-
আতশবাজি
আতশবাজি
-রাণা চ্যাটার্জী-“আরে, ঈশিতা,তুমি চুপ করবে? এবার না হয় দান ধ্যান করা একটু ছাড়ো! তোমার প্রশ্রয়ে দিন কে দিন কাজের মেয়েগুলো কিন্তু মাত্রা ছাড়াচ্ছে।”
কথাগুলো গজ গজ করে রণিত বলার মাঝেই তেলে বেগুনে জ্বলে “আঃ, এতো চেঁচাচ্ছ কেন বলোতো, রাত কটা বাজে, সে খেয়াল আছে তোমার” বলে,তিতলির পিঠ চাপড়ে ঈশিতা ঘুম পাড়াতে লাগলো।
রনিত তখনও একনাগাড়ে রাগের তুবড়ি, চরকি পোড়াতেই ব্যস্ত। একবার শুরু করলে নিজেকে সহজে থামাতে পারে না জেনেও, আবার জের টেনে ,”না ঈশিতা এত আস্কারা ওদের দিও না, জানবে ওরা কাজের মেয়ে। এই তো কিছুদিন আগে পুজোর বোনাস দিলে। আবার কি না বাজি কেনার জন্য টাকা দিতে বলছো! আমি ভেবে পাই না কি আশ্চর্য্য মানসিকতা ওদের! জানে বৌদি নরম মনের, হাত পাতলেই,ঠিক জুটিয়ে যাবে।”
-“এই ওপাশ ফিরে তুমি ঘুমাও তো যাও, আমি বুঝে নেব!”
-“কি সেই তুমি দেবে বলছো” রনিতের উৎকণ্ঠা গুগলি শচীন স্টাইলে দুর্দান্ত সামলে আর সাড়া দিলো না ঈশিতা। আগে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঠিক এভাবে লঙ্কাকান্ড করতো রণিত। ইদানিং যেন আরো বেশি খিট খিটে হয়ে গেছে!
তিতলির চার বছর বয়সটা পার হতেই, যখন সে অন্তত নিজের হাতে খেতে শিখেছে, ঈশিতা আবার বইয়ের ধুলো ঝেড়ে একটু একটু করে নিজেকে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে। সংসারের মধ্যে থেকে আসল সত্যটি সে বুঝে গেছে, মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটাই হলো আসল স্বাধীনতা। এটা খুব সত্যি যে, টাকা রোজগার করে স্বামীর পাশে থেকে হাল ধরলে পতিদেবরা খুশিই হয়, সংসারের শ্রীও ফেরে, নিজের ও কিছু ইচ্ছে মতো কেনা কাটা, শখ আহ্লাদ মেটানো সম্ভব হয়। ঈশিতার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ওকে সাফল্যের মুখ দেখিয়ে ছিল দু’বছরের মধ্যে বলেই সে স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পাড়া প্রতিবেশী এমনকি আপন কিছু আত্মীয়স্বজনের আচার আচরণও সে পাল্টে যেতে দেখেছে কিন্তু রণিত সেই একই তালে বইছে।
খুব আক্ষেপ হয় মাঝে মাঝে ঈশিতার। নিজের মেয়ের জন্য এতো প্যাকেট প্যাকেট ফটকা, ফুল ঝরি, রংমশাল কিনে আনতে পারলো রণিত আর কাজের দিদির ওইটুকু বাচ্ছা মুন্নির জন্য কিছু দিতে গেলেই দাঁত নখ বের করলো ওই ভাবে! বাচ্ছাটার কত আর বয়স, আমাদের তিতলিরই সমবয়সী, কি সুন্দর দু’টো বাচ্ছা এক সাথে খেলে যখন ওর মা ওকে সঙ্গে আনে। আর কিনা ওইটুকু বাচ্ছাকে খানিক মোমবাতি,আতশবাজি কেনার পয়সা, দেবে তা নয়, চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে।
এই সব চিন্তায় ভীষণ মাথা ধরা নিয়ে কাল দেরিতে শুতে গেছিলো সে। যখন ঘুম ভাঙলো,ওরে বাপরে একদম ঘড়িতে পৌনে নটা। কানে এলো রনিতের গলা, তিতলিকে ডাকছে কেন ওভাবে! তবে কি তিতলি কোথাও গেল! এই সব প্রশ্নের ভিড় ঈশিতাকে দৌড়ে ছুট কাটালো।
-“কি করছিস রে তিতলি, কৈ রে, গেলি কোথায়, তিতলি” হাঁকতে হাঁকতে রণিত দেখে তিতলি বারান্দার এক কোণে চুপটি করে বসে। “একি রে , তুই এখানে আর আমি হেঁকে ডেকে হয়রান।”
বাবার গলা শুনে কেমন একটা ভয়, আড়ষ্টতা জড়ানো সাত বছরের তিতলি প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। যেন সে কিছু অন্যায় করতে গিয়ে বাবার কাছে ধরা পড়ে গেছে!
পেছনে দৌড়ে ততক্ষণে, “কি হলো মা,কই দেখি তোমার হাতে ওটা কি সোনা” বলে ঈশিতা দেখলো ছোট্ট হাতে আঁকড়ে ধরা একটা ছোট্ট প্লাস্টিক ধরে তিতলি চোখে মুখে, চরম উৎকণ্ঠায়। তার নরম গাল বেয়ে, হড়হড় করে চোখ দিয়ে জল ঝরছে দেখে, রণিত মেয়েকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। আলতো করে প্লাস্টিকটা খুলে ঈশিতা, রণিত দুজনেই দেখলো, তিতলি ওর আতশবাজি, রংমশাল থেকে, দু’টো দু’টো করে সরিয়ে রেখেছে। আর ভেতরে একটা ছোট কাগজে, পেন্সিল দিয়ে অপটু হাতে লিখেছে, “মুন্নি,শুভ দীপাবলি, সাবধানে আতশবাজি পুড়িও কেমন।”খানিক মুখ চাওয়া চাওয়ি করে রণিত চুপ হয়ে গেল।
-
দুর্নীতি: সি বি আই
দুর্নীতি: সি বি আই
– রাণা চ্যাটার্জীএ দেশ টায় কি যে হবে বলতে পারেন গো দাদা,
যাদের উপর তদন্ত ভার তারা কিনা ছুঁড়ছে কাদা!দুর্নীতির কাদা ছোড়াছুড়ি দুই কর্তা সি বি আই,
দেশের সেরা তদন্ত সংস্থা,আহা সত্যি তুলনা নাই ।প্রথম,দ্বিতীয় অফিসার দ্বয়,গিলে ফেলেছেন ঘুঁষ,
লড়াই দুই রাঘব বোয়ালে,সরকারের তাই তো হুঁশ।
নজিরবিহীন এমন ঘটনা, ঘুঁষ ও কয়েক কোটি
ট্যাক্সে জনগণ অস্থির ,জোটাতে ভাত ও রুটি।চোরকে,চোর ধরা কাজ,শুরু করেছিলেন শেরশাহ
সিবিআই তাবলে ঘুষ খাবে,বলো এ কেমন আবহ!
চুপ চুপ ,গেল গেল রব, বিরোধীরা দেখি সোচ্চার,
মধ্যরাতেই হলো ছুটি মঞ্জুর ,ভেলকির সমাহার ।
সরগরম দিল্লি, লোধী রোড, তখন বারোটা কাল,
কোন্দল না মেটালে চলে,কেন্দ্র অস্থির,নাজেহাল।নতুন দায়িত্বে ডিরেক্টর এলেন, এম নাগেশ্বর রাও,
দুর্নীতি তদন্ত পরে,দুই কত্তা দীপাবলি তো কাটাও। -
শীতের টোটকা
শীতের টোটকা
-রাণা চ্যাটার্জীঅক্টোবর শেষ হালকা ঠান্ডা,শীতের হলো শুরু/
যে যাই বলুক,মাফলারটা বাগিয়ে নিও গুরু।তিতলি কেবল ভয় দেখালো,অল্প স্বল্প বৃষ্টি/
পুজো প্রিয় বাঙালির আবহাওয়া খবরে দৃষ্টি।মোটের ওপর উৎসব,পার হলো যেই দেখি/
ঠান্ডা নিয়ে শীত বাবাজি মারছে উঁকি ঝুঁকি।বাড়িতে বাড়িতে জ্বর সর্দি,হাঁচি কাশি দোসর/
ওই শোনো কান পেতে খক খক,ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর।তাই তো বলি,সাবধানে ,ঠান্ডা থাকুক দূর-ই/
সর্দি গর্মি,গায়ে হাতে ব্যাথা খুবই যে বিচ্ছিরি।সকালে মাফলার নিতেই,দেখছি তাকায় সবাই/
ঠোঁটে মুচকি হাসি,ভাবছে আজব যাচ্ছেতাই।তবুও আমি পণ করেছি,মাফলার ঠিক ব্যাগে/
রাত বিরেতে কাশলে,কার আর ভালো লাগে!লাগুক গরম,হাসুক লোকে,অভ্যর্থনায় শীত/
কমলা লেবুর মিষ্টি গন্ধ,হয়ে যাক সংগীত।এবার শীত জমিয়ে নাকি,বলছিল এক রোমিও/
বিয়ের প্লান ডিসেম্বরে,ঘরে খিল,লেপে ঘুমিও।কি ভাবছো,মুচকি হেসে, বিয়ের কথা শুনে/
মাফলারে হোক জমিয়ে প্রেম, বয়সটা নিও গুনে। -
বিজয়া স্মৃতি
বিজয়া স্মৃতি
-রাণা চ্যাটার্জীদশমীর সকাল,ঘুম ভাঙতেই এক রাশ বিষণ্নতা গ্রাস করতো। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল মন চাইতেই ফোন করার ধুম, দিন রাত কি করি, কি করি করে মোবাইলেকে কি পোষ্ট দিলো তার ছিল না উঁকি ঝুঁকি। তবু যেন বেশ ছিল সেই সব পূজা পার্বণের দিনগুলো। আন্তরিকতা, গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে সন্ধ্যায় বিসর্জনের পরে প্রণাম ও আশীর্বাদ আদান প্রদানের মধুরতা। তিলের নাড়ু, সিড়ির নাড়ু, নিমকি কত কি কাঁচের বয়ানে বানিয়ে রাখার তোড়জোড়। কোনো কোনো বাড়িতে ঘুগনি, কিনে আনা মতিচুর লাড্ডু পেলে তো আহা খুশিতে ডগমগ, মামার বাড়িতে আমার সেই শৈশব।
সব কিছু সেরে হ্যারিকেনের আলোতে এক গোছা পোস্টকার্ড নিয়ে দিদার সঙ্গে বসা, কাকে কাকে চিঠিতে বিজয়া আশীর্বাদ পাঠাবেন তার আলোচনা সেরে নিতাম উঠানে অন্ধকার আর ঝিঁ ঝিঁ শব্দ সঙ্গী করে।পুরানো ডাইরি ঘেঁটে ঠিকানা উদ্ধার করে তা দিদার নির্দেশ মতো লিখে ফেলার মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা,পোষ্টম্যানের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, চিঠির এক প্রান্তে দিদার কাঁপা কাঁপা হাতে আশীর্বাদ বার্তা, আর ঠিকানায় আমার অপরিপক্ক হাতের লেখনী সম্বলিত।
আজ বিজয়ার বিষাদ ভরা দিনে মনে পড়ছে পুরানো স্মৃতি। গ্রামে কাজের পাহাড় ভরা সংসারের এতো কাজ সামলে, ক্লান্ত ঘর্ম দেহে, একটু যে বিশ্রাম নেবে তা নয়, দুপুরে,রাত্রে একটু ফুরসৎ পেলেই গল্পের বই নিয়ে দিদার পড়তে বসা, আরো জানার আগ্রহ দেখতাম আর অবাক হতাম। আত্মীয় স্বজন, নাতি নাতনি, বেয়াই বেয়ান যে যেখানে আছে বিজয়া প্রণাম আসুক আর না আসুক দিদা কিন্তু আপন কর্তব্য সাবলীল ভাবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাসিমুখে পালন করে গেছে।
আজ শিক্ষা সংস্কৃতিতে বহুগুণ পারদর্শী হয়ে আমরা বিজয়া প্রণাম করতে, জানাতে ইতস্তত বোধ করি। ভুলে যাই ঘরের গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিতে, পাছে ওনারা যদি কিছু ভাবেন এই ভেবে। কেউ যদি কাঁচের বয়ান থেকে গুড়ের নাড়ু বের করে এনে দেয়, চোখ চাওয়া চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসি, আদতে দিন কালের সাথে সাথে আমরা কেমন যেন একটু একটু করে কৃত্রিম হয়ে উঠছি বিজয়া দশমীর আধুনিকতা গন্ধ গায়ে মেখে।
-
ময়না মতি
ময়না মতি
-রাণা চ্যাটার্জীআমি ময়না মতি ,
বড় আদরে শৈশব থেকে ডালপালা মেলে
বড়ো হয়ে ওঠা এক যুবতী নারী।
ছোটো বেলায় দাদার মুখে শোনা, রামু চাচা
একটা ময়না পাখি এনে দিয়েছিলো!
সেটাই ছিলো দাদার ধ্যান জ্ঞান।এক ঝড়ের রাতে, ভুল করে দরজা বন্ধ থাকায় মর্মান্তিক পরিণতিতে, আশ্চর্য্যজনক ভাবে খুবলে খেয়েছিলো কোনো দস্যি, হুলো বেড়াল !
তার কিছু দিন পরেই ক্লাস ফোরে পড়া
দাদা,পূর্বাভাস পায় “আমি আসছি “।ভাই না বোন তা নিয়ে,খুব একটা মাথাব্যাথা ছিলনা দাদার, কেবল ছিলো এক রাশ আনন্দ,
যখন গভীর রাতে মা, প্রথম বাবাকে জড়িয়ে
আমার আগমনের বার্তা দিয়েছিলো।আদরের ময়না হারিয়ে, দাদার সেই চোখে চোখে রাখা, আর মা বাবার পরম স্নেহে,
আমার ময়না মতি হয়ে ওঠার দিনযাপনের শুরু।আড়ালে কখনো কখনো ঠাকুমার হাপিত্যেশ শুনতাম,
কলতলায় যখন গোবর কুড়ানী ও পাড়ার খুড়িমা দুদণ্ড জিরোতে আসতো দুপুরে আমাদের বাড়ির পেছন দাওয়ায়।
আর একটা পুত্র সন্তান নেবার চাপ, অবশেষে সুখের দিনে নজর লাগালো অচিরেই ।এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার বৃষ্টি বাদলার ভোর রাতে,
গ্রামের উঁচু নিচু এবড়ো খেবরো জল-ডাঙ্গা রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনিতে তীব্র প্রসব বেদনায় বার বার জ্ঞান হারিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ!খুব সামান্য চাহিদায়,বড়ো স্নেহে দুই ছেলে মেয়ে, আর স্বামীর একটু আদর, অবজ্ঞাতেই খুশির স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, সরলমনা আমার মা।
মায়ের মুখটা মনে করতে করতে ঘুম ভাঙ্গা সকালে হঠাৎ জল ভর্তি মগের আচমকা হাত থেকে পড়ে যাওয়া,
ছ্যাঁক করে বুকের মাঝে যেন কিছুর বার্তা দিলো !সহজ পাঠ বইয়ের আঁকিবুঁকির মাঝেও শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা,”এই বুঝি বাবা এলো “!
দুপুরে বাবা এলেন,গ্রামের কিছু গ্রামের মাতব্বর সঙ্গে, সেই অপূর্ব সরলতা মাখা আমার মা হিমশীতল ডেডবডি হয়ে উঠোনে আমাদের সামনে!
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাক্স প্যাটরায় মায়ের শখের দু চার খান শাড়ি,সোনার জল ধরানো গয়না গায়ে উঠলো আমাদের সৎ মায়ের।বাবা সোহাগে পায়ের মল গড়িয়ে দিলেন,সেই মিষ্টি ছম ছম নূপুর ধ্বনি বড়ো বেমানান সুরে বাজতো আমার কানে! আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে দু দণ্ড গল্প করার নীরবতা বাধ সাধতো মুহূর্তে।
দাদার ঠাঁই হলো,দশ ক্রোশ দূরের আনন্দমার্গ স্কুলের হোস্টেলে।
ময়নামতির সেই অভাগীর দিন শুরু …!
নাম কা ওয়াস্তে,বইগুলো নিয়ে বসতাম আর, নতুন মায়ের ফাই ফরমাশ খেটে দিন গুজরান হতো।
মাঝ রাতে দাওয়ার কঞ্চি ঘেরা এক চিলতে চৌকিতে শুয়ে বালিশ ভেজানোর কতো রাত জাগা!
মা ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বপ্নে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে এলে আমায় নিয়ে যাবার বায়নায় বলে উঠতাম, “মা গো আমায় কি নিয়ে চলো না মা, তোমার কাছে !”
কখনো ঘোরে চিৎকার করে ‘ওরে দাদা ,আয়না রে ,আমায় নিয়ে চল।’
আমার প্রিয় ঘর, ছিঁটে বেড়া দেওয়াল, আর খাঁ খাঁ উঠোন আমায় গিলতে আসতো !কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠলো আমার শরীর,
পাড়া প্রতিবেশী, গ্রামের ফচকে ছোঁড়া, বুড়ো কেউই আড় চোখে আমার ডাগর শরীরের বেড়ে ওঠা দেখতে ছাড়তো না।মাতব্বরেরা বিধেন দিলেন হেঁকে, ‘ওরে ময়নার বাপ্, মেয়ে তো দিন কে দিন ডাল পালা মেলছে গতি কর জলদি’
মনে মনে হেসেছিলাম, দাদার আদরের ময়না মতীর একটা হিল্লের জন্য এই পুরুষ কুলের কতো চিন্তা !জানলাম না, চিনলাম না, গ্রামের দুগ্গা তলায় সিঁদুর দান সম্পন্ন হলো এক ভিনদেশি পুরুষের সাথে!
নব বধূর সাজে আমি ময়নামতী, ফুলশয্যার রাতেই বুঝলাম, আমার বাপের বয়সী, এক পোড়া কাঠ কয়লা হয়েছে আমার জীবনের সোহাগ।বিয়ের এক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেলো, মোটা অঙ্কের খেলায় নতুন মা, আমার সত্গতি করেছেন নপুংসক এই আধবুড়োর সঙ্গে।
প্রতি রাতে, ঘুমানোর ভান করে কান্নায় কেঁপে ওঠা আমার মন মায়ের কাছে, দাদার কাছে যখন আশ্রয় খুঁজতো, উপলব্ধি করতাম এক জান্তব লোমশ হাত আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাপ নেবার খেলায় মাতে!
মাত্র উনিশটা বসন্ত পার হওয়া আমি এখন ঠাঁই পেয়েছি হাসপাতালের ফিমেল বার্নিং ওয়ার্ডের বেডে,
একটা কাক সেই কখন থেকে কর্কশ ভাবে ডেকেই চলেছে কার্ণিশে!
সারা শরীর আমার অর্ধ দগ্ধ, জ্বলে গিয়েছে বুক, পেট তলপেট,নিম্নাঙ্গ!
এক উন্মত্ত ঝড়ো রাতে মদ্যপ স্বামীকে ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি।ময়না পাখি হয়ে শেকল কেটে বাঁচতে চেয়েছিলাম!
ভেবেছিলাম এক ছুটে দাদাকে খুঁজে সব বলে হালকা হবো,বলবো “দাদারে তোর ময়না মতীকে বাঁচা “।
রাত জাগা সকালে উঠে সে সুখ আর হয়নি !পৌরুষে আঘাত লাগা মদ্যপ যে ক্ষ্যাপা বাঘের চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার নজির পেয়েছি আমি হাতে নাতে!
প্রকৃতির ডাকে ঘুম চোখে ভোরবেলায় বাইরে আসতেই, কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আমার সর্বাঙ্গ!
ঠোঁটে দেশলাই কাঠি চেপে, ‘আমার নাকি রূপের গরব ,’ আর সেটাকেই পুড়িয়ে দিতে পারার উল্লসিত দেঁতো পুরুষতন্ত্রের হাসির মুখরিত ধ্বনি আজও কানে ভাসছে।হাসপাতালের বেডে পরম যত্নে আমার চোখের জল, মুছিয়ে দেবার আপ্রাণ চেস্টায় রত আমার নার্স আর দেখভাল করা মাসি ।
মন তখনো আকুতি নিয়ে বলছে, আয় না রে দাদা, একটি বার, এসে দেখে যা তোর ময়নামতি কেমন একটু একটু করে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে! -
এক টুকরো স্বাধীনতা
এক টুকরো স্বাধীনতা
-রাণা চ্যাটার্জীপাগলিটা আজ মার খেয়েই গেল…..
হ্যা,সত্যি বলছি,একটু আগে পাগলিটাকে বেধড়ক
মার, ঘাড় ধাক্কা নিজের আস্তানা থেকেই..!আমার পাড়ার ক্লাবে, পতাকা উত্তোলনের সাজো সাজো রব, দেশাত্মবোধক সংগীতের সুমধুরতা।
ব্যালকনি থেকে গর্বিত হয়ে উপভোগ করছিলাম
তেরঙ্গা পতাকার অসাধারণত্ব।
ছোট স্কুল বাচ্চাদের শৃঙ্খলিত লাইন, হাতে চকলেট
আর স্টেজে মান্যবর অতিথি বিধায়ক, গর্বে সাধের
কেতা দুরস্ত পাঞ্জাবি সামলাতে বেশ মগ্ন।মুহু র্মুহু ক্যামেরার ঝলকানি, গাঘেঁষে সেলফি
নেবার অস্থিরতা কোনো কিছুই নজর এড়াচ্ছিলো না!
পাশের গাছ তলায় থাকা পাগলিটার আস্তানা, ওই গাছ তলা থেকে সবেধন ওর একমাত্র সম্বল, ময়লা পুঁটলিটা ছুঁড়ে ফেলে, পাতা বেঞ্চে খোশ মেজাজে দলীয় চামচা আর দুচার আইন রক্ষক!
সামনে বিধায়কের দামী দুধ সাদা সজ্জিত গাড়ি।স্বাধীনতা দিবস পালনে ব্রতী সাধারণ জনগণ,
দলীয় অনুগত ভিড়, টপকে পাগলিটা, নিজের আস্তানা চিনতে না পেরে, ভুল করে তার ময়লা
হাতটা রেখে ফেলেছিল ওই দামি গাড়িতে..!রে রে করে ওঠা, পার্টির তাঁবেদার, স্বেচ্ছাসেবকরা,
পাগলীটা কিছু বোঝার আগেই, লাঠি পেটা করে
মেরে ওকে তাড়িয়ে দিল সেখান থেকে!ততক্ষণে মঞ্চে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার মাহাত্ম্য, উন্নয়নের জয় গান, বিধায়কের ভাষণ,পুষ্পবৃষ্টি।
পাগলিটার মাথা ফেটে গল গল রক্ত, ফোঁটা ফোঁটা ঝরে,খানিক আগে বৃষ্টির, জমা জল লাল করছে!
-
দুগ্গা মা
দুগ্গা মা
– রাণা চ্যাটার্জীদেখ্ মা আইছে দুগ্গা ঠাকুর
পরব পরব গন্ধ,
কত্ত মজা চাইরধারে
আর আমার কপাল মন্দ!গেল বছর পুজার সময়
বাপটা কইল্ল বিয়া,
ভাগায় দিল আমাদিকে
ফ্যালনা কইরে দিয়া।।বাবুদিগের ছুটো ব্যাটা
লতুন জামা পইরে,
লম্বা চুলে ,কানের দুলে
ফরফরায়ে দেইখ্ছে ঘুইরে।।গেল বছর যেই জামাটা
দিল বাবুর ব্যাটা,
পুরনো হল্যেও পায়্যেছিলম
মনে আছে তুর সেটা ?ছিঁড়ে গেছে জামাটাও
বল্ কি পইরব ইবার,
আমার ও তো মন করে
লতুন জামা লিবার।চাই যে একটা লতুন জামা
দে মা তুই কিনে,
পারবি নাই তো বুকে জড়ায়ে
বলেছিলিস কেনে?
“কিনে দিব লতুন জামা
বাবুঘরে ঝি খাইটে,
আমিই তোর মা রে
আমিই তোর বাপ বটে।”অ্যা মা, তোর চোখে জল!
কাদিস কিসের লাইগে?
চাইনা জামা, তোর শাড়িটাই
জুগাড় কইরব আগে।শুনছি ইবার উপাড়াতে
জামা কাপড় দিবেক,
তুই দ্যাখিস মা, লাইন দিয়ে
আমিই আগে লিবেক।নদীধারে কাশফুল গুলান
মনে লাগায় দোলা,
তুই ই আমার দুগ্গা মা রে
আমি যে তোর ছেইলা। -
নারী এক নদী
নারী এক নদী
– রাণা চ্যাটার্জীনারী হলো নদীরূপ এক বুক ভরা ঢেউ
অনুভবে টের পাবে গভীরে গেলে কেউ।।ছোট থেকে বড় হওয়া মেয়ে হয় নারী,
সমাজের নিয়ম-নীতি,বড় কড়া কড়ি।।নদী চলে আঁকে বাঁকে, কত নুড়ি বাধা
নারীর জীবনে পুরুষ ঠিক যেন ধাঁধা।।কত ভার বোঝা নিয়ে নদী চলে বয়ে ,
প্রেম প্রীতি হাতছানি নারী যায় ক্ষয়ে ।।নারী হলো সম্পদ,বড় অভিমানী নদী ,
ফুলে ফলে পল্লবিত,সাথ দাও যদি।।বুঝলে কি বৎস, নারী হলো উৎস ,
নারী হল যেন গতিধারা সুন্দরী মৎস্য।।নারী হলো প্রগতি রূপ ,নারী বসুন্ধরা,
স্রোতস্বিনী নদী হয়ে কাটায় যে খরা ।নারী জলে ভরা ডুব আহা কি পুণ্য,
নারী এক প্রকৃতি তাতে পুরুষ সম্পূর্ণ।।গতিপথে ভিড় বাড়ে,কত নুড়ি পাথরে
নারী হল মা, যেন সংসার গা গতরে ।।তবু আজ নারী যেন কাঠপুতলি খেলনা,
দিকে দিকে লোলুপতা এতই কি ফেলনা!।সংকটে মুখ বুজে যদি নারী ওঠে ফুঁপিয়ে
কিবা লাভ সভ্যতার নদী গেলে শুকিয়ে!।তাই নদী হলো নারী রুপ, চঞ্চলা ভরসা,
সমাজের জলতরঙ্গ বাজে রিমঝিম বর্ষা। -
অপেক্ষার ডাকবাক্স
অপেক্ষার ডাকবাক্স
– রাণা চ্যাটার্জীনোনা ধরা, হাড়-পাঁজর দেওয়াল,
খসে পড়া চুন-সুরকির অস্তমিত সূর্য সাক্ষী রেখে,
বৈঠকখানা ঘরের একরাশ কলরব আজ স্মৃতি!অনন্ত অপেক্ষায় আজও ঝুলন্ত ডাকবাক্স,
কমেছে ওয়েব স্বাধীনতার ঝড়ে চিঠির আনাগোনা,
নীল ইনল্যান্ড খাম,হলুদ পোস্টকার্ড, মানি অর্ডারে দু কলম মন ভালো করা বার্তা, ভুলেছে এ প্রজন্ম!কখনো একটা দুটো “ওঁ গঙ্গা”লেখা মৃত্যু খবর এসে পড়ে,সঙ্গ পায় এক রাশ বিষণ্ন মনখারাপ!
এক এক করে ছেড়ে চলে যায় ছোটকা, বড়দি,
মেজদা, রঙিন সুখ স্মৃতি, শৈশব গল্প, ছিন্ন করে..!দমকা বাতাসে উড়ে আসা, কখনো কেমন শুকনো পাতা,
পায়রা পালক, আমার একাকিত্বের গন্ধ নেয়!
ব্যস্ত ভারি স্কুল ব্যাগের বোঝা সামলে নাতি-নাতনিদের আসতে না পারা,
একটু একটু করে ঠেলে দেয় শূন্যতায়,
ফিস ফিস করে আমাদেরও যাবার সময়ের আগমন শোনায় চঞ্চল বাতাস।
পাশের রুমে চলৎশক্তিহীন বৃক্ক রোগে আক্রান্ত সহধর্মিনী,
বাইরে কালের স্মৃতি মেখে অপেক্ষায় ফাঁকা ডাকবাক্স, ঘরের অলিন্দ থেকে ভেসে আসা
একনাগাড়ে বোকাবাক্সের কল কলানি!নীরবতা,নিঃসঙ্গতার আঁকড়ে ধরা খড়কুটো,ঘড়ির টিক টিক, এই বুঝি এলো যমরাজের টেলিগ্রাম।
-
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
-রাণা চ্যাটার্জীএ এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার অথচ, তেমনভাবে দেখলে, অনেকে হয়তো ভাববে,” আমি মরছি নিজের জ্বালায়,মোবাইল থেকে কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে উড়ে গেছে আমার যাবতীয় কন্টাক্ট নাম্বার ,আর উনি কিনা রোমাঞ্চিত হয়ে অ্যাডভেঞ্চার গল্প শোনাচ্ছেন”!
মাকড়শাকে ভীষণ সিম্বলিক মনে হয় আমার। কি সুন্দর নিশ্চিন্তে, একটা অদৃশ্য জাল বুনে, অবস্থান করে । কাছে গেলে বা আলো ফেললে,বোঝা যায় কি অসাধারণ দক্ষতা নিপুণতা এই জাল তৈরিতে।আমরাও এখন পরিচিত হয়ে গেছি এই বৃহৎ ওয়েবজালে, সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানুষ নয় এক একটা আইডি ,প্রোফাইল , ডিপিতে,কোড পরিচয়ে।
মেসেঞ্জারে কথা বলতে বলতে এই অদৃশ্য টানের আপন আত্মার আত্মীয় বন্ধুদের প্রায়শই বলি,”আচ্ছা যদি হঠাৎ করে মারা যাই, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কিভাবে সবাই জানবে !স্ট্যাটাস আপডেট তো পাবে না “! সত্যিই এই ভাবনা আমায় ভাবায় !
এত্ত অপরিচিত মানুষ জন ইন্টারনেটের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ কি সুন্দর মিশে গেছে। সামনে এসে পরিচিত হবার সুযোগ নাই বা হলো তবু যান্ত্রিক জীবনে অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে মিশে,এক পারিবারিক বন্ধন। হঠাৎ মোবাইল বিগড়ে, মেমোরি ,হোয়াটসআপ কন্টাক্ট, মুছে গেলে নিজেকে বড় অসহায় লাগে ! মনের মধ্যে একটা ছবি ভাসে যেন এক নির্জন দ্বীপে একলা হয়ে গেছি আর জলে নুড়ি পাথর ছুঁড়ছি।
“কহ না প্যায়ার হ্যায়” সিনেমার ঋত্বিক,আমিশা হঠাৎ ঘুম ভেঙে,এমন নির্জন দ্বীপে এসে পড়ে ছিলো!ঋত্বিকের না হয় আমিশা ছিল। কন্টাক নম্বর হারিয়ে যে আমি ,তুমি হয়ে যাই বড় একা!এই ভাবেই হঠাৎ করে মোবাইল বিট্রে করলে বড় জ্বালা ,মাকড়শার জাল ছিঁড়ে গেলে যেমন মাকড়শা ঘাবড়ে পরিত্রাণের কথা ভাবে,আমরাও আবার বোনা জালে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হই।
না জুটুক দুমুঠো ভাত,রুটি
কমতি পড়ুক চাল-আটা,
হে সৃষ্টিকর্তা ,বিধাতা দেখো
যেন পাই নিরবিচ্ছিন্ন”নেট ডাটা”