দেয় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার জন্য। বস্তির ছেলে অসিতের সাহায্যে তুলসী যায় নার্সিংহোমে । যদিও খরচটা বেশি কিন্ত চিকিৎসা ভাল। সেখানে তুলসী আর তার এক মেয়ে বাঁচলেও আর একটা মেয়ে কে বাঁচাতে পারে না ডাক্তারা ।
কিন্ত সব ভুল ভেঙে যায় তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে। তিন্নি কে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না এ তারই মেয়ে। অবিকল বিমলির মুখ বসানো । তখনই ঠিক করে তিন্নি মানে তাদের কমলি কে নিয়ে আসবে তার কাছে । ঘর তার ভাঙা হলেও রাজকন্যা যে তার।
সেই মতোই আজ তিন্নিকে নিয়ে আসে সে । কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তার মেয়ের কাছে বাবা যে অন্য কেউ। বাবা হয়ে চরণ মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারছে না । আর এটাও ঠিক তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে সে বুঝেছে তমাল ঠিক কতটা ভালবাসে তিন্নিকে । বাবা হয়ে আর এক বাবার কাছ থেকে তার মেয়ে কে কেড়ে নিতে পারবে না সে । তুলসীকেও বোঝায় সে ।
বাইরে পুলিশের ডাকে বেরিয়ে আসে চরণ । দেখে পুলিশের সাথে তমালকে । তমাল তিন্নি খোঁজে ততক্ষণ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে গিয়ে দেখতে পায় তিন্নির যমজ বোন বিমলি কে । কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না তমালের।
তমাল পুলিশের কাছ থেকে কমপ্লেন তুলে নেয়। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় চরণের কাছে । এও জানায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে ঠিক কি বলে অসিত। অনুরোধ করে তিন্নিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
চরণ বলে —-
“নিয়ে যাও বাবু তোমার মেয়ে কে । ওর নরম মনে এত কথা বলে কষ্ট দিতে হবে না । আর তাছাড়াও ও তোমাকে বড় ভালবাসে ।তুমি বাবা যে !”“না চরণ ও আজ থেকে শুধু আমার মেয়ে নয় তোমারও মেয়ে। আমরা দুজনেই ওর বাবা হতে পারি না ? “
অনামিকাও আজ জানে সবটা । তমাল বাবু আর অনামিকার কাছে ভালোই আছে তিন্নি ।মাঝে মাঝে অবশ্য তার মালি কাকুও আসে ওর সাথে দেখা করতে ।
-
গল্প- কেঁচোর বিয়ে
কেঁচোর বিয়ে
– মুনমুন রাহাঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী। আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো! পাড়ার লোকেরাই তো বলল, মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে!
মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল!মেয়ে দেখতে এসে এমনই হা-হুতাশ করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী। কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন, আঃ, বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে। আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে!
-একদম ফালতু কথা বলবে না। ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেব? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেছে? না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।
কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না। যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল। তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল, একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো!
সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বললেন, বাবু একদম চুপ কর বলছি। আর যেন এসব কথা না শুনি।
ব্যাস, মায়ের ভয়ে বাবু কাবু। এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে।এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্রপক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন, তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল। সরমা দেবীর গয়না, পরেশ বাবুর ঘড়ি, মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে। কাঞ্চনকে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে। গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বলল, আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব। বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল। তারপর কেঁচোকে বলল, উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে? ভয়কে তো জয় করতে হবে! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল। এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল। বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা।দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলেকে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী।
-কেন মাসিমা, মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেননি? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না?
পরেশ বাবু বললেন, ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই?
মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল। সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বললেন, আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না!
মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোকগুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি।
সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপালকে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে।মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুড়ে এখন চিন্তার ছায়া। কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেইনি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন, দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিল না। তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারিনি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন।
মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না।সরমা দেবী বললেন, এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে।
মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে।
মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে। যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন, আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী, দূর্গাও হয়।ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে চার হাত চার চোখ এক হল। সরমা দেবীদের বৌমা সংজ্ঞার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল।
ঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী । আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো ! পাড়ার লোকেরাই তো বলল , মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে !
মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল !মেয়ে দেখতে এসে এমনই হাহুতাস করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী । কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন,
আঃ , বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি ! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে । আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে !একদম ফালতু কথা বলবে না ।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো ? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেবো ? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরে নি । কোথায় গেছে , না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে ! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না । যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল ! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল । তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল ,
একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো !
সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বল্লেন,
বাবু একদম চুপ কর বলছি । আর যেন এসব কথা না শুনি ।
ব্যাস , মায়ের ভয়ে বাবু কাবু । এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে ।
এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্র পক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন , তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল । সরমা দেবীর গয়না পরেশ বাবুর ঘড়ি মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে । কাঞ্চন কে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা ।
একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বল্ল ,
আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব । বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল । তারপর কেঁচোকে বলল ,
উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে ? ভয়কে তো জয় করতে হবে ! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে । বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল । এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল । বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা ।দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলে কে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে ! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম । দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী ।
কেন মাসিমা , মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেন নি ? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না ?
পরেশ বাবু বললেন,
ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই ?মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল । সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বল্লেন,
আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না !
মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোক গুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি ।
সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপাল কে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে ।মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুরে এখন চিন্তার ছায়া । কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেই নি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন ,
দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার ছিল না । তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারি নি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন ।
মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না ।সরমা দেবী বললেন,
এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে ।
মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে ।
মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে । যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে ! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন,
আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী , দূর্গাও হয়।ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে । চার হাত চার চোখ এক হল । সরমা দেবীদের বৌমা সঙ্গার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল ।।
-
গল্প- জ্বালা
জ্বালা
– মুনমুন রাহাকলেজের দেরি হয়ে গেছে দেখে ঝটপট পা চালায় সৃজনী। গ্রামের খালের পোলের উপর দাঁড়ানো প্রতীক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে একটু থমকে যায় সৃজনী। এই এক উৎপাত শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে । রাস্তাঘাটে যেখানেই দেখা হয় এই প্রতীক সৃজনীকে তার ভালোবাসা জানায়। কতবার সৃজনী বুঝিয়েছে এই ভালোবাসা এক তরফা। কিন্ত কে শোনে কার কথা! তার উপর আবার প্রতীক হল এখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে। তাই বেশি কিছু বলতেও পারে না সৃজনী। যতটা পারে এড়িয়ে চলে। সৃজনী কিছুদিন হল ঐ শিবতলার পথটা ছেড়ে এই পথ দিয়ে কলেজে যায় কেবলমাত্র এই প্রতীকের পাল্লায় পড়বে না বলে। কিন্ত আজ এখানেও ধাওয়া করেছে প্রতীক।
সৃজনী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগোলো পোলের দিকে। পোলের মাঝামাঝি আসতেই প্রতীক বাইক নিয়ে একদম সৃজনীর গায়ের কাছে চলে আসে তারপর বলে – ” কি সুন্দরী , আমার কাছে ধরা দেবে না বলে এই রাস্তা নিয়েছ তো! কিন্ত সোনা আমার কাছ থেকে যে পালানো এত সহজ নয়! আমার যে চোখ চারদিকে আছে। দেখ আমি তোমাকে ভালোবাসি বিয়ে করব । এই সোজা কথাটা কেন ঢুকছে না তোমার মাথায়? ভালো কথা অনেক দিন বলছি, এবার মটকা গরম হলে কিন্ত বিয়ের আগেই সব কিছু করব শুধু বিয়েটা করব না। “
কথা বলতে বলতে প্রতীক বাইক থেকে নেমে সৃজনীর হাতটা চেপে ধরছে। প্রতীকের চটুল কথায় তার বন্ধুরা হায়নার মতো হাসছে পিছন থেকে। যেন কোন মুখরোচোক ঘটনার সাক্ষী থাকবে বলে প্রাণ আনচান করছে তাদের। সৃজনী নিজের হাতটা ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে- “দেখো প্রতীকদা আমি তো তোমায় কতবার বলেছি, আমি কল্যাণকে ভালবাসি। কেন বারবার তুমি এক কথা বল বলতো ?”
-শালী বড্ড তেল বেড়েছে তোর, ভালো কথায় কিছু হবে না।এই কথা বলে প্রতীক সৃজনীর ওড়নাটা ধরে টান দেয়। সৃজনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেষে না পেরে প্রতীককে এক ধাক্কা মারে আর গালে একটা সজোরে চড় কষায়। প্রতীক আর তার বন্ধুরা বোধহয় এতটা আশা করেনি। তাই মুহুর্তের জন্য একটু বিচলিত হয়ে পড়ে এই সুযোগে সৃজনী ছুটে পালায়। প্রতীকরা কি ভেবে আর পিছু নিল না সৃজনীর।
কলেজের ক্লাসগুলোর একটাতেও মন দিতে পারে না সৃজনী । ক্লাস শেষ হতে কল্যাণের সাথে দেখা করতে যায় গঙ্গার ঘাটে। কল্যাণকে সব কথা বলতে, কল্যাণ বলে- “তুমি ঠিক করো নি সৃজা। ওরা অনেক পাওয়ারফুল লোক। এইভাবে ওদের সাথে ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হল না সৃজা।”
– ছিঃ কল্যাণ, তুমি একথা বলছ! তাহলে আমি কি করতাম নিজকে ওদের হাতে সমর্পণ করতাম?
– না না আমি ঠিক তা বলতে চাইনি।
-দেখ কল্যাণ তুমি তো বলেছিলে তোমার বাবা মাকে তুমি আমার কথা বলেছ। এবার তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাবস্থা কর। আমার মনে হয় এটাই এই সমস্যার সমাধান।
-একদম চিন্তা করো না সৃজা। আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি। কালই তোমার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলব বাবা-মাকে । বিয়ের কথা কালই পাকা করে আসুক ওরা।
মনের ভারী ভাবটা একটু হাল্কা লাগছে সৃজনীর। যাক বিয়ের কথা যদি কালই হয়ে যায় তবে আর প্রতীক নিশ্চয়ই জ্বালাবে না । সারা রাস্তা সৃজনী স্বপ্ন বুনতে থাকে ওর বিয়ের। ভাবনা চিন্তার মাঝেই সৃজনী পৌঁছে যায় গ্রামের সরু রাস্তার ধারে। আচমকাই কতগুলো বাইক এসে পড়েছে। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় আর হেলমেটের জন্য ঠিক করে মুখ দেখা যাচ্ছে না কারও। হঠাৎই একটা বাইক আরোহী দ্রুত বেগে চলে যাওয়ার আগে একটা বোতল ছুঁড়ে মারল সৃজনীর মুখ লক্ষ্য করে।
আজ তিন দিন বাদে নার্সিংহোমের বিছানায় চোখ মেলে তাকালো সৃজনী। সেদিনের প্রচন্ড জ্বালার স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না তার। সেদিন সৃজনীর মনে হয়েছিল কেউ একদলা আগুন ছুঁড়ে দিয়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল। চোখ খুলে দেখতে পেল সৃজনীর অসহায় বাবা মায়ের মুখ । আরও জানতে পারল কেউ বা কারা তার মুখের উপর অ্যাসিড ফেলে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ভগবানের অশেষ করুনা যে সৃজনীর চোখ দুটো কিছু হয় নি। ঠোঁটের উপর থেকে গলার কিছুটা অংশ ঝলসে গেছে।
আজ প্রায় একমাস পর বাড়ি ফিরছে সৃজনী। এখনও ওষুধ চলছে। বাড়ি এসে দেখল বাবা মা বাড়ির সব আয়নাগুলো সরিয়ে দিয়েছে। কারণটা সৃজনীর অজানা নয়। প্রথম বার নিজের ঝলসে যাওয়া চেহারাটা দেখে নিজেই চিৎকার করে ওঠে সৃজনী। এই একমাস সাক্ষী হয়ে আছে সৃজনীর এমন অনেক লড়াইয়ের। অবশ্য লড়াইয়ে সৃজনীর পাশে সব সময় তার বাবা মা ছিল। কিন্ত আরও একজনকে আশা করেছিল সৃজনী । কল্যাণকে, না তাকে দয়া করে বিয়ে করার জন্য নয় কেবল পরিচিতির খাতিরেই একবার দেখা করবে আশা করেছিল সৃজনী। কিন্ত কল্যাণ বোধহয় ভয় পেয়েছে, ভেবেছে দেখা করতে গেলে যদি সৃজনীর মতো আধ পোড়া মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়! তাই বোধহয় আর সাহস হয় নি তার সৃজনীকে নার্সিংহোমে দেখতে যাওয়ার।
ক্রমে দিনগুলো পার হতে থাকে । লড়াইটাও কঠিন হতে হতে একপ্রকার গা-সওয়া হয়ে গেছে সৃজনীর। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। লোকের চোখে নিজেকে কুৎসিত করে দেখার লড়াই। আইনের কাছে নিজের হার মেনে নেওয়ার লড়াই। পুলিশ এসে বেশ কয়েকবার জেরা করে গেছিল সৃজনীকে। নার্সিংহোমে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না সৃজনীর তাই বাড়িতেই জিজ্ঞেসবাদ করে পুলিশ। সৃজনী জানায় তার সন্দেহের কথা। বলে , প্রতীক আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের ওকে বিরক্ত করার কথা। পুলিশ ‘দেখছি দেখছি’ করে কাটিয়ে দিল বেশ কিছুদিন। তারপর বলে, প্রতীকদের বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব তাই তাকে কেবল জিজ্ঞেসবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেইদিন নাকি প্রতীক এই গ্রামেই ছিল না। সৃজনী এখন রাস্তায় বেরলে মুখ ঢেকে বেরোয়। যেন নিজেকে আড়াল করতে চায় সবার থেকে।
এইসব ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় ছমাস। সবার সবটা কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। সৃজনীর ঐ পোড়া মুখ দেখে গ্রামের লোক আর তেমন আতঙ্কিত হয় না। লোকের ঠুনকো সহানুভূতিগুলোও কেমন যেন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামে বেশ উৎসবের হাওয়া পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের বিয়ে বলে কথা যে! প্রতীকের সাথে সৃজনীর বাল্য বন্ধু তমশার বিয়ে হচ্ছে। কথাটা শোনার পর সৃজনীর বাবা মা সৃজনীকে তার মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে চায় না তারা।
পরবর্তী ঘটনাটা যেন ঘটে গেল আকস্মাৎ। বিয়ের আগের দিন প্রতীক সন্ধ্যার পর বাইক নিয়ে বেরোয় নিজস্ব কিছু কাজে। কিন্ত সেই সরু গলির মুখটাতে আসতেই মুখের উপর বোতল বন্দি আগুন এসে পড়ল। অ্যাসিড। ঝলসে যাওয়ার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায় প্রতীক। সবাই তাকে নিয়ে ছুটল নার্সিংহোমে। চোখ দুটোই বোধহয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সৃজনীর মা বাইরে ছিলেন, খবরটা শুনে ঘর আসে সৃজনীর বাবাকে খবরটা দিতে। কিন্ত এসে তাকে পায় না। হয়তো বাজারে গেছে। কিন্ত ঘরে পেল সৃজনীকে। তার হাতের কিছু কিছু জায়গা পুড়েছে । তাতেই মলম লাগাচ্ছিল সে। সৃজনীর মায়ের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। এসে দরজাটা বন্ধ করে মেয়েকে চেপে ধরে।
-কেন, কেন সৃজা এসব করতে গেলি? কি পেলি? এখন যদি পুলিশ এসে ঝামেলা করে? তখন আমারা কি বলব? তাছাড়াও তমশা তোর ছোট বেলার বন্ধু, তার কথাটাও একবার ভাবলি না রে? আইন নিজের হাতে নেওয়াটা যে ঠিক নয় রে মা।
সৃজনী তার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ঠোঁটটা শক্ত করে চেপে নিল একবার তারপর বলে- “হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বুঝেছ, আমিই প্রতীকের মুখটা অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। ওদের মতো বাবার ক্ষমতায় বলীয়ান জানোয়ারগুলো আইনের ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই এই কাজ করলাম। তবে কি জানতো মা এদিকে ভালোই হয়েছে পুলিশ ওকে সাজা দেয়নি। ওর কি আর শাস্তি হতো বল? জেল হেফাজত! কিন্ত তাতে ও বুঝতো না আমার জ্বালাটা, আমার সেদিনের পুড়ে যাওয়ার মর্মটা। কিন্ত আজ ও বুঝেছে। মা এই জ্বালা বড় বেদনা দেয়। শরীরের পুড়ে ঝলসে যাওয়া অংশগুলো হয়তো ডাক্তারের চিকিৎসায় ক্রমে সেরে ওঠে কিন্ত মনটা জ্বলতে থাকে জ্বলতেই থাকে। এই সমাজ মনের আগুনটাকে কিছুতেই নিভতে দেয় না। তবে আজ অনেকদিন পর আমার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনে একটু হলেও জল পরেছে। আর হ্যাঁ মা, কি বলছিলে তমশার কথা ভাবতে? মা, আমি ওকে বাঁচিয়ে দিলাম গো । ঐ রকম একটা জানোয়ারের হাতে সারা জীবন বাঁধা পড়ার থেকে।”
-সব বুঝলাম, কিন্ত পুলিশ! কি বলব পুলিশ কে?
– কেন মা , তোমরা তো আমাকে গ্রামের কত লোকের মাঝখান দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে মাসির বাড়ি রেখে এসেছ ! আমি তো ওখানেই ছিলাম। তাই না? যেমন সেদিন প্রতীক বাড়ি ছিল না। আর পুলিশ অবিশ্বাস করলে গ্রামের লোকেরা বলবে তারা আমাকে মাসির বাড়ি যেতে দেখেছে কিনা? এখন আমি আসি মা। তবে এবার ফিরে এসে আবার নতুন করে জীবনটা সাজানোর চেষ্টা করব। আর তার শুরু করব আমার পড়াশোনা দিয়ে। আবার আমি কলেজে যাব। জানি লোকের চোখ, লোকের মুখ অনেক কিছু দেখবে, বলবে। কিন্ত আজ আর তাতে আমার খুব একটা কিছু যায় আসে না। আমি বাঁচাব আমার মতো, আমার শর্তে। -
গল্প- রং- বেরং
রং- বেরং
-মুনমুন রাহাআকাশ জুড়ে রংয়ের মেলা। কোথাও ধূসর কোথাও বেগুনি আবার কোথাও এখনো লালচে আভা। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিদায় নিচ্ছেন সূর্য দেব । এই ক্লান্ত জৌলুসহীন সূর্যকে আর দরকার নেই পৃথিবীর। যতক্ষন পর্যন্ত তার তেজ ছিল , পরিশ্রমের ক্ষমতা ছিল ততক্ষন সে ছিল ভারী অমূল্য , ভারী প্রয়োজনের। আজ সে নিজের শক্তির সাথে নিজের প্রয়োজনীয়তাও হারিয়েছে। ঠিক সুচিত্রা দেবীর মতো ।
নিজের ঘরের বড় জানলাটার সামনে রাখা চেয়ারে বসে অস্তাচল সূর্যের দিকে তাকিয়ে এ কথাই ভাবছিলেন সুচিত্রা দেবী। আজকাল তার জীবনটাকে বোঝা মনে হয়। যত বার্ধক্য ঘিরে ধরছে ততই যেন পুরোন দিনের কথা গুলো বেশি বেশি মনে পড়ছে। আগে যে সংসারের ঊন কোটি চৌষট্টীটা কাজ তাকে ছাড়া হতো না সে সংসারের এখন সব কিছুই তাকে ছাড়াই হয় । নাঃ , অমর্যাদা নেই তার এই সংসারে । ছেলে , বৌ , নাতি বা সদ্য আসা নাত বৌ সবাই সম্মান করে । কিন্ত সব কিছুতেই যেন তিনি ব্রাত্য। কোন কিছু রান্না করতে গেলে বৌমা রে রে করে ওঠে , ঝাঁজ লেগে এখনই কাশি উঠবে বলে , বড়ি দেওয়া , সেলাই করাও বন্ধ হয়ে গেছে । চোখের অপারেশন আর কোমরের অপারেশনের পর ছেলের স্ট্রিকলি নির্দেশ তিনি যেন এসব কাজ না করেন। তবে সত্যি কথা আরও একটা আছে , কেবল সবাই বকাবকি করেন বলে যে তিনি এসব কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন তা নয় , তিনি নিজেও বুঝতে পারেন তিনি আর আগের মতো পারেন না , কষ্ট হয় বড়। তাই মেনেই নিয়েছেন সব কিছু।
এই যে কদিন আগে নাতির বিয়ে হল , তাতে কোন কাজে লাগলেন তিনি ? কেবল নাত বৌ বাড়ি আসার পর আশীর্বাদ করা ছাড়া! অথচ বিয়ে বাড়িতে কত কাজ , তার কাছে এসব কাজ এককালে নস্যি ছিল। আজ ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতার অভাব! আজকাল আর কিছুই ভাল লাগে না । খেতেও ইচ্ছা করে না , নানা রোগে ঘুম তো কবেই ছেড়ে গেছে। রাতে খুব জোর ঘন্টা দুই তিন ঘুমান । আজকাল মনে হয় এই বিশ্ব সংসারে তিনিই কর্মহীন। অন্তহীন সময় তাকে গ্রাস করতে আসে। তিনি যেন একটা ভার হয়ে বসে আছেন এই পৃথিবী বক্ষে। তার একমাত্র কাজ মুক্তির অপেক্ষা। এসব ভাবতে ভাবতে দুচোখ দিয়ে কখন যেন বারিধারা নেমে এসেছে । তিনি ক্লান্ত মনটাকে একটু আরাম দিতেই চোখ বুঝলেন।
সুচিত্রা দেবীর নাত বৌ পরমা এসে থেকেই দেখছে তার দিদি শাশুড়ি তেমন ভাবে কথা বলেন না , খান না । গল্প করা , হাসি আনন্দ এসবের যেন তার জীবনে কোন অস্তিত্বই নেই। আজ সুযোগ বুঝে তার বর মানে সুচিত্রা দেবীর নাতি রক্তিমকে জিজ্ঞেস করল,
” আচ্ছা আমি এসে থেকেই দেখছি তোমার ঠাম্মা ভারী রিজার্ভ। তাই না! আমি যে এত হাহা হিহি করে বেরাই সারাদিন তোমাদের বাড়িতে উনি কি তাতে রাগ করেন গো! মানে তেমন ভাবে তো কথাই বলেন না , তাই ঠিক বুঝতেও পারি না। “
রক্তিম নতুন বৌকে একটু কাছে টেনে বলল,
” তুমি আমার ঠাম্মাকে চেনোই নি। ভারী ভাল মানুষ। ছোটবেলায় কত মজার মজার গল্প বলতো জানো ! মা তো চাকরিতে যেত , আমাকে খাইয়ে দেওয়া , ঘুম পাড়ানো সব ঠাম্মা করত । এতকিছু করেও সুন্দর সুন্দর সেলাই করত, বড়ি আচার আরও কত কিছু বানাত। আর সব থেকে ভাল ছিল ঠাম্মার রান্না। রান্নার লোক থাকলেও আমি ছোটবেলায় ঠাম্মার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই চাইতাম না! জানো ঠাম্মা একটা গলদা চিংড়ির মালাইকারি করত দা_রুণ । তারপর আস্তে আস্তে সব বদলে গেল। ঠাম্মার শরীর ভেঙে পড়ল। মা ঠাম্মার খেয়াল রাখতে চাকরি থেকে বিরতি নিল সংসারের হাল ধরল। আমিও পড়াশোনা , চাকরিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ঠাম্মাও আস্তে আস্তে কেমন যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে লাগল। এখন তো আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। ভাল করে খাওয়া ঘুম কিছুই করে না । ডাক্তার তো বলছে ডিপ্রেসানের দিকে চলে যাচ্ছে । দেখা যাক কি হয়!
তবে এত কিছুর পরেও, আজও সেই গলদা চিংড়ির মালাইকারির জন্য মন কেমন করে । “সুচিত্রা দেবী সবে স্নান সেরে উঠেছেন। পরমা গুটিগুটি পায়ে এল তার ঘরে ,
” আসব ?”
” কে ? “
এক ঝলক পরমা দেখে খানিক বিরক্ত হয়েই বললেন,” কি ব্যাপার! তোমার আবার কি চাই? হঠাৎ আমার কাছে ?”
” কেন আসতে পারি না ?”
” আমার এত কথা ভাল লাগছে না ! কোন দরকার থাকলে বল ?”
” তোমার নাতি কাল তোমার গল্প করছিল! তোমার রান্নার গল্পও করল । শোনালো তোমার হাতের গলদা চিংড়ির মালাইকারির স্বাদের গল্প। ঠাম্মা , আমি এসব রান্না তেমন জানিনা । কিন্ত শিখতে চাই। শেখাবে আমাকে ?”
সুচিত্রা দেবী কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন পরমার দিকে। তারপর বলেন,
” রতির এখনও মনে আছে আমার রান্নার কথা !”
” হ্যাঁ গো। শুধু মনে নয়, প্রাণে জিভে সবেতেই আছে । শেখাবে গো আমাকে ?”
” বলছ রান্না জানো না ? কিন্ত তোমার শাশুড়ি মা যে বলেছিলেন, তুমি নাকি খুব ভাল রান্না কর ! “
” করি তো । তবে ইন্ডিয়ান পারি না। আমি খুব ভাল চাইনিজ আর থাই করি ।”
সচিত্রা দেবী একটু থেমে বললেন,
” সেসব না হয় বুঝলাম, কিন্ত আমার তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে তোমাকে রান্না করে শেখাব ! শরীর জানান দিচ্ছে এসব আর আমার জন্য নয়!”
” রান্না করতে হবে কেন ! তুমি বলবে আমি লিখে নেব , তারপর যখন রান্না করব তখন তুমি একটু করে চেখে দেখবে আর কি ভুল হয়েছে বলবে ,তাহলেই হবে।”
আজকাল সুচিত্রা দেবীর ভারী জ্বালা হয়েছে পরমাকে নিয়ে। সেই যে সেদিন মালাইকারি খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করল, সেই থেকেই মেয়েটা মাঝেমাঝেই চলে আসে সুচিত্রা দেবীর কাছে রান্নার রেসেপি জেনে নিতে । সত্যি বলতে কি সুচিত্রা দেবীরও বেশ ভালোই লেগেছিল যখন নাতি রক্তিম মালাইকারি খেয়ে সোজা হাজির হয়েছিল সুচিত্রা দেবীর ঘরে । সেই ছোট্ট বেলার মতো গলা জড়িয়ে বলেছিল,
” ঠাম্মা অনেকদিন পর আবার তোমার হাতের মতো রান্না খেলাম । তোমার তালিমে পরমা বেশ ভালোই রেঁধেছিল বল ! জানো কতবার ভেবেছি একবার বলি একদিন মালাইকারি করতে , কিন্ত ভয় হতো যদি আবদার সামলাতে গিয়ে তোমার শরীর খারাপ হয়!”
সুচিত্রা দেবীর ছেলে আনন্দ আর বৌমা শীলাও বেশ খুশি , রক্তিমের তো কথাই নেই । এখন ছুটির দিন হলেই সুচিত্রা দেবীর তালিম নিয়ে পরমা মাঝেমাঝেই সাবেকি রান্না করে । অবশ্য মাঝেমাঝে থাই বা চাইনিজও হয়। শীলা রোজকার রান্নাতে থাকে । দিন গুলো এগোতে থাকে । সুচিত্রা দেবী এখন আর দুঃখ বিলাসের খুব একটা সময় পাননা। পরমার জন্য রান্নার রেসিপি ভেবে রাখতে হয় যে !
শীত হাল্কা হাল্কা পরতে শুরু করেছে সবে । নিজের ঘরে দুপুর বেলা পানের ডিবেটা সবে বার করেছেন সুচিত্রা দেবী এমন সময় বাড়িতে হৈ হৈ শব্দ শুনে একটু থমকালেন। গলাটা যে পরমা আর রক্তিমের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্ত কি এত চেঁচামেচি করছে কে জানে ! আজ ছুটির দিন হলেও দুজনের টিকির দেখা নেই সকাল থেকে। অবশ্য নতুন বিয়ে এটাই তো সময় একে অপরের হাতে হাত রেখে ঘোরার! এসব ভাবনার মাঝেই পরমা , রক্তিম, শীলা, আনন্দ সবাই হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে সুচিত্রা দেবীর ঘরে । আনন্দ এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,
” দেখ তোমার নাত বৌ কি করেছে! “
পরমা এগিয়ে এসে সুচিত্রা দেবীর হাতে তুলে দেয় একটা বই । কিছু না বুঝতে পেরে সুচিত্রা দেবী চোখে চশমা এঁটে দেখেন বইয়ের মলাটে বড় অক্ষরে লেখা ” সাবেকি রান্নার সম্ভার ” লেখিকা , সুচিত্রা স্যানাল। খান চারেক বার নিজের নামটা পড়লেন সুচিত্রা দেবী , তারপর ভেজা দুচোখে পরমাকে বললেন,
” এসব সত্যি! আমার রান্নার রেসিপির বই ! এসব করলি কখন! “
” কেন মনে নেই তোমার থেকে রেসেপি জেনে একটা খাতায় লিখতাম! কেমন লাগছে বল ! রাইটার সুচিত্রা স্যানাল!”
রক্তিম বলে ,
” উঁ হুঁ , ওসব চোখের জলটলে কিচ্ছু হবে না । ট্রিট চাই ব্যাস! আজই অর্ডার করব মন যা চায়, পেমেন্ট কিন্ত তুমি করবে ঠাম্মা। “
সুচিত্রা দেবী তখনও তাকিয়ে আছেন পরমার দিকে , বললেন,
” জানিস আমার মনে হত আমার বুঝি সব কাজ শেষ হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে । কিন্ত তোর জন্য আবার একটা কাজ খুঁজে পেয়েছিলাম! যাক শেষ জীবনে নিজের নামটা তো বইয়ের পাতায় দেখতে পেলাম তোর জন্য। আমার আর কিছু দরকার নেই রে ! “
পরমা এবার সুচিত্রা দেবীর কাছে গিয়ে বলে ,
” ঠাম্মা এতবড় পৃথিবীর মাঝে আমাদের এইটুকু জীবনে সব কাজ ফুরানো এত সহজ নয়। কেবল কাজের দিক পরিবর্তনের দরকার হয় সময় মতো । বই লেখার কাজ শেষ তো কি ! আমি প্ল্যান করেছি আমরা , মানে আমি আর তুমি একটা রান্নার স্কুল খুলব। আমি থাই আর চাইনিজ শেখাব আর তুমি সাবেকি রান্না । অবশ্য আমি তোমার হেল্পারও হব। বয়স হলেই সব কিছু ফুরিয়ে যায় না ! পুরোন কে পিছনে ফেলে নতুনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন! আর তাছাড়াও ঠাম্মা ইউ আর আ স্টার। ঠিক সূর্যের মতো।”
সুচিত্রা দেবী এতক্ষন অবাক হয়ে পরমার কথা শুনছিলেন এবার বললেন,
” আমিও নিজেকে সূর্যের সাথে তুলনা করি জানিস ! অস্তচলে যাওয়া সূর্যের মতো যার সব কাজ শেষ , যার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে , যার তেজ শেষ হয়ে গেছে , তেমন সূর্য আমি ! “
পরমা হেসে বলে ,
” তোমার তো কনসেপ্টটাই ভুল। যার নিজস্ব আলো আছে তার তেজ কি ফুরায়? না তার প্রয়োজন কখনও কমে। আসলে সূর্য তো অস্ত যায় না , পৃথিবীর একদিকে আলো দেওয়া হয়ে গেলে সে চলে অন্যদিক আলোকিত করতে । দিক পরিবর্তন। তুমিও তেমন। সংসারের জন্য তুমি অনেক কাজ করেছ এককালে গায়ে গতরে। এখন অন্য ভাবে পরিশ্রম কর । যা তোমার শরীরে সহ্য হয়। অন্যভাবে আলোকিত কর আমাদের। আমাদের জীবনের রং আমরাই ঠিক করি । আমরা চইলে তা রঙিন আর না চাইলে তা বেরঙিন । শরীর বয়স তো আটকানো যাবে না তাই সে বাড়ুক নিজের মতো কেবল লক্ষ্য রাখবে মনের বয়স যেন না বাড়ে। ব্যাস , তাহলেই তুমি ইয়ং। বুঝলে ডারলিং!”
সুচিত্রা দেবী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
” মেয়ের সাহস তো কম নয় দিদি শাশুড়ির সাথে মশকরা হচ্ছে!”
রক্তিম আবার ফুট কাটে ,
” আমার প্রস্তাবের কি হল ?”
সুচিত্রা দেবী এবার আদেশের সুরে বলেন,
” তোমার প্রস্তাব ক্যানসেল করা হল । পরমা , খাতা নিয়ে আয় আজ রাতের মেনুর রেসিপিটা লিখে নে , বাসমতি পোলাও আর নবাবী মটন। “
-
গল্প- মরিচিকা
মরিচিকা
-মুনমুন রাহা
অন্তু আজ বড় ব্যাস্ত। এবাড়ির কর্তা অর্থাত অন্তুর বিপিন মামা মেয়ে ঝুমুরের বিয়ে আজ।তিনি বড় ভরসা করেন অন্তুর উপর। অন্তুও যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে খুশি রাখার। করারই কথা বিপিন মামা বড় বিপদের সময় আশ্রয় দেন অন্তুকে। অন্তু সে ঋণ কোনদিন ভুলতে পারে নি। তাই তো আজ সানাইয়ের শব্দটা যতই তেতো লাগুক এই বিয়ে বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই সে হাসি মুখে করছে।
প্যাণ্ডেলের লোককে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল অন্তু এমন সময় ডাক পড়ল অন্দরমহল থেকে। বিপিন বাবুর স্ত্রী নয়না দেবী ডাকছেন। গায়ে হলুদ নিয়ে আসা বরের বাড়ির লোকজনের খাবারের ব্যবস্থা করতে । জলখাবারের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। অন্ত পরিবেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল। তখনই চোখ পড়ল ঝুমুরের দিকে। আজ ইচ্ছা করেই অন্তু ঝুমুরের সামনে আসেনি। কি দরকার নিজের ব্যাথা কে নিজে খোঁচানোর ! কিন্ত এখন যখন ঝুমুরের গলার আওয়াজ পেল তখন অবাধ্য চোখটাকে আর আটকাতে পারল না অন্তু।
গায়ে হলুদের জন্য তৈরী হয়েছে ঝুমুর । সেজেছে হলুদ রাঙা শাড়িতে। ভারি সুন্দর লাগছে তাকে। তার অঙ্গের সব অলঙ্কার যেন ফিকে লাগছে ঝুমুরের রূপের আলোর কাছে। হেসে হেসে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলছে সে। অন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মন দিল নিজের কাজে। ঝুমুরকে তার এখন মরিচিকার মতো মনে হয়। বড় কাঙ্খিত , কিন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
দুপুর বেলাটা অন্তু নিজের ঘরে এল । উদ্দেশ্য একটু বিশ্রাম। মানসিক, শারীরিক দুই ক্ষেত্রেই দরকার। এই ঘরে অনেকদিন পরে এল সে।
ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে আজ ।
ভেবেছিল ঘরে এসে বিশ্রাম দেবে শরীরের সাথে মনটাকেও। ঝুমুরের সামনে না থাকলে হয়তো অতীত স্মৃতির থেকে মুক্তি পাবে। কিন্ত তা আর হল কৈ! ঘরে আসতেই মাথার মধ্যে ভির করে এল একরাশ স্মৃতিকথা। এই ঘরটাই একসময় বরাদ্দ ছিল তার জন্য। প্রথম যখন অন্তু এবাড়িতে এসেছিল তখন তার বয়স খুব বেশি ছিল না । বাবা মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়ি থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল অন্তু। কিন্ত মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট হওয়ার পরেও মামা বাড়ির হতদরিদ্রতার জন্য যখন অন্তুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল তখন তার ছোট মামা নিজের বাল্য বন্ধু বিপিন বাবুকে অনুরোধ করেছিল অন্তুর পড়াশোনাতে সাহায্য করতে । বিপিন বাবু অন্তুর রেজাল্ট দেখে তাকে নিজের বাড়িতে নিজের খরচে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রথম দিকে যে মামি নয়না দেবী খুব ভাল ব্যবহার করেছিল অন্তুর সাথে তা ঠিক নয়। তবে ক্রমেই অন্তুর আর নয়না দেবীর দুজনেরই অভ্যাস হয়ে যায় দুজনের ব্যবহার।ঝুমুর তখন ক্লাস সেভেন। অন্তুর সাথে ঠিক বন্ধুত্ব হয়েছিল বলাটা ঠিক নয়। বরং ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া স্মার্ট ঝুমুর মফস্বলের নিরীহ এবং আপাত আনস্মার্ট অন্তুকে নানা ভাবে অপদস্থ করে বেশ মজা করত। অবশ্য তাতে অন্তু কিছু মনে করে নি কোনোদিন। তবে আস্তে আস্তে অবস্থার বদল ঘটল। বিপিন বাবুর কল্যাণে সব রকম সুযোগ সুবিধা পেয়ে অন্তু উচ্চমাধ্যমিকে তৃতীয় হল। সেইদিন ঝুমুরের চোখে অন্তু প্রথমবার নিজের জন্য কেমন একটা সম্মান দেখেছিল। কলেজের পরিবেশ আর ঝুমুরের বদান্যতায় অন্তুও বেশ স্মার্ট হয়ে উঠল ।
তারপর আস্তে আস্তে ঝুমুরের সাথে সমীকরণ গুলো কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। বন্ধুত্ব থেকে ভাললাগা তারপর ভালবাসা ।
অবশ্য এই ব্যপারে পদক্ষেপটা ঝুমুরই প্রথম নিয়েছিল। অন্তুর মধ্যে বিপিন বাবুর প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ছিল সেটাই বারবার রাশ টানত অন্তুর মনের। কিন্ত ঝুমুরের জেদ আর জোরের কাছে টিকতে পারে নি সে সব । ঝুমুর বলত,
” দেখ , কলেজে পড় ! আর গার্ল ফ্রেন্ড থাকবে না ! তাও কি হয়! লোকে কি বলবে ! আর আমারও একটা বয় ফ্রেন্ডের দরকার । না হলে বন্ধুদের সামনে মান সম্মান থাকছে না । তাই সস্তার সেন্টিমেন্ট সরিয়ে রেখে জীবনে এনজয় কর ।”সুন্দরী রূপসী স্মার্ট ঝুমুরের ভালবাসার ডাককে অগ্রাহ্য করতে পারেনি অন্তু । মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসেছিল ঝুমুরকে। আঁকড়ে ধরেছিল মনের সবটুকু দিয়ে । তবে অন্তুর বরাবরই মনে হত ঝুমুরের যেন ভালবাসার থেকে অধিকার বোধটাই বেশি। যখন বলবে যে ভাবে বলবে সেভাবেই সব কিছু করতে হবে । বিশেষ করে ঝুমুরের বন্ধুদের সামনে অন্তুকে যেতে হলে অন্তুর জামা থেকে জুতো সবটাই পড়তে হত ঝুমুরের পছন্দের। এমন কি অন্তু কাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তাও ঠিক করত ঝুমুর । ঝুমুরের এই অধিকার প্রধান ভালবাসায় মাঝেমাঝেই হাঁপিয়ে যেত অন্তু । তবুও পরিজনের ভালবাসা না পাওয়া অন্তু তার আর ঝুমুরের সম্পর্কটাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল।
কিন্ত এই ভালবাসা যে কেবল অন্তুর কাছেই দামী ছিল তা জানা গেল কিছুদিন পরে । অন্তু তখন সবে একটা চাকরি পেয়েছে । মাইনেটা অন্তুর কাছে বেশ সন্তোষ জনক। সে আর দেরী না করে ঝুমুরকে প্রস্তাব দেয় বিয়ের। ঝুমুর তখন কলেজের লাস্ট ইয়ারে পড়ছে । বিয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে ঝুমুর । বলে ,
” তুমি ভাবলে কি করে যে তোমাকে বিয়ে করব ! তোমাকে বিয়ে করলে আমার বাবার মান সম্মান কিছু থাকবে ? “
” কিন্ত আমরা তো ভালবাসি একে অপরকে ! “
” ভালবাসা ! ” খুব অবাক হয়েছিল ঝুমুর । বলে ,
“আরে বাবা সমাজে চলতে গেলে কিছু দেখনদারী লাগে । তেমন আমার ও দরকার ছিল কাউকে বয় ফ্রেন্ড বানানো , তো ব্যাস তোমাকে তাই বলেছিলাম। এর মধ্যে এই সব ভালবাসা টালোবাসা টাইপের সেন্টিমেন্ট এনো না প্লিজ। “নাঃ , কথা গুলো মেনে নিতে পারে নি অন্তু। জীবনের প্রথম ভালবাসার নারীকে বাঁধতে চেয়েছিল আপ্রান। অন্তুর নাছোড় জেদ দেখে ঝুমুর কটাক্ষ করে তাকে। বলে ,
” তোমার স্বপ্ন কোনদিনও পূর্ণ হবে না অন্তু। তুমি ঙ কি ভেবেছিলে আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার সম্পত্তি হাতাবে! তা হচ্ছে না । তোমার মতো একজন ছেলেকে আমি বিয়ে করতে যাবই বা কেন? আমার বাবার আশ্রিতকে বিয়ে করার ভিমরতি আমার হয় নি। তাই তোমার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে । “
কথা গুলোর মধ্যে যে লুকনো বিষের ফলা ছিল তা সেদিন ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল অন্তুর সব স্বপ্ন গুলোকে। অন্তু আর ঝুমুর কে বোঝাতে যায় নি সে সত্যিই কি স্বপ্ন দেখেছিল । কোন সম্পত্তির লোভে নয় বরং একটু ভালবাসার আকাঙ্খাতেই ঝুমুর কে তার জীবনে চেয়েছিল অন্তু । এরপর অন্তু চাকরির অজুহাতে চলে যায় ঝুমুরদের বাড়ি থেকে। তবে ঝুমুরের সাথে যাই হোক বিপিন মামার উপকারের কথা ভোলে নি অন্তু। তাই বিপিন মামা যখনই অন্তুকে ডেকেছেন কোন কাজে অন্তু এক কথায় চলে এসেছে। কিছুদিন আগে অন্তু এবাড়িতে এসে জেনেছিল ঝুমুরের বিয়ে পাকা হওয়ার কথা । বিপিন মামা দেখেছিলেন তার হবু জামাইয়ের ছবি। বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হচ্ছে ঝুমুরের। অবশ্য বিয়ের পর জামাই আর মেয়ে বিপিন মামার বাড়িতেই থাকবে । এমনই ইচ্ছা ঝুমুরের, আর জামাই তো ঝুমুরের কথাতেই ওঠে বসে তাই তারও কোন আপত্তি নেই। এসব কথা বিপিন বাবুই গর্ব করে জানিয়েছিলেন অন্তুকে। ঝুমুরের বিয়ের কথাতে বুকটা মুচড়ে উঠেছিল ঠিকই তবে মনে হয়েছিল এই ছেলেই ঝুমুরের জন্য আদর্শ। যে ঝুমুরের প্রতি কথার তামিল করতে পারবে । এরপর অন্তুর আবার ডাক পড়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠানটা সামলে দেওয়ার জন্য। আসলে বিপিন মামার অর্থ বল থাকলেও ভরসার লোক বলতে অন্তুই। অন্তুও না করে নি , যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করছে সে ।
আজ একলা ঘরে অন্তুর মনে হচ্ছিল অন্যরকম কিছু কথা । আচ্ছা যদি ঝুমুর সেদিন তার প্রস্তাব মেনে নিত! যদি সত্যিই তাদের বিয়ে হত ! তবে অন্তু হয়তো তখন খুশি হত ঠিকই কিন্ত সুখী হত কি ? না কি ঝুমুর কে সুখী করতে পারত ! অন্তু বোধহয় নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সারা জীবন কেবলমাত্র ঝুমুরের দাস হতে পারত না ! আর তাতে অন্তু বা ঝুমুর কেউই সুখী হত না। তাই যে যদি গুলো হয় নি তা বোধহয় ভালোই হয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ। মিষ্টি আনতে যেতে হবে যে ! তাই আবার ডাক পড়েছে অন্তুর। অন্তু মনের ভিতর থাকা সব যদি গুলোকে পুরোনো ঘরের অন্ধকারে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসে । ঠিক করে আর ছুটবে না মরিচিকার পিছনে। এবার পালা সামনে তাকানোর।
-
গল্প- বিষ
বিষ
-মুনমুন রাহাআজকের রবিবারটা অন্য রবিবারগুলোর মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্ত সকালে বাজার থেকে এসে নিশিত যা খবর দিল তাতে মান্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মান্তুদের পাড়ায় অম্বিক আর তার বৌ নীতা নাকি একসাথে বিষ খেয়েছে। সকালের রান্নার লোক এসে অনেক ডাকাডাকি করেও যখন তুলতে পারেনি তখন পাড়ার ছেলেদের খবর দেয় আর তারপর তারাই দরজা ভেঙে দুটো মৃতদেহ উদ্ধার করে।
খবরটা শুনে থেকে মান্তুর মনটা কেমন যেন খচখচ করছে। খুব যে আলাপ ছিল ওদের সাথে তেমন নয়। কিন্ত নীতা মেয়েটাকে অফিস যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই দেখত মান্তু । কেমন যেন উদাস চোখে জানলার বাইরে দেখত। মুখ চেনা ছিল তাই চোখাচোখি হলে হাসি বিনিময় হত। কিন্ত ঐটুকুই। এর বেশি সেভাবে আলাপ ছিল না মান্তুর সাথে । আরও ভালো করে বলতে গেলে নীতার সাথে পাড়ার কারোরই সেভাবে আলাপ ছিল না । কেমন যেন ঘরকুনো প্রকৃতির মেয়েটা। অম্বিক বরাবরই নিজেকে নিয়েই থাকত । পাড়াতে খুব একটা মিশত না। কিন্ত সবাই ভেবেছিল ওর বৌ এসে এই দূরত্ব ঘোচাবে। কিন্ত বৌ নীতাও স্বামী অম্বিকের পথই অবলম্বন করল।
তবে মান্তু অম্বিকদের খবর মাঝেমাঝেই পেত পম্পার কাছ থেকে। পম্পা হল মান্তুদের বাসন মাজার লোক । সে আবার নীতাদের বাড়িতেও কাজ করত। সে মাঝেমাঝেই বলত অম্বিকের পয়সা থাকলেও নাকি তার মন খুব ছোট। নীতার আর অম্বিকের নাকি মিলমিশ নেই। আরও নানান কথা বলত কিন্ত মান্তু কোনোদিনই উৎসাহ দেখাত না এসব কথায়। অন্য লোকের হাঁড়ির খবর শুনতে কেমন যেন রুচিতে বাধত মান্তুর।
পরদিন সোমবার হলেও অফিস যায় নি মান্তু । ইচ্ছা একবার মায়ের কাছে যাওয়ার। পম্পা রবিবার দিন কাজে আসেনি । আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে। পম্পা একটু চুপচাপ। চোখগুলোও কেমন ফোলাফোলা। মান্তু আজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না । সব দ্বিধা দূর করে মান্তুকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে, নীতার এমন কথা শুনে কাল খুব কেঁদেছিস বুঝি ! কি করবি বল সবই নিয়তি। আচ্ছা, এই তো তুই বলতিস স্বামী স্ত্রীর বনিবনা হতো না ! তাহলে একসাথে বিষ খেল কেন? জানিস তুই কিছু? আমি অফিস যাওয়ার পথে দেখতাম নীতা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত। হ্যাঁ রে প্রেমটেম কিছু ছিল না তো? না মানে, হয়তো নীতার সেই প্রেমিকই কোন অশান্তির জেরে দুজনকে বিষ দিয়েছে! এমন তো কত কথাই শুনি আজকাল!”
পম্পা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “বৌদি, বিষ দিতে কি শুধু বাইরের লোকই লাগে? অথবা বিষ কি শুধু দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়? না গো , অনেক সময় কাছের মানুষটাই বিষ দিতে পারে । আর জান তো সব থেকে শক্তিশালী বিষ মানুষের ভিতরেই থাকে। ইচ্ছা করলেই সেই বিষ ঢেলে সামনের মানুষটার জীবন বিষাক্ত করে দিতে পারে কিছু বিষাক্ত মানুষ।”
– মানে! কি বলতে চাইছিস ?
-বৌদি আমার তো আর নীতা বৌদির বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাই। নীতা বৌদির জীবনের গল্প। খানিকটা তার কাছ থেকে শোনা কিছুটা নিজের চোখে দেখা । পম্পা শুরু করল- পম্পা মান্তুর কাছে বসে কথা বললেও তার দৃষ্টি যেন বহু দূরের। সেই দৃষ্টির দূরত্ব মাপার বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে মান্তু মন দিল পম্পার কথায়।নীতাকে ভগবান রূপ গুনে সুন্দর করে পাঠালেও, কপালটা তার সুন্দর ছিল না । খুব কম বয়সেই বাবা মাকে হারায় নীতা । বয়স তখন মাত্র বারো বছর। আশ্রয় হয় মামার বাড়িতে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকলেও বাবা মা পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে পড়াশোনাও বিদায় নেয় নীতার জীবন থেকে। কারণ নীতার মামি মনে করতেন নীতার পিছনে পড়াশোনার জন্য টাকা নষ্ট না করে মামা যদি ঐ টাকা জমায় তবে নীতার বিয়ের একটা হিল্লে হয়। তাই বারো বছরের নীতা পড়াশোনার পাঠ ছেড়ে মামির সংসারে ঝি বৃত্তি করতে লাগল।
এসব দেখে ভিতর ভিতর বড় কষ্ট পেত নীতার দিদিমা। কিন্ত তার কিছু করার ছিল না ছেলে বৌয়ের সংসারে। তাই তিনি যা করতে পারতেন তাই করলেন। চেনা পরিচিতদের পাত্র দেখার কথা বলেন। তখনই এক পরিচিত নীতার জন্য অম্বিকের সম্বন্ধটা আনলেন। অম্বিক বেশ অবস্থা সম্পন্ন। দাদুর কাছে মানুষ ছোট বেলা থেকে । বাবা মা নেই। দাদুও বেশ কিছু বছর হল স্বর্গবাসী। তাই এ হেন ভাল সম্বন্ধ হাত ছাড়া করতে চাইলেন না নীতার দিদিমা। তাই এগারো বছরের বড় অম্বিকের সাথেই পনেরো বছরের নীতার বিয়ে হয়ে গেল।
একরাশ স্বপ্ন বুকে বেঁধে দিন বদলের আশা নিয়ে নীতা অম্বিকের সাথে তার ঘরে এল। কিন্ত নীতার সেই স্বপ্ন আশা ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। কিছুদিনের মধ্যেই অম্বিকের আসল রূপ সামনে এল। অম্বিক নীতাকে বিয়ে করেছিল কেবল তার রূপ দেখে। রূপে মজে গিয়ে নয়! বরং নীতার রূপকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে। নিজের প্রমোশনের জন্য নীতাকে বসের কাছে ঠেলে দিত। নীতা রাজি হয়নি। কিন্ত অম্বিকের মার আর অত্যাচার তাকে বাধ্য করল অম্বিকের কথা মানতে।
নীতার রূপের মোহতে অম্বিকের বসও মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসতে লাগল। প্রথম প্রথম একটু চটুল কথা। হাতে হাত রাখা। পার্টিতে বসকে নিজের কোমরে হাত দিয়ে নাচতে অনুমতি দেওয়া বা তার প্রিয় ড্রিংকটা হাতের সামনে এগিয়ে দেওয়াতেই খুশি ছিল অম্বিকের বস। তাই অম্বিকও তার কাজ হাসিল হচ্ছে দেখে এতেই সন্তুষ্ট ছিল।
কিন্ত ঐ যে কথায় আছে না, নেশা আর পাপ এদের গতি সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। বছর খানেক পরেই বসের চাহিদা বাড়তে লাগল। কেবল এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় তার মন ভরল না। সে এবার বিছানায় একান্তে পেতে চাইল নীতাকে। অম্বিকের কোন কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্ত নীতা এই প্রস্তাব শুনেই ককিয়ে উঠল। তখন সে অম্বিকের সন্তানের মা হতে চলেছে। তার এক বুক নতুন স্বপ্ন সাজিয়েছে। মা ডাক শোনার অধির অপেক্ষারত সে। অম্বিকের হাতেপায়ে পড়ল। কিছুতেই কাজ হল না দেখ নীতা এবার আত্মহত্যার ভয় দেখায় অম্বিককে। এই কথায় অম্বিক থেমে যায়। কথা বাড়ায় না। নীতা নিশ্চিন্ত হয়।
তারপর হঠাৎই নীতার প্রতি অম্বিকের ভালবাসা আদর যত্ন বেড়ে যায়। মা হতে চলেছে বলে নীতার যত্নের ত্রুটি রাখে না সে। নীতা খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করে । ভাবে যাক, সে তার স্বামীর ভালবাসা না পেলেও তার সন্তান নিশ্চয়ই তার বাবার ভালবাসা পাবে । যে আগত সন্তানের জন্য অম্বিকের এত যত্ন , সেই সন্তান ভুমিষ্ট হলে না জানি কি করবে অম্বিক ! সুখের দিনের ভাবনায় আবার বুক বাঁধল নীতা। কিন্ত বোকা মেয়েটা এটা জানত না যে ছল কপট এইভাবেই আসে আশা ভরসার রূপ নিয়ে।নির্বিঘ্নে কাটল দুটো সপ্তাহ। একদিন সন্ধ্যার সময় অম্বিক নীতাকে বলে তার বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে। আর অম্বিক চায় নীতা যেন তার সাথে যায়। নীতা খুব খুশি হয়েছিল। এতদিন পার্টি মানেই অফিস পার্টি । বসের নোংরা হাতের ছোঁয়া আর লালসার দৃষ্টি দেখে এসেছে নীতা। তাই এমন ঘরোয়া পার্টিতে যাওয়ার কথা শুনে দ্বিমত করে না নীতা।
নির্দ্বিধায় সে অম্বিকের সাথে যায় পার্টিতে। বাড়িটা ছিল অম্বিকের বসের বাগান বাড়ি । অম্বিকের ষড়যন্ত্রে সেদিন নীতার উপর সারা রাত অত্যাচার চালানোর সুযোগ পেল অম্বিকের বস ও তার কিছু বন্ধুরা। সকালে নীতা যখন ঘরে ফিরল তখন সে জীবন্ত একটা লাশ ছাড়া কিছু নয়। আমি কাজ করতে গিয়ে দেখলাম নীতার দু’পা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তধারা। সব কথা শুনে শিউরে উঠলাম আমি । বুঝলাম নীতার গর্ভপাত হয়েছে। আমি আকুল হয়ে কাঁদলাম। কারণ আমি তো জানি নীতার কত আশা ছিল এই সন্তানকে নিয়ে। কিন্ত অদ্ভুত, নীতার চোখে এক ফোঁটা জল নেই। যেন একটা মৃতদেহ।
অনেকক্ষণ পর আমাকে নীতা বলে, “পম্পাদি একটু বিষ এনে দিতে পার ? ভাল বিষ, যেন আমার সম্পর্কের মতো ভেজাল না হয়। অনেক পুণ্য করার বৃথা চেষ্টা করলাম। এবার পাপ করতে চাই। ঐ জানোয়ারটাকে যদি আমি নিজে হাতে শাস্তি না দি তবে আমার সন্তান যেখানেই থাকুক শান্তি পাবে না।”
আমারও মনে জেদ চেপে গেল। বললাম নিশ্চয়ই দেব। আর দেরি না করে এনে দিলাম কিছু সেঁকো বিষ। আমি অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমার বিষ চিনতে ভুল হয় না। তাই বারবার সাবধান করে এলাম বড় সাংঘাতিক বিষ। কিন্ত আমি বুঝিনি নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ দিয়ে সেই খাবার নিজেও খাবে। ও তো অম্বিকের জন্যই আনতে বলেছিল এই বিষ কিন্ত নিজে কেন খেল কে জানে?”চুপ করল পম্পা। মান্তুর দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। সে জেন কিছুটা আপন মনেই বলে, “নীতা কি আজ মরেছে রে? নীতা তো সেদিনই মরে গেছিল যেদিন অম্বিকের কুচক্রে তার বস আর বসের বন্ধুরা মিলে ওর শরীরটাকে বিষিয়ে দিযেছিল। সেই বিষের এত জ্বালা যে ভিতরের ছোট্ট প্রাণটাও সেই বিষ সইতে পারেনি। নীতা তবুও নিজের মতদেহটাকে টেনে বাড়িতে এনেছিল বোধহয় অম্বিককে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। ওর কাজ শেষ করে ও নিজের শরীর থেকে মুক্তি নিয়েছে। হয়তো এই বিষাক্ত দুনিয়ার বাইরে ওর সন্তানের সাথে ওর আবার দেখা হবে!
যদিও আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্ত পরিস্থিতির চাপে। আর মানসিক যন্ত্রণায় নীতা কতটা মানসিক ভাবে সুস্থ ছিল আমার তাই নিয়ে খানিকটা সংশয় আছে । তবে একটাই শান্তি যে অম্বিকের মতো একটু জানোয়ার শাস্তি পেল। ইংরেজীতে একটা কথা আছে , চোখের বদলে চোখ। আর এখানে বিষের বদলে বিষ। অম্বিক যেমন নিজের বিষ দিয়ে নীতার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমনই নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ মিশিয়ে শাস্তি দিল তাকে।
-
গল্প- শীতল পরশ
শীতল পরশ
– মুনমুন রাহাআজ রায় বাবুদের বাড়িটা সেজে উঠেছে আলোয় আলোয়। আনন্দমুখরিত পরিবেশ। সবাই এমন এলাহি আয়োজনে ধন্য ধন্য করছে। পাড়া প্রতিবেশি থেকে আত্মীয়, সবার মুখেই ভেনু থেকে মেনুর প্রশংসা। হবে নাই বা কেন রায়বাবুর একমাত্র ছেলে নীলাদ্রির বৌভাত আজ । রায়বাবু যে বিস্তর সম্পত্তির মালিক তা সবাই জানে তাই তার ছেলের বিয়েতে এমন আয়োজনই প্রত্যাশিত।
কেবল আয়োজন দেখেই নয়, লোকে প্রশংসা করছে নীলাদ্রির বৌ তাপসীরও। রঙে , রূপে, শিক্ষায় সব কিছুতেই অসামান্য সে। নীলাদ্রি আর তাপসী, যেন মেড ফর ইচ আদার। কেবল নীলাদ্রি আর তাপসীই নয় মিল আছে ওদের পরিবারেও। নীলাদ্রির মতো তাপসীরাও খুব বড়লোক। কানাঘুষো এটাও শোনা যাচ্ছে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েকে নীলাদ্রির বিয়ে করার কারণ হচ্ছে তাপসীর বাবার সম্পত্তি। যার মালিক হয়তো ভবিষ্যতে বকলমে নীলাদ্রিই হবে।
অতিথিরা ফিরে গেছে যে যার বাড়ি। তাপসী ফুলের সাজে অপেক্ষা করছে নীলাদ্রির জন্য। প্রথম রাতের উত্তেজনা আর ভয় দুটোই গ্রাস করছে তাকে। ঘরে এসে ঢুকল নীলাদ্রি । তার অবশ্য তেমন ভয় বা উত্তেজনা কোনটাই নেই। কারণ সে বিছানায় এর আগেও বহুবার খেলেছে। সে এবিষয়ে পাকা খেলোয়াড়। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে যায় তাপসীর দিকে। মুখটা তুলে ধরে তারপর তার কোমোল ঠোঁটে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দেয়। তাপসী তার জীবনের প্রথম পুরুষের ছোঁয়াতে কেঁপে ওঠে। লজ্জায় রাঙা হয়ে নীলাদ্রির বুকে মুখ লুকায়।নীলাদ্রি আরও শক্ত করে তার বাহুডোর। নীলাদ্রির হাত খেলা করে তাপসীর পিঠের উপর আস্তে আস্তে নামতে থাকে হাত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত আসতেই তাপসী হাত সরিয়ে দেয় নীলাদ্রির। লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলে, চেঞ্জ করে আসি। নীলাদ্রি আরও একবার বুকে টেনে নেয় তারপর পকেটে রাখা হীরের আংটিটা পরিয়ে দেয় তাপসীর অনামিকাতে আর হাতে একটা প্যাকেট দেয়। বলে, আজকের রাতের জন্য স্পেশাল নাইট ড্রেস। তাপসী হেসে চলে যায় বাথরুমে চেঞ্জ করতে।
নীলাদ্রি ব্যালকনিতে এসে একটা সিগারেট ধরাল। মনটা তার ভারী ফুরফুরে লাগছে আজ। সুন্দরী বৌ আর সাথে তার অগাধ সম্পত্তি, আর কি চাই জীবনে। হঠাৎই ঘরের লাইটটা অফ হয়ে যায়। নীলাদ্রি দেখে রাস্তার আলোগুলো সবই জ্বলছে কেবল অন্ধকারে ঢেকে গেছে তার ঘরখানা। নিশ্চয়ই শর্ট সার্কিট। দেখতে যাবে বলে ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। ঘরের বাইরে বেরোনোর আগেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে একটা মেয়েলি হাত, হাতটা হীম শীতল। বোধহয় সবে স্নান সেরেছে বলে । নীলাদ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ভাল করে না দেখা গেলেও রাস্তার আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে নীলাদ্রির দেওয়া লাল ফিনফিনে নাইট ড্রেসটা। নীলাদ্রি আর দেরি করে না । তাকে কোলে নিয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।
নীলাদ্রি বিছানায় নিয়ে গেলেও নীলাদ্রি কিছু করার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলাদ্রির উপর। ঠান্ডা হাতটা দ্রুত নিরাভরণ করে নীলাদ্রিকে। তারপর দখল নেয় তার শরীরের উপর। এক মিনিট, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট… ছিটকে উঠে নীলাদ্রি একি! এ ছোঁয়া যে তার বড় চেনা। এই স্পর্শ সে তো ভুল করবে না! এ যে নয়নার স্পর্শ। এই উন্মাদনা তো নয়নার স্পর্শে সে পেত! কিন্ত নয়না! কিভাবে, কিভাবে সম্ভব! এবার দিল্লী থেকে পাকাপাকি কোলকাতায় আসার সময়েই তো নিজের হাতে গলা টিপে মেরে এসেছে নয়নাকে। বডিটারও ঠিকানা লাগিয়ে এসেছে। তাহলে , তাহলে! এসব কি হচ্ছে!ভাবনার মধ্যেই ঠান্ডা শরীরটা আবার দখল করেছে নীলাদ্রিকে। নীলাদ্রি চাইলেও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। অতিমানবিক শক্তির কাছে পরাস্ত সে। তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে সাপের মতো ঠান্ডা শরীরটা। নীলাদ্রির মনে পড়ে ঠিক এইভাবেই নয়নাকে আদর করতে বাধ্য করত নীলাদ্রি। প্রথমে সে আদর করত নয়নাকে তারপর নয়নাকে বলত তাকে এইভাবে আদর করতে। নয়না লজ্জা পেত, সংকোচ করত। কিন্ত নীলাদ্রি বলত এই খেলাতে কেবল ছুঁতে ভাল লাগে না অন্যজনের ছোঁয়াতেও ভালো লাগে।
নীলাদ্রিদের দিল্লীর অফিসে মাঝারি পোস্টে চাকরি করত নয়না। প্রথম দিকে তেমন ভাবে নীলাদ্রির নজরেও পড়েনি সে। একদিন বৃষ্টির রাতে অফিসের বাইরে নয়নাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিফট্ দেয় নীলাদ্রি। অফিসের বসের যাচা লিফট্ অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল না নয়নার। তারপর নীলাদ্রি শুরু করে তার প্রেমের অভিনয়। যা এর আগেও সে বহুবার করেছে মেয়েদের বিছানায় তুলতে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নয়নার সংস্কার একটু বেশিই ছিল। তাই খানিক সময় লাগে তাকে পার্ক, রেস্টুরেন্ট থেকে বিছানায় তুলতে । নয়না বিয়ের আগে নিজেকে সঁপে দিতে চায় নি নীলাদ্রির হাতে। কিন্ত নয়না আপত্তি জানালেই নীলাদ্রি সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখাত, তাতেই নয়না কাবু হয়ে যায়। কারণ নীলাদ্রি অভিনয় করলেও নয়না কিন্ত প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল নীলাদ্রিকে। দিল্লীতে ভালোই টাইম পাশ কাটছিল নীলাদ্রির। কিন্ত শেষের দিকে নয়না খালি ঘ্যানঘ্যান করত বিয়ের জন্য। তারপর যেদিন নয়না জানাল সে নীলাদ্রির বাচ্চার মা হতে চলেছে এবং এই বাচ্চা সে কিছুতেই নষ্ট করবে না। দরকার হলে নীলাদ্রির বাবা মাকে সব জানাবে, সেদিন আর নীলাদ্রি কোন রিস্ক নেয়নি। ততদিনে নীলাদ্রির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাপসীর সঙ্গে। নীলাদ্রি বোঝে নয়নার এই পদক্ষেপে বাধা পড়তে পারে তাপসীর সাথে বিয়েটা। তাই নয়নাকে সেই রাতেই গলা টিপে মারে সে।
নীলাদ্রির ঘুম ভাঙাল তাপসীর ডাকে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তাপসী বলে, ওঠো এবার, নীচে সবাই আমাকে কত খ্যাপাচ্ছে জানো, তুমি বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ বলে! মুখে একটা দুষ্টু হাসি খেলে যায় তাপসীর। নীলাদ্রি তাপসীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আচ্ছা কাল রাতে তুমি কিছু টের পেয়েছিলে? মানে, কাল রাতে কি হয়েছিল মনে আছে তোমার? তাপসী হেসে বলে, না গো কিচ্ছু মনে নেই। কাল এত ক্লান্ত ছিলাম কখন যে বাথরুম থেকে ঘরে এসেছি আর ঘুমিয়ে পড়েছি মনেই নেই। সকালে দেখলাম তুমি পাশে ঘুমাচ্ছ ! নীলাদ্রির মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাহলে কি হল কাল রাতে! তার যে অনুভূতি সেগুলো কি তবে সব কল্পনা! কিন্ত কল্পনা এত স্পষ্ট হয় কি?
মনের সব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাতের ঘটনাটা কল্পনা বলেই মেনে নেয় নীলাদ্রি। সকালটা ভালোই কাটে। কোন অস্বাভাবিকতার লেশ মাত্র নেই। তাই নীলাদ্রি আরও নিশ্চিত হয় রাতের ঘটনা কল্পনা ছাড়া কিছু নয় বলে। কিন্ত রাতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই অন্ধকার, সেই লাল ফিনফিনে রাত পোষাক, সেই ঠাণ্ডা শরীরের ছোঁয়া, সেই সাপের মতো সর্বাঙ্গ লেহন, নীলাদ্রির শরীরের উপর ঠান্ডা শরীরটার আধিপত্য বিস্তার। তাপসীর রাতের কোন স্মৃতি না থাকা। একরাত নয় দু’ রাত নয়, প্রতিরাতে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্ত সমস্যা হল নীলাদ্রির এই কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাইভাবে নীলাদ্রি ভুল বকছে। আর তাপসী নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত থাকে তাই কখন ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল থাকে না তার। অবশ্য তাপসীর নিজেরও তাই ধারণা। শুধু ওর একটাই অস্বাভাবিকতা লাগে প্রথম রাতে নীলাদ্রির দেওয়া নাইট ড্রেসটা এত করে খোঁজার পরও খুঁজে পায় না সে।কেটে গেছে একটা বছর। এই একটা বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। নীলাদ্রি এখন বদ্ধ উন্মাদ। তাপসীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার । নীলাদ্রি যতবার রাতের অভিজ্ঞতার কথা তাপসীকে বলেছে ততবারই তাপসীর মনে হয়েছে নীলাদ্রির মাথায় নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে। নীলাদ্রি প্রতিরাতের অত্যাচারে আর সবার অবিশ্বাসে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আস্তে নীলাদ্রির আচরণে পাগলামোর লক্ষণ দেখা যায়। নীলাদ্রিকে নিয়ে ওর বাবা সাইকোলজিস্টের কাছেও গিয়েছিল কিন্ত লাভ হয় নি কিছু। ডাক্তারের দেওয়া কড়া ঘুমের ওষুধেও ঘুম হয় না তার। এখনও প্রতিরাতে তাকে সহ্য করতে হয় ঐ ঠান্ডা শরীরের ছোঁয়া। সেই ছোঁয়া যেন প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে বুঝিয়ে দেয় অযাচিত ভাবে ছুঁলে ঠিক কেমন লাগে। প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে শাস্তি পেতে হয় তার কৃতকর্মের। কতদিন পেতে হবে তা জানা নেই, হয়তো আজীবন নীলাদ্রিকে ভোগ করতে হবে ঠান্ডা শরীরের স্পর্শ।