-
কবিতা- অমানুষ ও রাজাধিরাজ
অমানুষ ও রাজাধিরাজ
– অনির্বাণ মন্ডলআমার শরীরে কোনো রং ছিল না;
রং থাকার কথাও ছিল না।
রাজাধিরাজ, আপনিই রং মাখিয়েছেন
বারবার নিজের পছন্দ মতো;
আর আমি আনন্দে নেচে উঠেছি
নিজেকে রঙীন দেখে।
আপনি শুধু মুচকি হেসেছেন।আমার তো কোনো ছায়া ছিল না;
ছায়ার প্রয়োজন ও ছিল না।
রাজাধিরাজ, আপনিই আলো অন্ধকারের খেলায় জন্ম দিয়েছেন ছায়া
বারবার নিজের আপন খেয়ালে;
আর আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠেছি
নিজের থেকে বড় নিজের ছায়ামূর্তি দেখে।
আপনি শুধু দূর থেকে হাত নেড়েছেন।আমার তো কোনো ঘুম ছিল না;
ঘুম আসার মতো দুর্বলতা ও ছিল না।
রাজাধিরাজ, আপনিই তো ঘুম পাড়িয়েছেন
বারবার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে।
আর আমি পরম তৃপ্তিতে চোখ বুজিয়ে থেকেছি
ঘুমের মধ্যে সুখের স্বপ্ন দেখে।
আপনি শুধু হাততালি দিয়েছেন।রাজাধিরাজ, সম্বল বলতে
আমার কেবল মেরুদন্ডটাই ছিল।
সেটাকে এখন আর খুঁজে পাচ্ছিনা।
কিভাবে হারালো তা জানিনা;
আমি শুধু জানি
হাজার হাজার বছর ধরে
আপনি রাজাধিরাজ;
আর আমি সামান্য মানুষ;
অথবা আপনার চোখে অমানুষ! -
কবিতা- প্রেমালাপ
প্রেমালাপ
– অনির্বাণ মন্ডলযদি বলি একটু বসন্ত দাও;
বসন্ত; শুধুই বসন্ত;
যেখানে আদিবাসী মেয়েটা
আপনমনে নেচে উঠবে ধামসা মাদলের তালে
আর তার শরীরের প্রত্যেকটা খাঁজ থেকে
ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসবে
তার জীবনযুদ্ধের গল্প,
তার ভালবাসার গল্প,
তার না পাবার গল্প।যদি বলি একটু আগুন দাও;
আগুন; শুধুই আগুন;
যেখানে পুড়ে যাবে
প্রতিদিন কুড়ি কিঃমিঃ সাইকেল চালিয়ে
কাজে যাওয়া লোকটার
হঠাৎ কাজ হারাবার ভয়;
আর তার রংচটা শার্ট থেকে উঁকি মারা
তার স্বপ্নভঙ্গের গল্প,
তার খালিপেটের গল্প,
তার আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার গল্প।যদি বলি একটু বৃষ্টি দাও;
বৃষ্টি; শুধুই বৃষ্টি;
যেখানে হঠাৎ ধুয়ে যাবে
নাইট ক্লাবে কাজ করে সংসার চালানো মেয়েটার
সব কলঙ্ক;
আর তার উন্মুক্ত শরীরী রেখা দিয়ে বয়ে যাওয়া
তার মাথা নীচু করে ঘরে ঢোকার গল্প,
তার প্রতিবেশীদের মুখ ফিরিয়ে নেবার গল্প,
তার আত্মীয়দের ঠাট্টা তামাশার গল্প।যদি বলি একটু সময় দাও;
সময়; শুধুই সময়;
যে সময়ের স্রোত একদিন ভুলিয়ে দেবে
রাজনীতির ক্ষমতা যুদ্ধে বলি হয়ে যাওয়া
সদ্য স্বামী হারানো বিধবার যন্ত্রনা;
আর তার চোখের নীচের বলিরেখায় ফুটে ওঠা
তার রাতজাগার গল্প,
তার খুনসুটির গল্প,
তার আলিঙ্গনের গল্প।যদি বলি একটা পথ দাও;
পথ; শুধুই পথ;
যে পথে একদিন
স্থির হয়ে অপেক্ষা করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ
অস্থির অঙ্গুলিমালের জন্য;
সেই পথ ধরে নির্জনে আমরা হেঁটে যাব
হাত ধরাধরি করে।
কখনো কখনো আদিম আনন্দে মেতে উঠব দুজনেই
দুজনার শরীরের আনাচে কানাচে,
দুজনার চেতনার আনাচে কানাচে;
আর সময় অসময়ে খুঁজে বেরাব গৌতম বুদ্ধ কে;
ক্রমশ অঙ্গুলিমাল হয়ে ওঠা
জীবনের জন্য।প্রেম হিসেবে এটুকুই তো চেয়েছিলাম তোমার কাছে;
এটুকু; শুধু এটুকুই। -
কবিতা- শ্যাওলা
শ্যাওলা
-অনির্বাণ মন্ডলতোমার দু’টো চোখের গভীর দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে
লুকিয়ে আছে কান্না;
আর কান্নার জলের মধ্যে
জমেছে শ্যাওলা।তোমার দু’টো ঠোঁটের খাঁজে খাঁজে
লুকিয়ে আছে চুম্বন;
আর চুম্বনের স্বাদের মধ্যে
জমেছে শ্যাওলা।তোমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে
লুকিয়ে আছে কামরস;
আর কামরসের ঝাঁঝালো তীব্রতায়
জমেছে শ্যাওলা।শ্যাওলা জমেছে দেশপ্রিয় পার্কে,
শ্যাওলা জমেছে বিডন স্ট্রীটে,
শ্যাওলা জমেছে মৌলালিতে,
শ্যাওলা জমেছে দুপুরের বজবজ লোকালে,
শ্যাওলা জমেছে দক্ষিণ মেরুর গলে যাওয়া বরফে,
শ্যাওলা জমেছে সম্রাট অশোকের তলোয়ারে,
শ্যাওলা জমেছে গৌতম বুদ্ধের মুখ চাপা হাসিতে,
শ্যাওলা জমেছে আবেগী তরুনীর খোলামেলা ভালোবাসাতে,
শ্যাওলা জমেছে মিছিলে আর পাল্টা মিছিলে,
শ্যাওলা জমেছে ছিঁড়ে যাওয়া হনুমান টুপিতে,
শ্যাওলা জমেছে পৃথিবীর উত্তরায়ণ আর দক্ষিণায়নে,
শ্যাওলা জমেছে তিস্তা নদীর জলস্রোতে,
শ্যাওলা জমেছে আফ্রিকার সিংহের মুখে,
শ্যাওলা জমেছে তিব্বতের নরম ঘাসে,
শ্যাওলা জমেছে ভারকানায়স্কের বসন্ততে,
শ্যাওলা জমেছে তাইহোকুর দুর্ঘটনাতে,
শ্যাওলা জমেছে নিষিদ্ধ পল্লীর বিছানাতে,
শ্যাওলা জমেছে ব্রাজিলের কফি ক্ষেতে,
শ্যাওলা জমেছে বিকেল বেলার চায়ের কাপে,
শ্যাওলা জমেছে পাড়ার বৌদির ইশারাতে,
শ্যাওলা জমেছে একলা বাউলের একতারাতে,
শ্যাওলা জমেছে প্রথম সকালের খেঁজুর রসে,
শ্যাওলা জমেছে শিশির ভেজা কলমি শাকে,
শ্যাওলা জমেছে ডাইনোসরের জীবাশ্মতে;আর নিভৃত কবির কবিতাতে;
আসলে শ্যাওলা জমেছে
তোমার আমার শিরদাঁড়াতে! -
কবিতা- ইচ্ছা
ইচ্ছা
-অনির্বাণ মন্ডলতোমাকে দিতে চেয়েছিলাম
জানালার ধারে হঠাৎ করে পাওয়া সীট
আর নামহীন কোনো দুপুরে
না বলে আসা বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শরীর।তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম
চোখে চোখে তাকানোর সুখ
আর রাস্তার ধারে পড়ে থাকা
একমুঠো গন্ধহীন পলাশ।তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম
ফুটপাতের ধারে অনাদরে বিক্রি হওয়া
অখ্যাত কোনো লেখকের চটি বই
আর শেষ বিকেলের ট্রেনের জন্য
অপেক্ষা করা সময়।রাজনীতির রঙে যখন
ক্রমশ রঙীন হয়ে উঠছে
আমাদের চেতনার অস্থি মজ্জা ;
তখন তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম
বর্ণহীন একলা মধ্যরাত্রির প্রথম অন্ধকার। -
কবিতা- বধির
বধির
-অনির্বাণ মন্ডলথেমে যাওয়া চাকার কনায় কনায় ক্লান্তি;
হয়তো ক্লান্তি কোনো চোখে নয়;
চোখের বিবর্ন প্রতিফলনের অনু পরমানুতে।
চেনা গলি, চেনা ঘাসফড়িং, কুকুরগুলোর উৎসুক চাহনি
সবই বড় চেনা চেনা;
আর তাই বোধহয় কিছুক্ষনের জন্য সময় থমকে যায়।
খুঁজে পাওয়া নয়টা গ্রহ আর রহস্যের অন্ধকারে থাকা নিহারিকাপুঞ্জ
সবই কেমন যেন চুপচাপ।
ঝরে যাওয়া পাতার খড়খড়ে শব্দ হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল;
কিন্তু শোনা হয়নি।শোনা হয়নি হিটলারের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ,
শোনা হয়নি নাগাসাকিতে বিষ্ফোরণের শব্দ,
শোনা হয়নি রাশিয়ায় জারতন্ত্রের ধ্বংসের আওয়াজ,
শোনা হয়নি আলেকজান্ডারের পরাজয়ের অস্ফুট কান্না,
শোনা হয়নি সতীদাহের সময় একদল হৃদয়হীন লোভীর উল্লাস।ঠিক একইভাবে শোনা হয়নি
রাতের সূর্যকে সাক্ষী রেখে
নরওয়ের কোনো যুবক যুবতীর
গভীর রাতের ভালোবাসার উদ্দাম শীৎকার
কিংবা সকালের নামখানা লোকালে
হঠাৎ ভালো লেগে যাওয়া কোনো নারীর মিষ্টি কন্ঠস্বর।আমি শুনিনি এসব কিছুই!
আমরা কেউই শুনিনা;
আসলে শুনতে চাইনা! -
কবিতা- মাৎস্যন্যায়
মাৎস্যন্যায়
-অনির্বাণ মন্ডল
ঘুমভাঙা থেকে ঘুম আসার সময়
আর আমার চারপাশের সমুদ্র
সবই জলে আর জলে জলময়।
আমার ভিতরের সমুদ্র
সেও বসে নেই;
ক্রমাগত পাড় ভেঙে চলেছে।
নুড়ি,পাথর,শিলা সবই ভাঙছে
আর পড়ে থাকছে বালি।
চোখে, মুখে, স্বাদে, বিস্বাদে
বালি আর বালি।
নিজের অজান্তে বালি ঢুকেছে
আমারই চেতনায়;
তবু খাবার দিতে ভুল হয়না সামুদ্রিক মাছগুলোকে।
খিদের জ্বালায় তারা
কখনো কখনো খেয়ে ফেলে
অত্যন্ত যত্নে গুছিয়ে রাখা
আমার চেতনার আবর্জনাগুলোকে;
তবুও তাদের খিদে মেটেনা;
আর প্রত্যেক দিন আমি বেড়িয়ে পড়ি
ছোট মাছ আর কীটপতঙ্গের খোঁজে।
নিউজ চ্যানেলে, সংবাদপত্রে,
সোশ্যাল মিডিয়ায় আর চায়ের দোকানে,
পক্ষের বা বিপক্ষের মিছিলে
আমি শুধু খুঁজি কীটপতঙ্গ আর ছোট ছোট মাছ। -
কবিতা- অস্তিত্ব
অস্তিত্ব
-অনির্বাণ মন্ডলকথা ছিল পর্দাহীন কোনো জানালা
আর কুয়াশাহীন সকাল।
আমি নিজেই অত্যন্ত যত্নে
রঙচঙে পর্দা টাঙিয়েছি
আর নিজেই বারবার পর্দা পাল্টেছি;
তবু মনের মত নকশা
আজও বাছাই করা হলনা!কথা ছিল শব্দহীন নিঃশ্বাস
আর প্রশ্বাসে ভরা অন্ধকার রাত্রি।
বিছানার শিরা উপশিরা জুড়ে থাকা
স্বপ্ন আর যন্ত্রনায়
কেটে গেল শেষ রাত্রির অলিগলি;
তবু মনের মত অন্ধকার
আজও খুঁজে ওঠা হলনা!কথা ছিল ছায়াহীন নীরবতা
আর একটুকরো মরুদ্যান।
মরুভূমির বালির উৎসসন্ধানেই কেটে গেল
উত্থান পতনে ভরা আস্ত একটা সভ্যতা;
তবু মনের মত সাজানো নগর
আজও পেয়ে ওঠা হলনা!না বলে কয়ে আসা অসমাপ্ত ঘুমের মত
বর্ষা নামে আর চলেও যায়।
আবর্জনার স্তূপ থেকে উঁকি মারে
নামহীন, গোত্রহীন কোনো উদ্ভিদ।
মাঝে মাঝে বর্জ্য পাতের আওয়াজে চমকে উঠি–
আর অবাক হয়ে উপভোগ করি
আবর্জনার নীচে লুকিয়ে থাকা
আমারই শিকড়ের স্পর্শ। -
কবিতা- হিসাব
হিসাব
– অনির্বাণ মন্ডলসেদিন বিকেলে কোনো রোদ ছিলনা
তবু আমি সময় দিয়েছি;
আর সময়ের স্রোত বেয়ে
বিকেল একসময় হয়ে উঠেছে সন্ধ্যা।
সন্ধ্যায় কোনো সাঁঝবাতি ছিলনা;
তবু অচেনা মুখোশের ভীড়ে
জমজমাট মেলা থেকে
মোমবাতি কিনে বাড়ি ফিরেছি।
নিজেরই বাড়ির মধ্যে
নিজের বিছানাকে
একবারের জন্যও চিনতে পারিনি।
নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েছি
নতুন সকালের খোঁজে।
ঘুমজড়ানো আঙ্গুলগুলো
বারবার অঙ্ক কষেছে–
দশ আর দশে কুড়ি
কিংবা কুড়ি আর দশে ত্রিশ।
সেই আর একটা দশের খোঁজে
কেটে গেছে আস্ত একটা জীবন;
আস্ত একটা সভ্যতাও।