-
কবিতা- ছুটি
ছুটি
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়হঠাৎ এসেছে নতুন কাজের ডাক,
মনের ভাবনা যত, আজ থাক পিছে থাক।
যেতে হবে আজ সৃষ্টির সন্ধানে, নবীন প্রাণের টানে,
অজ্ঞাত কোনো খানে।
তাই আজ বুঝি এসেছে সময় খানি,
চেয়ে নেবো ছুটি, আপনার ঋণ মানি।
একদিন যবে এলাম তোমার দ্বারে,
সামান্য অর্ঘ্য লইয়া তোমার তরে,
তখন তোমার গৃহ ছিল জানি ভরে,
মণিমুক্তার সম্পদে থরে থরে।
তবুও তোমার করুণায় মাখা প্রাণে,
নিয়েছিলে তুলি আমার অর্ঘ্য দানে।
দিয়েছিলে স্থান নিজের গৃহের মাঝে,
সাজায়ে আমার নিবেদন নব সাজে।
তবু আজ বুঝি যেতে হবে এইবেলা,
পিছে ফেলে রেখে মিলনের এই মেলা।
সাঙ্গ করিতে হবে যে নতুন ভার,
সযতনে সুরে বেঁধে দিতে হবে তার।
তারপর সেই নতুন কাজের শেষে,
মিলে যাবে পথ তোমার দ্বারেতে এসে।
তবু জেনো সেই প্রতিদিন প্রতিক্ষণ,
মনে রবে তুমি মনের আলাপী মন। -
কবিতা- বাতের ওষুধ
বাতের ওষুধ
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়আমার মা আর আমার পিসি
সত্তরেতে পা,
গাঁটের বাত আর হাঁটুর ব্যাথায়
নড়তে পারেন না।
ওষুধ বিষুধ চলছে কত
কত মলম gel,
তারসঙ্গে চলছে মালিশ
ব্যাথা কমার তেল।
রোগ সারাতে ছোটেন তাঁরা
দেশ জুড়ে বারবার,
উত্তর আর দক্ষিণেতে
সব ডাক্তার পার।
MRI আর X-RAY plate এ
ব্যাগ উঠেছে ভরে,
গাঁটের বাত আর হাঁটুর ব্যাথা
যাবার নাম না করে।
কিন্তু দেখি প্রতি বছর
ঘটে Miracle,
যেই না আসে দুর্গাপূজা
কিংবা চৈত্র সেল।
হঠাৎ করেই মা আর পিসির
হাঁটুর ব্যাথা হাওয়া,
তাঁরা তখন লাফিয়ে চলেন
যায় না নাগাল পাওয়া।
দোকান থেকে দোকানেতে
খুঁজে চলেন শাড়ি,
জামা কাপড় বেডকভার আর
জিনিস রকমারী।
সফ্ট ঢাকাই না বালুচরী
নাকি কলমকারী,
কাঞ্জিভরম সাউথ সিল্ক ও
পছন্দসই ভারি।
খুঁজতে এসব তখন তাঁদের
টাট্টু ঘোড়ার চলা,
শপিং মলে লাফিয়ে ওঠেন
এক থেকে তিন তলা।
ভাবি মনে হায়রে কপাল
ওষুধ হলো ফেল,
মুখে কালি মাখলো মলম
ব্যাথা কমার তেল।
শপিং এরই গুনে দেখো
হাওয়া গাঁটের ব্যাথা,
লাঠি ফেলে বাতের রুগী
ছোটেন যথাতথা।
ঠাকুর তুমি দয়া করে
এমন দানো বর,
বাতের ওষুধ শপিং যেন
থাকে বছরভর।। -
কবিতা- দাতা
দাতা
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়বৈশাখী পূর্ণিমা মঙ্গলবারে,
বহু জন সমাগম আজি রাজদ্বারে।
দুই’হাতে রাজা করি অকৃপণ দান,
প্রতি সনে তীর্থ দর্শনে যান।
ভোর হতে তাই আজি মহা কোলাহলে,
প্রজাগণ রাজবাড়ী চলে দলে দলে।
মন্ত্রী মশাই মহা ব্যস্ততা ভরে,
দানের সামগ্রী সব তদারক করে।
সিপাই সান্ত্রী, রাজ কর্মী যত,
সামলাতে ভীড় তারা ব্যস্ত কত।
যথাকালে মহারাজ দেন দরশন,
আভরণ বিনা দেহে পট্টবসন।
চলে দান, রাজনের মুগ্ধ নয়ন,
ফিরে যায় একে একে খুশি প্রজাগণ।
দান শেষে চলে রাজা প্রাসাদ পানে,
হঠাৎ পথিক এক দৃষ্টি টানে।
জটাজুট সাধু এক চলে যান ধীরে,
দানের সামগ্রী পানে তাকান না ফিরে।
কুতুহলী মহারাজা কন সান্ত্রীরে,
সবিনয়ে আন ডেকে ওই সাধুজিরে।
সান্ত্রীর ডাকে সাধু আসিয়া দাঁড়ায়,
সকলেই মাথা নত করে তাঁর পায়।
করিয়া আশির্বাদ সাধু হেসে কন,
আমারে ডাকিলে কেন, কি তার কারণ?
রাজা কন আমি রাজা, পূর্ণিমা তিথি,
দান করি প্রজাগণে এই মোর রীতি।
বলুন বাসনা তব দ্বিধা নাহি ক’রে,
রাখিয়াছি আয়োজন দানিবার তরে।
সাধু কন আমি সাধু ত্যাগী মোর মন,
মহার্ঘ দানে মোর নাহি প্রয়োজন।
বস্ত্র সামান্য মোর সীমিত আহার,
মিটে যায় যতটুকু প্রয়োজন আর।
চাহি না তো দান নিয়ে আর ঋণী হতে,
যে পথ পেয়েছি খুঁজে চলি সেই পথে।
তবু রাজা বারেবার জোরাজুরি ক’রে,
দিতে চান দান তাঁর সাধুর তরে।
সাধু কন কি দানিবে কি তোমার আছে?
রাজা বলে যাহা কিছু চান মোর কাছে।
স্বর্ণ রৌপ্য বা অর্থের থলি,
আছে কত দানিবার আরো কত বলি।
হাসিয়া কহেন সাধু শুন হে রাজন,
মুঠিতে বাতাস সম সম্পদ ধন।
দানের সামগ্রী পরে কোন অধিকারে,
করো দান দাতা সেজে গর্ব ভরে?
ছিল না এসব কিছু জন্মের ক্ষণে,
ছেড়ে সব যাবে তুমি একা হুতাশনে।
যাহা নয় আপনার তাই দান করে,
কেন হও গর্বিত নিজ অন্তরে?
একান্ত তোমার কিছু দানের তরে,
থাকে যদি দাও, নেবো দু’হাত ভরে।
নত শির রাজা ফেরে প্রাসাদ পানে,
সাধু যায় আপনার পথের টানে।
পরদিন রাজা যাবে তীর্থ পথে,
সামগ্রী সাজায় সবে সুবিশাল রথে।
হঠাৎ সকলে দেখে প্রাসাদ দ্বারে,
রাজা এসে দাঁড়ায়েছে দীন বেশ পড়ে।
ডেকে কন মন্ত্রীরে রাজা সবিনয়ে,
চলিলাম সব কিছু প্রজাদের দিয়ে।
খুঁজে দেখি কোথা আছে সেই সে রতন,
যারে পেলে দীন হয় গর্বিত মন।
আমার আমি রে যবে দেবো দান ক’রে,
সেইদিন হবো দাতা নিজ অন্তরে। -
কবিতা- বিদ্রোহী মন
বিদ্রোহী মন
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়আবার ভেঙেছে এ ঘুম আমার
আমি বিদ্রোহী মন,
জানিনা গভীর নিদ্রা আমায়
ঘিরেছিল কতোক্ষণ।
হাজার যুদ্ধ লড়ার পরেও
হইনি তো আমি ক্ষান্ত,
যদিও আমার ঘামে ভেজা দেহ
হৃদয় হয়েছে ক্লান্ত।
শত রাইফেল গুলির শব্দ
কত বারুদের গন্ধ,
তবুও ছিল না সংশয় কিছু
মনেতে ছিল না দ্বন্দ্ব।
রাশিয়ার থেকে শুরু হয়ে পথ
ভিয়েতনামেতে মেশে,
স্পেন রুমানিয়া ভারতবর্ষ
মিলল সে পথে এসে।
সবখানে আমি থেকেছি অটল
নির্ভীক সংকল্প,
সে লড়াই ছিল মনের মানের
ছিল তা নির্বিকল্প।
হারিয়েছি কত আপনার জন
রক্ত ঝরেছে কত,
ভেঙে পড়া মনে দৃঢ়তা এনেছি
আবার আগের মত।
সে লড়াই ছিল ন্যায়ের যুদ্ধ
ফিরে পেতে অধিকার,
এ লড়াই তাই যুগ যুগ ধরে
লড়েছি যে বারবার।
ওরা লুঠে নিত ক্ষমতার জোরে
নিরীহের মাপা অন্ন।
নিজেদের ওরা বলেছে সভ্য
আসলে ছিল যে বন্য।
কাটিয়েছি কত অনিদ্র রাত
অনাহারে কত দিন,
তুষার বৃষ্টি মরু ঝঞ্ঝায়
শরীর হয়েছে ক্ষীণ।
শত্রুর গুলি দেহ ফুঁড়ে গেছে
পেয়েছি শোণিত ঘ্রাণ,
তবুও তুলেছি কালাশনিকভ
ট্রিগারে দিয়েছি টান।
দেখেছি আমার প্রিয়তমাকে
আতঙ্ক চোখে মুখে,
নগ্ন শরীর দু’ চোখে অশ্রু
গ্যাস চেম্বারে গেল ঢুকে।
বার্লিনে আমি হেঁটেছি কখনো
শবের মিছিল মাঝে,
কখনো শুনেছি নাৎসী ক্যাম্পে
মৃত্যু ঘন্টা বাজে।
শমনের সাথে মিলিয়েছি হাত
ভয়হীন অন্তর,
মুঠো করা হাত আকাশে ছুঁড়েছি
ভেঙে কত সবিবর।
গেভারার সাথে কিউবা গিয়েছি
তুর্কী ইরাক ইরান,
ইন্দোনেশিয়া, সার্বিয়া গেছি
গেছি দেশ আফগান।
যেখানে দেখেছি দানবের কাছে
মানবের পরাজয়,
লড়েছি জীবন বাজি রেখে আমি
দুর করে যত ভয়।
এ লড়াই ছিল নরখাদকের
কফিনে পেরেক পোঁতা,
এ লড়াই শেষ হলো শ্বাপদের
নোখ দাঁত করে ভোঁতা।
তারপর দেখি ওই এলো বুঝি
সেই শান্তির পল,
দু’চোখে আমার নেমে এসেছিল
ক্লান্ত ঘুমের ঢল।
সে ঘুম আমার ভেঙে গেল যেন
হঠাৎ বিষ্ফোরণে,
ভাবি মনে মনে তবে কি আবার
জেগেছি রনাঙ্গনে?
চারিদিকে শুনি গুলির শব্দ
গন্ধ বারুদ পোড়া,
হাতে পিস্তল পথে পথে ওই
ছুটে চলে কারা ওরা?
জিজ্ঞাসা করি ডেকে জনে জনে
কিসের যুদ্ধ ভাই?
আর কিছু নয় এ না কি চলছে
গদির মোহে লড়াই।
গদির লড়াই ক্ষমতা দখল
মন্ত্রীর টুপি কার,
শত কৌশল ছলে আর বলে
দেশটা লুঠে খাবার।
বলে ওরা কাল মেরেছে বলে
আমরা মারছি আজ,
ক্ষমতার বলে লুঠে খাব সব
তাইতো এ রণসাজ।
তবে জনগন, গনতন্ত্র
মানুষের অধিকার,
এসব কি শুধু কথার কথা
থাকবে না কিছু আর?
শাসনের নামে করবি শোষণ
নেই আর কিছু আজ,
প্রাণ দিয়ে যারা স্বাধীনতা দিলো
করলো কি ভুল কাজ?
মনে হয় দেখে এওতো একই
রুমানিয়া জার্মানি,
এখানেও সেই একই সন্ত্রাস
রক্তের হানাহানি।
তোরা ভুলে গেলি? চেসেস্কু গেছে
গদ্দাফি সাদ্দাম,
যারা মানুষের অধিকার কেড়ে
চুষলো শোণিত ঘাম।
সেদিন সেখানে ছিলাম আমি
আজও আছি আমি বেঁচে,
ভাবিস না তোরা পার পেয়ে যাবি
এই তান্ডব নেচে।
আছি আমি আজও জন অন্তরে
সুপ্ত আগুন হয়ে,
যদি উড়ি হয়ে ঝড়ের পাখি
সেই ঝড়ে যাবি বয়ে।
আজ এই হাতে কলম ধরেছি
কবিতা লিখেছি কত,
জেনে রাখ আজও তুলে নিতে পারি
রাইফেল উদ্যত।
এই রাইফেল সারা পৃথিবীতে
তুলেছে বুলেট ঝড়,
সেই ঝড় আজও ভেঙে দিতে পারে
অত্যাচারীর ঘর।
তবু আমি আজ শান্ত হৃদয়
পৃথিবীর পথে পথে,
জ্বেলে দিয়ে যাই শান্তির দীপ
গভীর আঁধার রাতে।
খুনের বদলা খুন যদি হয়
জেনে রাখ তুমি তবে,
একদিন এই গোটা পৃথিবীটা
মানুষ শূন্য হবে।
সেদিন কি হবে গদির লড়াই
সেদিন কে খাবে লুঠে?
দেখবে কে বলো পথের পাশে
কত ফুল আছে ফুটে?
হত্যা করেছি কত প্রাণ আমি
মরেছি যে কতবার,
তবু কি পেরেছি সাজাতে পৃথিবী
সুন্দর করে আর?
তাই আমি আজ নব বিপ্লবী
হৃদয়টা খানখান,
জেগে আছি নিয়ে শান্তি প্রদীপ
আমি বিদ্রোহী প্রাণ। -
নাটক-“বাটি চচ্চড়ি”
“বাটি চচ্চড়ি”
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়চরিত্র লিপি:
[ একটি সাধারন ঘর। আসবাব আরও সাধারণ। কটি চেয়ার, একটি টেবিল, একটি চৌকি, পাশে আর একটি টেবিলে একটি স্টোভ, কিছু বাসন ও কটি কৌটো। আলো জ্বলে, নেপথ্যে শোনা যায়] নেপথ্যে—ঘরটি শ্রীযুক্ত গোবিন্দ নস্করের। ব্যাক্তিটি আসপাশের সাত দশটি গ্রামে কৃপণ হিসাবে যথেষ্ঠ সুনাম অর্জন করেছেন। আজীবন অকৃতদার থেকে অর্থ নামক দেবীকে ব্যয় না করে কেবলমাত্র সঞ্চয় করার ব্রতে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। পাছে কেউ তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তাঁর অন্ন ধ্বংস করে, সেই ভয়ে তিনি কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেন না। বন্ধু বান্ধব বাড়িতে এলে চা খাওয়ানোর রেওয়াজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বন্ধুত্বের পাপচক্র থেকে নিজেকে শত হস্ত দূরে রাখেন। এ হেন ব্যাক্তির বাড়িতে এক রাতে দুই অতিথির আগমন ঘটলো। (বাইরে ঝড় বৃষ্টির আওয়াজ, তার মধ্যে দরজায় করাঘাত। ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসেন গোবিন্দ নস্কর।)
* গোবিন্দ নস্কর
* অলোক
* শ্রাবনী
গোবিন্দ– কেউ কি দরজায় কড়া নাড়লো, নাকি ঝড়ে আওয়াজ হচ্ছে? (আবার কড়াঘাত) নাহ্, এতো কড়া নাড়ারই আওয়াজ। বোঝো! এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে এত রাতে আবার কে এলো? নিশ্চই ব্যাটা হারু মুদি। সকালে দোকান আনতে গিয়ে দু-টাকা বাকি রেখে এসেছিলাম সেইটা চাইতে এসেছে। বলিহারী হিসেবি লোক বটে। কেন রে ব্যাটা আমি কি তোর দুটাকা মেরে দেব? এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই ওই দুটো টাকার জন্য লোকের বাড়িতে হানা দিতে হবে! তোর কী প্রাণের ভয়ও নেই, ব্যাটা চামার? (ঘন ঘন করাঘাত) ওঃ দরজাটা যেন ভেঙেই ফেলবে। দেবো না, আজ তোর দুটাকা আমি দেবো না। যতই তুই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে আয়, কাল যখন দেবো বলেছি তখন কালই দেবো, আজ নয়। (দরজা খুলে চমকে ওঠে) কে!(প্রবেশ করে দুই যুবক যুবতী। বেশ ধোপদুরস্ত মাথা থেকে জল টপকাচ্ছে।) কাকে চাই?
অলোক– আজ্ঞে আমার নাম অলোক মুখার্জ্জী আর এ আমার স্ত্রী শ্রাবনী।
গোবিন্দ– সে তো বুঝলাম, কিন্তু এখানে কি চাই?
অলোক– আজ্ঞে আশ্রয়।
গোবিন্দ– আশ্রয়! মানে?
অলোক- দেখুন না আমরা যাচ্ছিলাম মহেশপুর, আমার দিদির বাড়ি।
গোবিন্দ– হ্যাঁ আরো কুড়ি কিলোমিটার, তো?
অলোক– বেড়োতে একটু দেরিই হয়ে গেল, তারপর নামলো এই ঝড়বৃষ্টি, আর তার মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই…ঠিক আপনার বাড়ির সামনেই দেহ রখলো।
গোবিন্দ– (চমকে) অ্যাঁ দেহ রেখেছে! কে?
অলোক– আমার গাড়িটা।
গোবিন্দ– ও, তারপর।
অলোক– আশেপাশে কোন গ্যারেজও নেই যে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সারিয়ে নেব, তাই বলছিলাম কি…
গোবিন্দ– হবে না—
অলোক– অ্যাঁ!
গোবিন্দ– এখানে রাতের আশ্রয় হবেনা।আপনারা আসুন।
অলোক– কাকাবাবু, কাকাবাবু-
গোবিন্দ– কোন কাকাবাবু নয়, হবে না তো হবে না।
অলোক– কাকাবাবু দেখুন আমি আপনার ছেলের মতো।
গোবিন্দ– আমার ছেলে নেই।
শ্রাবনী– কাকাবাবু, তাহলে আমি নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের মতো।
গোবিন্দ– আমার মেয়েও নেই।
অলোক– ও, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর ছেলে বাইরে থাকে।
গোবিন্দ– না-আমার ছেলে মেয়ে নেই।
শ্রাবনী– তারমানে কাকীমা..আহারে।
গোবিন্দ– কাকিমাও নেই।
অলোক– ইস্,তার মানে কাকীমা অনেক দিনই চলে গেছেন।
গোবিন্দ– কাকীমা এ বাড়িতে কোনোদিন আসেই নি।
অলোক– অ্যাঁ,বিয়ের রাতেই ডিভোর্স!
গোবিন্দ– দুর, আমি বিয়েই করিনি।
অলোক– অ্যাঁ!
গোবিন্দ– হলো তো? এবার আসুন।
শ্রাবনী– (কাঁদো কাঁদো) ওরকম বলবেন না কাকাবাবু, আমি যুবতী নারী, এই ঝড় বৃষ্টির রাতে বাঘে খাবে কি ঘোগে ছোঁবে তার কী কোনো ঠিক আছে বলুন? একটু দয়া করুন কাকাবাবু, কথা দিচ্ছি ভোরের আলো ফুটলেই চলে যাব। অন্তত আমার মুখ চেয়ে একটু দয়া করুন। আপনার পায়ে ধরছি।
গোবিন্দ– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে থাকো। তবে একটা কথা, শোবার জন্য বিছানা দিতে পারবো না। এই চেয়ারে বসেই রাত কাটাতে হবে।
শ্রাবনী– না না, বিছানা বালিশ কিছু চাই না, দু’টো চেয়ার হলেই হবে, কঘন্টার তো ব্যাপার। (বসতে যায়।)
গোবিন্দ– দাঁড়াও, চেয়ারের আসনটা সরিয়ে নিই, তোমাদের জামা কাপড়ে জল কাদা লেগে আছে, ওগুলো নোংরা হবে, কাচতে গেলে সাবান খরচা হবে। (ঢাকা সরিয়ে নেয়।) হ্যাঁ, এইবার বসো।
অলোক– আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো কাকাবাবু?
গোবিন্দ– ধন্যবাদ দিতে হবেনা। ভোর হলেই চলে যেও।
অলোক– কাকাবাবু বলছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় হাত পাগুলো জমে গেছে, যদি একটু..
গোবিন্দ– পাবে না।
অলোক– অ্যাঁ!
গোবিন্দ– চা পাবে না, আমি চা খাই না।
অলোক– ও—-
গোবিন্দ– হ্যাঁ। আর একটা কথা, রাতের খাবার কিছু আশা কোরো না,কেন না আমার ঘরে কিছু নেই। রাতে আমি উপোষ করি, আর দিনে পাঁচ টাকার মুড়ি রোজ দোকান থেকে কিনে এনে খাই।
অলোক– বুঝলাম, তা কাকাবাবু, একটু জল পেতে পারি, না কি সেও রাস্তার কলে?
গোবিন্দ– না, জল পাবে, যদিও জল আমাকেই রাস্তার কল থেকে বয়ে আনতে হয়, কেন না আমার কোনো কাজের লোক নেই। বসো দিচ্ছি। (প্রস্থান।)
অলোক– ব্যাটা, মহা কঞ্জুস তো!
শ্রাবনী– হুঁ, না হলে বিপদে পড়ে বাড়িতে আসা অতিথিকে কেউ এভাবে বলতে পারে!
অলোক– অথচ দেখ, ঘরের কোনে স্টোভ, হাঁড়ি কড়া, সব রয়েছে।
শ্রাবনী– হ্যাঁ, আর কৌটো গুলো দেখছো না? ওগুলোতে নিশ্চয় চাল, ডাল আছে।
অলোক– হুঁ তাইতো মনে হচ্ছে। দাঁড়াও দেখতে হবে। (জলের গ্লাস হাতে গোবিন্দর প্রবেশ।)
গোবিন্দ– এই নাও জল।
অলোক– বাঁচালেন কাকাবাবু, গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছিল।
শ্রাবনী– কাকাবাবু, আমিও একটু জল খাবো।
গোবিন্দ– হ্যাঁ দিচ্ছি।(গোবিন্দ বেড়িয়ে যায় অলোক চট করে উঠে গিয়ে কৌটোগুলো খুলে দেখে আবার এসে বসে।)
অলোক– সব আছে। চাল,ডাল, তেল, নুন, মশলা সব। হাড় খোসটে বুড়ো খেতে দেবে না বলে মিথ্যে বলছে। দাঁড়াও ওর মজা দেখাচ্ছি। (গোবিন্দর প্রবেশ।)
শ্রাবনী– (জল খেয়ে)আঃ! জল খেয়ে শান্তি হলো। আসলে সেই দুপুরে খেয়ে বেড়িয়েছি তো, পেটে যেন ছুঁচোয় ডন মারছে, কি আর করা যাবে, জল দিয়েই পেটের ছুঁচো ঠান্ডা করি।
অলোক– শ্রাবনী, কাকাবাবু কে সেইটা দেখাবো?
শ্রাবনী– কোনটা?
অলোক– সেই যে কেদার যাওয়ার পথে।
শ্রাবনী– কেদার! (অলোক ইশারা করে) ও হ্যাঁ কেদার। কেদার বুঝলেন কাকাবাবু।
গোবিন্দ– কি কেদার?
অলোক– রাতের খাবার..
গোবিন্দ– বললাম তো কিছুই নেই, রাতের খাবার হবে না।
আলোক– কিচ্ছু লাগবে না। সে এক গল্প কাকাবাবু, আমি আর শ্রাবনী কেদার যাচ্ছি।(ইশারা করে।)
শ্রাবনী– হ্যাঁ, কেদার।
অলোক– পথে তুষার ঝড়ে আটকে পড়লাম এক গুহায়।
শ্রাবনী– (নাটকীয় ভাবে) গুহার মধ্যে বাঘ।
অলোক– ছিল না।
শ্রাবনী– অ্যাঁ! হ্যাঁ ছিলনা, বাঘ ছিল না।
অলোক– ছিলেন এক সাধুবাবা।
গোবিন্দ– সাধুবাবা!
অলোক– তো সেই সাধুবাবা, রাতে আমাদের বাটি চচ্চড়ি করে খাওয়ালেন।
শ্রাবনী– বাটি চচ্চড়ি! বাটি চচ্চড়ি।
গোবিন্দ– সাধুবাবা বাটি চচ্চড়ি করে খাওয়ালেন!
অলোক– হ্যাঁ কাকাবাবু, তবে আর বলছি কি। কি তার অপূর্ব স্বাদ, এখনো জিভে লেগে আছে।
গোবিন্দ– তা তোমরা কি আশা করছো আমি তোমাদের বাটি চচ্চড়ি রেঁধে খাওয়াবো?
অলোক– হ্যাঁ- মানে না, আপনি রাঁধবেন কেন? আমি রাঁধবো।
গোবিন্দ– ইয়ার্কি করছো? বললাম ঘরে কিছু নেই শুনতে পাওনি!
অলোক– কিচ্ছু লাগবে না তো।
গোবিন্দ– মানে!
অলোক– কিচ্ছু লাগবে না। তবে আর বলছি কী? এ হলো হিমালয়ের সাধুবাবার বাটি চচ্চড়ি। কিচ্ছু লাগবে না, শুধু একটা কড়া, একটু জল, একটা বাটি, একটু আগুন, আর একটা মন্ত্র।
গোবিন্দ– মন্ত্র!
অলোক– হ্যাঁ মন্ত্র। ওই মন্ত্রটাই তো আসল ওই মন্ত্রের জোরেই তো বাটি থেকে বাটি চচ্চড়ি হলো, আর আমরা দু’জন পেট ভরে খেলাম। বলো শ্রাবনী?
শ্রাবনী– হ্যাঁ, খেলাম।
অলোক– আর পরদিন সকালে আসার সময় সাধুবাবা মন্ত্রটা আমায় শিখিয়ে দিলেন।
গোবিন্দ– বলো কি কিছু না দিয়ে বাটি চচ্চড়ি!
অলোক– শুধু বাটি, কড়া, আগুন, জল।
গোবিন্দ– আর মন্ত্র?
অলোক– হ্যাঁ, মন্ত্র-
গোবিন্দ– তুমি জানো মন্ত্রটা?
অলোক– জানি তো, সাধুবাবা শিখিয়ে ছিলেন।
গোবিন্দ– তার মানে তুমি এখন রাঁধতে পারবে ওই বাটি ছাড়া, মানে কিছু ছাড়া-
অলোক– বাটি দিয়ে বাটি চচ্চড়ি।
গোবিন্দ– আমি বিশ্বাস করি না।
অলোক– অবিশ্বাস করবেন না কাকাবাবু, হিমালয়ের সাধুবাবা।
গোবিন্দ– বেশ তবে রেঁধে দেখাও দেখি জল ছাড়া,
অলোক– বাটি দিয়ে বাটি চচ্চড়ি।
গোবিন্দ– হ্যাঁ বাটি চচ্চড়ি। ওখানে স্টোভ, কড়া, বাটি সব আছে জল আমি দিচ্ছি।(যেতে গিয়ে স্বগত) এটা যদি সত্যি হয়! তাহলে মন্ত্রটা শিখে নিতে হবে, বাকি জীবন খাওয়া খরচাটাও বেঁচে যাবে। (প্রস্থান।)
শ্রবনী– কি করলে গো! তুমি তো ফেঁসে যাবে!
অলোক- কিচ্ছু ফাঁসবো না, দেখোই না মজাটা। (গোবিন্দর প্রবেশ)
গোবিন্দ– এই নাও জল। দেখি তোমার কেরামতি।
অলোক– এখুনি দেখাচ্ছি কাকাবাবু।(অলোক উঠে গিয়ে স্টোভ জ্বেলে কড়া বসিয়ে তার মধ্যে জল আর বাটি দিয়ে খুব নাড়তে থাকে। গোবিন্দ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।)
শ্রাবনী– কাকাবাবু..
গোবিন্দ– আঃ চুপ করো,
শ্রাবনী– আপনার নামটাই তো জানা হয়নি ককাবাবু।
গোবিন্দ– গোবিন্দ নস্কর।
শ্রাবনী– এই বাড়ি…
গোবিন্দ– আমার ঠাকুর্দা তৈরী করেছিলেন একশ বছর আগে। (অলোক কড়ায় খুন্তি দিয়ে খুব নাড়ছে আর মাঝে মাঝে চামচে করে চেখে আঃ-বলছে।)
শ্রাবনী– না বলছিলাম এই বাড়িতে আপনি একা থাকেন?
গোবিন্দ– একা, আমার বাবা নেই, মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই, বৌ নেই, ছেলে নেই, মেয়ে নেই কেউ নেই, আমি একা।
অলোক– (স্বগত) আর টাকা..
গোবিন্দ– অ্যাঁ কিছু বললে?
অলোক– না বলছিলাম এর স্বাদটা যা হয়েছে না.. শুধু যদি দু’ ফোঁটা ঘি পরতো তাহলে আর দেখতে হতো না….সাধুবাবাও দিয়েছিলেন আর কি।
গোবিন্দ– হ্যাঁ হ্যাঁ ঘি বোধহয় একটু হতে পারে। (ঘি দেয়। অলোক ঘি দিয়ে নাড়তে থাকে আর আহা আহা করতে থাকে।)
শ্রাবনী– কাকাবাবু আপনি রাঁধতে জানেন?
গোবিন্দ– হ্যাঁ ওই পারি এক রকম।
অলোক– (স্বগত) কিপটে লোকের আবার রান্না..
গোবিন্দ– কিছু বললে?
অলোক– বলছিলাম রান্নাটা এতো সুন্দর হয়েছে, সাধুবাবার থেকেও ভালো, শুধু যদি একমুঠো চাল পড়তো এতে। সাধুবাবাও দিয়েছিলেন আর কি।
গোবিন্দ– দাঁড়াও দাঁড়াও চাল বোধহয় একটু আছে, (চাল দেয় অলোক কড়ায় চাল দিয়ে নাড়তে থাকে, আর চেখে আহা আহা করতে থাকে।)
শ্রাবনী– কাকাবাবু আপনি সংসার করেন নি কেন?
গোবিন্দ– ওই হয়ে ওঠেনি আর কি–
অলোক– (স্বগত) অন্য কেউ ওনার অন্য ধ্বংস করবে সেটা কি কিপটে বুড়োর সহ্য হতো?
গোবিন্দ– কিছু বললে?
অলোক– না বলছিলাম রান্নাটা যা হয়েছে পরমান্নও হার মেনে যাবে, শুধু নামাবার আগে একটু ডাল আর এক চিমটে নুন দেওয়া গেলে পুরো রাজকীয় হয়ে যেত।
গোবিন্দ– আছে আছে, ডাল, নুন দুই আছে। (ডাল নুন দেয় অলোক যথারীতি নাড়তে থাকে আর আহা আহাহা করতে থাকে। একটু বাদে তিনটি থালায় খিচুড়ি এনে পরিবেশন করে।)
অলোক– নিন কাকাবাবু খান, সাধুবাবার বাটিচচ্চড়ি। শ্রাবনী তুমি খেয়ে বলো দেখি সাধুবাবার মতো হলো কিনা।
গোবিন্দ– (খেয়ে) অসাধারণ,আমি তো ভাবতেই পারিনি যে শুধু বাটি দিয়ে এতসুন্দর বাটিচচ্চড়ি রাঁধা যায়। বাবা অলোক আমার একটা উপকার করতে হবে।
অলোক– বলুন কাকাবাবু?
গোবিন্দ– দেখো বাবা তোমাদের আমি ঝড়ের রাতে আশ্রয় দিলাম বলে বলছি না, মানে তুমি যদি খুশি হয়ে ওই বাটি চচ্চড়ির মন্ত্রটা আমায় শিখিয়ে দাও বাবা।
অলোক– নিশ্চয় কাকাবাবু কেন দেব না? আপনি আমাদের এতবড় উপকার করলেন আর আপনার জন্য এটুকু করবো না?
গোবিন্দ– বাঁচালে বাবা—(অলোক খেতে খেতে এগিয়ে যায়)
অলোক– (স্বগত) মন্ত্র শিখে কি আর পয়সা বাঁচবে কাকাবাবু? মন্ত্রটা যে খুব সহজ কাকাবাবু, ইলি গিলি হোকাস ফোকাস বাটিচচ্চড়ি, কিপটে বুড়ো বুঝলো না তার খসলো কতো কড়ি। (আলো নেভে)
(সমাপ্ত) -
কবিতা- হে ঈশ্বর
হে ঈশ্বর
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়হে ঈশ্বর, প্রশ্ন করে মানুষ,
কিসে হও তুমি তুষ্ট?
কত সাধনায় যুগ যুগ ধরি,
শত ক্লেশ সহি মাথা কুটে মরি তব দ্বারে।
বারেবারে নিজেরে করেছি পেষণ,
তোমাকে পাবার সাধন যন্ত্রে।
কত মন্ত্রে বেঁধেছি তোমার জয়গান।
আজান দিয়েছি কত সারাদিন ধরি তোমারি তরে।
গড়ে গেছি নিজের শিল্পে ভরা তোমারই বাসগৃহ,
মসজিদ গির্জা মঠে মন্দিরে,
চিড়ে কাঠ, পাথর খোদাই করে,
অষ্টধাতুতে তোমাকে এঁকেছি নিজের মতন করে।
ভরে দেছি খাদ্য পানীয়ে কাঞ্চন পাত্র,
মাত্র তোমায় পাবার আশায়।
তবু কেন বঞ্চিত করো মোরে তব কৃপা হতে,
কি মতে পূজিলে, তব দানে ধন্য হয়ে শাসিবো এ ধরাতল?
বল দেব, কোন ধর্ম তব, কোন গ্রন্থ পাঠে তব দেখা মেলে।
পেল কোন গুরু কৃপা,
মেলে আসন তোমারি সমুখে?
কত দুখে চেয়ে দেখি,
আমি ব্যতি আরও জীবকূল,
ভুলেও ডাকেনা যারা,
আনেনা তোমার নাম দিনমানে একবারও মনে।
প্রতি ক্ষণে নিজেরে বাঁচাতে কর্ম তার।
আহার নিদ্রা তরে লড়াইয়ের মাঝে শুধু ব্যস্ত বংশের বিস্তারে।
তোমারে চেনে না সে হীন,
নহে দীন তোমার ভজনে ভবে।
তবে কেন তোমার করুণা বর্ষিত তাদেরই পরে,
যুগ যুগ ধরে?
আর আমি, সত্য হতে কলি,
মক্কা কবায়, গয়া কাশী হতে আরও
দূর্গম পথে চলি, ব্যর্থ মনোরথ,
কিঞ্চিৎ করুণা তব নাহি কি আমার পরে,
আমার ঘরে নাহি সে প্রদীপ,
তোমার আলোকে প্রজ্জ্বলিত।
ভীত মোরে জানাও বারতা তব হে নাথ,
কেন অকরুণ তুমি,
করিতে করুণা মোরে?
ওরে ভ্রান্ত মতি, কহেন দেবতা মৃদু হাস্য করি।
স্মরিতে আমারে কে কহিয়াছে তোরে?
ধরে যুগ যুগ যে দোর ঠেলিস,
আমি নাই সেই ঘরে।
নাই আমি তোর গীর্জা মঠে,
মসজিদ মন্দিরে।
চিড়ে কাঠ আর পাথরে,
বাঁধিবি মোরে?
ফলবতী গাছে মূর্তি গড়িয়া, ফল চাস তারি কাছে?
আছি আমি প্রতি ধূলিকণা মাঝে,
প্রতি প্রাণে, প্রতিটি কর্ম মাঝে।
বাজে স্পন্দন নিখিল বিশ্বে আমারই হৃদয় হতে।
কি মতে তবে মূঢ় তুই,
শত ছিন্ন করি মোরে,
বাঁধিবারে চাস, শত নামে গড়া
তোর নকল দেবাগারে?
আর যারে তুই দীন হীন বলি,
তুচ্ছ করিলি চিরদিন,
ক্ষীণ শক্তি লয়ে আমারে পাইলো তারা,
আপন কর্ম বলে,
জ্বলে আমার প্রদীপ তাদের নয়ন মাঝে,
অসীম সময় ধরে।
আর পড়ে রোস তুই ভ্রান্ত বুদ্ধি নিয়ে,
দেবালয়ের আঁধার ঘরেতে আগল দিয়ে। -
কবিতা- স্বাধীনতা কত মজা
স্বাধীনতা কত মজা
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়মাঝ রাতে গল্প ফিস্ ফিস্ ফিস্,
আগষ্ট পনেরো সাল সাতচল্লিশ।
দেশ পেল স্বাধীনতা ভারী মজা তার,
বাড়ি চিরে চলে গেল মোটা কাঁটাতার।
গোয়ালটা বিদেশে রামু দেখে ভোরে,
পাসপোর্ট নাই, দুধ দুইবে কি করে?
গোপালের আরও মজা থাকে বনগাঁয়,
চাকরি করতে রোজ বরিশালে যায়।
স্বাধীনতা পেয়ে ভারী আনন্দ তার,
চাকরি বাঁচাতে রাতে ইছামতি পার।
আব্দুল মিঁয়া বুঝি কত খুশি হলো,
ভিটেমাটি সব ফেলে ভিনদেশে গেল।
মেয়েটা যে হাত খুলে কোথায় হারালো?
পেল তার ছেঁড়া শাড়ি,আরও খুশি হলো।
আনন্দ ধরে না যে সুবোধের মা’র,
ছেলে থাকে লাহোরে, ফিরলো না আর।
ট্রেনে বাসে ঠেসে ঠুসে হাজারে হাজারে,
মানুষ যায়, না পশু, বলতে কে পারে?
সব গেছে তবু খুশি বেঁচে আছে শ্বাস,
চেয়ে দেখ চারিদিকে কত পচা লাশ।
ধর্ষণ রাহাজানি আরো কত হলো,
দেশবাসী তবু খুশি স্বাধীনতা পেল।
জনগন ভারী সুখী পেয়ে স্বাধীনতা,
নেতা মরে ভাবনায় ফাটে বুঝি মাথা।
ইংরেজ দিলো এত বড়ো দেশটা-রে,
মাথায় আসে না এরে চালাবে কি করে।
কোট টাই পড়ে বুকে গোলাপ সেঁটে,
তাই নিল দেশটাকে ভাগ করে কেটে।
যারা গেল ফাঁসিকাঠে গুলি খেল যারা,
নেতা ভাবে দুর দুর মহা বোকা তারা।
স্বাধীনতা আসে না কি গোলাগুলি ছুঁড়ে?
পাওয়া যায় সহজেই তোষামোদ করে।
জনগন খুব খুশি আধপেটা খেয়ে
সত্তর পার করা স্বাধীনতা পেয়ে। -
গল্প- অমিত চরিত
অমিত চরিত
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ছোটবেলা থেকেই অমিতের বদমাইশি ছিল অন্য মাত্রার। তাই তাকে বাগে আনাটাও ছিল কঠিন। আমাদের গ্রামে তখন ময়রা স্যার বলে একজন মাস্টার মশাই ছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন ময়রা বাড়ির ছেলে। যারা মিষ্টি টিষ্টি তৈরী করতো আর কি। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত পন্ডিত মানুষ। তখনকার দিনে বি.এ, এল.এল.বি পাশ করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের ছেলেদের পড়ানোর স্বার্থে ওকালতি না করে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করতেন আর খুব কম পয়সায় গ্রামের ছেলেদের টিউশন দিতেন। অমিতও পড়তো সেই ময়রা স্যারের কাছেই। স্যার ইস্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে ছাত্রদের পড়াতে বসে যেতেন। আর স্যারের স্ত্রী রোজ পরোটা ভেজে পাঠিয়ে দিতেন দোতলায় স্যারের পড়ানোর ঘরে। একদিন রাতে খেতে বসে ময়রা স্যার তাঁর স্ত্রী’কে বললেন, ‘তুমি আমাকে তিনটে করে পরোটা দাও কেন? কোন সকালে খেয়ে স্কুলে যাই, তিনটে পরোটায় আমার খিদে মেটেনা’। স্যারের স্ত্রী তো আকাশ থেকে পড়লেন, ‘কি বলছো! আমি তো চারটে পরোটাই দিই’। স্যার ‘হুঁ’ বলে চুপ করে গেলেন। পরের দিন চোর ধরা পড়লো। রান্নাঘর থেকে স্যারের পরোটা আনার দায়িত্বটা ছিল অমিতের। পরের দিন স্যার অমিতকে পরোটা আনতে পাঠালেন, আর ঠিক দুমিনিট পর নিজে নেমে গেলেন সিঁড়িতে। গিয়ে দেখলেন অমিত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাঁর চারটে পরোটার একটি সাবার করছে। স্যার তার কান ধরে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রী’কে বললেন, ‘শোনো, কাল থেকে বাঁদরটাকে দু’টো করে পরোটা খাইয়ে তবে ওপরে পাঠাবে, আমার ভাগে যেন কম না হয়’ আসলে অমিত খুব বড়ো পরিবারের ছেলে, তার উপর স্যারের স্ত্রী অমিতকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন, তাই সেদিন তার বদমাইশির আবদারকে প্রশ্রয় দিতে স্যারকে ভাবতে হয়নি। অমিতের বদমাইশি ছিল এমনই। ধরো মা রসবড়া করে রেখেছেন দালানের চৌকির তলায়। ঘুরতে ফিরতে অর্ধেক রসবড়া খেয়ে ফেলার পর যখন অমিতের হুঁশ হলো আর মায়ের হাতে মার খাওয়ার ভয়টা যখন মনের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করলো তখন সে নিজের পিঠ বাঁচাতে ছোট বোন দুটিকে এগিয়ে দিল রসবড়ার দিকে, আর মা’কে গিয়ে খবর দিলো, সে তার ছোট বোন দুটিকে দালানের চৌকির তলায় বসে কিছু খেতে দেখে এলো। মা তো সেই শুনে লাফাতে লাফাতে গিয়ে ছোট দুটিকে ধরে পিটতে আরম্ভ করলেন। অমিতের পিঠ বাঁচলো কিন্তু মনটা খারাপ হলো খুব। পরের দিন দোকান থেকে দু পয়সার লজেন্স কিনে বোনেদের দিয়ে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করলো অমিত। অবশ্য শুধু ছোটবেলায় বা গ্রামের মধ্যে নয়, বড়ো হওয়ার পর, এমনকি চাকরির জায়গাতেও অমিতের বদমাইশির খামতি ছিল না। আদ্রার ঘটনা তো আগেই বলেছি। তারপর অমিত বদলি হয়ে এলো হাওড়া স্টেশনে। বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতে লাগলো, আর সেই সঙ্গে আবার শুরু হলো নাটক। এবার অবশ্য শুধু গ্রামে নয়, তার সাথে কোলকাতাতেও। কোলকাতার বিখ্যাত বিশ্বরূপা থিয়েটারে গোরা নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে অমিত খুব সুনাম অর্জন করেছে। আর ঠিক সেই সময়েই অমিতের ঘাড়ে চাপলো এক নতুন বিড়ম্বনা। অমিতের অফিসে নতুন বড়োবাবু হয়ে যিনি এলেন তাঁর বাড়ি আমাদের স্টেশনে নেমেই যেতে হতো। অমিতের বাড়ি তাঁর বাড়ির কাছাকাছি জানার পরেই তিনি অমিতকে দিয়ে প্রায়ই বাড়ির নানান কাজ করাতে লাগলেন। কাজ মানে প্রায় দিনই বড়োবাজার থেকে সংসারের জিনিসপত্র কিনতেন বড়োবাবু। আর সেই সব জিনিস ভর্তি ভারি ভারি ব্যাগ ঘাড়ে করে হাওড়া স্টেশন, তারপর ট্রেনে করে এসে আমাদের স্টেশনে নামিয়ে বড়োবাবুর বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসতে হতো অমিতকে। অবশ্য অমিত একা নয়, সঙ্গে থাকতো বিশ্বাস, যার বাড়ি আমাদের দুটো স্টেশন পর। ব্যাপারটা ক্রমেই অমিতের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। সে ভাবতে লাগলো কি করে এর থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। একদিন হঠাৎ অমিতের মাথায় একটা উদ্ভট বুদ্ধি চাপলো। সেদিনও বড়োবাবু ব্যাগভর্তি মালপত্র কিনে অমিতদের সঙ্গে বড়োবাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। হাওড়া ব্রিজ পার করে এসে পৌঁছলেন স্টেশনে। সামনে বড়োবাবু পিছনে ব্যাগ ঘাড়ে করে দুই কুলি অমিত আর বিশ্বাস। স্টেশনে ঢুকেই অমিত হঠাৎ বিশ্বাসের জামা টেনে ধরলো। বিশ্বাস তাকাতেই অমিত তাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়লো একটা থামের আড়ালে। ওদিকে বড়োবাবু তো নিজের মনে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছেন। হঠাৎই তিনি খেয়াল করলেন যে পিছনে অমিত আর বিশ্বাস নেই। ‘আরে গেল কোথায় ছোঁড়াদুটো?’ বড়োবাবু ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু বড়োবাবু ওদের খুঁজে পেলেন না, তাঁর চিন্তা বাড়তে লাগলো। হঠাৎ বড়োবাবু স্টেশনের মাইকে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলেন। গোটা হাওড়া স্টেশন জুড়ে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘হাওড়া স্টেশন ম্যানেজার অফিস বড়োবাবু শ্রী অমিয় মজুমদার আপনার জন্য অমিতবাবু আর রঞ্জন বিশ্বাস আপনার বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছে।’ একবার, দুবার, তিনবার। বড়োবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ‘ছোঁড়াগুলো করেছে কি! একেবারে মাইকে? ছি ছি ছি, একেবারে গোটা অফিস জেনে ফেললো যে ওদের দিয়ে বাড়ির কাজ করাই!’ তিনি ছুটলেন এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে। পেয়েও গেলেন দুজনকে। আর পেয়েই একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলেন, ‘মাইকে এনাউন্স করাতে তোদের কে বললো?’ অমিত কাঁচুমাচু মুখ করে মাথা চুলকে বললো, ‘না মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই–‘ বড়োবাবু তো রেগে আগুন, বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে যা। মালপত্রগুলো ট্রেনে তুলে দিয়ে তোরা অফিস ফিরে যা’। অমিতরা তাই করলো। বড়োবাবুকে মালপত্র সমেত ট্রেনে তুলে দিয়ে লাফাতে লাফাতে অফিস ফিরে গেল। আর সেই শেষ হলো বড়োবাবুর মাল বওয়া। তারপর থেকে আর কোনোদিন তাদের বড়োবাবুর কুলি হতে হয়নি। অমিত ছিল এইরকমই। ঘরে বাইরে সবসময়ই বদমাইশি বুদ্ধি তার মাথায় কিলবিল করতো। অবশ্য শুধু যে বদমাইশি তা নয়, ভালো কাজেও অমিতের তুলনা ছিল না। গ্রামে কার মেয়ের বিয়ে পয়সার জন্য আটকে গেছে, কি কার শরীর খারাপ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, সব জায়গাতেই ছিল অমিত আর তার বন্ধুরা। না আজকে তাকে আর ‘অমিত’ বলবো না, ‘অমিতবাবু’ বলি, কেননা তাঁর বয়স এখন আশি এবং তিনি সুস্থ শরীরেই আছেন। বয়স বদলেছে কিন্তু অমিত বাবু বদলাননি। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে উদ্দিন আর বরকত ছাড়া বাকিরা প্রায় সকলেই ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। তবে গ্রামের প্রতি তাঁদের দান আজও রয়ে গেছে। অমিত বাবু আর তাঁর বন্ধুরা হঠাৎই একদিন ইট আর মাটি দিয়ে গ্রামের মধ্যে একটা নাটকের মঞ্চ তৈরি করে ফেলেছিলেন, যেটা আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। অমিত বাবু ভালোই আছেন। বন্ধুরা নেই তো কি হয়েছে? অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গেই আড্ডা দেন, মাছ ধরতে যান, আর মাঝে মাঝে উঁকি দেন নাটকের রিহার্সাল ঘরে। হ্যাঁ, অমিত বাবুদের তৈরি সেই মঞ্চে আজও নাটক হয়। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শুক্র আর শনিবার সেই মঞ্চ আজও মাতিয়ে রাখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। এক কাজ করুন না, সবাই মিলে চলে আসুন যেকোনো বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শুক্র শনিবার। নাটক দেখবেন আর অমিত বাবুর সামনে বসে তাঁর নিজের মুখেই শুনে নেবেন তাঁর জীবনের মজার মজার সব গল্প। সবার নিয়ন্ত্রণ রইলো। কি আসবেন তো?
-
গল্প- গাঁটছড়া
গাঁটছড়া
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়আমাদের এই গ্রাম বাংলায় একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রত্যেক অবস্থাপন্ন ঘরেই কাছের বা দূরের বিপদগ্রস্ত আত্মীয়রা এসে দীর্ঘ দিন থেকে যেতেন আশ্রিত হিসাবে। অবাক হলেন? না না অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটা সত্যি। কখনো কখনো তো আত্মীয়তা এতো দূর সম্পর্কের হতো যে তা লিখতে গেলে হয়তো একটা পাতার অর্ধেকটা খরচ হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে তাঁরা বাড়ির সদস্য হয়ে যেতেন, আবার কেউ কেউ তো দাপটের সঙ্গে রাজত্বও চালাতেন আশ্রয় পাওয়া বাড়িতে। তেমনি অমিতদের বাড়িতেও ওইরকম নিকট দূর মিলিয়ে জনা পাঁচেক আত্মীয় থাকতেন। তার মধ্যে দুজন বিমল আর শানু ছিল অমিতেরই বয়সী। শানু সম্পর্কে অমিতের কাকা হতো তাই অমিত তাকে শানুকাকা বলতো আবার তুইও বলতো। যাক, এদের কথা কেন বললাম সেটা পরে বলছি, আপাতত একটু অন্য দিকে ঘুরে আসি। সালটা উনিশশো তেশট্টি, অমিত আই এসসি পাশ করে হঠাৎই একটা মার্চেন্ট কোম্পানিতে কাজে ঢুকে পড়লো। অমিতের বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই চাকরি করবি! আর পড়াশোনা করবি না’? অমিতের সাফ কথা তার পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না, সে রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। অমিতের বাবা আর কি করেন? ছেলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আর জোরাজুরি করলেন না। দেখতে দেখতে ছয় সাত মাস কেটে গেল। অমিত চাকরি করছে ঠিকই, কিন্তু তার বদমাইশি একটুও কমেনি। সেই আড্ডা মেরে, তাস খেলে রাত করে বাড়ি ফেরা, সেই নাটক আর সেই ভবতারিণী আলু আশ্রম। একদিন কথা প্রসঙ্গে অমিতের বাবার পাড়ার এক বন্ধু বললেন, ‘বুঝলে ডাক্তার ছেলের এবার বিয়ে দিয়ে দাও। তাহলেই দেখবে বাইরের টান ছেড়ে ছেলে ঘরমুখী হয়েছে’। কথাটা অমিতের বাবার মনে ধরলো। অমিতের মাকে বলাতে তিনিও মত দিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে আমাদের আশেপাশের গ্রামে খুব কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো, আর অমিতের বাবা সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এখনকার মতো সেই সময়ে কলেরার চিকিৎসা এতো সহজলভ্য ছিল না। বিশেষ করে গ্রামের দিকে ওষুধ বা স্যালাইনের জোগান প্রায় ছিল না বললেই চলে। অমিতের বাবা আর ছঙ্কুর বাবা সারারাত ধরে বাড়িতে বসে স্যালাইন জল তৈরি করতেন। আর পরেরদিন সকালে সেই স্যালাইন জল শিশিতে করে ব্যাগে ভরে নিয়ে সাইকেল করে দুজনে বেড়িয়ে যেতেন দুদিকে। তারপর আট দশটা গ্রাম ঘুরে ফিরতেন সেই সন্ধ্যাবেলা। আর এই ব্যস্ততার মধ্যে অমিতের বিয়ের ব্যাপারটা তাঁর মাথা থেকে একরকম মুছেই গেল। হঠাৎ একদিন এক অনুষ্ঠান বাড়িতে অমিতের বাবার এক দূরসম্পর্কের দিদি অমিতের বাবাকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে ছেলের বে দিবি? আমার জানা একটা ভালো মেয়ে আছে’। অমিতের বাবা আগ্রহ দেখাতে তিনি যে বাড়ির কথা বললেন অমিতের বাবার চিনতে অসুবিধা হলো না। গ্রামটা আমাদের দু’টো স্টেশন পর আর রাস্তায় গেলে আমাদের গ্রাম থেকে আট দশটা গ্রাম দূরে, মুখুজ্জে বাড়ি। অমিতের বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তো ওখানে রুগী দেখতে যাই, একদিন না হয় ঘুরে আসবো। তাঁর দিদি তো হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘তুই ছেলের বাবা তুই যাবি কি! আমি ওদের খবর পাঠাচ্ছি, মেয়ের বাবা যাবে তোর কাছে’। অমিতের বাবা ছিলেন উদারমনস্ক মানুষ, হেসে বললেন, ‘না দিদি, সম্বন্ধ যখন আমার দিক থেকে যাচ্ছে তখন আমার যাওয়াটাই কর্তব্য’। তারপর হঠাৎই একদিন রুগী দেখতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সুবোধ মুখার্জির বাড়ি। আর গিয়েই সরাসরি বলে দিলেন তাঁর আসার উদ্দেশ্য। সুবোধ বাবু তো অবাক। কিন্তু কি আর করেন, ডাক্তার বাবু বলে কথা। এনে হাজির করলেন তাঁর পনেরো বছরের মেয়ে শুভাকে। সে তখন পুকুর পাড়ে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিলো। না সাজগোজ না কোনো আয়োজন। এ আবার কেমন কনে দেখা! কিন্তু তাতেই ডাক্তার বাবু কাত। এতো লক্ষ্মী প্রতিমা, এতো সুন্দরী মেয়ে হয়! একরকম কথা দিয়েই চলে এলেন অমিতের বাবা। শুনে অমিতের মা বললেন, ‘হ্যাঁ গো আমরা একবার দেখতে যাবো না’? অমিতের বাবা বললেন, ‘যাবে যাও, তবে সেটা শুধু ওনাদের পয়সা খরচ করাতে যাওয়া, কেননা ও মেয়েকে দেখে না বলার ক্ষমতা কারো নেই’? বাকি ব্যাপারগুলো খুব তাড়াতাড়িই মিটে গেল। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। অমিতের ওদিকে দোটানা অবস্থা। বিয়ের আনন্দ হচ্ছে ঠিকই আবার একটা চিন্তাও থেকে যাচ্ছে, মেয়ে যদি দেখতে খারাপ হয়! বাড়ির লোকজন বলছে ভালো, কিন্তু তাদের ভরসা কি? অমিত তো আর নিজে দেখেনি। সে গিয়ে ধরলো শানুকে, ‘দ্যাখ শানুকা আমার বিয়ের দিন তুইও আমার মতো সেজেগুজে যাবি। যদি মেয়েকে আমার পছন্দ হয় তাহলে আমি বিয়ে করবো, না হলে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো’। শানু ছিল নিরীহ মানুষ, কি আর করে, আস্তে করে ঘাড় নাড়লো। বিয়ে আর দিন পনেরো বাকি, হঠাৎ অমিতের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত। অফিস থেকে তাকে বদলি করেছে বিহারে। দুদিনের মধ্যে চলে যেতে হবে। বাড়িতে এসে বললো। বাবা শুনে বললেন, ‘তাতে কি? চলে যাও, জয়েন করে ছুটি নিয়ে চলে এসো’। সেই মতো পরের দিন অমিত একেবারে বাক্স প্যাঁটরা নিয়েই বেড়িয়ে পড়লো। অফিসে গিয়ে বদলির চিঠি নিয়ে সোজা চলে যাবে নতুন কাজের যায়গায়। সঙ্গে চললো বিমল। তার দায়িত্ব হলো অমিতের সঙ্গে থেকে নতুন যায়গায় সব কিছু ব্যবস্থা করে দিয়ে আসা। অফিসে পৌঁছে বড়বাবুকে অমিত তার বিয়ের খবরটা জানিয়ে ছুটির কথা বললো। বড়বাবু চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘বিয়ে! এর মধ্যেই? হুঁ, কিন্তু ছুটির ব্যাপারে তো আমি এখান থেকে কিছু করতে পারবো না। ওখানে গিয়ে বলে দেখো। তবে জয়েন করেই ছুটি! কে জানে, দেখো চেষ্টা করে’। অমিত পড়লো মহা চিন্তায়, যদি ছুটি না পায়! তাহলে তো বিয়েটাই করা হবে না। এইসব ভাবতে ভাবতে হাওড়ায় ট্রেনে উঠে বসলো, সঙ্গে বিমল। লোকাল ট্রেনে বর্ধমান সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে হাটিয়া। ট্রেন চলতে লাগলো আর অমিতের চিন্তাও বাড়তে লাগলো, ‘ইস্ বদলি করার আর সময় পেলো না! কেন আর একমাস বাদে বদলি করলে কি এমন অসুবিধা হতো’? ট্রেনটা এসে একটা স্টেশনে দাঁড়িয়েছে, হঠাৎ বিমল বললো, ‘জানিস তো এই স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি পাঁচ মাইল’। আসলে ওখানে ছিল বিমলের মামার বাড়ি। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা তাকে আর তার ভাই বোনদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। তারপর একটু বড়ো হওয়ার পর বিমলের ঠিকানা হলো অমিতদের বাড়িতে। বিমলের কথায় অমিতের হুঁশ ফিরলো, আর হঠাৎই সে বাঙ্ক থেকে বাক্সগুলো নামিয়ে বিমলের হাত ধরে টেনে নিয়ে নেমে পড়লো সেই স্টেশনে। বিমল তো অবাক, ‘কি রে নেমে পড়লি’? অমিত বললো, ‘তোদের বাড়ি যাবো’।
-‘তোর চাকরি!’
-‘চুলোয় যাক চাকরি, তারপর চাকরি করতে গিয়ে বিয়েটাই ফস্কে যাক আর কি’। বিমল আর কি করে মামাবাবু বকবে টকবে বলে একটু গাঁইগুঁই করে অমিতকে নিয়ে চললো তাদের বাড়ি। সেখানে দুদিন কাটিয়ে অমিত বাড়ি ফিরে এলো। তাদের দেখে তো সবাই অবাক। অবশেষে সব ঘটনা শোনার পর অমিতের বাবা একটু নকল রাগ দেখালেন বটে কিন্তু মনে মনে তিনি খুব হাসলেন। কদিন বাদে অমিতের বিয়েও হয়ে গেল। শানু কাকা অমিতের কথা মতো সেজেগুজে গেল ঠিকই কিন্তু তার আর কোন দরকার হলো না। মেয়ের বাড়িতে পৌঁছবার পর অমিত একবার উঁকিঝুঁকি মেরে বৌকে দেখার চেষ্টা করতে গেল তো বাড়ির মহিলারা রে রে করে তেড়ে এলো, ‘না, বিয়ের আগে মোটেই বৌএর মুখ দেখা যাবে না’। অমিত পড়লো মহা বিপদে, মেয়ে না দেখে বিয়ে করবে কি করে? আর হঠাৎই তার মাথায় এলো তার মাথার টোপোর আর গলার মালাটার কথা। এ দু’টো থাকলে বিয়ের আগে বৌকে দেখা যাবে না। সে ঘরে গিয়ে মালা আর টোপোরটা পড়িয়ে দিলো শানুকে, আর তারপরেই নিজে সোজা গিয়ে হাজির হলো মেয়ে যেখানে বসে আছে সেই ঘরে। সে দেখলো কেউ তাকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। অবশ্য নিজের হবু বৌকে দেখার পর শানুর কাছ থেকে মালা আর টোপোর কেড়ে নিতে তার বেশি সময় লাগেনি।
বিয়ের পাঁচ দিন পর বৌকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল অমিত। ঠিক ছিল একদিন কাটিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অমিতের বৌকে ছাড়লো না। ঠিক হলো দু’দিন পর অমিত গিয়ে নিয়ে আসবে। সেই মতো অমিত বাড়ি এসে ঠিক দু’দিন বাদে বিকেলবেলা চললো শ্বশুরবাড়ি থেকে বৌকে আনতে। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোতেই বিপত্তি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দুঘন্টা দেরি করে অমিত যখন গিয়ে শ্বশুরবাড়ির স্টেশনে নামলো তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। স্টেশন থেকে শ্বশুরবাড়ি আরও তিন মাইল। রিক্সাওয়ালাকে শ্বশুরবাড়ির গ্রামের নাম বলাতে সে বললো, ‘না বাবু গেরামের ভিতরি যেতি পারবো নি, পিচ রাস্তায় গেরামের মুখ ওবদি নামায়ে দে আসতি পারি’। অমিত বললো, ‘কেন গো’? রিক্সাওয়ালা হেসে বললো, ‘হেঁ হেঁ বাবু ইখানে নতুন মনি হচ্ছি’? অমিত বুঝলো রিক্সাওয়ালা যাবে না, কিন্তু কেন যাবে না সেটা বুঝতে পারলো না। হ্যাঁ বৃষ্টি হয়েছে বটে রাস্তায় একটু কাদা হবে, সে তো বর্ষাকালে সব গ্রামেই হয়, তাই বলে রিক্সা যাবে না! যাক কি আর করা যাবে ওই হাফ মাইল পথ হেঁটেই যেতে হবে। অমিত খান ছয়েক দেশলাই কিনে রিক্সায় উঠে বসলো। সে এমনিতে খুব সাহসী, কিন্তু সাপে তার ভীষণ ভয়। সঙ্গে কোন আলো নেই, দেশলাই কাঠি জ্বেলে জ্বেলেই চলে যাবে বাকি রাস্তাটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের মুখে বড়ো রাস্তার উপর তাকে নামিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালা যেন ল্যাজ তুলে পালালো। অমিত একটু অবাক হলো, ‘কি ব্যাপার রাতে এখানে ভুত টুত বেড়োয় নাকি’! যাক ভুতে অমিতের ভয় নেই। অন্ধকারের মধ্যে অমিত দেশলাই জ্বাললো, আর তখনই বুঝতে পারলো রিক্সাওয়ালার পালাবার কারণ। রাস্তা কোথায়! এতো পুরোটাই চষা মাঠ। দেখে তো অমিতের হাল খারাপ। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে কি করে! ইস্ আজকেই নতুন পাজামা পাঞ্জাবীটা পড়ে এলো, তার সঙ্গে নতুন কেনা সাদা রঙের রাদুর চপ্পল। একবার ভাবলো ফিরে যাবে। কিন্তু নতুন বৌয়ের এতো কাছে এসে ফিরে যাওয়ার মতো মনের জোর জোটাতে পারলো না অমিত। অগত্যা পা বাড়ালো। দু’পা যেতেই সাদা জুতো পাজামা কাদায় মাখামাখি। কিন্তু কি আর করা যাবে। হড়কাতে হড়কাতে চললো অমিত। একটু বাদেই তার মনে হলো সামনে যেন একটা লন্ঠনের আলো দুলতে দুলতে যাচ্ছে। অমিত একটু পা চালালো। লন্ঠনের আলোটা পেলে তবু একটু সুবিধা হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোর মালিককে ধরে ফেললো অমিত। ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে লন্ঠনটা তুলে বললেন, ‘কে? ও জামাই, এহেহে শ্বশুরবাড়ি আসার আর দিন পেলে না, কি অবস্থা বলো দেখি, এসো এসো আমার সঙ্গে এসো’। ধীরু কাকা, অমিতের শ্বশুরবাড়ির উল্টো দিকেই বাড়ি, স্টেশনে বড়ো মুদিখানার দোকান। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছেন। ধীরু কাকা এটা সেটা বলতে বলতে চলেছেন, পিছনে অমিত। হঠাৎ অমিতের একটা পা কাদার মধ্যে প্রায় হাঁটু অবধি ঢুকে গেল, আর অমিত টাল সামলাতে না পেরে সেখানেই থপ করে বসে পড়লো। ধীরু কাকা হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, ‘কি জামাই পড়ে গেলে’। রাগে অমিতের মাথা অবধি জ্বলে উঠলো। যা হোক করে দাঁড়িয়ে পা টেনে বাড় করলো তো চটিটা রয়ে গেল কাদার মধ্যে। সর্বনাশ চটিটা কোথায় গেল রে বাবা! অমিত সেই কাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে খুঁজে খুঁজে চটিটা টেনে বাড় করলো তো চটির সঙ্গে উঠে এলো এক দলা কাদা। পাজামা পাঞ্জাবী কাদায় ভর্তি। আর চটি পড়ে কাজ নেই। এখন অমিত নির্ভয়। চটি হাতে নির্দিঊধায় চললো ধীরু কাকার পিছনে। হঠাৎ অমিতের মনে হলো, ‘বুড়ো একবার পড়ে দেখি’। যেমন ভাবা তেমন কাজ, ধীরু কাকা চিৎপটাং, আর ধীরু কাকার লন্ঠনটা বার দুয়েক দপ দপ করেই নিভে গেল। অমিত মনে মনে খুশি হলেও মুখে আহা আহা করে উঠলো। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই যাহোক করে টেনে তুললো ধীরু কাকাকে। আর উঠেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার গেঁজেটা! গেঁজে হলো একটা কাপড়ের থলি। দোকানের সারাদিনের বিক্রি বাটার টাকা পয়সা ওই গেঁজের মধ্যে করে ধীরু কাকার কোমড়ে গোঁজা ছিল। সেটা ধীরু কাকা পড়ার সময় কোমড় থেকে ছিটকে কোথায় পড়ে গেছে। ধীরু কাকা অস্থির হয়ে উঠলেন। অগত্যা অমিত দেশলাই জ্বেলে অনেক খুঁজে সেটাকে উদ্ধার করলো। আবার হাঁটা শুরু হলো, এবার পুরো অন্ধকারে। অবশেষে অমিত এসে পৌঁছল শ্বশুরবাড়ির দরজায়। কড়া নাড়তে শ্বশুর মশাই এসে দরজা খুলে বললেন, ‘কে’। অমিত বললো, ‘আমি’। শ্বশুর মশাই লন্ঠনটা মুখের কাছে তুলে ধরে বললেন, ‘কে বাবা তুমি’? অমিতের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। কাদা মেখে তার এমন অবস্থা হয়েছে যে শ্বশুর মশাইও চিনতে পারছেন না। অগত্যা অমিত নিজের নাম বললো, আর নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যেন যুদ্ধ লেগে গেল। বাড়ির সবাই ছুটে বেরিয়ে এলো। ‘একি অবস্থা হয়েছে’, ‘এই বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট করে কেন এলে বাবা’, নানা জনের নানা কথা। তারই মধ্যে জামা কাপড় ছেড়ে চান টান করে ঘরে ঢুকলো অমিত। আর নতুন বৌকে দেখে কষ্টটাও বোধহয় লাঘব হলো। -
গল্প- নাটকে নাটক
নাটকে নাটক
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়অমিতের তখন অভিনেতা হিসাবে ভালোই নাম ডাক হয়েছে। আশেপাশের নাট্য দল থেকে মাঝেমধ্যেই তার ডাক পড়ছে বড়ো বড়ো চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। তারমধ্যে ডি.এল রায়ের শাজাহান নাটকে ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয় করে তার পরিচিতি আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ একদিন পাড়ার ছোটদের নাটকের দলের কয়েকটি ছেলে এসে অমিতকে ধরলো তাদের নাটকে একটা চরিত্র করে দেওয়ার জন্য। ছোট মানে, অমিতের বয়স তখন তেইশ আর তারা সব চোদ্দো পনেরো। তো সেই দলের ছেলেরা মানে অজয়, পুটু, দিপাল নাটক করার আমন্ত্রণ পেয়েছে আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে একটা কোম্পানির রিক্রিয়েশন ক্লাবে। তাদের নাটকে দু’টো বয়ষ্ক চরিত্রে অভিনয় করে দেওয়ার জন্য তারা অমিত আর গোপালকে ধরেছে। অমিতের তখন বেশ নাম ডাক, আর ওই বয়সে ভালো অভিনেতা হিসাবে নাম করে ফেলাতে অমিত মনে মনে একটু গর্বও অনুভব করে। অজয়, দিপালরা রিহার্সালে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগায় আর অমিত তাদের তুড়ি মেরে বলে, ‘যা যাঃ, তোরা নিজেরা রিহার্সাল করগে যা, আর গোপালটাকে ভালো করে রিহার্সাল করা। আমাকে দেখতে হবেনা, আমি ঠিক করে দেবো’। ছোটরা কিছু বলতে সাহস করে না। একে অমিত তখন নামকরা অভিনেতা, তার উপর ডাকাবুকো ছেলে বলে পাড়ার ছোটরা তাকে একটু ভয়ই পায়। তারা নিজেরাই রিহার্সাল করে আর গোপাল নিজের তাগিদেই রিহার্সাল করে। কেন না গোপাল নিজে তো বটেই এমনকি পাড়ার লোকেরাও জানে যে মঞ্চে ওঠার ব্যাপারে সে খুব নার্ভাস। নাটক করার ইচ্ছা খুব, কিন্তু প্রতিবারই ঠিক মঞ্চে ওঠার সময়েই তার নার্ভ ফেল করে। নাটকের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো। অমিত দু-এক দিন রিহার্সাল করলো। পার্ট ঠিক মতো মুখস্থ হয়নি। ছেলেরা বলাতে অমিত বললো, ‘ও নিয়ে ভাবিস না, সব মুখস্থ হয়ে যাবে’। রিহার্সাল হতো পুটূদের বাড়ির বৈঠকখানায়। নাটকের একটা দৃশ্য ছিল যেখানে শিল্পপতি অনিমেষ সেনের (অমিত) ড্রইংরুমে ডাক্তার (পিন্টু) এসে অনিমেষ সেনকে পরীক্ষা করে একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছে, আর অনিমেষ সেন তার ছেলেকে (পুটু) তার খারাপ কাজের জন্য ইংরাজিতে খুব বকাবকি করছে, আর সেই ঘরেই এককোনে বসে তখন মদ্যপান করছে অনিমেষের বন্ধু প্রকাশ (অনন্ত)। রিহার্সাল দেওয়ার সময় অনন্ত রোজই পুটুদের একটা জল খাওয়ার গ্লাস নিয়ে রিহার্সাল করতো, আর জল খাওয়ার মতো করে আলগোছে মদ খেতো। সবাই বকাবকি করলে বলতো, ‘আরে স্টেজে কি আর আলগোছে মদ খাবো নাকি’। দেখতে দেখতে নাটকের দিনও এসে গেল। দলের ছেলেরা সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে, গিয়ে পৌঁছলো নাটকের জায়গায়। মঞ্চ টঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি সবাই মেকাপ সেরে নিলো। আর ঠিক মেকাপ নেওয়ার পরেই অমিত বুঝতে পারলো আজকের পার্টটা যেন তার ঠিক মতো আয়ত্তে নেই। বিশেষ করে ছেলেকে বকাবকি করার দৃশ্যে অতগুলো ইংরাজি শব্দ ঠিক মতো মনে পরছে না যেন মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে গুম হয়ে একটা চেয়ারে বসে পার্টটা দেখতে লাগলো। ওদিকে গোপালকে দেখা গেল নিজের পার্ট হাতে মঞ্চের পিছনে খুব ব্যস্তভাবে পায়চারি করছে। সময় মতো নাটক শুরুও হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটক জমে গেল। একটার পর একটা দৃশ্য চলছে, সবাই মোটামুটি ভালোই অভিনয় করছে। অমিতেরও দু’টো দৃশ্যে অভিনয় হয়ে গেছে, ভালোই উতরে গেছে, অমিত অনেকটা নিশ্চিত। আর দু’টো দৃশ্য আছে, হয়ে যাবে, মনে মনে ভাবলো অমিত। আরও দু’টো দৃশ্যের পর এলো অমিতের সেই দৃশ্যটা। যেখানে অমিত মানে অনিমেষ, তার ছেলেকে বকাবকি করছে, ডাক্তার অনিমেষকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে, আর প্রকাশ বসে বসে মদ্যপান করছে। দৃশ্যের শুরুটা ভালোই হলো, কিন্তু গন্ডোগোলটা হলো ছেলেকে বকাবকি করার সময়। ডায়ালগ বলতে গিয়ে অমিত বুঝলো তার মাথা পুরো ফাঁকা। অমিতের ডায়ালগ ছিল, ‘why are you going to the below standard’. কিন্তু অমিতের why টা ছাড়া আর কিছুই মনে পরছে না। মঞ্চের উপর অমিত ঘামতে শুরু করলো। সে বার দুয়েক why why বলেছে, হঠাৎ দেখলো অনন্ত সেই গ্লাস থেকে আলগোছে মদ খাচ্ছে, আর সেটা দেখে দর্শক একটু আওয়াজ করে উঠলো, আর তাতে ঘাবড়ে গিয়ে অমিতের মুখ দিয়ে ‘why are you going to the below standard’ এর বদলে বেড়িয়ে এলো শুধু তিনটি শব্দ, ‘why to do’. বলেই অমিত চুপ, আর অমিতের ওই ডায়ালগ শুনে আরও ঘাবড়ে গেল ডাক্তার বেশি পিন্টু। সে এতোই ঘাবড়ে গেল যে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় অনিমেষের ফুল হাতা জামার হাতা না গুটিয়ে জামার উপর দিয়েই ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো, আর তাতে আরও হাসির রোল উঠলো দর্শকদের মধ্যে। অমিত যা হোক করে সিনটা ম্যানেজ করলো বটে, কিন্তু তার ধাক্কাটা গিয়ে পৌঁছলো মঞ্চের পিছনে। মঞ্চের উপর ওইসব তালগোল দেখে গোপালের নার্ভাস সিস্টেম একেবারেই ফিউজ হয়ে গেল। সে ছুটে গিয়ে অজয়ের হাত চেপে ধরলো, ‘ভাই আমাকে বাদ দে’। অজয় তো আকাশ থেকে পড়লো, ‘বাদ দেব মানে’! গোপাল বললো, ‘আমার কিছুই মনে পরছে না, সব ভুলে গেছি’। অজয় অবাক, ‘ভুলে গেছো কি গো’? গোপাল বললো, ‘হ্যাঁ ভাই সব ভুলে গেছি, দেখ মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে তো না ওঠা ভালো, তুই আমার দৃশ্যটা বাদ দিয়ে দে ভাই।’ অজয়ের ভীষণ বিরক্ত লাগলো। নাটকটা বেশ ভালোই চলছিলো হঠাৎ একটা দৃশ্য গুবলেট হয়ে গেল, তার উপর গোপালদার এই অবান্তর কথা। সে একরকম বিরক্ত হয়েই বললো, ‘ঠিক আছে যাও তোমাকে মঞ্চে উঠতে হবে না, তোমার সিনটা বাদ দিয়ে দেব’। গোপাল তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো, কিন্তু বিপদে পরলো আর একজন, মিত্তিরদের বিশু। সে ওই নাটকে এক প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করছে। দৃশ্যটা ছিল, মাস্টার মশাই, মানে গোপাল মঞ্চে বক্তৃতা দেবে আর বিশু দর্শক আসন থেকে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘থামুন মাস্টার মশাই, আগে আমার কথার জবাব দিন’। তারপর দর্শকদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে মঞ্চে উঠবে। সেইজন্য বিশু নাটক শুরুর আগে থেকেই মেকাপ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে গিয়ে বসে আছে। তার আশেপাশের দু’একজন, অচেনা মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘ভাই তুমি’? বিশু বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, ‘আমার রোল আছে নাটকে’। নাটক এগিয়ে যাচ্ছে। পাশের লোকজন আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ভাই কখন তোমার রোল’? বিশু বললো, ‘আসবে আসবে’। আর আসবে, মাস্টার মশাই তো ভেগেছে, আর মাস্টার মশাই না উঠলে প্রতিবাদী যুবক মঞ্চে উঠবে কি করে? এদিকে নাটক যত গড়ায় পাশের লোক তত খোঁচায়, আর প্রতিবাদী যুবক তত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সে বুঝে উঠতে পারে না যে তার দৃশ্যটা আসছে না কেন। এই করতে করতে নাটক শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতিবাদী যুবকের মঞ্চে আর ওঠা হলো না। যাওয়ার সময় পাশের লোকগুলো বলে গেল, ‘হুঁঃ, খালি চ্যংড়ামো, এসেছে নাটক দেখতে, আর সমানে বলে যাচ্ছে, নাটকে রোল আছে, যত্তোসব’। সেই খোঁচা খেয়ে বিশু লাফাতে লাফাতে চললো গ্রীনরুমে। গ্রীনরুমে গিয়েই রুদ্রমূর্তি। প্রথমেই ধরলো গোপালকে, ‘তুমি মঞ্চে উঠলে না কেন’? গোপাল ভয় পেয়ে বললো, ‘আমাকে অজয় উঠতে বারণ করেছে’। এবার বিশু খুঁজতে লাগলো অজয়কে, আর অজয় গিয়ে লুকালো অমিতের পিছনে। বিশুর রাগ তখন তুঙ্গে। যে কিছু বলছে তাকেই মারতে যাচ্ছে। অবশেষে অমিত বুঝিয়ে বলাতে সে একটু চুপ করলো, কেননা অমিতের সঙ্গে তর্ক করার সাহস তার নেই। কি আর করে, গ্রীনরুমের এককোনে বসে গজগজ করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে ওরা বেড়িয়ে পরলো। অমিতের মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল সিনটা বিগড়ে যাওয়ার জন্য। সে একটা জিনিষ বুঝতে পারলো যে ফাঁকি দিয়ে কোন কাজ ভালোভাবে করা যায় না আর এই ভাবনাই পরবর্তী কালে অভিনেতা অমিতকে অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সেদিন আর একটা ব্যাপারও অমিতের খুব খারাপ লেগেছিল। নাটকের শেষে দু’টো লোক এসে বলে গেল, ‘ভাই পরের বার থেকে মদটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে খেয়ো আর ইঞ্জেকশনটা দেওয়ার সময় জামার হাতাটা গুটিয়ে নিয়ো।।