• কবিতা

    কবিতা- মেকি

    মেকি
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    ঘুণধরা অবক্ষয় সমাজ
    দিনদিন কলুষিত
    নকলের ভারে বিশ্বাস আজ
    লুপ্ত অন্তর্হিত।

    তুমি আমার লাভার, তোমা
    ছাড়া বাঁচবোনা
    একই সংলাপ অনেককেই
    বলে প্রতারণা।

    পেয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি
    সহবাস সকাম,
    গর্ভবতী হলে অস্বীকার
    মেকি প্রেমের পরিণাম

    বর ধনী উচ্চপদস্থ
    ভেবে পিতার স্বস্তি
    বরের ঘরে নববধূ
    দেখে মিথ্যুক অতি।

    কিনে জালি শংসাপত্র
    ইস্কুলে মাষ্টারি,
    পারেনা লিখতে বলতে কেউ
    উচ্চ পদাধিকারী।

    নিয়ে লক্ষ কোটি ব্যাঙ্ক লোন
    পগারপার বিদেশে
    আত্মসাৎ কর ফাঁকি থাকে
    নিশ্চিন্ত আয়াশে।

    পুত্র মেকি সেবা যত্ন
    করে পিতার মন জয়।
    করতলগত সম্পত্তি
    টাকা বিষয় আশয়।

    নিপীড়িত সর্বস্বান্ত
    অসহায় নি:সম্বল,
    ভিক্ষালব্ধ অন্নে কাটায়
    পিতার আশ্রয় গাছতল।

    আসল নকলে দেশ এখন
    মিলে মিশে একাক্কার,
    পাদপ্রদীপের তলায় নকলিরা
    সাধ্য নাইকো ধরবার।

    নামীদামি নার্সিংহোমের
    ভিতর নকল ডাক্তার
    ভুল চিকিৎসা নকল ওষুধ
    রোগী মরে আকছার।

    নকল টাকা নকল উকিল
    নকল আপনজন
    নকল বন্ধু, প্রতিবেশীর
    দু:খে মেকি রোদন।

    ছদ্মবেশে সি আইডি সিবি আই
    ঘুসখোর জাল অফিসার।
    খেয়ে কৃত্রিম খাদ্যদ্রব্য
    আনে ডেকে কেনসার।

    রেহাই পেলেও পেতে পারো
    সর্পদংশন বিষে।
    নিস্তার নাই নিত্য খাদ্যবিষ
    শরীরে প্রবেশে।

    বিষ যুক্ত কুট, বিস্কুট যোগে
    ঢুকছে ভেজাল টী,
    ব্রেকফাস্টে সস মাখা চাউমিন
    বিষ মাখা পাউরুটি।

    খেলে কার্বাইডে পক্ক
    ফলাদি একান্তে,
    সাথে কেন্সাররূপ জহরের
    অনুপ্রবেশ অজান্তে।

    বাজার থেকে কিনে আনা
    শাক সবজিটি তাজা,
    কীট নাশকে কীটহীন টাটকা
    সুন্দরী তরতাজা।

    মাটীমাখা আলুতে বিষ
    রূপে আলামাটি
    বিষ প্রয়োগে পরিপুষ্ট
    হাইব্রিড আনাজপাতি।

    মৎস দর্শনে মনে হয়
    রূপ লাবন্যে তাজা,
    ফরমেলিন গরল প্রয়োগে
    সংরক্ষিতা তরতাজা।

    মেকি সভ্যতায় ভোটযুদ্ধ
    নামেই গনতন্ত্র।
    খুন জখম কারচুপি আজও
    দেশে রাজতন্ত্র।

    মেকি সমাজে যাচ্ছে প্রেম
    শিষ্ঠাচার রসাতল,
    আজ নি:স্বার্থী সমাজসেবী
    সজ্জন বড়োই বিরল।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- বিষকন্যা

    বিষকন্যা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    বিষকন্যা এমন এক নারী, অতিসুন্দরী হলেও জুটতো না ঘর।
    বরও যদি ভাগ্যে জুটতো
    তা ক্ষণিকের জন্য। গনকের গননায় যার কুষ্টিতে বৈধব্য যোগ থাকতো তাকেই বিষকন্যা করা হতো। কারন তিনি বিষকন্যা হবার উপযুক্ত। রাজা রাজড়ারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিষকন্যা ধীরে ধীরে তৈরি করতো।

    প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সময়ের গল্প-উপকথা-ইতিহাসের ভাণ্ডার নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। আর সে কৌতূহলেই বিভিন্ন সময় আমরা খুঁজে পাই বিভিন্ন আকর্ষণীয় চরিত্র। তার মধ্যে অন্যতম ‘বিষকন্যা’।

    এই ললনাদের দেহের শিরা-ধমনী বেয়ে রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হতো বিষ। তাদের সঙ্গে সম্ভোগ তো দূরের কথা, সামান্য স্পর্শেই মৃত্যু অনিবার্য। বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে আগুন ধরানো এই সুন্দরীদের ব্যবহার করতো রাজা-মহারাজা-সম্রাটরা। কল্কিপুরাণ, শুকসপ্ততী এবং চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রে একাধিকবার এসেছে বিষকন্যাদের কথা। গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবার স্ত্রী সুলোচনা ছিলেন এক বিষকন্যা।

    শুধু ভারতীয় সভ্যতাই নয়। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাতেও উল্লেখ আছে বিষকন্যাদের কথা। সভ্যতার আদিপর্বের সেই সমাজে নির্দিষ্ট করে বেছে নেয়া হতো মেয়েদের। তখনকার রীতি অনুযায়ী গণকের ভাগ্য গণনায় যদি দেখা যেত, সাধারণের ঘরের পরমা সুন্দরী কোনো মেয়ের ভাগ্যে বৈধব্যযোগ আছে,তবে তাদের আর স্বাভাবিক জীবনে থাকতে দেয়া হতো না। রাজা বা শাসকদের লোকজন তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে আসতো।বিচ্ছিন্ন জীবনে বরাদ্দ হতো বিশেষ পথ্য। শিশু বয়স থেকে তাদের দেহে প্রবেশ করানো হতো তিল তিল করে বিষ।
    প্রথম প্রথম বিষফল খেতে দেওয়া হতো।তারপর একটু একটু করে বিষের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হতো। সব রকম বিষ যখন রক্তে ধারন করতে সক্ষম হতো তখন কন্যাটিকে জীভে বিষধর সাপের ছোবল গ্রহন করতো।
    বিষে বিষক্ষয় অনিবার্য। বিষয়টা তাদের জন্য সহনীয় হয়ে যেত। পরে তাদের কেউ বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করতে পারত না। কিন্তু তারা কারোর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলে সঙ্গী পুরুষটির মৃত্যু হতো। ইংরেজিতে একে বলা হয় মিথ্রিডাটিজম

    নন্দরাজার মন্ত্রী এক বিষকন্যাকে পাঠিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যার লক্ষ্যে। কিন্তু চাণক্যের কূটবুদ্ধিতে চন্দ্রগুপ্তের বদলে সে হত্যা করে বসে পর্বতককে।

    অনেক ক্ষেতে শুধু সঙ্গম বা স্পর্শ বা দৃষ্টি নয়,এই সুন্দরীরা মদিরায় বিষ মিশিয়ে বধ করত শিকারকে। সাহিত্য, চলচ্চিত্রে ঘুরে ফিরে এসেছে বিষকন্যা বা পয়জন গার্লের প্রসঙ্গ।

    পুরুষের ইচ্ছেতে, অঙ্গুলি হেলনে কন্যারাই বহন করেছেন বিষ। পঙ্কিল ষড়যন্ত্রের বিষ ধারণ করার জন্য নারীরাই ভাল আধার! তবে অনেক আখ্যানে বিষকন্যার কথা বলা আছে যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সত্য হিসেবেই। অনেকের মতে, অতিরঞ্জিত হলেও বিষকন্যার বাস্তবতা ছিল।

    কোনো এক রাজ্যে
    রাজ্যের বাছাই করা সদ্যোজাত শিশুকন্যাদের নিয়মিত বিষ খাওয়ানোর আদেশ দিলেন  এক রাজা। এক জন ছাড়া মারা গেল তাদের সকলেই। আর প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠল চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী এক বিষকন্যা।
    এক দিন দলবল-সহ যুদ্ধে বন্দি হয়ে, বিষকন্যাকে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে পাঠালেন আক্রান্ত রাজা। সেই মেয়ের রূপ যেন এক আগল ভাঙা প্লাবন! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, মারা গেলেন নিজে।
    ষোড়শ শতকের এক ফরাসি আখ্যানে পাওয়া যায় এই গল্প। গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টের জন্মের আগেই বিষকন্যা ধারণার উৎপত্তি ভারতে, পরে তা ছড়িয়ে যায় বিশ্বের অন্যত্র। সম্ভোগের প্রখরতায় বিষকন্যারা সরাসরি রক্তে ঢেলে দিত বিষ। কখনও তাদের ঘাম অথবা দৃষ্টি, কখনও শুধু নিশ্বাসেই মৃত্যু ছিল অনিবার্য।

    ‘অৰ্থশাস্ত্র’ প্রণেতা চাণক্যও রাজাকে সাবধান করে বলেছিলেন, অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ হতেই পারে, তারা বিষকন্যা!

    চন্দ্রগুপ্তকে বিষ খাওয়াতেন চাণক্য
    জঙ্গলে বন্ধুদের সঙ্গে এক বালককে রাজা-রাজা খেলতে দেখে নিজের লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন চাণক্য। দাম্ভিক, প্রজা-বিদ্বেষী রাজা ধননন্দের মুখে নিজের অপমানের বদলা নিতে সেই বালককেই ভবিষ্যতের মগধ অধিপতি হিসেবে তৈরি করলেন তিনি। তার পরে এক দিন ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে চাণক্য এগিয়ে দিলেন প্রিয় শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে। চার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার  চক্রান্তের আভাস পাচ্ছিলেন চাণক্য, যার মধ্যে বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। প্রজ্ঞা আর চতুর কৌশলে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রেখেছিলেন চাণক্য, আর তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মিশিয়ে দিতেন তিনি। তিনি জানতেন, বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই এক দিন তৈরি হয়ে উঠবে চন্দ্রগুপ্তের শরীর।

    দৈববাণী অনুযায়ী যে বসুদেব – দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান রাজা কংসকে হত্যা করবে,
    সে গোকুলে লালিত পালিত হচ্ছে,এরূপ এক দৈববাণী শুনে রাজা কংস দশ বারো দিন বয়সী সব সন্তানকে মেরে ফেলতে পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিল। পুতনা ইচ্ছেমতো তার রূপ পরিবর্তন করতে পারত। সুন্দরী বধূ সেজে স্তনদান করে শিশুদের মারতে গিয়েছিল। সে যখন বসুদেব- দেবকীর পুত্র কৃষ্ণ কে মারতে স্তনদান করতে গেলো অন্তর্যামী কৃষ্ণ বুজতে পেরে পুতনার স্তনকে এমনভাবে চুষে নিষ্পেষিত করেছিল তাতে তীব্র বিষ জ্বালায় ছটফট করতে করতে পুতনার মৃত্যু হয়েছিল।এই পুতনা ছিল বিষকন্যা।

    এলোমেলো ভাবে প্রাচীন ভারতের কিছু আখ্যানে ছড়িয়ে আছে বিষকন্যাদের কথা। তার অন্যতম হল, সোমদেব ভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’। শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের ব্যবহার করা হতো মূলত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা। কখনও নাচের দলে, কখনও বা উপহার হিসেবে, এই সব বিষকন্যাদের শত্রু শিবিরে ঢুকিয়ে দিত চতুর প্রতিপক্ষ. তার পরেই শুরু হয়ে যেত তাদের বিষের ছোবলে কাঙ্ক্ষিত হত্যার খবর আসার অধীর প্রতীক্ষা।

    বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, এমনকী, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়,
    খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী ইত্যাদিকে ছলনায় পরাভূত করে মগধের প্রবল উত্থান ঘটছিল। তখন বিষকন্যারা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষত, নন্দ বংশের আমলে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেই সময়ে রাজা ও রাজপুরুষদের হত্যা করে গোলযোগ তৈরি ছিল এক নৈমিত্তিক ঘটনা।

    উপসংহার
    —————————————-
    ‘বিষকন্যা’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে না-দেখলে অন্য কিছু দ্যোতনা প্রতীয়মান হয়। এমনটাই বলে গিয়েছেন কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। ভারতের সর্বত্র প্রচলিত ‘চাণক্য নীতি’-তে জানানো হয়েছে, ‘বিষকন্যা’ শব্দটি অনেক সময়েই একটি অভিধা এবং যুগে যুগে বিষকন্যারা পুরুষের সর্বনাশ করতে সক্রিয় থাকেন। অথবা পুরুষের লালসাই অনেক সময়ে সাধারণ নারীকেও ‘বিষকন্যা’ করে তোলে।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- কৌতুহল

    কৌতুহল
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    জগতের সেরা জীব মানুষ। তাদের মস্তিষ্ক উন্নত। জানার ইচ্ছা থেকেই জ্ঞান আসে। ইচ্ছে শক্তির মধ্যেই রয়েছে কৌতুহল।
    অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন । বিশাল এই পৃথিবীর চারিদিকে কত কি দেখার, জানার রয়েছে, কত রহস্য রয়েছে লুকিয়ে । সেই অপরিচয়ের দুস্তর মহাসমুদ্রের অদৃশ্য তরঙ্গ প্রতিনিয়ত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে । সেই অজানাকে জানবার জন্যে আমাদের অসীম আগ্রহ, অনন্ত উৎকণ্ঠা । এই দুর্নিবার আকর্ষণে আমরা রুদ্ধ দুয়ার খুলে বের হয়ে পড়ি অজানার সন্ধানে ।
    দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী, মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরুভূমি, কতনা অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু রয়ে গেছে অগোচরে ।
    শিশুর মনে নানান কৌতূহল। কৌতুহল থেকেই জ্ঞানার্জন। সেই শিশুই কৌতুহল থেকেই বিজ্ঞানী হয়, মঙ্গলে চাঁদে মানুষ পাঠায়।কৌতুহলের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সে মুক্ত।ভাগীরথীর উৎস সন্ধানের কৌতুহল থেকেই গোমুখ পৌঁছে যাওয়া যায়।এভারেস্ট, থর মরুভূমি সাগর গিরি পাহাড় ডিঙিয়ে নিত্যনতুন স্থানে ভ্রমণে আগ্রহ জন্মে।
    এই ভূখণ্ডকে জানবার জন্য কৌতুহল থেকেই দেশ ভ্রমণ । ইতিহাস ও ভুগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই  প্রকৃত জ্ঞান ।
    হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে কৌতুহল । কৌতুহল আমাদের দেয় গতি, এই গতির আনন্দে মানুষ উষর মরু, উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দেয় । কৌতুহলে আবিষ্ট হয়ে দুর্লঙ্ঘ্য গিরিশৃঙ্গ অতিক্রম করে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে । সুদূর চীন থেকে ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন ভারতবর্ষে । অজানা দেশ জয়ের আনন্দে কলম্বাস জীবন বাজি রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন । ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, মার্কোপোলো প্রমূখ বিখ্যাত বিখ্যাত পর্যটকগনের দুঃ সাহসিক কৌতুহলের ফলে আজ পৃথিবীর বহু দুর্গম দেশ-দেশান্তর মানুষের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে এসে গেছে । আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীর কত নামহীন গিরি-নদী, কত অজানা অরণ্য, মরুভূমি, কত তুষারাছন্ন মেরুপ্রদেশ। মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
    মানুষের কৌতুহলের কোনো শেষ আছে?
    “চাঁদটা কেন বাড়ে কমে জোয়ার কেন আসে? “গ্রহন কেন হয়?
    মাটিতে আপেলটা কেন পড়লো?
    ফুটন্ত জলে কেটলির ঢাকনাটা কেন ওঠানামা করছে?
    বানর সেনা পাথর জলে ফেলে পাথর জলে ভেসেছিল! সেতুবন্ধন করেছিল?মঙ্গল গ্রহে জল, অক্সিজেন আছে। মানুষ আছে!
    রোবোট কিভাবে কারখানায় কাজ করে। ব্যাঙ্কে টাকা গুনে দেয়?
    মানুষ কেন পাগল হয়!
    প্রতিবেশীর ঘরে ঝগড়া হচ্ছে। কিসের ঝগড়া।
    মেয়েটির মৃত্যু স্বাভাবিক, হত্যা নাকি আত্মহত্যা?
    অপারেশন এর পর লোকটা বাঁঁচবে কিনা!
    চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরিটা পাবে কিনা!
    ঘরের বউ স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোথায় যায়।ঘরে কে আসে?
    স্বামী রাত জেগে কার সাথে হোটাস এপে চ্যাট করে।অশান্তির মূলে কে? রেশনের চাল কোথায় যায়? সন্তানটি কী কারো প্রেমে পড়েছে? ঈশ্বর আছেন তাকে জানার কৌতুহল থেকেই ঈশ্বর দর্শন হয়। সুতরাং কৌতুহলই সভ্যতার উন্নতির সোপান । কৌতুহলে মানব সভ্যতার একদিকে যেমন বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে অত্যধিক কৌতুলের জন্য সন্দেহবাতিকতাও সৃষ্টি হয়। মানসিক রোগের কারণ হয়।

  • গল্প

    গল্প – কলিকালে

    কলিকালে
    -শচীদুলাল পাল

    স্নিগ্ধ বাতাসে ও ভোরের আলো এসে চোখে লাগতে ঘুমটা ভেঙে গেলে অনিরুদ্ধ দেখলো ঘরের দরজা খোলা।
    বিছানা থেকে নেমে ঘর, উঠান, বেড়ার ধার, রাস্তা খুঁজে স্ত্রীকে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত মনে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো। গতকাল রাতে স্ত্রী উশ্রীর সাথে কথাকাটি হয়েছিল।
    — আমি এ বাড়িতে থাকবো না। তোমার সাথে ঘর করবো না।
    — আমি তোকে ভালোবাসি।
    — ভাত কাপড় দেবার মুরোদ নেই শুধু ভালোবাসি বললেই চলবে।
    — আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু কি করবো বল। আয় কিছুতেই বাড়ছে না। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে, ঘরে ঘরে পেপার দিয়ে কতটুকু আয় হয়!
    কিন্তু উশ্রী যে কোথায় গেল!
    এভাবে দিন দুয়েক কেটে গেল। অনিরুদ্ধ ভেবেছিলো হয়তো কোথাও আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়েছে, ফিরে আসবে। কিন্তু উশ্রি আর ফিরে আসেনি।

    আজ থেকে বছর দুয়েক আগে একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে টিউশন সেরে ফেরার পথে এক গাছ তলে দেখা হয়েছিল উশ্রীর সাথে। বছর ষোলোর কুমারী সদ্য যৌবনা সুন্দরী উশ্রী কোলে বাচ্চা নিয়ে কাঁদছে।
    কৌতুহল বশত কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেছিিল,
    — আমি এক পুরুষের লালসার শিকার। আমি গরীব বিধবা মায়ের সন্তান। পেটের দায়ে এক বাড়িতে কাজ করতাম। আমার তখন চৌদ্দ বছর বয়স।সে বাড়ির মালিক আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে সম্ভোগ করতো দিনের পর দিন। সে অনেক টাকা দিতো। হাভাতে অবস্থা থেকে আমাদের অবস্থা সচ্ছল হয়েছিল। কিন্তু যখন পেটে বাচ্চা এলো তখন ওই শয়তানটা বলেছিল,
    — বাচ্চাটাকে অন্য কোথাও অন্য শহরে জন্ম দে। অনেক টাকা দেব। তোকে বিয়ে করব। মালিকের কথামতো অন্য শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মা ও আমি থাকতাম। সেখানেই জন্ম হলো আমার বাচ্চার।
    তারপর আমি ও মা একদিন বাচ্চা নিয়ে তার কাছে গেলে ‘বেশ্যা মাগী” বলে লাথি মেরে দূর করে দিলো। এখন আমার মাথার উপর এক বিরাট বোঝা। আমি অন্ধকার দেখছি। আমি বাচ্চটার মোহে আত্মহত্যা করতেও পারছিনা।

    আমি তখন দয়া পরবশ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
    — আমি তোকে আত্মহত্যা করতে দেব না। আমি তোকে আশ্রয় দেব।
    — কিন্তু কুমারীর এই সন্তান কি তোমার পরিবার মেনে নেবে?
    — আমি তোকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেব।
    আমি উশ্রী আর তার সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম। মা-বাবা দাদা-বৌদি ভাইপো-ভাইজিকে নিয়ে আমাদের পরিবার। পরিবারের সবার সামনে ঘটনাটা খুলে বললাম। সব শুনে তারা কেউ ঠাঁই দিতে রাজি হলো না। বাবা বললো,
    — এই বেশ্যা মেয়েকে আমার ঘরে আশ্রয় দেব! তুই ভাবলি কি করে! মেয়েটাকে ত্যাগ কর। ছেড়ে দে।

    — তা হয়না বাবা। আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি আমি বিয়ে করবো।

    — বেরিয়ে যা। কুলাঙ্গার। তোর মুখ আমি দেখতে চাই না।
    -এই বাড়ির কিছু অংশ আমার প্রাপ্য। সেখানে একটা ঘর নিয়ে থাকতে দাও। আমি আলাদাই থাকবো।
    –এই বাড়ির ত্রিসীমার মধ্যে তুই ঢুকবি না। তোকে আমি ত্যজ্যপুত্র করলাম।
    এই বলে লাথি মেরে দূর করে দিল।

    এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বস্তিতে এক দরমার ঘরে আশ্রয় নিলাম দুজনে।
    অষ্টাদশী উশ্রী ছিলো উগ্র যৌবনা। যতো না সুন্দরী ছিল তার চেয়ে বেশি রূপসী মনে করতো নিজেকে। সাজগোজ করতে ভালোবাসতো। বাচ্চাটাকে খাটের সাথে বেঁধে সে কোথায় যেন যেত। অনেকদিন অধিক রাতে ঘরে ফিরতো। নিত্যনতুন নিজের জন্য অত্যাধুনিক সাজপোশাক বিলাস সামগ্রী কিনতো। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতো। আমি কিছু বলতাম না।
    বাচ্চাটাকে যত্ন করা, দুধ খাওয়ানো,  পরিস্কার করা ইত্যাদি কাজ আমিই করতাম।
    আমার কেমন যেন একটা মায়া জন্মেগেছিল বাচ্চাটার উপর।
    একদিন রাত্রি আটটা নাগাদ ঘরে এসে দেখি উশ্রি ফেরেনি। কিন্তু বাচ্চাটা গেল কোথাায়! দুশ্চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হলাম। এদিক ওদিক অনেক খুঁজলাম। দেখতে পেলাম না। অনেক রাতে উশ্রী এল। মুখে মদের গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম,
    — তুই মদ খেয়েছিস?
    — হ্যাঁ। বেশ করেছি।
    — বাচ্চাটা কোথায়?
    — বেচে দিয়েছি।
    — মানে!
    — মানে বিক্রি করে দিয়েছি।
    এই দ্যাখো কত টাকা।
    বাঁচতে গেলে টাকা চাই। বুঝলে। আমি আমার যৌবন এমন ভাবে হেলায় তোমার কাছে গচ্ছিত রাখতে পারব না।
    — আমি তোকে আশ্রয় দিতে গিয়ে আমার মা-বাবা, সংসার, বংশ, স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি সব ত্যাগ করলাম। আর তুই কিনা টাকার জন্য নিজেকে আর বাচ্চাটাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিলি!
    সেই থেকে বুঝতে পেরেছিলাম উশ্রী উগ্র যৌবনা দেহ স্বর্বস্ব এক মেয়ে।তার মন বলে কিচ্ছু নেই। সে আমার সাথে ছলনা করেছে।
    তবুও তাকে আমি ভালোবাসতাম।তার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়েছিলাম।
    কোনো দিন প্রতিবাদ করিনি।
    ওর পাপের টাকা কোনো দিন ছুঁইনি। আমার স্বল্প আয়ে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিন আমার সংসার ছেড়ে আমার বুকে তীর মেরে কোথায় যে চলে গেলো।
    কিন্তু তার এই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিনি।
    বস্তির লোকেদের সাথে রঙ মিস্তিরির কাজ করি। প্রায় প্রতিদিন কাজ থাকে। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে অতীত ভুলবার চেষ্টা করি।

    এক ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত হলাম। সেখানে বছরভর নানান অনুষ্ঠান হতো। খুব স্বল্প সংখ্যক লোকজন আসতো। মানুষের সনাতন ধর্মের প্রতি টান একেবারে তলানিতে। একদিন এক ধর্মীয় উৎসবের অনুষ্ঠানে এক প্রবচন প্রবক্তা বলছিলেন কলিযুগ প্রসঙ্গে —

    কলিযুগ হল হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ। অন্য যুগগুলো হল সত্যযুগ, ক্রেতাযুগ ও দ্বাপরযুগ। বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে, যেদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন সেদিন থেকেই পৃথিবীতে কলিযুগের সুচনা হয়েছে। পুরানে আছে—
    ছলনা, মিথ্যা, আলস্য, নিদ্রা, হিংসা, দুঃখ, সুখ, ভীতি, দীনতা
    লোভ, শঠতা, ঠকবাজি, অমানবিকতা কলি যুগের বৈশিষ্ট।

    বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সব কিছু সৃষ্টি করেন এবং কলিযুগে সমস্ত কিছু ধ্বংস করেন। বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী কম ধনের অধিকারী হয়ে মানুষ এই যুগে বেশি অহংকার করবে। ধর্মের জন্য অর্থ খরচ করবে না। ধর্ম গ্রন্থের ওপর মানুষের আকর্ষণ থাকবে না।মাতা পিতাকে মানবে না।

    পুত্র পিতাকে হত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে কুণ্ঠিত হবে না। ধর্ম অনুসারে কেউ বিবাহিত থাকবে না। স্ত্রীলোকেরা নিজেকে সুন্দরী মনে করবে। ধনহীন পতিকে মহিলারা ত্যাগ করবে। আর ধনবান পুরুষরা সেই নারী গনের স্বামী হবেন।

    কলিযুগে মানুষ ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় না করে কেবল গৃহ নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করবে। মানুষ পরকালের চিন্তা না করে কেবল অর্থ উপার্জনের চিন্তায় মগ্ন থাকবে। কলিযুগের নারীরা সাধারণত স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবে এবং পুরুষেরা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করতে অভিলাষী হবে।

    অসমর্থ মানুষেরা ধনহীন হয়ে পেটের জ্বালা ও ক্লেশ ভোগ করবে। কলিযুগে মানুষ যা কিছু ভোজন করবে। কলিকালে স্ত্রীলোকেরা নিতান্তই লোভী হবে, বহু ভোজনশীলা হবে। মহিলারা অনায়াসে পতি আজ্ঞা অবহেলা করবে।

    নারীরা নিজের দেহ পোশাকে ব্যস্ত থাকবে, কঠোর ও মিথ্যা কথা বলবে। কলিকালে চোদ্দ থেকে ষোল বছরের বালকরা সহবাসে, বারো থেকে চোদ্দ বছরের বালিকারা সন্তান প্রসব করবে। কলিকালে মানুষের বুদ্ধি অতি অল্প হবে, তাদের ইন্দ্রিয় প্রভৃতি অতিশয় অপবিত্র হবে।

    যখন পাষণ্ড লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে তখন সমাজের ভালো লোকেরা কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকবে না। সুন্দরী স্ত্রী যার তার সাথে বন্ধুত্ব করবে।

    একদিন কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি।দেখলাম পাড়ারই এক বাড়ির সামনে জটলা। বাড়ির মালিক মারা গেছে। তার শব পড়ে আছে।
    মৃতদেহ স্টিফ হয়ে গেছে। সকাল থেকে বেশ কয়েকজন ডাক্তার এসে ফিরে গেছে। কেউ ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছে না।
    লোকটা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিল। ঘরে স্ত্রী, যোয়ান মেয়ে ও ছেলে।
    লোকে বলাবলি করছে, লোকটার ছেলেটা বোনের সাথে এক বিছানায় শুতো। ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলিত হতো। লোকটা প্রতিবাদ করতো। তীব্র প্রতিবাদ করায় গতকাল রাতে তুলকালাম ঝগড়াঝাটি হয়েছে। পাড়ার লোকেরা শুনেছে। অবশেষে গতকাল রাতে স্ত্রী পুত্র কন্যা মিলে গলা টিপে লোকটাকে মেরে দিয়েছে। সকালবেলা শুনলো লোকজন রাতে চলে গেলে এক হাতুড়ে ডাক্তার এসে অনেক টাকা নিয়ে নরম্যাল ডেথ সার্টিফিকেট দিলে পাড়ার লোকজনের সহায়তায় রাতারাতি শ্মশানে নির্বিঘ্নে দাহ সম্পন্ন করেছে।

    আমি রঙ মিস্ত্রির কাজ করি এক বড়ো প্রমোটারের অধীনে। একদিন এক নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কাজ করছি। হঠাৎ অত্যাধুনিক সাজে স্বল্পবাস পরিহিতা এক মেয়ের উপর নজর পড়লো। গাড়ি থেকে নামছে। সাথে এক মধ্য বয়সী ধোপদুরস্ত লোক। দূর থেকে দেখলেও চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওইতো উশ্রী।  ফর্সা সুন্দরী উশ্রী আরও সুন্দর হয়েছে। পরিপুষ্ট নির্মেদ শরীর। শরীরে এক চমক, এক মাদকতা। এই দুবছরে অনেক পরিবর্তন।
    পাশের এক বিল্ডিংএ যাচ্ছে।
    উশ্রী অশালীন পোশাকে লোকটার ঘনিষ্ঠ হয়ে এক ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। আমি দূর থেকে নিয়মিত অনুসরণ করে ও আবাসনের এক সিকিউরিটি গার্ডের সাথে ভাব করে জানতে পারলাম —
    উশ্রী এক নষ্ট মেয়ে শুধু নয় এক চিটিংবাজ। এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে তার শিশু পুত্রটিকে অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছিলো। পরে বেইমানি করে জোর জবরদস্তি করে শিশুটিকে ছিনিয়ে এনে অন্য একজনকে মোটা টাকায় বিক্রি করে। ফ্ল্যাট কিনেছে, গাড়ি কিনেছে। বহু টাকার মালকিন। এখন সে এক কুখ্যাত মাফিয়ার রক্ষিতা। অশিক্ষিত মাফিয়াটি এ অঞ্চলের বেতাজ বাদশা। তার এই প্রকাশ্য ব্যভিচার এই আবাসনের সবাই সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে।উশ্রীকে সবাই ভয় করে।
    -আচ্ছা। ওই যে লোকটা উশ্রীকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো সেই কি মাফিয়া?
    –না। উনি মাফিয়া নন। উনি এক বিখ্যাত শিল্পপতি। উশ্রীর নতুন শিকার।
    -কেউ কিছু বলে না?
    -বলবে কি? এখন উশ্রী ধন ও মদমত্তে গর্বিত এই হাজার ফ্ল্যাট সমৃদ্ধ আবাসন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তার অঙ্গুলিহেলনে সবাই উঠবোস করে।

  • কবিতা

    গল্প- সিমলিপাল ও খৈরি

    সিমলিপাল ও খৈরি
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    আমি তখন ওড়িশা সরকারের জয়েন্ট সেক্টারের ইষ্ট কোস্ট কেমিক্যাল এন্ড ফার্টিলাইজার লিমিটেডের রাসায়নিক কারখানায় সিফট ইনচার্জ পদে চাকুরী নিয়ে ময়ূরভঞ্জ জেলার কলমাতে জয়েন করেছি। নির্মীয়মান কারখানায় তখন প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই আমার কোনো কাজ নেই। কারখানার ভিতরেই থাকতাম।
    কারখানার বাউন্ডারি ওয়ালের পর থেকে জঙ্গল শুরু। কর্তৃপক্ষ এক আদিবাসী ছেলেকে আমার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য যুক্ত করেছে। নাম তার সাপলা। একদিন বললাম- সাপলা আমি সিমলিপাল জঙ্গল দেখতে যাব। এই দেখ আজকের ম্যাগাজিনে খৈরি বাঘের ছবি বেরিয়েছে। খৈরিকেও দেখে আসব।
    সাপলা বলল- ঠিক আছে বাবু, চলুন কবে যাবেন বলুন। আমার ঘরে একরাত থাকবেন। আমার দাদা ফরেস্ট গার্ডের চাকরি করে। সে তার বসকে বলে জঙ্গল সফরের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে। বন্য জন্তু জানোয়ার আছে। সাফারি গাড়ি ছাড়া সেখানে ঢুকবার অনুমতি নাই। একদিন আদিবাসী ছেলেটির সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সে প্রথমে জঙ্গল সংলগ্ন তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেল। শাল পিয়ালের গাছে ভরা গাঁ। গাঁ না বলে আদিবাসী পাড়া বলাই ভালো। তিনদিকে বন।একদিক মেঠো পথ দিয়ে সড়কের সাথে যুক্ত।
    মাটির ঘরে পুয়ালের ছাউনি। সুন্দর নিকানো দেওয়াল। আসার সময় বড় রাস্তা থেকে মেঠো পথে যেতে যেতে দেখলাম একটা খরগোশকে বুনো শিয়াল তাড়া করেছে। সে প্রাণের ভয়ে ছুটছে। একটা ডোবাতে অজস্র সাপ কিলবিল করছে। ধান উঠে যাওয়া ক্ষেতে একটা গোসাপ। কতগুলো উলঙ্গ শিশু গোসাপটিকে ধরবার চেষ্টা করছে। এই গোসাপটিকে মেরে তার মাংস রান্না করে খাবে। জঙ্গলের মেঠো পথ ধরে এক সাপুড়ে সাপের খেলা দেখিয়ে ফিরছে। সাপলা বলল- বাবু সাপের খেলা দেখবেন? আমি বললাম- হ্যাঁ।
    সাপুড়েটি তার আত্মীয়।
    সাপলা আমার জন্য সাপের খেলা দেখাতে লোকটিকে অনুরোধ করল।
    ক্ষেতের ধারে সাপের খেলা দেখাতে দেখাতে সাপুড়ে বলল- এই সাপ ছ’ ফুট লম্বা এক মানুষের কপাল ছুঁয়ে দিতে পারে। শুধু দাঁতে নয় তার ল্যাজেও বিষ। ল্যাজ দিয়ে কাউকে ছুঁয়ে দিলেও সাথে সাথেই মরে যাবে। আমরা একে রানা সাপ বলি, সাপটিকে গত সপ্তাহে ময়ূরভঞ্জ জঙ্গল থেকে ধরেছি।
    সাপলা বলল- এই বিশাল সাপের বিষ খুব তীব্র ও পরিমাণে অনেক বেশি। কাকা এই সাপের বিষ বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক। কলকাতা থেকে বাবুরা এসেও নিয়ে যায়।

    কার্তিকের নাতিশীতোষ্ণ বাতাবরণে অপূর্ব লাগছে, স্নিগ্ধ হাওয়া। দূরের রক্ত রাঙা সূর্য অস্ত যাবে। রক্তিম আভা ঠিকরে পড়ছে বনবীথিকায়।
    আমরা সাপলার ঘরে পৌছলাম। বাড়ির লোকজন আমাকে দেখে আড়ষ্ট হলেও পরে সাপলার কাছ থেকে আমার পরিচয় জেনে খুব আদর যত্ন করল। খুব সহজ সরল মানুষ তারা। বনের রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে পড়ে গিয়ে আমার পায়ে চোট লেগেছিল। বাড়ির মেয়েরা এসে গাছের পাতা শিকড় বাকড়ের নির্যাস থেকে তৈরি তেল দিয়ে মালিশ করে দিল। পায়ের ব্যথা নিমেষে উধাও। সাপলার অনুরোধে ঘরের তৈরি মহুয়ার নির্যাস পান করলাম।
    ঘরে পোষা মুরগির মাংস দিয়ে ভাত দিল। খেয়েদেয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। মুরগির ডাকে,পাখিদের কলকাকলীতে, প্রভাত সূর্যের নরম আলো চোখে পড়তে ঘুম ভাঙল।
    আমরা জঙ্গল সফরের জন্য তৈরি হলাম। ঘুম থেকে উঠে সাপলা খরগোশ মেরে নিয়ে এসেছে। সেই খরগোশের মাংস আর পান্তাভাত দিয়ে আমরা প্রাতরাশ সারলাম।
    বারিপদা বনকর্তা/ বনসংরক্ষক অফিস থেকে সাপলার দাদার সুপারিশে বনদপ্তরের অফিস থেকে দেওয়া গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম সিমলাপাল সফরে।

    আমরা জনা পাঁচেক গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম শিমলিপাল অরণ্যে। পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের উঁচু নিচু চড়াই উৎরাই রাস্তায় একটা ছোট নদীকে পেরিয়ে রাস্তা। একছোট্ট আদিবাসী গ্রামের জারুলগাছ তলায় এসে গাড়ি থামল।
    নদীর কাছে গাড়ি থেকে আমরা সবাই নামলাম। গাইড বলল- এই সেই খৈরি নদী। পাহাড়ি নদী। এসময় জল বেশি থাকে না। বর্ষায় দুকুল ছাপিয়ে বান আসে। ভীষণ খরস্রোতা। আপনাদের আজ এক বাস্তব কাহিনি বলব।

    “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”- কিন্তু এর ব্যতিক্রম যে হয় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই সত্যি গল্প। ওই যে আদিবাসী গ্রাম দেখছেন সেই গ্রামের একদল আদিবাসী মধু সংগ্রহ করে ফিরছিল দেখল খৈরি নদীর ধারে এক বাঘিনী ও তার তিনটি বাচ্চা জল খাচ্ছে। একজন ছুটতে ছুটতে এসে গ্রামে খবর দিল বাঘ এসেছে খৈরির তীরে। গ্রামবাসীরা ড্রাম কানেস্তারার শব্দে বাঘিনীটিকে তাড়াবার চেষ্টা করতেই বাঘিনীটি তার দুটি বাচ্চাকে নিয়ে নদী পার হয়ে জঙ্গলে চলে যেতে সমর্থ হলেও এক দূর্বল বাচ্চা তার মায়ের সাথে যেতে পারলনা। গ্রামবাসীরা ফুটফুটে বাঘশিশুকে কোলে তুলে নিল। সেটি ছিল স্ত্রী বাঘ। সেই সময় সরকারি ফরেস্ট অফিসার (বনকর্তা) সরোজ রাজ চৌধুরী বন পরিদর্শনে গাড়ি নিয়ে টহল দিতে গিয়ে ড্রাম কানেস্তারার আওয়াজ শুনে নদীর ধারে গেলে গ্রামবাসীরা কুড়িয়ে পাওয়া সেই বাঘের বাচ্চাটিকে তার হাতে তুলে দিল। স্ত্রী- বাঘশিশুটি ছিলো ভীষণ দূর্বল। অফিসার পরম যত্নে গাড়ীতে উঠিয়ে নিজের বাংলোয় নিয়ে আসল।
    তিনি তাকে গরম গুঁড়ো দুধ খাওয়ালেন। আদরে আবদারে ভরিয়ে দিলেন। রাতে দুধ রুটি খাইয়ে একসাথে বিছানায় ঘুমোলেন। পরদিন সকালে একসাথে স্নান করলেন। বাঘশিশুটি খৈরি নদীর ধারে পেয়েছিলেন বলে তার নাম রাখলেন খৈরি।খৈরি ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা পরিণত হল। খৈরি রজত রায় চৌধুরীর কাছে পরম যত্নে কোলে পিঠে মানুষ হতে লাগল।একটু বড়ো হলে তাকে ডাল ভাত সবজি গুড়ো দুধ ও পাঁঠার মাংস রান্না করে খাওয়াতে হত। একসাথে এক বিছানায় খৈরি রজত বাবুকে কোল বালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। এভাবে না শুলে তার ঘুম আসতো না। বন সফরে গেলে তাকে সাথে নিয়ে যেতে হত। কিন্তু অফিসিয়াল কাজে শহরে গেলে সবাই ভয় করতো। অফিসিয়াল কাজে ভীষণ অসুবিধা হতো। তাই অন্য সময়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার এক মহিলাকে নিযুক্ত করলেন। তার নাম ছিল নীহার নলিনী সোয়াইন। তাদের দুজনের আদরে যত্নে খৈরি হয়ে উঠল এক বিশালাকৃতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তার ওজন হল ২০০ কেজি।
    পরে নীহার নলিনী সোয়াইনের সাথে সরোজ রায় চৌধুরীর বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ে হলে কি হবে?
    খৈরিকে আলাদা ঘরে রেখে এক বিছানায় দম্পতি শুতে গেলে ভীষণ জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতো। গর্জন করতো। সারারাত কাউকে ঘুমাতে দিতোনা। অবশেষে তাকে দুজনের মাঝখানে রেখে শুতে হতো। কিছুদিন পর তাও তার সহ্য হত না। ঠিক হল তাকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই মতো তাকে অনেক দূরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসল রজতবাবু।
    বিকেলে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। হঠাৎ সরোজ বাবু দেখলেন আঙিনায় খৈরি দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখে তার জলের ধারা। পরম স্নেহে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। নলিনীও অনেক অনেক চুমু দিয়ে আদর করতে লাগল।

    বন্য প্রাণীদের থাকার জন্য যশিপুরে তাদের সরকারি বাসস্থানে আরও বেশ কিছু বন্য প্রাণী পুষেছিলেন। একটি কুমির, জাম্বু নামে একটি ভালুকের বাচ্চা, বাইনা নামে একটি অন্ধ হায়না এবং একটি মঙ্গুস পুষেছিলেন। তাদের সকলেই তার আঙ্গিনায় অবাধে ঘুরে বেড়াত । 

    সরোজবাবুর পোষা কুকুর ব্ল্যাকির সঙ্গেই বড়ো হচ্ছিল খৈরি। এমনকি নানা জায়গা থেকে সরোজবাবু বন্য বিড়াল কিংবা হরিণ শাবক উদ্ধার করে নিজের দায়িত্বে লালন-পালন করতেন, খৈরি তাদের সঙ্গেও থাকতে পছন্দ করতো। তিনি লক্ষ করেছেন, হরিণটিকে বা কুকুরকে যখন নীহার খাইয়ে দিতো, সে সময় ঈর্ষান্বিত হতো খৈরি। সরোজ রাজ চৌধুরী খুব কাছ থেকে খৈরির আচার-ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতেন, বিশেষত বাঘেদের ফেরোমোন নিঃসরণের পদ্ধতি কিংবা বাঘেদের মিলনের সময়কালীন আচরণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করতেন। পরবর্তীকালে খৈরিকে নিয়েই বিখ্যাত বিজ্ঞানী রতনলাল ব্রহ্মচারী ফেরোমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত গবেষণা করেছিলেন এবং প্রাণীদের ফেরোমোনে বিশেষ তীব্র সুবাসের কারণ হিসেবে ২-এপি নামের একটি রাসায়নিক যৌগ অণুর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন। খৈরির সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগে থেকেই সরোজ রাজ চৌধুরী বাঘের পায়ের ছাপ দেখে বাঘগণনার পদ্ধতি চালু করেছিলেন, ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতে এই পদ্ধতিতেই বাঘ গণনা করা হত। ১৯৭২ সালে ভারতে প্রথম এই পাগমার্ক মেথডোলজির সাহায্যে বাঘ গণনা করা হয়। তাছাড়া তাঁরই উদ্যোগে ফরেস্ট অফিসারদের বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে আরো দক্ষ করে তুলতে ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে এই খৈরিই হয়ে ওঠে সরোজ রাজ চৌধুরীর অতিপ্রিয় বাঘিনী। তবে শুধুই ভালোবাসার খাতিরে খৈরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক।
    একদিন সরোজ রায় চৌধুরী হাবভাব ও লক্ষ্মণ দেখে লক্ষ্য করলেন খৈরির প্রজনন প্রয়োজন। প্রজজনের জন্য প্রস্তুত।তিনি একদিন গভীর বনে বাঘেদের দলে তাকে ছেড়ে দিলেন। লক্ষ করলেন সে বাঘদের গন্ধ সহ্য করতেই পারছে না। অদুরে সরোজ বাবুর ক্লোজ ভ্যান খুঁজে সেখানে উপস্থিত খৈরি। খৈরি গর্ভধারণ করতে পারেনি।
    সরোজ রাজ চৌধুরী ছিলেন একজন ভারতীয় পরিবেশবাদী, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদী, লেখক  এবং ওড়িশা সরকারের অধীনে প্রথম বন সংরক্ষক ও গবেষক।  তিনি ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও ছিলেন। চৌধুরী বাঘ শুমারি এবং খৈরি নামে গৃহপালিত বাঘের সাথে তার বন্ধুত্বের জন্য নিযুক্ত পাগমার্ক কৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন । ১৯৭৭ সালে তার লেখা একটি বই, খৈরি দ্য বেলভড টাইগ্রেস, প্রকাশিত হয়।
     ১৯৮৩ সালে ভারত সরকার তাকে চতুর্থ সর্বোচ্চ ভারতীয় বেসামরিক সম্মান “পদ্মশ্রীতে” ভূষিত করেন। সরোজ রাজ চৌধুরী, ওড়িশায় জন্মগ্রহণ করেন, ওড়িশা সরকারের চাকরিতে একজন বন কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং একজন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা হওয়ার পদে উন্নীত হন, তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম ব্যক্তি। পরবর্তীতে, তাকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে বদলি করা হয়, যা ১৮৭৮ সালে জার্মান বনবিদ, ডিট্রিচ ব্র্যান্ডিস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । যখন সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন চৌধুরীকে এর প্রতিষ্ঠাতা ফিল্ড ডিরেক্টর এবং প্রজেক্ট টাইগারের প্রধান করা হয় যার সদর দপ্তর বারিপাদায় । 

    গাইডের মুখে খৈরি, রজতবাবু ও নলিনীর কাহিনী শুনতে শুনতে পথ চলা শুরু করলাম। কখনো গাড়িতে কখনো পায়ে হেঁটে চলেছি দল বেঁধে। মাঠ, আল পেরিয়ে ঢুকলাম ঘন জঙ্গলের পাহাড়ি পথে।
    রাস্তা এত সংকীর্ণ পিচ্ছিল‌ ও জায়গায় জায়গায় ঢালু যেকোনো সময় যে কেউ পা পিছলে পড়ে যেতে পারে। কেউ যেন এগিয়ে চলে না যায়‌- গাইডের এই সর্তকবার্তা শুনে এগিয়ে চললাম।
    অরণ্যে অল্প একটু কথা বললেই তা অনেক জোরে মনে হচ্ছে, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

    আর জঙ্গল বলে কথা, তাও যে সে জঙ্গল নয় সিমলিপাল। তাই যতটা সম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করে অবশেষে তিন কিলোমিটার হাঁটার প‍র পৌঁছালাম অসুর মারা ফলস। অপরূপ এই জলপ্রপাত, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আপন গতিতে নেমে আসছে। ঐ পথ দিয়ে উৎস পর্যন্তও যাওয়া যায়, ওখানকার দৃশ্য নয়নাভিরাম, কিন্তু যাত্রা পথ পিচ্ছিল, আরও দুর্গম । যাইহোক কিছুটা তো চড়লাম। যাত্রাপথে জলপ্রপাতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মোহিত হলাম।
    জলপান করে ফিরে চললাম কুমারীর উদ্দেশ্য।
    গাড়ীর সামনে ফিরে ভরপেট জলখাবার খেয়ে সারাদিনের জন্য একে একে জঙ্গল পাহাড় ঘেরা উস্কিফলস, অপরূপ বরাপানি শেষে চাহালা ওয়াচ টাওয়ার।

    বরাপানির অপরূপ সৌন্দর্য চারপাশে উঁচু পাহাড়ের শ্রেণী তার মধ্যে খানে গভীর খাদ।
    এক উঁচু পাহাড় থেকে বুড়িবালাম নদী হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে বিপুল জলরাশিকে তীব্র গতিতে সশব্দে নিচে আছড়ে ফেলছে।
    আহা! কি অপরূপ দৃশ্য! এক পলক বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছিল। ভালো করে যতটা দেখা যায় দেখে ফিরছিলাম।

    রাস্তায় দুটো জায়গায় দেখলাম আমাদের গাড়ি যাবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক ক্যামেরার ফ্লাস জলে উঠল, বুঝলাম ওগুলো জঙ্গলের পশু অথবা কারা জঙ্গলে প্রবেশ করেছে তাদেরকে ওয়াচ করার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।
    এই জঙ্গল বাঘ, কালোবাঘ, চিতা, জায়েন্ট স্কুইরাল, হাতি, হরিণ, সম্বর, বনশুয়োর, হায়না, গৌড় বা বুনো মোষ সহ নানা ধরনের বুনো জন্তুর বিখ্যাত। আর আছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সাপ। এখানকার মশা ম্যালেরিয়া রোগ-এর বাহক। তবে শীতকালে প্রকোপ নেই।
    অবশেষে চাহালা পৌঁছে মনে একটু বল পেলাম, যাক লোকজন তো আছে,গভীর জঙ্গলে যেখানে জনমানুষের চিহ্ন নেই ।
    পশু পাখি তো চিড়িয়াখানায় অনেক দেখেছি কিন্ত এই বন্য পরিবেশে তাদের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবে যতটুকু তারা আমাদের দেখা দিয়েছে তাতেই আমরা ধন্য। হাতি দেখার আশায় অপেক্ষা করতে করতে হাতির দেখা সেদিন পেলাম না শুধু যা দেখতে গেছি মনের মনি কোঠায় সেই জঙ্গলকে রেখে দিনের আলোয় যে হরিণ কে দেখছিলাম তাদের জ্বলজ্বল করা চোখ আর ফ্লাশ লাইটের আলোয় হরিণের পালের ভীত পদচারনা দেখতে দেখতে পথ চলছি। এক জায়গায় ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখে বুঝলাম এখানে গতকাল বাঘ হরিণ মেরে খেয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
    না! আর না! এবার ফেরার পালা। গাড়ির হেড লাইটের আলো জঙ্গলের বুক চিরে পাশে আবছা আলোছায়া তৈরি করতে লাগলো আর আমাদের ক্ষুধার্ত দু চোখ কিছু দেখতে পাবার আশায় চারধার নিরিক্ষন করতে করতে ফিরে চললাম আশ্রয়ে।

    ​পরের দিন ঐ পাহাড়ি পথে সফরের অভিজ্ঞতা আকর্ষণীয়। বোল্ডার বিছানো প্রতিটি চড়াই উৎরাইয়েই মনে হচ্ছে এই বুঝি সামনে হাতি পড়বে, তখন কি করব? যাই হোক সেরকম কিছু হয়নি।

    মুগ্ধকর চিরস্মরণীয় অপরূপ অবর্ণনীয় জোরান্ডা জলপ্রপাত দেখে মোহিত হলাম। সেখান থেকে খাদের দিকে তাকালে বুক কেঁপে উঠতে পারে। জঙ্গল খুব গভীর,হাতির উপদ্রব আছে,তারজন্য বিট অফিস সহ চারিদিকে ট্রেঞ্চ কাটা। আবার চলা এবার থামলাম এক পাহাড়ের মাথায় এটাই বোধহয় সিমলিপাল রেঞ্জের সব থেকে উচু অঞ্চল। এখান থেকে দুরে দেখা যাচ্ছে জোরান্ডাকে। এখানে নাকি “মামা”,মানে বাঘের উপদ্রব। তবু ফটো তুলতেই হবে, অতএব কিছুক্ষণ বিরতি।
    পাহাড়ের চড়াই পথে সামনের গাড়িটা বাঁক নিয়ে ওপরে উঠেছে, বাঁকের মুখে নিচের ডান দিকের খাদে আমাদের নজরে পরলো একপাল হাতি।
    আমাদের ড্রাইভার সামনের গাড়িকে দেখানোর জন্য ভুলবশত হর্ন দেওয়ায় চোখের নিমেষে ওরা ঘন জঙ্গলে চোখের আড়ালে চলে গেল। সামনের গাড়ি থেকে কয়েকজন চীৎকার করে ছুটে নেমে এসেছে তাদের তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠালাম।
    বিশ্বাস নেই, এরা দলে থাকে যদি ওপরে কোন দল থাকে তাহলে সমূহ বিপদ। দু’দিক দিয়েই আমরা আটকে পড়বো। ওরা চাইলে আমাদের নিয়ে মনের আনন্দে ফুটবল খেলতে পারবে।
    জঙ্গলে সবসময় চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আর কোনরূপ অবাঞ্ছিত শব্দ করতে নেই। আর প্রত্যেককেই নজর রাখতে হয়। তবেই কিছু দেখা সম্ভব। এমনি করেই হরিণ, শুয়োর, বড় একটা পেঁচা, শিয়াল, হায়নার দেখা পেলাম।
    প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে লাগল সামনের বাঁক পেরোলেই লম্বা সোজা যে রাস্তা দেখা যাচ্ছে তার কোন এক জায়গায় যদি গাড়ির হেডলাইটের আলোয় “তার” দেখা পাই তো ষোলকলা পূর্ণ হবে।নিঝুম গভীর জঙ্গলে ভয়ার্ত হরিণের বাক বাক ডাক শুনলাম। কিন্তু তাকে মানে”মামাকে”দেখার সৌভাগ্য হল না। সামনে রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে। একটা তেমাথার মোড়,ডান দিকের রাস্তা চলে গেছে লুলুঙ্গের দিকে,ঐ জায়গাটাও দেখার মতো।
    গাইড বলল- সামনে ওই যে ছোট্ট নদী দেখছেন ওটাই খৈরি নদী।
    আমরা এবার বারিপদায় সরোজ রায় চৌধুরীর বাংলোয় উপস্থিত হলাম।
    দেখলাম নলিনীকে। যিনি সন্তান স্নেহে মায়ের মতো খৈরিকে লালন পালন করে চলেছেন।সরোজ রায় চৌধুরী এক অফিসে কর্মরত। খৈরিকে দেখার বিশাল লম্বা লাইন। একটা নিদিষ্ট সময়ে দর্শনার্থীদের খৈরি সাক্ষাৎ দেয়। ২০০ কেজি ওজনের বিশালাকারের খৈরি এখন খাঁচায় রাখা হয়েছে। কাছে গিয়ে কোনো খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ। চাক্ষুষ দর্শনের স্মৃতি চিরকাল মনে থাকবে। খৈরি দেখে আমি আমার কারখানার বাসস্থানে ফিরে এলাম।

    বাঘিনী খৈরির পুরুষ বাঘের সাথে যৌনমিলনে অনীহা, মানুষের সাথে থাকতে থাকতে বাঘের গন্ধকে সে সহ্য করতে পারতো না।
    তাই তার পিতামাতার (রজত- নলিনী) বারবার প্রজজনের জন্য প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।জঙ্গলে পুরুষ বাঘকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলোয় ফিরে এসেছে। তাই এই কিংবদন্তি রয়েল বেঙ্গল টাইগার “খৈরি” কোনো বাচ্চার জন্ম দিতে পারেনি।
    পরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছিলাম জঙ্গলের এক বুনো কুকুর বাংলোয় ঢুকে খৈরিকে আহত করে। তাই তাকে রেবিট ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল।
    বাঘিনী জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তখন ট্রানকুইলাইজারের অত্যধিক মাত্রায় খৈরির মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮১ সালে, মাত্র ৭ বছর বয়সে। তার একবছর পর খৈরির শোকে মৃত্যু হয়েছিল পদ্মশ্রী সরোজ রায় চৌধুরীর। স্বামীর মৃত্যুর পর শেষের দিকে অপত্য স্নেহের “খৈরি”-র স্মৃতি বুকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে কালযাপন করেন নলিনী।

  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভ্রমণ কাহিনী-পদব্রজে জয়দেব কেঁদুলি

    পদব্রজে জয়দেব কেঁদুলি
    শচীদুলাল পাল

    ১৯৬৮ সাল।আমি তখন হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের বি এস সি (কেমিস্ট্রি অনার্স) প্রথম বর্ষের ছাত্র। একটি অতি উন্নত মানের কলেজ। ভারত সরকার দ্বারা স্টার কলেজের তখমাপ্রাপ্ত।
    আমার হোস্টেলের সামনে হাজার দুয়ারি,যেখানে গুপি বাইন বাঘা বাইন সিনেমার সুটিং হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলার ছাত্ররা আমাদের হোস্টেলে থাকতো। আমার হোস্টেলের ৩ নং রুমে আমি থাকতাম। ১১ ছাত্রের সিট।
    উপরতলা নীচতলা মিলিয়ে অনেক রুম ছিল।
    পূর্বে রাজাদের বাঈজী নাচমহল ছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কলেজকে প্রায় সব বিষয় সম্পত্তি দান করে দিয়েছিলো। আমাদের দ্বিতল হোস্টেলে সব বিশাল
    বিশাল রুম। প্রতিটি ঘরের উচ্চতা বর্তমান ঘরের প্রায় ডবল। চুন সুরকির কাজ। বীরভূমের প্রচন্ড গরমে দুপুর বেলাতেও গরম লাগতো না। বেশ মনোমুগ্ধকর বাতাবরণ। বড়ো বড়ো জানালা। বিশাল কাঠের সিঁড়ি। একসাথে পাশাপাশি পাঁচ – ছজন উঠতে পারতাম।
    আমার এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রামদুলাল তেওয়ারি আমার পাশের সিটে থাকতো।
    দুপুর বেলায় একটা সময় যখন আমার ক্লাস থাকতো না। তখন দোতলায় আমি বাংলা ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলা প্রফেসরের ক্লাস লেকচার শুনতাম চুপিচুপি লুকিয়ে। খুব ভালো লাগতো।বড়োই মধুর। যদিও দেওয়ালের বাইরে থেকে খুব একটা শোনা যেতো না। কান পেতে শুনতে হতো। একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কখন যে দরজার পাশে চলে এসেছি খেয়াল নেই। স্যার আমাকে দেখে ফেলেছে। আমি চৌঁচা দৌড় লাগালাম। স্যার একটা ছেলেকে বললো
    — একটা ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ধরে নিয়ে এসো।
    ছেলেটি আমাকে ধরে স্যারের কাছে নিয়ে গেলে আমি কাঁদতে লাগলাম।
    স্যার বললেন
    — মাঝে মাঝে দেখি তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো।কি জন্য?
    — আপনার লেকচার আমার খুব ভালো লাগে স্যার। আর এমন করবোনা। আমাকে ছেড়ে দিন।
    — না। তোমাকে শাস্তি দিতে হবে।তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
    — স্যার আমি এই কলেজের বি এস সি( কেমিস্ট্রি অনার্সের) প্রথম বর্ষের ছাত্র।
    — ঠিক আছে। তোমার শাস্তি তুমি সামনের সিটে বসবে,যখন তোমার ক্লাস থাকবেনা।

    সেদিন কবি জয়দেব প্রসঙ্গে বলছিলেন। জয়দেব – পদ্মাবতীর কাহিনি বললেন।
    আমি আমার অনান্য সাইন্স ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরে বন্ধুকে সব কথা বললাম।
    ভর দুপুরেও সেই জয়দেবকেই দেখতাম।
    বন্ধুটিকে বললাম। বন্ধু বললো
    –হেলুশিনেশন।
    একদিন বললাম
    – রামদুলাল! আগামীকাল জয়দেব কেঁদুলি যাবি?
    সে এক কথায় রাজি হয়ে গেলো।

    বৈশাখ মাস।
    আমরা দুজনে সকালবেলা বের হলাম। বাসস্যান্ডে গিয়ে দেখলাম বাস নেই। সেসময় বাসের সংখ্যাও কম ছিলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কখন বাস আসবে?
    — কোথায় যাবে?
    — জয়দেব কেঁদুলি।
    — আজ ও কাল বিয়ের দিন। বিয়ের দিনে সব বাস রিজার্ভ হয়ে যায়।
    — কিন্তু আমরা আজই যাবো ঠিক করেছি।আজ রবিবার।
    — পাশেই সাইকেলের দোকান। সেখানে যাও সাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়।
    অগত্যা দুজনে সাইকেল সারানোর দোকানে গেলাম। বললাম
    — আমাদের দুটো সাইকেল ভাড়া দেবেন? আমরা জয়দেব কেঁদুলি যাবো। আমরা হোস্টেলে থাকি।
    তখন মানুষের বিশ্বাস ছিল। আমরা অপরিচিত হলেও বলল
    — হ্যাঁ দেবো।কিন্তু দুটো তো হবেনা। একটা হতে পারে।
    — ঠিক আছে। একটাই দিন।
    আমরা একটা সাইকেলে একজন সামনের রডে বসে পালাপালি করে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ বিকট শব্দে সামনের
    টায়ারটি বাস্ট করে গেলো। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা সাইকেলের দোকানের দেখা পেলাম। সে খুলে দেখে বললো
    — এর টায়ার টিউব দুটোই বদলাতে হবে।কিন্তু আমার কাছে তো নতুন টায়ার টিউব নেই।
    মহা সমস্যায় পড়লাম। দুজনেই হাঁটছি। ফিরে আসার ইচ্ছে নেই।
    অনেক দূর গিয়ে দেখলাম একটা গ্রাম।সেই গ্রামে একজনের বাড়িতে সাইকেল রাখলাম। সে জিজ্ঞেস করল তোমাদের পরিচয় কি? কোথায় যাবে?
    আমরা আমাদের পরিচয় দিয়ে বললাম
    —জয়দেব কেঁদুলি যাবো।
    —সেতো অনেক দূর। এখান থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার। আমরা বললাম
    — আজ বাস নেই। আমরা হেঁটেই যাবো।ফেরার সময় সাইকেল নিয়ে যাবো।
    অগত্যা দুজনেই হাঁটতে লাগলাম। বৈশাখের রোদ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ধু ধু মাঠ।রাখাল বালক গরু চরাচ্ছে। এঁদো ডোবার ধারে গাঁয়ের বধুরা বাসন মাজছে।তপ্ত দুপুরে লু বইছে। সারি সারি তালগাছ।গাছতলায় কেউ কেউ বসে তাড়ি খাচ্ছে। আর নেশার ঘোরে জীবন দর্শন বলছে।
    টাঁ টাঁ রোদে চাষিরা লাঙ্গল নিয়ে লাঙ্গল চালাচ্ছে। কাঠ কুড়ুনি দুটো সোমত্ত মেয়ে জ্বালানির কাঠ নিয়ে ঘরে ফিরছে।একদল আদিবাসী মেয়ে মহুয়া কুড়িয়ে ফিরছে।ধুঁ ধুঁ মাঠে সবুজের দেখা নেই।শুধু খেঁড়ো। লতানে ফসল এই খেঁড়ো আর কচু এ অঞ্চলের এই সময়ের সবজি।
    এদিকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের তেষ্টায় প্রাণ ওষ্টাগত।খিদেতে পেট চুঁ চুঁ করছে।জল একটু জল জ-ল।আর কতদূর কতদূর।

    অনেক দূরে একটা গ্রাম অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাঁটছি তো হাঁটছি।অর্ধমৃতপ্রায়।
    গতিবেগ ধীরে ধীরে কমে আসলেও হাঁটা থামায়নি। “স্লো বাট স্টেডি উইন্স দি রেস।”
    ধীরে ধীরে গ্রামটি স্পষ্ট হলো। ওইতো একটা ঝুপড়ির দোকান। উনানের ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে। দোকানটির কাছে আসতেই মনে একটা বল ভরসা পেলাম।
    বন্ধুটি বললো
    — এতো মুসলিম দোকান!
    — তাতে কি হয়েছে। রামকৃষ্ণ বলেছেন”যতমত তত পথ।”
    কাজি নজরুল লিখেছেন ” মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান “।

    দোকানদারকে বললাম বড়ো তেষ্টা পেয়েছে।একটু জল দেবেন?
    দোকানদার বলল
    — ইনশাআল্লাহ। জরুর দেব। দুজনকে দু ঘটি জল দিল মাটীর কলসি থেকে।
    আমরা বললাম
    — দাদু! আপনার দোকানে কিছু খাবার পাওয়া যাবে?
    — জরুর।মুড়ি আর চপ আছে দিব?
    — হ্যাঁ তাই দিন।
    বৃদ্ধ দোকানদারটি শালপাতার ঠোঙা
    মতো করে আধসের করে মেপে মুড়ি
    দিল আর দুটো করে চপ দিল।মুড়ির উপর জল ঢাললে মুড়িগুলো যতটুকু জল নেবার নিয়ে বাদবাকী সব পড়ে যায়। আমরা আবার আধসের করে মুড়ি ও দু দুটি চপমুড়ি খেয়ে সর্বমোট চার আনা দিলাম।
    চপমুড়ি আর জল খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এই দীর্ঘ পদযাত্রা আমাদের কাছে প্রথম। বন্ধুটি বলল চল ফিরে যায়। আমি বললাম
    শ্রীচৈতন্যদেব পায়ে হেঁটে নব্দ্বীপ থেকে জগন্নাথ ধাম গিয়েছিলেন।
    আর আমরা এই কুড়ি× ২, = ৪০ কিমি হেঁটে যেতে আসতে পারবো না?
    অনুপ্রাণিত হয়ে দুই বন্ধু মিলে কয়েক কিলোমিটার গিয়ে দেখি এক মিষ্টির দোকান
    বিরাট বড়ো বড়ো রাজভোগ দুজনে চারটি নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কত দাম দিতে হবে?
    — চার আনা। ( এখন যার একটির দাম কুড়ি টাকা)
    এক প্যাকেট চারমিনার সিগারেট কিনলাম।
    দাম বলল
    — চারআনা।
    আমরা সব দাম দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
    সূর্য তখন মধ্যগগনে। প্রচন্ড লু বইছে।সারা শরীর জ্বালা করছে। শুনেছি অনেকে সানস্ট্রোকে নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। অনেকে মারাও যায়।

    চলতে চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। জয়দেব কেঁদুলি। পূর্বে নাম ছিল কেন্দুবিল্ব। জয়দেবের সেই কল্পিত পর্ণকুটির ধারে।সামনেই অজয়। অজয়ের জলে স্নান সারলাম। বালি সরিয়ে গর্ত খুঁড়ে জল বের হলে উপু হয়ে বসে মুখ ডুবিয়ে জলপান করলাম।অনেকেই এই পরিশ্রুত জল খাচ্ছে । কলসি ভরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

    রাধামাধব মন্দিরে প্রণাম সেরে বসলাম
    সেই জয়দেবের বাসস্থানের ধারে। এক গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। ভরদুপুরে পথশ্রান্ত বন্ধুটি ঘুমিয়ে পড়লো। আমি জেগে রইলাম।
    মনে পড়তে লাগলো কলেজের বাংলা প্রফেসারের জয়দেব পদ্মাবতী কথা।
    মানসপটে দেখলাম —
    একদিন এমনি এক ভরদুপুরে জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করছেন। রাধাকৃষের প্রেমলীলা।
    কৃষ্ণ রাধাকে কয়দিন সাক্ষাৎ করেনি। তাই
    রাধার মান হয়েছে। তার মান ভঞ্জনের জন্য কয়েকটি শ্লোক লেখার পর লিখেছেন —

    “স্মরগরল খন্ডনম,মম শিরসি মন্ডনম”
    তারপর শ্লোকটি তার মনে আসলেও লিখতে পারছেন না। কি করে লিখবেন? শ্রীকৃষ্ণ তো অখিল ব্রহ্মাণ্ডপতি।
    এমন সময় জয়দেবের সহধর্মিণী পদ্মাবতী এসে বললেন
    — কতো বেলা হলো। এবার স্নান সেরে এসো।আমার রান্না প্রস্তুত।
    কবি জয়দেবের তন্ময়তা ভঙ্গ হলে লেখা ছেড়ে উঠে পদ্মাবতীকে বললেন।
    —আমায় তেল গামছা দাও আমি অজয়ে স্নান সেরে আসি। এই বলে জয়দেব গেলেন স্নানে দূরে অজয়ে।
    অল্প কিছুক্ষণ পরে জয়দেব এসে হাজির। বললেন
    আমি অজয়ে স্নান সেরে ছুটতে ছুটতে শীঘ্রই এসে গেলাম। আমার একটা শ্লোক মনে পড়ে গেলো। তুমি আমায় পান্ডুলিপি কালি ও লেখনী এনে দাও।শ্লোকটা লিখি।
    পদ্মাবতী এনে দিলে শ্লোক লিখে পান্ডুলিপি কালি লেখনী পদ্মাবতীর হাতে দিয়ে বললেন
    — যথাস্থানে রেখে আমায় খেতে দাও। আমি বড়োই ক্ষুধার্ত।
    পদ্মাবতী আজ্ঞা পালন করে অন্ন পরিবেশন করলেন। আর্ধেক অন্নগ্রহণ করে জয়দেব বললেন
    —আজ এই দুপুরে প্রচন্ড গরম,আমি যাই বিশ্রাম করতে।
    আর পদ্মাবতী জয়দেবের পাতে বসে উচ্ছিষ্ট অন্ন খেতে শুরু করেছেন,এমন সময় জয়দেব আসলেন। বললেন আজ একটু দেরি হয়ে গেলো। তারপর পদ্মাবতীকে দেখে
    অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন
    —- একি পদ্মাবতী! তুমি তো স্বামীর খাওয়ার আগে কোনোদিন খাওনা। আজ তুমি আমার আগেই খেতে বসে গেছো?
    পদ্মাবতী আরও আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললো
    — তুমি একটু আগে এসে বললে একটা শ্লোক মনে পড়ে গেলো, আমি খাতা-কলম এনে দিলাম। আপনি লিখলেন। তারপর অন্নগ্রহণ করে বিশ্রাম করতে গেলেন।
    — অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে কবি জয়দেব দেখলেন বিশ্রাম ঘরে কেউ নেই। তার খাতায় পরবর্তী শ্লোক অন্য হাতের লেখায় লিখিত পরবর্তী শ্লোক
    ” দেহি পদপল্লব মুদারম।”
    যে শ্লোকটি তিনি লিখতে পারছিলেন না। এজন্য যে কৃষ্ণ রাধাকে বলছেন, তোমার পদযুগল আমার মাথায় দাও।

    বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখলেন, আবেগে উচ্ছাসে
    পদ্মাবতীর কাছে এসে বললেন
    —তুমি ধন্য পদ্মাবতী। তুমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চাক্ষুষ দেখেছো। তোমার উৎসর্গীকৃত অন্ন নিবেদন করেছো
    এবং সেই উচ্ছিষ্ট অন্ন তুমি খাচ্ছো।তুমিই কৃষ্ণ কৃপা লাভ করেছো। এসো আজ আমি ও তুমি একসাথে অন্ন গ্রহণ করি।
    এই বলে জয়দেব পদ্মাবতীর সাথে অন্নগ্রহণ করতে লাগলেন একই পাতায়।
    সেই থেকে জয়দেব কেঁদুলিতে এলে এখনো স্বামী স্ত্রী একসাথে এক পাতায় খাওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে।
    ধীরে ধীরে আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। গাছে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভেঙে গেলো। বন্ধুকে ডেকে বললাম
    — চল এবার বেরিয়ে পড়ি।
    বন্ধুটি বললো
    — যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। রাতে রাস্তায় খাবার তো দূরের কথা জলও পাওয়া যাবেনা।তাছাড়া আমরা পথক্লান্ত। এখানে রাতটুকু থেকে ভোর বেলা বের হবো।
    অগত্যা আমরা অজয় তীরে এক বৃক্ষতলে রাত্রিযাপন করলাম। শুক্ল পক্ষের অষ্টমীর চাঁদ উঠলো। কি অপরূপ লাগছে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো। মনে পড়লো সেই বাংলা স্যারের কথা।জয়দেব মকরসংক্রান্তিতে প্রতিবছর পায়ে হেঁটে কাটোয়ায় গঙ্গা স্নানে যেতো।একবার পদ্মাবতী পিত্রালয় গিয়েছিল।সে একা। এবার ঘর ছেড়ে কিকরে কাটোয়া যাবে? হঠাৎ স্বপ্নে দেখলো মা গঙ্গা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলছেন
    — আমি তোর নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট। তোকে কাটোয়ায় আসতে হবেনা। আমি নিজেই উজানে কেঁদুলি ঘাটে পৌছবো।দেখবি একটা পদ্মফুল অজয়ে ভেসে আসছে। বুঝবি আমি এসেছি।
    ভোরবেলায় সে দৃশ্য দেখে জয়দেব অজয়ে স্নান সারলো। সেদিন থেকে মকরসংক্রান্তিতে কবি জয়দেব কেঁদুলি ঘাটে অজয়ে স্নান করতো।
    তাই আজও সবাই মকরসংক্রান্তিতে কেঁদুলি ঘাটে স্নান সারে। প্রতিবছর এখানে মকরসংক্রান্তিতে মেলা বসে।লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়।
    আমরাও আজ দুজনেই অজয়ে স্নান সেরে রওনা দিলাম হেতমপুরের উদ্যেশ্যে।
    এবার একটা গ্রামের ভিতর গেলাম। উদ্যেশ্য যদি দোকান থেকে খাবার কিনে নেওয়া।পথমধ্যে খিদে পেলে খাওয়া যাবে।একজন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে খাবারের দোকান কোথায়? আমরা পায়ে হেঁটে হেতমপুর যাবো। আমরা কলেজের ছাত্র।
    গ্রামবাসীটি বললো।
    —বাবাজীবন এতো সাতসকালে কোনো দোকান খুলবেনা।
    অগত্যা আমরা রওনা দিলাম।

    গ্রামপ্রান্তে এক মেঠো পথ দিয়ে চলেছি।হঠাৎ আমাদের পিছনে বোরখা পরা এক মুসলমান মেয়ে আমাদের ডাকছে। আমরা থেমে গেলাম। মেয়েটি কাছে এসে বললো
    — আমি এই গ্রামের বিবি। আপনারা যখন খাবারের দোকান খুঁজছেন ও লোকটির সাথে কথা বলছিলেন তখন আমি বারান্দা থেকে আপনাদের সব কথা শুনেছি।আমার এই গ্রামেই সাদি হয়েছে।আমার বাপের বাড়ি হেতমপুর। আমিও কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে সাদি দিয়ে দিল। পড়া আর হলোনা। আপনাদের যদি আমাদের খাবারে আপত্তি না থাকে তাহলে কিছু খাবার দিতে পারি।আমরা বললাম
    — আমরা ধর্মের ভেদাভেদ মানিনা।আপনি দিন।আমরা নিশ্চয়ই খাবো।
    মেয়েটি বোরখা খুলে খাবার বের করে আমাদের হাতে দিল।অষ্টাদশী মেয়েটি অপরূপা।সে আমাদের একটা পুটুলিতে বাঁধা বাদামভাজা, ছোলাভাজা আর চিঁড়েভাছা দিয়ে বললো
    — আপনারা আমার বাপের বাড়ির দেশের কলেজের ছাত্র। সেজন্য শ্রদ্ধাভরে দিলাম। খিদে পেলে খাবেন। তাহলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।মেয়েটির এই কথা শুনে, তার বিনয়ী আচরণ ও মানবিক মূল্যবোধ অনুভব করে তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
    মেয়েটি ধীরে ধীরে তার গ্রামের পথে চলে গেলো। আমাদের মনের মণিকোঠায় আজও সেই স্মৃতি বিরাজমান।

    আমরা পথ চলছি। ধীরে ধীরে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। চড়া রোদ। লু বইতে লাগলো। খরাপ্রবন অঞ্চল। কোথাও কোনো জনবসতি নেই। আমরা পথ ভুলে অন্য পথে যাচ্ছি।ভরদুপুরে জনমানবহীন রাস্তা।জলাশয় নেই।যতদূর দৃষ্টি চলে কোথাও কোনো বসতির লক্ষনমাত্র নেই। মনে পড়লো
    বঙ্গিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের সেই কবিতা টি।

    “দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
    আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্দ্ধারানিবদ্ধের কলঙ্করেখা॥”

    বন্ধুটি বললো
    আমাদের এই কষ্টের মধ্যে, দুঃখের মধ্যে কবিতা আসে কি করে?
    আমি বললাম
    রামদুলাল! মহর্ষি বাল্মিকী একদিন দুপুরে তমসা নদীতে স্নান করছিলেন সেইসময় একজোড়া পাখি যৌনসঙ্গমে রত ছিল। তখন এক ব্যাধ পুরুষ পাখিটিকে তীরবিদ্ধ করে নিহত করেছিল।
    তখন স্ত্রী পাখিটি মর্মান্তিক দুঃখে শোকাগত।

    মহর্ষি বাল্মিকীর মুখ থেকে এক শ্লোক বের হয়েছিল। মহর্ষি বাল্মিকীর অনেক দুঃখে এই মুখনিঃসৃত বাণী।এইটিই জগতের প্রথম কবিতা

    “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
    যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্”
    বাহ্। তুই সাইন্স স্টুডেন্ট হয়েও অনেক কিছু জানিস দেখছি।

    যাইহোক এখন আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।
    “একটু জলপাই কোথায় বলতে পারিস?”
    আমি বললাম
    — জলপাই এখন কোথায় পাবো? কাঁচা আম চাসতো দিতে পারি।
    দুজনে এভাবে হাসতে হাসতে পথ চলেছি।
    এবার রাস্তার ধারে সত্যিই এক আমগাছের দেখা পেলাম।
    আমরা ঢিল মেরে আম পাড়ার চেষ্টা করছিলাম।
    যদি এই ভর দুপুরে কাঁচা আম খেয়ে তেষ্টা ও খিদে কিছুটা নিবারণ হয়!
    এমন সময় সেখানে হঠাৎ এক ঘোমটা মাথায় মহিলা উদয় হলেন। হাতে পূজার থালা। মাথায় সিঁদুর। আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
    আমরা পরিচয় ও গন্তব্য সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।
    মহিলাটি বললো
    — আমি পুত্রসন্তান কামনা করে সামনে এক শিব মন্দিরে পূজা দিয়ে ফিরছি।
    বলে তিনি থালার সব প্রসাদ ও গ্লাসের জল খাওয়ালেন।
    আমরা দুজনাই তৃপ্ত হলাম।বললেন সামনে ওই গ্রামে আমি থাকি।তোমরা চল আমার বাড়িতে। আমি তোমাদের দুপুরে ভাত খাওয়াবো।
    — আমরা বললাম। আমাদের দেরি হয়ে যাবে।
    — না দেরি হবেনা। যা রান্না করে এসেছি তাই তোমাদের দেব।

    খিদে তেষ্টায় আমরা কাতর।
    তপ্ত দুপুরের রোদে গা ঝলসে যাচ্ছে। দুজনে রাজি হয়ে গেলাম। মহিলার সাথে তার বাড়িতে গেলাম। প্রথমে বাতাসা দিয়ে জল দিলেন। বললেন –যাও কুঁয়াতে গিয়ে স্নান সেরে এসো। আমি ভাত বেড়ে রাখছি।আমরা স্নান সেরে এলে উনি আমাদের সাত তরকারি দিয়ে ভাত পরিবেশন করলেন। আমরা দুপুরে ভোজন করে তৃপ্ত হয়ে প্রণাম করে বললাম
    — আপনি সাক্ষাৎ দেবি।
    এবার আমরা আসি।তিনি আমাদের দুজনকেই রাস্তায় হাত খরচের জন্য দু টাকা করে দিলেন। আমরা অভিভূত হলাম।

    এবার ভাত খেয়ে শরীরে বল পেয়ে ভরদুপুরে রওনা হলাম।
    এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে পথ চলছি।
    বেলা প্রায় তিনটে। তিনটার সময় সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা হয়।
    গ্রীষ্মের দুপুর, তার সাথে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহে আমরা কাহিল।
    বিরামহীন পদযাত্রা।
    চরৈবতি।চরৈবতি।
    ঘন্টা দেড়েক হেঁটে আমরা পৌছলাম সেই গ্রামে যেখানে আমরা ভাড়া করা টায়ার ফাটা
    সাইকেলটি রেখেছিলাম।
    সেই ভদ্রলোকটি অতি অমায়িক। আমাদের সাইকেলটি বের করে আমাদের বললেন
    — এই নাও তোমাদের সাইকেল।আমি সামনের চাকার টায়ার টিউব বদলে নতুন লাগিয়ে দিয়েছি।আমরা তার কথা শুনে বললাম
    — কিন্তু কতটাকা আমাদের দিতে হবে?
    — তোমাদের কোনো টাকা দিতে হবেনা।
    আমরা আশ্চর্য হয়ে বললাম কিন্তু কেন?
    — তোমরা বিপদে পড়ে বিশ্বাস করে আমার কাছে সাইকেল রেখেছো।এইটুকু কর্তব্য করতে পেরে আমি ধন্য।
    — আমাদের কাছে সেই মহিলার দেওয়া টাকা ছিল।আমরা সব টাকা দিয়ে দিতে গেলাম কিন্তু কিছুতেই টাকা নিতে রাজি হলেননা। বললেন তোমাদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দেখে বুঝেছিলাম তোমরা অনেক বড়ো হবে।
    — আমরা দুজনে সেই ভদ্রলোককে প্রণাম করলাম।
    তিনি আমাদের আশীর্বাদ করে বললেন
    — প্রকৃত বিদ্বান হও।
    ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ:
    এবার পালাপালি করে দুজনে সাইকেল চেপে সেই সাইকেল দোকানে পৌছলাম। বললাম
    —ভাড়া কতো দিতে হবে বলুন?
    সাইকেলের দোকানের মালিক বললো
    — সামনের চাকার টায়ারটি দেখছি নতুন।
    আমরা তখন সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে বললেন
    — তোমাদের টাকা দিতে তো হবেনা।কিন্তু আমাকে তোমাদেরকে টাকা দিতে হবে।
    আমরা বললাম
    — আপনাকেও কোনো টাকা দিতে হবেনা। তবে এই ভরদুপুরে প্রচন্ড গরমে আমাদের খুব তেষ্টা পেয়েছে।
    দু গ্লাস জল দিন।
    আমরা জলপান করে হেঁটে হেঁটে আমাদের হোস্টেলে ফিরে এলাম।
    ভরদুপুরের এক অভিযানের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি রয়ে গেলো আমাদের মনের মণিকোঠায়।

    1.  
  • কবিতা

    কবিতা- বলা হলো না

    বলা হলো না
    – শচীদুলাল পাল

    সেদিনের তোমার বালিকা বেলা
    কত গান হাসি খেলা।
    কেটেছে কৈশোর যৌবন কাল
    কত বসন্তের দীর্ঘকাল।
    অন্তরে তোমার আমার আশা
    ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা।
    হৃদয় মথিত হয়েছে পল পল
    হৃদয় মনে স্মৃতি সচল।
    আনন্দ উচ্ছাসের পল দন্ড
    হঠাৎ ঝড়ে হলো লণ্ডভন্ড।
    তোমার গৃহাঙ্গনে নহবতের সুরধারা
    আমার নয়নে সহস্র বারিধারা।
    তোমার আমার অপলক দৃষ্টি।
    বিধাতার বিধানে কি অনাসৃষ্টি।
    তোমার আমার রয়ে গেল অবলা
    হলোনা একসাথে পথ চলা।
    তুমি ছাড়া আমার দিন কাটেনা।
    নিস্তব্ধ রজনীতে ঘুম আসেনা
    কতখানি সুখে আছি কেউ জানেনা
    আমার চোখে কারোর চোখ পড়ে না।
    মেঘলা আকাশে রিমঝিম বৃষ্টি পড়েনা।
    মলয় বাতাসে ঘরে সুখ আসেনা
    তুমি ছাড়া বিবর্ণ পৃথিবীতে কিছু ভাল্লাগেনা।
    বিষন্ন দিন কাটেনা, টবে ফুল ফোটেনা।
    রিমঝিম বৃষ্টিতে সুর তোলে না।
    অস্তরাগে নদীজলে কারোর ছায়া পড়েনা।
    আমি তোমায় ভালবাসি কেন বলা হলোনা।
    তোমার নয়নের ভাষা কেন পড়লাম না।
    হৃদয়ের কথা হৃদয়ে রয়ে গেল বলা হলো না।

  • কবিতা

    কবিতা-হারিয়ে গেছে

    হারিয়ে গেছে
    শচীদুলাল পাল

    হারিয়ে গেছে অনেক কিছু সকাল থেকে রাত,
    ধুকপুক বুকে প্রথম প্রেমে প্রেমিকার ধরা হাত।
    হারিয়ে গেছে দম দেওয়া সেই কলের গান।
    ইথারে ছড়িয়ে থাকা তোমার গানের প্রাণ।
    টেলিগ্রাফের বার্তা ছিল টরে টক্কার কালে,
    নোলোক পরে পালকি চড়ে যায়না ঘোমটার আড়ালে।
    দেখিনাতো গড়গড়া আর হুঁকা, শুনিনা গুড়গুড়।
    আসল মাখা সন্দেশ, লেংচা মোয়া নলেন গুড়।
    হারিয়ে গেছে ঢেঁকি যত আওয়াজ ধুপুস ধুম।
    ছাঁদনা তলায় ছড়া পড়া, বাসর জাগার ধুম।
    হারিয়ে গেছে চড়াই পাখীর কিত্ কিত্ সেই খেলা,
    ঘোমটা খানা নতুন বধুর লাজুক চক্ষু মেলা।
    হারিয়ে গেছে ছন্দ মধুর যৌথ পরিবার।
    মস্ত উঠোন চতুর্দিকে দালান কোঠা তার।
    হারিয়ে গেছে গাঁয়ের পথে ছাউনি গরুর গাড়ী।
    হারিয়ে গেছে কু-ঝিক্ ঝিক্ রেলপথে দূর পাড়ি।
    হারিয়ে গেছে একতলা আজ বহুতলের জন্য,
    থাকছে গাড়ী ভুমিতলে এই মুলেতেই ধন্য।
    বড় বউয়ের আঁচলে আর নেইকো চাবিকাঠি,
    সতীন নিয়ে ঘর করেনা হয়না জীবন মাটি।
    হারিয়ে গেছে সহিষ্ণুতা আদর্শবাদী জুটি
    হারিয়ে গেছে দামী চুরুট শালপাতারই চুটি।
    হারিয়ে গেছে সদ ভাবনা শ্রদ্ধা কোমল মন
    হারিয়ে গেছে জীবন থেকে সঠিক আপনজন।

  • কবিতা

    কবিতা- শুধু তোরই জন্য

    শুধু তোরই জন্য
    শচীদুলাল পাল

    আজ আমি নিঃস্বা রিক্তা ধর্ষিতা এক রমনী,
    সমাজের বিচারে পারিনি হতে তোর ঘরনি।

    ছোটোবেলার প্রেমের পরিনামে হয়নি পরিণয়,
    আমার দেহমনে দিয়েছিলাম তোকেই ঠাঁই।

    দেহ আজ অচ্ছুৎ হৃদয় মন হয়নি অপবিত্র,
    রুক্ষ শুষ্ক অবনিপরে পড়ে নাই বৃষ্টি বিন্দুমাত্র।

    দেহটা কেড়ে নিয়ে গেলো এক আকস্মিক ঝড়ে
    ছিন্নভিন্ন করলো শার্দূল দল রাতের অন্ধকারে।

    কেটে গেছে কতশত বিনিদ্র রজনী
    আজ তোর শয্যাসঙ্গিনী অন্য কোনো রমনী।

    তোর আমার রয়ে গেল কিছু কথা অবলা
    হলোনা দুজনার হাতে হাত রেখে পথ চলা।

    মেঘলা আকাশে রিমঝিম বৃষ্টি পড়েনা।
    নাতিশীতোষ্ণ মলয় বাতাসে ঘরে সুখ আসেনা।

    তুই ছাড়া বিবর্ণ পৃথিবীতে কিছু ভাল্লাগেনা।
    অস্তরাগে নদীজলে কারোর ছায়া পড়েনা।

    আমি তোকে ভালবাসি কেন বলা হলোনা।
    তোর নয়নের ভাষা কেন পড়লাম না।

    বালিকা বেলায় তপ্ত দুপুরে গাছের তলায়
    ঘনঘোর বর্ষায় তুই আমি এক ছাতার তলায়

    শরতের কাশফুলে মেঘমুক্ত জ্যোৎস্নালোকে
    তোর চোখে চোখ রেখে খুঁজেছি ম্লান আলোকে।

    নিত্যনতুন সাজে সারারাত ঘুরেছি পুজা প্যান্ডেলে।
    দুজনে ছুটেছি হেমন্তের সোনালী ধানের আলে।

    নদীজলে যখন আমি ডুবন্ত মরনাপন্ন।
    আমার উদ্ধারে করেছিস নিজ জীবন বিপন্ন।

    তোর স্পর্শ ভরে আছে আজও সর্বাঙ্গ
    শুধু তোর জন্য প্রতিক্ষারত আমার অঙ্গ।

    হৃদয়ের কথা হৃদয়ে রয়ে গেলো আজও তুই অনন্য
    অনন্তকাল আছি প্রতিক্ষায় শুধু তোরই জন্য।

  • গল্প

    গল্প- মহানুভবতা

    মহানুভবতা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    স্টেশন শ্রীরামপুর । প্রায় ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে পড়লো ফিজিক্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মনীষা। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ট্রেনটি ধরতে না পারলে তার সঠিক সময়ে ফিজিক্স স্যারের কাছে লিলুয়ায় টিউটোরিয়ালে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অন্যদিন লেডিসে ওঠে।লেডিস কম্পার্টমেন্ট দূরে ছিল তাই
    আজ সামনেই জেনারেল কম্পার্টমেন্টের ভীড়ে ঠাসা লোকালে উঠতে বাধ্য হলো সে।
    ১৯ বছরের ফর্সা সুন্দরী ছিপছিপে গড়ন, আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।সে ট্রেনের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এক রুক্ষ শুষ্ক চুল,মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধ ময়লা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ।সে অনেকটা কাছে এসে তার হাত চেপে ধরল।মুখে যেন কি সব বলছে।মনীষা রেগে চীৎকার করে উঠলো।
    — অসভ্য! জানোয়ার!
    লোকটা আরও জোরে হাত চেপে ধরলো। মনীষা বললো
    — ছাড়ুন। হাত ছাড়ুন।
    সাথে সাথে ট্রেনের লোকজন বুড়োটাকে মারতে মারতে বললো
    –বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। কামুক বুড়ো! মার শালাকে।
    বুড়োকে মেরে তারা বীরত্ব প্রকাশ করতে লাগলো। মেরে তার পাঞ্জাবি ছিড়ে দিল।মুখে এমন ভাবে মারলো কপাল কেটে ঝরঝর রক্ত ঝরতে লাগলো। ঠোঁট ফেটে রক্তের ধারা বইতে লাগলো।
    আরও যাদের হাত নিসপিস করছিল তারাও এসে মারতে মারতে পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।মনীষা ট্রেনের জানালায় এক ঝলক দেখলো রক্তাক্ত বৃদ্ধটি গোঁগাচ্ছে।
    পুরো কম্পার্টমেন্ট বুড়োটার বিরুদ্ধে নানান কটুক্তি ও আদিম রসের রসদ পেয়ে কুৎসায় মসগুল হয়ে গেলো।
    একজন বুদ্ধিজীবী বলছিল
    –এক রকমের পুরুষ আছে এই পৃথিবীতে। কামনার আগুনে জ্বলছে।মেয়ে দেখলে তাদের স্পর্শ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
    এইসব বিকৃত মস্তিষ্ক পুরুষ জাতি দেশ ও সমাজের শত্রু।

    সপ্তাহে একদিন সে টিউশন পড়তে আসে লিলুয়ায়। লিলুয়ায় নেমে আজ সে একটা রিক্সা নিল। অন্যদিন পায়ে হেঁটেই যায়। সারা শরীর কাঁপছে।
    তার মনে হলো আজ তারই জন্য বৃদ্ধটির এই হাল হলো। সে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে লাগলো। বুড়োটা কি যেন তাকে বলছিল!

    টিউটোরিয়াল কক্ষে সে আজ সব শেষ বেঞ্চে বসলো। আনমনা।কিছুই তার ভালো লাগছে না।৯৫% মার্কস পেয়ে সে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে।টিউটোরিয়াল হোমে ও কলেজের ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট।
    স্যার তাকে গতকালের পড়ানো থেকে প্রশ্ন করলেন। মনীষা থতমত হয়ে বলতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরে আসবার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরলো। জানালা দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে এলো উল্টো দিকের সেই প্লাটফর্মে সেই বৃদ্ধটি পড়ে আছে। সে তড়িঘড়ি করে নেমে বৃদ্ধটির কাছে গিয়ে দেখলো শীতে জুবিথুবি হয়ে প্লাটফর্মেই পড়ে আছে। বৃদ্ধটির কপাল ও ঠোঁট দিয়ে রক্তটা জমাট বেঁধে আছে। উস্কোখুস্কো চুল, শতছিন্ন পাঞ্জাবি ।কেউ ভিখারি ভেবে কিছু রুটি দিয়েছিল। সেগুলো কুকুরে টানাটানি করছে। মনীষা ব্যাগ থেকে চাদর বের করে বৃদ্ধটির গায়ে জড়িয়ে দিল।
    রুমাল দিয়ে বৃদ্ধর রক্ত মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো আপনার নাম কি?
    বৃদ্ধটি বললো
    — জানি না
    বাড়ি কোথায়?
    — জানিনা, ভুলে গেছি।
    আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
    — মনে নেই।
    এবার সে মনীষাকে বললো
    — আমি বাড়ি যাবো।
    এবার মনীষার মনে হলো এই কথাটাই সে হাত ধরে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট স্বরে বারবার বলতে চাইছিল কিন্তু চলন্ত ট্রেনের শব্দে ও পাবলিকের চেঁচামেচিতে সে শুনতে বা বুঝতে পারেনি।
    এবার মনীষা বৃদ্ধটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।এবার সে নিজেই শক্ত করে তার হাত ধরলো। আপ ট্রেনের প্লাটফর্মে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠালো। তার নিজের স্টেশন শ্রীরামপুর আসলে বৃদ্ধটিকে নিয়ে হাত ধরে নামিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ঘরে এলো।
    মা বাবাকে সব কথা বর্ণনা করে শুনালো।আদর্শবাদী পিতা তার বর্ণনা শুনে মেয়ের প্রশংসা করে বললো
    — উপযুক্ত কাজ করেছিস মা।
    — বাবা, আমিতো তোমার কাছ থেকে আদর্শ মানবিকতা ও শিষ্ঠতার জ্ঞান লাভ করেছি।
    — কিন্তু ঘরে রাখলে কোনো সমস্যা হবেনা তো?
    — না বাবা। আমি দেখবো বৃদ্ধকে।
    মাকে বললো জল গরম করতে।
    নিজে হাতে দুধ সুজির হালুয়া বানালো। জল গরম হয়ে গেলে বৃদ্ধটিকে স্নান করালো। ঘসে ঘসে শরীরের নোংরা উঠিয়ে দিল।বাবাকে বললো একটা তোমার পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে দাও।ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল।
    লক্ষ করলো বৃদ্ধটির চোখমুখে এক আভিজাত্যের ছাপ।
    ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে
    চামচে করে খাওয়াতে গেলো।
    –খান।
    বৃদ্ধটি ঘাড় নেড়ে বললো
    খাবেনা।
    এবার মনীষা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে আনলো। ধমক দিয়ে বললো
    — খাও। তোমাকে খেতেই হবে।
    এবার ধমক খেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো এক চামচ খেলো।
    দ্বিতীয় চামচের বেলায় আবার ধমক। এভাবে তাকে পেট পুরে সবটাই খাওয়ালো।
    মুখ মুছিয়ে দিয়ে সিঙ্গল বেডের ঘরটিতে নিয়ে শুইয়ে দিল। মশারী খাটিয়ে চারিদিক গুঁজে দিল।
    কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।
    মনীষা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বৃদ্ধটির ঘরে গিয়ে দেখলো, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
    সে তাকে বিরক্ত না করে পড়তে বসলো। ফিজিক্সের একটা অঙ্ক সে কিছুতেই পারছে না। অন্যদিন ঝটপট করে ফেলে। আজ তার মনে বিরক্তির ভাব।
    হঠাৎ তাকিয়ে দেখলে গুটি গুটি পায়ে কখন এসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধটি। সে খাতাটি টেনে নিল। পেন নিয়ে অবশিষ্ট অঙ্কটি কাঁপা কাঁপা হাতে করে দিল।
    মনীষা হতবম্ব হয়ে গেলো। এটা কি অলৌকিক! এ কিভাবে সম্ভব। ইনি কে? কি তার পরিচয়? ইনি তো সাধারণ মানুষ নন। ছুটে গেলো বাবা মার কাছে। সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললো। তারা এসে জিজ্ঞেস করলো।
    –কি নাম আপনার? কোথায় থাকেন? বাড়িতে কে কে আছে? বৃদ্ধ লোকটি বললো
    — ভুলে গেছি। মনে করতে পারছিনা।
    আপনার বাড়ির ফোন নম্বর বলুন।
    এবার সে কষ্ট করে স্মৃতি হাতড়ে মনে করে একটা নম্বর বললেন।
    মনীষা সামনে ফিজিক্স খাতাতেই লিখে নিলে।
    অমিত মিত্র কল করলেন। রিং হচ্ছে।
    একবার দুবার কিন্তু কেউ উঠাচ্ছে না।
    কিছুক্ষণ পর তৃতীয় বার চেষ্টা করতেই অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো
    — আমি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়ের ছেলে ডাঃ হিমাদ্রি রায় বলছি। অমিত বাবু ভাবলো, যে ছেলে নিজের নামের আগে পিতার নাম আগে বলে সে নিশ্চয়ই কোনো আদর্শ পুত্র।
    — কাল থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার ঘরে রয়েছেন। উনি নাম বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারছেন না। মনে হয় স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করে এই নাম্বারটা উনি বলতে পেরেছেন।
    — আপনি লোকটার বিবরণ বলুন।
    অমিতবাবু সংক্ষেপে বর্ননা করলেন।
    ডাঃ হিমাদ্রি অপরপ্রান্ত থেকে বললেন
    — হ্যাঁ। আমার বাবা।প্রফেসার সমুব্ধ রায়।আমি তার পুত্র ডাঃ হিমাদ্রি রায়। বাবা আজ দিন কয়েক থেকে নিখোঁজ। খুঁজেছি নানাভাবে অনেক। কিন্তু পাইনি।আপনার ফোন পেয়ে অনেক আনন্দিত। আমি মাকে নিয়ে এখনই আসছি।
    মনীষা ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে বললো
    —এই যে স্যার। আপনার নাম কি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়?
    ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
    আপনার ছেলের নাম কি ডাঃ হিমাদ্রি রায়?
    — কিছুই মনে পড়ছে না।
    মনীষা স্নান করিয়ে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে, চুল আঁচড়ে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে বললো
    —এখুনি আপনার ছেলে আসবে আপনাকে নিতে।
    বাধ্য শিশু যেমন মায়ের দিকে নির্ভয়তায় চেয়ে থাকে তেমনি ভাবে অপলকে চেয়ে রইলো বৃদ্ধটি।
    অনেকক্ষণ পর এক দামী গাড়ি এসে থামলো বাড়ির গেটের সামনে। নেমে এলেন ডাঃ হিমাদ্রি রায় ও তার মা।
    ঘরে এসে অমিত বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন।
    অমিতবাবু বললেন
    — এ সব সম্ভব হয়েছে আমার কন্যার জন্য।
    এবার সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়ীতে উঠাতে যাবেন তখন প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলেন মনীষাকে।তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো,বললেন
    — আমি বাড়ি যাবো।
    এরপর একবছর কেটে গেছে।
    প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়, একদিন স্ত্রী মনোরমা, পুত্র ডাঃ হিমাদ্রিকে নিয়ে এক বিশাল গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে মনীষাদের বাড়িতে এলেন। সেদিন ছিলো ছুটির দিন।মনীষা ও তার বাবা মা বাড়িতেই ছিলো।
    মনোরমা বললেন
    — আজ আমার স্বামীকে ফিরে পেয়েছি আপনাদের মহানুভবতার জন্য।
    অমিত বাবু বললেন
    — সব কৃতিত্ব আমার কন্যার।
    ডাঃ হিমাদ্রি বললেন
    — বাবার সর্ট টার্ম মেমোরি লস হয়েছিলো। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
    এবার প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় এগিয়ে এসে বললেন
    — আমি একটা ভিক্ষা চাইছি।
    আপনারা রাজি থাকলে দেবেন।
    –বলুন। কি চাইছেন?
    — আমি আপনার মেয়ে মনীষাকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চাই।
    মনীষার বাবামা বললেন
    — এতো আমাদের সৌভাগ্য।
    আনন্দে মনীষার দুচোখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
    প্রফেসর সম্বুদ্ধ স্যার ও মনোরমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো।সম্বুদ্ধ স্যারের হাত শক্ত করে ধরে বললো
    ” আমি বাড়ি যাবো “।
    নিদিষ্ট দিনে মনীষা ও হিমাদ্রীর মহা ধূমধামে বিয়ে হয়ে গেলো।

You cannot copy content of this page