• কবিতা

    কবিতা- অপহৃত অধ্যায়

    অপহৃত অধ্যায়
    -রীণা চ্যাটার্জী

    জীবনের পরিচিত ছন্দগুলো,
    কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে!
    আলসেমির কার্ণিস বেয়ে…
    টুপ টুপ করে শরতের শিশিরের মতো,
    ছড়িয়ে যাচ্ছে কংক্রিট, ঘাস, মাটি
    ইতস্তত ছুঁয়ে- ধরা দিয়েও অধরা গোলার্ধে।

    আমি নয়, আমার মাঝে আর এক সত্ত্বা,
    অনর্থক উপাচারে হয়তো জমা ছিল,
    কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে তা’ও-
    মৃদু সুবাসে রেখে যাচ্ছে ছন্দিত আভাস।
    অলক্ষ্যে ভেসে যায় দূরে আরো দূরে
    পঞ্চ ভূ-তে মিশে যাচ্ছে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে।

    আবছায়া এক অবয়ব নীরব প্রতীক্ষায়
    প্রহর শেষের আলোয় নিভু নিভু জ্যোতি
    শক্তি সঞ্চয় করে, জ্বলে ওঠে দপ্ করে
    শেষ নিঃশ্বাসের জন্য জন্মের শোধ দিতে
    শুভ্র ধূম আশ্রয় করে, পড়ে থাকে
    শূণ্য কার্ণিসে ডানা মেলে অপহৃত অধ্যায়।

  • সম্পাদকীয়

    ভাবের ঘরে চুরি

    ভাবের ঘরে চুরি
    রীণা চ্যাটার্জী

    সুধী,
    রোজ চলার পথে আজকাল মুর্তি বড়ো বেশি চোখে পড়ে। নানারকম প্রকল্পমূলক প্রতীকের মুর্তি- যেখানে উন্নয়ন দু’হাত বাড়িয়ে মুচকি হাসে। আছে পুরোনো দিনের বহুল পরিচিত মুর্তি- পুরোনো কলকাতাকে মনে রাখার, ধরে রাখার প্রয়াস। যদিও তিলোত্তমা রোজ ক্ষয়রোগের দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে। আছে মনিষীদের পরিচিত ভঙ্গীর মুর্তি। ভাবগম্ভীর দু’হাত আড়াআড়ি, মাথার পাগড়ি ঘাড় দিয়ে সামনে এসে পড়েছে, সুদুর প্রসারিত পাথুরে দৃষ্টি। আছে টাক মাথা, হাতে লাঠি, চোখে চশমা, হেঁটো ধুতিতে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটার এক পা এগিয়ে রাখা মুর্তি। তারপর পুরানের রথী-মহারথী তাঁদের সারথী, হাতি, ঘোড়া সবকিছু নিয়ে যে যেমন জায়গা পেয়েছে, জাঁকিয়ে বসেছে ফুটপাতে, রাস্তার মোড়ে। কিন্তু বড়ো উঁচুতে, কাকপক্ষী নাগাল পায় অতি অনায়াসে। রোজ বাহ্যে-আহ্নিক সেরেও যায় সন্ধ্যায়-প্রত্যুষে। মানুষ শুধু মনে করে দিনক্ষণ দেখে। চাঁদা তুলে মালা, ধূপকাঠি জোগাড় করে ঝেড়ে, ফুঁকে পরিস্কার করে, অতিথি বরণে আর মাইকের অতিশব্দময় ব্যঞ্জনায় এলাকাবাসীর শান্তির দড়িতে টান দিয়ে মনে করিয়ে দেয় নির্জীব মুর্তির পিছনে তাদের সজীব অস্তিত্ব।
    হঠাৎ মুর্তির কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতেই পারে। কিন্তু সত্যিই কি অপ্রাসঙ্গিক? এক একটা মুর্তি যেন কোনো কোনো সময় মনের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়। স্বামীজির পাথুরে দৃষ্টি বলে দেয় অন্তঃসারশূন্যতার কথা। আমরা তাঁর কথা বুঝিনি, বুঝতে চাইনি, শুধু তাঁর অবয়বের প্রচার কাজে লাগিয়েছি, তাই তো তাঁর বাণী, তাঁর ভাবনা সব বিকাশের ভান করে দাঁড়িয়ে আছে, নাহলে হয়তো ওই দৃষ্টি পাথুরে প্রতীক না হয়ে যুবসমাজের চোখে ষ্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠতো। গান্ধীজির মাথাটা বাঁচাতে কবে যেন কে একটা ছাতা লাগিয়ে দিয়েছিল- ব্যস দায়িত্ব শেষ, ভুলে গেছে। তার বিবর্ণ শতছিন্ন অবহেলার নীচে গান্ধীজি- দৃষ্টিকটু? প্রথম প্রথম মনে হলেও এখন মনে হয় কি অদ্ভুত মিল, আমাদের তাপ্পি মারা মানসিকতার সাথে ওই মুর্তিটার। আমাদের হেরে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার জীবন্ত নিদর্শন। ব্যর্থতার পরিচয় দিতেই যেন দাঁড়িয়ে পড়েছেন রাস্তা ফুঁড়ে। দাঁড়িয়ে আছেন পরমহংসদেব, পাশে বসে মা সারদা, অন্য পাশে বসে স্বামীজি। তিনমুর্তি একসাথে- এরা বেশ নাগালের মধ্যে, ভালো ভাবে দেখাও যায়। কিন্তু বেমানান না! শুধু পরমহংসদেব দাঁড়িয়ে বাকি দুজন বসে.. মানীর মান! এ কিসের প্রতীক? যাই হোক শিল্পী বা পাড়ার দাদারা যেমন ভেবেছেন। আসি ভঙ্গিমার কথায়, আলোর বিকিরণ- বিচ্ছুরণ বোঝানোর মত দুই হাতে দুই ভঙ্গী রামকৃষ্ণের মুর্তিতে। ভাবখানা এই দিক দিয়ে এসে পড়লো, ওই দিকে বেরিয়ে গেল- চটজলদি। কি অদ্ভুত মিলে গেল আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ও ভাবনা। একটা বিতর্কের জন্ম হয়, চাপা দিতে আর একটা বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। আমজনতা মেতে ওঠে, একটার পর একটা ধরতে। বেশ ধামাচাপা পড়ে যায় আগের ঘটনা, নতুনটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলেই আরো একটা বিতর্ক বানাতে কতক্ষণ লাগে! আবার সময় মতো তুলে এনে তালুতে ফেললেই হল। সঙ্গে দোসর করোনা আর মিডিয়া- পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলেই করোনো বেড়ে যাবে, মিডিয়া ঘন্টায় ঘন্টায় ভয় দেখাবে “সীমা থেকে সীমানা” ছাড়িয়ে।
    তাহলে কি আমরা মনীষীদের দেখানো পথেই চলেছি- নাহ্, শুধু ভান করছি আর ভাবের ঘরে চুরি করছি।

    বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষাও ঘন্টা নাড়িয়ে এসেও গেছে- কিন্তু রেহাই নেই অস্বস্তির আর্দ্রতা থেকে। ঝলমলে আকাশ জুড়ে শরতের বাড়াবাড়ি। তবুও বর্ষামঙ্গল উপেক্ষা করার সাধ্য নেই। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা বৃষ্টির উচ্ছাস ও শুভেচ্ছা রইলো আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে সকল শুভানুধ্যায়ীদের।

  • কবিতা

    কবিতা- মেঘের কথা

    মেঘের কথা
    -রীণা চ্যাটার্জী

    মেঘের ওজন মেপেছো কখনো!
    কতোটা ভারী না কি ভীষণ হালকা?
    ভেসে ভেসে বেড়ায় যখন আকাশের বুকে
    ইচ্ছে হয়নি একমুঠো মুঠোবন্দী করে নিতে?
    ইচ্ছে হয়নি বুকের কাছে বন্দী মুঠো খুলে
    আপন করে নিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি?
    ভিজতে না হয় নিজের মতো
    একদিন আলগা সুরের অলসতা মেখে…

    ভেবেছো কখনো মেঘ কেন জমে?
    ব্যথায় না কোনো অজানা অভিমানে?
    একরাশ ভার বয়ে ভেসে যায়
    দূরে নীল আকাশের বুক চিরে-
    শত শত না-রাখা কথার ভিড় ঠেলে,
    আর অবহেলার অজস্র ফেনা নিয়ে
    জানো কি, যায় মেঘ কোন সে অভিসারে!

    রূপ আর রূপকের সাজে
    ছোট্ট রূপকথা সেজে আছে মেঘলা কোলে,
    ছুঁয়ে যায় আধজাগা চোখের ঘোর,
    স্বপ্নরা হাতছানি দেয় চুপচাপ,
    ভেঙে যায় উষ্ণতার বুদবুদে
    বৃষ্টি নামে ধরায়, মিটে যায় খরা?
    ভেজা মাটি, সোঁদা গন্ধ…
    যে যেমন পারে ছুঁয়ে যায়-
    তারপর পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে
    আকাঙ্খা-অনাকাঙ্খার জলোচ্ছ্বাস,
    পথ হারায় মেঘেদের আনাগোনা।

  • সম্পাদকীয়

    প্রতিবাদের আড়ালে

    প্রতিবাদের আড়ালে
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সুধী,
    কেমন যেন অদ্ভুত এক সময়! প্রতিবাদ, প্রতিবাদের ভাষা সবকিছুই কৌলিন্য হারিয়েছে, আমরা কি ফিরে যাচ্ছি সেই অন্ধকার যুগে? যেখানে হানাহানি, ছিনিয়ে নেওয়া ছিল জীবন জীবিকার শেষ কথা।
    কিন্তু আমাদের জীবিকা তো সভ্যতার মুখোশে… তাহলে! মৃত্যু সবসময় স্তম্ভিত করে, স্তব্ধ করে দেয়, কিন্তু আমরা দেখলাম অসভ্যতামি। একদম সত্যি বলছি- আমার মনে হয়েছিল কি অসভ্য এরা এইসময় এতো কোলাহল, এতো অশ্রাব্য ভাষার প্রতিযোগিতা, কাদের মাঝে আছি? এই কি শ্রদ্ধা? এটাই ভালোবাসা? না কি সবটাই স্রোতের মুখে জনপ্রিয়তা কেনার সস্তা প্রচেষ্টা? তারপর মনে হলো ভেড়ার পাল আবার নতুন খবর পেলেই ভ্যা ভ্যা করে দৌড়ে যাবে, মৃত্যুর স্তব্ধতা ওদের স্পর্শ করবে কি করে? কিশোর বেলায় দেখতাম দুরদর্শনে পুনঃপ্রচার হতো “অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত” এরা ঠিক সেই বিঘ্নকারক প্রাণী। তখন দুরদর্শন ছিল সাদা-কালোর যুগে, এরা বড়ো রঙীন- তফাৎ এইটুকুই বাকিটা বিঘ্নকারক।

      যে প্রতিবাদ আমার তিলোত্তমা নতুন দেখছে তা হলো "স্বখাত সলিল" ওখানেও একদল শুঁকছে, একদল ধুঁকছে- ভবিষ্যত জানা নেই। শুধু বুঝতে পারি এ তো আমাদের ভরসা ফল, বিশ্বাসের ফল, বাকিটা কারসাজি, তবু ডুবতে আমাদেরই হবে…

    একটু অন্য কথা-
    আলাপী মন ওয়েব ম্যাগাজিনের তিনটি মুদ্রণ প্রকাশ “প্রতিশ্রুতি”, “বোধন” ও “অবলোকন”। “অবলোকন” প্রকাশিত হবার পরেই অতিমারীর কবলে পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্তম্ভিত জীবন ধীর লয়ে স্বাভাবিকের পথে হাঁটলেও আশঙ্কার মেঘ এখনো মাঝে মাঝে ভয় দেখায়। ভয় যেমন আছে, ইচ্ছেগুলোও তো মনের কোণে বাসা বেঁধে আছে। ছাপা অক্ষরের ঘ্রাণে সিক্ত হয়নি আলাপী মন বেশ কয়েকটি ঋতু। ছাপা অক্ষরের ঘ্রাণ নিতেই আবার এক ছোট্ট প্রয়াস- শারদীয়া সংখ্যার মুদ্রণ প্রকাশ আলাপী মন-এর “স্বজন সাথী” সাহিত্যিকদের লেখনী সম্ভার নিয়ে।
    নিত্য লেখনী সম্ভারে যাঁরা আলাপী মনকে ঋদ্ধ করেছেন তাঁদের অফুরান ধন্যবাদ জানাই। যথাশীঘ্র সম্ভব তাঁদের সাথে যোগাযোগ করা হবে, আনন্দ ভাগ করে নিতে।

  • কবিতা

    কবিতা- অর্বাচীন

    অর্বাচীন
    -রীণা চ্যাটার্জী

    এক টুকরো মৃত হাসি ঝুলে আছে
    জীবিতের অধরের দু’ পাশে;
    কবে যেন হয়ে গেছে ফাঁসি!
    অবশ্যই অপরাধ চিহ্নিত হবার আগে।
    ওই অধরে কথা ছিল- সুখ, অ-সুখের কথা
    বলতে চাইতো যখন, তখন।
    গান ছিল- সুরে, বেসুরে গাইতে চাইতো
    উৎসাহে খেয়াল খুশীর রাগ।
    হাসি ছিল- ঝর্ণার মতো গড়িয়ে পড়তো,
    জীবনের উষ্ণতা খুঁজে নিতে।
    বোঝেনি সব অপরাধ ছিল-সব…
    জীবন জরিমানা নিয়ে গেছে তাই…
    দিয়ে গেছে প্রতিম্বিবিত প্রতিফলন,
    কোষে কোষে জমা হয় শাস্তির বিষ…
    নীরবতার ফ্রেমে বন্দী মৃত হাসি;
    অর্বাচীন জীবিত সূক্ষ্ম সূচকে মাপে।

  • কবিতা

    কবিতা- ইচ্ছের আলাপন

    ইচ্ছের আলাপন
    -রীণা চ্যাটার্জী

    আশৈশব লালিত যত্নের ইচ্ছেরা
    মুখোমুখি একান্তে আজ- তুমি আর আমি।
    ভাসিয়ে দিয়ে যাব কিছু সুখ
    ডুবিয়ে দিয়ে যাব বিগত দুখ…
    বলবো কথা তোমার কানে কানে,
    যা বলিনি কখনো কারো কাছে-
    উজাড় করে বলবো সব, শুনবে তুমি?
    না কি বধির তুমি স্রোতস্বিনী?
    পাপ-মায়ায় আবদ্ধ পার্থিব বন্ধনে!
    এতো ভিড়! এতো কোলাহল!
    তিলক, মাদল, বাদ্য শত উপাচারে
    উৎসুক পুণ্যলোভী উদগ্ৰীব পাপ স্খলনে
    কতো ভেক… কতো সাজ… তোমার জন্য।
    আড়ম্বরহীন আমার কথা? বলবো কখন?
    আরো কিছু কাল বয়ে যাক-
    আঁধার নামুক তবে তোমার কলেবর জুড়ে,
    মুখোমুখি বসবো দুজন আত্মার আলাপনে।
    স্পর্ধিত স্পর্ধায় স্পর্শের আকুতি নিয়ে
    দৃষ্টির অগোচরে এক নিবিড় আলিঙ্গন-
    পূর্ণতা খুঁজে নেবে আশৈশব যত্নে লালিত
    আমার অবুঝ ব্যাকুল ইচ্ছেরা।

  • সম্পাদকীয়

    মুক্ত করো ভয়

    মুক্ত করো ভয়
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সুধী,
    মাতৃভূমি, মাতৃদুগ্ধ, মায়ের আঁচল, মাতৃভাষা
    সবকিছুতেই জন্মগত অধিকার। ছিনিয়ে নিতে হয় না, নিজে থেকেই ভরিয়ে রাখে জন্মক্ষণ থেকে প্রকাশে-অপ্রকাশে। এ তো অনুভব আর অনুভূতির কথা, বাস্তব! একটু আলাদা।
    মাতৃভূমির নির্বাচিত জাঁদরেল, স্বশিক্ষিত, বিভিন্ন ধরণের ভূস্বামী (শাসক, প্রশাসন) বিরাজিত আছেন তাঁদের চেলা চামুণ্ডা নিয়ে স্বমহিমায়। আমি বা আমরা কেবল নাগরিক মাত্র, নাগরিকত্ব অধিকার ভোগ করি জন্মসূত্রের পরিচয়ে, মাতৃভূমি বলে গান গাইতে পারি, ভাবে আবেগে ভেসে যেতে পারি বিশেষ বিশেষ দিনে- তার বেশি কিছু নয়, এটা মনে রাখতে পারলে নাগরিকত্ব পরিচয়ের কার্ড আমার বা আমাদের পকেটে। মোদ্দা কথাটা মাতৃভূমিকে যতোই ভালোবাসো, ভূস্বামীদের ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মুখ খুললেই তা কিন্তু মাতৃভূমির বিপক্ষে যাবে, তখন নাগরিকত্ব নিয়ে টানাটানি হতেই পারে। মাতৃভূমিতে জন্মগত অধিকার কতটুকু- প্রশ্নের মুখে!

    মাতৃদুগ্ধ, সেও বড়ো ক্ষণস্থায়ী। সেই কবে খেয়েছি জ্ঞানচক্ষু খোলার আগেই, সেই স্বাদে শুধুই স্মৃতি। কর্মব্যস্ততার মাঝে পড়ে জন্মের কিছু দিন পর থেকেই নিমপাতা, লঙ্কাবাটা সহযোগে স্তনবৃন্ত শিশুমুখ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার নানারকম ফন্দিফিকির চলতেই থাকে। তারপর বিজ্ঞাপনের গুঁতোয় প্রোটিন-ভিটামিনের লোভনীয় তালিকা তো আছেই। অতএব… সুযোগের সদ্ব্যবহার, “আহা! দেখলেই বোঝা যায় __ বেবী” ছোটোবেলায় চেনা বিজ্ঞাপনী চমক।
    নামে হয়তো অনেক বদল এসেছে, নতুন নতুন চমক এসেছে। তাহলে মাতৃদুগ্ধ! যার যেমন ভাগ্য তেমন মেলে। তবে “মাঈ কা লাল” কিন্তু মাতৃদুগ্ধ আষ্ফালনের এক আজন্মের বিজ্ঞাপন, প্রয়োজনে ঝুলি ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

    মায়ের আঁচল- ওটাই শুধু বড়ো নিজের।
    মা-সন্তানের সম্পর্কের একান্ত আপন। মায়ের আঁচল যেন গ্ৰীষ্মে শীতলপাটি, শীতে একমুঠো রোদ্দুর আর উষ্ণতা। সবসময় মাতৃস্নেহে ম ম করছে। চোখ বুঁজলেই সেই ঘ্রাণ যেন ঘিরে ধরে- গভীর, ভীষণ গভীর চাইলেই যতবার খুশী ডুব দেওয়া যায়।
    এ স্বাদের ভাগ হবে না।

    মাতৃভাষা- “মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাঙলা ভাষা” ভাষার কথা এলেই তিনি এসে আগে হাত ধরেন। যদিও শুধু বাঙলা নয়, সবার কাছেই নিজের মাতৃভাষা বড়ো সুমধুর। শুধু মধুর নয় আবেগের, গর্বের।
    মাতৃভাষায় কথা বলে সুখ, গল্প করে সুখ, পরনিন্দা-পরচর্চায় বড়ো সুখ। যদিও এক শ্রেণী আছে যারা ভাষাদিবসে আলাদা করে বিশেষ যত্নে মাতৃভাষা শেখে ও শেখায়, বাকিদিনে ভুলে যেতে পারলেই বাঁচে।
    ভাষা নিয়ে বললে তো হাজার কথা, লক্ষ ব্যাখ্যা, তর্ক-বিতর্ক, তরজা, তর্জমা সবটুকু আর বুঝলাম কবে? শুধু মাতৃভাষার সান্নিধ্যে সুখে বিভোর হয়ে থাকলাম, মনের পাতায় আঁক কাটলাম। শ্রদ্ধায়, স্মরণে বেশ ছিলাম। কিন্তু ওই যে পুরস্কার! তা’ও তো অসুবিধা ছিল না- দৈ তো আর নেপোয় মারে নি, নিজের জিনিস ঘরে উঠেছে। তা বলে যা মুখে আসবে তাই বলে সাফাই!
    এমন কি তাঁর জন্মদিনেই উদাহরণে তিনি উঠে এলেন অবলীলায়। হায় বুদ্ধিজীবী সাফাই গাওয়া বাঙালী… এতোটুকুও লজ্জা পেলে না? আপামর বাঙালীর গর্বের জায়গায় অবলীলায় হাত রাখলে! আর কতো? তোমাদের জ্বালায় তো সব জলাঞ্জলি গেছে, সব কেড়ে নিয়েছো সে কবে পুনরুদ্ধার হবে, আদৌ হবে কি না কে জানে! তবুও যে কটা পুরোনো কাঠামো এখনো সচল- তারা ভাবি আমাদের শৈশবের কথকতা, কৈশোরের কিশলয়, যৌবনের চঞ্চল চারুলতা, বার্ধক্যের ব্রতকথা আদৌ অক্ষুন্ন রাখতে পারবো তো?
    আশার কথা গুরুদেব বলে গেছেন- “মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়…”

    এমন উষ্ণ দিনে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে।

  • রম্য রচনা

    রম্য- হালুয়া

    হালুয়া

    রীণা চ্যাটার্জী

    বললেই নিন্দুকেরা বলবে- ‘বলছে..’ তাও একসময় বলতেই হয় জীবনটা যেন হালুয়া- হয়ে গেছে, মানে শুধু ওই হালুয়ার মতো চটচটে পাকটা থেকে গেছে আর কি! পাক দেওয়ার আগে অবশ্য বোঝা দায়- তখন গাওয়া ঘি আর মেওয়ার সুবাস, ঝরঝরে সাদা সুজি, তেল আর তেলানির অপূর্ব চকচকে মিশ্রণ। তারপর তাতে যখন আলোচনার চিনি মেশাবে, ব্যস ওতেই যত বিপদ। যত পাকাবে তত চটচট করবে। কত পাক, কেমন পাক তা ঠিক মতো বোঝার আগেই, প্যাঁচপ্যাঁচে ঘামের মতো গায়ে লাগাবেই, আর হাত লাগলেই চটচট করবে। ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও পারবে না। ঝাড়ু মেরে তাড়াবে যে তার উপায় নেই- চটচটে যে, আঠার মতো সেঁটে যাবে। যদি একটিবার ভরসা করে ঝাড়ান দিয়েছো তো আলোচনা-সমালোচনা থিকথিক করবে। হয়তো ঝাড়ুকেই তখন ‘লে হালুয়া’ বলে ঘরের বাইরে ফেলে দিতে হবে। শখের ঝাড়ুখানা না হয় ফেলা গেল- তাতেও রেহাই নেই। “বোবার শত্রু নেই” প্রবাদ ঘুচিয়ে দিয়ে মিথ্যের ডোবাজলে ঝাড়ু পচবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে। নিজের নাকে নিজেই চাপা দিয়ে সেই দুর্গন্ধ সাফ করতে আবার নিজেকেই নামতে হবে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, না মরা অবধি শাস্তি নেই। পচা জলে নাকানিচুবানি খেতে হবে। নাকানিচুবানি খেতে খেতে ঝাড়ু খুঁজে তুলে দেখবে তাতে বেশ খানিকটা ঘ্যানঘ্যানে ছত্রাকের ভিড়- আনন্দে বাসা বেঁধেছে। মুখরোচক লাগে। পরের কথা সবসময় মুখরোচক, বিনে পয়সার হালুয়া যে- যত পচবে তত মিষ্টি। হালুয়ার পাক তখন রূপ বদলে চাটনি হয়ে গেছে। সেও চটচটে, মাখামাখি তাতে নতুন উপদ্রব মাছি উড়ছে, ভনভন করছে। ছিল হালুয়া, হয়ে গেল চাটনি- যেখানে পড়বে সেখানে জ্বালা- দূষিত জ্বালা।

    তখন মনে হবে এর থেকে হালুয়া ভালো ছিল- শুধু তো গায়ে লেগে ছিল ঘামের মতো। একবার এই অভিজ্ঞতা হয়ে গেলেই পরের বার মন বলবে- চাটনি হয়ে কাজ নেই বাপু ‘হালুয়া’ হয়ে কাটিয়ে দে বাপ বাকি জীবনটা। শুধু বলিস না- কারা হালুয়া করলো তাহলেই চাটনি… মনে রেখে পথ চলো, ভাবখানা এমন রাখতে হবে যেন মন হালুয়ায় মাখামাখি, নেচে নেচে হরি বলো, প্রসাদ নিতে ভিড়ের অভাব হবে না, অভিযোগ থাকবে না। শুধু জীবন-হালুয়া কেঁদে কেঁদে বলবে- “ত্রাহি মাম ত্রাহি মাম…” 

  • সম্পাদকীয়

    ফিকে শুভেচ্ছা

    ফিকে শুভেচ্ছা
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সুধী,
    পঞ্জিকা মতে বর্ষবরণের সূচনা হয়ে আজ দ্বিতীয় দিন। দিন পেরিয়ে রাত আসছে, রাত পেরিয়ে ভোর- ভয় ভোর। আবার কি অপেক্ষা করে আছে! নতুন খবর? না, তা নয়- বীভৎসতা কতোটা তীব্র, সেই খবরে আরো কতো উলঙ্গপনা!

    চাপান-উতোর, তর্ক-তরজা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। তাঁরা সে গুরুভার অক্লেশে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এইসব- “চলছে… চলবে”
    এরমধ্যে মাননীয় বাদী-বিবাদী পক্ষ আছেন তাঁদের যুক্তি-গপ্পো আছে। আর আছেন অতীতদ্রষ্টারা, যাঁরা অতীতের ঝুড়ি উপুড় করে একটা একটা করে পচাগলা উদাহরণ তুলে তুলে দেখাবেন। তাঁদের মনে হয় এটাই বক্তব্য অতীতে ওরা করেছে এখন আমরা করলে দোষ কি? বলছিলাম পরিবর্তনের অঙ্গীকার ভুলে গেলেন কি? আমরা পরিবর্তনের সভ্যতা-সংস্কৃতি দেখছি কি? না কি শেয়ালের কুমীর ছানা তুলে দেখানোর মতো পরিবর্তনের ছল দেখানোর কথা ছিল! তাহলে কুমীর ছানা শেষ হলে! ছলেবলে তখন পা’ বাঁচাতে পারবেন তো? আপনাদের অবশ্য চটি আছে- একটা ভরসা এই আর কি…

    আছেন ইতিহাস প্রাজ্ঞরা- যাঁরা এদেশ-ওদেশ-বিদেশ, একাল-ওকাল দেখিয়ে বলে দেবেন ইতিহাস সাক্ষ্য আছে ক্ষমতার পেশী প্রর্দশনীর। মন শান্ত হয় তো এইসব স্তোতবাক্যে? সভ্যতা কি? অবশ্যই আধুনিক শপিংমলে তা পাওয়া যায় না। সভ্য হলে তবে তো সভ্যতা। আপনারা ইতিহাসের উদাহরণ পাথেয় করলে প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়াই তো ভালো- আর যাই হোক শব্দের-বাক্যের ঝনঝনানি থেকে তো রেহাই পাব। কি বলেন প্রাজ্ঞজনেরা?

    শব্দের ঝনঝনানি থেকে মনে পড়ে গেল সদ্য কথিত (সংস্কৃতিমনস্ক?) এক বুদ্ধিজীবীর বাণী। যদিও এর পূর্বে উনি একাধিক বাণীতে সরগরম ফেলেছেন- তবুও শেষোক্ত বাণী যেন অমৃত সমান। কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করলেই অজান্তেই হাতটা পাদুকাযুগল স্পর্শ করছে। নাহ্, ওনার নয়, নিজের, তারপর?
    পাদুকাবন্ধনীর সদ্বব্যবহার করতে মনটা আনচান করছে, জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হবার উপায় নেই কারণ উনি মমতাময়ীর আদর্শের আঁচলে সুরক্ষিত এক অদ্ভুত প্রাণী।
    তবুও মনটা চীৎকার করে বলে উঠতে চাইছে- এমন প্রতিবাদী “নপুংসক” আরো শতসহস্র জন্ম নিক, আমরা মাতৃ জন্ম ধন্য মনে করবো এমন “নপুংসক” জন্ম দিয়ে, তবুও ওনার মতো বুদ্ধিজীবীর জন্ম দিয়ে গর্ভ কলঙ্কিত করতে চাই না, ওনার মা যেখানেই থাকুন (ওনার তো স্বর্গ-বেহস্ত ঘেঁটে আছে) একই কথা বলতেন মনে হয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লজ্জাও পেতেন। সন্তানের গর্বে গরবিনী হওয়া যায় কিন্তু এমন কুপুত্র! ছিঃ…

    শুভেচ্ছা, শুভকামনা সব যেন কেমন ফিকে লাগে, এতো রক্তের বন্যায়। এ যেন রক্তসেচন হচ্ছে! এর ফসল কি হবে? কি হতে পারে? জানি না, জানতেও ভয় করে।

  • কবিতা

    কবিতা- এখন আমি…

    এখন আমি…
    -রীণা চ্যাটার্জী

    এখন আমি চেরাপুঞ্জি
    বুকের ভেতর মেঘের পাহাড়
    যখন তখন বৃষ্টি নেমে
    জলছবিতে আমায় সাজায়।

    ঝরতে থাকে মাটির ‘পরে
    ভেজা মাটি সাক্ষ্য রাখে,
    ক্ষয়িষ্ণু সুখ কেঁদেছে কতো-
    নীরোদের ওই অঝোর ধারায়।

    ধুয়ে দিয়ে যায় বন জ্যোৎস্না,
    ভোরের আলো তা’ও ফিকে
    হারানো মন ভিজতে থাকে
    শিকড় থেকে শাখায়-শাখায়।

    একঘেয়েমির অবাধ্য সুর
    ওদের সুরে হাজারো কথা,
    দু’ একটা বেশ অন্যরকম
    চেরাপুঞ্জির কি আসে যায়!

    ভিজতে থাকে… ভিজবে বলে
    ভিজছে শিকড়, ভিজছে সেতু
    আগল খোলা আকাশ জুড়ে
    চেরাপুঞ্জি ভিজতে যে চায়।

<p>You cannot copy content of this page</p>