• কবিতা

    কবিতা- খুঁজে ফেরা

     খুঁজে ফেরা
     -শিলাবৃষ্টি

     

     

    জীবন খুঁজে পাওয়ার আশায়
    ছুটছি সবাই ছুটছি ;
    কোথায় পাবো সুখপাখিটা
    খুঁজছি শুধু খুঁজছি।

    সাগর পাড়ে পাহাড় ধারে
    সবুজ ঘাসে শিশির পরে –
    নদীর ধারে বালুর মাঝে
    হাঁটছি কেবল হাঁটছি ,
    জীবন খুঁজে পাওয়ার আশায়
    ছুটছি শুধু ছুটছি ।

    মনের মাঝে ভালোবাসা ,
    সব কিছুতে ভালোর আশা ,
    আঁধার কালোর পথ পেরিয়ে –
    আলোর দিশা খুঁজছি,
    জীবন খুঁজে পাওয়ার আশায়
    ছুটছি শুধু ছুটছি ।

    পুতুল নাচের পুতুল হয়ে ,
    ভালো থাকার অভিনয়ে ,
    দেখনা সবে সংসারেতে
    সবাই সেরা হচ্ছি ।
    কোথায় পাবো সুখ পাখীটা
    খুঁজছি শুধু খুঁজছি ।

    সংসারেতে সং সেজে আজ
    সবার তরে করছে সে কাজ।
    সুখ-তালাটার চাবিকাঠি ,
    খুঁজছে শুধু খুঁজছে –
    জীবন খুঁজে পাওয়ার আশায়
    ছুটছে সে আজ ছুটছে।

    একলা আসা একলা যাওয়া
    মাঝখানেতে মানুষ পাওয়া
    কান্না-হাসির দোলনাখানায়
    দুলছি মোরা দুলছি ।
    কোথায় পাবো সুখপাখীটা
    খুঁজছি শুধু খুঁজছি ।

    আয়না দেখি, বেরিয়ে পড়ি
    পথের মাঝে থাকনা নুড়ি
    সীমার মাঝে অসীম পেতে
    চলছি মোরা চলছি ,
    জীবন খুঁজে পাওয়ার আশায়
    ছুটছি সবাই ছুটছি ।।

  • গল্প

    গল্প- অবিশ্বাস্য

    অবিশ্বাস্য
    – শিলাবৃষ্টি ( করকাশ্রী চট্টোপাধ্যায়)

     

     

    গ্রামের বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আজ সন্ধ্যায় রোগীর ভিড় বেশী ছিলনা। মেঘলা আকাশ, খুব বাতাস বইছে, হয়তো কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে রাজু মানে ডঃ রাজেন্দ্র রায়। নদীর পাড়ে গিয়ে বহুদিন বাদে বসে। মনে পড়ে যায় সেই ছেলেবেলার সুন্দর দিনগুলোর কথা। জীবন সায়াহ্নে এসে আজ অনেক ছোট ছোট স্মৃতির সাথে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ভেসে ওঠে মনের কোণে।
    রাজেন্দ্রনাথ রায়- এখন প্রতিষ্ঠিত এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সে। ভবানীপুরে বাড়ি করেছে, একতলায় সুসজ্জিত চেম্বার। ভাবনার পথ ধরে অনেকগুলো দিন পিছিয়ে যায় রাজু ।

    তখন জয়েন্ট এনট্রান্স দিয়ে সবে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে থাকে।বাড়ীতে মাসে একবার যেতেই হয়, টাকা পয়সা আনতে হয়। অনেক খরচ।
    শহুরে জীবনে খাপ খাওয়াতে তার একটু সময় লাগছে। হোস্টেলের সিনিয়াররা বিভিন্ন ভাবে raging চালায় মাঝে মধ্যেই।
    মনে পড়ে গ্রামের সহপাঠী রতনের কথা। ভীষণ বোকা বোকা মুখ, ইয়ার্কি বুঝতো না। তখন কত ভাবে তাকে হ্যারাস করেছে রাজুরা। মাঝে মাঝে ব্যাগে নিজের টিফিন দেখতে না পেয়ে রতন তো কেঁদেই ফেলতো।হাজার কথা মনে আসে – ঘুম আসতে অনেক দেরী হয়ে যায়। কলকাতা শহরে সারারাতই নানান শব্দ। কখন যেন চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দরজায় শব্দ- কে যেন ডাকছে।আবার কেউ টোকা দেয়, না ভুল নয়, আজ রুম মেট অশোকও নেই। দরজা খুলে দেয় রাজু। রতন? এতো রাতে!
    – আয় আয়।
    – চল, ভেতরে চল।
    – কি ব্যাপার! কলকাতায় এসেছিলি?
    – হ্যাঁ রে, ভাবলাম তোর সাথে দেখা
    করে যাই।
    – ভালো করেছিস, আমি তো ভোরেই বেরবো, বাড়ী যাব। একসাথে বেরিয়ে
    যাব।
    – ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না রে রাজু, তার আগেই বেরোব।
    – ঠিক আছে। খাবি তো কিছু?
    – না, খেয়ে এসেছি। অনেক খেয়েছি আজ। শুয়ে পড়, আমি একটু বসছি।
    – তাহলে আয়, বাকি সময়টুকু গল্প করে কাটিয়ে দি।
    – বাঃ খুব ভালো হয়। রাজু আমি তোকে খুব ভালোবাসতাম রে, পড়াশুনায় তুই কত ভালো ছিলি! তাই সাহস করে তোর কাছে এগোতে পারিনি। আর তোরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতিস জানি, বোকা ছিলাম তো! সেটাই স্বাভাবিক! আজ সত্যি বলছিরে – তোকে আমার খুব ভালো লাগত, হিংসেও করতাম। তোর মতো বুদ্ধি ভগবান আমাকে
    দিল না কেন? অনেক স্বপ্ন ছিল রে, কিছু
    পুরণ হল না। জীবনে খুব অবসাদ এসে গেছিল।
    – রতন,তুই এভাবে বলছিস কেন? এই তো শুরু জীবনের, অনেক কিছু করার আছে আমাদের।
    – না না! আমার দ্বারা আর কিছু হতো না রে, তাইতো সব শেষ করে দিয়েছি। দাদা-বৌদির দিনরাত কথা শোনানো, বাবা-মায়ের আমাকে নিয়ে হতাশা। তার চেয়ে এই ভালো।
    – কি ভালো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না রতন। তুই কলকাতায় কেন এসেছিলি? আমাকে খুলে বল।
    – তোর জন্যই এসেছিলাম রে বন্ধু। মনে পড়ে তোর- স্কুলে আমাকে নিয়ে কতো মজা করতিস তোরা? আমাকে বোকা বানানো তোদের নিত্যদিনের একটা কাজ ছিল।কতদিন এমন হয়েছে- যে আমি নীরবে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছি। আজ হঠাৎ মনে হল – তোকে একটু চমকে দিই।
    হা হা হা ……
    রাজু চমকে ওঠে। রতন কি বিকট ভাবে হাসছে। অল্প আলোয় ওর মুখটাও কেমন বীভৎস লাগছে, ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। গা ছমছম করছে কেন?
    – নারে উঠি। আরেক জায়গায় কাজ
    আছে।
    – তার মানে? তুই যে বললি, একসাথে বেরোব?
    – না! তুই ঘুমিয়ে নে ঘন্টাখানেক। চললাম রে। খুব ভালো থাকিস, বড় ডাক্তার হয়ে –
    গ্রামকে ভুলে যাস না – ভাই, গ্রামের গরীব মানুষগুলোর কাছে পয়সা চাস না কখনও।

    আচমকা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় রতন। অবাক লাগে। রতন এত কথাও বলতে পারে? এভাবেও হাসতে পারে?
    বাকি রাতটা চোখের পাতা এক করতে পারেনা রাজেন্দ্র। ভোরে বেরিয়ে পড়ে – ফার্স্ট বাসটা ধরেই যাবে।
    বাসস্টপ থেকে নেমে প্রায় পাঁচ মাইল রাস্তা। হাঁটতে শুরু করে রাজু। কালী মন্দিরে প্রণাম করে লাল মাটির রাস্তাটা ধরে সে। রাস্তায় লোকজন কম। কাল রাতে রতনের আকস্মিক আগমন – এত কথা – চলে যাওয়া – সব মনে করতে করতে এগোয় সে।
    – বল হরি.. হরি বোল্,
    বল হরি হরি বোল। থমকে যায়
    পা দু’টো, পাশের গ্রামের কেউ মারা গেছে বোধহয়। অনেক মানুষ, মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে।
    শ্মশানের দিকে। পরিচিত মুখও অনেক আছে সঙ্গে। রাজু একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করে
    – ও কাকা, কে গো? কে মারা গেছে?
    – হায় হায় বাবা, কী বলি বলো, তোমাদের বয়সি জোয়ান ছেলেটা কাল রেল লাইনে গলা দিয়েছে,তখন রাত এগারোটাট। সে কি কান্ড সারারাত – গ্রামে কারো চোখে ঘুম নেই।
    – কে ? কার কথা বলছ?
    – ঐ যে গো – পূব গাঁয়ের হারান মিত্রের ছেলে রতন মিত্র।
    – কী? কি বলছো তুমি কাকা, কখন ঘটেছে – এ ঘটনা?
    – খবর পেয়েছি আমরা রাত এগারোটায়।তা দশটা হবে হয়তো …
    – কী বলছো তুমি? রাজু আর দাঁড়াতে পারে না। তার খুব শরীর খারাপ করছে। তবু বিশ্বাস করতে পারে না সে। টলতে টলতে শ্মশানের দিকে যায়। বডি নামানোর পরে রতনের মুখটা দেখতে পেয়ে – রাজু জ্ঞান হারায়।

    এ ঘটনা অবিশ্বাস্য, তাই জনে জনে বলে উপহাসের পাত্র সে হয়নি
    সেদিন। তবে পরবর্তী জীবনে রতনের কথা সে যতটা সম্ভব রাখতে চেষ্টা করেছে।
    গ্রামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরী করে – সপ্তাহে একদিন গরীব মানুষগুলোর বিনে পয়সায় চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।

    গায়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে সম্বিৎ ফেরে রাজেন্দ্রর। নদীর ধারের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে । তাড়াতাড়ি বালি ঝেড়ে হাঁটতে শুরু করে সে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে।।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- হঠাৎ খুশী

    হঠাৎ খুশী
    – শিলাবৃষ্টি

     

    নগর কলকাতায় জন্ম রিনির, গ্রামবাংলার কিছুই দেখেনি সে। শম্পার জেদেই- তার মামারবাড়ীর দুর্গপূজো দেখতে বেরিয়ে পড়ল ছুটিতে।
    একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। নাম সুবর্ণা। যেন তুলি দিয়ে আঁকা সে গ্রাম। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে বিকেলে রিনি, দু’পাশে সাদা ধবধবে কাশফুল, নীল আকাশে সাদা মেঘেদের আল্পনা। নদীর দুইধারে ছোট ছোট গ্রাম। প্রতিটা বাড়িতে শিউলির ঝরে পড়া যেন আগমনী গান। বেশ কয়েকটা পুকুরে পদ্ম শালুক জল থেকে মাথা তুলে যেন বলছে – আমি ফুটে গেছি। মাটির বাড়ীগুলোর দেওয়ালে সুন্দর আল্পনা! রিনি ভাবে কবিরা এইসব দেখেই বুঝি কবিতা গুলো লেখে। তার মনেও ছন্দ খেলে —
    আজকে বুঝি জীবনতরণীতে-
    হঠাৎ খুশী ঘনিয়ে আসে চিতে।

    ভালো লাগে তার এই গ্রামবাংলার নানান জীবন্ত ছবি। আর ভালো লেগে যায় একজনকে … যে আনমনে বাঁশী বাজায় বিকেলের অস্ত আলোয় নদীর ধারে বসে। সে সুর যেন সমস্ত আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়, আর রিনির সারা মন নাড়া দিয়ে যায় সে সুরের বিস্তার।

  • কবিতা

    কবিতা – দুগ্গা ও দুর্গা

    দুগ্গা ও দুর্গা
    -শিলাবৃষ্টি

     

    দুগ্গা আমার অষ্টবর্ষী
    চঞ্চলা এক প্রাণ ,
    গিন্নীপণায় চতুর ভঙ্গী
    মান আর অভিমান।
    দুগ্গা আমার ঝুমুর ঝুমুর
    রুপোর নূপুর পায়,
    সারা দিনমান কচি কচি পদে
    উঠোন পানে ধায়।
    দুগ্গা আমার আধো আধো বোল
    ভোরের দোয়েল পাখি,
    লাল টুকটুকে ঠোঁট দু’টি তার
    পটল চেরা আঁখি।
    দুগ্গা আমার এক পৃথিবী
    আর সবি রবে পাশে।
    মাতৃ জঠোর ভরেছে দুগ্গা
    সেদিন আশ্বিন মাসে।

    আমার দুর্গা শিউলি সুবাসে,
    কাশের দোলায় হাসে,
    আকাশের নীলে পেঁজা তুলো মেঘ
    ছবি কথা হয়ে ভাসে।
    আমার দুর্গা শিশিরে শিশিরে
    শরৎ ঘোষণা করে।
    ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খে শঙ্খে
    পল্লীবালার ঘরে।
    আমার দুর্গা বরাভয়দায়ী
    আঁধার বিনাশ করেন ,
    ঘরে ঘরে তিনি বন্দিতা হন
    জয়ের মাল্য পরেন।
    আমার দুর্গা সার্বজনীন
    বোধন বিসর্জনে,
    সিংহবাহিনী আমার দুর্গা
    সর্বকালের মনে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- মা দোয়েল

    মা দোয়েল
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    অনেক দিন আগের একটা ঘটনা — যা মনকে নাড়া দিয়েছিল খুব। একটা ছোট্ট মা দোয়েল পাখির মনছোঁয়া কাহিনী।আমাদের একতলা বাড়ির ছাদে সবসময় কারণে অকারণে যেতেই হত। সবচেয়ে বড় কথা বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে খোলাছাদ আমার এক নিরালা আস্তানা ছিল। সামনের বাড়ির পাঁচিলের ওধারে রক্তকরবীর গাছ কবে যেন অনেক বড় হয়ে গিয়ে আমাদের ছাদের সামনেই ডালপালা মেলে নিজের আনন্দে হাওয়ার তালে দোল খায়। আর সেই গাছের আনাচে কানাচে নেচে বেড়ায় দোয়েল, বুলবুলি, চড়াই পাখিরা। একদিন নজরে পড়ল গাছের ভেতরের দিকে গোপন ডালে – এক বুলবুলি মুখে করে শুকনো ঘাস বা খড় জাতীয় কিছু নিয়ে এসে বাসা বাঁধছে আর মাঝে মাঝে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। এরপর আমার কৌতুহলী চোখ ওই দিকেই চলে যেত। দু’ এক দিন পরে দেখলাম নীড় সম্পূর্ণ, আর দোয়েল পাখির দেহের অর্দ্ধাংশ সেই বাসায়। বেশ কয়েকবারই নজরে এল এই দৃশ্য। বুঝলাম ওখানে ওর ডিম আছে। কদিন পরে নজরে এল মুখে করে কিছু নিয়ে এসে ওই মা পাখিটা ছানাগুলোকে বোধহয় খাওয়াচ্ছে, তবে ছানাগুলোকে সেভাবে দেখতে পেতামনা। মন উসখুস করতো দেখার জন্য।
    মাসটা বোধহয় বৈশাখ ছিল! বিকেল থেকে প্রবল ঝড়, আর তারপরে নামলো বৃষ্টি! চারিদিক তোলপাড়! লোডশেডিং, অন্ধকার! হঠাৎ মনে পড়ে গেল করবী গাছে দোয়েল ছানাগুলোর কথা! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আহারে ছানাগুলো তো উড়তেও পারেনা। এই প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে ওরা মরেই গেল বোধহয়! তখনো বৃষ্টি কমেনি প্রবল কৌতুহল বশতঃ একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে ছাদে গেলাম, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! হাওয়া! গাছটা প্রবল দুলছে। লক্ষ্য স্হির করে টর্চের আলো ফেললাম, যা দেখলাম
    তা চমকের থেকেও আরো কিছু ছিল! মনে হয় বিস্ময়! আমি চমকে গেলাম, এও সম্ভব! দেখলাম,
    মা দোয়েল পাখিটা তার ছোট্ট শরীর আর আরো ছোট্ট দুটো ডানা দিয়ে তার বাসার মুখটা বন্ধ রেখেছে। এই প্রবল ঝড়ের আঁচ বা বৃষ্টির জলের ঢল – সে তার সদ্যোজাত সন্তানদের লাগতে দেয়নি। অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি ওই এক আঙুল একটা পাখির এত ক্ষমতা? নিজের ছানাগুলোকে বাঁচাতে এত বড় কালবৈশাখী নিজের ছোট্ট শরীরের দিয়ে বাধা দিয়েছে! চোখটা সেদিন শুকনো রাখতে পারিনি।
    আমি নিজে একজন মা । লক্ষ হাজার মায়ের মধ্যেও সেই মা দোয়েল আমার চোখে শ্রেষ্ঠ মা। সেদিনের
    সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা।

  • কবিতা

    কবিতা- বিবেকের খোঁজে

    বিবেকের খোঁজে
    – শিলাবৃষ্টি

     

    বিবেকের মেলা বসেছে আজকে
    নগরের এক প্রান্তে,
    হারিয়েছে আজ মানুষ বিবেক-
    কষ্ট হচ্ছে মানতে!
    মানবতা দেখো বিপন্ন বড়ো
    প্রতি পদে প্রতি ক্ষণে,
    মানবের পাশে মানব কোথায়?
    শুধাই জনে জনে।
    বিবেক কিনতে দ্বিধা কেন ভাই,
    নিজের মনকে শুধাও,
    মনুষ্যত্ব দেখাতে কি তুমি
    ভীষণ লজ্জা পাও?
    ধর্মের ধ্বজা ওড়েনা তো আজ
    লাঞ্ছিতা হন মাতা;
    ফুলের শিশুরা ছাড় পায়নাতো
    পথে হয় ধর্ষিতা।
    মানুষের তরে মানুষ কোথায়?
    হারিয়ে যাচ্ছে সাম্য!
    শিরদাঁড়াটাকে সোজা রেখে আজ
    একটা বিবেক কাম্য।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- অসমাপ্ত

    অসমাপ্ত
    -শিলাবৃষ্টি

     

    চোখে হাজার স্বপ্ন অরুণের। কিন্তু ব্যর্থতা পদে পদে। মা, বাবা, বোন তার মুখ চেয়ে দিন কাটাচ্ছে। জানে না অরুণ কিভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে! পার্টির লোকজন ধরে চাকরি তার মতো লাজুকের হবে না,
    ইন্টারভিউ দিয়েই চলেছে কিন্তু কোথাও কোনো আলো দেখতে পায়না সে। টিউশনি করে কয়েকটা, বাবার সামান্য পেনশনে চলছে সংসার।
    দীপা আর তার সম্পর্কটাও বন্ধুত্ব থেকে এগিয়ে গেছে। দীপার বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ দেখছে। কিছুই করার নেই। একে অন্য জাত, তার ওপরে বেকার ছেলেকে কেই বা কন্যা দান করবে!
    হতাশা কুরে কুরে খায়। অরুণ মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে পড়ছে। দীপা পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু অরুণের পক্ষে তাও সম্ভব নয়।
    চোখের সামনে দীপার বিয়ে হয়ে গেল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিই বা করতে পেরেছে সে!

    অবশেষে প্রাইমারি স্কুলে চাকরিটা পেল অরুণ। মনটা তবু শান্ত হল না। দীপার বিয়ের আগে কেন সে চাকরিটা পেল না। এইসব চিন্তায় কষ্ট পায় সে। বছর দু’য়েক কেটে যায় ভালো মন্দে। বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ভালোবাসাহীন বিয়ে অরুণ করতে চায় না। আরও কিছুদিন পরে.. প্রায় সন্ধ্যে হয় হয়। অরুণ স্কুল থেকে ফিরছে। প্রচন্ড মেঘ আকাশে। কালবৈশাখী ঝড় প্রায় শুরু হয়ে গেছে, পা চালায় অরুণ। কিন্তু পলাশ গাছটার পাশে সাদা শাড়ী পরে কে যেন দাঁড়িয়ে, এই সময় এখানে দাঁড়িয়ে আছে কে! চলে যেতে পারে না অরুণ, অস্বস্তি দানা বাঁধে। এগিয়ে যায়, “কে ওখানে? ঝড় এসে গেছে। কে ওখানে?”
    মহিলা খুব ধীরে আত্মপ্রকাশ করে। সামনে এগিয়ে আসে। দীপা! চরম বিস্ময় অরুণের। আলো আঁধারিতে ঠিক বুঝতে পারে না অরুণ।
    -“অরুণদা, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
    -“অপেক্ষা? অপেক্ষা তুমি করতে পারোনি দীপা..”    অরুণ না বলে পারে না কথাটা।
    “তোমার সাথে কিছু কথা আছে অরুণদা..”
    -“কিন্তু ঝড়! বৃষ্টি শুরু হবে।”
    – “হুম, তাই বল, বরাবর আশঙ্কাই করলে অরুণদা! চলো না ঐ নাটমন্দিরটায় একটু বসি, সেই আগের মতো”।
    –“কেউ দেখলে কী ভাববে? তুমি পরস্ত্রী এখন”
    – “অরুণদা! পরস্ত্রী ভেবে আমার দিকে এখনো ভালোভাবে তাকাওনি বুঝি? দেখ, আর আমি পরস্ত্রী নই, সব শেষ অরুণদা।”

    কী বলছে দীপা, বুঝতে কষ্ট হয়, ভাবতে আরও কষ্ট হয়। দীপা কী বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে! অন্ধকারে ভালোভাবে কিছু দেখতে পায়না অরুণ। নাট মন্দিরে বসে অনেক কথা বলে গেল দীপা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়েই দীপা বুঝেছিল তার স্বামী একজন গে, কোন মেয়ের প্রতি তার আকর্ষণ কোনদিন ছিলনা। সমস্ত আকর্ষণ এক পুরুষ বাল্যবন্ধুর ওপর। নাম-কান্তি, তার সঙ্গেই সারাদিন মেলামেশা।
    বুঝতে পারেনি বাড়ির লোক, ভেবেছিল বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, সবটাই ভুল। তাই ডিভোর্স অনিবার্য, তার স্বামীও তাকে মুক্ত করতে চায়।
    ফিরে এসেছে অবশেষে দীপা, কিন্তু অরুণ কি করবে।কেমন যেন সব ওলোট-পালোট লাগে, দীপা অনেক্ষণ নীরব হয়ে বসে থেকে বলে, ‘চলো অরুণদা, বৃষ্টি থেমে গেছে।
    হাঁটতে হাঁটতে দীপা আরও বলে, “অরুণদা, তুমি খুব সমস্যায় পড়লে তাইনা? তুমি চিন্তা করোনা। না, গো আর বিয়ে করার মানসিকতা আমার হবে না। তুমি আমার পরম বন্ধু, তাই তোমাকে সবটাই জানাতে চেয়েছিলাম, জানালাম। আমায় একটা কাজ খুঁজে নিতে হবে। জীবনকে আমি ব্যস্ত করে তুলবো অরুণদা। তুমি শুধু বন্ধু হয়ে আমার পাশে থেকো, হাতটা ছেড়ে দিওনা কোনদিন…”
    অরুণ দীপার ডানহাতটা ধরে বলে, “নিশ্চিন্ত হয়ে পথ চলো দীপা, এই অন্ধকার বন্ধুর পথে তোমায় আমি পড়ে যেতে দেবনা।”

  • গল্প

    গল্প- খেলা ঘর

    খেলা ঘর

    -শিলাবৃষ্টি

     

     

    খেলাই বটে!
    জীবনের এক চরম খেলা!
    ফেসবুকের খেলা!
    আজ আশার হৃদয় ব্যাকুলতায় ভরা। ভালো লাগছেনা কিছুই । সারাটা দিনের পরে অবসরে সব যেন ছবির মতো ভেসে উঠছে। ফেসবুকে পরিচয়। এত কিছু বুঝতো না আশা। কেমন যেন মায়া পড়ে গেল ছেলেটার ওপর। দিন দিন কথা বাড়ে- ফোনে, মেসেজে। নাম রাতুল। চাকরি একটা করে, তেমন কিছুই না।বিশ্বাস করে ফেলেছে সম্পূর্ণ আশা। বয়েসে অনেকটাই ছোট রাতুলের ওপর খানিকটা নির্ভরতাও এসে গেল। একদিন দেখাও হল।তারপর থেকে দরকারে অদরকারে দেখা হওয়া বেড়েই চলল। পরিবারে অনেকগুলো মানুষ। মেয়ে, স্বামী, দেওর, শাশুড়ির চোখ বাঁচিয়ে কেমন যেন অনেক কাছাকাছি চলে এলো তারা। অদ্ভুত এই সম্পর্কের কথা ভাবলে অবাক হয় আশা। রাতুল শোনায় নিত্য নতুন ভালোবাসার কথা, ভালো লাগে। এমন ভাবে তো কখনো কেউ বলেনি।
    স্বামীর সাথে সম্পর্ক কোনকালেই গাঢ় ছিলনা, দিনে দিনে আরো তেঁতো হয়েছিল।শুধু ব্যবহারিক জীবনে যেটুকু কথাবার্তা হয় … সেইটুকুই। তাই আশা রাতুলের ভালোবাসায় ভেসে গেল। কয়েকটা বছর
    অদ্ভুত এক স্বপ্নের মধ্যেই দিন হল অতিবাহিত। একেই বোধহয় প্রেম বলে।
    আশার এখন মনে হয়..রাতুল আগের মতো নেই। কেমন যেন পাল্টে গেছে। এখন সময় তার কাছে দামি অনেক। কাজের অনেক চাপ। বিয়ের জন্য প্রস্তুতি চলছে। সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল আশার। এবার জাগতে হবে । বাস্তবের মাটিতে পা রাখতে হবে। সংসার, স্বামী, সন্তান, বুড়ি শাশুড়ি.. সবাই যে তারই অপেক্ষায়।
    জোর করে রাতুলই একদিন তার খেলাঘরের একটা পুতুল বানিয়ে নিয়েছিল তাকে। জানে না আশা- এভাবে ফেসবুকের কত বন্ধুকেই হয়তো রাতুলের সঙ্গী হতে হয়েছে। মিথ্যের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সেই খেলাঘর থেকে আশার বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। আর তো রাতুল আগের মতো জোর করে না কোন কিছুতেই। আগের মতো ভালোবাসায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়না কোথাও। তবে কোনদিনই অসম্মানের মতো কোন কাজ রাতুল করেনি। এটা তার চরিত্রের বিশেষ গুণ।

    আজ পড়ন্ত বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আশা ভাবে — ঈশ্বর কেন এমন ঘটালেন …এর কি কোন প্রয়োজন ছিল?
    পাগলের মতো ভালোবাসা দিয়েছিল রাতুলকে। আজ ফেসবুকে অনেক মেসেজ দিয়েও রিপ্লাই আসেনা অন লাইনে থাকা রাতুলের। সাত সকালে কেউ মেসেজ দেয়না “তুমি ব্রেকফাষ্ট করোনি এখনো?” কেউ বলেনা – ” না, এখন একটু থাকো। আমরা গল্প করি।” ভালোবাসার, আদরের সোহাগের.. কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যখন নেট অফ করতো আশা…রাতুল রাগ করতো।
    আজ কিন্তু সব পাল্টে গেছে। আজ কথা শুরু হতে না হতেই রাতুল বলে-“তুমি কি ব্যস্ত?” হায় রে কপাল! রাতুল কি আজ আর বোঝেনা সব ব্যস্ততা তো তারই জন্য!

    না আর নয়। মুখে না বললেও রাতুল হয়তো মুক্তিই চাইছে। তার নতুন জীবনের শুরুতে আর কেন কাঁটা হয়ে থাকা! প্রতিটা দিন আশা ভাবছে বিদায় নেওয়ার কথা। কিন্তু কিছুতেই কেন পারছেনা। প্রতিনিয়ত চোখে জল আসছে। ঈশ্বর কি এভাবেই তাকে “ভালোবাসা কারে কয় “এর উত্তর দিলেন! কিন্তু আশার ভালবাসা তো মিথ্যে নয়। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে রাতুলের মঙ্গল কামনা করে যাবে। নীরব প্রেমই থাকবে তার সম্বল! আর থাকবে স্মৃতিগুলো। যা দিয়ে সারাজীবন একটা মালা গাঁথবে সে। স্মৃতির মালা! এভাবেই কাটবে তার সারাবেলা। চুলে ধরেছে পাক, কদিন পরে বয়েসের ছাপ পড়বে.. চোখে, মুখে, চামড়ায়। তার চেয়ে “এই করেছ ভালো নিঠুর হে।”খেলাঘর এবার ভাঙার সময় এসেছে । আর নয় । “যা পাখি, উড়তে দিলাম তোকে”।

    অনেক রাত এখন — আশা সন্তর্পণে বিছানা থেকে ওঠে। বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছাদে চলে যায়। হাতে প্রিয় মোবাইলট, অন করে। ফ্রেণ্ড লিষ্টে যায়। রাতুল মিত্র … স্পর্শ করে — ……ব্লক্।।
    উন্মুক্ত আকাশ মাথার ওপরে — দু’চোখে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। দু’টো হাত প্রসারিত করে আশা … উড়িয়ে দেয় জীবন ডাইরির কিছু পাতা।

  • কবিতা

    কবিতা- বাংলা মায়ের কোল

    বাংলা মায়ের কোল
    – শিলাবৃষ্টি

     

    ওই পারেতে শাল মহুয়া
    ডাকছে আমায়, যাবি?
    চল্ না বাবা, আজকে নাহয়
    আমার মাঝি হ’বি!
    পানকৌড়ি পানকৌড়ি…
    ডাকছে পাখি গাছে-
    মাছরাঙাটা কেমন করে
    ওঁৎ পেতেছে মাছে!
    হাওয়ায় দোলে তালের সারি
    নদীর জলে ছায়া …
    কাশফুলেরা হেলেদুলে
    বাড়ায় শুধু মায়া।
    আকাশ পানে তাকিয়ে দ্যাখ্-
    সাদা মেঘের ভেলা…
    ভেসে বেড়ায় বকের সারি,
    ভিনদেশীদের মেলা।
    কত রঙের, কত রূপের
    পরিযায়ী সব পাখি;
    আমার মনে সুখ এনে দেয় ,
    ভরিয়ে দেয় আঁখি।
    নদীর জলে পল্লীবধূ
    নাইতে নামে ঐ,
    কলসী ভরে জল ডোবাবে,
    সইটা গেল কৈ?
    ছোট ছোট শিশুরা সব
    ছুটছে মাঠের দিকে,
    দুপুর বোধহয় গড়িয়ে যায়,
    সূর্যটা আজ ফিকে।
    রাখাল বালক গুটি পায়ে
    চললো গাঁয়ের পথে,
    পালে পালে গরু বাছুর
    হাঁটছে যে তার সাথে।
    ও মাঝি! তুই দেখতে কি পাস্-
    বাংলা মায়ের কোল?
    কান পেতে শোন- নন্দী বাড়ির
    মিষ্টি ঢাকের বোল।
    শরৎরাণী সেজেছে আজ…
    শিউলি শালুক পরে,
    আল্পনা আর বরণ ডালা …
    মা দুর্গার তরে।

  • কবিতা

    কবিতা- এই শ্রাবণে

    এই শ্রাবণে
    শিলাবৃষ্টি

     

    আদিগন্ত চেয়ে দেখ নীল শুধু নীল,
    নদী আর সাগরের দেখেছ কি মিল?
    চারিদিকে জলোচ্ছ্বাস ভরে যায় মন,
    জুড়ায় হৃদয় মোর, জুড়ায় নয়ন।

    যতদূর আঁখি যায় জল শুধু জল…
    ঢেউ আসে ঢেউ যায় নদী কলকল্।
    ছোট ছোট খেয়াতরী বেয়ে যায় মাঝি,
    কোথায় চলেছে তারা অবেলায় আজি!

    দূর হতে ভেসে আসে ভাটিয়ালি গান…
    আকুল হৃদয় টানে টানে মন প্রাণ।
    আসে মনে ক্ষণে ক্ষণে “সোনার তরী”-
    যাহা ছিল নিয়ে গেল হৃদয় হ’রি।

    তীরে আসি আছাড়িছে ঢেউ আর ঢেউ ,
    তার ভাষা, তার মন বোঝে না তো কেউ।
    হঠাৎ অম্বর মাঝে আঁখি মেলি চাই……
    কালো মেঘ ধেয়ে আসে, মল্লার গাই।

    এলোমেলো হাওয়া লেগে উড়ে যায় পাল,
    পাগল পবন ধায় — হয়েছি মাতাল ।
    নামিল শ্রাবণ ধারা জল ছল্ ছল্ ……
    সারা তনু, সারা মন, ভিজিল কুন্তল।

    হৃদয় মাঝারে মোর কে আজ নাচিল!
    তাতা থৈ তাতা থৈ ঘুঙুর বাজিল।

    এত বারিধারা, ভিজে দিশেহারা,
    অলোক ছুঁয়েছে মোর;
    এত রূপরস দেখিনি তো আগে,
    জলধর ঘনঘোর।

    ময়ুরের মত নাচিল হৃদয়,
    উল্লাস এ কী উল্লাস!
    “আমার আমি” কে খুঁজে নাহি পাই,
    সিক্ত আজিকে আমার আকাশ।।

You cannot copy content of this page