• কবিতা

    কবিতা- দুই মন

    দুই মন
    -সুদীপা ধর

     চেনা মন বলে চিনেছ যাকে
    অচেনা মন বলে সত্য কি চিনেছো তাকে?
    চেনা মন বলে তুমি কি জানো মনের কথা?
    অচেনা মন বলে হায়রে!
    মনটাই যে চোরাবালিতে ভরা।
    চেনা মন বলে সাত রঙে সাজানো আমার মন,
    অচেনা মন বলে সাত রঙ! সেতো ক্ষনিকের,  সাদাকালোতেই ভরা।
    চেনা মন বলে মনটা যে স্বপ্নে-মেশা দিনরাত,
    অচেনা মন বলে স্বপ্ন! সেতো ক্ষণিকের ভালোলাগা ।
    চেনা মন বলে হাজারো ভিড়ের মাঝে তাকে আমি চিনি,
    অচেনা মন বলে চেনা ছবিটা, মুখোশের আড়ালে অচেনা।
    চেনা মন বলে সাজিয়েছি ইমারত একটু একটু করে মনের মধ্যে,
    অচেনা মন বলে ইমারত! সেও তো ঠুনকো, ভঙ্গুর।
    চেনা মন- অচেনা মনের দ্বন্দ্ব থাকবে চিরকাল
    বোঝাবুঝির ঊর্ধ্বে এ দুটি মনের খেলাঘর
    দুটি মনের কেউ কারো কে বুঝতে না পারে
    দুটি মন দুই প্রান্তে আপন খেয়ালে চলে।।

  • গল্প

    গল্প- শুভ নববর্ষ

    শুভ নববর্ষ
    – সুদীপা ধর

    – মা ও মা এদিকে শোনো না
    -কি বলছিস? এত ডাকছিস কেন?
    – বলছি কোন লাল রঙের শাড়িটা পড়বো কাল? একটু সিলেক্ট করে দাও না।
    – ওফ  কেন তুই পাচ্ছিস না।
    – প্রতিবার তো আমিই করি, এই বারটা বলছি করে দাও না। তুমি তো জানো কাল পাড়ায় কত বড় অনুষ্ঠান হবে, সেখানে আমি গান গাইবো।
    – সেতো প্রতি বছর হয়।  তোর এত সুন্দর গলার জন্য তোকে ছাড়া এই অনুষ্ঠান হয়ই না।
    – আচ্ছা ঠিক আছে আর মেয়ের গুনোগান করতে হবে না, আচ্ছা মা এবারে কে এসে বললো আমাকে গান গাইতে হবে?
    – প্রতিবার যে বলে, অয়ন, ওকে বললাম তোর সাথে দেখা করে যেতে, কিন্তু ও বললো ওর অনেক  কাজ, খালি বললো অদিতিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।
    – ও

    অদিতি ভাবতে লাগলো অয়নকে আর আগের মতো পাড়ায় দেখতে পাওয়া যায় না, কিছু মাস যাবত আমাকে দেখলেই কেমন যেন লুকিয়ে যায়। অদিতির এক বছর আগের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। ছোটবেলাকার বন্ধু হলেও অয়ন আমাকে বন্ধু হিসাবে দেখে, কিন্তু  আমি যেন অয়নকে আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কোনদিন হয়তো বলতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করে অয়নই একটা কথা আমাকে বললো,
    – অদিতি তোকে আমার কিছু একটা কথা বলার আছে।
    – বল না
    -আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

    শোনা মাত্র অদিতির সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। মন থেকে ভেবেই বসলো অয়ন আমাকে ছাড়া আর কাকে ভালোবাসবে, ভালোবাসার মানুষটি কে সেটা না জিজ্ঞেস করেই অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে অদিতি সেখান থেকে ছুটে পালায়।

    অয়ন ডাকে- ওরে শোন চলে গেলি কেন?
    পরের দিন অয়নের ফোন,
    – হ্যাঁ বল
    – হ্যাঁ,রে তুই গতকাল অমন করে চলে গেলি কেন?  আমার একটা জরুরী কথা বলার ছিল।
    -( লজ্জা পেয়ে )না মানে, কি জরুরী কথা
    – শোন আজ একবার কফিশপে আসতে পারবি পাঁচটার সময়।
    – আচ্ছা
    কফিশপে অয়ন ডেকেছে। শোনা মাত্র অদিতির আর তর সইছে না। অয়নের প্রিয় রং লাল, আজকে লাল রঙের শাড়ি পড়ে খুব সাজবে সে।

    যথাসময়ে কফিশপে পৌঁছিয়ে অদিতি দেখে অয়ন বসে আছে। অয়ন ডাকে,
    -অদিতি এদিকে আয়।
    অদিতি এসে সামনে দাঁড়াতে অয়ন অদিতিকে উপর থেকে নিচ অবধি পর্যবেক্ষণ করে বলে,
    -ওরে বাবা তুই এতো সেজেছিস কেন আজকে? কোথাও যাবি?
    -কেন আমাকে ভালো লাগছে না?
    -ভালো লাগছে না মানে, তুই এত সুন্দরী, আমি চোখ ফেরাতে পারছি না, যাক গে ও আমার সুন্দরী এবার দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।

    অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে অদিতির। অদিতির ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে অয়ন বললো,
    -এই শোন, তোর আজকে কি হয়েছে বলতো, কেমন লাজুক লাজুক লাগছে। যাই হোক আজকে আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। আজ একজন আসবে, আমি তোর সাথে তার আলাপ করাবো।
    -কে আসবে?
    -ঐ তো এসে গেছে।
    অয়ন ডাকলো, শ্রেয়া এদিকে এসো।
    অদিতি দেখলো জিন্স টপ পরা একটা স্মার্ট মেয়ে অয়নের ডাকে এদিকে এলো।
    -হাই অয়ন
    -হ্যালো, বসো শ্রেয়া। আলাপ করিয়ে দিই আমার ছোটবেলাকার বন্ধু অদিতি। তোকে এর কথাই বলছিলাম অদিতি। শ্রেয়া, মাই লাভ, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।

    বাকরুদ্ধ অদিতি আর একটা কথাও বলতে পারছে না। মনে হচ্ছিল সমস্ত সাজটা ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। এক তীব্র অপমানের জ্বালা বুকে নিয়ে অদিতি বললো- তোমার সাথে আলাপ হয়ে বেশ ভালো লাগলো।  কিন্তু শ্রেয়া এই অয়ন খুবই দুষ্টু, সামলাতে পারবে তো। এই সব টুকটাক কথা বলে অদিতি বললো, আমাকে এবার উঠতে হবে, কাজ আছে।
    -কাজ আছে মানে। আজকে তোর কিসের কাজ!

    অবশেষে শ্রেয়া বললো- আচ্ছা অয়ন কাজ তো থাকতেই পারে, সব কথা কি তোমায় বলবে,  যেতে দাও ওকে।
    -কিরে অদিতি বলিস নি তো তোর কাজ আছে।

    একটু রেগে অদিতি বললো,সব কথা কি তোকে বলতে হবে? কাজ আছে তাই যাচ্ছি। তোরা গল্প কর।

    তারপর নানা অছিলায় অদিতিই আর অয়নের সঙ্গে দেখা করে না। অয়ন রেগে যায়। কিন্তু অদিতি জানে ও অয়নকে দেখলেই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই মায়াটা কাটাতে চায়। কিন্তু মায়া কাটানো অতই সহজ। অয়ন ঠিকই অদিতির সঙ্গে দেখা করে। কথা বলে,  কিন্তু অদিতির আর যেন ভালো লাগে না।

    এইভাবে ছয় মাস কেটে গেল। একসময় অয়নই হঠাৎ করে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দেয়। অদিতি বুঝতে পারে না এর কারণ কি? ভাবতে লাগলো শ্রেয়ার সাথে কি কোনো ঝামেলা হল? দেখা করার চেষ্টা করলেও অয়নের টিকি পাওয়া যায় না।  যাইহোক অদিতিও ভাবে ভালোই হয়েছে। বছর শেষ হয়ে নতুন বছর উপস্থিত হল। হঠাৎ করে অদিতির ভাবনায় ছেদ পড়লো। মা এসে বলল, কিরে তুই কি ভাবছিস বলতো।  আধঘন্টা ধরে লক্ষ্য করছি লাল শাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভেবেই যাচ্ছিস। কি ভাবছিস এত?

    অদিতি বললো না যে এতক্ষণ ধরে সে আগের সব কথা ভাবছিল, অয়ন এইবার এসে বললো না গান গাইবার কথা, প্রতিবারই আসে, এসে বলে,
    -গলাটা ঠিক রাখিস, ব্যাঙ ঢুকে যায় নি তো..
    এবারে কি হলো কে জানে? যাই হোক কিছু একটা হয়েছে ওর।

    সন্ধ্যাবেলা উপস্থিত, খুব সুন্দর করে সাজলো অদিতি।

    যথাসময়ে জলসায় উপস্থিত হয়ে চার-পাঁচটা গান গাইলো, পুরো প্রোগ্রাম না দেখে অদিতি বেরিয়ে অয়নকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথায় ও। বর্ষবরণের দিনে অদিতির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রোগ্রাম আর  না দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চওড়া রাস্তা পার করে একটা বড় গলির মধ্যে অদিতির বাড়ি। সবাই যেহেতু জলসায় তাই গলিটা ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ করে পেছন থেকে কে হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল একটা বাড়ির নিচে। আচম্বিতে এমন ঘটনাটা ঘটে গেল যে অদিতি কি করবে বুঝতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করলো।  অদিতি বললো চিৎকার করে- কে আপনি? ছাড়ুন বলছি আমাকে? এটা আমার পাড়া, এখানে লোক জড়ো হতে বেশি সময় লাগবে না। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ করে চেনা কণ্ঠস্বর, চুপ কর, চুপ কর, চিল্লাস না।
    -কে অয়ন? তো তুই এইভাবে?  এতদিন কি হয়েছিল তোর? আমার সঙ্গে দেখা করিস না? আজ জলসাতেও দেখলাম না? শ্রেয়া কোথায়? তোর সঙ্গে নেই?

    হঠাৎ করেই অয়ন তার হাতটি দিয়ে অদিতির মুখটা ধরে বলে,
    – চুপ কর, অনেক প্রশ্ন করছিস? এবার চুপ কর।
    – এসব কি হচ্ছে অয়ন? রাস্তার মধ্যে মুখ চেপে ধরছিস।
    – কি আবার করলাম, বেশি কথা বলছিস তাই মুখ চেপে ধরেছি। আর পারলাম না, বুঝেছিস? এতদিনে সব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি।
    -কি পরিষ্কার হয়েছে? কি বকছিস তুই? শ্রেয়ার সঙ্গে কিছু হয়েছে? আজ ও নেই কেন তোর সাথে?
    -না রে, সত্যি বলতে কি  আমি তোকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবি নি কখনো। কিন্তু শ্রেয়ার আলাপ হওয়ার পর ওকে ভালো লেগেছিল, কিন্তু আমার গল্প ছিল ওর সাথে তোকে নিয়ে। শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে শেষের দিকে বলেছিল -অদিতি তোমার, তুমি অদিতির। আমি মাঝখান থেকে ঢুকে পড়েছি। আমি ক’ মাস তোর সাথে দেখা করিনি তার একটা কারণ আছে। দেখছিলাম তোকে ছাড়া সত্যিই আমি থাকতে পারবো কি না, বুঝলাম- না, সত্যি পারছিনা রে।

    এত কিছু শোনার পর অদিতির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
    – যা, কি যা তা বলছিস। সব তোর পাগলামি।
    – পাগলামি নয়, সত্যি। আমি এত বোকা যে আমি সেদিনও বুঝিনি তুই লাল শাড়িটা কেন পড়েছিলিস।আর আজকেও দেখ এই বর্ষবরণে তুই আমার প্রিয় রং লাল পরেছিস। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তোকে। কেন পরেছিস? আমার জন্যই তো? অদিতি আমাদের ছোটবেলাকার বন্ধুত্ব প্রাপ্তবয়স্কে প্রেমে পরিণত হয়েছে, আমরা বুঝতে পারি নি।

    অদিতি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। বললো,
    – ওরে আমি তোকে কবেই মন দিয়ে ফেলেছিলাম, তুই যখন শ্রেয়াকে নিয়ে এলি আমার ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। পারছিলাম না।
    -চুপ কর, আমাকে ক্ষমা কর।

    একগুচ্ছ গোলাপ প্যাকেট থেকে বার করে হাঁটু গেড়ে বসে অয়ন বললো,

    ” আজ এই বৈশাখে
    নতুন বছরের শুভ ক্ষণে
    পেলাম আমি তোমাকে আবার
    নতুন করে নতুন ভাবে।
    তুমিই আমার সখী, তুমিই আমার প্রিয়ে,
    নতুন বছরে ঘর বাঁধবো
    নতুন গানের সুরে।”
    শুভ নববর্ষ অদিতি, আমাকে গ্রহণ কর।
    শুভ নববর্ষ অয়ন, গ্রহণ করলাম।।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- অন্য এক চকলেট দিবস

    অন্য এক চকলেট দিবস
    – সুদীপা ধর

     আজ সোহমের খুব আনন্দ। গার্লফ্রেন্ডের সাথে মান অভিমানটা বোধহয় আজকেই শেষ হবে। দেখা করতে বলেছে সোহম, শ্বেতাকে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর শেষ পর্যন্ত রাজি হয় শ্বেতা। বিকেল সাড়ে চারটায় দেখা করার কথা আউট্রাম ঘাটে।

    ঝগড়াঝাঁটি হলেও সোহমকে শ্বেতা নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু অভিমানটা শ্বেতার একটু বেশি, বরাবর সোহমকেই ভাঙাতে হয়।

    খুব সেজেছে শ্বেতা। ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে সোহম তাকিয়ে আছে শ্বেতার দিকে,  কিন্তু গুরুগম্ভীর শ্বেতা তাকাচ্ছে না সোহমের দিকে। নদী বক্ষের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাই হোক সোহম ভালো করেই জানে এই মেয়ের অভিমান সহজে ভাঙে না, তাকেই ভাঙ্গাতে হবে। আলতো করে শ্বেতার হাত ধরে প্রথম কথা—

    “শ্বেতা আর কতদিন এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? কথা বলবে না তো? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি তাহলে।”

    ছলছল চোখে শ্বেতার জবাব “ঝগড়া করার সময় মনে থাকে না। আর এখন এত ভালোবাসা দেখাচ্ছ তুমি!”

    “ওরে আমার অভিমানী মেয়ে, হয়েছে বাবা আর ঝগড়া করবো না। চলো এবার ওখানে গিয়ে একটু বসি।”

    অদ্ভুত আনন্দে শ্বেতার মনটা ভরে যায়।  ও ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।  এই কদিন রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারে নি। যাইহোক অনেক কথা বলার পর সোহম এক বিরাট চকোলেটের বাক্স এগিয়ে দিল শ্বেতার হাতে।

    “শুভ চকলেট দিবস। নাও তোমার সমস্ত প্রিয় চকোলেট এরৎমধ্যে সাজিয়ে এনেছি। অভিযোগ করার সুযোগ আমি আর দেব না।”

    চকোলেট পেয়ে শ্বেতা হু হু করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল। থাকতে না পেরে সোহোম জড়িয়ে ধরলো শ্বেতাকে।

    অনেক দূর থেকে একটি ছেলে লক্ষ্য করছিল। কাছে এসে দু’টো ভিক্ষা চাইল সোহমের কাছে। আধময়লা,ছেঁড়া জামা, উস্কোখুস্কো চুল কিন্তু চোখ দু’টো মায়ায় ভরা। সোহম ওর দিকে  একশো টাকার একটা নোট বার করে দিলো। ছেলেটা পেয়ে খুব খুশি। চলে যাচ্ছিল হঠাৎ করে শ্বেতা ডাকলো —

    “এই শোন।  এদিকে আয় তো।”

    ভয়ার্ত চোখে গুটি গুটি পায়ে ছেলেটা হাজির হলো শ্বেতার সামনে।
    শ্বেতা বললো “আজকে কি দিন জানিস?”
    ছেলেটি বললো, “না”
    “চকলেট দিবস। বুঝেছিস।”
    ছেলেটি বললো, “দোকানে সাজানো থাকে দেখেছি। কি সুন্দর দেখতে। কিন্তু কোনোদিন খেতে পাইনি তো, তাই জানতেও পারিনি জিনিসটা কি?”
    শ্বেতা বললো, “তাইতো এটা তোর জন্য।”

    বিস্ফোরিত চোখে ছেলেটা একবার সোহম আর একবার শ্বেতাকে দেখছে। ও ভাবতেই পারছে না এই দুর্লভ বস্তুটা কোনোদিন ওর হাতে কেউ এভাবে দেবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটা চকলেটের বাক্সটা নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি বলবে ছেলেটা নিজেই বুঝতে পারছিল না, কিছুক্ষণ পরে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো—

    “তোমরা যে ভীষণ ভালো দাদা দিদি” বলেই দৌড়ে চলে গেল।

    আজ এই দিনে অদ্ভুত এক আনন্দে আর গর্বে সোহমের বুকটা ভরে গেল শ্বেতার জন্য। শ্বেতার এইরূপ সোহম কোনদিন দেখে নি। বাচ্চা মেয়েটার অভিমানটাই খালি দেখেছে সোহম এতদিন,  কিন্তু তার ভেতরে যে এত বড় হৃদয় আর একটা বিরাট মন লুকিয়ে ছিল, সোহম আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলো । সোহম ভাবল ও তার চলার পথের জীবনসঙ্গিনীটিকে ঠিক বেচেছে। এক অদ্ভুত আনন্দে সোহম শ্বেতাকে বুকে টেনে নিলো।

  • কবিতা

    কবিতা- সৃষ্টি

    সৃষ্টি
    -সুদীপা ধর

     

     

     আমার একটা প্রশ্ন আছে ‘সৃষ্টি’ কে
    তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?
    কোথায় তুমি যাবে?

     সৃষ্টি বলে– আমার গাছের শিকড় ছড়িয়ে আছে তোমাদের মননে, তোমাদের প্রতিভার মাঝে,
    এই ধরিত্রীর বুকে অসংখ্য  শিল্পীর বাস
    যেখানে শিল্পীরা সযত্নে লালিত করে তাদের স্বপ্নের আকরকে
    আমাকে তারা  নিজের মত সাজায়,  গহনা পরায়।

    আচ্ছা সৃষ্টি বলতো শুধু কি শিল্পীরাই  তোমার কদর করে, আর কি কেউ নেই বন্ধু?

     আছে তো.. এই অনন্ত বিশাল পৃথিবীর
    গুণী সুধীজনেরা, তাদের  মাঝেই তো আমি জীবন পাই, তারাই তো দ্রষ্টা, তারাই বিচারক, সেখান থেকেই হয় আমার উত্তরণ,
    সেখানেই আমার পরীক্ষা, সেখানেই আমার জিত
    শিল্পীরা তো শুধু রূপ দেয়, জল দেয়, সার দেয়,
    কিন্তু………
    হে  বন্ধু আমার মূল্যায়ন কোথায় জানো..
    সুধী বন্ধুদের সুন্দর মননে… তাদের হৃদয়ে
    সেখানেই আমার জয়, আমার সার্থকতা।

  • কবিতা

    কবিতা- ছেলেবেলা

    ছেলেবেলা
    -সুদীপা ধর

     

     

     ছেলেবেলাটা আজ অতীত ইতিহাসের অন্তরালে
    কিন্তু চাইলেই  ভবিষ্যতের মনি কোঠায় তাদের ছুঁতে পারি না।
    কিন্তু সেইসব দিনগুলো এখনো অনুভূতিতে তরতাজা বর্তমান।
    ছেলেবেলাটা ছিল অনেকটা সৃষ্টি সুখের উল্লাসের মতো
    ছেলেবেলাটা ছিল ভাইবোনেদের  সমাগম,
    ছেলেবেলাটা  ছিল বোনেদের সাথে রান্নাবাটি খেলার আয়োজন,
    ছেলেবেলাটা ছিল কুমিরডাঙা, চোর চোর ধরা,
    ছেলেবেলাটা ছিল রবিবার সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় ঠাকুমার কাছে বসে ভূতের গল্প শোনা,
    ছেলেবেলাটা ছিল মাকে লুকিয়ে শালপাতায় মোরা তেঁতুলের আচার নিয়ে ছুট্টে ছাদে যাওয়া,
    ছেলেবেলাটা ছিল বিশ্বকর্মা পূজায় মাঞ্জা দেবার  সরঞ্জামের আয়োজন
    দৌড়ে গিয়ে পায়রার বাসা থেকে নিয়ে আসা হতো ছোট্ট ছোট্ট ডিম,
    ছেলেবেলাটা ছিল পুতুলের বিয়ে দেওয়া,  বিশাল খাবারের আয়োজন,
    পড়ালেখার মাঝে হৈ হল্লা হট্টগোল,
    ছেলেবেলাটা ছিল রঙিন স্বপ্নে-মেশা দিন
    সেই স্বপ্নে ছিল শুধুই আনন্দ, শুধুই উল্লাস
    এই ভালোবাসাটার রেশ এখনো যে থেকে গেছে পরতে পরতে,
    কিন্তু আজকের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেবেলাটা পায় না এসব স্বাদ,
    তাদের নেই যেকোনো উল্লাস, নেই কোন রোমাঞ্চ,
    বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে হচ্ছে তারা বড়,
    এই ছেলেবেলাটা  বড়ই একা একাই খেলে নিজের খেলা,
    এই ছেলেবেলাটা খুবই যেন কৃত্রিম,
    চার দেওয়ালের মধ্যে মোবাইলের গেমে বন্দি।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- উপহার

    উপহার
    – সুদীপা ধর

     

     

     আজ আমার সমস্ত কথাগুলো বুক চাপা কান্নায় পরিণত হয়েছে। যে কান্নার কোনো আওয়াজ নেই। যে কান্না শুকিয়ে গেছে বুকের মধ্যে। আমার সঙ্গে ওই বীভৎস ঘটনাটা ঘটার পর দেবাদিত্য তুমি আমাকে একটু একটু করে আবার কথা শিখিয়েছিলে। আমি তো এক প্রকার নীরব হয়ে গেছিলাম। নীরব শব্দগুলো আমার এদিক ওদিক ডানা মেলতো। আর আজকে তুমি পারলে এই ঘটনা ঘটাতে।

     বছর পাঁচেক আগে যখন চার পাঁচ জন গণ-ধর্ষণ করে, ছিঁড়ে খেয়ে খালের ধারে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো তখন তুমি এসে আমায় উদ্ধার করলে, পরম আদরে পরম যত্নের সাথে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে আশ্রয় দিলে, এতো আদর, এতো ভালোবাসা আমি হয়তো কখনো পাইনি। তুমি আমার নতুন নাম রাখলে রাধিকা।  একটা মা যেমন একটা শিশুর যত্ন করে, দেবাদিত্য তেমনি তুমি আমার যন্ত্রণার জায়গায় ভালোবাসার প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিলে। স্বপ্নমাখা পৃথিবীটা আবার যেন ভালো লাগতে শুরু করল। তোমাকে আমি আমার মণিকোঠায় রাজপুত্র কল্পনা করে আমার যন্ত্রণার প্রলেপগুলো ভুলে যেতে বসেছিলাম। তোমাকে নিয়ে আমি নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।  তুমি যখন আমার ঘরের দিকে আসতে তখন তোমার সেই পায়ের শব্দে আমি ভ্রমরের গুঞ্জন পাখির কলরব শুনতে পেতাম। পাঁচটি বছর এই ভাবেই কেটে যেতে লাগলো সুখের গালিচায়।

     কিন্তু  বছর পাঁচেক পর একটা দিনে তুমি আমাকে একটি ছোট্ট উপহার দিলে। আমি খুব বোকা ছিলাম, তোমার মনের এইসব কথা, ইচ্ছা আমি  বুঝতেই পারিনি। সেই ধর্ষকগুলো আমাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়েছিল, তুমি যে যন্ত্রণাটা দিলে সেটা মানসিক। এক কঠিন কুঠারাঘাত করলে আমার মনের আত্মাতে। সেদিন  জানলার ধারে বসে ভাবছিলাম আমি, আমাদের সম্পর্কের কথা, হঠাৎ তুমি রাধিকা বলে ডাকলে আর একজনের সাথে আলাপ করালে। যখন জিজ্ঞেস করলাম উক্ত ব্যক্তির পরিচয় কী, তুমি বললে আজ থেকে নাকি এর বাড়িতেই আমার নতুন ঠিকানা, যে কথাটা বললে তার আগে আমার মরণ কেন হল না, তুমি বললে এনার কাছে নাকি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছো, কিছু বলতে পারলাম না, শুধু বললাম, এতদিনে একটুও ভালোবাসো নি? তুমি বললে, ভালোবাসায় তোমার নাকী ঘেন্না। তুমি যে নারীকে ভালোবেসে ছিলে সে নাকি তোমায় ছেড়ে চলে গেছে বিরাট এক ধনবানের কাছে। তোমার কাছে নাকি সব নারীই সমান।  কিছু আর বলতে পারলাম না, শুধু বললাম তোমাকে আমি মনে রাখব সারা জীবন, দগ্ধ হব প্রতি রাত তোমার দেওয়া এই উপহারের কাছে। যতদিন বাঁচবো তোমার দেওয়া এই উপহারটিকে যত্নে সাজিয়ে রাখবো বুকের মাঝে।

  • গল্প

    গল্প- 5 ই সেপ্টেম্বর

    5 ই সেপ্টেম্বর
    – সুদীপা ধর

     

     

           দিন যায়, মাস যায়, বছরগুলো পার হয় বয়সের সাথে, থামিয়ে রাখা যে বড়ো বালাই, দু’টো হলদে চোখের তারায় আজ অনেক স্মৃতি আছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। কিছু স্মৃতি বড় মধুর, কিছু স্মৃতি ক্ষণিকের, আবার কিছু স্মৃতি আজও বড় কষ্ট দেয় মনকে। আজ আমি বড় একাকী তোমাকে ছাড়া। বড্ডো যেতে ইচ্ছে করে অনুপ তোমার কাছে। তবু যেতে পারিনা আমি। কেননা যমদূত আজ তোমায় নিয়ে গেছে অনেক দূরে। আকাশের তারা করে রেখেছে। আমি রোজ তোমায় দেখি, শত তারাদের মাঝে খুঁজতে থাকি তোমায়। তবু ভাবি কোথায় তুমি? আমি যে বড় নিষ্ঠুর হয়েছিলাম তোমার প্রতি। শুনিনি তোমার ভালোবাসার হাতছানি, তুমি যে চেয়েছিলে আমাকে নিয়ে নীড় গড়তে, কিন্তু গড়া যে আর হয়ে উঠলো না। কিন্তু আজ ভাবি যাদের জন্য করলাম আমি এ জীবন ত্যাগ,  তাদের কেউ কি কোনোদিন বুঝবে আমায়, কোনোদিন কোন প্রতিদান দেবে আমাকে!

                       এত লিখে থামল শ্রীলেখা মিত্র।  বয়স তার সত্তর। কাঁচাপাকা চুল,  রোগাটে শরীরটা বয়সের ভারে সামান্য স্থূল হয়েছে।  কিন্তু অপরূপ সুন্দরী তিনি। এই বয়সেও তা যেন বিদ্যমান। তার জাজ্বল্যমান চোখদুটি এখনো বুদ্ধিদীপ্ত। দোতলা বাড়ি, বাবা মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। বাবা-মার একটি সন্তান তিনি।  বাড়িটাকে তিনি সাজিয়েছেন অনেক যত্ন করে। তেনার দুটি সাগরেদ- হরি ও জবা। হরি ঘরে বাইরের সমস্ত কাজ করে জবা সামলায় রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া এইসবের ঝক্কি।

                          শ্রীলেখা মিত্র একজন শিক্ষিকা।  রিটায়ার করেছেন। তিনি অনেক ছেলে মেয়েদের নিজের হাতে করে মানুষ করেছেন। অনেক গরীব মানুষ যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অনেক কম তাদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষা দান করেছন। এইরকম একটা উঁচু মনের মানুষ তিনি।  শিক্ষকতা হলো তার ধ্যান জ্ঞান। এর জন্য তিনি হয়তো নিজের দিকে একদম খেয়াল দিতে পারেন নি।

                           লেখা শেষ করার পর হঠাৎ তার মনে হলো হরিকে তিনি কতগুলো জিনিস আনতে বলেছিলেন। তাই তিনি  উঠে গিয়ে-হাঁক দিলেন ‘হরি এই হরি কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না। কোথায় তু্ই?’
    ‘যাই মা যাচ্ছিই।’
    ‘কোথায় থাকিস তু্ই ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।’
    ‘না মানে ওই একটু………’
    ‘থাক আর মানে মানে করতে হবে না। শোন্ আজ কত তারিখ মনে আছে তো?’
    ‘১লা সেপ্টেম্বর।’
    ‘আমি ভাবলাম তু্ই হয়তো ভুলে গেলি।’
    ‘না মা ভুলিনি, আজ অনুপ দাদাবাবুর জন্মদিন।’
    ‘মিষ্টি মালা সব এনেছিস তো।’
    ‘হ্যাঁ মা এনেছি। নিচে আছে নিয়ে আসছি।’
    ‘শোন্ জবাকে বলিস পায়েস রাঁধবার জন্য ও যে বড্ডো ভালোবাসতো খেতে।’
    ‘বলবো। একটা কথা বলবো মা, আপনি আজও অনুপ দাদাবাবুকে ভুলতে পারেননি।  দাদাবাবু কত চেয়েছিল আপনাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে, সংসার করবে, কিন্তু আপনি তার কোনূ স্বপ্নই সত্যি করলেন না। ছোট মুখে বড় কথা খুব অনাচার হয়েছে তার প্রতি।’

    ( দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) ‘হ্যাঁ হয়েছে।  আজ আমি বুঝি, সেই দিনগূলোতে বুঝিনি, বুঝতে চাইনি।  তখন ছোট বড় সব সবুজের দলগুলিকে নিয়েই আমার সংসার ছিল। তুই এই বাড়িতে অনেকদিনের হয়ে গেলি তাই তোকে বলতে আপত্তি নেই,  আর কাকেই বা বলবো– জানিস ও বলেছিল বিয়ের পর তুমি পড়াবে, আমার বা আমার বাড়ি তরফ থেকে কোনো আপত্তি থাকবেনা। কিন্তু আমি শুনিনি তার কথা, বুঝিনি কি পরিমাণ সে আমাকে ভালোবাসতো। আমার জন্য সে আর কারো সাথে ঘর বাধলো না। আজ নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যতদিন বেঁচে ছিল অনুপ ততদিন ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে থেকে ছিল আমার সঙ্গে। ( কাঁদতে কাঁদতে) তারপর একদিন একা করে দিয়ে চলে যায়।’
    ‘মা আপনি কাঁদবেন না।’
    ‘জানিস হরি এই যে ছাত্রছাত্রীরা এখনো মাঝে মধ্যে দেখা করতে আসে বটে, কিন্তু একাকীত্ব যে যায়না।  ঠাকুর যে কবে আমাকে নেবেন।’
    ‘ছিঃ মা এসব কথা বলতে নেই। মন খারাপ করবেন না একদিন ঠিকই কিছু হবে। যাই সবকিছু নিয়ে আসি।’

                 এই ভাবেই শ্রীলেখা মিত্রের সময়গুলো কেটে যায় স্মৃতি রোমন্থন করে, বই পড়ে, কবিতা পাঠ করে। দুদিন পর একটা ঘটনা ঘটলো।

     টিং টং
    ‘হরি দেখ তো কে এসেছে?’
    দরজা খুলে হরি দেখে এক সুদর্শন পুরুষ আর তার সাথে একজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসছে। সুদর্শন পুরুষটি প্রথম কথা বললো, ‘হরি কাকা চিনতে পারছ?’
    ‘না মানে ঠিক—- কে বলুন তো আপনারা?’
    (মেয়েটি হেসে বলল)’ এ বাবা তুমি ভুলে গেলে। ঠিক আছে এখন সরো তো দেখি যার কাছে আসা তার ঠিক মনে আছে কিনা আমাদের।’
    ‘মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? তিনি তো উপরে আছেন। আপনাদের কি নাম বলবো একটু বলুন না।আসলে অচেনা কাউকে—–‘
    ‘সুদর্শন পুরুষটি  বলল, অচেনা নই গো আমরা তুমি সরো তো এখন।’

     ছেলে ও মেয়েটি হরিকে সরিয়ে দিয়ে তরতর  করে ওপরে চলে গেল। শ্রীলেখা মিত্র কিছু বোঝার আগেই দুজনে নমস্কার করলো।
    ‘আরে আরে করছো কি? কে তোমরা?’
    ‘যুবকটি বলল ভালো করে চেয়ে দেখুন তো কে আমরা।’

     শ্রীলেখা মিত্র চশমার কাঁচটা ভালো করে মুছে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন দুজনের দিকে। তারপর উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘আরে তুই—-ই  ঋদ্ধি তো?’
    মেয়েটি বললো–‘ আমাকে ভুলে গেলেন?’
    ‘আরে কি করে ভুলবো, তুইতো শ্রেয়া।’
    ‘সেই যে দুজনে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলি তারপর ছয় বছর বাদে দেখা।’
    ঋদ্ধি বললো, ‘হ্যাঁ ম্যাম অনেকদিন বাদে ফিরলাম। আর যাবো না আমরা। এই বঙ্গদেশকে ভুলে থাকতে পারছি না। তাই পোস্টিং নিয়ে এখানে চলে এসেছি।’
    ‘জবা এই জবা, ওপরে একবার শুনে যা।’
    ‘আসতাছি। বলেন মা।’
    ‘শোন আজ ভাল ভাল রান্না কর। মাছ, মাংস, সোনামুগের ডাল চাটনি আর হরিকে বল মিষ্টি আনতে।’
    শ্রেয়া বললো- কি করছেন আপনি? আমরা শুধু গল্প করবো, খাওয়া-দাওয়া আরেকদিন হবে।’

    ‘ নানা আজ আমার বড় আনন্দের দিন। বোস বোস ওফ তোরা হলি আমার সেই ছাত্র ছাত্রী, যাদের জন্য আমার গর্ব বোধ হয়। তোরা ছিলিস আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রী। পঞ্চম ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলিস আর সেই বারো ক্লাস অব্দি রয়ে গেলি। কখন যে তোরা দুজন দুজনকে পছন্দ করলি তা বুঝতেই পারিনি কোনদিন।  আসলে আমি প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু জানতাম না( দু ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো), নাহলে কি অনুপ অভিমান করে আমায় ছেড়ে চলে যায়।
    শ্রেয়া বললো, ‘বুঝলাম না ঠিক, নেই মানে’।

    ‘ওই তোরা যে বছরে আমেরিকা গেলি তার পরের বছরই উনি পরলোক গমন করলেন।’
    ঋদ্ধি বললো, ‘খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা ভেবেছিলাম দুজনের সাথে বোধহয় দেখা হবে। আসলে আমরা অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই আপনার নাম্বারে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না।  সেই জন্যই হয়তো কোন খবর পাইনি।’
    ‘হ্যাঁরে, অনুপ চলে যাবার পর আমি আমার ফোন নাম্বারটা পাল্টে নিয়েছিলাম। ভালো লাগতো না কারো সাথে কথা বলতে। আসলে কথা বলতে গেলেই সবাই বলে আমি জীবনে কত বড় ভুল করেছি  ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে তখনই একটু কথা বলি। এই করেই আমার চলে। যাকগে এই বুড়িটার কথা না শুনে তোদের কথা বল।’
    ঋদ্ধি বললো, ‘আমরা সবাই ঠিক আছি ম্যাম’
    এইভাবে দুপুরে জমিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর অনেক পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করল সবাই মিলে।

     ঋদ্ধি বললো, ‘আজ তাহলে আসি।  তিন দিন পর আসবো, আপনাকে একটি সারপ্রাইজ দেবো।’

     এই বলে তারা চলে যায়।

     তিনদিন পর
    ডোরবেল এর শব্দ টিং টং
    হরি দরজা খুলে দেখে ঋদ্ধি।
    ‘এস দাদাবাবু ভেতরে এসো। তুমি সাহেবদের মতো হয়ে গেছো তো তাই সেদিন চিনতে পারিনি।’
    শ্রীলেখা মিত্র উপর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে রে হরি?’
    ‘আমি ঋদ্ধি।’
    ‘আয় আয় ওপরে আয়। শ্রেয়া কোথায়?’
    ‘আছে গাড়িতে বসে।’
    ‘কেন আসবেনা?’
    ‘না। আপনি দশ মিনিটে রেডি হয়ে নিন।’
    ‘কেন কোথায় যাব?’
    ‘নো কোয়েশ্চেন।’

     তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে শ্রীলেখা মিত্র নিচে নেমে এলেন। আজও ওনাকে সাজলে কি সুন্দরই না লাগে। বললেন, ‘কোথায় যাবি চল।’
    ‘হু চলুন।’
    ‘আসুন ম্যাডাম ঢুকে আসুন।’ শ্রেয়া বললো

              হু হু করে গাড়িটা চলতে শুরু করলো।  থামল একটা বিরাট গেটের সামনে। শ্রীলেখা মিত্র গাড়ি থেকে নেমে হোডিংটা পড়লেন,

    ‘ শ্রীনিকেতন চ্যারিটি।  এখানে কি করতে?’

     ঋদ্ধি বললো, ‘আমেরিকা থেকে ফেরার পর আমরা এই চ্যারিটি সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।  এখানে এসে দেখেছি ম্যাম এই বাচ্চালো খুব অসহায়। এদের আরো যত্নের সাথে সব কিছুর প্রয়োজন।  যে মানুষগুলো বিনা স্বার্থে সব কিছু উজার করে শিক্ষা দেবে, আলো দেখাবে ভবিষ্যতের, তারা নতুন করে পথ চলতে শিখবে,  সেইরকম মানুষদের খুব দরকার। তার মধ্যে একজন হলেন আপনি। আপনার মনে আছে ম্যাম আমার বাবার অবস্থা ভাল ছিল না বলে যতবছর পড়িয়েছেন আপনি কোনো টিউশন ফি নেন নি আমার কাছ থেকে। আপনি আমার আর এক মা। কাল থেকেই এই চ্যারিটিতে কখনো আমি কখনো শ্রেয়া যে যখন সময় পাব আপনাকে নিয়ে আসবো। আপনি নতুন ভাবে আবার মানুষ করবেন, নতুন আশার আলো দেখাবেন, আরো ঋদ্ধি আরো শ্রেয়া তৈরি করবেন। আপনি একা নন, আমরা সবাই আছি আপনার পাশে, আর এই শিক্ষক দিবসে এটাই আমাদের গুরুদক্ষিণা। চলুন ভেতরে কথা বলে আসি।’
    ‘ম্যাম আপনি কাঁদছেন’ শ্রেয়া বললো।
    ‘নারে আনন্দের জল।  আজকের দিনে তোরা আমাকে এত সুন্দর উপহার দিলি,  তোরাই যে আমার ছেলে মেয়ে, আমার আর কোন অভাব রইল না রে। আয় আমার বুকে আয় তোরা।’

     ভেতরে ঢুকে কথা বলে বেরিয়ে শ্রেয়াই বললো-‘চলুন আজ আমরা তিনজনে কোথায় ঘুরে খেয়েদেয়ে একদম বাড়ি ফিরবো।’

     শ্রীলেখা মিত্র বললেন, ‘চল যাবি তোরা।  অনেকদিন কোথাও বেরোইনি।’

     গাড়িতে উঠে বসে ঋদ্ধি বললো- ‘এই ছোট্ট উপহার কেমন লাগলো ম্যাম?’
    শ্রীলেখা মিত্র গাড়ির  জানলাগুলো খুলে দিয়েছেন, বললেন, ‘এই সময় আমার রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েক ছত্র লাইন মনে পড়ছে। খুব আবৃত্তি করতে ইচ্ছা করছে।’

     শ্রেয়া বললো, ‘করুন না ম্যাম,  আপনি তো আমাদের কত ভালো আবৃত্তি শেখাতেন। প্লিজ শুরু করুন।’

    “আকাশ তবু সুনীল থাকে
    মধুর ঠেকে ভোরের আলো
    মরণ এলে হঠাৎ দেখি
    মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।”

     আমি আর মৃত্যু কামনা করতে চাই না রে।  আজকের দিনটি থেকে বাঁচতে চাই তোদের সাথে, হাত ধরে। বাঁচতে চাই আমি।

              

  • গল্প

    গল্প- পরীক্ষা

    পরীক্ষা
    – সুদীপা ধর

    অনিমেষ আর  সুচেতা কলেজের বেস্ট ফ্রেন্ড। মারাত্মক বন্ধুত্ব তাদের দুইজনের মধ্যে, দুজনে যেন একে অপরকে ছাড়া চলার কথা ভাবতেও পারে না। লিটারেচারের ছাত্রী সুচেতা আর বিজ্ঞানের ছাত্র অনিমেষ। তাদের কবিতাপাঠ যেন নেশা ছিল।  কলেজের অফ টাইমে তারা যে কত কবিতা পাঠ করতো তার কোনো হিসাব ছিল না। সেই সময়টা অনেকেই ভিড় করে ঘিরে ধরে তাদের কবিতা পাঠ করা শুনতো। দুজনেই ভীষণ সুন্দর আবৃত্তি করতো। অদ্ভুত মায়াময় কন্ঠ ছিল দুজনের। তারা একসাথে অনেক স্টেজ শো করেছ।

    এদের প্রেমটাকে অনেকেই বুঝতো না। অনেকেই ভাবতো কবিতার প্রতি প্রেম নাকি সত্যি এদের মধ্যে কোন আত্মিক যোগ আছে। আবার কেউ কেউ এদের ‘অর্ধনারীশ্বর’ আখ্যায় ভূষিত করেছিল। এই ভাবেই বেশ মধুর দিনগুলো মধুর সম্পর্কের ভালোলাগার মধ্যে কেটে যাচ্ছিল।  কিন্তু হঠাৎ করেই কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যে ঘটনা হয়তো ঘটার দরকার ছিল না। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে ঘটে সত্য। এ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

    কলেজ জীবনের শেষ দিনে হঠাৎই অনিমেষ এক প্রস্তাব রাখলো সুচেতার  কাছে। প্রস্তাবটা এই যে, আমরা কি সত্যিই দুজন দুজনের জন্য সৃষ্টি হয়েছি, আমরা কি সত্যই একে অপরকে ছাড়া দিনযাপন করতে পারবো না। এমন অদ্ভুতুড়ে ভয়াবহ প্রস্তাবে সুচেতা বাক্যহারা- যেমন সুর না থাকলে বাঁশি সংগীতহারা হয় ঠিক তেমনি  অবস্থা হয়েছে সুচেতার। এর পরের প্রস্তাবটি আরো ভয়াবহ। আমাদের ভালোবাসার পরীক্ষাতে আমরা ছয় বছর দেখা করবো না একে অপরের সঙ্গে। আমাদের বুঝতে হবে আমরা একে অপরের অভ্যাস নাকি সত্যিই আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।

    রাজি হয় না সুচেতা এই প্রস্তাবে।  ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে যেমন চারিদিক লন্ডভন্ড হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে তার মনের ভিতর খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষকে বোঝানো বৃথা তাও জানে সুচেতা। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছে তার হৃদয়ের ভূমিকম্পের কথা, ঝড়ের কথা। বুঝতে পারছে, বুঝতে কি সত্যিই পারছে? না..বুঝছে না। তার জেদের কাছে হারলো সুচেতা। ঠিক হয়েছিল ছ বছর বাদে ঠিক এই কলেজের সামনে ফুল নিয়ে হাজির হবে দুজনে যদি সত্যি ভালোবাসা থাকে। আর যে আসবে না শুধুমাত্র ভালো বন্ধুত্বের খাতিরে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হবে, শুধুমাত্র কেমন আছে তা দেখার জন্য।

    এইভাবে কালের গতিতে একের পর এক বছর কেটে যেতে লাগলো। সেই দিনটা সত্যিই এল। অনিমেষ হাজির একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে। যেটা সুচেতার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়াবার পরেও যখন সুচেতা এলো না,  তখন হাজারটা প্রশ্ন অনিমেষের মনে ভিড় করতে থাকে। নিজেই নিজের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন-উত্তর তৈরী করতে থাকে মনের ভিতর। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় ছ বছর আগে এই অদ্ভুত প্রস্তাব রাখার জন্য। কারণ সুচেতা বারবার তাকে বারণ করেছিল,  কিন্তু সে শোনেনি। হয়তো সুচেতা রাগ করেই তার সাথে দেখা করতে আসেনি। অনিমেষ জানে বড় অভিমানী মেয়ে এই সুচেতা। অনিমেষকে এই রাগ ভাঙ্গাতে হবে। আহত মন নিয়ে কথা মত ইঞ্জিনিয়ার তরুণ-যুবক অনিমেষ একেবারে সুচেতার দোরগোড়ায় হাজির।

    সুচেতার বাবাই খুলেছিল দরজাটা।  ভিতরে ঢোকার পর অনিমেষের মনে হতে লাগলো কোথাও যেন কিছু ঠিক নেই।  সুচেতার বাবাই প্রথম কথা বলল, তুমি বুঝি অনিমেষ। গুরুগম্ভীর স্বরটি শুনতে পেয়ে অনিমেষ ‘হ্যাঁ’ বললো। চোখের জলের দু’ ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে নামতে নামতে নিয়তির পরিহাসের শিকার অভাগা পিতা জানালেন, আজ থেকে একবছর আগেই চলে গেছে সুচেতা। ধরে রাখতে পারলাম না বাবা, ভেবেছিলাম তোমার কাছে যাবো, গিয়ে ওর অসুস্থতার কথা বলবো, কিন্তু সুচেতা কিছুতেই তোমার কাছে যেতে দেয়নি। কি সব শর্তের কথা বলেছিল সে। আমার হাসি খুশি মেয়েটা তোমার নিছক খেলাখেলা শর্তের মুর্খামির জন্য চির বিদায় নিল।  ভালোবাসার পরীক্ষা কি এমন ভাবে হয় অনিমেষ। শুধু একটি চিঠি রেখে গেছে তোমার জন্য।  ও হয়তো জানতো তুমি আসবে।  তাই বলে গিয়েছিল এলে যেন তোমাকে দি।

    অনিমেষের মনে হতে লাগল চারিদিকে যেন ভুমিকম্প হচ্ছে। সুচেতা মিষ্টি হাতের লেখাটা চোখের জলে যেন ঝাপসা হয়ে গেল- ‘খুব কি দরকার ছিল পরীক্ষা নেওয়ার, আমাদের আত্মিক যোগ হয়তো তুমি বোঝোনি, বুঝেছিলাম আমি। আমি খুব জানতাম এক আত্মা কিছুতেই থাকতে পারবেনা আর এক আত্মাকে ছেড়ে। আমি জানতাম তুমি আসবে, কিন্তু তোমার ছেড়ে চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি,  ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো আর থাকা হলো না। তুমি ভালো থেকো।’

    এক একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত বোধহয় শত মাথা খুঁড়ে,  নিজের জীবনকে ঘৃণা করে, নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, বোধহয় হয়না।  সুচেতা হয়তো তার আর অনিমেষের ভালোবাসার পরীক্ষা এই ভাবেই দিয়ে গেল।

  • গল্প

    গল্প- অধিকার

    অধিকার
    -সুদীপা ধর

     

     

    আজ বাসে অন্যদিনের থেকে ভীড়টা একটু বেশি। একটু যেন বেশীই দমবন্ধ করা পরিবেশ। তাই অস্বস্তিটা রাইয়ের একটু যেন বেশিই। ভীড় বাসে মানুষজনের গুঁতোর জন্য নয়, কোনও এক চেনা মুখ দেখতে না পাওয়ার জন্য।

    আলাপ হয়েছিল আজ থেকে পাঁচদিন আগে। আলাপটা ছিল ভীষণই অদ্ভুত। সেদিন বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অহেতুক কথা কাটাকাটি হওয়াতে মাথাটা একটু গরমই ছিল। প্রসঙ্গ ছিল বিয়ে। সবে রাই তার কেরিয়ার শুরু করেছে, তাই এখুনি নতুন কোনো সম্পর্কে বাঁধার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মা তো মা’ই সে যে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে। তার কাছে থিতু হওয়া মানে বিয়েটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যাই হোক সেদিন তর্কাতর্কির ফলে মানিব্যাগটাই নিতে ভুলে গিয়েছিল।যার ফলস্বরূপ বাসের কন্ডাক্টরকে পয়সা দিতে গিয়ে পড়েছিল সে মহাবিপদে। এক অদ্ভুত পরিস্হিতিতে পড়ে মাথা আর কাজ করছিল না রাইয়ের। সে যে কি করবে তা ভাবতেও পারছিল না। কিন্তু কথায় আছে না মন যার পরিষ্কার, ভগবান হয়তো সেই মুহূর্তে কোন দূতকে পাঠিয়ে দেয় উদ্ধার করতে।

                      হঠাৎ করে গম্ভীর গলায় পাশে বসা যুবকটির গলা- ছেড়ে দিন খুঁজে পাবেন না। বাড়িতে বোধহয় ফেলে এসেছেন। এই নিন আমি না হয় দিয়ে দিচ্ছি। ‘না’ বলার কোন যৌক্তিকতা রাই খুঁজে পেল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতিই জানালো। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার যুবকটি আরও কিছু টাকা রাইকে দিয়ে বললো- এটা রাখুন কাজে লাগবে। হাত পাতা ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোন উপায় ছিল না। কারণ বাড়ি ফিরতে হবে যে। ধন্যবাদ কি ভাবে দেবে? ভাবতে ভাবতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পরের স্টপেজে যুবকটি নেমে গেল।

                       যাহ্.. নিজেকেই যেন ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছা হল। এত আহাম্মক সে কবে থেকে হল। ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা, মুখের দিকে তাকিয়েও দেখলো না যে এত বড় একটা বিপদ থেকে তাকে বাঁচালো। না দেখতে পাওয়ার একটা চিনচিনে কষ্ট বুকে নিয়ে পরের স্টপেজে রাই নেমে গেল।

                        পরের কটা দিন শুধু একবার তাকে দেখতে পাওয়ার বাসনা। শনি ও রবিবারটি তার মনোকষ্টেই কাটলো। এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল ওই গলাটির স্বরের মধ্যে। সেই আকর্ষণকে উপেক্ষা করা খুব শক্ত। সেই আকর্ষণের সুর মূর্চ্ছনা সেই দিনের সেই ক্ষণটুকুতে এতটাই বেষ্টন করে রেখেছিল যে মানুষটাকে না দেখেই তার গলার স্বরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তার দৃঢ়চেতা বাচনভঙ্গির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।কথাতো সে বিশেষ বলেনি, অথচ কি টান ওই কটা কথার মধ্যে।

                           আজ আবার যথারীতি অফিস যাওয়ার হুড়োহুড়ি। আবার সেই চেনা ছক। আজকে যথারীতি বাসে উঠে সিট  পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চোখ যে ঘুরছিল সেই মানুষটির উদ্দেশ্যে। একবার শুধু তাকে  দেখার জন্য মনটা করছিল ছটফট। কিন্তু না আজও তাকে দেখেতে পেল না। এইভাবে দু- দু’টো মাস পার হয়ে গেল।

                         হঠাৎ করে সেদিন ভিড়  বাসে, মানুষের গুঁতোর মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠলো, ভালো আছেন ম্যাডাম। ব্যাগ আনতে ভোলেননি তো আজকে। মাথাটা  ভনভন করে ঘুরতে লাগল যেন, কোথায় আপনি? বাসের মধ্যেই রাই লজ্জার মাথা খেয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করলো।আরে, এই যে রডের পাশে। রাই বাচ্চাদের মতন চিৎকার করে বলে উঠলো, কোথায় ছিলেন এতদিন দেখতে পাইনি। রোজ খুঁজেছি আপনাকে, ধন্যবাদটুকু পর্যন্ত দিতে পারিনি।  চলন্ত বাসে এই এতো অচেনা মানুষ শুনছিল এই দুই অচেনা মানুষ দু’টির কথোপকথন। কিন্তু এদের দুজনের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই ভাবেই আলাপটা বেড়ে গেল আস্তে আস্তে। রাই এই সম্পর্কের ভিত্তি গড়তে একটু বেশি উদ্যত হয়েছিল।  অর্ণব কোনোদিন বুঝতে পারেনি রাই তাকে এত ভালবাসে। অর্ণব একজন ভাল বন্ধু হিসাবে রাইয়ের সাথে মেলামেশা করতো। এখন আর একমাস দু’মাসের নয় মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে দেখা হয় দুজনের ।

                            এইভাবেই রাইয়ের দিনগুলি বেশ ভালই কাটছিল। একদিন অত্যন্ত সাহস করেই প্রস্তাবটি রেখেছিল রাই…বিয়ে করবে আমায়, আমার হাতটা শক্ত করে সারা জীবনের মতো ধরবে তুমি?

                          সোজাসুজি সপাটে গালে চড় মারার মত উত্তর এলো ‘না’। পৃথিবীটা মুহূর্তে যেন রংহীন হয়ে গেল রাইয়ের কাছে। এত বড় লজ্জা, অপমানিত সে বোধহয় কোনো দিন হয়নি। ‘কেন’ জিজ্ঞেস করাতে অর্ণব যা বলেছিল তাতে রাই তাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিল। জানো রাই আমি তোমাকে বলিনি বাসে করে কোথায় যাই। ডক্টর চেম্বারে রিপোর্ট দেখাতে, আমার যে মারণরোগ। সময় ঘনিয়ে এসেছে, বেশি দিন বাঁচবো না, ধরে নাও বড়জোর এক দু’ বছর। তাইতো ইচ্ছা করলেও তোমায় আমি বাঁধতে পারব না। ভগবান কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।তাই ভালোবাসো, তুমি আমাকে এই কথাটি আর বলো না। আজকের পর থেকে আর এসো না দেখা করতে। এটাই শেষ দেখা।

                        ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল রাইয়ের। ঘোর কাটার পরমুহুূর্তে রাইয়ের উক্তি ওই দুই বছরই আমি তোমার সাথে ঘর বাঁধতে চাই। আমার ভালোলাগার মানুষটার সাথে থাকতে চাই। এটাই ভালোলাগা, এটাই ভালোবাসা। এই ভালোবাসাটুকু আমি হারাতে চাই না। এটা আমার হক, আমার ‘অধিকার’।  রাইয়ের কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যেখানে হেরে গেল অর্ণব। বাকরুদ্ধ হয়ে গাল বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

                        একটি ফুলের ঝরে পড়ার কষ্ট সেই হয়তো বোঝে যে ফুলটিকে ভালোবেসেছে, সেই অর্ণব নামক ফুলটি তাই ঝরে পড়ার আগে রাই তাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চায়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে।

You cannot copy content of this page