-
কয়েকটি রবিবার
কয়েকটি রবিবার
-রীণা চ্যাটার্জীসুধী,
আজকের দুনিয়ায় নতুন ঢেউ উঠেছে- সামাজিক নানা মাধ্যমে পুরুষের কান্না (নাকি কান্না বললাম না, ওতে নারীর একছত্র অধিকার) শোনা যাচ্ছে। পুরুষ জাতি যে বড়ো অত্যাচারিত- তা কবিতা, কথকতা, গল্প, ভাষণে বেশ ফলাও করে বলা হচ্ছে, সমমনস্ক সমর্থকরা সমর্থনের বন্যায় (অবশ্যই man made বন্যা, বলতে দ্বিধা নেই) ভাসিয়ে দিচ্ছেন। দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধে নুইয়ে পড়া কাঁধ নিয়ে ফ্যাকাসে জীবন-যৌবন নিয়ে বাছাদের বড়ো কষ্ট…
সত্যিই তো একজন সত্যিকারের পুরুষের যে অনেক দায়িত্ব- তা অস্বীকার করার বা তর্ক করার মতো মুর্খতা মোটেই শোভা পায়না। কিন্তু সত্যিকারের পুরুষ কজন! সে বিস্ময় থেকে মনের নিষ্কৃতি নেই।
সামাজিক মাধ্যমের তর্ক ছেড়ে একটু সাংসারিক প্রেক্ষাপটে চোখ রাখি। পুরু সর তোলা দুধ, ঘি, মাখন, ছানা, কাঁটা ছাড়া মাছের পেটি সে সব তো ভাঁড়ারের কথা, মা-ঠাকুমার ভালোবাসা- ও নিয়ে কথা হবে না। যে যার ভাগ্যে খায়…
আরও একটু গভীরে– দাম্পত্য সুখের ফসল সন্তান। প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে দেখুন মহামান্যরা একবার, চোখের সব জল শুকিয়ে যাবে- এ আমার কথা নয়, চিলেকোঠার পাশে কানে কানে বলা দুঃখের কথা, পরম্পরায় ভেসে চলেছে। আর ওই যে বিশেষ চারটি দিন? অশ্লীল শোনাবে বললে তাই না? চুপচাপ সহ্য করতে হয় কিছু যন্ত্রণা মুখে হাসি নিয়ে- জানতে দিতে নেই। এমন শিক্ষাই দিতে হয় মেয়েকে মা’র- তাঁর মা-ও তো দিয়েছিলেন। বয়স পেরিয়ে যায় আজকের মা কালকের ঠাকুমা-দিদিমা হয়ে যায়। তখন নতুন মেয়ের নতুন যন্ত্রণার দিন তাঁদের কাছেও বেহায়াপনা মনে হয়।
এ তো সব মেয়েদের নারী হয়ে ওঠার গল্প।
নারীর সংসার, জীবনের পাঠ- পৌরাণিক কাহিনি বিক্রম-বেতালের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই যে বেতাল রাজার পিঠে চড়ে বলল- সমস্ত রাস্তা মুখ বন্ধ করে চলতে হবে। মুখ খুললেই ছেড়ে চলে যাবে। পিঠে বোঝা চেপে গেল, গল্প শোনার পাঠ শুরু হল, তার থেকে কি শিখতে পারল শেষে তা বলতে হবে, না বললেই খন্ড খন্ড হয়ে যাবার হুমকি। যেই মুখ খুলল- সঙ্গে সঙ্গে আবার শর্তভঙ্গের দায় চেপে গেল। ছেড়ে গেল সেদিনের বহু কষ্টে পেরোনো পথটুকু। আবার নতুন ভোরের অপেক্ষায়…
সংসারে যেদিন মুখ খুলবে সেদিন আত্মীয়-পরিচিতের মুখগুলি আর চেনা যাবে না। আয়নাও অচেনা লাগবে…
আজকের নারী, আজকের পুরুষ- কি চায়, কি বোঝে, কিভাবে চলবে সে তাদের ইচ্ছে, তাদের দায়। তবে আমার কটা বিশুদ্ধ রবিবার চাই- একটা শীতের লেপমুড়ি দেওয়া রবিবার, একটা বর্ষায় ভেজা রবিবারে ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ তরল পানীয় চাই, রবিবারের গ্ৰীষ্মের শুকনো দুপুর চাই, চাই কবিতার সঙ্গে একান্তে এক রবিবার, চাই নির্ভেজাল পুরুষোচিত আয়েসী রবিবার। বাকি সব চুলোয় যাক- জন্মজন্মান্তরে নারী জনম আপন করে নেব, শুধু কয়েকটি রবিবারের বিনিময়ে, বড়ো লোভ জাগে পুরুষালি রবিবারে।নতুন বছরের হিমেল হাওয়ায় মিশে থাকা মিঠে রোদ্দুরের উষ্ণ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে।
(সব কথা সবার জন্য যেমন নয়, আবার সব কথা সবার সহ্য হবে, এমনও নয়- তবে বিতর্ক কাম্য নয়, কারণ এ নিতান্তই মনের কথা)
-
কবিতা- বন্ধু
বন্ধু
-রীণা চ্যাটার্জীবন্ধু…
জ্ঞান পরিখায় শিখে নেওয়া শব্দ;
একটি শব্দের মাঝে হাজার সোপান
অর্থবহ.. অর্থহীনতার শমিত শিখায়
যেমন যে টুকু জোটে..
ভাগ্যের হাতে হাতে..
খুঁজছি, বন্ধু পাইনি তোমায়।বন্ধু..
শুধুই পরিচয়? একসাথে পথচলা?
ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া..
সূত্রের বহমান ধর্মে- দিনের শেষে
কখনো অচেনা বা স্বার্থের খোলসে
মুখছবি চিনতে পারা? জরিপে
খুঁজেছি, বন্ধু পাইনি তোমায়।বন্ধু..
খুঁজছি আবেগে, গভীর আবেশে
ঘ্রাণে, প্রাণে, নতুনে-পুরাণে..
হাত বাড়ানো স্বার্থের আভাসে
পাই নি খুঁজে, বিবশ আমি..
বয়ে চলা জীবনের খাঁজে খাঁজে
বন্ধু, খুঁজে চলেছি তোমায়।বন্ধু..
খুঁজেছিলে কোনোদিন আমায়?
ভুল করে? বা ভ্রান্তিবিলাসে!
না কি ‘বন্ধু’ শুধুই কথার কথা?
যায় না পাওয়া জীবন পথে,
কেবল আকাশ কুসুম চাওয়া!
বন্ধু, খুঁজছি তবুও জীবন কিনারায়। -
ফুটেজ
ফুটেজ…
-রীণা চ্যাটার্জীসুধী,
জীবন যখন মৃত্যুর কথা বলে- জীবিতের ভিড়ে একা একাকী মৃত্যু নির্ভয়ে শুয়ে থাকে। জীবন কাঁদে- কতক তাগিদে, কতক উপসর্গে। উপসর্গ তো একটাই- কান্না, ভীষণ ছোঁয়াচে। পরিবেশ বিষণ্ণ হয়ে উঠতে দেরি হয়না। কতোটা সাজানো, কতোটা গোছানো সে তো অন্য কথা। কিন্তু মৃত্যু তো থামাতে পারে না কিছুই, নিজেই থেমে যায়- সেখানেই বোধহয় জীবনের জয়। জীবনের চোখের জল শুকিয়ে যায়। আবার নতুন সূর্য দেখে, গতানুগতিক। হঠাৎ করে মৃত্যুর কথা হয়তো মনে হতেই পারে অপ্রাসঙ্গিক- আসলে বেশ কিছুদিন ধরে কেমন যেন জানা-অজানা মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাকে ঘিরে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে- কিছু মৃত্যু মিডিয়ার ভাষায় ‘ফুটেজ’ খাচ্ছে, তার রেশ মিটেও মিটছে না। দিন দিন মহার্ঘ্য হয়ে উঠছে, যতক্ষণ না আরও একটা ভারী ‘ফুটেজ’ খাওয়া মৃত্যু সামনে আসছে।নামী দামী মৃত্যুর হাজার জ্বালা- সবকিছুই প্রকাশ্যে চলে আসবে অনর্গল। খোলা খিড়কি, ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকবে না। সুচতুর খোলা চোখ অলিগলি খুঁজে সব বেআব্রু করবে। মৃতের প্রিয়জন, অতি প্রিয়জন কালো কাচের আড়াল খুঁজবে অনুভূতি ব্যক্তিগত রাখতে। সেখানে ভিড় পৌঁছাতে না পারলে ক্যামেরার ঝলকানি উঁকি দেবেই। আসল কথা হলো নামী হলেই নামটা বেচতে হবে- ওটা পাবলিক প্রপার্টি। খবরটা বেচতে হবে, বেচতে জানতে হবে।
বেনামী মৃত্যুর জ্বালা কম কিছু নয়। অর্থে দখল থাকলে শেষকৃত্যে বাঁধা নেই। যেখানে অর্থের অভাব সেখানে শেষকৃত্য পথ চেয়ে বসে থাকে। যতোই হোক মৃত্যু নথিভুক্ত তো করতে হবে। একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখলাম- ভোর রাতে আগুন লেগে পুড়ে গেল রাস্তার ধারে একটি ঝুপড়ি। পাওয়া গেল আধপোড়া বিকৃত মৃতদেহ, শেষকৃত্যে দেরি হলো- চাঁদা তুলতে হলো যে, যোগাড় অবশ্য হলো, নমো নমো করে আপদ চুকেও গেল। পরদিন সেই পোড়া ঝুপড়ির ফাঁকা জায়গা দেখে বিয়েবাড়ির বরযাত্রীরা বাজি ফোটালো। তারপর দিন ওখানে একটা নতুন ঝুপড়ি বাঁধতে দেখলাম। সবটুকু ‘ফুটেজ’-হীন। যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়লো যার যেভাবে, সে সেইভাবে দেখলো, সেইভাবে ভাবলো। শুধু একটাই সত্য- ওই প্রিয়জনদের শোক লুকোতে হয়নি, কালো কাচের আড়াল লাগেনি। রাস্তার ওপরেই কখনও বুকফাটা কান্না, কখনও নীরবে চোখ মোছা। ফিরে কেউ কেউ দেখেছে, চোখ ফিরিয়ে চলেও গেছে। ফিরে দেখার ‘অত সময় নেই…’ পথচারীদের। পথের শোক, পথেই মলিন হয়েছে অনায়াসে। জীবন ওখানে লিখে গেছে- মৃত্যু ক্ষণিকের, সত্য হলো চরৈবতি…ফুটেজ গড়াগড়ি খায় ফুটপাতে।
জীবনের উষ্ণতার ছোঁয়া শুভেচ্ছা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে। -
কবিতা- অসম্পূর্ণ
অসম্পূর্ণ
-রীণা চ্যাটার্জীদৃষ্টির শেষ কোণে- আলো হারানোর বেলায়
সূর্য ডোবার পরে শপথের বৈধতার প্রশ্নে
নতুন গল্প বলে না আর জীবন।
ভাবের ঘরে ভাবনারা সিঁদ কাটে,
হাট বাজারের ডানা ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ে,
নিখুঁত বসতের ভিত খুঁজতে।
ভেজাল ভিতে, চোরাবালির ঘুর্ণনে
ঘুমিয়ে পড়ে কতক সামগ্ৰী চিরদিনের মতো
চোরকাঁটা বুকে নিয়ে।
বাকি থাকে ফাঁকি যাওয়া বাঁকের ফাঁক,
হিমেল হাওয়ার অবাধ আনাগোনার
ফরমান জড়িয়ে।
পাঁজরের বুক চিরে হাপরের উষ্ণতার ফাঁপরে ফাটলের চোরা ফিসফাস ফেরি
হয়ে যায় অতি সহজে।
বেপরোয়া আঁধারের কোলে ইচ্ছেরা
বেসুরো সুর ধরে, ঝরে পড়ে আবিলতা
মুঠো মুঠো ভরে।
ভাবনারা অভ্যাসের ঘনঘটায় পথ চলার
পাথেয় হয়ে যায় সঙ্গোপনে অলিখিত চুক্তির চিরকুটে। -
আকাঙ্খিত
আকাঙ্খিত
–রীণা চ্যাটার্জী
নতুন আশা, নতুন ভাষা, নতুন করে ভালোবাসা।ভালোবাসার বন্ধনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা, জীবনের রসদ খোঁজা। আলাপী মন-এর বিজয়া সম্মেলন সকলের স্বতস্ফুর্ততায় প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিল সবটুকু সময়।
মিষ্টির বাক্স হাতে অতি প্রিয় মুখ-কি মধুর! তবে পরিচিত মুখগুলো দেখলেই মনে আনন্দ দোলা দিয়ে যায়। মিষ্টির বাক্স অবশ্যই উপরি পাওনা। উষ্ণ আলিঙ্গনে মনে যেন সেই এক সুর বেজে ওঠে অজান্তেই, ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো..’। আলাপী মন সাধ্য মত আয়োজন করে থাকে, কিন্তু তাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণময় করে তুলেছেন আলাপী মন-এর উপস্থিত সকল স্বজন সাথীরা।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, চতুর্থ মুদ্রণ সংকলন ‘জাগৃতি’র চোখ মেলে চাওয়া, স্মারক সম্মান, গান, কবিতা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে। বেলা ঘনিয়েছে নিজের নিয়মে- টের পাওয়া যায়নি। মুগ্ধতায় রেশ নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একটা সময় অনুষ্ঠান যেন এক কিশোর গলার জাদুতে বশ হয়ে গেছিল। আবেশ কথাটা শুনেছি, সেদিন অনুভব করলাম। কারোর মুখে কথা ছিল না- চোখে ছিল অবর্ণনীয় এক অনুভূতি। কবি কাজল দাস-এর পুত্র রূপ- সেদিন যেন রূপ সকলের কাছে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। উপস্থিত সকলেই হয়তো আমার সাথে একমত হবেন বলেই মনে হয়। এইভাবেই কেটে গেল বহু আকাঙ্খিত একটা দিন। উপস্থিত সকলের কাছে কৃতজ্ঞ আলাপী মন।
আরো কিছু প্রিয় মুখ দেখার অপেক্ষায় অধীর ছিল মন। কিন্তু মনকে বোঝাতে হয় সবকিছু একসঙ্গে পাওয়া যায় না- বিধির বিধান মেনে তো নিতেই হয়।
হেমন্তের শিশির সিক্ত শুভেচ্ছা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে সবার জন্য। আগামী শুভ হোক।
-
কবিতা- নীরবতা
নীরবতা
-রীণা চ্যাটার্জীনীরবতা, কোনো ঝঙ্কার আছে তোমার?
আছে কোনো পরিচিত ছন্দ!
কোনো গোপন কথা বা গভীর ব্যথা?
খুব জানতে ইচ্ছে করে-
যখন তোমার আলিঙ্গনে একাত্ম হয়ে যাই
মনে হয় কি যেন বলতে চাইছো বারবার,
প্রতিবারই নতুন অথচ ক্ষীণ ফিসফিস…
ক্ষণজন্মার মতো হারিয়ে যায়,
নাগাল ছেড়ে সীমানার বাইরে…
খুঁজি, খুঁজতেই থাকি-
ভাবনায় বাসা বাঁধে অন্বেষণ।
প্রলয় মাতন শিরায়-উপশিরায়-
অসহায় উন্মত্ততার নিদাঘ নিলামে,
ভেসে আসে বিচিত্র ফিসফাস-
আকুতির আকুল মেঘলা আকাশ
ঝরিয়ে দেয় অব্যক্ত অধরা শব্দ
নীরবতার অবসানে সে যেন
এক অনন্য নীরবতা- বেদনার রঙে নীল,
আবছা ধূসরতায় হারিয়ে যায় দূরে,
অষ্ফুট শব্দেরা, শোনা হয় না-
থেকে যায় নীরবে নিবিড় আলিঙ্গনে
হিম নীরবতা… একান্তে। -
উৎসবে ও উৎসে
উৎসবে ও উৎসে
-রীণা চ্যাটার্জীসুধী,
উৎসবের আমেজ নিয়েই শরতের যাওয়া-আসার শর্ত। আকাশ-বাতাসে উতলা স্বর, মন যেন ছুটি খোঁজে নিত্যদিনের দিনপঞ্জি থেকে। বাঙালির প্রিয় উৎসব আর এই উৎসবের আবহে বেশ কিছুদিনের শিথিলতা। কারোর ভাবনার ঘরে তালা, কারোর ভাবের ঘরে তালা। উৎসব আমাদের মনটাকে নিয়ে যায় অন্য আবহে- যেখানে প্রিয়জনকে কাছে পেতে চায় মন, আনন্দঘন মুহূর্তগুলো ভাগ করে নিতে চায় সাধ্যমত। আবার এই উৎসব ঘিরেই কত অচেনা মুখ পরিচয়ের গণ্ডী ছুঁয়েই আপন হয়ে ওঠে। কোনো কোনো পরিচিতি উৎসব শেষেও সম্পর্কের গ্ৰন্থিতে বাঁধা পড়ে, আবার কিছু পরিচয় আতস বাজির মতো ক্ষণিকের। আতস বাজির কথায় মনে এসে গেল আরো এক উৎসব- কালি পুজো, দীপাবলী, দীপান্বিতা। ওই একটা দিনেই বহু রূপে ঈশ্বরের আরাধনা- বিবিধ আচার। বাঙালি বড়ো আবেগপ্রবণ- আবেগের ধারায় ভেসে থাকে জলে যেমন পঙ্কজ ভাসে। বাঙালীর বোধহয় পঙ্কজ না হয়ে উপায় নেই। হঠাৎ করে যেভাবে ধর্মীয় সন্তানরা রীতিনীতি, সনাতনী, পুরাণ, বেদ, শাস্ত্রীয় আচারণ, সামাজিক আচরণ সবকিছু নিয়ে উৎসবের আবহে সমালোচনার ঢেউ তুলছেন তাতে ভাবনায় বেশ ধকল লাগছে। উৎস খুঁজলে একটা কথাই ভাবতে বাধ্য করছে মানুষ আগে না কি ধর্ম আগে! ধর্ম মানুষ সৃষ্টি করলো না কি মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করলো? সাধারণ জ্ঞান তো বলে ধর্ম মানুষের সৃষ্টি, আর ধর্মকে ধারণ করতে কিছু আচরণের ব্যয়-বৃদ্ধি। সমাজ যখন মানুষের তৈরি সম্মিলিত সংস্কৃতি। সব যখন মানুষের হাতেই গড়া- তাহলে সামাজিক আচরণ তো ধর্মের আঙিনায় বেড়ে ওঠে। আলাদা হয় কি করে? এইসব সাজানো রীতিনীতি, যা সুযোগ মতো সুযোগসন্ধানীরা চাপিয়ে দিয়েছিলেন বা দিয়েছেন। ক্ষত তৈরি করেছেন। পুরাণ বা সনাতন ধর্ম যা কিছুই হোক না কেন তৎকালীন সমাজ ও ধর্মীয় সন্তানরা দায় এড়াবেন কোন শর্তে? হঠাৎ করে যেন মনে হচ্ছে সেই ধার্মিক সন্তানরা আবার মাথাচাড়া দিয়েছেন। ইতিহাস না কি সব বিকৃত, নতুন করে গড়ে নিতে মজবুত হয়ে ওঠার ডাক দিচ্ছেন। জানি না, আজ যদি সত্যি করেই নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টা হয়, আগামী কবে তাকে “বিকৃত” উপাধি দেবে- অহেতুক রক্তক্ষরণের আভাস তাই থেকেই গেল ‘ধর্ম’ নামাঙ্কিত টোলের মহিমায়।আগামী ২৯ অক্টোবর আলাপী মন-এর বিজয়া সম্মেলনী। আলাপী মন-এর চতুর্থ মুদ্রণ সংকলন ওইদিনেই উষ্ণতার স্পর্শে চোখ মেলবে স্বজনসাথীদের উপস্থিতির মাঝে। ব্যস্ততায়, অপেক্ষায়, আশায় কেটে যাবে মাঝের কয়েকটি দিন।
আগামীর শুভেচ্ছা ও শুভকামনায় আলাপী মন।
-
গল্প- বিরতি
বিরতি
-রীণা চ্যাটার্জীঠিক সকাল নটা সাঁইত্রিশ, না না আরো দুই থেকে চার মিনিট আগেই দেখা হয় রোজ।
দেখা হয় মানে দেখতে পাওয়া। চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ নেই, কারণ ভঙ্গীটা রোজের একইরকম- চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে খবরের কাগজ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ে একদম নির্লিপ্ত। মধ্যপঞ্চাশের অফিসযাত্রী। হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে তাতে চোখ রেখেই পেরিয়ে যান মেট্রোরেলের এক একটা ধাপ- লিফটে ওঠা, গেটের বিধিনিষেধ পেরিয়ে প্লাটফর্মে হাঁটা, ট্রেনের অপেক্ষা, ট্রেন এলে উঠে বসা সবকিছুতেই কাগজ থেকে কিন্তু চোখটা সরে না। যেন কাগজটার প্রতিটা ইঞ্চিতে গভীর অনুরাগ। কখনো এ পাতা, কখনো ও পাতা, এই দু’ ভাঁজ তো পরক্ষণেই চার ভাঁজ, তারপর আটভাজা, শেষে কোনও বিশেষ একটা জায়গা খামচে ধরে চোখের সামনে রাখা। ‘কাগজ ভিজিয়ে’ পড়ছে এই কথাটা অনেকবার শুনেছে মৃদুল। কিন্তু এ তো ভেজানো নয়- ভাজাভাজি করা, খবর কবর থেকে বের করে আনা প্রায়। উৎসুক মন প্রায় মাস দুয়েক দেখতে দেখতে উৎসাহে আরো উৎসুক হয়ে উঠলো। কি এতো পড়তে পারে মানুষ? কোনও দুই একটা বিশেষ বিষয়ে আগ্ৰহ থাকতে পারে, কিন্তু… যাই হোক না কেন, ইচ্ছেটা পাশে থেকে দেখা, কি এতো যুদ্ধ করেন নিরীহ খবরের কাগজের সঙ্গে ভদ্রলোক! সুযোগ খুঁজলেই পাওয়া যায়, মিলে গেল। একদিন পাশে বসার জায়গা পেয়েই গেল মৃদুল, শুধু দেখার কাজটাই বাকি। কিন্তু দুর্ভাগ্য কাগজটি তখন ভাজাভাজির পালা সেরে প্রায় আট ভাঁজে, দশ আঙুল আর চোখের কবলে। অন্য কারোর দেখার উপায় নেই। পাশে বসেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলো না। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেল রোজের যাতায়াতের সময়। মেট্রোরেলে মিনিট ছয়েক জার্নি, সময় বড়ই কম। মেট্রো থেকে নামার পরেও এক ভঙ্গীতে তিনি এগিয়ে যান অটোস্ট্যান্ডের দিকে। ওই ফাঁক গলেই তিনি চোখছাড়া হয়ে যান, এক অটোতে বসার সুবিধা হয়ে ওঠে না। হয় তিনি আগে, নয় মৃদুল আগে, এই আগে-পরের চক্করে খবরের কাগজ ব্যবহারের শেষ পর্যায় আর দেখা হয়না। পরের ব্যাপারে নাক গলানোর ভীষণ বদ অভ্যাস জেনেও স্বভাববিরুদ্ধ এই বদ অভ্যাসে দিন দিন অস্বস্তি বাড়তে থাকে। ভেতরে একটা খচখচানি- একটা কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার অস্বস্তি। এমন অবস্থা হলো- ওনার চোখ কাগজে, মৃদুলের চোখ ওনার ওপর। আশেপাশের লোক যে তার আচারণেও কিছু ভাবতে পারে- সেই বোধ মেট্রোরেলের চাকায় বোধহয় পিষে গেছে।সবদিন তো আর সময় যায় না। কথায় আছে “উদ্যোগিনং পুরুষ সিংহ…” লক্ষ্মীলাভ এখানে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু উদ্যোগ প্রায় সফল। অটোয় পাশাপাশি বসার জায়গা হয়েই গেল। মৃদুলের মনে স্ফুর্তির স্ফুলিঙ্গ, ‘যাই করো বাপধন এখানে আর রেহাই নেই, তোমার ভাজাভাজি আজ দেখবই।’ যখন গুছিয়ে পাশে বসলো, ওনার চোখ ততক্ষণে আবার কাগজে। আশ্চর্য! চোখটা রাখলো ওনার কাগজে, কিন্তু এতো কাছাকাছি, পাশাপাশি বসেও… নাহ্, শুধু কালো পিঁপড়ের সারি, কাগজটা তখন প্রায় মুঠোবন্দী। মৃদুলের গন্তব্য এসে গেল ওনার আগেই। এমন সময়েই মুচমুচে কাগজটা প্রায় মন্ড পাকিয়ে ব্যাগে ভরে রাখছেন। এতোক্ষণে মনোযোগী পঠনে বিরতি পড়লো। দীর্ঘশ্বাস…মৃদুলের। মুখ ফস্কে বলেই ফেললো, শেষ হলো যুদ্ধ? উনি তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। বললেন, ‘আমাকে কিছু বললেন?’ চুপচাপ ভাড়াটা মিটিয়ে নেমে গেল- বাকযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই। অবশ্য আর দেখা হয়নি ওনার সঙ্গে বেশ কিছুদিন হলো। ট্রেনের টাইমটা বদলে নিয়েছিল মৃদুল। ভয়ে? হতেই পারে- প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়ার পর আর মুখোমুখি হতে চায়নি। হয়তো-বা বিরতি দিয়েছিল এই অহেতুক উৎসাহে, বদভ্যাসের বিরতিও বলা যেতে পারে।
-
ফাঁকে পাঁকে
ফাঁকে পাঁকে
-রীণা চ্যাটার্জীযা দেখছি, যা শুনছি, বলা ভালো দেখতে বা শুনতে বাধ্য হচ্ছি- এটাই গণতন্ত্র তো?
গত মাসে গুটি কয়েক সুশিক্ষিত নাগরিক ৭৬ তম না কি ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস এই নিয়ে বিতর্ক ও বাদানুবাদে বেশ খানিকটা সময় উপভোগ করলেন। কিন্তু তাঁরা যদি একটু বলতেন! কিসের স্বাধীনতা? কোথায় স্বাধীনতা? আলো দেখতে পেতাম নতুন করে। বিরোধী পক্ষ বা প্রশাসনিক পক্ষ যার কথাই ধরি না কেন- আপনারা উভয়েই ঠিক বলছেন তো? এ যেন স্ব-গর্বিত সুপ্রাচীন গণতন্ত্র বা স্বাধীনতার অন্তরালে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। কেউ বলছেন, ওরা একটা মারলে আমরা দশটা মারব। আবার কারোর বক্তব্য ‘গুলি’ই নাকি সঠিক দাওয়াই। দশটা মারুন আর গুলি করে মারুন কাকে মারবেন? যদি প্রকৃত অর্থে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব জীবনচক্রে উপভোগ করে থাকেন সেই স্নেহের পরাকাষ্ঠার দোহাই দিয়ে বলি, শুরু হোক নিজের ঘর থেকে… আর নিদেনপক্ষে মনুষ্যত্ব বলেও কিছু থাকে একটু ভাবুন- কতোটা অধিকার কাছে আপনাদের কাউকে মেরে ফেলার। গাছের প্রাণ আছে, ওরাও ব্যথা পায় ভারত শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আবিস্কার করেছিলেন, সেই নিয়ে আমরা ভারতবাসীরা গর্ব করতে পারি, কিন্তু মানুষের প্রাণ? ওটা মনে হয় আলাদা করে ভাবার দরকার নেই, গোটা কয়েক দুর্মূল্য জীবন ছাড়া বাকি সব কুরুক্ষেত্রের পাশার ছকেই থাক। দরকার মতো টেনে নিলেই হবে।
আসল কথা ক্ষমতা বড় বালাই- যার আছে তার, যার নেই তারও। একপক্ষের ক্ষমতা প্রদর্শনের পালা, আর একপক্ষের বৃথা আষ্ফালনের। আবার যুক্তি তক্কো তো আছেই, ওরা এর থেকে বেশী করেছে, ওদের আমলে এর থেকে বেশী হয়েছে, এ রাজ্যের থেকে ও রাজ্যের অবস্থা আরও খারাপ- খবরটা ভালো করে দেখো বা ইতিহাস বলছে এই ঘটনা আগেও হয়েছে ইত্যাদি, প্রভৃতি। আরে বাবা, যদি সেই চর্বিত চর্বনেই থাকতে হবে, তবে তোমরা পরিবর্তন ঢাক কেন বাজালে? শুভাকাঙ্খী কেন সাজলে? বেশ তো ছিলাম এক পাঁকে, এই ফাঁকে ফাঁকে পাঁক- এখন উদ্ধারের পথ?পরিবর্তন, উন্নয়ন সব কি বাহ্যিক! মাটি কেটে রাস্তা হলো, সেতুবন্ধন হলো। কিন্তু মানুষের আত্মিক উন্নতি হলো কি? সম্পর্কের সেতুবন্ধন! আসলে গাছটাই তো উপড়ে ফেলা হয়েছে, ফুলের আশা করা বৃথা। কিন্তু শিকড়ে বড়ো টান- মায়ের মনটা বড়ো ভীত আর সন্ত্রস্ত …তবুও ‘চেতনা আসবে’ এই আশাই জেগে থাক টিমটিমে মৃৎপ্রদীপের স্নিগ্ধ আলোর স্তিমিত ভাবনায়।
অন্তরে যাই থাক, তিলোত্তমা কিন্তু সেজে উঠেছে বহিরঙ্গে, বাঙলা-বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব শরৎ-পার্বনে। শরত শিশিরের সিক্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে।
-
নিষ্প্রাণ অনুভব
নিষ্প্রাণ অনুভব
-রীণা চ্যাটার্জীসুধী,
১৫ই আগষ্ট- স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটা ভারতের ইতিহাসে, বছরের দিনপঞ্জিতে যুক্ত হওয়ার আগে বিদেশী শাসকের যূপকাষ্ঠে বলি হলো কত নিষ্পাপ প্রাণ, স্বাধীনতার আকাঙ্খা মুঠোয় নিয়ে। দেখে যেতে পারেনি ওরা স্বাধীনতার উৎসব, দেখেনি জীবন্মৃত মায়ের শূণ্য কোল, শোনেনি আর্তনাদ, হাহাকার। যেদিন স্বাধীনতার পতাকা হাওয়ায় উড়ে মুক্তির বার্তায় মুখরিত হয়ে ছড়িয়ে গেল আকাশে-বাতাসে, সেদিন নেতাদের উল্লাসে, আনন্দে, পারস্পরিক অভিনন্দন বার্তার ছবিকে ছাপিয়ে দেশমাতৃকার মাটি স্বাধীনতার কণাটুকুও ছুঁতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষ হয়তো জানতে পারলো, বুঝতে পারলো কি? মুষ্টিমেয় জনগণ, নেতা-কুর্সি, ক্ষমতার ব্যবহার- অপব্যবহারে, অহঙ্কারে, লোভে, উন্নতি, উন্নয়নশীল নানান পরিভাষার পরিচ্ছদে কুক্ষিগত হয়ে গেল যেন কেমন করে স্বাধীনতার মুক্তি। ফিকে হয়ে এলো স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠের শোণিত ধারার রক্তিম আভা, তারপর ধূসর-মলিন।
ঘুরে দেখলে কি দেখতাম? লুকোনো এক জগৎ- যেখানে স্বাধীনতা না এলে কিছু যায় আসত না, ঠিক যেমন আজ ৭৫ বছর পরেও কিছু যায় আসেনি। অমৃতের ভাগ মহোৎসব ঘিরে ভাগাভাগি হয়ে গেছে, লুকোনো জগৎ আজও গরলে বাঁচে। ওরা নীলকণ্ঠ– ক্ষুধার বেদনায় নীল, অসহায় জীবনের ছবিতে নীল, ওদের চোখের জলের শুকনো ধারায় গালে স্থায়ী জলছবি- তবু ওরা বাঁচে, বেঁচে থাকে ধুকপুকে জীবন আর ভোগান্তির আয়ু নিয়ে।
বড়ো বেআক্কেলে কথা দিনক্ষণ না দেখেই বলছি, জানি অনেকের এটাই মনে হবে। এটাও মনে হবে, বলেই বা কি লাভ! এ তো প্রতি বছরের ‘থোর-বড়ি-খাড়া, …’ নতুন কি? আদতে আমি মানুষটাই তো বড়ো বে-আক্কেলে,নাহলে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’-র মতো মহান উৎসব থেকে দূরে সরে থাকার জন্য ঘরটা রঙীন করা হলো না- মনটা চাইলো না যে…স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠের ধূসর রঙটা কেমন যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে মানসপটে, নিষ্প্রাণ হয়ে যায় স্বাধীনতার অনুভব এই দিনগুলো ছুঁয়ে গেলে…সকল শুভানুধ্যায়ীদের জন্য রইলো আগামীর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে।