-
গল্প- একজোড়া চায়ের কাপ
একজোড়া চায়ের কাপ
সুনির্মল বসুওয়েলিংটন স্টীটে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বহু বছর ধরে চাকরি করছি। সাজানো সুন্দর অফিস। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। মাইনে কম। কিন্তু অফিসে ঠাট বাট আছে। নামে তাল-পুকুর, ঘটি ডোবে না।
পাঁচ বছর আগে বাটা কোম্পানি থেকে একজোড়া বুট জুতো কিনেছিলাম, বহু ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তার শুকতলা খুলে পড়েছে। চিফ অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার এ নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। সেদিন ছুটির পর চিনা পাড়ায় জুতো কিনতে গেলাম।
জুতোর দোকানের একটু আগে কাঁচের শোকেসের মধ্যে একজোড়া ভারী সুন্দর চায়ের কাপ ও প্লেট দেখতে পেলাম। কাপ এবং প্লেটের গায়ে নীল কারুকার্য করা ড্রাগনের ছবি। তিনশো কুড়ি টাকা দাম চাইলো। তিনশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। জুতো কেনা হলো না, সামনের মাসে মাইনে পেলে দেখা যাবে।
বাড়িতে কাপ দুটি দেখে আমার গিন্নী মিলি তো আনন্দে আটখানা। বাড়িতে অনেক কাপ প্লেট থাকলেও, বিশেষ অতিথিদের জন্য এই কাপ দুটি ব্যবহার করা হোত।
অফিসের বস মিস্টার বিভাস চৌধুরী অনেক দিন আমার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। এবার আমার ইচ্ছে হলো, ওনাকে একদিন বাড়িতে ডেকে চায়ের নেমন্তন্ন করে খাওয়াই। মিলিও এক কথায় রাজি।
পরের রোববার ওরা সস্ত্রীক এলেন। আমাদের ছোট্ট সাজানো ফ্ল্যাট। এই চায়ের কাপের জন্য আমার আজকে মান মর্যাদা বেড়ে গেল। চৌধুরী সাহেব এবং ওনার স্ত্রী বারবার কাপের প্রশংসা করলেন।মিলি আরো সতর্ক। বিশেষ অতিথি ছাড়া ঐ কাপ কখনো বাইরে বের করত না। কেউ বাড়িতে এসে চলে গেলে, অল্প বয়সী কাজের মেয়ে তিলোত্তমা
কাপ দুটিকে ভালো করে মেজে ঘষে, কাঁচের আলমারিতে তুলে রাখতো।তিলোত্তমা মাস ছয়েক ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মেয়েটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শুনেছি, রমেন বলে একটি যুবকের সে প্রেমে পড়েছে। রমেন বাপের পয়সায় মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় রেলা দিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাত সাফাইয়ের কাজও করে। ওর বাবা ভবেশ বাবু বলেন, ছেলে আমার টেকনিকেলে কাজ করে। রাতে ডিউটি। যায় আর একটা ঘটি নিয়ে আসে, যায় আর একটা বাটি নিয়ে আসে। অবশ্য তাতে আমার কি। আমার অফিসের কলিগ শোভনাকে আমার খুব ভালো লাগে। ও আমাকে বিশেষ পছন্দ করে। মনে মনে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল। একদিন ও বাড়ি এলো। মিলি চিনা কাপে ওকে চা করে এনে দিল।
শোভনা কাপের প্রশংসা করতে দ্বিধা করলো না।
আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিলি অবশ্য এই সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানতো না।যাবার সময় শোভনা টেবিলের পাশ গিয়ে বের হতে গিয়ে সামান্য ধাক্কায় একটি চায়ের কাপ ভেঙে গেল।
মিলির খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমারও। তবু যেহেতু ওর প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে, তাই আমি মেনে নিলেও, ও চলে যাবার পর মিলি বলল,
কিরকম চলাফেরা দেখেছো, এতদিনের ভালবাসার জিনিসটা টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।একটি চায়ের কাপ ভেঙ্গে যাবার পর, শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগলো। অফিসের ইঞ্জিনিয়ার সুজিত মল্লিককে শোভনা ভালোবেসে ফেললো।
অফিস থেকে ফেরার পথে বাসের জানালায় বসে আমি ভাবছিলাম, একটা কাপের ভেঙ্গে যাওয়া এবং শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা। নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।
এখন থেকে অন্য কাপে সকাল সন্ধ্যায় আমি চা খাই। সেদিন অফিস থেকে ফিরছি, ফ্ল্যাটের সামনে কেউ একজন মুখে সিটি বাজালো। তিলোত্তমা তাড়াতাড়ি করে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে চা খেতে গিয়ে দ্বিতীয় কাপটার দেখা পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, তিলোত্তমা তার হাতসাফাই প্রেমিকের জন্য কাপটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
পার্কে ওরা যখন কথা বলছিল, থানার ডিউটি অফিসার রমেনকে তাড়া করে। ওর নামে নানা এলিগেশন আছে। রমেন গলিপথে পালিয়ে যায়। এমনকি তিলোত্তমাও চটি খুলে দৌড়ায়।
বেজায় মন খারাপ হয়ে যায় আমার। কতদিনের শখের কাপ। শুনেছি, কাপটা ওখানে পড়েই ছিল।
বীথির মা দেখেছেন।দুই ভদ্রলোক পার্কে এসেছিলেন। ওরা দুজনেই কাপটা ওদের বলে দাবি করেছেন। একজন বললেন, আমি গড়িয়াহাট থেকে একজোড়া কাপ কিনেছিলাম, একটা বাড়িতে রয়েছে, অন্যটা এটি। অন্যজন বললেন, গুল মারবেন না তো, দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিট থেকে বড়দিনের দিন আমি এই কাপ কিনেছিলাম।
এরিয়ার টাফ রংবাজ হাত কাটা শ্যামল এসে বলল- কাপ তোদেরও না, তোদের বাপেদের না, এ কাপ হল আমার। তে’ মাথার মোড়ে বসে আমি এই কাপে চা খাবো, আর আমার ফিয়াসে বুলবুলির সঙ্গে প্রেম করবো।
শ্যামল কাপটা নিয়ে চলে গেল। ওর অপনেন্ট পার্টি তখন গলির মোড়ে পেটো চার্জ শুরু করেছে। শ্যামল পথ চলতি রামনিধি বাবুকে কাপটা দিয়ে দিল। দ্রুত রিভলবার বের করে বিপক্ষ দলের ল্যাংড়া হাবুকে তাড়া করলো।
পরদিন সকালে রামনিধি বাবু আমাদের বাড়িতে মিলির কাছে এলেন। বললেন, এই কাপটা শ্যামল আমাকে কালকে রাখতে দিয়েছিল। মারামারির জন্য আর ফেরত নিতে পারে নি। বৌমা, কাপটা তুমি রেখে দাও।
কাপের প্রতি খুব বিরক্ত এখন আমি।
বললাম, আপনি নিয়ে যান, ওই কাপ আমাদের চাই না।
রামনিধি বাবু বললেন, আমি তো শচীনের দোকানে গিয়ে চা খাই। বৌমা আমাকে চা দেয় না। এই কাপ নিয়ে আমি কি করবো।
কথাটা সত্যি, ভাবতে লাগলাম, তিলোত্তমা কাপটা চুরি করে ওর হাত সাফাই প্রেমিক রমেনকে দিয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে রমেন এবং তিলোত্তমা পালালে, দুই ভদ্রলোক এই কাপের দাবিদার হয়ে যান। যদিও তারা এই কাপের মালিক নন। মানুষের লোভ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
গায়ের জোরে শ্যামল কাপটা কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ও কাপটা ব্যবহার করতে পারেনি। রামনিধি বাবু কাপটা পেলেন। কিন্তু তাঁকে শচীনের দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়, বৌমা চা দেয় না।
আমি হেসে মিলিকে বললাম, ভাগ্যিস, অফিস ফেরত আমি সেদিন কাপ জোড়া এনেছিলাম, নইলে মানুষের এত বিচিত্র চরিত্র দেখতে পেতাম না।
অতিরিক্ত খুশিতে আমি মৌজ করে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, মিলি বলল, এখন সিগারেট ধরিও না। এই কাপে এখনই তোমাকে চা করে দিচ্ছি।
-
গল্প- খাদের অতি নিকটে
গল্প-
খাদের অতি নিকটে
-সুনির্মল বসুট্রান্সফার অর্ডারটা এসেছিল গত সপ্তাহে। কলকাতার অফিস থেকে যখন ওকে ব্যাঙ্গালোর পাঠাবার আদেশ এসেছিল, তখন মহুলের খুব মন খারাপ হয়েছিল। অথচ, হাতে অন্য কোনো অপশন ছিল না। বাবা-মাকে ছেড়ে প্রিয় শহর ছেড়ে যেতে মহুলের মোটেই ভালো লাগছিল না।
ও একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
পরে এমবিএ করেছে।বিকেলে গড়িয়াহাট মোড়ে দিতির সঙ্গে দেখা। ওদের মধ্যে বছর পাঁচেকের সম্পর্ক। শুনে দিতির খুব মন খারাপ।
-কিছু একটা করা যায় না?
-কি করব?
-তুমি তোমার প্রবলেমের কথা জানিয়েছো?
-হু। কিন্তু কোম্পানী শুনবে না।
-তুমি ওনাদের বুঝিয়ে বলো।
-কিছু করার নেই। চাকরিটা ট্রান্সফাররেবল
-এবার কি হবে?
-মন খারাপ কোরো না। প্রতিদিন ফোনে কথা হবে।
-আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।
-তুমি বুঝিয়ে বলো। আমি একটু গুছিয়ে নিই।
-বাবা পুরোনো আমলের মানুষ। কড়া ধাঁচের।
-এক্ষুনি আমি তো কোন উপায় দেখছি না।
-কবে যাবে?
-সোমবার সন্ধে ছটা চল্লিশে ফ্লাইট। ভালো থেকো।
-নিজের খেয়াল রেখো।সেদিন অনেক রাতে নতুন কর্মস্থলে পৌঁছল মহুল। মাকে পৌঁছানোর সংবাদ দেবার পর, দিতিকে ফোন করল- ভালো ভাবে পৌঁছে গেছি। তুমি ঠিক আছো তো?
-হ্যাঁ। আজ তোমার বন্ধু শুভমদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বললাম- তোমার অফিস তোমাকে বদলি করে পাঠিয়েছে।
-শুভমদা বলল, চলো, কফি হাউসের ঢুকি। গেলাম।
-ভালো।
শুভমদা একটা সিরিয়ালে চান্স পেয়েছে। আমায় বলল- টি স্টেটের চাকরিটা ও ছেড়ে দেবে।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ। তুমি এখন কি করছো?
-সবে তো এলাম। ঘর গোছাচ্ছি। সময় লাগবে।
-পেরে যাবে ঠিক।
-পারতেই হবে।
-তাহলে ছাড়ছি। পরে কথা হবে। টা টা।পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল মহুলের। জানালার সার্সির ভেতর থেকে দেখলো,:দূরে ঘুম ঘুম পাহাড়। হালকা মেঘ আকাশে ভেসে যাচ্ছে।
শহরটা সুন্দর করে সাজানো। বাড়ির বাইরে অজস্র ফুলের মেলা বসেছে যেন। তিন তলার উপরে ওর ঘর। সুন্দর বাথরুম। সামনে ঝুল বারান্দা। ঝুল বারান্দার পাশে, পাখিদের থাকবার ঘর। কত রকম পাখি সারাক্ষণ এখানে কিচিরমিচির করে চলেছে।মহুল একটা সিগারেট ধরানো। বাইরে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো, নিচের রাস্তায় অজস্র যানবাহন চলাফেরা করছে।
কাজের মেয়েটি এলো। ঘর পরিষ্কার করলো। তারপর জিজ্ঞেস করল- নাস্তা কিয়া?
-নেহী।
-মেয়েটি চা নাস্তা রেডি করে দিল। বলল, ওর নাম
জানকী।ও চলে যাবার পর, মহুল হোম ডেলিভারির জন্য ফোনে যোগাযোগ করলো। আপাতত কিছুদিন এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে। পরে অন্য যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
পরে ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে বসেই অফিসের কাজ শুরু করলো। কোম্পানী আগামী সপ্তাহে ওর জন্য একটা গাড়ি স্যাংশন করেছে। দুদিন বাদে ও কাজে জয়েন করলো।
রাতের দিকে কলকাতা থেকে দিতির ফোন এলো।
-কি খবর?
-ঠিক আছি। তবে গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।
-আজ আমি তপন থিয়েটারে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।
-বাহ, খুব ভালো কথা।
-আরে, শুভমদার শো ছিল। আমাকে নিয়ে গেল। বলল, তুমি সঙ্গে থাকো। আমি ভরসা পাই।
-তোমার ভালো লেগেছে?
-হ্যাঁ। লোকটা কিন্তু খুব গুণী মানুষ।
-তাই।
-ওর সিরিয়ালটাও ভালো চলছে।
-ওকে আমাকে ফোন করতে বোলো।
বলবো। কাজের পরে কিভাবে তোমার সময় কাটছে?
-এখানে কলকাতার মতো পথে-ঘাটে ভিড় নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। খুব সাজানো এই শহরটা।
-তাই নাকি!
-আমি তো লিখতে পারি না। কিন্তু লিখতে পারলে, দূরের পাহাড়ের বর্ণনা দিতাম।
-কাল তুমি আমায় ফোন করবে।
-ঠিক আছে। ভালো থেকো।
-তুমিও।মহুল কোম্পানী থেকে হ্যারিয়ার গাড়ি পেয়েছে। কোম্পানী ওকে ড্রাইভার দিতে চেয়েছিল, নেয় নি। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে যায়।
কখনো আবার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে যায়।
রাতের দিকে মহুল দিতিকে ফোন করে, -হ্যালো! আজ কোম্পানী থেকে গাড়ি দিয়েছে। তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি।
-দেখে কি করবো? এই শহরে না এলে, চড়া হবে না। কই দেখি?
-তোমার পছন্দ হয়েছে?
-খুব সুন্দর।
-তোমার কথা বলো।
-ঠিক আছি। শুভমদা মন্দারমনিতে যাবার জন্য বলছে।
-তুমি কি বললে?
-আমি কিছু বলিনি। বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে হবে।
-তারপর?
-দমদম থেকে এক পাত্রপক্ষ আমাকে দেখে গেছে।
-তুমি আমাদের ভালোবাসার কথা বাবা মা’কে বলোনি?
-না। তুমি কবে কলকাতায় ফিরবে?
-সবে তো এলাম।
-আজ ছাড়ছি। ভালো থেকো।মহুল মাঝখানে অফিসের কাজ নিয়ে রায়পুরে গিয়েছিল। তিন দিনের জন্য ব্যাঙ্গালোরে থেকে ও আবার নাগপুরে চলে যায়।
ইতিমধ্যে দিতির ফোন আসেনি। কাজের ব্যস্ততায় মহুল ওকে ফোন করবার সুযোগ পায়নি।গত বুধবার রাতের দিকে শুভম ফোন করেছিল।
-হ্যাঁরে, কেমন আছিস?
-ভালো।
-তুই কি চাকরি ছেড়ে দিলি?
-হ্যাঁ। স্টেজে, সিরিয়ালে কাজ করছি। দুটো সিনেমায় কাজের অফার এসেছে।
-খুব ভালো কথা। দিতি তোর অভিনয়ের প্রশংসা করছিল।
-তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তুই ওকে তপন থিয়েটারে নিয়েগেছিলি, আমাকে বলেছে।
-আসলে কি জানিস, ও অভিনয়টা বোঝে।
-ভালো কথা।
-তাহলে ছাড়ছি।
-ভালো থাকিস।হ্যারিয়ার গাড়ি চালিয়ে মহুল অফিস থেকে ফিরছিল। রাতে শহরটা এত মায়াময় লাগে। মন ভালো হয়ে যায়। অফিসে খুব খাটাখাটনি গেছে।
মহুল একটা পাও ভাজির দোকানের কাছে গাড়িটা দাঁড় করালো। তারপর পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা আইসক্রিমের দোকান থেকে কুলফি মালাই কিনলো।
সবে খেতে যাবে, এমন সময় একটা মেয়েরই কন্ঠস্বর ভেসে এলো- অ্যাই মহুল, আমি সুপ্রিয়া বলছি, তাকিয়ে দ্যাখ্।
মহুল বলল- তুই এখানে?
-আমি তো এখানেই চাকরি করি।
মহুল ওর জন্য একটা কুলফি মালাই নিল। বলল- খেয়ে দ্যাখ্। ভালো লাগবে।
সুপ্রিয়া খুশিমনে কুলফি মালাইতে কামড় বসালো।মহুল জিজ্ঞেস করল- এখানে একাই আছিস?
-হ্যাঁ। এদিক-ওদিক বেড়াতে যাস না?
-মাঝে মাঝে। সিরডির সাঁই বাবার ওখানে দুবার গিয়েছি। ত্র্যয়ম্বকেশ্বর মন্দিরে একবার।
-তুই কোথায় উঠেছিস?
-কোম্পানীর দেওয়া ফ্ল্যাটে। আসিস একদিন।
-যাবো। যাক, একজন কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল।
মহুল হেসে ফেলল। বলল- আমারও।
-কি করে সময় কাটাস?
বই পড়ে। তুই?
-লেখালেখি করি।
-তাই নাকি?
-তোর এই গুনটার কথা আগে জানতাম না তো!
-কি করব, সময় কাটাবার জন্য।
-তোর লেখা পড়তে চাই।
-আগামী সপ্তাহে আসবো। তখন তোর জন্য কবিতার বই নিয়ে যাবো।
-ওয়েলকাম।
-থ্যাঙ্ক ইউ। চলি রে।অনেকদিন হয়ে গেল, দিতির কোন খবর নেই। মহুল ভেবে দ্যাখে, ওর স্বভাব ঠিক উল্টো। প্রতিদিন ও দিতিকে মনে করে যায়। দিতি এ কদিনে সব ভুলে গেল? আউট অফ সাইট,আউট অফ মাইন্ড।
সেদিন অফিসে হঠাৎ কলকাতা থেকে একটা ফোন এলো। আয়নাংশুর ফোন। ও হেয়ার স্কুলে একসঙ্গে ছোটবেলায় ওর সঙ্গে পড়তো।
-কেমন আছিস?
-ভালো।
-এখন অফিসে?
-হ্যাঁ।
-চাপে আছিস?
-সেভাবে নয়।
-একটা কথা বলি, দিতির সঙ্গে তোর রিলেশন ঠিক আছে?
-কেন?
-ইদানিং শুভমের সঙ্গে ওর মাখামাখি সম্পর্ক নিয়ে চারদিকে চর্চা চলছে। বন্ধু হিসেবে তোকে জানালাম।
-ঠিক আছে।দুই সপ্তাহ বাদে অফিসে বেয়ারা একটা বিয়ের কার্ড দিয়ে গেল। প্রজাপতি আঁকা ছবি। সাত পাঁকে বাঁধা।
মহুল ভাবলো- দিতি আমার সঙ্গে এমনটা করতে পারলো? বালিগঞ্জ লেক, মেনোকা হলে সিনেমা দেখা, আশুতোষ কলেজের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা বেলায় ফুচকা খাওয়া, গভীর রাতে নিয়ন আলোর নিচে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা। সব মিথ্যে, সবটাই অভিনয়। কিন্তু শুভম। ওর বন্ধু হিসেবে এটা কি করলো?
বিশ্বাস না থাকলে, মানুষ পৃথিবীতে কি নিয়ে বাঁচবে? দিতি একদিন বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। এর চেয়ে বড় মিথ্যে কথা আর কিছু হতে পারে না।
মহুল ভাবলো, জীবনটাকে আমি একটা আর্ট গ্যালারি বানাতে চেয়েছিলাম। ওরা তাতে কালি ছিটিয়ে দিল।
অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই, মহুল বিশ্রী ভাবে গাড়ি চালানো শুরু করলো।
তিনটে ক্রসিং পেরোতেই, সুপ্রিয়া ওকে গাড়ি থামাবার জন্য হাত দেখালো।
-কিভাবে গাড়ি চালাচ্ছিস তুই?
-কেন?
-এভাবে রাফ ড্রাইভিং কি ঠিক হচ্ছে?
ভালো লাগছে না।
-চল্, তোর সঙ্গে যাবো।
-কোথায়?
-কোথায় আবার! তোর বাড়ি।
সুপ্রিয়া গাড়িতে উঠে বসলো।
-আস্তে চালাবি। অফিসে ঝামেলা বাঁধিয়েছিস?
-না তো।
-তাহলে? কিরে চুপ করে আছিস কেন?
-মন ভালো নেই।
-হতেই পারে। তা বলে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাবি? কিছু বল, কথা বলছিস না কেন?
-বিশ্বাস শব্দের কোন দাম নেই।
-কে বলেছে?
-আজ আমি জানতে পারলাম।
-সহজ করে বল। আমি তোর মতিগতি বুঝতে পারছি না। আমার ভালো ঠেকছে না। কি হয়েছে তোর? আমাকে বলা যাবে না?মহুল ফ্ল্যাটের নিচে পৌঁছে গেছে। গাড়ি গ্যারেজ করে বলল- উপরে আয়।
ওরা উপরে এলো।সুপ্রিয়া বলল+ তোর কিচেন টা দেখা।
ডান হাত উঁচু করে মহল দেখিয়ে দিল।
সুপ্রিয়া চা করল। তারপর ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করল।
সামনে খাবার রেখে বলল, খেতে খেতে তোর কথা শুনবো।
মহুলের মাথাটা তখন টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়েছে।
বলল- কষ্ট হচ্ছে।
-আমাকে বল।
-সব কষ্টের কথা সবসময় বলা যায় না।
-তুই তাহলে আমাকে বন্ধু মনে করিস না?
মহুল চুপ করে রইল।
-কি বলবি না তো! ঠিক আছে। আমি যখন তোর বন্ধু নই, তাহলে এখানে আছি কেন? আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আমি চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকলো না।
-সুপ্রিয়া, শোন। চলে যাস না। আমি বলব, সব কথা তোকে বলবো।
সুপ্রিয়া ফিরে আসে। মুখোমুখি বসে।
মহুল বলে- দিতিকে আমি ভালবাসতাম। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। আমি চলে আসার পর আমারই এক বন্ধুকে ও বিয়ে করছে। এই যে বিয়ের কার্ড।
সুপ্রিয়া চুপ করে শুনলো।
বলল- ও আসলে বেটার খুঁজছিল। তুই ওকে ভালবাসতিস। ও তোকে ঠকিয়েছে, তুই তো ঠকাসনি। তাহলে?
মহুল একটা সিগারেট ধরালো। বলল, যে ভালোবাসার আয়নায় মুখ দেখেছিলাম, ওরা সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।
সুপ্রিয়া বলল- এটা এখন ঘটেছে, ভালো। পরে ঘটলে কি হতো?
-জানিনা। কোনদিন ভেবে দেখিনি।
-আমি একটা কথা বলবো?
-বলতে পারিস।
-জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।
-মানে?
-আমি যদি বলি, মহুল, আমি তোকে ভালবাসি। তুই বিশ্বাস করবি?
-আমার জীবন থেকে বিশ্বাস শব্দটা চলে গেছে।
-আমি তোকে সব ফিরিয়ে দেবো।
-কি?
যা যা তুই জীবন থেকে হারিয়েছিস।
-আমার জন্য কেন তুই এসব করতে যাবি?
-ভালোবাসার কাদায় তোর পা ডুবে গেছে, আমি তোকে সত্যিকার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবো।
-কেন ?কেন? কেন?
কোন ভালো মানুষের কখনো দুঃখী মানুষ হওয়া চলে না।
সুপ্রিয়া মহুলের পিঠের উপর হাত রাখলো।
তারপর ধীরে ধীরে বলল-আয়, নতুন করে শুরু করি। ভালোবাসা পাওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। সবার সেটা নেবার ক্ষমতা, দেবার ক্ষমতা থাকে না।মহুলের মনে হল, ঈশ্বর আছেন।
একদিন যে সত্যিকারের বন্ধু ছিল, সে এসে তার বিশ্বাসের হাতখানি, ভালোবাসার হাতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
সহসা ওর মনে হলো, পাহাড়ের খাদের কাছে দাঁড়িয়ে আজ সুপ্রিয়া ওকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। তখন অনেক রাত। ফুল বাগানে কুয়াশা আর শিশির পড়ছে।
গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মহুল বললো- চল, তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিই।
সুপ্রিয়া তখন মহুলের কোলের উপর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল।
মহুলের বাঁ হাতের উপর হাত রেখে বলল- এই হাত আমি কোনদিন ছাড়বো না। কোনদিন না।
-
গল্প- মানুষ মানুষের জন্য
মানুষ মানুষের জন্য
-সুনির্মল বসুসেদিন কলেজের ছুটি ছিল। তাই অন্য একটা কাজ নিয়ে সুধাময় সান্যাল সীমান্ত শহর বনগাঁয় গিয়েছিলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। ব্যাগের মধ্যে কিছু শুকনো মুড়ি ছিল। খেয়ে জল খেয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন।
তাঁকে এই অঞ্চলের পথের কুকুরগুলোও চেনে। তারা এসে ঘিরে ধরেছিল। তিনি স্টল থেকে বিস্কুট কিনে ওদের খেতে দিলেন।
তারপর স্টেশনে এসে পেতে রাখা টানা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাথার কাছে ব্যাগ ছিল। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা পয়সা ছিল। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠতেই, স্টেশনের উলঙ্গ বাচ্চাগুলো এসে বলল- জেঠু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো, আমরা তোমার ব্যাগ পাহারা দিয়েছি।
সুধাময় বাবু ওদের খুব পরিচিত। ওই বাচ্চাদেরও তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।
বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে ওদের বিশাল জমিদারি ছিল একসময়। সুধাময় সব গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন।
ওর স্ত্রী মালবিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় ওদের একটা পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু সে দীর্ঘায়ু হয়নি।
বাচ্চাটা মারা যাবার পর, মালবিকা স্বামীকে বলেছিলেন, এবার আমাদের একটা বাচ্চা এডাপ্ট নিতে হবে।
সুধাময় বলেছিলেন, একটা বাচ্চা ভাবছো কেন, আমি একশো বাচ্চা এডাপ্ট নিতে চাই।
মালবিকা একথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
সুধাময় বলেছিলেন, আমি আমাদের জমিতে ছোটদের জন্য একটা স্কুল বানাবো।
ওনাদের বাড়ির মূল ফটকের পাশে পুরুষানুক্রমে রয়েছে একটি শিব মন্দির। প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যে এখানে ভক্তদের সমাগম ঘটে।
স্কুল করবার কথা জানাজানি হতে, ভক্তদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশেষ গুঞ্জন শুরু হলো।
একজন এসে বললেন, স্কুল বসালে, মুসলমান বাড়ির বাচ্চারা এখানে পড়তে আসবে, পাশে শিব মন্দির, এটা করা মনে হয় উচিত হবে না।
একদল এসে বলল- এ হলো গণ্ডমূর্খ গ্রাম। শুধু শুধু এদের পড়াবার জন্য চেষ্টা করলে, কোন লাভ হবেনা। ওরা কি বড় হয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
সুধাময় শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে ছোটদের জন্য স্কুল গড়তে গেলে, চারিদিক থেকে তার উপর চাপ আসবে।
তিনি বললেন, আমি তো ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে। কিন্তু মুসলমান বাড়ির ছেলেরা এখানে পড়তে আসলে আমার কোন অসুবিধা নেই। ওরা এক সময় আমাদের প্রজা ছিল। সুখে দুঃখে বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে রয়েছি। কেউ জাতপাতের প্রশ্ন তোলেনি। বিপদে-আপদে ওরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে।
অন্য একজন রগচটা তরুণ এসে বলল, দাদা, কাজটা তুমি মোটেই ভালো করছ না। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।
বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর উপর নানারকম চাপ এসেছিল। তিনি গ্রাহ্য করেন নি।
মনে মনে বলেছিলেন, একটাই তো জীবন। খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে চলে যাবো। কিছু নিয়ে আসিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাবো না।
সুধাময় ততদিনে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি হাতে পেয়ে গিয়েছেন। কর্তা গিন্নীর উপার্জনের সিংহভাগ এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ব্যয় হয়।
স্কুলের জন্য কম্পিউটার কিনেছেন, নিজে ভাঙ্গা কম্পিউটার নিয়ে বাড়িতে নিজের কাজ করেন।
মালবিকা স্কুলের নাম দিয়েছেন, সহজ পাঠ। দূর দূর গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে প্রতিদিন পড়তে আসে। বই খাতা পত্র সবই পেয়ে যায়।
সুধাময় বাবু বরাবর একটু অন্যরকম।
নিজেদের জমিদারি একদিন যেমন সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন, এভাবেই শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে,
আজ সহজপাঠ শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ওই অঞ্চলের মানুষ বলে, উনি মানুষ নন। বিলকুল দেবতা আছেন।প্রতিপক্ষেরা বলে, লোকটাকে কিছুতেই দমানো গেলো না।
একটা কাজ শেষ হয়েছে। আবার একটা কাজ শুরু করছেন তিনি। শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে হবে তাঁকে। বয়স বাড়ছে। সময় কমে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান আজও তিনি।
মানুষকে ভালোবাসার কথা তিনি মুখে কখনো বলেননি, করে দেখিয়েছেন।
গতকাল রাতে সন্ধের টিভির খবরে জানা গিয়েছে আগামী ২৬শে জানুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হবে, তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবার ডাক এসেছে।
সেদিন কলকাতায় সুধাময় বাবুর সঙ্গে একটি সাহিত্যের বাসরে আমার দেখা হয়েছিল। ওনার কাজের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। এত বড় মনের মানুষ সংসারে সচরাচর চোখে পড়ে না।
আমি ওনার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। বললাম- ও দাদা, কি করে পারলে, এত মনের জোর তুমি কোথায় পাও?
উনি হেসে বললেন- রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না, কিছু করতে হবে না, শুধু শিকড়টা ছুঁয়ে থাকবি। আমার একটা ছেলে যেদিন মারা গেল, সেদিন আমি আমার গিন্নীকে একশো ছেলের দায়িত্ব নেব বলেছিলাম। আজ সহজ পাঠ শিশু নিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে। ভালো আছি ভাই। এর চেয়ে বেশি কখনো তো কিছু চাইনি। লিও টলস্টয় এর গল্প মনে পড়ে, একটা মানুষের কতটুকু জমি দরকার।
‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাস এ ম্যান রিকোয়ার্ড?’ফিরে এলাম।
মনে মনে বললাম, ভালোবাসার মানুষ থাকলে, ভালোবাসার বাড়ি হয়। মনে ভালোবাসা থাকলে, ছোটদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেবার ইচ্ছে জাগে। সহজ পাঠ শিশু নিকেতন তৈরি হয়।
দাদা তুমি পেরেছো, দাদা, তোমার মতো করে ভাবতে পারলে, দেশে শত শত হাজার হাজার দীপাবলীর রাতের মতো কত আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত।
সংসারের ক্ষেত্রে এমন পবিত্র আলোর মতো মনের মানুষ দেখতে পেলে, গভীর আবেগে হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ ওঠে।
আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। শুধু মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ভাবনার গভীর ডুবে যাই। দু’চোখ জলে ভরে যায়।
পৃথিবীতে অনেক কিছুই মনের মতো নয় হয়তো, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, এত আলো জ্বালিয়ে দেন, তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।
আমি কখনো ঈশ্বরকে দেখিনি। এদেরকে দেখলে মনে হয়, আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই না।
ছোটখাটো চেহারার মানুষগুলোকে তখন আকাশের সমান লম্বা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! আমি ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি।এদের জন্য বড় শ্রদ্ধা জাগে মনে। কত কত দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, চোখের সামনে বারবার একই দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে।
তখন মনে হয়, জীবন আমার ভালবাসায় ভরে গেছে। ঈশ্বর আমাকে ঈশ্বর প্রতিম মানুষ দেখিয়েছেন।
চোখে জল আসে। ঘুরেফিরে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আপনারা এত ভালো কেন বলুন তো?
মনে মনে আমি ওনাকে বললাম, তোমাকে আনত প্রণাম, দাদা।
সেই সঙ্গে মনে হল, আমার এই দীর্ঘ জীবনে চলার পথে অন্তত দু-একজন ঈশ্বর ঈশ্বরীর দেখা পেয়েছি।
যাওয়া আসার পথের ধারে কত মনিমানিক্য পড়ে থাকে, দেখার চোখ থাকলে, জীবনের কোনো বাঁকে ঠিক একদিন ঈশ্বর এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।
-
গল্প-মর্নিং ওয়াক
মর্নিং ওয়াক
-সুনির্মল বসুভোরের কুয়াশায় ঢাকা নদী। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওপারে সূর্যের প্রথম আলো। ওঁরা চারজন এপারে একসঙ্গে হাঁটছিলেন। ভোরের পাখি আকাশের প্রান্তরেখায় ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল। ঘাসের উপরে শিশির বিন্দু। পথের পাশে বনফুলের রং বাহার।
মর্নিং ওয়াক। ভোরের শীতল বাতাস ওদের নাকে মুখে চোখে এসে লাগছিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এভাবেই ওঁরা প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে থাকেন। নদীর পাড়ে পার্কের দিকে বহু মানুষ মর্নিং ওয়াকে আসেন।
ওঁরা সবাই সারা জীবন সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। অবসর নেওয়ার পর নিজেদের মতো একটা অন্য জীবন কাটাচ্ছেন।
ভুবন মুখুজ্জে বলছিলেন, মানুষের মধ্যে যদি বড় হবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসে।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
সন্তোষ দাশগুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ক্যান, কি হইছে?
অনল চৌধুরী বললেন, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই, বুঝলেন ভায়া।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, ইচ্ছাশক্তি শুধু থাকলেই হবে না, সেই সঙ্গে ভাগ্যের একটা হাত থাকা চাই।সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- খোসা ছাড়াইয়া কন।
অনল চৌধুরী দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন- চলুন, অনেকটা হেঁটেছি। গাছের ছায়ায় বসি।
ত্রিদিব সিনহা গল্প শুরু করলেন।
-ভাই, ভোরের আকাশ দেখে সারাদিনটা কেমন যাবে, আগে থেকে ভাবা যায় না। আপনাদের বাটা মোড়ের শ্রীকান্ত সরকারের কথা মনে আছে? ওর ছেলে সবুজ সরকার নঙ্গী স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বরাবর খানিকটা অস্থির প্রকৃতির। দু’ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসতো। বরাবর ফার্স্ট হত।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হ। পলাডার অনেক প্রশংসা শুনছি।
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- সবুজ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা হচ্ছিল। বয়স্ক চাকরিপ্রার্থীরা বাইরে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করছিলেন- ট্রাম কে আবিষ্কার করেন? বলুন না?সবুজ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দিল, মিঃ ট্রেন।
সবাই চমকে গিয়েছিল সেদিন।ত্রিদিব সিনহা বললেন, সেই ছেলেটি জীবনের কোন ক্ষেত্রে কোথাও আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়নি। হারতে হারতে ওর পায়ের তলায় জমি নেই। তাই বলছিলাম, শুধু ইচ্ছা শক্তি বড় হলেই চলবে না, ভাগ্যের সহযোগিতা না থাকলে, জীবনে সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন-হেইডা কেমন কইরা ঘটল, একটু ক্লিয়ার কইরা বলেন।
ভুবন মুখুজ্জে নিজের হাতের স্টিকের উপর মাথা রেখে বললেন- ভেরি স্যাড।
অনল চৌধুরী বললেন- ছেলেটার উপর সবার খারাপ নজর পড়ে গিয়েছিল মনে হয়।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষায় সবুজ ফার্স্ট হয়েছিল। অথচ, ফাইনালে ও কোনো রকমে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে। গোটা স্কুল বাড়ি সেদিন ওর এই শোচনীয় পরিনাম দেখে হতাশ হয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হেরপর কি হইল?
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- অনেক পেছনে পড়ে থাকা ছেলে এইসব পরীক্ষায় ভালো ফল করে চমকে দেয়,
আবার যাদের উপর স্কুল বহু আশা করে বসে আছে, ফাইনালি তারা ওখানে গিয়ে ডোবায়।ত্রিদিব সিনহা বললেন- কলেজে গিয়ে সবুজ সরকার ইকোনমিক্সে অনার্স নেয়। ম্যাক্রো, বেনহাম নিয়ে পড়াশোনা করে। সাময়িক ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। এই সময় ওর জীবনে এষা চ্যাটার্জীর আগমন ঘটে। সেই থেকে ওর জীবনে পতন শুরু হয়।
জীবন মুখুজ্জে বলেন- একটা মেয়ে একজন পুরুষকে শূন্য থেকে উপরে ওঠাতে পারে, আবার তাকে ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনতে পারে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- আইজ কালকার পোলাপানদের পেরেম ভালোবাসার কথা আর বলবেন না, দেখছেন না, গান বানাইছে,তু তু তু তু তুতু তরা। য্যান কুত্তারে বিস্কুট দিতাসে।
অনল চৌধুরী বললেন- তাই নাকি!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- সেদিন আমার মাইয়া শ্রাবন্তী আইছিল, আমারে একখান ফিল্ম দেখাইলো, কি নাম যেন, আমি তোমার কেডা।
জীবন মুখুজ্জে হেসে বললেন- বুঝেছি ‘হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন’।
ত্রিদিব সিনহা কথা শুরু করলেন। বললেন- এষা মেয়েটি প্রেম-ভালোবাসার অভিনয় করে একটা সিএ ছেলেকে বিয়ে করে সল্ট লেকে ভেগে গেল।
অনল চৌধুরী বললেন, তারপর?
ত্রিদিব সিনহা বললেন- সবুজ সরকারের ক্যারিয়ার খতম। অনার্স পেল না। ভালো চাকরি পেল না। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে পয়সা উপার্জন করছে। তাই বলছিলাম, ইচ্ছা শক্তি থাকলে, ভালো ছাত্র ছাত্রী হলেই চলবে না, ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। অথচ, জীবনের শুরুতে কত সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিল ওই ছেলেটা!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- এইসব ডেস্ট্রাক্টিভ মাইয়াগুলোর কথা আর বলবেন না।
অনল চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- ভাগ্যিস, সব মেয়েরা এইরকম নন। ম্যান টু ম্যান, মানুষে মানুষে তফাৎ তো চিরকাল থাকেই।
অনল চৌধুরী বললেন- মেয়েরা সংসারের লক্ষ্মী। ওরা সংসারের সৌন্দর্য। ওরা না থাকলে, পৃথিবী অচল। ওদের মধ্যে ধারণী শক্তি রয়েছে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- আমাগো মা কাকিমা গো কথা একবার ভাইববা দ্যাখেন। আমাগো মানুষ করতে গিয়া ওঁনারা কি না করেছেন! আর এত বছর যে চাকরি বাকরি কইরা আসলাম, তাও তো অগো জন্যই।
জীবন মুখুজ্জে বললেন- সিনহাদা, আপনার কথা মানছি ভাই। সবকিছুর উপরে ভাগ্য একটা ব্যাপার।
ওরা উঠে পড়লেন।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- রোদ্দুর উইঠা গেছে। গিন্নী চা রেডি কইরা বইসা আছে। দেরি করলে, ডালের হাতার বাড়ি মারবো আনে।
অনল চৌধুরী বললেন- দাদা, আপনি বৌদিকে ভয় পান?
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- বৌরে ভয় পায় না, কোন্ হালা?
-
গল্প- অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
সুনির্মল বসুলোকটাকে সব বাচ্চারাই ভারী ভয় পেত। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা একটা বাঙালি শার্ট। পরনে ধুতি। বাঁ হাতে একটা ছোট বাক্স। ডান হাতে সর্বক্ষণ একটা ধূমায়মান সিগারেট। অদ্ভুত তাঁর সিগারেট টানার ভঙ্গি। ছোটখাটো চেহারা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। একটু মোটা গোঁফ। মাথার চুল কাঁচা পাকা হলেও, গোঁফটা একেবারে কুচকুচে কালো।
পথের মোড়ে তাঁকে দেখা গেলেই, সবাই বলতো, অ্যাই পালা, ভগবান আসছে।
সে আসলে পেশায় নাপিত নাম- নরসুন্দর ভগবান দাস। পাড়ার লক্করবাজ চ্যাংড়ারা বলতো, ভগবান দাসের ইটালিয়ান সেলুন। ইটের উপর বাচ্চাদের বসিয়ে ভগবান চুল ছেঁটে দিত। মাথার সামনের দিকে ফুলের মতো
সামান্য বড় চুল রেখে, বাকি পেছনের অংশে সবটাই সে জল দিয়ে হাতের যন্ত্রপাতির সাহায্যে সবটাই চেঁছে দিত।ভগবানের বাড়ি বালিয়াতে। ওখানে ওর বউ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ের নাম দুলারী। হবু জামাইয়ের খেতির কারবার আছে। বড় ছেলে জীবনলাল হাটে সবজি বিক্রি করে। ছোট ছেলে পবনলাল সিক্স ক্লাসে পড়ে। সপ্তাহে সপ্তাহে ভগবান পরিবারের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠায়। সে বছরে দুবার বাড়িতে যায়। তখন সবার জন্য কলকাতা থেকে নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে যায়। দিন পনেরো থেকে আবার এখানে কাজের জায়গায় ফিরে আসে।
যখন ছোট ছিলাম, ভগবান নির্বিচারে আমার চুল কেটে দিত। খুব মন খারাপ হতো আমার। চুল বড় থাকলে, মা বলতেন, তুই বড় চুল রাখছিস, দাঁড়া,তোর বাবাকে বলবো? বড় হবার পর,আমার নিজের বড় চুল রাখবার পেছনে আসল প্রতিবাদ ছিল সেখানেই। কিন্তু সেই ছোট্টবেলায় লোকটাকে খুব সমীহ করতাম।
দুষ্টুমি করলে, মায়েরা বলতেন, ভগবানকে ডাকবো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বেশি বেশি ভাত খেতে হতো।মা হেসে বলতেন, এইতো সবটা খেলি। কার পেট ভরলো, আমার না তোর?
তখন একটু বড় হচ্ছি। ক্লাস এইটে পড়ি। ইটের উপর বসে আছি। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ভগবানকে বলছেন, কেটে ছোট করে দাও। কানের উপর চুল, সখি সখি ভাব, আমার মোটেই পছন্দ নয়। ভগবান মনে মনে খুশি হচ্ছে। চুল ছোট করায় তাঁর বড় আনন্দ। একটু বড় হতেই, চুল কাটতে কাটতে ভগবান আমাদের অনেক নীতি শিক্ষা দিত।একদিন আমাকে বলল, বাবু, জীবনে ঘোড়ার মতো হবে, কখনো গাধা হবে না।
-কেন?
-সোসাইটিতে গাধার কোন মান সম্মান নেই। হ্যাঁ, যদি ঘোড়া হতে পারো, তাহলে লোকের কাজ থেকে রেসপেক্ট পাবে।বাংলায় কথা বলবার সময়, ভগবানের ডায়লগে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে আসতো। তার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। বাটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মিঃ বারতোস থেকে শুরু করে মিঃ ওয়াটসন, মিস্টার চিচেক ভ্যালেন্টা, মিঃ ভেরোল, মিঃ লেডেন, মিঃ জন বেক, মিঃ ভবতোষ সেন চৌধুরী, মিঃ ভি, লিপনার, সবাই চুল, দাড়ি কাটবার জন্য ভগবানের শরণাপন্ন হতেন। ভগবান তখন সাহেবদের বাড়ি উপস্থিত হয়ে তাঁদের চুল দাড়ি কামাতেন। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ ভগবানের মুখে উচ্চারিত হতো। মুড ভালো থাকলে, ভগবান তাঁর ছেলেদের গল্প শোনাতো। বড় ছেলে বেশি লিখাপড়া করেনি। ছোট ছেলেকে শেষ পর্যন্ত লিখাপড়া করাবার ইচ্ছে ভগবানের।
দিন বদলে গেল। সত্তর দশক এলো। যাদের এক সময় চুল কেটেছে ভগবান, তারা বড় হয়ে গেল।
কলেজে পড়তে গেল। কেউ কেউ মস্তান হিসেবে পরিচিত হলো।হেবো মাস্তানি করে পয়সা করলো। তাঁর কোমরে দেশি পিস্তল সব সময় গোঁজা থাকে। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রিভলবার নাচায়। সে এখন এই অঞ্চলের ত্রাস। একলা পুলিশ তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না। ওসি সুবর্ণ সরকার একদিন জীপ থেকে নেমে বলেছিলেন- বড্ড তেল বেড়েছে দেখছি তোর। খুব জলদি তোকে তুলে নেব।
হেবো রিভলবার নাচিয়ে বলেছে- আগের ওসিও ওই এক ডায়লগ দিয়েছিল। আমার সামনে কোনদিন খাপ খুলতে পারে নি।
একদিন হেবোর সঙ্গে মুখোমুখি ভগবানের দেখা।ভগবানের ঘাড়ে হাত রেখে হেবো বললো- কেমন আছো গুরু?
ভগবান ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললও-তোর বাপ আমাকে দাদা বলে ডাকে, ছোটবেলায় আমাকে দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতিস, এখন আমাকে গুরু বলছিস? আচ্ছা, কলিকাল!দেশে অস্থিরতা শুরু হল। কোম্পানি ছোট হয়ে আসছে। কর্মীদের ছাটাই করে দেওয়া হচ্ছে। চুল দাড়ি কেটে নিজে খেয়ে বাড়িতে আর টাকা পাঠানো যায় না। খুব বিপদে পড়ে গেল ভগবান।
তারপর একদিন আমাদের মফস্বল শহর ছেড়ে নিজের দেশের বাড়িতে চলে গেল। আমরা কেউ ভগবানকে মনে রাখি নি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চায়ের ঠেকে ভগবানকে নিয়ে আলোচনা হতো। তারপর স্মৃতির পাতা থেকে ছোটবেলার সেই ভয় পাওয়া মানুষটাকে আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম।
বেশ কয়েক বছর পর আমি তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বালিয়াতে ব্রিজ বানাবার কাজে গিয়েছি। অনেকদিন ধরে কনস্ট্রাকশন এর কাজ চলছিল। একদিন হঠাৎ দেখি, ভগবান রাস্তা ধরে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। ওর পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে ছেঁড়া চটি। পরনে ময়লা পোশাক। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
ভগবান আমাকে চিনতে পারেনি। আমি চিনতে পেরেছিলাম। সামনে গিয়ে বললাম- ভগবানদা, কেমন আছো তুমি?
-ভালো নেই। বউ মারা গেল। ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে হাওয়া।
-আমাকে চিনতে পারছো?
-হা হা। তুমি ফোরম্যান দত্ত বাবুর ছেলে।
– তোমার সংসার কিভাবে চলে?
-হাত কাজ নাই। কাজ করবার সামর্থ্য নাই। বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। ভগবানের কন্ঠে অসহায়তার সুর। আমার মনে পড়লো, সেই ছোট্টবেলায় আমরা সবাই এই মানুষটাকে দেখলে, ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যেতাম।-তোমাকে কেউ দেখে না?
-মেয়ে দ্যাখে।
ছেলেরা?
-আরে না না। আমি ছেলেদের পড়ালিখার জন্য পয়সা খরচা করেছিলাম। মেয়ের জন্য কিছু করিনি। আমি চারটে পাঁচশো টাকার নোট ভগবানের হাতে গুঁজে দিলাম।ভগবান বললো- আমার কথা মনে আছে তাহলে! তুমি ঘোড়া হয়েছো, ভাগ্যিস গাধা হওনি! তারপর খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির দিকে গলির প্রান্তে মিলিয়ে গেল। সেই শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ আজ আমার সঙ্গে কেমন আশ্চর্যভাবে আমাকে দেখা দিয়ে গেলেন। সেদিনের ভগবানের আশ্চর্য দাপটের সঙ্গে আজকের মন ভেঙ্গে যাওয়া মানুষটার কিছু মাত্র মিল, আমি দেখতে পেলাম না।
মহুয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি জীবনের প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হলাম। সময়, কাকে যে কিভাবে জীবন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না।
ভগবান গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতেই, আমি কেমন ঘোরের মধ্যে নিজের মনে বলে ফেললাম, ভালো থেকো, তুমি ভালো থেকো, ভগবানদা।তারপর মনে মনে আবার বললাম, তোমাকে ভালো থাকতেই হবে, তা না হলে, তোমরা চলে গেলে, আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সেই সঙ্গে চলে যাবে যে!
-
গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা
সোনার সিঁড়িতে পা
-সুনির্মল বসুতখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশিরের শব্দ, মাঠে মাঠে কাশফুল, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেলা, দীঘির জলে শাপলা শালুক, নদীতে ভেসে যাচ্ছে গায়নার নৌকো। উদাসী প্রকৃতি। বাতাসে বাজছে উৎসবের সুর।
তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন।
গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।
মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।
অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।
মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।
অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।
ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।
একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।
গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।
এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।
জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।
একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।
অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।বিশ্বরূপ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।
জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাবসলিউটলি,নট।
দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।
সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।
-
কবিতা- কথা ছিল না
কথা ছিল না
-সুনির্মল বসুগভীর রাতে সরল বস্তি কাঁদে, গভীর রাতে যে মেয়েটি একলা ঘরে ফেরে,এ শহর তাঁর দিকে কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি,
গভীর রাতে যে বেকার যুবক চাকরির সন্ধান করে একবুক হতাশা নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরেছে,এশহর তাঁর ফিরে
চেয়ে দ্যাখে নি,গভীর রাতে চাঁদ, নীহারিকা মন্ডল চেয়ে দ্যাখে,
গভীর রাতে কেঁদে ওঠে ক্ষুধার্ত শিশু,
পথেই লেখা হয় যাদের জীবনলিপি,গভীর রাতে বাতাস কাঁদে, নদী কাঁদে,
আকাশ ও সমুদ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,
কারা কেড়ে খায় শিশুর খাবার,কারা ভোগের মধ্যেই করছে জীবন কাবার,কারা পৃথিবীতে আনছে দূষিত বাতাস,
তাদের চিহ্নিত করো,বলো,এ দেশ আমার,
এ দেশ নয় তো লুটের খামার,এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,
ছদ্মবেশীদের চেনো,শোধ করো জন্মভূমির ঋণ,প্রাসাদের নীচে কেন বস্তি,কেন জীবন হারিয়েছে স্বস্তি,কারা প্রতিদিন আকাশকে করছে কালো,
দেশে কতজনের হয়েছে ভালো,তাদের চিহ্নিত করো,
চোর সাধুর ভেক ধরেছে কেন,সুন্দর আকাশ একদিন আমরা আনবোই,
এই সত্যটা জেনো। -
রম্য- মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
–সুনির্মল বসুআমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক আছেন, সব সময় তিনি ভুল ইংরেজিতে কথা বলেন। অথচ, মাতৃভাষায় কথা বলায় তাঁর প্রবল বিরক্তি। প্রায়ই বলেন, বাংলা ভাষাটা আমার ঠিক আসে না। পথে দেখা হলে, জিজ্ঞাসা করেন, তারপর, সব ভালো তো। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে, এর পরেই বলেন, ঘড। আসলে, উনি যে গুড কে ঘড বলেন, এটা বুঝে নিতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।
পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ভদ্রলোক ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সব সময় ইংরেজিতে ঘড বলে থাকেন। ইংরেজরা এ দেশ থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন, ইংরেজিয়ানা যায়নি।
একটি খ্যাতনামা জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে আমার বাড়ি। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্ত্রীরা অনেকেই বলেন, আমাদের উনি ম্যানেজার হইছেন।
ম্যানেজার, সোল পুটিং ডিপার্টমেন্ট।পাড়ার বখাটে ছেলেরা বলে, ম্যানেজার, কথাটার ব্যাসবাক্য সহ সমাস কি হবে বলো তো?
নিজেরাই উত্তর দেয়, এরপর। বলে, মানে নেই যার।পূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো।মিসেস চৌধুরী দরোজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।
মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি?
শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন!
মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি?
এই সময়ের জন্য তৈল একটি অতি মূল্যবান বস্তু। আমার ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া বন্ধু জগন্ময় বাটা কোম্পানির এক ম্যানেজারের গাড়ি ধুয়ে এবং বাজার করে দিয়ে, বর্তমানে ম্যানেজার হয়েছে।
এখানে কর্মীদের সপ্তাহে বেতন। প্রোডাকশন বেশি হলে, খুশি হবার কথা।
কিন্তু আমার বন্ধুটি এই ঘটনায় রেগে যায়। কারণ, কর্মীদের একেক জনের সাপ্তাহিক বেতন কি হবে, সে অংকটা জগন্ময়ের জানা নেই।
আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী!
বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রম গুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন?
সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতা ওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।
অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই।কাকু বললেন, পুনশ্চ,
এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।
একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো?
কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম।আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।
মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়।
ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি!দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার।
মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে। কোলে মার্কেটে কিংবা মানিকতলার বাজারে এত চিল চিৎকার নেই।
সাহিত্য সাধনা কাহাকে বলে!
আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই।
ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি!
জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন?দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।
এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই!
বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।
মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে
লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে ,লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন?একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে, স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন?
বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়?মনের দেউলিয়া পনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।
ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।
অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তার পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।
আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
দূর্গা পূজার বিসর্জনের সময় কেপে কেঁপে নাচ আর ক্ষেপে ক্ষেপে গানের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতিক গরম মশালা পরিবেশন করা হয়। মুখোমুখি চারটে মাইকে চার রকম হিন্দি গান। কোনটার কথাই বোঝা যাবে না। এই না হলে পুজোর আনন্দ!
সরস্বতী পূজার সময় প্যান্ডেলের ঠাকুরের চেয়ে রাস্তার সরস্বতী দেখার জন্য তরুণ তুর্কিদের হামলে পড়া। সে ভারী দেখার মতো দৃশ্য!
আমাদের পাড়ার টোকনদা পড়াশুনোয় চতুর্থ শ্রেণীর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন, ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনি সব সময় ইংরেজী কাগজ বগলে নিয়ে ঘোরেন। রোববার সকালে দেখি, উনি শচীনের চায়ের দোকানে বসে আছেন। চোখ ইংরেজী কাগজের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কাগজে কি লিখেছে টোকনদা?
তিনি উল্টো করে কাগজ ধরেছেন।
maruti suzuki র অ্যাড ছিল। বললেন, গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে। চাকা উল্টে গেছে।আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাস পণা।শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আরকি!
আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে?
ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি!সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।
এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে!
-
গল্প- কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
-সুনির্মল বসুঝাউবন পেরিয়ে সামনে নীল সমুদ্র। রঞ্জনা বিয়ের পর এই প্রথম স্বামী অনিকেতের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
সামনে ধূ ধূ বালিয়াড়ীর ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
অনিকেত রঞ্জনার হাত ধরেছিল। বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে রঞ্জনার শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছিল।
অনিকেত কম কথা বলা মানুষ।
রঞ্জনা বলল, কি মশাই, একেবারেই চুপচাপ যে,
অনিকেত বলল, সমুদ্র দেখছি, বড়র সামনে এলে,
মুখে ভাষা আসে না।
রঞ্জনা বলল, সমুদ্র কত পুরাতন, কত নতুন,
আমাদের আগে কত মানুষ এখানে এসেছে, কত মানুষ ফিরে গিয়েছে, সমুদ্র একই রকম আছে।
অনিকেত বলল, আমরা একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, সমুদ্র থাকবে।
রঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, দূর সমুদ্রের ধারে কিছু
নুলিয়ারা একটি দাঁড়িয়ে থাকা নৌকোর পাশে ব্যস্ততার সঙ্গে নিজেদের কাজ করে চলেছে।
সমুদ্রের পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে এলো।
তখন পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠে একটা ডাক এলো, এই অনিকেত,
পেছন ঘুরে অনেকেত দেখল, রিমঝিমকে। সঙ্গে একজন সুদর্শন যুবক।
রিমঝিম পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাসবেন্ড
পার্থ, আর এ হোল, অনিকেত। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু।
অনিকেত রঞ্জনার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।
অনিকেতের মনে পড়ছিল, এই সেই রিমঝিম, যে একদিন ওকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। পরে অনিকেত জানতে পেরেছিল, বাবার মনোনীত বড়লোক পাত্র পেয়ে, তাকেই বিয়ে করেছে রিমঝিম।
ভালোবাসা আজকাল বড় সস্তা হয়ে গেছে। আর অনিকেত অংক করে ভালবাসতে শেখে নি।
সেদিন কত কথা ছিল ওদের।
কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, গোলদীঘির পাড়ে প্রতিদিন দেখা হতো ওদের।
রিমঝিম বলেছিল, তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো, অনিকেত।
কী মিথ্যে, কী মিথ্যে,
সেদিনের রিমঝিমের সঙ্গে আজকের এই সুখী রিমঝিমকে একটুও মেলানো যায় না।
রিমঝিম সত্যিই কি সুখী হয়েছে। নাকি, সুখে থাকার অভিনয় করছে। একটা মানুষের কত অসংখ্য মুখ থাকে।
আজকে ওই ভালোবাসাকে প্রবলভাবে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, অনিকেতের।
রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছো,
রঞ্জনা বলল, হোটেল তরঙ্গমালায়। আপনারা একদিন আসুন না।
পার্থ বলল, যাবো কাল সকালে,
অনিকেত চুপ করে ছিল। ও কিছুতেই রিমঝিমকে আর সহ্য করতে পারছিল না।
তখন আকাশে একটি দুটি তারা ফুটেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। পার্থ রিমঝিমকে বিদায় দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।
পরদিন রিমঝিম স্বামী পার্থকে সঙ্গে করে, অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতে এলো।
রিমঝিম বলল, কবে বিয়ে করলে, জানাওনি তো,
অনিকেত বলল, চাকরি পাবার বছর তিনেক বাদে
বাবা মা বিয়েটা দিলেন।
ও, ভালো, তোমার বউ তো খুব সুন্দরী হয়েছে।
আমি একটা সুন্দর মন খুঁজেছিলাম,
পার্থ তখন টিভি চালিয়ে খেলা দেখছিল।
রঞ্জনা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল।
রিমঝিম বলল, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছো না কেন, অনিকেত। দেখছি, আমার উপর থেকে তোমার রাগ এখনো পড়েনি।
অনিকেত জবাব দিল না।
রিমঝিম বলল, কি, আমার কথার উত্তর দেবে না,
অনিকেত বলল, আমি সত্যিকার ভালোবেসে ছিলাম, আমি কাউকে ঠকাইনি। যে ভালোবাসা নিয়ে একদিন খেলেছিল, সে ঠকেছে।
রঞ্জনা ওদের মিষ্টি ও কফি পরিবেশন করলো।
বলল, ওর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি, রিমঝিম।
এ কথার কোন উত্তর দিল না রিমঝিম। মনে মনে অনুভব করল, সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে,
একদিন সেই ভালোবাসার জন্য কাঁদতে হয়। সেদিনের জয়, আজ এত পরাজয়ের বার্তা এনে দেবে, রিমঝিম কোনো দিন সে কথা ভাবেনি।
মিষ্টি কফি খাবার পর, পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে
শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করছিল।
একসময় ওরা বিদায় নিল। যাবার আগে, পার্থ অনিকেত আর রঞ্জনাকে ওদের লেকটাউনের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্ন করেছিল।
গভীর রাতে, রঞ্জনা বলল, রিমঝিমের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে,
অনিকেত বলল, একেবারে না। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু গোপন করিনি।
রঞ্জনা বলল, ভালোবাসা আর ঘৃণা পাশাপাশি থাকে, দেখলে, রিমঝিম তোমাকে দেখাবার জন্য কেমন পার্থকে নিয়ে ঢলাঢলি করছিল।
অনিকেত বলল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ভালোবাসা দেখাবার জন্য এমন আদিখ্যেতা দেখাতে হয়।
রঞ্জনা বলল, ওদের বাড়ি লেক টাউনে একবার যাবে নাকি,
অনিকেত বলল, কক্ষনো না। রিমঝিম শুধু আমার বিশ্বাস ভাঙ্গেনি, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে খেলা করেছে,
বিকেল বেলায় ওরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মোহনার কাছে অনিকেত আর রঞ্জনা চলে এসেছিল।
বিশ্রামের জন্য ওরা একটা দেবদারু গাছের নিচে
দাঁড়ালো। রঞ্জনা দেখলো, ওদের পায়ের কাছে অনেক লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল কাঁকড়া গুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, আবার গর্তে ফিরে যাচ্ছিল।
তা দেখে অনিকেত বলল, সবাই ঘর খোঁজে, ভালো ঘর, ভালোবাসার ঘর খোঁজে কজন,
রঞ্জনা বলল, যত বড়ই ঘর হোক, ভালোবাসা না থাকলে, সে আবার ঘর কিসের,
সমুদ্রের উতরোল ঢেউ এসে, ওদের দুজনের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল। -
গল্প- অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
-সুনির্মল বসুতখন তাঁর ভয়ংকর ব্যস্ততার দিন।
সারাদিন স্কুল করবার পর, অনেক সময় খাবার সময় জোটে না, তাঁকে এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে বেড়াতে হয়। যাতায়াতের জন্য সাইকেল একমাত্র ভরসা।
সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাচ পড়িয়ে সুদিন বাবু সবে দ্বিতীয় ব্যাচ পড়াতে শুরু করেছেন, গিন্নী জয়ার ফোন।
তুমি কোথায়?
স্টেশন রোডের কাছে, পড়াচ্ছি তো!
একবার একটু এখানে আসতে পারবে?
কোথায়?
জয়দেব দার দুর্গা বাড়িতে।
কেন?
এসোই না, তখন বলবো।
ছাত্রদের টেস্ট পেপার থেকে কাজ দিয়ে সুদিন বাবু
ওখানে উপস্থিত হলেন।
সন্ধ্যেবেলায় আরতি পর্ব চলছিল। প্রচুর ভক্তদের ভিড়।
জয়া বললো, এসো।
জয়দেবদা, সুদিন বাবুর হাতটা দেখতে চাইলেন।
অনেকক্ষণ দেখার পর বললেন, আজ কিছু বলবো না। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই,আপনি পরে একদিন আসুন।
সুদিনবাবু ফিরে গিয়ে পুনরায় ছাত্র পড়াতে বসলেন।
কদিন বাদে সময় বের করে দুর্গা বাড়ি গেলেন।
জয়দেবদা বললেন, আপনার তো এখানে জন্মাবার কথা না!
মানে?
আপনি তো বিরাট বড় বাড়ির লোক মশাই।
কি বলছেন?
আপনার তো বিরাট বাড়ি। বিরাট প্রজামহল। সবাই আপনাকে খুব মান্যতা করে।
দাদা, আমি খুব সামান্য মানুষ। দেখছেন না, সারাদিন দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
কি করে হবে?
আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলবো। সেটা করতে পারবেন? তাহলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।তিনি কানে কানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বললেন। বললেন, কাউকে বলা যাবে না কিন্তু! আজ রাতেই করুন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
সুদিন বাবু টিউশনি পড়াতে ঢুকলেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথার মধ্যে নেননি কখনো।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি যখন শুতে গেলেন, তখন জয়দেব দার গোপন প্রক্রিয়াটার কথা তার মনে পড়ল।পরীক্ষার ছলে তিনি সেটি করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর এমন ঘটনাই স্বাভাবিক।
ঘুমের মধ্যে খানিকটা সময় বাদে জিনিস দেখলেন, তিনি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে চাইছেন। দেখলেন, প্রচুর সবুজ গাছপালা। একটা বড় রাজপ্রাসাদের মত সাদা বাড়ি। বড় বড় জানালার উপর লাল রঙের সেড দেওয়া। বাড়ির বিশাল বড় গেট। সুদিন বাবু দৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। দেখলেন, বড় একটি আম গাছের নিচে এক ভদ্রলোক হলুদ ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জমিদারী স্টাইলের পাঞ্জাবী ও ধূতি। পায়ে সাদা রঙের চটি।
সুদিন বাবু ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে চাইলেন।
ওনার পাঞ্জাবিটা ঘাড় থেকে সামান্য নেমে এসেছে।
পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সুদিন বাবু বিভিন্ন সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাষণ দিতে যান।
বক্তৃতা দেবার সময় বারবার জামার কলারে হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হচ্ছিল, ওনার পাঞ্জাবিটা উনি একটু তুলে দিলেই পারতেন। ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণ। সুদিন বাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারায় কিছু মাত্র মিল নেই। কিন্তু ওনার চোখের দিকে তাকাতেই, সুদিন বাবু একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। হুবহু ওনার নিজের চোখ। চিন্তান্বিত অবস্থায় তাঁর চোখটা এমনই দেখায়। প্রথম দিন এই পর্যন্ত।পরদিন সুদিন বাবু দুর্গাবাড়িতে গেলেন। জয়দেবদাকে বললেন, আমি আমাকে গতকাল রাতে দেখেছি।
জয়দেব দা বড় মাপের সাধক। বললেন, মাঝে মাঝে আবারো করুন। নিজেই সব দেখতে পাবেন।
সুদিন বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।দুদিন বাদে তিনি আবার ওই প্রক্রিয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, আগের দিনের সেই ভদ্রলোক একটা বিরাট জলাশয়ের কাছে এসেছেন।
তাঁর চারপাশে ফতুয়া আর ধূতি পরা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক জলাশয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে ওনাদের কিছু একটা দেখিয়ে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।পরদিন সুদিন বাবু জয়দেব দার কাছে দ্বিতীয় দিনের স্বপ্নের কথা জানালেন।
তৃতীয় দিন রাতে ওই প্রক্রিয়াটি করবার পর, সুদিন বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘরের মধ্যে দেখলেন, টানা বারান্দা দিয়ে এক দীর্ঘকায় ভদ্রমহিলা হেঁটে চলেছেন।
পরদিন তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, কাকে দেখলাম?
আপনার আগের জন্মের স্ত্রী।কদিন বাদে সুদিন বাবু ওই প্রক্রিয়াটি করে শুতে গেলেন। খালি বাদে স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, মাটির চওড়া রাস্তা। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা। অনেক লোক বাসের মাচায় করে দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে।
জয়দেবদা, এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি?
আপনার বাড়িতে পূজোর জন্য দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি মায়ের মুখটা দেখতে পেয়েছেন?
নাতো দাদা। দেখিনি। তবে অনেক মানুষ বাসের মাচাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখেছি।কদিন পর সুদিন বাবু আবার ওই প্রক্রিয়া করলেন। তারপর শুতে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। আগের দিনের সেই ভদ্রমহিলা গোল ঘোরানো সিঁড়ির দোতলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক প্রধান দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তাঁকে ঘরের ফিরতে দেখে, ভদ্রমহিলার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়লো যেন।এর কিছুদিন পর সুদিন বাবুর বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে পরিণত বয়সে মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেল।
সুদিন বাবু এই অশৌচ কালের মধ্যে জয়দেব দার শেখানো প্রক্রিয়াটি করলেন। কিন্তু কোনই ফল পেলেন না। বারে বারে চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কিছুতেই আর সেই ছবিগুলো আসছিল না।
তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, বারবার চেষ্টা করছি। আর তো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
পাবেন না তো!
কেন?
আপনার এখন অশৌচ কাল।সুদিন বাবু নানান ব্যস্ততার কারণে পরবর্তীকালে আর কখনো ওই চেষ্টাটা করেননি।
কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এইসব অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। বর্তমান সংসারের প্রতি মায়াটান কমে যায়।
জয়দেবদা বললেন, আগামী জন্মে আপনি ও বাড়িতেই জন্মাবেন। আগের জন্মে কালী মন্দিরটা অসম্পূর্ণ রেখে আপনি মারা গিয়েছিলেন। আগামী জন্মে ওখানে জন্মে আপনাকে সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।