• কবিতা

    কবিতা- আছন্ন অন্ধকার

    আছন্ন অন্ধকার
    – অমরেশ কুমার

     

     

    হাসি আমার সহজাত, অভিমান অন্তরে ;
    তাও বুকে অভিমান চেপে,
    মুখে হাসি, কেননা সহজাত ধর্মই–
    আমাকে হাসায়, যাতে আমার
    না বলা কথা কাউকে আঘাত না করে ।

    বাস্তবে!
    প্রেমের জ্বালায় জ্বলে আমি জ্বলন্ত ক্ষত,
    হাসছি তবু; দেখবো বলে
    ঠিক তোমায়, আগেরই মতো।

    বাস্তবে, পারিনা হাসতে, পারিনা কাঁদতে,
    পারিনা, না দেখে, দূরে থাকতে;
    সদা ভাসে মনে,
    ওই, হাসি মাখা রাঙামুখ —
    খুঁজে পায় স্মৃতিবিজড়িত কত সুখ।
    আজও, মনে পড়ে বাড়ে বাড়ে…
    আর! অঝোরে অশ্রুগুলি ঝরে।

    জীবনে তোমার অন্ধকারে,
    আজও আমি আছন্ন;
    অন্ধকারে অন্ধ চোখে দেখি;
    দিনের আলোয়, চোখ বুজায়ে
    সেজেই থাকি মেকি।
    আমি আজও তোমারই জন্য
    রেখেছি স্থান…
    যদি সব ভুলে, আপন করে, আসো ফিরে
    দুয়ার রাখিব খুলে —

  • কবিতা

    কবিতা- একাকী

    একাকী
    – অমরেশ কুমার

     

     

    জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রই
    একা একা আপন মনে
    ছোট ছোট আগাছা ঝুপরির ছায়া
    ছড়িয়ে পড়েছে জানালার পাশে ঘরের কোনে ।
    নিশ্চুপ , শান্ত সে প্রকৃতির ছায়া ।
    ধীর , স্থির একাকী বসে রই
    মৃদু আলোয় আলোকিত চারিদিক ;
    দেখি , একাকীর ব্যথায় ঝুপরির ঝোপ নিস্তব্ধ ।

    কোথা হতে আসে উড়ে বুলবুল পাখি ;
    প্রবেশ করে ঝোপের অন্তরে ।
    দুলে ওঠে ছায়া ।
    আনন্দে কেঁপে ওঠে বুক খানি ,
    পায় খুঁজে একাকীত্বের সাথী ।

    কিছু ক্ষণ পরে পাখী উড়ে চলে যায় ,
    আসে ফিরে সঙ্গিনী নিয়ে ।
    বাসা বাঁধে, ঝোপও আনন্দে মাতৃস্বরূপ ঠাঁই দেয় ।
    সব একাকীত্বের অবসান ।
    ছায়াও দুলছে , নিস্তব্ধ কেটে কুজন সুর ভাসছে ,
    শুধু জানালার এপারে একা একার চিন্তায় মগ্ন;
    বেদনার ভাষা আরোও বেড়ে যায় ,
    হায়! এ প্রকৃতি ছলনাময়ী ।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- ভাষার গতি

    ভাষার গতি
    অমরেশ কুমার

     

     

    ভাষায় যত জটিলতা আসবে ভাষা ততো জটিল হবে । ভাষা যত সহজ সরল হবে ততই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠবে; নতুবা জটিলতা থেকে পৃথক সত্তায় নতুন ভাষার আবির্ভাব ঘটবে ।

    জটিলতার সুবিধা হলো নতুন ভাষার উৎপত্তি , কোন কিছুতে জটিলতা না থাকলে নতুন কিছু পাওয়া যায় না ।

    অসুবিধা হলো ভাষার খন্ডীকরণ, ফলে পুরানো ভাষা অনেক সময় বিপন্নের মুখে পড়ে ।

    বর্তমানে একাধিক ভাষা বিপন্নের সম্মুখীন । যে সকল ভাষায় আগে মানুষ কথা বলতেন এখন সেই ভাষার অর্থ প্রচুর মানুষ বোঝেন না । দীর্ঘকাল ধরে ভাষা সুপ্ত থাকতে থাকতে লুপ্ত হয়ে যায় । বিলুপ্ত ভাষা পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের ভাষাবিদরা একের পর এক গবেষণা চালিয়ে চলেন । বাস্তবে দেখা গিয়েছে এই গবেষণার ফল বইয়ের পেজ এ ছাড়া আর কোথায় ব্যবহৃত হয় না । কেননা সেগুলোর কোন কথ্য রূপ জন সম্মুখে ব্যবহৃত হয় না । ভাষার এই বহুবিধ গতির ফলে একাধিক ভাষার জন্ম হয়, যা থেকে জন্ম নেয় পৃথক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতি । যা পৃথক সত্তার অধিকারী । যা মনুষ্যজাতির খন্ডীকরণ এর প্রধান হাতিয়ার । এই হাতিয়ারকে কেন্দ্র করে মানুষ নিজের সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে চলে, যা উন্নয়নের গতিকে অনেক সময় স্তব্ধ করে দেয় ।

    সুতরাং , ভাষার অগ্রসর এর পথে গতিও রয়েছে আবার বাধাও রয়েছে । ভাষাবিদরা যদি প্রথম থেকে ভাষার উপর পূর্ণ দক্ষতার সহিত বাধা গুলি উপলব্ধির মাধ্যমে সেগুলি দূর করার চেষ্টায় ব্রত থাকেন তাহলে ভাষার গতি বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে ।।

  • গল্প

    গল্প – মোতি

    মোতি
    – অমরেশ কুমার

     

     

    বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মোতি। সঙ্গে রয়েছে তার দুই ছেলে কিরণ আর মনি। দু’দিন খাওয়া হয়নি, অনাহারে পেট পুরো ঢুকে গেছে, আর হাঁটতে পারছে না ছোট ছেলে মনি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে খাবার খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না মোতি, তার ছেলেদের জন্য।
    সামনে একটা রুটির দোকান, মোতি ভাবল একটা রুটি না নিলে আর উপায় নেই। কিন্তু এইভাবে সে মানুষ হয়নি, দোকান থেকে চুরি করা, তার মন সায় দিচ্ছে না, চুরি করতে বিবেকে লাগে। কিন্তু এদিকে বাচ্চা যে মারা যাবে, সে বাধ্য হয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিল একটি রুটি। দোকানের মালিক একটা জুতো ছুঁড়ে মারলো। মোতির মুখে গিয়ে লাগলো, তাও সে খাবার ছাড়েনি বাচ্চার কথা ভেবে।
    মোতি খাবার নিয়ে গিয়ে দেখে কিরণ ডাকছে, তার দুই চোখ বেয়ে জল টপ টপ করে পড়ছে। মা খাবারটা মনির সামনে রাখলো। মনি আর দাঁড়াতে পারছে না, শুয়ে রয়েছে। বুকটা ধুক ধুক করছে। মা, রুটি নিয়ে মনির মুখে দেয়। খাওয়ার ক্ষমতা মনির মধ্যে আর নেই, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে; সে দাদা আর মাকে যেন বিড়বিড় করে কি সব বলছে। মায়ের দুই চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চোখের সামনে খাবারের অভাবে তার মনি মারা যাচ্ছে, অথচ খাবার মায়ের কাছে রয়েছে তাও কিছু করতে পারছে না মা ।

    ধীরে ধীরে মনির চোখ ঘোলা হয়ে আসে, মনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
    মোতি হাঁটু গেড়ে বসে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে ।
    কিরণ মনির বুকে মুখ রেখে চুপ করে ভাইয়ের পাশে শুয়ে থাকে ।

    মতি খুব ভালো করে জানে, এটা তার এলাকা নয়; তাই এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে। তার আগেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।কিরনকে ইশারা করে এগিয়ে যেতে বলে।

    কিরণ মুখে করে রুটি নিতে যাবে, মোতি তার দিকে তাকায় । কিরণ রুটি রেখে দেয় যথাস্থানে। মা ছেলে সোজা হাঁটা আরম্ভ করে ।

    মোতি কি এই ভেবে রুটি রেখে গেল, যদি ঈশ্বর কখনো তার মনির ঘুম ভাঙ্গায়, তার মনি যেন ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মা তার জন্য খাবার রেখে গেছে। মনি খিদেতে যেন কষ্ট না পায় ।

    রাস্তায় চলার পথে কত কুকুর তার দিকে চেয়ে রয়েছে। কেউ চিৎকার করে ছুটে আসছে, এই না প্রাণে মেরে দেয়। মোতি ভয়ে ভয়ে কিরণকে পাশে নিয়ে চলতে থাকে। কত কুকুরের কত কটুক্তি। কিন্তু, মা কারো কথায় কান দেয়নি, আপন মনে হেঁটে চলেছে।

    শেষ পর্যন্ত, ঝুপড়ি বস্তি এলাকায় একটা আস্তানা বেছে নিলো মতি। ছেলেকে নিয়ে সেখানেই থাকা শুরু করলো। রাস্তায় যা পায়, যা জোটে, তাই খায়। এই দুঃখের দিনে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। পাড়ার এক দাদা মোহিত, মোতির পিছনে পড়েছে। মোহিত মোতিকে জীবন সাথী করতে চায়। মোহিত, মোতিকে প্রস্তাব দেয়। অসুবিধার কথা বলে না করে দেয় মতি।

    মোহিতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে মোহিত কাউকে সহ্য করে না। কিরণকে মেরে ফেলে পথের কাঁটা সরাতে চায় মোহিত।
    ভয়ে শিউরে থাকে মতি। কিরণ তার চোখের মণি। মনি মারা যাওয়ার পর থেকে কিরণ তার একমাত্র হীরে। কিরণকে নিয়ে পালিয়ে যায় মতি।

    মোহিত, মতির পিছু ছাড়েনি চুপিচুপি ওদের পিছন পিছন যেতে থাকে। নতুন পরিবেশ আবার, নিজেকে মানিয়ে নেওয়া কষ্টকর, কিন্তু কিরণের জন্য তার এই কষ্ট করতেই হব। সে যে মা, সে না পারলে কে পারবে কষ্ট করতে?

    নতুন এলাকায় অনেকে মিলে তাদের ঘিরে ধরে। মোহিত ক্ষতবিক্ষত হয়ে লড়াই করে মা ছেলেকে রক্ষা করে। এইরকম একবার, দু’বার নয়; বহুবার তাদেরকে রক্ষা করেছে মোহিত। তারা যেখানেই যায় মোহিত তাদের সাথে সাথে যায়। একদিন কিরণ খেলা করছে ঠিক তখন মোহিত কিরণের দিকে ছুটে যায়, মতি দেখতে পেয়ে মোহিতের দিকে ধেয়ে যায় কিরণকে বাঁচাতে। শুরু হয় মোহিত-মোতির লড়াই। মতি কিছুতেই মোহিতকে আটকাতে পারছে না। মোহিত, মতির চোখে জল দেখে কিরণকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ।

    কিরণ পায়ে গুরুতর চোট পায়। মা আবার জায়গা পরিবর্তন করবে বলে ঠিক করে । কিন্তু কিরণের হাঁটার অবস্থা নেই, এখান থেকে না পালাতে পারলে কাল আবার মোহিত আসবে । কাল কিভাবে কিরণকে বাঁচাবে মোতি ভেবে পাচ্ছেনা ।

    মোতি বসে বসে ভাবছে, মোহিতের প্রস্তাবে রাজি না হলে কিরণকে বাঁচাতে পারবে কি না । এখনো পর্যন্ত যত বিপদ এসেছে সব থেকে মোহিত তাদের বাঁচিয়েছে। তার একার পক্ষে এই সমাজে চলা অতি কষ্টকর, সে একটা মেয়ে, তার কতটুকু আর ক্ষমতা সমাজের সাথে লড়াই করার, জীবনে পুরুষের যে খুব প্রয়োজন, অন্তত বারেবারে কেউ আঙ্গুল তুলে পণ্যের মতো কিনে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন হয়তো জুটে যাবে কিন্তু মান সম্মান ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিতে হবে না।

    পরদিন, মোহিত আসছে দেখে মোতি নিজে মোহিতের কাছে গেল। মোহিতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় মোতি। মোতি, মোহিতের জীবন সাথী হয়ে যায়। মোহিতও কিরণকে মেনে নেয়। তারা একসাথে দিন কাটাতে থাকে। কেউ এখন আর মোতির দিকে ছুটে আসে না ষ, মতির পিছু করে না।

    এইভাবে তাদের আট মাস কেটে যায়, আট মাস পরে মোতির চারটে বাচ্চা হয়। তারা সবাই মিলে, পুরোপরিবার খুশিতে দিন কাটাতে থাকে।

    কিন্তু, কে এই মোতি? মোতি আর কেউ না, একটা কুকুর। বাড়ির মালকিন দ্বারা বিতাড়িত, বর্তমানে রাস্তায় তার সুখের সংসার। মোতির উপলদ্ধি হয়েছে অট্টালিকায় আবদ্ধ রাজভোগের সুখের তুলনায় রাস্তার ফুটপাথের আবর্জনা মিশ্রিত নোংরা খাবার অমৃতসম। সম প্রজাতির মধ্যে পরিবারসহ থাকার সুখই হলো আসল স্বর্গ।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- নারীর অগ্রগতি নারীর হাতে

    নারীর অগ্রগতি নারীর হাতে
    – অমরেশ কুমার

     

     

    পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের পাশে থেকে তাদের অধিকারের জন্য আমাদের লড়তে হবে, লড়তে হবে সেই সকল অত্যাচারিত মহিলা, শিশু, বৃদ্ধা, বৃদ্ধদের জন্য। যাদের ইচ্ছা থাকলেও প্রকাশের ভাষা নেই, যাদের মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। আজ আমরাই নারী সমাজের ভবিষ্যৎ, আমাদের উচিত আমাদের মাতৃ সমাজের পাশে দাঁড়ানো, আমাদের উচিত আগামী দিনের সমাজকে সুস্থ রাখা। কিন্তু, তা আমাদের একার দ্বারা সম্ভব নয়, দরকার সমষ্টি। আজ আমাদের ভাইদেরকে বলতে হবে বোঝাতে হবে, যে নারীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ; নারী ছাড়া সমাজ কখনো সুষ্ঠ ভাবে চলতে পারে না, তাই দরকার নারী সমাজের অগ্রগতি ।

    প্রত্যেক নারীকেও মাথায় রাখতে হবে যে কিছু পাইয়ে দেওয়া যায় না, তা ছিনিয়ে নিতে হয়। প্রয়োজনে নিতে হবে। নারীর উন্নতিতে বহু পুরুষ কৃতিত্বের পরিচয় রাখে। তবে যতদিন না সকল নারী সমাজে একত্রিত হয়ে আন্দোলনে নামবে ততদিন সমগ্র ভাবে বাঁধা কাটানো সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। আজও সমাজে পণপ্রথা চালু, লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, যে নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য লড়ছে সেই নারী নিজের ঘরে ছেলের হয়ে পণ আনার জন্যও লড়ছে। নারীর এই দ্বিচারিতা আচরণ নারী সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সকল নারীকে এক বাক্যে বলতে হবে।

    আজও বহু ভাইয়েরা আমাদের এগিয়ে চলার জন্য সর্বদা হাত বাড়িয়ে হাত ধরতে প্রস্তুত থাকে। যখন তারা আমাদের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছে তখন আমরা পিছিয়ে থাকলে চলবে না, আমরা নারী সমাজ,আমাদের তা বুঝতে হবে। আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু এগিয়ে এলে হবে না সবাইকে আরো এগিয়ে আনতে হবে ।

    গ্রাম বা শহর প্রত্যেকটি অলিতে গলিতে দেখলে বোঝা যায় আজও পুরুষ শাসিত সমাজে নারী অবহেলিত, এর জন্য আমরাই দায়ী আমরা কখনো এগিয়ে আসিনি, আমরা কখনো প্রতিবাদ করিনি।
    আমাদের বিশ্বাস, আমরা সবাই মিলে একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তুলবো। হয়তো আজ আমরা ক্ষুদ্র, তবে তুচ্ছ তো নয়। হ্যাঁ, আমরা চেষ্টা করলে আরো কিছুজনের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বাসনার জাগরণ ঘটাতে পারবো। তাই আমাদের লক্ষ্য, সুস্থ সমাজ। একটি সমাজকে তখন সুস্থ বলা যায় যখন সমাজের নারীরা সুরক্ষিত থাকে, নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে, আর আগামী দিনের শিশুরা মাতৃ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।
    সেই জন্য আমরা সবাই চেষ্টা করবো একত্রিত ভাবে কাজ করার।

  • কবিতা

    কবিতা- ঈশ্বরের খিদে

    ঈশ্বরের খিদে
    – অমরেশ কুমার

     

     

    ছোট পরিবার, ছোট সংসার
    ছোট ঘর বাড়ি, ছোট যে দুয়ার
    পিতা-মাতা নাই , স্বামী-স্ত্রী রয়
    পুরো পরিবার আনন্দময় ।

    কাটিল কিছুদিন, বাড়িল কিছু স্মৃতি
    আসিল ঘরে নতুন অতিথি;
    জীবন যেন আরো মধুময় হয়
    খুশিতে দম্পতি আত্মহারা রয় ।

    মায়ের আঁচল তলে শুয়ে
    বলছে যেন কোলের শিশু —–
    “মাগো! তুমি এত খুশি কেন আজ
    আমি কি দিলাম তোমায় কিছু?”

    কিভাবে বুঝিবে সে বালক
    কি পাইলো তাহার মা;
    মা, বক্ষে জড়ায়ে কহিলেন—-
    ” ওরে বাছা,
    দশ মাস দশ দিন গর্ভে করেছি ধারণ তোরে
    যাইছিনু প্রসবকালে মরে,
    বহু প্রতীক্ষার পরে, শত শত জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে
    তুই এসেছিস মোর কোলে
    আনন্দ সহকারে, নৃত্যের তালে
    তাইতো দুলাইতেছি তোরে দুলে দুলে।”

    খিলখিলিয়ে হাসছে শিশু
    বলছে মারে,” তোকে ছেড়ে
    যাবো না মা থাকবো চিরকাল।”
    মায়ের মুখের রাঙা হাসি
    উঠল আবার ফুটে ,সম্মুখে
    আনিয়া লইলো হাতের
    মুঠে । মুখপানে চাহি
    করুণা নয়নে কহে, “কোথা
    যাবি বাবা, আমায় ছাড়িয়া ?
    মোর তো একটাই আশা
    শুধু তোকে দেখিব দু’নয়নে
    ভুলিব সকল ব্যথা; লইয়া
    তোরে শান্ত- বক্ষ -পানে।।”

    মায়ে- ছেলে হেসে খেলে
    দিন কাটে আনন্দে ডানা মেলে ।
    দিন যায় রাত যায়
    সে গুটি গুটি পায়ে হামাগুড়ি দেয় ।
    মা পিছু পিছু ছোটে
    আর বলে,” দেখোনা,
    তোমার ছেলে হয়েছে কেমন ছটফটে ।”

    সারা বাড়ি জুড়ে, তোলপাড় করে
    ধরিতে গেলে মা, বলে– “পারিবেনা তুমি
    আমি ছুটিব আরো জোরে ।”
    মায়ের দিকে চেয়ে
    বাবা, কহে হেসে—” মা হওয়া কি মুখের কথা ?
    বুঝিয়ে দেবে ঘাড়ে তোমার কটা মাথা “।

    মাও হেসে কহে —
    “সব মায়েরাই চায়
    তার সন্তানের দুষ্টুমি সেও যেন পায় ।।”

    ছোট্ট এই পরিবারে আনন্দ আরো বাড়ে
    সন্তানের মুখে প্রথম মা ডাক শুনে ।
    আনন্দে মেতে উঠে মায়ের প্রাণ
    হাজার সুখের মাঝে মা যেন
    খুঁজে পান মাতৃত্বের সন্ধান
    পূর্ণ হল মায়ের আশা, পূর্ণ হল মন
    মা যেন হাতে পেল সাত রাজার ধন ।।

    বছর তিনেক কাটিয়া গেল
    এমন খুশির রেসে
    হাসিতে হাসিতে সন্তান বাড়িয়া উঠে
    মায়ের চারিপাশে ।

    চিন্তা বাড়িল মায়ের বক্ষ বাসে
    আসিল বিপদ অবশেষে
    ঈশ্বর মেটাইলো ক্ষিদে স্বার্থের সংঘাতে ।।

    ঈশ্বর কর্তৃক, নামিল প্রবল বর্ষণ
    রুদ্রধারি প্রকৃতি সংহারী
    থামিলোনা আর এ চির বর্ষণ ;
    টানা তিন মাস,
    মাঠ ঘাট নদী নালা পুরো থৈ থৈ
    পাড়া নিরিবিলি করিছে না কেউ হইচই ।
    অবশেষে থামিল এ ধ্বংসের বৃষ্টি
    চারিদিকে শুধু জল, যত দূর যায় দৃষ্টি ।।
    বাবা কহে, “ ওগো, এ কাল বর্ষণ কমিয়াছে
    চারিদিকে শুধু জল জমিয়াছে,
    তুমি ছেলেকে রেখো সাবধানে ;
    এই রহিলো ছেলে, যাচ্ছি কাজে চলে ।”
    বাবা বাহির চলে যায় ,
    যাবার কালে ছেলের মুখে
    হামি দিয়ে যায় ।।

    ফুটবল লয়ে উঠানে ছুটে
    ঘুরে ঘুরে খেলে বেড়ায় ছেলে ;
    মা বসে বসে রান্না করে ,আর তাকিয়ে দেখে,
    কিভাবে ছেলে ফুটবল লয়ে খেলা করে ।
    বাবা চলে যেতে দেখে, ছেলে
    পিছু পিছু ছোটে,
    এড়িয়ে যায় মায়ের নজর ।।

    ছেলে ছুটে চলে, বাবা বাবা বলে
    গুটি গুটি পায়ে , যায় সে বাবার দিকে;
    কিছুদূর গিয়ে, মনে বাধা পেয়ে
    ফিরে আসে বাবা ।
    ফেরা পথে দেখে, রাস্তার পাশে
    কচুরিপানার ঝিলে
    জলসহ পানা নরিছে একই তালে ।

    বাবা , রাস্তা দিয়ে চিৎকার করে
    বউকে শুধাই, “ওরে , আমার বর্ষা খানা
    নিয়ে আয় । কচুরিপানার ঝিলে
    বড় মাছ যে খাবি খায় । ”
    রান্না ফেলে , ছেলেকে ভুলে
    ধরিতে আসে মাছ ; বলে,
    “ কি গো, ফিরে এলে আজ,
    নাহি কি আজ কোনো কাজ ?”
    বর্ষা হাতে লয়ে বলে,
    “ চুপ চুপ কোন কথা নয় ,
    শব্দে পালিয়ে যাবে,
    ঠিক করে মারা চায় । ”

    তাক করে ছুড়িল বর্ষা ,
    স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে
    হেসে হেসে কহে,
    “ একদম ঠিকঠাক করিয়াছি তাক ,
    পারিবেনা পালাইতে, রাখেনি কোন ফাঁক ।”
    হাসি হাসি মুখ করে বলে,
    “ দেখি ! তোলো,
    বর্ষায় কি মাছ বিঁধিল ।”

    সন্তর্পনে তুলিল বর্ষা
    বিঁধিয়া রহিয়াছে তাহারি সন্তান ,
    বর্ষার ফলা –
    বিঁধিয়া আছে হৃদপিণ্ড দিয়া
    রক্ত ঝরিছে ঝরঝরিয়া
    এখনও , রহিয়াছে শেষ প্রাণ
    ডাকিছে মা- মা বলিয়া ।

    ফাটিল মায়ের কোমল বুক
    উড়িলো মাতৃত্বের সকল সুখ ।
    হাত বাড়ালো মা ,
    সন্তানকে লইবে কোলে
    পড়িল মা মূর্ছা
    এ ধুলার ধরণীতলে ।।

    পিতা !
    করুন নয়নে চাহে ,
    শিশুকে রাখলি মায়ের পাশে
    রক্তে ভাসিছে চারিপাশ ।
    সন্তানের বুকে হাত রাখিয়া কহে ,
    “হে ঈশ্বর, এই ছিল মোর ভাগ্যে
    নিজ হাতে মারিলাম নিজ সন্তানকে,
    আজ আমি হলাম খুনি পিতা ,
    ফুলের মত আমার শিশুকে
    আমি তুলিলাম চিতায় ;
    যে শরীর দিয়া জন্ম দিয়েছে তারে ,
    তারে ফেলিলাম নিজে মেরে ,
    যে হাতে ঝিনুক বাটি তুলিয়াছি মুখে
    সে হাতে বিঁধিলাম ফলা , তারই বুকে
    হায় ! হায় ! হায় !
    একি আমি করিলাম ভুল
    হায়! হায়! হায়!
    এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নাই!
    বাঁচিবার মোরে কোন অধিকার নাই ।”

    ছুটিয়া যাইলো ঘরে
    দড়ি ঝুলাইয়া ঝুলিল সশরীরে
    সন্তানের সাথে সাথে শেষ হইলো নিজে ।।

    মায়ের মূর্ছা ভাঙ্গে
    চিৎকার করিয়া উঠে,
    “ওরে , বাবান কথা বল
    তুই পারবিনা যেতে, আমাকে এভাবে ফেলে ।”

    মা , সন্তানকে জড়াইয়া বুকে
    কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ে বাড়ে মূর্ছা যায়
    আবার , জ্ঞান ফিরিয়া পায় ।
    মা , চাহিয়া রহে সন্তানের মুখপানে
    পরিছে রক্ত মায়ের কোলে টোপে
    রক্তে মায়ের সারা শরীর রাঙা হয়ে ওঠে ।।

    চারিদিকে শুধু,
    মায়ের ক্রন্দন চিৎকার ।
    শুনছে না কেউ , শুধু শুনেছে
    তৃষ্ণায় পিপাসু ক্ষুধার্থ ঈশ্বর ।

    নাহি কোনো শব্দ তার সন্তানের মুখে,
    মা , শুধু জড়িয়ে আছে সন্তানকে বুকে ।
    শেষে ক্রন্দন থামাইয়া
    ঈশ্বরের পানে চাহিদা বলে,
    “ হে ঈশ্বর, তুমি নিয়েছো মোর সন্তানকে লয়ে
    পেয়েছে কি তোমার এতটাই খিদে ?
    মায়ের বুক থেকে সন্তানকে নিয়ে
    মিটিলো কি তোমার তৃষ্ণার খিদে ?
    বলো , হে ঈশ্বর,
    মিটিলো কি তোমার রক্তের পিপাসা ?
    নাকি, এখনো করিবে পান —–
    রহিয়াছে কি বুকে এখনও তৃষ্ণার আশা ?
    কেন তবে রহিয়াছো চুপ করে
    নেই কেন মুখে কোন ভাষা —?” ।।

    নিশ্চুপ,
    মা, আকাশ পানে চাহিয়া কয়
    “ও ! এখনো মেটেনি তোমার আশা, হে বিধাতা ! ”

    সন্তানের বুক দিয়া উঠাইয়া ফলা
    সজোরে নিজ বুকে আঘাত মারিয়া কহে ,
    “ নাও, তবে করো পান,
    মেটাও তোমার রক্তের পিপাসা ” ।।

  • কবিতা

    কবিতা- বিপ্লব

    . বিপ্লব
    -অমরেশ কুমার

    হিংসা, আজও চারিদিকে
    হিংসা, মেতেছে রাষ্ট্রনীতিতে
    হিংসায় জ্বলছে শহর, জ্বলছে মনুষ্যত্বের মেরুদন্ড
    হিংসায় জ্বলছে গ্রাম,
    পুড়ছে আঁচল ঢাকা মায়ের বুক।

    হিংসা শুধু হিংসা
    হিংসা মিশে গেছে জাতীয়তাবাদের ধর্মের রক্তে।
    তুমি বিপ্লবী, তুমি বিপ্লব
    জ্বলন্ত হিংসায় দগ দগ করে জ্বলছ
    তাও নীরবে সবকিছু দেখছো—
    জ্বলন্ত হিংসায় হাত চেপে মুখ।

    চারিদিকে পড়ে শুধু বিপ্লবের ছাই
    আজও ওড়ে, আজও ওড়ে; যদি দেখো চেয়ে।
    বিপ্লব রক্তে বিপ্লবী আমি..
    উড়ন্ত ছাইয়ের জমাটি রূপে
    বানাবো অট্টালিকার ভিত।
    আমি বিপ্লব, আমি বিপ্লব
    বিপ্লবে পুড়ে যাক হিংসার বিভীষিকা রূপ।

    কলহ সমাজে বারেবারে নেমে আসে
    বিপ্লবের তরঙ্গের ঢেউ —
    ভেঙে ছারখার হয়
    ইস্পাতে ঘেরা কংক্রিটে মোরা
    যত, সামাজিক বেড়াজাল, অন্ধ রীতিনীতি।

    বিপ্লব চলমান, বিপ্লব জানে নাকো মানা
    বিপ্লব, রুদ্ব দ্বারে আঘাত হেনে, আনে নতুন বার্তা
    পরিবর্তনের সেই তো বিপ্লব ,
    বিপ্লব আনে — পরিবর্তন-পরিবর্তন-পরিবর্তন।

  • কবিতা

    কবিতা- মৃত্যুর মালা

    মৃত্যুর মালা
    – অমরেশ কুমার

     

    জীবনে, জোৎস্নার সাথে অমাবস্যাও আসে
    ঘাত – প্রতিঘাত নেমে আসে আলো-আঁধারে।
    ঠিক যেমন, হাসির মাঝে অশ্রু বিন্দু ঝরে পরা,
    সব জেনেও, দু’দিনের পৃথিবীতে হাসি মুখে ঘোরা।
    জীবিত, চলমান মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে
    ধারণ করেছি মৃত্যুর মালা।
    কত আত্মীয় পরিজন আসে–
    দাঁতে দাঁত চেপে হাসি মুখে বলে,
    “ভালো আছিস রে? একদম ভেঙে পড়বি না”
    আমিও ছল ছল মুখে ভাঙা স্বরে বলি,
    “না থেকে উপায় কি? এই তো আছি বেশ,
    এতো দিনের কাল রূপী রোগে
    এখনোও যে আছি …… ”

    রোজ রোজ কত আয়োজন, কত প্রস্তুতি —
    কত কানা ঘুষ কথা আসে ভেসে,
    আজ কি শেষদিন? নাকি, আরো কিছু দিন…
    নীচু স্বরে কেউ বলে, “ডাক্তার তো বললো তাই”।
    দলে দলে লোক, বৈঠক বটে;
    সত্যি সে এক, আলোচনার সভাগৃহ।
    কেউ কাঁদে ,কেউবা কান্না লুকিয়ে —
    বাস্তবের সম্মুখে।

    আমি শুধু মনে মনে ভাবি, আছে তো দেহখানি,
    মন যে কবেই গ্রহণ করেছে,
    এ মৃত্যুর মালা।
    দেহের স্মৃতিতে এত কিছু?
    হায় রে মন, সবাই মন চাই-
    মনের মৃত্যুর হদিস কেউ না পায়।

    যত সময় পেরোই ততোই অবসাদ গ্রাস করে,
    চিন্তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হতে থাকে —
    সব আলোচনায় ফুটে ওঠে,
    একটাই সুর; যমালয়ের অট্টহাসি
    ব্যাটা পড়েছে মৃত্যুর মালা; তাও, হয়ে কানে কালা
    দেহ রেখেছে ধরে …..শুধুই ব্যঙ্গ হাসি।

    শেষমেষ, একটাই কথা বারে বারে
    মনে আসে, সেই কবরের পাশে–
    “দাঁড়াও পথিক,
    আজ তুমি যেখানে, কাল আমি সেখানে ছিলাম,
    আজ আমি যেখানে, কাল তুমি সেখানে থাকবে”।

    সব চিন্তার অবসান,
    স্রোতের গতিতে সবই যে ভাসমান।
    জোৎস্না রাতে মহামারি ক্যান্সার হলো জয়ী।
    ঝিকিমিকি আলোতে অমাবস্যার আগমন,
    নিঃস্তব্ধ পরিবারে।
    পরিসমাপ্তি সভাগৃহের দেহের মরণজ্বালা,
    ঘটল পরাজয়, পড়িল মৃত্যুর মালা;
    পরিল —— মৃত্যুর মালা।

  • গল্প

    গল্প- বিশু

    বিশু
    – অমরেশ কুমার

     

    এক
    এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে তাদের সব থেকেও কিছু নেই। তারা জন্মায় কেবল অবহেলার শিকার হয়ে, বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু সরঞ্জাম প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তাদের কপালে জোটে- তার বেশি পাওয়া তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারে না।

    ধনী গরীবের এই ভেদাভেদ চিরকাল আমাদের সমাজে। তার ছোঁয়া প্রতিটি পদক্ষেপে বজায় থাকে। টাকায় টাকা বাড়ছে আর কিছু মানুষ অনাহারে রাস্তায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়। কিছু মানুষ অট্টালিকাতে বসবাস করে থাকে, আর কিছু মানুষ রাস্তার পাশে ছেঁড়া চাদরের মধ্যে পুরো পরিবার নিয়ে থাকে। প্রথম শ্রেনীর মানুষ ভোগ করবার জন্য বেঁচে থাকে। তাদের জন্ম হয়েছে ভোগের থালা হাতে নিয়ে, আর দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য জন্মেছে। সুখ তাদের কপালে নেই, বাঁচতে হয় তাই বেঁচে রয়েছে ।ভুলবশত তাদের বাঁচতে বাধ্য করা হয়।

    বাঁচবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই বিশ্বজিতের, তাও যেন বাঁচবার জন্য তাকে বাধ্য করা হচ্ছে। না বেঁচে থেকেও উপায় নেই, তিন তিন বার মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েও পিছপা হতে বাধ্য হয়েছে বিশ্বজিৎ। সে যখন যা করতে যায়, তখন কিছু একটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধার সৃষ্টি করে থাকে, আর তখনই বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসতে হয়।

    বিশ্ব সংসারে আপন বলতে ঠাম্মা ছাড়া আর কেউ নেই বিশ্বজিতের। ঠাম্মা ছিল তার কাছে গোটা জগৎ, ঠাম্মাকে আঁকড়ে ধরে সে বড় হয়েছে।

    প্রতিটি শিশুর সঠিক ঠিকানা হলো মায়ের আঁচল, মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা শিশুর কাছে প্রকৃত ভালোবাসা; যা প্রতিটি শিশু তার মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বজিৎ সে কপাল নিয়ে জন্মায়নি; মায়ের স্নেহ, মমতা সে কোথা থেকে পাবে? মাকে তো সে চোখেই দেখেনি কখনো।

    তিন তিন বার মরতে গিয়েও ফিরে এসেছে শুধুমাত্র ঠাম্মার কথা ভেবে, ও ছাড়া যে ঠাম্মার আর কেউ নেই, ও না থাকলে ঠাম্মাকে দেখবে কে?
    কিন্তু, প্রকৃতি কারো ইচ্ছানুযায়ী চলে না, চলে নিজের ইচ্ছানুযায়ী। কে থাকলো আর কে চলে গেল তাতে তার কিছু যায় আসে না; প্রকৃতি বড়ই কঠোর, বড়ই নিষ্ঠুর, প্রিয়জনদের কেড়ে নেবার জন্য সর্বদা অপেক্ষা করে।
    প্রকৃতির এই রুদ্র নিয়মে ঠাম্মাও একদিন নাতিকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো।

    দুই

    বিষ্ণুপুর গ্রামে বিশ্বজিতের বাড়ি। গ্রামের রাস্তাগুলি মাটির, বিদ্যুৎ এর আলোও পৌঁছায়নি, প্রায় সব বাড়িগুলি মাটির তৈরি এবং খড়ের ছাউনি দেওয়া, বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা জমে থাকে রাস্তায়।

    বিশ্বজিতের ঠাম্মা শচীদেবীর স্বামী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। বহু কষ্ট করে তিনি ছেলে সমরজিৎকে বড় করে তুলেছিলেন। তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন পাশের গ্রামের মেয়ে সরলার সাথে।

    সরলার বাবার আর্থিক অবস্থা সমরজিৎ এর তুলনায় অনেকটাই ভালো, সে জন্য নিজের তুলনায় সচ্ছল পরিবারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে প্রথমে রাজি ছিলেন না শচীদেবী। মেয়ে দেখতে শুনতে ভালো, তার উপর বিয়ের সমস্ত খরচ মেয়ের বাবা দিচ্ছেন সঙ্গে দশ হাজার টাকা; তাই শচীদেবী আর না করেননি।

    এদিকে মেয়ের স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো ছিল না। সেজন্য সরলার বাবা ভেবেছিলেন মেয়েকে নিজের ঘাড় থেকে যত তাড়াতাড়ি নামিয়ে বিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো ।

    প্রথম প্রথম তাদের দাম্পত্য জীবন খুব ভালো ভাবে কাটতে থাকে, কিন্তু সে সুখ তাদের দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। অভাবের একঘেয়েমি সংসার সরলার আর ভালো লাগতো না। অভাবের কারণে মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে প্রচুর অশান্তি হতো ।

    বছর দুই যেতে না যেতে বিশ্বজিৎ-এর জন্ম হয়। বিশ্বজিতের আগমনে সব থেকে খুশি হোন শচীদেবী, আনন্দে পুরো পাড়াময় গল্প করতে থাকেন। আমার নাতি হয়েছে, আমার নাতির নাম রেখেছি বিশু।

    সংসারে কিছু নিন্দুক থাকে, যারা কিছু একটা পেলেই নিন্দা করতে ছাড়ে না। অবশ্য নিন্দা বললে ভুল বলা হবে, নিন্দুকেরা গ্রামের মধ্যে যা রটাচ্ছে তার পুরটাই মিথ্যা নয়, অধিকাংশই সত্যি।

    গ্রামের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সরলা। গ্রামের দু’চার জন বউ একত্রিত হলেই সরলাকে নিয়ে চর্চা শুরু করে দেয়। পাড়ার বউরা মিলে বলাবলি করতে থাকে সরলার যে ছেলে হয়েছে তা সমরজিতের নাকি ওই পাড়ার অশোকের? এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা কম চলে না।

    সরলার চরিত্রের কথা অনেকেই জানত। অশোকের সাথে সরলার যে একটা সম্পর্ক রয়েছে তা অনেকেই অনুমান করত, তার উপর দু’জনকে মাঝে মাঝে একসাথে দেখাও গিয়েছে। পাড়ার লোকতো বলবেই , তারা যখন সব কিছু নিজের চোখে দেখছে তখন তাদের বলতে অসুবিধা কোথায়। খবর মুখে মুখে ছড়াতে থাকে এবং একদিন সমরজিৎ এর কানে গিয়ে পৌঁছায়।

    শান্ত প্রকৃতির লোক ছিল সমরজিৎ, সে কারো কথাতে থাকতো না, নিজের মতো নিজে থাকতো। বউ এর কেচ্ছা কাহিনীতে সে এতটা ভেঙে পড়েছে যে সে নিজে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় তার। সর্বদা নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করে চলতো। তার বউ এত নীচ, এত ছোট মনের। বউ এর কাছ থেকেও আগের মতো ভালোবাসা সে আর পায় না, সর্বদা প্রত্যাখ্যান। এত অল্প বয়সে সে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে, সংসার নিয়ে চিন্তা করতে তার আর ভালো লাগে না, বউ এর নোংরা স্বভাব তাকে জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, পুরো গ্রামের মধ্যে বদনাম সে যেন আর সহ্য করতে পারছে না। তাই জ্বালা নিবৃতির সহজ উপায় সে বেছে নিলো- বৃদ্ধা মা, সদ্যোজাত ছেলে, বউ সবাইকে ছেড়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলো সমরজিৎ।

    সমরজিৎ না থাকায় সংসারে আরও দারিদ্রতা নেমে আসে। কি ভাবে সংসার চালাবে বুঝতে পারছিলেন না শচীদেবী। একে বয়স হয়েছে তার উপর সন্তান হারা হয়ে আরো দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বৌমাকে কখনো ছোট বড় কথা বলেননি।
    আজও কিছু না বলে, বৌমার মানসিক অবস্থার কথা বুঝে বৌমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজে লোকের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছেন, নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বৌমা ও নাতিকে সুস্থ রাখার।

    কিন্তু, এভাবেই বা আর কদিন চালানো যায়, এক বেলা খাওয়া হয় তো এক বেলা খাওয়া হয় না। সরলা মনে মনে ভাবে এভাবে চলা সম্ভব নয়। তাকে কিছু রোজগার করতে হবে, কিন্তু কি করবে বুঝতে না পেরে সেই অশোকের শরণাপন্ন হয়। সে জানতো অশোক তাকে ফিরিয়ে দেবে না। অশোক বদ লোক, সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। অশোকের সাহায্যে সরলার সংসার মাস দুই চলতে থাকে, স্বাভাবিক ভাবে একজন বিধবার সাথে একজন পুরুষের মেলামেশার ফলে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আগের তুলনায় দৃঢ় হয়। এরপর তারা ঠিক করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে এবং সম্পূর্ণ নতুন ভাবে জীবন গড়ে তুলবে। কিন্তু, মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বজিৎ। অশোকের মতে বিশ্বজিৎকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কিন্তু সরলা নিজের ছেলেকে ফেলে পালাতে রাজি হয়নি।
    কিন্তু, কিছু দিন পরে সরলা ভেবে দেখলো কি লাভ এই ভাবে গ্রামে পড়ে থেকে বিধবার জীবন যাপন কাটিয়ে, বিধবাদের যে সমাজে কেউ ভালো চোখে দেখে না। সারাজীবন বদনাম মাথায় করে নিয়ে বেরোনোর থেকে যার সাথে বদনাম রটেছে তার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করাই শ্রেয়। কেউ জানতেই পারবে না তার পুরানো জীবন। নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আশায় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে অশোকের হাত ধরে গৃহ ত্যাগ করে সরলা।

    তিন
    একে বয়স হয়েছে তার ওপর মানসিক চিন্তায় ভারাক্রান্ত, সব কিছু মিলেমিশে শচী দেবীকে আরো জড়বস্তুতে পরিণত করে, তাও কিন্তু শচী দেবী ভেঙে পড়েননি। তার শেষ সম্বল- তার বিশু। বিশুকে বড় করতেই হবে, সেই দৃঢ় মানসিকতার উপর নির্ভর করে লোকের বাড়িতে কাজ, কখনো বা বাজারে শাক-পাতা, কচু, ঘেটু হেঁকে হেঁকে বিক্রি করেছেন। বয়স যত হয়েছে জীবনে বাঁধা ততো বেড়েছে। সব বাঁধা অতিক্রম করে, তার বিশুকে বড় করে তুলেছেন।

    পনেরো বছর ধরে শচীদেবী নাতিকে বুকে করে জড়িয়ে রেখেছেন, শত কষ্টের মধ্যে নাতিকে আঁকড়ে ধরে বড় করেছেন। কিন্তু বার্ধক্যের কাছে কোনো কিছুই জয় লাভ করতে পারে না, বার্ধক্য সব সময় জয়ী হয়। এছাড়া সংসারের অভাব, হাজার অশান্তি, মানসিক অস্থিরতা সব কিছুর মাঝে আজ নাতির কোলে মাথা রেখে নাতির কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন শচীদেবী। বিশ্বজিতের দু’ চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে, আর চিৎকার করে কাঁদছে। আজ যে সে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির কমলা কাকিমা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করে,
    কি হয়েছে রে বিশু?
    ভাঙা ভাঙা স্বরে উত্তর দেয় ঠাম্মা… ঠাম্মা.. আর নেই কাকিমা….

    ঠাম্মা কিছুদিন ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন তা কাকীমা জানত। তাই কোনো উত্তর না করে ছুটে গিয়ে কাকাকে ডেকে আনে।

    কমলা, সম্পর্কে বিশুর কাকীমা হয়, প্রায় একই সময়ে বিশুর মা সরলা এবং কমলার একই পাড়াতেই বিয়ে হয়। তাই পাশাপাশি বাড়ি থাকার কারণে ধীরে ধীরে কমলা সরলার বন্ধু হয়ে ওঠে। গ্রামে গঞ্জে এই রকম সম্পর্কে একে ওপরের দিদি বলে ডাকে কেউবা সমবয়সী হওয়ায় ভালোবাসার খাতিরে নাম ধরে ডাকে। সরলার বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কম বেশি কমলা বিশুকে দেখে। শচী দেবী কাজের জন্য মাঠে ঘাটে চলে গেলে কমলার কাছে বিশু বেশি সময় থাকতো। তাই কমলা কাকীমা বিশুকে খুবই ভালোবাসে ।

    ঠাম্মাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতায় তুলে মুখে আগুন দিয়ে কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে বিশু কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার কেউ নেই কাকিমা, আমি একা হয়ে গেলাম”
    কাকিমা বিশুর মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি তো আছি।”
    কাকিমা বিশুকে খুব ভালোবাসত, বাবা- মা ছিলোনা বলে নিজের ছেলের মতই দেখত।

    একমাথা ঝাঁকড়া চুল, উস্কখুস্ক দেহ নিয়ে রাত দিন বাড়িতে পড়ে থাকতো বিশু। কাকিমা, যা নিয়ে যেত তাই খেতো। কিন্তু, এই ভাবে তো চলা অসম্ভব, সবার অভাবের সংসার; তারপরে ওর সারাজীবন পরে রয়েছে, ও করবে কি? এইভাবে একা একা বাড়িতেই বা কদিন থাকবে? সবকিছু চিন্তা করে কাকীমা কাকাকে একদিন বলে, “বিশুর জন্য একটা কাজ দেখো না, ছেলেটা এভাবে কি করে কাটাবে।”
    ঠিক আছে, দেখছি বলে কাকা চলে যায়।
    দিন দুয়েক পরে কাকা কাকিমাকে বলে, “বুঝলে একটা কাজের খোঁজ পেয়েছি, বিশুর জন্য।”
    – কি কাজ? কোথায়? কাকিমা আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে।
    – দোকানের কাজ, কিন্তু..
    – কি কিন্তু?
    – অনেকটাই দূরে, কলকাতা শহরে।
    শহরের নাম শুনে চুপ করে যায় কাকীমা, একা একা শহরে কি করে থাকবে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তারপরে বলে দূরে তো কি হয়েছে? কত লোকে এখান থেকে শহরে কাজের জন্য যায়। ও না হয় কষ্ট করে থাকবে ওখানে, ওতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, বাইরের জগৎটাকে চিনতে পারবে। তুমি কাজের কথা পাকা করে ফেলো।
    – আগে তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো যে ও কাজ করবে কি না।
    – হ্যাঁ, করবে। আমি বললে ও ঠিক করবে।
    – তাও, একবার ….
    -ঠিক আছে ,একবার জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি।

    কাকীমা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখে বিশু ঘুমাচ্ছে, ঘরের যেখানে দুপুর বেলা খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে পড়ে রয়েছে। না ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় ঘুম ভেঙে যায় বিশুর।
    – কে, কাকিমা?
    – জেগে আছিস?
    – হ্যাঁ
    – খাসনি কেন?
    – ভালো লাগছে না।
    – ভালো লাগছে না, বললে হবে, খেতে তো হবে।

    কাকিমা জোর করে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দেয়। খেতে খেতেই বিশু বলে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো কাকীমা?
    – কি কথা?
    – আমার মা কে কাকিমা?
    কথাটা শুনে করুণ ভাবে বিশুর দিকে চেয়ে থাকে কাকিমা এবং উত্তর দেয়,
    – জানিনা রে বাবা।

    সব কিছু জানত কমলা, তাও উত্তর দিতে ভরসা পায়নি। বিশু যখন একদম ছোট তখনই সরলা তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে এ সব কথা তার জানা, সরলার সাথে কমলার ভালো সম্পর্ক ছিল, পাশাপাশি বাড়ি ছিল তাই কথাবার্তা ভালোই হতো।

    খেতে খেতে বিশু বলে, না মাঝে মাঝে এসব কথা চিন্তা হয়, যদি কখনো মা কে সামনে পেতাম একটাই প্রশ্ন করতাম,
    “মা, আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেন?”

    কথাটা শুনে কাকিমা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। কমলা জানে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, সেও একজন স্নেহাশীলা মা, মায়ের সব থেকে বড় সম্পদ হলো তার সন্তান; সন্তানের সুখ মায়ের সুখ। কোন নারী তখনই সবচেয়ে খুশি হয় যখন সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে পায়।

    কাকীমা শুধু মৃদু স্বরে উত্তর দেয়, থাক না বাবা ওসব কথা।
    ওদিন কাজের কথা বলতে পারেনি, তাই পরের দিন গিয়ে বলে,
    বিশু, তোর কাকা তোর জন্য একটা কাজ দেখেছে।
    – আমি কাজ করবো না।
    – করবো না বললে হবে, কিছু তো করতে হবে। তা না হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবি কিভাবে? সব সময় কি আমি থাকবো তোর পাশে?
    – আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না কাকিমা।
    – ছেড়ে যেতে কে বলেছে, তুই কাজ করবি, বড় হবি, মাঝে মাঝে আমাদের দেখতে আসবি। তারপর বিয়ে করবি, সংসারী হবি।

    কাকীমা, বিশুকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে কাকার সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। যাবার আগে বলে যায়, “আমি আবার ফিরে আসবো কাকীমা তোমার কাছে।”

    চার

    কাকা বিশুকে দোকানে রেখে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। একটি বিস্কুট দোকানে বিস্কুট বিক্রি করা ছিল বিশুর কাজ, দোকানদার প্রথম কিছুদিন বিশুকে নিজের বাড়িতে রেখেছিল। কিন্তু, শহরে কে বা কার কথা রাখে, সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। বিশু ছিল একটু খাম খেয়ালিপনা স্বভাবের। কখন যে ও কি ভাবে তা কেউ বুজতে পারতো না। বেশির ভাগ সময় একা একা থাকতো। দোকানদারের মনের মতো সে হয়ে উঠতে পারে নি। তাই , কিছু দিন পর নিজের আশ্রয় নিজেকে খুঁজে নিতে বলে মালিক।

    একগুঁয়ে ধরনের ছেলে ছিল বিশু। কোথায় যাবে, কিভাবে থাকবে তার কিছুই জিজ্ঞাসা না করে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে মনে ভাবে, এখন কী করবে? কোথায় থাকবে?

    শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত নতুন নতুন জিনিস দেখে সে। সুন্দর ঝাঁ চকচকে রাস্তা, যেখানে বর্ষাকালে কাদা হয় না; রাস্তার ধারে কত আলো, কিবা রাত কিবা দিন বোঝার উপায় নেই, চারিদিকে কত লোক… গ্রামের দিকে একটা মেলাতেও এত লোক একসাথে দেখা যায় না। চারিদিকে সুন্দর সুন্দর দোকান, সুন্দর সুন্দর গাড়ি, এসব দেখতে দেখতে ভাবে তার যদি এমন একটা গাড়ি থাকতো। কিছুক্ষণ পর নিজেই আবার বলে, যার নিজের থাকার জায়গায় নেই তার আবার গাড়ি-বাড়ির স্বপ্ন ।

    আরো কিছুটা হাঁটার পর একটা জায়গায় বসে ভাবে তার এসব কিছুই লাগবে না তার কাছে তার গ্রাম অনেক ভাল, অন্তত থাকার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর ছিল। ভাবতে থাকে তার গ্রামের কথা —- তার কাছে সব থেকে প্রিয়জন তার ঠাম্মা। ঠাম্মা যদি আজ বেঁচে থাকতো হয়তো তাকে এখানে আসতে হতো না, বারবার যেন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠাম্মার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। ঠাম্মা তাকে বকতো, জোর করে বাজারে পাঠাতে কিন্তু সেসবের মধ্যে ছিল ভালোবাসার ছোঁয়া। আজ তার বকার কেউ নেই, মারারও কেউ নেই; বড় একা, নিঃসঙ্গ সে। চারিদিকে কত লোকের কত কোলাহল–অথচ সে নিজে বোবা। সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র সময় কারোও নেই। সবাই নিজের জন্য ব্যস্ত।

    একটু আশ্রয়ের জন্য সারা শহরের রাস্তার দিকে ছুটে চলেছে বিশু। এমন যানবাহন চালিত রাস্তায় চলার অভ্যেস নেই তার। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারে বিশুকে।
    মা! বলে চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ে রাস্তার উপর মাথা, নাক, মুখ দিয়ে তীব্র গতিতে রক্ত ঝরতে থাকে, তারপর আর কোন সাড়া শব্দ নেই।

    তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এক ভদ্রমহিলা। বিশুকে সন্তানের মতো করে কোলে তুলে হসপিটালে ভর্তি করেন ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়।

    বিশুর কাছে দোকানের একটা কার্ড ছিল সেই কার্ড দেখে দোকানে খবর দেওয়া হয়, সেখান থেকে খবর পৌঁছে যায় তার কাকীমার কাছে।
    একটুও দেরি করেনি কাকিমা, কাকাকে সঙ্গে করে যত দ্রুত সম্ভব এসে পৌঁছলো।

    হসপিটালে ঢুকে রক্তমাখা মহিলাকে দেখে চমকে উঠে কমলা, বিস্ময় ও হতাশা নিয়ে মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে না, চিনতে একটুও ভুল হয়নি। এ যে সরলা, বিশুর গর্ভধারিণী মা। সরলাও চিনতে ভুল করেনি কমলাকে। তাদের পাশাপাশি বাড়ি ছিল, পনেরো বছর আগে ঘর ছেড়ে চলে এলেও, আজও সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে সরলা।

    কমলার কথা বলার সময় ছিল না সরলার সাথে, ছুটে যায় বিশুর কাছে। কিন্তু, অনেক আগেই সব শেষ, ডাক্তার বিশুকে মৃত বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

    বিশুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে কাকিমা, “তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বিশু, আমি তোকে জোর করে কাজে পাঠিয়েছিলাম। তার পরিণাম তুই আমাকে এইভাবে দিবি আমি ভাবতে পারিনি, তুই বলেছিলিস, ‘আমি তোমার কাছে ফিরে আসব কাকিমা’, তুই আমার কাছে ফিরে আসিস বাবা, আমার গর্ভে” বলতে বলতে মুখ আঁচল দিয়ে চেপে বাইরে বেরিয়ে আসে।

    বিশুর মা সরলা বিশুকে ফেলে রেখে অশোকের হাত ধরে চলে এসেছিল এই শহরে। অশোক চিরকাল বদবুদ্ধির লোক। সরলাকে সঙ্গে করে এনে মাস ছয়েক পরে সরলাকে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যায়। ছেলের কথা মনে পড়লেও গ্রামে ফিরতে পারেননি সরলা, গ্রামের মানুষের মাঝে কি ভাবে মুখ দেখাবে সেই ভয়ে। কলকাতা শহরেই থেকে যায়। এ শহরে টাকা উপার্জনের বহু উপায় রয়েছে, নিজের ইচ্ছা মতো পথ বেছে নিতে পারলেই হলো। দেখতে-শুনতে ভালো ছিল সরলার। রূপের অহংকার এখন আর নেই, নিজের দেহের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছে তার। তাই এই দেহকেই মেলে ধরে অর্থ রোজগারের সিদ্ধান্ত নেয় সে। মাস গেলে ভালো আয় হতো, আর বর্তমানে সে তো পতিতালয়ের একজন লিডার এ পরিণত হয়েছে । কলকাতার মতো শহরে থেকে গাড়ি বাড়ি বানাতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। গাড়ী,বাড়ী সব থাকলেও মনে কোনো শান্তি ছিল না সরলার।
    অর্থের অভাবে ভালো ভাবে খাওয়া হতো না, খিদের টানে ঘুম আসতো না, সর্বদা অশান্তির ঢেউ; আজ অর্থের পাহাড়ে ঘুমায় সে, পেটে খিদে নেই তবুও কিন্তু মনে শান্তি নেই ; আজও সেই ঢেউ তবে তফাৎ শুধু পরিস্থিতির।

    কমলা ঘর থেকে বের হতেই সরলা এগিয়ে বলে,
    – চিনতে পেরেছিস কমলা?
    চোখের জল মুছে উত্তর দেয় কমলা,
    -চিনতে পারবো না তোকে, তা তুই এখানে?
    সরলা, কিভাবে হাসপাতালে উপস্থিত হল তার পুরো ঘটনা কমলাকে বলতেই, কমলা কিছুটা হাসি মুখে বলে, “বিধাতার কি পরিহাস, যার গর্ভে জন্ম তারই হাতে মৃত্যু, জন্ম – মৃত্যু একই কোলে।”

    কথাটা সরলার মনে একটু খটকা লাগে, তাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলে,
    – কি বলছিস কমলা?
    – পনেরো বছর আগে গ্রামের কথা মনে পড়ে তোর, কাউকে ফেলে এসেছিস?
    কথাটা বুঝতে আর বাকি থাকল না সরলার, কমলার প্রতি উদ্দেশ্য করে বলে, আমার ছেলে.. বিশ্বজিৎ!
    কমলা শুধু আস্তে করে ঘাড় নাড়ল।
    সরলার ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল.. আমার বিশু! বাবা, চেয়ে দেখ বাবা, আমি — আমি তোর মা।
    বিশুর কোন সাড়াশব্দ নেই, সে চুপ করে মায়ের কোলে চির নিদ্রায় নিদ্রিত। এ ঘুম যে তার আর কখনোই ভাঙবে না। এই প্রথম মাকে সামনে পেল,অথচ চোখ মেলে মাকে শুধু একটি বার দেখবে সে শক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে ঈশ্বর।

    কমলা শুধু পিছন থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে, আর মনে মনে এটা ভেবে খুশি হচ্ছে যে অন্তত মরার পর মাকে কাছে পেয়েছে বিশু। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে পেরেছে।
    সরলা চিৎকার করে কমলাকে বলে, “কমলা, বিশুকে শুধু একবার মা বলে ডাকতে বল।
    উত্তর না দিয়ে থাকতে পারল না কমলা, সে বলে ফেললো, “সরলা, সন্তান জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, মা হতে গেলে দায়িত্ব পালন করতে হয়।”
    মা, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কমলার দিকে তাকিয়ে বলে , “কমলা, আমি বেশ্যা, বেশ্যাই থেকে গেলাম, ছেলেকে জন্ম দিয়েও মা হতে পারলাম না।”

    প্রকৃতির স্বাভাবিক সামাজিক নিয়মে সন্তানের হাতে মায়ের শেষকৃত্য হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে বিধাতার লীলাখেলার পরিণামে মায়ের হাতে সন্তানের শেষকৃত্য সম্পন্ন।

  • কবিতা

    কবিতা- সামাজিক ব্যাধি : গঙ্গা জলে নারী পুজো

    সামাজিক ব্যাধি : গঙ্গা জলে নারী পুজো
    – অমরেশ কুমার

     

    হিংসার বিভীষিকাময় রূপ,
    আজ এই অ্যাসিড আক্রান্ত;
    ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম হয়ে উঠেছে,
    এই সামাজিক ব্যাধি।
    প্রণয় কিংবা পরিবার, অথবা, বিচ্ছেদ,
    ক্রমাগত ঘটিয়ে চলেছে.. কুৎসিত, এ ব্যাধি।
    আবেগ কিংবা দুঃখ শুধু নয়,
    সুনির্দিষ্ট, পরিকল্পিত, লিঙ্গ ভিত্তিক এই সামাজিক ব্যাধি।
    বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বময়, আক্রান্ত, ভারাক্রান্ত, জরাজীর্ণ,
    বহু সমালোচিত এই ব্যাধি।

    এ, লজ্জা যে, সম্পূর্ণ একান্তই;
    তাই, বয়ে বেড়াতে হয়ও একাই।
    জানি, তুমি আবেগে ভাসবে,
    কিন্তু, প্রতিবাদ!
    ..এগিয়ে আসবে না ,
    আমি নিশ্চিত, সমালোচনার ঝড় বইবে,
    কিন্তু, আমার মনের ঝড়ের হাওয়ার,
    গতি পরিমাণ করতে, কেউ আসবে না।

    দিনে দিনে বেড়ে চলেছে,
    কেউ বা প্রকাশ্যে, কেউ বা অন্ধকারে আচ্ছন্ন; চলমান মৃতদেহ নিয়ে ছুটে চলা।
    গ্রাম, শহর কিংবা শহরতলীতে,
    ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে হেঁটে চলে
    কত মায়েরা, কত বোনেরা..
    কেউ আক্রান্তে মৃত,
    কেউ, পুনরায় আক্রান্তের ভয়ে
    জরা, বধির ।
    যেটুকু দেহে প্রাণ, তাও যদি নেয় কেড়ে ।

    দেহ ?
    সে তো কবেই অধিকার করে বসে আছে,
    অধিকারের বশে, ক্রমাগত
    ঘটে চলে এই মহামারি আক্রান্ত ।

    প্রতিবাদ ?
    ..হাস্যকর,
    চুপ! চুপ!
    – সব বুদ্ধিজীবীরা দেখছে,
    চুপিসারে, ফাইল তৈরি হচ্ছে।
    জামিন?
    – জেলে যাওয়ার আগেই হয়ে গেছে ।
    জরিমানা?
    -বালাই ষাট,
    ধর্ষণেও ধর্ষকের উকিল মেলে,
    আর এখানে, না বলাই থাক।

    হাজার হাজার স্বপ্ন, না বলা কথা,
    চোখের জলে আর প্রভাবশালীদের ভিড়ে
    হারিয়ে যাচ্ছে,
    যবনিকার ন্যায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে জীবন ।

    ওইতো, মেয়েটি সবেমাত্র কলেজে উঠেছে,
    সামনে রঙিন ভবিষ্যৎ ।
    প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন,
    কিন্তু, স্বপ্ন আর পূরণ হলো না,
    দু’দিনেই শেষ হল ।
    পাশের পাড়ার বিপ্লব, তাকে ভালোবাসে,
    তার ভালোবাসায় মেয়েটির জীবন পুড়ে গেল ।
    ভালোবাসার আরেকটি রূপ যে,
    অ্যাসিড বৃষ্টি; তা হয়তো মেয়েটি বোঝেনি।
    ফুটফুটে সুন্দর চেহারার মেয়েটি
    আজ আর, আয়নার সামনে দাঁড়ায় না,
    দাঁড়াতে ভয় পায়, লজ্জিত বোধ করে।
    যে মেয়েটি, দিনের প্রায় সমস্ত সময়
    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কল্পনায় ভাসত;
    আজ, আর সে কল্পনা তাকে টানে না ।

    নারীর রূপের কাছে, জয় হলো সামাজিক ব্যাধির,
    যা, সামাজিক লজ্জা।
    আজ আর, সে ভালোবাসার প্রস্তাব পায় না,
    আজ আর, তাকে নিয়ে কেউ স্বপ্ন দেখে না,
    সেতো অভাগী কঙ্কালসার সামাজিক প্রাণী,
    আজ আর সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে না ।
    সে চলমান নারী বটে, রমনী তো নয় ।

    তবে, এখানেই কি লজ্জাজনক ব্যাধির অবসান ?
    – হয়তো, আপনার কল্পনায়, চরিত্রে নয়,
    সাজানো আইনের চোখে, সমাজের চোখে তো নয়।
    ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যান? – গঙ্গাজল,
    বিয়েতে ভর্ৎসনা? -গঙ্গাজল ,
    যৌন মিলনে বাধা? -গঙ্গাজল ,
    পণ নিয়ে সংঘাত? -গঙ্গাজল ।

    নারীর রূপকে ধ্বংস করতে পারে এ ব্যাধি,
    কিন্তু, মনের শক্তি?
    না, তাকে ধ্বংস করা কখনোই সম্ভব নয়;
    মনের শক্তির জাগরণে নারী শক্তির জাগরণ।
    এই জাগ্রত শক্তির আরাধনায়—
    ধ্যানযজ্ঞে মগ্ন বিশ্বময় পূজারী ।

    মাটির প্রতিমার সজ্জিত রূপে,
    মাতৃরূপে করো পুজো, উৎসবেতে মাতো,
    জয়মা বলে মায়ের পা, দাও ধুয়ে দাও
    গঙ্গামায়ের গঙ্গাজলে ।

    একই রূপের একই সত্তা পৃথক চোখে দেখো,
    জীবন্ত মা কাঁদছে হেসে, আড়ালে মুখ ঢেকে
    প্রতিমা মা, নীরব চোখে মিষ্টি মুখে,
    উৎসব, নাচানাচি করছে গমন, সিঁদুর মেখে।
    চরণামৃত করছে পান ভক্তকুলে মাথা পেতে ।

    গঙ্গা জলে নারী পুজো,
    ব্যাধির সমাজে, লজ্জিত পূজারী।

You cannot copy content of this page