• কবিতা

    ঘোষণা

    ঘোষণা
    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

     

     

    শিকারীর বুকে শেষ আঘাতে জাগা,,
    তারপর একে একে যুদ্ধেরা সামিল।
    লড়াইয়ের মাঝে আমি তুমি সকলেই শিকারী …..

    জেগেছিলো ওরা ডান আর বাম বুকে ;
    নিঃশ্বাসের খোঁজে, প্রেমিকার সাজে।
    তবুও বিব্রত চোখে,
    তাকিয়ে শৃগালের মুখোমুখি।
    আমি মরি, সে’ও মরে ভয়ে।

    পিছনে দাবানল, কলম চালিয়ে জ্যোৎস্নায় স্নান সেরে ফিরেছেন কবি, ডাক দিয়ে ভোর!
    নীল আকাশ দেখাতে চায়, ঘোষণা জানাতে চাই তখন কোনো পরিক্ষিত প্রেমিক, সোনার ক্ষেতের পাশে।

    হাজারো জলছবি হাবুডুবু তখন চোখের কিনারে, কেউ আজ- কেউ কাল- কেউ পরশু;
    ঘোষণা জানিয়ে যায় এভাবেই..।

  • কবিতা

    স্বভাব

    স্বভাব
    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

     

     

    কবিতা ১
    যদি বোঝাও তবে বুঝবো –
    নীল কমলের স্বচ্ছলতা,
    গাঙুড়ের ভেলায় বেহুলার জ্ঞান।।

    যদি বোঝাও তবে বুঝবো –
    অজ্ঞানী শুধুই শরীরের ক্ষমতায়,
    সভ্য কেবলই দাঁড়িপাল্লার মাপ।।

    যদি বোঝাও তবে বুঝবো –
    শিকারীর শিকারের খোঁজে,
    মৃত্যু বরণও প্রেম চন্দনে ঘটে।।

    যদি বোঝাও তবে বুঝবো –
    ধূর্ত শৃগাল হঠাৎ মাংসাশী নয়,
    নায্য বাস্তুতন্ত্রের দখলে অন্বিত।।

    তোর জন্য একটা ঘর বেঁধেছি –

    পুঁটলি বাঁধা নিথর দেহের ঘর,
    তারপর একে একে নাড়িভুঁড়ি।
    আরও পরে মেকাপের বসে তারকা।।

    দিনের শেষে –
    নদীর ধারে একলা থাকার ঘর,
    তাল পাতাদের শক্ত করে গাঁথা।
    সন্ধ্যা শেষে দেখা হবে তারাদের দেশে।।

    তারপর একটা –
    দু’বেলা পান্তা ভাতের ঘর,
    ঘুমের স্বপ্নে লন্ঠনের রোশনাই।
    বিষাদের সুরেও সুখের রাজ্যের চেষ্টা ।।

    তারপর না হয় –
    মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনের ঘর,
    নিয়ত হেরেও রাজমুকুটের চেষ্টা।
    লক্ষ্য কাজের হাজার খানেক হয়।।

    অবশেষে –
    স্বপ্ন হবে বৃহৎ অট্টালিকা,
    সুখের মাঝে দুঃখের কিঞ্চিৎ প্রহরী হয়ে।
    অঢেল থেকেও শূন্য খোঁজার দেশে।।

    যদি আমি আরেক পা করে বাড়িয়ে চলি,
    বাড়িয়ে চলি সমুদ্র পথ,
    যেখানে একটা সুর ধরে দিকভ্রান্ত আমি,
    সঙ্গে আমার সহস্র পথিক ….
    তারা মাইল গুনে চলেছে ক্রমশ।।

    যদি সেই পথে হাজির কোনো বাউল কণ্ঠ,
    নক্ষত্রের ভিড়ে প্রতিচ্ছবিরা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অপেক্ষায়।।

    সেই পথেই চিনেছি বহুবার আমাকে,
    দেখেছি বেড়ে ওঠা শামুকের দল,
    হঠাৎ হঠাৎ করে বিষ চেয়ে বসে।
    তারা কিনা পতনের মুখে পড়ে।।

    কোনো সোজা আলোর বিস্তীর্ণ পথ,
    যদি আমি এগিয়ে নিয়ে চলি,
    যেখানে বেঁকে গেলেই বেচাকেনা,
    অন্ধকারের ঘোর।
    হাত চেটে খেতে চাই, সহস্র হিংস্র কদর।।

    সবসময় বাঁচতে নেই।
    কিছু সময় মরতে হয়
    আবার কিছু কিছু সময় মারতেও হয়,,
    – এ অজ্ঞানী ঈশ্বরকে।
    যে ঈশ্বর নিয়ত আমাকে নিয়ে শুধু খেলা করে চলেছে,
    একহাত থেকে অন্য হাতে,
    মোহের বশীকরণে, মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে।।

    যদি উঠতে অক্ষম হয় মাঝেমধ্যেই,
    শক্ত করে পাঁচটা আঙ্গুল আঁকড়ে ধরতে হয়,
    না পেলে একটা আঙুলই আরও শক্ত করে,
    দৃঢ়তার সাথে,,
    কিংবা নিজেরটা নিজেই।

    তারপরেও সন্ধান না পেলে,
    – অস্তিত্বটুকুই অজানা ঈশ্বর।।

    তবুও বেঁচে আছে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে হতবুদ্ধি,
    বেঁচে আছে স্বপ্নের ভেতরের স্বপ্নেরা,
    বদ্ধঘরে জয়ের স্বপ্ন নিয়ে,
    বেঁচে আছে কালজয়ী ত্রাস এ শরীরে।
    মৃত্যুর অপেক্ষায় নয়, বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবো বলে।
    খোঁজার জন্য, অন্য কোনো অজানা ঈশ্বর।।

  • কবিতা

    আমি

    আমি

    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

    কে আমি??
    আমি!
    আমিতো বৃহত্তর প্রশান্তের এক কলস জল,
    তরঙ্গে উচ্ছ্বাসিত চৈতন্য ঘিরে।
    চেতনের পরীক্ষক, আর পরীক্ষারা সামিল,
    এ কলসের সমস্ত গাঢ়তর সমস্যা জুড়ে।।

     

    আমিতো অনতি থরের বুকে জন্মানো ক্যাকটাস,
    অগাধ বালুরাশির কাল পরিমাপক।
    নিত্য পরিচালকের ভূমিকায়, হ্রস্ব দ্বৈতসত্তার মাঝে,
    আমিত্ব বাঁচিয়ে রাখার অভিভাবক।।

     

    আমিতো নীল শূন্যের অখিলে ব্রহ্মের সন্ধানী,
    নিয়ত ভাবের বশে ইন্দ্রজালের ফাঁসে।
    মেঘের ত্রিকোণমিতির আশ্রয়ের খাঁজে চাতকের ভ্রমে,
    পঞ্জিকা উদঘাটনে বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে।।

     

    আমিতো মহামিছিলের জ্ঞানে আছি ধূলিকণা বেশ,
    প্রতিযোগিতার চারণভূমির পিষ্ট স্থান ।
    লড়াই করেছি, অঙ্ক কষেছি কেবল জয় – পরাজয়ের,
    প্রতিশব্দ পেয়েছি, পেয়েছি বহু জয়গান।

  • কবিতা

    চুপ

    চুপ
    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

    চারিপাশটা অন্ধকারের কেউটে,
    কামড় না দিয়েও বিষ ছুঁড়েছে গায়।
    লবনের দাম জিজ্ঞেস কেউ করে, কেউ করেনা,,
    তবুও সংগ্রামের আগে সমাধি পেয়েছে ঠাঁই।।
    আমিতো মরেছি অনেক বছর আগেই,
    অস্তিত্ব শুধু কৃত্রিম সাড়ম্বরে।
    লোভ দেখিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছে দেহ,
    পাতার মতো ঝড়ছে মাথা নেড়ে।।
    আরেকটি বার শপথ বাক্য দিন,
    জন্ম দেবো আমার আমি টাকে।
    সৈন্য সবে অঙ্কে বাজি রাখুক,
    মন্ত্রী কেবল হিসাবটা গুনে রাখে।।
    পতনের পরে প্রাচীনই দোষী হয়,
    বন্দুক ধরে একে অন্যের ঘাড়ে।
    সাবলীল যদি প্রেমের যুক্তি ফাঁদে,
    জ্ঞান পাপীদের শৃঙ্খল টনক নাড়ে।।
    সময়ের অভাব বাস্তুই ভালোবাসে,
    তার চেয়েও আলস্য ফুটপাত।
    হঠাৎ করে জ্যোৎস্নাকে ভালোবেসো,
    পূর্ণিমা দেখাবে তোমায় উল্কাপাত।।
    শুধু ভালোবেসে আজ নিজের শরীরটাকে,
    মোহের গন্ধে অন্ধকারে মরি।
    আজ শহরে শৃগালের মত খিদে,
    খবরের পাতায় শুধু মৃত্যুর দরাদরি।।

  • কবিতা

    উদ্বাস্তু

    উদ্বাস্তু
    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

    চশমার ফাঁকে লেগেছে আজ ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি,
    ধুলো বসা কাদাটে ছোপ।
    হলদেটে আর লালচে বন্ধুরা আজ,
    পেনের কালির সাথে করেছে আরোপ।
    আজ ঘুম ভেঙেছে সবুজ পাতার,
    প্রেমে আজ জমাট বস্তি।
    ব্যাস্ত কুলির আজ হালকা বোঝা,
    ক্লান্ত ফড়িং আজ পেয়েছে বড়ো স্বস্তি।
    বহুদিন পরে আজ আবার মিত্র মিলন,
    সবাই হঠাৎ সাঁকো ধরে হাঁটে।
    বর্ষায় আজ পূর্ণ ভরা কটাল,
    আমাদের শাল নদীও তাড়াহুড়ো করে ছোটে।
    হাজার অপেক্ষার পাত্র চিঠি আজ,
    যানজট বন্ধের মরা টেবিলে।
    ও পাড়ার পরিণত বাস চালকেরাও,
    সকলেই গঙ্গা পারে সাঁতারের কবলে।
    তোমার হারানো তাজাটে গোলাপ ,
    বিরহের দিন খোঁজেনা আর।
    বিকালের চায়ের চুমুকে উদ্বায়ী বাষ্প কথা,
    কেন সন্ধানী হয়গো বারবার?

  • কবিতা

    যাপন

    1. যাপন

    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

     

     

    যে ফুল আমি ফুটায়েছি তোমারি দ্বারে,
    এ প্রার্থনা কেবলই প্রণতির ঠাঁই ধরে।
    শিশু কর্ণ সে হেতু মিথ্যা কেতুর ভালে,
    আজি রজনী পহিল সজনি আসার কালে।

    নিজের দহনে অপেক্ষাকৃত স্বামী,
    কেমনে আসিবে সংসার ফেলে তুমি ?
    যাহাদের তুমি এত কাল কহিছ আপন,
    সে লোক মিত্র সাজিয়া, নিজেরে করিছে গোপন।

    পহিল ফাগুন, বসন্ত একে একে –
    শ্রাবনের বেলায় বিদায় ডেকেছি বাঁকে।
    প্রিয়তমা তুমি, অতীতের মিত্র বলে,
    শত্রু হলেও ,সে প্রেম থাকিত কবলে।

    প্রাতের যুদ্ধ, সন্ধ্যা নামিলে ডাকে,
    অবয়ব খানি, শুধু সংসার বাঁধিয়া রাখে।
    অপারগ তবু, কেমনে রাখিছে বাঁধি।
    মোহিনী বিদ্যায়, নিজেরে করেছি বাদী।

  • কবিতা

    আরেকটা চুম্বন

    আরেকটা চুম্বন
    -সুদীপ ভট্টাচার্য্য

     

     

    পর্ব -এক

    -মাঠে থেকে সবেমাত্র ফিরেছে।
    – শয্যায় শায়িত মা আবারও হাঁপানিতে ধুঁকছে।
    কী করবে সে?
    নিজে জল গড়িয়ে খাবে? না মা’কে দেখবে?
    -কেউ এসে তাকে জল গড়িয়ে দেবে এমন লোকটিও যে নেই। শুধু জল নই, সপ্তাহের দু – একদিন আধ খাওয়া করেই কাটে বরুলের। বর্তমান প্রযুক্তির যুগেও তার চাষ সেই লাঙল দিয়েই চলে। শরীর পুরো “তাল পাতার সিপাহী “-যদিও অবস্থা তার কোনোদিনই এরকম ছিলনা। এখন ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় পুরাতন আর নতুন শোক ওকে দমবন্ধ করে রেখেছে।
    হবে নাই বা কেন?
    -দু বছর আগে,উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার একমাস আগে বাবাটা গেল ডেঙ্গুর প্রকোপে।
    কোনোরকম পরীক্ষা দিয়েই সমস্ত সংসারের চাপ তার ঘাড়ে। – বোন শিমূলের তখন ছয় ক্লাস। সে পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী। তার পড়াশোনাটাও যে চালিয়ে যেতে হবে। আর ও বরুলের একটা হৃদপিণ্ড বলা যায়। ওদিকে মায়ের ওষুধ।
    সমস্ত দায়িত্ব যে এখন ওর ঘাড়েই।
    -কতই আর বয়স, মাত্র উনিশ।
    -যৌবনে পা রাখতে না রাখতেই, সংসারের দহন, মানসিক চাপে ফেলেছিল।
    চাষের জমিটুকু ছাড়া আর তেমন কিছু জানেও না। গ্রামের পশ্চিম পাড়ে বিঘে দেড়, আর গ্রামের ওই পাড়ে কাঠা দশেক মত।
    – আত্মীয় পরিজন বলতে, মামারা ছিল।
    তাদের কাছে সাহায্যের কোনো সংজ্ঞা না থাকায়, বাবাই সম্পর্ক ত্যাগ করে ফেলেছে।
    – এমতাবস্থায় কার কাছে যাবে ও??
    সমস্ত চিন্তা একত্রিত করে,সিদ্ধান্তে উপনীত হয়,
    ” এ জমি চাষ আমার সাধ্যের নয়, আমি বিশুদাকে বলবো বহরমপুরে কোনো একটা কাজের ব্যাবস্থা করতে। ”
    – রীতিমতো বিশুদাকে বলে কাজের ব্যাবস্থা করেও ফেলে। নামকরা মুদির দোকান, মাস গেলে আড়াই হাজার করে দেবে। হিসেবের কাজ।
    এটা ওর মনে একটা জোড় ভরসার সৃষ্টি করে। কিন্তু নানারকম প্রশ্নেরও সৃষ্টি করে –
    -“কেমন কাজ?
    – করতে পারবে কী না?
    – শহরে থাকতে পারবে কী না? ”
    সবমিলিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জট পাকাতে শুরু করে মাথার মধ্যে। আর এমন প্রশ্ন জাগাতো স্বাভাবিক।
    -সে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর গুলোকে গুছিয়ে নিয়ে, নিজের গোছগাছটাও শুরু করে,
    মায়ের কষ্ট দেখে, বোনের ছলছল মুখ দেখে, বুকের মধ্যে একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে রওনা দিল।
    এ যে ভাগ্যের লিখন –
    কলেজ যাওয়ার বদলে জুটল মুদির দোকান।
    – দিনের আট ঘন্টা তাকে দোকানে থাকতে হয়, কেমন একটা হিসেেবী পরিবেশ সারাদিন ধরে। লাভ ক্ষতির অঙ্ক সাতদিনেই একটা তীব্র লড়াই করে ফেলেছে। সে এখন মালিকের ঘরেই থাকে।
    -যাইহোক মানুষতো অভ্যাসের দাস।
    কষ্ট গুলো সহ্য করে ছয় মাস কাটিয়েও ফেলেছিল। দুবার চার হাজার করে টাকা পাঠিয়েছে, বোনের সাথে কথাও হত –
    ওদিক থেকে বিশুদার বাবার ফোনে আর এদিক থেকে শেফালির ফোনে , তবে মাসে দু এক বার।
    – শেফালি!
    হ্যাঁ, বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আগত বহরমপুর নার্সিং কলেজের ছাত্রী।
    ওদের কলোনীর কোনো এক মহিলা মেসে থাকে। প্রায়শই ওদের দোকানেই প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেত।
    – কথায় আছে “গ্রামের মানুষ কোনোদিন গ্রামের মানুষকে চিনতে ভুল করেনা “।
    – শেফালিও চিনতে ভুল করেনি।
    ওর কষ্ট গুলো যে মুখের কোণায় কোণায় ছাপ রেখে বসে আছে, সেটা কিছুদিন যাওয়াতেই স্পষ্ট হয়েছিল।
    – কিছুদিন ধরে একটা ইচ্ছা পোষণ করছিল মনে মনে, আলাপ করার।
    এই শহরের কোনো একটা পরিচয় হয়তো তাকে স্বস্তি দিতে পারে, দিতে পারে দুঃখ ভাগ করার আনন্দ।
    -সেও হয়তো এমন কোনো চাপা দুঃখ নিয়ে এই শহরে হাজির।
    সে ইচ্ছা কিছুদিনের মধ্যেই পূরণ হয়েছিল।

    বরুলের স্বভাব ছিল, প্রতিদিন কাজের শেষে, ল্যাম্পপোস্টের লালচে আলোর সাথে নিজের পরিচয় করানো।গঙ্গার মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগিয়ে শত দুঃখের মাঝে আনন্দ খুঁজে নেওয়া।
    – কোনো এক সোমবারের রাত, বরুল প্রতিদিনের মত হেঁটে চলেছে ল্যাম্পপোস্ট ধরে।
    পেছন থেকে ডাক –
    -“ওই ”
    পেছন ঘুরে তাকালে, একটা অস্পষ্ট লালচে মুখ, সামনে যেতেই হকচকিয়ে বলে উঠল “ও দিদি তুমি ? – আফিস থেকে ফিরছো বুঝি? ”

    এটা ওদের প্রথম আলাপ তাও শেফালির হাত ধরেই।
    – এরপর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল।
    প্রথমে “দিদি “, পরে লাজুক “তুমি “,
    অতঃপর তারা সমবয়স্ক জানতে পারায়, ও এখন শেফালি বলেই ডাকে।
    – আর এই ডাকটিও শেফালির খুব পছন্দের। আস্তে আস্তে ওদের বন্ধুত্ব দৃঢ় থেকে একসময় যে সেটা প্রেমের রূপ ধারণ করবে তারা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারেনি। যতই আত্ম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোক, বরুলের এখন যৌবন। ভালোলাগার রঙ, ভালোবাসার রঙগুলোকে শরীর থেকে মুছতে চাইলেও, মন থেকে মুছবে কেমন করে?
    – সে এখন প্রতিজ্ঞ বদ্ধ প্রেমিক।
    -ছয়মাস মুদির দোকানে কাজ করে, তারপর ওখান থেকে ছেড়ে একটা শপিং মলে কাজের ব্যাবস্থাও করেছে। মাস পেরোলে সাত হাজার করে পাই। ওই টাকায় এখনকার লোকের দিন না চললেও, ও অনেকটাই বিলাসী এখন। শহরের জল, আবহাওয়া, পোশাক -আশাক সব কিছুর একটা চূড়ান্ত পরিবর্তন ঘটেছে এখন।
    -শেফালির সাথে প্রত্যেক রবিবার ওদের প্রিয় পার্ক কুঞ্জকলিতে দেখাও করে।
    বেশ একটা জীবন উপভোগ করছে ও।

    পর্ব -দুই

     

    – সম্ভবত সে বছরেরে সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার।
    প্রত্যেক রবিবারের মত মিলিত হয়েছিল।
    অন্য দিনের মত সেদিন ওরা ইচ্ছা করেই মাঝে কোনো দূরত্ব রাখেনি। কয়েক আঙুলের দূরত্ব। পার্কের মাঝে বিশালাকার দিঘির চারিদিকে প্রচুর রমণ -রমণীর ভিড়। তাদের মধ্যে ওরাও একজোড়া,একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে আছে, কথা চলছে দিঘির দিকে তাকিয়ে –
    প্রচুর ধরনের কথা,
    – প্রান্তিক চাষীর কথা,
    – রবি ঠাকুরের বলাইয়ের কথা,
    -মহেশের কথা।
    আরও অনেক_
    – ঘড়িতে বিকেল ৪:২০, মেঘটাও কালো করে আসছে, বৃষ্টি হয়তো আর একটু পরেই নামবে।
    – হঠাৎ করে,কালো মেঘের সাথে আর হাজারো কথার সাথে, শেফালির কণ্ঠ থেকে ভেসে উঠল –
    “একটা চুম্বন চাই ”
    – সে কণ্ঠ বরুলের কানে প্রবেশ করতেই, তার মনের অতীতগুলো আর নবীন যৌবনগুলোর দ্বন্দ রক্ত প্রবাহের হার যেন বাড়িয়ে তুললো।
    – উপস্থিত হলো হাজারো প্রশ্ন, প্রশান্তীয় ঢেউ যেন বারবার আঘাত করল। নিমেষের মধ্যেই মনে পড়ে গেল শিমূলের মুখ, মনে পড়ে গেল মায়ের স্পর্শ।
    -“এ ভালোবাসার ভাগীদার কাকে করব?”
    নিজেই নিজেকে বোঝাতে উদ্ধত্য হলো, ও যে “নতুন বরুলকে” জন্ম দিয়েছে। সমস্ত ভয় কাটিয়ে, মুহূর্তের থমকানিতে কোমল কণ্ঠে বলে উঠল
    – “তাই ? ”
    – শুরু হলো এক বিশেষ রোমাঞ্চঘন পরিবেশ।
    – বরুলের মনের মধ্যে তখনও প্রশ্ন –
    ” যে কিনা শিশুকাল ছাড়া মাতৃ চুম্বন উপলব্ধি করেনি, সে কিনা কোনো অজানা অচেনা? ”
    তবুও সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বাজি রেখে,
    – দূরত্বের শেষ সীমা পার করে, বরুলের ঠোঁট যুগল মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করলো শেফালির কপালে। সে স্পর্শ অক্সিটোসিনের মাত্রা যেন বাড়িয়ে তুললো সমগ্র শরীর জুড়ে। তবে সে স্পর্শ ছিল কয়েক সেকেন্ডের।
    -একটা থমথমে পরিবেশ জড়ো হয়ে এল,
    – বরুলের ভয়, সেকেন্ডের স্পর্শ ,মোটেও ভালো লাগেনি শেফালির।
    এদিকে ঝিমঝিম বৃষ্টিও নেমেছে।
    “শেফালি যে আর একটু স্পর্শ চেয়েছিল।”
    চেয়েছিল নিঃশ্বাসের উষ্ণতা।
    -র্নিদ্ধিধায় বলে ফেলল শেফালির অকুতোভয় –
    – ” আরও একটা চুম্বন চাই। ”
    বরুলের মেজাজী সুর বলে উঠল –
    “না, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। আমাদের বেরোনো উচিত। ”
    – সত্যিই যেন বৃষ্টির জোড় এসে সেদিন সব থামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পার্ক থেকে বেড়িয়ে দুজনে দুদিকের অটো ধরলো। বরুল যে ওই কলোনিতে আর থাকেনা।
    – রীতিমতো সেদিনও বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায়, আধ ভেজা অবস্থায় দুজন দুজনের বাড়ি ফিরেছিল।
    বরুলের নতুন নিজের ভাড়ায় নেওয়া ঘর, সাথে টিভি, মোবাইল, আধুনিকতার জন্য যাবতীয় সবকিছুই একটা রুমের মধ্যে।
    রুমের চারিদিকের তিনদিকে জানালা। বেশ একটা উন্মুক্ত বলাচলে। দু দিকের ফাঁকা মাঠ। তবে পশ্চিম প্রান্তীয় জানালাটাই সবচেয়ে উন্মুক্ত। তাই, ওটাতেই একটা কেদারা স্হির ছিল। কাজের শেষে এসে, নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে, লাইট বন্ধ করে, জানালার হাওয়া মাখতো। এখন সে নতুন নেশাও করে। তো প্রতিদিন বসার সাথে সাথে একটা করে সিগারেটের বিস্তর টান দিয়ে, রান্নার কাজ সেরে, রাত্রে শেফালির সাথে কথা বলে, ঘুমে যেত।
    – সেদিনও একই ভাবে বসে, জানালার ধারে বৃষ্টির হাওয়া মাখছিল। হাতে সিগারেট ছিল, কিন্তু অর্ধেকটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘ সময় পরে পরে একটা টান।
    – কী সব যেন ভাবছিল।
    তবে সেসব ভাবনা গুলো যে ওকে বিচলিত করছিল, তা ওর চরিত্র দেখে স্পষ্ট।
    হঠাৎ লাইট জ্বেলে, ডায়েরিটা খুলে বসে পড়ল।
    – হাজারো প্রশ্ন,
    ” যা করছি, সেটা কী ঠিক? ”
    ” আমি কেন এমন বরুলের জন্ম দিলাম? ”
    এরকম হাজারো প্রশ্ন, যার উত্তর গুলো প্রতিদিনই অধরা ওর কাছে।
    এরকম প্রচুর প্রশ্ন জমা, ডায়েরির পাতায় পাতায়।
    – কলম টাকে ডায়েরিতে গুঁজে, রান্না ঘরে গেল।
    – রান্নার কাজ শেষে রাত্রের খাওয়া সেরে, একটা কল করেছিল শেফালিকে।
    – “আপনি যে ব্যাক্তিকে কল করেছেন সেটি এখন বন্ধ আছে “।
    – ওপাশ থেকে একটা সুর ভেসে এলো।
    – রাগ হলে যে শেফালির এটা হয়, সেটা জানা ছিল বরুলের।
    -“তবে রাগটা কী জন্য? ”
    – অনেক কথা মাথায় আনার পর ভাবলো, আমার মেজাজটা হয়তো ওর রাগের কারণ।
    – “কিন্তু আমিতো ভালোর জন্যই বলেছিলাম। যাইহোক, সে ঠিক হয়ে যাবে।”
    – এই ভেবে সে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেদিন।

    পর্ব -তিন

     

    – গত দুদিন ধরে শেফালির কোনো খবর পাইনি বরুল।
    এই দুদিনে কয়েকশো বার ফোন করেছে ও শেফালিকে। কোনো সাড়া পাইনি।
    বরুলের মনের মধ্যে আজ হাজার প্রশ্ন আঁকিবুকি কাটতে থাকলো। কোনো কাজেই মন বসেনা।
    ম্লান একটা মুখ নিয়ে সারাদিন।

    – সেদিনই সন্ধ্যায় কাজ সেরে ঘরে ফিরে, ব্যাগ রেখেই ছুটে গেল সেই ল্যাম্পপোস্টের কাছে।
    – “শেফালিকে দেখার আশায় ?
    – নাকি অতীত গুলোকে ফিরে পাবার আশায়?”

    আজ যেন ল্যাম্পপোস্টের লালচে আলোর চেয়েও লালচে, ফ্যাকাসে বরুলের মুখ হয় উঠেছে।
    – কোনো কথা না ভেবেই হেঁটে চলেছে সীমাহীন ভাবে,
    -গঙ্গার পাশে, ল্যাম্পপোস্ট ধরে।
    – স্মৃতির জানালাটা কেউ যেন এসে খুলে চলে গেল ওর সামনে।
    – স্মৃতি গুলো অধরা হয়ে ওর সামনে শুধু ধ্বনি তুলতে লাগলো।
    – শেফালির সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো –
    মুহূর্তের পর মুহূর্ত –
    আর দুচোখ জুড়ে অশ্রু বারি –

    এমন সময় শত অশ্রুর মাঝে, হাজার স্মৃতির মাঝে,
    গঙ্গা আর ভালোবাসার ল্যাম্পপোস্টকে সাক্ষী রেখে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল –
    -” ভগবান কী মোহে পড়েছি আমি?”
    এ প্রশ্ন যেন আজ ওকে কিছু জানান দিয়েছে।
    এই বুকফাটা আওয়াজ আজ সমগ্র জায়গা জুড়ে কয়েক প্রতিধ্বনি জাগালো।
    কোনো হতাশার চাতক পাখি যেমন জলের আশায়, চিত্তের মোহে ধৈর্য্য করে।
    সেই চাতকের আশার জল যেন ওর চোখ দিয়ে ঝড়ছে ।
    – তবে কী সে কান্না শুধু শেফালির জন্য?

    – না, শেফালির জন্য নয়, স্মৃতি রোমন্থনের কোনো এক সময় ওর মনে পড়ে গেছে, গত দু মাস ধরে ওর বাড়ি থেকে কোনো ফোন আসেনি,কোনো টাকাও পাঠাইনি সে।
    শোনেনি শিমূলের কণ্ঠ, পাইনি মায়ের কোনো খবর।
    – আর পাবেই বা কী করে?
    শেফালির মোহে ইতিমধ্যে দুবার নাম্বারেরও পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে।
    মন যে আরও কিছু আশঙ্কার সামনে সামিল।
    -ও যে “শেফালির মোহে মগ্ন ছিল ” বারবার এ কথাটা আঘাত করছিল ওর হৃদযন্ত্রকে।

    -হতচকিতে মুহূর্তের মধ্যেই, পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লিস্টে বিশুদার বাবার নাম্বারটা খুঁজতে লাগলো।
    – কল লিস্ট ঘেঁটে খুঁজে পেলোনা।
    -অনেকদিন হয়েগেছে, সামনে তো আর থাকবেনা।
    – যাইহোক, অবশেষে মনে পড়েছে, সে ওটা ফোনেও সংগ্রহ করে রেখেছে।
    – নাম্বারটা বের করেই, কল করতে লাগলো।
    ওদিক থেকে কোনো সাড়া নেই। মনকে সেদিনের মতো সান্ত্বনা দিয়ে নিজের ঘরে ফিরেছিল।

    পর্ব -চার

     

    – আজ প্রায় দু সপ্তাহ হয়ে গেল। কোনো খবর পাইনি বাড়ীর, কোনো খবর নেই শেফালির।
    – মানসিক চাপ তাকে ক্রমশই গ্রাস করতে শুরু করেছে।
    – কাজেও ঠিকঠাক যায়না আর।
    ওদিক থেকে শপিং মলের মালিকের তলব। এবার ছুটি নিলেই কাজ ছেড়ে দিতে হবে।
    – এ যেন আর এক অন্ধকার বার্তা।
    – “বিশুদার বাবা কী অজানা নাম্বার দেখে ধরছে না?
    – আমিতো পুরনো সিম কার্ড টাও খেয়ে বসেছি। ”
    – দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে,
    ” হে ভগবান, এ কী পরিহাস তোমার? ”

    – সম্ভবত মঙ্গলবার দুপুর, এ কাজটা ওর যাবে বরুল নিশ্চিত।
    – তাই আর কাজে যায়নি।
    – দুঃখ গুলোকে জড়িয়ে ধরে, আধপেটা হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
    – “ওকে ঘিরেই তো ওর মা আর শিমূল বসে আছে। কী করে শহর ছেড়ে ও ফিরে যাবে?
    আর কাকেই বা বলবে তার দুঃখের কথা ?”
    প্রতিদিনের মত আবারও বৃথা চেষ্টার একটা কল করলো বিশুদার বাবাকে।
    – আজ উত্তর এসেছে,
    – “কে? ”
    সমস্ত কথা উজাড় করতে গিয়ে, জড়াজড়ি গলায় বলল ;
    – “আমি, আমি বরুল। ”
    – ” ও, তো এতদিনে আর কার খবর নিবিরে বাবা? ”
    – “কেন ? কী হয়েছে?”
    আজ যেন বিশুদার বাবাও কেঁদে ফেলছে, বলতে গিয়ে।
    – ” তোর মা এখন পুরোপুরি শয্যায়, হাঁপানির চোটে কিছুই করতে পারেনা।”
    – “আর শিমুল?
    ওর পড়াশোনা? ”
    শিমুল নামটা শুনতেই বিশুদার বাবা আঁতকে ওঠে। শত সত্যকে চাপা না রেখে, কিছুটা সত্য ঘেঁষা মিথ্যা বলেই ফেলল।
    – ” ও ভালো নেই রে। গত মাস থেকে টাইফয়েডএ ভুগছে।
    – তোর সাথে কথা বলার জন্য এসেছিল রে। কিন্তু তোর নাম্বারে ফোন যায়নি। ”
    বরুলের ভেতরে আজ অন্তঃসারশূন্যতার অবশিষ্ট আলোও আজ অন্ধকারে । দুচোখ দিয়ে জল অঝোরে ঝরতে থাকে। নিজেকে কী আর বলে বলীয়ান করবে?
    -তার শেষ ইচ্ছা শিমুলও যে অসুস্থ।

    কিছু না ভেবেই সেই রাতে সব গোছগাছ করে রওনা দিল পরেরদিন ভোরের ট্রেনে নিজের ভিটেমাটির দিকে।
    – বাসন্তীপুর,মালদা।
    – ঘড়িতে সকাল ৯:৪৫।
    রংপুর স্টেশন থেকে দীর্ঘ তিন কিমি হাঁটা পথ।
    সেই পথ ধরেই হেঁটে চলেছে।
    – দীর্ঘ দুবছর পর ওর রাস্তা গুলো কেমন যেন সব মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।
    – মনে পড়ে যাচ্ছে , শিমুলকে সাইকেলে করে নিয়ে সারা গ্রাম ঘোরা,
    মনে পড়ছে, সেই পুকুরের সাঁতার,আর পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুলের “দাদা, দাদা ” ডাক।
    মনে পড়ছে সেই বট গাছ, যেখানে প্রতিদিন দোলনায় দোলাতো সে শিমুলকে।
    যতই গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সবাই ওর শহুরে চালচলনের দিকে তাকাচ্ছে।
    বিশুদাকে ও দেখেছিল, কিন্তু বিশুদা মুখ ঘুড়িয়ে চলে গেছিল।

    – অবশেষে বাড়ীর কাছাকাছি,
    -দূর থেকে “শিমুল শিমুল” বলে একরাশ আনন্দের চিৎকার করতে করতে প্রবেশ করলো।
    প্রবেশ করতেই যে দৃশ্যপট হাজির তা থমকে দিল বরুলকে।
    – ছেঁড়া, বিদীর্ণ,ময়লাতে পরিপূর্ণ কাঁথায় মা শায়িত।
    চারিদিকে নিঃস্তব্ধ, বাড়ীর উঠোন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
    – ওপরের চাল ফুটো হয়ে আলোর ছটা ঢুকছে। বৃষ্টির জল ওই ফুটোতে ঢুকে বাড়ির মেঝেতে গর্তের সৃষ্টি করেছে।
    – আর এদিকে মা ধুঁকতে ধুঁকতে বলে উঠলো,
    -” মনে পড়েছে বাবা?”
    – এ যেন কত পরিচিত ডাক, কত দিন শোনেনি এই স্নেহ মাখা সুর।
    মায়ের মুখের সামনে মুখটা নিয়ে গিয়ে বললো –
    “মা, শিমুল কোথায়?
    আমি ওর জন্য অনেক কিছু এনেছি। ওর টাইফয়েডের ওষুধ এনেছি শহর থেকে । এই দেখো – ”
    নিজেই সারা বাড়ি ডাকতে লাগল “শিমুল কই তুই? শিমুল – ”
    – মায়ের মনতো, চাপা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে।
    – “ও তোর জন্য অপেক্ষা করছিল, প্রতিদিন কাতরাতো জ্বরে, আর তোর নাম করতো। জ্বর নিয়েই বিশুর বাবার কাছে গিয়েছিল তোর খোঁজ নিতে। তোকে পাইনি। প্রতিদিন একটাই কথা বলতো।”
    – “দাদা কবে এসে আমার ওষুধ কিনে দিয়ে আমাকে ঠিক করে তুলবে মা? ”
    – “এখন সময় শেষ বাবা, ও আর অপেক্ষা না করতে পেরে বাবার কাছে চলে গেছে। ”
    – মায়ের শব্দ গুলো নিমেষের মধ্যে তাকে হারিয়ে দিল,এর থেকে বেশি শূন্য যে ও এর আগে কোনোদিন হয়নি। শ্রবন যন্ত্রের কর্মক্ষমতা যেন শেষ হয়ে যাওয়ার মতো। চোখের সামনে অন্ধকার এসে মেলে ধরলো। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে, দাঁতে দাঁত লেগে পড়ে গেল মাটিতে।

    পর্ব – পাঁচ

     

    – আজ, তিনমাস হয়েছে বাড়ি ফেরা। এখন মা ওর কাছে সব।সমস্ত শোকগুলোকে চাপা রেখে, চাষের কাজে ব্যস্ত।
    – সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, চারিদিকে টিমটিমে লন্ঠনের লালচে আলো।
    – প্রতিদিনের মতো সেদিনেও মাঠে থেকে ফিরেছে। মা হাঁপানিতে ধুঁকছে।
    হাত পা ধুয়ে নিজের তৃষ্ণা অব্যক্ত রেখে মায়ের তৃষ্ণা ভরা গলায় জল দিয়ে, মাতৃত্ব প্রেমের সবকিছু উজাড় করে কপালে একটা দীর্ঘ স্হায়ী চুম্বন করলো ,
    মায়ের প্রতিটি নিঃশ্বাস, সব অনুভূতি গুলো যেন নিঙড়ে নিচ্ছে,
    আর মনে মনে বলে উঠল –
    ” এটাই হয়তো সেই আরেকটা চুম্বন”।

You cannot copy content of this page