• কবিতা

    কবিতা- রোদনে দিন যাবে…

    রোদনে দিন যাবে…

    -অমল দাস

     

    দক্ষিণা বাতাস ঘিরে- প্রেমাকাশ ফুরফুরে;

    ছুঁতে চায় যদি কোন ঢেউ,   

    ভিজিয়ো না গা তাতে- নাই পারো সাঁতরাতে;

    ডুবো তরী তুলবে না কেউ!  

     

    পিরিতে আগুন লেগে- শরীরী ঘ্রাণ জেগে;

    যদি সঙ্গী হয় অঙ্গ হারা,   

    সময় যা যাবে চলে, চীৎকার সুরে তুলে-

    বলে ‘হরি পার করো’ দ্বারা।

     

    রোদনে দিন যাবে- এ দেহ শীর্ণ হবে;

    দীর্ণ হবে তব মন প্রাণ!

    সইতে যদি না পারো- ভাঙা প্রেম আরও ধরো;

    মিলবে শ্মশানে পরিত্রাণ।

     

    এ নরম দেহ অন্তরে- চলছে সব যন্তরে;

    জং ধরে হবে সে অচল,

    পিরিতে দিয়ে ঘাস- উৎসুকে দিয়ে বাঁশ;

    জীবনকে করো-রে সচল।

     

  • কবিতা

    কবিতা- শুধু তোমার জন্য

    শুধু তোমার জন্য

    -অমল দাস

     

    হেমন্ত আলাপের সান্ধ্য লগনে আঁধার মনে দীপ জ্বেলেছ তুমি,

    জ্যোৎস্না সাঁঝের উজান স্রোতে নৌ-বিলাসে উৎসাহিত আমি।  

    কি উপহার দেবো তোমায়!তাই গেয়েছিলাম বীণার সুরে গান,

    ছন্দ লয় প্রত্যয় ঝংকারে, একাত্মে বাঁধা হলো যুগল দুটি প্রাণ।  

     

    তোমার গহীন আঁখি বিশ্ব আমার, আনন শ্বেত শান্তির দূত,

    তোমার স্বর্গে সঁপে দিলাম আমার উপন্যাসের ভবিষ্য ও ভূত।

    ভেসে, নিলাম ভাসিয়ে তোমায় সব সমুদ্র তেপান্তরের পাড়ে,

    দুরত্বের এই বৃহৎ গোলক আবর্তনে থামলো তোমার দ্বারে।  

     

    রাজপথের ওই নিয়ন ধারায় আস্কারা ডাক ভিজতে পাশাপাশি,  

    অকপট মন মুক্ত হাওয়ায় ছড়িয়ে দিলো ভালোবাসা রাশিরাশি।

    আমরা একান্তে আর সঙ্গোপনে পড়েছিলাম সুপ্ত-মনের ভাষা,   

    অবয়বের অমোঘ ঘ্রাণে রক্তস্রোতে তীব্র জোয়ার যাওয়া আসা।

     

    নিঃস্ব! শীতল হৃদের বাতায়নে তোমার উষ্ণ হাওয়া এসেছিলো,

    আমার নয়ন তোমার নয়ন গভীর প্রেমের কাব্য লিখেছিলো।  

    ডুবে ছিলাম কেশ সমুদ্রে হারিয়ে ছিলাম অজানা আলোকবর্ষে,  

    এক অলীক তৃষ্ণার তৃপ্তি পেলাম তোমার গোলাপ ঠোঁটের স্পর্শে।

     

  • রম্য রচনা

    রম্য রচনা- শুকনো কেস

    শুকনো কেস

    -অমল দাস

     

    পাড়ার প্রীতি বৌদিকে বেশ ভালোই লাগে আমার। যত দিন যায় ততই যেন চাঙ্গা হয়ে উঠছে। যেমন গৌরবর্ণ ত্বক তেমনই আকর্ষণীয় দেহ। মুখশ্রী দেখলেই প্রাণে দোলা লেগে যায়। আলাপ আছে, মাঝে মাঝে বৌদির সাথে কথা হয় বইকি! কিন্তু মন যেন অমোঘ কিছু চায় তার কাছে। বৌদির একটা ছেলে আছে তুহিন, ষোলো বছরের, বেশ ডানপিটে। আর বৌদির ছোট বোনটাও এ বাড়িতেই থাকে। রাই, বয়স বছর কুড়ি হবে! বৌদির বাবা আগেই গত হয়েছেন! মা সদ্য মারা যাওয়ায় সত্যদা (বৌদির স্বামী) ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। মাসি ও বোনপো জুটি বেশ একাত্ম হয়ে উঠেছে। এদের দুইয়ের আচার-ব্যবহারে পাড়ায় বিস্তর অভিযোগ আছে। যদিও আমার খারাপ কিছু মনে হয় না। ওরা বর্তমান সমাজের, দু’জনেই বেশ খোলা মনের, প্রায় একসাথেই থাকে হাসি ঠাট্টায়ও বেশ মশগুল। নিন্দুকের হয়তো এতেই আপত্তি।

    প্রত্যেক রবিবারের মত এ রবিবারও ছুটির দিন বৌদিদের বাড়ির সামনের গলি পথে  নদীতে স্নান করতে যাই। প্রখর গরমে মুক্ত জলে স্নানের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য একটিই একবার হাঁটা পথে বৌদির দর্শন। রাস্তার পাশেই তার রান্না ঘরের জানলাটা। হালকা বাদামী রঙের লম্বা চুলের একটা বড় ঝুলন্ত খোঁপায় হলদে শাড়ির আঁচলটা পিঠ থেকে ঘুড়িয়ে এনে নাভির কাছে গুঁজে দিয়ে ডালের কড়াইয়ের হাতা নাড়া অবস্থায় একনজর দেখে বেশ দারুণ লাগে। মনে হলো যেন ফুটন্ত ডালে ডুব দিয়ে সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে নিই এক নিমিষে। কিন্তু বাস্তবটা তো অন্য! ভাবি সে কেন এখানে পড়ে আছে! সে আমার কেন নয়। বয়সের পার্থক্য আছে তবুও…ফালতু উচাটন..  

    একটু আড় চোখে দেখতে দেখতেই বৌদির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়, সে একটা মুচকি হাসি দিতেই আমার সারা শরীরে যেন উৎসুক আর উদ্দীপনার চোরা স্রোত বইতে লাগলো। জানলায় এঁটে যেতে ইচ্ছা ছিল! কিন্তু আঁটলাম না, সামনে হাঁটলাম।

    পূবালী হাওয়ায় বেয়ে মৃদু স্বরে বৌদির একটা ডাক ভেসে এলো- ‘রূপম…’

    আমি শুনলাম! ভাবলাম আমার ভ্রান্তি, না শোনার ভান করলাম। বৌদি ভাবলো শুনিনি! সে আবার ডাকলো – রূপম একবার শুনবে..!

    এবার যেন কানকে বিশ্বাস হলো যে, ঠিকই শুনেছি তাহলে। আপ্লুত আমি জানলার কাছে ফিরে গেলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাস করি তার আগেই সে বললো- এখানে নয় গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে এসো।

    হঠাৎ কেমন যেন একটা শিহরণ জেগে গেল সমস্ত শরীরে। ভয় আনন্দ মিশ্রিত এক অভিনব আলোড়ন হতে লাগলো মনের মধ্যে। সামনের গেটটা খুলে ভিতরের দিকে যেতেই দেখি বৌদি একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আগ্রহ নিয়ে কিছুটা কেঁপে ওঠা গলায় প্রশ্ন করলাম- কিছু বলবে বৌদি?

    বৌদি তৎক্ষণাৎ ডানহাতের তর্জনীটি ঠোঁটে চেপে ধরে একটা আওয়াজ দিলো হিশ্‌শশ… …

    আমারও ঠোঁটে যেন আড়ষ্টতা এসে গেল। তার চুপ করানোর ইশারা যেন তীরের মত গেঁথে গিয়েছিল অন্তরে। বৌদি খুব নিচু সুরে বললো- এখানে এসো কথা আছে।

    একেই বৌদির রূপে আমি উচ্ছন্নে যাই তার উপর চাপা স্বরে সামনে থেকে হাতছানি আমার রক্ত আরও তেজে ছুটতে লাগলো শিরায়। রোমকূপ যেন ফুলে উঠতে লাগলো, রোমগুলোও সব ফণা তুলে খাড়া। আর কি কি সাপের মত ফণা তুলতে হতে পারে জানিনা! তবে নিমেষে গায়ের তোয়ালেটা নামিয়ে কোমরে হাফ্‌ প্যান্টের উপর জড়িয়ে নিলাম। কেন? সে নাই বললাম।

    কাছে, বৌদির একদম কাছে যেখানের নিঃশ্বাসের আওয়াজ নেওয়া যায় সেখানে গিয়ে বললাম- কি ব্যাপার আজ দুপুরে ডাকলে যে?

    বৌদি আবারও চাপা সুরে- একমাত্র তুমিই পারবে আমার উৎসুক মেটাতে! তাই..

    আমার আনন্দ আর আমার আয়ত্বে নেই, কথাটা লুটে নিয়েই জানতে চাইলাম – তা সব কি এই খোলা বারান্দায় এখানেই হবে, না ঘরে?

    -আস্তে কথা বলো! সাবধানী স্বরে বললো।

    – কেউ আছে ঘরে? জানতে চাইলাম অন্তরের বাঁধনহারা পুলকে।

    -থাকলে কি আর এই দুপুরে তোমায় ডাকতাম আমার দেওর সোনা।

    এই বলে সে আমার ডান দিকের গালটা হালকা টিপে দিলো। আর যাই কোথায়। আমি আর আমাতে নেই। কামনার দহনে সম্পূর্ণরূপে পুড়ে ছাই হতে লাগলাম। মনে হলো এখুনি বৌদির নীল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি ডুবে যাই তলে, গভীর তলে। থামিয়ে দিই সুদীর্ঘ জ্বলনের জ্বালা। বললাম- আর দেরি সইছে না যে বৌদি! তাড়াতাড়ি কর!

    বৌদি যেন তার ঐশ্বরিক ক্ষমতায় আমাকে সম্পূর্ণ পড়তে পেরেছিল। সে হেঁয়ালিতে বললো- নদীতে জালা ডুবিয়ে পূর্ণ করবে, না জল এনে জালা ভরবে।

    বৌদির প্রায় ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে বললাম- জালা যে ভাবে ভরতে চায় সে ভাবেই  ভরে দেবো, বাধ্য ছেলে… দ্বিতীয় আর নেই আমার মত।

    বৌদি আমার উন্মুক্ত বুকে আলতো ভাবে তার দুই হাতের তালু দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বললো- লক্ষ্মী সোনা যাও তবে ওই দিকে..  

    আমি আমোদী সুরে হেলেদুলে বললাম- আবার ওইদিকে কেন বৌদি? ঘরে নয়!  

    -না না!লক্ষ্মীটি ঘরে একদম নয়। ওই গোয়াল ঘরের পাশের ঘরে। (গোয়াল ঘরটা মূল বাড়ির দক্ষিণে দু’পা হেঁটে।) 

    -ধু….স্‌ বৌদি! ওখানে তো নোংরা খড় কাঠে ভর্তি ঘরটা।

    -তাতে কি হয়েছে গো…!

    -ওখানে কি ভাবে হবে?

    -কেন তুমি কি শুতে যাচ্ছো ওখানে? যা হবে দাঁড়িয়েই হবে! এতো চিন্তা করোনা।

    -না! মানে ওই গাছপালার মধ্যে তুমি আর আমি দাঁড়িয়ে….! কেউ দেখে ফেললে!

    -কেউ দেখবে না! আর দেখলেই বা কি? আমি নই তুমি! তুমি একা!

    আমি তো অবাক! তুফান বিনা নারকেল গাছের মত গোড়া থেকে ভেঙে পড়লাম। প্রায় আশাহত মৃত কণ্ঠে গভীর আর্তনাদে নির্বোধের মত জানতে চাইলাম -আমি! একা? মানে.. কি করবো..?

    বৌদি যথেষ্ট আব্দারে রসে ডুবুডুবু সুরে বললো- ভুল বুঝো না! একটিবার যাওনা গো.. কেউ একটা ওখানে ঢুকেছে। পিছন দিকটা দিয়ে ঘুরে একবার লুকিয়ে দেখে আসো না কে!

    আমার যৌবনী নৌকা চোখের সামনে ডুবে গেছিলো একটু আগেই, এবার আমি মর্মাহত। সমস্ত আশায় জলাঞ্জলি হয়ে গেলো। অগত্যা বৌদিকে আর নিরাশ করলাম না, আমি যতই নিরাশ হই। বললাম একা নয় তুমিও সাথে চলো।

    -আবার আমিও! কি একটা ভাবল তারপর বললো- আচ্ছা চলো, তবে সাবধানে চুপিচুপি কোন রকম আওয়াজ না হয়!

    পিছন দিক দিয়ে ঘুরে যখন গোয়ালঘরের পাশের ঘরের জানলার কাছে পৌঁছলাম তখন দু’টো অস্ফুট স্বর শুনতে পেয়ে আমরা আরও সাবধানী হয়ে গেলাম। কে বা কারা জানি না। আমাদের দেখে না নেয়, তাই দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে কান পাতার চেষ্টা করলাম।

    একটি ছেলের কণ্ঠ- এ রাই নাড়তে বললি যে। সেই থেকে নেড়েই যাচ্ছি! পড়ছে কই?

    একটি মেয়ের কণ্ঠ- আহ্‌ ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? নাড়তে থাক ধীরে ধীরে। আগে ফুলে উঠবে, তারপর দেখবি বাড়বে! তারপর.. পড়বে!

    আমার বুঝতে আর বাকি রইল এরা সেই গুণধর মাসি বোনপো, যাদের নিয়ে পাড়ায় চর্চা চলে। কিন্তু একি শুনছি আমি.. তাহলে নিন্দুকেরা কি ঠিক! বৌদি কিছু শুনলো কিনা জানি না। আমার কান আরও দৃঢ় হয়ে খাড়া হয়ে গেলো কৌতূহলে।

    তুহিন- নেড়েছি তো..! ফুলেও উঠেছে, কিন্তু পড়ছে কই?

    রাই- তোর সবটায় তাড়া! নাড়তে নাড়তে মজা নে… ঠিক পড়বে।  

    তুহিন- আমি আর পারছিনা, নে তুই একটু নেড়ে দে..।

    রাই- তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না! ভোগের ইচ্ছে খুব, অথচ ধৈর্য্য নেই।

    তুহিন- ধুর! ওর থেকে বোঁটায় টান দিয়ে দুধ বার করা অনেক সহজ! এতে তো গরম, ঘাম আর খাটনি।

    একটু চুপ থাকার পর আবার মাসি- নে এবার পড়ার সময় হয়ে এসেছে বুঝি, তুই ধর! আমি একটা বাটি নিয়ে আসি চুপিচুপি, তুলে রাখতে হবে তো!

    মানে! এ কি শুনছি? বাটিতে ধরবে সেটা…ছিঃ ছিঃ! আমি আর সইতে পারলাম না, আড়াল ভেঙে বেরিয়ে ওদের কিছু একটা বলতে যাবো অমনি দেখি বৌদি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেমন সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে ঝড়ের গাছের মত ডালপালা সমেত হুড়মুড়িয়ে পড়ল আমার উপর। বুঝলাম বৌদি সবই শুনেছে, অনাচার সহ্য হয়নি, তাই এই অবস্থা। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বৌদিকে তো ভালো লাগে, আশাও করি কিন্তু এভাবে আমার গায়ে লুটিয়ে পড়বে বা এইভাবে আমি তাকে জড়িয়ে ধরবো তা কল্পনা করিনি। পাতা আর গাছের ডাল পালায় ঝরঝর করে আওয়াজ হওয়াতে ওরা’ও জানলা দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে পড়ল। তুহিন অবাক চমকিত চোখে তাকিয়ে বললো- তোমরা এখানে কি করছো? আর মায়ের কি হয়েছে?

    রাইও আকস্মিক উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত সুরে- দিদির কি হলো গো.. এই দিদি..

    সে জানলা টপকে এদিকে বেরতেই যাবে আমি থামালাম- থামো আসতে হবে না, উগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলাম- এখানে দুজনা! এসব কি নোংরামি হচ্ছে?

    তুহিন থতমত খেয়ে সভয়ে বলল- কি! কি হচ্ছে?

    -‘কি করছিলে’ উচ্চ কণ্ঠ ঝাড়লাম!

    রাই প্রশ্নের ভীতি কোনমতে সামলে – কেন দুধ গরম করছিলাম তো!

    আমি এবার অবাক -মানে?

    – ‘ও’ দুধের সর খেতে খুব ভালোবাসে তাই!

    -তা.. ঘর ছেড়ে এখানে কেন?

    – জামাইবাবুকে ডাক্তার দুধের সর খেতে বারণ করেছে কোলেষ্ট্রল বেড়ে যাওয়ার ভয়ে। একই ভয়ে দিদি ওকেও দেয়না, অথচ ওর খুব প্রিয়। তাই এখানে লুকিয়ে….

     

    শুরু থেকেই আমার সব ধারনাই আজ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমিও এবার প্রায় নিশ্চল পাথর, কি হয়েছে আর কি ভাবছি। বৌদিও বোধকরি শুনে একটু আশ্বস্ত হলো, ভুল ভাঙল হয়তো! সে ওঠার চেষ্টা করলো, আমিও হাত ধরে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তুহিনকে বললাম- এদিকে আয় একটু ধর।

    আহাম্মক বলে কিনা  ‘তুমি মাকে একটু নিয়ে যাও ঘরে, আমি দুধের সরটা খেয়ে আসছি’।

    কেমন বেআক্কেল বুঝুন! মা আমার উপর এলিয়ে পড়ে আছে, আর ছেলে দুধের সরে ডুবে। যাই হোক আমি কোনমতে ধরে ধীরে ধীরে বৌদিকে ঘরে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলাম। কোথায় ডুবে যেতে চেয়েছিলাম আর কোথায় ফেঁসে আছি। মাসি বোনপো গোয়ালঘরের আড়াল থেকে একে অপরের ঠোঁট মুছতে মুছতে বেরোচ্ছে। আর আমি হাফ্‌ প্যান্টটা একটু কোমরের উপর তুলে খালি গায়ে তোয়ালেটা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এমন সময় সত্যদা বাইক নিয়ে ঢুকে হাঁ করে দেখছে। ওদিকে ওদের, এদিকে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে কি বুঝল জানি না! কিন্তু গভীরতা বুঝে একবার চিৎকার করে উঠলো- ‘রূপম! আমার সর্বনাশটা হয়ে গেলো। ওরে কে কোথায় আছিস ধর’ বলতে বলতে গলাটা প্রায় শুকিয়ে গেলো। কেউ শুনল কিনা জানিনা। সে উঠোনের মাটিতে মাথায় হাত রেখে ‘থ’ মেরে বসে গেলো।

    আমি বুঝলাম অবস্থা বেগতিক, এ সময় আমার কথা কেউ শুনবে না। লোক জমায়েত হলে ‘লিনচিং’ ঘটতে পারে। এই শুকনো কেস থেকে বাঁচতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যতেই মাসি বোনপোকে বললাম এবার সামলাও আমি পালালাম।    

     

  • কবিতা

    কবিতা- অধিকার

    অধিকার

    -অমল দাস

     

    তুমি যেটা করছো, সবই

    তোমার কাছে ভালো,

    আমার উঠোন এমনই বাঁকা

    গায়ের রঙও কালো।

    ভাবনা আমার রঙ লাগেনা

    সব নিছক সাদামাটা

    তোমার চিন্তা উদার স্বাধীন

    বিশ্ব বাজার ঘাঁটা।

     

    আমার কলম মূল্যহীন

    অলীক সলীক গল্প,

    তোমার কথায় লাগে ব্যথা

    সেটাও কথা শিল্প।

    তোমার যেটা সুখ-দায়ক

    সেটাই গণতন্ত্র,   

    আমার সুখ তোমার অসুখ

    তোমার শোষণ যন্ত্র।

     

    আমার দাবী অস্ফুট থাক

    সেটাই তোমার ইচ্ছা,

    তুমি উগ্র চোখেই ঢাকছো  

    তোমার যত কেচ্ছা।  

    আমার জানতে চাওয়া সত্ত্বহীন

    ভাঙছে সব স্বাধীকার,

    তুমি যে রোজ প্রশ্ন করো

    সেটাই শুধু অধিকার।

     

    তোমার ভাবনা যেন কল্পতরু

    রুক্ষ মাঠেও ঘাস,

    আমি কর্মহীন আহার বিনা

    অর্ধ পেটেই বাস।

    তুমি আসবে তাই ধর্না দিলে

    আসন দিলাম ঘরে,

    তোমার মেজাজ আগুন ঝাড়ে

    আমি ভীষণ জ্বরে।

     

  • কবিতা

    কবিতা- হাজারো স্বপ্নের শব

    হাজারো স্বপ্নের শব

    -অমল দাস

     

    কথার আড়ালে ব্যথার ভিড়  

    চোখের তলায় জল নোনা,

    অন্তরে যে কি সুখের ঝড়

    কেবল শব্দ যায় না শোনা।

     

     

    শত উপাখ্যানে লিখিত জীবন

    লক্ষ বিষাদ জলাশয়ে ঘেরা,

    জীবন জীবন্তের নেই তাগিদে

    কারো কারো মুখ চেয়ে চলাফেরা!  

     

     

    অভিমানী মনের আত্ম গোপন

    অলিগলি ভিড় আপন সমারোহে,

    বাইরে প্রস্ফুটিত নিষ্পাপ ফুল

    চিতাগ্নিতে অন্তঃ-শ্মশান দহে।

     

     

    অদৃশ্য আঘাতে ক্যানভাস দেহ

    নির্বাক নীরব দেয়াল সাক্ষী,  

    যেন প্রতি প্রহরেই মুক্তি মাগে

    দগ্ধ খাণ্ডব আবদ্ধ এক পক্ষী।  

     

     

    সময়ের সাথে রোজ পরাজয়

    দেহ পাশে ব্যস্ততার মায়াজাল

    হাজারো স্বপ্নের শব পরে থাকে

    যেন,পুরাণের অভিশপ্ত কোন কাল।   

      

  • গল্প

    গল্প- ‘পান্তা ভাত’

    পান্তা ভাত

    -অমল দাস

    -পান্তা পান্তা পান্তা… আরে পান্তই তো খেতে বলেছে! তো কি হয়েছে? মুখের মধ্যে দিয়ে ঠুসে তো দেয়নি? বিষও দেয়নি! তাই বলে এতো কাণ্ড? রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবি?  

    -মা তুমি আমাকেই বকছো? তুমি আমার মা তো, না ওর? এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে…

    -হ্যাঁ এসেছিস কেন? বিষ দিলে না হয় থানা পুলিস করতাম। পান্তার জন্য কি নতুন আত্মীয়ের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করতে যাব!

    -আমি কি তাই বললাম তোমাকে, ঝগড়া করতে যাও? একটু উগ্র কণ্ঠেই বলে।

    -তাহলে এলিই কেন? জামাই বা দিয়ে গেলো কেন? যে জামাই হাসি ছাড়া কথা বলে না! সে আজ একটুও কথা না বলেই চলে গেল! নতুন সংসার কিভাবে মানিয়ে চলতে হয় সেটাও বলে দিতে হবে! বয়স তো কম হয়নি!

    -এ ব্যপারে তোমাকে আমার কিছুই বলা উচিৎ হয়নি! বিয়ের পর ছ’মাসেই যে আমি পর হয়ে গেছি বুঝিনি। আগামীতে আর আসবো কি না ভাববো।

    -সে যা ভালো বুঝিস করবি।কিন্তু রাগ মিটিয়ে ও বাড়ি গিয়ে উঠ, তারপরই না হয় ভাবিস। এবার একটু থেমে নিজেই আস্তে আস্তে বিড়বিড় করতে লাগলো, আমাদেরই ভুল ছেলে মেয়েদের ভালোমন্দ খাইয়ে আদর যত্নে বাড়িয়ে তুলেছি তো, যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি, যা খেতে চায়নি তা দিইনি! যদি ছোট থেকেই পান্তাভাত ঠেসে ঠেসে খাওয়াতাম তাহলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না! রাতের জল দেওয়া ভাতে সকালে শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে বা পিয়াঁজ কুচিয়ে বা আলু ভাজা, কাঁচা লঙ্কা-নুন দিয়ে মাখিয়ে খেতে যে কি স্বাদ.. সে আর এজনমে বুঝবি না। বোঝাতেও পারলাম না!….       

    এখানে নবীন বিবাহিতা মেয়ে পামেলা ও তার মা জয়শ্রীর কথোপকথন তুলে ধরা হোল। পামেলার বিয়ে হয়েছে ছ’মাস পূর্ণ হয়ে সাতে পড়েছে। আজ সকালে পামেলার শাশুড়ি সুমেধা তার ননদের বাড়িতে পূজা অনুষ্ঠানের জন্য গেছে বিকালেই ফিরবে। যাওয়ার সময় পুত্র রিতেশ কে বলে গেছে -টিফিন কিছু করলাম না, জল দেয়া ভাত আছে খেয়ে ডিউটি যাস! আর বৌমা যদি খায় তো খাবে, না হয় কিছু একটা করে নিতে বলিস।

    রিতেশ বিকেলে ডিউটি থেকে ফিরে হাত পা ধুয়ে টিভি চালিয়ে নিউজ দেখছে। পামেলা রিতেশের জন্য হালকা টিফিন সাজিয়ে নিয়ে এলো, খেতে খেতেই জিজ্ঞাস করলো- দুপুরে কি রান্না করলে? পারলে… কিছু করতে?

    একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে অভিমানী সুরে পামেলা উত্তর- যাহ্‌… এভাবে বলছ কেন? আমি কি রান্না জানি না! মা করেন বলে আমি করিনি এতো দিন, তাই বলে মা না থাকলে কি করব না!

    -কি জানি মা থাকলে তো সকালে টিফিনটা হয়! আজ তো হোল না! পান্তা খেয়ে গেলাম। তা তুমি কিছু বানিয়ে খেলে না তুমিও পান্তা…

    শেষ হয়নি তার আগেই পামেলা বলে ওঠে- আমাকে পান্তা খেতে বোলনাতো, আমার ভালো লাগে না!

    -তাহলে কি খেলে?

    -কিছুই না!

    -সাড়া সকাল না খেয়ে রইলে, তবু পান্তা খেলে না? একদিন না হয় খেয়েই দেখতে! শুধু শুধু ভাতটা নষ্ট হোল।

    -দেখ ভাত নষ্টের দায় আমাকে দিও না, আমি খাইনা জানো! তবুও মা মাঝে মাঝেই আমাকে খেতে বলেন। সেটা আমার ভালো লাগেনা।

    -মা খেতে বলে মানে…? তোমাকে কি বলেছে নাকি খাও বা খেতেই হবে! এমন তো জোর করেনি!

    ব্যস এই এক কথায় দু কথায় একটু মনকষাকষি হতেই নতুন বউ হয়ে আসা পামেলা অভিমানী হয়ে বলে ওঠে- আমি আজ বাড়ি যাবো যদি পারো দিয়ে এসো একবার! না হয় আমি নিজেই…

    রিতেশ আর কোন রকম বাঁধা না দিয়েই নির্লিপ্ত সুরে শুধু বলল, তৈরি হও দিয়ে আসছি।

    রাতে সুমেধা ফিরে বৌমাকে ঘরে না দেখে রিতেশকে প্রশ্ন করে, তুই ঘরে, বৌমা কোথায়?

    রিতেশ মুখ লুকিয়েই উত্তর দেয়- বাড়ি গেছে।

    মা আঁচ করতে পেরেছিল রিতেশ মিথ্যে বলছে, তাই শুধালো হঠাৎ বাড়ি কেন? কি হয়েছে?

    -ওর মা ফোন করেছিলেন তাঁর শরীরটা ভালো নেই তাই দেখতে গেছে।

    -তুই নিয়ে গেলি না একাই… একটু থেমে আবার প্রশ্ন- কবে আসবে কিছু বলল?

    প্রথম প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রিতেশ একটু উদাস সুরে বলল- যাক! গেছে, দেখি কবে আসার ইচ্ছে হয়!   

    মায়ের মনে সন্দেহ হোল ভাবল আমি বাড়ি থেকে কি গেলাম! অমনি ঝগড়া মনকষাকষি। বা হঠাৎ কি কাণ্ড করলো দুজনা যে, একজন বাপের বাড়ি আর একজন ঘরে বসে চুপচাপ! প্রশ্ন অনেক তবুও আর বিশেষ কিছু বলল না.. চুপ করে পাশের ঘরে চলে গেল।

    পামেলা রাতে মায়ের সাথে ঝগড়া করে প্রায় না খেয়েই শুয়েছিল। তাই সকালে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙতেই খিদেয় পেট কামড়াতে থাকে। ওর বাবার মুদি দোকান আছে বাজারে কাছে, মা’ও বাবার সাথে গেছে কিছু সব্জি নিয়ে ফিরবে। যাওয়ার সময় বলে গেছে- ডিম রুটি আনা আছে, জ্যাম, জেলি, কলা-দুধ কর্ণফ্লেক্স, বাটার সবই আছে যা ইচ্ছা, করে খেয়ে নিতে, রাতে তো দানা-পানি কিছু পড়েনি! খিদে লাগবে নিশ্চয়ই?

    পামেলা বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢুকে এটা সেটা হাতাতে থাকে। ডিম রুটি কলা চোখের সামনেই ছিল কিন্তু সে কিছু অন্যই খুঁজছে হয়তো! একটা ছোট গামলার ঢাকনা খুলেই দেখে সেখানে অল্প জল দেয়া ভাত রয়েছে, যা আছে খেলে তার চলে যাবে।সে রুটি ডিম জ্যাম জেলি ভুলে পান্তার দিকে ধ্যান জ্ঞান দিয়ে একাগ্র চিত্তে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ এভাবেই দেখে মনে মনে কি হিসাব নিকেশ করল জানা নেই! হয়তো ভাবলো খেয়ে দেখি বিষ না সুস্বাদু, কিছু তো হবে! হয় মরব না হয় পেট ভরবো। রাগ তো আছেই মায়ের উপর শাশুড়ির উপর রিতেশের উপর যা হয় হবে। হয়তো এমনটাই ভেবে ছিল বা অন্য কিছু, সে আলু পিঁয়াজ কেটে গ্যাস জ্বেলে কড়াইয়ে ভেজে নিলো। তারপর পান্তা থালায় তুলে একবার জল দিয়ে ধুয়ে আবার একটু জল নিলো। তারপর নুন কাঁচালঙ্কা আর ভাজা দিয়ে মেখে নিলো। এবার মুখে দেওয়ার আগে সে কেমন একটা গন্ধ অনুভব করে মুঠো ভাত আবার থালায় রেখে দিলো। কিছুক্ষণ নিশ্চল থেকে আবার নাক চেপে মুখে দিতে লাগলো, তখন তার চোখে অবজ্ঞার জল ছলছল করছে। কিন্তু প্রথম গ্রাস গিলতেই কি অনুভব করলো সেই জানে। তারপর আর এক গ্রাস তারপর আবার তারপর… এভাবেই নিমেষে শেষ করে নিলো। এটা যে খুবই সুস্বাদু সেটা কিছুক্ষণ পরেই তার মুখ ও শরীরী হাব ভাবেই স্পষ্ট ছিল এবং এই গরমে বেশ আরামদায়ক সেটা সে বুঝেছিল।

    মা ফিরে এসে মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাস করল না, হয়তো রাতের রাগ এখনো রয়েছে। রান্না ঘরে ঢুকে দেখে ডিম রুটি আর বাকি সব তেমনই পড়ে আছে, ভাতের জায়গাটা খালি। মা বুঝল স্নেহ মিশ্রিত আনন্দে মুচকি হাসলো, তবু চুপ রইল, অপেক্ষায় রইল মেয়েই এসে বলুক তার পান্তার অভিজ্ঞতা।

    পামেলাকে আনার জন্য সুমেধা রিতেশকে সকালেই বলে রেখেছিল, এদিকে পামেলাও বিকেলে রিতেশকে ফোন করেছে নিতে আসার জন্য। সেই মত রিতেশ সন্ধ্যার পরেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তবে রাতে তার আর ফেরা হয়নি, শ্বশুর-শাশুড়ির আপ্যায়নে সেখানেই থেকে গিয়েছিল। এদিকে রিতেশের ডিউটি যেতে হবে তাই    সকালে ঘুম থেকে উঠে আর দেরি না করেই দুজনে বেরিইয়ে পড়েছিল। ফেরার পথে রিতেশের খোঁচা দেয়া প্রশ্ন, রাগ মিটেছে না কি বাপের বাড়ির ভাতও হজম হোল না? পামেলা শুনেও শুনলোনা, লজ্জিত তবে অভিমান মুছে রেখে খোলা বাতাসে মনের ডানা মেলে ধরেছে।

    বাড়ি ফিরে পামেলাকে নামিয়ে রিতেশ অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পামেলা শাড়ি বদলে রান্না ঘরে শাশুড়ি মায়ের সাহায্য করতে লেগে যায়। বেলা বাড়তেই সুমেধা বলে ওঠে বৌমা টিফিন আছে খেয়ে নাও! ঐ সকালে বেরিয়েছ নিশ্চয়ই কিছু খাওনি! রিতেশকে বললাম সেও খেলো না অফিস যেতে দেরি হবে বলে। হয়তো ওখানে কিছু খেয়ে নেবে! তুমিও কিছু খেয়ে নাও খালি পেটে থেকোনা।

    পামেলা তখন সব্জি কাটছিল মাথা নিচু করেই সলজ্জিত ভাবেই বলল- মা জল দেয়া ভাত আছে? তাহলে দিন আমি খাবো!

    সুমেধা মাথা তুলে পামেলার দিকে চেয়ে রইল এবং চোখে একটা হাসির ঝলক ফুটে উঠলো। যে মেয়ে পান্তার নাম শুনতে পারেনা সে আজ… যাই হোক ভাবনায় অনেক কিছু ছিল তবু সে ভাবল না, স্নেহের হাত রাখতে চেয়েছিল পামেলার মাথায় কিন্তু রাখল না। পামেলার অবনত নিষ্পাপ মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, মাতৃ স্নেহে চোখ ছলছল করে উঠলো। কোন সাড়া না পেয়ে পামেলা যখন শাশুড়ির দিকে তাকায় তখন সুমেধা সজল চোখ লুকাতে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। যদিও পামেলার তা অগোচরে রইল না, সে আবার মাথা নত করে নিশ্চুপ ভাবে সব্জি কাটতে লাগলো।

    সুমেধা হাসি মুখেই মৃদু স্বরে বলল, বৌমা তুমি পান্তা খাবে কেন? টিফিন করেছিতো সেটাই খাও!

    -না মা আজ পান্তা দিন আমি খাবো।

    -না বৌমা ওটা তোমার খেতে হবে না, খাওয়ার সময় অবজ্ঞা ধরে নিলে কিন্তু শরীর খারাপ হতে পারে! তুমি টিফিনটাই নাও, জল দেয়া ভাত বেশি নেই ও আমিই খেয়ে নেব।

    -দিন না মা! আজ দুজনা ভাগ করে খাই।

    এই কথা বলেই পামেলা শাশুড়ি সুমেধার দিকে তাকাল সুমেধাও পামেলার দিকে, একজনার গভীর আব্দার অনুযোগের চোখ তো অন্য জনার সন্তান বাৎসল্যের আত্মিক আন্তরিকতার চোখ, সে এক গভীর আবেঘ ঘন মুহূর্ত, যেন সংসারের সমস্ত মায়া সুখ শান্তি এই একটি পলকে উজ্জীবিত হয়ে যায় এবং এই স্বল্প নয়নালাপেই সুদীর্ঘ সুদৃঢ় এক আত্মীয়তার বন্ধনের ভাষা ব্যক্ত করে দেয়।

    এই অল্প সময়েই দুজনার চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। তখন নিজেদের সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চোখের কোন মুছতে কাপড়ের আঁচল তুলে ধরে। সাময়িক চুপ থেকে সুমেধা বলল- একটু বস বৌমা কটা ডাল ভিজিয়ে রেখেছিলাম, পাটায় বেটে বড়া ভেজে নি, তাই দিয়েই দুজনা আজ খুব করে পান্তা খাবো।

    তখন পামেলার মুখমণ্ডলে দখিণা বাতাসের সমারোহ, আনন্দ উৎফুল্ল উছ্বলে পড়ছে, যা নিমেষেই চোখে ধরার মত, এই উৎসুক আবেগে সে বলেই ফেলল- মা! আজ কিন্তু আমি আপনার হাতেই খাবো।

    সুমেধা শুনে একটু আচম্বিত হোল কিছুক্ষণ পামেলার পানে চেয়ে থাকে। তারপর উঠে এসে পামেলা কে জড়িয়ে ধরে। তার চোখের জল তখন ছলছল নয়, রীতিমত গড়িয়ে পড়ছে। পামেলার পিঠে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই ঠোঁটে শব্দ বেরিয়ে এলো- মা তুমি আমার কত জন্মের পুণ্যের ফল বলতো! আজ তোমাকে পেয়ে আমার মেয়ের অভাব আর রইল না মা, তোমাকে এভাবেই বুকে ধরে রাখব সারা জীবন। এভাবেই…! এভাবেই কেটে গেল কিছু সময়।

  • কবিতা

    কবিতা- আমরা হিংস্র

    আমরা হিংস্র

    -অমল দাস

     

    আমরাই হিংস্র…

    হিংস্রের খাতা খুলেছি আদি থেকেই

    আমরা বাঁচার তাগিদে কাঁচা মাংস খেয়েছি

    রক্তে তৃষ্ণার জল পেয়েছি!

    আমরা দল গড়েছি!

    গোষ্ঠী গড়েছি, সমাজ গড়েছি…

    আমরা অন্য সমাজ গিলেও নিয়েছি!

    আদি থেকেই আমরা রক্তের স্বাদ পেয়েছি,

    আমরা ছড়িয়ে পড়েছি এ ভুবনের নানান প্রান্তে।

    রক্তে চাবুক ভিজিয়ে, গিলোটিনে মুণ্ডু কেটে উল্লাসে মেতেছি

    সমস্ত রস চুষে নিয়ে মৃত্যুর লাশ ফেলেছি…

    আমরা গায়ের জোরে দেশ গড়েছি সীমা টেনেছি

    শিরায় শিরায় ভাগ করেছি!

    আমরা শাসন নামে রক্তশোষণ পুঁতে দিয়েছি

    পীড়িতকে পীড়া দিয়েই সুখ পেয়েছি!

    আমরা আদি থেকেই লোলুপ ঠোঁটে লোহিত কণার স্বাদ লভেছি

    আমরা আদি থেকেই একই পথে

    আপন হাতে আপনকেই কবর খুঁড়ে ঢেকে দিয়েছি

    আমরা হিংস্র…।

    আমরাই বেশি রক্ত-মাংসের স্বাদ পেয়েছি।

  • কবিতা

    কবিতা- ছদ্মবেশী ভক্তি

    ছদ্মবেশী ভক্তি

    -অমল দাস

     

     

    আঘাত লেগেছে অন্তরে কাঁদছি সবাই আমরা,  

    এইতো কদিন!নতুন চাপে বদলাবে রঙ চামড়া।

    ভুলের ঘোরে কজন ঋষি কোন মহত্বের গুনে!

    পুষ্পমাল্যে বছর ফেরে শুধু জন্ম-মৃত্যু দিনে।

     

    খুব তামাসা দেখছি সবে রঙ বাহারি রূপে,

    বগল ঘামের গন্ধে সমাজ বৈশাখী এই ধুপে।

    ভাঙছো ভাঙো কিসের তরে ছদ্মবেশী ভক্তি?  

    ভেকের কান্নায় ঝাণ্ডা ওড়ায় ইঞ্চি প্রতি শক্তি!

     

    যে মনীষী স্বত্বা জাগায় শোধন করে আত্মা,

    কৃষ্টিতে তাঁর অচ্যুত মার্গ নাইবা দিলে পাত্তা।  

    কু-সংস্কারের অন্ধকূপে যাঁরা লড়ছে আমরণ,  

    অবক্ষয়ের ভারত ভূমে তাঁরা সত্যের জাগরণ।

     

    প্রত্যারোপের মাস্তুলে নাচে সেনা-দল কৃত ভুল,

    অতীত ভেঙে ভাঙছে আজো উড়বে আরও ধূল!  

    চক্ষু জলে আবেগ চুরির আর কি আছে দরকার?

    তুমি জঞ্জালগুলি দমন করো নরম করো হুঙ্কার।

  • কবিতা

    কবিতা- তুমিই একা বিশ্ব

    তুমিই একা বিশ্ব

    -অমল দাস

     

    তোমায় আজ ডাকিনি- ডাকোনি তুমি মোরে,   

    ফুল চন্দনে সজ্জিত তুমি সকলের ঘরে ঘরে।

    সমস্ত দিন কাটিল ভাবে একটি কাব্য আসিল না,

    ওহে রবি মম কাব্য পাতা কেন তোমাতে ভরিল না।

    কবি গুরু ওহে রবি আমার কাব্য মাঠ একা,

    একটু পরশ একটু আশীষ একবার দিও দেখা।

    তুমি আমার গানের পাড়ে তুমি হিয়ার মাঝে,

    তোমার সুরে আমার সকাল দোদুল দুপুর সাঁঝে।  

    তুমি আমার লেখনী সুধা আমার কাব্য কলরব,

    কোন মোহে তুমি ডাকিছো কাছে উন্মাদ হয় সব।

    কত স্তুতি কত শব্দ  তোমার কত ছন্দের খেলা,

    তোমার কাব্য গল্প গান সাহিত্যের অসীম বেলা।  

    সৃষ্টিতে তুমি অদ্বিতীয় সঞ্চয়ে শৈলীর সম্ভার,

    প্রেমের সূত্রে বাঁধিছো মনন তোমার শক্তি অপার।

    তোমার সঙ্গোপন পাই আমার নিভৃতে নিঃসঙ্গে,  

    তোমার সপ্ত সুরে উজান আসে আমার মরা গঙ্গে।  

    বহু মানুষের কোলাহল মাঝে বহু সম্ভাষণে তুমি,

    আজ তোমার স্নেহের পরশে হয়েছে ধন্য বঙ্গভূমি।

    মৈত্রী বাঁধনে বেঁধেছো জাতি শান্তির বাণী বয়ে,

    বিশ্ব গুরু! তুমি ঈশ্বর তুমিই প্রভু সকল কবি হৃদয়ে।

    তোমার তরে আমার আবেগ মম আত্ম সমর্পণ,

    আমি এসেছি সেই তোমার কাছে করেছি আপন।

    বিশ্ব মাঝে একা তুমি তুমিই একা বিশ্ব,

    তুলির টানে তোমার- সে এক অপরূপ দৃশ্য।

    ‘নৌকাডুবি’ বুকের উপর আমি তোমাতে নির্বাক,

    প্রণাম লহ মোর তব জন্মদিনে পঁচিশে বৈশাখ।         

     

  • কবিতা

    কবিতা- খনিজ তৃষ্ণা

    খনিজ তৃষ্ণা

    -অমল দাস

     

    একলা পথের নেই ভুবনে সবুজের নেই কোন চিহ্ন,

    সব ঠিকানা এক যেখানে সেখানে চিন্তারা খুব দীর্ণ।

    যখন নিরুত্তরের নীল দরিয়ায় শৈবাল রূপে ভাসি,

    তখন অর্থাভাবে সাজানো শব্দগুলো পান্তার মত বাসি।

    লঙ্কা পেঁয়াজে সেই সকালে স্বাদ নেওয়ার এক চেষ্টা,

    জিভে লেগেই শব্দগুলো মেটালো গভীর কাব্য তেষ্টা।

    ফেলা দেওয়া রাতের টুকরো কাগজ প্রভাতের নক্ষত্র,

    জুড়ছি বসে সপ্তঋষি দিলাম জলে প্রেমের লেখা পত্র।

    পাখির কূজন বিষাদ লাগে মিশে রক্ত শিশুর কান্না,

    সরল পথের ছন্দ থামে যেখানে জাত-কুজাতের ধর্না। 

    রোজ এক প্রকৃতির আঁকছি ছবি শতেক রূপ লাবণ্য,

    ধ্বংসস্তূপের ধুলোর ধোঁয়ায় মন খুঁজছে কিছু অন্য।

    পাহাড় নেমে বাতাস বয়ে নদীপথে সমুদ্র শেষ প্রান্ত,

    দেখছি জীবাশ্মের কি ইতিহাস বিলুপ্তরা কয়টি জীবন্ত।

    বরফ শীতল উপত্যকায় গভীর ভাষা তত্ত্বের সন্ধান,

    তীব্র তীব্র নিন্দা লিখে কলমের পাতার’পর প্রাণ দান। 

    অনেক ভাবি সাম্য ধম্ম অষ্টরম্ভা লোলের কুরুক্ষেত্র,

    সব রঙ চরিত্র ধৃত-গান্ধারী,আজও বন্ধ জ্ঞান নেত্র।

    প্রান্ত ধরে এক-একটি বর্ণে গড়ি ভীষ্মের শর-শয্যা,

    অন্তমিলের খনিজ তৃষ্ণা জলে শ্রান্তিতে অস্থি- মজ্জা।

     

     

     

     

You cannot copy content of this page