-
ভৌতিক গল্প- ভাড়াবাড়ির অশরীরী
ভাড়াবাড়ির অশরীরী
-ইন্দ্রনীল মজুমদার
রাতে কি একটা শব্দে বেশ যেন সৌমিতের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। বেশ জাঁকিয়ে ঘুমটা এসেছিল বটে, কিন্তু এই আওয়াজটাই ঘুমের রেশটা কাটিয়ে দিল। ঘুমন্ত চোখে লাইটের স্যুইচটা জ্বেলে টলতে টলতে কোনোরকমে বাথরুমে গেল সে। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ঘুমের ভাবটা কাটাতে হবে। তারপর খুঁজতে হবে আওয়াজের উৎস। তাই হল। ভালোভাবে সব কিছু লক্ষ্য করতে আরম্ভ করল সৌমিত। খুব ভালোভাবেই মনে আছে কে যেন বেশ জোরে জানালাটা ধাক্কাচ্ছিল। হ্যাঁ, পাঁচিলের দিকের কাঠের জানালাটা বন্ধই থাকে। কেননা মশার ভয়। ওই জানলাটাই মনে হয় ধাক্কাচ্ছিল কেউ। সৌমিত কৌতূহলভরে জানলাটা খুলল। খুলে দেখল কেউ নেই। আবার জানালাটা বন্ধ করে বিছানায় আসতে যাবে এমন সময় সে জানলায় ধাক্কা মারার আওয়াজ শুরু হল। কে যেন হয়তো বোঝাচ্ছে যে, জানলা খোলো, অনেক দরকারি কথা আছে। সৌমিত ভয়ে অস্ফুট গলায় বলল, “কে? কে ওখানে?” কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পেল না। কিন্তু, জানলা ধাক্কানোর আওয়াজ ক্রমশ বেড়ে চলল। এক সময় মনে হল জানলাটা বোধহয় ভেঙেই যাবে। ঠিক তখনি বেশ সাহস সঞ্চয় করে জানলাটা খুলল সৌমিত। কিন্তু এবারও অবাক কাণ্ড! কোথাও কেউ নেই। সৌমিত জোড়ে চিৎকার করে উঠল,– “কে?জানলা ধাক্কাচ্ছিলেন কেন? কে আপনি? কই গেলেন?”কিন্তু, কোনও সাড়াশব্দ পেল না সৌমিত। ব্যাপারটা তো বেশ রহস্যজনক।
সৌমিত আজই কলকাতার এই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে এল। সদ্য কলকাতার একটি নামী অফিসে জয়েন করেছে সে। তাই কোচবিহার থেকে কলকাতার এই বাড়িতে আসা বৈকি। বাড়িটা বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল সৌমিতের। আর ভাড়াও বেশ কম। ও ওর একার পক্ষে এই বাড়ি ঠিকই আছে। কিন্তু প্রথম দিন রাতেই যে এমন অদ্ভূতুড়ে উপলব্ধি হবে, কিন্তু সেটা ও কোনোকালেই ভাবতেই পারেনি। সদ্য বি.টেক. পাশ করা বছর বাইশের সৌমিত কুণ্ডুর জীবনে এই প্রথম যেন অলৌকিকতার প্রবেশ ঘটল। যাই হোক, সৌমিত শুনেছিল যে বাড়িটা বহুদিন খালি পড়েছিল তাই হয়তো জানলা দরজাগুলো অব্যবহৃত ছিল। সেই জন্যে বোধহয় হালকা হাওয়ায় জানলাটা ওরকম করছিল। কিংবা পেঁচা কি বাঁদুড়ের সাথে ধাক্কা লাগছিল হয়তো জানলাটার সাথে তাই ওই আওয়াজটা হচ্ছিল। কিন্তু তা বলে এত…..। এরপর, সৌমিত আর কিছু ভাবলো না। ওইটুকু নিজেকে বুঝিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কেননা পরের দিন ওর অফিস আছে তাই ঘুমটা খুব দরকার।
সেই রাতে পরের দিকে ঘুমটা বেশ ভালই হল সৌমিতের। সকালে উঠে বেশ ঝরঝরে লাগলো। বেশ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসের দিকে রওনা হল। অফিসের ব্যস্ততায় ভুলেই গেল গতকালের ঘটনা। সেদিন অফিসের একটু বেশি কাজ ছিল তাই ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ফিরে যখন সদর দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আলোটা যেই না জ্বেলেছে ওমনি তার মনে হল খাটে কে যেন ছায়ামূর্তি বসে ছিল তাকে দেখে খাট থেকে নেমে পালিয়ে কোথায় যেন একটা মিলিয়ে গেল তা ঠিক ঠাহর করা গেল না। সৌমিতের শরীর দিয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে তারপর মনের ভুল ভেবে স্বাভাবিক কাজকর্মগুলো সম্পন্ন করল সে। সেদিন রাতে এমনকি বেশ কয়েকদিন কোনও ঘটনা ঘটল না। এমনিভাবেই চলছিল একদিন ঘটে গেল এক অদ্ভূতুড়ে ঘটনা। রাতে বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়ল সৌমিতের। বাথরুমের দরজাটা যেই না খুলতে যাবে ওমনি সে শুনতে পেল বাথরুমের কলের জলের আওয়াজ। কে যেন কল খুলে তার জল ব্যবহার করছে। এত রীতিমতো তাজ্জব ব্যাপার! তাহলে কি কোনও চোর ঢুকল ঘরে? শিগগিরি সৌমিত সদর দরজা চেক করল কিন্তু সদর দরজা তো বন্ধ। আর জানলাগুলো প্রায় সবই বন্ধ। একটা যাও খোলা কিন্তু সেখানে তো গ্রিল লাগানো আছে। তাহলে বাথরুমে কে? সৌমিত ছুটে গেল বাথরুমের দিকে। কিন্তু, আবার বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই যে, বাথরুমের দরজা তো বাইরে থেকে আটকানো। তবে লোকে সেখানে ঢুকলো কিভাবে? সৌমিত বড় চমকে গিয়েই বাথরুমের আলোর স্যুইচ জ্বেলে দরজা খুলে দেখে কোত্থাও কেউ নেই। কলটাও বন্ধ। অথচ বাথরুম জলে ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে সদ্য কেউ যেন ব্যবহার করেছে। ভারী অবাক করার মতোই ব্যাপার। যাইহোক, সৌমিত বাথরুম করে ফিরে এল বেশ নির্বিঘ্নেই কোনও অসুবিধা ছাড়াই। আর মনে মনে ভাবল যে, এর একটা বিহিত করা দরকার। আগামীকাল শনিবার– অফিস ছুটি। তাই, একবার বাড়িওয়ালার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলা দরকার। এখানে অন্য কেউ আছে না কি? অশরীরী কেউ?
পরদিন বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে বেশ নিরাশাই হতে হল সৌমিতকে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি বেশ বয়স্ক। একাই থাকেন। বেশ হেসে হেসে বললেন, “কি হে সৌমিত? বাড়িটিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
– না। তবে কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে যেগুলোর ঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না।
এই বলে সৌমিত ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বলে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি শুনে প্রথমের দিকে বেশ গম্ভীর ছিলেন। কিছু একটা চিন্তায় বেশ বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন বেশ যেন। এক দৃষ্টিতে, এট মনে যেন কোনও এক চিন্তায় ডুবে ছিলেন। সৌমিত জ্যেঠু বলে ডাকাতে তাঁর যেন হুঁশ এল। তিনি যেন ঘোর কাটিয়ে বেশ স্বাভাবিক অবস্থায় হেসে বলেন, “না না, ও তোমার মনের ভুল। ও বাড়ি খুব ভালো বাড়ি। কোনোদিন কোনো অভিযোগ তো পাইনি। ঐসব তোমার মনের ভুল মাত্র। এত খাটা খাটনি কর তো। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করে করো।”
– আচ্ছা, বেশ। আসি তাহলে।
– কোন টেনশন নেই। কিছু সমস্যা হলে জানিও। ভালো থেকো।
কিন্তু এত কিছু আশ্বস্তবাণীর পরেও সৌমিতের মনের দ্বন্দ্ব কাটে না। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি কি যেন কোনও কথা না বলে চেপে গেলেন। খোলসা করে বললেন না ব্যাপারটা। সৌমিত অগত্যা নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। তা ঘরে ফিরে সৌমিত দেখে যে তার ঘর পুরো লণ্ডভণ্ড। ফাইল সব ছড়ানো আছে, বই সব মাটিতে পড়ে আছে, জলের বোতল খোলা আছে আর তার থেকে জল গড়িয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি যা তা অবস্থা হয়ে রয়েছে। সৌমিতের বেশ ভয় খেলে গেল। ঘরের কারুর ঢোকার তো জো নেই কেননা সদর দরজা তো বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করা ছিল। গ্রিল দেওয়া জানালাগুলোও তো বন্ধ ছিল। তাহলে? সৌমিত বেশ ভয়ে আবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো,– “কে তুমি? কি চাও কি? কে আছ এখানে?” বেশ কয়েকবার এই প্রশ্নগুলো উচ্চারণ করার পরও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এবার সৌমিত কিছুটা থেমে বেশ রেগে গিয়েই বলল, “তুমি যেই হও না কেন, চলে যাও এখান থেকে। চলে যাও।” ঠিক সেই সময় কে যেন সৌমিতকে পেছন থেকে জোড়ে ধাক্কা মারলো। সৌমিত উল্টে পড়ে গেল ঠিকই কিন্তু গুরুতর কোনো আঘাত বা চোট পেতে হয়নি তাকে।
এরপর, সোমবার অফিসে গিয়ে মানসীদিকে ব্যাপারটা জানায় সৌমিত। আসলে হয়েছে কি, সৌমিত ঐসব ভূতুড়ে ঘটনার জেড়ে বেশ মনমরা হয়ে পড়েছিল। তা দেখে মানসীদি সৌমিতকে জিজ্ঞাসা করেন, “কি রে, সৌমিত? কি হয়েছে তোর? খুব তো জলি থাকিস, তা আজ এত মনমরা লাগছে। ভাই, কি ব্যাপার বলতো?
সৌমিত কাতর কন্ঠে বলল, “আর বলো না দিদি। এই ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার পর যা সব ঘটছে।”
– তা ছেড়ে দে।
– আর কোথাও পাব বলো তো এত কম দামে?
– তা কি কি হচ্ছে বল তো।
– তোমাকে না হয় টিফিন টিফিন ব্রেকের সময় বলব। এখন প্রেজেন্টেশনটা একটু বানিয়ে নিই।
টিফিন ব্রেকের সময় সৌমিত মানসীদিকে সবকিছু খুলে বলে। মানসীদি সৌমিতকে নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করেন ও ভালোবাসেন। আবার সৌমিতের কাছে মানসীদি শুধুমাত্র একজন বন্ধু বা ফিলোসফার বা গাইডই নন– একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী ও বড়দির মতো। তা, মানসীদি তো সব শুনে বললেন, “ঐ বাড়িতে বেশিদিন থাকিস না। আমাদের এদিকে একটা ফ্ল্যাট আছে বটে এখানে চলে আয়। ঐ বাড়ির মধ্যে অশুভ কিছু প্রেত বা ভূত ঐ জাতীয় কিছু একটা আছে হয়তো।”
সৌমিত ভয়ে চমকে ওঠে, “কি বললে প্রেত বা ভূত?”
– হ্যাঁ। হতে পারে ঐ বাড়িতে কেউ আত্মহত্যা করেছিল বা খুন হয়েছিল, তোকে যা জানাইনি। জানালে বাড়ির জন্য ভাড়াটে পাওয়া যেত না।
– এই রে! (সৌমিত আরও ভয় পেয়ে যায়।)
– তাই বলছি আর কি। ঐ বাড়ি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দে।
সৌমিত তৎক্ষণাৎ ভেবেই নেয় যে ঐ হানাবাড়িতে এরপর আর থাকবে না। তাই এ মাসটা কোনওরকম কাটিয়ে চলে যাবে অন্য জায়গায়।
মানসীদি আবার বলে ওঠেন, “একটু খোঁজখবর নিস তো ঐ বাড়িতে কেউ কখনো আত্মঘাতী বা খুন হয়েছিল কি না।”
– আচ্ছা, বেশ। তোমার চেনা জানা কোনও ভাড়াবাড়ি পাওয়া যাবে? আছে তোমাদের ঐদিকে কোথাও?
– আছে। আমাদের বাড়ির কাছে। একটু খোঁজখবর নেব। বাড়িওয়ালা আমার হাসবেন্ডের চেনা আছে। আশা করি হয়ে যাবে। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি গেলে তোর অফিসটাও বেশ কাছে হয়ে যাবে। ঐ ভূতুড়ে বাড়ি ছেড়ে দে, চলে আয় এদিকে।
– তাই হোক দিদি।
সেদিন রাতে আর কিছু হল না। তার বেশ কয়েকদিন পর যা সব ঘটল তা সৌমিতের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এই ক’দিন অফিসের কাজের চাপে খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। সৌমিত মানসীদির কথা মতো তাঁদের ওখানেই যাচ্ছে। সেই মতো সবকিছুর তোড়জোড়ও চলছে। একদিন রাতে ফেরার সময় সৌমিত ভাবল যে, মানসীদি ঠিকই বলেছেন। ও যে বাড়িতে আছে সেই বাড়ি সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। কোথায় নেবে? সৌমিত ভাবল যে হোটেলে ও রাতে নিয়মিত খায় সেখানেই জিজ্ঞেস করবে। আগে করবে ভেবেছিল কিন্তু অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কিংবা নানান কারণে করা হয়ে ওঠেনি। আবার সময় পেয়ে যখন করবে ভেবেছিল তখন অচেনা মানুষজনকে প্রশ্ন করতে গিয়ে কোথাও একটা লজ্জাবশত ‘কিন্তু কিন্তু’ করেও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। যাইহোক, খাবার খেয়ে বিল মেটানোর সময় দোকানে আর কেউ ছিল না সৌমিত তখন দোকানের মালিককেই জিজ্ঞেস করল, “কাকু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
– হ্যাঁ, বলো।
– আচ্ছা, আমি আপনাদের দোকানের উল্টোদিকের গলিতে দ্বিতীয় নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকি।
– ও আচ্ছা। তা বাড়িওয়ালার নামটা কি যেন।
– রঞ্জনবাবু, রঞ্জন বাগচী।
– ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কি জানতে চাও বলো?
– ঐ বাড়ির ব্যাপারে কিছু বলবেন। কিরকম যেন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। একা খুব ভয়ে আছি। ওখানে কি কেউ আত্মহত্যা বা খুন হয়েছিল?
মালিক ভদ্রলোক কেযন যেন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, “একটা বাড়ির সম্বন্ধে এরকম শুনেছিলাম বটে। সেটাই কি এই বাড়ি? আচ্ছা, দাঁড়াও তো…” তারপর ওঁর পাশে বসা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ গো, বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছিল যে ছেলেটি, সেটা কি রঞ্জনবাবুর?
মালিকের স্ত্রী জানালেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। রঞ্জনবাবুর ছেলেই তো আত্মহত্যা করেছিল। ঐ বাড়ি নিয়েই তো যত অপবাদ। কেউ টিকতে পারে না।”
সৌমিত জিজ্ঞাসা করে, “কাকিমা, কাইন্ডলি একটু ডিটেলসে বলবেন?”
মালিকের স্ত্রী বলতে আরম্ভ করলেন,– “ছেলেটি যতদূর জানতাম একটু পাগলাটে গোছের ছিল। তাই ওর কিছু হয়নি। হাজার বলা সত্ত্বেও না করেছিল বিয়ে না করত কোনও কাজ। রাতদিন খালি নেশা করে একে ওকে তাকে জ্বালিয়ে কাটাত। বাপের থেকে খালি টাকা চাইতো। সেই নিয়ে বাপ ও ছেলের খুব ঝগড়া হত। ছেলে মারা যাবার বছর দশেক আগে রঞ্জনবাবুর স্ত্রীও মারা যান। শেষের দিকে ছেলেটা আরও বিগড়ে যাওয়াতে বাপে ও ছেলের মধ্যে এতটাই ঝগড়া হত যে পাড়া মাথায় উঠত। তা, একদিন হঠাৎ করে শুনলাম ছেলে ফ্যানে দড়ি লাগিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। ছেলের আত্মহত্যার পর রঞ্জনদাও ঐ বাড়ি ছেড়ে পাশের একটা ফ্ল্যাটে চলে যান। এরপর, একজন দম্পতি ভাড়াটে ছিলেন বটে তবে তাঁরা বেশিদিন থাকতে পারেননি। তাঁরাও নানান অভিযোগ করেছিল। তারপর বহুদিন ভাড়াটে ছিল না ওই বাড়িতে। মাঝে কোভিডের সময় তো বন্ধই ছিল। এই কয়েক মাস পর তুমি এলে।”
দোকানের মালিক এবার বললেন, “হ্যাঁ, মনে পড়লে এবার। আগের ভাড়াটে ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রীও বলতেন ঐ বাড়িতে থাকা যায় না। কার যেন ছায়া ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। বাথরুমের জল খোলা থাকে, জানলা ও দরজায় নানা ধরণের আওয়াজ হয় ইত্যাদি।”
দোকানের মালিকের স্ত্রী বললেন, “তুমিও বাবা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও। নয়তো তোমার শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। ঐ প্রেতাত্মা খুব জ্বালায়।”
সৌমিতের বেশ ভয়ে ধরে যায়। বাড়িতে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ মাঝ রাতে এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে যে সিলিং ফ্যান থেকে দড়িতে কে যেন ঝুলছে। হঠাৎ, ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সৌমিত। না, কোথাও কেউ নেই। জল খেয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না কিছুতেই। এভাবেই ভোর হলে সৌমিত উঠে মর্নিং ওয়াকে বেড়োয় তাতে মনটা হয়তো ভালো থাকবে। আজ অফিস করে কাল ছুটি নিয়ে ঐ ভাড়া বাড়িতে চলে যেতে হবে। সব কথা বলাই আছে। মাসও শেষ হতে চলল। এর মধ্যে যা করার তাই করতে হবে। পরদিনের ছুটি মঞ্জুর হল। সামান্য জিনিস আছে বেশিক্ষণ লাগলো না শিফ্ট করতে। তারপরের দিন শনিবার– মাসের শেষ তারিখ। সৌমিত বাড়িওয়ালাকে মাসের টাকাটা দিয়ে আসল।
এবার এই ভূতের বাড়ি ছাড়তে হবে। ছাড়ার সময় যখন সদর দরজায় তালা আটকে সৌমিত চলে আসছিল তখন জোড়ে জোড়ে ভেতর থেকে দরজা ধাক্কার আওয়াজ শোনা গেল। সৌমিত এবারও কৌতূহলভরে আবার তালা খুলে দেখে ভেতরে কেউ নেই। এমনকি ভেতরে উঁকি-ঝুঁকি মেরেও কাউকে কোথাও দেখল না। আবার, দরজায় তালা দিয়ে বেড়োচ্ছে এমন সময় আবারও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শোনা গেল। এবার যেন আরও জোড়ে। সৌমিত এবার অবশ্য ভয় পেল না, বরং বেশ সাহস সঞ্চার করে বলল, “এই চোপ্!” ওমনি আওয়াজও থেমে গেল। তারপর সৌমিত দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর নরম গলায় বলল, “বিদায়, ভালো থাকিস। আর কাউকে জ্বালাস না। তুই শান্তি লাভ কর।” তারপর, আর কোনও আওয়াজ শোনা যায়নি। ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসে সৌমিত। তারপর, নতুন ভাড়া বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বলা ভালো, সে বিদায় দেয় ভাড়াবাড়ির অশরীরীকে।
-
কবিতা- ওরাই জ্বালিয়ে রেখেছে আলো
ওরাই জ্বালিয়ে রেখেছে আলো
– ইন্দ্রনীল মজুমদারওরা জ্বালিয়ে রেখেছে আলো।
তা তো আর আজকের নয়,
ওরা কয়েক কোটি বছর ধরে আলোকময়।
আর এই কোটি বছর ধরেই
ওদের জন্মলগ্ন থেকেই,
ওরা জাগিয়ে রেখেছে অনন্ত বিস্ময়,
ওরা জ্বালিয়ে চলেছে আলো,
এক দূষণহীন ও অকৃত্রিম আলো।ওরা দিয়ে চলেছে আলো,
তা জ্ঞানের, তা মুক্তির,
তা সুন্দরের, তা তপস্যার।
ওদের শরীর বাজীর মতোও ফাটছে,
আবার প্রদীপের মতোও জ্বলছে।
ওদের উপস্থিতি গোটা মহাকাশময়।
ওরাই নক্ষত্রের দল, হতে না দিয়ে কালো,
এই অন্ধকারময় মহাবিশ্বে ওরাই জ্বালিয়ে রেখেছে আলো। -
কবিতা- এক অন্য ধরণের পৃথিবী চাই
এক অন্য ধরণের পৃথিবী চাই
– ইন্দ্রনীল মজুমদারএক অন্য ধরণের পৃথিবী চাই,
যেখানে—
মানুষ বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে।
যেখানে—
শহর-গ্রাম ও অরণ্য পাশাপাশি হাত ধরে বাঁচবে।
যেখানে—
কোনও কৃত্রিমতা নয়, প্রকৃতির কোল হবে আশ্রয়।
যেখানে—
কোনও ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোনও সংশয়।
যেখানে—
থাকবে না কোনও পরশ্রীকাতরতা, থাকবে না কোনও মাৎস্যন্যায়।
যেখানে—
মানুষ বিচার পাবে সহজে, থাকবে না কোনও অন্যায়।
হ্যাঁ, ঠিক এই ধরণের পৃথিবী আমরা চাই। -
কবিতা- আমি অসহায়
আমি অসহায়
-ইন্দ্রনীল মজুমদারমাঝে মাঝে মনে হয়,
সমস্ত লোকের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়ে,
একলা একটি ঘরের কোণে
চুপটি করে বসি গিয়ে।কোনো কাগজ পড়বো না, টিভিও দেখবো না,
খুলো না কোনো সোশ্যাল মিডিয়া,
কেবলই মুখ গুঁজে থাকব বইয়ে,
পুরোনো দিনের বই পড়ে,লিখে।তবুও লোকজনের সাথে মিশবো না,
কেননা মানুষের মন আজ বিষিয়ে গেছে।
মানুষই আজ বিষাক্ত হয়ে গেছে,
কে ভালো? চিনবো কেমন করে?ঘরের দরজা-জানলা খুলবো না,
কেননা বাইরের হাওয়াটাই যে আজ বিষাক্ত।
অন্য কারুর জলখাবারে স্পর্শ– নৈব নৈব চ!
মানুষের মনে আজ বড়োই বিষ।তাই ভাবছি, মিশবো না কারোর সাথে,
মনের ভাব প্রকাশ করব না অন্যের সাথে কথা বলে।
আমি ভালোই থাকবো এতে,
আরম্বরহীন, মিডিয়াহীন জীবনে।অন্ধকার ঘরে,
ওই ছোট ফুঁটো দিয়ে আসে আলো।
তা ইশারা করে,
আমাদের বলে–“তোমরা আছো ভালো। ”সেই জানলা জানায়,
“জেগে ওঠো–ভালো সময় আসছে।”
আর সে বলে,
“সবকিছুই আগের মতো নর্মাল হয়ে যাবে।”
সে আশ্বাস দেয়– “সব মিটে যাবে।”
আর বলে, “তোমরা ততদিন ঘরে নিরাপদে থেকো।” -
কবিতা- বিদ্যাসাগরের প্রতি
বিদ্যাসাগরের প্রতি
-ইন্দ্রনীল মজুমদারহে দয়ার সাগর–বিদ্যাসাগর,
তোমার চরণের চাপ, এই ধরাধামে
আজও লেগে রয়েছে, এবং লেগে থাকবেও।
আরও দ্বিশতবর্ষ পরেও।
তোমার আদর্শ কোনোদিনও
হবে নাকো ম্লান।তোমারই আদর্শে আজ এগিয়ে চলছে– আধুনিকতা ও নারী-শিক্ষা।
তোমারই দেখানো পথে
এগিয়ে যাবে বাংলা সাহিত্য, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান।
তোমারই কলমে, আমরা লাভ করেছি অক্ষরজ্ঞান।
তুমি সেই পরম শিক্ষক,
আমাদের শিখিয়েছ দয়া-মায়া-মমতা যুক্ত পরম জ্ঞান।তোমাকে আবার চাই,
বিশ্বাস কর–তোমাকেই চাই।
এই বিশৃঙ্খল যুব সমাজকে
আলো ও নব-জ্ঞানের পথ দেখাতে,
মানুষের দুঃখ ঘোচাতে,
হে দয়ার ও বিদ্যার সাগর–তোমাকেই চাই।(গত ২৬শে সেপ্টেম্বর,২০২০ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সেই উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে এই কবিতাটি লেখা।ধন্যবাদ।)
-
গল্প- আগন্তুক
আগন্তুক
– ইন্দ্রনীল মজুমদারহলঘর। লোকের সমাগম। সামনের সারিতে সাংবাদিকদের ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভিড়। অনুষ্ঠানটির আয়োজিত হয়েছে ‛সেরা উদ্ভাবনী পুরস্কার’ প্রদানের জন্যে। সঞ্চালক বলে উঠলেন, “এ বছরের সেরার সেরা উদ্ভাবক যিনি একাধারে অজ গ্রামে জ্বালিয়েছেন শিক্ষার আলো, তিনি আবার ‛তারার আলো’ ফুটিয়েছেন বিভিন্ন গ্রামে এবং এর সাথেও ভিডিওর মারফতে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাকে পৌঁছে দিয়েছে সবার দোড়গোড়ায়। এর আগে তিনি রাজ্য সরকারের বিজ্ঞান এবং শিক্ষা দপ্তর থেকে পুরস্কার লাভ করেছেন। তাই, তাঁর আর পরিচয়ের দরকার নেই, প্লিজ ওয়েলকাম, এবারের ‛সেরার সেরা উদ্ভাবক’–মিঃ শুভজিৎ চক্রবর্তী। একটা জোরে হাততালি।”
খুব জোরে হাততালির আওয়াজে স্বাগত জানানো হলো শুভজিৎ-কে। শুভজিৎবাবু পুরস্কার নিলেন। পুরস্কার গ্রহণের পর তিনি সাংবাদিকদের ‛প্রশ্নত্তোর পর্ব’-এর সম্মুখীন হলেন। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগলো?” শুভজিৎ হেসে উত্তর দিলেন,–“মনে হলো আমার ‛শিক্ষার আলো’, ‛তারার আলো’ চ্যানেলের সোনার মুকুটে আরেকটি পালক জুড়ল। অন্তর থেকে শান্তি পেলাম এটা জেনে যে আমার সমস্ত শ্রম মানুষের উপকারে লাগাতে পেরে সার্থক হলাম।” স্মিত প্রশান্তির হাসি হাসেন শুভজিৎ।
এবার অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, “আপনার এই জার্নিটা কিরকম ছিল? মানে, আজকের এই দিনটির জন্য অনুপ্রেরণা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? কিছুটা বিলম্বিত করেন শুভজিৎ। যেন আপন মনে তাঁর জার্নিটার কথা ভাবতে থাকেন। সত্যি তো কি শোচনীয় অবস্থা থেকে আজকের এই অবস্থায় আসতে শুভজিৎ-এর জীবনে সে দিনটার প্রভাব যেন ফ্ল্যাশব্যাকে খুঁজে পান তিনি। সেই এক বিশেষ দিন….. যাই হোক একটু স্মিত হেসে শুভজিৎ বলেন, “আমার এই আজকের দিনটায় আসার জন্য একটি বিশেষ দিনের কথা বলতেই হয়। দিন বলার চেয়ে সময় বলাই ভালো। কারণ সে সময়টায় ‛হতাশা, প্রেমে ভাঙ্গন, চাকরি খোয়ানো আরও কত কি! ডিপ্রেশন থাবা বসিয়েছিল গোটা মস্তিষ্কে। যদি পুরোটা বলি তবে আজ মনে হয় সেটা যেন জাস্ট একটা গল্প, যা রূপকথাকেও হার মানাবে। আপনাদের সাথে আজ গোটা ঘটনাটাই শেয়ার করতে চাই। আগে থেকে বলে নিচ্ছি যে ঘটনাটা বেশ বড়ো, ধৈর্য্য ধরে শোনার জন্য আগাম ধন্যবাদ। তাহলে, শুরু করা যাক ‛বন্ধুর পথ থেকে মসৃণ পথের’ এক অবিশ্বাস্য জার্নি।”
হলঘরে কেবল একটাই শব্দ গর্জে উঠলো, “নিশ্চয়ই, শুরু করুন।”
এরপর শুভজিৎ তাঁর জীবনের এক গল্প বলা শুরু করলেন। হলঘরে তখন যেন একেবারে ‛পিনড্রপ সাইলেন্স’।
“দশ বছর আগের কথা। লেখাপড়ায় ভালোই ছিলাম। একটি নামকরা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি.টেক. ভালো রেজাল্ট করে পাশ করি। একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে যোগ দিই। এক বছর বলতে গেলে গাধার মতো খাটাখাটনি করালো। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর বুঝতে পারি যে কোম্পানির সো-কল্ড ‛নোংরা রাজনীতি’-র পাঁকে আমিও জড়িয়ে পড়েছি। যে বস আমাকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন সেই বসের কাছে আমি চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম। একদিন বস তাঁর ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। যথেচ্ছভাবে আমাকে অপমান করা হলো সেখানে। বুঝতে পারলাম অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বসের কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে। আসলে, কাজ আমি ভালোই পারতাম তাই আমার প্রমোশন আটকাতে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরাই এ কাজ করেছে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও আমি বস-কে বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু বস নাছোড়। অবশেষে, তিনি আমাকে ‛রিজাইন লেটার’ ধরালেন। আমার বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। এমন আঘাত কোনোদিনও পাইনি। চোখের জল কোনোরকমে চেপে অফিস থেকে বের হলাম। আসলে বেসরকারি কোম্পানিগুলিতে এধরনের ‛জব রিস্ক’ থেকেই থাকে। একজনের পেছনে দশজনের লাইন থাকে, একটা পদের জন্যে একশো জন অ্যাপ্লাই করে। বাড়িতে যাবার সময় মাঠে বসলাম। ভাবলাম, মোনালিসাকে ফোন করি। আমার মোনালিসা, আমার প্রেমিকা, আমার ‛স্যুইট হার ডার্লিং’। মোনাসিলার কাছে হয়তো সান্ত্বনা পাব। কিন্তু অবাক ব্যাপার, মোনালিসা আমার কথা শুধু শুনেই গেল। প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না। কেবলমাত্র শেষে বললো, “সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে শুভজিৎ। কিছু চিন্তা করো না। ঘুমিয়ে পড়ো ডার্লিং।”
বাড়ি গেলাম। দাদু-দিদার সাথে বিশেষ কথা বললাম না। ও, এখানে বলে রাখি আমার বাবা-মা শিলিগুড়িতে থাকেন। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় দাদু-দিদার বাড়িতে থাকি। চাকুরীও এখানেই হয় তাই ওই বাড়িতেই ছিলাম। দিদা ব্যাপারটা হয়তো কিছুটা আঁচ করেছিলেন তাই বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন যে শরীর ঠিক আছে কিনা। আমি প্রতিবারই হাসিমুখে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, “কই, কিছুই তো হয়নি। ঠিকই তো আছি!” বলে। রাতে বিশেষ কিছু খেলাম না। আসলে খেতেই ইচ্ছে করছিল না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুম কিছুতেই এলো না। কিছুতেই ঘুম আসছে না দেখে মোনালিসাকে টেক্সট করলাম। আশ্চর্যজনকভাবে কোনো রিপ্লাই পেলাম না। বেশ অনেকগুলো টেক্সট করলাম কিন্তু রিপ্লাই-এর ‛আর’-ও পেলাম না। এরকম কত রাত অবধি মেসেজিং চলেছে আমাদের মধ্যে তার হিসেব নেই। কত মনের সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করেছি। হয়তো আজ বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে হয়তো রিপ্লাই পাব।এই ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে রিপ্লাই না পেয়ে হতাশ হলাম। এরপর বেশ কয়েকবার ফোন করলাম কিন্তু ফোন তুললো না। তারপর ফোন করাতে সে যা বলল তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ফোনের ওপার থেকে যা শুনলাম তা এই-
“তুমি একটা অপদার্থ শুভজিৎ। তোমার দ্বারা কোনদিন কি হয়েছে? কি করেছো আমার জন্যে? তার উপর আবার তোমার চাকরি গেল। চাকরি তো যাবেই তুমি তো যা একটা গাধা! প্রভাসকে দেখো সে কত স্মার্ট, হ্যাণ্ডসাম আর তুমি একটা ‘গেঁয়ো ভূত’, ইডিয়েট কোথাকার! আজ থেকে তোমার সাথে আমার ব্রেক আপ। আর কোনোদিন যদি ফোন বা মেসেজ করেছ তো মরেছ।সাবধান!”
এই বলে ও আরও নানা অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে (যা মোনালিসার মতো মেয়ের কাছ থেকে আশা করিনি) যা তা বলে সে ফোন রেখে দিল। আমার কোনো কথা বলার ভাষা ছিল না। এই প্রথম বিশাল এক ধাক্কা খেলাম সামলানো গেল না। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল। মোনালিসা জন্য কি কিছুই করিনি? কত টাকা খরচ করেছিলাম ওর জন্য তার হিসেব নেই। কতদিন হয়েছে অফিস থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়েও কোনো এক নামজাদা হোটেল কিংবা শপিং মলে মোনালিসার সঙ্গে দেখা করেছি। কত খরচ করেছি ওর জন্যে। যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। ওর ভাইয়ের পড়ার ও যাবতীয় ফূর্তির খরচও মিটিয়েছি। নিজের দুঃখ কষ্ট ওকে একবারের জন্যও বুঝতে দিইনি। নিজে না খেয়ে টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে তা খরচা করেছিলাম মোনালিসার জন্য গিফট্ কিনবার জন্য। কিন্তু এর বিনিময়ে কিছুই পাইনি। আসলে মোনালিসার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি শুধু অন্তর দিয়ে ভালোবেসে গিয়েছি। মোনালিসার দাবি কিন্তু সমস্তই মিটেয়েছি। আর প্রভাস! তার সম্পর্কে আর কি বলব? লেখাপড়ায় খারাপ ছিল। অল্প বয়স থেকেই মদ, জুয়া, গাঁজা কোনো নেশাই তার বাদ ছিল না।মেয়েবাজিও প্রচুর করেছে। আমার অফিসের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সে। সম্প্রতি বসকে তৈলমর্রদন করে তার প্রমোশন হয়। কাজের বেলায় সে আমার কাছে কিছুই নয় বলে আমাকে হিংসা করতো। আমার শত্রু পক্ষের লোক বলা যায়। কিন্তু আমি সৎভাবে কাজ করতে চাইতাম। তৈলমর্দনের পদ্ধতিটি কোনোদিন শিখিনি। তাই অফিসে হাড়-ভাঙ্গা খাঁটুনি খেটেও প্রমোশন জোটেনি।
বড়ো ব্যথা পেলাম। কিন্তু যা গেছে তা গেছে এখন উঠে পড়ে লাগতে হবে চাকরির খোঁজে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত ইন্টারনেট ঘেঁটে কোনো জব ওপেনিংস পেলাম না। টেবিলে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি এমন সময় পাড়ার মস্তান বুড়ো কলিং বেল বাজিয়ে দাদুকে দশ হাজার টাকা দেবার হুমকি দিল। তা না দিলে এখান থেকে উঠিয়ে দেবে বলে রীতিমতো শাসাছে সে।প্রায় দুই মাস কাটলো এখনো কোন চাকরির ব্যবস্থা হলো না এদিকে আমাদের অবস্থার অবনতি করতে লাগলো বিশেষ করে আর্থিক অবস্থা। কলেজে পড়াকালীন এডুকেশনাল লোন নিয়েছিলাম, সেটা শোধ করতে হচ্ছিল। আগের মাইনেগুলোর থেকে টাকা দিচ্ছিলাম কিন্তু সেই টাকা শেষ হলে টাকা কোথায় পাবো? এই চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেছে। টাকার অভাবে বাবা মাকেও টাকা পাঠাতে পারছিলাম না। এমনকি এদিকে বাড়ির ভাড়া দু-তিন মাস দেওয়া হয়নি। প্রমোশন হয়নি তাই টাকার অভাব আরও দেখা দিয়েছে।এদিকে বাড়িওয়ালা রোজ দাদুকে তাগাদা দিচ্ছে ভাড়ার জন্যে। সেদিন হুমকিও দিয়ে গেছে যে, “ভাড়া না দিলে এবার কিন্তু আর শুনবো না। সোজা পাড়ার মস্তান ডেকে বাড়ি ছাড়া করে ছাড়বো।” দাদু প্রতিবারেরই মতো শান্ত গলায় বলেছেন, “দেবো, পরের মাসে সমস্ত ভাড়া মিটিয়ে দেবো।” এদিকে দাদুর শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। আমি তখন কি করি ভেবে না পেয়ে চরম মানসিক বিষাদে ভুগতে লাগলাম। এদিকে কোনো মনোবিদকে দেখাবার সামর্থ ছিল না। ডিপ্রেশন ক্রমশ কুরে কুরে খেতে লাগল আমায়। একদিন সকালে পুরো ব্রেকফাস্ট না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দিদা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছিস বাবা? পুরোটা খেয়ে যা।”
-না দিদা, ইচ্ছে করছে না। বরং বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
আসলে জীবনের যা চরম সিদ্ধান্ত নেবার তা নিয়ে ফেলেছি অর্থাৎ ‘আত্মহত্যা’ করবো। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না। তাই ট্রেন, বাস ইত্যাদি ধরে চলে এলাম ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কোনো এক গ্রামে। একটা ভাঙ্গা বাড়ি, হয়তো বহুকাল আগে অনেকে থাকত এখন প্রায় ভগ্নপ্রায় এরকম এক বাড়ির ভেতর আশ্রয় নিলাম। বাড়িটি শুনশান, কেউ কোথাও নেই, চারিদিকে গাছপালা। আর তখন বিকেল হয়ে গেছে আর তাছাড়া বেশ ভালো হওয়া দিচ্ছে। এমনিতে ক্লান্ত শরীর তার উপর হঠাৎ কেমন একটা মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, যেন নেশার ঘোরে চলে গেলাম। তাই দু’-হাতের কনুই হাঁটুর উপর রেখে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো এক অপরিচিত কন্ঠে- “মহাশয়, কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
ধড়মড় করে উঠলাম। দেখি সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। দেখতে বেশ শৌখিন। আমাকে দেখে সেলাম জানালেন। আমিও প্রতি নমস্কার জানালাম। আমি উঠে বললাম, “হ্যাঁ, এই একটু তন্দ্রা চলে এসেছিল।”
-মশাই বুঝি কলকাতার?
-হ্যাঁ
-আপনার তো চারিদিকের অবস্থা খুবই শোচনীয়। চাকরি নাই, প্রেমিকা চইল্যা গেসে….
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি, আপনি কে? আপনি কি করে জানলেন এইসব?”
আগন্তুকটি হাসলেন আর বললেন, “আমি সবই জানি। আপনার ‘আত্মহত্যা’ করার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না তো? তাই এখানে আইলেন কেন্?
প্রায় কেঁদে ফেলার মতো বললাম, “ভাগ্যের দৌড়ে। না না ভুল বললাম কারণ ভাগ্যদেবী আমার প্রতি প্রসন্না নন, তো আমার আবার ভাগ্য কিসের?
আগন্তুক হেসে বললেন, “Man is the maker of his own destiny-অর্থাৎ মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে। কেউ অস্ত্র তুলে নরহত্যা করে ভগবানের নাম নিয়া আবার কেউ ভগবানের নাম নিয়া মানুষ সেবা করে।”
-হ্যাঁ, তা তো বটেই! কিন্তু……..আমার জীবন যে পুরোপুরি অন্ধকার এখন মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এই সূর্য যা এখন ডুবতে বসেছে তা কাল আবার উঠবে কিন্তু আমার জীবনের সূর্য যে ডুবে গেছে তা আর কোনোদিন উদিত হবে না। এই জীবনটা আমার কাছে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই এই বোঝা নামাবার জন্য আমি আত্মহত্যা করতে চাই।”
-তা রেললাইন তো সামনে। যাও গে আত্মহত্যা ক্যইরা আসো। তাছাড়া দড়ি আনো নাই কেন? বিষ খাইয়া মরতি পারতে।
এবার কেঁদে কিরে উঠবো আর কি, “কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না। হাজার হোক এই জীবনটাকে শেষ করে দিতে মন চাইছিল না। তবে এখন ঠিক করেছি আর নয়….. এবার দেব জীবনটাকে শেষ করে।”
আমি ওখান থেকে বেরিয়ে রেললাইনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম এমন সময় আগন্তুকটি ডাকলেন,”দাঁড়াও। অন্ধকারে একা যাইতাছ ক্যান্? আত্মহত্যা করবার জন্যে?
করুণ স্বরে বলি, “আর কি!”
-আরে পাগলের মতো করো কি?
-এছাড়া আর কি উপায় আছে?
-আত্মহত্যা করা যে মহাপাপ। এমন কাজ কখনোই করবা না…..
-কেন? তুমি কি আমাকে বাঁচাতে পারবে? পারবে আমার চাকরি ফেরাতে? পারবে মোনালিসাকে, আমার ডার্লিংকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে? পারবে? পারবে বাড়িওয়ালার টাকা মেটাতে? পারবে না তো তবে দূর হও, অনেক কথা বলেছি আর ভালো লাগছে না। আ-আমি মরতে চাই। আ-আমাকে মরতে দাও। Let me commit suicide.
আগন্তুক এবার ম্লান বিবর্ণ হাসলেন। আমার বিরক্তি আরও বেড়ে গেল। তারপর পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিছু উপায় ভাইব্যাছিলে এতদিন?”
এবার মাথা গরম করে বললাম, “ভেবেছিলাম তো। ভেবেছিলাম সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ভর্তি হবো কিন্তু বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে ফোন করে তাদের কোর্স-ফি শুনে পিছিয়ে আসি। অত টাকা আমার কোথায় আর তাছাড়া ওখানে পরেই যে চাকরি পাব তার নিশ্চয়তাই বা কি?”
এরপর প্রায় কেঁদেই বললাম, “নাঃ আর এ জীবন নয়। এবার আমাকে যে কোনো উপায়ে একে শেষ করতে হবে।”
এবার আগন্তুক যা বললেন তা এই, “কি বোকা গো তুমি! এত ভালো লেখাপড়া করেছ। বাবা-মায়ের কত্ত স্বপ্ন তোমাকে নিয়া। তাঁরা লোন নিয়া, নিজেদেরকে কষ্ট দিয়া তোমাগো লেখাপড়া করিয়াছেন। আর তুমি একটা কুড়ি হাজার টেকার চাকরির জন্য নিজে মহামূল্যবান জীবন শেষ করে দিবা? কি বোকা তুমি! আর ওই কার একটা নাম কইল্যা…ও হ্যাঁ মোনালিসা……হেঃ একটা মাইয়ার পেছনে জীবনটাই শেষ করতে যাচ্ছ! ও তো তুমার টেকার লোভে তুমার সাথে সঙ্গলাভ ক্যইরা ছিল। এখন তোমার চাকরি নাই তাই টঙ্কা নাই তাই সে এখন তোমার শত্রু প্রভাসের পকেট সাফাই করসে।
-মানে?
-মানেটা হইলো গিয়া তুমি আলেয়ার আলো দেইখ্যা তার পিছনে ছুটছিলা…..আরে তোমার বাবা-মায়ের কথা ভাবো….. বৃদ্ধ দাদু-দিদার কথা ভাইব্যা দেখো….অন্তত একবার নিজের জীবনের কথা তো ভাবো। মরীচিকার পেছনে ছুইট্যা কোনো লাভ নাই।
এত কিছু শোনার পর আমার মন একটু গললো। একটু শান্তি পাচ্ছি যেন। তবু কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বললাম, “তাহলে এখন উপায়?”
-চাঁদের জোৎস্নার আলো দেইখ্যা চাঁদের প্রেমে কত কবি না পড়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিমান তাঁরা টেলিস্কোপ বানায়্যা চাঁদকে পর্যবেক্ষণ ক্যইরা দেইখ্যাছিলেন চাঁদের কলঙ্ক এবং তার আলো নিজের নয় তা আসলে সূর্যের। তুমি চাঁদকে ধ্যইরা বসে আছ ক্যান? যখন তুমি নিজেই একজন সূর্য। তোমার নিজেরই যখন এত আলো আর শক্তি আছে তখন তুমি খামোখা অন্যের আলো ও তেজের জন্যে প্যইরা থাকবে ক্যান্?
-মানে? (বেশ শান্ত গলায় বললাম)
-মানে ভেরি সিম্পেল। তুমি নিজের কথা ভুইল্যা গিয়া অন্যের কথা শুইন্যা এক আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে ঢুকলা রোজগারের নিমিত্তে। দিনরাত পাগলের মতো খাইট্যা, মাথার ঘাম পায়ে ফেইল্যা কি তৈরি হইলা? না একজন বিদেশিদের চাকর! যে কিনা নিজের দ্যাশের জন্য কাজ না ক্যইরা করতাছে পর দ্যাশের জন্যে। হায় আল্লাহ্, কি বুদ্ধি তোমার?
-এখন তাহলে আমার কি করণীয়?
-ওই যে কইলাম নিজে আলো দিতে পারবা জেনেও আলেয়ার আলোর পিছনে ছুটছিলা। আচ্ছা কও তো দেখি তুমি কিসে পারদর্শী? একটু ভাইব্যা কও কেমন।
আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম তারপর আকস্মিক বললাম, “কলেজে থাকাকালীন পাওয়ারপয়েন্ট প্রেসেন্টেশনে নানান প্রজেক্টের স্লাইড বানাতাম। সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ের স্লাইড বানাবার একটা নেশা ধরে যায়। আর তাছাড়া, আরেকটা শখ আছে বৈকি।
– তা কিসের কও দেখি? (আগন্তুক হেসে হেসে বলে)
-তা হলো অ্যাস্ট্রোনমির। আসলে, ছোটবেলা থেকেই জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল জানেন। দেশ-বিদেশের যেমন স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিং এমনকি কেপলার, নিউটন,গ্যালিলিও আর রাধাগোবিন্দ চন্দ, মণি ভৌমিক, অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি নানান লেখকের আর্টিকেল ও বই পড়েছি। ছোটবেলার খেলনার বাইনাকুলার দিয়ে কতবার আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছি তার হিসেব নেই। সব তারামণ্ডলের নাম ও স্থান ছিল নখদর্পণে। এই বিষয়ের নানান বই, ভিডিও, দেশ-বিদেশের নামী পত্রিকার প্রবন্ধ বাড়িতে আছে। অ্যাস্ট্রোনমির বহু জার্নালও পড়েছি।এই বিষয়ের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ঘাটলেই তো বহু তথ্য পাওয়া যায়।
আগন্তুক এবার হেসে বললেন, “তাহলে বুঝলা, তুমি এক কাজ করো। নানান এডুকেশনাল স্লাইড বানাও তোমার জানা বিষয়গুলির উপর। এছাড়া এই কাজে আগ্রহী এরকম বন্ধুদের জোগাড় করো। তাদের লইয়্যা এক এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট বানাও। তোমাদের এই সময়ে অনলাইন এডুকেশনও খুব প্রয়োজনীয়। তাছাড়া জানোই তো আমাদের দুই বাংলার গ্রামগুলিতে শিক্ষার আলো বিশেষ পৌঁছায় না। নানা জায়গায় স্কুল আছে, কলেজ আছে কিন্তু আদর্শবান শিক্ষকের অভাব। নানা জায়গায় দু’একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনোরকমে টিকিয়া আছে। তুমি তাই শিক্ষার আলো সবার ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করো। তোমাদের এই ইন্টারনেট ও অ্যাপের যুগে এই কাজটা অনেকটাই সহজ।”
আমি আস্তে আস্তে আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। বললাম, “ঠিকই বলেছ আর হ্যাঁ শখে একটা প্রোজেক্টর কিনেছিলাম বহু বছর আগে। বাড়িতে সেটা পড়েই আছে। চাকরির চাপে সেটার কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম।ধন্যবাদ, সেটার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যে।”
-আর হ্যাঁ একটা কি বলছিলা- জ্যোতির্বিদ্যা। হ্যাঁ, তুমি এক কাজ করো বিজ্ঞানের এই বিষয়টির উপর নানান আকর্ষণীয় স্লাইড তৈরি করো। আর একটা টেলিস্কোপ কেনো। প্রত্যেক শনি ও রবিবার গ্রামে গ্রামে কিংবা শহরে, নানান শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন পাড়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা শোনাও স্লাইডের মাধ্যমে। আকাশে মহাজাগতিক কিছু দেখা দিলে সেটাকে নিয়া ক্যাম্প করো, টেলিস্কোপ দিয়া সেটাকে লোকজনকে দেখাও। তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে জানাও। অতএব, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রচারে নাইম্যা যাও।
-মানে, একদিকে টিউশনি অন্যদিকে বিজ্ঞান প্রচারক।
-এক্সাক্টলি! একদম ঠিক! মনে রাখবা সর্বদাই যে, তুমি কিভাবে দ্যাশ ও দশের সেবা করতে পারবা? অন্যের মঙ্গল করে যে যাওয়া মানে নিজেরও মঙ্গলসাধন করা আর জানোই তো স্বামী বিবেকানন্দের অমর বাণী- “বহুরূপে বহুসম্মুখে কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেইজন,
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
আর মনে রাখবা যে সর্বদা বাধা আসবেই তবে তাকে অতিক্রম করা তোমারই দায়িত্ব। অতএব,
‘Always do what you love and love what you do.’ OK, All the best.আমি এই প্রথম এতদিন পর একটু হাসলাম। অজান্তেই শ্রদ্ধার সঙ্গে হাত-জোড় করে বললাম, “ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি আমার পরম উপকার করলেন। সত্যিই আপনাকে চিরকাল মনে রাখব। তবে যা এতক্ষণ জিজ্ঞেস করিনি, আসলে খেয়ালই ছিল না তা হলো, আপনি কে? আপনার পরিচয়টা তো ঠিক জানলাম না তো।
-ওঃ, আমার নাম হইলো গিয়া আয়মান হুসেন। আমি ওপার বাংলার মানুষ। পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলাম?
-তবে এপারে এলেন কিভাবে?
আগন্তুক হেসে বললেন, “আমাদের এপার-ওপার দুই বাংলাতেই অবাধ যাতায়াত। কোনো মানুষ বিপদে পড়লে তারে সাহায্য করতে ঠিক আসিয়া থাকি। কৃত্রিম কোনো কাঁটাতার কাজে আহে না।”
আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”মানে আপনি কি জন্যে এখানে আসেন?”
-ভাই, আমি ছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আমার জীবনের আদর্শ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতে গেলে আমার রাজনৈতিক গুরু। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জাগো জাগো/ বাঙালি জাগো। জয় বাংলা’। এই স্লোগান তুলে অত্যাচারী, বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছিলাম। ৭ই মার্চ,১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর রমনা মাঠের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে গ্রামে ফিরছিলাম। তখন পাকিস্তানি সেনারা তাদের মাটি সরে যাচ্ছে দেখে আরও অত্যাচার বাড়ায়া দেয়। তো ফিরবার সময় খবর পেলাম যে, পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় একটি মন্দিরে অনেক সোনাদানা লুঠ করেছে। এর সঙ্গে ওই মন্দিরের পুরোহিত ও তার পরিবারকেও খুন করেছে। শুনে মাথায় রক্ত চ্যইরা উঠলো। প্ল্যানমাফিক ঝোঁপের ভিতর গিয়া লুকাইলাম। যখন সেনার গাড়ি ওই পথ দিয়া যাইতেছিল তখন কৌশলে গাড়ি আটকায়া আমি ও আমার সহযোদ্ধারা বন্দুকের গুলি চালাইয়া সেনাদের খতম করলাম। এরপর ওই মোহর নিয়া সেইদিন রাতে নৌকা ক্যইরা ইন্ডিয়াতে আইস্যা এক গুপ্ত জায়গায় লুকাইয়া রাখলাম। পরে ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা যে বর্বর ‘সার্চলাইট অপারেশন’ চালায় তাতে আমার মৃত্যু হয়, শত চেষ্টাতেও পাকিস্তানি সেনাদের খতম ক্যইরাও শেষ রক্ষা হয় নাই। আসলে, সেদিন ওরা অনেকে ছিল তার তুলনায় আমরা অনেক কম ছিলাম। তবে, আমি গর্বিত একজন বিপ্লবীর মতো মৃত্যুকে বরণ কইরাছি বলে। তবে, বিপ্লবীর মৃত্যু হলেও, বিপ্লবের মৃত্যু হয় না। তাই, তোমার মতো কেউ যদি বিপদে পড়ে তবে হাত বাড়ায়া দিইই। তাহলে, আজ আইলাম। ভালো থাকবা….”
আমার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ কি একটা বলতে যাব এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল। তড়াক করে উঠে দেখলাম কোথাও কেউ নেই। চারিদিক নিস্তব্ধ। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে গেল। আপন মনে পায়চারি করতে লাগলাম। এমন সময় পায়ের নীচ একটা পুটলিতে ঠেকলো, সেটা কৌতুহল বসে তুলে খুললাম। খুলে চমকে উঠলাম- আরে এ যে মোহর! মনে হয় সেই মন্দিরের। চোখে জল এলো। আয়মানকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।
এরপর।
সেই মোহর বিক্রি করে যা টাকা পেলাম তার থেকে কিছু অংশ বাড়ির ভাড়া মেটালাম। এরপর শুরু হলো আসল খাটুনি। অঙ্ক ও বিজ্ঞানের নানা স্লাইড বানালাম। অন্যান্য যারা অফিস থেকে কাজ হারিয়েছে তাদেরও ডাকলাম। দেশে বেকারের অভাব নেই। তাই সবাইকে এক করে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যান্য বিষয়ের স্লাইড বানাতে বললাম। সিলেবাস দেখে, নানান বইপত্র ঘেঁটে, নেট ঘেঁটে আমরা সবাই মিলে দিনরাত এক করে স্লাইড বানাতে লাগলাম। গ্রামে ও শহরে নানান টিউশন পয়েন্ট খুললাম এবং সেখানে স্লাইড ও প্রোজেক্টর মারফৎ পাঠ্য বিষয়ের প্রেশেন্টেশন দেখানো হতো। পড়ুয়ারা সবাই খুব মজা পেল, তারা শিখলও অনেক। এতে আমাদের খুব আনন্দ লাগল। এরপর শিক্ষা যেন সবার ঘরে পৌঁছে যায় সেজন্য খুললাম ‘শিক্ষার আলো’ বলে একটি ইউটিউব চ্যানেল। এখানে নানা বিষয়ের নানা ক্লাসের ভিডিও দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। শিক্ষক-ছাত্র এমনকি সাধারণ মানুষও এতে বিশেষ উপকৃত হলো। সকলের প্রশংসা পেলাম।
এরপর শুরু হলো ‘তারার আলো’। বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে গ্রামের প্রতি শনি ও রবিবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা স্লাইড বানিয়ে সেগুলো দেখাতাম। গ্রামের আকাশে ভালো দেখা যায়। তাই টেলিস্কোপ কিনে গ্রামের মানুষদের গ্রহ, তারা পর্যবেক্ষণ করাতাম। নানান উল্কা, বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, বুধ ও শুক্রের সরণ, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, চাঁদের কলা ও চাঁদের পৃষ্ঠদেশ ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখালাম জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্যাম্প করে।
এখন মোনালিসাকে নিয়ে ভাবি না সে বলতে গেলে খরচের খাতায় চলে গেছে। এখন প্রচুর অর্থ এমনিই রোজগার করি টিউশনি, জ্যোতির্বিজ্ঞানের শো এবং চ্যানেল চালিয়ে তাই আর চাকরির কথা ভাবি না। সবচেয়ে বড়ো কথা আজ আমার কাজ, আমাদের গোটা টিমের কাজে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা খুশি, দর্শকরা খুশি, আপনারা খুশি। এটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য। আর একজনকে পেয়েছি জীবনে। সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার তার মতো কাউকে পাওয়া সে হলো আমার জীবনসঙ্গিনী- আত্রেয়ী। বিভিন্ন স্লাইড তৈরি করতে ওর অবদান ভোলার নয়। ওর উৎসাহই আমাকে আরও উৎসাহিত করে।
আর সেদিন আত্মহত্যার চিন্তা যখন আমাকে গ্রাস করছিল তখন সেই মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ডিপ্রেশন থেকে, আত্মহত্যার চিন্তা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে এসেছিলেন। হয়তো ভগবানই তাঁকে পাঠিয়েছিলেন যাতে আর কেউ যেন আত্মহত্যার মতো চরম বোকামি না করে বসে। আমার আজকের দিনটি জীবনে পাবার জন্য ওঁর অবদান অনস্বীকার্য।”
চোখে জল আসে শুভজিতের, আপন মনে তিনি বলে ওঠেন, “ধন্য ‘আগন্তুক’, ধন্য মুক্তিযোদ্ধা আয়মান, ওপারের বাঙালি হয়েও এপারের এই বাঙালিকে মনের ব্যাধি থেকে মুক্তি দিয়ে আজকের এখানে এই সুন্দর পরিবেশে নিয়ে এসেছ। ধন্যবাদ। যেখানেই থেকো,ভালো থেকো।”
হলঘরের সবাই সিট থেকে উঠে হাততালি দেয়। শুভজিৎ স্টেজ থেকে নীচে নামছেন এমন সময় দেখলেন দূরে একজন দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। আরে! ইনি তো সেই আইয়মান। মনে হয় তিনিও মুচকি মুচকি হাসছেন। আজ শুভজিতের জন্য তিনি নিজেও খুব গর্বিত। তাঁর হয়তো একটা শ্রম সার্থক হয়েছে। মানুষের ভিড় ঠেলে যখন শুভজিৎ সেই সিটের কাছে গেলেন তখন দেখেন সেখানে কেউ নেই, কেবল এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে যাতে লেখা রয়েছেঃ-
“Never, ever give up. অবস্থা যেমনই হোক, হাল ছেড়ো না বন্ধু। ভালো থেকো, আরও এগিয়ে যাও। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।”
-
ভৌতিক গল্প- দুর্ভিক্ষের পরে
দুর্ভিক্ষের পরে
-ইন্দ্রনীল মজুমদার
“আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী। আমার বাড়ি কলকাতার গড়িয়াহাটে। নানা অজ গ্রামে ঘুরে বেরানো বলা যেতে পারে আমার এক অভ্যাস। আমাকে ‘ভবঘুরে অভিযাত্রী’ ভাবলে চলবে না কারণ আমি ভবঘুরে নই। বাড়ির লোকের মুখে শুনেছিলাম যে পূর্বে আমরা জমিদার ছিলাম। তাই, বাংলার জমিদারের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সংকলন করা আমার এক নেশা। বলতে পারা যায়, এই বিষয়ে আমি একজন গবেষক। অন্তত দু’শোর মতো জমিদার বাড়ি দেখেছি দুই বাংলা জুড়ে। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে, অ্যাপের যুগে আমি যা তথ্য পেয়েছি এইসব যান্ত্রিক সহায়তায় তার থেকে বেশি পেয়েছি লাইব্রেরীতে পুরনো বই, কাগজপত্র, নথি ঘেঁটে। ভাবছি এরইমধ্যে ‘www.bengalizamindars.in’ নামে একটি ওয়েবসাইট বা জালাধান খুলব। পরে বছরের মধ্যে এই বিষয়ের উপর একটি বই প্রকাশ করব। প্রকাশকের সাথে কথা চলছে। বছর তিন-চারেক আগে শান্তিপুরের একটি জমিদার বাড়ির খবর পেয়েছিলাম বন্ধু স্বাগতর কাছে। গ্রামটি যে কোথায় তা ঠিক বোঝানো যাবে না। তবে কাঁথি থেকে অনেকটা গিয়ে তারপর এই গ্রাম পড়বে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে রওনা হয়েছিলাম। তা পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা হয়ে গেল। দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ ট্রেন মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সিগন্যালের গন্ডগোলের জন্য। তা একদিকে ভালোই হলো কারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা রাতে ভালো অনুভব করা যায়। তা জমিদার বাড়িতে যে রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটি এখন বলার অপেক্ষা। যাইহোক, প্লাটফর্মে নামলাম কোনোরকমে। কারণ ট্রেন থামতেই সমস্ত লোক হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। দেখলাম একটি মহিলা দোকান বন্ধ করছে। তার কাছে গেলাম। তাকে ডাকলাম, “এই যে শুনছেন….”। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আজ্ঞে। বলুন আমি এই দোকানের চাওয়ালি।”
– বেশ। তা এখনই দোকান বন্ধ করছেন।
– হ্যাঁ। রাত হয়ে গেছে। রাত্রি আটটার পর এতল্লাটে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলাম, “তা এত তাড়াতাড়িতে?”
– আজ বাবু জ্যোৎস্নার রাত। তাই……। তা আপনি যাবেন কোথায়?
-যোগীন্দ্রনাথ জমিদারের বাড়ি। শুনেছি বাড়িতে আজও আছে তাই সেটি দেখার বড়োই ইচ্ছে।
মহিলাটি হঠাৎ আচমকাই চমকে উঠে বললে, “রাম রাম। আর কোথাও যাবার জায়গা পেলেন না। শেষে কিনা…..” কথাটি শেষও করলো না তাড়াতাড়ি পালালো।
ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হলো। একটা পুরনো জমিদার বাড়ির নাম শুনে ওই মহিলার এরকম হলো কেনো? কে জানে? এরপর দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটি আলো প্ল্যাটফর্মের ওদিকে দেখা যায়। আমি সেই আলোর দিকে এগোই এবং দেখি একটি ভ্যানরিকশা। আমি থামাবার ইঙ্গিত করি। সেটি থামে। দেখি অল্পবয়স্ক এক রিকশা চালক। সে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবেন বাবু?”
– আমি কলকাতার লোক। শুনেছি এখানকার এককালের ডাকসাইটে জমিদার শ্রীযোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িটি আজও নাকি আছে।
চালকটি হঠাৎ ভয় ভয় ভাব নিয়ে বলে ওঠে, “তা তো আছেই। আপনাকে গাঁয়ে আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু খামোকা সেখানে যাবেন কেন?”
– এমনি দেখার জন্য এসেছি। তোমার নাম কি?
-যে আজ্ঞে অম্লান। অম্লান বারুই।
-তা বেশ। রাত্রি আটটার পর এখানে সব ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যাপার কি? আর তোমার মুখ জমিদার বাড়ির নাম শুনে শুকিয়ে গেল যে!
অম্লান এবার হেসে বলল, “আজ পূর্ণিমার রাত কি না। আমিও ন’টার পর আর চালাব না।”
আমি হেসে বলি, “পূর্ণিমার রাত তো কি হয়েছে?”
-বুঝবেন বাবু, বুঝবেন। সময় হলে সব বুঝবেন। আমি মুখ্যু মানুষ। আমি আপনাকে আর কি বুঝাব? বরং এখানকার আর্য তরফদার বলতে পারবে।
-কে তিনি?
-গ্রামের বয়স্ক মানুষ। পণ্ডিত লোক। নিজের স্কুল আছে। নামী স্কুল। উনি অনেক পুরনো কথা জানেন।
রিকশা চলতে থাকে ক্ষেতের মাঝপথ দিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোই যা ভরসা। জব্বর সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে এই জোৎস্না। এই ‘Romantic moments’-কে কিনা এরা দোষ দেয়। গাঁয়ের লোক হয়তো কুসংস্কারী। একটু পরে রিকশা থামে।
অম্লান বলে উঠলো, “বাবু, এইটে জমিদার বাড়ি। ত্রিশ টাকা দেন।”
আমি ভাড়া মেটাই।
অম্লান জিজ্ঞেস করে, “বাবু, এখানে থাকবেন কোথায়? এখানে তো কেউ থাকে না। এই রাত্তিরে টর্চ, দেশলাই, খাবার সব আছে তো?”
আমি হেসে জানাই যে-“সব আছে আর সঙ্গে কার্বলিক অ্যাসিড-ও আছে। এর ফলে সাপের কোনো ভয় থাকবে না।”
বাড়িটাকে দেখলাম এতক্ষণে। সর্বাঙ্গ ভেঙে পড়েছে এমনকি গেটটাও। বাড়িটা বড়োই রহস্যময় ও বিচিত্রময় বলে মনে হল কেন জানি না।
অম্লান বলে উঠলো, “এখানে রাত্রে দোকান পাবেন না তাই আমার বাড়িতে খাবেন না হয়।”
-আচ্ছা। আমার সার্ভে করতে ঘন্টাখানেক লাগবে। তারপর না হয় এসো।
-আচ্ছা বাবু। তবে যাই। সাবধানে থাকবেন। হরি হরি….
বুঝতে পারলাম না কেন অম্লান সাবধানে থাকতে বলল। হয়তো রাত বলেই। তা যাক গে। আমার কাজ শুরু করা যাক। বাড়িটাকে দেখলাম বেশ পুরনো বাড়ি। তাছাড়া কতকাল যে কারুর চরণের ধুলো পড়েনি তা কেবল ভগবানই জানেন। ক্যামেরা ছিল তা দিয়ে একখানা ছবি তুললাম বাড়িটার। এরপর গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। গেটে মরচে পড়ে গেছে। সামনের সিংহ মূর্তিগুলোও ভাঙ্গা। ভেতরে ঢুকলাম। এমনিতে অন্ধকার হলেও জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়িটাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। পেটের খিদের জ্বালাটা বেশ বেড়ে গিয়েছিল, তাই বাড়ির থেকে আনা টিফিন খেয়ে নিলাম। খেয়েও মনে হল খিদেটা এখনো মেটেনি। যাক অম্লানের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারা যাবে খন। তারপর সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর দরজায় অল্প ঠেলা দিতেই আচমকা একটা ‘খ্যাঁচ’ করা আওয়াজে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আমি অবাক। দেখলাম মোমবাতি রাখা আছে। মেঝেতে খান কয়েক বস্তা। আশ্চর্য ব্যাপার!
বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। এমন সময় হঠাৎ বাইরে কুকুরের তারস্বরে চিৎকার উঠলো। কি ব্যাপার? এমন সময় মনে হলো যে দমকা হাওয়া বাইরে থেকে এসে পেছনে লাগল। ঠিক তখনই রোম-খাঁড়া হয়ে যাওয়া এক ঘড়ঘড়ে গলায় অচেনা ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
– মহাশয়ের বুঝি কলকাতা থেকে আসা হয়?
আমি শিহরিত হয় চমকে পিছনে ফিরে বলি- “হ্যাঁ।”
দেখলাম অচেনা ব্যক্তিটি পৌঢ়। বয়স আনুমানিক ষাট। পরণে ধুতি-পাঞ্জাবী। পায়ে নাগরাই চটি। বেশভূষা তো জমিদারের মতোন। তবে কণ্ঠস্বর ভারী রহস্যময় এবং চোখ দুটো বড়ো বড়ো এবং রহস্যময় ও ভূতুড়ে ভাব স্পষ্ট।
আমি ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে?”
-আমি এখানেই থাকি। আজ রাত্রে এলাম। আসলে পূর্ণিমা রাতে আমি আসি। আজ নয় বহুদিন…….
আমি কথা থামিয়ে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু লোকে যে বলে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। অনেকদিন আগে জমিদার যোগীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। তাঁর পরিবারও কেউ নেই। আর থাকলেও আপনি কেবল পূর্ণিমার রাতে আসেন কেন?
-মায়ায়। হ্যাঁ, বড়ো মায়া। এই বাড়িতে লোক আছে। গাঁয়ের লোক সব বাজে কথা বলে। বিশ্বাস যদি না হয় তবে আসুন আমার সাথে। সব দেখলেই বুঝতে পারবেন।
লোকটির কথা বড়োই অদ্ভুত। আমি ওঁর সাথে বাইরে গেলাম। আর গিয়েই চমকে উঠলাম। একি! এ যে নতুন ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। সিংহমূর্তি দুটোও অক্ষত। বাইরে এক পুরোনো মডেলের গাড়ি। কোথায় সেই ভাঙা বাড়ি? কোথায় মরচে ধরা গেট? এই ভদ্রলোক কি জাদুকর? না আমারই মনের ভুল? না দিবাস্বপ্ন? দিবাস্বপ্ন যে আমি দেখছি না তা হলফ করে বলতে পারি।
-বুঝতে পারবেন না মশাই। যা দেখেছেন সবই সত্যি।
-বটে। (আশ্চর্য হলাম উনি আমার মনের কথা ধরতে পেরেছেন দেখে)
অচেনা ব্যক্তি এবার দুঃখের স্বরে বললেন, “কি জানেন আমার ছেলেটা আমারই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আমার গুদামের সমস্ত চাল, ডাল বিলিয়ে দেয় কাঙাল বা না খেতে পারা লোকেদের।”
-কবে?
-কেন দুর্ভিক্ষের সময়, মন্বন্তরের দিনগুলিতে…..
আমি চমকে ঢোক গিলে বললাম, “মানে, ১৩৫০ বঙ্গাব্দে বা ১৯৪৩ সালে?আপনি এতোকাল আগে……
– ভাবছেন মশকরা করছি। সাহেবদের সাথে আমার ভালোই ওঠাবাসা ছিল। ওই বস্তাগুলিতে (বস্তার দিকে আঙুল করে) চাল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্যে। আমার ছেলেটি করেছিল কি ওগুলো এই গরীব কাঙালদের বিলিয়ে দিয়েছিল। আমার মান আর রাখলো কোথায়?
-ভালোই তো করেছিল। যারা খেতে পারছিল না তাদেরকে খেতে দিয়েছিল। এতে ক্ষতি কোথায়?
-সব শেষ হয়ে গেল। (কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বললেন) চলুন। একটু বাড়ির আশপাশটায় ঘুরে আসা যাক। একটু ওপরে চলি।
অতএব, চললাম দুজনে। এঘর-ওঘর দেখতে দেখতে ওপরে চলে এলাম। আসার সময় নানা ঘরে ভদ্রলোক দেখালেন এটা হুঁকো, এটা জমিদারের পাইপ, নানা অসাধারণ পেন্টিং, মূর্তি ও বিভিন্ন বিষয়ের দুষ্প্রাপ্য বই এবং শিকার করা বাঘ, হরিণের চামড়া ইত্যাদি। তারপর ওপরের কোণের একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, “এবার যা দেখবেন তা দেখে কোনোদিন আর এখানে আসার বাসনা থাকবে না আশা করা যায়।”
তাঁর কথাগুলো বেশ রহস্যময় শোনাল। আরও অবাক করার ব্যাপার হল এই যে দরজাটা যেন আপনি আপনি খুলে গেল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। সামনের খাটের দিকে তাকালাম। ওপরের ঝাড়লন্ঠনের আলোয় বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে যা, তা দেখে আমার পিঠের ওপর দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। রক্ত যেন জল হয়ে এলো। একি! যে ভদ্রলোক এতক্ষণ কথা বলছিলেন তাঁরই মৃতদেহ খাটে পড়ে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে, হাতে বিষের বোতল, মুখ দিয়ে ফ্যানা বেরিয়ে আছে। এইরকম মর্মান্তিক দৃশ্য কি দেখা যায়? আর ঠিক তখনি সারা বাড়িময় জুড়ে “হা হা হা হা…….হা” করে বাঁজখাই হাসি যা কোনোদিনও ভোলার নয়।
কোথায় সেই ভদ্রলোক? পাশে তো কেউ নেই! এমন সময় দৌড়ে নীচে এসে দেখলাম যে ঘরটায় বস্তাগুলো রাখা ছিল, সেই ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে এক সু-পুরুষ চেহারার যুবক। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোগা-হাড় বেরানো, প্রায় বস্ত্রহীন কয়েকজন ‘না-মানুষ’ চেহারার মানুষ। একটি মহিলার কাঁধে একটি শিশু কাঁদছে আর বলছে- “মা খেতে দাও, খেতে দাও না।” তার মা তার পিঠ চাপড়ে বলছে- “এই তো বাবা, এইবারই খাওয়া হবে, আর কাঁদিসনি।” শিশুটি না খেয়ে প্রায় কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে।
সকলে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলছে, “শহরে গিয়ে কিছু পেলাম না বাবু। সব নিষ্ঠুর। না খেতে পেয়ে মরব। শহুরে বাবুরা ভাত তো নয়ই এমনকি ফ্যানও দিলে না। শরীর বড়োই অবসন্ন তাই লাইনে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই আর। তাছাড়া সেখানকার চাল,ডালও অতি অল্প, ভালো নয়। ভাত না দাও বাবা, অন্তত ফ্যান দাও।”
যুবক ওই অসহায় মানুষদের আশ্বস্ত করে বললেন, “গুদাম ঘর তো খোলা হয়েছে তোমাদেরই জন্যে। এখানে চাল,ডাল ভালোই পরিমাণে আছে তাই বেশি করে দিচ্ছি, পরিবারের সবার পেট পুরে খাওয়া হয়ে যাবে।”
এমন সময় ওপর থেকে ভেসে এলো সেই অচেনা ভদ্রলোকের তারস্বরে চিৎকার, “নাআআআআ…..”
আমি তখনই বাড়ি থেকে দৌড়াই। তখন আমার দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। ছুটতে ছুটতে রাস্তায় আসি। একটি ভ্যান-রিকশার সাথে ধাক্কা খাই। দেখি সেটার চালক অম্লান।
আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বলি,”চলো, চলো, নিয়ে চলো, শিগগির এখান থেকে।”
অম্লান বলল, ” তাড়াতাড়ি উঠে বসেন। ওই বাড়িতে আপনি কেন গেলেন বাবুমশাই? ওখানে কেউ যায় না। ওটা একেবারে অভিশপ্ত বাড়ি বুঝলেন কিনা।”
আমি আধো-আধো ভাবে ঘটনাটা বলার চেষ্টা করলাম।অম্লান চমকে উঠে বলে, “সর্বনাশ। আমার বাড়ি চলুন।”
রিকশায় উঠে দেখি কঙ্কাল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে, “ভাত না দাও, ফ্যান দাও। ভাত না দাও ফ্যান অন্তত দাও।” আমি ভয়ে আত্মহারা হয়ে যাই।
অম্লান বলে ওঠে, “ওদিকে তাকাবেন না বাবু। আপনি আমার দিকে মুখ করুন।” এই বলে সে দ্রুত রিকশা চালায়।
অবশেষে অম্লানের বাড়িতে পৌঁছলাম।অম্লানের ছেলে আমাকে দেখে বলে উঠলো, “মা, বাবা একজন কাকুকে নিয়ে এসেছে।”
অম্লান তার স্ত্রীকে সবকিছু বলল। বাড়িতে ছিলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তিনি আমাকে নমস্কার জানালেন। আমিও প্রতি নমস্কার জানালাম।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, “আমি আর্যবাবু- আর্য তরফদার। হরণাথ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলটা আমারই। অম্লানের মুখে আপনি ওই অভিশপ্ত বাড়িতে গেছেন শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। অম্লানকে ধমক দিয়ে আপনাকে তক্ষুনি নিতে পাঠাই। ওকে বলি, “আর পরে যেতে হবে না তুই এখনই যা, দেখ এরমধ্যে কোনো অঘটন না ঘটে যায়।” আর আমিও এখানে চলে আসি।”
আমি দু-গ্লাস জল খেয়ে একটু ধাতস্থ বোধ করি। কিছুক্ষণ পরে আমরা খেতে বসি। অম্লানের বউয়ের হাতের রান্না ভারি চমৎকার। তা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাড়ির উঠোনে বসে গল্প আরম্ভ করি।
অম্লানের স্ত্রী হেসে বলল,”ঠাকুরের কৃপায় বড়োজোর প্রাণ নিয়ে বেঁচে গেছেন।”
আমি হেসে জানাই, “সেই। ভাগ্যিস অম্লান তখন এসেছিল। অসংখ্য ধন্যবাদ অম্লানকে, আর্যবাবু সহ আপনাদের সবাইকে।”
আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া ওই ভৌতিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে আর্যবাবুকে জিজ্ঞেস করি, ” আর্যবাবু, আপনি প্রবীণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তা ঘটনার মূল কাহিনীটা কি? একটু যদি বলেন।”
আর্যবাবু গল্প আরম্ভ করলেন, “আমার আশীতিপর বয়স। আমি একজন ইতিহাসবিদ। গ্রামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি। ১৯৪৩ সালে এক ভয়াবহ ও প্রবল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে গোটা বাংলা। জানেন তো তাতে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এই দুর্ভিক্ষ আসলে এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। চাল,ডাল ভালো পরিমাণেই পাওয়া যেত অন্তত ১৯৪১, ১৯৪২-এর থেকেও। ব্রিটিশ সরকার ‘৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ সহ্য করতে না পেরে এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। তার সাথে যোগ দেয় এই যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতো আড়তদার ও কালোবাজারিরা। সেই সময় বাংলার সব গ্রামের মতো এই গ্রামও জনশূন্য হয়ে যায়। বটতলায় সন্ধ্যেবেলায় আর আড্ডা বসে না, বাড়ির তুলসী-তলায় জল পড়ে না, চণ্ডীমণ্ডপ ফাঁকা, মন্দিরে পুজো বন্ধ এমনকি প্রদীপ জ্বালাবারও কেউ নেই। খেতে না পেয়ে রোগাটি হয়ে যায় সবাই। শহরে যায় কিন্তু সেখানে সামান্য ফ্যানটুকুও না পেয়ে গ্রামে ফিরে আসে। জমিদার যোগী বা যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িতে চাল, ডাল সবই ছিল তবে তা নিজেদের জন্যে বা সরকারি লোকেদের জন্যে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। তাঁর ছেলে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিদেশ থেকে শিক্ষালাভ করে দেশে এসে যখন দেখেন এই শোচনীয় অবস্থা অথচ বিদেশি সরকারের কোনো হেলদোল নেই। তারা যেন বিপ্লবীদের অন্যতম উৎপাদন ক্ষেত্র বাংলাকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর তখন তিনি কৌশলে গুদামের সমস্ত চাল,ডাল ওইসব মানুষের জাত-ভাইদের বিলিয়ে দেন। উপেন ছিলেন নিঃস্বার্থপর, সরল, উদার, সাহসী ও বুদ্ধিমান এক যুবক। কিন্তু ছেলের এরূপ আচরণ মেনে নিতে পারেননি পিতা যোগীন্দ্রনাথ। পরে সরকারের কাছে হেনস্থা হবার ভয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আর ছেলে উপেন্দ্রনাথ?”
-তিনি পরে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারান কিছু উগ্র অ-মানুষের হাতে। তবে বলা হয় তাঁকে চক্রান্ত করেই সরকার মেরেছিল কারণ তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বিপ্লবী।
-যাক, অশেষ ধন্যবাদ। আপনাদের কাছে আমি অনেক ঋণী। আপনাদের জন্যই আমি আজ রক্ষা পেলাম,সুস্বাদু খাবার পেট পুরে খেতেও পেলাম। কাল সকালেই আমি রওনা দেব। সত্যিই বলতে কি, এ এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল যা কোনোদিনও ভোলা যাবে না। কথা দিচ্ছি, এখানে পরে আবার আসব তবে ওই বাড়িটার ত্রিসীমানা মারাবো না। আজ যদি অম্লান না আসত, তবে হয়তো……
আর্যবাবু হেসে বললেন, “তা তো নিশ্চয়ই। অম্লানই আপনাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। আপনি আমাদের অতিথি আর ‘অতিথি দেব ভব’। আর তাই বিপদগ্রস্ত অতিথির পাশে দাঁড়ানোই তো আমাদের প্রধান কর্তব্য। যাক,আপনি আবার আসলে ভালোই লাগবে।”
অম্লান বলল,” কাল বাবু, সূর্য উঠার পরই বেরিয়ে যাব।”
পরদিন সকালে অম্লানের স্ত্রী, ছেলে সবাই হাসিমুখে বিদায় জানাল। বারবার অনুরোধ করতে লাগলো তাদের বাড়ি আবার আসার জন্যে। আমিও অম্লানের পরিবারকে আমার কলকাতার বাড়িতে আহ্বান করি, সাথে আর্যবাবুকেও নিয়ে আসতে অনুরোধ করি। অম্লানে রিকশা করে এগোতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। মাঝপথে সেই ভূতুড়ে জমিদার বাড়িটা দেখলাম। সেই জমিদার বাড়ি……
যাক, মনে মনে ভাবলাম, ‘ইতিহাস মানে তো অতীত। আর অতীত মানে তো ভূত। আজও কিছু মানুষ স্বার্থপর ও লোভী। তাদের বিপুল ধনসম্পত্তি থাকা সত্বেও তারা সমাজকে কিছু দেয় না, মানুষের কোনো উপকার করে না। অন্যের ক্ষতি দেখলেই তাদের যেন আনন্দ। অন্যকে খেতে না দিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়াই যেন আজকের এইসব বর্বর লোকেদের কাজ। আর যেদিন এই শোষক শ্রেণী আরও চাইবে সমস্ত রক্ত চুষতে সেদিন সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তার জন্য কোন অ্যাটম বোমা লাগবে না।
রেল-স্টেশনে পৌঁছালাম। অম্লান ভাড়া নিয়ে বিদায় নিলো।
-ধন্যবাদ বাবু,আবার আসবেন।
আমি সেই চায়ের দোকানের কাছে গেলাম। চায়ের দোকানটা সবই খোলা হয়েছে। অম্লানের বাড়িতে চা খেয়েছি। তাই, আর চা পান করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই চায়ের দোকানের মহিলাটি আমায় দেখে এক্কেবারে ‘থ’। হয়ত জীবিত যে দেখবে ভাবতে পারেনি।
সে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো একাধিক প্রশ্ন- “ভাল আছেন বাবু? কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বেঁচে গেছেন তাহলে? যাক ভালোই হলো। ঠাকুর কৃপা করেছেন।” এইসব বলে সে দু-হাত উঠিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকল।
আমি হেসে বললাম, “দিব্যি আছি। বলতে পারো নতুন এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হলো…..”
এমন সময় ট্রেনের আওয়াজ হলো। আমি চায়ের দোকান থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আসার সময় ভাবতে লাগলাম যে বাড়িতে গিয়ে লিখে ফেলতে হবে জমিদার বাড়ির ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাটি। ওয়েবসাইটে দেবো- ‘A Haunted Zamindar House’ অর্থাৎ ‘এক ভূতুড়ে জমিদার বাড়ি’। ফেসবুকেও এর সম্বন্ধে লিখবো। সাথে ছবিটাও দেব। দেখি কটা ‘Like’, ‘Share’ ও ‘Comments’ পাওয়া যায়।
-
ভৌতিক গল্প- নর-কঙ্কাল
নর-কঙ্কাল
→ ইন্দ্রনীল মজুমদারঅমলেশবাবু বাড়িতে সোফায় বসে খবরের কাগজটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন। বাইরে ঝম্ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, তাই কোথাও বেড়োনো যাবে না। তিনি রিটায়ার্ড মানুষ, তাই কোনও কাজকর্ম নেই। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন এবং মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর সাথে বিদেশে থাকেন। তাই বাড়িতে বলা যায় তিনি একলাই থাকেন। মাঝে মাঝে ও পাড়ার বন্ধু মানিকবাবু তাঁর সাথে আড্ডা মারতে আসেন। মানিকবাবু ছিলেন একজন সরকারি অফিসের চিফ্ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এখন বেশ কয়েক বছর হল অবসর নিয়েছেন। তিনি কাজের সূত্রে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। তাই অফুরন্ত তাঁর গল্পের স্টক,বিশেষ করে ভূত বা অলৌকিক গল্পের। মানিকবাবু আসলে আড্ডাটা বেশ জমে।অমলেশবাবুর কেমন বিশেষ বন্ধু-বান্ধব নেই। তাই, অমলেশবাবু খালি ভাবছেন যে, আজ এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটিবার যদি মানিকবাবু আসতে পারে তাহলে আড্ডাটা বেশ জমে। অমলেশবাবু বড্ড একাকীত্ব বোধ করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, বৃষ্টিটা বেশ ধরেছে, মানিকবাবু আসতেই পারেন। এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এমন সময় কলিংবেলের ঘন্টা বাজলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল হাসিমুখে মানিক চৌধুরীকে। তিনি একটি প্যাকেট তুলে বললেন, “বেগুনি ও আলুর চপ নিয়ে এসেছি মশাই। মুড়ি দিয়ে এই ওয়েদারে বেশ জম্পেশভাবে খাওয়া যাবে। এরসাথে চা হলে তো কোনো কথাই নেই।”
অমলেশবাবুও হেসে বললেন, “শুধু কি তাই? আপনার ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে বেশ জমে যাবে এই বৃষ্টি-বাদলার দিনটা। আমি তো খালি আপনার কথাই ভাবছিলাম আর ঠিক তখনই আপনি এসে হাজির। অনেক আয়ু আপনার মশাই।”
মানিকবাবু হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। ওদিকে অমলেশবাবুও রান্নাঘরে চা ও খাবার রেডি করতে লাগলেন। সব রেডি হয়ে ট্রেতে করে খাওয়ার যখন অমলেশবাবু
আনছিলেন তখন মানিকবাবু বলে উঠলেন, “আজ ঘুরঘুটিয়া গ্রামে কি সব ঝামেলা হয়েছে। খবরে তা বেরিয়েছে। পড়েছেন কি?
– হ্যাঁ, ওই আর কি সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। মারামারি, খুন, থানা,পুলিশ আরও কত কি!
মানিকবাবু খানিকক্ষণ থেমে বললেন, “এই ঘুরঘুটিয়ায় সেই ঘটনাটি ঘটেছিল।”
অমলেশবাবু বেশ কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ঘটনা?”
– নর-কঙ্কাল নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর ভৌতিক ঘটনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় মশাই, রোম খাঁড়া হয়ে যায়।
অমলেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার মতো বিজ্ঞান মনস্ক লোক ভূতে বিশ্বাস করেন,ভৌতিক গল্পে জমাটি আড্ডা দেন, ভৌতিক গল্প ও উপন্যাস লেখেন- এসব বিশ্বাস করতে কেমন একটা যেন লাগে।”
মানিকবাবু হো হো করে বেশ খানিকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, “আগে একদমই করতাম না জানেন মশাই। এই ঘটনাটার পর থেকে করি। আসুন আপনাকে ঘটনাটা পুরোটা বলছি।”
এইবার অমলেশবাবু ও মানিকবাবুর ভৌতিক আড্ডা শুরু হবে। সাথে চলবে খাওয়া-দাওয়া। ওদিকে আবার বৃষ্টির বেগও বেড়েছে, সাথে শুরু হয়েছে ঝড়। গল্প শুরুর সময় কারেন্টও অফ গেল। বাধ্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভৌতিক আড্ডা শুরু করতে হল। অতএব পাঠকগণ বোঝাই যাচ্ছে একটা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আর এই পরিবেশেই মানিকবাবু ঘুরঘুটিয়ার গ্রামে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা শুরু করলেন।
– সে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। সরকারের কোনো এক প্রজেক্টের কাজে ঘুরঘুটিয়ায় আমার পোস্টিং হয়। তখন ঘুরঘুটিয়া গ্রাম এতটা জমজমাট ছিল না। যাকে বলে অজ পাড়া-গাঁ সেরকম একটা ছিল আর কি। তা আমার পোস্টিং যেখানে হয় সেই জায়গাটা বেশ ফাঁকাই ছিল। ফাঁকা মাঠের মাঝে থাকার জন্য মেসবাড়ি টাইপের একটি বাড়ি বলা যায়। বাড়িটার উল্টোদিকে একটি পোড়ো বাড়ি টাইপের একটা বাড়ি ছিল। দেখে মনে হয় বিশেষ কেউ ওখানে থাকে না, বাড়িটা পরিতক্ত। যাইহোক, মেসে আমার সাথে আরেক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার শ্রী বিমল মিত্র ছিলেন। শুরু থেকেই কেন জানি না আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটা। চারপাশে ঘন-জঙ্গল ও মাঠের মাঝখানে এই বাড়িটাকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হত। বাড়িটা বহু পুরনো তাই হয়তো আমার আকর্ষণ আরও বেড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সকালে কোনোরকমে ব্রেকফাস্টে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে যেতাম, সারাদিন অফিসের কাজ, প্রকল্পের কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরতাম। আমার পাশের রুমেই থাকতেন বিমলবাবু। এখানে বলে নিই আমাদের থাকার বাড়িটি ছিল একতলা, সেখানে ছিল মাত্র দুটোই ঘর। এই অজ গ্রামে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা না থাকার ফলে কর্মীরাও তেমন আসতেন না। আর সরকারি প্রকল্পও তেমন হত না। রাত্রে বাড়ি ফিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করত না তাই বাইরে কোথাও খেয়ে এসে শুয়ে পরতাম। যাই হোক, একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করি। এমন সময় জানলার কাছে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। উল্টোদিকের বাড়িটা সকালবেলা অফিস যাবার সময় দেখতাম অন্ধকার কিন্তু এখন দেখছি ওই বাড়ির উপরতলায় আলো জ্বলছে। একটা ছায়াও লক্ষ্য করলাম। তার মানে ওখানে কেউ থাকেন। কিন্তু সকালবেলায় বা এমনকি ছুটির দিনেও সারাদিন তো কাউকে ওখানে দেখা যায় না। কি ব্যাপার কে জানে? কৌতুহল নিয়েই জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এরকম অভিজ্ঞতা আরেক দিনেও হয়েছে। সেদিন অবশ্য অফিসের কাজের চাপ ছিল তাই রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। তখন একেই গরমকাল, তাই জানলা খুলে খাটে শুয়ে শুয়ে একটি বই পড়ছিলাম। মাঝে মাঝে চোখ যাচ্ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটায়। না বাড়িটা তো অন্ধকারেই আছে। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে, চোখে ঘুম চলে এলো তাই বই বন্ধ করে ঘুমোতে যাব এমন সময় দেখি ওই বাড়িটার দোতলায় আলো জ্বলে উঠল। তাজ্জব ব্যাপার! যাই হোক, তখন বেশ ঘুম চলে এসেছিল তাই আর ওদিকে কৌতূহল না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল বিমলকে বলে দেখতে হবে। তা পরদিন অফিসের ক্যান্টিনে বিমলকে ঘটনাটা বলতেই, বিমলও দেখি বাড়িটার ব্যাপারে বেশ কৌতুহলী। বিমল জানালেন যে তিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। তিনি বললেন, “দাদা, ওই বাড়িটায় একটু নজর দেওয়া দরকার। কোনো সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি হতে পারে।
– একদম ঠিক কথা বলেছ। তাই হবে হয়তো।
– একদিন একটু ঢুঁ মারা দরকার।
– ক্ষেপেছ দাদা, ওদের হাতে অস্ত্রসস্ত্র থাকলে কি হবে?
– তা তো ঠিকই।
যাই হোক, সেদিন এর বেশি আর কথা এগোয়নি। আমরা দুজনেই কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন পর বিমল অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাতে দেখেছ দাদা?”
– কাল রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কেন কি ব্যাপার বলতো?
– রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর ঠিক তখন ওই বাড়িটায় চোখ পড়তে দেখি ছাদে একজন উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একেই অন্ধকার, তাই অত ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তাকে একটা ছায়ামূর্তি হিসেবেই দেখাচ্ছিল। স্পষ্ট না হলেও, গোটা বাড়িটা দেখলাম সম্পূর্ণ অন্ধকার। তাই, ওখানে একটিমাত্র লোক আছে বলেই মনে হয়।
– আচ্ছা। তাহলে একদিন তো যাওয়াই যায়। এই সামান্য ইনভেস্টিগেশন করতে।
– গেলে তো রাতেই যাব।(উৎফুল্ল হয়ে বললেন বিমল)
– তা তো বটেই। তুমি ওই লোকটাকে দেখেছো?
– না। সেটাই তো তোমাকে বললাম তাকে দেখতে পারিনি। সে একভাবে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমারও এদিকে ঘুম পেয়ে গিয়েছিল তাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
– আচ্ছা। তাহলে একদিন যাওয়া হচ্ছে।
সেদিন আর এ নিয়ে কথা হয়নি। পরে একদিন ঠিক হল যে সামনের শনিবার রাত দশটার সময় আমরা সেই বাড়িটায় যাব। তা সেই শনিবার টর্চ সমেত গেলাম সেই বাড়িটায়। বাড়িটার সামনে বাগান, বাগানে আগাছায় ভর্তি। অনেকদিন এই বাগানে কারুর পা যে পড়েনি তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ভেবেছিলাম টর্চ প্রয়োজন ছাড়া চালাবো না। কিন্তু যা অন্ধকার, তাই একদণ্ড টর্চ ছাড়া চলছিল না। অগত্যা টর্চটা জ্বালাতে হল। সামনে দড়ির মতো কি একটা চলে গেল না। বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিমল বললেন, “ওটা সাপ ছিল, ডানদিকে চলে গেছে, চলো পা টিপে টিপে সামনের দরজার দিকে এগোই।” সেভাবেই এগোচ্ছিলাম দরজার দিকে। বলা যায় না, কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে আছে, তাই চারিদিকে টর্চ ফেলছিলাম। দরজার কাছাকাছি চলে এসেছি, বাঁদিকে টর্চ ফেলে হঠাৎ ভয়ে আত্মারাম খাঁচা হবার জোগাড় হল। ভয়ে হাত থেকে টর্চটা পড়েই গেল। দরজার কাছে ওই গাছের ডালে ওটা কে বসে? মনে হয় তার দুটো চোখ যেন লাল আগুনের গোলা। টর্চটা কোনোরকমে তুলবার সময় বিমল বললেন “ওটা একটা প্যাঁচা গো দাদা। ভয় নেই।”
– কিন্তু প্যাঁচা হলে ওর চোখটা যেন লাল আগুনের গোলা কেন?
– তাইতো দাদা, চলো তো দাদা গিয়ে দেখি।
আমরা প্যাঁচাটার দিকে এগোতে লাগলাম। কাছাকাছি আসতেই সেটি ‛ক্র্যাও ক্র্যাও’ করে ডেকে উড়ে চলে গেল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজায় তালা লাগানো নেই, তাই সহজেই সেখানে ঢোকা গেল। বাড়িটার দরজায় নামের প্লেটটা ভাঙা। তাই নামটা পড়া যাচ্ছিল না। সামনের আলোটাও ভাঙা। তাই আলোও থাকে না। পুরো বাড়িটাই এক অন্ধকারময় জগতে রয়েছে। তা দরজায় ঠেলা দিতেই সেটি খুলে গেল। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যজনক মনে হল। এ বাড়িতে কেউ কি থাকে আদৌ?একটু সন্দেহ হচ্ছিল। দরজার ঠিক ডানদিকের একটি ঘর খোলা। সেখানে টর্চ ফেলতেই দেখলাম উপরের সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে বাঁদুরের দল। তাদের দিকে টর্চ ফেলতেই তারা কিচিরমিচির করতে লাগল। বেশ কয়েকটা মাথার উপর দিয়ে উড়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়েও গেল। আমরা সেখান থেকে সরে এলাম। বিমল রসিকতা করলেন, “এখানে কি ভ্যাম্পায়ার আছে নাকি দাদা?” আমি শুধু বললাম, “কি জানি ভায়া থাকতেও পারে।” নীচের অন্যান্য ঘরগুলি বন্ধ। শুধু বাঁদিকে একটা বাথরুম খোলা ছিল, আর সেখান থেকে টপ্টপ্ করে আওয়াজ আসছিল। কাছে গিয়ে দেখি কল থেকে কিছু সময় অন্তর অন্তর জল কলের নীচে একটি বালতিতে পড়ছিল। বাথরুম থেকে কার যেন পায়ের ছাপ অন্য একটা বন্ধ ঘরের দিকে চলে গেছে। বেশ ভয় হল। ঘরের দরজা খুলে কোনো বিভীষিকা মূর্তি উপস্থিত হবে না তো? অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে। কিন্তু কেউ এলো না। আমরা এগোতে লাগলাম। বেশ একটা নিস্তব্ধতা অনুভব করছিলাম। আসলে, আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ আর কথা বলার ফিস্ফিস্ ছাড়া আর বাথরুমের টপ্টপ্ করে জল পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছিল না।
খালি মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এখানে আদৌ কেউ থাকে? একটা কথা বলা হয়নি তা হল এই বাড়িতে আসার মূহুর্ত থেকেই মনে হচ্ছিল যে যেন এক অন্য জগতে চলে এসেছি। বেশ অসস্তি বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে, এই বাড়িতে না আসলেই ভালো হত। জানেন তো মশাই কোনো কিছুতে অতি কৌতূহল ভালো নয়। আমাদেরও তাই অবস্থা। যাইহোক, বিমল বললেন, “ওই তো সামনে একটা সিঁড়ি,চলো দাদা। উঠে দেখি তো।” সিঁড়িতে উঠতে মন চাইছিল না তবুও আমরা সেটা বেয়ে উপরে উঠলাম। অবশেষে দোতলার একটি ঘরে এলাম। ঘরটা ছিল ফাঁকা, তার দরজার সামনে বারান্দা। ওই বারান্দায় কেউ নেই তো? ভালোভাবে তো কিছু বোঝাই যাচ্ছে না। ভয়ে দুজনেই টর্চটা নেভালাম। আমরা ঘরেই অপেক্ষা করছিলাম। এরসাথে ঘরটাও পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সবকিছু ভালোমতোনভাবে দেখার জন্যে তাই টর্চের আলোটা আবার জালালাম।
ঘরটায় দুটো আলমারি রয়েছে। আলমারিগুলোতে ধুলো এতটাই জমে আছে যে আছে যে সেগুলোর ভেতর দেখা যাচ্ছিল না। দরজা জানালা সব বন্ধ, তাই ঘরটা বড্ড গুমোট। দেখলাম মেঝেতে একপুরু ধুলো জমে আছে, সামনে আলমারির কাঁচের দেরাজগুলোতে ধুলো জমে গিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো পরিস্কার করে ভালোভাবে দেখার জন্যে যেই না একটু পা বাড়িয়েছি অমনি শুনতে পা খট্খট্ করে একটা পায়ের আওয়াজ- কে যেন সিঁড়ি বেয়ে এদিকে আসছে। তড়িঘড়ি করে আমরা নিজেদের টর্চটা নেভালাম। অপরদিকে একটা ঘর দেখলাম আর মাঝে একটা প্যাসেজ, সামনে বারান্দা। আমরা বারান্দার দিকে এগিয়ে ডানদিকে ওই ঘরটার সামনে গিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম। এমন সময় খট্খট্ আওয়াজটা বেড়ে গেল। এমনসময় বেশ কয়েকটি শেয়াল ও কুকুর যেন ডেকে উঠল। মনে হল ওরা কিছু একটা অশনিসংকেত জানান দিয়ে গেল। আমরা ভয়ে দরদর করে ঘামছি। ‘কি হয়, কি হয়’- একটা টেনশন কাজ করছে। লুকিয়ে সবকিছু নজর রাখছি। এমনসময় যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। একটা নর-কঙ্কাল সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। তার চোখ দিয়ে যেন ঠিঁকরে বেরোচ্ছে আগুন। সে আমরা যে ঘরটায় ছিলাম, সেখানে ঢুকল। বেশ অনেকক্ষণ সেখানে থেকে বোধহয় আমাদের খোঁজ করছিল। তারপর কাউকে না পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপরের সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। ভাগ্যিস এদিকে তাকায়নি। খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। আমার তখন হৃদপিণ্ড হাতে চলে আসার মত অবস্থা বুঝলেন মশাই। আমি কোনোরকমে বিমলকে ফিস্ফিস্ করে বললাম, “চলো বিমল, আর এখানে নয়। ছাদ থেকে নেমে পড়ার আগে আমরা পালাই এই বাড়ি থেকে। বিমলেরও দেখি একই অবস্থা। আমরা কোনোরকমে দৌড় মারলাম মেসবাড়ির উদ্দেশ্যে। ওইদিকে কুকুর ও শেয়াল আবার ডাকা শুরু করেছে। যাইহোক, কিভাবে যে এক নিশ্বাসে দৌড়ে মেসে পৌঁছে ছিলাম তা আমরাই জানি। কোনোরকমে মেসবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের অবস্থা দেখে শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে তো, বাবুরা? কোনও রকমে বলে উঠলাম, “খুব জোর বেঁচে গিয়েছি।যা দেখলাম তা আর এ জীবনে ভোলার নয়।” তখন আমাদের অবস্থা দেখে একজন বলে উঠল,“এই বাবুদের জল দে।” গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ তাই জল খেয়ে একটু স্বস্তি বোধ হল। তো আরেকজন বলে উঠল, “চলুন আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।” আমরা বললাম, “থাক, থাক।” যাই হোক, কোনোরকমে ঘরে ঢুকলাম। সাথে ওই মানুষগুলোও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “আমরা এই লোকাল ক্লাবের ছেলে। দূর থেকে এই ফটিক সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় আপনাদের দেখতে পায় ওই বাড়িতে ঢুকতে। তাই সে ক্লাবের সেক্রেটারি বিপনদাকে খবর দেয়। আমরা সবাই তা শুনেই ছুটে চলে এলাম। আপনারা ওই বাড়িতে ঢুকেছেন জানতে পেরে সবাই চলে এলাম আপনাদের বাঁচাতে। আসতেই দেখি ওই বাড়ি থেকে আপনারা এই অবস্থায় বেড়িয়ে আসছেন।”
–তা ভালোই করেছেন। আচ্ছা, ওই বাড়িটার ইতিহাস কিছু জানেন?
এবার একজন নেতা গোছের লোক এগিয়ে এলেন, ইনি মনে হয় বিপনদা। যাই হোক, তিনি বললেন, “নমস্কার, আমার নাম বিপন। আপনারা ওই বাড়িতে কেন যে গেলেন? আমরা তো ভুলেও এমন কি দিনের বেলাতেও ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যাই না। ওটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি।”
আমি আমাদের কৌতূহলের ব্যাপারটা বললাম। বিমল বললেন, “বাড়িটার ইতিহাস সম্পর্কে যদি একটু বলেন।”
তখন আমরা কোনোরকমে ধাতস্থ হয়েছি। আর এমনিতেও তো ওই বাড়িটার প্রতি একটা কৌতূহল ছিলই। তা বিপনবাবু বলতে শুরু করলেন,“সে অনেকদিন আগেকার কথা। আজ থেকে বছর দশ-পনেরো তো হবেই। ওই বাড়িতে থাকতেন এক দম্পতি। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। গৃহস্বামী খুব একটা সুবিধার লোক ছিলেন না। নানান জায়গায় ধারদেনা করে শোধ দিতে পারছিলেন না। এদিকে তিনি তেমন কিছু কাজও করতেন না। অসৎ সঙ্গে পড়ে প্রচুর টাকা নষ্ট করেছেন। লোকটার জুয়া ও মদেরও নেশা ছিল। তা একদিন, তিনি তাঁর বিপদের কথা তাঁর এক বন্ধুকে জানালেন। সেই বন্ধু ছিল বড়োই সাহায্যকারী, তিনি কলকাতায় কাজ করতেন। তা একদিন বন্ধুকে সাহায্য করার জন্যে ওই বাড়িতে আসেন। বেশ কিছু অর্থ ধার দেন বন্ধুকে। যতদূর শুনেছি ঐই ভদ্রলোকের হাতে ছিল একটি হীরের আংটি যা সোনা দিয়ে বাঁধানো। তা সেই আংটি দেখে ওই বাড়ির গৃহকর্তার ভারী লোভ হল। তিনি ভাবলেন ওই আংটি বাগাতে পারলে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে। তাঁর মাথায় সবসময়ের শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করত। তা সেই লোভে পড়ে একদিন তিনি তাঁর বন্ধুর খাওয়ারে বিষ মিশিয়ে দিলেন এবং তাঁর বন্ধু তা খেয়ে মারা গেলেন। ভদ্রলোক তখন আন্টিটা খুলে নিয়ে বন্ধুর লাশটি কোথাও একটা গায়েব করে দিয়েছিলেন। পুলিশি তদন্ত হয়েছিল পরে কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি। আসলে, তখন এখানে প্রচুর ডোবা ছিল আর শেয়াল, কুকুরেরও অভাব ছিল না। মানুষজন তো ছিল সামান্যই। তাই লাশ গায়ের করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। যাই হোক, তারপর থেকে শুরু হল এক উৎপাত। রোজ রাতে ওই বাড়িতে কঙ্কাল দেখা যেতে লাগল। বাড়ির ছাদে অনেকেই এক কঙ্কালকে চলতে-ফিরতে দেখেছেন। বাড়ির মালি একদিন সেই কঙ্কাল দেখে আতঙ্কে বাগানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গৃহকর্ত্রীও একদিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে কঙ্কাল দেখে অজ্ঞান হয়ে যান,জ্ঞান ফিরলে স্বামীকে ভয় ভয় বলেন, “চলো এখান থেকে চলে যাই। এখানে কঙ্কালের উৎপাত শুরু হয়েছে। আজ আমিও দেখলাম, মনে হল তোমার সেই কলকাতার বন্ধু।” গৃহস্বামীও স্থির করেন বাড়ি ছাড়ার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। পরদিন দেখা গেল বাড়ির সামনে দুটো লাশ পড়ে, ওই স্বামী-স্ত্রীর, তাঁদের জিভ বার করা ও চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। গলার দাগ দেখে মনে হল কেউ যেন গলা টিপে তাঁদের হত্যা করেছে। মনে হয়, ওই কঙ্কালই তার প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু এরপরেও কঙ্কালের উৎপাত থামেনি। রোজ রাতেই দেখা যায় সেই নর-কঙ্কাল এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলো জ্বালিয়ে কিছু একটা যেন খুঁজছে। ছাদে উঠে ঘুরতে দেখা যায়। আমাদের মনে হয়, সেই মৃত ব্যক্তিটিই আজও কঙ্কাল হয়ে খুঁজে চলেছেন তাঁর সেই হারানো আংটিটা। ওই কঙ্কাল এছাড়া কোনো অসুবিধা আজ পর্যন্ত কাউকে করেনি। আমরা ওই ভদ্রলোকের নাম জানতাম না। তবুও লোকাল তান্ত্রিক, ওঝা ও পুরোহিত ডেকে আমরা শান্তি স্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।তো, এই হচ্ছে গিয়ে ব্যাপার বুঝলেন দাদারা।”
ওনারা চলে যাবার পর, সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হতে লাগল মনে হতে লাগল ওই কঙ্কালটা আমাদের এই দরজায় এসে হয়তো ঠক্ঠক্ করবে। তাই, যে ভাবেই হোক এখান থেকে ছেড়ে চলে যেতেই হবে। পরদিন রবিবার ভয়ে ভয়ে কাটালাম। সোমবার আমরা বদলির চিঠি দিলাম এবং তা মঞ্জুরও হয়ে গেল। দুজনেই বদলি হয়ে গেলাম অন্য জায়গায়।তা এই ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভৌতিক কাহিনী।কি মিঃ অমলেশ দে, ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?”
অমলেশবাবু শুনে কেবল বিস্মিত হয়ে হাঁ হয়ে রইলেন। আর ওদিকে বৃষ্টিও গেছে থেমে, কারেন্টও এসেছে চলে। অমলেশবাবু এবার কোনোরকমে স্বভয়ে বললেন, “আপনি এরপরে ওই জায়গাটায় গিয়েছিলেন?”
– হ্যাঁ মশাই। তা বছর পাঁচেক আগে ওই গ্রামের পাশের একটি গ্রামে একটি বিয়ে ছিল। সেই উপলক্ষ্যে একটা ফাঁকে ওই মেস ও ওই ভয়ঙ্কর বাড়িটা দেখার আগ্রহ দমন করতে পারিনি। কিন্তু হায় কপাল, গ্রাম তো একেবারে বদলে গেছে। লোকজন, গাড়ি-বাড়ি প্রচুর বেড়ে গেছে। দুঃখের বিষয় সরকারের কোনও প্রজেক্ট না থাকার দরুন ওই মেস দশ বছরের বেশি হয়ে গেল বন্ধই হয়ে আছে। ওখানে বিকেলে স্থানীয় বাচ্ছারা খেলা করে।”
অমলেশবাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আ-আ-আর ওই ভূতুরে বাড়ি? ওই কঙ্কাল?”
মানিকবাবু হেসে বললেন, “ওই বাড়ি? ওই বাড়ি এখন ভেঙে একটা হোটেল উঠেছে। আর বিপনবাবুদের কাউকেই খুঁজে পেলাম না। স্থানীয় ক্লাব এখন অন্য রকমের। পুরো ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং হয়ে গেছে। ক্লাবের ছেলেরাও একেবারে অন্যরকম। তা, সেই ক্লাবের যিনি সেক্রেটারি তাঁকে ওই অভিশপ্ত বাড়ি ও কঙ্কালের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! বুঝলাম কঙ্কালের কথা কারোর আর মনে নেই কিংবা তার উপদ্রব আর নেই। তাহলে, অমলেশবাবু, আমার কথাটি ফুরোলো, বৃষ্টির দিনে ভুতুড়ে গল্পটি ভালোই জুড়ালো। কি বলেন?
অমলেশবাবু বেশ হেসেই বললেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই। আপনার গল্প বলে কথা ভয়েতে রোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল মশাই।”
-আজ তবে উঠি। আবার গল্প হবে অন্য একদিন। -
ভৌতিক গল্প- প্লেগ
প্লেগ
→ ইন্দ্রনীল মজুমদারকরোনার আতঙ্কে গোটা শহর বা গোটা দেশ কেন গোটা বিশ্ব আজ কাঁপছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই মারণরোগে, মৃত্যু হচ্ছে কয়েক হাজারেরও বেশি মানুষের। গোটা কলকাতা শহর লকডাউন। কি করি, কি করি তাই এই লেখাটি লিখতে বসলাম। ও হ্যাঁ, এর ফাঁকে আমার পরিচয়টা দিয়ে রাখা ভালো। আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী, ভৌতিক বা প্যারানরমাল বিষয় চর্চা করতে আমি বেশ আগ্রহী। যাই হোক, এবার মূল ঘটনাটায় আসি। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। কলেজের সেমিস্টার পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন ছুটি পাওয়া গেল। সেই ছুটিতে এখনকারই মতো বাড়িতে বসে বোর হচ্ছিলাম। হঠাৎ, মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। ফেসবুকে “প্যারানরমাল বাংলা” বলে একটি গ্রুপ চালাই, সেখানে ভূত-সম্পর্কে বেশ কয়েকজন আগ্রহী বন্ধু আছেন। তা সেই গ্রুপে একটি পোস্ট দিলাম- “প্ল্যানচেট করার ইচ্ছা আছে? তাহলে সত্ত্বর আমার মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করুন আর ভূত নামাবার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাভ করুন।” তো বেশ কথা। অনেকেই লাইক, কমেন্ট, রিঅ্যাকশন জানাল। কিন্তু মেসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো মাত্র চারজনের। বাকিরা কি তার মানে ভীতু? হবে হয়তো কিংবা এস্ক্যাপিস্ট। যাকগে, এই চারজনকে আমি আমার যোগাযোগ নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রাখলাম। আর বলে রাখলাম বিকেল পাঁচটার সময় আসতে আসতে।
অধীর আগ্রহ থাকলে বাঙালিও হয়তো সাহেব বনে যায়। ঠিক পাঁচটার সময় কলিংবেল বাজল। কিছুক্ষণ আগেই লোডশেডিং হল। তাই আমিও অতিথিদের জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিলাম। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলাম চারজনের বদলে দু’জন হাজির। তাঁদের পরিচয়টা দিয়ে রাখি- একজন বিশ্বরূপ দাস তিনি পেশায় প্রাইভেট শিক্ষক ও অন্যজন হলেন গৌতম ঘোষ যিনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি অফিসার বর্তমানে ভূত ও মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেন। বাকি দুজন যাঁরা আসবেন বলেছিলেন তাঁরা বিশ্বরূপবাবুর চেনা। তাঁদের মধ্যে একজন অফিসের কাজে আটকে গেছেন আর অন্যজন প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে বলেছিলেন, “সর্বনাশ। এভাবে কি সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়?” বিশ্বরূপবাবু যদিও তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, “আরে মশাই, ভয় নেই, আমরা তো আছি। তাছাড়া উল্টোপাল্টা কাউকে নামাব না।” বোঝানো সত্ত্বেও তিনি আসেননি। আমি বললাম, “একদিকে ভালোই হল। কখন যে কি হয়ে যাবে তখন আমাদের ঘাড়েই দোষ পড়বে। আর তাছাড়া প্ল্যানচেটে তো তিনজন লোক লাগে। আমি ইচ্ছে করেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম। জানতাম, এইসব ব্যাপারে লোক কমই আসবে। বিশ্বরূপবাবু বললেন, “তা তো বটেই! আর তাছাড়া লোডশেডিং। শুনলাম কারেন্টের কাজ চলছে তা ঠিক করতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই। এরকম জমজমাট রোমহর্ষক পরিবেশ প্লানচেট করার পক্ষে বড়োই শ্রেয়।”
তা, আমরা তিন-পায়া টেবিল, মোমবাতি, কাগজ ও পেন্সিল নিয়ে ছাদের পাশের ঘরটিতে প্লানচেট করতে বসলাম। সমস্ত গুছিয়ে বসলেই তো আর হল না। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে ডাকব কাকে? রোজই তো কারুর না কারুর মৃত্যু ঘটছে। আর তাছাড়া ভালো কাউকে তো ডাকতে হবে। এই “ডাকব কাকে?”- হ্যাঁ এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যখন তখন গৌতমবাবু উপদেশ দিলেন, “একজনকে ডাকা যায়। শুনেছি এই অঞ্চলে তারাপদ চট্টোপাধ্যায় বলে একজন থাকতেন বহু বছর আগে। তিনি এক জায়গায় খুব সম্ভবত আত্মীয়র বাড়ি গিয়েছিলেন। তারপর আর ফিরে আসেননি। তাঁর মৃত্যুরহস্য কেউ জানে না। অতএব,চলুন তাঁকেই আহ্বান করা যাক।”
আমি উৎসাহের সাথেই বলে উঠলাম, “হুম্, তাই হোক। দেখা যাক তিনি আসেন কিনা।”
আমরা সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে বসলাম প্ল্যানচেটে। একমনে সময় তারাপদবাবুকে মনে মনে ডাকতে বা স্মরণ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ডাকার পর হঠাৎ দেখি বিশ্বরূপবাবু অস্বাভাবিকভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন। বুঝলাম, তাঁর মধ্যে আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে। আমি কাগজ ও পেন্সিল এগিয়ে দিলাম আর প্রশ্ন করলাম, “তারাপদবাবু এসেছেন?”
বিশ্বরূপবাবুর চোখ বন্ধ অথচ না দেখে লিখলেন, “হ্যাঁ।”
গৌতম বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মশাই, আপনাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানতে চাই যে, আপনার মৃত্যু হয়েছিল কিভাবে? যদি একটু বলেন।”
এই প্রশ্ন শুনে আত্মা বিশ্বরূপবাবুকে মিডিয়াম করে যা লিখলেন, তা জাস্ট একটা রোমাঞ্চকর কাহিনী। আনুমানিক মিনিট পঁচিশ ধরে এই লেখা চলল। তারপর বিশ্বরূপবাবুকে ধাতস্থ ও স্বাভাবিক হতে দেখে বুঝলাম তারাপদবাবুর আত্মা চলে গেছেন। আমরা বিশ্বরূপবাবুকে প্রশ্ন করলাম, “কেমন লাগছে এখন?” বিশ্বরূপবাবু আস্তে আস্তে চোখ খুলে বললেন, “এখন একটু ভালো লাগছে। একটু জল হবে?।
“নিশ্চয়ই।” বলে এক গ্লাস জল দিলাম। বিশ্বরূপবাবু জল খেয়ে বললেন, “একটু আগে হঠাৎ শরীরটা বেশ ভারী লাগছিল আর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তাই কিছুই মনে নেই।”তখন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কারেন্টও চলে এসেছিল। তাই, আলো জ্বালিয়ে কাগজের লেখাটি পড়লাম। তাতে লেখা আছে-
“২৩ শে মার্চ, ১৯২০।
তখন বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্লেগ সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করে এলো। কাতারে কাতারে লোক মরছে। মহামারীর আঁচ লাগল আমাদের দেশে। এখানেও শহরে, গ্রামে-গঞ্জে ছেয়ে গেল মহামারীতে। লোকে মরতে লাগল। এসবের মধ্যে আমাদের গ্রাম নিশ্চিন্দপুরেও হঠাৎ মহামারী প্লেগের আবির্ভাব হল। সেখানেও চিকিৎসার অভাবে কাতারে কাতারে লোক মরতে লাগল। আমার তিনকুলে কেউ ছিল না। কলকাতায় এক সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতাম। তা হঠাৎ একদিন গ্রামের ছেলেবেলাকার বন্ধু মৃন্ময় রায়ের কাছে থেকে চিঠি পেলাম। বন্ধু কেমন আছে?বা তার পরিবারের কোনো খবর চিঠিতে লেখা নেই। কেবল লেখা আছে- “এখানে আসতে হবে, বড়োই জরুরী।” তা ওইসময় প্লেগের দাপট একটু কমেছিল। বড়ো সাহেবকে ব্যাপারটা জানাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন। তা নিশ্চিন্দপুর রওনা দিলাম বন্ধুর সাথে দেখা করতে। নিশ্চিন্দপুর স্টেশনে যখন পৌঁছাই, তখন সেখানকার আবহাওয়ায় কেমন একটা থমথমে ভাব। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে একটা গরুর গাড়ি ধরার জন্যে এগোলাম। কিন্তু একটা মানুষকেও দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যেবেলা অথচ কোথাও শঙ্খধ্বনির আওয়াজ নেই, মানুষের কোলাহল নেই। সব যেন ফাঁকা, জনমানব শূন্য। তা, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ রেল স্টেশনের দিকে আসছিলেন। তিনি আমাকে দেখে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাওয়া হবে?”
– আজ্ঞে, রায় বাড়ি।
– রায় বাড়ি! ও বাড়ির সকলেই তো……..পুরোটা শুনলাম না। গটগট করে হাঁটতে লাগলাম। একেই সন্ধ্যা নেমে গেছে তারউপর পথ পুরো ফাঁকা। যেভাবেই হোক, তাড়াতাড়ি বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতেই হবে। রায়বাড়ি কিছু হবে তা আমি বিশ্বাস করি না। বন্ধুর চিঠি যখন পেয়েছি তখন ওরা প্লেগে মারা যায়নি। তা বন্ধুর বাড়ির সামনে যখন এলাম তখন বেশ অবাকই হলাম। ধু-ধু করছে বাড়ির চারপাশ। বাগানে আগাছায় ভর্তি। মনে হচ্ছে, বাড়িতে কেউ নেই। অথচ মাস দুয়েক আগেই এসেছিলাম। বেশ ভালো অবস্থাই ছিল। বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম। দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল! যেন আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল এই যে, দরজার সামনে কেউ নেই! ভেতরে বেশ খানিকটা দূরে এক ঘোর অন্ধকারে বন্ধু, ওর মা-বাবা, দাদা-বৌদি ও বাড়ির কাজের লোক সবাই বসে আছে। যেন আমি আজই ও এই সময়টাতেই আসব আর সেজন্যেই সবাই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বন্ধু অস্বাভাবিক ক্ষীণ গলায় বলল, “এসেছিস। আমি জানতাম তুই ঠিক আসবি।”
আমি বললাম, “তা তোদের দেখতে তো আসবোই। আরে! এভাবে অন্ধকারে এই সন্ধ্যেতে কেউ।বসে থাকে? আলোর ল্যাম্প জ্বালাসনি?”
বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ক্ষীণ গলায় বলল, “ল্যাম্পের আলো বা যেকোনো আলো এখন আর সহ্য হয় না রে।”
আমি সন্দেহবশতই জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা সবাই ঠিক আছিস তো? কিছু মনে করিস না এই বাড়িতে কেমন যেন একটা দুঃখের ছায়া।”
বন্ধু আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, “ওই টেবিলটাতে গিয়ে বস। তোকে কিছু খেতে দিই।”
অন্ধকারে আমি কাউকেই ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। বন্ধুর মা যখন আমার কাছে খাবার নিয়ে এলেন আর বলতে লাগলেন, “খা বাবা, অনেকদিন পর এলি যে!” তখন আমার পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওই অন্ধকারেই কাছ থেকে যেটুকু দেখা গেল তা হল বন্ধুর মা এক কঙ্কাল ও তাঁর চোখ থেকে ঠিঁকরে যেন আগুন বেরোচ্ছে। বাকিদের দিকে তাকিয়েও দেখি সবার একই অবস্থা। সবাই কঙ্কাল আর সবার চোখের কোটর থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। আমি ভয়ে দৌড়াতে লাগলাম, পেছন থেকে শুনছিলাম, সবাই বলছিল,- “এই ধর, ধর, পালাচ্ছে, ধরে……।” আমি তো দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছি। ওদের ডাকার উদ্দেশ্যে তাহলে বোঝা গেল। কতক্ষণ দৌড়েছি তার খেয়াল নেই। এমন সময় কোনোরকমে প্লাটফর্মে এসে হাজির হলাম। তাড়াহুড়োতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে লাইনে আছড়ে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দেখি, বেশ ভালোই লাগছে, ভয়ও কেটে গেছে। কিন্তু সামনে কিছু লোকজন ও পুলিশ কেন?
এগিয়ে একজন কুলিকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে দাদা? ওখান ভিড় কেন? আবার পুলিশও দেখতে পাচ্ছি।”
তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, “কে একজন লাইনে পড়ে মাথা ফেটে মারা গিয়েছে। তাই পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল।”
আমার ভেতরটাহঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। একটু কাছে গিয়ে দেখি, আরে! এই রক্তমাখা দেহটা তো আমারই! এত রক্ত ভেসে আছে যে মুখটা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় হঠাৎ ওপারে দূরে চোখ পড়তেই দেখি বন্ধু ও তার পরিবার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ওদের চেহারা কঙ্কালের নয় বা ওদের চোখ থেকে কোনো আগুনের গোলাও ঠিঁকরে বেরোচ্ছে না। ওরা যেন জ্যান্ত ছায়ামূর্তি। এই আমার মৃত্যু-কাহিনী। এবার আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি এখন আসি। আপনারা ভালো থাকবেন।
ইতি
তারাপদ চট্টোপাধ্যায়আজ যখন করোনা নামক মহামারী পৃথিবী কাঁপাচ্ছে তখনই মনে পড়ে গেল সেই প্ল্যানচেটের ঘটনা যেখানে উল্লেখ রয়েছে ঠিক একশো বছর আগের প্লেগ মহামারীর কথা।
(কোথাও একটা দেখছিলাম যে, পৃথিবীতে ১৭২০, ১৮২০, ১৯২০ আর ২০২০ অর্থাৎ একশো বছর অন্তর অন্তর মহামারী দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যের না! এই কঠিন সময় সবাই সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ও ঘরে থাকুন। সমস্ত সকারি নির্দেশিকা মেনে চলুন।)
-
কল্প-বিজ্ঞান- সাদা গহ্বরের পথ ধরে
সাদা গহ্বরের পথ ধরে
-ইন্দ্রনীল মজুমদার
রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলতেই চমকে উঠি। এ কে রে! এ যে আমি! আচ্ছা, আমার সামনে কি আয়না বসানো? নাহ্ এটা আমার প্রতিচ্ছবি নয়। জ্যান্ত মানুষ। জিজ্ঞেস করলো- এটা কোন গ্রহ? সূর্য কোথায়?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “মরণ। নেশা করছো নাকি? ঠিক আছ তো? এটা যে পৃথিবী তাও জানো না? আহাম্মক কোথাকার!”
-না। আমি ঠিক আছি। আমার নাম নীলাঞ্জন রায়।
এবারে আরও চমকে উঠলাম। আরে এ যে আমারই নাম!
তারপর আমার জমজ বলল, “আমি অন্য গ্রহের মানুষ। গ্রহটার নামও পৃথিবী। সেটিও সৌর জগতের বাসিন্দা। সেখানেও সূর্য আছে।
– তা বাপু তুমি কি কর?
– যে আজ্ঞে পড়াশোনা। এবার কলেজ পাশ করলাম।
– আরে আমিও তো তাই। আচ্ছা ওখানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর সমস্যা আছে?
– হ্যাঁ। তবে আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক উন্নত।গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি আছে।
-তোমাদের পৃথিবী কোথায়?
-ওটা অন্য এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তোমরা ভাবো যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা ইউনিভার্স(Universe) বুঝি একটাই। আদপে তা কিন্তু নয়। অসংখ্য ইউনিভার্স আছে যাকে বলে ‘মাল্টিভার্স’। আবার অসংখ্য ইউনিভার্স নিয়ে গঠিত ‘ক্লাস্টার অফ ইউনিভার্স’। এই ক্লাস্টার অফ ইউনিভার্সগুলিকে নিয়ে গঠিত ‘সুপার ক্লাস্টার’। সব ইউনিভার্সই প্রত্যেকটা ইউনিভার্সের সমন্তরাল যাকে বলে ‘প্যারালাল অফ ইউনিভার্স’।
– বুঝলাম। তা তুমি এখানে এলে কিভাবে?
– মহাকাশে নাইট ওয়াক করছিলাম খাওয়া দাওয়ার পর স্পেসশিপে চড়ে। তা ভুলবশতঃ ঢুকে পড়লাম ব্লাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে।
– সর্বনাশ! তা ওখানে তো আলোও বেঁচে বেরোতে পারে না তা তুমি কি করে বেঁচে বেড়িয়ে এলে?
– হ্যাঁ তাই মনে হয়েছিল। তবে কি না সাদা গহ্বরের পথ ধরে চলে এলাম।
– মানে?
– মনে হল যেন বিশাল লম্বা হয়ে গেলাম তারপরে ছারখার হয়ে ঢুকে গেলাম কৃষ্ণ গহ্বরের মুখে। তারপর মনে হলো কোন একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তারপর মনে হল মারা-ই গেছি এবং তারপর হঠাৎ মনে হল বেঁচে গিয়েছি এবং ব্ল্যাক হোল থেকে বেড়িয়ে গেছি। যখন বের হলাম তখন দেখি আমি ও আমার সাথে আলোও বের হচ্ছে। আমি আবার জোড়া লেগে আগের অবস্থায় ফিরে এলাম। বলতে গেলে এক অন্য জীবন পেলাম। কি জানি প্রকৃতির কোন নিয়ম খাটলো? আসলে কি জানো, ওয়ার্ম হোল নামে এক ধরনের টানেল আছে যা ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর আর হোয়াইট হোল বা সাদা গহ্বরকে কানেক্ট করে। তা ওয়ার্মহোল দিয়ে হোয়াইট হোলে চলে এলাম। হোয়াইট হোলে আলো নির্গত হয় এবং অন্য ব্রহ্মাণ্ডে পৌঁছানো যায়। তা বলাই চলে সাদা গহ্বরের পথ ধরে চলে এলাম এই ব্রহ্মাণ্ডে।
– বুঝলাম।
তারপর ছেলেটি চলে গেল। যাবার পর মুহূর্তে দেখলাম ‘মেন ইন ব্লাক’-এর এজেন্ট K এবং এজেন্ট J হাজির। এজেন্ট J নীলাঞ্জনের ফটো নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, “Have you seen this guy?”-Yes.
এরপর এজেন্ট K আমার দিকে একটা ছোট মেশিন বের করে। মেশিনে স্যুইচ টিপলেন এবং আলো ঝলকালো। উনি নিরাশ স্বরেই বললেন, “Oh my God! It’s not him.”