• অণু গল্প

    অণুগল্প- বাঁশি

    বাঁশি
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    কালের নিয়মে পৃথিবীতে আবার এসেছে বসন্ত। বাতাসে লেগেছে নেশা। রিক্ত শাখায় নতুন কচি পাতার নাচন, ডালে ডালে নতুন কুঁড়ি। মানবচিত্তে লাগে দোলা। কিন্তু অচিনপুরের রাজামশাই মহা বিরক্ত। তিনি যে ঘোর বাস্তববাদী। এইসব কাজভোলানো মনমাতানো ফাল্গুনী হাওয়ার‌ ওপরে বেজায় চটা। ক্ষণে ক্ষণে মানুষকে উদাসী করে, তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনকে এলোমেলো করে দেওয়াই যেন দখিনা পবনের একমাত্র কাজ। আজকাল রোজ সভার কাজে পড়ছে বাধা। কোকিলের কুহুতানে সবাই উন্মনা। মন্ত্রীর ভাষণ মাঝপথে খেই হারায়, পন্ডিতের গণনায় হয়ে যায় ভুল, গৃহস্থ ভোলে নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম, আর সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো রাজামশায়ের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামে ঘটছে ব্যাঘাত। এইভাবে সংসার চলে কী করে? অতঃপর উপায় খুঁজতে জরুরি বৈঠক বসলো।
    -“সমস্ত গাছপালা কেটে নির্মূল করে দাও, তাহলেই বন্ধ হবে বসন্ত বাতাসে কিশলয়ের মাতামাতি আর শাখান্তরালে কোকিলের কুহুতান।” বললে চাটুকারের দল।
    -“আরে না না, গাছপালা না থাকলে গুটি পোকা বাসা বাঁধে কী করে? আর তারাই যদি না থাকে রেশম তৈরী হবে কেমনে? রেশম বিনে‌ রাজপোশাক তো আর তৈরী হয় না!সবেগে টিকি নেড়ে বললে পন্ডিত।
    ঠিক বাৎ। তাহলে উপায়? রাজ্য জুড়ে গগনচুম্বী পাঁচিলের বন্দোবস্ত করা হোক, যাতে ঊর্ধপানে চেয়ে চেয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেলেও নীল আকাশ, মুক্ত বিহঙ্গ,ঋতু বদল, কিছুই নজরে না আসে। কাজ ভোলানো বসন্তসমীরণ, আর বখাটে কোকিল দুই-ই হবে জব্দ।
    ঠিক ঠিক ঠিক- রব উঠলো সভা মাঝে।
    -“দাঁড়ান মহারাজ কঠোর পাহারার বন্দোবস্ত করছি আমি। সেপাই শান্ত্রী দলবল নিয়ে স্বয়ং পাহারায় র‌ইলাম, আজ থেকে আকাশপানে চোখ তোলাই মানা। যতোদিন না পাঁচিল তৈরী হয় ততদিন এই ব্যবস্থাই লাগু হোক। অন্যথা হলেই গর্দান যাবে।” বললে সেনাপতি।
    সাধু সাধু রব তুললে মোসাহেবের দল।
    এতক্ষণ সভার এককোণে নীরব শ্রোতা হয়ে বসেছিল বিদূষক। এখন আপন বাঁশিটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
    -“একী চললে কোথায় হে বিদূষক? বসো বসো, সভার কাজ শেষ হয় নি এখনো।”
    -“এবার আমার বিদায় নেবার পালা।”
    -“বিনা অনুমতিতেই?”
    -“আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। যিনি এই জগতের মহারাজাধিরাজ তিনিই যে স্বয়ং ডাক পাঠিয়েছেন। ওই শুনুন রাখালিয়া বাঁশিতে মেঠো সুরের আমন্ত্রণ। সে আহ্বান উপেক্ষা করি এমন সাধ্য ক‌ই! আপনার এই রুদ্ধদ্বার সভাকক্ষে, আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি চললাম।”
    -“প্রাণের ভয় নেই তোমার?”
    -“না মহারাজ! এক বিদূষক গেলে আর একজন আসবে, তারপর হয়তো অপর একজন। দুই হাত দিয়ে উতল হাওয়া রুখবেন এমন সাধ্য যে আপনার‌ও নেই রাজামশাই!”
    বিদূষক বাঁশিতে তান তুলে এগিয়ে গেল বাহিরপথে। তার বাঁশির সুরে উদাসী হলো গৃহস্থের মন। স্থলে জলে বনতলে লাগলো দোলা। সব ভয় ভাবনার হিসেব গেল গুলিয়ে। আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে পড়লো পথে।
    সেই থেকে আজ অবধি, রাঙা পলাশ বিছানো পথে হেঁটে যায় মানুষ। বাঁশি বাজে, বেজেই চলে অনন্তকাল ধরে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- মেঘ ও রৌদ্র

    মেঘ ও রৌদ্র
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    অটো থেকে নেমে অশক্ত শরীরে খুচরো গুনে ভাড়া মেটাতে দেরী হচ্ছিলো বলে অত্যন্ত রুক্ষ ব্যবহার করলেন অটোওয়ালাটি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অশীতিপর অবিনাশ বাবুর। বয়সের ভারে কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছেন ঠিক‌ই কিন্তু সেইজন্য এতটাই অসৌজন্য কি পাওনা হয় মানুষের! বয়স বেড়েছে বলেই বোধহয় দিন দিন একটু বেশিই স্পর্শকাতর হয়ে পড়ছেন অবিনাশবাবু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুটপাতের উপরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
    অবিনাশবাবুর গন্তব্য রাস্তার ওপারে ব্যাঙ্কটি। অফিসটাইমের অনর্গল গাড়ির স্রোত পেরিয়ে ওপারে যেতেই পারছেন না, অনেকক্ষণ ধরে। কোনও ট্র্যাফিক সিগন্যাল‌ও নেই আশেপাশে। কতক্ষণে যে একটু ফাঁক পাওয়া যাবে কে জানে, মনে মনে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন অবিনাশ বাবু, হঠাৎ নজরে এলো ওপার থেকে পান দোকানের তরুণ মালিকটি একছুটে রাস্তা পেরিয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একগাল হেসে তাকে আগলে ধরে বললো-“চলুন দাদু পার করিয়ে দিই আপনাকে।” আশ্চর্য ! এই ব্যস্ত সময়ে খদ্দেরের ভিড়ে কেমন করে সে খেয়াল করলো ,আধচেনা এই বৃদ্ধটিকে!
    মনটা খুশিতে ভরে উঠলো অবিনাশ বাবুর। মানবিকতার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি তাহলে।
    মানবজীবনে নিরন্তর চলছে এই মেঘ ও রৌদ্রের খেলা।

  • কবিতা

    কবিতা- বেলা যায়

    বেলা যায়
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    জীবনের এই স্থবির বেলায়
    তাকাই যখন পিছনপানে ,
    কল্পনাছুট ভাসিয়ে নে যায়
    ছেলেবেলার সেই উঠানে।
    দড়ির পরে ঐ যে মেলা মায়ের শাড়ি আমার জামা,
    পিঠের উপর চুল এলিয়ে ফুল তুলছে আমার ঠামা।
    ঠিক পিছনে সাজি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট দিদি,

    সাবধানে ফুল গুছিয়ে রাখে, উপছে ভুঁয়ে ছড়ায় যদি!!
    স্পষ্ট শুনি দাওয়ায় বসে চেঁচিয়ে দাদা নামতা পড়ে,
    লাউয়ের মাচায় ফুল ধরেছে , সবুজ পাতা হাওয়ায় নড়ে।
    দাদুর গলায় ভৈরবী সুর, বাবা এখন অফিস যায়,
    “আসার সময় লজেন এনো”
    বলছি আমি চিকন গলায়।
    হঠাৎ কখন চটকা ভাঙে
    মোবাইল ফোনের রিং এর টোনে
    ছায়ায় মিলায় সকল মায়া,
    বাষ্প জমে নয়ন কোণে।
    তারার দেশে গেছেন যাঁরা তাঁরা নাকি সবাই অতীত,
    এতো মায়ায় জড়িয়ে রাখে,
    কেমনে তা কল্পনাতীত!!
    দাদা ছিলো অঙ্কে তুখোড়, যাচ্ছে ভুলে বর্তমান,
    ‘স্মৃতিভ্রংশ’ বাংলা কথায়
    ইংরেজিতে কী যেন নাম !!
    সারাটা দিন আঁকছে ছবি ,
    ছোট্টো ছোট্ট তুলির টানে,
    মাঠঘাট আর পুকুর বাগান,
    হাঁটছে দাদা পিছনপানে।
    দিদি সে তো কবেই গেছে সাতসাগরের ওপার দেশে
    দূর বিদেশেই ঘর সংসার,
    কাটাচ্ছে দিন ঘোর আয়েশে।
    তবুও নাকি যেদিন হোথায় আকাশভাঙা বৃষ্টি নামে,
    শূন্যে চেয়ে উদাস দিদি কী যে ভাবে সে-ই তা জানে!!
    তাই তো বলি আয় না দিদি পরষ্পরের হাতটা ধরি,
    ওই উঠোনেই তিনজনেতে খেলবো আবার লুকোচুরি।

You cannot copy content of this page