• কবিতা

    গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা

    সোনার সিঁড়িতে পা
    -সুনির্মল বসু

     

     

    তখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশিরের শব্দ, মাঠে মাঠে কাশফুল, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেলা, দীঘির জলে শাপলা শালুক, নদীতে ভেসে যাচ্ছে গায়নার নৌকো। উদাসী প্রকৃতি। বাতাসে বাজছে উৎসবের সুর।

    তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন।

    গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।

    মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

    ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।

    অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।

    সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
    অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
    সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
    অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
    হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
    অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
    আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
    সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
    কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
    হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
    ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
    অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।

    সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।

    ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।

    মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।

    অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।

    ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
    অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।

    তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

    মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।

    একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।

    গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
    আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।

    জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।

    এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।

    জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।

    শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।

    একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।

    অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
    অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
    তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
    বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
    ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
    বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।

    বিশ্বরূপ ‌ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।

    সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
    বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
    প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।

    জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
    বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
    সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।

    আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।

    জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
    সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।

    আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
    বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
    সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাবসলিউটলি,নট।
    দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।

    গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।

    সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।

  • কবিতা

    কবিতা- কথা ছিল না

    কথা ছিল না
    -সুনির্মল বসু

     

     

    গভীর রাতে সরল বস্তি কাঁদে, গভীর রাতে যে মেয়েটি একলা ঘরে ফেরে,এ শহর তাঁর দিকে কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি,

    গভীর রাতে যে বেকার যুবক চাকরির সন্ধান করে একবুক হতাশা নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরেছে,এশহর তাঁর ফিরে
    চেয়ে দ্যাখে নি,

    গভীর রাতে চাঁদ, নীহারিকা মন্ডল চেয়ে দ্যাখে,
    গভীর রাতে কেঁদে ওঠে ক্ষুধার্ত শিশু,
    পথেই লেখা হয় যাদের জীবনলিপি,

    গভীর রাতে বাতাস কাঁদে, নদী কাঁদে,
    আকাশ ও সমুদ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,

    এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,

    কারা কেড়ে খায় শিশুর খাবার,কারা ভোগের মধ্যেই করছে জীবন কাবার,কারা পৃথিবীতে আনছে দূষিত বাতাস,

    তাদের চিহ্নিত করো,বলো,এ দেশ আমার,
    এ দেশ নয় তো লুটের খামার,

    এমন তো কথা ছিল না,এমন তো কথা ছিল না,
    ছদ্মবেশীদের চেনো,শোধ করো জন্মভূমির ঋণ,

    প্রাসাদের নীচে কেন বস্তি,কেন জীবন হারিয়েছে স্বস্তি,কারা প্রতিদিন আকাশকে করছে কালো,
    দেশে কতজনের হয়েছে ভালো,

    তাদের চিহ্নিত করো,
    চোর সাধুর ভেক ধরেছে কেন,

    সুন্দর আকাশ একদিন আমরা আনবোই,
    এই সত্যটা জেনো।

  • রম্য রচনা

    রম্য- মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়

    মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
    সুনির্মল বসু

    আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক আছেন, সব সময় তিনি ভুল ইংরেজিতে কথা বলেন। অথচ, মাতৃভাষায় কথা বলায় তাঁর প্রবল বিরক্তি। প্রায়ই বলেন, বাংলা ভাষাটা আমার ঠিক আসে না। পথে দেখা হলে, জিজ্ঞাসা করেন, তারপর, সব ভালো তো। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে, এর পরেই বলেন, ঘড। আসলে, উনি যে গুড কে ঘড বলেন, এটা বুঝে নিতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।

    পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ভদ্রলোক ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সব সময় ইংরেজিতে ঘড বলে থাকেন। ইংরেজরা এ দেশ থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন, ইংরেজিয়ানা যায়নি।

    একটি খ্যাতনামা জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে আমার বাড়ি। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্ত্রীরা অনেকেই বলেন, আমাদের উনি ম্যানেজার হইছেন।
    ম্যানেজার, সোল পুটিং ডিপার্টমেন্ট।

    পাড়ার বখাটে ছেলেরা বলে, ম্যানেজার, কথাটার ব্যাসবাক্য সহ সমাস কি হবে বলো তো?
    নিজেরাই উত্তর দেয়, এরপর। বলে, মানে নেই যার।

    পূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো।মিসেস চৌধুরী দরোজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।

    মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি?

    শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন!

    মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি?

    এই সময়ের জন্য তৈল একটি অতি মূল্যবান বস্তু। আমার ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া বন্ধু জগন্ময় বাটা কোম্পানির এক ম্যানেজারের গাড়ি ধুয়ে এবং বাজার করে দিয়ে, বর্তমানে ম্যানেজার হয়েছে।

    এখানে কর্মীদের সপ্তাহে বেতন। প্রোডাকশন বেশি হলে, খুশি হবার কথা।

    কিন্তু আমার বন্ধুটি এই ঘটনায় রেগে যায়। কারণ, কর্মীদের একেক জনের সাপ্তাহিক বেতন কি হবে, সে অংকটা জগন্ময়ের জানা নেই।

    আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী!

    বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রম গুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন?

    সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতা ওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।

    অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
    আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই।

    কাকু বললেন, পুনশ্চ,
    এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।

    পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।

    একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো?
    কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম।

    আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।

    মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।

    আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়।
    ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি!

    দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার।

    মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে। কোলে মার্কেটে কিংবা মানিকতলার বাজারে এত চিল চিৎকার নেই।

    সাহিত্য সাধনা কাহাকে বলে!

    আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই।

    ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি!
    জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন?

    দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।

    এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই!

    বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।

    মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে
    লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
    সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে ,লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন?

    একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে, স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
    মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন?
    বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
    ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
    বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়?

    মনের দেউলিয়া পনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।

    ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।

    অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তার পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।

    আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
    দূর্গা পূজার বিসর্জনের সময় কেপে কেঁপে নাচ আর ক্ষেপে ক্ষেপে গানের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতিক গরম মশালা পরিবেশন করা হয়। মুখোমুখি চারটে মাইকে চার রকম হিন্দি গান। কোনটার কথাই বোঝা যাবে না। এই না হলে পুজোর আনন্দ!
    সরস্বতী পূজার সময় প্যান্ডেলের ঠাকুরের চেয়ে রাস্তার সরস্বতী দেখার জন্য তরুণ তুর্কিদের হামলে পড়া। সে ভারী দেখার মতো দৃশ্য!
    আমাদের পাড়ার টোকনদা পড়াশুনোয় চতুর্থ শ্রেণীর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন, ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনি সব সময় ইংরেজী কাগজ বগলে নিয়ে ঘোরেন। রোববার সকালে দেখি, উনি শচীনের চায়ের দোকানে বসে আছেন। চোখ ইংরেজী কাগজের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কাগজে কি লিখেছে টোকনদা?
    তিনি উল্টো করে কাগজ ধরেছেন।
    maruti suzuki র অ্যাড ছিল। বললেন, গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে। চাকা উল্টে গেছে।

    আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
    একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাস পণা।

    শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আরকি!

    আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে?
    ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি!

    সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।

    এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে!

  • গল্প

    গল্প- কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা

    কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
    -সুনির্মল বসু

    ঝাউবন পেরিয়ে সামনে নীল সমুদ্র। রঞ্জনা বিয়ের পর এই প্রথম স্বামী অনিকেতের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
    সামনে ধূ ধূ বালিয়াড়ীর ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
    অনিকেত রঞ্জনার হাত ধরেছিল। বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে রঞ্জনার শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছিল।
    অনিকেত কম কথা বলা মানুষ।
    রঞ্জনা বলল, কি মশাই, একেবারেই চুপচাপ যে,
    অনিকেত বলল, সমুদ্র দেখছি, বড়র সামনে এলে,
    মুখে ভাষা আসে না।
    রঞ্জনা বলল, সমুদ্র কত পুরাতন, কত নতুন,
    আমাদের আগে কত মানুষ এখানে এসেছে, কত মানুষ ফিরে গিয়েছে, সমুদ্র একই রকম আছে।
    অনিকেত বলল, আমরা একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, সমুদ্র থাকবে।
    রঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, দূর সমুদ্রের ধারে কিছু
    নুলিয়ারা একটি দাঁড়িয়ে থাকা নৌকোর পাশে ব্যস্ততার সঙ্গে নিজেদের কাজ করে চলেছে।
    সমুদ্রের পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে এলো।
    তখন পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠে একটা ডাক এলো, এই অনিকেত,
    পেছন ঘুরে অনেকেত দেখল, রিমঝিমকে। সঙ্গে একজন সুদর্শন যুবক।
    রিমঝিম পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাসবেন্ড
    পার্থ, আর এ হোল, অনিকেত। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু।
    অনিকেত রঞ্জনার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।
    অনিকেতের মনে পড়ছিল, এই সেই রিমঝিম, যে একদিন ওকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। পরে অনিকেত জানতে পেরেছিল, বাবার মনোনীত বড়লোক পাত্র পেয়ে, তাকেই বিয়ে করেছে রিমঝিম।
    ভালোবাসা আজকাল বড় সস্তা হয়ে গেছে। আর অনিকেত অংক করে ভালবাসতে শেখে নি।
    সেদিন কত কথা ছিল ওদের।
    কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, গোলদীঘির পাড়ে প্রতিদিন দেখা হতো ওদের।
    রিমঝিম বলেছিল, তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো, অনিকেত।
    কী মিথ্যে, কী মিথ্যে,
    সেদিনের রিমঝিমের সঙ্গে আজকের এই সুখী রিমঝিমকে একটুও মেলানো যায় না।
    রিমঝিম সত্যিই কি সুখী হয়েছে। নাকি, সুখে থাকার অভিনয় করছে। একটা মানুষের কত অসংখ্য মুখ থাকে।
    আজকে ওই ভালোবাসাকে প্রবলভাবে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, অনিকেতের।
    রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছো,
    রঞ্জনা বলল, হোটেল তরঙ্গমালায়। আপনারা একদিন আসুন না।
    পার্থ বলল, যাবো কাল সকালে,
    অনিকেত চুপ করে ছিল। ও কিছুতেই রিমঝিমকে আর সহ্য করতে পারছিল না।
    তখন আকাশে একটি দুটি তারা ফুটেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। পার্থ রিমঝিমকে বিদায় দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।
    পরদিন রিমঝিম স্বামী পার্থকে সঙ্গে করে, অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতে এলো।
    রিমঝিম বলল, কবে বিয়ে করলে, জানাওনি তো,
    অনিকেত বলল, চাকরি পাবার বছর তিনেক বাদে
    বাবা মা বিয়েটা দিলেন।
    ও, ভালো, তোমার বউ তো খুব সুন্দরী হয়েছে।
    আমি একটা সুন্দর মন খুঁজেছিলাম,
    পার্থ তখন টিভি চালিয়ে খেলা দেখছিল।
    রঞ্জনা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল।
    রিমঝিম বলল, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছো না কেন, অনিকেত। দেখছি, আমার উপর থেকে তোমার রাগ এখনো পড়েনি।
    অনিকেত জবাব দিল না।
    রিমঝিম বলল, কি, আমার কথার উত্তর দেবে না,
    অনিকেত বলল, আমি সত্যিকার ভালোবেসে ছিলাম, আমি কাউকে ঠকাইনি। যে ভালোবাসা নিয়ে একদিন খেলেছিল, সে ঠকেছে।
    রঞ্জনা ওদের মিষ্টি ও কফি পরিবেশন করলো।
    বলল, ওর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি, রিমঝিম।
    এ কথার কোন উত্তর দিল না রিমঝিম। মনে মনে অনুভব করল, সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে,
    একদিন সেই ভালোবাসার জন্য কাঁদতে হয়। সেদিনের জয়, আজ এত পরাজয়ের বার্তা এনে দেবে, রিমঝিম কোনো দিন সে কথা ভাবেনি।
    মিষ্টি কফি খাবার পর, পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে
    শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করছিল।
    একসময় ওরা বিদায় নিল। যাবার আগে, পার্থ অনিকেত আর রঞ্জনাকে ওদের লেকটাউনের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্ন করেছিল।
    গভীর রাতে, রঞ্জনা বলল, রিমঝিমের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে,
    অনিকেত বলল, একেবারে না। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু গোপন করিনি।
    রঞ্জনা বলল, ভালোবাসা আর ঘৃণা পাশাপাশি থাকে, দেখলে, রিমঝিম তোমাকে দেখাবার জন্য কেমন পার্থকে নিয়ে ঢলাঢলি করছিল।
    অনিকেত বলল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ভালোবাসা দেখাবার জন্য এমন আদিখ্যেতা দেখাতে হয়।
    রঞ্জনা বলল, ওদের বাড়ি লেক টাউনে একবার যাবে নাকি,
    অনিকেত বলল, কক্ষনো না। রিমঝিম শুধু আমার বিশ্বাস ভাঙ্গেনি, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে খেলা করেছে,
    বিকেল বেলায় ওরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মোহনার কাছে অনিকেত আর রঞ্জনা চলে এসেছিল।
    বিশ্রামের জন্য ওরা একটা দেবদারু গাছের নিচে
    দাঁড়ালো। রঞ্জনা দেখলো, ওদের পায়ের কাছে অনেক লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল কাঁকড়া গুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, আবার গর্তে ফিরে যাচ্ছিল।
    তা দেখে অনিকেত বলল, সবাই ঘর খোঁজে, ভালো ঘর, ভালোবাসার ঘর খোঁজে কজন,
    রঞ্জনা বলল, যত বড়ই ঘর হোক, ভালোবাসা না থাকলে, সে আবার ঘর কিসের,
    সমুদ্রের উতরোল ঢেউ এসে, ওদের দুজনের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল।

  • গল্প

    গল্প- অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে

    অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
    -সুনির্মল বসু

    তখন তাঁর ভয়ংকর ব্যস্ততার দিন।
    সারাদিন স্কুল করবার পর, অনেক সময় খাবার সময় জোটে না, তাঁকে এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে বেড়াতে হয়। যাতায়াতের জন্য সাইকেল একমাত্র ভরসা।
    সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাচ পড়িয়ে সুদিন বাবু সবে দ্বিতীয় ব্যাচ পড়াতে শুরু করেছেন, গিন্নী জয়ার ফোন।
    তুমি কোথায়?
    স্টেশন রোডের কাছে, পড়াচ্ছি তো!
    একবার একটু এখানে আসতে পারবে?
    কোথায়?
    জয়দেব দার দুর্গা বাড়িতে।
    কেন?
    এসোই না, তখন বলবো।
    ছাত্রদের টেস্ট পেপার থেকে কাজ দিয়ে সুদিন বাবু
    ওখানে উপস্থিত হলেন।
    সন্ধ্যেবেলায় আরতি পর্ব চলছিল। প্রচুর ভক্তদের ভিড়।
    জয়া বললো, এসো।
    জয়দেবদা, সুদিন বাবুর হাতটা দেখতে চাইলেন।
    অনেকক্ষণ দেখার পর বললেন, আজ কিছু বলবো না। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই,আপনি পরে একদিন আসুন।
    সুদিনবাবু ফিরে গিয়ে পুনরায় ছাত্র পড়াতে বসলেন।
    কদিন বাদে সময় বের করে দুর্গা বাড়ি গেলেন।
    জয়দেবদা বললেন, আপনার তো এখানে জন্মাবার কথা না!
    মানে?
    আপনি তো বিরাট বড় বাড়ির লোক মশাই।
    কি বলছেন?
    আপনার তো বিরাট বাড়ি। বিরাট প্রজামহল। সবাই আপনাকে খুব মান্যতা করে।
    দাদা, আমি খুব সামান্য মানুষ। দেখছেন না, সারাদিন দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
    আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
    কি করে হবে?
    আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলবো। সেটা করতে পারবেন? তাহলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।

    তিনি কানে কানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বললেন। বললেন, কাউকে বলা যাবে না কিন্তু! আজ রাতেই করুন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন।

    সুদিন বাবু টিউশনি পড়াতে ঢুকলেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথার মধ্যে নেননি কখনো।
    অনেক রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি যখন শুতে গেলেন, তখন জয়দেব দার গোপন প্রক্রিয়াটার কথা তার মনে পড়ল।

    পরীক্ষার ছলে তিনি সেটি করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর এমন ঘটনাই স্বাভাবিক।

    ঘুমের মধ্যে খানিকটা সময় বাদে জিনিস দেখলেন, তিনি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে চাইছেন। দেখলেন, প্রচুর সবুজ গাছপালা। একটা বড় রাজপ্রাসাদের মত সাদা বাড়ি। বড় বড় জানালার উপর লাল রঙের সেড দেওয়া। বাড়ির বিশাল বড় গেট। সুদিন বাবু দৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। দেখলেন, বড় একটি আম গাছের নিচে এক ভদ্রলোক হলুদ ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জমিদারী স্টাইলের পাঞ্জাবী ও ধূতি। পায়ে সাদা রঙের চটি।
    সুদিন বাবু ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে চাইলেন।
    ওনার পাঞ্জাবিটা ঘাড় থেকে সামান্য নেমে এসেছে।
    পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সুদিন বাবু বিভিন্ন সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাষণ দিতে যান।
    বক্তৃতা দেবার সময় বারবার জামার কলারে হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হচ্ছিল, ওনার পাঞ্জাবিটা উনি একটু তুলে দিলেই পারতেন। ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণ। সুদিন বাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারায় কিছু মাত্র মিল নেই। কিন্তু ওনার চোখের দিকে তাকাতেই, সুদিন বাবু একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। হুবহু ওনার নিজের চোখ। চিন্তান্বিত অবস্থায় তাঁর চোখটা এমনই দেখায়। প্রথম দিন এই পর্যন্ত।

    পরদিন সুদিন বাবু দুর্গাবাড়িতে গেলেন। জয়দেবদাকে বললেন, আমি আমাকে গতকাল রাতে দেখেছি।
    জয়দেব দা বড় মাপের সাধক। বললেন, মাঝে মাঝে আবারো করুন। নিজেই সব দেখতে পাবেন।
    সুদিন বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।

    দুদিন বাদে তিনি আবার ওই প্রক্রিয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, আগের দিনের সেই ভদ্রলোক একটা বিরাট জলাশয়ের কাছে এসেছেন।
    তাঁর চারপাশে ফতুয়া আর ধূতি পরা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক জলাশয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে ওনাদের কিছু একটা দেখিয়ে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।

    পরদিন সুদিন বাবু জয়দেব দার কাছে দ্বিতীয় দিনের স্বপ্নের কথা জানালেন।
    তৃতীয় দিন রাতে ওই প্রক্রিয়াটি করবার পর, সুদিন বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘরের মধ্যে দেখলেন, টানা বারান্দা দিয়ে এক দীর্ঘকায় ভদ্রমহিলা হেঁটে চলেছেন।
    পরদিন তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
    দাদা, কাকে দেখলাম?
    আপনার আগের জন্মের স্ত্রী।

    কদিন বাদে সুদিন বাবু ওই প্রক্রিয়াটি করে শুতে গেলেন। খালি বাদে স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, মাটির চওড়া রাস্তা। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা। অনেক লোক বাসের মাচায় করে দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে।
    জয়দেবদা, এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি?
    আপনার বাড়িতে পূজোর জন্য দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি মায়ের মুখটা দেখতে পেয়েছেন?
    নাতো দাদা। দেখিনি। তবে অনেক মানুষ বাসের মাচাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখেছি।

    কদিন পর সুদিন বাবু আবার ওই প্রক্রিয়া করলেন। তারপর শুতে গেলেন।
    ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। আগের দিনের সেই ভদ্রমহিলা গোল ঘোরানো সিঁড়ির দোতলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক প্রধান দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তাঁকে ঘরের ফিরতে দেখে, ভদ্রমহিলার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়লো যেন।

    এর কিছুদিন পর সুদিন বাবুর বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে পরিণত বয়সে মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেল।

    সুদিন বাবু এই অশৌচ কালের মধ্যে জয়দেব দার শেখানো প্রক্রিয়াটি করলেন। কিন্তু কোনই ফল পেলেন না। বারে বারে চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কিছুতেই আর সেই ছবিগুলো আসছিল না।

    তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
    দাদা, বারবার চেষ্টা করছি। আর তো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
    পাবেন না তো!
    কেন?
    আপনার এখন অশৌচ কাল।

    সুদিন বাবু নানান ব্যস্ততার কারণে পরবর্তীকালে আর কখনো ওই চেষ্টাটা করেননি।

    কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এইসব অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। বর্তমান সংসারের প্রতি মায়াটান কমে যায়।

    জয়দেবদা বললেন, আগামী জন্মে আপনি ও বাড়িতেই জন্মাবেন। আগের জন্মে কালী মন্দিরটা অসম্পূর্ণ রেখে আপনি মারা গিয়েছিলেন। আগামী জন্মে ওখানে জন্মে আপনাকে সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।

  • কবিতা

    কবিতা- এই উঠোন, এই কুয়োতলা

    এই উঠোন, এই কুয়োতলা
    -সুনির্মল বসু

     

     

    সেদিনের মতো আজও এই উঠোনে প্রতিরাতে এসে পড়ে জ্যোৎসনার রোদ্দুর,তাল বনের মাথার উপর চাঁদ ভেসে যায়, বাতাসে শিউলি ফুল সুগন্ধ ছড়ায়,
    রাত গভীরে এই উঠোন, এই কুয়োতলা আবহমানকাল ধরে স্মৃতির গল্প বলে, মধ্যরাতে কারা যেন ঝুমকো লতার বনে হাঁটে,
    বড় দীঘির পাড়ে সুপারি বনের ছায়ায় প্রেমিক প্রেমিকা ফিসফিস কথা বলে,
    অরণ্য পাখি কর্কশ কন্ঠে ডেকে ওঠে,
    কাঠ বাদাম গাছের মাথায় ঢাউস ঈগল উড়ে যায়,
    গভীর রাতে অরণ্য লোক ভালোবাসার কথা বলে,
    কত স্মৃতি জমা হয়ে আছে দীঘির জলে,
    বাতাসে ভেসে যায় প্রেমের আশ্লেষ,
    এই উঠোন, এই কুয়োতলা, দূরের অরণ্য কি ভালবাসার দেশ, দোলনচাঁপার বন বাতাসে দোলে,
    মাধবীলতার বনে কার উদাসী আঁচল ওড়ে, মধ্যরাতে কারা ভেসে যায় ভালোবাসার ঘোরে,
    আকাশে তারার মেলা, বাতাসে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,
    মায়াময় প্রকৃতি দিচ্ছে ভালোবাসার ডাক,
    কবে কখন কারা যেন হেঁটে গেছে বড়দীঘির পাড়,
    জীবন থমকে থেমে আছে, কাকে সে কথা বলি আর,
    এই উঠোন, এই কুয়াতলার উপর দিয়ে মধ্যরাতে চাঁদ হেঁটে যায়, প্রেমিক প্রেমিকার মুখের উপর চাঁদের আলো পড়ে, হাজার হাজার বছর ধরে কারা ভালোবাসার নতুন ইতিহাস গড়ে,
    দীর্ঘ প্রলম্বিত বাতাস বয়ে যায় প্রতিদিন জীবনের ঘরে।

  • কবিতা

    কবিতা- যেভাবে যাওয়া আসা

    যেভাবে যাওয়া আসা
    সুনির্মল বসু

     

     

    জীবনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু, সুখের পাশে জেগে থাকে দুঃখ,
    শ্মশানে দাউ দাউ চিতা জ্বলে,বহতা নদীর বাতাস ভারী হয় ছাই ও ধোঁয়ায়,
    নিঃশেষিত জীবন স্মৃতি রেখে যায়, জীবনে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি,
    জীবনের গুঢ় রহস্য বোঝার আগেই মহা প্রস্থান,
    তবু আকাশ মেঘ শিল্প আঁকে,
    জ্যোৎস্নায় কাঠবাদাম গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ ওঠে,
    আকাশে ঝিকিমিকি তারাদের মিছিল,
    নীল সমুদ্রে বাজে সমুদ্র নীল বাঁশির সুর,
    ধীর মন্থর গতিতে নদী বয়ে চলে, সমুদ্র জলে ভাসে সাধের সাম্পান, মানুষ রচনা করে জীবনের গান,
    পুরনো রাস্তায় হেঁটে যায় নতুন মানুষ,
    জীবন কথাকলি রচনা করে, গাছগাছালির ফাঁকে সূর্য উঠে, প্রজাপতি, গঙ্গা ফড়িং ডানা মেলে বিলের জলে,
    জীবন ও মৃত্যু কত কাছে,
    তবু জ্ঞানপাপী মানুষ স্বার্থের মাতে,
    জীবনের লেনদেন শেষে মানুষ ফিরে যায়
    অনির্দেশ্য যাত্রায়,
    ভুবন জুড়ে জীবনলীলা ভেসে যায়।

  • গল্প

    গল্প- নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য

    নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য
    -সুনির্মল বসু

    নীলাঞ্জনার সঙ্গে দেখা বিশ বছর বাদে। আসলে, দুর্গাপুর থার্মাল প্রজেক্টের একটা কাজ দেখতে এখানে আসা।
    চীফ ইঞ্জিনিয়ার অনুতোষ চৌধুরীর
    অনুরোধে তাঁর বাড়িতে আসতে হল নিরুপমকে। নীলাঞ্জনা যে অনুতোষ চৌধুরীর স্ত্রী, এটা জানা ছিল না ওর।

    স্মৃতিতে ধাক্কা।

    সেই নীলাঞ্জনা, নিরুপমের অতীত।
    পরিচয়পর্ব সারা হল। নীলাঞ্জনার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। নিরুপম স্বাভাবিক হতে পারছে না।

    স্মৃতি পিছু টানছে।

    ভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়তো ওরা। সাহিত্য সভায় গল্প পড়তো নিরুপম। নীলাঞ্জনার বাবা কোম্পানির ডিরেক্টর। প্রতিদিন এম্বাসেডর চেপে আসতো ও।
    নীলাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী। ছেলেদের পাত্তা দিত না। সেই মেয়ে একদিন যেচে আলাপ করতে এসেছিল নিরুপমের সঙ্গে।
    আমিতো বন্ধন রায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।
    বন্ধন রায় নিরুপমের গল্পের নায়ক। সেই প্রথম আলাপ।
    তারপর রাখালদের ক্যান্টিনে, কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে কতবার কথা হয়েছে, কত অসংখ্য বার। রাতে গোল দীঘির পাড়ে বসে চাঁদের আলোয় জ্যোৎসনায় ভিজেছে দুজন, কতদিন।

    এক বিকেলে কফি হাউসে গিয়ে দু কাপ কফির অর্ডার দিতেই, নীলাঞ্জনা হঠাৎ বলেছিল, ওই দ্যাখো, অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি এসেছেন!
    ওনার পাশের ভদ্রলোককে চেনো?
    নাতো। ঠিক বলতে পারছি না!
    উনি হলেন এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য।
    তাই বুঝি! আমি রেগুলার ওই পত্রিকা পড়ি।
    আমি ইবসেনের নাটকের উপর ওনার পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়েছি।
    কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে। খেতে হবে তো!
    হু।
    বাংলা ভাষায় তোমার প্রিয় কবি কে?
    শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
    দুজনই আমার প্রিয় কবি। সেই সঙ্গে আমি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাম যোগ করছি।
    ঠিক বলেছো। ওনার নাম বাদ দিলে, সেটা বিরাট অন্যায় হয়ে যেত।
    এবার উঠতে হবে। লাইব্রেরীতে যাবো। কাল ভার্সিটিতে আসছো তো?
    আসবো তো অবশ্যই। ইদানিং আমার বিয়ে নিয়ে বাবা-মা খুব উঠে পড়ে লেগেছেন।
    আমাদের ভালবাসার কি হবে?
    তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
    আমি মোটেই সে কথা বলিনি।

    আরেকদিন সন্ধ্যায় বসুশ্রী হলে সিনেমা দেখে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা বলেছিল, গত দুদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, আমার বুকের মধ্যে যে কি কষ্ট হচ্ছিল,
    তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
    ভালোবাসা মানে একটা ঝড়, বুকের মধ্যে সব সময় থমকে থামা ঝড়ের ইশারা।
    তোমার কষ্ট হয় না, আমাকে না দেখলে?
    হয় তো বটেই। কাছে না পেলে, মনে মনে তোমাকে কত অসংখ্যবার পেতে চেষ্টা করি।
    মানে?
    মানে, আমার চারদিকে তখন নীলাঞ্জনা ছায়াছবির মতো ঘুরে বেড়ায়। বলে, কষ্ট পেয়ো না, এইতো আমি তোমার কাছেই আছি। আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখো!
    অ্যাই, সব সময় ঠাট্টা ইয়ার্কি না?
    নিরুপম হো হো করে হেসে ফেলে।

    কত কত দিন কেটে গেছে এভাবেই। সেইসব সোনালী বিকেলগুলো, মনোরম সন্ধ্যা গুলো চার জোড়া চোখে কত যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। স্বপ্নের মিনার, স্বপ্নের গম্বুজ, স্বপ্ন দিয়ে গড়া ভালবাসার রাজপ্রাসাদ।

    অথচ, তারপর একদিন এলো, সব স্বপ্নের ইমারত ভেঙেচুরে খানখান। আজ সে সব অতীত।

    কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?
    নিরুপম অতীত খুঁড়ে দেখতে চায় নি কখনো।

    নীলাঞ্জনাও স্বামীর সামনে অতীত পরিচয়ের কথা তোলেনি, নিরুপম উদাস থেকেছে।
    এক সময় কফি মিষ্টি খেয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

    বিকেলে পার্টিতে আবার দেখা।
    অনুতোষ রিসেপশনে ব্যস্ত।

    নীলাঞ্জনা কাছে এলো নিরুপমের।
    আবার দেখা হলো,
    তাইতো,
    কুড়িটা বছর পার,
    জীবন তো রাজধানী এক্সপ্রেস,
    হুম,
    সেসব দিন মনে পড়ে?
    পড়ে, না পড়াই ভালো,
    কেন?
    শুধু শুধু পুরনো ক্ষতে হাত,
    দোষটা কার?
    কারো নয়,
    মানে?
    দোষটা ভাগ্যের,
    বিয়ে করেছো?
    প্রেমহীন বিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই, তাছাড়া সময় পাই নি,
    নিজেকে কষ্ট দাও কেন?
    জানিনা, বলতে পারব না,
    আমি কিন্তু অপেক্ষা করেছিলাম!
    জানি, আমার পায়ের তলায় তখন জমি ছিল না,
    আমার বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছিল, হয়ে গেল,
    আর, সেই রাতে আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে সোজা ধানবাদ,
    খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?
    পুরুষের অক্ষমতা তুমি বুঝবে না,
    জানি, আন্দাজ করতে পারি,
    ভালো হয়েছে, কেউ নেই, তাই কারো জন্য ভাবনার ঢেউ নেই,
    তাই নাকি?
    তুমি সুখী হয়েছো তো?
    দেখে কি মনে হয়?
    দেখে বোঝা যায় নাকি?
    চলে যাচ্ছে বেশ,
    মিস্টার চৌধুরী তো যথেষ্ট সফিস্টিকেটেড মানুষ।
    তা ঠিক, তবে কি জানো, বিয়ে একটা অভ্যাস, একটা দায়বদ্ধতা, এই নিয়ে বেঁচে থাকা।

    আমার মনে হয়, তোমাকে পাইনি বলে, তুমি রোজ আমার কাছে আসো, যখন তোমাকে দেখি না, তখন তোমাকে আরো বেশি করে দেখি,
    কাজের সূত্রে আসো না এখানে,
    না, ভাগ্য যে দেয়নি, তাকে ঘুরপথে পেতে চাইনা,
    তুমি বদলে গেছো নিরুপম,
    হবে হয়তো,
    আমার তো সব মনে পড়ে,
    কি?
    সেই সব পুরনো দিনের স্মৃতি, সেইসব মায়াবী রাত, গড়িয়াহাটে সন্ধ্যেটা কাটানো, ঝিলের পাশে পাশাপাশি হাঁটা, আলেয়া সিনেমাতে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখা, সব সব,
    আমি জানলে, এখানে আসতাম না,
    আমি তো ভুলে থাকতে চাই, তুমি এসে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিলে,
    নীলাঞ্জনা, এই ভালো। সেই সব দিনগুলো আমার জীবনের ওয়েসিস, স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় বেশ,
    তুমি পারো, আমি পারিনা,
    তুমিও পারবে,
    কিভাবে?
    ঝরা ফুলের গন্ধ কেমন জানো, দেখবে তার মধ্যেও ভালোবাসার সুগন্ধ লুকিয়ে থাকে। আমাকে ভুলে যেও, আমাকে মনে রেখো না, স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো!

    ততক্ষনে পার্টিতে ঘোষণা শোনা গেল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, প্লীজ্ কাম অন স্টেজ।

    নিরুপম দেখলো, নীলাঞ্জনা আর ওর স্বামী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। ভালো লাগছে, ওদের দুজনকে।

    ভালো থাকো তোমরা। সুখের বৃষ্টি আসুক তোমাদের জীবনে। সেই সব দিন রাত্রি গুলো আমার কাছে স্মৃতির সংগ্রহশালা হয়ে থাক, নিরুপম মনে মনে বললো।

    ভালো থেকো নীলাঞ্জনা। সুখী হও।

    নীলাঞ্জনা, আমি আর আসবো না। যেটুকু পেলাম, সেটুকুই আমার স্বর্ণ কমল সঞ্চয়, যা পেলাম না, তা হয়তো আমার ছিল না।

    আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সেদিনের স্মৃতি গুলো গভীর মমতায় আগলে রাখবো আমি, নিজেকে বোঝাবো,
    কিছু হারায় নি আমি। ভালোবাসা হারায় না কখনো।

    জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বারবার শুধু তার অর্থ পরিবর্তন হয়। ঝরা ফুলের সুগন্ধ নিতে কজন জানে।

    যে জানে, সে জানে।

    তার কাছে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে সানাইয়ের সুরের মতো বেজে বেজে যায়।

    কজন সেই সুরের মাহাত্ম্য শুনতে পায়, যে শুনতে পায়, তার বেঁচে থাকাটা অন্য মাত্রা পায়।
    নিরুপম নিজেকে বোঝালো, নীলাঞ্জনাকে পেলে,
    প্রতিদিনের ধূলিমলিনতায় হয়তো এই ভালবাসার
    মর্যাদা নষ্ট হতো, অথচ, ওকে পায় নি বলে, আশ্চর্যজনকভাবে আজ ওদের সেদিনের ভালোবাসা চিরকালের ভালোবাসা হয়ে রইলো, এই পবিত্র ভালোবাসা স্মরণ করলে, এক জীবন পার করে দেওয়া মোটেই শক্ত নয়, নিরুপমের এরকমই মনে হল।

    ততক্ষনে স্যান্ট্রো গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ও দ্রুত গতিতে শহরের হাইওয়ের দিকে ছুটে চললো।

  • কবিতা

    কবিতা- শেষের সেদিন

    শেষের সেদিন
    -সুনির্মল বসু

     

     

    শরতের সকালে যেভাবে শিউলি তলা থেকে ছোটবেলায় ফুল কুড়িয়ে নিতাম, সেভাবেই জীবনের অস্তাচল পর্বে ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে চাই দুহাত ভরে,

    কে কিভাবে অন্যকে বঞ্চিত করে বৈভবের অহংকারে আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করল, সেদিকে ফিরেও তাকাতে চাই না, সঙ্গে করে কিছু আনিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যেতেও পারব না,

    আকাশ এত মুগ্ধতা দিল, সমুদ্র দিগন্ত থেকে দিগন্তের দিকে ছুটে গেল, ভোর বেলায় ফুলের সম্ভার চুপিচুপি ভালোবাসার কথা বলে গেল,

    খালের জলে, বিলের ওপর, নদীর উতরোল ঢেউয়ে
    প্রতিদিন কত ভালোবাসার কথা লেখা হলো,

    চাঁদের মালা পরা রাত, বর্ষণমুখর মেঘমেদুর আকাশ
    বৃষ্টি হয়ে ভালোবাসা হয়ে পৃথিবীর উপর ঝরে পড়ল,

    ইত্যাকার ভালোবাসার মধ্যে ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রতিদিন
    মানুষকে কত কি শেখায়,

    অথচ বেড়ে চালাক মানুষ কিছু শিখল না,

    পৃথিবীটাকে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ ছোট করে ফেললো,
    দ্যাখো আমি বাড়ছি, দ্যাখো আমি উঠছি,

    ওঠা নামার তফাৎটা আজকাল বোঝেন না অনেকেই, অথচ বিজ্ঞভাব, অন্যকে ঠকানো সহজ,
    নিজে যে কবে থেকে হেরে ভূত হয়ে বসে আছেন,

    সেটা টের পেতে জীবন চলে যায়,
    জীবনের শেষ স্টেশন এসে পড়ে,

    উত্তর পুরুষের ভাবী জীবনে অশান্তি আনবার জন্য
    লোক ঠকানো সম্পদ জীবনকে বিষ জর্জরিত করে,

    সেদিন নিজের অহংকারী মুখটা নিজেকেই ক্রমাগত
    ঠাট্টা করে যায়।

  • কবিতা

    কবিতা- তুমি চলে যাবার পর

    তুমি চলে যাবার পর
    -সুনির্মল বসু

     

     

    কাল রাতে তুমি চলে যাবার পর সারারাত অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল,
    কাল রাতে তুমি চলে যাবার পর আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি,

    কাল রাতে দমকা হাওয়ায় ঘরবাড়ি কেঁপে উঠেছিল,
    দূরের তালবন, কাঁঠালিচাঁপার গাছ, বাঁশবন দুলে উঠেছিল,

    সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমিতো কম চেষ্টা করিনি, তবু,

    কে যেন তখন মনের মধ্যে বলে উঠলো,
    যে বাতাস ভুল সংলাপ বলে, তার কাছে ভালোবাসার কথা বলতে যেও না,

    দেখছো না, এখন প্রজাপতিরা বিলের উপর মৌ মৌ গন্ধ ছড়াচ্ছে না, ধানক্ষেত মরা সাপের মতো শুয়ে আছে, নদীও নাব্যতা হারিয়েছে, পাহাড় নীরব দর্শক, রাতের নীল জোছনা স্বপ্ন ছড়াচ্ছে না,

    তবে তুমি কার কাছে ভালবাসার জন্য প্রার্থী হও,
    তবে তুমি কার কাছে ভালোবাসার জন্য হাঁটু গেড়ে বসো, এসব তোমাকে মানায় না,

    এখনো সময় আসে নি,

    এখনো ভালোবাসা আলোকবর্ষের ওপারে,
    ইউক্যালিপটাস গাছের মাথা ছাড়িয়ে পাহাড়ের ওপারে তার অবস্থান,

    রাত শেষে সে আসবে, সে আসবে রাজ বেশে,
    নদী ও গাছপালা এবং অরণ্য পাখির গান তার আসার কথা বলে দেবে, তখন ঝিরঝিরি বাতাস বইবে, কৃষ্ণচূড়ার বন লালে লাল, কদম ফুলের বনে
    ফিঙ্গে পাখি লেজ ঝুলিয়ে বসবে,

    নদীর ওপর ভোরের সূর্য উঠবে, দীঘিতে দেখা দেবে পদ্ম শালুক, কাঠবাদাম গাছে বউ কথা কও পাখি গান গাইবে, কাঁঠাল গাছে এসে বসবে বসন্তবাউরি,
    যে বাতাস ভুল সংলাপ বলে, তার কাছে ভালোবাসার কথা বলতে যেও না,

    বরং অপেক্ষা করো, আগামী বসন্ত দিনের,

    সেদিন শিমূল বন পেরিয়ে কৃষ্ণচূড়ার বনে এসো,
    দেখা হবে, কথা হবে তোমার আমার, জানি, একদিন আমার কাছে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে তুমি,

    ভালোবাসার বিশ্বাস থেকে এ কথা বলছি,
    আর ,আমাদের আরণ্যক প্রেম নিয়ে কবিতা লিখবেন, একালের কোনো তরুণতম কবি।

    তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার জন্য নির্ঘুম রাত্রিগুলো তোলা থাকুক।

You cannot copy content of this page