-
কবিতা- গোগল্
গোগল্
– শান্তনু বন্দোপাধ্যায়ইউক্রেন ছেড়ে মস্কোতে এসে,
পুশকিনের সাথে হলো পরিচয়,
গল্পের ফাঁকে লিখলেন বসে,
‘গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর’ গোগল মহাশয়।ব্যঙ্গে-রঙ্গে ভরা মজাদার নাটক,
দেড়শো বছরেরও আগে যে লেখা,
প্রতিবাদে হতে হয় এখনও আটক,
সময় থেকে হয়নি এখনও শেখা।কালজয়ী হয়েছেন একবারে নয়,
একঘেয়েমী কাটাতে কলমে মনন,
ছোটো গল্প শুরু না করে কালক্ষয়,
আজও তাই লোকে তাকে করে স্মরণ।দি নোস্, দি ওভারকোট,
হলো ছোটো গল্পের সেরা জোট।
যে কথা বলবার এখানে,
দাঁড়িয়ে আজও আমরা সেখানে। -
কবিতা- রাসপুটিন
রাসপুটিন
– শান্তনু ব্যানার্জীশহরে এসে সাধু আজ সাইবেরিয়ার চাষা,
অসুস্থকে সুস্থ করে তীব্র চোখের ভাষা।
খবর পৌছোয় রাজপ্রাসাদে জাগিয়ে অনেক আশা,
হত্যে দিয়ে রানীমা পেলেন নূতন ভালোবাসা।ভ্রাতা- ভগ্নী বিয়োগে তখন বড় একা,
গ্রামে গ্রামে ঘুরে পেলেন নিত্য জীবনসখা।
পুত্র কন্যা গ্রামে রেখে এলেন শহরে,
অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতে ডাক এলো দরবারে,রাজপুত্রের রক্তক্ষরণ বন্ধে ব্যর্থ বদ্যি সবাই,
নূতন সাধুর আগমনে বন্ধ হলো লড়াই।
সুস্থ হলেন রাজপুত্তুর অনেক কিছুই পেলেন সাধু,
অন্তিমে বাকী রইল লক্ষ্য পূরণে ক্ষমতা শুধু।রাজা গেলেন যুদ্ধে, রাণীর হাতে রাজ্য,
সাধুর মতে চলল দেশ, সকলে করলো সহ্য।
যুদ্ধ ফেরত রাজাকে মানলো না কোনো প্রজা,
পারিষদ বর্গ একজোট হয়ে হত্যায় দিল সাজা।গুপ্তঘাতক সাধুর খাবারে মেশায় সেঁকো বিষ,
রাজতন্ত্রের অবসান হলো মিটলো জন প্রতিষ। -
কবিতা- দস্তয়ভস্কি উবাচ
দস্তয়ভস্কি উবাচ
– শান্তনু বন্দোপাধ্যায়বোকারা বলে বেশী কথা প্রয়োজন ছাড়া,
সর্বদা মনের আনন্দে থাকে হয়ে আত্মহারা।
প্রকৃতি, আত্মা, ভালোবাসা হৃদয় ভরে থাকে,
মস্তিষ্ক সেখানে অপাংক্তেয় যুক্তি ধরে রাখে।পুষে রাখা রাগে জন্ম নেয় হতাশা,
হতাশা অনুদিত মনে লালিত জিঘাংসা।
সভ্যতার মাত্রা জানা যায় সে দেশের কারাগারে,
ঈশ্বরহীন সমাজে সবকিছুর অনুমতি এই বিশ্বসংসারে।শিশুদের সাথে থাকলে আত্মা শান্তি পায়,
তাড়িয়ে অ-সুখ সুখসন্ধান তখনি পাওয়া যায়।
স্বপ্নে যে প্রেম হয় তা বড়ো মোহময়,
জীবন রঙ্গে স্বপ্ন ভঙ্গে হয়ে যায় মৃন্ময়।বুঝিনা আমরা ভুল যারা করে তাদের বলি পিশাচ,
যা কথা হলো সবই কিন্তু দস্তয়ভস্কি উবাচ।। -
কবিতা- অন্য আবেগ
অন্য আবেগ
(মায়াকোভস্কি অনুসরণে)
– শান্তনু বন্দোপাধ্যায়রাতটা ছিল বুঝে নেবার,
যদি সে এবং আমি
প্রেমিক যুগল হতে পারি
রাঁতের আধারের আচ্ছাদনে,
দেখ কেউ কিন্তু দেখতে পেত না।সত্য আমি তার উপর ঝুঁকে ছিলাম,
যা করেছিলাম সেটাও সত্য।
আমি বলেছিলাম দয়ালু পিতার মত,
এ সব আবেগে চর্বি।
অতএব তুমি কি দূরে চলে যাবে না?
দূরে চলে যাও প্লিজ। -
কবিতা- সেলাম সাহসী শ্বেতলানা
সেলাম সাহসী স্বেতলানা
– শান্তনু বন্দোপাধ্যায়ছোট্ট দেশের মেয়ের আজ অনেক বয়স,
চুম্বক চোখে, সন্ধানী মনের জন্ম বেলারুশ।
একবিংশ শতাব্দী শুরুর বছরে হল ইতিহাস,
রুশভাষায় স্বেতলানার লেখায় এলো সভ্যতার পরিহাস।অভাবনীয় ছিল স্বেতলানার কাছে নোবেল জয়,
কলমে চেরনোবিল তুলেছিল ঝড় স্বেতলানা অকুতোভয়।
নির্ভীক সাংবাদিকতায় নজরে ছিল সোভিয়েট – আফগান যুদ্ধ,
বহুস্বরভুক্ত লেখায় তার সাহিত্য হল সমৃদ্ধ।রাশিয়া, ইউক্রেন, পোলান্ড, লিথুনিয়া, লাটাভিয়া চারপাশ,
বেলারুশের বাবা, ইউক্রেনের মায়ের যত্নে স্বেতলানার বিকাশ।
তবু তাকে ছাড়েনি বেলারুশ করেছিল তাকে বদ্ধ,
চিকিৎসার জন্য জার্মানী গেলেন মুচলেকায় কন্ঠরুদ্ধ।রাজনীতির প্যাঁচের বাঁধন খুলে আরো স্বেতলানা আসুক,
সারাবিশ্বের শূন্য গহ্বরে অনেক অনেক প্রতিবাদ আনুক। -
কবিতা- ত্রিভুজ
ত্রিভুজ
– শান্তনু বন্দোপাধ্যায়1917-এর অক্টোবর – নভেম্বরে,
পুরনো নুতন ক্যালেন্ডারে,
শেষ জারের হলো পতন,
রুশ বিপ্লবের বীজ বপন।চে-মারাদোনা দুটি নাম,
ডাক্তার- ফুটবলার জনতার প্রাণ,
লেখক থেকে যোদ্ধা গেরিলা,
আর্জেন্টিনা ছেড়ে পৌছাল কিউবা।বাতিস্তা তাড়িয়ে ফিদেল প্রেমী,
লাতিন আমেরিকার শ্রমিক শ্রেনী,
দেখল এবার বলিভিয়ার পাশে,
চে এসে জুড়ল বসে।ঘাতকের হাতে মৃত্যু চের,
ফুটবলার হলো এক ফিদেলিস্তা,
বিপ্লবের হাওয়া ছড়িয়েছে ঢের,
বাড়ে দমন পীড়নের আপেক্ষিকতা।হারিয়েছি অনেক আগেই দুটি বাহু,
মারাদোনার মৃত্যুতে ত্রিভুজ হবে না কভু।। -
কবিতা- মরুদ্যান
মরুদ্যান
– শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়পুবের আকাশে সূর্যের ছটা আজ ধূসর,
মর্টারের আওয়াজ শুষে নিয়েছে উৎসবের কাঁসর।
অহর্নিশ ছুটছে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁজোয়া গাড়ী,
আশ্রয় খোঁজে দিনভর শিশুকোলে বৃদ্ধ ও নরনারী।অভুক্ত শরীরের দায় নেই কখনো কারোর,
জিততেই হবে যুদ্ধে এই সীমান্ত শহর।
গ্যাব্রিয়েল, ভ্লাদিমির, আসগর, বলবিন্দার,
কেউ কর্নেল বা সৈনিক বা কেউ ডাক্তার।দমবন্ধ করা পোড়া গন্ধে চারদিকে হাহাকার,
ঝলসানো গাছের কালো ধোঁয়ায় নিঃস্তব্ধ অন্ধকার।
এসেছে অর্ডার জলদি জলদি সামনে এগোবার,
কঠিন মুখে রয়েছে শুধু সংকল্প দুর্বার।কেউ চুক্তিতে, কেউ চাকরীতে মায়ার বন্ধন খোলে,
সীমানা বলে কিছু নেই আর মনের অর্গলে।
প্রশ্রয় পায় নিষ্ঠুর আদিমতা মানবিকতা ভুলে,
মায়া, মমতা,ভালোবাসা সব শিকেয় তুলে।এক সৈনিকের দৌলতে এক দলছুট শিশুর বেঁচে যায় প্রাণ,
দুরুহ পরিবেশে মা বাবা যেন খুঁজে পায় মরুদ্যান। -
গল্প- সহজিয়া কথা
সহজিয়া কথা
– শান্তনু ব্যানার্জীএ লেখাতে সহজিয়া কথাটা আভিধানিক নয়। জীবনের যাত্রা পথে সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের স্পর্শে নিজেকে সম্মানিত মনে হয়েছে। স্বল্প পরিসরে সামান্য কিছু ঘটনার একটা কোলাজ। একটু আদর মিশিয়ে তাদেরকে আমি বলি সহজিয়া। গ্রামকে গ্রাম হিসেবেই দেখেছি। তাদের dialect বা বিশেষ জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়নি। বলা বাহুল্য সব ঘটনাই বহু বছর আগের। অবশ্যই গ্রামীণ পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে।
মুড়ির ঠোঙা মার্কা একটা লোকাল বাস। সন্ধ্যার সময় যাত্রা করে পরের দিন সকালে পৌঁছবে। বাসের লোকজন সকলেই পাহাড়ি। পাহাড়ি পথে বাস এগিয়ে চলেছে। দূরে টিম টিম করে গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলো জ্বলছে। রাত সাড়ে আটটায় বাসটা একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো। দশ মিনিটের জন্য। চা আর বাঁধাকপির বড়া পাওয়া যাচ্ছে। শীতের রাত। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। যখন রাত এগারোটা, তখন ড্রাইভারের মর্জিতে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। রাতটা এখানে থাকবে। ড্রাইভারের ঘুম পেয়েছে। অর্থাৎ সকালে পৌঁছনো হবে না। বেলা গড়িয়ে বারোটা বেজে যাবে। চেঁচিয়ে লাভ নেই। যাত্রীরা এরকম ঘটনায় অভ্যস্ত। সবাই নিজের নিজের থাকার জায়গা খুঁজে নেবে। আমার পাশে বসা মানুষটির সাথে আগেই আলাপ হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু আমি যেন চাইনিজ বলে নিজেকে পরিচয় দিই। কারণ এখানে চাইনিজদের খুব খাতির করে। আমি ভাবলাম যে আমাকে কি চাইনিজ বলে মনে হয়। যাই হোক ওর সরল বিশ্বাসে বাঁধা দিলাম না। কিন্তু যেখানে থাকার ব্যবস্থা হল তা একেবারেই অনুপযুক্ত জায়গা। কিছু করার নেই এক রাত কাটাতে হবে। পরের দিন ভোরে গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিন্তু কিছুটা গিয়ে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। মিস্ত্রি না আসা পর্যন্ত গাড়ি কি হবে বোঝা যাবে না। সেই লোকটিই বললো, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। হেঁটে গেলেও পৌঁছে যাব। অগত্যা রাজি হলাম। রাস্তা বলতে কিছু নেই। সঙ্গের লোকটি অভিজ্ঞ। পথে কারো ফেলে যাওয়া খালি সিগারেট প্যাকেট, চুয়িংগামের মোড়ক দেখে দেখে এগোতে শুরু করলো। এখানে অন্ধকার হলে ভালুকের ভয়। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের অপর সীমানায় পৌঁছলাম। তখন বেলা তিনটে। একজায়গায় পৌঁছতে আমাকে বিশাল বড় থালায় ভর্তি গরম সুজির হালুয়া দিয়ে গেল। চার চামচ খাবার পর থালাটা ফেরত দিতেই দেখলাম থালাটা অন্যদের এগিয়ে দিচ্ছে।
নিমন্ত্রিত হয়ে একবার একটা আধাশহর আধাগ্রামে উঠেছিলাম পল্লব ভদ্রের বাড়িতে। পৌঁছতেই এক গ্লাস লেবুর সরবত এসে গেলো। পল্লব জানত আমার সিগারেটের নেশার কথা। তাই জোর করেই পাঁচ প্যাকেট ক্যাপ্সটেন আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। তখন এই ব্র্যান্ডের একটা স্ট্যাটাস ছিল। কিছু কম দামী ব্র্যান্ড ছিল যেগুলো বহুবছর উঠে গেছে। যেমন পাশিং শো, কুল ইত্যাদি। আমার ঠোঁটে সিগারেট কখনো নিভতো না। প্রচলিত ছিল যে, মুখ তো নয় মনিকর্নিকার ঘাট।
কথা হল পরদিন গ্রামের বাড়িতে চড়কের মেলায় নিয়ে যাবে। বললাম, সন্ধ্যায় একটু আশপাশটা ঘুরে দেখি …..
রাস্তায় খুব ধুলো। কিছু দূর অন্তর লাইটপোস্টে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব লাগানো আছে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে তখনকার বেডফোর্ড ইঞ্জিন ছুটে যাচ্ছে। কচ্চিৎ লেল্যান্ড ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছিল।
রাস্তার ধুলো খুব রোল করছিল। এর মধ্যেই রাস্তার এক কোনে একটু ভীড়। ফুলুরি ভাজা হচ্ছে। আমরাও খেলাম।
পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম জলখাবার খেয়ে, গ্রামে লাঞ্চ হবে। তারপর চড়কের মেলায় মজা করে ফিরে আসব। গ্রামের যেখানে আমাদের বিশ্রামের ব্যাবস্থা ছিল সেখানে আগে থেকেই খাটিয়া পাতা ছিল। পৌঁছতেই আমরা আপ্যায়িত হলাম রেকাবিতে করে ছানা আর চিনি সমেত। আন্তরিকতাটাই আলাদা। তার সঙ্গে আমার সিগারেট খাওয়া চলছেই। একটা নাদুস নুদুস আঠারো, ঊনিশ বছরের ছেলে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হাসছে। চোখাচোখি হতেই বললাম, একটা ছাইদানি নিয়ে আসতে। ছুটে গিয়ে একটা প্লেটে কিছু ছাই নিয়ে চলে এলো। সপ্রতিভ কিন্তু সরল এবং সহজিয়া।
চড়কের মেলায় আনন্দ করে ফেরার পথে পল্লব জানালো যে পরের দিন সকালে আমাকে কাছে একটা ড্যামে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সন্ধ্যাতে আমার ফেরার ট্রেন।
ড্যামে পৌছে বেশ ভালো লাগছিল। চন্দ্রশেখর ঢালি বলে একজন অল্পবয়সী সদ্য বিবাহিত মাস্টার মশাইয়ের সাথে আলাপ হলো। কাছেই স্কুল। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন একটু বেড়াতে। এর মধ্যে শুনলাম এখানে সস্তায় টাটকা বড় মাছ ফিসারি অফিস থেকে পাওয়া যায়। ইচ্ছে হলো পল্লবকে একটা মাছ প্রেজেন্ট করি। তাই করলাম। একটা পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা মাছ। পল্লব বললো, এতটা মাছ খাবার লোক নেই। বরং মাস্টার মশাই কিছুটা নিন। মাছ কাটার ব্যবস্থা চলছে সেই সময় আর একটি অল্প বয়সী ছেলে এসে দাঁড়ালো। কলকাতা থেকে একাই এসেছে আর মাসির বাড়ি উঠেছে। কয়েক দিন থাকবে। এল আই সি তে কাজ করে । বললো, ও এখানে পারমিশন নিয়ে স্পিড বোটের ব্যাবস্থা করতে পারে। মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী উৎসাহিত হতেই এক দৌড়ে গিয়ে সব ঠিক করে এলো। মাছ কাটার কাজ চলছে। মাস্টার মশাই বাইনোকুলারটা ছেলেটাকে হাতে ধরতে বলে মাছগুলো গোছাতে শুরু করলো। এর মধ্যেই স্পিড বোট এসে গেছে। মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী চড়ে বসলেন। ছেলেটিও চড়ে বসলো। কিছু বোঝার আগেই বোট ছেড়ে দিল। মাছ গুছিয়ে হাত ধুয়ে মাস্টার মশাই দাঁড়িয়ে রইলো। স্পিড বোট অনেক দূরে চলে গেছে। একঘন্টার চুক্তি। কাউকে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে। ওর হাতেই তো মাস্টার মশাইয়ের বাইনোকুলার। আমার সময় হয়ে আসছিল বিদায় নিলাম। উনিও মাছের জন্য ধন্যবাদ জানালেন। ফেরার সময় মনে হলো যেন ওনার মাথাটাও স্পিড বোটের মত চক্কর কাটছে। -
অণুগল্প- ভরদ্বাজ
ভরদ্বাজ
– শান্তনু ব্যানার্জীকলকাতায় বড়ো হয়ে ওঠা রতন তেওয়ারি আমেদাবাদের হোটেলে চেক- ইন’এর সাথে সাথে রিসেপশনে মিঃ সুরেশ প্যাটেলের ফোন। কোম্পানির মালিক। ছয় মাস হলো এই কোম্পানিতে জয়েন করে কলকাতায় বসে বাংলা সহ পাশাপাশি আরও তিনটে স্টেটের কাজকর্ম দেখছে। মালিক বাড়িতে সন্ধ্যার সময় ডেকে পাঠিয়েছে কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বোধ হয় কোনো পুজো আছে। পরে আরও দু’দিন থাকা হবে ব্যাবসার আলোচনার জন্য।
গুজরাতের ব্যবসায়ীরা অনেকেই খুব বিত্তশালী। ক্ষীণ চেহারার লোকও কায়িক পরিশ্রমে ভয় পায় না । সাধারণত সব কোম্পানিই দেশের বিভিন্ন শহরে দু’ মাস অন্তর ভালো হোটেল ভাড়া নিয়ে মিটিং করে। কিন্তু কোলকাতায় আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্যবসার অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। অথচ আয়ুর্বেদিক ব্যাবসা প্যাটেলের প্রাণ। তাই তিন পুরুষ কলকাতায় বাস করা তেওয়ারিকে সিলেক্ট করেছে। ইউনিয়নকে ভয় করে কোনো বাঙালী রাখেনি। তাছাড়া তেওয়ারি ভালো বাংলাও জানে। কলকাতার সংস্কৃতিরও ছোঁয়া আছে ।
অধ্যাবসায় আজ সুরেশ প্যাটেলকে এই জায়গায় এনে দিয়েছে। আগে ওষুধের দোকানে কাউন্টারে কাজ করতো। তখন দেখে ছিল আয়ুর্বেদিক ওষুধের বিদেশেও চাহিদা আছে। বাইশ বছর বয়সে দোকানের চাকরি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতেই আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করা শুরু করলো । দোকানে দোকানে সাইকেলে করে নিজের তৈরী ওষুধ সাপ্লাই করতো। আজ বাষট্টি বছর বয়সে কয়েক শত কোটি টাকার মালিক। অফিস, ফ্যাক্টরি সবই ঝা চকচকে।
ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় হোটেলে গাড়ি এলো। মিনিট কুড়ির মধ্যে মালিকের বাড়ি। বাড়িতে ঠাটবাট বলতে কিছু নেই। সাধারণ ভাবে পরিবার বর্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। দেশের অন্য কোনো জায়গা থেকে কোনো ম্যানেজারকেই ডাকা হয়নি। কিন্তু সপরিবারে ফ্যাক্টরির সমস্ত শ্রমিকই উপস্থিত ছিল। প্রায় সত্তর আশি জন হবে। এরা সবাই শতরঞ্জি পেতে বসেছিল।
কথা বলতে বলতে বাড়ির সকলের সাথে সুন্দর গ্লাসে গাঢ় কালো রঙের পানীয় দিয়ে গেল। একটু হকচকিয়ে গেলেও তেওয়ারি বুঝতে পারলো যে ওটা ফলের রস। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই একটা নাম খুব শুনতে পাচ্ছিল- ভরদ্বাজ.. ভরদ্বাজ প্রায় সবার মুখেই। কিন্তু ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে মিউজিক সিস্টেম এসে গেলো। সামনে স্টেজের মতো করা আছে। মাঝখানে একটা সিংহাসনের মতো চেয়ার। তার চারপাশে অনেক জায়গা। সে জায়গায় মালিক পক্ষের পরিবার বর্গ। অন্য দিকে শ্রমিকদের পরিবার বর্গ। মিউজিক শুরু হতেই মালিক তেওয়ারির হাত ধরে টেনে নিল। তেওয়ারি নাচানাচিতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। ঘরোয়া পরিবেশে বেঢপ শরীরে শাড়ি পরে নাচা দেখে তেওয়ারি মালিকের হাত ধরে কোমর দোলাতে শুরু করলো।
এর মধ্যে একটা গুঞ্জন ভরদ্বাজ এসে গেছে। দেখি সামনে দাঁড়িয়ে এক সাদা চুল এবং লম্বা দাড়িওলা প্রায় ছ ফুট উচ্চতার মানুষ। প্রথমেই মালিক এবং পরিবার বর্গ এক এক করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো। তেওয়ারিও বুঝে না বুঝে একটা পেন্নাম ঠুকে দিল। এরপর সেই সিংহাসনে ভরদ্বাজকে বসানো হলো। এরপর শ্রমিকদের হুড়োহুড়ি লেগে গেল ভরদ্বাজের চরণ যুগল স্পর্শ করে আশীর্বাদ নেবার জন্য। শ্রমিকদের মতো করে এক ঘণ্টা ধরে উদাত্ত গলায় উপদেশ দিয়ে গেলেন। যার মর্মার্থ হচ্ছে ভগবানের আশীর্বাদ পেতে গেলে মালিকের ইচ্ছা মত মন দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। কারণ ভরদ্বাজ যে তাদের খুব চেনা লোক। এখন মালিকও তাকে পায়ে ধরে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। এরপর প্রসাদ খাইয়ে শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তেওয়ারিকে গাড়িতে করে হোটেলে পৌছে দিল। আর ভরদ্বাজকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল।পরিশেষে এই আমাদের ভারতবর্ষ। অন্ধবিশ্বাসে কেউ ঠকে, কেউ ঠকায়। এরকম ভরদ্বাজ অফিসে কারখানায় বহু ছড়িয়ে আছে।
এই ভরদ্বাজের আসল পরিচয় কি? দু’ বছর আগে ঐ কোম্পানিতেই চাকরি করতো । ইউনিয়ন করার জন্য কোম্পানি বরখাস্ত করে অন্য কোনো দোষ দেখিয়ে। সাময়িক ভাবে শ্রমিকরা চুপ করে যায়। আবার আন্দোলন দানা বাঁধলে ভরদ্বাজকে অন্য ভুমিকায় ডেকে নিয়ে আসে। মালিক নিজের পরিবারের সকলকে নিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে শ্রমিকদের বিশ্বাস অর্জন করে নিজের কাজ হাসিল করে নেয়।
-
অণু গল্প- ফুলমনি সরেন
ফুলমনি সরেন
– শান্তনু ব্যানার্জিফুলমনির জন্ম কোলকাতায়। ধীরেন বাবুর হাত ধরে ফুলমনির বাবা- মার কোলকাতায় আসা। নিজের মশলা তৈরীর কারখানা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শুধু প্রয়োজন ছিল বিশ্বস্ত লোকের। সাঁওতাল পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুজনকেই চাকরি দেন। থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই দুয়ারসিনির সাঁওতাল গ্রাম থেকে ওদের নিয়ে আসেন। ভুল কিছু করেন নি। ওরা ধীরেন বাবুর মান রেখেছেন। ফুলমনির বড় হওয়ার সাথে স্কুলেও ভর্তি করেছেন। উপরন্তু ওর মা বাবার কাজের গুরুত্বও বাড়িয়ে দিলেন। একটু বড় হতেই দেখা গেল যে মেয়েটির মধ্যে এমন একটা শক্তি আছে যা সহপাঠীরা সহজেই মেনে নেয়। তা ওইটুকু মেয়ে হলে কি হবে? স্বভাবে সুন্দর, বক্তব্যে স্পষ্ট।
ধীরেন বাবুর বাবা ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন। নিজে দর্শনে MA পাশ করেও ব্যাবসা শুরু করেন। মেয়েটিকে যত দেখেন তত বেশী ভালো লাগে। মনে এসে যায় বিতর্কিত হলেও আর্য -অনার্যদের সংঘাতের কথা। মনে পড়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল কর আদায়ের কালে অত্যাচারে জর্জরিত সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা। তাছাড়া যেটুকু গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডাসের বিবরণ থেকে জানা যায় সিন্ধু ও বালুচিস্তানের কুটির শিল্পীদের বলা হতো সান্তাল। নিজেদের বিভিন্ন সময়ের গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে এরা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ও পূর্ব ভারতে। তারপর বসবাস শুরু করে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে। দীর্ঘ দিন ধরে নগর সভ্যতার সাথে সম্পর্কহীন থাকায় এরা অরণ্যচারী আদিবাসীতে পরিণত হয়। এখনকার সাঁওতালরা তাদেরই উত্তরপুরুষ। এক সময় সিন্ধু প্রদেশের নাম ছিল চাম্পা। এই অঞ্চলে ছিল সান্তালদের চোদ্দটি গোষ্ঠীর চোদ্দটি কেল্লা বা গড়। চায়গড়ে থাকতো সরেন গোষ্ঠী।
এর মধ্যে কলকাতার নব্য কালচারে প্রাইমারি ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে যোগাযোগ শুরু করে। দেদার খরচ, ডোনেশন, টেনশন, নিজের বাচ্চাদের মগজ ধোলাই, একে ধরা ওকে ধরা এবং সর্বোপরি অনিশ্চয়তা ।
ফুলমনির অন্য স্কুলে যাবার প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া বাংলা ভাষাকেও খুব ভালোবেসে ফেলেছে। চারজন ছেলে আর ফুলমনি একই বেঞ্চে বসে। যেমন অসিত, তারক, বরুণ আর রঞ্জন। সকলের মন খারাপ। সবাই যে ওকে খুব ভালোবাসে আর ওর কথা মেনে চলে। বাড়িতে বললেও বকুনি খাবে। এখন ফুলমনির বুদ্ধিই ভরসা। ফুলমনি বললো, একটু ভাবতে হবে।
পরদিন সোজা হেডমাষ্টার মশাই-এর কাছে একা একাই কিছু বলে এল। এরপর উনি বাকি চার অভিভাবককে ডেকে পাঠালেন। বললেন, পঞ্চাশ মিটার দৌড়ে যে প্রথম হবে তাকেই একমাত্র এই স্কুলে রাখা হবে। বাকিরা অন্য স্কুলে যাবার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। ফুলমনি এত জোরে দৌড়তে পারে যে কেউ ওর সাথে পেরে উঠত না। কাজেই অভিভাবকরা খুব খুশি। ফুলমনি ফার্স্ট হবে। আর বাকিরা অন্য স্কুলে চলে যাবে।
কিন্তু অন্তিম সময়ে দেখা গেল সকলে একই সময়ে পৌঁছেছে। পাঁচ জনেরই একই সময় লেগেছে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রথম। সবাই চেঁচিয়ে উঠল হিপ হিপ হুররে। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। জয় বন্ধুত্বের জয়। জয় বাংলা ভাষার জয়।
ফুলমনির মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।