-
গল্প- অমিতের কীর্তি
অমিতের কীর্তি
-সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়গোস্বামী বাবুর খাদে মাছ ধরতে গিয়ে অমিতের মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার খবরটা জানাজানি হতে বেশি সময় লাগলো না। খবরটা অমিতের বাবার কানেও পৌঁছলো। তিনি বিরক্ত হয়ে অমিতের মাকে বললেন, ‘ছেলেটা কি আরম্ভ করেছে বলতো, এইভাবে যেচে বিপদ ডেকে আনার কোন মানে হয়? পড়াশোনায় মতি নেই, শুধু পাড়ার ছেলেদের নিয়ে হল্লা করে বেড়াচ্ছে। কদিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা, কি রেজাল্ট করবে বুঝতেই পারছি’। আসলে অমিতের বাবা অমিতের উপর একটু রেগেই ছিলেন। কদিন আগেই হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় অমিতের রেজাল্ট মোটেই ভালো হয়নি, বিশেষ করে সংস্কৃতে। সংস্কৃত পরীক্ষায় প্রথমেই ছিল বাংলা থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ, আর তার প্রথমটা ছিল ‘হরিণেরা সরোবরে জল পান করছে’ দেখেই তো অমিতের মাথা খারাপ। একে সবসময় পন্ডিত মশায়ের ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে এসেছে, তার উপর যে দু’ একটা মুখস্থ করে এসেছে তার একটাও আসেনি। কিন্তু কি আর করা যাবে, কিছু তো লিখতে হবে। অগত্যা অমিত লিখতে আরম্ভ করলো ‘হরিন্যাং সরবরাং জলং’ ইত্যদি ইত্যাদি। মানে সব বাংলা শব্দের পিছনে একটা করে অং বা অ্যাং। কপাল গুনে সেদিন অমিতদের ঘরে পন্ডিত মশাই নিজেই গার্ড ছিলেন। ঘরে পায়চারি করতে করতে তাঁর হঠাৎ অমিতের খাতার দিকে নজর গেল, আর অমিতের অনুবাদ দেখে তো তাঁর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তিনি অমিতের পাশে এসে বললেন, ‘বাপ, ব্রাহ্মণ সন্তান, একটু আধটু সংস্কৃত জ্ঞান না থাকলে কি চলে? খাতা দেখবো আমি, এই সব লিখে তো আমার হাতে ফেল করবি বাপ, তারপর সেই রাগ এসে পরবে আমার উপর’। আসলে ঘটনাটা হয়েছিল আগের পরীক্ষার পর। পরীক্ষা হয়ে গেছে রেজাল্ট তখনও বেড়োয়নি। অমিত একদিন সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গেছে স্টেশনের দিকে। হঠাৎ পন্ডিত মশায়ের সঙ্গে দেখা। তিনি কোথাও গিয়েছিলেন, বাড়ি ফিরছেন, সঙ্গে রাজ্যের পোঁটলা পুঁটলি। অমিতকে দেখে বললেন, ‘যাক বাবা যাক, ভালো হয়েছে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবি চ, নাহলে এতো রাস্তা আমাকে হেঁটে ফিরতে হবে’। স্টেশন থেকে পন্ডিত মশায়ের বাড়ি প্রায় চার মাইল। অমিতের ইচ্ছা ছিল না মোটেই, কিন্তু কি আর করে, পন্ডিত মশাই বলে কথা, তার উপর ভীষণ রাগী। না বললেই হয়তো চেঁচিয়ে উঠবেন, ‘ওরে অকাল কুষ্মান্ড, গুরু বাক্য অমান্য করছিস’! অগত্যা অমিত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। পন্ডিত মশায়ের ওজন বেশি নয়, সাকুল্যে হয়তো চল্লিশ কেজি হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাঁর পুঁটলি নিয়ে। নয় নয় করে খান পাঁচেক তো হবেই। পন্ডিত মশাই সাইকেলের রডে উঠে বসলেন, আর পুঁটলিগুলো, কটা সাইকেলে বাঁধা হলো আর কটা তিনি হাতে নিলেন। অমিত সাইকেল ছাড়লো। সমস্যা হলো স্টেশন থেকে এগিয়ে এসে প্রথম যেখানে রাস্তাটা ঘুরেছে, সেইখানে রাস্তা ঘুরলেও হ্যান্ডেলের ফাঁকে পন্ডিত মশায়ের পুঁটলি ঢুকে যাওয়ায় সাইকেল আর ঘুরলো না। অমিত পন্ডিত মশাই সমেত সাইকেল নিয়ে সোজা মাঠে নেমে গেল, তারপর টাল সামলাতে না পেরে চিৎপাত। পড়ে গিয়ে পন্ডিত মশাই আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘মেরে ফেললে রে, মেরে ফেললে…’ তারপর অমিত তাঁকে যাহোক করে টেনে তুলতেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বাবা, তুই কি করে জানতে পারলি বল, কি করে জানতে পারলি’? অমিত তো আকাশ থেকে পড়লো, কিছুই বুঝতে পারছে না। পন্ডিত মশাই বলে চললেন, ‘পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলে কি করে নম্বরটা দেবো বাবা? আমার হাতে ফেল করেছিস জানতে পেরে আমাকে মেরে ফেলার তাল করছিস? কি দস্যি ছেলে রে বাবা’! অমিতের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। তার মানে সংস্কৃত পরীক্ষায় সে ফেল করেছে! পন্ডিত মশাই আবার বললেন, ‘দাঁড়া বাবা দাঁড়া তোকে পাশ করিয়ে দিচ্ছি’। এই বলে তিনি হঠাৎ রাস্তার উপর বসে একটা পুঁটলি খুলে ফেললেন। অমিত অবাক হয়ে দেখলো তার মধ্যে তাদের পরীক্ষার খাতা। পন্ডিত মশাই তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে তার খাতাটা বার করে নিলেন। অমিত দেখলো সে আটাশ পেয়ে ফেল করেছে। অমিতের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়। পন্ডিত মশাই সেই রাস্তার উপর বসেই তার খাতায় কি সব নম্বর টম্বর যোগ করে উপরে লিখে দিলেন আঠাশ প্লাস তিন একত্রিশ। দিয়েই বললেন, ‘দ্যাখ বাবা দ্যাখ, আটাশ পেয়েছিলি, আরও তিন নম্বর জুড়ে একত্রিশ করে দিলাম, এক নম্বর বেশি দিলাম বাবা, খুশি তো? এবার বাড়ি পৌঁছে দে বাবা, আর যেন ফেলে মারিস না’। অমিত কে আর পায় কে? সংস্কৃতটা নিয়েই চিন্তা ছিল, সেটা উতরে গেল। পন্ডিত মশাইকে সাইকেলে চাপিয়ে একটানে তাঁর বাড়িতে গিয়ে নামিয়ে দিল অমিত। বাড়ি পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে পন্ডিত মশাই বললেন, ‘ঘরদোরটা একটু ঝাঁট দিয়ে দে বাবা’। অমিত দিয়ে দিলো। তারপর বললেন, ‘একটু খাবার জল তুলে দিয়ে যা বাবা’। অমিত তুলে দিলো। তারপর পন্ডিত মশাই বললেন, ‘যা যা, সামনে সপ্তাহে খাতা বেড়োবে তখন দেখে নিস খাতায় কি সব লিখেছিস। তারপর থেকে পন্ডিত মশাই অমিতকে আর খুব একটা বকাবকি করতেন না। তবে সেদিন পরীক্ষা হলে তিনি অমিতের কানটা মুলে দিলেন। অবশ্য তারপর পাশ করার মতো উত্তর বলে দিয়ে সে যাত্রায় অমিতকে বাঁচিয়েও দিয়েছিলেন। যাই হোক অমিতের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিনের জন্য অমিতকে তার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। এখানে থাকলে পড়াশোনা করবে না, ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল মারবে। অগত্যা অমিতের মামার বাড়ি যাত্রা। অমিতের মামার বাড়ি চুঁচুড়া শহরে। তখনকার চুঁচুড়া শহর কিন্তু আজকের মতো ছিল না। অনেক ফাঁকা, লোকজন কম, মানে আজকের গ্রামের থেকে একটু ভালো আর কি। অমিত তো মামার বাড়িতে গিয়ে থাকতে আরম্ভ করলো। গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ। কয়েকমাস কেটেও গেল। অমিতের খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। সে ওখানে গিয়েও দল পাকিয়ে ফেলেছে। বরং অসুবিধা হচ্ছে গ্রামের বন্ধুদের। অমিত নেই, সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনাও ঘটছে না। একদিন সবাই মিলে যুক্তি করে, ‘ও কি করছে দেখে আয় তো’ বলে ছঙ্কুকে পাঠালো অমিতের মামার বাড়ি। ছঙ্কু গিয়ে পৌঁছলো অমিতের মামার বাড়িতে। তাকে দেখে অমিত তো ভীষণ খুশি, বললো, ‘কি রে বাড়িতে বলে এসেছিস তো? আজ কিন্তু তোকে ছাড়ছি না’। ছঙ্কু জানালো যে সে রাতটা ওখানেই কাটিয়ে পরের দিন ফিরবে। অমিত আনন্দে লাফাতে লাফাতে ছঙ্কুকে নিয়ে চললো শহর দেখাতে। ইমামবাড়া, ব্যান্ডেল চার্চ, মহসীন কলেজ, কোর্ট, সব দেখে তারা যখন ফিরলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমিতের দিদিমা একটু রাগারাগি করলেন, ‘ছেলেটা এই প্রথম এলো, তাকে বাড়িতে দুদন্ড বসতে না দিয়ে চোরকি ঘোরা ঘুরিয়ে মারলি’। ছঙ্কু কিন্তু ভারি খুশি, সে গাঁয়ের ছেলে, এসব জিনিস সে আগে দেখেই নি। কিছুক্ষণ পরে রাতের খাবারের ডাক পরলো। খাওয়ার পর শোয়ার পালা। ছঙ্কু দেখলো অমিত দু’টো বালিশ বগলে করে বেড়িয়ে আসছে। ছঙ্কুর হাতে একটা বালিশ দিয়ে বললো, ‘ঘরে খুব গরম বুঝলি, চ একজায়গায় শুতে যাবো।’ আসলে তখন চুঁচুড়া শহরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকলেও সব বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছয়নি। ছঙ্কু চললো অমিতের পিছু পিছু। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা নির্জন জায়গায় এসে পৌঁছলো। ছঙ্কু বুঝতে পারলো সেটা গঙ্গার ধার। একটা পোড়ো মন্দির আর একটা বিরাট বটগাছ। ছঙ্কু বললো, ‘এটা কোথায় এলাম রে দাদা’?(ছঙ্কু, উদ্দিনরা অমিতকে দাদা বলেই ডাকতো।) অমিত বললো, ‘এটা শ্মশানঘাট। শুনে ছঙ্কুর বুক ধড়াস করে উঠলো, ‘শ্মশানঘাটে শুতে হবে’! চারিদিক প্রায় অন্ধকার, একটা বাতিস্তম্ভে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে, তাতে যেন অন্ধকার আরও বেড়ে গেছে, চারিদিকে জনমনিষ্যি নেই, ভয়টা যেন ছঙ্কুকে আস্তে আস্তে চেপে ধরতে লাগলো। অমিত বললো, ‘তুই মন্দিরের রোয়াকটায় শুয়ে পর আমি গাছতলার বেদিটায় শুচ্ছি। বলেই অমিত বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লো। ছঙ্কুও শুলো, কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। একবার পেঁচা ডাকে তো চমকে ওঠে, একবার হাওয়ায় বটগাছের ডালে মড়মড় আওয়াজ হয় তো চমকে ওঠে। তারই মধ্যে কখন একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছে হঠাৎ তার মনে হলো কেউ যেন ভিজে কাপড়ে তার পাশ দিয়ে ছপ ছপ করে হেঁটে চলে গেল। ছঙ্কু ধড়মড় করে উঠে বসলো। অমিত বললো, ‘কি হলো রে’? ছঙ্কু বললো, ‘কে ছপ ছপ করে হেঁটে গেলো’? অমিত উত্তর দিলো, ‘ও কিছু নয় গঙ্গার ঢেউ এসে ঘাটে ধাক্কা মারছে তাই ওরকম আওয়াজ হচ্ছে, শুয়ে পর’। ছঙ্কুর সারারাত প্রায় ঘুম হলোই না। ওদিকে অমিত অঘোরে ঘুমোচ্ছে, এদিকে নানা রকমের আওয়াজে তার বুক ধড়ফড় করে উঠছে। মাঝরাতে একদল লোক একটা মড়া নিয়ে শবদাহ করতে এলো। তারই মধ্যে কখন বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পরেছিলো ছঙ্কু, ঘুম ভাঙ্গলো অমিতের ডাকে। গঙ্গার জলে ভোরের সূর্যের রক্তিম আভায় ছঙ্কু মুগ্ধ হয়ে গেল। সেদিন সকালেই সে বাড়ি ফিরে এলো, আর সন্ধ্যেবেলা প্রায়দিনের মতো অমিতের বাবা এলেন ছঙ্কুদের বাড়িতে। ছঙ্কুকে বললেন, ‘কি রে তুই নাকি অমিতের ওখানে গিয়েছিলি, তা কি বললো ও’? ছঙ্কুর মুখে সব কথা শুনে অমিতের বাবার তো চোখ কপালে, ‘কি, রাতে শ্মশানে শুতে যায়’! মনে মনে ভাবলেন ভুলটা তাঁরই, অমিতকে তিনিই বাগে আনতে পারেন না, অমিতের দাদু দিদিমা কি করে পারবেন? পরের দিনই তিনি গিয়ে অমিতকে নিয়ে চলে এলেন। অমিতের হলো মহা ফুর্তি। আবার গ্রামের বন্ধুরা, আবার সেই হৈ হল্লা। দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল, আর শীত পড়তেই গ্রামে শুরু হলো ছিঁচকে চুরি। লোকের এঁটো বাসন থেকে ভাঙা বালতি, কিছুই বাদ দেয়না চোর। গ্রামের লোক অতিষ্ঠ। অমিতরা রাত পাহারা শুরু করলো। একরাতে প্রবল ঠান্ডা পরেছে। অমিতরা পাহারা দিতে দিতে হঠাৎ দেখলো বিজে ঘোসের বাড়ির পাঁচিলের পাশ থেকে একটা লোক বেড়িয়েই আবার লুকিয়ে পড়লো। যেন তাদের দেখেই লুকিয়ে পড়লো। অমিতরা আস্তে আস্তে গিয়ে যেই লোকটাকে ধরেছে, লোকটা বলে উঠলো, ‘আমি চুরি করিনি’। ব্যাস আর যায় কোথায়? সবাই তো এই মারতে যায় সেই মারতে যায়। ‘চুরি করনি মানে, আমরা বলেছি তুমি চুরি করেছো? আমাদের দেখে লুকোলে কেন? বাড়ি কোথায়? কার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিলে’? আরও হাজার প্রশ্ন। লোকটা কিছুই বলেনা, খালি ‘আমি চুরি করিনি’। সবাই মারতে যায় আর অমিত সবাইকে আটকায়। শেষে ছকু বললো, ‘ঠিক আছে মারবো না, আমি ওর অন্য ব্যবস্থা করছি’। এই বলে ছকু লোকটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেললো সামনের পুকুরের জলে। ওই প্রবল ঠান্ডায় জলে পরেই লোকটা হিহি করে কাঁপতে লাগলো। ছকু আর উদ্দিন মিলে লোকটাকে একবার ডোবায় আর তোলে,আর বলে, ‘কোথায় চুরি করেছিস বল’? লোকটা কিছুই বলে না খালি কাঁপতে থাকে। অমিতের খুব খারাপ লাগলো ব্যাপারটা। সে একরকম চেঁচামেচি করেই লোকটাকে জল থেকে টেনে তুললো। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। লোকটার কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান। এইবার ভয় ধরলো সবার মনে। ঠান্ডায় মরে গেল নাকি লোকটা! অমিত বললো, ‘এক মুহুর্ত দেরি করিস না, এক্ষুনি বাবার কাছে নিয়ে চল’। সবাই মিলে লোকটাকে কাঁধে তুলে ছুটলো অমিতদের বাড়ি। বাড়ির রোয়াকে লোকটাকে শুইয়ে অমিত তার বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে এলো। তিনি সব শুনে, তাঁর ডাক্তারি চোখে দেখেই বুঝলেন লোকটার অবস্থা ভালো নয়, বললেন, ‘একে এক্ষুণি গরম করতে হবে নাহলে বাঁচাতে পারবে না, সবকটা খুনের দায়ে জেলে যাবে’। অমিতদের তো আক্কেল গুড়ুম, চোরকে গরম করবো কি করে? বুদ্ধিটা অমিতের মাথাতেই এলো। বাড়ি থেকে এক বোঝা খরের কুঁটি নিয়ে এসে তাতে আগুন ধরিয়ে তার উপর দুলিয়ে দুলিয়ে চোর সেঁকা চলতে লাগলো। একবার অমিত হাতদুটো ধরে তো উদ্দিন পাদুটো, আবার ছঙ্কু পা ধরে তো ছকু হাত। যেন চিকেন তন্দুরির মতো চোর তন্দুরি। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর চোখ মেললেন চোরবাবু, আর চোখ খুলেই তিনি বললেন, ‘আমি একটা বিড়ি খাবো’। তারপর স্বীকার করলো ঘোসেদের বাড়ি থেকে কাঁসার বাসন চুরি করে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। সবাই বললো ওকে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। অমিতের বাবা ধমক দিয়ে বললেন, ‘সবাই জেলের ঘানি টানা থেকে বেঁচে গেছ, ওকে পাঁচটা টাকা দিয়ে বিদেয় করো’।
-
গল্প- মৎসশিকার
মৎসশিকার
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়নাটকের পাশাপাশি অমিতের আর একটা নেশাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো, সেটা হলো মাছধরা। আর সেই মাছ ধরতে গিয়েই দু’বার দু’টো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটলো অমিতের জীবনে। উদ্দিনদের পাড়ার সাত্তার চাচার মৎস্য শিকারী হিসাবে খুব নাম ডাক ছিল। অমিত তারই সঙ্গ নিলো। ছিপ কেনা হলো, হুইল কেনা হলো, সুতো কেনা হলো, বঁড়শি কেনা হলো, আর তার সঙ্গে তৈরী হলো বিভিন্ন রকমের চারের সরঞ্জাম। মাছ ধরার জায়গার অভাব নেই। তখনকার গাঁ গঞ্জের সব পুকুরই মাছে ভর্তি। আর মাছ মানে যে সে মাছ নয় তিন চার কিলো থেকে চোদ্দো পনেরো কিলো রুই কাতলা। সে সব মাছ ধরতেও মজা খেতেও মজা। মাছধরা চলতে লাগলো আর অমিতও আস্তে আস্তে পাকা মেছুরে হয়ে উঠলো। আশপাশের দু’ একটা গ্রামে অমিতের একটু আধটু নামও ছড়িয়ে পড়লো পাকা মেছুরে হিসাবে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একদিন অমিতের বাবার পাশের গ্রামের এক বন্ধু গোস্বামী বাবু অমিতদের বাড়িতে এসে হাজির। তিনি অমিতকে দেখে বললেন, ‘কি রে ব্যাটা, শুনলাম তুই নাকি খুব মেছুরে হয়ছিস, তবে যা আমার বালির খাদে মাছ ধরে আয় দেখি তাহলে বুঝবো তোর মাছ ধরার দৌড়’। তোমরা হয়তো জানো না, আমাদের এদিকে মাটির নিচে প্রচুর বালি পাওয়া যায়। তাই আগে ব্যবসাদাররা জায়গায় জায়গায় বড়ো বড়ো পুকুরের মতো কেটে তার থেকে বালি তুলে বিক্রি করতো ইমারতি কাজের জন্য। সেই সব খাদ যেমন বড়ো তেমনি গভীর। এখন অবশ্য খাদ থেকে বালি তোলা বন্ধ হয়ে গেছে। যাইহোক অমিতের তো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। সাত্তার চাচা অনেক দিন ধরেই বলছে, ‘গোস্বামী বাবু তো তোর বাবার বন্ধু, তাঁকে বলে তাঁর খাদে একদিন মাছ ধরার ব্যবস্থা কর দেখি, ওনার খাদে চোদ্দো পনেরো কিলো কাতলা আছে। একটা লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে’। তো আজ মেঘ না চাইতেই জল। সেই খাদেই মাছ ধরার আমন্ত্রণ! গোস্বামী বাবু একটা চিরকুট লিখে দিয়ে বললেন, ‘এটা পাহারাদারকে দেখিও, তাহলেই সে তোমাকে মাছ ধরতে দেবে’। চিরকুট হাতে অমিত তো লাফাতে লাফাতে চললো সাত্তার চাচার বাড়ী। সাত্তার চাচা সব শুনে বললো, ‘হুঁ ব্যাপারটা সহজ নয়। ওই খাদে যা মাছ, একবার যদি ছিপে লাগে, তাকে ডাঙায় তুলতে আচ্ছা আচ্ছা মেছুরের ও কপালে ঘাম ফুটে যাবে, তাই ওই খাদে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে ঠিকঠাক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। সরঞ্জাম মানে সুতো, বঁড়শি। তিন কিলো মাছের সুতো বঁড়শিতে তো আর পনেরো কিলো মাছ উঠবে না। মাছের টানে সুতো ছিঁড়ে যাবে, বঁড়শি সোজা হয়ে যাবে। একে একে সব সরঞ্জাম জোগাড় করে অবশেষে একদিন অমিত আর সাত্তার চাচা চললো গোস্বামী বাবুর খাদে মৎসশিকার করতে, আর তাদের সঙ্গ নিলো আরেকজন, উদ্দিন। আগেই বলেছি বালির খাদগুলো হতো খুব গভীর। গ্রীষ্মকালে খাদের জল পাড় থেকে পনেরো কুড়ি ফুট নিচে নেমে যেত। তাই মাছ ধরতে গেলে, শ্রমিক ওঠানামার জন্য যে পাড়টা ঢালু করে কাটা হতো সেই পাড় দিয়ে নেমে গিয়ে জলের কাছাকাছি বসতে হতো। তার মানে কেউ যখন খাদে মাছ ধরতে বসতো, খাদের পাড় থাকতো মেছুরের মাথার পনেরো ফুট ওপরে। যাক, অমিতরা জায়গায় পৌঁছে চার টার করে পরিপাটি করে বসলো মাছ ধরতে। সারাদিনের ব্যাপার। বাড়ি থেকে সবাই ভাত খেয়ে গেছে, আর উদ্দিন, সিমুই বানিয়ে নিয়ে গেছে দুপুরে খাওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে সকালটা গড়িয়ে গেল। মাছ যে ওঠেনি তা নয়, দু তিন কিলো ওজনের রুই মৃগেল। তবে যার জন্য আসা, সেই চোদ্দো পনেরো কিলোর কাতলার দেখা নেই তখনও। সাত্তার চাচার কথা অনুযায়ী, ওই সব কাতলা আসবে বিকেলের দিকে। যেন বিকেলের হাওয়া খেতে বেড়িয়ে সাত্তার চাচার টোপ গিলবে। অমিত আর উদ্দিন তো অসীম ধৈর্য নিয়ে বসে আছে, এই বুঝি ফাতনা ডুব মারলো। এদিকে তারা খেয়ালই করেনি কখন আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে। হঠাৎই অমিত সেটা খেয়াল করে সাত্তার চাচাকে বললো, ‘চাচা আকাশ দেখেছো? এক্ষুনি তো তুমুল বৃষ্টি নামবে গো’। উত্তরে সাত্তার চাচা বললো, ‘তবেই তো জমবে মজাটা, বড়ো বড়ো মাছ তো বৃষ্টির মধ্যেই টোপ ধরে’। সাত্তার চাচার কথা শেষ হতে না হতেই নামলো তুমুল বৃষ্টি। মুহুর্তের মধ্যে তিনজনে ভিজে চান করে গেল। মাছ ধরা মাথায় উঠলো অমিত আর উদ্দিন তখন জিনিসপত্র সামলাতেই ব্যস্ত। সাত্তার চাচার কিন্তু কোন হেলদোল নেই। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফাতনার দিকে। অমিত তাড়া লাগিয়ে বললো, ‘চাচা ছিপ গোটাও, না হলে এরপর ওই ঢালু পাড় দিয়ে ওঠা যাবে না’। চাচা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ওই জন্যই তোদের মতো চ্যাংড়া ছেলেদের নিয়ে মাছ ধরতে যেতে নেই, এইটুকু বৃষ্টিতেই ভয় পেয়ে গেল’। অবশ্য সাত্তার চাচার বীরত্ব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বৃষ্টির বেগ ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো, সাত্তার চাচা প্রমাদ গুনলো। ছিপের সুতো গুটোতে গুটোতে অমিতদের বললো, ‘নাঃ, আর বসে থাকাটা ঠিক হবেনা বুঝলি, তোরা মালপত্রগুলো পাড়ে তোল আমি আসছি’ অমিত আর উদ্দিন ওই বৃষ্টির মধ্যে মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো যাহোক করে টেনে তুললো খাদের পাড়ে। তারপর আনতে গেল সাত্তার চাচাকে। আর ঠিক তখনই শুরু হলো আসল বিরম্বনা। খাদের ঢালু পাড়ের এঁটেল মাটি বৃষ্টির জলে তেল পড়ার মতো পিছল হয়ে আছে। ভারী চেহারার সাত্তার চাচা একহাত ওঠে তো হড়কে দু’হাত নেমে যায়। এদিকে সেই ঢাল দিয়ে নদীর মতো জল নামছে খাদের মধ্যে। একে পিছল তার উপর সেই জলের স্রোত সাত্তার চাচাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খাদের দিকে। একবার খাদের জলে পড়লেই একশো দেড়শো ফুট গভীর। সাত্তার চাচা সাঁতার জানে, কিন্তু একে বয়স হয়েছে তার উপর ওঠানামার লড়াইএ দম শেষ। একবার খাদে পড়ে গেলে তলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। অমিত আর উদ্দিন দুজনে মিলেও টেনে তুলতে পারছে না সাত্তার চাচাকে। অবশেষে বুদ্ধি লাগালো উদ্দিন। তিনজনের মাছধরা জালের তিনটে লাঠি পরপর পুঁতে দিলো সেই ঢালে, আর তার সঙ্গে বেঁধে দিলো তিনটে মাছ রাখার জাল। সাত্তার চাচাকে বললো সেই জাল গুলো ধরে ওঠার চেষ্টা করতে আর তারা দুজনে চাচাকে পিছন থেকে ঠেলতে লাগলো। চাচার হলো মহা মুশকিল, চিরকাল লুঙ্গি ছাড়া কিছু পড়া অভ্যাস নেই। একে দম শেষ, তার উপর জাল ধরে ওঠার চেষ্টা করে তো লুঙ্গি খুলে যায় আবার লুঙ্গি ধরে তো হাত থেকে জাল ছেড়ে যায়। চাচার তখন পরিত্রাহি অবস্থা। মাছ ধরার বীরত্ব সব শেষ, মুখে শুধু আল্লা, আল্লা ছাড়া আর কোন কথা নেই। যাই হোক অনেক পরিশ্রমের পর অবশেষে অমিত আর উদ্দিন সাত্তার চাচাকে টেনে তুললো খাদের পাড়ে। চাচা পাড়ে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘বাপেরা, আজ তোরা ছিলি বলে আমার জান বাঁচলো’। তারপর বৃষ্টি ছাড়লে সেদিনকার মতো তারা বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু ওই কথায় বলে না ‘মাতালের মন শুঁড়িখানায়’। দু’দিন যেতে না যেতেই সেই ভয়াবহ ঘটনা সাত্তার চাচার মন থেকে একরকম মুছেই গেল, বরং তার মনে বারবার ঘাই মারতে লাগলো গোস্বামী বাবুর খাদের পনেরো কিলো কাতলা। সে আবার অমিতকে ধরলো গোস্বামী বাবুর থেকে চিরকুট লিখিয়ে আনার জন্য। অমিতের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কি আর করে, সাত্তার চাচার তাড়ায় একদিন গোস্বামী বাবুর বাড়ি গিয়ে আবার একটা চিরকুট লিখিয়ে নিয়ে এলো। আবার একদিন দুজনে চললো সেই একই খাদে মাছ ধরতে। এবার অবশ্য অমিত সাত্তার চাচার কাছে কথা আদায় করেছে যে বৃষ্টি শুরু হলেই তারা উঠে আসবে। চাচা কথা দেওয়ার পর বলেছে, ‘কুছ পরোয়া নেহি, এবার এমন ব্যবস্থা করবো যে কোন সমস্যাই হবে না’। ব্যবস্থাটা হলো, সাত্তার চাচা সঙ্গে করে একজন লোক নিয়ে গেছে। সে গিয়ে কোদাল দিয়ে ওই ঢালটার ওপর সিঁড়ির মতো ধাপ কেটে দিয়েছে, আর একটা বড়ো দড়ি পাড়ের ওপরে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে সেই সিঁড়ির পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ব্যাস সব ব্যবস্থা করে সাত্তার চাচা মনোনিবেশ করলো সেই পনেরো কিলো কাতলার প্রতি। অমিতের কিন্তু মাছ ধরায় আজ ঠিক মন নেই। বারবার মনটা উসখুস করছে, যেন বসে থাকতেই ইচ্ছা করছে না। সেদিন কিন্তু একেবারেই মাছ ধরা হলো না। সকল থেকে একটা চুনোপুটিও টোপ ধরলো না। আর ঠিক দুপুর হতেই শুরু হলো সেই তুমুল বৃষ্টি। সেদিন বৃষ্টির রূপ যেন আরও ভয়ঙ্কর। অমিত জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলে তাড়া লাগালো সাত্তার চাচাকে। আজ আবার উদ্দিনও নেই। আগের দিনের মতো অবস্থা হলে অমিত একা কিছুই করতে পারবে না। সাত্তার চাচার ওঠার নাম নেই। তার মাথায় তখন জেদ চেপে গেছে। অমিতের হঠাৎই ভীষণ ভয় করতে লাগলো। সে সাত্তার চাচার হাত থেকে ছিপটা কেড়ে নিয়ে একরকম তার হাত ধরে টানতে টানতে উঠিয়ে নিয়ে এলো মাছ ধরার জায়গা থেকে। অমিত চাচাকে নিয়ে দশ পা গেছে কি যায়নি হঠাৎই খাদের পাড়ের একটা বিরাট অংশ ধস নামার মতো হুড়মুড় করে নেমে এসে অমিতদের বসার জায়গাটার ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো খাদের জলে, আর তার ধাক্কায় খাদের জলটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দু’পাড়ে আছড়ে পরতে লাগলো। আর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে সাত্তার চাচা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো। তারপর অমিত ওই বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে গ্রামের লোকজন ডেকে এনে সাত্তার চাচাকে উদ্ধার করেছিল সেটা আর নাই বললাম। মানুষের জীবনে মাঝেমাঝে এমন কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। সেদিন যদি অমিতদের উঠতে আর এক মিনিট দেরি হতো তাহলে হয়তো আজ আমার সুযোগ হতো না তাকে নিয়ে গল্প লেখার।
-
গল্প- শবযাত্রী
শবযাত্রী
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়সে বছর শীতকালে হঠাৎ আমাদের গ্রামে বৃষ্টি শুরু হলো। সালটা বোধহয় উনিশশো উনষাট কি ষাট হবে। অমিতদের ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’ এর আড্ডা ঠিক মতো জমেছে না। তিন চার দিন টানা বৃষ্টিতে সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। একে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, চারিদিক অন্ধকার তার উপর গ্রামের রাস্তায় এক হাঁটু কাদা, হাঁটাচলা করাই দায়, সেই সঙ্গে প্রবল ঠান্ডা। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎই এক দুপুরে সিধু বোসের বাবা মারা গেলেন। সিধু বোস পড়ল মহা বিপাকে। এই শীতের বৃষ্টির মধ্যে কাকে পাবে শ্মশানযাত্রী হিসাবে। এক আধ জনের কাজ নয়, অন্তত আট দশ না হলে চলবে কি করে! আমাদের গ্রাম থেকে শ্মশান প্রায় পাঁচ মাইল পথ। সেই পথ শবদেহ কাঁধে নিয়ে হেঁটে শ্মশানে পৌঁছতে হতো। তার উপর তখনকার শ্মশান। না ছিল বৈদ্যুতিক চুল্লি না আলো। অন্ধকারে হ্যারিকেনের আলোয় কাঠের চিতা সাজিয়ে শবদাহ করা হতো। শুধু তাই নয় কাঠে শবদাহ করাও সহজ কাজ নয়, রীতিমত উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন। আট দশ জনের কমে হয় না। সিধু বোসের প্রতিবেশী যারা এলেন, বেশিরভাগই সহানুভূতি জানিয়ে চলে গেলেন। যে দুএকজন শ্মশানে যাওয়ার জন্য গামছা কাঁধে করে এলেন তাঁরা সকলেই পঞ্চাশোর্ধ। সিধু বোস পড়ল মহা চিন্তায়। ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’ এর ছেলেদের খবর দিলে হয়, কিন্তু সিধু বোসের ধুতির কাছায় ইঁদুর বেঁধে দেওয়ার পর থেকে ওই ছেলেগুলোর থেকে সে শতহস্ত দূরে থাকে। মনে মনে রাগও কম নয়। কিন্তু কি বা করা যায় ওই দূর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। আবার এদিকেও চিন্তা বাড়ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সেরকম দু’চারজন পাওয়াও গেল না, যাদের নিয়ে শবযাত্রা করা যায়। অগত্যা স্ত্রীর পরামর্শে সিধু বোস চললো ছঙ্কুর বাড়ি। ছঙ্কুর বাড়িটা তার পাড়াতেই। ছঙ্কুকে ডেকে পরিস্থিতির কথা বলতে ছঙ্কু বললো, ‘কোন চিন্তা করো না আমরা আসছি’। সিধু বোস বাড়ি ফিরে এলো, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলো জনা পনেরো ছেলে। দেখে তো সিধু বোসের চক্ষু চড়কগাছ। এদিকে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। তাই আর দেরি না করে চটপট বাঁশের চালি বেঁধে, তার উপর সিধু বোসের বাবার শবদেহ তুলে ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে ছেলেরা ছুটলো শ্মশানের দিকে, আর তাদের পিছনে ছাতা মাথায় হাঁপাতে হাঁপাতে চললো সিধু বোস আর তার দু’একজন বন্ধু। প্রবল ঠান্ডা, তেমনি তুমুল বৃষ্টি, একহাত দূরে লোক দেখা যায় না, আর তার সঙ্গে কাদায় পথ এতো পিছল যে হাঁটা তো দূরের কথা যেন দাঁড়িয়ে থাকাই যায় না। তার মধ্যেই ছেলেরা ছুটছে আর সিধু বোস পেছলাতে পেছলাতে হাঁক পারছে, ‘আস্তে চ বাবারা আস্তে চ’। ছেলেরা এক ঘন্টার মধ্যে শ্মশানে পৌঁছে শবদাহের তোরজোড় শুরু করে দিল, সিধু বোস এসে পৌঁছল আরও আধঘন্টা পরে। ততক্ষণে রাত আটটা সাড়ে আটটা বেজে গেছে। ছেলেরা নিজেদের পয়সায় একটু চা বিস্কুট খেয়ে কাজে লেগে পড়েছে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। তাড়াতাড়ি চিতাটা জ্বেলে ফেলতে হবে। বৃষ্টি আবার বেড়ে গেলে চিতা জ্বলতে চাইবে না তখন শবদাহ করতে মহা ঝামেলায় পড়তে হবে। সব কাজ মিটতে মোটামুটি তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। তার মানে বাড়ি ফিরতে রাত একটা দেড়টা। অমিত ছঙ্কুকে বললো, ‘যা সিধু বোসকে হোটেলে গিয়ে রাতের খাবারের অর্ডারটা দিয়ে আসতে বল’। হোটেল মানে, খড়ের চালা মাটির ঘর। তারই এককোনে চৌকির উপর গামলায় মিষ্টি রাখা, আর একপাশে কটা বেঞ্চ পাতা, আর ঘরের পিছনে রান্নার জায়গা। আসলে তখন দূর দূর গ্রাম থেকে লোকেরা হেঁটে শ্মশানে আসতো, যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। তাই মৃতের বাড়ির লোকেরা শবযাত্রীদের দুপুর বা রাতের খাবার খাইয়ে দিত। এটাই রেওয়াজ ছিল। আর তার জন্য শ্মশান ঘাটের পাশে তৈরী হয়েছিল ঘুপচি ঘুপচি কটা হোটেল। শ্মশানে পৌঁছে তাদের বলে দিতে হতো, ক’জন খাবে, কি খাবে। তারা সেই মতো সময়ের মধ্যে খাবার তৈরি করে রাখতো। তো অমিতের কথা মতো ছঙ্কু গিয়ে সিধু বোসকে খাবার কথা বলাতে সিধু বোস তো হাঁ হাঁ করে উঠলো, ‘খাবার! খাবার কি হবে? এই তো সবে আটটা, তাড়াতাড়ি কাজ মেটাও, বাড়ি ফিরে খাবে। আর খিদে পেলে দুটো করে বিস্কুট খাও’। আসলে সিধু বোস ছিল হাড় কৃপণ। তার তখন মাথা ফাটছে, বাবার শ্রাদ্ধে ক’পয়সা খরচা হবে। তার মধ্যে আবার এদের খাবার বায়না, ইয়ার্কি নাকি? সিধু বোসের কাছে তাড়া খেয়ে ছঙ্কু গিয়ে দাঁড়ালো অমিতের কাছে। অমিত মুখ ভার করে বললো, ‘খাওয়াবে না বলছে? তাহলে যে কাজের জন্য ডেকেছিল সেটাও হবে না’। ছঙ্কু বললো, ‘হবে না কি? হয়ে তো গেছে। মড়া তো পৌঁছে গেছে শ্মশান ঘাটে। এবার ডোমকে হাতে পায়ে ধরে দু’চার পয়সায় ম্যানেজ করে নেবে’। অমিত বললো, ‘করাচ্ছি ম্যানেজ। মড়া পেলে তবে তো ডোম পোড়াবে’? ছঙ্কু অবাক, অমিত কি বলছে! অমিত বললো, ‘ডাক সবাইকে, মড়া যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফেরত যাবে’। যেমন বলা তেমনি কাজ। সিধু বোস শ্মশানে ঢোকার মুখে বসে তখন সবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে, আর মনে মনে ভাবছে বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কোন কোন লোকগুলোকে বাদ দেওয়া যায়। হঠাৎ সে দেখলো একদল ছেলে একটা মড়া কাঁধে করে হরিবোল দিতে দিতে শ্মশান থেকে উল্টো পথে ফিরে যাচ্ছে। প্রথমটা সে খেয়াল করেনি। তারপর হুঁশ ফিরতে সে বুঝতে পারলো, আরে এতো অমিতদের দলের ছেলেরা, তার বাবাকে নিয়েই ফেরত যাচ্ছে। আর যায় কোথায়, সে ও ছুটলো অমিতদের পিছনে। কিন্তু ততক্ষণে অমিতরা বিশ তিরিশ হাত এগিয়ে গেছে। সিধু বোসের চেহারা ভালো ছিল, মানে এককথায় মোটাসোটা। ছেলেরা হরিবোল দিতে দিতে মড়া নিয়ে ফেরত যাচ্ছে, তাদের পিছনে থপথপ করতে করতে ছুটছে সিধু বোস। এদিকে আশপাশের দোকান থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। সবাইকার প্রশ্ন, ‘ও ভাই কি হলো, মড়া ফেরত নিয়ে যাচ্ছ কেন, বেঁচে উঠলো নাকি?’ সিধু বোস অতিকষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ধরলো অমিতদের, ‘ও বাবারা কি হলো? মড়া ফেরত নিয়ে যেতে নেই বাবারা, বুড়ো মানুষ ভুল করে ফেলেছি বাবারা, যা খেতে চাইবি তাই খাওয়াবো, ফিরে চল বাবারা ফিরে চল,’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে অনেক আকুতি মিনতির পর অমিতরা আবার চললো শ্মশানের দিকে। খাবার অর্ডারও দেওয়া হলো। অনেক ঝামেলার পর কাজ মিটতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেল। অমিতদের পেটে তখন ছুঁচোর কেত্তন চলছে। সেই দুপুরে খেয়ে বেরিয়েছে, আর সেই সন্ধ্যা বেলা দুটো করে বিস্কুট। তারা গিয়ে হোটেলে খেতে বসলো। ওইসব হোটেলে তখন পেট ফুরোন খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল, মানে মিল সিস্টেম। মাছ, মাংস ডিম একবার, বাকি ভাত, ডাল, তরকারি যতখুশি। তার জন্য বেশি পয়সা লাগতো না। তো অমিতরা খিদের জ্বালায় এমন খেলো যে দুটো শবযাত্রী দলের খাবার শেষ। খাওয়ার পর অমিত যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছে, হোটেলের মালিক বললেন, ‘বাবা তোমরা কোথা থেকে আসছো?’ অমিত গ্রামের নাম বলাতে তিনি বললেন, ‘বাবা পরের বার যখন আসবে আমার একটা উপকার করো, শ্মশানে ঢোকার আগে একবার মুখটা দেখিয়ে যেও বাবা।’ অমিত জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন বলুন তো, কোন স্পেশাল মেনু করবেন নাকি?’
‘না বাবা, দোকানের ঝাঁপটা বন্ধ করে পালাবো।’ -
গল্প- নাটকের ঝামেলা
নাটকের ঝামেলা
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়অমিতদের ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর তখন রমরমা বাজার। গোটা গ্রামের দায়িত্ব মোটামুটিভাবে তারাই কাঁধে তুলে নিয়েছে। রাত পাহারা থেকে মড়া পোড়ানো, মানুষের বিপদ আপদ থেকে বিয়ে বাড়ির পরিবেশন। যেখানেই লোকের দরকার সেখানেই ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’। তার মধ্যে অবশ্য বরকতের ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ একই ভাবে বেজে চলেছে। তার সঙ্গে চলেছে অমিতদের নাটকের রিহার্সাল, আর নাটকের জন্য চাঁদা তোলা। এবারের নাটক ‘কানাগলি’। (নাটকটা অবশ্য অন্য নামে হতো)। নাটকটা আমাদের গ্রামের বহু পুরোনো সংস্কৃতি। তবে আজকের দিনের সঙ্গে তখনকার নাটকে একটু তফাৎ ছিল। তখনকার নাটকে বৈদ্যুতিক আলোর বদলে পাম্প দেওয়া হ্যাজাকের মতো আলো ব্যবহার করা হতো, তার নাম ছিল ডে লাইট, আর মহিলা চরিত্রগুলোতে গ্রামের ছেলেরাই অভিনয় করতো। অবাক হলে, না? না না অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই সত্যি। আমাদের গ্রামে এমন অনেক ছেলে ছিল যারা মহিলা চরিত্রে অভিনয় করে খুব নাম করেছিল। যেমন ধরো মুখুজ্যে বাড়ির অন্তু, চন্দ্রগুপ্ত নাটকে সেলুকাসের মেয়ে হেলেনের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য শুধু অন্তু কেন, এরকম আরও অনেকেই ছিল, যারা নাটকে মেয়ে সাজলে দর্শক হাঁ করে তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতো। যাই হোক, নাটক আর এসে গেছে চাঁদা তোলাও চলছে জোর কদমে। সে বছর ছেলেদের মধ্যে নাটক নিয়ে একটা বিশেষ উদ্দীপনা রয়েছে। তার দু’টো কারণ ছিল। প্রথমত, সে বছর প্রথম ডে লাইটের পরিবর্তে জেনারেটরের বৈদ্যুতিক আলোয় নাটক হবে, আর দ্বিতীয় ও প্রধান কারণটি হলো গ্রামের নাটকে সেই প্রথম বাইরে থেকে পেশাদারী অভিনেত্রী আসছেন মহিলা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। ছেলেরা ব্যাপারটা জানাজানি হতে দেয়নি। তারা চেয়েছিল নাটক দেখতে এসে সবাই বিষয়টা জানুক। কেননা তাদের মনে সন্দেহ ছিল যে ঘটনাটা গ্রামের লোকজন কি ভাবে নেবে। (কেননা তখনকার দিনে অনেক মানুষের ধারণা ছিল, যে সব মেয়েরা নাটক করে তারা সব লাল বাতি এলাকার মেয়ে)। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। নাটকের দিন পনেরো আগে পেশাদারী অভিনেত্রীর ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। গ্রামের মধ্যে প্রথমে ফিসফিস, গুনগুন, তারপরে ঝড় শুরু হলো। প্রথম প্রকাশ পেল সিধু বোসের কথায়। একদিন সন্ধ্যাবেলা উদ্দিন আর গোপাল এসে জানালো যে সিধু বোস নাটকের চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছে। তার বক্তব্য, ‘তোমরা মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তি করবে, আর আমরা চাঁদা দেব? এক পয়সাও দেব না’। ব্যাস আর যায় কোথায়? ছেলেদের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। অমিতদের দলে সবচেয়ে বিচ্ছু ছিল টিলু। সে বললো, ‘দাঁড়া, ওর মজা আমি দেখাচ্ছি’। সিধু বোস রোজ সন্ধ্যাবেলায় ষষ্ঠীতলার রোয়াকে বসে তাস খেলে। ঘটনার ঠিক দু’দিন বাদে টিলু তার খেলাটা খেলে দিলো। সেদিন সন্ধ্যাবেলা সিধু বোস যখন মশগুল হয়ে তাস খেলতে ব্যস্ত, টিলু তার পিছন দিকে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে তার ধুতির কাছায় একটি মড়া, পচা ইঁদুর বেঁধে দিয়ে চলে এলো। লম্পর আলোয় তাস খেলা, চারিদিকে অন্ধকার, তাসুরেদের মধ্যে কেউ খেয়ালই করলো না টিলুর কীর্তি। সিধু বোস যতক্ষণ তাসে মশগুল ছিল ততক্ষণ কিছু বুঝতে পারলো না। ঘটনাটা ঘটলো তার বাড়ি ফেরার পরে। কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসার ফলে পচা ইঁদুর নাড়াচাড়া পেয়ে তার সুগন্ধ ছড়াতে আরম্ভ করলো। সিধু বোস এসে যেই ঘরে ঢুকলো, তার বৌ রে রে করে উঠলো, ‘ইস্, কিছু মাড়িয়ে এসেছে না কি গো? কি পচা গন্ধ’! সিধু বোস অস্বীকার করে বললো, ‘আমি মাড়াতে যাবো কেন? নিশ্চয়ই ঘরে ইঁদুর পচেছে, দাঁড়াও বড়ো আলোটা নিয়ে আসি’। এই বলে সে যেই পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো, ওমনি সেখানে তার ছেলে মেয়েরা হৈচৈ করে উঠলো, পচা ইঁদুরের গন্ধে। সিধু বোস তো অবাক, ‘বাবা, সব ঘরেই ইঁদুর পচেছে নাকি’! সে তার ছেলে মেয়ে বৌ সবাই মিলে সারাবাড়ি ছুটে বেরাতে লাগল পচা ইঁদুরের সন্ধানে, কেননা গন্ধটা সব ঘর থেকেই বেরোচ্ছে। এইভাবে খোঁজাখুঁজি করতে করতে একবার সিধু বোস হেঁট হয়ে খাটের নিচে উঁকি দিচ্ছে, হঠাৎ তার ছেলে বলে উঠলো, ‘বাবা তোমার কাছায় ওটা কি গো’? ছেলের কথার রেশ ধরে মেয়েরা আর বৌ ও সেটা দেখতে পেয়ে চেঁচাতে লাগলো। আর সেই চিৎকারে সিধু বোস ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করতে করতে, লাফাতে লাফাতে গিয়ে ঝাঁপ মারলো বাড়ির পিছনের পুকুরে। যেন তার কাছায় ইঁদুর নয়, আস্ত একটা কেউটে সাপ বাঁধা আছে। সিধু বোস তো জব্দ হলো, কিন্তু পেশাদারী অভিনেত্রীর ব্যাপারটা গ্রামে মহামারী আকার ধারণ করলো। গ্রামের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ নিজের নিজের বাড়িতে নিদান দিলেন যে ওই নাটক দেখতে যাওয়া যাবে না। খবরটা জানাজানি হতে অনেক অভিনেতার বাড়ি থেকেও নাটকে অভিনয় করা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। অমিতের বাবা অবশ্য আধুনিক মনস্ক মানুষ ছিলেন। শুধু অমিতের মাকে বললেন, ‘গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে যাওয়ার কি দরকার?’ কিন্তু অমিত ছিল জেদী, গ্রামবাসীদের ভয়ে পিছিয়ে আসার ছেলে সে নয়। আর তার পিছনে ছিল টিলু, উদ্দিন, গোপাল, ছঙ্কুরা। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি এমন তৈরি হলো যে নাটকের দিন তাদের উপর আক্রমণ না হয়। অবশেষে নাটকের দিন চলে এলো। কাছেই মফঃস্বল শহর থেকে অমিতের অন্য বন্ধুরা, শৈল, অভয়, রাধিকা, অনিরা এলো অমিতদের সমর্থনে। ঠিক সময়ে নাটক শুরু হলো। দর্শক আসনে তখন জনা কুড়ি লোক। নাটক যত গড়াতে লাগলো আস্তে আস্তে দর্শকও বাড়তে লাগলো। নাটকের শেষে দর্শক আসন ভর্তি এক হাজার লোকে। গ্রামের প্রাচীন পন্থীরা সংস্কৃতির নতুন আলোকে সেদিন ঘরে আটকে রাখতে পারেননি। অমিতদের নাটক গ্রান্ড সাকসেস। আর আমাদের গ্রামে সেই শুরু হলো মহিলা চরিত্রে মেয়েদের অভিনয়, যা আজও অব্যাহত।
-
গল্প- ভেড়া চোর
ভেড়া চোর
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়সালটা উনিশশো সাতান্ন আটান্ন হবে। আজ থেকে মোটামুটি বাষট্টি বছর আগে। অমিতের বয়স তখন আঠেরো বছর। অমিতকে মনে আছে তো? আরে আমাদের গ্রামের সেই অমিত, যে, তার বন্ধু মধুচরণের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে পুরুত বিভ্রাট ঘটিয়েছিল। সময়টা শীতকাল। সে বছর শীতটা পড়ে ছিল জাঁকিয়ে। গ্রামের দিকে শহরের থেকে গরম যেমন কম হয়, শীতটা হয় তেমনি প্রকট। তো সেইরকম এক শীতের সন্ধেবেলা অমিতরা বসে আছে আমাদের গ্রামের দুর্গাদালানে (যেটা আজও আছে)। উদ্দেশ্য আড্ডামারা, তাসখেলা। অবশ্য জায়গাটার একটা নতুন নামকরণ হয়েছে, ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’। নামটা আজগুবি, তবে এ নাম যে কেন হয়েছিল সে খবর অন্তত আমি জানিনা। যাই হোক, ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর সদস্য কিন্তু অনেক। অমিত, গোপাল, টিলু, ছঙ্কু, উদ্দিন, বরকত, শম্ভু, সাধু, মধূ, কেতো, আরও অনেকে। বেশিরভাগই গ্রামের ভালো পরিবারের ছেলে এবং ততোধিক বিচ্ছু। ‘ভবতারিণী আলু আশ্রম’এর ছেলেদের নামে গ্রামের লোকজন অতিষ্ঠ। কার বাগানের আমটা, কার গাছের নারকেলটা, আগে আশ্রমে পূজো না দিয়ে আসলে, পুরো বাগান সাফ। তবু গ্রামের লোক তাদের সহ্য করতো একটাই কারণে, দিন হোক বা রাত, বর্ষা হোক বা শীত বিপদে পড়ে ‘ভবতারিনী আলু আশ্রম’এর একটা ছেলেকে খবর দিতে পারলেই হলো, পুরো দল হাজির। তো যে কথা বলছিলাম, অমিতরা কেউ আড্ডা মারছে, কেউ তাস খেলছে, আর বরকত প্রত্যেক দিনের মতো তার রেকর্ড প্লেয়ারে তার ফেভারিট গান চালিয়ে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে। বরকতের ওই এক খ্যাপামি। রোজ বাড়ি থেকে রেকর্ড প্লেয়ারটা বগলদাবা করে নিয়ে আসবে, সঙ্গে একটাই রেকর্ড, ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়’, আর সন্ধ্যে আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত একটাই গান বাজবে, ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’। গান শুনতে শুনতে বরকত ওখানেই ঘুমিয়ে পড়তো। কেউ ডেকে দিলে বাড়ি ফেরা হতো, না হলে সারারাত ওখানেই কেটে যেত। অন্য কোন গান বাজবে না। কেউ কিছু বললেই তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়ার ভয়ে তাকে কেউ কিছু বলে না, আর এখন ব্যাপারটা বাকিদের কানে সয়ে গেছে। তার মধ্যে অমিত হঠাৎ টিলুকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ব্যাপার বলতো, উদ্দিন এখনও এলো না’! আর সেটা বলতে বলতেই উদ্দিন এসে দাঁড়ালো তার সাইকেল নিয়ে। অমিত বললো, ‘কিরে উদ্দিন এতো দেরি হলো’। উদ্দিন জবাব দিল, ‘আমার আব্বা আজ আবার আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল’। অমিত বললো, ‘অ’।
আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, উদ্দিনদের বাড়িতে এটা প্রায় দিনেরই ঘটনা ছিল। উদ্দিনের আব্বা ছিলেন ‘মাদারবক্স’, গ্রামে তাঁর বেশ প্রতিপত্তি ছিল, আর সেটা তিনি বাড়িতেও ফলাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাই কি হয়? দরবারে যিনি রাজা পরিবারের কাছে তিনি প্রজা। কোনদিন হয়তো মাদারবক্স বেলা বারোটার সময় হাতে একটা মুরগি ঝুলিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে উদ্দিনের মাকে বললেন, ‘মালেকা, এটাকে তেল ঝাল দিয়ে রেঁধে ফেল দেখি’। মালেকা জবাব দিল, ‘রাঁধতে হয় নিজে রাঁধো, পরের গতরে এতকিছু হয়না’।
ব্যাস লেগে গেল ঝগড়া। ঝগড়া করতে করতে উদ্দিনের আব্বা বললো, ‘আমি চললাম রেলে মাথা দিতে’। উদ্দিনের মা উত্তর করলো, ‘যাবার আগে ভাতটা খেয়ে যেও, আমি ভাত আগলে বসে থাকতে পারবো না’। উদ্দিনের আব্বা চুপ। কিছুক্ষণ বাদে স্নান করে এসে ভাতের থালা টেনে খেতে বসে পড়লো। সেদিনও কি নিয়ে লেগেছিল উদ্দিনের মা আর আব্বার মধ্যে। উদ্দিনের আব্বা একটা দড়ি হাতে নিয়ে বললো, ‘আমি চললাম গলায় দড়ি দিতে’। তাতে উদ্দিনের মা বলল, ‘ও দড়িটা পচে গেছে। নতুন গরু বাঁধা দড়িটা নিয়ে যাও, আর ঘরের দরজাটা খুলে রেখো, না হলে ভাঙতে হবে’। আর যায় কোথায় লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। তো সেই সব থামিয়ে আসতে গিয়ে উদ্দিনের সেদিন দেরি হয়ে গেল। উদ্দিন সাইকেল রেখে অমিতের পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, ‘দাদা কালীসাগরের মাঠে ভেড়ার পাল এসেছে’। কালীসাগর হচ্ছে আমাদের গ্রামের একটা পুকুর। তারপরেই চাষের মাঠ। তখন শীতকালে বিশেষ চাষবাস হতো না বলে মেষপালকরা গ্রামের মাঠগুলোতে ভেড়ার পাল নিয়ে চড়াতে আসতো। অমিত বললো, ‘ঠিক আছে কাল যাবো, আর কাউকে বলার দরকার নেই’। পরদিন সকালে অমিত আর উদ্দিন গিয়ে তদন্ত করে এলো। পালে অন্তত দুশো আড়াইশো ভেড়া হবে, আর সঙ্গে লোক দুজন। আজ রাতেই কাজ সারতে হবে। কাজ মানে, ভেড়া চুরি। দুশো আড়াইশো ভেড়া থেকে একটা সরিয়ে নিলে ভেড়ার মালিক বুঝতেই পারবে না, আর সেটা দিয়ে পরের রাতে জমিয়ে পিকনিক হবে। সেই মতো চারজনের দল ঠিক হলো। অমিত, উদ্দিন, টিলু আর ছঙ্কু। ঠিক হলো টিলু, উদ্দিন আর ছঙ্কু ভেড়াওয়ালাদের পাহারা দেবে আর অমিত সেই ফাঁকে ভেড়া চুরি করবে। কথা মতো সেইদিন রাতে চারজনে এসে জড়ো হলো কালীসাগরের পাড়ে। রাত তখন নটা। চারিদিক নিস্তব্ধ। তখনকার গ্রামে, শীতের রাতে নটা মানে মাঝরাত। একে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, চারিদিক অন্ধকার তার উপর ঠান্ডা, সন্ধ্যা হতেই গ্রামের রাস্তায় লোক চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতো। চারজনে গিয়ে উঁকি দিলো ভেড়াওয়ালাদের তাঁবুতে। তারা তখন কাঠের আঁচে রুটি বানাচ্ছে, আর পাশে বাটিতে কিছু তরকারি ঢাকা দেওয়া আছে। অমিত চললো ভেড়া সরাতে, বাকিরা তাঁবুর বাইরে পাহারায় রইলো। কিন্তু অমিত যেই ভেড়ার পালের মধ্যে ঢুকেছে শুরু হলো আসল সমস্যা। ভেড়াগুলো অচেনা লোক দেখে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগলো। ভেড়াওয়ালারা রুটিফুটি ফেলে, ‘ডাকু আয়া, ডাকু আয়া’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে লাঠি হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ব্যাস আর যায় কোথায়, লেগে গেল মারামারি। ছঙ্কু আর উদ্দিন মারপিটে ওস্তাদ। তারা তুমুল বিক্রমে ভেড়াওয়ালা দুটোর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো, কিন্তু টিলু কোথায়? উদ্দিন মারপিট করতে করতেই টিলুর উদ্যেশ্যে গালাগালি দিতে লাগলো। আর হঠাৎই সে দেখতে পেল টিলু তাঁবুর মধ্যে বসে গোগ্রাসে ভেড়াওয়ালাদের বানানো রুটি তরকারি খেয়ে চলেছে। দেখে উদ্দিনের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। এমনসময় সে খেয়াল করলো অমিত ঝোপের আড়াল দিয়ে পালাচ্ছে, আর তার কোলে একটা কিছু রয়েছে। উদ্দিন বুঝলো কাজ হয়ে গেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে ভেড়াওয়ালাগুলোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছঙ্কুর হাত ধরে নিয়ে ছুটলো অমিতের পিছনে। অমিতের গিয়ে গ্রামের কালীমন্দিরের সামনে অপেক্ষা করার কথা, তো তারাও ছুটলো কালীমন্দিরের দিকে। পথেই পেয়ে গেল টিলুকে। তাকে খুব গালাগালি দেওয়াতে সে বললো, ‘কি করবো, তাঁবুতে ঢুকে দেখি ব্যাটারা রুটি মাংস করে রেখেছে, লোভ সামলাতে পারলাম না ভাই। একটু পরেই তারা এসে পৌঁছল কালীমন্দিরের সামনে, আর সেখানে গিয়ে যেটা দেখলো, সেটা দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। অমিত দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কোলে একটা সুন্দর ছোট্ট সাদা রঙের ভেড়ার বাচ্চা। উদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো, ‘এটা কি রে! বড়ো ভেড়া কই’? অমিত লাজুক মুখে উত্তর দিলো, ‘বড়ো ভেড়া আনিনি। এটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমি এটাকে পুষবো’। তিনজনে রে রে করে উঠলো। বিশেষ করে উদ্দিন আর ছঙ্কু, কেননা লাঠির বাড়ি তারাই খেয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে? আর তো কিছু করার নেই। অগত্যা তারা গাঁইগুঁই করতে করতে বাড়ি চলে গেলো, আর অমিত বাড়ি চললো ভেড়ার বাচ্চাটাকে নিয়ে। অমিত বাড়ি ফিরে বাচ্চাটাকে একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখলো। তারপর রাতের খাওয়া শেষ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। অমিত আর অমিতের বাবা একই ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটে শুতো। অমিত শুয়ে পড়ার একটু বাদেই অমিতের বাবা ঘর ঢুকলেন। অমিত কে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লি, শরীর টরির খারাপ না কি’? অমিত এটাসেটা বলে এড়িয়ে গেল। একটু বাদে অমিতের বাবাও শুয়ে পড়লেন, আর তার পরেই শুরু হলো আসল ঝামেলা। লেপের ভেতর গরম পেয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ম্যাঅ্যাঅ্যা করে ডেকে উঠলো আর সেই ডাক শুনে অমিতের বাবা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ‘কোথায় ছাগল ডাকছে রে! বাগানে নয়তো? অমিত বললো, ‘হতে পারে’। অমিতের বাবা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘যাঃ যাঃ তোর মায়ের সখের গাছগুলো সব গেল রে’। এই বলে তিনি দরজা খুলে হারিকেন হাতে ছুটলেন বাগানে। অমিতের খুব খারাপ লাগলো, কিন্তু কিছু করার নেই। একটু পরেই অমিতের বাবা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে জানালেন যে বাগানে কিছু নেই। তারপর হ্যারিকেনটা কমিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। আর যেই না শোয়া ওমনি ভেড়ার ছানার ‘ম্যাঅ্যাঅ্যা’। এবার অবশ্য আর অমিতের বাবা উঠলেন না। শুয়ে শুয়েই বললেন, ‘মনে হয় পাঁচিলের ওপাশে ডাকছে। আহারে কাদের বাচ্চা, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে, সারারাত কাঁদবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, আর অমিত অনুভব করলো তার বিছানাটা গরম আর ভিজে ভিজে লাগছে। পরেরদিন সকালে অমিতের বাবা চেম্বার করছেন। রুগীরা সব বসে আছে, হঠাৎ একজন লুঙ্গি পড়া লোক এসে হাজির। সে জানালো যে সে একজন ভেড়াওয়ালা, গ্রামের মাঠে ভেড়ার পাল নিয়ে চড়াতে এসেছে। কাল রাতে চারজনে মিলে তাদের পাল থেকে একটা বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে। সকালে গ্রামে খুঁজতে আসায় গ্রামের লোকেরা বললো, ডাক্তার বাবুর ছেলেকে গিয়ে ধর তাহলেই পেয়ে যাবে। তাই সে ডাক্তার বাবুর কাছে এসেছে, যদি তিনি বাচ্চাটা ফেরত পেতে সাহায্য করেন। কথাটা শুনেই আগের রাতের ছাগল ডাকার ব্যাপারটা অমিতের বাবার কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। তিনি লোকটিকে আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠিয়েই অমিতকে ডেকে পাঠালেন। অমিত এসে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়ালে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন যে তিনি সব জানতে পেরেছেন। হয় অমিত এখুনি গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ফেরত দিয়ে আসবে না হয় রাতে ওটাকে নিয়ে বাইরে শোবে। অমিত আর কি করে অগত্যা উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে সেই বাচ্চা বগলে করে চললো ফেরত দিতে। মাঠে পৌঁছতেই ভেড়াওয়ালারা তাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এলো। অমিত জানালো বাচ্চাটাকে তারা গ্রামের মধ্যে ঘুরতে দেখে ফেরত দিতে এসেছে। ভেড়াওয়ালারা খুব খুশি হয়ে তাদের ধন্যবাদ দিতে লাগলো। আর ঠিক তখনই বাচ্চাটা ডেকে উঠলো, ‘ম্যাঅ্যাঅ্যা’, আর সেই ডাক শুনে পালের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো বাচ্চার মা’টা, আর বাচ্চাটা অমিতের হাত থেকে লাফ মেরে ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে দুধ খেতে লাগলো। আর তার মা পরম স্নেহে তাকে চাটতে লাগলো। সেটা দেখে আনন্দ আর অনুশোচনায় অমিতের চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো।
-
গল্প- পুরুত বিভ্রাট
পুরুত বিভ্রাট
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়গল্পটা আজ থেকে ষাট বছর আগের। অবশ্য এটাকে গল্প বললে ভুল হবে, ঘটনাটা ষোলো আনা সত্যি। তোমরা হয়তো জানো না তখন আমাদের গ্রামের দিকে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। গ্রামের রাস্তা ছিল কাঁচা। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হতো। অবশ্য গ্রামের বাইরে দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের বাঁধানো রাস্তা এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে চলে যেত। আবার সেই রাস্তা ধরেই শহরে যাওয়া যেত। যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি। এমনকি বিয়ে বাড়ীতে বরযাত্রী কনেযাত্রীরাও ওই গরুর গাড়িতেই নেমন্তন্ন খেতে যেত। তখন অবশ্য গরুর গাড়ির উপর ছৈ চাপিয়ে দেওয়া হতো। ছৈ জানো না বুঝি? ছৈ হচ্ছে বেত বা বাঁশের ছিলা দিয়ে তৈরি ওল্টানো নৌকার মতো এক ঢাকনা। কোথাও যাওয়ার সময় সেটা গরুর গাড়ির উপর চাপিয়ে দেওয়া হতো আর তার ভিতরে বসে যাত্রীরা রোদ জল থেকে রক্ষা পেত। আর কখনো সখনো দূরে বিয়ে হলে শহর থেকে ছোট বাস ভাড়া করে আনা হতো। তো সেই রকম এক সময়ে আমাদের গ্রামের কুমোর পাড়ায় কুমোর বাড়ির দুই ছেলে সাধুচরণ আর মধুচরণের বিয়ে লাগলো একই দিনে, তখন তাদের বয়স কুড়ি বছর। সম্পর্কে তারা জাঠতুতো খুড়তুতো ভাই। অবাক হলে না? হ্যাঁ তখন ওইরকমই হতো। গ্রামের ছেলে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেতো। যাই হোক, বিয়ে তো লেগে গেল। দুই ভাই বন্ধু বান্ধবদের নেমন্তন্ন শুরু করে দিল। আমাদের গ্রামে চিরকালই বামুন, কায়েত, ছূতোর, নাপিত, কুমোর, কামার সব সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস। তাই ছেলেপিলেদের মেলামেশায় জাতপাতের কোন বিধিনিষেধ ছিল না। আমাদের বামুন পাড়ার অমিত আর গোপাল ছিল সাধু আর মধুর বন্ধু। অমিত বয়সে একটু বড় ছিল আর গোপাল ছিল তার আত্মীয় আবার পাড়াতো ভাই। সাধু মধুর আর দশজন বন্ধুর মতো অমিত আর গোপালেরও নেমন্তন্ন এসে গেল দুই ভাইয়ের তরফ থেকেই। সঙ্গে আবার বরযাত্রী। দুই ভাইয়ের একই দিনে বিয়ে তাই বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো তারা ভাগাভাগি করে দুই ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী যাবে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। দুই ভাইয়েরই বিয়ে হচ্ছে অনেক দূরে। তাই শহর থেকে দুটো বাস ভাড়া করে আনা হয়েছে বর, বরযাত্রীদের যাওয়ার জন্য। এলাহি ব্যাপার। অমিতের সঙ্গে মধুচরণের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি থাকায় সে মধূচরণের সঙ্গেই চললো, আর সে যেখানে গোপাল ও সেখানে। সময় মতো উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মধ্যে দুটো বাস ছেড়ে চললো দুদিকে। অমিতদের বাস, মানে মধুর বরযাত্রী চলেছে পশ্চিমে, আর সাধুর বরযাত্রী পূবে। বাস ছুটছে, ছেলে ছোকরারা হৈ হৈ করছে, বয়ষ্করা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, মহিলারা এককোনে জড়ো হয়ে মৃদু স্বরে খুকখুকে হাসির ফোয়ারা তুলছে। কেবলমাত্র বরকর্তা মানে মধুর বাবা বাসের একটি সিটে গুম হয়ে বসে আছেন। না দুঃশ্চিন্তায় নয়, আসলে তিনি একটু নেশাড়ু মানুষ। ছেলের বিয়ের আনন্দে সেদিন দুপুর থেকেই গলায় ঢালতে আরম্ভ করেছেন। না বিলিতি নয় দেশী। তখনকার দিনে গাঁ গঞ্জে বিলিতির বালাই ছিল না। রসমোদীরা দেশীতেই আত্মাতুষ্টি করতেন। অমিত বাবার একটা বেনিয়ান আর ধুতি পড়েছে। ও দুটোই অমিতের বাবাকে জামাই ষষ্ঠীতে অমিতের মামার বাড়ি থেকে দিয়েছে। বেনিয়ানটার দাম নাকি একশো টাকা, ভীষণ দামী। অমিতের বাবা ডাক্তার মানুষ। একবার বলেছিলেন, অতো দামী পোশাক পড়ে ওই অজ পাড়াগাঁয়ে যাওয়ার কি দরকার? জলে কাদায় নষ্ট হবে। অমিত মাকে বলে ম্যানেজ করেছে। হাজার হোক প্রথম বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। বাসে যেতে লাগবে চার ঘন্টা। দু ঘন্টা পার হতেই বোঝা গেল বয়ষ্করা সকলেই মধুর বাবার রাস্তা নিয়েছে, কেননা তাঁরাও একই পথের পথিক। বয়ষ্ক মহিলারা ঘোমটার ফাঁক থেকে চোখ মটকে বললেন ‘মরণ’।
অবশেষে বাস গিয়ে থামলো এক রাস্তার মোড়ে। মেয়ের বাড়ির গ্রাম নাকি এসে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার, হ্যাজাক হাতে কয়েক জন লোক অপেক্ষা করছে। ওখান থেকে হাফ মাইল পথ হাঁটতে হবে আলের রাস্তায়, বাস আর যাবে না। বরযাত্রীর দল হ্যাজাকের আলোয়, আলের রাস্তায় টলতে টলতে গিয়ে পৌঁছলো বিয়ে বাড়ীতে। সেখানে আর এক প্রস্থ শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনিতে বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করে বরকে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো টালির চালা মাটির ঘরের বরাসনে। অমিত গোপালকে বললো ‘চল বিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি’, আর বিয়ে বাড়ীতে ঘুরতে ঘুরতে অমিত আবিষ্কার করলো যে তারা একেবারে মদের ভাটিতে এসে পড়েছে। অতিথি অভ্যাগত থেকে মেয়ের বাড়ির লোকজন, মায় পুরুত পর্যন্ত সকলেই উনিশ বিশ মাতাল। যে দু-এক জন একটু সুস্থ আছে তারাই বিয়ে বাড়ির কাজকর্ম দেখাশোনা করছে। ঠিক তখনই অমিতের কানে এলো একটা হৈচৈ এর আওয়াজ। তার মনে হলো আওয়াজটা আসছে, যে ঘরে বরাসন হয়েছে সেই ঘর থেকে। অমিত গোপালকে নিয়ে ছুটলো সেই ঘরের দিকে। গিয়ে জানতে পারলো, বরের বাড়ির পুরুতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করছে পুরুতকে কেউ দেখেছে কিনা, কিন্তু সবাইকার একটাই উত্তর ‘না দেখিনি’। অবশেষে একজন ছুটলো মধুর বাবার কাছে জানতে কোন পুরুতের আসার কথা। তিনি আধখোলা চোখে উত্তর দিলেন দীনু ঠাকুর, আর ঠিক তখনই বোমাটা ফাটালো কামার বাড়ির ছেলে রামু। সে বললো, যে সে দীনু ঠাকুরকে দেখেছে সাধুচরণের বাসে উঠতে। তার মানে দুজন পুরুতই চলে গেছে ওই বাসে এখানে কেউ আসেনি। আবার হৈচৈ, কেউ ছুটলো কনের বাড়ির পুরুতের কাছে, যে ‘আপনি দুটো পুরুতের কাজই করে দিন, আবার কেউ এসে ধরলো গোপালকে, কেননা, সে একটু আধটু পুজোটুজো করে। একজন মাতাল আর একজন গোঁয়ার। মাতাল পুরুত বললো, সে কারো বাপের চাকর নয় যে সব কাজ তাকেই করতে হবে। এদিকে গোপাল ছিল রাম গোঁয়ার। একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সে এক পাউন্ড পাঁউরুটি কেরোসিনে ডুবিয়ে খেয়ে নিয়েছিল, আর একবার বইয়ের ব্যবসা করবে বলে কোলকাতা থেকে বই কিনে ফেরার সময় ভুল করে ননস্টপ ট্রেনে উঠে পরেছিল, আর সেই ট্রেন যখন তার স্টেশন পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, সে বইয়ের বান্ডিল বুকে করে ‘জয় মা তারা’ বলে প্লাটফর্মে লাফ মেরেছিল। তারপর ক্ষতবিক্ষত শরীর কোন রকমে টানতে টানতে মাঝরাতে গিয়ে অমিতের বাবার কাছে চিকিৎসা করিয়েছিল। এ দুটো ছাড়াও এরকম আরও অনেক ঘটনাই গোপালের ছিল। তো সেই গোঁয়ার গোপাল নিদান দিলো যে, সে বিয়ে বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে পুরুতের কাজ করতে নয়। সে পারবে না। অগত্যা সবাই গিয়ে ধরলো অমিতকে, কেননা বরযাত্রী দলে অমিত আর গোপাল ছাড়া আর কোন ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে আসেনি। অমিতদের বাড়িতে কষ্মিনকালেও কেউ পুরোহিতের কাজ করেনি। তাদের বাড়িতে সবাই উচ্চশিক্ষিত। বাড়িতে বারোজন সদস্যের মধ্যে ছজন ডাক্তার। যদিও অমিত একটু বাড়ি ছাড়া। সে নাটক যাত্রা করে, মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সেই বিয়ে বাড়ীতেও অমিত এগিয়ে গেল বন্ধুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে, অর্থাৎ সে রাজি হলো বরের বাড়ির পুরুতের কাজটা করে দিতে। কাজ অবশ্য বিশেষ কিছু নয়, বরের বাড়ির তরফে কনেকে আশির্বাদ করা। অমিত বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে বসলো পুরুতের আসনে। সামনে বন্ধুর ভাবী স্ত্রী, একপাশে কনের বাবা আর এক পাশে কনের বাড়ির পুরুত, দুজনেই গলা অবধি খেয়ে ফিট হয়ে আছে, আর তাদের ঘিরে রেখেছে আর একদল মাতাল। অমিতের একটু অস্বস্তি হতে লাগলো। আশীর্বাদ করাটা কোন ব্যাপার নয়, সে ব্রাহ্মণ সন্তান আশীর্বাদ করাটা তার রক্তে আছে, কিন্তু অতগুলো মাতালের মধ্যে নিজেকে একটু অসহায় মনে হলো তার। মাতাল পুরুতটা তার পোষাক দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলল, ‘একি বিলিতি পুরুত নাকি, তা কোন উড়োজাহাজে নামলে বাবা’? আশেপাশের মাতালগুলোও খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো। আর ঠিক তখনই, একটা কথা মনে পড়ে অমিতের মাথায় বজ্রাঘাত হলো, কপালে ঘাম ফুটে উঠল। কাল পুকুরে চান করতে গিয়ে পৈতেটা গলা থেকে খুলে জলে পড়ে গিয়েছিল আর খুঁজে পায়নি। নতুন পৈতে এখনও তৈরী করা হয়নি। ইস্ একটু আগে মনে পরলে গোপালের পৈতেটা চেয়ে আনতো। অবশ্য ও আবার যা গোঁয়ার। এইসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় এক আজগুবি বুদ্ধি এলো। সে ঝট করে পাঞ্জাবির তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নতুন আন্ডার প্যান্টের দড়িটা বুড়ো আঙ্গুলে জড়িয়ে নিয়ে, পেটের কাছে হাত রেখে মন্ত্র পড়ার ভঙ্গীতে মুখে বিড় বিড় করতে লাগলো। কিন্তু ওই মাতাল পুরুত কি চুপ থাকবে? নেশা তখন তার তুঙ্গে। আবার ঝটকা দিল ‘কি বাবা বাউনের ছেলে পৈতে বার করতে লজ্জা করছে নাকি? পরিস্থিতি কঠিন, কিন্তু অমিতও নাটক করা ছেলে। স্টেজ কি করে ম্যানেজ করতে হয় সে ভালোই জানে। অমিত হঠাৎ লাফ মেরে গিয়ে পড়ল মাতাল পুরুতের পায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরুত মশাই চমকে উঠে বললেন ‘কি হলো বাবা, কি হলো?’ অমিত তার পায়ের ধুলো নিয়ে বলল ‘কি করি বলুন ঠাকুর মশাই, এখন কি কেউ আর পৈতের মর্যাদা দেয় যে পৈতে বার করবো? পুরুত মশাই একে মাতাল তার উপর আকষ্মিক প্রণাম পেয়ে উচ্ছ্বসিত। আবেগ গদগদ গলায় বলে উঠলেন ‘ঠিক বলেছ, এ সব শালারা শুয়োরের বাচ্চা, পৈতের মর্যাদা এরা কি বুঝবে? তুমি একদম পৈতে বার করবে না, ওইখান থেকেই আশীর্বাদ করো।’ এই বলে তিনি নিজেও অমিতের মতো পেটের কাছে হাত রেখে আশীর্বাদ করতে লাগলেন, সভার মাতালরা চুপ।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল অমিতের। ছেলের বাড়ির পুরুতের কাজটা যা হয় উতরে গেল এবার খাওয়াটা সেরে নিতে হবে। গোপালও তাড়া লাগাচ্ছে। তারা দুজনে চললো খাবার জায়গায় পরিস্থিতিটা আঁচ করে নিতে। তখনকার দিনে গাঁ গঞ্জে বিয়ে বাড়ির খাওয়ার জায়গায় চেয়ার টেবিলের বালাই ছিল না। তাল পাতার আসনে, মাটিতে বসে, কলা পাতায় খাওয়া। আর খাওয়া বলতে, হয় ডাল ভাত তরকারি, না হয় লুচি বেগুন ভাজা ছোলার ডাল। অবস্থাপন্ন ঘর হলে পাঁঠার মাংস না হলে পুকুরের মাছ। এখনকার মতো চিকেনের রেওয়াজ মোটেই ছিল না তখনকার দিনে। শেষ পাতে দই আর পানটা অবশ্য ছিল। যাই হোক অমিত আর গোপাল তো উঁকি দিচ্ছে খাবার জায়গায় হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন মেয়ের বাবা মানে মধুর ভাবী শশুর মশাই। বিনয়ের সঙ্গে বললেন ‘বাবা তোমরা বামুন ঠাকুর না’? অমিত বললো, হ্যাঁ তারা ব্রাহ্মণ, আর সে বরের বাড়ির পুরোহিতের কাজটা করেছে। মেয়ের বাবা তো একেবারে রে রে করে উঠলো, ‘ছি ছি ছি তোমরা এখানে খাবে কি? তোমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, এসো আমার সঙ্গে’। এই বলে তাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন একটা ঘরের দাওয়ায়। বললেন, ‘তোমরা এইখানে বসো আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি’। অমিত আর গোপাল বসে রইল। ঘরটা টালির চালা মাটির ঘর। বোঝা গেল ঘরটাকে এখন টেম্পরারি ক্রেস হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে একপাল বাচ্চা চ্যাঁ ভ্যাঁ করছে, আর ঘরের দরজায় বসে এক বয়ষ্ক মহিলা, ভাবলেশহীন মুখে হাত পাখায় হাওয়া খেয়ে চলেছেন। অমিত আর গোপাল বসে আছে খাবারের প্রতীক্ষায়। আধঘন্টা, চল্লিশ মিনিট, একঘন্টা, খাবার আর আসে না। হঠাৎ অমিত দেখে মেয়ের বাবা তাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। অমিত উঠে গিয়ে বললো, ‘মেশোমশাই আমাদের খাবারটা?’ তিনি শিবনেত্র হয়ে বললেন, ‘কেন খাবার জায়গায় বসে খাওনি?’ অমিত বললো, ‘না আপনি বললেন ব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, তাই’। মেয়ের বাবা চোখ মুখ কুঁচকে ধমকে উঠলেন, ‘কেন বামুন বলে কি পেড়োর পীর নাকি? খেতে হলে ওখানেই খাও’। (অনেকদিন আগে আমাদের এদিকে পেড়ো বলে একটা দরগা ছিল। সেই দরগার পীর সাহেব ছিলেন খুব গণ্যমান্য ব্যক্তি, সবাই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করতো। পরবর্তী কালে পেড়োর পীর কথাটা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহার করা হতো।) এই বলে তিনি টলতে টলতে চলে গেলেন। অমিতদের কপাল ভালো মেয়ের বাড়ির একজন হাফ সুস্থ মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদের জন্য লুচি, তরকারি, মাছ, দই এনে তাদের খাবার ব্যবস্থা করে দিল। অমিতরা খেতে বসে দেখলো যা খাবার দিয়ে গেছে তাতে একজনেরও পেট ভরবে না। অথচ খাবার দিয়ে লোকটা সেই যে হাওয়া হয়ে গেল আর তার টিকি নেই। অমিত একটা লুচির টুকরো ডাল মাখিয়ে সবে মুখে পুরেছে ঠিক তখনই ঘটলো কান্ডটা। ঘরের ভেতর থেকে একটা বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে বুড়ির পা টপকে বেড়িয়ে এসে ওই দাওয়ার উপরেই প্রাতকৃত্যের দু’ নম্বর কাজটি সেরে দিল। বয়ষ্ক মহিলা সেই দেখে হাঁ হাঁ করে উঠলো। কিন্তু কি আর করা? যা হবার তো হয়ে গেছে। অমিতের গা গুলিয়ে উঠলো। সে গোপালকে বলাতে গোপাল বললো, ‘আরে ও তো ও দিকে করেছে, ও দিকে তাকাচ্ছিস কেন? উল্টোদিকে মুখ করে খেয়ে নে’। অমিতের আর খাওয়া হলো না। অবশ্য তার লুচি গুলোও গোপালের পেটেই গেল।
এবার বাড়ি ফেরার পালা। আবার সেই আলের রাস্তায় টাল খেতে খেতে বড় রাস্তা অবধি আধ মাইল পথ। এবার অবশ্য আর হ্যাজাকের আলো নেই, কেননা হ্যাজাকের আলো দেখাবার মতো কোন ব্যক্তি আর মেয়ের বাড়িতে খাড়া নেই । দু’ একজন কার কাছে টর্চ ছিল তাই রক্ষে। সবাই চলেছে বিষন্ন মুখে। বোঝাই যাচ্ছে সবাই আধপেটা, সেই নিয়ে টুকটাক আলোচনাও চলছে। অমিত তখনও জানেনা যে শেষ ধাক্কাটা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সবাই হাঁটছে। সবার মন আলের রাস্তায়, বেসামাল হলেই গিয়ে পড়তে হবে পাশের চষা জমিতে। অমিতের কাঁধে হাত রেখে টলমল করে চলেছে অর্ধচেতন মধুর বাবা। হঠাৎ তাদের সামনে হাত দশেক দূরে কি একটা বিরাট কালো মতো জিনিস মাটি থেকে লাফিয়ে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ঘোরের মধ্যে মধুর বাবা সেটা দেখে ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠে অমিতকে জড়িয়ে ধরলো, আর অমিত টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পরলো চষা জমির মধ্যে। ধুতি বেনিয়ান কাদায় মাখামাখি। তাড়াতাড়ি দু’;একজন টেনে তুললো অমিতকে। ততক্ষণে হৈচৈ পড়ে গেছে ওই ভূতুড়ে জিনিসটাকে নিয়ে। দুএকজন দূর থেকে হম্বিতম্বি করতে লাগলো, কিন্তু কাছে কেউ গেল না। অবশেষে অমিত সেই কাদা মাখা অবস্থায় একটা টর্চ নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল জিনিসটার দিকে। ওটার উপর আলো পরতেই অমিত হাঁফ ছাড়ল। আরে ওটাতো একটা গরুর গাড়ির ছৈ। আসার সময় ওইটার ভেতরে বসেই তো মধু বাস থেকে মেয়ের বাড়ি অবধি গেল। অমিতের সাহসে সাহসী হয়ে সবাই যখন এগিয়ে এলো ঠিক তখনই ছৈটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ধোপা বাড়ির ছেলে তোতলা কেতো। তাকে ধমকধামক দেওয়ার পর যখন সবাই জিজ্ঞাসা করলো যে সে ছৈটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, কেতো তুতলে উত্তর দিলো, ‘শা-আ-লারা খে-তে দেয়নি, এটাকে ভে-এ-ঙে দিয়ে যাবো। সবাই বললো সে কি রে! এতো দামী জিনিস, ভাঙবি কি রে? জিনিসটা সত্যিই দামী। সুন্দর বেতের নকশা করা ছৈ, দাম অন্ততপক্ষে তিনশো টাকা হবেই। কেতোর সেই এক কথা, ‘কো-ও-নো কথা শু-উ-নবো না। কেতোর খুব মাথা গরম, মারদাঙ্গাতেও ওর জুড়ি নেই, তাই ওকে আর কেউ ঘাঁটালো না। কেতো আবার ঢুকে গেল ছৈ এর নিচে। দুপাশে দুটো হাত লম্বা করে ছৈ এর তলাটা ধরে কেতো ভারী ছৈটাকে একটু করে তোলে দু’পা যায় আবার নামিয়ে রাখে। এই ভাবে চলতে চলতে সে ছৈ টাকে নিয়ে গিয়ে রাখলো বাসের সামনে। তারপর সবাই বাসে উঠলে সে ড্রাইভারকে বললো, ‘চা-আ-লাও’। ড্রাইভার বললো, ‘চালাবো কি মশাই! এতো দামী জিনিস ভেঙে যাবে যে’। কেতো চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘ভা-আ-ড়া পাবেনা কিন্তু’। ড্রাইভার আর কি করে, অগত্যা সে বাস ছেড়ে দিলো, আর ছৈ টা বাসের চাকায় পড়ে মড়মড় করে উঠলো।
অমিতের খুব খারাপ লাগলো, তবে মনে মনে সে তিনটে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কোনোদিন বাবার জামা পড়ে বিয়ে বাড়ি যাবেনা, বিয়ে বাড়ীতে গিয়ে প্রথম ব্যাচেই খেয়ে নেবে আর বরযাত্রীর বাসে ওঠার আগে দেখে নেবে পুরুত উঠেছে কিনা। -
কবিতা- ঈশ্বর বাদ
ঈশ্বর বাদ
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়লিখেছ বিধান তুমি পূর্ব নির্ধারিত
মাপা আছে মানুষের যত হিতাহিত ।
তবে কেন আশা কর পূজা উপাচার,
বদল হবে কি যাহা লিখিয়াছ আর?
জানি তুমি বলবে কি নিজেরে বাঁচাতে,
অদৃষ্ট গড়িলে নিজে কে পারে হারাতে?
তবেই বা কেন তুমি পূজা অভিলাষী,
সব করি নিজে কেন ভাগ চাও আসি?
আমারে তো দাও বাদ পূজি না তোমায়
জানো আছে কত শত পরে তোমা পায়?
জানেনা যে আর কিছু তুমি বিনা তারা
তবু জ্বলে দুখ তাপে তবু সুখ হারা।
তুমি কি কৃপণ না কি হয়ে গেছ জড়,
তোমারে কি কারণে তবে পূজি ঈশ্বর ? -
কবিতা- এই তো কদিন আগে
এই তো কদিন আগে
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়এই তো কদিন আগে,
তোমার আমার প্রথম দেখা,
মনে পড়ে? তুমি বলবে সে অনেক দিন,
আবছা স্মৃতি জাগে।
দুর, কোথায় অনেক দিন!
তুমি বড় ভুলো, সব কিছু যাও ভুলে।
তখন আমি উনিশ, ফ্রক ছেড়ে শাড়ি
প্লিটে সেফটীপিন।
লিপস্টিক নেলপলিশ,
রং মেলে না শাড়ির সাথে, ফ্ল্যাট হিলের স্কুল স্যু,
চুল বাঁধার লাল ফিতে, বিরক্তিকর,
আরও হাজার নালিশ।
স্কুলের গন্ডি পার,
ফর্ম তুলতে কলেজ গেটে লাইন, মনেতে ভয়,
হবে না কেন? সেই তো প্রথম একা,
নতুন চারিধার।
আজও নতুন লাগে,
তোমার রংচটা জিন্স, টি শার্ট আর
ঝাঁকড়া মাথার চুল, আমাদের প্রথম দেখা,
এইতো কদিন আগে।
মিলতো কেমন করে?
আমার কলেজ যাওয়া তোমার টাইপ স্কুলের ছুটি?
হয়তো তোমায় দেখে নিতাম আমার দু’চোখ ভরে।
নাম জানিনা যে,
কেমন করে বলবো কথা, যদিও ইচ্ছে হতো খুব।
মনে আমার ভাবনা কত, এমনি করে কথা
কোন মেয়ের কি আর সাজে!
রাগ হতো খুব,
এই ছেলেটা কি রে! দেখেও দেখেনা
তারপর সে একদিন কিছু না বলেই
হঠাৎ করে ডুব।
রোজই দু’চোখ খোঁজে,
আসোনা কেন আর, টাইপ শেখা শেষ?
চাকরী পেলে? জ্বর হয়েছে? ভাবি অনেক কিছু,
মনটা বোঝে না যে।
তারপর সে অনেক দিন,
কোথা দিয়ে পেড়িয়ে গেল কে জানে,
কলেজ শেষ, চাকরীর খোঁজ, ইন্টারভিউ,
জীবন বিরামহীন ।
হঠাৎ আবীর এলো।
সে তোমার মতো নয়, চলা বলায় ধোপদুরস্ত,
আধুনিকতার ছোঁয়া, আর তুমি, জিন্স টি শার্টে
কেমন এলোমেলো।
হাতটি তারই ধরে
পেড়িয়ে এলাম অনেকটা পথ এখন আমি ষাট।
ছেলেও আমার বড়, বিদেশে থাকে,
বিরাট চাকরি করে।
না জানি কোন কাজে
হঠাৎ সেদিন এসেছিলাম পুরোনো সেই পথে।
জানো, টাইপ স্কুলটা নেই, সেখানে এখন হাইরাইজ
সেজেছে নতুন সাজে।
প্রশ্ন জাগে মনে,
তুমিও কি দেখতে আমায় তেমনি চুরি করে?
সত্যি করে বলো, নাকি অন্য সুর বেজেছিলে
তোমার কানে- কানে?
আজও নতুন লাগে,
আমার চুলে রূপোর রেখা, চশমা বাইফোকাল,
তবুও নতুন আমার দেখা, টি শার্ট জিন্স, ঝাঁকড়া চুল
এই তো কদিন আগে। -
কবিতা- স্রষ্টা ও সে
স্রষ্টা ও সে
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়কোটি বছরের নিদ্রার পর চোখ মেললেন স্রষ্টা।
নিরালা একাকিত্বে নিঃসঙ্গ হৃদয় আলাপ করে নিজের সাথেই।
সময় বড় ধীর, আরও হানে একাকিত্বের শানিত আয়ুধ মস্তিষ্কের স্নায়ুতে স্নায়ুতে।
হঠাৎ দোলা লাগে দেহে মনে।
মননের তরঙ্গ ছুঁয়ে যায় স্রষ্টার আঙুল।
সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেল হৃদয় একাগ্র হয়
কোটি বছরের সৃষ্টি সাধনায়।
মুছে যায় কালের হিসাব, ক্ষণের বেগে
ধায় যুগ। পূর্ণতা পায় অনাবিল সৃষ্টিসুখ।
ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির মুহূর্তে স্রষ্টার তৃপ্তির
চরম প্রকাশ তাঁর অট্টহাসিতে।
সেই অট্টরব, সৃষ্টির সংবাদ নিয়ে ধ্বনিত হয়
মহাশূন্যের কোণে কোণে। স্রষ্টার সৃষ্টি,
রূপ নেয় আপন গতিতে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি পান করেন, নিজ সৃষ্টির সুধারস।নিদাঘে ধরিত্রীর মতো, কিংবা পিপাসার্ত চাতকের মতো।
পূর্ণ করেন নিজের অন্তর দিন রাত যুগে মাপের অতীত
সেই অনন্ত কাল ধরে।
অগ্নিময় গোলকের সহস্র কোটি বছরের উত্তরন সবুজে, নীলিমায়।
ধীরে ধীরে ক্লান্তি আসে দৃষ্টিতে। ক্লান্তি আসে
অনুভবে, সময় রথের চাকায় ভর করে।
নিজের হাতে সৃষ্ট যা কিছু, সব লাগে জীর্ণ,
যেন জরাগ্রস্ত ক্রীড়নক।
স্রষ্টার হৃদয় আবার ব্যাকুল, আবার দোলা লাগে মস্তিষ্কের গোপন কোনোখানে, নব সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায়।
স্থান নাই স্থান নাই নূতনের, যেন রব ওঠে
অসীম ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে।
নূতনের নাই আবাহন পুরাতন বিদায়ের আগে।
জাগে সংশয়, জাগে দ্বন্দ্বের দোলা তাঁর মনে।
ধংসের বেদীতে নূতনের আবাহন!নিজ হাতে কাল গর্ভে নিজের সৃষ্টি! কালান্তক অসাধ্য সাধনে।
উপায় কি আছে কিছু? ভাবনার জটাজাল স্রষ্টার মনে।
অবশেষে আনিলেন প্রাণী রূপে শমনের দূত ধরাতলে,
দানিলেন কাহারে নগ দেহ, কাহারে বা করিলেন সমৃদ্ধ
নখ, দন্ত, গরলে, লয়ের নিমিত্তে আপন সৃষ্টি।
তারা মারে, মরে, জেতে হারে, আর যায় কালের
সমাধি পরে। বেঁচে রয় সৃষ্টি তাঁর আরও প্রাণ
আরও রূপ নিয়ে, আরও অসীম সময় বেয়ে।
পাঠান ধেয়ে কত শত বজ্রানল, দাবানল।
ধুলিজাল, অগ্নিভস্ম ঘেরা ঘূর্ণি, প্রলয় রূপেতে
মাতে কত জলচ্ছাস।
তবুও অটল সে রচনা, আসেনা যে পরিণতি
মনে প্রাণে চান রূপকার। উপলব্ধি করেন
অন্তরে অন্তরে, অক্ষম তাঁর ধূমজাল বজ্রানল
কিংবা নখ দন্ত গরলের তেজ, নাশিতে সৃষ্টি তাঁর,শত প্রয়াসে। বয়ে যায় কত কাল,
অপ্রসন্ন হৃদয়ে, শেষে আনিলেন এক দেহধারী ,
ক্ষুদ্রকায় শক্তিহীন দুর্বল অতি। কেড়ে নেন
নখ দাঁত খড়গের বল, দেহের গরল দেন মনে। ভরে দেন চাতুর্যের ভ্রান্ত অহমিকা
অন্তরে অন্তরে। দুর্বল সে, নিজেরে ভাবে
শক্তিধর অতি, ভ্রান্ত মতি, হেলায় অন্যেরে দেয়
নীচের আসন। রাজার আসনে বসে ত্রাসের
শাসনে সব বাঁধিবারে চায়। খুঁজে নেয় অস্ত্র
তার, দেশ, ধর্ম, ঐশ্বর্যের রূপে। উথলিয়া
পাতাল, ধরা, ধায় অন্তরীক্ষ পানে, হানে শত
ধংসের বাণ, স্রষ্টার সৃষ্টির পুষ্পে, পত্রে, মূলে।
সে মরেনা, মারে, আর নিজ হাতে গড়ে তোলে
জতুগৃহ, আপনার তরে।
সস্মিত ওষ্ঠ কোণে স্রষ্টা আবার বসেছেন ধ্যানে
সৃষ্টির নূতন বীজের সন্ধানে পরম তৃপ্তিতে।
একদিন সব নাশী সেই দেহধারী, প্রবল অনলে
জ্বালিবে জতুগৃহ।
শেষের দিনের শেষে, স্রষ্টা আবার করবেন নূতনের আবাহন অকৃপণ দানে,
আর সেই দেহধারী, নিজ ধংসের পড়ে আপনারে দেবে বিজয়ীর মালা।
তার মূর্খ আস্ফালন, ধংস করি নিজ ঘর, মানুষ আমি, আমি মহা- শক্তিধর। -
কবিতা- ভাবনা
ভাবনা
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়এমন কোন ভাবনা খুঁজে পাও?
যে ভাবনাতে ভাবনা তুমি নও।
তোমার বাড়ি তোমার গাড়ি
তোমার আপনজন,
তাদের নিয়ে ভাবতে কেবল
ব্যস্ত তোমার মন।
শোনোনি কি তাদের কথা
ভাবনা যাদের বিলাসিতা,
সারা দিনের বাঁচা মড়ায়
ভাবনা লুকায় মুখ।
ভাবনা তোমার চুরি করে,
একটু দিলে তাদের তরে,
মিলবে তোমার হৃদয় ভরে
আনন্দ আর সুখ।
এমন কোনো বেঁধেছ কি গান,
যার সুরেতে মাতবে হাজার প্রাণ।
কিংবা তোমার গানের ভাষা জুড়ে
প্রেম ফুল পাখি চাঁদ আসে ফিরে ফিরে।
বাঁধো যদি এমন সুর,
দুরের মানুষ ভুলিয়ে দুর,
আসে হৃদয় মাঝে।
জানবে তবেই গান বেঁধেছ,
সেই রাগেতে সুর সেধেছ,
যে সুর প্রাণে বাজে।
এমন পথে চলার স্মৃতি জাগে?
শেষে কি তার জানতো না কেউ আগে।
মশাল হাতে তুমিই দিলে পাড়ি,
তোমার পিছে মানুষ সারি সারি ।
মুছিয়ে আঁধার রাতের কালো,
পথ দেখালো তোমার আলো,
দেখলে অবশেষে,
পথ হারানো মানুষ যত,
তোমার ছোঁয়ায় ভুলিয়ে ক্ষত,
গেল মানস দেশে।