-
গল্প- দৌড়…।
দৌড়…।
–রুদ্রপ্রসাদ(১)
“এ ইউ…, স্ট্যাণ্ড আপ। বসে বসে হাত দোলাচ্ছিস কেন? এটা কি মিউজিকের ক্লাশ হচ্ছে? নাকি তুই কোনো কনসার্ট শুনছিস?” অরূপ স্যারের বিরক্তমাখা গলা শুনে একটু চমকে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝল কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। ইতস্ততঃ করে উঠে দাঁড়াতেই স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে, ডানহাতে কি করছিলি?”
“না মানে… কিছু না, স্যরি স্যার।”
“স্যরি তো বুঝলাম, কিন্তু ওটা কি করছিলি, সেটা বোঝা।” স্যারের গলায় ঈষৎ কৌতুকের আভাস দেখে একটু ভরসা পেল সায়ন্তন।
“না… মানে… রিলিজের ফলো-থ্রুটা ঠিক করছিলাম, মানে… শ্যাডো প্র্যাকটিস।” আমতা আমতা করে জবাব দিল।
“ও তো বিরাট কোহলি হবে স্যার।”
ক্লাশের ফার্স্টবয় অর্ঘ্য ফুট কাটল দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল সায়ন্তনের। তেরিয়া হয়ে বলল, “জীবনে কখনো মাঠে নেমেছিস? চশমা এঁটে সারাদিন তো বইতে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিলি, ব্যাটা গুবরে পোকা কোথাকার। একবার মাঠে এসে দেখিস, হাঁটুতে চিন-মিউজিক শুনতে পাবি।” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঘন্টার শব্দে থেমে গেল।
“এনাফ ইজ এনাফ। খেলার কথা খেলার মাঠেই রেখে আসবি। ফের যদি কখনো আমার ক্লাশে এরকম দেখি, ঘাড় ধরে বের করে দেব। আর তুই, কে বড়ো হয়ে কি হবে, সেটা কি তোর পারমিশন নিয়ে হবে! নিজের চরকায় তেল দে। আমার ক্লাশে কোনোরকম বাঁদরামি আমি সহ্য করব না। আণ্ডারস্ট্যাণ্ড? নেক্সট ক্লাশে সবার হোমওয়ার্কের খাতা যেন আমি টেবিলে দেখতে পাই।” স্যার ধমক দিয়ে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ছুটির পর মাঠ থেকে ফেরার সময় দেখল ক্লাশেরই কতগুলো ছেলের সাথে অর্ঘ্য বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। ‘এদের সাথে অর্ঘ্যের কি করে বন্ধুত্ব হয়েছে কে জানে! পড়াশোনা বা রুচি, কোথাও তো মেলে না’, অবাক হয়ে ভাবে সায়ন্তন। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলের দল পরীক্ষার হলে অর্ঘ্যের সৌজন্যে উতরে যায়। যদিও অর্ঘ্যও বিশাল পয়সাওলা ঘরের ছেলে, তবুও কোথাও বেমানান লাগে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কানে আসে, “আরে… বি-র-র-রা-ট বড়ো প্লেয়ার যাচ্ছে রে…। আবে… গুরুর পা ধুয়ে জল খা যদি পাশ করতে পারিস।” শেষের কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। তবুও উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সরে এলো।(২)
খেলার মাঠ থেকে ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে বসেছিল সায়ন্তন। ক্লাশের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। পড়াশোনায় কোনোকালেই খারাপ ছিল না। মাধ্যমিকে বিশাল কিছু ভালো রেজাল্ট না করলেও নেহাৎ খারাপ করেনি। সেজন্য সায়েন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ পেতেও অসুবিধা হয়নি। এমনিতে কারোর সাতে-পাঁচে থাকে না, কিন্তু কিছু নম্বর বেশি পেয়ে সবসময় অর্ঘ্যের সব ব্যাপারেই হামবড়ামি একদম সহ্য করতে পারে না সে। মনে মনে ভাবে, ‘মুখে বলে নয়, একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েই সবার জবাব দিতে হবে।’
“কি রে! ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন! শরীর ঠিক আছে?” বলতে বলতে ঘরে এসে আলো জ্বেলে দিলেন সত্যব্রতবাবু। তার ফ্রেণ্ড-ফিলোজোফার-কাম-গাইড, যিনি তাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, তার সবচেয়ে বড়ো সমালোচক ও বন্ধুকে কাছে পেয়ে স্কুলের সমস্ত ঘটনা বলে একটু হালকা হ’ল সায়ন্তন। সত্যবাবু তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছিস, তার পেছনে ছোটার চেষ্টাও যখন শুরু করেছিস, তখন এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। বি ব্রেভ, হোল্ড ইওর নার্ভ এ্যাণ্ড গো অ্যাহেড। লক্ষ্য যত উঁচুতে রাখবি, পৌঁছতে ততই বাধা-বিপত্তি আসবে। ভয় পেয়ে থেমে গেলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে। নে, এবার ওঠ।”
“কিন্তু বাবা…;”
“কোনো ‘কিন্তু’ নয়। গীতায় কি বলেছে জানিস? বলেছে ‘কর্মণ্য বাধিকারাস্তে মা ফলেষু কদাচনঃ’, মানে ফলের চিন্তা না করে এক মনে কাজ করে যাও। ইংরেজিতে বলে ফলো দ্য ‘ডি’। ড্রীম, ডিজায়ার, ডিসিপ্লিন, ডেডিকেশন এ্যাণ্ড ডিটারমিনেশন, এই পাঁচটা ‘ডি’ যদি ঠিক রাখতে পারিস, তাহলেই পৌঁছে যাবি আল্টিমেট ‘ডি’ – ডেস্টিনিতে। আর যদি পাঁচটার কোনো একটাও এদিক-ওদিক হয় তাহলে হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হবে আর একটা ‘ডি’ নিয়ে – ডিসকোয়ালিফায়েড। কাজেই ফলের আশা ছেড়ে লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে মনোযোগসহকারে শ্রম করে যাও, একদিন লক্ষ্যভেদ নিশ্চিত হবে।”
মন খারাপের ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যায় সায়ন্তনের। এই জন্যই বাবাকে এতো ভালোবাসে, মনে মনে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।’(৩)
ত্রিকোণমিতির অঙ্কগুলো করতে করতে কখন দশটা বেজে গেছে খেয়াল করেনি। মায়ের ডাকে বইপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ে। ছোটো বোনের সাথে খুনসুটি করতে করতে খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়ে সায়ন্তন। বাবার বলা কথাগুলো ভাবতে তার মনে হয়, মৃদুভাষী অনিন্দিতা দেবীর সাহচর্য্য ছাড়া বাবাও হয়তো তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাতে পারতেন না। ছোটোবেলা থেকেই মায়ের কড়া শাসন ছিল বলেই হয়তো আজ সে কিছুটা হ’লেও ডিসিপ্লিনড হতে পেরেছে। বাবাও একসময় খেলাধূলা করতেন, পরে সাংসারিক চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই পোস্ট অফিসের সাধারণ চাকরি নিতে হয়েছিল খেলাধূলা করে স্বপ্ন পূরণের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে। তাদের পড়াশোনার জন্যই সব কষ্ট সহ্য করে এই ছোট্ট দু’কামরার ভাড়া ঘরে থাকতে হচ্ছে। মনে মনে বলে, ‘তোমাদের সবার সব স্বপ্ন আমি পূরণ করব।’ ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন স্কুলে গিয়ে টিফিনের সময় পেছন থেকে টিটকারি শুনে আর স্থির থাকতে পারল না, সোজা গিয়ে অর্ঘ্যর কলার চেপে ধরল। “স্কুলে পড়াশোনা করতে এসেছিস, ওটাই কর। আমার কথা ভাবতে তোকে কেউ বেতন দিয়ে রাখেনি। পরেরবার যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলেছিস তো নিউটনের থার্ড ল আর অ্যানাটমির পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে এমন বুঝিয়ে দেব যে আর কিছু বোঝার মতো অবস্থায় থাকবি না।” দাঁত চেপে কথাগুলো ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল সায়ন্তন।
তারপর দিন তিনেক কেটে গেছে। স্কুলে প্রার্থনার সময় হেডস্যার বললেন, “আজ আমাদের একটা খুব আনন্দের দিন। আমাদের স্কুলের সায়ন্তন বেঙ্গল আণ্ডার নাইন্টিন টীমের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছে। অল দ্য বেস্ট সায়ন্তন এ্যাণ্ড মেনি মেনি কনগ্র্যাচুলেশনস্।”
খবরটা পাওয়ার পর থেকেই অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না। কোনোরকমে ছুটির ঘন্টা পড়তেই সোজা হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। বড়ো রাস্তা থেকে একটা নির্জন গলি দিয়ে শর্টকাট করে সায়ন্তন। গলিটাতে ঢোকার মুখে পেছন থেকে আসা একটা বাইকের ধাক্কায় রাস্তার একপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আচমকা পড়ে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেও বুঝতে পারল বাইক একটা নয়, অন্তত দু’তিনটে, আর বাইকগুলো থেকে কয়েকজন নেমে এসেছে। কিছু বোঝার আগেই বাঁ হাঁটুর নিচে এক প্রচণ্ড আঘাতে গলা চিরে গোঙানি বেরিয়ে এলো তার। ধূলা আর রক্তে মাখামাখি সায়ন্তন ঘাড় ঘুরিয়ে আক্রমণকারীদের মুখ দেখার চেষ্টা করতে যেতেই মাথা লক্ষ্য করে সপাটে নেমে এলো একটা হকিস্টিক। জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেল, “খুব উড়ছিলি না? নে, ডানা ছেঁটে দিলাম। একে বলে হাঁটুতে চিন মিউজিক…।” অর্ঘ্যর গলা!(৪)
যখন চোখ খুলল, তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। ধাতস্থ হতে সময় লাগলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা। কিছু বলার চেষ্টা করেও পারল না। তবুও ঠোঁট নড়ছে ডাক্তারের পাশে দাঁড়ানো বাবা বললেন, “রিল্যাক্স। বিশেষ কিছু হয়নি। ঘাবড়ে যাওয়ার দরকার নেই।” কিন্তু পায়ের কাছে দাঁড়ানো মায়ের চোখ-মুখ দেখে বুঝেই গেল চোট রীতিমতো গুরুতর। তার যে ট্রায়ালে যাওয়া হচ্ছে না, স্বপ্নের পেছন দৌড়ানো যে সাময়িকভাবে বন্ধ হ’ল, এসব ভেবেই শারীরিক যন্ত্রণা ছাপিয়ে মনের দুঃখেই দু’চোখ জলে ভরে এলো।
ডাক্তারবাবু বেশ মজার মানুষ, পাশের টুলে বসে বললেন, “ডোন্ট ওয়্যারি, রিবসে দুটো হেয়ারলাইন ক্র্যাক হয়েছে, ও কিছু না। বাম পায়ের শিনবোনে কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার আছে, প্লাস্টার করে দিয়েছি, ছ’সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে। আর মাথায় জাস্ট খান পাঁচেক স্টিচ পড়েছে, ভেতরের ঘিলু-টিলু সব ঠিকঠাক জায়গাতেই আছে। অতএব ভয়ের কিছু নেই।” তাঁর বলার ভঙ্গিতেই এতো যন্ত্রণার মধ্যেও হেসে ফেলল সায়ন্তন। দেখে ডাক্তারবাবু আবার বললেন, “দ্যাটস্ লাইক আ গুড বয়। জীবনের ওঠাপড়ার সাথে চোট-আঘাত তো থাকবেই, তার জন্য এতো মুষড়ে পড়লে চলবে না। অলওয়েজ কীপ স্মাইলিং। তাছাড়া চোট-আঘাত না থাকলে আমাদের যে ভিক্ষা করতে হবে বাবা।”
বাকিরা সবাই চলে যাওয়ার পর বাবাকে সব কথা বলল সায়ন্তন। সত্যবাবু সজল চোখে কিছু না বলে ছেলের পায়ের প্লাস্টারের ওপর লাল মার্কার দিয়ে ‘গেট ওয়েল সুন’ লিখে একটা স্মাইলি এঁকে দিলেন।
দু’দিন পর স্কুলের হেডস্যার এলেন। সাথে পুলিশ! এসে আগে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বললেন। তারপর সায়ন্তনকে বললেন, “চিন্তা করিস না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। তোর জন্য যাতে একটা স্পেশাল ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা যায়, তার জন্য আমি স্কুলের তরফে আবেদন করব।” একটু থেমে পুলিশ অফিসারকে দেখিয়ে বললেন, “এঁর কিছু জানার আছে, সব খুলে বল। অপরাধী যেন কোনোভাবেই ছাড়া না পায়।”
পুলিশ অফিসার অমায়িকভাবেই বললেন, “তোমার বাবার কাছে মোটামুটি শুনেছি। তোমার মুখ থেকে পুরোটা শুনব। কোথাও কিছু বাদ দেবে না। তবে তোমার কিছু মনে হচ্ছে বা হয়েছে, এমন কিছু বলবে না। শুধু যা ঘটেছে, সেটাই বলো।” মোটামুটি যতটুকু মনে করতে পেরেছে, সেটাই বলল সায়ন্তন। তার বয়ান আর একজন পুলিশ লিখে নিল। তারপর আবার আসবেন বলে তাঁরা বিদায় নিলেন।(৫)
পরের দিন দুপুরে আবার সকলে এলেন, সাথে অর্ঘ্য ও তার বাবা হৃষিকেশবাবু। হৃষিকেশবাবুই প্রথমে সায়ন্তনকে বললেন, “বাবা তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু যা ঘটে গেছে, তা তো পাল্টানো সম্ভব নয়।… তোমার কমপ্লেনে ওর জেল হতে পারে। ওর পুরো কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। তোমাকে অনুরোধ করছি, ওর এতোবড়ো ক্ষতিটা তুমি হ’তে দিও না। তোমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি দেব। চাও তো আলাদা করে ক্ষতিপূরণও দেব।”
“আপনি শুধু আপনার দিকটাই দেখছেন। ওর কত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন? সুযোগ সবাই পায় না। আজ আপনার ছেলের জন্য ওর এতো বড়ো সুযোগটা হাতছাড়া হ’ল।” বিরক্তভাবে বললেন হেডস্যার। পেছনে তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য।
সত্যব্রতবাবু উভয়ের বাদানুবাদের মাঝে চুপচাপ ছেলেকে লক্ষ্য করছিলেন। কথাবার্তা শুনতে শুনতেই মনস্থির করে ফেলেছিল সায়ন্তন। তারপর একসময় হৃষিকেশবাবুর “বাবা তুমিই বলো, এখন সবটাই তোমার হাতে।” শুনে বলল, “আমার যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। তবে আমার ক্ষতি করেছে বলে আমি কারোর ক্ষতি করতে পারব না। আমি কোনো কমপ্লেন করিনি। আপনারা যখন জানতে চেয়েছেন, তখন যা সত্যি, তাই বলেছি। আমি কোনো কমপ্লেন কোথাও করছি না। আর হ্যাঁ, যে যন্ত্রণা আমি পেয়েছি এবং পাচ্ছি, তা টাকা দিয়ে মেটানো যায় না। সবকিছুর মূল্যায়ন টাকায় হয় না।” একটানা বলে যখন থামল, ঘরে তখন অখণ্ড নীরবতা।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। একসময় হেডস্যার বললেন, “সায়ন্তন ক্ষমা করে দিয়েছে, এটা ওর মহানুভবতা। তবে সবকিছু জেনেও যদি আমি অর্ঘ্যকে ক্ষমা করে দিই, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সায়ন্তন বলল, “স্যার, আমি কিন্তু ওকে ক্ষমা করিনি। ওর কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেটাই চেষ্টা করছি। ও আমার ক্ষতি করেছে বলেই যদি আমিও ওর ক্ষতি করি, তাহলে ওর সাথে আমার পার্থক্য কোথায়?”
“তুই ঠিক বলেছিস”, বলে হেডস্যার হৃষিকেশবাবুকে বললেন, “আমি আপনার ছেলেকে রাস্টিকেট করছি না। তবে আগামীকাল এসে ওর টিসিটা নিয়ে যাবেন। আই অ্যাম সিওর, আপনি আপনার পাওয়ার আর পজিশন দিয়ে অন্য কোথাও সুযোগ পেয়ে যাবেন। তবে আমি থাকতে, আমার স্কুলে ওর জায়গা হবে না।” মাথা নিচু করে বিদায় নিলেন হৃষিকেশবাবু।(৬)
সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছিল সায়ন্তন। বাড়ি ফিরে মায়ের সামনেই বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “অর্ঘ্যর ব্যাপারে আমার ডিসিশন কি ভুল ছিল?”
সরাসরি উত্তর না দিয়ে সত্যবাবু বলেছিলেন, “স্পোর্টসম্যান স্পিরিট্ এমন এক বিশেষত্ব যা খেলোয়াড়কে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে। তুই খেলোয়াড় হিসেবে কতটা বড়ো হতে পারবি বা জীবনে কত সাফল্য পাবি তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যখন তুই তোর মতামত জানালি, অ্যাট দ্যাট ভেরি মোমেন্ট আই ফীল প্রাউড টু বি ইওর ফাদার। রিয়েলি, আই মীন ইট।” শুনে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল সায়ন্তনের। মায়ের চোখেও তখন দেখেছিল পরিতৃপ্তি, অনিন্দিতা দেবী শুধু বলেছিলেন, “তুই উঠবি, আবার খেলবি, তবে এখন থেকে পড়াশোনায়ও মনোযোগ দিবি। সবাইকে দেখিয়ে দিবি, শুধু খেলাধূলায় নয়, পাশাপাশি পড়াশোনাতেও তুই কারোর চেয়ে কম নয়। শুধু মনে রাখিস মানুষ হ’তে হবে, সত্যিকারের মানুষ।” শুধু ছোটো বোন কিছু না বুঝতে পেরে চুপ করে দাদার দিকে তাকিয়ে ছিল।
নির্ধারিত সময়ে প্লাস্টার কাটার পর যখন বাম পায়ে জোর পাচ্ছিল না, তখন হতাশায় কেঁদে ফেলেছিল। ডাক্তারবাবু, বাবা-মা, সবাই আশ্বস্ত করলেও সংশয় কাটছিল না কোনোমতে। যখন খুব হতাশ লাগত, তখনই বোনকে নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে হাজির হ’ত, আর বাবার কাছে কথামৃত, ফোক ইত্যাদির গল্প শুনে মনের জোর খুঁজে পেত।
সময়ের সাথে সাথে দৌড়ানো শুরু করলেও বল করার সময় সমস্যা হচ্ছিল, ডেলিভারী দেওয়ার আগে স্টেপিংয়ে গোলমাল হচ্ছিল, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছে। বায়োলজি প্রাকটিক্যাল ক্লাশে গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে আসত স্কেলিটন আর হিউম্যান মাসল্ স্ট্রাকচারের ডায়াগ্রাম আর বাড়ি ফিরে সযত্নে নিজেই মালিশ করত বাম পা।
ম্যাচ ফিট না থাকার জন্য মাঠে সময় অনেক কম কাটাত। সেই বাড়তি সময়টা ব্যয় করত পড়াশোনার পেছনে। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়। যে বায়োলজিকে ফোর্থ সাবজেক্ট বলে একটু কম পড়ত, নিজের চেষ্টায় সেই বায়োলজিতেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে টুয়েলভে উঠল আশাতীত ভালো রেজাল্ট করে।(৭)
আস্তে আস্তে সায়ন্তন ফিরে পেতে থাকে তার চেনা ছন্দ। পুরো অফ সীজনটা পরিশ্রম করার ফল পায় মরশুমের শুরুতেই। দীপাবলীর ছুটির পর স্কুল খুলতেই তার ডাক পড়ে হেডস্যারের ঘরে। যেতে হেডস্যার বলেন, “একটা ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব ট্রায়ালে তোকে দেখতে চেয়েছে, পারবি তো?” মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ফিরে আসে। তারপর থেকে প্র্যাকটিসে ডুবিয়ে দেয় নিজেকে।
মাঝে একদিন রাস্তায় তার মুখোমুখি হঠাৎই এসে পড়েছিল অর্ঘ্য, কিন্তু কিছু না বলে নেহাতই না চেনার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছিল। যদিও অর্ঘ্যর হাবভাবে তাকে কোনোভাবেই অনুতপ্ত বলে মনে হয়নি সায়ন্তনের।
খেলার মাঠে সময় বেশি দিতে হচ্ছে বলে কিন্তু পড়াশোনাকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং স্যারেদের সহযোগিতায় সামনের পরীক্ষার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করেছে নিজেকে। আর তার প্রমাণ সে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টেও পেয়েছে।
নভেম্বরের শেষের দিকে বাবার সাথে গিয়ে ট্রায়াল দিয়েও এসেছে। ফেরার পথে বাবা বলেছিলেন, “ট্রায়ালে ভালোই করলি, কিন্তু এতোবড়ো ক্লাবে একবারেই সিলেক্ট হবি – এমনটা আশা করিস না। যদি না হ’তে পারিস, তখন খারাপ লাগবে। একটা কথা মাথায় রাখিস, ‘কম্পিট উইথ ইওরসেল্ফ।’ প্রত্যেকবার চেষ্টা করবি নিজেকে উজাড় করে নিজের সেরাটাকে ছাপিয়ে যেতে।” ট্রায়ালের দিন তিনেক পরই ক্লাবের তরফে ডাক এসেছিল কন্ট্র্যাক্ট সাইন করার জন্য।
পরীক্ষার কথা মাথায় রেখেই তাকে খেলানো হবে বলে ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মনে মনে হিসেব করে, ‘বড়োজোর দশ-বারোটা ম্যাচ পাবে। তবুও পরে যাতে সুযোগ পেতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য ভালো পারফর্ম করতে হবে।’
সব সংশয়কে পেছনে ফেলে এসে পৌঁছেছে মাঠে, আজ তার প্রথম ম্যাচ। বাবার সাথে মা, বোনের সাথে হেডস্যার আর অরূপ স্যারও এসেছেন। টীম ক্যাপ্টেন তাকে বল করতে ডাকতেই আম্পায়ারকে টুপিটা দিয়ে নিরুত্তাপভাবে বলল, “রাইট আর্ম, ওভার দ্য উইকেট।” তারপর পা মেপে এগিয়ে চলল বোলিং মার্কের দিকে। উত্তেজনায় নিজের হৃদস্পন্দনকেই প্যারেডের ড্রামরোলের মতো মনে হচ্ছিল সায়ন্তনের। সামনে দেখল এখনকার বাংলা সিনিয়র দলের এক সমীহ-জাগানো ব্যাটসম্যান। হাতের বলটা ট্রাউজারে পালিশ করে প্রস্তুত হ’ল সে। একটা আসন্ন যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত ভেতরের ‘আমি’টা যেন তাকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য গর্জে উঠল, ‘দ্য গেম ইজ অন, লেটস্ রান। দ্য চেস অফ ইওর ড্রীম বিগিনস নাউ…’।।।। সমাপ্ত ।।
-
শব্দসন্ধান
শব্দসন্ধান
-রুদ্র প্রসাদআঁকিবুকির ফাঁকে লুকানো কত মায়া,
পলে-অনুপলে বাহারের অনুপম কায়া!
আলোর খোঁজে উৎসাহ মুক্তবেগে ধায়,
নষ্ট আয়াস কৌতুকাবহে শূণ্যে মিলায়।চমকে দমকে ভীত অন্তরে খাণ্ডবদাহন,
কল্পমায়ায় হরষে-বিষাদে মধুর সমাপন!
খামখেয়ালী আঁচড়ে গুমরায় কাতরতা,
অবহেলা দীর্ঘায়িত, হতশ্রী মৌনমুখরতা।এলোমেলো ভাবনায় বয় ভাবহীন রেশ,
খটোমটোর মিছিলে প্রাণহীন অবশেষ!
বেড়াজালে আটকে হারিয়ে গেছে শব্দ,
খালি পাতা বলে ‘হ’ল তো কেমন জব্দ’।যদিও বা আসে কখনো লয় আর ছন্দ,
খাগ রসকষহীন, কভু ছিল কিনা সন্দ!
আপনাতেই সুরাসুর, ভাবনারা বেয়াড়া,
মুখবন্ধ পেরিয়ে হ’তে চায় লাগামছাড়া।মনের মাতন চাষার মতন, সঞ্চারী প্রাণ,
স্বপন আর জাগে কবে হ’তে আগুয়ান?
শতমুখী কত পথে বিচরণ পৃথিবী ’পরে,
দেখা ফিরে আসে যদি ভারে আর ভরে।আনমনা মাথায় কাজ করে কোন বোধ?
সুযোগ বুঝে উঁকি দেয় অসীম অনুরোধ!
ভুলে ভরা সব হেঁয়ালি, জরাগ্রস্ত নিষেক,
নড়াচড়া ক্ষীণ, আকুতিনামায় অভিষেক।দোদুল দোলে সেথা ভোলে নাকো ভবী,
আবছায়া মুকুরে ভাসে ক্লান্ত ছায়াছবি!
ব্যোমযান পরিহাসে হাসে, নতমুখী নায়,
মরা গাঙে বানের ডাক সুধা আঙিনায়।হয়তো কখনো আবার আসর সাজবে,
মন কেমনের সুরেলা ওঠাপড়া বাজবে।
একলহমায় উড়ে যাবে কুটো আর খড়,
টলমল লেখনী তুলবে তৃষিত বুকে ঝড়।বয়ান হবে অনুপুঙ্খে স্বতঃ সালতামামি,
নীরবতা সোচ্চারে দেবে বাঙ্ময় সেলামী।
সৃষ্টিসুখ আবেশীয় তানে বিভোর নিদান,
সফল হবে সামান্য কলমের শব্দসন্ধান।। -
আবেশীয়ানা
আবেশীয়ানা
-রুদ্র প্রসাদদিনকরের লঘুচালে আবেশ আপন খেয়ালী,
আলো-আঁধার মাঝারে আবছায়ার হেঁয়ালি;
কম্পিত লাজে অধরসিক্ত, পুলকিত দামিনী,
নিশিযাপন আবেগে শিহরিত কুসুমকামিনী।কোন অমোঘ আকর্ষণে পলাতক মন হোতা!
অচেনা-অজানা মানিক, আছে যেন কোথা?
দূর হতে আগতনামা, হাসে আকাশের গায়,
ভ্রমেই দিকভ্রষ্ট, নিজেতেই নিজেকে হারায়!মহাশূণ্যে সকাশ বিদ্রুপে নক্ষত্রখচিত চমক,
আপনাতেই বিজন রূদ্ধকণ্ঠে বাষ্পীয় দমক!
চন্দ্রিমাও আপন কলঙ্কে মলিন বিদগ্ধ বসনা,
জ্যোৎস্নার মায়াজালে বোনা অলীক বাসনা।বিরসেই সিক্ত রস, আরাধনায় মাধুরী বন্দন,
কল্প-কাননে পারিজাত ভাসে সুরভিত নন্দন!
অম্বর গরজে কভু, আধার নিষিক্ত কোথাও,
চকিত হরষে চমকিত সেথা, কাদম্বরী উধাও!নীলের বুকে বেহাগ স্রোতে অনুক্ষণ বিলীন,
মুক্তমনে দিশাহারা অনুভূতিরাও শব্দবিহীন;
ময়ূরপঙ্খী ফেরার, উজানে নিস্তরঙ্গ বন্যতা,
আকর্ষণে স্থবির ঘর্মস্রাব, পেলব আদিমতা।অজান্তে অযাচিত মন ধায় কেমন আবেশে,
শূণ্য মাঝে পূর্ণ সেথা কোন সে পরীর দেশে!
মোচনে রাগ-রাগিণী লয় সাজায় আনমনে,
উদ্দীপনাময় কৌতুকাবহ নিভৃত আলাপনে।কোলাহলময় হলাহলে সুখ শীৎকার বঞ্চিত,
শত ব্যস্ততার ফাঁকে অভিসারী আশ সঞ্চিত;
নিমীলিত আঁখিপটে সঞ্চারিত ঈপ্সিত বর্ণন,
স্বপ্নিল অক্ষেই দোদুল্যমান অবদমিত মনন।লালকমল-নীলকমলে আঁকা রিক্ত করতল,
গুঞ্জনে অলির মাধুকরী, বিকশিত শতদল!
অন্তর দর্শায় অশনিযোগে প্রয়াস সুদূরগামী,
আবেশীয় বশে মন, স্বপ্নের নীরব অনুগামী।। -
মানবতা…
মানবতা…
-রুদ্র প্রসাদ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানুষ, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘হোমো সেপিয়েন্স’, জীবকূলের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সে তো মানুষ-জাতিই, তার আবার জাতিভেদ কিসের! তার একমাত্র পরিচয় সে মানুষ। সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত অভিযোজিত হতে হতে, সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজের মাথায় শ্রেষ্ঠত্বের উষ্ণীষ স্বমহিমায় প্রতিভাসিত করে এসেছে মানুষ।
কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় সীমারেখার গণ্ডীতে, বা ভৌগোলিক যুক্তিতে, কিংবা নিছক গাত্রবর্ণ বিচারে তার নাম-নামান্তর হলেও মূলতঃ সে মানুষ। সে বিশ্ব-বিধাতার সন্তান, এক অননুকরনীয় সৃষ্টি, যে সৃষ্টিতে নেই কোনো ভেদ-বৈষম্যের পার্থক্যরেখা। কিন্তু মানুষ নিজেই রচনা করেছে কৃত্রিম জাতি, সৃষ্টি করেছে ঘৃণ্য বৈষম্য।
ভেদবুদ্ধি-প্রণোদিত স্বার্থান্বেষী মানুষ নিছকই লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষে-মানুষে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছে। জাগতিক যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যত কলঙ্কিত অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়, যত হানাহানি আর রক্তপাত, সবের মূলেই রয়েছে এই অবাঞ্ছিত অন্তর।
বিবর্তনের হাত ধরে ধূলার এই ধরণীতে যখন মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন ‘স্বজাতি-বিদ্বেষ’ বলে কোনো অনুভূতির অস্তিত্ব ছিল না বলেই জাতিভেদের মতো নীচতা কখনোই স্থান পায়নি মানুষের আচারে বা ব্যবহারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিবর্তনশীলতার পথে মানুষ যতই অগ্রসর হয়েছে, ততই তার মনে সঞ্চারিত হয়েছে পরস্পর-বিদ্বেষী ভাব, যার দহন জ্বালায় জর্জরিত পৃথিবী শোণিত-স্নাত হয়ে খিন্নকণ্ঠে বারেবারে আর্তনাদ করে উঠেছে। বিভেদের বিষক্রিয়ায় মানুষ সহজাত প্রবৃত্তি হারিয়ে অন্ধ হয়েছে, ছিন্নমস্তার মতো আপন রূধির-পানে হয়ে উঠেছে উন্মত্ত। সেই চক্ষুলজ্জাহীন জাতিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকে সঙ্কটের মুখে ফেলেছে বারবার, যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে পৃথিবী বারেবারে উঠেছে শিউরে।পৃথিবীতে মানুষে-মানুষে সংঘাত ও রক্তপাতের শুরু অতি প্রাচীনকাল থেকেই। ভৌগোলিক পরিসীমার বেষ্টনীতে আবদ্ধ মানবগোষ্ঠী সময়ের সাথে সাথে স্থানান্তরের গোষ্ঠীকে আলাদা ভাবতে শিখেছে, যার ফলে ক্রমাগতভাবে নিজেকে অন্যের থেকে পৃথক করার প্রবণতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক সীমা-বেষ্টনীর মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে কৃত্রিম একাত্মতার ঘোরে গঠন করেছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, যারা ক্রমশঃ রূপান্তরিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে। আর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নামে সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলা।
সময়ের সাথে সাথে ক্ষীণ হতে থাকলেও বৈষম্য প্রদর্শন আজও কদর্যভাবে বর্তমান। প্রাচীনকাল থেকে শ্বেতাঙ্গ জাতি অশ্বেতাঙ্গদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে এসেছে, ক্রীতদাসপ্রথা যার এক কলঙ্কিত ইতিহাস। ‘সুসভ্য’ শ্বেতনখরে ‘অসভ্য’ কৃষ্ণকায়দের কম রক্ত ঝরেনি। একবিংশ শতকে যখন সারা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা শান্তি ও সাম্যের কথা চিন্তা করছেন, তখনও বিস্ময়ে বাকরোধ হয় দেখে যে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বর্ণবৈষম্যের এই দূরপনেয় কলঙ্ক আজও মুক্ত হয়নি!
পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, এই পৃথিবী সাক্ষী থেকেছে মানুষের চরম বর্বরতার, মানবতার দুঃসহ লাঞ্ছনার। দৈহিক বর্ণের জন্য কখনোই কোনো মানুষ দায়ী হতে পারে না। জলবায়ুর পার্থক্যই মূলতঃ মানবদেহের বর্ণের বিভিন্নতার জন্য দায়ী। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায়ও ‘কালো আর ধলো, বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারি সমান রাঙা।’ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আর্থ-সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক, সব বিচারে প্রাগ্রসর শ্বেতাঙ্গরাই বরাবর বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে আদিম বর্বরতার কাছে আত্মবিক্রয় করেছে, কৃষ্ণকায়দের অর্ধ-মানব বা ‘হাফ-ম্যান’ মনে করে তাদের ওপর করে এসেছে নৃশংস অত্যাচার। বর্ণাভিমান ও জাত্যাভিমানের নির্লজ্জ প্রকাশ যে মানুষকে কত মূঢ়, নিষ্ঠুর পশুতে পরিণত করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যাণ্ড তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ রোডেশিয়ায়ও হয়েছে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আমেরিকায়ও সমানাধিকারের দাবির স্বার্থে প্রাণ দিয়েছেন নিগ্রোনেতা মার্টিন লুথার কিং, প্রেসিডেণ্ট কেনেডি এবং রবার্ট কেনেডি।
প্রাচীন ভারতবর্ষ এই মহান সত্য উপলব্ধি করেছিল যে ‘মানুষ এক, মানুষে-মানুষে কোনো বিভেদ নেই, সকল মানুষের অন্তরেই শ্রীভগবানের বাস’। কিন্তু বৈদিক যুগের অবসানে মনুষ্যত্বের সেই গরিমা হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। জীবিকা ও গুণের বিচারে সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চার ভাগে বিভক্ত হলেও পরবর্তীকালে আত্মপ্রকাশ করে ঘৃণ্য জাতিভেদ-প্রথা, শুরু হয় মানবতার নির্লজ্জ অপমানের এক কালো অধ্যায়। সমগ্র সমাজ বৈষম্যের অসংখ্য প্রাকার তুলে আত্মহননের পথে অগ্রসর হয়েছে। যে ভারতবর্ষ মানুষের অন্তরে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছিল, সেই ভারতবর্ষই তার এক বিশাল জনসম্প্রদায়কে ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, অপাঙ্ক্তেয় ও পতিত করে রেখেছিল দীর্ঘকাল। পরে যদিও অপমানের শরশয্যা থেকে পীড়িত মানবতাকে তুলে এনে তার যথাবিহিত পূজার আয়োজন করা হয়েছে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দ যার প্রধান কাণ্ডারী, তবু আজও যখন ক্রোধ ও বিদ্বেষের লেলিহান অগ্নিশিখায় হরিজন বালককে পুড়িয়ে মারা হয়, বা জাতপাতের নামে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন ভারতবাসী হিসেবে লজ্জায় অবনত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পৃথিবী থেকে ভেদাভেদের রক্তপাতের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্যই এসেছিল ধর্ম আর সব ধর্মের মূলকথাই ছিল সংঘবদ্ধভাবে কিছু রীতিনীতি সহযোগে পরস্পরের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান তথা সাম্য ও সহিষ্ণুতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, চৈতন্য- সবাই মানুষকে শান্তির পথ দেখানোর জন্যই বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু চিরকালই মানুষের হাতে সেই ধর্ম কলুষিত হয়েছে। ধর্মের ছুরিকাঘাতে পৃথিবী হয়েছে রক্তাক্ত, ধর্মোন্মত্ত পাষণ্ডদের হুঙ্কারে মানব সভ্যতার উঠেছে নাভিশ্বাস। ধর্মের নামে পৃথিবীতে যত রক্তপাত ঘটেছে, এমন আর কোনো কিছুতেই কখনো হয়নি। যুগে যুগে ধর্ম ডেকে এনেছে ঘৃণ্য পরধর্মবিদ্বেষ, তাতে রূধিরোৎসবে আত্মঘাতী হয়েছে মানুষ, অবলীলায় যুপকাষ্ঠে বলী হয়েছে মানবতা। আজ বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী থেকে ধর্মের সেই ভ্রান্তিবিলাস ধীরে ধীরে অপসারিত হচ্ছে। অহিফেনবৎ ধর্মের বটিকা পরিত্যাগ করে আজ জাগছে অন্তরের মানুষ, মনুষ্যত্ব উজ্জীবিত হয়ে মানবতাবোধের হচ্ছে আনয়ন। শম্বুকগতিতে পরিবর্তন আজ অতি সামান্য কতিপয়ের মধ্যে হলেও এই জাগরণ এক আশাপ্রদ আগামীর বার্তাবাহী।
ভিন্ন ভিন্ন গাত্রবর্ণের মানুষেরা সবার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে এবং পাবে কিনা, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানে থাকবে কিনা, এইসব প্রশ্নের উত্তর সময়ের গর্ভে। কিন্তু মহাকাল মিলনবিলাসী। মানুষে-মানুষে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ মিলনই সবার কাম্য। সেই মিলন যদি সমানতা ও বিবর্তনের পথে না হয় তবে হয়তো বেজে উঠবে রুদ্রবীণা, মানবতার মহামিলনের পথে যে কৃত্রিম ‘বাধার বিন্ধ্যাচল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিকে দিকে, সব ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে এক লহমায়। হয়তো তার জন্য আরও এক বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সমগ্র মানবজাতিকে। কিন্তু যখন এই ঘৃণা-পঙ্কিল ও ভেদ-ক্লিষ্ট পৃথিবী সেই মহামিলনের পরমলগ্ন প্রত্যক্ষ করবে, তখন হিটলার বা ভেরউডের প্রেতাত্মা কি করবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও, বিধাতা যে সমগ্র মানবজাতিকে আশীর্বাদ করবেন, একথা বলাই বাহুল্য। সেদিন আবার সবার হৃদকমলে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত ও চিরবিরাজমান হবে ‘মানবতা’।।
-
যুগল মিলন
যুগল মিলন
-রুদ্র প্রসাদদিন আসে, দিন যায়, জাগতিক নীতি,
নীতির বদল হয় কালের খেয়ালে।
ইন্দ্রজালে মোহাচ্ছন্ন জগৎ-সংসার!
সার করে অসার যতনে কাটে সময়…,
বুভুক্ষিত দ্রবীভূত প্রাণ নীরবে নিভৃতে,
রঞ্জিল হরিষে-বিষাদে এ পাষাণ চিতে!
ফুল-ফল ঝরে যায় বৃন্তচ্যুত হয়ে,
রয়ে রয়ে আলো জ্বালায় অগনিত তারা;
তারা বলে, ‘মহাশূন্য ছাড়া অন্যকিছু নাই’।
কার টানে সব শূন্যে ভাসমান?
আনচান করে মন, জানতে চায় উত্তর।
উত্তর আসে ঐ মহাশূন্য থেকে…,
যাতে ঐ সৃষ্টি-স্থিতি-লয়, সবই একাকার;
বারবার তারই বক্ষে নিরবধি ঘোরে ঐ…,
দূরে অগনতি গ্রহ-নক্ষত্র, আপন কক্ষপথে।
পথে পথে ওড়ে ধূলি, বিষণ্ণ গোধূলিবেলায়
হেলায় হারায় সবই, ঐ মহাশূন্য মাঝে।
সাঁঝে ঝরে বিন্দুবারি শিশির হয়ে…,
হিয়া ভরে অসীম শূন্যতার গানের ভাষায়।
প্রাণে প্রতিধ্বনিত হয় মহাশূন্যেরই সুর,
দূরে, বহু দূরে, গভীরে যায় অবচেতন মনে,
ক্ষণেক্ষণে যেন মনে হয়, হেথা সবই শূন্যময়!
প্রলয় নাচন নাচে নটরাজরূপে, সে বিধাতা।
খাতায় লেখনী চলে আপন খেয়ালে;
দেওয়ালে মাথা কুটে শেষ হয় কেউ…,
কেউ বা ভেসে যায় খুশির জোয়ারে।
বারেবারে ধ্বনিত হয় সে সুরের লহরী!
প্রহরী অতন্দ্র, সীমাহীন শূন্যে, ঐ মহাশূন্যে;
দিবানিশি অহর্নিশ হেরি শুধু নীল, ঘননীল,
মিলে সেই কৃষ্ণরূপে সৃষ্টি-কৃষ্টি-লয়-স্থিতি;
রসবতী প্রেমময়ী রাধা তো তারই পরিপূরক,
তাই আজও অমর সেই যুগল-মিলন তিথি।। -
ফিরে আসা
ফিরে আসা
– রুদ্র প্রসাদ
(১)
“এ্যাই…, দরজা খোল।” দুমদাম ধাক্কার শব্দে বিরক্ত হয়েই আধখাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে দরজা খুলে দিল সায়ন, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা অমরেশকে পাশ কাটিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমনসময় “ কি গুরু… আজ বিধবা ছেড়ে মামুতে একাই সুখটান দিচ্ছো…?” চোখ টিপে ফুট কাটল। মেজাজটা এমনিতেই খিঁচড়ে ছিল, তবুও কিছু না বলে সরে এল। কব্জি উল্টে ঘড়িতে দেখল টিফিন শেষ হতে আরও মিনিট দশেক বাকি। ক্লাশ করার ইচ্ছা কোনোকালেই বিশেষ থাকে না, আজ আর আড্ডাবাজি না করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এসে ফাঁকা পার্কের বেঞ্চে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিল। গত পরশুরই কথা, “সানু, ন’টা বাজে।” বাবার গম্ভীর গলা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছিল। “স্কুলের রিপোর্ট কার্ড নিয়ে ওঘরে আয়।” অবাক হয়ে ভেবেছিল সায়ন, ‘গতকালের মক টেস্টের রেজাল্টের কথা কে বলে দিল!’
“তিনটে সাবজেক্টে সিঙ্গল ডিজিট! তোর লজ্জা করে না! নিশ্চয়ই গার্জেন কল করেছে?”
“না মানে…”
“ইয়েস অর নো?” নীরবে মাথা নেড়েছিল তখন।
“তোর জন্য কি একটুও স্বস্তিতে থাকা যাবে না! দাসবাবুর মেয়েকে দেখে শিখতে পারিস না। সবার সামনে অপমানিত হওয়া ছাড়া তোর থেকে কি আর কিছুই আশা করা যায় না? তোর জন্য সবার কাছে মাথা নিচু করে থাকবে হবে! ছিঃ!”
“স্যরি বাবা…,” দাসবাবুর মেয়ে মানে বাণীব্রতার কথা উঠতেই একটা গালাগাল জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল, কষ্ট করে সামলে নিল।
“শ্যাট আপ। অ্যানুয়্যাল পরীক্ষায় যদি পাশ না করতে পারিস, নিজের ব্যবস্থা দেখে নিস। বসিয়ে বসিয়ে তোকে গেলাব আর তুই সোসাইটিতে আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে বেড়াবি, এ আমি বরদাস্ত করব না। দিস ইজ ইওর লাস্ট ওয়ার্নিং”, রাগে গজগজ করছিলেন মিঃ সেন।(২)
এখন ক্লাশ ইলেভেন। যখন ওয়ানে পড়ত, তখন মাত্র তিনদিনের অজানা জ্বরে মাকে হারিয়েছিল সায়ন। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মধুছন্দা দেবীকে ঘরণী করে আনেন মিঃ সেন। নিয়ম মেনেই তার পরের বছর আসে সায়ক। এই দু’জনকে কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না সায়ন। বিশেষ করে মায়ের জায়গায় ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখলেই একটা অন্ধরাগে যেন বোবা হয়ে যায় সে। অত্যন্ত সহৃদয়া হ’লেও ‘সবই লোক দেখানো ভড়ং’ ভেবে নিজেদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে রেখেছে সে। আর যত আক্রোশ গিয়ে পড়ে ছোটো ভাইয়ের ওপর, সুযোগ পেলেই গায়ের ঝাল মেটাতে নির্দয়ভাবে পেটায়। গতকাল একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। সামান্য টিভি দেখা নিয়ে মেরে নাক-মুখ ফাটিয়ে রক্ত বের দিয়েছে, ভেবেই নিজের মনে গভীর অনুশোচনায় জ্বলতে থাকে সায়ন। মা-হারা ছেলে বলে সকলের অনুকম্পার পাত্র হলেও ওর উদ্ধত স্বভাবের জন্য সকলেই ওকে অপছন্দ করে, একমাত্র মধুছন্দা দেবী ছাড়া।
ছবিটুকু ছাড়া নিজের মায়ের কথা কিছু মনেই পড়ে না, জন্মদাত্রী কবে যে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে টেরই পায়নি। ‘মা’ বলে কখনো না ডাকলেও ‘মায়ের স্বরূপ’ বলতে তার চোখের সামনে মধুছন্দা দেবীর মুখটাই ভাসে। ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করে সায়ন। মনে মনে স্থির করে, ‘আমাকে বদলাতেই হবে। এখনই শোধরাতে হবে নিজেকে। উঠে দাঁড়াতে হবে।’ ভেতরের ছটফটানি নিয়ে অস্থিরভাবে সামনে তাকাতেই চোখ পড়ে পার্কের দেওয়ালে আঁকা স্বামী বিবেকানন্দের ছবিতে, মনে মনে বলে, ‘হে স্বামীজী, পথ দেখাও…।’(৩)
অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরে দেখল ছোটো সায়ক বসে টিভি দেখছে। মুখে-মাথায় ব্যাণ্ডেজ দেখে মনের অপরাধবোধের কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমে এসে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। ঐ ঘটনার পর থেকে সায়কও কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। বাড়ির থমথমে পরিবেশ যেন গিলে খেতে আসে সায়নকে, মনে মনে ভাবে, ‘এসবের জন্য আমিই দায়ী। আমাকেই সবকিছু ঠিক করতে হবে।’ আস্তে আস্তে নিজেকে পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয় সে। এই পরিবর্তনটুকু আর কারোর চোখে না পড়লেও মধুছন্দা দেবীর চোখ এড়ায় না।
একদিন পড়ার টেবিলে সায়ক বৃত্ত আঁকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঠিকমতো পেরে উঠছিল না দেখে নিজেই এঁকে দিয়ে “দ্যাখ সুকু, পেন্সিল কম্পাসের ওপরে ধরে আঙুল দিয়ে ঘোরাবি, দু’হাতে ধরলে কম্পাস নড়ে যাবে, আর কম্পাস নড়ে গেলে রেডিয়াসটা কমবেশি হয়ে যাবে, তখন সার্কলটা ঠিক হবে না, বুঝলি?” বলে তার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিল। ছোট্ট সায়ক গাঁট্টার বদলে অন্যরকম ব্যবহার পেয়ে চমকে গেলেও মধুছন্দা দেবীর বুঝতে কিন্তু অসুবিধা হয়নি, সব দেখে তিনি চোখের জল আড়াল করতেই চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে সরে গেলেন।
সায়ককে মেরেছিল বলে বাবা বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছিলেন। তারপর থেকে বাবার সাথে কথাবার্তাও বন্ধ। বাকিরা যে যার মতো আছে। কথা না বললেও রাতে পড়ার সময় হাতের কাছে গরম হরলিক্সের মগটা দেখলেই নিজেকে আরও ছোটো মনে হ’তে থাকে সায়নের। জামাকাপড় থেকে শুরু করে নিজের বিছানা, খাওয়ার – সব জায়গাতেই তাঁর নীরব উপস্থিতি খোঁচা দেয়। অবাক হয়ে মনে মনে ভাবে, ‘মা কি এমনই হয়!’(৪)
স্কুল, কোচিং, খেলার মাঠ আর বাড়ির মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া সায়ন আস্তে আস্তে খেয়াল করে এখন সায়ক একটু হ’লেও দাদার পেছনে লাগে। যে সায়ক দাদার কাছে বসা তো দূরের কথা, দেখলেই দৌড়ে পালাতো, সে এখন তার অনুপস্থিতিতে তারই ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে গল্পের বই পড়ে, গান শোনে, গেম খেলে, যদিও ধরতে গেলেই পালায়, দূর থেকে মুখ ভ্যাঙচায়।
মেলামেশা কমিয়ে দেওয়ার কারণে পুরোনো বন্ধুদের সংখ্যাও কমে গেছে, আজকাল অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। আর যারা ভালো ছাত্র-ছাত্রী বলে পরিচিত, তারা আগের সায়নকে মনে করে মিশতে ভয় পায়। সবমিলিয়ে একা হয়ে গেলেও সায়নের খারাপ লাগে না। সে তার লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছে। ক্লাশের পড়া বাদে সে এখন অনেক বই পড়ে। স্বামীজীর বাণী তার চিন্তাধারা বদলে দিয়েছে।
স্কুলে তাদেরই ব্যাচের ফার্স্টগার্ল বাণীকে একবার প্রপোজ করে সবার সামনে অপমানিত হয়েছিল। তখন ভেবেছিল, ‘একবার সুযোগ পাই, দেখে নেব। এমন হাল করব, কোথাও মুখ দেখাতে পারবি না।’ এখন ভাবে, ‘সত্যিই কি মূর্খ ছিলাম! ঝোঁকের বশে যদি ভুলভাল কিছু করে ফেলতাম!’ এখন বুঝতে পারে সেই ভালো লাগাটা আজও রয়ে গেছে! ভাবতে ভাবতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে সায়নের মুখে। ‘আমাকেও ভালো হ’তে হবে’ ভাবনায় আরও বেশি করে পড়াশোনায় ডুবে যায়।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সময়। ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়া সায়ন আরও ভালো করার লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে তৈরী করে। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টে নিজের নাম প্রথম দশের মধ্যে দেখে মনে মনে মুচকি হাসে আর ভাবে, ‘এই তো সবে শুরু, আরও অনেক দূর এগোতে হবে।’
সায়কের দুষ্টুমি একটু একটু করে কমিয়ে আনলেও সম্পর্কের শীতলতা পুরোপুরি কাটছিল না। একরকম ঝড়ের বেগেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ভালোভাবে দেওয়ার পর চুটিয়ে খেলা আর টিভি দেখার ফাঁকে পছন্দের বেশ কিছু বই পড়ে ফেলেছে সায়ন। খেলতে যাওয়া আসার ফাঁকে দেখত ছুটিতেও কম্পিউটার ক্লাশে বাণীর যাতায়াত।(৫)
রেজাল্টের দিন যত এগিয়ে আসছিল, ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা তত বাড়ছিল। রেজাল্ট বেরোনোর দিন সকালে ইন্টারনেট থেকে জেনে গিয়েও বিশ্বাস হয়নি, দুপুরে স্কুলে গিয়ে মার্কশিট হাতে পেয়েও বিস্ময় কাটছিল না সায়নের। সে শুধু ভালোভাবে পাসই করেনি, নম্বরের দিক দিয়ে শুধু বাণীকে টপকেও যায়নি, একেবারে মহকুমাতে দশম স্থান অধিকার করেছে!
মার্কশিট হতে নিয়ে সবার অভিনন্দনের বন্যায় কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলছিল, এমন সময় “কনগ্রাচুলেশনস্” কথাটা শুনে পিছন ফিরে দেখল বাণী। ভ্যাবাচাকা খেয়ে একটু সময় নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস্।” তারপর একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, “তোর দু’মিনিট সময় হবে? কিছু বলার ছিল…।”
নীরব সম্মতি পেয়ে বলল, “তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, গতবছরের আগের বছর সরস্বতী পূজার দিন তোকে প্রপোজ করেছিলাম। সেটা নিয়ে তোরা সবাই মিলে খুব হ্যাটা করেছিলি, সেই সব কথা নয়। সেদিন আমি তোর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্য ছিলাম না, আজও নই। বাট আই লাইক ইউ। সেদিনও লেগেছিল, আজও লাগে। আই রিয়েলি ডু। আমার বন্ধু হবি…?”
পড়ন্ত বেলার আলোতে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো বাণীর মুখটা তখন লাল হয়ে উঠেছে। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “আই লাইক ইউ টু সায়ন। বাট, কান্ট বি জাস্ট ফ্রেণ্ডস। ভেবে জানিও। আর একটা কথা এই নতুন সায়ন ঠিক আছে কিন্তু পুরোনো সায়নকে হারিয়ে যেতে দিও না। একটা দারুণ কেয়ার ফ্রী অ্যাটিচিউড আছে তোমার মধ্যে অ্যাণ্ড আই লাইক দ্যাট। বি বোল্ড, বি অ্যাগ্রেসিভ, বাট উইথ কশাসনেস। আই অ্যাম এক্সপেক্টিং আ লট ফ্রম ইউ।”
হঠাৎ বাণীর মুখে ‘তুমি’ শুনে একটু অবাক হ’লেও কিছু বলল না। একটু থেমে বাণী আবার বলল, “এখন থেকে নিজেদের তুই-তোকারি বাদ দাও, আমি পছন্দ করি না। সময়ই আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তবে আমি তোমার পাশে থাকব, কথা দিলাম। আর হ্যাঁ, আমার কাছের মানুষেরা সবাই আমাকে ‘বৃষ্টি’ বলেই ডাকে, আজ থেকে তুমিও তাই বলে ডেকো।”
“থ্যাঙ্কস্। আই ওন্ট লেট ইউ ডাউন… প্রমিস। অ্যাণ্ড… লাভ ইউ বৃষ্টি।” বলে আলতোভাবে বাণীর হাতটা ছুঁয়ে দিল সায়ন আর কিছু না বলে মুখ নামিয়ে নিল বাণীব্রতা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বড়ো রাস্তায় পৌঁছে পরস্পরকে তখনকার মতো বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরল।(৬)
ছেলের রেজাল্ট বলেই আজ অফিসে যাননি মিঃ সেন, মোটামুটি সব জানার পর অধীর আগ্রহে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সায়ন ফিরে দেখল বাবার মুখটা আনন্দে চকচক করছে। নিজের পরিকল্পনা মতো বাবাকে কিছু না বলে মধুছন্দা দেবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমবার তাঁকে প্রণাম করে তাঁর হাতে মার্কশিটটা দিয়ে বলল, “মা, এটা তোমার জন্য।” ভাববিহ্বল মধুছন্দা দেবীর দু’চোখে তখন আনন্দধারা। মিঃ সেন আগের কথা ভেবেই ছেলেকে বললেন, “যাও, মাকে দেখিয়ে এসো।”
ততক্ষণে সায়ন জড়িয়ে ধরেছে মধুছন্দা দেবীকে। ছেড়ে দিয়ে ধরা গলায় বাবাকে বলল, “ঐ ছবিটুকু ছাড়া মায়ের কোনোকিছুই আমার মনে পড়ে না। ‘মা’ বলতে যা বুঝি তা এই মাকেই বুঝি। এতোদিন বলতে সাহস হয়নি। তোমার শেখানো ‘নতুন মা’ বা ‘ছোটো মা’ বলার ইচ্ছে কখনো হয়নি।”
“দূর বোকা, মা তো মা-ই হয়, তার আবার নতুন কি আর ছোটো কি!” বলে আবার বুকে টেনে নিলেন সায়নকে। তখন মিঃ সেনের চোখেও জল। ছোটো সায়ক বুঝতে পারছিল না ‘দাদা ভালো রেজাল্ট করেছে তো কান্নার কি হয়েছে!’ বড়োদের কান্নার মাঝে সে কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেই সময়ই ঘরের নীরবতা ভেঙে মোইবলটা তারস্বরে বেজে উঠল। রিংটোনের খ্যানখ্যানে শব্দে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চন্দ্রবিন্দুর বিখ্যাত গান, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়…।’ -
শেষের পথে
শেষের পথে
-রুদ্র প্রসাদ(১)
আলোর আবছায়া রেখা জানালা গ’লে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘরের ভেতর। আধপোড়া ধূপের ধোঁয়া এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। তার মাঝে আট বাই বারোর ফ্রেমে আটকে থাকা মুখে লেগে আছে হালকা হাসির আভাস। সদ্যফোটা রজনীগন্ধার মালা যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে অনুপমাকে। দেখতে দেখতে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিলেন শান্তনু, এমন সময় মোবাইলের টুংটাং শব্দ তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
সামনে অনেক কাজ। গত কয়েকটা দিনেই বেশ কিছু মুখোশ কদর্যভাবে খসে পড়ে বেরিয়ে এসেছে আসল চেহারাগুলো। তিক্ত হ’লেও কঠোর সিদ্ধান্তটা একরকম নিয়েই ফেলেছেন, এবার শুধু জানিয়ে দেওয়ার পালা। ‘আরও একটা যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, যা কুরুক্ষেত্রের তুলনার কোনো অংশে কম নয়। অর্জুনের তবুও একটা শ্রীকৃষ্ণ ছিল, কিন্তু এখানে চক্রব্যূহে একেবারেই একা। কোথাও নিজের বলে কেউ নেই! তবুও অভিমন্যুর মতো বিজিত নয়, জয়ী হতেই হবে, তা সে যেভাবেই হ’ক না কেন…’, ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তাঁর। যদিও বয়সের সংখ্যাটা সত্তর ছুঁয়ে ফেলেছে, তবুও শিরা-উপশিরায় পুরোনো আগুনে দাপাদাপিটা অনেকদিন পর বেশ টের পাচ্ছিলেন। একসময় “অনুর অশান্ত” বলে খুব খ্যাপানোর চেষ্টা করত অনুপমা, আর তিনি সেটা বেশ উপভোগও করতেন। কিন্তু গত কয়েকদিনেই সব কেমন আমূল বদলে গেছে! কথাগুলো মনে পড়তেই মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল, চোখ বন্ধ করে বসে পড়লেন নিজের প্রিয় আরামকেদারায়। মনের ক্যানভাসে ভেসে বেড়াতে লাগল দগদগে ঘায়ের মতো কিছু সদ্য ঘটে যাওয়া অতীত।(২)
গত বেশ ক’বছর হ’ল তেমনভাবে বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরোনো হয়নি। দু’জনার সংসার হ’লেও ঘর ছেড়ে বেরোতে নানা ঝামেলা – ব্যাগ গোছানো, টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং ছাড়াও পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা, কেবলওয়ালা, কাজের লোকেদের বারণ করা, তালাবন্দী ইত্যাদি হাজার একটা বাধা। বয়সের কারণে একটু নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট থাকার প্রয়াসী শান্তনু পুরো সংসার অনুপমার হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। অন্য কোনো পরনির্ভরতাও নেই। স্বচ্ছলতার সাথে থাকা অভাবটুকু শুধুই মানসিক, জীবনের সায়াহ্নে এসে দু’জনেই সেটা অনুভব করেন। একসময় নিয়ম করে বছরে দু’একবার বেরোতেন, কিন্তু ইদানিং গ্যাস, অম্বল, প্রেসার, সুগার – সবমিলিয়ে আর পেরে উঠছেন না। আগে ছেলেরা আসত, গত বছর পাঁচেক হ’ল তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, কাজের চাপ, সাংসারিক ঝামেলা, নানা অজুহাতে আর এমুখো হয়নি। যতটুকু যোগাযোগ ঐ মুঠোফোনের বদান্যতায়, তার তাগিদও এই তরফেরই।
শান্তনু সরকারি চাকরিতে যখন ছিলেন, তখন ছুটি বিশেষ মিলত না। আর এখন তো সারাক্ষণই ছুটি। আগে ভাবতেন, ‘ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসারের চাপমুক্ত হওয়া যাবে আর চাকরির পরে তো অঢেল সময়, তখন যেখানে খুশি যাওয়া যাবে’। কিন্তু তেমনটা আর হ’ল কোথায়!
হায়দরাবাদে এক বেসরকারী কোম্পানির উঁচু পদে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনীয়র বড়ো ছেলে, সাম্যদীপের কাছে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তনু আর অনুপমা, ইচ্ছে ছিল সপ্তাহখানেক কাটিয়ে নিজাম প্যালেস, গোলকুণ্ডা ফোর্ট, রামোজী সিটি দেখার ফাঁকে আশেপাশে ঘুরে ছেলে, বৌমা, নাতনীর সাথে সময় কাটিয়ে, ফেরার আগে নিজেদের স্মৃতির ঝুলি ভরে নেবেন অবসরে রোমন্থনের জন্য। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই ধাক্কা খেতে হ’ল। সদ্য পরিচিত এক স্থানীয় প্রবাসী বাঙালির আমন্ত্রণে গিয়ে ফিরতে একটু সন্ধ্যাই হয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঢোকার মুখে শুনেছিলেন বৌমার বিরক্তিমাখা গলা, “আমাদের জ্বালানো ছাড়া কি তোমার বাবা-মায়ের আর কোনো কাজ নেই! তুমি কিছু বলবে? না আমাকেই সব করতে হবে?”
দু’জনেই খুব আশা নিয়ে ছেলের জবাবের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু যখন কানে এল, “যদি কিছু বুঝতে না চায়, কি আর করি বলো। দুটো দিন দাও। কিছু বলতে গেলেই তো রাগারাগি আর অশান্তি। যদি বুঝতে না চায়…”, আর কিছু শোনার প্রবৃত্তি হয়নি। বিচলিত শান্তনু সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ঋতু পরিবর্তনে কেবল দিন বদলায় না, অনেক কিছুরই বদল ঘটে, স্বজনেরাও তার বাইরে নয়।’ পুরোনো দিনের মানুষ শান্তনু স্বভাবে গম্ভীর, জেদী ও নির্ভীক, হয়তো মুখের ওপর অপ্রিয় কথা বলেই দিতেন, কিন্তু অনুপমার মৃদুস্বরে “কিছু ব’লো না” আকুতি তাঁর কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিল।
বৌমার উষ্মা আর বড়ো ছেলের আলগা ব্যবহার মন ভেঙে দিয়েছিল। হয়তো আধুনিক সমাজে তাঁদের উপস্থিতি বেমানান বা ফ্ল্যাট কালচারে আর সাহেবী কেতায় অনভ্যস্ততা অনুঘটকের কাজ করেছিল। রাতেই সব গোছগাছ করে পরের দিন নাতনীকে শেষ বেলার আদর করে বিদায় নিতে হয়েছিল সব অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করেই।(৩)
মনের জ্বালা জুড়াতেই এক রকম বিনা নোটিসে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ছোটো ছেলের কাছে। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিলেন মুম্বইয়ের খার অঞ্চলে থাকা নামজাদা ট্যাক্স কনসাল্টেন্ট ছোটো ছেলেকে। সায়নদীপ বেশ কিছু পরে এসেছিল নিজের নতুন কেনা গাড়িতে চড়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, “একটা খবর দিয়ে তো আসতে হয়। বয়স তো অনেক হ’ল, ম্যানার্স বলে কি কিছুই শেখোনি! এবার কি হবে? আমরা তো কালকেই চলে যাচ্ছি, এই ট্যুরটা কোনোভাবেই ক্যানসেল করা যাবে না।”
অনুপমার ইশারায় চুপ করে গিয়েছিলেন তখনকার মতো। নিজেদের জিনিসপত্রের ব্যাগ আর খোলেননি। সন্ধ্যায় জনান্তিকে ধরা গলায় বলেছিলেন, “ছেলেদের কাছে আমরা বোঝা হয়ে গেছি। বুঝতে পারছি না কেন এলাম এদের কাছে! চলো, আমরা সকালেই ফিরে যাই।” নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল অনুপমা।
রাতে যখন ওঁদের ফেরার কথা বললেন, তখন ছেলের নীরবতা দেখে বেশ ভেঙে পড়লেও সারসত্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনুপমার। তার আগে পর্যন্ত টানাপোড়েনের শিকার হয়েই ছিল, একদিকে স্নেহের বাতুলতা আর একদিকে নিজের মানুষটার যন্ত্রণা, মাঝখানে পিষে যাচ্ছিল প্রতিটা মুহূর্তে। আসার সময় প্ল্যান করেছিল সবাইকে নিয়ে সিদ্ধিবিনায়কে পুজো দিতে যাওয়ার। দু’চার দিন থেকে মেরিন ড্রাইভ, মহাবালেশ্বর ঘুরে বহুকাঙ্ক্ষিত এলিফ্যান্টা কেভস্ দেখে ফিরবে।
কিন্তু মন ভাবে এক, হয় অন্য কিছু। অনাহূত অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঠিকই, তবে অবাঞ্ছিত হিসেবে তো আর থাকা চলে না। প্রায় পঞ্চান্ন বছরের চেনা মানুষটা সময়ের সাথে সাথে একটু অভিমানী হয়ে উঠলেও এই বয়সে তাঁর মনে জ্বালাটা ঠিক কোথায় আর কিভাবে বেজেছে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি অনুপমার। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য সহমর্মিতাটুকু ছাড়া আর কিছুরই তো প্রয়োজন ছিল না। সব বুঝত বলেই নিঃশব্দে চোখের জল ফেললেও সব সময় আগলে আগলে রাখত, কখনও একা ছাড়েনি তাঁকে। ‘কিসের টানে আর কাদের জন্য এতদূরে ছুটে এসেছিলাম? একটু সময় আর মনোযোগ দেওয়া কি এতোটাই দুঃসাধ্য ছিল? ছেলেরা একটু বুঝতেও চাইল না!’ – এই সব চিন্তার মাঝে কোনোরকমে কেটে গিয়েছিল বিনিদ্র রাতটা। সকালে বুকের কষ্ট বুকে চেপে, নাতিকে আদর করে বিদায় নিয়েছিলেন দু’জনে। গাড়িতে ওঠার আগে অনুপমা সস্নেহে “কি আর করবি বল, জানিসই তো তোদের বাবাকে। সাবধানে থাকিস, নিজেদের খেয়াল রাখিস…”, বললেও কোনো কথা বলেলনি শান্তনু।(৪)
দু’জায়গাতেই প্রত্যাখ্যানের অপমানে মূক হয়ে যাওয়া শান্তনু মুখ খুলেছিলেন ফিরতি পথে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে, “চলো না অনু, গঙ্গার ধারে একটু বসি।” ভাঙাচোরা মানুষটাকে তখন আর কিছু না বলে অনুসরণ করেছিল অনুপমা। মিঠে-কড়া রোদে পৌষালী শীত আর গঙ্গার হাওয়া মিলে বেশ লাগছিল। কিছুক্ষণ পর অনুপমা প্রস্তাব রেখেছিল, “আর এক জায়গায় তো যাওয়া বাকি রয়ে গেল। চলো না সোনুর কাছ থেকে ঘুরে আসি। তোমারই তো মেয়ে।”
মুহূর্তে নড়ে উঠেছিল স্মৃতি। তাঁদের মেয়ে সন্দীপা, একমাত্র বলেই হয়তো পক্ষপাতিত্বের পাল্লাটা বরাবর তার দিকেই বেশি ছিল। গ্র্যাচুয়েশন কমপ্লিট করার আগেই একদিন নিজের পছন্দের মানুষ বেছে নিয়েছিল। কৌলীন্য বা শিক্ষা-দীক্ষায় কোনোভাবেই সমতুল্য না হলেও মেয়ের জেদে সবই মেনে নিয়েছিলেন। প্রথাসম্মতভাবে বিয়ে দেওয়ার পর যতদিন চাকরি ছিল, ততদিন পর্যন্ত মেয়ের সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে সাধ্যমতো চাহিদা পূরণ করে গেছেন। যতদিন দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, ততদিনই সুসম্পর্ক বজায় ছিল। অবসরের পর থেকেই মেয়ের সাথে যোগাযোগ ক্রমশঃ কমে আসছিল, গত বছর পাঁচ-সাতেক হ’ল সেটাও বন্ধ। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসাদার জামাই কোনোদিনই তাঁকে ‘বাবা’র জায়গা দেয়নি, বরং তাঁদের সহৃদয়তাকে বরাবর সন্দেহের চোখে দেখে এলেও সবসময় সুযোগ বুঝে ফায়দা লুটে এসেছে।
পুরোনো বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মনটা বিষিয়ে থাকলেও ডুবন্ত মানুষ যেমন হাতের কাছে খড়-কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি অনুপমার কথায় কোথাও যেন একটু আশার আলো দেখেছিলেন সেদিন। যদিও অতীতের কথা ভেবে বলতে চেয়েছিলেন, ‘এতোকিছুর পর সব জেনে বুঝেও আবার?’ কিন্তু অন্তহীন শূন্যতার মাঝে হাহাকারের মতো বেজেছিল অনুপমার কথাগুলো, আকুলতা কোথাও স্পর্শ করেছিল শান্তনুকেও। আত্মজাকণ্ঠে স্বজনধ্বনি শোনার লোভ সংবরণ করা সহজ ছিল না। সব স্মৃতিকে দূরে সরিয়ে বলেছিলেন, “যাবে? চলো তাহলে। তবে বিশেষ কিছুর আশা মনে রেখো না। কম তো দেখা হ’ল না।”
ট্যাক্সি ধরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। নিউটাউনে মেয়ের ফ্ল্যাটে পৌঁছে একরকম শীতল অভ্যর্থনাই জুটেছিল। মায়ের সাথে কথাবার্তা সামান্য বললেও বাপের প্রতি নিরাসক্ত ব্যবহারই করেছিল মেয়ে। পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকা নাতির সাথে আর দেখা হয়নি। জামাই বাবাজীবনের দেখা মিলেছিল রাতে খাওয়ার সময়। স্খলিত কণ্ঠে নিয়মমাফিক কুশল বিনিময়ের পরই রণজয় তার স্বরূপ দেখাল। বলেছিল, “সবই শুনলাম। এমন তো হওয়ারই কথা। এতোদিন ধরে মাথায় তুলেছেন যখন মাথাব্যথা না হয়ে আর যাবে কোথায়। আপনারা যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতেই পারেন, তবে আপনার সম্পত্তির অর্ধেক আমার নামে লিখে দেবেন। অথবা পঞ্চাশ লক্ষ নগদে আমার অ্যাকাউন্টে ফেলে দেবেন। বলেন তো কাল সকালেই উকিলের সাথে কথা বলিয়ে দেব।…”
পরের কথাগুলো আর কানে ঢোকেনি। ঐটুকু শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। অনুপমারও তখন একই হাল। পরদিন কাকভোরে মেয়েকে ডেকে বলেছিলেন, “তোমার মায়ের আগ্রহেই দেখা করতে এসেছিলাম। হয়তো এই শেষবার। ভবিষ্যতে খেয়াল রেখো যেন আমার বাড়িতে তোমাদের ছায়াটুকুও না পড়ে।”(৫)
বাড়ি ফিরে নাওয়া খাওয়া ভুলে দু’জনেই চুপচাপ বসেছিলেন। নীরবতা ভেঙেছিল অনুপমাই, “আমাদের কোথাও কি কোনও ভুল হয়েছিল?” ধরা গলায় ভাগ্যের দোহাই দিয়ে প্রবোধ দিতে চেয়েছিলেন শান্তনু, কিন্তু প্রশ্নটা নিজের মনেও ছিল প্রবলভাবে। রাতে চোখের জলে অ্যালবামের পাতা উল্টে স্মৃতিতে সুখ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন দু’জনে। পরস্পরের সাহচর্য্যে ব্যথা ভোলার চেষ্টায় শান্তনু বুঝিয়েছিলেন, “আমরা তো কারোর মুখাপেক্ষী নই। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পরনির্ভরশীলও নই। তাহলে যাদের কাছে আমাদের কোনো মূল্য নেই, তাদের কথা ভেবে কেন কষ্ট পাচ্ছি? এখন থেকে ভুলে যাও তোমার ছেলে-মেয়েদের কথা। আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। এখন থেকে আমরা শুধুই নিজেদের জন্য বাঁচব।” কিছুক্ষণের মৌনতার পরে আবার মতামত নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, “ভাবছি, এই বাড়িটা বিক্রী করে দিয়ে গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব, টাকা-পয়সা আশ্রমে দান করার পর মরণোত্তর দেহদান করে সব ঝামেলামুক্ত হয়ে যাব। যা পেনশন পাই তাতে তোমার-আমার দিব্যি চলে যাবে। জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি… কি বলো?”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর দৃঢ় গলায় উত্তর এসেছিল, “বাড়ি বিক্রী, আশ্রমে দান বা মরণোত্তর দেহদান – যাই করতে চাও, তা হবে মরার পর। এই বাড়িটাতো খালি একটা বাড়ি নয়, এটা তোমার-আমার ভালোবাসার সৃষ্টি। এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও মরতে আমি পারব না। তোমাকেও তা করতে দেব না। তবে ছেলে-মেয়েদেরকে না দিয়ে আশ্রমে দান করে দেওয়া অনেক ভালো। তোমার এই সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করি, তবে যা হবে আমাদের মৃত্যুর পর, আগে নয়। লেখাপড়া করে সেভাবেই কাগজপত্র তৈরী করে রেখো।” একটু থেমে তারপর আবার আপনমনেই বলেছিল, “আর মনটা একটু থিতু হ’ক, একবার শান্তিনিকেতন যাব। রবিঠাকুরের পরশ ছুঁতে খুব লোভ হয়। ইচ্ছে করে কবিগুরুর ঘরের অলিতে-গলিতে ঘুরে আপন সত্তাকে একটু সজীব করে নিতে। বেশি কিছু নয়, একগোছা ফুল রেখে প্রণাম করে আসব।”
নামমাত্র খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন দু’জনেই। ঘুম নয়, পুরোনো স্মৃতি ভিড় করে এসেছিল শান্তনুর মাথায়। সেই কবে এক সরস্বতী পুজোতে ক্লাশ এইটে পড়া জোড়া বেনী দোলানো মেয়েটাকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন, যে মনটা আজও সযতনে সেখানেই রাখা আছে। বছর সাতেকের লুকোচুরি খেলার শেষে অনুর নির্ধারিত বিয়ের আগের দিন সবার অমতে শুধুমাত্র ভালোবাসার ভরসায় অনিশ্চয়তার রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে রাতের অন্ধকারে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে পা-বাড়ানো, পরবর্তী কালে ঐ ঘটনার জেরে ত্যাজ্যপুত্র হওয়া, সামান্য কেরাণী থেকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি, এই বাড়ি তৈরী – সবই মনে পড়ছিল এক এক করে। কঠিন সময়ে সবসময় সাহস জুগিয়ে হাসিমুখে পাশে থাকা অনুপমার জন্যই আজ টিকে থাকতে পেরেছেন তিনি। কখনো প্রশ্রয়ে, কখনো শাসনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে বাঁধন। অনুপমার সৌজন্যেই তিনি আজ হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রানুরাগী, কবিগুরুর সৃষ্টিই অনুর একমাত্র মুশকিল-আসান। রবিঠাকুর ছাড়া অনু অস্তিত্বহীন আর অনু ছাড়া তিনিও তাই। ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে দেখলেন অকাতরে ঘুমোচ্ছে অনুপমা। তার গায়ের লেপখানা ঠিক করে দিতে দিতে মনে মনে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই যাব অনু, দু’জনে মিলে চষে বেড়াব সারা শান্তিনিকেতন।’(৬)
রোজ সকালে গরম চায়ের সাথে তাঁর ঘুম ভাঙানোর কাজটা অনুপমাই করে বরাবর। সেদিন ঘুম ভেঙে দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে একটু অবাকই হয়েছিলেন তিনি, ‘এখনও শুয়ে আছে অনু!’ মনে মনে ভেবেছিলেন, ‘ক’দিনে শরীর আর মনের ওপর তো কম ধকল যায়নি। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। রোজকার নিয়ম পাল্টে আমিই না হয় আজ চা এনে ঘুম ভাঙাই।’ চুপিসারে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে অনভ্যস্ত হাতে চা করে এনে ডেকেছিলেন, “অনু…।” সাড়া মেলেনি। কাঁধের কাছটা ধরে নাড়া দিতে গিয়ে যেন তড়িতাহত হয়েছিলেন তিনি। সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা! সে শরীরে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই! ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তাঁর অনু!
কতক্ষণ ঠায় বসেছিলেন মনে পড়ে না। তবে ঘড়ির সুরেলা শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরেছিলেন, আসন্ন কাজগুলোর কথা মনে করেই উঠেছিলেন যন্ত্রের মতো। কিভাবে প্রতিবেশীদের খবর দিয়েছিলেন, তা ওরাই বলতে পারবে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল পুরো সময়টা। ওরাই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। ডাক্তার এসে ‘ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ বলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার পর আর কিছুই মাথায় ঢুকছিল না শান্তনুর। পরের কাজগুলো সামলাতে এগিয়ে এসেছিল মোড়ের মাথায় ক্লাবে দিনভর আড্ডা দেওয়া সেই ছেলেগুলো, যাদের ‘বখাটে ছোঁড়ার দল’ ভেবে বরাবরই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে এসেছেন। সব বন্দোবস্ত করার ফাঁকে শান্তনুকে সান্ত্বনা দেওয়ার কাজটা তারাই করেছিল। আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ বহুকাল ছিল না। ছেলে-মেয়েদের খবর দেওয়ার কাজটা প্রতিবেশীরাই করেছিল। মাঝে কেউ একজন জানতে চেয়েছিল, ছেলেদের আসা পর্যন্ত দাহকার্য স্থগিত রাখা হবে কিনা। উত্তরে কাঁপা কাঁপা অথচ দৃঢ় গলায় শান্তনু বলেছিলেন, “কারোর জন্য সময় অপেক্ষা করে না। অনুর মুখাগ্নি আমিই করব।”
ক্লাবের কিছু ছেলে আর কয়েকজন প্রতিবেশী শ্মশান-যাত্রী হয়েছিল। সব সমাধা করে ফিরে আসার পর ফাঁকা বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসছিল। আশেপাশের লোকজন সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছিলেন না। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না অনুর এভাবে চলে যাওয়া। ডাক্তারী হিসাব যতই হৃদরোগের কথা বলুক, তিনি তো জানেন ছেলে-মেয়েদের কাছে পাওয়া একের পর এক ধাক্কাগুলোই অকালে থামিয়ে দিয়েছে তার হৃদস্পন্দন।
ছেলে-মেয়েরা এসেছিল তাদের সময়মতো। তার আগেই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয়েছে ঘাটক্রিয়া। এখন ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাই মিলে ঘরে অনেকে থাকলেও একটা বিষণ্ণতা পেয়ে বসেছে তাঁকে। বাপের সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাক্যালাপ না হ’লেও নিজেরা দিব্যি খোশগল্প চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র নেই! সরাসরি কিছু না বললেও ওদের কথাবার্তা যেটুকু কানে আসে, তাতেই বুঝেছেন তাদের একমাত্র চিন্তা আর আলোচ্য বিষয় ‘কিভাবে কে কতটা বেশি এই বাড়িটার ভাগ দখল করতে পারে।’ সত্যি, কি বিচিত্র মানুষের মন! এরাই কিনা তাঁর আত্মজ!(৭)
ইলেকট্রনিক দেয়াল ঘড়ির বাজনা নৈঃশব্দ ভেঙে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল শান্তনুকে, সাথে জানান দিয়ে গেল বেলা এগারোটা বেজে গেছে। এতো সময় স্মৃতিতে এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে খেয়ালই করেননি কখন চোখ থেকে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। হঠাৎ যেন একরাশ অভিমান এসে জমেছে মনে, ‘কেন অনু? কেন…? কেন এভাবে একা ফেলে চলে গেলে? সারাজীবন আগলে রাখবে কথা দিয়েছিলে, কেন কথা রাখলে না?’ গলার কাছে দলা পাকানো এক বুক কষ্ট নিয়ে ভেজা চোখে একবার তাকালেন অনুপমার ছবিটার দিকে, মনে হ’ল যেন সেই চিরপরিচিত ঢঙে অনুপমা বলতে চাইছে, ‘আমি তো আছি…।’
চাদরের খুঁট দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে করণীয় কাজগুলোর কথাই ভাবছিলেন। ‘আর দেরিতে কাজ নেই’ ভেবে নিজেকে সামলে, মনস্থির করে এগোলেন দরজার দিকে, সামনে অপেক্ষায় আর এক রণাঙ্গন। বেরিয়ে দেখলেন সম্বন্ধী-ভগ্নীপতি মিলে কিছু নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছিল, তাঁকে আসতে দেখেই চুপ করে গেল। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। ওদেরকে বললেন, “বাকিদের ডাকো, কিছু কথা আছে।”
সবাই আসার পর তিনি বলতে শুরু করলেন, “আমি তোমাদের মায়ের সাথে আলোচনা করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি গুরুদেবের আশ্রমে দান হিসেবে যাবে। কাগজপত্র সেভাবেই তৈরী করা হয়েছে।”
“কিন্তু বাবা…” বলে ছোটো ছেলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই তিনি হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন, “আমাদের সম্পত্তি বলতে এই বাড়িটা আর আমার সামান্য পেনশন। এই বাড়ির পেছনে আমার মেহনত আর তোমাদের মায়ের সহযোগিতা ছাড়া আর কারোরই কোনো যোগদান নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছুই আমার নেই। কাজেই আমাদের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার জন্য আমার কারোর অনুমতির প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, তোমরা বলতেই পারো। কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমার, যা আমি নিয়ে নিয়েছি। একথা ঠিক যে তোমাদের জন্ম তোমাদের ইচ্ছায় হয়নি। তবে তোমাদের কখনো কোনোকিছুর অভাব বোধ করতে দিইনি। নিজেদের সাধ্যমতো করেছি। কোথাও কখনো কার্পণ্য করিনি। এখন তোমরা যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত, সবারই নিজের নিজের সংসার হয়েছে। তোমাদের জীবনে আমরা কখনো কোথাও অংশীদার ছিলাম না, আর তোমাদের তথাকথিত কাস্টমাইজড্ মদ্যপ কালচারে আজ কোনোভাবে হতে চাইও না। আমি কোনোভাবেই তোমাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না, নতুন করে ভবিষ্যতে হ’তে ইচ্ছুকও নই। আমাদের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ আমার মৃত্যুর পর আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ড ঠিক করবে। তোমরা এখান থেকে কিছু পাওয়ার অহেতুক আশা কর না।” একটু থেমে আবার বললেন, “আর একটা কথা, বেলা হয়ে গেছে। তোমাদের মা বলতেন, ‘বেলায় বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।’ শেষবারের মতো খেয়ে যেও। তবে সূর্যাস্তের পর এ বাড়িতে আর যেন তোমাদের কারোর মুখ দেখতে না হয়। এবার তোমরা আসতে পারো।”(৮)
শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ মিটে যাওয়ার পর ফাঁকা বাড়িতে আরও বেশি করে একা মনে হ’তে লাগল শান্তনুর। জীবনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা এসে ঘিরে ধরেছে। চারদিকে শুধুই হতাশা। একাকীত্ব যেন প্রতি মুহূর্তে হাঁ করে গিলে ফেলতে চাইছে। দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে জীবন। এমতাবস্থায় তিনদিনের মাথায় ভোরে উঠে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তার আগে অনুপমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বললেন, ‘যাওয়ার আগে তোমার শেষ ইচ্ছেটা ঠিক পূরণ করে যাব, দেখে নিও।’
গন্তব্যে পৌঁছে অতীতের স্মৃতির সাথে মেলাতে গিয়ে বর্তমানের শান্তিনিকেতনকে বেশ মলিন বলেই মনে হ’ল তাঁর। ‘হয়তো সদ্য শেষ হওয়া পৌষ মেলার সৌজন্যেই চারপাশ নোংরা লাগছে’, মনে মনে ভাবলেন তিনি। একগোছা লাল গোলাপ নিয়ে কঙ্কালীতলার বেদিতে রেখে নতমস্তকে প্রণাম করলেন নাস্তিক শান্তনু। তারপর যখন হাঁটতে হাঁটতে কোপাইয়ের পাড়ে পৌঁছালেন, তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। শীর্ণকায়া কোপাই, চারপাশের প্রকৃতি – সবমিলিয়ে পড়ন্ত বেলায় বেশ বিহ্বল করে দিল।
আকাশে এলোমেলো হালকা মেঘ আর উদাসী বাতাস বারবার অনুপমার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এক বিশাল শূন্যতা নিয়ে উপলব্ধি করলেন, ‘সব শূন্যতার বোধ ও ভাষা এক নয়। কিছু শূন্যতার গভীরতা এতোটাই যে তার সামনে জীবনটাকে অনেক ছোটো মনে হয়।’ জীবনের ছায়াসঙ্গীকে যেন প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করতে পারছেন তিনি। যেন তাঁর সাথে সাথেই পথ চলছে। তন্ময়ভাবে সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন, এমন সময় দমকা হাওয়া হঠাৎই যেন শিহরণ জাগিয়ে দিল। মনে হ’ল যেন প্রিয়তমা ছুঁয়ে গেল! আর সাথে দিয়ে গেল আগামী দিনে বেঁচে থাকার মন্ত্রগুপ্তি, শেষের পথে পাড়ি জমানোর মহা বীজমন্ত্র। প্রেমরঙা আবীরে অনুভূতি রাঙিয়ে, হাওয়ার বেশে সুপ্ত চেতনা জাগিয়ে, সেই চেনা গলায় যেন কানে গুনগুনিয়ে বলে গেল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে… একলা চলো রে…।।’ -
মন্দ ভালোবাসা
মন্দ ভালোবাসা
-রুদ্র প্রসাদ(০১)
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মনের মতো বেস পেয়ে অ্যাটাকটা শুরু করেছে, সীজ মেশিন দিয়ে ওয়াল ভাঙার পর পরপর জায়ান্ট, ভাল্ক, কুঈন ছেড়ে দিয়ে সবেমাত্র হিলিং স্পেলটা দিতেই যাচ্ছিল এমন সময় কাঁধে টোকা পড়তে বিরক্ত হয়েই তাকিয়ে দেখল তুম্বোমুখে প্রফেসর জে.বি.! গম্ভীর গলায় বললেন, “বোর্ডে যে প্রবলেমটা লেখা আছে, তার সলিউশন কি হবে?”
“আই… আই ডোন্ট নো স্যার।”
“ওকে দেন, এক্সপ্লেন দ্য ফরমূলা।”
“স্যরি স্যার।”
“শো মি।”
“ইটস নাথিং স্যার।”
“গুড, কখনোসখনো গেমস্-এর মতো পরীক্ষাতেও স্কোর করে দেখাস, ইডিয়ট। নাউ গেট আউট অফ মাই ক্লাস, ইউজলেস ফেলো। আই’ল টক টু দ্য প্রিন্সিপাল অ্যাবাউট ইউ অ্যাণ্ড মেক সিওর দ্যাট ইউ ওন্ট এবল টু অ্যাটেণ্ড মাই ক্লাসেস এগেন, ব্লাডি ব্যাকবেঞ্চার।”
ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে এলোমেলো চিন্তা করতে করতে গত সপ্তাহের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। কলেজের একটা বাওয়াল নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য গার্ডিয়ান কল হয়েছিল, মামা এসে মিটিয়ে দিলেও বাড়ি ফিরে যথারীতি মামার ঘরে ডাক পড়েছিল, “গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে গেছে বলে কি নিজেকে বিশাল হনু ভেবে বসেছিস নাকি? মস্তান হয়ে গেছিস! শক্তি দেখাচ্ছিস? শক্তি সবার মাঝে মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যে, তোর স্ট্রেন্থটা কোথায়? কলেজে অ্যাডমিশনটাও তো আমার ইন্ফ্লুয়েন্সে। আমার একটা নাম আছে, স্যোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত বলে সম্মান আছে, আর তুই কি করছিস? পাশকোর্সে বিএসসি! অনার্স জোটানোর মুরোদটুকুও নেই। ভালোই হয়েছে তোর বাপ-মাকে এই দিন দেখতে হয়নি, তাদের অনেক সৌভাগ্য।”
“যদি সৌভাগ্যই হ’ত তাহলে তোমাদের স্যোসাইটি মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিত না, বাবাকেও হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করতে হ’ত না।”
“জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেব হারামজাদা। দু’বেলা বসিয়ে বসিয়ে গেলাচ্ছি আর নবাবপু্ত্তুর এখানে মুখে মুখে তর্ক করছিস!”
“তোমাদের নাম আর সম্মানের বহর নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। মানসিকতা তো ছেড়েই দিলাম। থাকতে আর দু’বার খেতে দিয়ে যে সারাদিন বেগার খাটাও, তার বেলা? একটা কাজের লোক রেখে দেখো, তাহলেই বুঝবে…;” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা সপাটে আছড়ে পড়া চড় আর বাছাই করা কিছু শব্দব্রহ্ম থামিয়ে দিল সুজয়কে। কথাগুলো মনে পড়তেই ভেতরটা তেতো হয়ে গেল।(০২)
বেয়ারা এসে বলে গেল প্রিন্সিপালের অফিসে দেখা করতে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে অলসভাবে গিয়ে দেখল অফিসে কেউ নেই। করিডরে ফিজিক্সের প্রফেসর জে.বি.-কে দেখে আর ক্লাসের দিকে যেতেও ইচ্ছে হ’ল না। ‘কেন যে মালটা বেছে বেছে আমার পেছনেই কাঠি মারে কে জানে!’ ভাবতে ভাবতে হেডফোন কানে গুঁজে জয়তীর ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ শুনতে লাগল।
হঠাৎ বামাকণ্ঠের ডাকে সম্বিত ফিরল, “এক্সকিউজ মি, ইজ প্রিন্সিপাল ইন?”
আপাদমস্তক ভালো করে দেখল সুজয়, স্লিম ফিগার তবে হাইটে প্রায় তার সমান, মাজা মাজা গায়ের রঙ, হলুদ-সাদা সালোয়ারে দেখতে নেহাৎ মন্দ নয়, বরং সুন্দরীই বলা চলে। ‘হবে কোনো ফ্রেশার’ ভেবে নিজেকে সিনিয়র বোঝাতেই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কোন স্ট্রীম? পার্সেন্টেজ প্রবলেম? নাকি কম্বিনেশন প্রবলেম?”
“কোনোটাই নয়”, আর কিছু বলার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল, “হ্যালো, না এখনও দেখা হয়নি, ওয়েট করছি, দেখা হলে কথা বললে বোঝা যাবে চান্স আছে কি না।”
“ডোন্ট ইভন থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুজয় আবার বলল, “অ্যাডমিশনের চক্কর তো? এই কলেজের ট্র্যাক রেকর্ড জানা আছে? গত দশ বছরে একটাও ফার্স্টক্লাস বেরোয়নি। আর এখানে যত টীচার আছে, সবার যেন একটাই কোয়ালিফিকেশন। বেছে বেছে সব বোরিং আর খাড়ুশদেরই আনা হয়। আমাদের যে ফিজিক্স পড়ায়, তার পড়ানো নিউটন বা আইনস্টাইন হ’লেও বুঝত কিনা সন্দেহ, আমরা তো কোন ছার!” দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল, মেয়েটা কিছু বলছে না দেখে “জাস্ট আ কশান, চয়েস ইজ ইয়োরস্” বলেই হাঁটা দিল ক্যান্টিনের দিকে।(০৩)
সারা উইকএণ্ডটা যথারীতি গাধা মজুরি করে আর মুখঝামটা খেয়ে কাটিয়ে সোমবার কলেজে এসে এমনিই ক্লাসে বসে সবার সাথে আড্ডা মারছিল এমন সময় হঠাৎ প্রিন্সিপাল ক্লাসে এলেন। সাথে আগের দিনের দেখা সেই মেয়েটা! প্রিন্সিপাল সোজা ডায়াসে উঠেই বললেন, “গুড মর্নিং ক্লাস, আজ থেকে তোমাদের ম্যাথস্ পড়াবেন প্রফেসর অঞ্জনা দত্ত। ম্যা’ম, নাউ ইটস্ অল ইওরস। হ্যাভ আ গুড টাইম এভরিবডি।”
“হ্যালো স্টুডেন্টস।”
সুজয়ের মনে হচ্ছে এখনই একছুটে পালায়। পরিচয়পর্বের মাঝেই “এক্সকিউজ মি ম্যা’ম” বলেই বেরিয়ে এল।
নির্ধারিত সময়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক কোণে একা বসে দাঁতে নখ খুঁটতে থাকা একটা পরিচিত মুখ দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে অঞ্জনা বলল, “স্ট্রেঞ্জ! প্রথম ক্লাসটাই বাঙ্ক মেরে দিলে!”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুজয় বলল, “আই নো আই অ্যাম আ ব্যাড স্টুডেন্ট, ভেরি ব্যাড ইনডিড। আপনি নতুন লেকচারার। বাট সেদিন যখন আমি কলেজ নিয়ে যাচ্ছেতাই বলছিলাম, তখনই আপনি বলতে পারতেন আপনি পড়তে নয়, পড়াতে এসেছেন। ইউ শ্যুড নট এমব্যারাস মি লাইক দ্যাট। অ্যাট লিস্ট আমারও কিছু সেল্ফ-রেসপেক্ট আছে ম্যা’ম।”
“তোমাকে এমব্যারাস করার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, আই শ্যুড থ্যাঙ্ক ইউ। কারণ তোমার জন্যই আমি ভাবতে শুরু করেছি যে এই বোরিং সাবজেক্টটা কিভাবে সবার কাছে ইন্টারেস্টিং করে তোলা যায়। প্লীজ অ্যাটেণ্ড মাই ক্লাস, যদি বোর হয়ে যাও তাহলে আমার বাকি ক্লাসগুলো বাঙ্ক করতে পারো। ওকে?”
পরেরদিন ক্লাসে কোনো চ্যাপ্টার নয়, ম্যাথকে কেন ‘মাদার অফ অল সায়েন্স’ বলে সেটাই আলোচনা করলেন অঞ্জনা ম্যা’ম, আর এতো প্রাঞ্জল করে বোঝালেন যে সুজয়ও ইন্টার-অ্যাক্ট না করে পারল না। ক্লাসের শেষে “এনি প্রবলেম রিগার্ডিং দিস সাবজেক্ট, ইউ ক্যান কন্ট্যাক্ট মি থ্রু” বলে বোর্ডে লিখে দেওয়া ফোন নম্বর আর ই-মেল আইডিটা সেভ করে নিতেও ভুল হ’ল না তার।(০৪)
সকালের কাজ সেরে তৈরী হতে গিয়ে চোখে পড়ল রোজকার মতো আজও বরুণের মুখ ব্যাজার। সব গুছিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে অঞ্জনা বলল, “এই নাও তোমার পার্স আর রুমাল।”
“রেখে দাও।”
“কাল ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে? কিছু বলল?”
“ডাক্তার আবার কি বলবে!”
“তুমি এভাবে রিঅ্যাক্ট করছ কেন?”
“কারণ তুমি অহেতুক প্রশ্ন করছ। সময় নষ্ট না করে গিয়ে দেখো টিফিন রেডি হল কিনা।”
আর কিছু না বলে রান্নাঘরে গিয়ে মেডকে বলল, “মণি, দাদাবাবুর খাওয়া হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ দিদিমণি।”
“টিফিনটা এখনও প্যাক করো নি! ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি খেতে বসে যাও দিদিমণি, আমি এখনই করে দিচ্ছি।”
নিজের খাওয়ারটা নিয়ে সবে বসেছে, তখনই বরুণের “এখনও হয়নি! ডিসগাস্টিং!” শুনেই “না, না, এই তো হয়ে গেছে।” বলেই সব ফেলে উঠে পড়তে হল। সব গুছিয়ে বরুণ অফিস বেরিয়ে যেতে আবার খেতে বসতেই যাচ্ছিল, তখনই শাশুড়ীমা এসে পড়লেন। বিরক্তকর গলায় বললেন, “সক্কালে উঠেই বাঁজাটার মুখ দেখতে হল, সারাদিনটাই বরবাদ। কতজনার কত কি হয়, তোর কিছু হয় না! মরলেও শান্তি পেতাম ‘আপদ গেছে’ বলে। সাজানো সংসারটা নষ্ট করে দিল! গোপাল, তুমি দেখো।”
আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, “মা, ডাক্তারী রিপোর্টে আমার কোনো সমস্যাই ধরা পড়েনি। আপনাদের কোনো ব্যাপারে কখনও আপত্তি তো করিনি। ডাক্তার-বদ্যি থেকে তাবিজ-কবচ, তুক-তাক কিছুই তো করতে ছাড়েননি। আর কত? খালি মুখেই বলেন ‘সব গোপালের ইচ্ছা!’ সত্যি পারেনও বটে!”
“আমার গোপালের দিব্যি, এই শ্রাবণের মধ্যে পোয়াতি হলি তো বেঁচে গেলি, নইলে যদি তোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় না করেছি তো আমার নাম সুভদ্রা নয়। তারপর আবার খোকার বিয়ে দেব। আমার বংশপ্রদীপ না দেখে আমি মরব না গোপালের কৃপায়।”
রোজ রোজ একই ব্যাপার। বেডরুমে গিয়ে বাবাকে ফোন করল, সব কথা শুনে বাবা সবই কপালের দোষ বলে চালিয়ে দিলেন। মাও বললেন, ‘এমন সোনার টুকরো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা। তার বংশরক্ষা করা তোমার কর্তব্য। আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো।’ নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় অঞ্জনার, বিনা দোষেই সে আজ সবার চোখে অপরাধী। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মণির “দিদিমণি, তুমি কিছু খেলে না?”এর জবাবে “কলেজে কিছু খেয়ে নেব” বলে বেরিয়ে পড়ল।(০৫)
কোনোরকমে একটা ক্লাস নেওয়ার পরই পেট জানান দিতে শুরু করল যে কাল থেকে কোনো দানাপাণি পড়েনি। ক্যান্টিনে কিছু খেতে গিয়ে সুজয়কে বসে থাকতে দেখে সামনে গিয়ে বলল, “তুমি এখন এখানে! নো ক্লাস?”
“বাঙ্ক মেরে দিয়েছি ম্যা’ম।”
“আই লাইক ইওর অনেস্টি, বাট হোয়াই?”
“অনেস্টলি ম্যা’ম, পড়াশোনা পৃথিবীর সবচেয়ে বোরিং কাজ। এতে আমি কোনো ইন্টারেস্ট পাই না। এক একটা লেকচার যেন এক একবছরের জেলের সাজা বলে মনে হয়, শেষ হতেই চায় না। কিন্তু আপনার ক্লাস আমার ভালো লেগেছে, আই রিয়েলি এনজয়েড ম্যা’ম, ভেরি নাইস। বেসিক্যালি আমি কলেজে অ্যাডমিশন এজন্যই পেয়েছি কারণ বেশ কিছু সীট খালি ছিল প্লাস মামার ইন্ফ্লুয়েন্স, এই জন্য নয় যে আমার এই মোটা মোটা বইগুলোর প্রতি খুব বেশি ইন্টারেস্ট আছে। সত্যি বলতে কি পড়াশোনায় আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্র হলেও কলেজে আমার অলরেডি পাঁচবছর হয়ে গেছে।”
“এনিওয়ে, কোন ক্লাস বাঙ্ক করলে?”
“ফিজিক্স ম্যা’ম, এই বইটা দেখলেই আমার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। আই মীন লুক অ্যাট দ্য সাইজ! এটা দিয়ে এক্সারসাইজ করে মাসল্ বানানো যেতে পারে। আর ভেতরের যত বিদঘুটে ল, থিওরী, ফরমূলা আর কম্পোজিশন? মাঝে মাঝে ভাবি বিজ্ঞানীগুলোর আর কোনো কাজ ছিল না বলে নিজেদের সারাজীবন নষ্ট করেও ক্ষান্ত হয়নি, এখন সিলেবাসে ঢুকে আমাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। আই ডোন্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড হোয়াই!”
“তো? তোমার কি পছন্দ?”
“আমার কোনো পছন্দ নেই ম্যা’ম।”
“হ’তেই পারে না। হয়তো তুমি দেখেও দেখোনি, বা হ’তে পারে তোমার মধ্যে অন্য কোনও গুণ আছে হুইচ ইজ ইয়েট টু বি এক্সপ্লোর্ড।”
“আমি খুবই সাধারণ ম্যা’ম, আমার মধ্যে কোনো গুণই নেই।”
“এনিওয়ে, ইউ মে ট্রাই দিস, মনে হয় না তোমার অপছন্দ হবে,” বলে একটা গল্পের বই এগিয়ে দিয়ে আবার বললেন, “পড়ে দেখো, যদি ভালো লাগে তাহলে ঐ মোটা বইটা তারপরে পড়ে দেখো।”
“গ্রেট এক্সপেক্টেশন আই মাস্ট সে ম্যা’ম, বাট আই’ল ট্রাই টু।”
পরেরদিন সকালে সুজয়ের ফোনে একটুও অবাক হল না অঞ্জনা। কল রিসিভ করতে শুনলেন, “বইটা পড়লাম ম্যা’ম কিন্তু বেশ কিছু জায়গা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি।”
“না বোঝার কারণ হচ্ছে অনেককিছুই ঐ গল্পে পরিষ্কার করে বোঝানো হয়নি, যা বোঝার জন্য তোমাকে ফিজিক্স পড়তে হবে। এবার তুমি তোমার মনে আসা প্রশ্নগুলোকে মাথায় রেখে তোমার সেই মোটা বইটা পড়ে দেখো। আই অ্যাম সিওর, তোমার এখন পড়তে আর ততটা বোরিং লাগবে না।”
“ওকে ম্যা’ম, থ্যাঙ্ক ইউ, হ্যাভ আ নাইস ডে। বাই ম্যা’ম।”(০৬)
এভাবেই সময় বয়ে চলে আপন গতিতে আর একটু একটু করে আপন থেকে আপনতর মনে হতে থাকে প্রিয় অঞ্জনা ম্যা’মকে। সাথে সাথেই এক অদ্ভুত টানাপোড়েন চলতে থাকে সবসময়। সবকিছুই যেন কেমন হেঁয়ালি লাগে। ঠিক-বেঠিক, যদি-কিন্তুর মাঝে পিষতে থাকে, কিভাবে, কেন, কোন মাপকাঠি আর কিসের গণ্ডী – এসবের মাঝে মন আর মাথার দড়ি টানাটানিতে রক্তাক্ত হ’তে থাকে। একসময় হৃদয়ের আবেগ জয়ী হয়, জীবনে চলার পথে কখন কোনদিকে যেতে হবে যে কোনোদিন ভাবেনি, সেই নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার হ’তে পারে। যদিও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুই আলোচনা হয়নি কখনো, তবুও জীবনের প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার কানাগলিতে ঠোক্কর খেতে খেতে, অন্ধকারে একমাত্র আলোর রেখা মনে হয় অঞ্জনার সান্নিধ্য। তিল তিল করে সাহস সঞ্চয় করে ভাবে, ‘হয় এসপার, নয় ওসপার’, কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। কোথায় যেন আটকে গেলেও কলেজে যাওয়া-আসার পথে সঙ্গী হতে ভুল হয় না কখনও।
পুজোর ছুটি পড়ার দিন কলেজ শেষে বন্ধু-বান্ধবকে ‘বাই’ বলে গেটের কাছে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়, আজ বলেই ফেলব’, এমন সময় কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল – অঞ্জনা ম্যা’ম। “আরে তুমি এখনও ওয়েট করছো! চলো, চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ পর অঞ্জনার খেয়াল হ’ল সুজয় যেন একটু বেশি চুপচাপ, “কি ব্যাপার? ছুটির সব প্ল্যানিং কি এখনই সেরে ফেলবে নাকি?”
একটু ইতস্ততঃ করে বলতে গিয়ে আটকে যায় সুজয়, “না, মানে… ম্যা’ম…;”
“কি ব্যাপার বলো তো? কি বলতে চাও বলে দাও। ডোন্ট হেজিটেট, টেল মি।”
“ম্যা’ম, আই কান্ট।”
“কান্ট! হোয়াই?”
“আই ডোন্ট নো হোয়াট আই অ্যাম ফীলিং অ্যাণ্ড হাউ টু টেল ইট টু ইউ। বুঝতে পারছি না ঠিক না ভুল, খুব নার্ভাস লাগছে।”
“রিল্যাক্স। ওয়েট আ সেকেণ্ড, টেক আ ডীপ ব্রেথ। তাছাড়া তুমি যখন কোনো কথা আমাকে বলতে চাও, তখন এতো নার্ভাস হওয়ার দরকার নেই। নিশ্চিন্তে বলো। কাম অন, টেল মি।”
“আই লাইক ইউ ম্যা’ম, আই রিয়েলি ডু।”
“দ্যাট’স সো নাইস অফ ইউ।”
“নো, ম্যা’ম, আই মীন টু সে… আই লাভ ইউ। বুঝতে পারছি ইট’স উইয়ার্ড, বাট আজ পর্যন্ত আমি কারোর জন্য এমনটা ফীল করিনি বা কেউ আমাকে এমনটা ফীল করায়নি। আমার বোঝানোর ভাষা নেই ম্যা’ম। অনেস্টলি, আমার চোখে আপনি এক অসাধারণ মানুষ, আ ভেরি ভেরি স্পেশাল পার্সন। আজ আমার মধ্যে যতটুকু সেল্ফ-কনফিডেন্স এসেছে, যা আমি ফীল করতে পারি বা যা আমার কাজে দেখতে পাচ্ছি, সেটা শুধু আপনার কারণে।”
“সুজয়…;”
“ম্যা’ম প্লীজ, আজ বলতে দিন। আজকাল আমি শুধু আপনার কথাই ভাবি, ভাবি কি করলে আপনাকে খুশি দেখতে পাব। সিরিয়াসলি ইওর স্মাইল মীনস্ আ লট টু মি ম্যা’ম। আই অ্যাম ডীপলি ইন লাভ উইথ ইউ…;” বলতে বলতে গলা ধরে আসে সুজয়ের।
“থ্যাঙ্কস্ সুজয়, নিজের ফীলিংস এতো খোলামেলাভাবে এক্সপ্রেস করাটা মুখের কথা নয়, তার জন্য সৎসাহস লাগে। তবে কি জানো, তোমার কথাতে আমি রাগ করিনি বা কষ্ট পাইনি, কারণ তোমার এই ফীলিংসে ভুল কিছু নেই। ভুল হতে পারত যদি তুমি তোমার ফীলিংস নিয়ে অবসেশড হ’তে বা আমি তোমাকে রেসিপ্রোকেট করতাম। এনিওয়ে, এই জন্মে তো হবে না, হয়তো পরের জন্মে, হয়তো… এখানেই বা অন্য কোথাও, হয়তো… আমরা পরস্পরের সঙ্গী হতে পারি।” একটু থেমে হঠাৎ হাসতে হাসতে আবার বলল, “শেষের কথাগুলো জাস্ট মজা করে বললাম। বাট অন আ সিরিয়াস নোট, আমি বিবাহিতা এবং তুমি আমার ছাত্র অর্থাৎ সন্তানতুল্য, কাজেই এই ব্যাপারে কথা বলা বা ভাবনাচিন্তা করাটাও সমাজের চোখে পাপ আর আমার পক্ষেও অনুচিত। কাজেই এইসব চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে বের করে দাও। তুমি তোমার ফীলিংস আমার সাথে শেয়ার করলে, দ্যাট’স গুড, কিন্তু এখন সব ভুলে স্টাডিতে কনসেন্ট্রেট করো, পরীক্ষা বেশি দূরে নেই। অ্যাণ্ড আই হোপ তুমি আমাকে অন্তত নিরাশ করবে না। নাও, চোখ মোছো, রাস্তার মাঝে সিনক্রিয়েট হচ্ছে। এবার চলো, পুজোর ছুটির শুরুটা আমরা ফুচকা দিয়ে সেলিব্রেট করি।”(০৭)
রোজকার মতো ভোর চারটের সময় বেরিয়ে দৌড়াতে গিয়ে সুজয়ের মনে কোথাও যেন একটা আনন্দের সুর বাজছিল। প্রায় একমাসের ছুটি শেষ। আবার কলেজে যাওয়া মানেই অঞ্জনার সান্নিধ্য। লেভেল ক্রসিংটা টপকানোর সময় হঠাৎ ট্রেনের হুইসল্ শুনে সেদিকে তাকাতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। একটা আবছায়া স্ত্রী-মূর্তি লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে আর সেই লাইনেই এগিয়ে আসছে ট্রেন! হতভম্ব হয়ে পড়লেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করল সে। ছায়ামূর্তিটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে যখন পাশের পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখনই হুইসল্ বাজিয়ে বিকট শব্দে পাশ দিয়ে চলে গেল এক্সপ্রেস ট্রেনটা। কয়েকটা জায়গায় কেটে-ছড়ে যাওয়া ছাড়া আঘাত গুরুতর না হলেও ধাতস্থ হ’তে একটু সময় লাগল। উঠে বসার সময় একটা কাতর গলার অস্ফুট গোঙানি “আমাকে মরতে দাও, প্লীজ” কানে আসতেই এক বিশাল ধাক্কা লাগল সুজয়ের – অঞ্জনা ম্যা’ম! ঘোরটা কাটিয়ে কোনোমতে ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু সুস্থ করে তুলল। সুজয়কে চিনতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল অঞ্জনা। স্ট্রীটলাইটের আলোতে ভালো করে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠল সুজয়, এই ক’দিনেই যেন শুকিয়ে দড়ি পাকানো চেহারা হয়ে গেছে! দেখে মনে হচ্ছে যেন মানুষ নয়, একটা পোড়া চ্যালা কাঠ!
একটু শান্ত হওয়ার পর ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইতেই বিশ্রীভাবে উন্মোচিত হ’ল এক অজানা কদর্য দিক। বিয়ের তিনবছরেও বাচ্চা না হওয়ার কারণে আঙুল উঠেছে অঞ্জনার দিকে। ডাক্তারী পরীক্ষায় কোনো ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও সেই সবার কাছে দোষী। ঘরে বাইরে মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হতে জীবনের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। পরিচিত গণ্ডীতে আকারে ইঙ্গিতে নোংরা প্রস্তাব দেওয়া তো আছেই। পুজোর সময় মা-ছেলে মিলে মারধর করে জোর করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। দাদার বিয়ের জন্য দেখাশোনা চলছে। যতই নিজের মেয়ে হ’ক, একে ডিভোর্সী তায় বাঁজা, তার দায়ভার কে নেবে? মেয়েকে সাপোর্ট করতে গেলে যদি ছেলের অমঙ্গল হয়, তখন? তাই বাপের বাড়ির দরজাও বন্ধ।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ ভেবে সুজয় বলল, “ম্যা’ম, কাছাকাছি একটা পিজি ফর ওয়ার্কিং উইমেন আছে, আপাততঃ ওখানেই চেষ্টা করে দেখা যাক। যদি খালি রুম পাওয়া না যায় তাহলে শেয়ারে থাকতে হবে। পরে অন্য কোথাও দেখা যাবে। ট্রাস্ট মি ম্যা’ম, দু’জনে মিলে কিছু না কিছু একটা জোগাড় ঠিক করে ফেলতে পারব। আর সুইসাইডের চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিন।”
ভাগ্যক্রমে একটা খালি ঘর পাওয়া গেল। মোটামুটি থাকার মতো গোছগাছ করে যখন বাড়ির দিকে পা বাড়াল, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারল আজ দারুণ অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে।(০৮)
টাকার জোরে কি না হয়! কিছুদিন যেতে না যেতেই ডিভোর্সের মামলায় সরকারী সীলমোহর পড়ে গেল। কিন্তু পেছনে রসালো মন্তব্য বন্ধ হ’ল না। দেওয়ালে কান পাতলেই ফিসফাস শোনা যেতে লাগল। সুজয়ের সঙ্গটুকু ছাড়া সব দিক থেকেই ক্রমশঃ একা হয়ে যেতে লাগল অঞ্জনা। সরস্বতী পুজোর কারণে ক্লাসও তেমন নেই, কলেজও ফাঁকা ফাঁকা। লাইব্রেরিতে বসে সব দিক নিজের মতো করে ভেবে নিয়ে মনস্থির করে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল।
‘সু,
আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর দামী মুহূর্তগুলো উপলব্ধি করানোর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ। গত কয়েকটা দিনে জীবনের অনেক অদেখা, অচেনা দিকের সাথে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমার কষ্টের সময় তুমি পাশে ছিলে সবসময়। কোনোদিন ভুলব না তোমায়। তোমার উপস্থিতি যেভাবে আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে তাতে আগামীকাল আমি যদি না থাকি, তাহলেও জীবনের কাছে অন্তত আমার কোনও আক্ষেপ থাকবে না। মনে আছে তোমার, একবার মজা করে বলেছিলাম, হয়তো পরের জন্মে, হয়তো অন্য কোথাও আমরা একে অন্যের হব – আই মীন ইট টুডে। হ’তে পারি আমি তোমার টীচার, কিন্তু তুমি আমাকে শিখিয়েছো ভালোবাসার প্রকৃত মানে। কাউকে ভালোবাসি বলাটা যত সহজ, তার গভীরে গিয়ে তাকে অনুভব করা আর জীবনভর সেই দায়িত্ব নিষ্ঠাভরে পালন করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য, যা তুমি অনায়াসে করে দেখিয়েছো। ভালোবাসার সার্থকতা প্রাপ্তিতে নয়, ত্যাগে। তোমার সঙ্গলাভে আমি ধন্য।
এখন আমি রিজাইন করে চলে যাচ্ছি, এই যাওয়া সত্যিই খুব জরুরী তোমার জীবনের জন্য। কারণ থেকে গেলে তোমার জীবনটা আমার চারপাশেই শেষ হয়ে যাবে, যা কখনোই কাম্য নয়। জানি আমাকে ভুলতে তোমার কষ্ট হবে, কিন্তু সময় সব ঠিক করে দেবে। অলওয়েজ বি হ্যাপী অ্যাণ্ড কীপ স্মাইলিং, যদিও মন চাইছে এক ছুটে গিয়ে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে খুঁজে নিই নিজের ঠিকানা, চোখে চোখ রেখে বলি আই লাভ ইউ, বাট হয়তো পরের জন্মে… দেখে নিও তখন আর আমার নামের পাশে বাঁজা বা ডিভোর্সীর অপবাদ থাকবে না।
ভালো থেকো সবসময়,
অঞ্জনা।’
চিঠিটা লেখা শেষ করেই বুঝতে পারল গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে উঠেছে। উঠে আসা কান্নাটাই তাকে বুঝিয়ে দিল ‘এর শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত হয়ে গেছে তার অজান্তেই।’(০৯)
স্থানুর মতো বসেছিল, হঠাৎ কাঁধে এক ফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল পড়তেই চমকে উঠে ফিরে দেখল কখন সুজয় এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। তার চোখের জল বুঝিয়ে দিচ্ছে চিঠিটা সে পড়ে ফেলেছে। তাকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই হাত তুলে থামিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় “হাউ ক্যান ইউ বি সো সেলফিশ টু মি ম্যা’ম?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল।
তার পেছনে অঞ্জনাও বেরিয়ে এসে ফাঁকা করিডোরের এক কোণে গিয়ে তাকে ধরল, “তুমি কেন বুঝতে চাইছো না? এই সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না। তাছাড়া আমি বয়সেও তোমার চেয়ে বড়। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লীজ;”
“বয়স? ডাজ ইট ম্যাটারস্? আমার আর কে আছে যে মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন আসছে? মামার বাড়িতে নাকি টাকাপয়সার হিসেব মিলছে না। আমাকে একরকম ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিল! এক বন্ধুর মেসে নিজের সামান্য জিনিসপত্র রেখে আপনার কাছে এসেছি, আপনি যে আমার শেষ আশ্রয়, ইউ কান্ট লীভ মি লাইক দিস ম্যা’ম।”
কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল অঞ্জনা। ঠিক তখনই গলা খাঁকরানির শব্দে পেছন ফিরে দেখল প্রফেসর জে.বি. তাদের দিকেই আসছেন! কাছে এসে বললেন, “ডোন্ট ওয়্যারী, তোমাদের কথাবার্তা সবই জানি।” এই গলা যে এতো অমায়িক হ’তে পারে, তা ধারণার বাইরে ছিল সুজয়ের, বিস্ময়ে চুপ করে গেল। জে.বি. বলে চললেন, “আজকাল কানাঘুষোয় অনেক কথাই শুনি। আই ডোন্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, হাউ ক্যান পিপল্ বি সো ইনহিউম্যান! বাট ফর ওয়ান থিঙ আই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ ম্যা’ম। আজ একটা বখাটে ছেলেকে রেসপন্সিবল্ জেন্টলম্যান হতে দেখছি, অল ক্রেডিট গোজ টু ইউ। তবে… বলি কি, তোমরা বিয়ে করে নাও, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তোমরা পরস্পরের পরিপূরক হ’তে পারবে।” হতবাক দু’জনের কারোরই মুখে কোনো কথা যোগালো না। জে.বি. আবার বললেন, “সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু নেই।”
অঞ্জনা ইতস্ততঃ করে বলল, “কিন্তু স্যার…;”
চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে জেবি বললেন, “প্রিয়জনের সঙ্গলাভের সৌভাগ্য সবার হয় না। আর যারা পেয়ে হারায়, তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নয়। তোমরা হারিয়ে যেও না। ইউ টু লুক ‘মেড ফর ইচ আদার’ টু মি।” তারপর সুজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বেশ কিছুদিন ধরে যেভাবে ম্যা’ম মিসবিহেবের শিকার হচ্ছিলেন, সেটা দেখে তোমাকেও ঐ ক্যাটেগরির বলে ভেবেছিলাম। যদিও তোমার কথা জানতাম, তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, আজ যদি কিছু কড়া কথা শোনানোর ইচ্ছে নিয়ে এখানে না আসতাম, তাহলে হয়তো কখনো বিশ্বাস করতাম না। স্যরি ইয়ংম্যান। ডোন্ট লীভ ইচ আদার, লেটস্ কাম হোয়াট মে।”
জেবি চোখের আড়াল হতেই অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁকে এঁকে দিল এক প্রগাঢ় চুম্বন, তারপর মাথা চুলকে বলল, “স্যরি, কন্ট্রোল করতে পারলাম না।” প্রথমবার সুজয় দেখল অঞ্জনাকে ব্লাশ্ করতে।(১০)
এর পরের কয়েকটা দিন ঝড়ের মতো কেটে গেল। সাধ্যের মধ্যে পছন্দের বাড়ি পেয়ে সব গুছিয়ে উঠতেই কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল বোঝাই গেল না। তারপর জে.বি. স্যারের সৌজন্যে আর কলেজের বন্ধুদের সহযোগিতায় রেজিস্ট্রি করে বিয়েটাও সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল। বিয়ের পর প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই জেবি বললেন, “এতোদিন যেভাবে ম্যা’মের গাইডেন্স ফলো করেছো সেইভাবে এবার থেকে বউয়ের গাইডেন্স মেনে চলবে। বুঝলে?” হকচকিয়ে সুজয় “ইয়েস স্যার” বলতেই সবাই হেসে উঠে তার অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিল।
সব কাজ সেরে যখন বাসাতে ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় গিয়ে বসতে অঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, “টায়ার্ড?”
উত্তরে “ইয়েস ম্যা’ম, আ বিট” বলেই বড় করে জিভ বের করে বলল, “স্যরি।”
তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে অঞ্জনা বলল,“আর যদি ‘ম্যা’ম’ বলেছো তো নো মোর ফুলশয্যা মনে রেখো।”
সুজয়ও এবার হাসতে হাসতে বলল, “ইয়েস ম্যাডাম।” তারপর সব ক্লান্তি উপেক্ষা করে পরস্পরের সান্নিধ্যে সুখের সাগরে তৃপ্ত উত্তাপে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল দুজনে।(১১)
দেখতে দেখতে ফাইন্যাল পরীক্ষাও হয়ে গেল। অঞ্জনার কথামতো সুজয় যেমন হ’ক একটা চাকরীর খোঁজের সাথে সাথে ইউ.পি.এস.সি. পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিতে থাকল। এভাবেই কাটছিল দাম্পত্যের দিনগুলো। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর অঞ্জনার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখে সুজয় জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”
“হুমম, শরীর ঠিকই আছে তবে একটা খবর আছে।”
“তাই? ভালোই হয়েছে, তবে আমার কাছেও একটা খবর আছে তোমার জন্য।”
“কি খবর? তাড়াতাড়ি বলো;”
“না, আগে তুমি বলো, লেডি’স ফার্স্ট।”
“হুমম, লেডি’স ফার্স্ট মানে আমি আগে শুনব, প্লীজ বলো…;”
“ওকে, আপাততঃ একটা চাকরী পেয়েছি, বিশেষ কিছুই নয়, তবুও…;”
“মেনি মেনি কনগ্রাচুলেশনস্” বলেই তাকে জড়িয়ে ধরল।
“এবার তুমি বলো।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে খুব আদুরে গলায় বলল, “আমি প্রেগন্যান্ট।”
“সত্যি???” সুজয় যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
নতমুখে মাথা নেড়ে অঞ্জনা বলল, “এ মাসের পিরিয়ডটা মিস্ হ’তেই মনে হয়েছিল। কিট্ নিয়ে টেস্ট করে পজিটিভ দেখার পরেও সন্দেহ পুরোপুরি কাটেনি। আজ ফেরার পথে ডাক্তারের সাথে কথা বলে কনফার্ম হলাম।” আর কিছু বলার আগেই খেয়াল করল সুজয় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে এঁকে দিচ্ছে ভালোবাসার স্পর্শ। বুকের ওমটুকু নিতে নিতে অঞ্জনা উপলব্ধি করল লোকে যে যতই মন্দ বলুক, সুজয়ের ছোঁয়ায় সে পেয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসার সুলুকসন্ধান। তখন বাইরের আকাশে গোধূলির রক্তিম আভায় অপরূপে রাঙিয়ে দিয়েছে চরাচর।সমাপ্ত
-
সমাজের সাহিত্য ও সাহিত্যের সমাজ
সমাজের সাহিত্য ও সাহিত্যের সমাজ
-রুদ্র প্রসাদযুগ যুগান্তরের অক্লান্ত সাধনার ফলে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই সমাজ, রচিত হয়েছে তার পরিকাঠামো। প্রতিনিয়ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হতে সৃষ্টি হয়েছে নানান রূপরেখার তরঙ্গ। ভেতরের-বাইরের সেই সমস্ত তরঙ্গায়িত রূপরেখার ভাবস্পন্দন অপরূপে ফুটে উঠে বিকশিত হয়েছে সাহিত্য। তাই তো সৃষ্টির জগতে ‘জীবন’ মহান শিল্পী এবং সাহিত্য তারই অনুপম ‘স্বরূপ’।
একদিকে প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ, আর অন্যদিকে সামাজিক উচ্ছ্বসিত জীবন তরঙ্গ – উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েই দৃষ্টিগোচর হয় চারপাশের বিদ্যমান জগত, যার নিত্য-প্রবহমাণ জীবন-ধারা, সামাজিক প্রেক্ষাপটে শত-সহস্রের কর্ম-কোলাহল ও সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে, সময়ের সাথে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মুখরিত স্বরূপ যখন ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ আত্মপ্রকাশ করে, তখন তা রূপ নেয় সাহিত্যের। সাহিত্য তাই সমাজের দর্পণ, তাতে দেখা যায় বিশেষ দেশ-কাললব্ধ সমাজের মুখ।
সাহিত্যের প্রত্যক্ষ উপকরণ সমসাময়িক সমাজ ও সামাজিক জীবন, কিন্তু তা কোনও নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে নিঃশেষিত হয় না। তা স্রষ্টার শৈলীর অপরূপ শিল্প-সৌকর্যে সমকালীনত্ব অতিক্রম করে, স্রষ্টার শিল্প-প্রতিভার অনুপম রূপ চিরন্তনতার জয়টিকা ললাটে নিয়ে হয়ে ওঠে সর্বকালীন, সার্বজনীন। ক্ষণিকের ভাবনা হয়ে যায় চিরকালের, পরিবর্তনশীল সমাজ ও নীরব সময়, স্রষ্টার মুদ্রিত সৃষ্টির গুণে হয়ে ওঠে মুখর, বাঙ্ময়।
বহিরঙ্গের বিশ্ব-প্রকৃতি বা সামাজিক পরিপ্রেক্ষণী থেকে উপকরণ সংগৃহীত হলেও স্রষ্টা হলেন সৃষ্টি-সাম্রাজ্যের অধিকর্তা। ‘সৃষ্টিকর্তা’ তাঁর একান্তই আপন অনুভব দিয়ে বিশ্বকর্মার মতোই ‘আপনা’কে রচনা করেন, কিন্তু সেই স্রষ্টার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে আর এক মহাশিল্পী সেই সৃষ্টিতে সহযোগী হয়। সমাজই সেই ‘মহাশিল্পী’, সে স্রষ্টার অবচেতন মানস দর্পণে ফেলে আপন প্রতিচ্ছবি, সাহিত্যরূপে রচনা করে যায় জীবনবেদ। কোনও শিল্পীই তাঁর সমকালীন সমাজকে অস্বীকার করতে পারেন না, তাই তাঁদের রচনা-সম্ভারে মূর্ত হয়ে ওঠে তৎকালীন সমাজের নির্ভুল প্রতিবিম্ব।
যাঁর মধ্যে সাহিত্যের নব-নব রূপ আত্মপ্রকাশের জন্য উন্মুখ, যিনি অতিন্দ্রিয় অনুভব ক্ষমতা ও উপলব্ধি শক্তির অধিকারী, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নানা ঘটনা তরঙ্গ, সমাজের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রবল আবর্তে সৃষ্ট এক অনির্বচনীয় ভাবরস সিঞ্চিত করে যাঁর চেতনালোক, যাঁর অনুভূতির রঙে পান্না হয় সবুজ, গোলাপ হয় সুন্দর – তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সাহিত্য সৃষ্টির কারিগর। আসলে এই সমাজই যেন হাসি-কান্নার এক আশ্চর্য ফল্গুধারা, স্রষ্টা তাতে অবগাহন করেন, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ঘটে সংগৃহীত জলে ফলিয়ে তোলেন সৃষ্টির অভিনব শস্য। বহির্বিশ্বের বৈচিত্র্য তাঁর অন্তরের অন্তঃস্তলে সঞ্চিত হয়ে যখন প্রকাশবেদনায় ব্যাকুল হয় রূপলাভের জন্য, স্রষ্টা তখন তাকে ‘বাণীরূপ’ প্রদান করে স্থাপন করেন সাহিত্যের হিরণ্ময় পাত্রে । সমাজ থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতা এভাবেই সাহিত্যায়নের মাধ্যমে হয়ে ওঠে শাশ্বত, নান্দনিক।
সমাজ সৃষ্টি করে স্রষ্টাকে, স্রষ্টা সৃষ্টি করেন শিল্প। কোনও স্রষ্টা কখনওই সমাজের অনতিক্রম্য অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না। কারণ, ‘সমাজ’ মানে তো কেবলমাত্র স্থান বা কাল এবং মানুষ নয়, ‘সমাজ’ মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আচার-আচরণ, বিচার-অবিচার, সংস্কার-ব্যবহার, মহত্ত্ব-নীচতা, অমৃত-গরল — সমস্ত কিছুরই সমাহৃত যোগফল। সেখানে যেমন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত আছে, তেমনই আছে অর্থনৈতিক নানান ঘটনাপুঞ্জ; সেখানে যেমন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার আছে, তেমনই আছে অকুণ্ঠ মানবিক উদারতা। চারপাশের ওঠাপড়া থেকেই স্রষ্টা আহরণ করেন তাঁর সৃষ্টির উপকরণ। সমাজের বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে খড়-কুটো সংগ্রহ করে রচিত হয় তাঁর সৃষ্টির খেলাঘর। কারণ তিনি একাধারে দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাবলী, বস্তু-সম্ভার ও বহু-বিচিত্র মানব-জীবনকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন, অননুকরণীয় উপলব্ধি শক্তিবলে তার ভাবসত্য অনুভব করেন এবং তাকে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন্ত ভাষা-শৈলীর মাধ্যমে রূপদান করেন। তাই স্রষ্টারা সাধারণের মধ্যে থেকেও অনন্যসাধারণ, স্বতন্ত্র।
কবি, সাহিত্যিকেরা হলেন সমাজের মুখর চারণ। তাঁদের লেখনীতে ভাস্বর হয়ে ওঠে সমাজের সত্য, স্বরূপ। সাহিত্যের মুকুরে তাই দেখা যায় সমাজের সমসাময়িক প্রতিরূপ। তা সে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘শকুন্তলা’, ‘কাদম্বরী’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়র’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অলিভার ট্যুইস্ট’, ‘ওয়ার এণ্ড পীস’, ‘মাদার’ বা ‘গোরা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘নীলদর্পণ’ থেকে ‘কেয়া পাতার নৌকা’, ‘প্রথম আলো’, ‘দ্বিখণ্ডিত’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘হলদে গোলাপ’ – যাই হ’ক না কেন, সর্বত্র মুখরিত হয়েছে সমাজের আবেগ-মথিত মর্মবাণী। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে তৎকালীন বাংলার সামাজিক বিন্যাস ও অর্থনৈতিক রূপরেখা অকিঞ্চিতকরভাবেই প্রতিভাসিত। তার সাহিত্যচিত্রের মুক্ত বাতায়ন পথে সমগ্র সমাজ হয়ে ওঠে জীবন্ত, দৃশ্যমান। ‘চর্যাপদ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকাব্য’, ‘মঙ্গলকাব্য’, জীবনী-সাহিত্য — সর্বত্র সমাজের ভাবমূর্তি অত্যন্ত সাবলীলভাবেই উদ্ভাসিত। কাজেই, ‘সাহিত্য’ সমাজের এক বিশ্বস্ত দলিল।
কবি, সাহিত্যিকেরা হলেন দক্ষ মধুকর এবং সৃষ্ট সাহিত্য এক অনিন্দ্য মধুচক্র। সমাজ উপবনের বহু-বিচিত্র পুষ্পরাজি থেকে তিল তিল করে মধু সঞ্চয় করে, তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনানুযায়ী নবতর সৃষ্টির আনন্দে যা নির্মাণ করেন, তা তিলোত্তম সৌন্দর্যের শিল্পময় প্রকাশ, চিরন্তন হৃদমধুর অফুরন্ত ভাণ্ডার। কাজেই, সাহিত্যের যে চিরায়ত মধুধারা, তা শিল্পীকে সরবরাহ করে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ সমাহৃত সমকালীন সমাজ। সাহিত্যের অক্ষয় ধাত্রে সমকালের সমাজ চিরকালের মধুময় সম্পদরূপে সংরক্ষিত হয় এক শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অনবদ্য কৌশলে।
এই ভাবেই ‘স্রষ্টা’ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে নানাবিধ সামাজিক সামগ্রী নিয়ে মেতে ওঠেন নিত্য-নতুনের সৃষ্টিখেলায়, ফলে যা সামান্য, তা সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে অনন্য; যা ব্যক্তিবিশেষের, তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন; যা অবলীলায় পেরিয়ে যায় দেশ-কালের গণ্ডী। কিন্তু সবার অগোচরে সমাজই তার বৈচিত্র্যময় সম্ভার নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির অনির্বচনীয় খেলায়। তাই ‘সাহিত্য’, ‘সমাজ’-এরই বিশ্বস্ত দর্পণ, ‘সমাজ’-এর ‘সাহিত্য’, তারই নির্ভুল প্রতিচ্ছবি ।।
-
পুজোর পাঁচালি
পুজোর পাঁচালি
-রুদ্র প্রসাদমণ্ডপে মণ্ডপে রোশনাই, সপরিবারে মা এলো,
কয়েকটা দিনের বাৎসরিক সফরই তো হ’ল;
কৈলাসের ঘর ছেড়ে, নেমে আসা এই মর্ত্যে,
সবাই দেখ কেমন যেন একেবারে গেল বর্তে!
চারদিকেই উড়ছে কেমন সাজো সাজো রবে,
কেউ কি কখনও বোঝে? বোঝে না তো সবে;
দেখনদারিতেই খালি বুঝিয়ে দেওয়ার পালা,
বোঝে না খালি পেটে থাকার কি বিষম জ্বালা!
কোথাও থাকে কোনও এক ছোট্ট কুমারী কন্যা,
কোথাও তো থাকে পড়ে, আরও এক অনন্যা;
কেউ হয় বরণীয় দেবী, মাতৃরূপে হন পূজিতা,
কেউ থাকে উপেক্ষিতা, বুভুক্ষিতা, চিরলাঞ্ছিতা!
একজনের তো অনেক, অনেক আছে আজ,
তবেই না একই অঙ্গে উঠবে ফুটে মোহন সাজ;
তবুও আকাশছোঁয়া, অন্তহীন চাহিদা যে তার,
জমকালো আড়ম্বরে দেখাবে অপরূপ বাহার!
কোথাও তো আছে পড়ে ক্লিষ্ট আরও একজন,
ভালো থাকার কথা কি কখনও ভাবে তার মন?
হায় রে! সাজগোজের তার তো নেইকো বালাই,
এই সব ভাববার কোনও উপায়ই যে তার নাই!
এদিকে কতই না উন্মাদনার মদমত্ত হর্ষোল্লাস,
মেটে অবাধে সকল সাধ, একেবারেই অনায়াস;
আর জোগান তো অঢেল, সীমাহীন, অগুণতি!
অক্লেশে মেলে চরম সুখ আর পরমতম শান্তি!
ওদিকে ধুলি-ধূসরিত, ক্লান্ত, স্খলিত, নগ্ন পায়,
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, চিন্তায় বারেবারে ফিরে চায়;
অসমর্থ জীর্ণ, শীর্ণ দেহে টুকরো বস্ত্রও সঙ্কুলান,
অতিকষ্টেও হয় না কোনোক্রমে দিন গুজরান!
বিত্তের দম্ভে দুর্গন্ধে পূর্ণ আজ মানবতার গাত্র,
স্বার্থ ছাড়া অন্যকে করে চলে তাচ্ছিল্যের পাত্র;
‘দানবীর’ না হয়ে সব হয়েই উঠতে চায় ‘দানব’!
ধরাকে সরা জ্ঞান করাই দস্তুর, হ’ক না জান্তব!
মেকী জৌলুস আর বৈরী বৈভবী উৎকর্ষতায়,
আর্তের ক্ষীণ কণ্ঠ রোধ করে চরম নিষ্ঠুরতায়;
মিথ্যা অহং, আস্ফালনে ঘুরে বেড়ায় দাপিয়ে,
অবহেলায় পদতলে দেয় অবলীলায় দাবিয়ে!
তাণ্ডবকারী মানুষ রূপে শুম্ভ-নিশুম্ভ আছে যত,
দাপটেই চাপা পড়ে হারিয়ে যায় প্রাণ কত শত;
আরও আছে সাথে মহিষসম উগ্র প্রচণ্ডাসুর,
মায়ের গলার আজ বাজে বেহাগের করুণ সুর!
কোথাও অকাতর অজুহাতে পেট পুজো শেষে,
কোথাও আবার হাত পেটে জোটে গঞ্জনা বেশে;
কোথাও মোটা বকশিশের রীতিনীতি চমৎকার!
কোথাও শুধুই চোখ রাঙানী, ঘৃণা বা ফুৎকার!
কোথাও আবার আবিষ্ট অনেকের মাঝে, ভিড়ে,
কোথাও বা চলে সারমেয়র সাথে জীবন নীড়ে!
এদিকে একটু নজর কাড়ার বিড়ম্বিত আয়াস;
অন্যদিকে খাবার দখলের সে কি অসম প্রয়াস!
উদারতার বুলি কপচানো মানুষেরা মুখেই বলে,
তাই তো আজও মায়ের চোখ ভরে অশ্রুজলে;
মনের শিক্ষা দীক্ষায় আজ মূল্যবোধ বড়ই কম,
স্যাঁতস্যাঁতে নোনায় ধরে দাঁড়িয়ে কত বৃদ্ধাশ্রম!
কেউ করে ভিক্ষা, কেউ বা রাস্তায় বেচে ফুল,
মায়েরা খেতে পরতে নাইবা পেলে কিসের ভুল?
বাঁচার জন্য কেউ হয়তো করে আরও কত কি,
তাতে কখনও কারোরই কিছু এসে যায় নাকি?
একদিকে কৃত্রিমতা উদ্ভাসিত রঙীন আলোকে,
অন্যদিকের দুর্গাকে আড়ালে রাখে দ্যুলোকে;
কোথাও অবলোকনে সজ্জিত সম্মোহনী কায়া,
কোথাও মলিনে করাল এক গম্ভীর আবছায়া ।
লোক দেখানো শ্রীহীন শ্রদ্ধাতেই নতমুখী সবাই,
বেমালুম বিস্মৃতি! মানবিকতা বলে কিছুই নাই;
আনন্দেই দেখে সব সুবেশে আলোকিত মৃন্ময়ী,
আঁধারে আর্তনাদ চেপেই বাঁচে কত মৃতবৎ চিন্ময়ী!!!