-
গল্প- আনন্দ পার্বণ
আনন্দ পার্বণ
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
“শুধায়ো না কবে কোন গান,
কাহারে করিয়াছিনু দান—
পথের ধুলার পরে
পড়ে আছে তারই তরে
যে তাহারে দিতে পারে মান।
তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
জানি না তোমার নাম,
তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি। “ -
গল্প- পুরনো আবাস
পুরনো আবাস
-সুমিতা দাশগুপ্তশান্তিনিকেতনে আমি বহুবার গেছি তবু কেন কে জানে শান্তিনিকেতন আমাকে অহরহ ডাক পাঠায়। সংসারের পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আমার, সবসময় সেই ডাকে সাড়া দেবার সুযোগ ঘটে না বটে, তবু অহরহ মনে মনে আমি ‘সেথায় মরি ঘুরে।’
সদা ব্যস্ত সংসারী মানুষজনের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। পৌষ মেলা,বসন্ত উৎসব, সোনাঝুরির হাট, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা, উত্তরায়ণ,সবই তো হয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার, তবে? তবে আবার কেন?
কেন যে সেকথা বোঝাই কাকে, কী করেই বা বোঝাই ,তাছাড়া আমার সবাইকে সব কিছু বোঝানোর দায়টাই বা কী! আমি বরং একা একাই পথ হাঁটি না হয়।
যারা কেবল উৎসবের শান্তিনিকেতন দেখেই সন্তুষ্ট ,তারা থাক না নিজ মনে, আমার যে আরও কতো কিছু দেখবার, অনুভব করবার বাকি রয়ে গেছে!
আমি দেখতে চাই দূরের মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে আসা কালবোশেখীর রুদ্ররূপ, পেতে চাই ঘন বর্ষায় কেতকী ফুলের গন্ধ, লেবুফলের গন্ধমাখা ভোর, উন্মুখ হয়ে থাকি, কবে কখন, শীতের হাওয়া, নাচন লাগাবে আমলকীর ঐ ডালে ডালে ! শুকনো পাতা খসে পড়ার খসস্ শব্দ মনে ভরে নিয়ে নিঝুম দুপুরে, হলদে পাখির পালক খুঁজতে যদি চলেই যাই খোয়াই এর শীর্ণ নদীটির পাশে,
‘তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার !’
একা একা পথ চলি। আশ্রম গেটের সামনে থমকে থেমে মনে মনে দেখি, সাঁঝবেলাতে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি পিছনে রেখে ঐ বুঝি তিনি হেঁটে আসছেন শালবীথির রাঙামাটির পথটি ধরে।
আসেন না নিশ্চয়ই। তবুও ভাবলামই বা, অসুবিধে কোথায়!
আসন্ন সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি, তারার আলোয় একলা দাঁড়িয়ে থাকা তালাবন্ধ বাড়িগুলোর সামনে।একসময়ে কতো না আনন্দে দিনযাপন ছিলো বাসিন্দাদের। আজ পরিত্যক্ত বাড়িগুলির গেটে পাথরের ফলকে লেখা, আদরের নামটিও অস্পষ্ট, কেবল আগাছা ভরা বাগানের এক কোণে বৃদ্ধ কাঁঠাল গাছের মোটা পাতায়, শিশির ঝরে টুপটাপ। কেন এতো অবহেলা! উত্তরাধিকারীরা কী সবাই ভয়ঙ্কর রকমের কর্মব্যস্ত! হবেও বা! এই যে সামনের ‘গেহ’ নামের পেল্লায় দোতলা বাড়িটা, কবে থেকে একলাটি বসে আছে ।শুনি নাকি সেই বাড়ির অন্দরে বই আর ছবির মেলা। কারুরই বোধহয় আর সাধ জাগে না সেগুলি আর একবার উলটে পালটে দেখতে!
এবার নিজেই নিজেকে জোর ধমক লাগাই।
অন্যের ব্যপারে নাক গলানোর স্বভাবটা আর গেল না! তাঁদের সুবিধে অসুবিধের কথা কী জানো হে! ধমক খেয়ে মনের দুর্বল অংশটা গুটিয়ে যায়, তাও মিনমিন করতেই থাকে…
এসব কথা কী কাউকে বলবার!মোটকথা কেবলই দেখতে নয়, রূপ,রস, গন্ধ সমেত সমস্তটুকু নিজের মধ্যে ভরে নিতে আমার এই বারে বারে ফিরে আসা।
সন্ধ্যা গাঢ় হয়, আমি একলাটি পথ চলি।
চেনা টোটোওয়ালাটি কাছে এসে দাঁড়ায়। দিদিমণির ধাত তার বোঝা হয়ে গেছে।
” সাঁঝের বেলায় এখন আর কী দেখবেন! কাল সকাল সকাল তোয়ের হয়ে থাকবেন, যে-যে বাড়ি দেখতে চান সব দেখিয়ে দেব। সমস্ত বিখ্যাত লোকের বাড়ির হদিশ,আমার জানা। আজ রাতেই লিষ্টিটা করে রাখবেন।”অভিভাবকের ভূমিকায় নিজেকে স্বনিযুক্ত করে টোটোওয়ালা চলে যায়।
লিষ্টি আর নতুন করে কী বানাবো,সে তো কবে থেকেই আমার মনের মধ্যে ‘তোয়ের’ হয়ে রয়েছে!
প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’তে কতকাল আগে পড়ে ফেলেছি , শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়ি তৈরির গল্প।
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে,পারুলডাঙায় জমি কেনা,পরে ধীরে ধীরে ছোট্ট একখানা বাড়িও হলো।বাড়ির নাম দেওয়া হ’লো ‘স্বাগত-বিদায়’…বুদ্ধদেবের শেষ বয়সে রচিত কাব্যগ্রন্থটির নামে, সেই বাড়ির নামকরণ।
শেষজীবনে প্রতিভা বসু , মহানগরীর কোলাহল এড়িয়ে, ওই বাড়িতেই থাকতে চাইতেন,নিস্তব্ধ রাতের চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা বাড়িটি কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকতো।
পাশের সোনাঝুরি নামের বাড়িটি গায়িকা নীলিমা সেনের।
“আচ্ছা প্রতিভাদি সারাক্ষণ বারান্দায় বসে তুমি কী দেখো?”
“উপরে আকাশ দেখি ,আর নীচে দেখতে আসি কখন তুমি যাও।তোমার সুন্দর মুখখানা দেখে আমার আকাশ দেখারই আনন্দ হয়।”—- এবারে ঠিক দেখে নেব সেইসব বাড়ি ঘর।আগের বারে এসে দেখে গেছি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের দোতলা বাড়ি, ‘আনন্দধারা’। এখন সেখানে তাঁর ছোটবোনের সপরিবারে বসবাস। তাই সে বাড়িটির সর্বত্র যত্নের ছোঁয়া, শুধুই কী তাই! বাড়ি দেখতে গিয়ে এমন আন্তরিক অভ্যর্থনা কল্পনারও অতীত ছিল। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা শিল্পীর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ণ দেখে, ফিরে আসার আগে, সামনে এসে বসলেন শিল্পীর ছোটবোন। দুইবোনের মুখশ্রীর মিল অবাক করা। গরম চায়ের পেয়ালা দিয়ে আপ্যায়ন শেষে বিদায় নিয়ে ফিরে আসার আগে পরমাত্মীয়ের মতোই বললেন ‘আবার এসো।’ অভিভূত আমার মুখে বিশেষ কথা জোগায় না।ওই আন্তরিকতার জবাবে,ধন্যবাদও কী দেওয়া যায়!
পরদিন সকাল সকাল টোটোওয়ালা এসে হাজির। তার অভিভাবকত্বে নিজেকে সঁপে দেবার আগে, নিজের ইচ্ছেটাও জানান দিয়ে রাখি।
প্রতিভা বসুর মতোই, লীলা মজুমদারও চেয়েছিলেন শেষজীবনে এই শান্তিনিকেতনেই ঠাঁই নিতে। অনেক পরিশ্রমের পর তৈরী হলো তাঁর মনের মতো বাড়ি। তার বিস্তৃত বিবরণ নিজেই দিয়েছেন সম্ভবত পাকদন্ডী বইতে। বাড়ির নাম হলো
সু-র-ক-লি, স্বামী,পুত্র,কন্যা এবং নিজের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে।
গাছপালায় ঘেরা সেই বাড়ির জানলার পাশে লেখার টেবিল। খাতার পাতা রোদে মাখামাখি।সেইখানে বসে তিনি লিখে চলেছেন- হলদে পাখির পালক। সেই পূণ্যতীর্থ না দেখে কী ফেরা যায়!টোটোওয়ালা হতাশ। সেই বাড়ি তো আর নেই গো। হাতবদলের পর সেটি এখন নিশ্চিহ্ণ। তবুও আমার হতাশা কাটাতে শুধু জায়গাটি দেখাতেই আমায় নিয়ে চলে সে। গাইড হওয়া কী চাড্ডিখানি কথা!!
আশাপূর্ণা দেবীর সাধের বাড়ি ‘উজ্জ্বয়িনী’রও ওই একই হাল।আশাপূর্ণাদেবীর স্বামীর নাম ছিল কালিদাস গুপ্ত। শুনেছিলাম স্বয়ং নরেন্দ্র দেব নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাড়িটির, ওই নামটিই পছন্দ করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িটির কথা টোটোওয়ালার জানা নেই। শোনেই নি সেটির কথা। তাও চেষ্টা চালায় বেচারি। ইজ্জত কী সওয়াল! কিন্তু সেই বাড়িটি সম্পর্কে কেউই কোন খবর জানাতে পারে না। কেউ যে আমাকে ভারতবর্ষের মানচিত্র খুঁজে দেখার পরামর্শ দেয় নি এই ঢের!
বাড়িটি না হয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, জমিটিও কি তাই ! আমার স্বনিযুক্ত গাইডটির অহমিকা চূর্ণ! সাধে কি আর শাস্ত্রে বলেছে ‘মা কুরু…’ ইত্যাদি ইত্যাদি, থাক সেকথা।
সারথিটি এতক্ষণ আমারই ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আহত সম্মান পুনরুদ্ধারে, এবারে লাগামটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, নিজেই হাল ধরলেন। নিত্যই কতো ঝামেলাবাজ ট্যুরিষ্ট সামলান তিনি! আর এ-তো…..,আমিও চুপটি করে বসে থাকি,উটকো বায়না ধরি নে।
পিচের মসৃণ পথ বেয়ে চলতে চলতে আচমকাই, এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় নেমে যায় টোটো। দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে, কোথায় কে জানে! সহসাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যান চালক ।
বাঁ ধারে খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অর্ঘ্য সেনের বাড়ি… ‘খোঁয়াড়’। বাইরে থেকে দেখে মোটেও খোঁয়াড়ের মতো ঠেকে না, হাট করে খোলা গেটের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় একফালি সবুজ জমি, ওপাশের কিনারা ঘেঁষে কিছু আটপৌরে ফুল গাছ। বাইরে দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। নীচ তলায় কারা যেন ঘরের কাজে ব্যস্ত। একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিত্যই এমন পাতিমার্কা লোকজন দেখে তারা ক্লান্ত।দোতলাটি বন্ধই। বাড়ির এমন নামকরণের কারণ ব্যখ্যা করতে পারতেন যিনি, তিনি দর্শকদের কাছে জবাবদিহি করার জন্য এই ধরাধামে আর বসে নেই।একটু এগিয়েই ডান হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলা বাড়ি— ‘একা এবং কয়েকজন’, একলাটি দুয়ার এঁটে নিশ্চুপ। বাইরে থেকেও কিচ্ছুটি দেখবার জো নেই। লোহার পাতে মোড়া পেল্লায় কপাটটি যেন বাড়িটিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এবার এগিয়ে আসেন আমার অভিভাবক, টোটো স্যার।
গেটের বাইরে থেকেই পেল্লায় একখানা বাঁজখাই হাঁক ছাড়তেই, চিচিং ফাঁক।কেয়ার টেকার তার চেনা মনিষ্যি কিনা।সেই সুবাদে গেটের ভিতরে লাল কাঁকুরে পথটিতে পা রাখার অনুমতি মেলে। পথটি সোজা এগিয়ে বাড়ির সদরের সিঁড়ি ছুঁয়ে দুপাশে চলে গেছে। ডানপাশে লন। লনের ওপাশে সুনীলের কালো পাথরের আবক্ষ মূর্তি। সামনে দোতলা বাড়িটি এখন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে, বাঁদিকে ছোট্ট পুকুরে হাঁস সাঁতার দেয়। দেখতে দেখতে মনে ধাঁধা লাগে ,ওই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন, মহা সোরগোল তুলে সশব্দে দোতলায় উঠে যাচ্ছেন সিঁড়ি বেয়ে!
টোটোওয়ালা সারাদিন আমায় ঘোরায়, হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারে সে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
দূর থেকেই দেখি রাণী চন্দের বড়ো সাধের ‘জিৎভূম,’ বুদ্ধদেব গুহর ‘রবিবার’, —এই তো মাত্তর সেইদিনও যেখানে জমাটি আড্ডাটি বসেছিলো।শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতে এসে জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন কবি অশোকবিজয় রাহা। শান্তির নীড় ছোট্ট বাড়িখানার নাম দিলেন ‘সুরাহা’…স্ত্রী সুপ্রীতি আর অশোকবিজয় রাহার মিলিত রূপে বাড়ির নাম। কতশত জ্ঞানীগুণীজনের আনাগোনা।সদাহাস্যময়ী সুপ্রীতি তৎপর থাকতেন অতিথি সেবায়।
আজ বাড়িখানার হাতবদল হয়ে সেখানে উঠেছে আধুনিক কেতার দোতলা বাড়ি। গেটের বাইরে প্রস্তর ফলকে ‘সুরাহা’ নামটি অটুট রয়েছে এইটুকুই যা সান্ত্বনা।
শেষ বেলায় এসে দাঁড়াই ‘স্বাগত বিদায়’ এর বন্ধ গেটের সামনে। ওই তো বিশাল জমির ওপ্রান্তে দু কামরার ছোট্ট বাড়িখানা।
একসময়ের গুণীজনসম্মেলন ধন্য, সেই আবাস, আজ একাকী, নিশ্চুপ। বাগানভরা ফুলেরা কবেই বিদায় নিয়েছে, ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের দাপটে। কেবল গেটের ফলকের ‘স্বাগত বিদায়’ আর বারান্দার থামে উৎকীর্ণ, ‘চিঠি’ শব্দটি আজও অপেক্ষায়।
ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামে, আকাশে একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যায়… বুঝি চুপিসাড়ে দেখে যায় এই অবেলায় আবার কে এলো !
পাশেই সোনাঝুরি। গায়িকা অনেকদিন আগেই বিদায় নিলেও বাড়িটি সযতনে রক্ষিত। কারা যেন আজও বসবাস করেন সেখানে।গেটের সামনে থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি লাল মোরামের পথটিতে,গুটিকতক সাদা ফুল ঝরে পরে আছে। মনের মধ্যে সব কিছু ভরে নিয়ে ফিরে চলি।
অদেখা রয়ে গেল আরও কতো শতো পূণ্যস্মৃতির ঠিকানা। ভারি মনে পথ চলি। আগামীকাল,কলকাতা ফেরার টিকিট। কিন্তু একেবারেই ফিরে যাওয়া কী যাবে!
নিজেকেই নিজে কথা দিই আবার আসিবো ফিরে, আসবোই। -
গল্প- শারদোৎসব
শারদোৎসব
সুমিতা দাশগুপ্তআকাশ জোড়া পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের অঝোরধারার বর্ষণে পৃথিবী যখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ,মনখারাপি আবহ আর কাটতেই চায় না,ঠিক সেইসময়েই সহসা একদিন মেঘ ছেঁড়া আলো এসে উদ্ভাসিত করে তুললো আমাদের সাধের পৃথিবীখানাকে। নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো শরৎকাল,গ্রামে গঞ্জে,মাঠে ঘাটে,নদীর ধারে আগমনী গান গেয়ে উঠলো গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। নিঝুমরাতের নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে, আকাশ থেকে তারার বাণী বহন করে যেন শিশির ঝরলো টুপটাপ।ঘুম ভাঙলো শেফালির। শিউলি গন্ধ মাখানো ভোরে,জেগে উঠলো মানুষ, মনে পড়ে গেল মেলাই কাজ পড়ে আছে,গড়িমসির সময় নেই আর। শারদোৎসব আসন্ন !
পাড়ায় পাড়ায় , বড়ো মাঠে পড়ে থাকা স্তূপাকৃতি বাঁশের দল, গা ঝাড়া দিয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠলো, জলদি করো,জলদি করো, প্যান্ডেল বাঁধতে হবে ! সময় তো আর বেশী নেই, মা দুগগা এলেন বলে!
আসলে পুজো মানেই তো ফিরে আসা, ফিরে আসা নিজেরই কাছে, নিজের মাঝে, পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো অনুষঙ্গের অপ্রতিরোধ্য টানে। এই পুজোর সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে কত হারিয়ে যাওয়া দিন, মানুষজন,ঘর বাড়ি, আর ছেলেবেলা।আমাদের ছেলেবেলার অনেক ক’টা দিন কেটেছে বিহারে, বাবার কর্মস্থলে।
বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে তাঁকে, আকছার ছোটবড়ো নানা জায়গায় বদলি হতে হতো। বসবাসের জন্য অবশ্য রেল কোম্পানির কোয়ার্টারের সুবিধে মিলতো, ছোট, বড়ো মাঝারি, বাগানওয়ালা, বাগানবিহীন ইত্যাদি নানা কিসিমের কত রকমের যে বাড়ি ঘর দোর! নতুন জায়গায়,নতুন বন্ধুবান্ধব, তাদের অন্য ধরনের আচার ব্যবহার, জনবসতি। তবে একটি জিনিসই কেবল অপরিবর্তিত থাকতো। যখন যেখানেই থাকি না কেন, যথাসময়ে পুজোর গন্ধটা ঠিক মনের দুয়ারে কড়া নাড়তোই। জায়গা ভেদে মাতৃমুখের আদলে হয়তো কিঞ্চিৎ হেরফের হতো, আঞ্চলিক কারিগরের হাতে, তবে তাতে বিশেষ কিছু এসে যেতো না। মা,তো মা-ই হন। আয়তনেত্রের ওই করুণাঘন মায়াদৃষ্টির তো আর বদল হয় না!
আমরা যখন একটু বড়ো হয়ে উঠছি, সেইসময় বাবা বদলি হলেন বিহারের একটি সদর শহরে। কোয়ার্টারখানাও একটু অন্য ধরনের । বড়ো বড়ো পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো পেল্লায় উঁচু ছাদওয়ালা , আগাগোড়া কাচের দরজা জানলা, কাঠের সানশেড, সামনে লম্বাচওড়া বিস্তৃত একখানা বারান্দা। তিন চার ধাপ সিঁড়ি নামলেই,বাড়ির চারপাশে অনেকটা করে বাগান করার জায়গা।
ওগুলোতে নাকি এককালে সাহেবসুবোদের কোয়ার্টার ছিলো। স্বাধীনতার পরে এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে দেশীয় সাহেবদের সেইসব কোয়ারর্টারে থাকতে দেওয়া হতো। এটি ছিল সেই জাতেরই একখানা বাড়ি।
সাহেবরা চিরকালের শৌখিন জাত। তাঁদের সময়ে, তাঁরা নিশ্চয়ই কোয়ার্টার সংলগ্ন বিস্তৃত ওই জায়গাটিতে ফুল ফলের বাগান তৈরী করেছিলেন, তবে আমরা যখন ওই বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলাম, তখন আর সেই সবের চিহ্ণমাত্রও ছিল না।অনাদরে অবহেলায়,কবেই সেইসব বাগান বিলুপ্ত।এখন তার শুকনো মরুভূমিসদৃশ আকার । আগের বাসিন্দারা বোধহয় ঘোরতর বৃক্ষবিরোধী ছিলেন।ওদিকে আমাদের বাবা আবার চিরকালের বাগানবিলাসী, গাছপালার সঙ্গে তাঁর অগাধ মৈত্রী। লতাপাতারা তাঁকে দেখলেই ডেকে কথা কয়। অতএব রতনে রতন চিনে নিল। কোয়ার্টারের সামনে ,পাশে , পিছনের বিস্তীর্ণ পোড়োজমি সদৃশ এলাকা,অচিরেই ফুলে ফলে বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ হয়ে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠলো।
দেখতে দেখতে দূরের পাঁচিলের সীমানা বরাবর,সারি সারি আম, পেয়ারা, সজনে গাছেরা মাথা তুলতে আরম্ভ করলো, হাওয়ায় তাদের ডালপালারা খুশিতে মাথা দোলায়। রুক্ষ লালচে মাটিতে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, এতদিনে কোয়ার্টারটাকে বেশ বাড়ি বাড়ি মনে হতে থাকলো।মাঝে মাঝে মায়ের আফশোশ ,কবে আবার বদলির হুকুম আসবে কে জানে! সব ছেড়েছুড়ে পাততাড়ি গুটোতে হবে!বাবা তখন দার্শনিক , আনমনে গানের লাইন আওড়াতে আওড়াতে জলের ঝারি হাতে তুলে নেন…
“পরের জায়গা,পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই…”
বাবার গলার স্বর ক্রমশ মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায়।আমাদের তখন অতোশতো গভীর তত্ত্ব বোঝবার, বয়সই নয়! ছুটির দিনে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই। গাছপালার সঙ্গে একধরনের সখ্যও জন্মায়।
উঁচু বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে, লাল ইট বাঁধানো রাস্তা এগিয়েছে মূল ফটকের দিকে।সেই পথের দুপাশে বেলিফুলের ঝাড়, বৈশাখের ভোরের হাওয়াকে গন্ধে বিভোর করে তোলে। রাতের ঘুমে হাসনুহানা, আর লেবুফুলের স্নিগ্ধ সুবাস শান্তির প্রলেপ দেয় ।ওদিকে বর্ষার জল পেয়ে,পাঁচিলের ধারে ধারে স্থলপদ্ম আর শিউলিগাছ তেজী হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। পুজো আসছে, মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে, তাদেরই তো চাই। তখনও বিহারপ্রদেশে,খুব কম বাড়ির বাগানেই তাদের দেখা মিলতো। বাবা, কলকাতার রথের মেলা থেকে চারা সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
ক্রমে পুজো এসে পড়ে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে চকচকে মসৃণ রাঁচি- হাজারিবাগ রোড। একটু দূরেই সেই রাস্তাটি বাঁক নিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে। সেই মোড়ের খাঁজে একখন্ড এবড়োখেবড়ো জমি্ সমান করে নিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়। ষষ্ঠির দিন সকালে প্রতিমা আসে।
আমাদের কাছাকাছি এলাকায় ওইটিই একমাত্র পুজো, অতএব অলিখিতভাবে ,ওটি আমাদেরই নিজস্ব পুজো। তাই উৎসাহ উদ্দীপনার আর অন্ত নেই।
সপ্তমীর সকালে ভোর হবার অপেক্ষা শুধু। স্নান সেরে, বাগান থেকে নতুন কেনা ছোট ছোট বাঁশের চুপড়ি ভরে শিউলি, স্থলপদ্মের রাশি নিয়ে দে ছুট, পুজোমন্ডপে ঠাকুরমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে তো! হরিণ গতিতে ভাই, আমার চাইতে অনেকটা এগিয়ে যায়,আমি পিছু পিছু ছুটতে থাকি।
অন্যান্য কিছু বাড়ি থেকেও পুজোর ফুল আসে , কিন্তু স্থলপদ্ম! উঁহু, সেটি আর হয় না। ঠাকুরমশায়ের হাতে ফুলের ডালাখানা ধরিয়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠে দুই ভাইবোনের।
যথাসময়ে পুজো আর অঞ্জলি শেষে,একটু করে প্রসাদ মেলে, আখের টুকরো- পেয়ারা কুচি। ভাঙা নাড়ু পেলে তো আর কথাই নেই আহ্লাদে আটখানা। আমাদের মধ্যে ততক্ষণে কার ক’খানা, জামা হলো, কে কবে কোনটা পড়বে, দূরের হিলকলোনির পাড়ার সিংহটার চোখটা কেমন যেন ট্যারা ,ওদের চাইতে আমাদের প্রতিমা হাজার গুণে ভালো ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে,ওদিকে মায়েদের ঘর গেরস্থালির কাহিনী… কোন ফাঁকে বেলা গড়ায়। ঘরে ফেরার সময় এসে পড়ে।
না ,তখনও এই দুনিয়ায় কর্পোরেট জগতের অঢেল দাক্ষিণ্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি পুজো প্যান্ডেলে, আমাদের ওই ছোট্ট বিহারী শহরে তো নয়ই, ফলে প্যান্ডেলে বসে ঢালাও খিচুড়ি খাবার গল্প তখনও দূর অস্ত্ , তবে যথাসময়ে প্যান্ডেলে উপস্থিত থাকলে শালপাতার দোনায় করে অল্প বিস্তর ভোগপ্রসাদও পাওয়া যেত বৈকি!
সন্ধ্যে হতে না হতেই,প্যান্ডেলের আলো জ্বলে ওঠে, গেটের আলো ছড়িয়ে পড়ে বাইরের ফাঁকা মাঠে। একে একে সবাই জড়ো হয়।অন্য পাড়ার লোকজনও কেউ কেউ আসেন প্রতিমা দর্শনে। তাঁদের দেখলেই আমরা ঠিক চিনে ফেলি , এঁরা আমাদের নন, অন্য পাড়ার ,নিজেদের মধ্যে কানাকানি চলে, গুরুজনদের ধমক খেয়ে চুপ করি।
শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় আরতি, বাজে ঢাক ঢোল,কাঁসর ঘন্টা।ধুনুচির ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসে মায়ের মুখ। ক্রমে রাত বাড়ে।
বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরি। শুনশান নির্জন পথ, মাথার উপরে একফালি চাঁদ, আকাশ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে, আমরা কেউ কথা বলি না , চুপচাপ পথ হাঁটি।
জীবনে তো কত পথ হাঁটা হলো, পাল্টে গেল বাড়িঘর,স্থান কাল পাত্র। দেখা হলো কতো ধরনের,পুজো, পুজোর আড়ম্বর, আয়োজন,সাজসজ্জা,মনোমুগ্ধকর অসামান্য সব শিল্পকর্ম।
তবু আজও জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে পুজো বলতেই মনের মাঝে ভেসে ওঠে সেই কতকাল আগে দেখা একটি মুখচ্ছবি,আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অর্চনা।
মন ফিরে চায়, সেদিনের সেই ছোট বিহারী শহরে। সেবারে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করেছেন বেলাবেলি প্রতিমা বিসর্জনে রওনা হওয়া হবে, সকাল সকাল যেন বরণের কাজ সেরে ফেলা হয়।
মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোনও উপস্থিত। মা স্টেজে,আমরা নীচে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখছি, বিশেষ করে কাছাকাছি গাঁও থেকে,প্রতিমা দর্শনে আসা একদল মানুষকে। কমলারঙা সিঁদুরমাথায় ঘোমটা টানা মহিলারা, মলিন বেশে ছেলেপুলে, যুবক, বৃদ্ধের একটা ছোটখাটো সমাবেশ।হঠাৎ হৈ হৈ রব, পিছু ফিরে দেখি স্টেজে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, সবাই দ্রুত নেমে আসছে –কীভাবে যেন প্রতিমার পিছনের পাতলা কাপড়ে আগুন ধরে গেছে! আগুন ছড়িয়ে পড়লো বলে!
সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সহসা দুহাতে ভীড় ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে স্টেজে উঠে এলো এক দেহাতী তরুণ, ঝাঁপিয়ে উঠে পড়লো জ্বলন্ত আগুনের পাশে,প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে। আগুনের হল্কা উপেক্ষা করে, হাত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে থাকলো জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরোগুলো যাতে, আগুন মায়ের অঙ্গস্পর্শ করতে না পারে! নিজের প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নেই ।
অবশেষে সে সফল হলো। আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারলো না,এড়ানো সম্ভব হলো বড়সড়ো বিপর্যয়।
এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঘিরে ধরলো তাকে,কেউ চায় তার পরিচর্যা করতে,আবার কেউ বা সাবাশি দিতে। তাঁর কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই,সে তখন মায়ের সামনে নতজানু হয়ে দরবিগলিত নয়নে অনন্যমনা হয়ে প্রার্থনা করে চলেছে, মা যেন ক্ষুদ্র মানুষের অপরাধ না নেন।
আজ এতগুলো বছর পার করে এসে, জীবনের অপরাহ্ণবেলাতেও প্রার্থনার সেই মুখচ্ছবিটি আমার মনে একই ভাবে সমুজ্জ্বল। -
গল্প- খেলা যখন
খেলা যখন
-সুমিতা দাশগুপ্ত
আজ রবিবার। ভোরবেলাতেই জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।এখন আকাশটা পরিষ্কার। নীল আকাশ বেয়ে সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ছে গাছগাছালির মাথায় মাথায়। চমৎকার দেখাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির শোভা, শুধু ডাঃ দিব্যদ্যুতি রায়ের আজকের প্রাতর্ভ্রমণটাই মাটি হয়ে গেল, এই যা!দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গেটের বাইরে সোজা কালো পিচের রাস্তাটার দিকে চেয়েছিলেন দিব্য। বৃষ্টিতে ঝরে পড়া কদমকেশর আর ছাতিমফুলের ছেঁড়া পাঁপড়িতে কালো পিচের রাস্তাটা যেন সেজে উঠেছে। শরৎকাল প্রায় এসে গেল ,তাও এই বছরে বৃষ্টিটা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। মহালয়াটা যেন কবে? আরে আজকেই তো!! এবারে মহালয়াটা রবিবারে পড়ায়,আলাদা ছুটি মেলে নি বলেই বোধহয় তারিখটা ঠিক খেয়াল করতে পারছিলেন না তিনি।
অভিজাত এই শুনশান পাড়াটায়, শব্দদূষণের প্রকোপ যেমন নেই, তেমনই নেই, ভোরবেলায় পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসা মহালয়ার স্ত্রোত্রপাঠের মন ভালো করা সুর।প্রতিবেশীরা সবাই কেমন যেন দূরে দূরে, প্রত্যেকেই নিজের মনে একলা থাকার অভ্যেস রপ্ত করে নিয়েছে।
একদা মধ্যবিত্ত দিব্য রায়, এখানে এসে পাড়া কালচারটা বড্ডো মিস্ করেন, অবশ্য কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকেন তিনি ! সেই সাত সকালে বাড়ি থেকে বের হন, আর ফেরেন যখন তখন তো সন্ধ্যের চৌকাঠ পেরিয়ে, দিন রওনা দিয়েছে রাত -গভীরে।শহরের ব্যস্ততম ডাক্তারদের অন্যতম দিব্যদ্যুতি রায়ের, সারা সপ্তাহ দম ফেলবার ফুরসত থাকে না, কেবল রবিবার আর ছুটিছাটার দিনগুলিতেই ঢিলেঢালা অবকাশে সময় কাটানোর সামান্য যা সুযোগ মেলে।
ছুটির দিনে ভরপেট জলখাবার খেয়ে,ফোনে
দুই একজন আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে টুকটাক গপ্পোগাছা,ল্যাপটপে জমে থাকা ব্যক্তিগত মেইলগুলো চেক করে প্রয়োজনীয় চিঠিচাপাটি চালাচালি, এইসব করেই সকালটা পার হয়ে যায়। এছাড়া কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। না, কোনোও বাঁধাধরা রুটিনমাফিক ব্যাপার নয়। স্বেচ্ছায় একেক দিন গিয়ে ঘুরে আসেন কয়েকটি ওল্ড এজ হোম থেকে। সাধারণ হেলথ চেক আপ, কিছুক্ষণ বৃদ্ধমানুষগুলির সঙ্গে বসে, সুখ দুঃখের গল্প করা, কারো কারো ব্যক্তিগত সমস্যায় কিছু পরামর্শ দেওয়া, অথবা সম্ভব হলে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এইসবই আর কী! এইটুকতেই কতো যে খুশি হয়ে যান একাকী নিঃসঙ্গ মানুষগুলো, সেই হাসিখুশি মুখগুলো দেখে দিব্যর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। না, কোনও স্বার্থ নয়, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধে এই কাজগুলো করে থাকেন তিনি, ঠিক তাঁর নিজের বাবার মতোই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন তাঁর বাবা, রবিবার সকালটায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এলাকার গরীবগুরবো মানুষগুলোর। দিব্যও বোধহয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই এই দায়িত্ববোধটুকু বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন।দুপুরে পছন্দের খাওয়া দাওয়া, কোনও দিন দিবানিদ্রা, কখনও বা গপ্পের বই— সন্ধ্যাবেলায় কোনোদিন গ্রুপ থিয়েটার, আবৃত্তির আসর, অথবা চিত্রপ্রদর্শনী। ব্যস্, এইভাবেই কেটে যায় অকৃতদার দিব্য রায়ের একলা জীবন। গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা রবিঠাকুরের ভাষায়—- “যেন ঘোলা জলের ডোবা,না সেখানে হাঙর কুমিরের নিমন্ত্রণ,না রাজহাঁসের।”
পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো,সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দিব্যদ্যুতি রায়, আজও সুদর্শন।বয়স বিশেষ একটা ছাপ ফেলতে পারে নি, কেবল একমাথা চুলের সামনেটায়,একগুচ্ছ কাশফুল অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখে যায়।
দিব্যর সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার বিভামাসিমার উপরে। না, রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই তাঁর সঙ্গে, কিছুটা আকস্মিক ভাবেই বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের জেরে দুটি মানুষ আজ পরষ্পরের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিব্যর পরিচিত একটি বৃদ্ধাবাসে, দায় এড়িয়ে ফেলে রেখে যাওয়া, অসহায়,নিঃসন্তান, ভাগ্যতাড়িতা অভিজাত মহিলাটিকে,দিব্যই একদিন উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। দয়া নয়, মানবিকতা! আশ্রিতা হিসেবে নয়, সসম্মানে মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এই সংসারে।
ব্যাপারটা ঘটেছিল খুব আকস্মিকভাবে।সেদিন দিব্যর ওখানে যাবার কথা ছিল না তবু ঘটনাচক্রে আচমকাই গিয়ে পড়েছিলেন ওই হোমটিতে।
সেইদিনই আবার হোমের কর্তৃপক্ষ,বিভাদেবীর হাতে ঘরছাড়ার নোটিস ধরিয়ে দিয়েছিলো। গত দুমাস ধরে নাকি প্রতিশ্রুতিমাফিক টাকাপয়সা জমা পড়ছিলো না। তথাকথিত আত্মীয়রা, যারা নাকি, কী সব কাগজপত্তরে, সইসাবুদ করিয়ে তাঁর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করার এবং নিয়মিত তাঁর মাসের টাকা পয়সা,তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়ে যাবার কড়ারে, ব্যাঙ্কের সমস্ত কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে , এবং সুযোগ বুঝে তাঁকে ঘরছাড়া করে এই বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল, সম্প্রতি তারা সবাই নাকি “আনরিচেবল!”
নিজের সন্তান ছিল না বলে, বিভাদেবী যাদের সন্তানতুল্য জ্ঞান করতেন, বুকে করে মানুষ করলেন, স্বামী মারা যাবার পর, তাদের এই রূপান্তর তাঁর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।
লোক পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে, সাবেকী বসতভিটা ভেঙে, ফ্ল্যাট উঠছে। প্রোমোটারের কাছ থেকে পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে শরিকরা সবাই হাওয়া হয়ে গেছে।অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিলেন বিভাদেবী। দিব্য রায় সেদিন বুঝি বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন,তাঁর সামনে। ডুবে যাবার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোই দিব্যর হাত দুখানি ধরে বিভাদেবী,অশ্রুসজল চোখে, তাঁকেই কোনও অনাথ আশ্রমে
যা হয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। নইলে যে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিলো না।
অন্য কেউ হলে হয়তো বা দায় এড়িয়ে চলে যেতো, কিন্তু দিব্য পারেন নি। কী দেখেছিলেন সেই বিপন্ন মুখে কে জানে! হয়তো বা কতোকাল আগে লোকান্তরিতা মায়ের ছায়া!
সেই মুহূর্তে কী করবেন ঠিক করতে না পেরে, হোমের বাকি বকেয়া মিটিয়ে আরও ক’টা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। বড়ো কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা, বিচার বিবেচনা করার প্রয়োজন। বিপাকে পড়েছেন বলেই একদা সম্পন্ন ঘরের মাতৃসমা মহিলাটিকে কী করে অনাথ আশ্রমে, প্রায় পরিচারিকা হতে, রেখে দিয়ে আসা যেতে পারতো!
শেষটায় অনেক ভেবে দিব্য তাঁকে এই বাড়িতেই নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না মহিলাটিকে অবশ্য সহজে রাজি করানো যায় নি। অনেক কষ্টে অবশেষে দিব্য তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলেন, যে প্রয়োজনটা কেবল তাঁর একার নয়, পারষ্পরিক। বস্তুত কয়েকমাস আগে প্রবল ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত দিব্যকে, মধ্যরাতে একগ্লাস জল এগিয়ে দেবার মতো একজনও কেউ ছিলো না। সেই থেকে, সত্যিই ইদানীং দিব্যর মনে, মাঝে মাঝে একটা বিপন্নতাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো।
দিব্য, বিভাদেবীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, লোকে যদি সন্তান দত্তক নিতে পারে ,তাহলে মা’কেই বা কেন নয়!
অনন্যোপায় বিভাদেবী প্রথমটায় সাময়িকভাবে থাকতে রাজি হয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন-এই শর্তে, কিন্তু পরবর্তীকালে,এই স্বজনহীন ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খল সংসারে, দিশাহারা দিব্যকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারেন নি। তিনি থাকলে, সময়ে ভাতের থালাটুকু তো অন্তত মিলবে দিব্যর। আবারও সেই মায়া!!
বলাই বাহুল্য , নিকট আত্মীয়ের দল, যাঁরা কিনা নিজেদের দরকার ছাড়া, কখনো উঁকি দিতেও আসতেন না, তাঁদের কপালে বড়ো বড়ো চিন্তার ভাঁজ পড়েছিলো বৈকি, কিন্তু তাতে বিভাদেবীর কিচ্ছু এসে যায় নি । অতঃপর,সন্তানসম মানুষটির এই সংসারেই তিনি থেকে গেলেন দিব্যর মাসিমা হয়ে।
এই বাড়িতে আসার পর তিনি হাফডজন চাকর-বাকর, মালি, ড্রাইভারের হাতে থাকা টালমাটাল সংসারটির হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী, মৃদুভাষী মহিলাটির নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারোর হয় না, এমন কী খাওয়া দাওয়া, শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দিব্যকেও আজকাল তাঁর নির্দেশ মেনেই চলতে হয়।বিভাদেবীর সব চাইতে ভালো ব্যাপার হলো, দিব্যর ব্যক্তিগত পরিসরে, তিনি কোনও দিন মাথা গলান না, নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ।
মোটকথা বিভাদেবী আসার পর, দিব্যর ছন্নছাড়া সংসারটা আবার মনের খুশিতে ঘরোয়া কাজকর্মের খুটখাট আর বাসনকোসনের ঠুনঠান, সুরেলা আওয়াজে মেতে ওঠে। স্রেফ ইট-কাঠ কংক্রিট দিয়ে তৈরী দিব্যর বাড়িখানা, এখন বেশ গেরস্তর ঘর-দুয়ার হয়ে শোভা পায়!
ইতিমধ্যে দিব্য আরও একটা কাজ করে ফেলেছেন। তাঁর প্রাক্তন রুগী, শহরের এক নামজাদা দুঁদে উকিল এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে, বিভাদেবীর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটি চালু করে দিয়েছেন। না শুধুই অর্থের জন্য নয়, ন্যায়বিচার পাবার অধিকার তো সকলেরই আছে। আরও একটা কারণে দিব্য এই পদক্ষেপটি নেওয়া জরুরী মনে করেছিলেন, নিজেকে আশ্রিতা ভাবার কুন্ঠাবোধ থেকে বিভাদেবীকে মুক্তি দেওয়া।এখন বেলা প্রায় এগারোটা। সকালের বৃষ্টিটার পর চড়া রোদ উঠেছে। বাগানের কোণের শিউলি গাছটা থেকে ঝরা শিউলির মৃদু সুবাস এখনও হাওয়ায় ভাসছে।
শিউলি ফুল মায়ের খুব প্রিয় ছিলো। মাসিমা সেই কথা জানতে পেরে রোজ সকালে কাঁচের ডিশে করে একরাশ শিউলি ফুল মায়ের ছবির সামনে রেখে আসেন। দিব্যর মনটা ভরে যায়।জীবনটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত।
কে যে কোন অন্তরালে বসে তার অদৃশ্য
অঙ্গুলি হেলনে এই বৃহৎ সংসারের নাটমঞ্চ পরিচালনা করেন ,ভেবেও কূল তল পাওয়া যায় না।
জীবনে একটু থিতু হতে না হতেই, দিব্যকে এই বিশাল পৃথিবীতে একা করে দিয়ে বাবা,মা দুজনেই চলে গেল, তারপরেও যাকে আঁকড়ে ধরে, নতুন করে জীবন সাজাতে চেয়েছিলেন
সে-ও তো—ভাবনাটা মনের চৌকাঠে এসে দাঁড়াতেই, সজোরে এঁটে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।
‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
চটপট ঘরে এসে বিছানায় বসে ল্যাপটপটা খুলে বসলেন।
ও বাবা! কতো মেইল এসে পড়ে আছে। সবই সেই অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসা। সপ্তাহ পার হয়ে গেল,এখনও লোকের এতো উচ্ছ্বাস!
সম্প্রতি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসা হতদরিদ্র একটি শিশুর খুব জটিল হার্ট অপারেশন করেছিলেন তিনি এবং তাঁর সহযোগিরা। সাফল্যের আশা প্রায় ছিলোই না। কতোটা তাঁদের হাতযশ আর কতোটা ঈশ্বরের কৃপা সে বিষয়ে তিনি নিজেই আজও নিশ্চিত নন। সংবাদপত্রে খবরটা ফলাও করে বেরিয়েছিল। দুই একটা কাগজ আবার তাঁর এবং সহযোগীদের ছবিও ছেপে দিয়েছে। ব্যস্ সারা শহর জুড়ে হৈ চৈ। উফফ্ ,বড়োই এমব্যারাসিং। এতো হৈ চৈ করার মতো কিছু আছে বলে দিব্য মনে করেন না। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন যে কোনও ডাক্তারকেই তো,কখনও না কখনও প্রাণ বাঁচানোর এই লড়াইটা লড়তেই হয়!
হ্যাঁ এক্ষেত্রে লড়াইটা খুব কঠিন ছিলো সন্দেহ নেই, তবু…।
মেইলগুলো পরপর চেক করছিলেন। দরকারি কিছু মিস্ হয়ে না যায়। নজর বোলাতে বোলাতে আচমকা এক জায়গায় এসে দিব্যর নজরটা আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, লন্ডন থেকে জনৈক মিসেস ব্রাউন,একখানা দীর্ঘ মেইল পাঠিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! কে এই মিসেস ব্রাউন! এই নামে কাউকে চেনেন বলে তো মনে পড়ে না, তা-ও আবার ঝরঝরে বাংলায়,এবং নির্ভুল বানানে!
কৌতূহলী হয়ে চিঠিতে মন দিলেন দিব্য।“শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
আপনি আমাকে চিনবেন না,আমি হলেম ঝুমকোলতা,আমার মায়ের নাম কলমীলতা,ওরফে কমলিনী।”
— কী –ই-ই। প্রচন্ড জোরে একখানা ধাক্কা লাগলো বুকের মধ্যে।
ঠাস্ করে বন্ধ করে দিলেন ল্যাপটপটা। ছটফটিয়ে উঠে আবার বেরিয়ে এলেন বাইরে। কে এই মিসেস ব্রাউন! তাঁর মুখে এইসব নাম ! কী করে –কোথা থেকে? আশ্চর্য!! যে কথা কেউ জানে না,যা একান্তই তাঁর মনের মণিকোঠায় তুলে রাখা নিজস্ব সম্পদ, সাত রাজার ধন এক মানিক, সেকথা অন্য কেউ জানলো কি করে!
উদগ্র কৌতূহল,তাঁকে বাধ্য করলো আবার ঘরে ফিরে এসে ল্যাপটপখানা খুলে বসতে।” জানি এইটুকু পড়েই আপনি টানটান, হয়ে উঠে বসেছেন। আরে দাঁড়ান,
আগেই অতোটা উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনাকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়,বরং বলতে পারেন, অচেনা কারো লেখা চিঠিখানা আপনি যাতে এড়িয়ে না যান, একটু মন দিয়ে আমার সমস্যাটার কথা শোনেন, সেইজন্য শুরুতেই এই ধাক্কাটা দিতে চেয়েছিলাম।আমার যে আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
এবারে আসল কথায় আসি।
শুনুন বলেছি বটে আমার মা, আসলে তিনি আমার মাতৃসমা পিসিমণি, আর আমি, তাঁর জীবনে ‘কোনওদিন না আসা মেয়ে’, —যাকে বলে মানসকন্যা। আমার আসল নাম, স্পৃহা।
আপনার বর্তমান অবস্থান, অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই আমার জানা নেই, কিন্তু এই দুনিয়ায় আর কাউকেও খুঁজে পেলাম না যিনি এই বিপদ থেকে আমার পিসিমণিকে উদ্ধার করতে পারেন। আমার পিসিমণির খুব বিপদ।
এককালে এই পৃথিবীতে আপনিই তো ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন! তাঁর নিজের লোকেরা যে থেকেও নেই ,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানে!
ভাবছেন হয়তো আমি নিজেই কেন এগিয়ে যাচ্ছি না।আসলে এই মুহূর্তে আমি একেবারে নিরুপায়। একে আমি লন্ডনবাসী,তার উপরে গত সপ্তাহে একটি কন্যা সন্তানের জননী হয়েছি। আশাকরি পরিস্থিতিটা বোঝাতে পারলাম।
আপনি হয়তো জানেন না, আপনাকে হারিয়ে পিসিমণি, সারাটা জীবন, সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে নিজের তৈরী করা জগতেই বসবাস করে গেলেন। সেই জগতে ‘ফুল নেই পাখি ডাকে না, ভরা গলায় নাম ধরে ডাকে না কেউ’…তিনি আজও মনে মনে আপনারই পথ চেয়ে বসে আছেন।
মাঝের এতোগুলো বছর তাঁর কাছে, অস্তিত্বহীন। না,তিনি পাগল নন, কেবল গভীর বিতৃষ্ণায়,পরিবারের মানুষগুলিকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তারা যেন থেকেও নেই, পরাবাস্তবের,ছায়া মানব-মানবী। পিসিমণি তাঁর জীবনে একা। তাঁর দৈনন্দিন একলা যাপনে আজও আপনি, হ্যাঁ একমাত্র আপনিই তার সঙ্গী। আমাকেও অবশ্য একটু ঠাঁই দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন আমিও তো দূরের মানুষ হয়ে গেছি।খুব ছোটবেলায়,অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে টলোমলো পায়ে একদিন তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। জানলার শিক ধরে, পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির আঁচল ধরে টানতেই চমকে পিছন ফিরে, অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর সেই যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সারাজীবনেও আর ছাড়লেন না। সেই থেকে আমিই তাঁর ঝুমকোলতা, এই পরিবারে একমাত্র আপনজন।
একটু বড়ো হতে না হতেই ,তাঁর জীবনের সব কাহিনী আমার জানা হয়ে গেল, কিছুটা তাঁর টুকরো টুকরো কথায়, বেশির ভাগটাই, এই বাড়ির বহু পুরনো চাকর গোবিন্দদাদার কাছে, আর বাকিটা বাড়ির বাতাবরণে টাঙানো, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দরপরদার আড়াল থেকে উঁকিমারা গল্পের রেশ ধরে।
আপনি তখন মেডিক্যাল কলেজে সিনিয়ার হাউজস্টাফ, আর পিসিমণি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ। ফেষ্টে আলাপ।প্রথম দর্শনেই মফস্বলের সহজ সরল,নরম স্বভাবের মেয়েটি নজর কাড়লো। তার, পিঠের প’রে দোলানো লম্বা বেণী আর দীঘল চোখের মায়ায় প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন, তারপর ভেসে গেলেন তার আবৃত্তির টানে। আপনি নিজেও যে একজন দক্ষ আবৃত্তিকার! দিনের পরে দিন যায়। পরিচয় দানা বাঁধে, ঘন হয়। আপনারা জুটি বেঁধে আবৃত্তি করেন।জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসা যুগল আবৃত্তির টানে টাপুর টুপুর শব্দ ঝরে, আপনাদের নিত্যকার জীবনেও। অবশেষে ঠিক সেইটাই হলো যেটা হওয়া স্বাভাবিক ছিলো। আপনাদের প্রেম ধীরে ধীরে দানা বাঁধলো।
ওদিক পাশ করেই আপনার চাকরী জুটে গেছে, পিসিমণি ফাইন্যাল দেবে।
স্বপ্নের দিন গোনা শুরু। নিরন্তর আঁকা হতে থাকে ভবিষ্যত সংসারের মনোরম ছবি। আপাদমস্তক রোম্যান্টিক আপনি পিসিমণির নতুন নাম দিলেন কলমীলতা,আর ভবিষ্যতের কন্যার নাম হলো ঝুমকোলতা! সুখের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে দুজনকে।
এইসব খবর তো আর চাপা থাকে না।দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো, পৌঁছে গেল ঠাকুরদার কানে। পিসিমণিকে শুধু যে গৃহবন্দী করে ফেলা হলো তাই-ই নয়, অবিলম্বে ঘটক লাগিয়ে ,পালটি ঘরের পাত্র খোঁজা শুরু হলো। অচিরেই বংশমর্যাদায় মানানসই, অথচ,বয়স, শিক্ষা, আচার-ব্যবহার, রুচি, পছন্দে সম্পূর্ণ বেমানান এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে পাকাও হয়ে গেল। এই বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করলে না। কে করবে?পিসিমণির মা ছিলো না যে, তাছাড়া তখন বাকিরা সবাই পিসিমণিকে তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করতে পারলেই বাঁচে। কখন কে এসে বাগড়া দেয়! ওদিকে পাত্রপক্ষরা আবার বেজায় ‘উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর!’ সোজা কথা !মরিয়া পিসিমণি গোপনে গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করে, আপনাকে নাকি একখানা চিঠিও পাঠিয়েছিল, বিয়ের আগের রাতে পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থাও পাকা , কিন্তু পৃথিবীতে গুপ্তচরের তো আর অভাব নেই! আপনার আর পৃথ্বীরাজ হওয়া হলো না,পরদিন ভোরে গ্রামবাসীরা নাকি অর্ধমৃত অবস্থায় আপনাকে হাইওয়ের পাশ থেকে উদ্ধার করেছিলো।
কয়েক মাস বাদে সুস্থ হবার পর,আপনি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, ব্যস্ এইটুকু খবরই জানা গিয়েছিলো,বাকিটা আমাদের কারো জানা নেই।পিসিমণির বিয়েটা কিন্তু হয় নি। একমুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবার চেষ্টায় ছিলো বেচারি, ঈশ্বর সেইটুকু কৃপাও করেন নি তাঁকে।
এবার আসি পরবর্তী অধ্যায়ে।
বড়ো হয়ে পড়াশুনা শিখে আমি অধ্যাপনার জগতে পা রাখলাম। বাধা এসেছিলো বৈকি।তবে নখদন্তহীন শার্দুলরা তখন হীনবল।অধ্যাপনা করি, নিজের কাছেই মাঝে মাঝে লাইব্রেরী যেতে হয়।
একদিন বৃটিশ কাউন্সিলে,ঘটনাচক্রে জনের সঙ্গে আমার আলাপ। বৃটিশ হাইকমিশনের, কী একটা কাজে, সে এদেশে এসেছিলো। ইতিহাসের ছাত্রী জেনে উৎসাহিত জন নিজের থেকে এসে আলাপ করলে। জব চার্নকের শহরের প্রেমে মুগ্ধ বৃটিশ যুবকটি সারা শহর চষে বেড়াতে চায়। কে জানে কেন আমাকেই তার মুরুব্বি ঠাওরালে। কয়েকটা মাস কেটে গেল, কলকাতা শহরের প্রেমে মুগ্ধ ইংরেজ যুবকটির শহরবাসিনীর প্রেমে পড়তেও দেরী হলো না। বাকিটা,বুঝতেই পারছেন, অলমিতি বিস্তরেন।
না, পিসিমণির মতো ভুল আমি করিনি,বাড়িতে সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবার আগেই রেজিষ্ট্রি বিয়েটা সেরে ফেলেছিলাম। তা সত্ত্বেও কম ঝামেলা পোয়াতে হয় নি, তবে দূতাবাসের ক্ষমতা তো জানেনই, আটকে দেবার আগেই তারা আমায় উদ্ধার করে নিয়েছিল।
অসহায় পিসিমণিকে ছেড়ে চলে আসতে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো। সেইদিন কিন্তু পিসিমণি তাঁর নিজস্ব ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো। কে জানে, হয়তো বা বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া নাটকের পুনরাভিনয় তাঁকে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে, চোখের জল মুছিয়ে, বলেছিলো —“যা পালা”।
উপহার দিয়েছিলো তাঁর একমাত্র সম্বল আপনার দেওয়া সঞ্চয়িতাখানা।চলে আসার আগে খুব গোপনে গোবিন্দদাদাকে একখানা মোবাইল কিনে দিয়ে এসেছিলাম। কেবল মা-ই, ব্যাপারটা জানতো। খবরাখবর সব তার মাধ্যমেই দেয়া নেয়া চলে। এইভাবেই দিন যায়। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত।
দিন পনেরো আগে মা সঙ্গোপনে গোবিন্দদাকে একখানা গোপন ষড়যন্ত্রের খবর দেয়।
আমাদের পেল্লায় বাড়িটা নাকি হাত বদল হতে চলেছে, হোটেল হবে। বিশাল লোভনীয় অফার, কেবল গোল বেধেছে পিসিমণিকে নিয়ে। কে তার দায়িত্ব নেয়!
উকিল বন্ধু পরামর্শ দিয়েছে,পিসিমণিকে পাগলা গারদে পাঠাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। একখানা সার্টিফিকেট জোগাড়ের ওয়াস্তা , তাহলেই কেল্লা ফতে! পিসিমণির দায়ও নিতে হয় না,ওদিকে তার ভাগের সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া যায়। পুজোর পরেই নাকি সব ফর্মালিটিস সেরে ফেলা হবে!
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো, সমস্ত চেনা জানা সোর্স কাজে লাগিয়েও যখন কোনও সুরাহা করে উঠতে পারছিলাম না ,তখন স্বয়ং ঈশ্বরই যেন পথ দেখালেন। গোবিন্দদা কাগজে আপনার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে!
আমার স্বামী জন আপনার মেইলিং এ্যাড্রেসটা জোগাড় করেছে। আপনার বর্তমান পারিবারিক পরিস্থিতি আমার জানা নেই,তবু আপনার কাছে আমি করজোড়ে মিনতি করছি ,আপনি আমার পিসিমণিকে পাগলা গারদে যাওয়া থেকে আটকান। অবসাদগ্রস্ত একজন মানুষকে পাগলা গারদে ঠেলে দিলে, তার যে কী পরিণতি হতে পারে,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানবে!এখন তো আপনার অনেক প্রতিপত্তি, পিসিমণিকে উদ্ধার করে যে কোনও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। টাকা পয়সার চিন্তা নেই সব দায় দায়িত্ব আমার। গোবিন্দদা আর তার বৌ- ই
সমস্ত দেখাশোনার ভার নেবে। আপনার এ্যাকআউন্ট নম্বরটা পেলেই আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। তারপরেই না হয় আপনি কাজটা শুরু করবেন!
আমার আর গোবিন্দদাদার ফোন নং এই সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি…জানি এই অপরাহ্ণবেলায়, প্রভাতকালের কোনও কিছুই হয়তো আর অবশিষ্ট নেই, তবু এককালে তো ভালোবেসেছিলেন, সেই ভালোবাসার দোহাই……।
আবার আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ,সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বনষ্পতিগুলো,প্রবলবেগে বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। দিব্যর মনেও মহাসমুদ্রের কলরোল। অতীতের ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা উড়ে এসে আবার সব কিছু এলোমেলো করে দিলো।প্রবল বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছিলেন দিব্য।
“আসতে পারি?” —বারান্দায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিভাদেবী।
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ”—গলাটা স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়,সোজা হয়ে বসলেন দিব্য।
“শরীরটা কি খারাপ? দুপুরে তো কিছুই প্রায় খেলেন না!”
” না না , একদম ঠিক আছি, ঐ একটা …” থেমে গেলেন দিব্য।
“তাহলে বুঝি মন খারাপ! একটু বসতে পারি?”
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ , কী আশ্চর্য…”
“বলছিলাম যে , মাসিমা বলে তো ডাকেন, দুঃখটা কি একটু ভাগ করে নেওয়া যায়!”
আর পারলেন না দিব্য। দরদী ছোঁয়ায়,এতো কালের চেপে রাখা পর্বতপ্রমাণ পাষাণভার, নামিয়ে হালকা হতে, এই প্রথমবার অকপট হলেন তিনি।
“এখন আমি কী করি?”
বাচ্চা ছেলেটি যেন মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছে।
” এতো ভাবনার কী আছে ? আপনার কতো লোকবল। চটপট কাজে লেগে পড়ুন।পুলিশের ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, আইনজীবির পরামর্শ নিন, ফর্মালিটিস সেরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পরুন রাজকন্যা উদ্ধারে।”
ম্লান একটুকরো হাসি দেখা দিলো দিব্যর মুখে।
“কিন্তু ওকে এনে রাখবো কোথায়? যেখানে সেখানে তো আর তোলা যায় না। ভাড়া বাড়ি অথবা হোম জোগাড় করতেও তো সময় লাগে, তাছাড়া মানসিক অবস্থাও তো–“
” কেন হোমের কী দরকার! গৃহলক্ষ্মীকে তো ঘরেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখন দেবীপক্ষ, ঘট স্থাপনের এটাই তো উপযুক্ত সময়!”
“মাসিমা!! “
“হ্যাঁ বাবা,আর দেরি নয়,কাজে লেগে প’রো। ছেলে,বৌমা নিয়ে ঘর করা আমার অনেক দিনের সাধ!”
আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন বিভাদেবী।
এরপর ঘটনার চাকা দ্রুত গড়ালো। দিন দুয়েক বাদে
একটু বেশী রাতে দিব্যর গাড়ি ছাড়াও পুলিশের গাড়িসহ আরও খানদুই গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করাই রণনীতি। দূরে কোথাও ছাতিম ফুটেছে। বাতাসে ছাতিমের ভারী গন্ধ।
আবৃত্তিকার দিব্য আবার জেগে উঠছিলো বহুদিন পর … …
মনের ভিতরে হাজির হ’লো চেনা ক’টি লাইন—
“লক্ষ বছর পার করেছি আমি
তোমার হাতেও আদিম কালের শোক
অতীত জীবন মুহূর্তে আগামী
এবার কোথাও নতুন কিছু হোক।আজ তাহলে বাঁচারই গান জ্বালি…”
এইখানে এসে চিন্তাটা থমকে গেল দিব্যর।কমলিনীর মনে তো আজও সেই তরুণ দিব্যরই বসবাস, এই দিব্যকে সে যদি চিনতে না পারে ? যদি অন্য কেউ ভেবে..!!
রাত পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন রাস্তা দিয়ে।
দিব্যর মনে তোলপাড় প্রশ্ন
— সময়ের উজান কেউ কী কখনও বাইতে পেরেছে!
অন্তরীক্ষে, অনন্তনক্ষত্রবীথি নিরুত্তর। -
মুক্ত গদ্য- মনে মনে
মনে মনে
-সুমিতা দাশগুপ্ত
আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ , তুমুল বষ্টি নেমেছে। দ্বিপ্রাহরিক অলস অবসরের নিরালা বেলায়, ভাতঘুমে মগ্ন সবাই, কেবল আমার চোখেই ঘুম নেই। কী করে থাকবে! আমার যে চক্ষু জুড়ে কেবলই তৃষ্ণা।বহু যুগের ওপার হতে অজস্র প্রাণের সম্ভার নিয়ে, “আবার এসেছে আষাঢ় ,আকাশ ছেয়ে।” ঝরঝর শব্দে বেজে ওঠা আষাঢ়ের সুর তাল ছন্দ,এখনই শুনে না নিলে ,আর কবে! আর কখন!
দোতলার বারান্দায় বসে, প্রবল ছাটে ভিজে যাওয়া আমি, একটুও নড়ি নে – সেই ছেলেবেলার মতোই বৃষ্টি- ফোঁটা হাতের তালুতে ধরার নেশায় বুঁদ হয়ে বসেই রই।কে জানে কবেকার কোন পুণ্যের ফলে , মহানগরীর ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গ এক উপনগরীর বাসিন্দা হয়েও,অজস্র গাছগাছালি ভরা, নিরিবিলি একটি পাড়ায় ঠাঁই মিলেছে আমার।
সন তারিখের হিসেব অতশত মনে রাখিনি, তবে ওই যে কবে যেন,জনবিষ্ফোরণে হাঁসফাঁস, কলকাতা মহানগরীকে একটু স্বস্তি দিতে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নগরপরিকল্পকরা শহরের পুর্বপ্রান্তের জলাজমি ভরাট করে উঁচু রাস্তা বানিয়ে, পাশ বরাবর সুন্দর খাল কেটে এলাকার সৌন্দর্যায়ন সেরে,জায়গাটির ভোল বদলে ফেললেন,আর সেইখানে পাশাপাশি অনেক ক’টি প্লট বানিয়ে বেশ কিছু মানুষজনের আপন বাসা বানিয়ে ফেলার সুযোগ করে দিলেন, সেইখানটিতে আমাদেরও একটুকু ঠাঁই মিলে গেল। ওমা! কি ভাগ্যি! সঙ্গে জুটলো চমৎকার একখানা প্রশস্ত দক্ষিণের বারান্দা!
অলস অবসরে,বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটিতে বসলেই নজরে আসে উদার উন্মুক্ত নীল আকাশের ইশারা। এইখানটিতে এসে বসলেই আমার কেন যেন মনে পড়ে যায় আশাপূর্ণা দেবীর গল্পের নায়িকা, ‘সুবর্ণলতার’ কথা। জীবনে বেচারি বেশি কিছু তো চায় নি, শুধু চেয়েছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে, মাথার উপরের একটুকরো নীল আকাশ দেখতে দেখতে, খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে। সামান্য সেই চাওয়াটুকুও পূর্ণ হয় নি তার , তীব্র ক্ষোভে ছটফটিয়ে মরেই গেল বেচারি! আর আমার জন্যে কিনা এতোবড়ো একখানা সৌভাগ্যি অপেক্ষা করে ছিলো!
এসব কথা বলিই বা কাকে! বাড়ির সকলেই
সদা ব্যস্ত। তারা ভাবে সাধারণত ফ্ল্যাট বাড়িতে, ছোট, বড়ো যা হোক একখানা বারান্দা তো থাকবেই, আগেভাগে প্ল্যান দেখেই তো বাড়ি নেওয়া, তাহলে বারান্দা নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে!
কী যে আছে,সেই কথাটাই তো মোবাইলে নিবদ্ধদৃষ্টির আধুনিক কর্মব্যস্ত মানুষজন, না নিজেরা বোঝে ,না আমি তাদের বুঝিয়ে উঠতে পারি।
তা বেশ, নাই বা বুঝুক বেবাক লোক, একান্তে আমার গোপন সম্পদ হয়েই থাকুক না হয় সেটি! চোখের সামনে থাকলেও ,স্রেফ বারান্দায় বসে বসেই, এমন নয়নাভিরাম পান্নারঙা সবুজের ঐশ্বর্য দেখতে পাওয়া কী এতোই সহজ! দেখার চোখ চাই, অনুভবের মন লাগে। কে না জানে “সবার তরে নহে সবাই।”এই পাড়ায় ষড়ঋতুর অনায়াস আনাগোনা। প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতি তার নিজস্ব রঙ রূপ মেলে ধরে ,পরিপূর্ণ মহিমায়, অকৃপণ দাক্ষিণ্যে। অকাতরে বিলিয়ে দেয় তার রূপ রস গন্ধ।
বাঙালি জীবনের প্রধান এবং সবচাইতে বড়ো শারদীয়া উৎসবের পালা ফুরোতে না ফুরোতেই, চলে আসে কুয়াশার ঘোমটা টানা হেমন্তকাল। খাস কলকাতায়, কোলাহল মুখর মহানগরীর আনাচে কানাচে, গরীব ঘরের পল্লীবধূটির মতো এতোই কুন্ঠিত চরণে তার আনাগোনা, যে ক’জনে তার খোঁজ রাখে সন্দেহ। এখানে কিন্তু সে বেশ স্বচ্ছন্দ, হিমের চাদর গায়ে, দিব্যি জানান দিয়ে সে আসে! ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ভোরের বেলায় ঘাসের আগায় ছড়িয়ে দেয় হীরের কুচি সকালবেলার নবীন সূর্য খেলা করবে বলে। সন্ধ্যার কুয়াশায় পথ দেখাতে মিটমিট করে জ্বালে তারার আলোর প্রদীপখানি।
যদিও খুবই ক্ষণস্থায়ী তার অবস্থানকাল, তবু সে আসে।
তার বিদায়ের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে না আসতেই শীতের হাওয়ায় নাচন লাগে। উড়িয়ে দেবার মাতন জাগিয়ে শীত সঙ্গে নিয়ে আসে পাতা খসাবার মরসুম।
একটা একটা করে পাতা ঝরে,ঝরতেই থাকে অহোরাত্র। শীর্ণ ডালপালা নিয়ে, বৃক্ষদল রিক্ত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের দাক্ষিণ্যের আশায়। কিছুদিনের মধ্যেই শুকনো ডালপালায়, কচিপাতারা লাজুক শিশুটির মতো উঁকিঝুঁকি দেয়।বসন্তের আগমনী ঘোষণা করে কোকিলের কুহুতান।এইসব যে নেহাৎই কাব্যকথা, অথবা রচনা বইয়ের পাঠ্যবস্তু, নয় সেকথাটি বেশ বোঝা হয়ে যায় রসিকজনের।
এখানে জারুলে,কৃষ্ণচূড়ায়, বকুলে, কদমে গলা জড়াজড়ি ভাব। পেল্লায় বট আর নিমের নজরদারিতে বেঁচে বর্তে থাকে কাঠবিড়ালি, কাক কোকিল, ঘুঘু ,চড়াই পাখির দল।
কালবৈশাখীর ঝড় কেশর ফুলিয়ে তেড়ে এলে,কৃষ্ণচূড়ার ছেঁড়া পাপড়ি যেমন রেড কার্পেট অভ্যর্থনা জানায়,ঠিক তেমনই কদমকেশর শোনায় বর্ষার আগমনী গান। আর সামনের বিশাল বটগাছে সাঁঝের আঁধারে আশ্রয় নেওয়া বকের দল, ডালে ডালে কী চমৎকার যে থোকা থোকা ফুলের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারে, স্বচক্ষে না দেখলে কোনদিন জানাই হতো না।
আজ এই আষাঢ়ের ধারাবর্ষণে পল্লবে পল্লবে শিহরণ দেখতে দেখতে মনে বড়ো সাধ যায়, ভেজা মাটিতে করতল বিছিয়ে বসতে, অনুভব করতে মৃত্তিকার গভীর থেকে উঠে আসা “লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকার” ডানা মেলার অশ্রুত ধ্বনি।
জানতে বড়ো ইচ্ছা করে মাতা বসুমতীর কোলে ঠাঁই পেয়ে এখন কেমন আছো সীতাদেবী ! মায়ের স্নিগ্ধ পরশে কি জুড়োলো তোমার মর্ত্যভূমির তীব্র অপমানের বহ্ণিজ্বালা!
ভাবতে সাধ হয়, এই ধারাবর্ষণেই বুঝি থাকে মায়ের হাতের পরশ। কতকাল হয়ে গেল , আমিও তো আর পাইনে আমার বৃদ্ধা মায়ের শিরা ওঠা হাতের ছোঁয়াটুকু ! আর ওই যে তরুণী মেয়েটা, এই তো সেদিন একমাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল,তারপর উড়ে গিয়ে ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে বসেছে পৃথিবীর অপর গোলার্ধে, তার পরশটুকুই বা মেলে কই!
বড্ডো মনকেমনের উথাল পাথাল ঢেউ আজ আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায়।
আচমকা কেজো পৃথিবীর তীব্রস্বর বেজে ওঠে —
“একী, এই ভরদুপুরে বসে বসে বৃষ্টিতে ভেজে কেউ! জ্বরজারি হলে—-”সত্যিই তো। ঘরে ফিরে এসে দুয়ার এঁটে বসি, ওদিকে ভুবন জুড়ে তখন প্রকৃতি মায়ের লীলাখেলা।
আমি তাহলে এখন কী করি!
আমার যতটুকু সম্বল তারই আশ্রয়
নিই তবে —কলম হাতে তুলে নিয়ে লিখে রাখি মনের কথা..
“ভিজছে শহর, ভিজছে পাড়া
ভিজছে কানাগলি,
মনখারাপের গল্পগুলো
তোমায় তখন বলি!” -
গল্প- অপরাহ্নের আলো
অপরাহ্নের আলো
-সুমিতা দাশগুপ্তবিকেল বেলায় দোতলার বারান্দায় বসে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ দেখতে বড্ড ভালো লাগে ইন্দিরার। রোজ তাই এই সময়টায় বারান্দায় এসে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। আজও হাতদুটো কোলের উপর রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন , আকাশে ভাসা টুকরো টুকরো মেঘগুলো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় কেমন সুন্দর নিজেদের রাঙিয়ে নিচ্ছে নানা রঙে।মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, মানুষের জীবনটাও বোধহয় অনেকটা এইরকমই। প্রথম জীবনের নানা রঙের দিনগুলো, যখন বার্ধক্যের ছোঁয়ায় ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠতে থাকে ,তখন নিজেকেই চেষ্টা করে বাইরের রঙে রাঙিয়ে, জীবনকে উজ্জ্বল করে নিতে হয়, নইলে মনকেমনের আঁধারে ডুবে যায় দিনযাপন। সেই আঁধার সাঁতরে পার হওয়া যে কী পীড়াদায়ক, ভুক্তভোগী মাত্রেরই জানা। আশেপাশে কম মানুষকে তো আর দেখছেন না। বিদেশের মানুষজন যে এতো হবি নিয়ে মাতামাতি করে সে কি আর এমনি!
উদার আকাশে হারিয়ে যেতে যেতে এইসব নানা দার্শনিক চিন্তায় ডুবে ছিলেন ইন্দিরা।“এই নাও , তোমার চা।” পাশে রাখা বেতের টেবিলে ঠক্ করে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বললে মিনতি।
“দাদুকে চা দিয়েছিস?”
“হুঁ, কী একটা বই পড়তেছে তাই ঘরে বসেই চা খাবে বললো।”
“আর আমার সুতো?”
“এনেছি রে বাবা এনেছি, নইলে আমার কপালে দুঃখু আছে সে কী আর আমি জানি নে, ও,ভালো কতা, লেস বোনার সুতোর দাম কিন্তু পাঁচ ট্যাকা করে বেড়ে গেচে , বলে রাকলুম।”
” আচ্ছা বেশ, কী আর করা যাবে।”
“সে তুমি বোজো গে যাও। সারাদিন ধরে কষ্ট করে আঙ্গুল ব্যাতা করে বোনো আর একে তাকে বিলিয়ে দাও ,তাও যদি সবাই এর মম্মো বুজতো “
আরে আমি তো লেশ বুনতে ভালোবাসি রে , আর ভালোবেসেই ওদের দিই। তোকেও তো দিয়েছি, তুইও তো খুশি হয়েই নিলি”
“আমার কতা বাদ দাও, তোমার ঐ ছোট জা সেদিন কী বললে মনে নেই! কতো বড়ো একখানা টেবিল ঢাকা দিলে, আর মুকের ওপর বলে কিনা, কী লাভ হয় বলতো দিদি, এইসব কষ্ট করে বুনে ,সবই তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মেশিনে বোনা ওইসব লেসগুলোর ফিনিশ আরও কতো সুন্দর!ছেলে নাকি বিদেশ থেকে পাইট্যেচে, সেই দেমাকেই মলো। ইচ্ছে করছিলো দিই বেশ করে দুকতা শুনিয়ে, তুমি আবার কী বলবে তাই চুপ মেরে গেলাম।”
“আচ্ছা বেশ আর দেব না ওকে, আর শোন্ এই সুতোটা আনালাম বিন্দি দিদিভাই এর জন্যে। ওর মা ফোন করেছিলো, দিদিভাইদের স্কুলে কুরুশ দিয়ে কী সব যেন করতে শেখাবে, তাই আগেভাগেই কুরুশ বোনা শেখাতে ওকে নিয়ে আসবে, মালবিকা।”
“ওমা ,তা-ই!সে তো শুনিচি মেমসাহেব দিদিমণিদের ইস্কুল! সেখানেও এইসব শেখাবে?”
“তবেই বোঝ্, নে এবারে তোর দুঃখু ঘুচলো তো। যা গিয়ে কাজে মন দে ,আর শোন্ কাল বিকেলে রুটি করার দরকার নেই।ওরাও আসবে , সকলের জন্য লুচি মাংস, বেশী করে বানাবি,তুইও বাড়ির জন্য নিয়ে যাস্।”
“সে হবেখন, আর শোনো এরপর আমার জন্য একখানা টি,ভির ঢাকনা বানিয়ে দিও তো।”
“ওমনি বায়না শুরু হলো ,যা তো এখন কাজে মন দে।”
তা এটুকু বায়না সে করতেই পারে। বহুদিন ধরেই রয়েছে এই বাড়িতে, ইন্দিরা আর অমলেশের সংসারে, তাঁদের স্বঘোষিত অভিভাবক আর সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে। এখন ও-ই বোধহয় এই নিঃসন্তান দম্পতিটির সবচাইতে কাছের মানুষ-রক্তের সম্পর্কের অন্যান্য পরিজনদের চাইতেও বেশি। তারা মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেয় না তা নয় তবে তাদের আর সময় কোথায়! এই মিনতিই বলতে গেলে সর্বক্ষণের সাথী।
সকাল বেলা নিজের সংসার কিছুটা সামলে ,সে চলে আসে এই বাড়িতে, দুপুর বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি যায়, আবার বিকেল হতেই চলে আসে, ইন্দিরার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ সেরে , ছাদের দরজা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মশারি টাঙিয়ে, মায় টিপয়ে জলের গ্লাস, বোতল রেখে, রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। মোটকথা জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, এমনকি টুকটাক কাজে মিস্ত্রি ধরে আনা থেকে, ঠিকে কাজের লোকের উপরে ছড়ি ঘোরানো , সব কিছুই তার আওতায় পড়ে।
মিনতি, নীচে নেমে গেল। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে , ইন্দিরা আবার ডুবে যাচ্ছিলেন নিজের ভাবনায়।
তাঁদের একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বেশ কয়েকবছর আগে মালবিকারা ভাড়ায় এসেছিলো,বিন্দি তখন এইটুকু ,বোধহয় বছরখানেকের। দেখতে দেখতে বছর পাঁচেক কেটে গেলো। বিন্দি,এই বাড়িতেই বড়ো হলো, খিলখিল হাসিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে, উপর নীচে ছুটোছুটি করে বেড়াতো, সংসারটা বেশ ভরভরতি লাগতো, তারপর তো নিজেরা ফ্ল্যাট বানিয়ে চলে গেছে,ঘরদুয়ার আবার ফাঁকা।তবে যোগাযোগ আছে। এই তো মাসছয়েক আগে মালবিকার এন্-আর- আই দিদি আলোলিকা দেশে এসে দেখা করতে এসেছিল তাঁদের সঙ্গে, পারফিউম, ক্রিম,ব্যাগ, হ্যানা ত্যানা, আরও কতো উপহার নিয়ে। হঠাৎ একটা কথা মনে করে হাসি পেয়ে গেল। ইন্দিরা ওকেও খান দুই -তিন,হাতে বোনা বড়ো বড়ো লেশের ঢাকনা উপহার দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলো! দেশে ফিরে নিজের ঘরে , নানা কর্ণার টেবিলে সেগুলি পেতে সাজিয়ে গুছিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে।
ও, খুশি হয়েছে, ব্যাস্, ওইটুকুই ইন্দিরার আনন্দ, আর কী চাই!পরদিন বিকেলবেলায় বিন্দিকে নিয়ে চলে এলো মালবিকা।বিন্দিকে হাতে ধরে কুরুশকাঠি ধরার কায়দা থেকে, আরম্ভ করে বোনার প্রাথমিক ধাপটুকু শিখিয়ে দিলেন ইন্দিরা। এরপর ক্লাশে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। তাছাড়া তিনি তো রইলেনই।
ইন্দিরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন, মালবিকা কেমন যেন একটু উশখুশ করছে।বেশ বুঝতে পারছিলেন ওর আরও কিছু বলার আছে। শেষটায় ইন্দিরাই আগ বাড়িয়ে বললেন
“নাও এবারে কী বলবে বলে ফেলো তো।মালবিকা অবাক—
“কী করে বুঝলেন আমি কিছু বলবো?”
“ভুলে যাও কেন আমাদের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।”
মালবিকা এবারে অকপট হলো।
সঙ্গে আনা বড়োসড়ো ব্যাগ থেকে একগাদা লেশবোনার রেশমী সুতো আর ক্রচেট ডিজাইনের বই ইন্দিরার হাতে দিয়ে বললো
“দিদি পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
এইসঙ্গে একখানা আবদারও আছে।“শুনি কী আবদার!”
“আপনি দিদিকে যে লেসের ছোট বড়ো নানারকমের ঢাকা বুনে দিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে দিদির এক বিদেশিনী বান্ধবীর খুব পছন্দ হয়েছে …”
“বুঝেছি তারও গোটাকতক চাই, তাই তো! বেশ তো…”
” হ্যাঁ চাই তো বটেই, তবে তার চাহিদা আরও একটু বেশি।
এইসব জিনিসগুলো একসময়ে খুব পপুলার ছিলো,বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সেকথা তো জানেনই। তারপর মাঝে ফ্যাশন উঠে গিয়েছিলো। ইদানিংকালে আবার নতুন করে সে ফ্যাশান চালু হয়েছে, যাকে বলে “ইন-থিং”। পোশাক আশাকে লেসের কাজের খুব চাহিদা।
ওদিকে দিদির বান্ধবীটির একটা ছোটখাটো ফ্যাশান-স্টোর্স,আছে,ও চাইছিলো,যদি লেসের কিছু স্টক দোকানে রাখা যায়। তুমি যদি রাজি থাকো…”“ও বাবা , সে তো অনেক বড়ো ব্যাপার , আমি শখের কারবারি, এইসব কি করে সামলাবো?”
“শোনো না , দিদির আরও একটু পরিকল্পনা রয়েছে। দিদি বলছিলো, আমাদের দেশে সেলাই করে সংসার চালায় এমন অনেক দুস্থ মহিলা আছেন, তাদের যদি তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দাও, হয়তো তোমার মতো এতো ভালো কাজ হবেনা তবু তাদের দিয়েই যদি নানা ডিজাইনের লেসের টেবিল ক্লথ, বেডকাভার তৈরি করানো যায়!!! মাল মেটিরিয়াল জোগান দেওয়া, থেকে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট ওদেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা,সব ওদের।”
“কী বলছো ! এই বয়সে কি এইসব সম্ভব, তাছাড়া এটা তো আমার মনের আনন্দের ব্যাপার , না না এটাকে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যেতে মন চায় না।”
” শোনো না, তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে, শুধু ওদের শিখিয়ে, ভুলভ্রান্তি শুধরিয়ে, নতুন নতুন ডিজাইনের কাজ করিয়ে নেবে। ইচ্ছে হলে তুমিও বুনবে, আগে যেমন নিজের জন্য বুনতে, ইচ্ছে না করলে নয়। ভেবে দেখো না এতে তোমারও শখ মিটবে , কিছু গরীব মেয়েরাও কাজ পাবে। খুব কিছু মন্দ হবে কি?”
এইরকম আচমকা প্রস্তাব এলে চট্ করে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বিশেষ করে এই বয়সে এসে?
বেশ কিছুদিন দোনামনা করতে করতে অবশেষে রাজিই হয়ে গেলেন ইন্দিরা। ভাবছিলেন, সত্যিই যদি তাঁর শখটা আরও একটু বিস্তৃত করলে কয়েকজনের আর্থিক সাহায্য হয়, তাহলে মন্দ কী! কতো মানুষ তো কতো ভালো কাজ করেন,তাই তো এই দুঃসময়েও পৃথিবীটা চলে!মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটা বেশ চালু হয়ে গেল।
মিনতির উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। সে-ই, স্বনিযুক্ত ম্যানেজার। হম্বিতম্বি ছুটোছুটি করে ব্যাপারটা বেশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইন্দিরাও আজকাল মনের সুখে নিত্যনতুন ডিজাইন তুলিয়ে দেন মেয়েদের।সঙ্গে নিজের শখের বোনাও তো আছেই। মিনতিসহ অনেকক’টি মেয়ে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আজকাল দেশের মধ্যেও এই হাতে বোনা লেসের চাহিদা বাড়ছে।
খবরের কাগজের প্রতিবেদনে অনেকেই ব্যাপারটা এখন জেনে গেছেন। আত্মীয় স্বজনদের অভিনন্দনে মনে মনে হাসেন তিনি।
এবারে পুজোর সময়, বিদেশেই আলোলিকারা স্টল দিয়েছিলো, সেখানে তাঁদের হাতের কাজ বেশ সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষ্টিমনস্ক বঙ্গসন্তানদের আগ্রহে হয়তো বা আগামী বছর বিদেশের প্লেনে চড়তে চলেছেন ইন্দিরা আর অমলেশ।
সূর্যাস্তের শোভায় মগ্ন থাকা ইন্দিরা ভাবেন তাঁর জীবনেও বুঝি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অপরাহ্ণের আলো।সুমিতা দাশগুপ্ত।
-
রম্য- যতো দোষ, নন্দঘোষ
যতো দোষ, নন্দঘোষ
– সুমিতা দাশগুপ্তসত্যি কথা বলতে কী, এই বিশ্বসংসারটি এক আজব জায়গা, এখানে প্রতিটি মানুষের একখানা করে বেচারি মানুষ লাগে, যার ঘাড়ে অনায়াসেই নিজের ছোটখাটো সমস্ত অপকর্ম, ত্রুটি বিচ্যুতির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও বিবেক দংশনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, আরো অবাক করা কান্ডটি কি জানেন? রাজা গজা থেকে সংসারী মানুষ প্রত্যেকের কপালেই কিভাবে যেন একখানা করে নিরীহ, বেচারি ভালোমানুষ জুটেও যায়, যদিও সেই বেচারি মানুষটি কিন্তু বোকা নয় মোটেও, বরং উল্টোটাই, বুদ্ধিমান তো বটেই উপরন্তু সহনশীল এবং শান্তিপ্রিয়, সব বুঝেও মুখটি বুজে সবকিছু মেনে নেয়, নইলে জগৎসংসারই বা চলে কী করে!
সেই পুরাকালে ছিল, বেচারি নন্দবাবু,মানে নন্দঘোষ, বালকৃষ্ণের যাবতীয় দুষ্টুমির দায় মাথায় নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর আমাদের সংসারে রয়েছি আমি। সত্যি কথা বলতে কী,আজকাল আমার নিজের মনেই একখানা দৃঢ় বিশ্বাস পাকাপাকি ভাবে জন্ম নিতে শুরু করেছে, এই জগৎসংসারে যেথায় যতো অনাসৃষ্টি কান্ড ঘটে চলেছে —ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে, ইউনিভার্সিটির অর্থসঙ্কট, আন্দোলনরত চাকুরিপ্রার্থীর হাতে পুলিশি কামড় থেকে পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপকদের লিষ্টিতে বঙ্গসন্তানদের অপ্রতুলতা, এইসব কিছুর জন্য এই আমাকেই কোনও না কোনওভাবে দায়ী করা গেলেও যেতে পারে।
এই যেমন একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন, আজ সকাল থেকে বৌদি গজগজ করেই চলেছে, ছেলের স্কুলবাসটা মিস হয়েছে বলে। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে এর জন্য আমিই নাকি দায়ী। জুতোজোড়া পরাতে যদি দেরী না করতাম, অথবা বাসদাদাদের সঙ্গে দুমিনিট খেজুরে আলাপ করে, তাদের যদি একটু আটকে রাখতাম, তাহলে তো আর… কৈফিয়ৎ হিসেবে বলা যেতেই পারতো বাচ্চাটাকে যদি, আর একটু আগে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া যেত…. সে কথা বলে কার সাধ্যি।
ওদিকে বাবা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, এই তো বাচ্চাটা কিছুদিন আগেই জ্বর থেকে উঠলো, কোন আক্কেলে এই সাতসকালে তাকে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যদি,আবার জ্বর আসে, যদি ফাইন্যাল পরীক্ষাটা দিতে না পারে … যদির বন্যায় ভাসতে ভাসতে বলা গেল না, এখন তাড়াতাড়ি না গেলে যে আজকের ক্লাশ টেষ্টটা মিস্ হয়ে যায়!
অফিস যাবার আগে খাবার টেবিলে বসে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো মায়ের গজগজানি ভেসে আসে ,ফুলের প্যাকেটে বেলপাতা মিসিং। ফুলওয়ালি যা দেয়,অন্ধের মতো তাইই হাতে নিয়ে চলে আসার আগে, আমারই কী উচিৎ ছিল না…ইত্যাদি ,ইত্যাদি ।
ওদিকে পাড়ার ইস্ত্রিওয়ালা বৌয়ের কামিজ ইস্ত্রি করে দিয়ে যায়নি, সকাল থেকে চাপা গজগজানি হাওয়ায় ভাসে, কারুর অর্থাৎ আমার যদি একটুও সহানুভূতি থাকত, তাহলে অনায়াসেই,দু পা এগিয়ে গিয়ে….,যেন আলমারি ঠাসা বাকি পোশাকগুলির,সবকটাই, অস্পৃশ্য,অশুচি।
বাবার নতুন চশমার ডেলিভারি দেবার ডেট তো কবেই পেরিয়ে গেছে, দাদার না হয় অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়, কেন আমার কী একটুও আক্কেল নেই? একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে চশমাটা নিয়ে আসা যায় না? লোকে মনে করাবে তবে আনব!
হায়রে ,যদি বলা যেত, সে কাজটা তো দাদাও করতে পারতো, তাছাড়া বৌদির না হয়, ছেলেপুলেদের স্কুল থেকে তুলে এনে বাড়ি ফেরার তাড়া, আমার স্ত্রী, তাঁদের আদরের নতুন বৌমাটিও তো আছেন, একদিন অফিসফেরত কী চশমার দোকানে ঢুঁ মারা যায় না! কিন্তু বোবার শত্রু নেই, এই নীতি মেনে চুপ থাকাই শ্রেয়।
ঐ শুনুন আমার নবতিপর ঠাকুমা চেঁচাচ্ছে…
জপ করতে করতে তাঁর নাকি চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, জেগে উঠে দেখে থালায় নাড়ু কম! কার কাজ সেকথা বুঝতে কি কারুর বাকি আছে! ছোট্টবেলা থেকেই সেই একইরকম রয়ে গেলাম, ইত্যাদি,ইত্যাদি, ভুলে যায় সেই বয়সটি আমি কবেই পেরিয়ে এসেছি, তবে হ্যাঁ ,আজ কিঞ্চিৎ দায় আমারও রয়েছে, আমিই ভাইঝিটাকে নাড়ু চুরি করতে হেল্প করেছি। বেশ করেছি , ঠিক কিনা আপনারাই বলুন! -
প্রসঙ্গে – বসন্ত যাপন
বসন্ত যাপন
-সুমিতা দাশগুপ্তবসন্ত এসে গেছে- বাতাসে নিয়মভাঙার চোরাটান। শহরের অলিগলিতে উদাসী হাওয়ায়,ঝরে পড়া শুকনো পাতার খসখস শব্দে মনকেমনের বার্তা। কে যেন বলতে থাকে, ওরে গৃহবাসী খোলো দ্বার,চলো বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু সংসারের জাঁতাকলে, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে কী অতই সহজ, হুট্ বলতে বেরিয়ে পড়া! তাহলে উপায়! উতলাচিত্ত ভ্রমণপিপাসুর কি কেবল, মনখারাপই সম্বল! উঁহু,দুর্গমগিরি, কান্তারমরু পার হয়ে যাওয়া বাঙালি অত সহজে হার মানবে না। সে মনে মনে বলে-
“আমারে তুমি দাবায়ে রাখতে পারবা না”
তার কাছে বই রয়েছে না! ভ্রমণ কাহিনী!
খুব সম্প্রতি এমনই একখানা বই এসেছে আমার হাতে। ইচ্ছুক পাঠক আমার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়তেই পারেন।
কিন্তু কোথায়? কেন, এই তো কাছেই শান্তিনিকেতনে।
কী বললেন সে জায়গা অনেকবার ঘোরা? আরে না না আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে নিয়ে যাবো এমন এক জায়গায়, দোল অথবা পৌষ উৎসব দেখে ফেরা মানুষজন যেটির হদিশ পান নি মোটেও। এই বইটি আপনাকে দেবে অচিনপুর আবিষ্কারের আনন্দ। বইটির নাম হলো
“সদা থাকো আনন্দে…শান্তিনিকেতনে”
বইটির লেখক, আদতে উত্তর কলকাতার বাসিন্দা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
তুখোড় ছাত্র,শ্রী দীপঙ্কর রায় মহাশয় যখন বিশ্বভারতীতে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে শান্তিনিকেতনবাসী হলেন,তখন তাঁর মোটেও মন বসতো না সেখানে, সদাই নিজেকে ‘বহিরাগত’ ভেবে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার ভাবনা মনে চেপে বসতো,তারপর কে জানে কোন মন্ত্রবলে,প্রকৃতির ডাক পৌঁছলো, তাঁর কাছে। ছুটির দিনগুলিতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকলেন। ধীরে ধীরে একদিকে যেমন পরিচয় হতে থাকলো,ফকির বাউলদের সঙ্গে, ঠিক তেমনই প্রকৃতি তাঁর কাছে হাট করে খুলে দিল তার দুয়ারখানি। লেখক হদিশ পেয়ে গেলেন অগাধ রত্নভান্ডারের । “তাঁর কাছে খুলে যেতে থাকে,প্রকৃতির এক নতুন ও আশ্চর্য জগৎ, তিনি আবিষ্কার করেন অজস্র নতুন গাছ,সম্পূর্ণ অচেনা সব পাখি, জোনাকি পোকার মিলনোৎসব, বসন্তের গন্ধ, খোয়াই এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য,”- কলকাতায় বসে যার খোঁজ পাওয়া দুষ্কর।চলুন তাহলে বেরিয়েই পড়া যাক, লেখকের হাত ধরে এগিয়ে যাই অচিনপুর আবিষ্কারে।
আচ্ছা,কেউ কি কোনোদিন আপনাকে কথা দিয়েছিল, হলুদ পলাশ এনে দেবে বলে, অথচ দেয়নি! দুঃখ পাবেন না, কবি তো কবেই বলিয়াছেন,
“কেউ কথা রাখে না”- তার চাইতে নিজেই খুঁজে নিন না, সেই গাছ, চলুন বেরিয়ে পড়ি অপুর মতো “কল্পনার উড়ানে।”খেলার মাঠের গায়ে,পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে,লক্ষ্য রাখুন।এইখানেই কোথাও নানা গাছের ভীড়ে লুকিয়ে রয়েছে হলুদ পলাশের গাছ।না, না টানা হেঁচড়া করে ডাল ভেঙে নয়,মাটিতে ঘাসের উপরে পড়ে থাকা হলুদ পলাশক’টি সংগ্রহ করে নিন,হয়তো তারা অপেক্ষায় ছিল আপনারই জন্য।
রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলুন, সামনেই পড়বে আশ্চর্য রকম পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রাম, কুটিরগুলির দেওয়ালে দারুণ সুন্দর সব আলপনা ,মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন তো , লেখক জানিয়ে দেবেন, এই তো কিছুদিন আগেই বাঁধনা পরবে আঁকা হয়েছিল,সুচারু চিত্রগুলি।
কোনও এক বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, গৃহকর্তার অনুমতি নিয়ে, ছবি তুলে নিন না যতোগুলো ইচ্ছে।
চাইলে দাওয়ায় গিয়ে বসতেও পারেন, কথায় কথায় জেনে নিতে পারেন কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে,পরিযায়ী পাখিদের অস্থায়ী ঠিকানা যে ঝিল, তার পথ নির্দেশ। শাল শিমুলের জঙ্গলে নৈঃশব্দের জগতে কেবলই পাখির ডাক। পক্ষীপ্রেমিকরা হয়তো একেবারে নিরাশ হবেন না। ঘুরতে ঘুরতে সহসা নজরে পড়তে পারে জঙ্গলের ফাঁকে বিকেলের রোদ ঝলমলে রাঙা খোয়াই।
সন্ধ্যের আগে ফেরার পথ ধরুন, সেটি যদি দোলের দিন হয়, তাহলে, সঠিক দিক নির্দেশ নিয়ে পৌছে যান পথের ধারে গড়ে ওঠা ইটালিয়ান দিদির তৈরী নাট্যগ্রামে অথবা ফ্রান্সপ্রবাসী বাউলের আখড়ায়।
রাত বাড়লে মাথার উপরে পূর্ণচাঁদের মায়ায় পথনির্দেশ খুঁজে নিয়ে ফিরুন নিজের আস্তানায়।
শান্তিনিকেতনে যাবেন অথচ খোয়াই দেখবেন না তা,ও কি হয়! ছেলেবেলায় যে লীলা মজুমদারের হাত ধরে অজস্রবার গিয়েছিলেন হীরের ফুল ,পক্ষীরাজ ঘোড়া আর হলদে পাখির পালক খুঁজতে, আজ সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ান তার সামনে। দেখে আসুন রূপকথার বাইরে ঢেউ খেলানো ঊষর মাটি, গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় যেন তার ঝকঝকে আলোতে আগুন ধরেছে। দেখে নিন তার আদিম রূপ। জানা আছে কি, এই খোয়াই, একদা প্রস্তর যুগের মানুষের বাসভূমি ছিল! খননকার্যে পাওয়া পাথরের অস্ত্রগুলি,আজ তার প্রমাণ দেয়।
কেবল রুক্ষপ্রান্তর নয়, এই খোয়াইয়ের ঈর্ষণীয় বায়োডাইভার্সিটিও পর্যবেক্ষণের বিষয়, কারণ এই খোয়াইকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়েটল্যান্ড-জল বইবার খাত। এখানেই রয়েছে প্রচুর কাজুবাদাম,আকাশমণি, শিশু, পলাশ, আমলকির বন। এখানে নানা জাতের প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে, হেমন্তে আসে হাজারে হাজারে পাখি। এইখানেই আপনি পেতে পারেন অরণ্যভ্রমণের স্বাদ।
অলমিতি বিস্তরেণ, শুধু শেষ করার আগে বলে যাই, ইচ্ছে হলে নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন বইটি, কারণ এই বইটি একবার পড়ে তৃপ্তি হয় না, তাছাড়া অরণ্যভ্রমণই একমাত্র বিষয়বস্তু নয়,আপনি চাইলে বাউল সংস্কৃতি, পৌষমেলা, নববর্ষ উদযাপন, বাইশে শ্রাবণ ইত্যাদি আরো অনেক অনেক বিষয়ের তথ্যমূলক এবং মনোগ্রাহী নিবন্ধ পাঠের আনন্দ পেতে পারেন।( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ- এই লেখাটি শুধুই আমার একটি ভালো লাগা বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া)
-
গল্প- কেশ কীর্তন
কেশ কীর্তন
–সুমিতা দাশগুপ্তসে ছুৃটছিলো, ছুটতে ছুটতে বে-দম হয়ে যাবার উপক্রম। দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, কয়েক ঢোক জল খেতে পারলে ভালো হ’তো, কিন্তু এখন সে উপায় নেই। এক মুহূর্তের ব্যবধানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, একখানা ভ্যানগাড়ি, নিজেকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়েছিলো তার উপরে, কিন্তু হায় শেষ রক্ষা হলো না। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে টেনে নামিয়ে নিলেন বটুক স্যার, তারপর রাস্তার উপর দাঁড় করিয়েই আচ্ছা করে গোটা কতক উত্তম মধ্যম দিয়ে , তার বড়ো সাধের চুলের টেরিখানা বাগিয়ে ধরে কাঁচি দিয়ে কচাৎ—
আঁ আঁ করে চিৎকার করতে করতে ঘুম ভেঙে গেল করঞ্জাক্ষবাবুর। হাঁফাতে হাঁফাতে সটান উঠে বসলেন বিছানায়।
নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল মাথায়, হায় কোথায় সেই ঘন চুলের গোছা, টাকের উপরে গোটাকতক চুল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড়ের মতো খাড়া হয়ে আছে।
নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় ঘরের সবকিছু দৃশ্যমান। পাশে শোয়া গিন্নি একবার চোখ মেলে চেয়েই ব্যাপারখানা বুঝে নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলেন– “মরণ”,
তারপরই আবার পাশ ফিরে শুলেন, নাক ডাকতে লাগলো তাঁর।
পাশের টিপয়ে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে, বড়োসড়ো একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন মধ্যরাত,অগত্যাই আবার শুয়ে পড়তে হলো।
মনটা এই বয়সেও উথাল পাথাল, কেন যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে বারে বারে ফিরে ফিরে আসে স্বপ্নটা! মনের অবদমিত বাসনা আজও পিছু ছাড়লো না!
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, কেবলই এপাশ ওপাশ করতে করতে স্কুলজীবনে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি।
তখন ক্লাস এইট-নাইন, দুপুরে স্কুল পালিয়ে ম্যাটিনি শো, ধীরে ধীরে রপ্ত করে ফেলছেন তাঁদের ক্লাশের কয়েকজন। না পালিয়ে উপায়ই বা কী। চকবাজারের নতুন সিনেমা হলে দেবানন্দের নতুন নতুন সিনেমা আসে। দেবানন্দ তখন তাঁদের আইডল, কী তাঁর চেহারা, কী কথাবার্তা বলার স্টাইল, আর ঘন একমাথা চুলের দুর্ধর্ষ টেরিখানা!! ওফফ্… ঐ রকম চুলের স্টাইল থাকলে যে কোন মেয়েকে ইমপ্রেস করা তো বাঁয়ে হাত কা খেল!!
শয়নে ,স্বপনে , জাগরণে তখন একটাই বাসনা, কীভাবে দেবানন্দ হওয়া যায়।একটু হেলে দাঁড়ানো, কথা বলার ধরন ,সবকিছুই আয়ত্ত করার আপ্রাণ প্রয়াস তাদের অনুক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রত্যেকের পকেটেই একখানা করে গুপ্ত চিরুনি লুক্কায়িত থাকে, সুযোগ পেলেই টুক করে একবারটি…
ব্যাপার স্যাপার বুঝতে বটুক স্যারের দেরি হলো না। কম ধুরন্ধর ছিলেন তিনি! সবসময় তক্কে তক্কে থাকতেন, হাতে চিরুনি দেখেছেন কি কেড়ে নিয়ে একখানা বিরাশি সিকদার চপেটাঘাত। উঃ ভাবলে এখনও গালটা টনটন করে ওঠে।সেই বটুক স্যার আজও পিছু ছাড়েননি।স্কুলের পরে কলেজ, ভেবেছিলেন এখন আর কে কার তোয়াক্কা করে, ওয়েলকাম দেবানন্দ ওয়েলকাম টেরি, কিন্তু হায় ততদিনে এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছেন অমিতাভ, রাজেশ খান্নারা। মেয়েরা আর টেরির দিকে ট্যারা চোখেও চায় না। প্রথমে ভেবেছিলেন নাইবা রইলো ফ্যাশন, তিনি আকৈশোর লালিত ইচ্ছেখানা ত্যাগ করবেন কেন! কালে দিনে বেশ জম্পেশ করে একখানা টেরি বাগিয়েও ছিলেন , ওমা তাই দেখে সকলে মিলে বিশেষ করে মেয়েরা সেকি প্যাঁক দেওয়া শুরু করে দিল!
তাও তিনি অকুতোভয় ছিলেন, একা কুম্ভ হয়ে রক্ষা করে যাবেন দেবানন্দের স্টাইল, এই ছিল তাঁর পণ। কিন্তু হায় ,এরপরই এলো চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সখানা। বিয়ের পিঁড়িতে বসে শুভদৃষ্টির সময় নববধূর ভ্রুকুটি কুটিল দৃষ্টি আর কুঞ্চিত ওষ্ঠাধরের মানে বোঝা গেল ফুলশয্যার রাতে । আংটির সঙ্গে সঙ্গে টেরি বিসর্জনের প্রতিশ্রুতিখানাও দিয়ে দিতেই হলো, করঞ্জাক্ষবাবুকে।
ব্যাস্ টেরির কিসসা খতম। এখন স্বপ্নেই তার বাসা, তাতেও কি রেহাই মিলেছে! কোনোদিন বটুক স্যার, কোনও দিন মুখরা গিন্নি ছুটে এসে ঝুঁটি নেড়ে দিয়ে যায়। -
কবিতা- শাশ্বত বাণী
শাশ্বত বাণী
-সুমিতা দাশগুপ্তজোর করে কেউ পায় না কিছুই,
মিছেই ছড়ি ঘোরাচ্ছো,
যতোই তুমি খাটাচ্ছো জোর,
ততোই কেবল হারাচ্ছো।‘মেলাই আছে অস্ত্রবল
সুশিক্ষিত সৈন্যদল,
আমায় দেখে হও প্রণত
নইলে বিপদ রীতিমতো’
এসব ব’লে যতোই তুমি
গলার জোরে চেঁচাচ্ছো,
ভিতর ভিতর ততোই তুমি
দখল তোমার খোয়াচ্ছো–
যতোই তুমি খাটাচ্ছো জোর,
ততোই কেবল হারাচ্ছো।
জোর করে কেউ পায় না কিছু
ইতিহাসেই বলে
অজাতশত্রু হারিয়ে গেছেন
কালের মন্ত্রবলে,
তথাগত আছেন আজও
জুড়ে সবার চিত্ত ,
করুণাময় চক্ষুদুটি
প্রেমের মায়ায় সিক্ত।
মুক্ত কৃপাণ, সঙিন,কামান
কেউ পারে নি কাড়তে জবান,
তুমি আবার কোন মহারাজ,সেদিক পানেই
ঝুঁকছো!
দু- হাত দিয়ে মিছেই জেনো
উতল হাওয়া রুখছো।