• অণু গল্প

    অণুগল্প- জন্মদিন

    জন্মদিন
    – শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    জন্মদিন কোনো দিন উদযাপন করি নি । না তেমন কোনো কারণ নেই, তবে কোনো দিনই এ ব্যাপারে উৎসাহ ছিল না। বলতে গেলে আমার কিন্তু তিনটে জন্মদিন। একটু অদ্ভুত লাগছে তাই তো! খুলেই বলা যাক। সবার মতো আমার তো একটা জন্মদিন আছেই। তাছাড়া আরও দু’টো তারিখ।
    প্রথমটা সাঁইত্রিশ বছর আগের কথা। সকাল দশটাতেই আমার গৌহাটি অফিসে খবর এল যে আমার মৃত্যু হয়েছে। অন্যত্র কাজ সেরে অফিসে পৌছতে বেলা তিনটে হয়ে গেল । আমাকে দেখে সকলেই চমকে উঠলো যেন সাক্ষাত ভূত দেখছে। চারদিকে কেমন বিমর্ষ ভাব। কাজকর্ম বন্ধ করে চারদিকে গুঞ্জন চলছে। এবার আমি হাঁক মারতেই সকলের সম্বিত ফিরে এলো। কি ব্যাপার বলুন তো! অফিস খুলতে খুলতেই মুম্বই ( তখন বলা হত বোম্বে) হেড অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে ট্রেন দুর্ঘটনায় আপনার মৃত্যু হয়েছে। কলকাতা অফিস থেকেও ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আমরা খালি আপনার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিল না। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, তাই অপারেটরকে হেড অফিসে হট লাইনে কানেক্ট করতে বললাম। কিছু বাদে লাইন পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ উত্তেজিত ভাবে কথাবার্তা চললো। লাইন ছাড়তে সবাই ঘিরে ধরল ব্যাপারটা বোঝার জন্য। হেসে বললাম যে কিছুদিন আগে একটি অল্প বয়সী ছেলে মুম্বই যাচ্ছিল ইন্টারভিউ দিতে কোনো একটা কোম্পানিতে। আমার কাছে দু’দিন যাবৎ ইন্টারভিউ সংক্রান্ত আলোচনা করেছিল। ওকে আমার কার্ড সমেত কিছু প্রস্তুতি বিষয়ে কাগজপত্র দিয়ে ছিলাম। ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার পথে ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয়। যদিও ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তবু আমার দেওয়া কাগজপত্র রেল লাইনের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পুলিশ সেগুলো সংগ্রহ করে হেড অফিসের ঠিকানা আর ফোন নম্বর দেখে যোগাযোগ করে।

    দ্বিতীয়টা সাতাশ / আঠাশ বছর আগেই হবে। চিরকালই খুব আড্ডা মারতে ভালোবাসতাম। নিয়মিত যাতায়াতের জন্য ট্রেনের অনেক যাত্রীই চিনতো। ভেস্টিবিউল কোচের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। খুব মার্জিন টাইম নিয়ে যাতায়াতের বদ অভ্যাসের জন্য অনেকেই একটা করে জায়গা আমার জন্য রেখে দিত । একদিন বিকেল পাঁচটার সময় শেষ মূহূর্তে ট্রেনের শেষ বগিতে উঠে পড়লাম। শীতের সন্ধ্যা। উঠে দেখি ওটা একমাত্র বগি ছিল সেদিন ভেস্টিবিউল থেকে আলাদা। পরের স্টেশন আড়াই ঘণ্টা বাদে। বসার জায়গা পরের কথা। আড্ডা মারবো কিভাবে! দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। যদি কোনো স্টেশনে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে তবে কামরা পাল্টে নেবো। আধঘণ্টার মধ্যে সুযোগ এসে গেলো। কিন্তু একি? আমি প্লাটফর্মের লোকজনের মাঝে পড়ে আছি। লোকজন আমাকে ধরে নিয়ে বেঞ্চে বসালো। আমার ব্রিফকেস লাইন থেকে তুলে আনলো।আর ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। পুলিশ এলো। ভাবলো আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে চলে গেল।
    সেদিন কিন্তু ট্রেনটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে গিয়ে ছিল মনে হয়ে ছিল। এটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি জানিনা। তবে এটা আমার দ্বিতীয় নবজন্ম।

  • গল্প

    গল্প- গুপ্তশত্রু

    গুপ্তশত্রু
    – শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    দুপুর পৌনে তিনটে। দেরি হয়ে গিয়েছে।জ্যোতিষরাজের চেম্বার সপ্তাহে দু’দিন খোলা। মঙ্গল আর শুক্র। দক্ষিণ কলকাতার এই জায়গায় দাপুটে লোকজনের বাস। আর এখানেই উনি হাত দেখে ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাবসা দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। সাত্যকি সোমের আজ দ্বিতীয় দিনের সাক্ষাত্ হবে। প্রথম বার এসেছিল এক মাস আগে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন ফর্সা অল্প টাক সমেত লাল সিল্কের কাপড় জড়ানো একজন মানুষের কথা। কপালে একটা লাল সিদুরের টিকা। দু’পাশে দু’টো করোটি। রিসেপশনে পৌঁছতে চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটি জানিয়ে দিল আজ আর হবে না। বেলা একটা বেজে গেছে। শুনেই হঠাৎ তেড়ে ফুঁড়ে সাত্যকি এগিয়ে গেল চেম্বারের দিকে। দেখে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়জামা পরে উল্টো দিকে মুখ করে উনি শুয়ে আছেন। এর মধ্যে ছেলেটি হাত ধরে টানাটানি করে বের করে নিয়ে যেতে চাইছে। কথাবার্তায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো জ্যোতিষরাজের। ছেলেটিকে বললো দশ মিনিট বাদে পাঠাতে। ঠিক দশ মিনিট বাদে গিয়ে দেখে সেই আগের মতো লাল কাপড়ে অভিষিক্ত হয়ে আছেন। বসতে বলার পরেই বললেন আপনার গুপ্ত শত্রু আছে । আপাতত একটা হীরের আংটি পড়তে হবে। সাত্যকির চোখে পড়লো ওনার দু’হাতে ভর্তি আংটি। জ্যোতিষরাাজও সময়ের হেরফেরে একটু দমে ছিলেন। এত আংটি পরে ওনার কি লাভ হয়েছে জিজ্ঞেস করায় বললেন, বাড়ি- গাড়ি কিছুই হয়নি। থাকেন হাবরাতে। বিভিন্ন জায়গায় চেম্বার করেন। এ যাত্রা কোনো পয়সা নিলেনই না। বললেন আর একদিন আসতে।
    সাত্যকি সোমের কোনো দিনই হাত দেখানোর উপর কোনো বিশ্বাস ছিল না । মায়ের কোনো কথা না শুনলেও মায়ের মন রাখতে কয়েকবার এরকম লোকজনের কাছে যেতে হয়েছে। উপরন্তু মা আগে থেকেই পয়সা জোর করে সাত্যকির ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন। বেরিয়ে একটু দূরেই যুগলস’র মিষ্টির দোকান । দোকানে ঢুকেই একবার মায়ের কথা মনে পড়লো। ছোট বেলায় একবার স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে দেখে মা একটু বেরোচ্ছে। এক্ষুনি ফিরে আসবেন। সাত্যকিকে বললেন হাঁড়িতে মিষ্টি আছে খেয়ে নিতে। ফিরে আসতেই সাত্যকি জানাল সব মিষ্টি খেতে পারে নি। মায়ের চোখ ছানাবড়া। মাত্র চারটে মিষ্টি আছে। অথচ বাড়িতে লোকজন আসার কথা।
    এরকমই আরেকবার সাত্যকি গিয়েছিল লিন্ডসে হোটেলে। লিফটে করে সাততলায় উঠে একটা রুমের সামনে দাঁড়াতে একজন লোক বললো, দুশো টাকা দিয়ে স্লিপ লিখিয়ে অপেক্ষা করতে। একজন বেরোলেই ঢুকতে পারবেন। এক মাসের জন্য উনি হোটেল রুম বুক করে রেখেছেন। চল্লিশ মিনিট বাদে একজন বেরোতেই ঘরে ঢুকে একদম ভ্যাবাচ্যাকা। ধুনোর ধোঁয়াতে অন্ধকার। চোখ জ্বালা করছে। পিতলের একটা লম্বা স্ট্যান্ডের উপর প্রদীপ জ্বলছে। তার পেছনে কালো, মোটা এবং কপালে চন্দনের তিলক কাটা এক বাবাজি বসে আছেন। দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন। চারদিকে দক্ষিণ ভারতীয় দেবতার ছবি। একটা হুঙ্কার দিয়ে সাত্যকিকে বললেন, তিনটে প্রশ্ন করতে। এরপর গুণ বিচার করে কি যজ্ঞ করা হবে এবং তার জন্য কত খরচ জানানো হবে। সাত্যকি বললো, বাবাজি মেরা একই প্রশ্ন হ্যায়। বাবাজি অভয় দিয়ে বললেন ‘বোল বেটা’ সাত্যকির প্রশ্ন ছিল ‘লাইফ ক্যায়সে চলেগা।’ প্রচণ্ড হুঙ্কার দিয়ে বাবাজি বললেন, ‘এ কই প্রশ্ন হ্যায়! প্রশ্ন হোনা চাহিয়ে কই গুপ্তশত্রু হ্যায় কি নেহি। প্রমোশন হোগা কি নেহি! অব ফরেন ট্রিপ কব হোগা!’ বললেন যা আজ ভাগ। দুসরা দিন আও ।
    এতদিনে সাত্যকি এদের কাজ কারবার ভালোই বুঝেছে । গুপ্তশত্রুর কথা বলা মানে মনের একটা নেতিবাচক দিককে উস্কে দেওয়া। অনেকেই ভাবতে শুরু করে তাদের মধ্যে নিশ্চয় কোন গুণ আছে যা দেখে অন্যরা হিংসা করে এবং লুকিয়ে শত্রুতা করে।
    আরেকবার ব্যারাকপুরে একজনের কাছে গিয়েছিল। সকাল আটটায় নাম লেখালে বিকাল চারটার পর সুযোগ পাওয়া যায়। নইলে আরও দেরী। তিনি কিছু প্রশ্ন করে যান। তার উত্তর দিতে হয়। তাঁর উপর আলোচনা চলে। এখানে সাত্যকি একটা কান্ড করে বসলো। যাই উনি বলেন, সাত্যকি সবই বলে মিলে যাচ্ছে। মানে যে কথা মেলেনি তাও সাত্যকি সায় দিয়ে গেছে। তাই মাইন্ড গেমের সুযোগ হয়নি। অগত্যা বলল আরেক দিন আসতে।
    আরেকটা মজার ঘটনা। এক বন্ধু একজনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে সাত্যকিকে বললো, যে আপনার স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। এক্ষুনি সারবার উপায় নেই। লাগলে তুক না লাগলে তাক। লজ্জায় বন্ধু সাত্যকিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
    কিছুটা মজা করতে গিয়েই এসব করে এসেছে সাত্যকি। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে এরকম মজাও কাজে লেগে গেছে। যেমন একবার ট্রেনে করে ধানবাদে যাবার সময় এক ভদ্রলোক টিকিট কেটে উঠতে পারে নি। একদম সময় ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ যাবার পর চেকিং শুরু হোল। ভদ্রলোক খুব ভয় পেয়ে গেছেন। বেইজ্জতি হতে হবে। সাত্যকি দূর থেকে চেকারকে দেখেই বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু সাত্যকি সবার হাত দেখবে আর সবাইকে বলতে হবে যে সব মিলে যাচ্ছে। ব্যাস এটুকু হলেই চলবে। যথারীতি চেকার এল। সাত্যকি গভীর ভাবে হাত দেখায় ব্যস্ত। চেকার এসে পাশে বসে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল। সাত্যকি একঝলক ওনার দিকে তাকিয়ে বলল আজকে আমি একটাই কথা বলবো। পরে একদিন ভালো করে দেখে দেবো। গম্ভীর পরিবেশ। সাত্যকি বললো, আপনার একটা ব্রেন সার্জারি হয়েছে! ভদ্রলোক বললেন কি করে জানলেন! আপনি সত্যি আশ্চর্য মানুষ। আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো। এই বলে কারও টিকিট চেক না করেই চলে গেল। রহস্যটা এবার জানা গেল। দূর থেকে ওনাকে দেখেই চিনতে পেরেছিল সাত্যকি। কারণ মাস ছয়েক আগে ওনাকে বলতে শুনেছিল ওনার অন্যান্য বন্ধুদের কাছে যে ওনার একটা ব্রেন সার্জারি হবে । সাত্যকি তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সেটাই কাজে লেগে গেল।
    এরকমই একটা ঘটনা আরেকবার ঘটে ছিল। একটা কোম্পানিতে একটা ডীল কিছুতেই কমপ্লিট হচ্ছিল না। একদিন সাত্যকি একটা ফাইলে অফিসের কাগজ পত্রের সাথে কিছু ফাঁকা হরস্কোপ নিয়ে গিয়েছিল। কথা চলাকালীন ফাইলের কাগজপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে বের করে। কোম্পানির ম্যানেজার হরস্কোপ দেখে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। সাত্যকি তৎক্ষনাৎ বিচার করে বললো, একটা বিরাট বড় প্রাপ্তিযোগ আছে। কিন্তু গুপ্তশত্রুতে আটকে আছে। সেটাও ব্যবস্থা করা যাবে। এই ডীলটাও কিন্তু সাইন হয়েছিল ।
    এক্ষেত্রেও কয়েক মাস আগে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনেছিল যে ওনার একটা শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির প্রাপ্তিযোগের কথা।
    কোনো কথাই যায় না ফেলা।

  • গল্প

    গল্প- আমার শার্লক হোমস

    আমার শার্লক হোমস
    – শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    লম্বা চেহারার ভদ্রলোক। ছফুটের কাছাকাছি হবে। অদ্ভুত রকমের স্মার্ট। মেদহীন চেহারা। ফুলহাতা পিওর কটনের হালকা স্ট্রাইপের শার্ট। আকর্ষণীয় হাঁটার ছন্দ। এক হাত প্যান্টের পকেটে আর এক হাতে ছোটো সুদৃশ্য একটা কালো রঙের ডায়েরি। অথবা প্যান্টের দু’ পকেটেই হাত ঢোকানো থাকত। পরিভাষায় সুন্দর হাইলি স্লোপ শোলডার। ফটোক্রোম্যাটিক লেন্সের চশমায় আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছিল প্রাথমিকভাবে সাইকোপ্যাথ। কারো জন্য আনুগত্য ছিল না। অন্যের আবেগের কোনো স্থান ছিল না ওনার মনে।
    অফিসের কাজে কিছু দিনের জন্য রায়পুর এসেছি। কর্পোরেট লোকজন বেশি থাকে এমন হোটেলকে বেছে নিলাম। কাজের শেষে রাত আটটার পর হোটেলে ফিরে দেখি করিডোরে একজন সুদর্শন পুরুষ বাংলাভাষায় উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে। বাংলা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের ভাষায় ‘আমি আজ পর্যন্ত যা মাল খেয়েছি সেই জলে তোমরা স্নান করোনি। আমার পয়সায় মাল খাবে আর আমাকেই বলবে মাতাল!!’ উত্তেজনা কমাতে কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই ওনাকে একাই আমার রুমে নিয়ে এলাম। প্রসঙ্গত যে দুজনের সঙ্গে কথা চলছিল তারাও বাঙালি। ব্যাস, তারপরেই রসায়ন শুরু হয়ে গেল। দিনে দু’ কাপ চা ছাড়া কোনো নেশা ছিল না। সিগারেট খেতাম কিন্তু প্রিয় বান্ধবীকে অসন্তুষ্ট করতে চাইনি বলে তাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওনার কোনো কথা জড়ানো নয়। স্পষ্ট এবং কাটাকাটা।
    জানলাম উনিও কোম্পানির প্রোজেক্টে মাস তিনেকের জন্য এসেছেন। ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ফিরে যাবেন কোলকাতায়। অনেকক্ষণ কথা চলার পর মনে হলো আমি শার্লক হোমসকে পেয়েছি।
    কলকাতায় ফিরে এক বছরের মাথায় দেখা হয়ে গেল এক রোববার নিউ কেনিলওয়র্থ হোটেল লাউঞ্জে‌। স্ত্রী এবং দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ডিনার করতে। আমি গিয়ে ছিলাম কর্পোরেট বুকিং লিস্ট চেক করতে। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে ডাকলেন- সমীরণ.. পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বললাম আমার নাম কিন্তু ‘সমীরণ’ নয় । উনি আজীবন কিন্তু আমাকে সমীরণ বলেই ডেকে এসেছেন। আমিও ওনাকে শার্লক বলেই ডাকতাম‌। অন্য কাজ থাকায় ডিনারে যোগদানে অক্ষমতা জানিয়ে আমি চলে এলাম। সকলে মিলে আমাকে পরের রবিবার লাঞ্চ করতে ওনাদের সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে নিমন্ত্রণ করলেন। অল্প সময়ে এটুকু বুঝেছিলাম উনি খুব ডমিনেটিং। বাড়ীর লোকজন সকলেই খুব তটস্থ থাকেন। ঘরে বাইরে একইরকম। মানে ‘আমিই শেষ কথা ‘ ভাবলাম এর সাথে আমার কোনোদিন বনিবনা হবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি উল্টো হয়ে গেল। সবসময় আমাকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সন্তুষ্ট করতে চাইতো।
    পরের রবিবার শার্লকের বাড়িতে লাঞ্চ করার পর ওনার স্ত্রীর অনুরোধে যমুনা সিনেমা হলে ইভনিং শোতে সিনেমা দেখতে বেরোলাম।
    হাউস ফুল চলছে। শার্লক বললো, কুছ পরোয়া নেই। হলের সামনে ওর পরিবারকে আমার কাছে রেখে সোজা সিনেমা হলের মধ্যে ঢুকে গেল। মিনিট পনেরো বাদে বেরিয়ে এসে ভেতরে আসতে বললো। গিয়ে দেখি আমাদের জন্য গোটা পাঁচেক খুব ভালো গদিআটা চেয়ার আলাদা করে ব্যবস্থা করা আছে। আমাকে দেখেই ম্যানেজার খুব খাতির করতে শুরু করল। সিনেমা শেষে বাইরে বেরিয়ে জানতে পারলাম শার্লক নিজেকে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক বলেছিল আর আমার পরিচয় দিয়েছিল ওনার উপরওয়ালা হিসেবে।
    ব্যক্তিত্ব ও কঠিন গলার স্বরে সব জায়গাতেই নিজের কাজ করে নিত। হার না মানাটাই ছিল স্বভাব।
    একবার আসানসোল থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে হাওড়া ফেরার পথে দুর্গাপুরে সামনে কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। ট্রেন কখন যে ছাড়বে তার ঠিক নেই। অগত্যা আমাকে বসিয়ে রেখে কিছু ট্রেনের লোকজন সঙ্গে স্টেশন মাস্টার অফিসে গিয়ে হাজির। আধঘণ্টা বাদে ফিরে এলো। ট্রেনটা পিছনের দিকে ব্যাক করে থার্ড লাইন ধরে হাওড়ার দিকে এগোতে শুরু করলো। এরকম তো কখনো কেউ দেখেনি। সকলে শার্লকের দিকে তাকিয়ে ছিল। পরে জানলাম উনি নিজেকে সেন্ট্রাল মিনিস্টারের ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক এখনকার সময়ে এসব করে পার পাওয়া যায় না।
    গলার স্বর এবং ব্যক্তিত্বকে খুব ভালো ব্যবহার করত শার্লক। একবার ট্রেনে এসি থ্রি টায়ারের জায়গা দখল করেছিল দুজন। নিজেদের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের লোক বলে পরিচয় দিয়ে সবাইকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল।
    শার্লক সম্বন্ধে ঘটনা বলে শেষ করা যায় না। মোটা বই তৈরি হতে পারে। সিনেমা হতে পারে।
    যাই হোক কাজের চাপে আমিও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরাচ্ছিলাম। মাঝ খানে সাত বছর যোগাযোগ ছিল না। একদিন সকালে দেখি আমার বাড়ি খুঁজে খুঁজে এসে হাজির। এই প্রথম আসা আমাদের বাড়ি। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। বাঘ যেন বিড়াল হয়ে গেছে। স্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে উচ্চ পদস্থ অফিসার ছিলেন। রিটায়ার হবার অনেক আগেই মারা গেছেন। ফোন নম্বর হারিয়ে যাওয়ায় আমাকে যোগাযোগ করতে পারেন নি। ক্যালকাটা ক্লাবে নাতির জন্মদিন পালন হবে, তার জন্য নিমন্ত্রণ।
    জন্মদিনে গিয়েছিলাম। মনে হলো দুই ছেলে তাদের বন্ধু বান্ধব এবং পরিবার নিয়েই আছে। শার্লক এখন অনস্তিত্ব। বাঘ থেকে বিড়াল এবং এখন যেন ইঁদুর। কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে ফিরে এলাম।
    এর কিছুদিন বাদে আমি ভুবনেশ্বর থাকাকালীন বড় ছেলের ফোন পেলাম। শার্লক মারা গেছে। খুব কষ্ট পেলাম। বললাম দু’দিন বাদে কলকাতায় ফিরে ওদের বাড়িতে যোগাযোগ করবো। তবে ফোন করে যাব।
    কলকাতায় ফিরে এসে ওদের বাড়িতে ফোন করলাম। আধঘণ্টা কেউ ল্যান্ড ফোন তুললো না। তারপর ফোনটা তুলে নামিয়ে রাখলো। জানতেও চাইলো না কে ফোন করছেন। ঘরের মধ্যে উৎসবের আমেজ। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। কত রকমের আলোচনা রিসিভার দিয়ে ভেসে আসছে।
    আমি আমার ফোন বন্ধ করলাম। মনে হলো, আজকের দিনে রূদালিদেরও কোনো মার্কেট নেই।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- মনের উজানে সুজানা

    মনের উজানে সুজানা
    -শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    আকাশ পারিয়ালের অকাল প্রয়াণে মন নাচের স্কুলগুলো ধরে নেয়। বিয়ে করবে না বলেই দিয়েছে। রাতে এক ঘন্টার মতো ছাদে থাকে, সিগারেট টানে তারপর নেমে আসে। বর্ষায় একটা ছাতা। সারাদিনের কাজের পর এটুকুই বিনোদন। চারদিকে তাকিয়ে দেখা বা নিজের সাথে কথা বলা।
    বেশ দূরে একটা ছাদে একটা অবয়বকে নড়াচড়া করতে দেখত। দেখতে না পেলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হতো।
    পূর্ণিমার রাতে একদিন লোডশেডিং। আলোছায়ায় গ্রিসীয় কিংবা মিশরীয় স্ফিংসের ছড়াছড়ি। একটু আনমনা হতেই মনের পাশে একটা অবয়ব এসে দাঁড়ালো। চাঁদনি রাতে প্রথম মন সুজানাকে সামনে থেকে দেখলো। বাড়ি ক্রোয়েশিয়ায়। প্রজেক্ট শেষ। কাল চলে যাচ্ছে ।
    হয়তো যোগাযোগটা ছিল ইথেরিয়াল।

  • গল্প

    গল্প- ঝালমুড়ি

    ঝালমুড়ি
    – শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    ই সি এলে নূতন চাকরি । বাড়ি কলকাতায় কিন্তু থাকে বরাকরে । ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে শনিবার বা কোনো ছুটির দিনে বাড়ি আসে আর তার পরদিন আবার ফিরে আসে বরাকরে। মাস গেলে মোটা টাকা ঘরে আসে। তাই কলকাতায় এলে এটা ওটা সকলের জন্য খরচা করে। তার মানে এই নয় যে সকলেই বরাকরে বা নিজ নিজ চাকরি স্থলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বেশিরভাগ লোকই ডেইলি প্যাসেঞ্জার। যাতায়াত মিলিয়ে হাওড়া থেকে হাওড়া ট্রেন লেট না হলে ছয় সাত ঘন্টা লেগে যায়। তার ওপর কেউ থাকে গড়িয়া বা কেউ বেহালা বা শ্যামবাজারে। অর্থাৎ বাড়িতে সর্বসাকুল্যে তিন চার ঘন্টা বিছানায় গা এলিয়ে নিতে পারে। কিন্তু পারিবারিক দায়বদ্ধতায় হাসিমুখে দিনের পর দিন এই একই রুটিন চলতে থাকে । তাছাড়া প্রত্যেকের মাইনে তো সমান নয় যে অফিসের কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে সব খরচ খরচা সামলে নিতে পারে। কিন্তু এই ট্রেন জার্নির একটা মজার দিকও ছিল । কেউ লেট করে স্টেশনে এলে ডেইলি প্যাসেঞ্জারেরা তার জন্য জায়গা রেখে দিত । তাস খেলা, চা খাওয়া, ঝালমুড়ি ইত্যাদি চলতেই থাকত। মাঝে মধ্যে মিষ্টিও হত। হয়ত কারো সন্তান হয়েছে বা কারো ছেলে মেয়ে রা ভালো রেজাল্ট করেছে অথবা কারো প্রমোশন হয়েছে। আবার একটা বেদনার জায়গাও ছিল। যখন কেউ রিটায়ার করে। এমনও অনেককে হতাশ হতে দেখা যেত যে শেষ জীবনে এত কষ্ট করে সংসার অতিবাহিত করেও বাড়িতে প্রাপ্য মর্যাদা পান না। সব মিলিয়ে অনাত্মীয় সকলেই আত্মীয়ের মতো হয়ে যেত। কারও অকালমৃত্যু বেদনা আরও বাড়িয়ে তুলতো।
    শোভনের অবশ্য এদিনের জার্নিটা রবিবারেই ছিল। সন্ধ্যের মধ্যে বরাকরে পৌছে পরের দিন অফিস করবে। আরেকজন কলিগ প্রীতমের বড় ঘড়ির তলায় হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করবে। যাই হোক ট্রেনটা ছিল তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। তার মধ্যে একটা জায়গা বেছে নিয়ে শোভন আর প্রীতম বসে পড়লো। সাধারণ দিনে তিন জনের সিটে চার থেকে পাঁচ জন বসে। সেদিন একপাশে তিনজন মহিলা আর উল্টো দিকে জানালার পাশে আরেকজন মহিলা। সেই মহিলার পাশে শোভন আর তার পাশে প্রীতম৮। অর্থাৎ দু’দিকে তিনজন করে । ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎই একজন লোক এসে প্রীতমকে বলল একটু সরে বসতে।
    শোভনের সামনের সিটে বসা একজন ছিল অতীব সুন্দরী বয়স্কা মহিলা। চারজন মহিলাই একসঙ্গে আছেন। যাইহোক শোভনের চোখ যেন ওই মহিলা থেকে সরছিলই না। হঠাৎ সম্বিত ফিরল। ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বলল তাস খেলবে?
    ওনাদের সকলে আবার তাস খেলতে পারেন না। প্রীতমের পাশের লোকটা লাফিয়ে উঠে বললো যে সে খেলতে চায়। শোভনের প্রথম থেকেই লোকটাকে পছন্দ হয়নি। কেমন যেন হ্যাংলা মার্কা। শোভন বলে উঠলো, না না গান হবে। প্রীতম ভালো গান করে। প্রীতম লজ্জা পেয়ে কিছুতেই গান করতে রাজি হল না। তখন বৃদ্ধা মহিলা বলল আমিই তবে গান গাই। আমার বয়স কিন্তু চুরাশি বছর। বলে শুরু করলেন, সে কি গান! পুরোপুরি ক্লাসিকাল বেসে।
    ‘নুরজাহান, নুরজাহান
    সিন্ধু নদীতে ভেসে
    এলে মেখলামতির দেশে, ইরানি
    গুলিস্তান।’
    ……….. ……… …………
    ……….. ……… …………
    গান ত নয় যেন এক মূর্ছনা। পিন পড়ার শব্দ নেই। এ বয়সে যে এত ভালো গান করতে পারেন ভাবা যায় না। নানা গল্পের মাঝে একসময় মানকড় স্টেশন পেরিয়ে গেল।
    মহিলারা নিজেদের মধ্যে নানা রকম রান্না নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। প্রীতমের পাশের লোকটা এবার বলে উঠল যে সে নাকি কাঁচালঙ্কা খেতে ওস্তাদ। যত খুশি কাঁচালঙ্কা চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারে। মনে হলো এর মধ্যে দিয়ে একটা বীরত্ব প্রকাশের উন্মাদনা কাজ করছে। পানাগড় স্টেশন আসছে। একটা ঝালমুড়িওয়ালার আওআজ পাওয়া গেল। পাশের কিউবিকিউলে বিক্রি করছে। ঐ সময় প্রীতমের পাশের লোকটি একটু টয়লেটে গেল। শোভন বিদ্যুত গতিতে মুড়িওয়ালাকে কিছু বলে নিজের সিটে বসে পড়লো। টয়লেট থেকে ওই লোকটিও এসে বসলো। শোভন বলল সময়টা সকলের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কেটে গেল। তাই ও সবাইকে ঝালমুড়ি খাওয়াবে। বলতে বলতে ঝালমুড়ি ওয়ালা এসে হাজির। শোভন সেই ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল উনি দুর্গাপুরে নেমে যাবেন। ওনাকে স্পেশাল করে আগে বানিয়ে দাও । খেতে খেতে দুর্গাপুরে পৌছে যাবে। যেন তৈরিই ছিল। ওনার হাতে এক ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে অন্যদেরটা বানানো শুরু করলো।
    এবার কিন্তু ভদ্রলোক অসম্ভব গম্ভীর হয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে যাচ্ছেন। মহিলাদের মনে হয় কিছু চোখে পড়েছে। সবাই মিটিমিটি হাসছে।
    দুর্গাপুর স্টেশন এসে পড়লো। শোভনের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
    শোভন এখন রিটায়ার করে গেছে। হঠাৎ একদিন এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে দেখা। শোভন খেয়াল করেনি। সকলেরই বয়স হয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর উনি হেসে হেসে বললেন যে লঙ্কার ঝালটা কিন্তু এখনও মুখে লেগে আছে।
    বাড়ি ফিরতে ফিরতে শোভন ভাবলো যে হবেইবা না কেন? ঝালমুড়িতে চারভাগের তিন ভাগই লঙ্কার কুচি দেওয়া ছিল।

  • গল্প

    গল্প- যেখানে বাঘের ভয় ..

    যেখানে বাঘের ভয় ….
    – ব্যানার্জী শান্তনু

     

     

    রাত বারোটা বেজে গেছে। গোমর নদীতে বোট চলছে। নিকষ অন্ধকার। ডিসেম্বর মাস। চারদিকে ছোট বড় নানা আয়তনের দ্বীপ। এদিক ওদিক করে এগিয়ে চলেছে আমাদের বোট। গন্তব্যস্থল দুলকি গ্রাম। যাত্রী সংখ্যা হবে ছত্রিশের মতন। রান্না চলছে নীচে ইঞ্জিন সংলগ্ন ঘরে। ছোট একটা আলো আছে তবে জ্বালানো হয়নি।
    ঘন কুয়াশা। বোট চলছে আস্তে ধীরে । রাতে বিশেষ কারণ ছাড়া বোট চলে না । সে অর্থে প্রয়োজনও নেই । তবে ভারত বাংলাদেশের জলপথে জাহাজের আনাগোনা আছে। দূর থেকে মাস্তুলের আলো দেখা যায়। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে সারি দিয়ে জাহাজ যাতায়াত করে। পণ্যবাহী জাহাজ। আছে জায়গায় জায়গায় নদী পারে লাল আলোর দিক নির্দেশকারী নিশানা। কারণ অনেক জায়গায় পলি পড়ে নাব্যতা কমে গিয়েছে। দিনের বেলা অবশ্য অনেক জায়গায় গাছে সাদা কাপড়ের টুকরো বাধা থাকে দিক নির্দেশের জন্য। আরেকটা বিষয় হল অনেক সময় কোনো জায়গায় গাছে লাল কাপড় বাধা থাকে। জঙ্গলে যারা মধু সংগ্রহ করতে যান তাদের জন্য সতর্কীকরণ। অর্থাৎ ঐ পথে বাঘ কাউকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আর আছে নদীর পাড়ে কিছু জায়গায় বনবিবির মন্দির।ধর্ম নির্বিশেষে মৌলেরা এখানে পুজো দিয়ে মধু সংগ্রহে যায়। ব্যস্। ভয় ভয় ভাব নিয়ে সবাই বাঘের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন শুরু করলো।
    এহেন অবস্থায় আলো জ্বালতে হলো। একজনের জন্মদিন। বন্ধুরা কেক নিয়ে এসেছে। বোট চলা অবস্থায় তা পালন হবে। নিস্তব্ধতার মধ্যে মানুষের আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
    এত দেরী হবার কারণ হচ্ছে কুয়াশা। সারা ভারতেই এখন কুয়াশার দাপট। বিমানের ওঠা নামা অনিয়মিত। তাই চোদ্দটি চিকিৎসক পরিবার দিল্লি থেকে ট্রেনে করে এসেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। সকাল এগারোটার বদলে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন পৌঁছায়। যাত্রীনিবাসে পরিচ্ছন্ন হয়ে একটু খেয়ে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রওনা হওয়া গিয়েছিল সুন্দর বনের গতখালির উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল পৌঁছতে। তারপর মালপত্র বোটে তুলে যাত্রা শুরু। রীতিমতো অ‍্যাডভেঞ্চার একে রাত, তার উপর সবাই নূতন।
    দু’টি পরিবার ছাড়া সবাই অবাঙালি। নদীবহুল জায়গায় ঘোরা অভ্যাসের মধ্যে পড়ে‌ না। অনেকের মধ্যেই ইতি উতি একটু ভয়ের চিহ্ন দেখা গেল। যখন জানা গেল আরও দু’ঘণ্টার উপরে জলপথ পেরোতে হবে। কম সময়ে এভাবে সুন্দরবন ঘুরলে আনন্দ একটা পাওয়া যায় ঠিকই তবে ঠিক ঠাক ঘুরলে মোটামুটি সাত দিন লেগে যায়। বোটেই ভ্রমণ এবং খাওয়া দাওয়া আর মাঝে মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারে ওঠা। এদেশের তুলনায় বাংলাদেশের সুন্দরবন আয়তনে বড়ো।
    দেখতে দেখতে দুলকি গ্রামের নদীপাড় পৌঁছে গেলাম। অন্ধকার এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। রাত দুটো পেরিয়ে গেছে। নামতে হবে। তারপর এক কিলোমিটার হেঁটে রিসর্টে পৌছতে হবে। ভয়ে সকলের মুখ শুকিয়ে গেছে। বোট থেকে নদীর পাড় অনেক ফারাক। লাফিয়ে নামা যাবে না। তাই সরু পাটাতন লাগিয়ে দেওয়া হলো। তাতে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট কাঠের টুকরো লাগানো আছে যাতে পা হড়কে না যায়। উপরে একজন এবং নিচে একজন একটা বাঁশ ধরে দাড়িয়ে আছে রেলিং এর মতো করে। প্রথম নামলেন একজন মহিলা চিকিৎসক। তাকে দেখে অন্যরা নামতে শুরু করলেন। যদিও সবকিছু সহজ হয়নি।
    আসার সময় বাঘের গল্প অনেক হয়েছে। তাই সকলের মধ্যে একটা ভয় তো আছেই। কেউ পেছনে থাকতে চাইছে না। শোনা হয়ে গেছে যে বাঘ পেছন থেকে আগে আক্রমণ করে। সামনে একজনের হাতে টর্চ দিয়ে আমি সবার শেষে দাঁড়িয়ে বললাম রিসর্টের দিকে এগোতে ।
    হঠাৎ একটা জোরালো ঝাপটা খেলাম। মাটিতে পড়ে গেছি। মনে হলো একটা ভারী কিছু আমার উপর দিয়ে চলে গেল। বেশ ভয় লাগল। তবে কি বাঘ ! আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল! ওরা কেউ জানতে পারেনি। এগিয়ে গেছে। সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলাম।
    আকাশ ফরসা হলো। একটু বেলাতে চা পান করে ছুটলাম সেই জায়গায় যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল। আশেপাশের লোকজন জানাল যে দু’দিন আগে বাঘ এসেছিল ঐ জায়গায় কিন্তু সকাল সাড়ে দশটার সময়।
    কিন্তু ধাক্কাটা কিসের ছিল। …..বাদুড়! বন বাদারের জায়গা তো।
    ঘটনাটা বছর পাঁচেক আগেকার।

<p>You cannot copy content of this page</p>