• প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ-নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
    আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
    ভাগ হয়নিকো নজরুল “
    – কবি অন্নদাশংকর রায়

    ভূমিকা :~
    বাংলা কাব্য জগতে – হাতে অগ্নিবীণা, ও রণতূর্য, মুখের বাঁশের বাঁশরী আর রোমান্টিক কবিমন নিয়ে ধূমকেতুর মতই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। তাঁর কবিতা ও গানে একই সঙ্গে বিদ্রোহের, পৌরুষের ও যৌবনের বেদনার ভাষা বানীরূপ লাভ করেছে । রবীন্দ্রোত্তর – কাব্যজগতে নজরুল রবিতাপে কিন্তু হারিয়ে যাননি ; বরং রবীন্দ্র মায়াজাল ভেঙে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন।

    জন্ম :~
    বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের চব্বিশে মে (বাংলা ১১ই জ্যেষ্ঠ) অতি দরিদ্র এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা – কাজী ফকির আহমেদ, মাতা – জাহেদা খাতুন। বাল্যনাম – দুখুমিঞা। দারিদ্র্যতার কারণে শৈশব থেকেই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নজরুল।

    প্রতিভার প্রেরণা :~
    প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁরও সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল। দেশে ফিরলেন অনেক রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে। বুকে ছিল পরাধীনতার দুঃসহ বেদনা। রচনা করলেন “রিক্তের বেদন”। আবির্ভূত হলেন – বাংলার কাব্যাকাশে। তিনি বিদ্রোহের কবি, বৈভবের কবি।

    গজল :~
    সঙ্গীতের প্রতি নজরুলের অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই। কবিতা রচনার সাথে সাথে তিনি রচনা করেছেন সঙ্গীত, করেছেন সুর সংগ্রহ। অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। যেহেতু প্রবন্ধের বিষয় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত, সেহেতু গজলের প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।
    বাংলা গজল গানে নজরুল সার্থক স্রষ্টা। পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যই গজলের জন্ম। গজলের দুটি অংশ –
    ১) অস্থায়ী এবং ২) অন্তরা। অস্থায়ী অংশ সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হয়, অন্তরা তাল ছাড়া, এই অংশকে বলা হয় – শের বা শেয়র। গজল গানে নজরুল নানারকম রাগ রাগিনী এনেছেন। মূল কাঠামো ঠিক রেখে তিনি – ঠুংরী ও দাদরার আঙ্গিকে বেশ কিছু গজল রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি গান – “উচাটন মন ঘরে রয়না”, “আধো আধো বোল লাজে”।
    আবার বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রনে নতুন ধারার গজল সৃষ্টিতে তিনি অতুলনীয়।
    বাগেশ্রী এবং পিলু রাগের মিশ্রনে তিনি সৃষ্টি করলেন –
    “চেয়োনা সুনয়না ” দুটি বিপরীতমূখী রাগ এই গানে একাত্ম হয়ে গেছে। “আমার যাবার সময় হল”,”পাষানের ভাঙলে ঘুম “- অসামান্য দুটি গজল। নজরুলের গজলের কয়েকটি বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যেমন – তাঁর হাতে –
    ১) বিদেশী শব্দগুলো একেবারে “বাঙালি” হয়েগেছে।
    ২) আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করেছেন।
    ৩) বাংলা সঙ্গীতে নজরুলের গজল একটি বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে বিত্তশালী এবং মুটে মজুরের গানের যে সীমারেখা ছিল – নজরুলের গজল যেন একটি যাদুকাঠিতে সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। “বাগিচায় বুলবুলি তুই” বা “কে বিদেশী, মন উদাসী” গজল গুলি জাত বেজাতের সীমা লঙ্ঘন করল। তাঁরই একটি গানে বলব – “পাষানের ভাঙালে ঘুম, কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়? ” ।

    শ্যামাসঙ্গীত :~
    ভক্তিগীতি রচনায় নজরুল
    যে অসাধারনত্ব এনেছেন – তা তাঁর আগে কারোরই বোধহয় সম্ভব হয়নি। তাঁর ভক্তি গীতির সংখ্যা – কৃষ্ণ, শ্যামা ও ইসলামী মিলিয়ে প্রায় ৭-৫০। এই গানগুলি এক অপূর্ব আলোয় ঝলমল করছে।
    যে তিনটি শ্যামাসঙ্গীত প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে – সেগুলি – শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ,বলরে জবা বল, কালো মেয়ের পায়ের তলায়।

    শ্মশানে জাগিছে > কৌশিক / ত্রিতালে রচিত। আশাবরী ঠাট, মালকোশের প্রভাবে – অপূর্ব এটি একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ কালীস্তোত্র। শ্মশান কালীর এই রূপ আর কোথাও পাওয়া যার না।

    বলরে জবা বল -> গানটি ভাষার সারল্যে কাব্য সৌন্দর্যে বাঙালীর হৃদয় হরণ করেছে।

    কালো মেয়ের পায়ের তলায় -> গানটি মিশ্র আশাবরী রাগে দাদরায় নিবদ্ধ। অসাধারণ সুর সংযোজনায় গানটি অতুলনীয়।।

    এছাড়াও বেহাগ খাম্বাজ / দাদরায় – বক্ষে ধরেন শীব যে চরণ ;
    দেশ খাম্বাজ / দাদরায় – আমার মুক্তি নিয়ে কী হবে মা, তুই লুকাবি কোথায় কালী।
    নজরুলের এই সুরের সাম্রাজের বিশালতা শুধু অনুভব করতে হয়।

    উপসংহার :~
    বঙ্গ সংস্কৃতির এক গৌরবময় সম্পদ নজরুলের গজল ও শ্যামাসঙ্গীত সহ সমস্ত গান। নজরুল গীতি যেন – অমৃত সুরসুধায় সিক্ত এক অপূর্ব আস্বাদন সামগ্রী। তিনি বলেগেছেন – “গান আমার আত্মার উপলব্ধি”।

  • প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    সূচনা~
    রাক্ষসী পলাশী গ্রাস করে নিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা সূর্যকে। দীর্ঘ দু’শ বছর ধরে শত শত সংগ্রামী নিজের দেশকে ভালোবেসে নির্ভয়ে এগিয়ে গেছে রণক্ষেত্রে,হাসি মুখে বলি দিয়েছে নিজের প্রাণ।
    তবে দেশপ্রেম মানেই যে কেবল জীবন বিসর্জন দেওয়া, তা নয়।দেশের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ নানা ভাবে ঘটতে পারে।কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথও পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উদাসীন ছিলেন না।সংগীতে, কবিতায়, প্রবন্ধে এবং অন্যান্য রচনায় তিনি সেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

    বাল্যজীবন ও শিক্ষা
    ~~~~~~~~~~~
    ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে যে বিস্ময়কর প্রতিভা জন্মগ্রহণ করেন- তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ভোগবিলাসের মধ্যে যে তার জীবন কাটেনি–তা “জীবন স্মৃতি ” তে প্রকাশিত। বিভিন্ন নামী স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে নিয়ম মাফিক শিক্ষা তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির উন্নত পরিবেশের মধ্যেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা গ্রহণ। শুধু লেখাপড়াই নয়, সেকালের ঠাকুর পরিবারে সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীত চর্চার যে অনুকূল আবহাওয়া ছিল, সেই আবহাওয়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

    সারস্বত সাধনা~
    ~~~~~~~~~~
    “জল পড়ে পাতা নড়ে” দিয়ে যাঁর ছন্দের অনুরণন শুরু হয়,তা থেকেই নির্মিত হতে থাকে পরবর্তী কাব্য জগৎ।
    বনফুল, প্রভাত সঙ্গীত, সন্ধ্যা সঙ্গীত,ভানু সিংহের পদাবলী দিয়ে যাত্রা শুরু করে মানসী, সোনার তরী, নৈবেদ্য, গীতালি, গীতাঞ্জলি , পূরবী,বলাকা, মহুয়া ইত্যাদি হয়ে শেষ লেখায় তিনি থামেন মৃত্যুর দেড় ঘণ্টা পূর্বে। কবি ছাড়াও
    ঔপন্যাসিক, নাট্যকার,প্রবন্ধকার,চিত্রকার,সুরকার,গীতিকার রবীন্দ্রনাথকে আমরা সবাই চিনি কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন-“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।”

    স্বদেশ চিন্তা
    ~~~~~~~
    স্বদেশচিন্তা – সৃজনকর্মে সদা ব্যস্ত মানুষটি শুধু সাহিত্য শিল্পের নন্দনকাননে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, প্রথম জীবন থেকেই তিনি দেশমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছেন – দেশবাসীর মনে চেতনা জাগাতে তুলে নিয়েছেন কলম। লিখেছেন একের পর এক স্বদেশী গান – “আমরা সবাই রাজা”, “এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি প্রান”, “এখন আর দেরি নয় ধরগো তোরা হাতে হাতে ধরগো”, “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”, “ও আমার দেশের মাটি”, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”। ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেম জাগাতে “ভারততীর্থ”র মত লিখেছেন কতনা কবিতা!

    দেশপ্রেম ~
    ~~~~~~
    সমকালীন বহু ঘটনা তাঁর মনে ঝড় তুলেছে – রুখে দাঁড়িয়েছেন – উদ্ধত, মত্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে। মানুষের সুখ দুঃখের স্মারক হয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থ তিনি দান করে দিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদী আন্দোলনে তিনি স্বয়ং যোগদান করেছেন। তাঁর রচিত “বাংলার মাটি বাংলার জল” এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল। ১৯১৯ খ্রী. জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। ভাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে সৃষ্টি করেছেন “রাখীবন্ধন”। তাঁর রচিত “জনগণ মন” গানটি আজ স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত।

    উপসংহার ~
    ~~~~~~~
    ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭-শে কিন্তু – তিনি সেদিন সে আনন্দে যোগদান করতে পারেননি, কারন তার মাত্র ৬ বছর আগে ১৯৪১-শে বাইশে শ্রাবণ তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু এ শুধু তাঁর মরদেহেরই অবসান। এই ভাবসাধক কবিশ্রেষ্ঠ খণ্ডকালের হয়েও সর্বকালের। ভারত-আত্মার এই বিগ্ৰহকে তাঁর বঙ্গভূমি, তাঁর ভারতবর্ষ তো ভোলেইনি, সমগ্ৰ বিশ্বের দরবারে তিনি সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত।।

  • প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- মূল্যবোধের অবক্ষয়

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।

     

    মূল্যবোধের অবক্ষয়
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    আজকে বড়ই লজ্জার বিষয় এটাই যে — বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক মূল্যবোধহীনতা!যে মানুষের মধ্যে আছে অনন্ত সম্ভাবনা,যা দিয়ে মানুষ পারে একটা স্বর্গ রচনা করতে– সেই মানুষই মনুষ্যত্বহীনতায়,মানহীনতায় ,হুঁসহীন হয়ে করছে একের পর এক জঘন্য অপরাধ।
    পশুর সাথে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আজ পার্থক্য কোথায়? লোভ তাদের গ্রাস করছে। মানুষ হয়ে উঠছে ক্রমশঃ স্বার্থপর। ভাবতে আজ অবাক লাগে — আমরা নাকি সেই বরেণ্য মহাপৃুরুষদের উত্তরসূরী! এই সেদিন যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন –আমরা তাঁদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে ! অথচ আমাদের দেশের একটি শিশুও আজ নিশ্চিত জীবন কাটাতে পারেনা — তাকেও পাশবিক বল প্রয়োগ করা হয়! সে হয় ধর্ষিতা।
    ছোটরা শিখছে কথায় কথায় মিথ্যে বলতে,ভালো লাগা জিনিসটা চুরি করতে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে নানান কু কীর্তি করে বেড়াচ্ছে।
    পণপ্রথা আইন করেও বন্ধ করতে পারেনি সরকার। বধূ হত্যা ,বধূ নির্যাতন সমাজে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।বিবাহ বিচ্ছেদ আজ তো কোন ব্যাপারই নয়! সম্পত্তি নিয়ে গৃহ বিবাদ, বাপ- ছেলের কলহ,খুনোখুনি লেগেই আছে। শিক্ষককে আজ সামান্য সম্মানটুকু দিতেও ছাত্রদের কৃপণতা। মানুষকে ঠকানোতেই মানুষের চরম আনন্দ লাভ।
    আজ এই সবের কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে — যুবসমাজের উপর এখন পড়েছে উগ্র আধুনিকতার প্রভাব, একান্নবর্তী পরিবারের অভাব, সুবিধাবাদী নীতির ছড়াছড়ি, আদর্শের অভাব,পাঁচমেশালি সংস্কৃতির প্রভাবে বেপরোয়া মনোভাব। আর এসব কিছু একদিনে হয়নি – একদিকে এগিয়েছে সভ্যতা আর অন্যদিকে অবনমন ঘটেছে মূল্যবোধের।
    মনে হয় সর্বাগ্রে চাই মানুষের মনে ন্যায় বোধের জাগরণ, তাহলে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটবে। মহাপুরুষদের জীবনীপাঠ এবং তাঁদের জীবন পথের অনুসরণ করা।ধ্বংসের পথে না এগিয়ে কিছু সৃষ্টির মনোভাব রাখা।কর্মমুখী চেতনা যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে না দিতে পারলে ভয়ানক এক দিনের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে হয়তো।বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতিশিক্ষার বা আদর্শচর্চার ক্লাস অবশ্যই রাখা উচিত। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আজ শৈশব বিপন্ন। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা! তাই ছেলেবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা বড় নিঃসঙ্গ ,বড় একা ।
    এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভয়াবহ এক সময়ের সামনে আসতে হবে। তাই চাই বিশ্বাস । মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস। কারণ মানুষের মধ্যেই আছে প্রকৃত সম্ভাবনা। মানুষের চারিত্রিক সম্পদের অনুসন্ধান মানুষকেই করতে হবে ।।

  • কবিতা

    কবিতা- নবান্নে হও সাথী

    নবান্নে হও সাথী
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    বঙ্গের এই রঙ্গশালায়
    নটরাজের নাচন…
    ছয়টি কালের আসা যাওয়া
    মনের মাঝে মাতন।
    ঢাকের বাদ্যি ,শিউলি শালুক
    শরৎ সুবাস শেষে,
    বৈরাগিনী হেমন্তিকা
    আসলো মৃদু হেসে।
    হিমেল আবরণে আজি
    ঘোমটা খানি টেনে —
    দুহাত ভরে দিয়েই গেলে
    স্ব- স্নিগ্ধ নয়নে।
    খেটে মরে চাষা সারা দিনভর
    বারোমাস জলেরোদে,
    মুখের আহার জোগায় তাহারা-
    মেটায় পেটের খিদে।
    হেমন্তে আসি উৎসবে মাতে
    হাতে হাতে ধান কাটে,
    স্বর্ণ ফসলে ভরে দেয় গোলা
    আনন্দ মাঠে বাটে।
    আঙিনার মাঝে ঘট পাতা ঐ
    নতুন ধানের শিসে
    উৎসব হোক তোমার আমার…
    স্নেহ ভালবাসা মিশে।
    নবান্ন এল প্রতি ঘরে ঘরে
    মাঠের সোনার ধানে,
    অঙ্গন আজ হাসছে দেখো …
    তোমার পূর্ণ দানে।
    নিজেকে কেন গুটিয়ে রাখা!
    বিষন্নতার ছায়ে!
    হেমন্তিকার প্রাচুর্য তো –
    তোমার পায়ে পায়ে।
    মমতাময়ী মাগো আমার
    উদাস কেন বলো?
    নতুন ধানের ঘ্রাণে যখন-
    সবাই দেখে আলো!
    তোমার আশিস মাথায় নিয়ে
    আনন্দে আজ মাতি,
    শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে
    “নবান্নে” হও সাথী।

  • গল্প

    গল্প- রং মাখা মানুষ

    রং মাখা মানুষ
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    অফিস থেকে ফিরতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে অমলের । মেয়েটা সারাদিন বাবার পথ চেয়ে বসে থাকে । এলেই ব্যাগ হাতড়ায় – তার জন্য কি এনেছে পাপা।
    আজ কিন্তু পরিবেশটা একদম অন্যরকম। বৌ এর মুখটা বাংলার পাঁচ । মেয়েকে দাবড়ানি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে পড়াতে । সেও ভয়ে ভয়ে রয়েছে । অমল একটু জোরেই ডাকে — আমার বিনি কৈ ? আজ কি এনেছে পাপা দেখো । নিয়ে যাও। কিন্তু বিনি আসেনা । একটু পরে আসে সুধা ।
    – কি হয়েছে ? অমল প্রশ্ন করে । সুধা কোনো উত্তর না দিয়ে একটা মুখ খোলা খাম এগিয়ে দেয় । ক্যুরিয়ারে এসেছে ।
    কি এটা ?
    – নিজেই দেখে নাও । জীবনে আর কি কি করেছ বলোতো তুমি ? এখন তো দেখছি কোনো হিসেব নেই তোমার মহান কীর্তির । আমাকে এবার মুক্তি দাও।
    ভয়ে ভয়েই চিঠিটা খোলে অমল । আজই এসেছে ।

    মেঘ ,
    অবাক হচ্ছো ? নাগো ,এখনো তোমাকে ভুলতে পারিনি ,ভুলতে পারিনি আমার দেওয়া সেই প্রিয় নামটা — মেঘ। তুমি ভাবছো তোমার ঠিকানা আমি কি করে পেলাম ! পাওয়া যায় । ইচ্ছে থাকলেই উপায় একটা পাওয়া যায় ।অনেক ভেবেছি ,তবু পারলামনা । লিখলাম মনে ছটফট করতে থাকা কিছু কথা । তোমার সংসারে অশান্তি এনে দিলাম হয়তো আবার ! কিন্তু আমি কোথায় শান্তি পেলাম বলো ? প্রথম থেকেই তুমি আমার সাথে মিথ্যাচার করেছিলে । অভিনয় এত নিখুঁত কি ভাবে করতে মেঘ ? আমাকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখাতে তুমি ! যত ভাবি অবাক হই । বিয়ে হয়ে গেছে ,সন্তান আছে তোমার সমস্তটাই চেপে গিয়েছিলে । যখন জানলাম – তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল ! তুমিও উপায় না পেয়ে সব স্বীকার করলে ঠিকই , কিন্তু নিজেকে যেমন করে হোক সরিয়ে নিতে থাকলে । ফেসবুকে ব্লক করে দিলে ।কতবার ফোন করলেও ধরতে না । ব্যস্ততার অযুহাত দিতে দিতে একদিন চরম অপমান করে সমস্ত সম্পর্কটাতে ইতি টানলে ।
    জানো মেঘ – কত রাত আমি বিনিদ্র থেকেছি । জেদ চেপে গেল । আর একটা নাম দিয়ে একাউন্ট খুললাম শুধু তোমার জন্য । যা ভেবেছিলাম তাই হল । আবার আমার দ্বিতীয় আমির সঙ্গে তোমার প্রেমের খেলা শুরু করলে । বুঝতেও পারলেনা । আরো খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম – তোমার এফ বি ফ্রেণ্ড খুঁজে খুঁজে । জানলাম তোমার চরিত্রটাই এরকম । এত মেয়েকে কিভাবে সামলাও মেঘ ! মুখোশ ? না না সার্কাশের রং মাখা মানুষগুলো দেখেছ? আজ তোমাকে আমার তাই মনে হয় ! রং মাখা মানুষ ! আর কেউ না চিনলেও আমি কিন্তু তোমাকে চিনে ফেলেছি । এই বড় খামের ভেতরে একটা ছোটো খাম আছে । খুলে দেখো — তোমার একটা ছবিকে আমি সাতটা রং দিয়ে সাজিয়েছি । দেখোতো চিনতে পারো কিনা ! ইতি
    বৃষ্টি
    অমল ছবিটা খোঁজে । কই নেইতো খাম !
    বৃষ্টি অন্য নামে তার ফ্রেণ্ড ! কিন্তু কে সে ?কিছু ভাবতে পারেনা আর অমল ! ছবিটা নেইতো !
    সামনে তাকিয়ে দেখে বিনির হাতে একটা ছবি ,-পাপা পাপা দেখো রং মাখা জোকার দেখো দেখো । কাঁপা হাতে ছবিটা ধরে অমল । খুব ক্লোজ একটা ছবি বৃষ্টির সঙ্গে; কিন্তু তার মুখটায় রং দিয়ে একটা জোকার বানানো হয়েছে যেন ! হঠাৎ দরজায় দাঁড়ানো সুধা চিৎকার করে হাসতে শুরু করে ।

  • কবিতা

    কবিতা- ইচ্ছে আমার

    ইচ্ছে আমার
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    ইচ্ছে আমার আকাশ হবো
    ইচ্ছে -হবো বাতাস …
    পাখনা মেলে ইচ্ছে ওড়ে
    এপাশ থেকে ওপাশ।

    এমন যদি হয় তবে ভাই
    ভীষণ মজা হবে ,
    রামধনু রং আকাশখানা
    হাতের মুঠোয় রবে।

    যেথায় খুশী উড়ব আমি
    মেলে রঙিন ডানা,
    প্রজাপতি হবো আমি
    হবো পাখির ছানা ।

    রাতের বেলায় জোনাক হয়ে
    জ্বেলে দেব আলো…
    অন্ধকারে আলোর ছোঁয়ায়
    বাসবে সবাই ভালো।

    এমন যদি সত্যিই হয় …
    নিকষ আঁধার রাতে
    হুতোম পেঁচার রূপ ধরে ভাই
    থাকবো কোনো ছাতে।

    ভয় পেয়ে সব হুড়মুড়িয়ে
    পড়বে ধপাস্ করে…
    বলবে সবে পেঁচার বেশে
    ভুত এসেছে ঘরে।।

  • কবিতা

    কবিতা- জন্মান্তর

    জন্মান্তর
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    বারংবার আঘাত হেনেছ তুমি…
    টলমল শব্দে তবু ভেঙে পড়িনি আমি।
    কতবার হয়েছি স্তম্ভিত
    হয়েছি বাক রোহিত ……
    ভাবিনি কখনো এও হতে পারে
    জীবনে আবার!
    ভাবিনি নিঃশব্দে ইমারত গড়বো তোমার!
    বারবার হয়েছি মিথ্যের মুখোমুখি…
    কতবার খুলেছি তোমার রঙিন মুখোশ!
    তবু পারিনি চলে যেতে।
    সবই জেনে হায় সবই বুঝেও
    তোমার করুণার স্পর্শখানি চেয়ে
    দিয়েছি হাত পেতে।
    ক্ষণে ক্ষণে প্রশ্ন জাগে হৃদয় কোণে
    ভালোবাসা’র স্বরূপ তবে কি?
    উত্তর পেয়েছি মনে
    কবির গানে –” সে যে বড়ই যাতনা ময়।”
    তবে কি সে শুধুই বেদনা দেয়?
    না না, কতবার পেয়েছি পরম লগন,
    হয়েছ জীবনে কাছের সুজন…
    লেগেছে সুখের পরশ।
    সব ভুলে তোমাতে করেছি সমর্পন
    আমার ভালোবাসা।

    কতবার বলেছিলে —
    তুমি ছিলে নাকি কোন জনমে আমার।
    সে-তো নেই স্মরণে !
    মনের দর্পণে একবার শুধু একবার
    দেখতে চাই সে মুখ-খানি।
    বড় সাধ অন্তরে।
    সে সাধ পুরাই কেমনে!

    কোন্ সে জনমে বিদায় বেলার…
    স্মৃতিচিহ্ন কিছু ছিল কি আমার
    তব কাছে ?
    দেখাও হে নাথ ! একবার
    শুধু একবার ।
    সেদিনের সেই বালিকা বেলার ছবিখানি ।
    প্রতিদিন ঊষাকালে
    আনমনে যে মেয়েটি
    ছুটে যেত নদীতটে ;
    ছুটে যেত পাহাড়ের কিনারায়।
    বাঁশির মধুর ধ্বনি তব…
    বার বার দিত তারে হাতছানি ।
    ভোরের শিশিরস্নাত
    বকুল ফুলের মালাখানি…
    জড়িয়ে নিয়ে কোমল হাতে
    ছুটে যেত তব পানে……
    সেই ভালোবাসা আবার এলো যদি ফিরে
    কেন কেন কেন তা এ নামে ! এ রূপে !
    হা ঈশ্বর ! আজ এ জনমে –
    কোনভাবেই আর আমি নই তার
    সে নয় আমার ।
    মাঝখানে কেন তবে এই খেলা ?

    আমার ঠাকুর ! ঈশ্বর মোর ! জীবন দেবতা
    তোমার কাছে রব’না হাত পেতে ,
    নিজেই নিজের ভাগ্য লিখন
    লিখব আঁধার রাতে ।

    চলে যাই ,চলে যাই প্রিয় !
    সুখের সাগরে ভাসাও ভেলা
    জীবন তো নয় শুধুই খেলা ।

    শুধু বিদায় বেলায়
    অপরাধ মোর নিয়োনা মুখে ।
    আজ আঁধার মেঘে সব কিছু যাক চুকে।
    শুধু পাগলা হাওয়ার বৃষ্টি দিনে
    একটিবারের তরে,
    মনের কোণে অতীত স্মৃতি
    রেখো যতন করে ।
    এই জনমে তোমার উপর
    নেইতো কোনো জোর ।
    তাই অন্তিমে আজ প্রার্থনা মোর –
    আর জনমে এসো বন্ধু,
    এসো প্রিয় সখা
    তোমার সাথেই হয় যেন গো
    আমার প্রথম দেখা।।

  • গল্প

    গল্প- নূপুরের শব্দ

    নূপুরের শব্দ
    শিলাবৃষ্টি

     

     

    সুনীতি দেবীর আজ আর মনে পড়েনা কবে থেকে তিনি কলম ধরেছেন ! প্রথমে কবিতা লিখতেন ,কবিতার বেশ কয়েকটা বইও নিজে শখ করে তখন প্রকাশ করেছিলেন । পরের দিকে গল্প লেখায় মেতে উঠলেন। সে সব অনেক কাল আগের কথা । একটু একটু করে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে । পাঠক মহল অপেক্ষায় থাকে সুনীতি রায়ের নতুন উপন্যাসের কবে মোড়ক উন্মোচন হবে! আর ফিরে তাকাতে হয়নি । সাহিত্য জগতে এখন সম্মান প্রতিপত্তি অগাধ । তবু নিজেকে মাঝে মাঝে বড় একা লাগে। বাবা মাও মারা গেছে । বোন ভগ্নীপতি মুম্বাইবাসী।
    তবে এই পূজোর আগেটায় খুব চাপ থাকে।
    শারদীয়া সংখ্যার জন্য পাবলিসার্সদের বায়নার শেষ নেই। এই তিন মাস দিনরাত লিখতে হয় সুনীতিকে। আর লেখার জন্য নিজেকে নির্বাসন দেন তিনি জয়পুর জঙ্গলের পাশের এই আস্তানায়, নাম “বনলতা”। ভীষন নির্জন । এই বাংলোটা বাবা কিনেছিলেন এককালে । নামটা অবশ্য সুনীতি দেবীই রেখেছিলেন “বনলতা”।
    গতকাল বিকেলে জয়পুরে এসে পৌঁছেছেন তিনি । কেয়ারটেকার গঙ্গাধর আগেই সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল। বনলতার দোতলার ব্যালকনিটা সুনীতি দেবীর খুব প্রিয় । সন্ধেবেলায় আরামকেদারায় বসে আছেন, কুয়াশা মোড়া অন্ধকার গাছগাছালি মধ্যে জোনাকির মিটমিটে আলো। বেশ গা ছমছমে একটা পরিবেশ। নদীর ঢেউএর মৃদু শব্দ …এমন সময় কানে আসে শুকনো পাতার মচমচ আওয়াজ ।
    -কে? গঙ্গাধর ? নাহ কেউ নয়।
    পরের দিন সন্ধ্যা। বারান্দায় বসে ব্ল্যাক কফির পেয়ালায় চুমুক দেবেন হঠাৎ আগের দিনের মতোই শব্দ ! যেন শুকনো পাতায় কেউ নূপুর পায়ে হেঁটে গেল । সচকিত হলেন ,শব্দটা দূরে মিলিয়ে গেল। রহস্যের গন্ধ ! ডিনারের সময় গঙ্গাকে জানালেন। সে বলে দিল
    – জন্তু জানোয়ার হবে !
    সন্ধ্যায় বসে পরবর্তী উপন্যাসের কাহিনী ভাবছিলেন সুনীতি আর প্রতীক্ষায় ছিলেন সেই পদশব্দের। তখন আটটা দশ , আবার শুনলেন শুকনো পাতার উপর নূপুরের শব্দ । দেরী না করে দ্রুত নেমে এসে শব্দ অনুসরণ করে এগোতে থাকলেন।
    অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। ঠিক সেই সময় শাল গাছটার পাশে হালকা আলোর আভাস দেখতে পেলেন । বুঝলেন ভুল হয়নি তাঁর। রহস্য ঘনীভূত। ভয় পেলেন খুব, তবু চিৎকার করে বললেন-
    – কে ? কে ওখানে ? বেরিয়ে এসো।
    সেই মুহূর্তে টর্চটাও বিট্রে করলো। ব্যাটারীর মশলা বোধহয় ফুরিয়ে গেছে। ছুটে পালালো কেউ । শুকনো পাতার ওপর ঝুমঝুম শব্দটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
    ফিরে এলেন বনলতায় ।
    আশ্চর্য হলেন আরও। নীচের ভাঙা স্টোর রুমে আলো জ্বলছে ! একি ! এতো রহস্যের ওপর রহস্য ! ঘুম আসছেনা । খুব চিন্তায় পড়লেন । এতবার এখানে এসেছেন ,মাসের পর মাস কাটিয়েছেন কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
    কে ছিল জঙ্গলে? রোজ শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কে হেঁটে যায় নূপুর পায়ে ! সে যে মহিলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্টোর রুমে আলোই বা কিসের ! এ রহস্যের কিনারা করতেই হবে তাঁকে। গঙ্গাধর নিশ্চয় কিছু জানে ,কিন্তু বলছেনা। নাঃ ঘুম আর আসবেনা । এভাবেও তো চলতে পারেনা । এই রহস্যের কিনারা তাকেই করতে হবে।

    পরের দিন রাতে …
    গঙ্গাধর খাওয়ার জন্য তাগাদা দিল একটু বেশি তাড়াতাড়িই। খেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন, তারপর অন্ধকার বারান্দায় সন্তর্পনে গিয়ে দাঁড়ালেন , হুমম – যা ভেবেছেন তাই। স্টোর রুমে আলো জ্বললো । সন্তর্পনে নেমে এলেন নীচে। রুমের ভেতরে ফিসফিস করে কথা বলছে কারা ! সুনীতি ঘেমে উঠলেন ,দরজাটা ঠেলে দিলেন । একি ! গঙ্গাধর আর একটি শ্যামলা আদিবাসী মেয়ে খেতে বসেছে ঘরের এক কোণে !
    ততক্ষণে ওরাও ভয়ে কাঠ। ভুত দেখার মতো দুজনেই চমকে উঠেছে।
    —খেয়ে নাও, তারপর ড্রইংরুমে এসো তোমরা‌। গম্ভীর গলায় বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
    একটু বাদেই দুজনে ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ালো সুনীতি দেবীর সামনে।
    – বসো।
    একটু তফাত রেখে মাটিতে বসল দুজন।
    – গঙ্গাধর ! এই মেয়েটি কে ? আর কেনই বা আমার কাছে মিথ্যে বলেছ তুমি ? তোমার বাবা এই বনলতার দেখাশোনা করেছেন প্রায় তিরিশ বছর । এখন তুমি ।
    কিন্তু এসব কি ? সব সত্যিটা আমাকে বলো।
    এরপর গঙ্গাধরের মুখে যা শুনলেন –
    এই মেয়েটি গঙ্গাধরদের পাশের গ্রামের , নাম দুগ্গা। গঙ্গাধর ভালোবেসে মন্দিরে বিয়ে করেছিল কয়েক মাস আগে, কিন্তু দুগ্গার দাদা বোনের বিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে দোজবরে বুড়োর সাথে পাকা করে ফেলেছিল । চার দিন আগে দুগ্গা ঘর থেকে পালিয়ে আসে। গঙ্গাধর উপায় না পেয়ে এই ভাঙা ষ্টোর রুমেই তাকে লুকিয়ে রাখে।

    – কিন্তু তোমার বাড়িতে ওকে কেন নিয়ে গেলেনা ? আর ও প্রতি রাতে কেন বেরোতো জঙ্গলের দিকে ?

    – না দিদিমণি। আমাকেও ওরা পাগলের মতো খুঁজছে।
    দুগ্গা আমার ফোন থেকে ওর সইকে ফোন করতে রাতের বেলা বাইরে বেরোতো-গ্রামের পরিস্থিতি জানার জন্য ।
    বনলতায় টাওয়ার থাকেনা।
    এতক্ষনে সব রহস্যের জট খুললো । রাত দুটো বেজে গেছে। উঠলেন তিনি ।
    -আমাকে সব কথা তোমার জানানো উচিত ছিল গঙ্গাধর।
    – দিদিমণি ! কিছু তো কর । আমাদের বাঁচাও , খুঁজে পেলে উরা মোদের বলিটো দিবেক ।
    দুগ্গার আকুতিতে ফিরে তাকালেন সুনীতি ,নজর পড়ল তার পায়ের নূপুরে। এবার তাঁর কাছে সবটা পরিষ্কার হল।

    – না না ভয় পেয়োনা। আমি পুলিশ নিয়ে ঐ গ্রামে যাবো। বলি দেওয়া কী এতই সোজা ? যাও তোমরা। অনেক রাত হয়েছে । আমিতো আছি ,ভয় কি ?
    নিঝুম ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন তিনি । মনে এসে ছুঁয়ে গেল নিজের যৌবন । কলেজ জীবনে সুশান্ত তাকে ভালোবেসেছিল । তিনিও নীরব সায় দিয়েছিলেন সেদিন ; কিন্তু বাবা মেনে নেননি সেদিনের সেই অসম প্রেমকে। অনেক কষ্টে নিজেকে একটু একটু করে সরিয়ে আনতে হয়েছিল সুশান্তর ভালোবাসা থেকে । ভালোবাসার মর্যাদা দিতে গিয়ে সারাজীবন একাই কাটালেন।
    রাতজাগা একটা পাখি ডেকে উঠল শাল- সেগুনের জঙ্গলের ভেতর থেকে।
    তাঁর জীবনে ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু দুগ্গা আর গঙ্গাধরের ভালোবাসাকে তিনি বাঁচাবেন। তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের নাম দেবেন ” দুগ্গা “।।

  • কবিতা

    কবিতা- শরতের স্মৃতি

    শরতের স্মৃতি
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    অঙ্গণে আজ মা দুর্গা
    খুশির ছোঁয়া মনে,
    শিশির ভেজা স্বপ্নগুলো
    লুকায় মনের কোণে।
    তোমার আশায় আকুল আঁখি
    নীরব অশ্রু ঝরায়
    চেয়ে চেয়ে পথের পানে
    সে বুঝি আজ ঘুমায়!
    মনে পড়ে,সেদিনের সেই
    মিষ্টি বিকেল বেলা?
    সোনাঝরা রোদের দুপুর
    লুকোচুরির খেলা?
    গানে গানে পথ চলা সেই………
    দিন গুলো আজ কোথায়!
    আজকে সবই স্বপ্ন শেযে
    বাস্তবের এই পাতায়।
    ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু
    গুনতে বসি আজও-
    তুমি ছাড়াই দিনগুলো যায়
    হয় না কোনো কাজও
    শিউলিগুলো আজও ঝরে
    যেমন দেখেছিলে…
    দূর্বাঘাসে শিশির দেখে
    সেদিন বলেছিলে-
    “আমাদের এই ভালোবাসা
    জন্ম জন্মান্তরে,
    যেমন করে সব শরতে
    শিউলিগুলো ঝরে।”
    আজকে সবই স্বপ্ন যেন
    শিশির ভেজা ভোরে…
    কোথাও তোমায় পাইনা খুঁজে
    তেমন আপন করে।

  • কবিতা

    কবিতা- আমিই সেই দশভুজা

    আমিই সেই দশভুজা
    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    নারী হয়ে জন্ম আমার,
    কিন্তু ধরি শক্তি অপার…
    সেটাই আমার অহংকার,
    ঘোচাতে চাই অন্ধকার।

    মাতৃ স্নেহ আমার বুকে,
    ভগ্নি আদর আমার মুখে,
    প্রেমের ধারায় সিক্ত হিয়া,
    প্রেমিক হৃদে জ্বালাই দিয়া।
    পরকে আপন আমিই করি,
    মিষ্টি কথায় হৃদয় হরি।

    ঢাল তলোয়ার ঝাঁসির রাণী
    স্বাধীনতায় মাতঙ্গিনী —
    আমিই আবার বীণাপাণি,
    ব্রতকথায় লক্ষ্মী মানি।
    আলতা সিঁদুর বরণডালা…
    স্বয়ম্বরে পরাই মালা।

    ঘোমটা মাথে আলের ধারে …
    কলসী কাঁখে নদীর চরে ,
    কোমল হাতে রাঁধি বাড়ি …
    উল বুনছি কাঁড়ি কাঁড়ি ।
    দশটা পাঁচটা অফিস করি
    কত কথাই শুনে মরি ।

    নারী আমি শক্তিধারী –
    শারদীয়ায় ত্রিশূল ধরি।
    মা বোনেদের অত্যাচারে-
    এগোই আমি অন্ধকারে।
    কালি হয়ে খড়্গ ধরি,
    অসুর নিধন আমিই করি।

    আমি নারী, জিন্স-কুর্তা-
    সর্ব দিকেই স্বতঃস্ফুর্তা।
    টেনিস খেলি, ক্রিকেট খেলি,
    মুখের উপর ধরি চেলি।
    কখনো বা বোরখা পরি–
    ভাঙবো তোদের জারিজুরি।

    অত্যাচারী অত্যাচারের…
    চাই প্রতিবাদ বন্ধ দ্বারের।
    ঘুচিয়ে দেব অন্ধকার …
    সেটাই আমার অহংকার।

You cannot copy content of this page